ইমাম কাযেম (আ.)

ইমাম কাযেম (আ.)0%

ইমাম কাযেম (আ.) লেখক:
: মোঃ মাঈনুদ্দিন তালুকদার
প্রকাশক: -
বিভাগ: ইমাম মুসা ইবনে জাফর আল কাজেম (আ.)

  • শুরু
  • পূর্বের
  • 15 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 5061 / ডাউনলোড: 2130
সাইজ সাইজ সাইজ
ইমাম কাযেম (আ.)

ইমাম কাযেম (আ.)

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

ইমাম কাযেম(আ .)

মূল লেখক  :মূল:দার রাহে হাক প্রকাশনীর লেখকবৃন্দ

ভাষান্তরে : মোঃ মাঈন উদ্দিন তালুকদার

ভূমিকা

যখন গোধূলী লগ্নে সুউচ্চ খোরমা-শাখে মৃদু সমীরণের কোমল স্পর্শ আপাদমস্তক আন্দোলিত হয়ে কানাকানি করে তখন তোমারই নির্মল জীবনের বীরত্ব গাঁথা চুপিসারে গেঁয়ে যায় । আর তোমার উপর যে অন্যায় ও অত্যাচার করা হয়েছে তার শোক গাঁথা আলতো হাওয়ায় ছড়িয়ে দেয় ।

হৃদয় ভারাক্রান্ত বাসন্তী আকাশের মেঘপুঞ্জ যখন অশ্রুবারি বিসর্জন করে নীলীমের দ্বারগুলো উম্মুক্ত করে দেয় ,তখন তোমার আহত হৃদয় অনুসারীরাই যুগ-যুগান্তরে ইতিহাসের বিস্তীর্ণ কপল আঁখিজলে সিক্ত করেছে ।

অশ্রুর স্থূল অবগুন্ঠন ,তোমার প্রতিবাদ প্রতিরোধ ,ও পরিণামে আত্মবিসর্জনের বীরত্ব গাঁথা থেকে আমাদেরকে বিরত রাখবে না । আর যদি তোমার নিমত্ত আঁখিজল বিসর্জন দিয়ে থাকি ,তবে তা হবে দণ্ডায়মান অবস্থায় যাতে তোমার প্রতিরোধের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে পারি । আর সেই সাথে বিশ্ব ও ইতিহাসের পাতায় তোমার বীরত্বের স্মরণে সম্মান প্রদর্শন করতে পারি ।

আমাদের হৃদয় পটের সুন্দরতম ও বীরত্বপূর্ণ স্থান থেকে তোমার জন্য থাকবে নির্মল ও নিষ্কলুষ অভিনন্দন ও পবিত্রতম দরূদ -সর্বক্ষণ ও সর্বাবস্থায় ।

আবওয়া 1 নামক গাঁয়ের পরিবেশ ঐ দিন প্রভাতেই যেন কিছুটা অন্য রকম ছিল । সূর্য রশ্মি সমুন্নত খর্জুর বৃক্ষ কোমর পর্যন্ত সোনালী আভায় মুড়িয়ে দিয়েছিল । আর তাদের প্রলম্বিত ছায়াগুলো ঐ গাঁয়ের পুষ্পিত ছাউনির উপর ছড়িয়ে পড়েছিল... ।

রাখালদের সাথে চলমান উষ্ট্রগুলোর কণ্ঠ ধ্বনি ও মেষদলের শোর গোল ছাপিয়ে ভোরের পাখিরা ,আনন্দ ও প্রভাতী শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করছিল । আর জীবন সঙ্গীতে কর্ণকুহর হয়েছিল পরিপূর্ণ ।

গাঁয়ের পাশে নির্মল জলাধার ও সুমিষ্ট পেয় জল সরেবরে অদ্য প্রশান্ত বাতাসের মৃদু স্পর্শে কিঞ্চিত তরঙ্গ সৃষ্টি হয়েছিল । গাঁয়ের রমণীকুল এ জলাধার থেকেই মশক পূর্ণ করত । কয়েকটি আবাবিল হতবিহবল হয়ে নির্মল সরোবরের উপর দিয়ে এদিকে সেদিক ছুটোছুটি করছিল ;আর কিছুক্ষণ অন্তর স্বীয় রক্তিম বক্ষ জলাধারে সিক্ত করছিল যেন আমুল ফিলের (হস্তী বছরে আবরাহার বাহিনীর উপর নিক্ষিপ্ত) ঐ কংকরের উত্তাপ তখনও উপলব্ধি করছিল । একটু দূরে একমাত্র খোরমা বৃক্ষের সবুজ ও সুউচ্চ ত্রিকোণ ছায়ার আশ্রয়ে একটি সমাধি । এ সমাধির উপর ঐ দিন প্রাতে এক রমণী আনত ভঙ্গিতে সশ্রদ্ধ চুম্বন এঁকে যাচ্ছিলেন । আর অস্ফুট সূরে ক্রন্দনরত আর ওষ্ঠাধারে কি এক অভিব্যক্তি যেন ধ্বনিত হচ্ছিল । মৃদু সমীরণে তার সে ধ্বনি ভেসে আসছিল ,যেন সে ধ্বনিতে এ কথা শুনা যাচ্ছিল :

হে আমিনা! তোমার প্রতি দরুদ । হে নবী (সা.)-এর সম্মানিতা মাতা! মহান আল্লাহ তোমার প্রতি করুণা ও রহমত বর্ষণ করুন , (যে তুমি স্বীয় জন্মভূমি থেকে দূরে মৃত্যুবরণ করেছিলে) ।

এখন আমি তোমার পুত্রবধু ;তোমার বংশধর গণের মধ্য থেকে এক শিশু আমার গর্ভে বিদ্যমান ,গত নিশী থেকে যে বেদনা আমি অনুভব করছি ,তাতে মনে হয় আজই হয়ত এ পবিত্র শিশু এ গাঁয়ে তোমারই সমাধির পাশে ভূমিষ্ঠ হবে ... ।

আহ! ওহে মহতী ,যে তুমি সমাধিতে শুয়ে ;আমার পতি আমাকে বলেছেন যে ,আমার এ সন্তান আপনার পুত্র মহানবী (সা.)-এর সপ্তম উত্তরাধিকারী হবেন ।

হে আমার সম্রাজ্ঞী! মহান আল্লাহর কাছে আমার জন্য চাও যাতে এ সন্তানকে সুস্থ অবস্থায় জন্ম দান করতে পারি... । ভোরের রবি তখন সমাধির উপর বেড়ে উঠা একমাত্র বৃক্ষের শাখা থেকে নিচে নেমে এসে মাটির উপর ছড়িয়ে পড়েছিল... ।

হামিদাহ ধীরে-সুস্থে উঠে দাঁড়ালেন ,তার পরিধেয় সমাধির পবিত্র ধুলি-স্পর্শে যে ধূলিত হয়েছিল ,তা হাওয়ার ছড়িয়ে দিলেন ,এক হাত পেটের উপর রেখে অন্তঃসত্তা রমণীরূপ ধীর ,সতর্ক ও সাবধানতার সাথে গাঁয়ে ফিরে যেতে লাগলেন ।

পরক্ষণে সূর্য যখন আকাশের সর্বোচ্চ স্থানে এসে দাঁড়াল গায়ের পাখীরা তার জ্যোতির ঝর্ণা ধারায় আবওয়ার নির্মল নীলাকাশে পাখাগুলো ধৌত করছিল । আনন্দ ধ্বনি গায়ের নিভৃত কোন থেকে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছিল ... । আর আমার অনুভূতি নির্মল জলা ধারের কিনারা থেকে অবলোকন করছিল যে ,রমণীগণ গাঁয়ের লতানো পথ বেয়ে দ্রুত বিহবল হৃদয়ে এদিক সেদিক ছুটোছুটি করছিল ... ।

তখন দু রমণী একই ভঙ্গিতে জলাধারের দিকে বৃহদাকার মৃৎপাত্র হস্তে জল বইয়ে নিতে আসছিল. ।

আমার অনুভূতি নতুন সংবাদ শ্রবণের জন্য অপেক্ষা করছিল... । ভগ্নি! বললেন ইমাম সাদিক (আ.) । অতঃপর নবজাতক সন্তানের জন্মের সংবাদ শ্রবণান্তে বললেন : আমার পর যে পথ প্রদর্শক হবে ,মহান আল্লাহর সে উৎকৃষ্টতম বান্দা জন্ম গ্রহণ করল । 2

ওহে শোননি তাঁর নাম কি রাখা হয়েছে ?সম্ভবত তাঁর জন্মের পূর্বেই তাঁর নাম রাখা হয়েছিল মূসা ।

এ গাঁয়ে কি ঘটেছে আমি জানিনা । তবে অবচেতন মনের কল্পনার চোখে দেখতে পেলাম ,জলাধারের পাশে ,প্রান্তরে এক রাখাল তাঁর যষ্ঠি দিয়ে মেষ পালকে সম্মুখপানে তাড়া  করছে.. ।

মুহূর্তের জন্য আমার স্মৃতিপটে তরঙ্গায়িত হলো ঐ রাখাল সেই মূসা ,আর ওখানে সিনা প্রান্তর । কল্পনার আকাশ থেকে অবতরণ করত দেখত পেলাম এ মূসাতো সেই নবজাতক ;তবে সে কোন ফেরাউনের প্রতিকূলে এ ধরাধামে পদার্পণ করেছে... ?!

ইমাম ও আব্বাসীয় শাসন

ইমাম মূসা ইবনে জা ফর কাযেম (আ.)-এর চার বছর বয়সের সময় স্বেচ্ছাচারী উমাইয়্যা শাসনের মূলোৎপাটিত হয়েছিল ।

উমাইয়্যা শাসকদের আরবীয়করণ নীতি ,অন্যায় অত্যাচার ,লুন্ঠন প্রক্রিয়া ইরান বিরোধী শাসন ব্যবস্থা জনগণ ,বিশেষ করে ইরানীরা যারা প্রকৃত ইসলামী ও ন্যায়ভিত্তিক শাসনব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা আশা করত ,বিশেষ করে যারা ইমাম আলী (আ.)-এর স্বল্পকালীন খেলাফত আমলের শাসনব্যবস্থার পুনরাবৃত্তি আশা করত তারা উমাইয়্যা দুঃশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন । এমতাবস্থায় তদানিন্তন রাজনীতিবিদরা মানুষের এ প্রবণতাকে বিশেষ করে  ইরানীদের হযরত আলীর বংশধর ও আলীরূপ শাসনব্যবস্থার প্রতি তাদের আকর্ষণকে অপব্যবহার করেছিল । তারা যার অধিকার তার কাছে ফিরিয়ে দেয়ার নামে ,আবু মুসলিম খোরাসানীর সহযোগিতায় উমাইয়্যাদেরকে পদচ্যুত করালেন । কিন্তু তারা ষষ্ঠ ইমাম জা ফর সাদেক (আ.)-এর পরিবর্তে আবুল আব্বাস সাফ্ফাহ আব্বাসীকে খেলাফতের মসনদে এবং প্রকৃত পক্ষে রাজ সিংহাসনে বসালেন । 3

এভাবেই 123 হিঃ সনে রাজতন্ত্রের এক নব ধারার পত্তন ঘটল ,তবে তা খেলাফত ও নবী (সা.)-এর উত্তরসূরীর পোশাকে তারা ধর্মহীনতা ,অত্যাচার ও কপটতার দিক থেকে উমাইয়্যাদের চেয়ে কোন অংশেই কম ছিল না ,বরং এগুলোর দিক থেকে তারা উমাইয়্যাদেরকেও হার মানিয়েছিল ।

পার্থক্য শুধু এটুকু যে উমাইয়াদের কু-শাসন খুব বেশী স্থায়ী হতে পারেনি । আর আব্বাসীয়রা 656 হিজরী পর্যন্ত অর্থাৎ 524 বছর একইভাবে বাগদাদ থেকে খেলাফতের নামে রাজত্ব করেছিল ।

যাহোক ,সপ্তম ইমাম তাঁর জীবদ্দশায় আবুল আব্বাস আস সাফফাহ ,মানসূর দাওয়ানিকী ,হাদী ,মাহদী ও হারুনের খেলাফতামল তাদের সকল অত্যাচার ,মানহানি ও বল প্রয়োগের ঘটনাপঞ্জী সহ অতিবাহিত করেছিলেন ।

ইমামের জীবন দর্পন ,দুঃখের তাম্রমলে ঢেকে দেয়ার কিংবা বেদনার অমানিশায় আচ্ছাদিত করার জন্য কেবলমাত্র এ শয়তান প্রকৃতির মানুষগুলোর দুষ্ট ও নিষ্ঠুর আত্মার কলুষতাই যথেষ্ট ছিল । অথচ এদের প্রত্যেকেই (মানসূর থেকে হারুন পর্যন্ত) এ মহাত্মনের দেহ ও মনের উপর চরম নিষ্ঠুর ও নিকৃষ্ট অত্যাচার চালাতে কুন্ঠাবোধ করেনি । যদি কিছু না করে থাকে তবে তা অপারগতা বশত ,করতে চায় নি যে ,তা নয় ।

আবুল আব্বাস আস সাফফাহ 136 হিজরীতে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলে তার ভ্রাতা মানসূর দাওয়ানিকী তার স্থলাভিষিক্ত হলো । সে বাগদাদ নগরী গড়ল এবং আবু মুসলিমকে হত্যা করল । যদোবধি খেলাফতের মসনদে অধিষ্ঠিত হলো হযরত আলীর সন্তানগণকে হত্যা কারারুদ্ধ ও নির্যাতন করা এবং তাদের ধনসম্পদ লুট-তরাজ করা থেকে এক মুহূর্তের জন্যও ক্ষান্ত হয়নি । সে এ বংশের সকল মহান ব্যক্তিদেরকে হত্যা করেছিল । আর তাদের শীর্ষে ছিলেন ইমাম সাদেক (আ.) ।

হারুন ছিল রক্তপিপাসু ,প্রতারক ,চরম হিংসুক ,কৃপণ ,লোভী ও বিশ্বাস ভঙ্গকারী । আবু মুসলিমের ক্ষেত্রে তার বিশ্বাস ভঙ্গের ঘটনা সাধারণের কাছে প্রবাদে পরিণত হয়েছিল । কারণ সে এক জীবন কষ্টের বিনিময়ে তাকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল ।

যখন ,ইমাম কাযেম (আ.)-এর মহান পিতাকে শহীদ করা হয়েছিল ,তখন তাঁর বয়স ছিল বিশ বছর । তিনি তাঁর জীবনের ত্রিশ বছর পর্যন্ত মানসূরের ভয়-ভীতি ,ত্রাস ও শ্বাসরুদ্ধকর দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন এবং তাঁর অনুসারীদের জন্য গোপনে সংবাদ প্রেরণ করতেন ও তাদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতেন ।

মানসূর 158 হিজরীতে নিহত হলে রাজ সিংহাসনের দায়িত্ব ভার তার পুত্র মাহদীর উপর ন্যস্ত হলো । মাহদী আব্বাসীর রাজনীতি ছিল প্রবঞ্চনা ও প্রতারণামূলক ।

সে তার পিতার শাসনামলের রাজবন্দীদের মধ্যে মুষ্টিমেয় কয়েকজন ব্যতীত প্রায় সকলকেই মুক্তি দিয়েছিল ,যাদের অধিকাংশই ছিলেন ইমাম কাযিমের অনুসারী । সে তাদের লুন্ঠিত মালামালও ফিরিয়ে দিয়েছিল । কিন্তু তাদের কাজ কর্মের প্রতি নজর রেখেছিল এবং অন্তরে তীব্র ক্ষোভ গোপন রেখেছিল । এমনকি যে সকল কবিরা হযরত আলীর বংশকে দুর্নাম করত ,তাদেরকে অগণিত পুরস্কার দিত । যেমন : একবার বাশার ইবনে বুরদকে সত্তর হাজার দেরহাম দিয়েছিল এবং মারওয়ান ইবনে আবি হাফসকে একলক্ষ দেরহাম দিয়েছিল ।

মুসলমানদের বাইতুলমালের টাকা তার আরাম ,আয়েশ ,মদপান ও নারীর পিছনে উদার হস্তে খরচ করত । সে তার পুত্র হারুনের বিবাহে পঞ্চাশ মিলিয়ন দেরহাম খরচ করেছিল ।

মাহদী আব্বাসীর সময় ইমামের খ্যাতি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল । কল্যাণ ,তাকওয়া ,জ্ঞান ও নেতৃত্বের আকাশে তিনি পূর্ণ শশীসম কিরণ দিচ্ছিলেন । দলে দলে লোকজন গোপনে তার নিকট আসত এবং অনাদি কল্যাণের ঐ ঝর্ণাধারা থেকে স্বীয় আত্মিক পিপাসা মিটাত ।

মাহদীর গুপ্তচররা এ সকল ঘটনার সংবাদ তার কাছে পৌঁছালে স্বীয় খেলাফতের ব্যাপারে ভীত-সন্ত্রস্ত হলো এবং ইমামকে মদীনা থেকে বাগদাদে এনে বন্দী করার নির্দেশ দিল ।

আবু খালিদ যাবালেয়ী বলেন : এ আদেশ অনুসারে যে নিযুক্ত ব্যক্তিরা হযরতের জন্য মদীনায় গিয়েছিল ,ফিরে আসার সময় যাবালেতে হযরতকে সহ আমার গৃহে অবস্থান নিয়েছিল ।

ইমাম ক্ষুদ্র সময়ের সুযোগে ,নিযুক্তদের চোখের আড়ালে আমাকে তাঁর জন্য কিছু জিনিস ক্রয় করার নির্দেশ দিলেন । আমি খুব হৃদয় ভারাক্রান্ত ছিলাম এবং সবিনয়ে নিবেদন করলাম : আপনি যে ,রক্তলোলুপের কাছে যাচ্ছেন ,তাতে আপনার জন্যে খুব ভয় হয় ।

তিনি বলেলেন : আমি তাকে ভয় করি না । তুমি ঐ দিন ঐ স্থানে আমার জন্য অপেক্ষা কর ।

তিনি (ইমাম) বাগদাদ গেলেন । আমি আশঙ্কার সাথে অপেক্ষার প্রহর গুণছিলাম । প্রতিশ্রুত দিবস আসল ,আমি কথিত স্থানের দিকে ধাবিত হলাম ;হৃদয় আমার দুরুদুরু কাঁপছিল ,সামান্য শব্দেই লাফিয়ে উঠতাম ;অপেক্ষার আগুনে জ্বলছিলাম । একটু একটু করে দিগন্ত রক্তিম হতে লাগল ,সূর্য নিশীথের কোলে ঢলে পড়তে লাগল । হঠাৎ দূর থেকে ছায়ার মত কাউকে দেখলাম ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে আসছিল । হৃদয় আমার চাইল তাদের নিকট উড়ে যাব ;আবার ভয় পাচ্ছিলাম যে ,যদি তিনি না হয়ে থাকেন ;পাছে আমাদের গোপনীয়তা প্রকাশিত হয়ে যায় ।

যথাস্থানেই অপেক্ষমান থাকলাম ,ইমাম আমার নিকটবর্তী হলেন । তিনি একটি খচ্চরের পৃষ্ঠে ছিলেন । যখনই তাঁর দৃষ্টি আমার উপর নিবদ্ধ হলো ;বললেন : আবা খালিদ ,দ্বিধা করো না এবং বলতে লাগলেন : পরবর্তীতে আমাকে আবার বাগদাদে নিবে ,আর তখন আর ফিরে আসব না । পরিতাপের বিষয় তেমনটিই ঘটে ছিল ... । 4

যাহোক এ সফরেই যখন আব্বাসীয় খলিফা মাহদী ইমামকে বাগদাদ নিয়ে আসল ও কারারুদ্ধ করল ,তখন আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)-কে স্বপ্নে দেখল যে তিনি তাকে উদ্দেশ্য করে এ আয়াতটি পাঠ করছেন :

) فهل عسيتم ان تو لّيتم ان تفسدوا في الارض و تقطّعوا ارحامكم (

ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত তোমরা সম্ভবত পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে । 5 রাবী বলেন : মধ্যরাত্রিতে আব্বাসীয় খলিফা মাহদী আমাকে ডেকে পাঠাল । খুব সন্ত্রস্ত  হলাম ও তার নিকট দ্রুত উপস্থিত হলাম ;দেখলাম ( .. .فهل عسيتم ) আয়াতটি পাঠ করছিল ।

অতঃপর বলল : যাও ,মুসা ইবনে জা ফরকে কারাগার থেকে আমার নিকট নিয়ে আস । আমি গিয়ে তাঁকে নিয়ে আসলাম ;মাহদী ওঠে দাঁড়াল এবং তাঁকে চুম্বন করে নিজের নিকট বসাল ,অতঃপর নিজের স্বপ্নের কথা তাঁর নিকট ব্যক্ত করল ।

অতঃপর তৎক্ষণাৎ ইমামকে মদীনায় ফিরিয়ে দেয়ার জন্য নির্দেশ দিল ।

রাবী বলেন : পাছে কোন বাধা আসে ,এ ভয়ে ঐ রাতেই ইমামের যাত্রা কালীন জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে তার যাত্রার ব্যবস্থা করলাম প্রভাত আলোয় তিনি মদীনার পথে ছিলেন... । 6

ইমাম মদীনায় আব্বাসীয়দের শ্বাসরূদ্ধকর প্রহরা সত্ত্বেও মানুষকে সঠিক পথ প্রদর্শন ,জ্ঞান বিতরণ ও শিয়াদেরকে (আধ্যাত্মিক ভাবে) গড়ে তোলার জন্য ব্যস্ত ছিলেন... । ইতোমধ্যে 169 হিজরীতে মাহদী নিহত হলে তার পুত্র হাদী আব্বাসী রাজতন্ত্রের মসনদে অধিষ্ঠিত হলো ।

হাদী তার পিতার অনুরূপ জনসাধারণের ন্যূনতম অধিকারটুকুও রক্ষা করত না এবং প্রকাশ্যে হযরত আলী (আ.)-এর বংশধরদের সাথে কঠোর আচরণ করত ;এমন কি যা কিছু তার পিতা তাদেরকে (হযরত আলীর বংশধরদের) দিয়েছিল তা-ও ছিনিয়ে নিয়েছিল ।

তার ঘৃণ্যতম কৃষ্ণকর্ম হলো ফাখের নৃশংস ও নির্মম হত্যাকান্ড ।

ফাখের মর্মন্তুদ ঘটনা

মদীনার আলাভীগণের মধ্যে হুসাইন ইবনে আলী আব্বাসীয়দের দুঃশাসন ও অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলেন । তিনি ইমাম মুসা কাযেম (আ.)-এর অনুমতিক্রমে 7 হাদীর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলেন এবং প্রায় ছয়শত সঙ্গী নিয়ে মদীনা থেকে মক্কা অভিমুখে যাত্রা করলেন ।

হাদীর সৈন্যরা তাকে ফাখ নামক স্থানে অবরোধ করতঃ তার সৈন্যদেরকে শহীদ করল এবং কারবালার বেদনাবিধূর ঘটনার অনুরূপ ঘটনা তাদের ক্ষেত্রেও ঘটল । সকল শহীদের মাথা কর্তন করে মদীনায় নিয়ে আসল এবং হযরত আলীর বংশধরগণ ,বিশেষ করে ইমাম মুসা কাযেম (আ.) যে সভায় ছিলেন সেখানে প্রদর্শনীর জন্য রাখল । ইমাম ব্যতীত কেউ কিছু বলল না ;ইমাম কাযেম (আ.) ফাখ আন্দোলনের নেতার কর্তিত মস্তক দেখে বললেন :

انّا لله وانّا اليه را جعون مضي و الله مسلما صالحا صوّاما قوّاما آمرا بالمعروف وناهيا عن المنكر ما كان في اهل بيته مثله

আমরা আল্লাহ থেকে এবং তাঁরই নিকট প্রত্যাবর্তন করব । আল্লাহর শপথ সে মুসলমান ও সৎকর্ম করে শাহাদাত বরণ করেছে ;সে বেশী বেশী রোযা রাখত ও রাত্রি জাগরণ করত এবং সৎ কর্মে আদেশ ও অসৎ কর্মে নিষেধ করত ,তার পরিবারের মধ্যে তাঁর সমকক্ষ কেউ ছিলনা । 8

হাদী দুষ্ট রাজনৈতিক চরিত্র ছাড়াও ,ব্যক্তিগত আচরণেও ছিল উচ্চাভিলাষী ,মদ্যপ ও আরাম প্রিয় । একদা ইউসুফ সাইকালীকে কয়েক পঙ্ক্তি কবিতা সুন্দর ভঙ্গিতে আবৃতি করার জন্য এক উষ্ট্রের বোঝা পরিমাণ দেরহাম ও দিনার তাকে প্রদান করেছিল । 9

ইবনে দাবনামী বলেন : একদিন হাদীর নিকট গেলাম । তাঁর চোখগুলো মদ পান ও জাগরণের ফলে রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছিল । সে আমার কাছে শরাব সম্বন্ধে কবিতা শুনতে চাইল । আমি একটি কবিতা আবৃতি করলাম । সে কবিতাটি লিখে রাখল এবং আমাকে চল্লিশ হাজার দেরহাম প্রদান করল । 10

আরবের বিখ্যাত গায়ক ইসহাক মুসেলী বলেন : যদি হাদী বেঁচে থাকত আমরা আমাদের গৃহের প্রাচীর স্বর্ণ দিয়ে গড়তাম । 11

যাহোক ,অবশেষে হাদীও 170 হিজরীতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল । আর সেই সাথে ইসলামী রাষ্ট্রের বাদশাহ হলো হারুন । 12

আর এ সময় ইমাম মুসা কাযেমের বয়স 42 বছরে পৌঁছেছিল ।

হারুনের সময় আব্বাসীয় দুঃশাসনের দৌরাত্ম্য ,শক্তি ,স্বৈরাচার ও সফলতা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল ।

হারুন বাইয়াতের অনুষ্ঠান শেষে ইয়াহিয়া বারমাকিকে (ইরানীদের মধ্যে যে বাদশাহের মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করেছিল) নিজের মন্ত্রী নিযুক্ত করল এবং নিয়োগ ,বরখাস্ত ইত্যাদি যে কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে তাকে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করেছিল । আর তদানিন্তন সময়ের নিয়মানুসারে এ স্বাধীনতার প্রমাণ হিসেবে স্বীয় আংটি তার অধিকারে রেখেছিল । 13

অতঃপর হারুন অন্যায়ভাবে বায়তুল মালের টাকা আত্মসাৎ করে মদ ,নারী ,মণিমুক্তা ক্রয় ও আমোদ-প্রমোদের জন্য ব্যয় করতে লাগল ।

বাইতুল মালের সঞ্চিত সম্পদের পরিমাণ তখন পাঁচশত মিলিয়ন ও দুই লক্ষ চল্লিশ হাজার দেরহাম ছিল ,যখন দুই কিংবা চার বছর বয়স্ক একটি মেষ এক দেরহামে ক্রয়-বিক্রয় হত । 14 আর হারুন সে সম্পত্তি নস্যাৎ করার জন্য উদার হস্ত হলো । যেমন : আশযা নামক এক কবিকে তার প্রশংসা গীতির বিনিময়ে এক মিলিয়ন দেরহাম পুরস্কার প্রদান করেছিল । 15 আবুল আতাহিয়া নামক এক কবি এবং ইবরাহীম মুসেলী নামক একজন সংগীতজ্ঞ কয়েক পংক্তি কবিতা ও সংগীত পরিবেশনের জন্য প্রত্যেকেই এক লক্ষ দেরহাম ও একশতটি পোশাক লাভ করেছিল । 16

হারুনের প্রাসাদে অনেক সুকন্ঠী ,সুশীলা ও রূপসী নারীর সমাহার ঘটেছিল এবং তদানিন্তন সময়ের বিভিন্ন বাদ্য যন্ত্র সেখানে বিদ্যমান ছিল । 17 রত্নসম্ভার গড়া ছিলো হারুনের অন্যতম শখের বিষয় । একদা একটি আংটি ক্রয় করার জন্য সে এক লক্ষ দিনার (স্বর্ণ মুদ্রা) পরিশোধ করেছিল । 18

তার রন্ধন শালার প্রতিদিনের খরচ ছিল দশ হাজার দেরহাম । কখনো কখনো তার জন্য ত্রিশ রকমের খাবার তৈরী করা হতো । 19

হারুন একবার উটের মাংসের খাবার চেয়েছিল । যখন তার জন্য সে খাবার আনা হলো ,জা ফর বারমাকী বলেছিল : খলিফা কি জানেন তার জন্য এই যে খাবার আনা হলো তার মূল্য কত ?

জবাবে বলা হল : তিন দেরহাম ... ।

বলল : না ,আল্লাহর শপথ ,এ পর্যন্ত চার হাজার দেরহাম খরচ হয়েছে । কারণ ,অনেকদিন ধরে প্রত্যহ একটি করে উট জবাই করা হচ্ছিল ,যাতে খলিফা যদি উটের মাংস চায় তাৎক্ষণিক ভাবে উপস্থিত করা যায় । ! 20

হারুন একজন জুয়াড়ি এবং মদ্যপও ছিল বটে । কখনো কখনো সে সভায় সকলের উপস্থিতিতেই মদ পান করত । অপরদিকে সে জনসাধারণকে ধোঁকা দেয়ার জন্য ইসলামী সভায়ও যেত । যেমন : হজ্ব পালন করত । আবার কখনোবা তাকে উপদেশ দেয়ার জন্য কোন কোন বক্তাকে অনুরোধ করত ও কাঁদত !