ইমাম মাহদী (আ.)

ইমাম মাহদী (আ.)0%

ইমাম মাহদী (আ.) লেখক:
: মীর আশরাফুল আলম
প্রকাশক: -
বিভাগ: ইমাম মাহদী (আ.)

ইমাম মাহদী (আ.)

লেখক: দার রাহে হাক প্রকাশনীর লেখকবৃন্দ
: মীর আশরাফুল আলম
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 12722
ডাউনলোড: 3074

পাঠকের মতামত:

ইমাম মাহদী (আ.)
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 28 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 12722 / ডাউনলোড: 3074
সাইজ সাইজ সাইজ
ইমাম মাহদী (আ.)

ইমাম মাহদী (আ.)

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

ইমামের জন্ম গ্রহণের খবর গোপন থাকার কারণ

ইসলামের ইতিহাস সাক্ষ্য দান করে বনি উমাইয়া ও বনি আব্বাসের শাসনামলে বিশেষ করে ষষ্ঠ ইমাম হযরত সাদিকের পর থেকে আব্বাসীয় খলিফারা অন্যান্য ইমামগণের ব্যাপারে স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছিল। তার কারণ হলো সমাজের মানুষের মাঝে তাদের বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা ছিল। আর যতই দিন যাচ্ছিল সমাজের ভিতর তাদের গ্রহণযোগ্যতা ও তাদের প্রতি মানুষের ভালবাসা বেড়েই চলছিল। তাই আব্বাসীয় খলিফারা ,নিজেদের খেলাফত হাত ছাড়া হয়ে যাওয়ার আশংকা করত। বিশেষ করে ইমাম মাহ্দীর বিষয়ে সকলে জানত যে ,তিনি নবীর উত্তরসূরী ও মাসুম ইমামগণের বংশোদ্ভূত এবং হযরত আসকারীর ঔরসে জন্মগ্রহণ করে দুনিয়াকে সমস্ত প্রকার অন্যায় অত্যাচার থেকে মুক্ত করে ন্যায় ও আদর্শ প্রতিষ্ঠা করবেন। এই কারণেই ইমাম হাসান আসকারীকে তারা কড়া নজরে রাখে। যেমনভাবে তাঁর দাদা ও পিতাকে তাদের (আব্বাসীয়) খেলাফতের রাজধানী সামাররাতে নিয়ে এসে কড়া নজরে রেখেছিল। আব্বাসীয়রা চেষ্টা করেছিল যে ,ইমাম মাহ্দীর অস্তিত্ব লাভ ও বেড়ে ওঠার পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে ,কিন্তু মহান স্রষ্টার অবশ্যম্ভাবী ইচ্ছা ও অখণ্ডনীয় বিধি এটাই ছিল যে ,এই শিশু জন্ম গ্রহণ করবে এবং তাদের সমস্ত প্রকার অপচেষ্টাই অনর্থক হবে। আল্লাহ্ তা য়ালা তাঁর জন্মকে হযরত মূসার (আ.) মতই গোপন করে রাখলেন। শুধুমাত্র ইমাম হাসান আসকারীর (আ.) অতি নিকটের কিছু সাহাবা কয়েকবার ইমাম মাহ্দীকে (আ.) তাঁর পিতা জীবিত থাকা অবস্থায় দেখেছেন। ইমাম হাসান আসকারীর (আ.) ইন্তেকালের সময় তিনি প্রকাশ্যে আসেন এবং তাঁর পিতার জানাযার নামায পড়ান। সে সময় সাধারণ মানুষও তাকে দেখেছিল। নামায শেষে তিনি আবার অদৃশ্য হয়ে যান ।

জন্মের সময় থেকে শুরু করে তাঁর পিতার শাহাদতের সময় পর্যন্ত তাঁর নিকটতম আত্মীয়-স্বজন ও পিতার নিকটতম সাহাবাগণ তাকে দেখতে সমর্থ হয়েছিল বা তারা ইমাম হাসান আসকারী (আ.)-এর বাড়ীতে তাঁর অবস্থান সম্পর্কে জানতো। আসলে ইমামের পদ্ধতি এমন ছিল যে ,তাঁর সর্বসম্মানিত সন্তানকে লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখলেও সময় ও সুযোগ মতো প্রকৃত সাহাবাদেরকে চাক্ষুসভাবে তাঁকে দেখিয়ে ইমাম মাহ্দীর অস্তিত্ব লাভ সম্পর্কে জ্ঞাত করবেন এবং তারা অন্যান্য অনুসারীদের মধ্যে এ বিষয়টিকে পৌঁছে দেবে। ফলে তাঁর ইন্তেকালের পরে তারা পথভ্রষ্ট হবে না। উদাহরণ স্বরূপ কয়েকটি ঘটনা এখানে উল্লিখিত হলো :

1-আহমাদ বিন ইসহাক যিনি শিয়াদের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ও ইমাম হাসান আসকারী (আ.)-এর একজন প্রকৃত অনুসারী ছিলেন বলেন : ইমামের পরে কে তাঁর প্রতিনিধি তা জানার জন্য তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করতে গিয়েছিলাম। তাঁর কাছে কোন প্রশ্ন করার আগেই তিনি বললেন : হে আহমাদ! আল্লাহ্ রাব্বুল আ লামিন যখন আদমকে সৃষ্টি করেছিলেন তখন থেকে পৃথিবীকে তাঁর প্রতিনিধি বিহীন রাখেন নি এবং কিয়ামত পর্যন্ত প্রতিনিধি বিহীন রাখবেন না । পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধি থাকার কারণেই পৃথিবী থেকে বালা-মুছিবত দূর হয় ,বৃষ্টি আসে ,বরকত বৃদ্ধি পায়।

বললাম : হে আল্লাহর রাসূলের সন্তান! আপনার পরে ইমাম বা প্রতিনিধি কে ?তিনি দ্রুত বাড়ীর ভিতরে গেলেন এবং তিন বছর বয়সের একটি শিশু যাকে দেখতে চাঁদের মত দেখাচ্ছিল ঘাড়ে করে ফিরে এসে বললেন : হে আহমাদ বিন ইসহাক! যদি তুমি আল্লাহ্ ও তাঁর প্রেরিত পুরুষের কাছে অতি প্রিয় না হতে তাহলে কখনই আমি তোমাকে আমার ছেলেকে দেখাতাম না। তাঁর নাম ও ডাক নাম নবী (সা.)-এর নাম ও ডাক নামের অনুরূপ। সে এমনই এক ব্যক্তি যে ,এ পৃথিবীতে ন্যায় ও আদর্শের প্রতিষ্ঠা করবে ,তা যতই জুলুম ও অত্যাচারে ডুবে থাকুক না কেন। হে আহমাদ বিন ইসহাক! সে এই উম্মতের জন্য খিজির (আ.) ও যুলকারনাইনের মতই। আল্লাহর কসম সে অন্তর্ধানে থাকবে। তাঁর অন্তর্ধানে থাকা অবস্থায় ধ্বংস হওয়া থেকে কেউই রেহাই পাবে না। তারা ব্যতীত যাদেরকে আল্লাহ্ তাকে মেনে নেয়া ও এ পথে দৃঢ় থাকার তওফীক দিবেন এবং তাঁর আবির্ভাব ত্বরান্বিত হওয়ার ব্যাপারে দোয়া করবে।

বললাম : হে আমার নেতা! এমন কোন আলামত আছে যা দেখলে আমার অন্তরে তাঁর ব্যাপারে অধিকতর বিশ্বাস স্থাপিত হবে ?

এ সময় ঐ শিশু পরিশুদ্ধ আরবী ভাষায় আমাকে বলল :  হে আহমাদ বিন ইসহাক! জমিনের বুকে আমিই হচ্ছি বাকিয়াতুল্লাহ্ (আল্লাহর সঞ্চিত সম্পদ) যে আল্লাহর শত্রুদের কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করবে। সুতরাং এর চেয়ে  বেশী আলামত খোঁজা থেকে বিরত থাক ...।

মরহুম সাদুক বলেন এই রেওয়ায়েতটি আলী বিন আবদুল্লাহর হাতে লেখা অবস্থায় পেয়েছি। সে এই রেওয়ায়েতটি কোথা থেকে পেয়েছে জানতে চাইলে সাঈদ বিন আবদুল্লাহর কাছ থেকে আহমাদ বিন ইসহাকের উদ্ধৃতি দিয়ে আমার কাছে বর্ণনা করল। 55

2-আহমাদ বিন হাসান বিন ইসহাক বলেন : যখন পুত পবিত্র শিশু হযরত মাহ্দী জন্ম গ্রহণ করেছিলেন তখন আমার মাওলা আবু মুহাম্মদ হাসান আসকারীর (আ.) পক্ষ থেকে আমার দাদা আহমাদ বিন ইসহাকের নিকট একটি চিঠি এসেছিল। যার মধ্যে ইমাম নিজের হাতে লিখেছিলেন : আমাদের একটি সন্তান  জন্মগ্রহণ করেছে। তাঁর জন্মের বিষয়টি গোপন থাকার প্রয়োজন আছে। কাউকে এ বিষয়ে অবহিত করবে না। আমরা এই শিশুর জন্মকে কারো কাছে বলব না। শুধুমাত্র অতি নিকট ব্যক্তিবর্গ ,আত্মীয়-স্বজন ,বন্ধু-বান্ধব ছাড়া। তোমাকে ভালবাসি বলেই খবরটি তোমাকে দিয়েছি। যেন আল্লাহ্ তা য়ালা এর মাধ্যমে  তোমাকে আনন্দিত করেন যেমনভাবে আমাদেরকে আনন্দিত করেছেন। ওয়াস-সালাম। 56

3-ইমামের ফুফু হাকিমা খাতুন ,ইমামের খাদেম নাসিম ,শিষ্য আবু জা ফার মুহাম্মদ বিন উসমান আমরী ,হুসাইন বিন হাসান আলাবী ,আমর আল আহ্ওয়াযী ,খাদেম আবু নাসর ,কামেল বিন ইবরাহীম ,আলী বিন আ সেম কুফী ,আবদুল্লাহ্ বিন আব্বাস আলাবী ,ইসমাইল বিন আলী ,ইয়াকুব বিন ইউসুফ যাররাব ,57 ইসমাইল বিন মুসা বিন জা ফার ,আলী বিন মুতাহ্হার ,ইবরাহীম বিন ইদরিস ,তারিফ খাদেম ,58 আবু সাহল নৌবাখতি ,59 এ সকল ব্যক্তিত্বরা ইমাম মাহ্দীর জন্ম গ্রহণ সম্পর্কে জানতেন এবং এ সম্পর্কে খবর দিয়েছেন।

4-জা ফার বিন মুহাম্মদ বিন মালেক একদল শিয়ার পক্ষ থেকে বর্ণনা করে যে ,ইমাম আসকারী তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন : আমার পরবর্তী হুজ্জাতের কাছে প্রশ্ন করার জন্য তোমরা এসেছো।

তারা বলল : হ্যাঁ ,আমরা তাঁর কাছে প্রশ্ন করার জন্য এসেছি।

হঠাৎ চাঁদের মত দেখতে একটি শিশু সেখানে উপস্থিত হলো। তাঁকে দেখতে অনেকটা ইমামের মতই লাগছিল অর্থাৎ তাঁর চেহারা ও ইমামের চেহারাতে বেশ মিল ছিল। ইমাম বললেন : এই হচ্ছে আমার পরে আমার স্থলাভিষিক্ত বা তোমাদের ইমাম। তাঁর নির্দেশকে মেনে চলবে এবং তাঁর থেকে দূরে সরে যাবে না তাহলে ধ্বংস হয়ে যাবে। জেনে রাখ! তোমরা আজ তাকে দেখার পরে আর দেখবে না ,যতক্ষণ না তাঁর বয়স পরিপূর্ণ হবে। উসমান বিন সাঈদ যা কিছু বলবে তাই মেনে নিবে কেননা সে তোমাদের ইমামের প্রতিনিধি এবং কাজ-কর্ম যা কিছু আছে তা সবই তার দায়িত্বে। 60

5-ঈসা বিন মুহাম্মদ জৌহারী বলেন : আমরা কয়েকজন মিলে দল বেঁধে ইমাম মাহ্দীর জন্মের শুভেচ্ছা জানাতে ইমাম আসকারীর কাছে গিয়েছিলাম। আমাদের অন্যান্য ভায়েরা আগেই আমদেরকে খবর দিয়েছিল যে ,হযরত মাহ্দী শা বান মাসের 15 তারিখে শুক্রবার ভোরে জন্মগ্রহণ করেছেন। আমরা সেখানে পৌঁছে তাকে সালাম দেওয়ার আগেই তাকে শুভেচ্ছা জানালাম... আর কোন প্রশ্ন করার আগেই তিনি বললেন : তোমাদের মধ্যে এমন কেউ কি আছে যে তার অন্তরে আমার সন্তান মাহ্দী কোথায় এই প্রশ্নটি মনে পোষণ করে রেখেছে। আমি তাকে আল্লাহর কাছে আমানত রেখেছি যেমনভাবে মূসার মা মূসাকে যখন বাক্সে ভরে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিল তখন তাকে আল্লাহর কাছে আমানত রেখেছিল এই বলে যে ,তিনি যেন তাকে তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেন। 61

অন্তর্ধান সম্পর্কিত আলোচনা

ইসলামের মৌলিক উপাদানসমূহ ,রাজনৈতিক ,সামাজিক ,সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়াবলী এবং শিক্ষণীয় অন্যান্য বিষয়সমূহ নবী করিম (সা.)-এর নবুওয়াতের সময় থেকে শুরু করে যতদিন পর্যন্ত ইমামগণ (আ.) সমাজে উপস্থিত ছিলেন (সন 260 হিজরী পর্যন্ত) ব্যাখ্যাসহ বর্ণিত রয়েছে এবং গ্রন্থসমূহে লিপিবদ্ধ হয়েছে। যদিও এই সময়কালে অত্যাচারী ও বিরুদ্ধাচারণকারীরা শক্তভাবে কোমর বেঁধেছিল। কিন্তু পুত পবিত্র ইমামগণ সময় ও সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়কে ব্যাখ্যা দিয়ে মানুষের সামনে পরিস্কার করে দিয়েছেন । তাঁরা ইসলামের বিভিন্ন বিষয়কে এমন সুন্দর ও সাবলীল ভাষায় বর্ণনা করেছেন যে সমগ্র পৃথিবীকে একটি শাসনতন্ত্রের অধীনে এনে তাকে শাসন করার মত ক্ষমতা ও যোগ্যতা রাখে। এ ব্যাপারে কোন প্রকার সন্দেহের অবকাশ নেই। 62

এক দিক দিয়ে এই ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থার উত্তম নমুনা আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও আমিরুল মু মিনীন আলী (আ.) এর শাসনামল আমাদের (মানবজাতির) সামনে বাস্তব রূপ পেয়েছে। যাতে করে মানুষ তা থেকে শিক্ষা অর্জন করে এবং এই ধরনের শাসন ব্যবস্থার বিরোধী শাসন ব্যবস্থা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় । সুতরাং হযরত মাহ্দী (আ.)-এর সময় পর্যন্ত আল্লাহ্ রাব্বুল আ লামিনের পক্ষ থেকে পৃথিবীর একক শাসন ব্যবস্থা বাস্তবায়নের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণভাবে তৈরী ছিল। ইসলামের সকল আইন-কানুন সংকলিত ও ইসলামের ন্যায় ভিত্তিক শাসনের বাস্তব নমুনাও স্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু এর বিপরীতে পৃথিবীর মানুষের আল্লাহ্ প্রদত্ত শাসন ব্যবস্থাকে বাস্তবে রূপদান করার প্রস্তুতি বা যোগ্যতা ছিল না। যদি পৃথিবীর মানুষ এই ধরনের শাসন ক্ষমতাকে মেনে নিতে প্রস্তুত থাকতো ইমাম লোক চক্ষুর অন্তরালে না গিয়ে আল্লাহর আইন-কানুন বাস্তবায়নের জন্য কাজ করতেন এবং ইসলামের ন্যায়-নীতিকে সমগ্র পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করতেন। সুতরাং সম্ভাবনা আছে যে ,এই কারণেই তিনি লোক চক্ষুর অন্তরালে চলে গেছেন এবং ঠিক একই কারণে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী অন্তর্ধানের প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছে যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। আর তিনি সে সময়ই আবির্ভূত হবেন যখন পৃথিবীর অধিবাসীরা তাদের পূর্ববর্তীদের ন্যায় তাঁর শাসন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে না এবং সব দিক থেকে তাঁর শাসনকে মেনে নিতে প্রস্তুত থাকবে।

মরহুম খাজা নাসির উদ্দিন তুসি লিখেছেন : ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর অন্তর্ধানে যাওয়াটা আল্লাহর পক্ষ থেকে নয়এবং তাঁর নিজের পক্ষ থেকেও নয়। অতএব ,এটা মানুষের কারণে হয়েছে। ভয়কে পরাভূত ও ইমামের আনুগত্যের দিকে ধাবিত না হওয়াই হচ্ছে প্রধান কারণ। যখন এই কারণসমূহের অবসান ঘটবে তখনই তিনি আবির্ভূত হবেন। 63

অবশ্য অন্তর্ধানের বিষয়টি আল্লাহর প্রজ্ঞা ও ইচ্ছায় হয়েছে এবং আমরা ঐ রহস্যময় বিষয়ে অবগত নই। কিন্তু সম্ভাবনা আছে অন্তর্ধানে যাওয়ার পিছনে যে মৌলিক বিষয়টি সক্রিয় তা হয়তো এটাই হবে। একাদশ ইমামের সময়কাল পর্যন্ত বিভিন্ন ইমামের ইমামতের স্বীকৃতি না দেয়া ,তাদের নির্দেশ পালন না করে বরং বিরুদ্ধাচারণে ব্রত হওয়া এবং তাঁদের প্রতি মুসলিম সমাজের পৃষ্ঠপ্রদর্শনের তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছিল। তাই ইমাম উপস্থিত থাকার অকার্যকারিতার বিষয়টিও আমাদের সামনে পরিষ্কার হয়ে গেছে। আর এ বিষয়ের প্রতি কোন সন্দেহের অবকাশ রাখে না যে মানুষ ইসলামের ন্যায় ও আদর্শ ভিত্তিক শাসনের অধীনে যেতে চায় না। এরূপ পরিস্থিতিতে ইমামের অন্তর্ধানে থাকা একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। আর এই সমাজে তাঁর আবির্ভাব ও উপস্থিতিটা প্রশ্নের সৃষ্টি করে। বরং প্রশ্ন করতে হয় ইমাম কেন এ সমাজে উপস্থিত থাকবেন ?তিনি অদৃশ্যে থেকে তার দায়িত্বকে গোপনেই পালন করে যাবেন। যতক্ষণ পর্যন্ত না তার আবির্ভাবের প্রেক্ষাপট তৈরী হয়। প্রেক্ষাপট তৈরী হলেই তিনি আবির্ভূত হবেন এবং অপেক্ষাকারীদেরকে তাঁর দর্শন ও অলৌকিক সাহায্য দিয়ে সফল করবেন।

اِنَّ اللَّهَ لاَ يُغَيِّرُ ما بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُوا ما بِاَنْفُسِهِمْ

অবশ্যই আল্লাহ্ কোন জাতির কিছুই (ভাগ্যের) পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নিজেরা তার পরিবর্তন ঘটায় ।

এই রহস্যটি আবির্ভাবের সময় পর্যন্ত গোপন থাকবে এবং ঐ সময় পৃথিবীর মানুষ বুঝতে পারবে যে তাদের নিজেদের মধ্যেই তার অন্তর্ধানে থাকার আসল কারণটি লুকিয়ে ছিল। যা থেকে তারা ছিল উদাসীন। আর যদি তারা নিজেদেরকে তৈরী করত তাহলে ইমাম তাদের মাঝে আবির্ভূত হতেন। কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ে তারা তাদের পরিশুদ্ধ ও তৈরীর কাজে এগিয়ে না এসে বিভিন্ন অত্যাচারী ও বিচ্যুত শাসকদের নিকট আত্মসমর্পণ করেছিল এই ভেবে যে ,এই অত্যাচারী ও বিচ্যুত শাসকরা হয়তো তাদের দুঃখ কষ্টকে লাঘব করতে পারবে অথবা বাহ্যিক তথাকথিত নামী দামী সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে পারবে।

অবশ্য মানুষই ইমামের অন্তর্ধানে যাওয়ার জন্য দায়ী। এটা বলার অর্থ এই নয় যে ,তারা সবাই এত বড় পাপে লিপ্ত হয়েছে। বরং উদ্দেশ্য এটাই যে ,একটি নির্দিষ্ট পরিমান ভাল মানুষের প্রয়োজন আছে তাঁর আবির্ভাবের জন্য। বলার অবকাশ রাখে না যে ,কিছু সংখ্যক উপযুক্ত ব্যক্তি সব সময়ই তাঁর আবির্ভাবের জন্য তৈরী ছিলেন বা আজও আছেন। কিন্তু সমাজের অধিকাংশ লোক এই ধরনের প্রস্তুতি রাখে না। আর যে সমাজ এই ধরনের যোগ্যতা রাখে না অবশ্যই ঐ সমাজের সাথে তাঁর প্রশাসনের সমস্যা দেখা দেবে। সুতরাং এ কারণেই তাঁর অন্তর্ধানে থাকাটা অব্যাহত থাকবে। অন্য দিকে আল্লাহ্ রাব্বুল আ লামিন অন্তর্ধানের মাধ্যমে ইমাম মাহদী (আ.)-কে নিহত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেছেন। কেননা যদি তিনি উপযুক্ত সময়ের আগেই আবির্ভূত হন তবে অবশ্যই তাঁকে শত্রুরা হত্যা করবে এবং আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব পালন থেকে তিনি অপারগ হবেন। আর পৃথিবীতে তাঁর আবির্ভাবের উদ্দেশ্য পরিপূর্ণ হবে না।

মরহুম কুলাইনি তার কফি নামক গ্রন্থে ও শেখ তুসি তার গেইবাত নামক গ্রন্থে যুরারাহর উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছেন যে ,তিনি বলেছেন : ইমাম সাদিক (আ.)-এর সমীপে উপস্থিত হয়েছিলাম ও তাঁর কাছ থেকে শুনেছি যে ,তিনি বলেছেন : কায়েম (ইমাম মাহ্দী) কিয়াম করার আগে অন্তর্ধানে থাকবেন।

বললাম : কেন ?

ইমাম সাদিক (আ.) তাঁর পেটের দিকে ইশারা করলেন । এটা বোঝালেন যে ,নিহত হওয়ার ভয়ে। 64

ইমাম মাহ্দী (আ.) কোন অত্যাচারী শাসক বা সরকারকে এমনকি বাহ্যিকভাবেও ( তাকিয়ার { বাধ্য হয়ে কল্যাণকর কোন উদ্দেশ্যে স্বীয় বিশ্বাস গোপন করা } কারণে অন্যান্য ইমামদের যেমনটি করতে হয়েছে ) বৈধ বলে স্বীকৃতি দেন নি এবং দেবেন না এবং তিনি কোন সরকার বা বাদশাহর থেকে তাঁর বিশ্বাসকে গোপন করে চলছেন না। আর কোন অত্যাচারী সরকার বা বাদশাহর অধীনেও থাকেন নি এবং থাকবেন না। যখন আবির্ভূত হবেন তখন কারো হাতে বাইয়াত করবেন না (অর্থাৎ তিনি কারো আদেশ বা নির্দেশে চলবেন না)।

يَقُومُ الْقاَئِمُ وَ لَيْسَ لِاَحَدٍ فِى عُنُقِه عَهْدٌ وَ لاَ عَقْدٌ وَ لاَ بَيْعَةٌ 65

কেননা অবশ্যই সত্যের অনুবর্তী হয়ে কাজ করবেন এবং আল্লাহর দীনকে পরিপূর্ণভাবে (কোন প্রকার গোপনীয়তা ,ভয়-ভীতি বা অন্য কিছুর দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে) বাস্তবায়ন ও সমাজে প্রতিষ্ঠা করবেন। অতএব কারো সাথে কোন প্রকার চুক্তি বা সন্ধির প্রয়োজন নেই বা কারো সাথে আলোচনা বা কাউকে সমীহ্ করে চলারও প্রয়োজন হবে না।

তিনি এমন অবস্থায় আবির্ভূত হবেন যে ,অতীতের ঘটে যাওয়া প্রতিটি বিষয়ের প্রতি স্বচ্ছ ও স্পষ্ট ধারণা রাখবেন এবং কারো সাথে কোন প্রকার প্রতিশ্রুতিতে বা অঙ্গিকারে আবদ্ধ হবেন না। আর আবির্ভূত হয়ে সমস্ত তাগুতী শাসন ব্যবস্থাগুলোকে নিশ্চিহ্ন করবেন এবং সমগ্র পৃথিবীতে ইসলামের আইন-কানুন প্রতিষ্ঠা ও তার ভিত্তিতে শাসন পরিচালনা করবেন।

স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী অন্তর্ধান

একাদশ ইমামের শাহাদতের পর 260 হিজরী থেকে 329 হিজরী অর্থাৎ প্রায় 69 বছর হচ্ছে স্বল্পমেয়াদী অন্তর্ধান। 66 আর এর পর থেকেই এখনও পর্যন্ত এবং ইমাম মাহ্দী (আ.) আবির্ভাব করা পর্যন্ত সময়কালটিই হচ্ছে দীর্ঘ মেয়াদী অন্তর্ধান।

স্বল্পমেয়াদী অন্তর্ধানকালে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সাথে মানুষের যোগাযোগ একেবারে বিচ্ছিন্ন ছিল না কিন্তু তা সীমিত পর্যায়ে ছিল। শিয়া মাযহাবের প্রত্যেকেই তাঁর বিশেষ প্রতিনিধির (যারা শিয়াদের মধ্য থেকে বিশেষভাবে মনোনীত ছিল) মাধ্যমে নিজেদের সমস্যা বা বিভিন্ন প্রশ্ন ইমামের সমীপে পৌঁছাতো এবং তাদের মাধ্যমেই ঐ প্রশ্নসমূহের উত্তর গ্রহণ করত। কখনও তারা স্বয়ং ইমামের সামনে উপস্থিত হতো। এই সময়টিকে দীর্ঘমেয়াদী অন্তর্ধানে পদার্পনের জন্য প্রস্তুতি পর্ব হিসাবে ধরা যেতে পারে। এভাবে কিছু দিন চলার পর তাঁর সাথে মানুষের ঐ ধরনের সম্পর্কের পরিসমাপ্তি ঘটে। তারপর থেকে মানুষ তাদের বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাপারে নির্দেশিত হলো ইমামের সাধারণ প্রতিনিধি অর্থাৎ ফকীহ্ বা যারা দীন ও দুনিয়ার বিষয়ে জ্ঞাত ,তাদেরকে অনুসরণ করে চলতে।

যদি হঠাৎ করেই বা প্রথম থেকেই দীর্ঘকালীন অন্তর্ধানের অবতারণা হতো তাহলে চিন্তা-চেতনায় বিভ্রান্তি দেখা দিত ,তাছাড়া তাদের এরূপ প্রস্তুতি ও ছিল না। কিন্তু স্বল্পকালীন অন্তর্ধানের মাধ্যমে মানসিকভাবে জনসাধারণকে প্রস্তুত করে তবেই পূর্ণ অন্তর্ধান শুরু হয়েছে অর্থাৎ মানুষের সাথে একেবারে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন না করে তাদেরকে দীর্ঘকালীন অন্তর্ধানের জন্য প্রস্তুত করে তিনি সম্পূর্ণভাবে লোক চক্ষুর অন্তরালে চলে যান। আর ইমামের স্বল্পমেয়াদী অন্তর্ধানে থেকে তাঁর বিশেষ প্রতিনিধিদের মাধ্যমে মানুষের সাথে সম্পর্ক রাখা এবং অনুসারীদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁর সান্নিধ্যে পৌঁছানটা তাঁর জন্ম গ্রহণ ও জীবিত থাকাকেই প্রমাণ করে । যদি দীর্ঘমেয়াদী অন্তর্ধান এ ধরনের কোন প্রকার ভূমিকা ছাড়াই শুরু হতো তাহলে হয়তোবা এই বিষয়টি আমাদের কাছে এমনভাবে পরিস্কার হতো না এবং হয়তো কারো কারো জন্যে এ বিষয়টি বিভ্রান্তির সৃষ্টি করত বা বিরাট প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াতো। আল্লাহ্ রাব্বুল আ লামিন তাঁর ক্ষমতা দিয়ে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর অন্তর্ধানের বিষয়টিকে দুইটি পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন যেমনটি পূর্ব থেকে নবী (সা.) ও ইমামগণ (আ.) খবর দিয়েছিলেন। অল্প সময়ের জন্য অন্তর্ধানে থাকাটা হচ্ছে দীর্ঘকালীন অন্তর্ধানের জন্য প্রস্তুতি পর্ব (যাকে আমরা স্বল্প বলে আখ্যায়িত করেছি)। তারপর দীর্ঘ বা পূর্ণ অন্তর্ধান শুরু হয়েছে (যাকে আমরা দীর্ঘকালীন অন্তর্ধান বলে আখ্যায়িত করেছি) যাতে করে আহলে বাইতের অনুসারীরা তাদের ঈমানের প্রতি দৃঢ় ও অটল থাকে এবং তারা যেন তাদের ইমামের প্রতি নিজেদের অন্তরের বিশ্বাসকে হারিয়ে না ফেলে। তাঁর অপেক্ষায় থেকে আল্লাহর দেয়া স্বস্তি অনুভব করে এবং আল্লাহর দীনকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করে নিজেদের আত্মশুদ্ধির পথকে সুদৃঢ় করে। আর এর সাথে সাথে দীনের প্রতি তাদের যে দায়িত্ব-কর্তব্য আছে তাও যেন প্রকৃতভাবে সম্পন্ন করে ,ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ পর্যন্ত না ইমামের আবির্ভাবের ব্যাপারে আল্লাহ্ রাব্বুল আ লামিন নির্দেশ দেন।