ইমাম মাহদী (আ.)

ইমাম মাহদী (আ.)20%

ইমাম মাহদী (আ.) লেখক:
: মীর আশরাফুল আলম
প্রকাশক: -
বিভাগ: ইমাম মাহদী (আ.)

ইমাম মাহদী (আ.)
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 28 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 13937 / ডাউনলোড: 4371
সাইজ সাইজ সাইজ
ইমাম মাহদী (আ.)

ইমাম মাহদী (আ.)

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

স্বল্পকালীন অন্তর্ধানের সময়ে ইমামের অলৌকিকত্ব

স্বল্পকালীন অন্তর্ধানের সময়ে ইমাম যে সকল অলৌকিকত্ব দেখিয়েছেন তা তাঁর দূরের ও কাছের অনুসারীদের ঈমানের দৃঢ়তা ও পরিপক্কতা দানে বিশেষ ভূমিকা রাখে। অলৌকিক ঘটনাগুলো সেই সব অনুসারীদের জন্যেই বেশী ঘটতো যারা সামাররা ও বাগদাদ শহরে দূরদূরান্ত থেকে আসতো এবং ইমামের বিশেষ প্রতিনিধিদের মাধ্যমে তাঁর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতো এবং তাঁর অলৌকিক ক্ষমতাকে স্বচক্ষে অবলোকন করতো।

এই সময়কালে ইমামের অলৌকিক ঘটনার পরিমান এতই বেশী ,যা বর্ণনা করতে আলাদাভাবে বই লেখার প্রয়োজন পড়বে। মরহুম শেখ তুসি (রহঃ) বলেন : ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর স্বল্পকালীন অন্তর্ধানের সময় তাঁর মাধ্যমে এত অধিক পরিমান অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে যা গণনাতীত। ১২১

আমরা এখানে নমুনা স্বরূপ কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করলাম মাত্র :

১ - ঈসা বিন নাসর বলেন : আলী বিন ছিমারী ইমামের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লেখে। তাতে সে তাঁর কাছে একটি কাফনের কাপড়ের আবেদন জানায়। চিঠির উত্তর এভাবে আসে যে ,তোমার ৮০ বছর বয়সে (২৮০ হিজরীতে) এই কাপড়ের প্রয়োজন পড়বে। ইমামের বাণী অনুযায়ী সে ৮০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করে এবং তার ইন্তেকালের পূর্বেই ইমাম তার আবেদন অনুযায়ী তার জন্য কাফনের কাপড় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ১২২

২ - আলী বিন মুহাম্মদ বলেন : ইমামের অনুসারীদের প্রতি তার নিকট থেকে নির্দেশ এসেছিল যে ,তারা যেন ইমামগণের মাজার (কারবালা ও কাযেমাইন) যিয়ারত করতে না যায়। কয়েক মাস যেতে না যেতেই খলিফা তার উজির বাকতানীকে ডেকে বলল : বনি ফুরাত (একটি গোত্র ,এই উজিরও সেই গোত্রের ছিল) ও বুরেস (কুফা ও হিল্লির মধ্যবর্তী স্থান) এলাকার লোকদের সাথে দেখা করে তাদেরকে কাযেমাইনে ইমামগণের মাজার জিয়ারত করতে যেতে নিষেধ কর। আর ইতোমধ্যে খলিফা নির্দেশ দিল যারা ইমামগণের মাজার যিয়ারত করতে যাবে তাদেরকে বন্দী করার জন্য। ১২৩

৩ - ইমামের দ্বিতীয় প্রতিনিধি আবু জা ফর মুহাম্মদ বিন উসমানের নাতী বলেন , নওবাখতী বংশের কিছু লোক যাদের মধ্যে আবুল হাসান বিন কাসির নওবাখতী (রহঃ) এবং আবু জা ফর মুহাম্মদ বিন উসমানের কন্যা উম্মে কুলছুমও রয়েছেন আমাকে বলেছেন : কোম ও তার আশে পাশের এলাকা থেকে খুমস ,জাকাতের অর্থসামগ্রী আবু জা ফরের কাছে পাঠানো হয়েছিল ইমামের কাছে পৌঁছানোর জন্য। অর্থসামগ্রী নিয়ে এক ব্যক্তি বাগদাদে আমার পিতার বাড়ীতে তা পৌঁছে দিল। সে চলে যাওয়ার সময় আবু জা ফর তাকে বললো : যা কিছু তোমাকে আমার কাছে  পৌঁছানোর জন্য দেয়া হয়েছিল তার কিছু অংশ বাকী রয়েছে ,সেগুলো কোথায় ?

সে বলল : হে আমার অভিভাবক ,কোন কিছুই আমার কাছে বাকী নাই ,সব কিছুই আপনার কাছে পৌঁছে দিয়েছি।

তিনি বললেন : কিছু পরিমান বাকী আছে ,নিজের ঘরে ফিরে যাও দেখ কোন কিছু ফেলে এসেছো কি না ,আর যা কিছু তোমাকে দিয়েছিল তা স্মরণে আনার চেষ্টা কর।

সে চলে গেল এবং কয়েক দিন ধরে চিন্তা-ভাবনা ও খোঁজাখুজির পর কিছুই পেল না। আর তার সাথে যারা খোঁজাখুজির কাজে সাহায্য করছিল তারাও কিছু পেল না। সে পুনরায় আবু জা ফরের কাছে ফিরে এসে বলল : কিছুই আমার কাছে অবশিষ্ট নেই যা কিছু দিয়েছিল তা আপনার কাছে পৌঁছে দিয়েছি।

আবু জা ফর বলল (ইমামের পক্ষ থেকে) তোমাকে বলা হচ্ছে অমুক যে দু টি আলখেল্লা (মরক্কোর নিকটবর্তী বড় দ্বীপের অধিবাসীদের তৈরী বিশেষ পোশাক) তোমাকে দিয়েছিল তা কোথায় ?

সে বলল : হ্যাঁ ,আপনি সত্য বলছেন। আমি সেগুলোকে ভুলেই গিয়েছিলাম। ঐ আলখেল্লা দু টির কথা আমার একেবারেই মনে ছিল না। কিন্তু এখন এও জানি না যে সেগুলো কোথায় রেখেছি।

সে আবার ফিরে গেল এবং তার জিনিসপত্রের মধ্যে খোঁজাখুজি শুরু করে দিল। যারা তার কাছে মাল বহন করে এনেছিল তাদেরকেও খুঁজে দেখার জন্য অনুরোধ জানালো। কিন্তু পোশাক দু টি খুঁজে পাওয়া গেল না।

আবার আবু জা ফরের কাছে ফিরে এলো এবং পোশাক দু টি হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি বর্ণনা করলো । আবু জা ফর বলল : তোমাকে এটা বলতে বলা হয়েছে যে তুমি অমুক তুলা বিক্রেতার কাছে যাও। যার জন্য তুমি দুই গাঁট তুলা নিয়ে গিয়েছিলে এবং ঐ দুই গাঁটের মধ্যে যেটির উপরে এই এই বিষয়গুলো লেখা আছে সেই গাঁটটা খুলে তার মধ্যে খুঁজবে। তার মধ্যে ঐ পোশাক দুটিকে পাবে।

লোকটি আবু জাফরের এই কথা শুনে আশ্চর্য ও হতভম্ব হয়ে গেল। তারপর সে তার কথা মত সেখানে গেল এবং নির্দেশ মত তুলার গাঁটটিতে খুঁজলো ও তার মধ্যে পোশাক দু টিকে পেল। পোশাক দু টিকে নিয়ে এসে আবু জা ফরের কাছে পৌঁছে দিয়ে বলল : আমি ঐ পোশাক দু টির ব্যাপারে ভুলে গিয়েছিলাম। যখন মালামাল আপনার কাছে আনার জন্য বস্তায় বেঁধে ফেলেছিলাম এই দু টি পোশাক অতিরিক্ত থেকে গিয়েছিল। আমি ঐ দু টি পোশাক একটি তুলার গাঁটের মধ্যে রেখে দিয়েছিলাম যাতে করে সংরক্ষিত বা নিরাপদে থাকে।

লোকটি বিশেষ করে এই বিষয়টার ব্যাপারে অবাক হয়েছিল। যা সে আবু জা ফরের কাছ থেকে শুনেছিল যা দেখেছিল।

কেননা নবিগণ ও ইমামগণই কেবল আল্লাহ্ রাব্বুল আ লামিনের নিকট থেকে এ ধরনের বিষয়ে অবগত হন অন্য কেউ নয়। এ বিষয়টি সে সবাইকে বলতে লাগলো। সে আবু জা ফরের ব্যাপারে কোন প্রকার ধারণাই রাখতো না। তার মাধ্যমে শুধুমাত্র অর্থ ও বিভিন্ন সামগ্রী পাঠানো হতো । যেমনিভাবে ব্যবসায়ীরা তাদের মালামালকে দোকানদের উদ্দেশ্যে কোন ভাল লোকের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিত। তার কাছে ঐ মালামালের কোন ভাউচার বা তার সাথে আবু জা ফরের নামে কোন চিঠিও ছিল না। কেননা আব্বাসীয় খলিফা মো তাজেদের শাসনামলে পরিস্থিতি খুব বিপদজনক ছিল। তার তলোয়ার থেকে সবসময় রক্ত ঝরতো। ইমামের সংশ্লিষ্ট বিষয় শুধুমাত্র তাঁর বিশেষ প্রতিনিধিদের অবগতিতে থাকতো। আর যারা অর্থ ও মালামাল নিয়ে আসতো তারা এসবের কোন কিছুর ব্যাপারেই খবর রাখতো না। শুধুমাত্র তাদেরকে বলা হতো এই অর্থ ও মালামাল এমন জায়গায় এমন লোকের কাছে পৌঁছে দেবে। মালামাল গ্রহণকারীর ব্যাপারে কোন প্রকার আনুষঙ্গিক খবরা খবর ব্যতিরেকেই ও তার নামে কোন প্রকার চিঠি ছাড়াই পাঠানো হতো। এ কারণে যে যদি কেউ কোন দিন বা কখনও এই মালামাল ও অর্থ এবং প্রেরণকারী ও গ্রহণকারীর ব্যাপারে জেনে ফেলে এই ভয়েই এই বিষয়গুলো গোপন থাকতো। ১২৪

৪ - মুহাম্মদ বিন ইবরাহীম বিন মেহযিয়ার আহওয়াযী বলেন : ইমাম আবু মুহাম্মদ আসকারী (আ.)-এর শাহাদতের পর ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর অস্তিত্বের ব্যাপারটিতে আমি সন্দিহান হয়ে পড়লাম। ঠিক এমনই পরিস্থিতিতে প্রচুর পরিমানে অর্থ ও মালামাল যা ইমামের সম্পদ আমার বাবার কাছে এসে পৌঁছেছিল এবং আমার বাবা সেগুলোকে সযত্নে দেখাশুনা করছিল ইমামের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য। সেগুলোকে একটি বড় নৌকায় তুলে রওনা হওয়ার সময় হঠাৎ বাবার বুকে ব্যথা শুরু হল। যেহেতু আমি তাকে বিদায় জানাতে এসেছিলাম তাই তিনি আমাকে বললেন : আমাকে বাড়ী ফিরিয়ে নিয়ে চলো। আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে চলো কেননা আমার মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে। এই মালামালের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর এবং সেগুলোকে আমার হাতে দিয়ে ইমামের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য বলে ইন্তেকাল করলেন।

আমি মনে মনে বললাম : আমার পিতা এমন লোক ছিলেন না যিনি কোন ভুল বিষয়ে আমাকে দায়িত্ব দিয়ে যাবেন। অতএব ,এই মালামালগুলিকে ইরাকে নিয়ে যাব এবং নদীর ঘাটে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে এগুলিকে তার মধ্যে রেখে দিব বা কাউকে এ ব্যাপারে কিছু বলবো না। যদি এমন কিছু যা ইমাম আসকারী (আ.)-এর জামানায় ঘটেছিল তা আমার সামনে ঘটে তবেই এই জিনিসগুলিকে প্রেরণ করবো অন্যথায় পুরোটাই ছদকা দিয়ে দেব।

ইরাকে গিলাম এবং নদীর ঘাটে একটি ঘর ভাড়া নিলাম। কয়েক দিন সেখানে থাকার পর একজন পত্র বাহক আমার কাছে আসলো এবং আমাকে একটি চিঠি দিল যার মধ্যে এমন লেখা ছিল : হে মুহাম্মদ! তোমার সাথে যে থলেগুলো আছে সেগুলোর মধ্যে এই এই জিনিসগুলো আছে। আমার সাথে যে মালামালগুলো ছিল সেগুলোর সম্বন্ধে আমি এত কিছু জানতাম না যা সেই চিঠিতে সবগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দেয়া ছিল।

সমস্ত সম্পদগুলো পত্র বাহকের কাছে হস্তান্তর করলাম। আর আমি আরও কয়েকদিন সেখানে থাকলাম। কিন্তু কেউ আমার খোঁজ খবর নিতে আসলো না। আমি খুব দুঃখিত হলাম। এমতাবস্থায় আমার কাছে অন্য আরেকটি চিঠি পৌঁছালো যাতে এমন লেখা ছিল : তোমাকে তোমার বাবার স্থলাভিষিক্ত করেছি। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় কর। ১২৫

৫ - হাসান বিন ফাযল ইয়ামানী বলেন : আমি সামাররাতে আসার পর ইমাম (আ.) এর পক্ষ থেকে একটি ব্যাগ যার মধ্যে কয়েকটি দিনার ছিল এবং দু টুকরো কাপড় আমার কাছে পৌঁছালো। আমি সেগুলোকে ফেরত পাঠালাম এবং মনে মনে বললাম : আমার শান ও মর্যাদা তাদের কাছে এতটুকুই! অহংকার আমাকে ঘিরে ধরলো। পরে অনুতপ্ত হয়ে ছিলাম। অবশেষে চিঠি লিখে ক্ষমা  চেয়েছিলাম এবং ইসতেগফার করলাম এবং নির্জনে আল্লাহকে বললাম ,হে আল্লাহ্! তোমার পবিত্র নামের প্রতি কসম খেয়ে বলছি যে ,যদি দিনার ভর্তি কয়েকটি ব্যাগও আমার কাছে পাঠায় ,আমি সেগুলোকে খুলেও দেখবো না এবং তার থেকে কোন কিছু খরচও করবো না ,যতক্ষণ না আমার বাবার কাছে যাবো। কেননা সে আমার থেকেও অধিক জ্ঞানী।

ইমামের পক্ষ থেকে সেই বাহকের প্রতি (যে আমার কাছে দিনারের ব্যাগটি ও দু টুকরো কাপড় নিয়ে এসেছিল) পত্র এল যার বিষয়বস্তু এমন : তুমি কাজটি ভাল করনি। তাকে বল নি যে আমরা কখনও কখনও আমাদের বন্ধু ও অনুসারীদের সাথে এমনই করে থাকি আবার কখনও কখনও তাদেরকে আমরা এমন কিছু দিয়ে থাকি । এজন্য যে সেগুলো থেকে যেন তারা বরকত নিতে পারে। আর আমার প্রতি বলা হলো : তুমি ভুল করেছো আমাদের উপহার ও ভালবাসাকে গ্রহণ না করে। যেহেতু আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছো আল্লাহ্ তোমাকে যেন ক্ষমা করে দেন এবং যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েছো যে দিনারগুলোর উপর হস্তক্ষেপ করবে না বা সেগুলোকে খরচ করবে না ,সুতরাং সেগুলোকে তোমাকে আর দিলাম না । কিন্তু দু টুকরা কাপড়ের প্রয়োজন তোমার আছে। ঐ দু টুকরো কাপড় দিয়ে তুমি মোহরেম হবে (ঐ কাপড়কে তুমি তোমার এহরামের কাপড় হিসাবে ব্যবহার করবে) ...। ১২৬

৬ - মুহাম্মদ বিন সুরী কোমী ( রহঃ ) বলেন : আলী বিন হুসাইন ববাভেই তার চাচাতো বোনকে (মুহাম্মদ বিন মুসা ববাভেইর কন্যা) বিবাহ করেন। কিন্তু তাদের কোন সন্তান হতো না। ইমামের তৃতীয় প্রতিনিধি জনাব হুসাইন বিন রূহ নওবাখতীর উদ্দেশ্যে এই মর্মে চিঠি লিখে যে ,তিনি যেন তাঁর পক্ষ হয়ে ইমামের কাছে আবেদন জানায় তারা যেন উত্তম জ্ঞানী সন্তান লাভে সমর্থ হয়।

ইমামের পক্ষ থেকে ঐ চিঠির উত্তর আসে এভাবে : তুমি তোমার বর্তমান স্ত্রীর দ্বারা সন্তানলাভে সমর্থ হবে না। তবে অতিসত্ত্বর তুমি উন্নত চরিত্রবতী একটি দাসীর মালিক হবে। আর তার মাধ্যমে দুই জ্ঞানী পুত্র সন্তানের অধিকারী হবে।

ইবনে ববাভেই তিনটি ছেলে সন্তানের জনক হন মুহাম্মদ ১২৭ ,হুসাইন ও হাসান। মুহাম্মদ ও হুসাইন দু জন প্রখর স্মৃতিশক্তি সম্পন্ন ফকীহ্ ছিলেন এবং এমন সব বিষয়ে তারা পারদর্শী ছিলেন যা কোম শহরের কেউ জানতেন না। তাদের ভাই হাসান সবসময় ইবাদতে লিপ্ত থাকতো ও একরূপ দুনিয়া নিরাসক্ত ছিল তাই জনগণের সাথেও কোন প্রকার যোগাযোগ ছিল না এবং ফিকাহ্ শাস্ত্র থেকে উপকৃত হওয়া থেকেও বঞ্চিত ছিল।

জনগণ আবু জা ফর (মুহাম্মদ) ও আবু আবদুল্লাহ্ (হুসাইন) আলী বিন হুসাইন ববাভেইর দুই সন্তান এর প্রখর স্মৃতি শক্তি দেখে ও তাদের হাদীস ও রেওয়ায়েতের উপর জ্ঞান দেখে আশ্চর্য হয়ে বলতে লাগলো যে এই প্রখরতা ও তীক্ষ্ণতা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর দোয়ার কারণে হয়েছে। এ বিষয়টি কোমের জনগণের মধ্যে বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ আছে। ১২৮

সুন্নি মাযহাবের হাদীস থেকে

1-রাসূলে আকরাম (সা.) হযরত মাহ্দী (আ.)-এর অবশ্যম্ভাবী আবির্ভাবের ব্যাপারে বলেছেন : যদি দুনিয়ার বয়স শেষ হতে আর মাত্র একদিন বাকী থাকে ,আল্লাহ্ আমার বংশের থেকে একজনকে পাঠাবেন এই দুনিয়াতে সুবিচার ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করার জন্যে ,যতই অন্যায় ও অত্যাচার দুনিয়াকে গ্রাস করে  ফেলুক। 30

2-নবী (সা.) বলেছেন : ততদিন পর্যন্ত কিয়ামত আসবে না যতদিন পর্যন্ত না আমার আহলে বাইতের মধ্য থেকে একজন এই দুনিয়ার নেতৃত্ব গ্রহণ করবে ,যার নাম আমার নামের অনুরূপ হবে। 31

3-মহানবী (সা.) বলেছেন : যেমন আলী আমার পরে উম্মতের ইমাম এবং প্রতীক্ষিত মাহদী (তাঁর সন্তানদের মধ্যে থেকে) যখন আবির্ভূত হবে জমিনকে ন্যায় ও সুবিচারে পূর্ণ করবে পৃথিবী তখন যতই জুলুম ও অত্যাচারে ভরে থাকুক না  কেন। তাঁর কসম যিনি আমাকে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে পাঠিয়েছেন। সন্দেহাতীতভাবে যারা তাঁর অন্তর্ধানে থাকা অবস্থায়ও তাঁর উপর দৃঢ় ঈমান রাখবে তাদের সংখ্যা বিরল পরশমনির থেকেও কম হবে।

জাবির ইবনে আবদুল্লাহ উঁঠে দাঁড়িয়ে বললেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ্ ,আপনার সন্তান মাহ্দী কি অন্তর্ধানে থাকবেন ?

বললেন : হ্যাঁ। আমার আল্লাহর কসম। মুমিনরা পরীক্ষিত ও পরিশুদ্ধ হবে আর কাফেররা ধ্বংস হয়ে যাবে। হে জাবির! এই নির্দেশ আল্লাহরই একটি নির্দেশ। এই রহস্যপূর্ণ বিষয়টি তাঁর গুপ্ত বিষয়াবলীর মধ্যে একটি যা তাঁর বান্দাদের কাছে তিনি গোপন রেখেছেন ,এটার ব্যাপারে সন্দেহ করা থেকে দূরে থাক কেননা আল্লাহর নির্দেশের ব্যাপারে সন্দেহ করা কুফরী কাজ। 32

4-উম্মুল মু মিনীন উম্মে সালামা বলেন : রাসূলুল্লাহ্ প্রতিশ্রুত মাহ্দীর কথা স্মরণ করে বলেছিলেন : হ্যাঁ। সে সত্য এবং সে ফাতিমার বংশধর থেকে আসবে। 33

5-হযরত সালমান ফারসী বলেন : একদিন নবী (সা.)-এর নিকট গিয়ে দেখলাম ,হুসাইন বিন আলীকে নিজের উরুর উপর বসিয়ে তার চোখগুলোতে ও ঠোঁটে চুম্বন করছেন আর বলছেন : তুমি নেতা ,নেতার সন্তান ও নেতার ভাই ,তুমি ইমাম ,ইমামের সন্তান ও ইমামের ভাই ,তুমি আল্লাহর হুজ্জাত (স্পষ্ট ও প্রামাণ্য দলিল) ,আল্লাহর হুজ্জাতের সন্তান ও তাঁর হুজ্জাতের ভাই ,তুমি আল্লাহর নয়জন প্রামাণ্য দলিলের পিতা তাদের মধ্যে নবম ব্যক্তি হচ্ছে প্রতীক্ষিত মাহ্দী। 34

6-ইমাম রেযা (আ.) বলেছেন : হাসান বিন আলী আসকারীর স্থলাভিষিক্ত উপযুক্ত সন্তানই সাহেবুজ্জামান (সময়ের অধিপতি) আর সেই হচ্ছে মাহ্দী মওউদ (প্রতীক্ষিত মাহ্দী)। 35

7-মুহাম্মদ মুস্তাফা (সা.) বলেছেন : তোমাদেরকে মাহ্দীর সুসংবাদ দিচ্ছি ,সে আমার উম্মতের মধ্য থেকেই অভিষিক্ত হবে। যখন আমার উম্মত মতপার্থক্যের ও পদস্খলনের মধ্যে থাকবে। সে জমিনকে পরিপূর্ণভাবে ন্যায় ও আদর্শে ভরে দেবে। তা যতই জুলুম ও অত্যাচারে ভরে থাকুক না কেন। আসমান ও জমিনের সকলেই তাঁর উপর সন্তুষ্ট হবে...। 36

8-ইমাম রেযা (আ.) বলেছেন : যে লোকের তাকওয়া (খোদভীতি) থাকে না তাঁর কোন দীন নেই। তোমাদের মধ্যে সেই আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় যার পরহেজগারিতা সকলের চেয়ে অধিক। অতঃপর বলেন : আমার বংশধরের চতুর্থ সন্তান এক সম্ভ্রান্ত দাসীর সন্তান ,আল্লাহ্ তাঁর মাধ্যমে জমিনকে সব ধরনের জুলুম ও অন্যায় থেকে মুক্তি দিবেন এবং সে ঐ ব্যক্তি যার জন্মের বিষয়ে মানুষের সন্দেহ থাকবে। সে অন্তর্ধানে থাকবে। যখন আবির্ভূত হবেন তখন জমিন আল্লাহর নূরে আলোকিত হবে। আর মানুষের মাঝে ন্যায়ের মানদণ্ড স্থাপন করবে। যার কারণে কেউ অন্যের উপর অত্যাচার করতে পারবে না...। 37

9-আমিরুল মু মিনিন আলী (আ.) বলেছেন : আল্লাহ্ রাব্বুল আ লামিন এমন এক দল লোককে আনবেন যারা তাঁকে ভালবাসে এবং তিনিও তাদেরকে ভালবাসেন। এমন এক ব্যক্তি তাদের মধ্যে ঐশী নেতৃত্ব লাভ করবে যে লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকবে। আর সে হচ্ছে মাহ্দী মওউদ (প্রতিশ্রুত মাহ্দী) ...। সে  জমিনকে সুবিচার ও ন্যায়ে পূর্ণ করবে এবং এ কাজ করতে তাঁর কোন প্রকার সমস্যা বা অসুবিধা হবে না। শিশু বয়সেই সে তাঁর বাবা-মার কাছ থেকে দূরে থাকবে মুসলিম দেশগুলোকে নির্বিঘ্নে জয় করবে। যুগের সব কিছু তাঁর অনুকূলে ও তাঁর জন্যে প্রস্তুত থাকবে। তাঁর বক্তব্য যুক্তিপূর্ণ হবে এবং নবীন প্রবীণ সকলেই তাকে অনুসরণ করে চলবে। তিনি পৃথিবীকে ন্যায় ও সুবিচারে পূর্ণ করবেন যতটাই তা অন্যায় ও অত্যাচারে পূর্ণ হোক না কেন আর ঠিক ঐ সময় তাঁর ইমামত পরিপূর্ণতায় পৌঁছাবে ও তাঁর খেলাফত বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত হবে। এই পৃথিবী ইমাম মাহ্দীর পরশ পেয়ে তাঁর হারিয়ে যাওয়া রূপ বা সৌন্দর্যকে পুনরায় ফিরে পাবে। পৃথিবী তরতাজা ও নির্মল এবং নিয়ামতে পূর্ণ হবে ,নদ-নদীতে নির্মল পানির প্রবাহ বয়ে যাবে। পাপাচার ,শত্রুতা ,ফিতনা ,সকল অন্যায় পৃথিবী থেকে নিশ্চি হ্ন হবে ,বিদ্বেষ দূরীভূত হয়ে মানুষের অন্তরগুলি একে অপরের প্রতি ভালবাসায় পূর্ণ হবে ,সকল মানুষ ভালকাজে লিপ্ত হবে। আর তাদের সবকিছুই তখন বরকতময় হয়ে উঠবে। এর বেশী কিছু বলার প্রয়োজন দেখছি না শুধুমাত্র ঐ দিনের প্রতি আমার শুভেচ্ছা রইলো। 38

শিয়া মাযহাবের হাদীস থেকে

1-ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন : মানুষ তাদের ইমামকে হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু সে হজ মৌসুমে সেখানে উপস্থিত হয়ে তাদেরকে দেখবে। কিন্তু মানুষ তাকে দেখতে পাবে না। 39

2-আসবাগ বিন নাবাতাহ্ বলেন : আমিরুল মু মিনীন আলী (আ.)-এর সমীপে উপস্থিত হয়ে তাঁকে চিন্তায় মগ্ন থাকতে দেখলাম। তিনি আঙ্গুল মোবারক দিয়ে মাটিতে টোকা দিচ্ছিলেন। বললাম : আপনাকে কেন চিন্তিত লাগছে ,আপনি কী মাটির প্রতি ভালবাসা রাখেন ?

বললেন : না ,আল্লাহ্ সাক্ষী কখনই মাটি ও এই দুনিয়ার প্রতি ভালবাসা আমার ছিল না বা এখনও নেই। এক জাতকের বিষয়ে চিন্তা করছি যে আমার বংশ থেকে আসবে এবং আমার সন্তানদের মধ্যে একাদশতম ব্যক্তি সে। তার নাম মাহ্দী । সে দুনিয়াকে ন্যায় ও আদর্শে ভরে দেবে। তা যতই জুলুম ও অত্যাচারে ডুবে থাকুক না কেন। সে অন্তর্ধানে থাকবে এ বিষয়ে একদল ধ্বংস প্রাপ্ত হবে এবং অন্য একদল হবে হেদায়ত প্রাপ্ত...। 40

3-ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন : যদি তোমাদের কাছে খবর পৌঁছায় যে জামানার (যুগের) ইমাম অদৃশ্যে আছেন তবে তাঁর এই অদৃশ্য হওয়ার খবরটিকে অস্বীকার করবে না। 41

4-তিনি আরও বলেছেন : আল কায়েমের (ইমাম মাহ্দী) দুইটি অন্তর্ধান থাকবে যার একটি স্বল্প মেয়াদী এবং অন্যটি দীর্ঘ মেয়াদী। স্বল্প মেয়াদী অন্তর্ধানে তাঁর বিশেষ কিছু অনুসারী ছাড়া তাকে কেউ দেখতে পাবে না এবং দীর্ঘ মেয়াদী অন্তর্ধানে তাঁর অতি নিকটের লোকেরা ছাড়া অন্য কেউ তাঁর ব্যাপারে জানতে পারবে না। 42

5-তিনি আরও বলেছেন : আল কায়েম (ইমাম মাহ্দী) এমন অবস্থায় কিয়াম করবেন যে তিনি কারো সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ নন বা কেউ তাঁর হতে বাইয়াত গ্রহণ করে নি। 43

6-নবী করিম (সঃ) বলেছেন : আল কায়েম (ইমাম মাহ্দী) আমার সন্তান ,তার নাম ও ডাক নাম আমার নাম ও ডাক নামের অনুরূপ। দেখতেও অবিকল আমার মতো। শরীরের আকৃতি ও গঠন আমার মতোই। তার সুন্নত (অনুসৃত নীতি) হচ্ছে আমারই সুন্নত। মানুষদেরকে আমার দীন ও শরীয়তের এবং আল্লাহর কিতাবের প্রতি দাওয়াত দেবে। যারা তাঁকে অনুসরণ করবে তারা আমাকে অনুসরণ করলো এবং যারা তাঁর সাথে বিরোধিতা করবে তারা আমার সাথে বিরোধিতা করলো। আর যারা তাঁর অন্তর্ধানকে অস্বীকার করবে তারা আমাকে অস্বীকার করলো। 44

7-ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) বলেছেন : আমাদের কায়েমের (ইমাম মাহ্দী) সাথে বিভিন্ন নবীর যেমন নূহ ,ইবরাহীম ,মূসা ,ঈসা ,আইয়ুব ও হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা (সা.)-এর মিল রয়েছে। নূহ নবীর সাথে বয়সের দিক দিয়ে। হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর সাথে গোপনে ভুমিষ্ট হওয়া ও মানুষের থেকে দূরে থাকা। মূসা (আ.)-এর সাথে অদৃশ্য থাকা ও জীবন নাশের ভয়ের ব্যাপারে। ঈসা (আ.)-এর সাথে মানুষ যেভাবে তাঁর ব্যাপারে মতবিরোধ করেছিল সে দিক দিয়ে। আইয়ুব (আ.)-এর সাথে তার দুঃখ-বেদনা ও উদ্বেগ লাঘব হয়ে মুক্তির পথ সুগম হওয়ার দিক থেকে। নবী করীম (সা.)-এর সাথে তার মতো তলোয়ার হাতে সংগ্রাম করা। 45

8-ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন : এরূপ যে শেষ জামানার ইমাম অদৃশ্যে থাকবে। ঐ সময় আল্লাহর বান্দারা অবশ্যই যেন তাকওয়ার (পরহেযগারী) পথ অবলম্বন করে ও আল্লাহর দ্বীনকে আঁকড়ে থাকে। 46

9-তিনি আরও বলেছেন : মানুষের সামনে এমন এক সময় আসবে যখন তাদের ইমাম তাদের চোখের অন্তরালে (অদৃশ্যে) থাকবে।

যুরারাহ বলেন : তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম যে ,ঐ সময় মানুষের দায়িত্ব বা করণীয় কী ?

বললেন : যা কিছু তাদেরকে আগেই বলা হয়েছে বা তাদের কাছে আগেই পৌঁছেছে (অর্থাৎ দীনের প্রতি বিশ্বাস ও তাঁর দেয়া আদেশ-নির্দেশসমূহ) তা জামানার ইমাম আবির্ভূত হওয়া পর্যন্ত মেনে চলা। 47

10-তিনি আরও বলেছেন : এই ঘটনাটি (ইমামের আবির্ভাব ও তার উত্থান) তখন সংঘটিত হবে যখন এমন কোন দল ও গোষ্ঠী অবশিষ্ট থাকবে না মানুষের উপর শাসনকার্য পরিচালনা করে নি। যাতে করে কেউ বলতে না পারে যে ,আমাদের হাতে ক্ষমতা থাকলে আমরাও ন্যায় ও আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করতাম বা তার ভিত্তিতে শাসনকার্য পরিচালনা করতাম। অবশেষে কায়েম (ইমাম মাহ্দী) ন্যায় ও আদর্শের পক্ষে কিয়াম করবেন। 48

ইমামের জন্মলাভ

ইসলামের দ্বাদশ পথ নির্দেশক হযরত হুজ্জাত ইবনুল হাসান আল মাহ্দী (আ.) 255 হিজরীর 15ই শাবান (868 খৃস্টাব্দে) শুক্রবার ভোরে ইরাকের সামাররা শহরে একাদশ ইমামের গৃহে জন্ম গ্রহণ করেন। 49

তাঁর পিতামাতা হচ্ছেন যথাক্রমে ইসলামের একাদশ পথ নির্দেশক হযরত ইমাম হাসান আসকারী (আ.) ও সম্ভ্রান্ত ও সম্মানিতা রমণী নারজীস। যিনি সুসান ও সাইকাল নামেও পরিচিত। তিনি রোমের বাদশার ছেলে ইউসায়া র কন্যা এবং সামউ ন (সে হযরত ঈসা (আ.) এর একনিষ্ঠ অনুসারী ছিল)-এর বংশধর ছিলেন। তিনি এমনই সম্মানিতা ছিলেন যে ,ইমাম হাদী (আ.)-এর বোন হাকিমা খাতুন তাকে নিজের ও তার বংশের নেত্রী এবং নিজেকে তার সেবিকা হিসাবে পরিচয় দিয়েছেন। 50

যখন নারজীস খাতুন রোমে থাকতেন রাতে অসাধারণ স্বপ্ন দেখতেন। একবার তিনি স্বপ্নে নবী আকরাম (সা.) ও ঈসাকে (আ.) দেখলেন যে ,তাকে ইমাম হাসান আসকারীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করালেন। অন্য আরও একটি স্বপ্নে দেখলেন যে হযরত ফাতিমা (আ.)-এর দাওয়াতে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলমান হয়েছেন। কিন্তু এ বিষয়টিকে তিনি তার পরিবারের কাছে ও আত্মীয়-স্বজনের কাছে গোপন রেখেছিলেন।

তারপর মুসলমান ও রোমানদের সাথে যুদ্ধ শুরু হওয়ায় রোমের বাদশাহ্ যুদ্ধের ময়দানের দিকে রওনা হলো। এদিকে নারজীস খাতুন স্বপ্নের মধ্যে নির্দেশ প্রাপ্ত হলেন যে ,সৈন্যদের সেবা করার জন্য যে সকল দাসী বা সেবিকা যুদ্ধের ময়দানে পাঠানো হয় তাদের সাথে যেন অপরিচিতের মত একেবারে সীমান্তের কাছাকাছি সৈন্যদের যে তাঁবু আছে সেখানে চলে আসেন। তিনি তাই করলেন। তাদের সাথে যাওয়ার সময় এপাশের মুসলমান সীমান্ত রক্ষীরা তাদেরকে বন্দী করলো। তাকে রাজ পরিবারের সদস্য বুঝতে না পেরে বা সেবিকা ভেবেই বন্দীদের সাথে বাগদাদে নিয়ে গেল।

এই ঘটনাটি ইসলামের দশম পথ প্রদর্শক ইমাম হাদী (আ.)-এর ইমামতের শেষের দিকে ঘটেছিল। 51 ইমাম হাদী (আ.) রোমান ভাষায় লেখা একটি চিঠি যা তিনি নিজেই লিখেছিলেন তা তাঁর এক ভৃত্যকে দিয়ে বাগদাদে নারজীস খাতুনের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। ইমামের সেই ভৃত্য তাকে দাসী বিক্রয়ের স্থান থেকে কিনে নিয়ে সামাররায় ইমামের কাছে নিয়ে এল। তিনি স্বপ্নের মধ্যে যা কিছু দেখেছিলেন ইমাম সেগুলো তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন ,তিনি একাদশ ইমামের স্ত্রী ও এমন এক সন্তানের জননী যে এই পৃথিবীর অধিকর্তা হবে। আর পৃথিবীর বুকে ন্যায়-নীতির প্রতিষ্ঠাকারী। তারপর ইমাম হাদী (আ.) তাকে তাঁর বোন হাকিমা খাতুনের (যিনি নবী পরিবারের সম্মানিতা নারী ছিলেন) হাতে তুলে দেন। 52

হাকিমা খাতুন যখনই ইমাম আসকারী (আ.)-এর কাছে আসতেন তার ব্যাপারে দোয়া করতেন যে ,আল্লাহ্ যেন তাকে সন্তান দান করেন। তিনি বলেন : একদিন ইমাম আসকারীকে দেখতে গেলাম ও আগের দোয়ারই পুনরাবৃত্তি করলে তিনি বললেন : যে সন্তানের জন্য দোয়া করছেন আল্লাহ্ তা আমাকে দিয়েছেন। সে আজ রাতেই দুনিয়ায় আগমন করবে। 53

নারজীস খাতুন এগিয়ে এসে আমার পা থেকে জুতা খুলে নেওয়ার জন্য বলল :  আমার সম্মানিতা নেত্রী আপনার জুতোজোড়া আমাকে দিন।

বললাম : তুমিই তো আমার নয়ন মণি ও আমার কর্ত্রী। আল্লাহর কসম আপনাকে আমার জুতা খুলে নিতে বা আমার সেবা করতে দেব না। কেননা প্রকৃতপক্ষে আমিই আপনার সেবিকা।

ইমাম আসকারী (আ.) আমার কথাটি শুনতে পেয়ে বললেন : ফুফু আম্মা আল্লাহ্ আপনাকে উপযুক্ত পুরস্কারে পুরস্কৃত করবেন।

সন্ধ্যা পর্যন্ত তার কাছে থাকলাম। তারপর চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে এক দাসীকে আমার পোশাক আনতে বললাম। ইমাম বললেন : ফুফু আম্মা ,আজ রাত আমাদের কাছে থেকে যান। কেননা আজ রাতে এমন এক শিশু ভূমিষ্ঠ হবে যে আল্লাহর কাছে অনেক সম্মানিত ও প্রিয়। যার মাধ্যমে আল্লাহ্ মৃত দুনিয়াকে আবার জীবিত করবেন।

বললাম : হে আমার পথনির্দেশক! আপনি কার ভুমিষ্ঠ হওয়ার কথা বলছেন ?আমি তো নারজীস খাতুনের মধ্যে গর্ভবতী থাকার কোন লক্ষণই দেখলাম না!

বললেন : নারজীসের মাধ্যমেই হবে ,অন্য কারো মাধ্যমে নয়।

আমি উঠে গেলাম এবং নারজীসকে দ্বিতীয় বারের মত নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করলাম। কিন্তু তার মধ্যে গর্ভবতী থাকার কোন লক্ষণই পেলাম না। ইমামের কাছে ফিরে এলাম এবং আমার পর্যবেক্ষণের কথা তাকে জানালাম। তিনি মুচকি হেসে বললেন : ভোরে আপনার কাছে পরিস্কার হয়ে যাবে যে ,তার গর্ভে সন্তান ছিল। কেননা সে মূসা কালিমুল্লাহর মায়ের ন্যায়। সে কারণেই তার গর্ভাবস্থা প্রকাশিত নয়। আর কেউ তার ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময়কে জানতো না। কেননা ফেরাউন মূসার খোঁজে (এজন্য যে সে দুনিয়ায় আসতে না পারে) গর্ভবতী মহিলাদের পেট ফেঁড়ে বাচ্চা বের করে মেরে ফেলেছিল। আর যে শিশু আজ রাতে জন্ম নিবে সেও মূসার মতই (ফেরাউনদের ক্ষমতাকে ধ্বংস করে ফেলবে) এবং তারাও তার খোঁজে আছে।

হাকিমা খাতুন বলেন : আমি ভোর পর্যন্ত নারজীস খাতুনের পরিচর্যায় ছিলাম। সে শান্ত হয়ে আমার পাশে ঘুমিয়ে ছিল। কোন প্রকার নড়া-চড়াও করেনি। রাতের শেষের দিকে অর্থাৎ ছুবহ্ সাদেকের সময় আচমকা নড়ে উঠলে আমি তাকে আমার কোলের মধ্যে নিয়ে আল্লাহর নাম পড়ে তার শরীরে ফুঁক দিলাম।

ইমাম পাশের ঘর থেকে সূরা কদর পড়ে তার মাথায় ফুঁ দিতে বললেন। আমি তাই করলাম। নারজীসের কাছে তার শরীরের অবস্থা জানতে চাইলাম। সে বলল : যা কিছু আমার মাওলা আপনাকে বলেছিল তা পরিস্কার হয়ে গেছে।

আমি ইমামের নির্দেশ অনুযায়ী সূরা কদর পড়ে তার মাথায় ফুঁ দিতে থাকলাম। এই সময় তার পেটের শিশুটিও আমার সাথে একই সুরে সূরা পড়তে শুরু করল। আমি যাই পড়ি সেও আমার সাথে তাই পড়ে। সে আমাকে সালাম দিল। আমি দারুণভাবে চমকে উঠলাম। ইমাম পাশের ঘর থেকে আবারও বললেন : আল্লাহ্ রাব্বুল আ লামিনের কর্মে আশ্চর্যান্বিত হবেন না। আল্লাহ্ তা য়ালা আমাদেরকে (ইমামদের) শিশু অবস্থাতেই তাঁর প্রজ্ঞা দ্বারা সজ্জিত করেন আর পরিপূর্ণ বয়সে দুনিয়াতে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেন।

ইমামের কথা শেষ না হতেই নারজীস আমার পাশ থেকে উধাও হয়ে গেল। বলা যায় যেন আমার ও তার মাঝে একটি পর্দা টাঙানো হয়েছে। কেননা তাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। চিৎকার দিয়ে ইমামের কাছে ছুটে গেলাম। তিনি বললেন : ফুফু আম্মা ফিরে যান। তাকে অচিরেই আগের জায়গাতে দেখতে পাবেন।

ফিরে এলাম। কিছু সময় যেতে না যেতেই ঐ পর্দার প্রলেপটি আমাদের মধ্য থেকে সরে গেল। আমি নারজীসকে দেখলাম সে যেন নূরের আলোর মধ্যে ডুবে আছে। তাকে  দেখতে গেলে ঐ নূরের আলোক ছটায় আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসলো। যে পুত্র সন্তানটি ভূমিষ্ঠ হয়েছে তাকেও দেখলাম ,সে সেজদারত অবস্থায় আছে এবং তর্জনী উঠিয়ে বলল :

اَشْهَدُ أَنْ لاَ اِلَهَ اِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ وَ أَنَّ جَدِّى مُحَمَّداً رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَ أَنَّ أَبِى اَمِيرُ الْمُؤْمِنِينَ

সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ্ ছাড়া কোন মাবুদ নেই ,তিনি অদ্বিতীয় ও তাঁর কোন শরিক নেই এবং বাস্তবিকই আমার পিতামহ মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসূল এবং মু মিনদের নেতা আলী (আ.) আমার পিতা।

তারপর একের পর এক নিজে সহ অন্যান্য ইমামগণের ইমামতের সাক্ষ্য দিয়ে বললেন : হে আল্লাহ্! আমার প্রতিশ্রুতি প্রদানের স্থান ও কালকে ত্বরান্বিত কর ,আমার কাজকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাও ,আমার প্রতিটি পদক্ষেপ দৃঢ় করতে দাও এবং আমার মাধ্যমেই এই দুনিয়াতে ন্যায় ও নীতির প্রতিষ্ঠা কর ... । 54


3

4

5

6

7

8

9

10