ইমাম কাযেম (আ.)

ইমাম কাযেম (আ.)0%

ইমাম কাযেম (আ.) লেখক:
: মোঃ মাঈনুদ্দিন তালুকদার
প্রকাশক: -
বিভাগ: ইমাম মুসা ইবনে জাফর আল কাজেম (আ.)

  • শুরু
  • পূর্বের
  • 15 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 5086 / ডাউনলোড: 2151
সাইজ সাইজ সাইজ
ইমাম কাযেম (আ.)

ইমাম কাযেম (আ.)

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

ইমামের ভূমিকা

হারুন আব্বাসীয় দুঃশাসনের বিরুদ্ধে হযরত আলীর বংশের দৃঢ় অবস্থানের কারণে খুব ক্রোধান্বিত ও অসন্তষ্ট ছিল ;ফলে যে কোন ভাবেই হোক তাদেরকে শাস্তি ও ক্লেশ দেয়ার চেষ্টা করত ,চেষ্টা করত সমাজে তাদের মর্যাদাহানির । আর সে হযরত আলী (আ.)-এর পরিবার বর্গের দুর্নাম করার জন্য আত্মবিক্রিত কবি ও দরবারী কীর্তনকারীদেরকে অগণিত অর্থ প্রদান করত উদাহরণস্বরূপ মানসূর নামারীর কথা উল্লেখ করা যায় । সে ইমাম আলীর পরিবারবর্গকে নিন্দা করে কবিতা রচনা করেছে বলে হারুন তাকে বাইতুল মালের কোষাগারে নিয়ে যাওয়ার আদেশ দিয়েছিল যাতে তার ইচ্ছা মত অর্থ নিতে পারে । 21

বাগদাদের সকল আলাভীগণকে (আলী বংশীয়) মদীনায় নির্বাসন দেয়া হয়েছিল এবং তাদের অগণিত ব্যক্তিকে হত্যা ও বিষ প্রয়োগ করেছিল । 22

এমন কি হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কবর যিয়ারতের জন্য মানুষের আসা যাওয়াটাও সে সহ্য করতে পারত না । সে ইমাম হোসাইনের সমাধিস্থল এবং এর সংলগ্ন গৃহসমূহ বিনষ্ট করার ও ঐ পবিত্র সমাধিস্থলের পার্শ্বে যে কুল গাছ ছিল তা কেটে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিল । 23 পূর্বে মহানবী (সা.) একে একে তিনবার বলেছিলেন : তার উপর মহান আল্লাহর অভিসম্পাত ,যে কুল গাছ কাঁটবে । 24

নিঃসন্দেহে ,ইমাম মুসা কাযেম (আ.) হারুন ও তার পূর্বসূরীদের এ ধরনের অত্যাচারী ও অনৈসলামিক আচার সর্বস্ব হুকুমতের সমর্থন করতে পারেন না । আর এ কারণেই তিনি যদি ফাখের আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন এবং নিজের অনুসারীদের সাথে সার্বক্ষণিক গোপন সম্পর্ক রেখে ছিলেন ,তবে তা সমসাময়িক স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রত্যেকের ভূমিকা নির্ধারণ করার জন্যেই ।

ইমাম মুসা কাযেম (আঃ) একবার ,সাফওয়ান ইবনে মেহরানকে বলেছিলেন : তুমি সবদিক থেকেই উত্তম শুধুমাত্র এ দিকটি ব্যতীত যে ,তুমি তোমার উটগুলো হারুনকে ভাড়া দিয়ে থাক । সাফওয়ান বলল : হজ্বের জন্য ভাড়া দিয়ে থাকি এবং আমি স্বয়ং উটের সাথে যাই না ।

তিনি বললেন : আর এজন্যেই তুমি অন্তরে কামনা করনা যে ,হারুন কমপক্ষে মক্কা থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত জীবিত থাকুক ,যাতে তোমার উটগুলো না হারায় এবং ভাড়ার মূল্য তোমাকে পরিশোধ করতে পারে ?

জবাবে বলল :জী ,হ্যাঁ ।

ইমাম বললেন : যদি কেউ অত্যাচারীদের বেঁচে থাকা কামনা করে তবে সে অত্যাচারীদের অন্তর্ভূক্ত বলে পরিগণিত হয় । 25

যদি কাউকে হারুনের শাসনব্যবস্থায় নিযুক্ত থাকার অনুমতি দিয়েও থাকেন তবে তা রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে এটাকে কল্যাণকর মনে করেছেন বলে । আবার এ কারণেও কাউকে নিযুক্ত করেছেন যে ,তিনি জানতেন হারুনের দুঃশাসনে ,ভয় ,সন্ত্রাস ও শ্বাসরূদ্ধকর পরিস্থিতি বিরাজমান ,আর হুকুমতে তাদের উপস্থিতি শিয়া জনসমষ্টির জন্য লাভজনক এবং তাদের মাধ্যমে আলাভীদের বিরুদ্ধে হুকুমতের প্রবঞ্চনা সম্পর্কে অবহিত হতে পারতেন । যেমন : আলী ইবনে ইয়াকতীন যখন হারুনের দরবারে স্বীয় পদ থেকে ইস্তফা দিতে চেয়েছিলেন ,তখন ইমাম কাযেম (আ.) তাকে অনুমতি দেননি ।

যাহোক ,কোন অবস্থাতেই ইমাম এ স্বৈরাচারীদেরকে সমর্থন করেননি এমনকি যখন ঐ অত্যাচারীদের হাতের থাবায় বন্দী ছিলেন তখনও ।

একবার ইমামের বন্দীদশায় ,হারুন ইয়াহিয়া ইবনে খালিদকে এজন্য কারাগারে প্রেরণ করল যে ,মুসা ইবনে জাফর (আ.) যদি ক্ষমা প্রার্থনা করেন তবে তাঁকে মুক্তি দিবে । ইমাম এ কর্ম থেকে বিরত থাকলেন । 26

ইমাম (আ.) এমনকি তাঁর বন্দী অবস্থার নিকৃষ্টতম সময়েও ,তাঁর ধীশক্তি ,বীরত্ব ,সংগ্রামী ও আপোষহীন মনোভাব পরিত্যাগ করেন নি ।

একদা কারাগার থেকে হারুনের নিকট লিখিত নিম্নলিখিত পত্রাংশটুকুর দিকে গভীর মনোযোগ দিলে অনুধাবন করা যায় যে ,তা কতটা জ্বালাময়ী ,দৃঢ়মনোবলের পরিচয়বহ এবং লক্ষ্য ও  উদ্দেশ্যের প্রতি কতটা নিশ্চিত অভিব্যক্তির প্রকাশ বহন করে । যথা :

...এমন কোন দিন নেই যে দিন আমি কষ্টে কাটাইনি অথচ এমন কোন দিন নেই যে ,তুমি সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে কাটাওনি ।

কিন্তু ,ঐ দিন পর্যন্ত আরাম আয়াশে লিপ্ত থাক যে দিন আমরা উভয়েই এমন এক জগতে পর্দাপন করব যার কোন শেষ নেই এবং ঐ দিন অত্যাচারীরা ক্ষতিগ্রস্থ হবে... । 27

যাহোক ,হারুন এরূপেই ইমামের অস্তিত্বকে সহ্য করতে পারেনি । এটা আমাদের বোকামী হবে যদি মনে করি যে ,হারুন কেবলমাত্র মানুষের অন্তরে ইমামের আধ্যাত্মিক প্রভাব ও প্রথিত যশার কারণে হিংসাপরায়ণ হয়ে ইমামকে কারাগারে বন্দী করেছিল ।

হারুন ইমামের অনুসারীদের সাথে তাঁর সার্বক্ষণিক যোগাযোগের কথা তার বিশেষ নিরাপত্তাবাহিনীর মাধ্যমে সম্পূর্ণরূপে জানতে পেরেছিল এবং সে আরো জানতে পেরেছিল যে ,ইমাম যখনই উপযুক্ত সুযোগ পাবেন স্বয়ং বিপ্লব করবেন কিংবা তাঁর সঙ্গীদেরকে আন্দোলন করতে নির্দেশ দিবেন ,ফলে তার হুকুমতের অনিবার্য পতন ঘটবে ।

সে দেখল ,এ নির্ভীক আত্মার মাঝে কিঞ্চিৎ পরিমাণেও আপোসের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না ,যদিও সাময়িক সময়ের জন্য বাহ্যিকভাবে নিশ্চুপ থাকেন ,তবে তার অর্থ নীরবতা নয় ,বরং তা হল সঠিক সুযোগের অপেক্ষায় তাঁর কৌশলগত নীরবতা । এ জন্য সে আগেভাগেই ব্যবস্থা নিল ।

হারুন সম্পূর্ণ নির্লজ্জ ভাবে ও জনগণকে প্রবঞ্চণা করার জন্য মহানবী (সা.)-এর কবরের পাশে দাঁড়াল এবং খেলাফত হরণ ,অত্যাচার ও জনগণের সম্পদ লুট-তরাজকরণ ,আর খেলাফতকে রাজতন্ত্রে রূপান্তরের জন্য কোন প্রকার লজ্জা করার পরিবর্তে মহানবীকে  উদ্দেশ্য করে বলল :

হে রাসূলুল্লাহ! আপনার সন্তান মুসা ইবনে জা ফরের ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত আমি গ্রহণ করেছি ,তার জন্যে দুঃখ প্রকাশ করছি ,আমি আন্তরিক ভাবে তাঁকে বন্দী করতে চাই না ;কিন্তু আমি এ ভয়ে ভীত যে ,আপনার উম্মতের মধ্যে যুদ্ধ ও বিরোধ সৃষ্টি হবে ;আর এজন্যে এ কর্ম করেছি!!

সে তৎক্ষণাৎ ইমামকে বন্দী ও বসরায় নিয়ে কারারুদ্ধ করার আদেশ দিল । তখন ইমাম সেখানে নবী (সা.)-এর কবরের পাশে নামাযে মশগুল ছিলেন ।

ইমাম বসরার শাসক ঈসা ইবনে জা ফরের কারাগারে এক বছর বন্দী ছিলেন । ইমামের উত্তম চরিত্র ঈসা ইবনে জা ফরের উপর এমন প্রভাব ফেলেছিল যে ঐ জল্লাদ হারুনের নিকট লিখেছিল : তাঁকে আমার নিকট থেকে ফিরিয়ে নাও নতুবা আমি তাঁকে মুক্ত করে দিব ।

হারুনের আদেশানুসারে ,ঐ মহান ব্যক্তিকে বাগদাদে ফাযল ইবনে রাবির নিকট কারারুদ্ধ করা হলো । অতঃপর কিছুদিন ফাযল ইবনে ইয়াহিয়ার নিকট হস্তান্তর করা হয় । সেখানে ,কিছুদিন কারারুদ্ধ থাকার পর সানদি ইবনে শাহাকের নিকট হস্তান্তর করা হয়েছিল । একের পর এক এ স্থান থেকে অন্যস্থানে স্থানান্তরের কারণ ছিল এটাই যে ,হারুন প্রতিবারই কারা প্রহরীর নিকট চেয়েছিল যে কোন ভাবে মহান ইমামকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে । কিন্তু তাদের কেউই এ কর্মটি সম্পাদনে ইতিবাচক সাড়া দেয়নি । অতঃপর এ শেষোক্ত জল্লাদ অর্থাৎ সানদি ইবনে শাহাক ইমামকে বিষ প্রয়োগ করেছিল । তাঁর শাহাদাতের পূর্বে ,একদল প্রখ্যাত ব্যক্তিবর্গকে উপস্থিত করেছিল ,যাতে তারা সাক্ষী দেয় যে ইমাম মুসা কাযেম (আ.) চক্রান্তের স্বীকার হননি ,বরং কারাগারে স্বাভাবিক মৃত্যুর মাধ্যমে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন । আর এ প্রবঞ্চনার মাধ্যমে সে আব্বাসীয় খেলাফতকে ঐ মহান ইমামের হত্যার দায়িত্ব ভার থেকে মুক্ত করতে করতে চেয়েছিল । আর সেই সাথে চেয়েছিল ইমামের অনুসারীগণের সম্ভাব্য আন্দোলনকে প্রতিরোধ করতে । 28

কিন্তু ইমামের প্রত্যুৎপন্নমতিতা ও ধীশক্তি তাদের চক্রান্তকে ব্যর্থ করে দিয়েছিল । কারণ ,যখন ঐ সাক্ষীরা ইমামের দিকে তাকিয়েছিল ,তিনি বিষের প্রচণ্ডতা ও বিপন্ন অবস্থা সত্ত্বেও তাদেরকে বললেন : আমাকে 9টি বিষযুক্ত খোরমা দিয়ে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছে ,আগামীকাল আমার শরীর সবুজ হয়ে যাবে এবং তার পরদিন আমি ইহধাম থেকে বিদায় গ্রহণ করব । 29

আর এ ভাবেই ঐ মহানুভব সংবাদ প্রদান করেছিলেন । দু দিন পর (অর্থাৎ 183 হিজরীর 25শে রজব) 30 গগণ ধরায় শোকের ছায়া নেমে আসল । আর সেই সাথে শোকাহত হল বিশ্বাসীগণ ,বিশেষ করে শিয়াগণ যারা তাদের প্রিয় ইমামকে হারিয়েছিল । এখন সেই মহান শহীদ সম্পর্কে বলব :

তত্ত্বীয় ও জ্ঞানগর্ভ বিতর্ক ও কথোপকথন

আমাদের ইমামগণ ঐশী জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন ,ফলে যে কোন প্রশ্নই তাদেরকে করা হতো তার সঠিক ,পূর্ণ ও প্রশ্নকারীর বোধগম্যতার আলোকে জবাব দিতেন । যে কেউ এমন কি শত্রুরাও যদি ইমামগণের সাথে জ্ঞানগর্ভ ও তত্ত্বীয় আলোচনায় বসত ,স্বীয় অক্ষমতাকে স্বীকার করার পাশাপাশি তাঁদের বিস্তৃত চিন্তা শক্তি ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ের উপর পূর্ণ দখলের কথা অকপটে স্বীকার করত ।

হারুনুর রশিদ ইমাম কাযেম (আ.)-কে মদীনা থেকে বাগদাদ নিয়ে আসল এবং তাঁর সাথে বিতর্কে লিপ্ত হলো । হারুন : অনেকদিন যাবৎ ভাবছি আপনার কাছে কিছু জিজ্ঞাসা করব ,যা আমার মনে জেগেছে । আজোবধি কাউকে জিজ্ঞাসা করিনি । আমাকে বলা হয়েছে যে ,আপনি কখনোই মিথ্যা বলেন না । আমার প্রশ্নের সঠিক ও সত্য জবাব প্রদান করুন!

ইমাম : যদি আমাকে বাক স্বাধীনতা দাও ,তবে তোমার প্রশ্ন সম্পর্কে আমি যা জানি ,তা তোমাকে অবহিত করব ।

হারুন : আপনি স্বাধীন । আপনার যা বলার মুক্তভাবে ব্যক্ত করতে পারেন... ।

যাহোক আমার প্রথম প্রশ্ন হলো : কেন আপনি এবং জনগণ বিশ্বাস করেন যে ,আপনারা আবু তালিবের সন্তানরা ,আমরা আব্বাসের সন্তানদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব রাখেন । অথচ আমরা এবং আপনারা একই বৃক্ষের অংশ ।

আবু তালিব ও আব্বাস উভয়েই মহানবী (সা.)-এর চাচা ছিলেন এবং আত্মীয়তার দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই ।

ইমাম : আমরা তোমাদের চেয়ে মহানবী (সা.)-এর বেশী নিকটবর্তী ।

হারুন : কিরূপে ?

ইমাম : যেহেতু আমাদের পিতা আবু তালিব ও মহানবী (সা.)-এর পিতা পরস্পর আপন ভাই (পিতা ও মাতা একই) ছিলেন কিন্তু আব্বাস আপন ভাই ছিলেন না (কেবলমাত্র মাতৃকূল থেকে) ।

হারুন : অন্য প্রশ্ন : কেন আপনারা দাবী করেন যে ,আপনারা মহানবী (সা.) থেকে উত্তরাধিকার প্রাপ্ত হবেন ,অথচ আমরা জানি যে ,যখন নবী (সা.) পরলোক গমন করেছেন ,তখন তার চাচা আব্বাস (আমাদের পিতা) জীবিত ছিলেন । কিন্তু অপর চাচা আবু তালিব (আপনাদের পিতা) জীবিত ছিলেন না । আর এটা সকলের জানা যে ,যতক্ষণ পর্যন্ত চাচা জীবিত আছেন ,চাচার সন্তানের নিকট উত্তরাধিকার পৌঁছে না ।

ইমাম : আমি স্বাধীন ভাবে কথা বলতে পারি তো ?হারুন : আলোচনার শুরুতেই আমি বলেছি ,মতামত ব্যক্ত করার ব্যাপারে আপনি স্বাধীন ।

ইমাম : ইমাম আলী (আ.) বলেন : সন্তানের উপস্থিতিতে ,পিতা ,মাতা ও স্বামী ,স্ত্রী ব্যতীত কেউ উত্তরাধিকার প্রাপ্ত হবে না । আর সন্তান থাকলে চাচার উত্তরাধিকার লাভের ব্যাপারটি কোরআনে কিংবা রেওয়ায়েতে প্রমাণিত হয়নি । অতএব ,যারা চাচাকে পিতার নিয়মের অন্তর্ভূক্ত করে ,নিজ থেকেই বলে এবং তাদের কথার কোন ভিত্তি নেই । (অতএব ,নবীকন্যা যাহরা (আ.)-এর উপস্থিতিতে তাঁর চাচা আব্বাসের নিকট উত্তরাধিকার পৌঁছে না) ।

তাছাড়া আলী (আ.)-এর সম্পর্কে মহানবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে বর্ণিত হয়েছে যে ,

اقضاكم علىّ

আলী তোমাদের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট বিচারক । ওমর ইবনে খাত্তাব থেকেও বর্ণিত হয়েছে :

علىّ اقضانا

আলী আমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বিচারক : এ বাক্যটি হলো সামগ্রিক তাৎপর্যবহ যা হযরত আলীর জন্য প্রমাণিত হয়েছে । কারণ ,সকল প্রকারের বিদ্যা যেগুলোর মাধ্যমে স্বীয় সাহাবীগণকে প্রশংসা করেছেন যেমন : কোরআনের জ্ঞান ,আহকামের জ্ঞানও সর্ব বিষয়ে জ্ঞান ইত্যাদি সবকিছুই ইসলামী বিচারের তাৎপর্যে নিহিত রয়েছে । যখন বলা হবে আলী (আ.) বিচারকার্যে সকলের চেয়ে উৎকৃষ্ট ,তবে তার অর্থ হবে ,তিনি সর্বপ্রকার জ্ঞানেই সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ।

(অতএব ,ইমাম আলীর এ উক্তি যে ,সন্তানের বর্তমানে চাচা উত্তরাধিকার প্রাপ্ত হবে না তা চূড়ান্ত দলিল রূপে পরিগণিত হবে । সুতরাং একে গ্রহণ করা উচিৎ ,না কি যে মত বলে : চাচা আইনগত ভাবে পিতার স্থানে । কারণ ,নবী (সা.)-এর বক্তব্য অনুসারে ,আলী (আ.) দীনের আহকাম সম্পর্কে সর্বাপেক্ষা বেশি জ্ঞাত) ।

হারুন : অপর প্রশ্ন ।

কেন আপনারা মানুষকে অনুমতি দেন আপনাদেরকে রাসূল (সা.)-এর সাথে সম্পর্কিত করতে এবং এ কথা বলতে আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর সন্তান । অথচ আপনারা হলেন আলীর সন্তান । কারণ ,প্রত্যেককেই তার পিতার সাথে সম্পর্কিত করা হয় (মাতার সাথে নয়) । আর মহানবী (সা.) হলেন আপনাদের নানা ।

ইমাম : যদি মহানবী (সা.) জীবিত হয়ে তোমার কন্যাকে বিয়ে করতে চান ,তবে তুমি কি তোমার কন্যাকে তাঁর সাথে বিয়ে দিবে ?

হারুন : সুবহানাল্লাহ ,কেন দেব না । বরং ঐ অবস্থায় আরব ,অনারব এবং কোরাইশদের সকলের উপর গর্ববোধ করব । ইমাম : কিন্তু নবী (সা.) জীবিত হলে আমার কন্যার জন্য প্রস্তাব দিবেন না ,কিংবা আমিও দিব না ।

হারুন : কেন ?

ইমাম : কারণ ,তিনি আমার পিতা (যদিও মাতৃদিক থেকে ) কিন্তু তোমার পিতা নন । (অতএব ,নিজেকে আল্লাহর রাসূলের সন্তান বলে মনে করতে পারি) ।

হারুন : তাহলে কেন আপনারা নিজেদেরকে রাসূলের বংশধর বলে মনে করেন । অথচ বংশ পিতৃকুল থেকে নির্ধারিত হয় ,মাতৃকুল থেকে নয় ।

ইমাম : আমাকে এ প্রশ্নের জবাব প্রদান থেকে অব্যাহতি দাও ।

হারুন : না ,আপনাকে জবাব দিতে হবে ;আর সেই সাথে কোরআন থেকে দলিল বর্ণনা করুন.. ।

ইমাম :   

) ومن ذرّيّته داود وسليمان و وايّوب ويوسف و مو سي وهارون وكذلك نجزي المحسنين و زكريّا و يحيي و عيسي (

তাহার(ইবরাহীম) বংশধর দাউদ ,সুলায়মান ,আইয়ুব ,ইউসুফ ,মূসা ও হারুনকেও ,আর এভাবে সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করি এবং যাকারিয়া ,ইয়াহিয়া ,ঈসা .. ।

এখন তোমাকে প্রশ্ন করব : এ আয়াতে যে ,ঈসা (আ.) ইবারহীম (আ.)-এর বংশ বলে পরিগণিত হয়েছে ,তা কি পিতৃকুল থেকে ,না মাতৃকুল থেকে ?

হারুন : কোরআনের দলিল মোতাবেক ঈসা (আ.)-এর কোন পিতা ছিলেন না ।

ইমাম : তাহলে মাতৃকুল থেকেই বংশধর বলে পরিগণিত হয়েছে । আমরাও আমাদের মাতা ফাতেমার (আল্লাহ তাঁর উপর শান্তি বর্ষণ করুন) দিক থেকে রাসূলের বংশধর বলে পরিগণিত হই ।

অন্য একটি আয়াত পড়ব কি ?

হারুন : পড়ুন!

ইমাম : মোবাহেলার আয়াতটি পড়ব : 

) فمن حاجّك فيه من بعد ماجائك من العلم فقل تعالوا ندع ابنائنا و ابنئكم و نسائنا و نسائكم و انفسنا وانفسكم ثمّ نبتهل فنجعل لعنة الله علي الكاذبين (

তোমার নিকট জ্ঞান আসার পর যে কেউ এ বিষয়ে তোমার সাথে তর্কে লিপ্ত হয় ,তাকে বল ;আস ,আমরা আহবান করি আমাদের পুত্রগণকে ও তোমাদের পুত্রগণকে ,আমাদের নারিগণকে ও তোমাদের নারিগণকে ,আমাদের নিজ দিগকে ও তোমাদের নিজদিগকে ;অতঃপর আমরা বিনীত আবেদন করি এবং মিথ্যাবাদীদের উপর দেই আল্লাহর লা নত ।

কেউই এরূপ দাবী করেনি যে ,মহানবী (সা.) নাজরানের নাসারাদের সাথে মোবাহেলা করার জন্য আলী ,ফাতেমা ,হাসান ও হোসাইন ব্যতীত অন্য কাউকে নিজের সঙ্গী করেছেন । অতএব ,উল্লিখিত আয়াতে আব না য়ানার (আমাদের পুত্রগণ) দৃষ্টান্ত হলেন ইমাম হাসান (আ.) ও হোসাইন (আ.) ,যদি ও তারা মাতৃ দিক থেকে রাসূলের সাথে সম্পর্কিত এবং তাঁর কন্যার সন্তান ।

হারুন : আমার নিকট কিছু চাইবেন কি ?

ইমাম : না ,আমার নিজের গৃহে প্রত্যাবর্তন করতে চাই ।

হারুন : এ বিষয়ে চিন্তা করে দেখব ... । 31

ইমামের ইবাদত

ইমাম মুসা কাযেমের বিশেষ খোদা পরিচিতি ,মহান প্রভুর প্রতি ,তাঁর সত্তাগত জ্যোতির প্রতি তাঁর আত্মিক আকর্ষণ যা পবিত্র ইমামগণের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি সকল কিছুই তাঁকে প্রেমময় ইবাদত ও উপাসনার দিকে ধাবিত করেছিল । তিনি  ইবাদতকে সৃষ্টির উদ্দেশ্য বলে মনে করতেন ,যেরূপ মহান আল্লাহ বলেছেন : সামাজিক কর্মকাণ্ডের অবসরে তিনি কিছুকেই এর সমকক্ষ বলে মনে করতেন না । যখন হারুনের নির্দেশক্রমে তিনি কারারুদ্ধ হয়েছিলেন ,তখন বলেছিলেন :

الّهمّ انّي طالما كنت اسئلك ان تفرغني لعبادتك وقداستجبت منّي فلك الحمد علي ذالك

প্রভু হে! কতদিন তোমার নিকট চেয়েছি আমাকে (কেবল মাত্র) তোমার ইবাদতের জন্য অবসর দাও । এমন আমার প্রার্থনা তুমি গ্রহণ করেছ ,সুতরাং এজন্য তোমার নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি । 32

এ উক্তিটি কারাগারে আসার পূর্ব পর্যন্ত সামাজাকি কর্মকাণ্ডে ইমামের অপরিসীম ব্যস্ততার প্রমাণবহ ।

যখন ,ইমাম রাবির কারাগারে ছিলেন ,হারুন কখনো কখনো ইমামের কারাগারের ছাদে আসত এবং কারাভ্যন্তরে উঁকি দিয়ে দেখত । যতবারই তাকাত ,প্রত্যেকবারই দেখত একগুচ্ছ জামা কাপড়ের মত কারাগারের এককোণে পড়ে আছে এবং সেখান থেকে স্থানান্তরিত হচ্ছে না । একবার জিজ্ঞাসা করেছিল ঐ পোশাকগুলো কার ?

রাবি বলল : পোশাক নয় ,তিনি মুসা ইবনে জা ফর (আ.) যিনি অধিকাংশ সময়ই প্রভুর ইবাদতের মধ্যে কাটান ও সিজদাবনত হয়ে মাটিতে চুম্বন করেন ।

হারুন বলল : প্রকৃতই তিনি বনি হাশেমের ইবাদতকারীদের অন্তর্ভূক্ত ।

রাবি জিজ্ঞাসা করল : তবে কেন কারাগারে তার উপর কঠোর ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়ে থাকেন ।

হারুন বলল : হায়! এছাড়াতো আমার কোন উপায় নেই!! 33

একবার হারুন ভরা শশী এক দাসীকে তাঁর সম্মানে পাঠিয়েছিল । আর এর আড়ালে এ কুমন্ত্রণা ছিল যে ,যদি ইমাম ঐ দাসীর প্রতি আকৃষ্ট হন ,তবে তা হবে তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচারের উত্তম হাতিয়ার । ইমাম ঐ নারীর আনয়নকারীকে বললেন : তোমরা এ উপহারের প্রতি প্রলুব্ধ এবং এ গুলোই তোমাদের দম্ভ ,এ উপঢৌকন ও এগুলোর মত কিছুই আমার প্রয়োজন নেই । হারুন (আল্লাহর অভিশম্পাত তার উপর) ক্রুদ্ধ হলো এবং ইমামকে এ কথা বলার নির্দেশ দিল যে ,আমরা আপনার খুশীমত আপনাকে কারাবন্দী করিনি । (অর্থাৎ এ দাসীর কারাগারে থাকাটাও আপনার ইচ্ছার উপর নির্ভর করে না । )

কালাতিপাত হয়নি ,ইমাম ও ঐ দাসীর সম্পর্কের ব্যাপারে সংবাদদাতা গুপ্তচররা হারুনকে সংবাদ দিল যে ,ঐ তরুণী অধিকাংশ সময়ই সেজাদাবনত থাকে । হারুন বলল : আল্লাহর শপথ! মুসা ইবনে জা ফর (আ.) ঐ নারীকে যাদু করেছে ... ।

দাসীকে নিয়ে আসার পর জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে ,সে ইমামের সুনাম ব্যতীত কিছুই বলে নি ।

হারুন ঐ দাসীকে নিজেদের নিকট আটক রাখার জন্যে তার প্রহরীদেরকে নির্দেশ দিল যাতে সে কারো নিকট এ ব্যাপারে কিছু না বলতে পারে । ঐ দাসী অনবরত ইবাদতে মশগুল থাকত এবং ইমামের শাহাদাতের কিছু দিন পূর্বে পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণ করেছিল । 34

ইমাম এ দোয়াটি প্রায়ই পড়তেন :

الّهمّ انّي اسالك الرّاحة عند الموت والعفو عند الحساب

প্রভু হে! আমি তোমার কাছে সহজ মৃত্যু কামনা করি ,আর কামনা করি বিচার দিবসে সহজ হিসাব । 35

ইমাম মুসা কাযেম (আ.) এত সুন্দর ও সুললিত কন্ঠে কোরআন পড়তেন যে ,যে কেউ তাঁর কোরআন পাঠ শুনত ,ক্রন্দন করত । মদীনার অধিবাসীরা তাঁকে যাইনুল মুতাহাজ্জেদীন অর্থাৎ রাত্রি জাগরণকারীদের সৌন্দর্য উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন । 36

ইমামের মহানুভবতা ,সহিষ্ণুতা ও নম্রতা

ইমামের মহানুভবতা ও সহনশীলতা ছিল অতুলনীয় যা অপরের জন্য ছিল আদর্শ ।

তাঁর কাযেম ( كاظم ) উপাধিটি যা তাঁর নামের সাথে সংযোজিত হয় ,তা তাঁর এ বৈশিষ্ট্য থেকেই উৎসারিত এবং ক্রোধ অবদমনকারী ও সহিষ্ণু হিসেবে তাঁর খ্যাতির প্রমাণবহ ।

যে দুঃসময়গুলোতে ,আব্বাসীয়রা ইসলামী সমাজের সর্বত্র শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল এবং মানুষের ধন-সম্পদ বায়তুল মালের নামে হরণ করে নিজেদের আরাম-আয়েশের পথে ব্যয় করত । আর তাদের অন্যায় ও স্বেচ্ছাচারিতার ফলে দারিদ্র্যের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছিল । অধিকাংশ মানুষ অসামাজিক ,সংস্কৃতিবিবর্জিত ও দরিদ্র হয়ে পড়েছিল । অপরদিকে আলাভীদের (আলী বংশীয়) বিরুদ্ধে আব্বাসীয়দের অপপ্রচার নির্বোধ মানুষের মন তাঁর সম্পর্কে বিষিয়ে তুলেছিল । কখনো কখনো অজ্ঞতাবশত কেউ কেউ ইমামের সাথে দুর্ব্যবহার করত । কিন্তু ইমাম স্বীয় মহানুভবতা ও সমুন্নত আচরণের মাধ্যমে তাদের ক্রোধ সংবরণ করাতেন এবং সুন্দর ভাষায় তাদেরকে উপদেশ দিতেন ।

মদীনায় বসবাসরত দ্বিতীয় খলিফার বংশধরদের মধ্যে এক ব্যক্তি ইমামকে কষ্ট দিত এবং কখনো ইমামকে দেখলে কটু কথা বলত ও অবমাননা করত ।

ইমামের সঙ্গীদের মধ্যে কেউ কেউ ঐ ব্যক্তিকে হত্যা করতে পরামর্শ দিয়েছিল । ইমাম তাদেরকে কঠোর ভাবে এ কর্ম থেকে বিরত রাখলেন ।

একদা ইমাম মদীনার বাইরে এক শস্যক্ষেতে ওকে দেখলেন । পশুর পৃষ্ঠে আরোহণ করলেন ও তার নিকটবর্তী হলেন এবং পশুর পৃষ্ঠে আরোহী অবস্থায়ই শস্য ক্ষেতে প্রবেশ করলে সে চিৎকার করে বলল : আমার শস্য পদদলিত করবেন না! হযরত তার কথায় কান না দিয়ে তার কাছে গেলেন এবং যখন তার কাছে পৌঁছলেন 37 পশুপৃষ্ঠ থেকে অবতরণ করলেন । উদার দয়াদ্র ভঙ্গিতে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন :

এ ফসলের জন্য কত খরচ করেছে ?

বলল : একশত দিনার

তিনি জিজ্ঞাসা করলেন : কতটা লাভ পাওয়ার আশা কর ?

বলল : অদৃশ্যের ব্যাপার ,আমি জানি না ।

ইমাম বললেন : আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম কতটা তুমি আশাবাদী ?

বলল : দুইশত দিনার লাভ পাওয়ার আশা করি । হযরত তাকে তিনশত দিনার প্রদান করলেন এবং বললেন এ ফসলও তোমার নিজেরই থাকল । মহান আল্লাহ তোমাকে যা কামনা করছ তা দান করবেন ।

লোকটি উঠে দাঁড়াল এবং হযরতের মাথায় চুম্বন করল এবং তাঁর কাছে পূর্ববর্তী অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইল । ইমাম স্মিত হাসলেন এবং ফিরে আসলেন ।

পরদিন ঐ ব্যক্তি মসজিদে বসেছিল । ইমাম সেখানে প্রবেশ করলেন । ঐ ব্যক্তি ইমামকে দেখেই বলতে লাগল :

الله اعلم حيث بجعل رسالته

মহান আল্লাহ যথার্থই অবগত আছেন যে ,স্বীয় রেসালাত কাকে দিবেন (অর্থাৎ ইমাম মুসা ইবনে জা ফর (আ.) প্রকৃতই ইমামতের যোগ্য) ।

তার বন্ধুরা আশ্চর্য হয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করল : ঘটনা কী ,পূর্বে তো তুমি তার কুৎসা রটাতে ?

সে পুনরায় ইমামকে দোয়া করল এবং তার বন্ধুরা তার সাথে বিবাদে লিপ্ত হলো .. । ইমামের যে সকল সঙ্গীরা ঐ ব্যক্তিকে হত্যা করতে চেয়েছিল তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন : কোনটি উত্তম তোমাদের নিয়ত ,না আমি যে স্বীয় ব্যবহারের মাধ্যমে তাকে পথে আনলাম তা ?38