ইমাম মাহদী (আ.)

ইমাম মাহদী (আ.)0%

ইমাম মাহদী (আ.) লেখক:
: মীর আশরাফুল আলম
প্রকাশক: -
বিভাগ: ইমাম মাহদী (আ.)

ইমাম মাহদী (আ.)

লেখক: দার রাহে হাক প্রকাশনীর লেখকবৃন্দ
: মীর আশরাফুল আলম
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 12668
ডাউনলোড: 3033

পাঠকের মতামত:

ইমাম মাহদী (আ.)
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 28 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 12668 / ডাউনলোড: 3033
সাইজ সাইজ সাইজ
ইমাম মাহদী (আ.)

ইমাম মাহদী (আ.)

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

ইমাম মাহদী (আ.)

মূল :দার রাহে হাক প্রকাশনীর লেখকবৃন্দ

ভাষান্তরে : মীর আশরাফুল আলম

بسم الله الرحمن الرحیم

পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু

আল্লাহর নামে

) و َلَقَدْ كَتَبْنا فِى الزِّبُورِ مِنْ بَعْدِ الذِّكْرِ اَنَّ الْأرْضَ يَرِثُها عِبادِىَ الصَّالِحُونَ (

তৌরাতের পরে যাবুরের মধ্যেও আমরা উল্লেখ করেছি যে আমার সৎকর্মশীলবান্দারাই হবে জমিনের উত্তরাধিকারী(আম্বিয়া : 105)।

ভূমিকা

শতাব্দীর পর শতাব্দী অপেক্ষার পর ,পাহাড়সম ধৈর্য্যের প্রতিমূর্তি ,দৃঢ় সংকল্প ও সিদ্ধান্তের অধিকারী এক অশ্বারোহী আসবে তাঁর ঐশী হাতের তরবারীটি হীন ,নীচ ও জঘন্য লোকদেরকে ধ্বংস করার জন্য ঝংকিত হবে। ভাল মানুষের হেদায়েতের জন্য তার নূরের ছটা প্রজ্জলিত হবে। তিনি আসবেন মানবতার সবচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন রজনীতে উজ্জ্বল এক উল্কার ন্যায় ,অসত্যের ভয়ংকর পদভূমিতে মহা সত্যের প্রতীক হিসাবে মুহাম্মদ (সা.)-এর পাগড়ি মাথায় ,তাঁর আলখেল্লা পরিধান করে ,তাঁর জুতা পায়ে দিয়ে ,তাঁর  কোরআন বুকে নিয়ে এবং আলী (আ.)-এর যুলফিকার (তরবারী) তার হাতে ,যাহরা (সা .আ.)- এর ভালবাসা অন্তরে ধারণ করে ,ইমাম হাসান (আ.)-এর  মতো ধৈর্য রয়েছে তাঁর ব্যক্তিত্বে ,ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মতো সাহসিকতা তার পদক্ষেপে ,ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর মত ইবাদতকারীর খ্যাতি নিয়ে ,ইমাম বাকির (আ.)-এর মত জ্ঞানের ভাণ্ডার ,ইমাম মূসা কাযেম (আ.)-এর মত মহানুভবতা ,ইমাম রেযা (আ.)-এর সন্তুষ্টি ,ইমাম জাওয়াদ (আ.)-এর দানশীলতা ,ইমাম হাদী (আ.)-এর হেদায়েত ,ইমাম আসকারী (আ.)-এর ভাবমূর্তি নিয়ে তিনি আসবেন ...।

মাথা থেকে পা পর্যন্ত নবুয়ত ও ইমামতের প্রতিচ্ছবি ,সমস্ত নবীর বৈশিষ্ট্যে তাঁর অস্তিত্বে প্রতিফলিত ,যেমন হযরত আদম (আ.)-এর মতো মনুষ্যত্বকে আলোকিত করা ,হযরত নূহ (আ.)-এর মতো শতবছর ধরে কষ্ট ও নিপীড়নের বোঝা বহন ,হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর মতো তাওহীদের ধ্বনি দিয়ে মূর্তিসমূহ ভেঙ্গে চুরমার করবেন ,যেমন হযরত মূসা (আ.)-এর ন্যায় ফিরাউনদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবেন ,হযরত ঈসা (আ.)-এর ন্যায় মৃত মানুষকে জীবিত করবেন এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ন্যায় বিশ্ববাসীর কল্যাণ ও সফলতা বয়ে আনবেন ... ।

যখন তিনি নামায পড়বেন চিরন্তন সত্তার প্রকৃত ইবাদতকারীর প্রতীক স্বরূপ ,যখন তিনি উপদেশ দান করবেন তাঁর কথায় নবীদের উপর নাযিলকৃত ওহীর আওয়াজ ভেসে উঠবে ,তাঁর গর্জন শতাব্দীকে প্রকম্পিত করবে ,অত্যাচারীদের তলোয়ারের ঝন ঝনানি চির দিনের জন্য থামিয়ে দিবেন ,তাঁর কিয়াম কিয়ামতের ন্যায় পৃথিবীকে জাগরিত করবে ,যেহেতু তাঁর আবির্ভাবের অর্থই হচ্ছে ধার্মিকতার উত্থান সেহেতু দীন ইসলামকেই পৃথিবীর উপর প্রতিষ্ঠিত করবেন ,যেহেতু তাঁর হাতদুটি উর্বর ফলদায়ক গাছের ডাল পালার ন্যায় (অর্থাৎ ইমামতেরই অংশ বিশেষ) জমিন এবং আসমানের মধ্যে যোগ সূত্র স্থাপন করবে (অর্থাৎ পৃথিবীকে এমন আধ্যাত্মিকতায় ভরে দিবে যে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি হবে) ,যেহেতু তার বাণীসমূহ আল্লাহ্ তা য়ালার ওহীর সহগামী তাই ফেরেশতাদেরকেও মানুষের পাশা পাশি ডাকবেন ...।

যখন তাঁর উত্থান ঘটবে বিভ্রান্তিসমূহের বিলুপ্তি ঘটবে ,তিনি যখন শির উঁচু করবেন হেদায়েতের পতাকা উত্তোলিত হবে ,তাঁর উত্থানস্থল বিশৃংখলা সৃষ্টিকারীদের বধ্যভূমি ,তাঁর নাম মানবতার শত্রুদের কাছে মৃত্যুদূতের স্মরণ ,তাঁর আবির্ভাব অত্যাচারীদের যবনিকা টানবে ,তাঁর অবস্থান সৎকর্মশীলদের জন্য কল্যাণকর ,তাঁর অন্তর্ধান নিপীড়িতদের জন্য দীর্ঘতম রজনী স্বরূপ এবং তাঁর আবির্ভাব প্রতীক্ষমান সত্যিকার প্রেমিকদের জন্য শুভ সকাল।

তিনি পৃথিবীর বুকে আল্লাহর শাসন প্রতিষ্ঠা করেবেন ,মানুষ যে আল্লাহর খলিফা তার প্রকৃত অর্থকে তাদের সামনে তুলে ধরবেন ,তাঁর অস্তিত্ব আল্লাহর উপর ঈমানের বৃহৎ অলৌকিক নিদর্শনসমূহের একটি ,তার অন্তর্ধান হচ্ছে অদৃশ্যের ব্যাখ্যাকারী ,তাঁর আবির্ভাব আখেরাতের সু-সংবাদদাতা ,তাঁর কিয়াম জিহাদ ও ঐশী প্রতিশ্রুতির ব্যাখ্যাকারী ,তাঁর ভাষ্যই কোরআনের ব্যাখ্যা ,পথহারাদের জন্য তাঁর দৃষ্টি নবীদের ভালবাসায় ভরা সমুদ্রের তরঙ্গ স্বরূপ অবশেষে তিনিই একমাত্র ভরসা যিনি দীনের প্রকৃত সৈনিকদেরকে তাদের নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দেবেন এবং নবীদের মিশন ও তাদের কষ্টকে ফলাফলে পৌঁছাবেন ...।

সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত

নাম : মাসুম (পাক ও পবিত্র) ইমামগণ তাদের অনুসারীদেরকে ইমাম মাহ্দী (আ.) -এর নাম উচ্চারণ করতে বারণ করেছেন। আর এ বিষয়ে এতটুকুই বলেছেন যে ,আমাদের নবী (সা.)-এর নাম ও ডাক নামই তার নাম ও ডাক নাম 1 এবং তাঁর আবির্ভাব না হওয়া পর্যন্ত তাঁর আসল নাম উচ্চারণ করা ঠিক হবে না। 2

উপাধি : এই মহান ব্যক্তির সব থেকে পরিচিত উপাধিগুলো হচ্ছে যথাক্রমে মাহ্দী ,কায়েম ,হুজ্জাত ও বাকিয়াতুল্লাহ্ ।

পিতা : ইমামতের আকাশের একাদশতম নক্ষত্র হযরত ইমাম হাসান আসকারী (আ.)।

মাতা : সম্মানীতা ও সম্ভ্রান্ত রমণী নারজীস। তিনি ছিলেন রোম সম্রাটের দৌহিত্রা।

জন্ম তারিখ : 255 হিজরীর 15ই শা বান রোজ শুক্রবার।

জন্মস্থান : ইরাকের সামাররা শহরে।

বয়স : এখন আরবী 1436 সন ,আর তিনি আরবী 255 সনে জন্ম গ্রহণ করেছেন ;সে অনুযায়ী তাঁর বয়স আনুমানিক একহাজার একশ একাশি বছর চলছে। আর এভাবেই চলতে থাকবে যতদিন পর্যন্ত আল্লাহ্ রাব্বুল আ লামিন চান। আর তিনি একদিন আল্লাহ্ রাব্বুল আ লামিনের অনুমতিতেই পৃথিবীতে আবির্ভূত হবেন এবং পৃথিবীকে অত্যাচার ও জুলুমের মধ্যে নিমজ্জিত অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়ে সমস্ত স্থানে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করবেন।

ইসলাম ছাড়াও বিভিন্ন ধর্মে হযরত মাহ্দীর উপর বিশ্বাস

ইমাম মাহ্দী (আ.) যিনি আল্লাহর তরফ হতে পৃথিবীর বুকে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য আসবেন। বিভিন্ন মাযহাব ও দীনের লোকদেরকে তাঁর উপর বিশ্বাস রাখতে দেখা যায়। শুধুমাত্র শিয়ারাই নয় বরং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা য়াত ও অন্যান্য দীন যেমন ইহুদী ,খৃস্টান ,অগ্নিপূজক ,হিন্দু সবাই আল্লাহর পক্ষ হতে একজন ঐশী সংস্কারকের আবির্ভাবের বিষয়টি স্বীকার করে এবং তাদের ধর্ম গ্রন্থ এরূপ ব্যক্তির আগমনের ঘোষণা দিয়েছে। তারা ও তাঁর অপেক্ষায় দিন গুনছে।

হিন্দু ধর্মের দিদ নামক ধর্মীয় গ্রন্থে এভাবে লেখা হয়েছে যে : এই পৃথিবী মন্দে (অত্যাচার ,জুলুম ,নিপীড়ন ,অন্যায় ,অবিচার) পূর্ণ হওয়ার পর শেষ জামানায় একজন বাদশাহ্ আসবেন যিনি সৃষ্টি কূলের জন্য পথ প্রদর্শক হবেন। তার নাম মানসুর বা সাহায্যপ্রাপ্ত। 3 সমস্ত পৃথিবীকে তিনি তার হাতের মুঠোয় নিয়ে আসবেন। কে মু মিন আর কে কাফের চিনতে পারবেন। আর তিনি আল্লাহর কাছে যা কিছুই চাইবেন আল্লাহ্ রাব্বুল আ লামিন তাই তাকে দিবেন। 4

যারথুষ্ট্র ধর্মের প্রবক্তা যারথুষ্ট্রের এক শিষ্যের লেখা জামাসব নামক বইতে এভাবে উল্লেখ আছে যে : আরবের হাশেমী বংশ থেকে এমন এক লোকের আবির্ভাব হবে যার মাথা ,দেহ ও পা যুগল হবে বিশালাকারের। তাঁর পূর্বপূরুষের দীনের উপর প্রতিষ্ঠিত ঐ ব্যক্তি বিশাল সৈন্য বাহিনী নিয়ে ইরানে আসবে এবং এই দেশকে সুখ-শান্তি ,সত্য ও ন্যায়ে পূর্ণ করবেন। আর তাঁর ন্যায় পরায়ণ শাসনে বাঘ ও ছাগল একই ঘাটে পানি পান করবে। 5

যারথুষ্ট্রদের ধর্মীয় গ্রন্থ যানদ -এ বর্ণিত হয়েছে যে ,ঐ সময় ইয়ায্দানদের (অগ্নিপূজকদের খোদাদের) পক্ষ হতে বড় ধরনের বিজয় আসবে এবং আহরিমানকে (অশুভ আত্মাকে বা শয়তানকে) নিশ্চিহ্ন করবে। আর পৃথিবীতে  আহরিমানের (শয়তানের) সমস্ত অনুচরদেরকে নিরাশ্রয় করা হবে। ইয়াযদানদের বিজয় ও আহরিমানের পরাজয়ের পর এই পৃথিবী তার প্রকৃত পূর্ণতায় পৌঁছাবে এবং আদম সন্তানরা সৌভাগ্যের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হবে। 6

তওরাতে সেফরে তাকভীন হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর বংশ থেকে যে বারজন ইমাম আসবেন ,তাদের ব্যাপারে বলা হয়েছে : ইসমাইলের জন্য তোমার দোয়া শুনেছি এ কারণে তাকে বরকতময় করেছি এবং বংশধরের মধ্যে বারজন নেতার আবির্ভাব ঘটাব এবং তাকে বিশাল উম্মত দান করব। 7

হযরত দাউদ (আ.)-এর মাযামিরে উল্লিখিত হয়েছে : অবশ্য সৎকর্মশীলদেরকে মহান আল্লাহ্ সাহায্য করবেন সৎকর্মশীলরা এমন এক ভূমির উত্তরাধিকারী হবে যার মধ্যে তারা স্থায়ী হবে। 8

আর পবিত্র কোরআনেও উল্লেখ করা হয়েছে :

) و َ لَقَدْ كَتَبْنا فِى الزَّبُورِ مِنْ بَعْدَ الذِّكْرِ أَنَّ الْاَرْضَ يَرِثُها عِيبادِىَ الصَّالِحُونَ ( .

নিশ্চয়ই আমরা জিকরের (অর্থাৎ তওরাতের) 9 পর যাবুরের (দাউদ) 10 মধ্যে লিখেছি যে আমার সৎকর্মশীল বান্দারাই জমিনের উত্তরাধিকারী হবে। 11

পবিত্র কোরআনে আরও বলা হয়েছে :

) و َعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَ عَمِلُوا الصَّالِحاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِى الْارْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الّذينَ مِنْ قَبْلِهِمْ و لَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِى ارْتَضَى لَهُمْ وَ لَيُبَدِّلَنَّهُمْ مِنْ بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْناً يَعْبُدُونَنِى لا يُشْرِكُونَ بِى شَيْئاً (

আল্লাহ্ রাব্বুল আ লামিন তোমাদের মধ্যে থেকে যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে তাদের প্রতি ওয়াদা দিয়েছেন যে ,তাদেরকে জমিনের বুকে নিজের খলিফা ও প্রতিনিধি নিযুক্ত করবেন।  যেভাবে তাদের পূর্ববর্তীদের খেলাফত ও প্রতিনিধিত্ব দান করেছিলেন। যে দীনকে আল্লাহ্ তাদের জন্য পছন্দ করেছেন তাকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করবেন এবং তাদের ভয়-ভীতিকে শান্তি ও নিরাপত্তায় পরিবর্তন করবেন , (এই শর্তে) যে ,শুধুমাত্র আমার ইবাদত করবে এবং কোন কিছুকে আমার সাথে শরিক করবে না। 12

আরও উল্লেখ আছে যে

) و َ نُرِيدُ أَنْ نَمُنَّ عَلى الَّذِينَ اسْتُضْعِفُوا فِى الْارْضِ وَ نَجْعَلَهُمْ أَئِمَّةً وَ نَجْعَلَهُمُ الْوارِثِينَ (

পৃথিবীতে যাদেরকে দুর্বল করে রাখা হয়েছিল আমি চাইলাম তাদেরকে (আল্লাহর সেইসব বান্দা যারা অত্যাচারীর অত্যাচারের সামনে শক্তিহীন অবস্থায় ছিল) অনুগ্রহ করতে এবং তাদেরকে নেতৃত্ব দান ও জমিনের উত্তরাধিকারী করতে। 13

এই আয়াতগুলো যা নমুনা স্বরূপ উল্লেখ করা হয়েছে। তা থেকে এ ধারণা পাওয়া যায় যে ,অবশেষে এই পৃথিবীর দায়িত্ব আল্লাহর যোগ্য অর্থাৎ মু মিন বান্দাদের হাতে আসবে এবং তারাই এর উত্তরাধিকারী হবে। আর এই বিশ্বের নেতৃত্বের আসনে তারা সমাসীন হবে। মানবজাতি যদি সঠিক পথ এবং আল্লাহর নির্দেশিত বিধান হতে দূরে সরে যায় তবে যতই সে দূরে সরতে থাকে বিচ্যুতির অতল গহবরে তলিয়ে যেতে থাকে। যখন সে পতনের প্রান্তসীমায় পৌঁছায় হঠাৎ তার বিবেক জাগ্রত হয় তখন বুঝতে পারে নিজের শক্তি ,চিন্তা ,জ্ঞান ,কৌশল ও বস্তুগত প্রযুক্তিসমূহ দিয়ে সে বিশ্বে শৃংখলা ,ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় সক্ষম নয়। আর এ অবস্থায় সে এ সত্যও উপলব্ধি করে যে,ওহী ও ঈমান নির্ভর ঐশী নেতৃত্ব অর্থাৎ শুধুমাত্র একজন বিশ্বজনীন ঐশী সংস্কারকই পারে বিশ্ব ও মানব জাতিকে পতন হতে রক্ষা করতে ও মুক্তি দিতে। শুধুমাত্র তার সাহায্যেই পারে তারা পূর্ণতার পথ অতিক্রম করে ন্যায় ,শান্তি ,নিরাপত্তা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ বিশ্বজনীন শাসন প্রতিষ্ঠা করতে।

ইসলামী উৎসসমূহে প্রতিশ্রুত ইমাম মাহ্দীর উপর বিশ্বাস

ইসলামের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) এবং নিষ্পাপ ইমামগণ ,বিভিন্ন সময়ে বা বিভিন্ন উপলক্ষ্যে হযরত মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাব ,উত্থান ,দীর্ঘদিন মানুষের দৃষ্টির অন্তরালে থাকা এবং তার আরও বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে খবরা খবর দিয়েছিলেন। তাদের অনেক অনুসারী বা ছাত্ররাই এই খবর বা হাদীসসমূহকে উল্লেখ করেছেন। ইমাম মাহ্দী গ্রন্থের লেখক তার এই গ্রন্থে নবী (সা.)-এর 50 জন সাহাবী ও 50 জন তাবেইন (যারা সরাসরি নবীকে (সা.) দেখেন নি কিন্তু তার সাহাবাদেরকে দেখেছেন) যারা হযরত মাহ্দী সংক্রান্ত হাদীসসমূহকে লিপিবদ্ধ করেছে তাদের নাম উল্লেখ করেছেন। 14

কিছু সংখ্যক বিশিষ্ট ও নামকরা কবি অনেক বছর ধরে এমনকি ইমাম মাহ্দীর জন্মগ্রহণের একশত বছর আগে থেকেই এই হাদীসসমূহের ভাবার্থের উপর ভিত্তি করে তারা তাদের কবিতা রচনা করেছেন :

কুমাইত একজন বিপ্লবী শিয়া কবি (মৃত্যু 126 হিজরী) ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর উপর রচিত একটি কবিতা ইমাম বাকির (আ.)-এর সামনে পাঠ করে তাঁর আবির্ভাবের সময় সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিল। 15

ইসমাইল হামিরী (মৃত্যু 173 হিজরী ) ইমাম সাদিক (আ.)-এর সংস্পর্শে এসে তাঁর মাধ্যমে হেদায়েত পাওয়ার পর ,একই ছন্দে গাঁথা প্রশংসা মূলক একটি দীর্ঘ কবিতা রচনা করে যা নিম্নে উল্লিখিত হলো :

وَ اُشْهِدُ رَبِّى أَنَّ قَوْلَكَ حُجَّةٌ

عَلَى الْخَلْقِ طُرّاً مِنْ مُطِيعٍ وَ مُذْنِبٍ

بِاَنَّ وَلِىَّ الْامْرِ وَ الْقاَئِمَ الَّذِى

تَطَلَّعَ نَفْسِى نَحْوَهُ بِتَطَرُّبٍ

لَهُ غَيْبَةٌ لا بُدَّ مِنْ أَنْ يَغِيبَها

فَصَلِّىَ عَلَيْهِ اللَّهُ مِنْ مَتَغَيِّبٍ

فَيَمْكُثُ حِيناً ثُمَّ يَظْهَرُ حِينَهُ

فَيَمْلَأُ عَدْلاً كُلَّ شَرْقٍ وَ مَغْرِبٍ

(আর আমার আল্লাহকে সাক্ষী রাখছি যে আপনার (ইমাম সাদিক) মুখের কথা সমস্ত সৃষ্টির উপর যারা অনুগত ও যারা পাপী ,তাদের সবার উপর দলিল স্বরূপ।

(বলেছিলেন যে) ওয়ালীয়ে আমর (নির্দেশের অধিকর্তা) ও কায়েম (উত্থানকারী) যার জন্য আমার প্রাণ ব্যাকুল ,তাঁর অন্তর্ধান থাকবে যাতে কোন সন্দেহ নেই ,ঐ অন্তর্ধানের উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক।

একটি নির্দিষ্ট সময় অদৃশ্যে থাকার পর আবির্ভূত হবেন। আর পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত অত্যাচার ও জুলুমকে অপসারণ করে আদর্শ ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করবেন।

দে বেল খুযা ই হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর প্রথম দিকের একজন উচ্চমানের সাহিত্যিক ছিলেন (মৃত্যু 246 হিজরী)। তিনিও এসম্পর্কে একটি প্রশংসামূলক দীর্ঘ কবিতা রচনা করে ইমাম রেজা (আ.)-এর সামনে পাঠ করেন ,যা এরূপ :

فَلَوْلاَ الَّذِى اَرْجُوهُ فِى الْيَوْمِ اَوْ غَدٍ

تَقَطَّعَ نَفْسِى اَثْرَهُمْ حَسَراتٍ

خُرُوجَ اِمامٍ لاَ مُحالَةَ خاَرِجٌ

يَقُومُ عَلَى اسْمِ اللَّهِ وَ الْبَرَكاَتِ

يُمَيِّزُ فِيناَ كُلَّ حَقٍّ وَ باطِلٍ

وَ يَجْزِى عَلَى النَّعْماءِ وَ النَّقَماتِ

আজ অথবা কাল যা কিছু ঘটবে সে বিষয়ে যদি আমি আশান্বিত না থাকতাম তাহলে আমার অন্তর আহলে বাইতের দুঃখে ও অনুতাপে টুকরো টুকরো হয়ে যেত।

এবং সেই আশা ,এমন এক ইমামের অবির্ভাবের জন্য যিনি নিঃসন্দেহে আবির্ভূত হবেন। যিনি আল্লাহর নাম ও বরকত সাথে নিয়ে কিয়াম করবেন। আর তিনি আমাদের মধ্যকার সত্য ও বাতিলকেও পৃথক করবেন এবং ভাল কাজের পুরস্কার ও খারাপ কাজের শাস্তি দিবেন। 16

যখন দে বেল এই কবিতাটি পাঠ করলো ইমাম রেজা (আ.) মাথা তুলে বললেন : ওহে খুযা ই! এই কবিতাটিকে রুহুল কুদুস তোমার মুখ দিয়ে উচ্চারণ করিয়েছেন। আরও বললেন : তুমি কি জান সেই ইমাম কে ?

দে বেল : না জানিনা। শুধু এতটুকুই শুনেছি যে ,একজন ইমাম আপনার বংশ থেকে আবির্ভূত হবেন এবং পৃথিবীতে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করবেন।

ইমাম : ওহে দে বেল! আমার পরে আমার ছেলে মুহাম্মদ (ইমাম জাওয়াদ) ইমাম ও তারপর তার ছেলে আলী (ইমাম হাদী) ,তারপর তার ছেলে হাসান (ইমাম আসকারী) এবং তারপর তার ছেলে হুজ্জাতে কায়েম যে থাকবে লোক চক্ষুর অন্তরালে আর মানুষ থাকবে তার অপেক্ষায়। যখন তাঁর আবির্ভাব ঘটবে সবাই তাকে অনুসরণ করে চলবে। যদি দুনিয়া ধ্বংস হওয়ার মাত্র আর একদিনও বাকি থাকে আল্লাহ্ সেই দিনকে এতটা দীর্ঘ করে দিবেন যাতে করে সেই কায়েমের আবির্ভাব ঘটতে পারে এবং দুনিয়াতে অত্যাচার ও জুলুমের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে সেখানে আদর্শ ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। অত্যাচার ও জুলুমের পরিমান যতই বেশী হোক না কেন। 17

অন্যান্য আরও কিছু সংখ্যক কবি ও লেখক যারা ইমামগণের সমসাময়িক অথবা ইমামগণের সমসাময়িক কবিদের ছাত্র ছিল ,তারা তাদের কবিতায় পরিষ্কারভাবে হযরত মাহ্দী (আ.)-এর বিষয়ে ইশারা করেছে। 18 কখনও কখনও এমন হয়েছে যে ইমামদের কাছে অনেকেই প্রশ্ন করত ,আপনি কি রাসূলের বংশের সেই উত্থানকারী (কায়েম আলে মুহাম্মদ) অথবা প্রতীক্ষিত মাহ্দী (মাহ্দী মুনতাযার) ?ইমামগণ তাদের প্রশ্নের উত্তরে স্থান ,কাল ,পাত্র ভেদে ইমাম মাহদী আল কায়েম (আ.)-এর পরিচয় তুলে ধরতেন।

আর এ সম্পর্কিত (ইমাম মাহ্দীর আবির্ভাবের) হাদীসসমূহের প্রসিদ্ধির কারণেই তাঁর জন্মের পূর্ব থেকেই অনেকেই নিজেদেরকে মাহ্দী হওয়ার মিথ্যা দাবী করেছে অথবা তাদেরকে মাহ্দী বলে অভিহিত ও প্রচার চালিয়ে অন্যরা এই পথে সুবিধা আদায় করেছে। উদাহরণ স্বরূপ : কিসানিয়াহ্ ফেরকার অনুসারীরা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর জন্মের প্রায় দুইশত বছর আগে মুহাম্মদ হানাফিয়াকে ইমাম ও প্রতীক্ষিত মাহ্দী বলে মনে করত। আর তাদের ধারণা ছিল যে ,সে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেছে। একদিন আবার আবির্ভূত হবে। তারা তাদের দাবি অনুযায়ী ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর ব্যাপারে নবী (সা.) ও অতীত ইমামগণের নিকট থেকে যে সকল হাদীস শুনেছিল তা মুহাম্মদ হানাফিয়ার ব্যাপারে বলতে শুরু করলো। 19 আব্বাসীয় খলিফা মাহ্দীও নিজেকে প্রতিশ্রুত মাহ্দী বলে মানুষের মাঝে পরিচিত করাতে চেয়েছিল যাতে করে ইমাম মাহ্দীর অপেক্ষায় থাকা মানুষদের নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে।

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত ও শিয়া মাযহাবের অনেক আলেমই ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর ব্যাপারে বিভিন্ন রেওয়ায়েত ও হাদীস তাদের লিখিত বইতে লিপিবদ্ধ করেছেন। 20 মুসনাদে আহমাদ বিন হাম্বাল (মৃত্যু 241 হিজরী) ও সহীহ বুখারী (মৃত্যু 256 হিজরী) যা আহলে সুন্নতের আলেমদের কাছে নির্ভরযোগ্য বলে গণ্য তাতে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর জন্মের অনেক আগেই তাঁর ব্যাপারে হাদীস লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। 21

হাসান বিন মাহবুব কর্তৃক লিখিত মাশিখাহ্ বইটি যা মরহুম তাবরাসীর ভাষ্য অনুযায়ী ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর দীর্ঘ কালীন অন্তর্ধানের একশত বছর পূর্বে লিখিত হয়েছে। তাতে ইমামের অন্তর্ধান সম্পর্কে হাদীস বর্ণিত হয়েছে। 22 মরহুম তাবারসী আরও বলেন যে ,ইমাম বাকির ও সাদিক (আ.)-এর সময়কার শিয়া মুহাদ্দিসরা ইমাম মাহ্দীর অন্তর্ধানে থাকার বিষয়টিকে তাদের গ্রন্থসমূহে বর্ণনা করেছেন। 23

আরও কিছু শিয়া ও সুন্নি মনীষী প্রতীক্ষিত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর ব্যাপারে স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেছেন 24 যার কিছু কিছু তার জন্মের পূর্বেই রচিত হয়েছে। রাওয়াজনী (মৃত্যু 250 হিজরী) একজন সুন্নি আলেম ,তিনি ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর জন্মের আগেই তাঁর সম্পর্কে আখবারুল মাহ্দী নামে একটি বই লিখেন। 25 ইমামদের কিছু সাহাবাও যেমন : আনমাতী ,মুহাম্মদ বিন হাসান বিন জুমহুর ইমামের জন্ম ও তাঁর অন্তর্ধানের পূর্বেই তাঁর সম্বন্ধে বই লিখেন। 26

তাঁর বিষয়ে এত পরিমানে হাদীস ও রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে যে ,ইসলামের অন্য কোন বিষয়ে এত অধিক হাদীস বর্ণিত হয় নি। শিয়া ও সুন্নি উভয় মাযহাবের আলেমদের দৃষ্টিতে এই সকল হাদীসগুলো সহীহ এবং নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত। শুধুমাত্র শিয়া আলেমরাই নন বরং অনেক সুন্নি আলেমও এগুলোকে মুতাওয়াতির বলে স্বীকার করেছেন। 27 যেমন সাজযী (মৃত্যু 363 হিজরী) তার মানাকিবুস শাফিয়ী নামক গ্রন্থে লিখেছেন : হযরত মাহ্দী সংক্রান্ত হাদীসসমূহ যা নবী (সা.)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করা  হয়েছে তা মুতাওয়াতিরের পর্যায়ে পড়ে। 28

শিয়া ও সুন্নি উভয় মাযহাবের সূত্রসমূহে ইমাম মাহ্দীর ব্যাপারে যত হাদীস পাওয়া গেছে তা যদি গণনা করা হয় নিঃসন্দেহে তা এত অধিক পরিমানে হবে যে ,ইসলামের নিশ্চিত বিশ্বাসের বিষয়েও অর্থাৎ যে সকল বিষয়ে মুসলমানরা কোন প্রকার সংশয় রাখেনা বা যে বিষয়গুলোকে মেনে চলা বাঞ্ছনীয় বলে মনে করে তার ব্যাপারেও এত পরিমান হাদীস বর্ণিত হয় নি। 29

এ কারণেই মুসলমানরা ইসলামী ইতিহাসের সেই প্রথম থেকেই মাহ্দী মওউদের (প্রতিশ্রুত মাহদী) আবির্ভাব ও উত্থানের বিষয়ে অবগত ছিল। বিশেষ করে শিয়া মাযহাবের অনুসারী যারা নবী (সা.)-এর পবিত্র আহলে বাইতের হাতে দীন ও দুনিয়ার বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হয়েছিল। এ জন্যেই তারা এই বিষয়ের উপর শক্ত ও মজবুত বিশ্বাস রাখতো এবং অন্যান্য ইমামদের জীবদ্দশাতেও ইমাম মাহ্দীর জন্মের জন্য অধীর অপেক্ষায় থাকতো।

বিভিন্ন হাদীসে হযরত মাহ্দীর ব্যাপারে বলা হয়েছে যে তিনি হাশেমী বংশের হযরত ফাতিমা (সা.)-এর সন্তান ,শহীদদের সর্দার ইমাম হুসাইনের বংশধারা হতে হবেন। তাঁর পিতার নাম হচ্ছে হাসান এবং তাঁর নিজের নাম ও ডাক নাম নবী (সাঃ)-এর নাম ও ডাক নামের অনুরূপ। গোপনে জন্মগ্রহণ করবেন ও লোকচক্ষুর অন্তরালে জীবন-যাপন করবেন। দুইটি অন্তর্ধান হবে। যার একটি স্বল্প মেয়াদী অপরটি দীর্ঘ মেয়াদী। যতদিন আল্লাহ্ চাইবেন অন্তর্ধানে থাকবেন। অবশেষে আল্লাহর নির্দেশে আবির্ভূত ও কিয়াম (মহাবিপ্লব) করবেন। আর সারা বিশ্বে দীন ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। পৃথিবীকে অত্যাচার ,জুলুম থেকে মুক্ত করে সেখানে আদর্শ ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করবেন।

এই হাদীসগুলোতে দ্বাদশ ইমামের শারীরিক ও ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। আমরা এখানে নমুনা স্বরূপ কয়েকটি হাদীস তুলে ধরব। সুন্নি ও শিয়া মাযহাবের হাদীসগুলোকে আমরা এখানে পৃথক পৃথকভাবে তুলে ধরবো যাতে করে পাঠকের বোঝার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়।