ইমাম মাহদী (আ.)-এর আত্মপ্রকাশ(আসরে যুহুর)

ইমাম মাহদী (আ.)-এর আত্মপ্রকাশ(আসরে যুহুর)0%

ইমাম মাহদী (আ.)-এর আত্মপ্রকাশ(আসরে যুহুর) লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: ইসলামী সেবা দপ্তর,কোম,ইরান
বিভাগ: ইমাম মাহদী (আ.)

ইমাম মাহদী (আ.)-এর আত্মপ্রকাশ(আসরে যুহুর)

লেখক: আল্লামা আলী আল কুরানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: ইসলামী সেবা দপ্তর,কোম,ইরান
বিভাগ:

ভিজিট: 81160
ডাউনলোড: 9314

পাঠকের মতামত:

ইমাম মাহদী (আ.)-এর আত্মপ্রকাশ(আসরে যুহুর)
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 62 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 81160 / ডাউনলোড: 9314
সাইজ সাইজ সাইজ
ইমাম মাহদী (আ.)-এর আত্মপ্রকাশ(আসরে যুহুর)

ইমাম মাহদী (আ.)-এর আত্মপ্রকাশ(আসরে যুহুর)

লেখক:
প্রকাশক: ইসলামী সেবা দপ্তর,কোম,ইরান
বাংলা

শুভ আবির্ভাবের আন্দোলন

রেওয়ায়েতসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে ,ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর পবিত্র আন্দোলন ও বিপ্লব চৌদ্দ মাসে পূর্ণতা লাভ করবে। প্রথম ছয় মাসে ইমাম উদ্বিগ্নতার মধ্যে কাটাবেন এবং তাঁর সঙ্গী-সাথীদের মাধ্যমে গোপনীয়তা রক্ষা করে আন্দোলন পরিচালনা করবেন এবং পরবর্তী আট মাসের মধ্যে পবিত্র মক্কায় আবির্ভূত হবেন। এরপর তিনি মদীনা অভিমুখে রওয়ানা হবেন। সেখান থেকে ইরাক ও কুদ্স (বাইতুল মুকাদ্দাস) অভিমুখে যাত্রা করবেন এবং শত্রুদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হবেন। তিনি সমগ্র মুসলিম বিশ্বের ওপর কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবেন এবং সমগ্র মুসলিম বিশ্ব তাঁর আনুগত্য করবে ও আদেশ-নির্দেশ মেনে চলবে। তখন রোমীয়দের (পাশ্চাত্য) সাথে তিনি যুদ্ধ বিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করবেন। এ ব্যাপারে বিস্তারিত বিবরণ পরে যথাসময়ে দেয়া হবে।

ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের আন্দোলনের আগে দু টি ঘটনা ঘটবে যেগুলো হবে মহান আল্লাহর নিদর্শন । তখন তিনি তাঁর আবির্ভাবের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি শুরু করবেন :

প্রথম ঘটনা : উসমান সুফিয়ানীর নেতৃত্বে শামদেশে সামরিক অভ্যুত্থান। কিন্তু জনগণ ভাববে যে ,এ অভ্যুত্থান হচ্ছে আরব ও মুসলিম দেশগুলোতে সচরাচর যে সব সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে থাকে সেগুলোর মতোই।

তবে মুসলিম উম্মাহর চিরশত্রু পাশ্চাত্য ও ইহুদীরা এটাকে তাদের প্রতিষ্ঠিত একটি শক্তিশালী ও ক্রীড়নক সরকার হিসাবে মনে করবে এবং ফিলিস্তিনের আশে-পাশের অঞ্চলের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে একে একটি কার্যকর পদক্ষেপ হিসাবে বিবেচনা করবে। সুফিয়ানীর সরকার শক্তি প্রয়োগ করে এ অঞ্চলের সার্বিক অবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার যথাসাধ্য চেষ্টা করবে এবং তাদের পাশ্চাত্য ও ইসরাইলের বিরুদ্ধে পরিচালিত সামরিক অভিযানসমূহ প্রতিহত করবে। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ,এ এলাকায় এ সামরিক শক্তিই আল কুদ্স অভিমুখে অগ্রসরমান প্রেরিত প্রথম ইরানী বাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়াবে এবং তাঁদেরকে ইরাক সীমান্তে ব্যস্ত রাখবে।

সুফিয়ানী সংক্রান্ত রেওয়ায়েতসমূহ সম্পর্কে যাঁদের ধারণা আছে এবং জানে যে ,মহানবী (সা.) কর্তৃক সুফিয়ানীর আবির্ভাব ও অভ্যুত্থানের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে ,তারা বলবে যে ,মহান আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূল (সা.) সত্য বলেছেন : আমাদের প্রভু পবিত্র এবং নিশ্চয়ই প্রভুর অঙ্গীকার বাস্তাবায়িত হবে... এবং তাদের অন্তরসমূহ প্রতিশ্রুত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর ব্যাপারে আশাবাদী হবে। তখন তারা তাঁর ব্যাপারে অনেক কথা বলবে এবং তাঁকে সাহায্য করার ব্যাপারে নিজেদের প্রস্তুতি ঘোষণা করবে।

দ্বিতীয় ঘটনা : দ্বিতীয় ঘটনা হচ্ছে পৃথিবীবাসীর প্রতি একটি আসমানী আওয়াজ যা সবাই এবং সকল ভাষাভাষী গোষ্ঠী ও জাতি তাদের নিজ নিজ ভাষায় শুনতে পাবে। এ আহবান-ধ্বনি হবে খুবই শক্তিশালী ও ভেদকারী যা আকাশ এবং সব দিক থেকে ভেসে আসবে। এ ধ্বনি ঘুমন্ত ব্যক্তিকে জাগ্রত এবং উপবিষ্ট ব্যক্তিকে নিজ পায়ের ওপর দাঁড় করাবে। জনগণ এ আসমানী ধ্বনি শুনে বিষয়টি জানার জন্য উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করতে করতে নিজ গৃহ থেকে বের হয়ে আসবে। এই ধ্বনি জনতাকে অন্যায়-অত্যাচার ,কুফর ,দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ ও রক্তপাত থেকে বিরত থাকা এবং ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আনুগত্য করার প্রতি আহবান জানাবে। এ ধ্বনি ইমাম মাহ্দী (আ.)-কে তাঁর পিতার নামসহ ডাকা হবে ।

রেওয়ায়েতসমূহে বর্ণিত হয়েছে যে ,মানব জাতি মহান আল্লাহর প্রতিশ্রুত এ ঐশী নিদর্শনের সামনে মাথা নত করবে। কারণ এটা হচ্ছে মহান আল্লাহর এ বাণীর ব্যাখ্যা :

যদি আমরা তাদের ওপর আসমান থেকে মুজিযা অবতীর্ণ করতে চাই যার সামনে তারা সবাই আত্মসমর্পণ ও মাথা নত করবে।... (শুয়ারা : 4)

তখন অবশ্যম্ভাবীরূপে বিশ্বব্যাপী এ প্রশ্ন সকলের মুখে মুখে জোরালোভাবে উচ্চারিত এবং সকল প্রচার মাধ্যমের পক্ষ থেকে মাহ্দী কে ,তিনি কোথায় আছেন তা অনুসন্ধান করা হবে ও আলোচনা-পর্যালোচনা অনুষ্ঠিত হবে।

কিন্তু যখনই সবাই জানবে যে ,তিনি মুসলমানদের নেতা ,মহানবী (সা.)-এর আহলে বাইতের একজন সদস্য এবং তিনি অতি সত্বর হিজাযে আত্মপ্রকাশ করবেন ,তখন উক্ত আলৌকিক আসমানী আহবান-ধ্বনির ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টির চেষ্টা এবং বিশ্বব্যাপী নয়া ইসলামী জাগরণের ওপর মরণাঘাত হানা ও ইসলামী আন্দোলনের এ মহান নেতা ইমাম মাহ্দীকে হত্যা করার জন্য পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র করা হবে। কিন্তু গায়েবে বিশ্বাসীরা যারা এ আহবান-ধ্বনি সংক্রান্ত রেওয়ায়েতসমূহ শুনেছে তারা ভালোভাবে বুঝতে ও উপলব্ধি করতে পারবে যে ,এ ধ্বনিই হচ্ছে প্রতিশ্রুত সত্য ধ্বনি এবং তারা শুকরানা সিজদা আদায় করবে এবং মহান আল্লাহর সামনে তাদের অন্তরের বিনয় বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। তারা সবসময় ইমাম মাহ্দী (আ.) সম্পর্কে আলোচনা করবে ,তাঁকে অন্বেষণ করতে থাকবে এবং তাঁকে সাহায্য করার জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত করবে।

এ আসমানী ধ্বনি যা জনগণকে ইমাম মাহ্দী (আ.)-কে অনুসরণ ও আনুগত্য করার জন্য আহবান জানাবে এবং তাঁকে তাঁর নাম ও তাঁর পিতার নামসহ স্মরণ করবে এতৎসংক্রান্ত অগণিত রেওয়ায়েত শিয়া ও সুন্নী সূত্রসমূহে বিদ্যমান রয়েছে। আর এগুলো অর্থগতভাবে মুতাওয়াতির। 292

ইবনে হাম্মাদ এ রেওয়ায়েতটি তাঁর হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপির 59 ,60 ,92 ,93 পৃষ্ঠায় এবং আরো অন্যান্য স্থানে এবং মাজলিসী বিহারুল আনওয়ার গ্রন্থের 52তম খণ্ডের 119 ,287 ,289 ,293 ,296 ও 300 ও অন্যান্য পৃষ্ঠায় ইমাম জাফর সাদিক (আ.) থেকে বর্ণনা করেছেন : আকাশ থেকে একজন আহবানকারী ইমাম মাহ্দী (আ.) সম্পর্কে উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করতে থাকবে : নেতৃত্ব ও শাসনক্ষমতা অমুকের পুত্র অমুকের। অতএব ,কিসের জন্য হত্যাকাণ্ড (সংঘটিত হচ্ছে) ? 293

তিনি বলেছেন : দু টি ধ্বনি শোনা যাবে। একটি হলো প্রথম দিন রাত শুরু হওয়ার সময় এবং দ্বিতীয়টি হলো দ্বিতীয় রাতের শেষে। হিশাম ইবনে সালিম বলেন , আমি জিজ্ঞাসা করলাম : তা কেমন ? তিনি বললেন , একটি ধ্বনি আকাশ হতে এবং অন্যটি শয়তানের পক্ষ থেকে হবে। আমি তখন জিজ্ঞাসা করলাম , কিভাবে একটিকে আরেকটি হতে আলাদা করা যাবে ? তিনি বললেন , এর শ্রোতা তা অস্তিত্ব লাভের পূর্বেই তা নির্ণয়ে সক্ষম হবে। 294

মুহাম্মদ ইবনে মুসলিম থেকে বর্ণিত : আকাশ থেকে একজন আহবানকারী আল কায়েম আল মাহ্দী (আ.)-এর নাম ধরে এমনভাবে ডাকবেন যে ,পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত তা শোনা যাবে ,এ ধ্বনির প্রভাবে ঘুমন্ত ব্যক্তি জাগ্রত হবে ,দণ্ডায়মান ব্যক্তি বসে পড়বে এবং যে বসা থাকবে সে পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে যাবে। আর ঐ ধ্বনিটা হবে রুহুল আমীন জিবরাঈল (আ.)-এর ধ্বনি। 295

আবদুল্লাহ্ ইবনে সিনান থেকে বর্ণিত : আমি ইমাম সাদিক (আ.)-এর সামনে উপস্থিত ছিলাম। আমি তখন একজন হামাদানবাসীকে জিজ্ঞাসা করতে শুনলাম যে ,আহলে সুন্নাহ আমাদেরকে তিরষ্কার করে বলে : তোমরা বিশ্বাস কর যে ,আকাশ থেকে একজন আহবানকারী ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর নাম ধরে আহবান জানাবে! হযরত হেলান দেয়া অবস্থায় ছিলেন। তিনি এ কথা শুনে রাগান্বিত হয়ে উঠে বসলেন এবং বললেন : এ বিষয়টা আমার থেকে বর্ণনা করো না ,বরং আমার পিতা থেকে বর্ণনা করবে। সেক্ষেত্রে তোমাদের ওপর কোন আপত্তি থাকবে না। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে ,আমার পিতা বলতেন : মহান আল্লাহর শপথ ,এ বিষয়টা তাঁর কিতাবে স্পষ্ট বিদ্যমান। যেমন এরশাদ হয়েছে : আর যদি আমরা চাইতাম তাদের ওপর আকাশ হতে একটি মুজিযা (আলৌকিক নিদর্শন) অবতীর্ণ করতাম যার সামনে তারা তাদের মাথা নত করত। 296

সাইফ ইবনে উমাইরাহ্ বলেন : আমি দ্বিতীয় আব্বাসী খলীফা আবু জাফর আল মানসুরের কাছে উপস্থিত ছিলাম। তিনি ভূমিকা ছাড়াই বললেন : হে সাইফ ইবনে উমাইরাহ্! নিঃসন্দেহে আকাশ হতে এক আহবানকারী আবু তালিবের বংশধারা হতে এক ব্যক্তির নাম ঘোষণা করবে। আমি বললাম : হে আমীরুল মুমিনীন! আপনার জন্য কোরবান হই। এ বিষয়টা আপনি রেওয়ায়েত করছেন! তিনি বললেন : হ্যাঁ। যাঁর হাতে আমার জীবন ,তাঁর শপথ ,এ বর্ণনাটি আমি নিজ কানে শুনেছি। আমি বললাম : হে আমীরুল মুমিনীন! আমি এখন পর্যন্তও এ রেওয়ায়েতটি শুনি নি। তিনি বললেন : হে সাইফ! এ কথা সত্য। আর যদি এমন আহবানকারীই আগমন করে তাহলে আমরাই তাঁর আহবানে প্রথম সাড়াদানকারী হব। এমন নয় কি যে ,ঐ আহবান-ধ্বনি জনগণকে [আমাদের পিতৃব্য পুত্রদের মধ্যে থেকে] এক ব্যক্তির দিকে আহবান জানাবে। আমি বললাম : সে ব্যক্তিটি কি হযরত ফাতিমার বংশধর হবেন ?তিনি বললেন : হে সাইফ! হ্যাঁ। আমি যদি এ কথা আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে আলীর কাছ থেকে না শুনতাম এবং সমগ্র পৃথিবীবাসীও যদি তা বর্ণনা করত তাহলে আমি কখনই তাদের কাছ থেকে তা মেনে নিতাম না। তবে তিনি (এ বর্ণনাকারী) হলেন মুহাম্মদ ইবনে আলী (ইমাম বাকির) 297

ইবনে হাম্মাদের হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপিতে (পৃ. 92) সাঈদ ইবনে মুসাইয়াব থেকে বর্ণিত : এমন একটি ফিতনার উদ্ভব হবে যা শুরুতে শিশুদের খেলনার মতো হবে। তা যদি কোন একদিকে প্রশমিত হয় তাহলে তা অন্য এক দিক থেকে মাথা তুলে দাঁড়াবে। এ ফিতনা আসমান থেকে আহবানকারীর আহবানের সময় পর্যন্ত শেষ হবে না। আহবানকারী আহবান করে বলতে থাকবে : তোমরা সবাই শুনে নাও যে ,তোমাদের নেতা অমুক ব্যক্তি। ইবনে মুসাইয়ার তাঁর হাতদ্বয় এমনভাবে পরস্পর সংযুক্ত করলেন যে ,সেগুলো কাঁপছিল। তখন তিনি তিনবার বললেন : তিনিই হলেন তোমাদের সত্যিকার নেতা।

ঐ একই গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে : যখন আকাশ থেকে একজন আহবানকারী উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করবে যে ,সত্য মুহাম্মদ (সা.)-এর আহলে বাইতের সাথে আছে ,তখন ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর নাম জনগণের মুখে মুখে ধ্বনিত হবে এবং মানুষের অন্তরে তাঁর প্রতি ভালোবাসা আসন লাভ করবে এবং জনগণ তখন তাঁকে ব্যতীত আর কোন কিছুর চিন্তাও করবে না।

আরো বর্ণিত হয়েছে : ইমাম বাকির (আ.) থেকে জাবির এবং তাঁর থেকে সাঈদ আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন , আকাশ থেকে এক আহবানকারী উচ্চৈঃস্বরে আহবান করে বলবে : তোমরা সবাই জেনে নাও যে ,সত্য ,মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আহলে বাইতের মধ্যেই আছে । এরপর পৃথিবী থেকে আরেকটি ধ্বনি ধ্বনিত হবে এবং বলা হবে : তোমরা সবাই জেনে রাখ যে ,সত্য হযরত ঈসা (আ.)-এর বংশে অথবা আব্বাসের বংশে আছে (আমার সন্দেহ আছে) এবং নিশ্চয়ই পৃথিবী থেকে উত্থিত দ্বিতীয এ ধ্বনিটি হবে শয়তানের। সে মানব জাতিকে নিরাশ করতে এরূপ ধ্বনি উঠাবে। (সন্দেহকারী আবু আবদিল্লাহ্ নাঈম)

এ গ্রন্থের 60 পৃষ্ঠায় মহানবী (সা.) থেকে ইবনে মাসউদের সূত্রে বর্ণিত হয়েছে : যখন রমযান মাসে আকাশ থেকে ধ্বনি শোনা যাবে তখন তোমরা সবাই জানবে যে ,শাওয়াল মাসে এক ভীষণ গোলযোগ হবে ;যীলক্বদ মাসে গোত্রগুলো একে অপর থেকে পৃথক হয়ে যাবে এবং যিলহজ্ব মাসে রক্তপাত সংঘটিত হবে। তিনি তিনবার বললেন : কিন্তু মুহররম কেমন মুহররমই না হবে! কত দূর! কত দূর! এ মাসে বিশৃঙ্খলা ও গোলযোগের কারণে অসংখ্য মানুষ নিহত হবে। আমি প্রশ্ন করলাম : হে রাসূলাল্লাহ্! আসমানী ধ্বনি ও আহবানটি কী ? তিনি বললেন : এ ধ্বনি রমযান মাসের মাঝামাঝিতে শুক্রবার রাতে শোনা যাবে। এটি হচ্ছে এমন এক ধ্বনি যা ঘুমন্ত ব্যক্তিকে জাগ্রত করবে এবং দণ্ডায়মান ব্যক্তিকে বসিয়ে দেবে এবং সতি-সাধ্বী পর্দানশীল মহিলাদেরকে পর্দা থেকে বের করে আনবে...। যে বছর ভূমিকম্প অধিক হবে ,যখন শুক্রবার দিবসের ফজরের নামায আদায় করবে তখন নিজেদের ঘরে ফিরে দরজা ও জানালা বন্ধ করে নিজেদেরকে ঢেকে রাখবে এবং নিজেদের কান বেধে রাখবে । যখন ঐ শব্দটা শুনবে তখন সিজদার স্থানে মাথা রেখে বলবে :

سبحان القدّوس سبحان القدّوس سبحان القدّوس

যে কেউ এমন করবে সে-ই নাজাত পাবে। আর যে ব্যক্তি তা করবে না সে ধ্বংস হয়ে যাবে। এবং অন্যান্য রেওয়ায়েত যেগুলো এ প্রসঙ্গে শিয়া-সুন্নী সূত্রসমূহে বর্ণিত হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে শিয়া-সুন্নী সূত্রসমূহে বিভিন্ন হাদীস বর্ণিত হয়েছে। মাহ্দী (আ.)-এর বিরোধী এ পার্থিব ধ্বনিটি যা রেওয়ায়েতসমূহে বর্ণিত হয়েছে তা সরাসরি ইবলীসের কণ্ঠনিঃসৃত ধ্বনিও হতে পারে। যেমন সে উহুদ যুদ্ধে চিৎকার করে বলেছিল : মুহাম্মদ নিহত হয়েছে। আবার তা ইবলীসের সঙ্গী-সাথী অর্থাৎ আন্তর্জাতিক শয়তানী চক্রের প্রচার মাধ্যম দ্বারাও প্রদত্ত হতে পারে। তারা আসমানী আহবান-ধ্বনি বিশ্বব্যাপী ইসলামের যে পুনর্জাগরণী ও জোয়ার সৃষ্টি করবে তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও বাধা দানের জন্য আসমানী আহবানধ্বনি বিরোধী অথচ তৎসদৃশ আহবান-ধ্বনি তৈরি করবে।

তবে আসমানী আহবান-ধ্বনি যে যুদ্ধ বন্ধ করার দিকে সবাইকে আহবান জানাবে তা ঐ বিশ্বযুদ্ধ হতে পারে যা আমরা আগে আলোচনা করেছি এবং বলেছি যে ,ঐ যুদ্ধ পারমাণবিক যুদ্ধ নাও হতে পারে ;বরং তা বিভিন্ন ধরনের আঞ্চলিক যুদ্ধ হতে পারে। রেওয়ায়েতসমূহের বর্ণিত হয়েছে যে ,ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের বছরে পৃথিবীতে অনেক যুদ্ধ সংঘটিত হবে।

আসমানী আহবান-ধ্বনি সংঘটিত হওয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট রেওয়ায়েতগুলোর মাঝে কিছুটা পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় -এ বিষয়টি আমাদের দৃষ্টিতে থাকা উচিত। কারণ ,যেমন আপনারা প্রত্যক্ষ করেছেন তদনুসারে কতিপয় রেওয়ায়েত এই আহবান-ধ্বনিকে রমযান মাসে ,কতিপয় রেওয়ায়েত 298 রজব মাসে এবং আরো কতিপয় রেওয়ায়েত ,যেমন ইবনে হাম্মাদের হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপিতে পৃ. 92 বর্ণিত হাদীসটি হজ্ব মৌসুমে এবং উক্ত পাণ্ডুলিপি আবার (93 পৃষ্ঠায়) নাফসে যাকীয়ার মৃত্যুর পরে মুহররম মাসে হতে পারে বলে উল্লেখ করেছে।

আরো কতিপয় রেওয়ায়েত থেকে ধারণা হয় যে ,ঐ আসমানী আহবান-ধ্বনি একাধিক হবে ,এমনকি কতিপয় রেওয়ায়েতে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত হয়েছে। একজন গবেষক আলেম শিয়া হাদীস সূত্রসমূহে বর্ণিত আহবান-ধ্বনির সংখ্যা আট পর্যন্ত হিসাব করেছেন এবং দেখা গেছে যে ,আহলে সুন্নাতের হাদীস সূত্রসমূহেও উক্ত আহবানধ্বনির সংখ্যা আট। তবে সর্বোত্তম বলে যা মনে হয় তা হচ্ছে ,আসমানী আহবান-ধ্বনি কেবল একটি হবে -একাধিক হবে না। আর তা রমযান মাসেই শোনা যাবে। তবে উক্ত আহবান-ধ্বনি যে একাধিক হবে এ ধারণাটি আসলে এ আহবানের সময় সংক্রান্ত রেওয়ায়েতের মধ্যকার পার্থক্য থেকেই উদ্ভূত। আর এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ্ই ভালোভাবে অবগত।

এ দু নিদর্শন অর্থাৎ রজব মাসে সুফিয়ানীর আবির্ভাব ও অভ্যুত্থান এবং রমযান মাসে আসমানী আওয়াজের পর মুহররম মাসে হযরত মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবকাল পর্যন্ত প্রায় ছয় মাস ব্যবধান থাকে। আহলে সুন্নাতের হাদীস সূত্রগুলো এ কয় মাসে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর কয়েকটি পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেছে ,যেমন মদীনা মুনাওওয়ারায় এবং মক্কায় নিজ সঙ্গী-সাথীদের সাথে তাঁর মিলিত হওয়া এবং বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে আগ্রহ ,উদ্দীপনা ও ব্যাকুলতা সহকারে তাঁর বাইআত করার জন্য যারা তাঁর সন্ধান করছে তাদের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ। এ সব ব্যক্তির মধ্যে বিভিন্ন মুসলিম দেশ থেকে আগত সাত জন আলেম পূর্ব নির্ধারিত কোন কর্মসূচী ছাড়াই ইমামের সাথে পবিত্র মক্কায় সাক্ষাৎ করবেন যাঁদের প্রত্যেকেই আবার (মক্কায় আসার আগে) তাঁদের নিজ নিজ শহরে তিনশ তের জন মুখলিস ধার্মিক ব্যক্তির কাছ থেকে ইমাম মাহ্দীর পক্ষে বাইআত গ্রহণ করবেন। তাঁরা ইমাম মাহ্দীর সন্ধান করতে থাকবেন যাতে তাঁরা নিজেদের এবং তাঁদের অনুসারীদের পক্ষ থেকে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর বাইআত করতে পারেন এবং তিনি তাঁদেরকে গ্রহণ করেন অর্থাৎ তাঁদেরকে তিনি তাঁর বিশেষ সাথীদের অন্তর্ভুক্ত করেন। আর মহানবী (সা.) তাঁর ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছেন। শীঘ্রই আমরা এতৎসংক্রান্ত বিশদ বিবরণ প্রদান করব।

আর শিয়া সূত্রসমূহে এ ছয় মাসকে দীর্ঘ অন্তর্ধানকালের পর আবির্ভাবের গোপনকাল বলে অভিহিত করা হয়েছে। তাঁর নাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়া পর্যন্ত তাঁর আবির্ভাবের বিষয়টি অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য থাকবে। হযরত আলী (আ.) হতে বর্ণিত এ হাদীসটির অর্থ হলো যখনই তাঁর নাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে তখনই তিনি আবির্ভূত হবেন। শুরুতে ইমাম মাহ্দী (আ.) ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করবেন। অতঃপর সাধারণ মানুষের কাছে আবির্ভাবের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে । তাঁর ধীরে ধীরে আবির্ভাব এ কারণেও হতে পারে যে ,ইমামের আবির্ভাবের বিষয়টিকে জনগণ কিভাবে নেয় তা পরীক্ষা করা এবং তাঁর আবির্ভাবের বিষয়টি পুরোপুরি স্পষ্ট ও সর্বত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

এ যুগ সম্পর্কে পূর্ববর্তী হাদীস ছাড়াও আরো কিছু রেওয়ায়েত ও হাদীস বিদ্যমান যেগুলো সনদের দিক থেকে সহীহ বলে গণ্য এবং এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে স্পষ্ট হচ্ছে স্বীয় প্রতিনিধি আলী ইবনে মুহাম্মদ আস সামাররীর কাছে প্রেরিত হযরত মাহ্দী (আ.)-এর হস্তলিখিত পত্র। এতে তিনি বলেছেন : অতি শীঘ্রই আমার অনুসারীদের মধ্য থেকে একদল লোক আবির্ভূত হবে যারা আমাকে দেখার দাবি করবে। তোমরা জেনে নাও যে ,যে কেউ সুফিয়ানীর আবির্ভাব ,অভ্যুত্থান এবং আসমানী আহবান-ধ্বনি শ্রুত হবার আগে আমাকে দেখেছে বলে দাবি করবে সে আসলে মিথ্যাবাদী। আর উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন মহান আল্লাহ্ ব্যতীত আর কোন শক্তি ও ক্ষমতা নেই) । 299

এ দু ঘটনা ঘটার আগে যে ব্যক্তি ইমাম মাহ্দীকে দেখেছে বলে দাবি করবে -এর অর্থ হচ্ছে এই যে ,সে সাহিবুল আমর অর্থাৎ ইমাম মাহ্দীর প্রতিনিধি বলে নিজেকে দাবি করবে ;তবে প্রতিনিধিত্বের দাবি অথবা এ ব্যাপারে কোন কথা বলা ব্যতিরেকে শুধু ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সমীপে উপস্থিত হওয়া এবং তাঁকে দেখা ও তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করার বিষয়টি উপরিউক্ত হাদীসের ব্যতিক্রম বলে গণ্য হবে। ইমাম মাহ্দীর সাথে সাক্ষাতের ব্যাপারে বেশ কিছু সংখ্যক নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত আলেম ও আল্লাহর ওলীদের সূত্রে পর্যাপ্ত সংখ্যক রেওয়ায়েত বিদ্যমান। আর সম্ভবত এ কারণেই স্বয়ং ইমাম মাহ্দীর লিখিত পত্রে ইমামকে দেখা ও তাঁর সাথে সাক্ষাতকে ( رؤيت ) প্রত্যাখ্যান না করে বরং মুশাহাদাহকে 300 ( مشاهدة ) প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।

ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর লিখিত পত্র থেকে প্রতীয়মান হয় যে ,সুফিয়ানীর আবির্ভাব ও অভ্যুত্থান এবং আসমানী আহবান-ধ্বনির মাধ্যমে তাঁর দীর্ঘ অন্তর্ধানের পরিসমাপ্তি হবে। এর পরের অন্তর্ধানটি গোপন থাকার দৃষ্টিতে তাঁর প্রথম অর্থাৎ সংক্ষিপ্ত অন্তর্ধানের সদৃশ হবে এবং তা তাঁর আবির্ভাবের সূচনা ও পূর্বপ্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ হবে। অর্থাৎ ইমাম এ সময় জালিমদের ও তাদের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক থেকে গোপন থাকবেন। তবে এ সময় তিনি তাঁর সঙ্গী-সাথীদের সাথে যোগাযোগ করবেন এবং তাঁদের মধ্য থেকে বেশ কিছু সংখ্যক ব্যক্তি তাঁর সমীপে উপস্থিত হবেন। আর তিনিও তাঁর ও মুমিনদের মাঝে সংযোগ স্থাপনকারী হিসাবে বেশ কিছু প্রতিনিধি নিযুক্ত করবেন।

পরবর্তী রেওয়ায়েতসমূহ থেকে এ রকম মনে হয় যে ,ইমাম মাহ্দী (আ.) সুফিয়ানীর আবির্ভাবের পর আবির্ভূত হবেন ;অতঃপর মুহররম মাসে তাঁর প্রতিশ্রুত আবির্ভাবকাল পর্যন্ত গোপন থাকবেন। ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) থেকে বর্ণিত হাযলাম বিন বশীরের রেওয়ায়েতে বর্ণিত আছে : যখন সুফিয়ানী আবির্ভূত হবে তখন ইমাম মাহ্দী (আ.) কিছুদিন গোপন থাকবেন এবং এরপর তিনি পুনরায় জনসমক্ষে আবির্ভূত হবেন। 301

আমাদের বিশ্বাসমতে ,রজব মাসে সুফিয়ানীর আবির্ভাবের পর ইমাম মাহ্দী (আ.) যে আবির্ভূত হবেন এবং তখন থেকে মুহররম মাসে পুনরাবির্ভূত হওয়া পর্যন্ত তিনি গোপন থাকবেন -এতদ্ব্যতীত আর কোন ব্যাখ্যা এ রেওয়ায়েতের জন্য প্রযোজ্য নয়। তবে রেওয়ায়েতটি ইমাম মাহ্দীর আবির্ভাব কি রমযান মাসে আসমানী আহবান-ধ্বনির আগে না পরে হবে তা সুনির্দিষ্ট করে নি ।

ইমাম সাদিক (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে : আল কায়েম আল মাহ্দী ততক্ষণ আবির্ভূত হবে না যতক্ষণ না বারো ব্যক্তি তাকে দেখেছে বলে ঐকমত্য পোষণ করবে । কিন্তু তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করা হবে। 302

বাহ্যত মনে হচ্ছে যে ,তাঁরা সত্যবাদী হবেন ;কারণ ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সাক্ষাতের ব্যাপারে ঐকমত্যটা ইমাম বর্ণনা করেছেন এবং জনগণ যে তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করবে -এ ব্যাপারে তিনি আশ্চর্যান্বিত হয়েছেন। দৃশ্যত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সাথে তাঁদের সাক্ষাৎ ঐ সময়ে ঘটবে যখন ইমাম গোপনে থাকাবস্থায় আবির্ভূত হবেন যাতে করে ধীরে ধীরে তাঁর আবির্ভাবের বিষয়টি স্পষ্ট ও প্রকাশিত হয়ে যায় এবং অবশেষে তাঁর নাম ও স্মরণ উচ্চকিত হয় ;আর ঠিক তখনই তিনি (সমগ্র বিশ্ববাসীর সামনে) প্রকাশিত হবেন।

অতএব ,হযরত মাহ্দী (আ.) এ যুগসন্ধিক্ষণে নেতৃত্বের প্রায় পূর্ণাঙ্গ ভূমিকা পালন করবেন এবং ঐ সংবেদনশীল মুহূর্তে তিনি তাঁর দিক-নির্দেশনাসমূহের দ্বারা ক্ষেত্রপ্রস্তুতকারী ইয়েমেনী ও ইরানী সরকারদ্বয়কে পরিচালিত করবেন এবং সকল মুসলিম দেশে তিনি তাঁর সাথীদের সাথে যোগাযোগ করবেন যাঁরা হবেন মহান আল্লাহর ওলী।

এখন ,যাতে আমরা সংক্ষিপ্ত প্রকাশকালে ইমাম মাহ্দী (আ.) কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপগুলোর ব্যাপারে ধারণা লাভ করতে পারি সেজন্য আমরা তাঁর অন্তর্ধানকালের কর্মকাণ্ডসমূহ সংক্ষেপে উল্লেখ করব। কতিপয় রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে ,ইমাম মদীনা মুনাওওয়ারায় বসবাস এবং ত্রিশ জনের সাথে সাক্ষাৎ করবেন।

ইমাম সাদিক (আ.) থেকে বর্ণিত আছে : এ বিষয় অর্থাৎ ইসলামের অধিপতির (ইমাম মাহ্দীর) একটি অন্তর্ধান আছে এবং ঐ অন্তর্ধানকালে তাকে বাধ্য হয়েই নির্জন বাস করতে হবে। তার সর্বোত্তম বাসস্থান হবে মদীনা। সে সেখানে তার ত্রিশ জন সাথীর সাথে বসবাস করবে। আর তাদের উপস্থিতি ও সঙ্গদানের কারণে তার কোন দুশ্চিন্তা ,উৎকণ্ঠা ও অস্থিরতা থাকবে না। 303

একইভাবে আরো কতিপয় রেওয়ায়েতে বর্ণিত আছে যে ,ইমাম মাহ্দী (আ.) হযরত খিযির (আ.)-এর সাথে থাকবেন। এতদপ্রসঙ্গে ইমাম রেযা (আ.) বলেন : খিযির (আ.) যেহেতু আবে হায়াত পান করেছিলেন সেহেতু তিনি ইসরাফীলের সিঙ্গায় ফুঁ দেয়া পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করবেন না। তবে তিনি আমাদের কাছে আসেন এবং আমাদেরকে সালাম দেন ;আমরা তাঁর কণ্ঠ শুনি ,কিন্তু তাঁকে দেখি না। যখনই যে স্থানেই তাঁর নাম উচ্চারণ করা হবে তখন সেখানে তাঁর ওপর দরুদ ও সালাত প্রেরণ করা উচিত। তিনি হজ্ব মৌসুমে মক্কায় উপস্থিত হয়ে হজ্বের সকল (মানাসিক) আমল আঞ্জাম দেন। তিনি আরাফাতে অবস্থান করেন এবং মুমিনদের প্রার্থনা শেষে আমীন বলেন। মহান আল্লাহ্ খিযির (আ.)-এর মাধ্যমে আমাদের কায়েম আল মাহ্দীর একাকিত্বকে অন্তরঙ্গতা ও ঘনিষ্টতার এবং তার নিঃসঙ্গতাকে তার পাশে মিলন ,বন্ধুত্ব ও সখ্যতায় রূপান্তরিত করে দিয়েছেন। 304

পূর্ববর্তী রেওয়ায়েত থেকে দৃশ্যত মনে হয় যে ,ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর 30 জন সাথী সবসময় পরিবর্তিত হতে থাকবে। অর্থাৎ যখনই তাদের একজনের মৃত্যু হবে তখনই অন্য একজন তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবেন। যদিও এ সম্ভাবনাও আছে যে ,মহান আল্লাহ্ তাঁদের কারো জীবন খিযির (আ.) ও ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর মতো দীর্ঘায়িত করে দিতে পারেন। যে সব আবদাল -এর কথা ইমাম সাদিক (আ.) থেকে বর্ণিত 15 রজবের দোয়ায় বর্ণিত হয়েছে সম্ভবত তাঁরা হতে পারেন এ সব ব্যক্তি।

ইমাম সাদিক (আ.) মহানবী ও তাঁর আহলে বাইতের ওপর দরুদ ও সালাত প্রেরণের পর বলেছেন : হে আল্লাহ্! আপনার যোগ্য সৎকর্মশীল মুমিন ,মহৎ ব্যক্তি ,রোযাদার ,ইবাদতকারী ,নিষ্ঠাবান ,দুনিয়াত্যাগী ,চেষ্টা-সাধনাকারী এবং আপনার পথে সংগ্রামরত মুজাহিদদের ওপর দরুদ ও সালাত প্রেরণ করুন। 305

শক্তিশালী সম্ভাবনার ভিত্তিতে এ ত্রিশ জন অথবা ততোধিক সংখ্যক ব্যক্তি যাঁরা মহান আল্লাহর ওলী (বন্ধু) তাঁরা ইমাম মাহ্দী (আ.) অন্তর্ধানকালে যে সব পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন সেগুলোতে সক্রিয় ভূমিকা রাখবেন। বিভিন্ন রেওয়ায়েত থেকে প্রতীয়মান হয় যে ,ইমাম মাহ্দী (আ.) ব্যাপক কর্মকাণ্ড শুরু করবেন এবং বিভিন্ন দেশে আন্দোলন গড়ে তুলবেন অথবা তিনি কুঁড়ে ঘর ও প্রাসাদসহ সকল গৃহ ও স্থানে প্রবেশ এবং বাজারসমূহে চলাফেরা করবেন। তিনি প্রতি বছর হজ্বের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন... আর যেমনভাবে হযরত খিযির (আ.)-এর পদক্ষেপ ও কর্মকাণ্ডগুলোর রহস্য ও অন্তর্নিহিত দর্শন মূসা (আ.)-কে সেগুলো সম্পর্কে অবগত করার পরই কেবল তাঁর জন্য উন্মোচিত হয়েছিল তেমনি ইমাম মাহ্দীর অন্তর্ধানের রহস্যও কেবল তাঁর আবির্ভাব ও আত্মপ্রকাশের পরপরই উন্মোচিত হবে।

আবদুল্লাহ্ ইবনে ফযল বলেন : ইমাম সাদিক (আ.)-কে বলতে শুনেছি : ইসলামের অধিপতির (ইমাম মাহ্দীর) অবশ্যই একটি অন্তর্ধান আছে যা বাতিলপন্থীদেরকে সন্দেহের মধ্যে ফেলবে । আমি জিজ্ঞাসা করলাম : আপনার জন্য উৎসর্গীকৃত হই। কেন তা হবে ?তিনি বললেন : একটি বিশেষ কারণে যা তোমাদের কাছে বলার অনুমতি আমাদের নেই। আমি জিজ্ঞাসা করলাম : ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর অন্তর্ধানের রহস্য কী ?তিনি বললেন : ইমাম মাহ্দীর অন্তর্ধানের দর্শন মহান আল্লাহর পূর্ববর্তী হুজ্জাতদের (নবী ও তাঁদের উত্তরাধিকারীদের) অন্তর্ধান-দর্শনের অনুরূপ। যেমনভাবে হযরত খিযির (আ.)-এর পদক্ষেপ ও কর্মকাণ্ডসমূহের রহস্য অর্থাৎ নৌকা ছিদ্র করা ,একটি বালককে হত্যা করা এবং দেয়াল মেরামত ও পুনঃনির্মাণ ,হযরত মূসা (আ.)-এর কাছে খিযির (আ.) থেকে তাঁর বিচ্ছিন্ন হবার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত স্পষ্ট হয় নি ,ঠিক তেমনি ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর অন্তর্ধান-রহস্য কেবল তার আত্মপ্রকাশ ও আবির্ভাবের পরপরই স্পষ্ট বোধগম্য হবে। হে ফযলের পুত্র! এ বিষয়টি হচ্ছে মহান আল্লাহর অন্যতম ঐশী নির্দেশ ,তাঁর অন্যতম রহস্য এবং গায়েবী বিষয়াদির অন্তর্ভুক্ত...। আর যদি আমরা মহান আল্লাহকে প্রজ্ঞাময় বলে জানি ,তাহলে তাঁর সকল কর্মকেও অবশ্যই প্রাজ্ঞজনোচিত বলে গণ্য ও বিশ্বাস করতে হবে ,যদিও এগুলোর রহস্য আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। 306

মুহাম্মদ ইবনে উসমান উমরী থেকে বর্ণিত আছে যে ,তিনি বলেছেন : মহান আল্লাহর শপথ ,সাহিবুল আমর (ইমাম মাহ্দী) প্রতি বছর হজ্বের মৌসুমে উপস্থিত থাকেন ,জনতাকে প্রত্যক্ষ করেন এবং তাদেরকে চিনেন। কিন্তু জনতা তাঁকে দেখা সত্ত্বেও চিনতে পারে না। 307

ইমাম সাদিক (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন : মহান আল্লাহ্ হযরত ইউসুফ (আ.)-এর ব্যাপারে যে কাজ আঞ্জাম দিয়েছিলেন তা তিনি তাঁর (সর্বশেষ) হুজ্জাতের (ইমাম মাহ্দীর) ক্ষেত্রে যে আঞ্জাম দেবেন -তা কিভাবে (মুসলিম) উম্মাহ্ অস্বীকার করবে ?সে তাদের হাট-বাজারসমূহে চলাফেরা করবে এবং তাদের কার্পেটের ওপর পা রাখবে ,অথচ মহান আল্লাহ্ যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের সামনে তার পরিচয় প্রকাশ করার অনুমতি না দেবেন ততক্ষণ পর্যন্ত তারা তাকে চিনতে পারবে না। যেভাবে তিনি হযরত ইউসুফ (আ.)-কে অনুমতি দিয়েছিলেন ,এ ব্যাপারটিও তেমন হবে। যখন তিনি (ইউসুফ) বললেন : তোমরা কি জান যে ,ইউসুফ ও তার ভাইয়ের সাথে কেমন আচরণ করেছিলে এবং তাদেরকে কী ধরনের বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছিলে ,অথচ তখন তোমরা অসচেতন ছিলে। তখন ভাইয়েরা বলেছিল : তুমিই কি ইউসুফ ?তিনি বলেছিলেন : হ্যাঁ ,আমি ইউসুফ এবং এও আমার ভাই। 308

এ সব রেওয়ায়েত এবং এতদসদৃশ অন্যান্য রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে বলা যায় যে ,অন্তর্ধানকালে ইমামের অবস্থা ইউসুফ (আ.)-এর অবস্থা সদৃশ হবে। তাঁর আচরণ হবে ইউসুফ (আ.)-এর আচরণ সদৃশ। পবিত্র কোরআন এ সব আশ্চর্যজক বিষয়াদির খানিকটা আমাদের কাছে প্রকাশ করেছে ও তুলে ধরেছে। এমনকি এ সব রেওয়ায়েত ও হাদীস থেকে প্রতীয়মান হয় যে ,হযরত মাহ্দী ও হযরত খিযির (আ.) একত্রে বসবাস এবং একে অপরকে সাহায্য-সহযোগিতা করেন।

অবশ্য আমাদের এ কথা বলাই উত্তম যে ,হযরত মাহ্দী (আ.)-এর অধিকাংশ পদক্ষেপ তাঁর সুযোগ্য সঙ্গী-সাথী ও শিষ্যদের হাতে বাস্তবায়িত হবে। যে সব ব্যক্তি পৃথিবী এবং দূরত্বসমূহ অতি দ্রুত অতিক্রম করেন এবং মহান আল্লাহ্ যাঁদেরকে তাঁদের ঈমান এবং হযরত মাহ্দীর শিক্ষার মাধ্যমে হেদায়েত করেন ,বরং যাঁদের কারামতসমূহ ,যেমন পানির ওপর হাঁটা ,পায়ে হেঁটে নিমিষে পৃথিবী প্রদক্ষিণ ইত্যাদি সংক্রান্ত বেশ কিছু বিশ্বাসযোগ্য কাহিনী ও রেওয়ায়েত ,এমনকি মহান আল্লাহর ওলী এবং যোগ্য বান্দাদের চেয়েও যাঁরা নিম্নতর আধ্যাত্মিক মর্যাদার অধিকারী তাঁদের ক্ষেত্রেও এ সব কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।

তবে মহান আল্লাহ্ ছোট-বড় যাবতীয় ঘটনা ও বিষয় এগুলোর নিজস্ব কারণসমূহের মাধ্যমে সংঘটিত করান। তবে এ সব কার্যকারণ তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন এবং তিনি যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে তাঁর যে কোন বান্দা অথবা ফেরেশতার মাধ্যমে এগুলো বাস্তবায়ন করেন। বহু ঘটনা ও বিষয় যেগুলো আমাদের কাছে মনে হয় যে ,স্বাভাবিক প্রাকৃতিক কারণসমূহের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে যদি সেগুলোর প্রকৃত অবস্থা আমাদের কাছে প্রকাশিত হয় তাহলে আমরা সেগুলোর সংঘটনের ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর গায়েবী হাত (ঐশ্বরিক কারণ) ক্রিয়াশীল দেখতে পাব।

তাই অত্যাচারী শাসকের প্রেরিত ব্যক্তি যখন যে নৌকাটি হযরত খিযির (আ.) ফুটো করে দিয়েছিলেন তা জোর করে নেয়ার ইচ্ছা করে তখন সে তা ক্রটিযুক্ত দেখে ছেড়ে দেয়। অথচ সে ঐ অবস্থায় এ বিষয়ে যে গায়েবী হস্তক্ষেপ ছিল তা মোটেও বুঝতে পারে নি।

একইভাবে ঐ বালকটির পিতা-মাতা যখন ঈমান সহকারে জীবন যাপন এবং মহান আল্লাহ্ ইচ্ছা ও নির্দেশ পালন করেছে তখন বোঝা যায় নি যে ,তাদের এ পুত্র-সন্তান যদি জীবিত থাকে তাহলে তাদেরকে কুফর ও খোদাদ্রোহিতার দিকে টেনে নিয়ে যাবে এবং তাদেরকে ধ্বংস করে দেবে।

আর যখন ইয়াতীম ভ্রাতৃদ্বয় প্রাপ্তবয়স্ক হবে এবং দেয়ালের নিচে সংরক্ষিত তাদের গুপ্তধন খুঁজে পেয়ে বের করে আনবে তখনও তারা জানতে পারবে না যে ,যদি হযরত খিযির (আ.) ঐ প্রাচীরটি মেরামত না করতেন তাহলে উক্ত গুপ্তধন প্রকাশিত হয়ে যেত অথবা এর সংরক্ষণ করার স্থান ধ্বংস হয়ে যেত।

আর এ তিনটি ঘটনা যেগুলো মহান আল্লাহ্ তাঁর গ্রন্থ আল কোরআনে উল্লেখ করেছেন সেগুলো যদি খিযির (আ.) মূসা (আ.)-এর সাথে যে গুটিকতক মুহূর্ত কাটিয়েছিলেন সেই সময় তাঁর দ্বারা সংঘটিত হয়ে থাকে তাহলে যে সব অগণিত বিষয় তিনি তাঁর দীর্ঘ আয়ুস্কালে তাঁর কর্মবহুল দিবসগুলোতে আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন সেগুলো নিয়ে আমাদের অবশ্যই ভেবে দেখা উচিত।

মহানবী (সা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে : মহান আল্লাহ্ আমার ভাই মূসা (আ.)-এর ওপর দয়া করুন। তিনি ঐ জ্ঞানী ব্যক্তির (হযরত খিযিরের) সাথে ত্বরা করেছিলেন। কিন্তু তিনি যদি ধৈর্য ধারণ করতেন তাহলে তাঁর কাছ থেকে এমন সব আশ্চর্য্যজনক বিষয় প্রত্যক্ষ করতেন যা তিনি কখনো দেখেন নি। 309

একইভাবে অন্তর্ধানকালে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর কর্মকাণ্ড নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা উচিত। আর তিনি সকল ইসলামী রেওয়ায়েত অনুসারে হযরত খিযির (আ.)-এর চেয়েও মহান আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদাবান। কারণ ,তিনি ঐ সাত ব্যক্তির অন্তর্ভুক্ত যাদের ব্যাপারে বর্ণিত হয়েছে যে ,তাঁরা সকল বেহেশতবাসীর নেতা এবং পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। মহানবী (সা.) বলেছেন : আমরা আবদুল মুত্তালিবের সাত বংশধর ,বেহেশ্তবাসীদের নেতা। এ সাত জন স্বয়ং আমি ,হামযাহ্ ,আলী ,জাফর ,হাসান ,হুসাইন এবং মাহ্দী। 310

হযরত কায়েম আল মাহ্দী (আ.) ,তাঁর সহকারী খিযির (আ.) ও তাঁর সাথীরা এবং তাঁদের শিষ্য মহান আল্লাহর ওলীরা বিশ্বব্যাপী যে সব কাজ আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন এবং যে সব ছোট-বড় ঘটনা ঘটাচ্ছেন সেগুলো সম্পর্কে কেবল মহান আল্লাহ্ই অবগত আছেন।

তবে তাঁদের অন্তর্ধান এবং কার্যকলাপের অন্তর্নিহিত কারণ প্রকাশিত না হওয়াই স্বাভাবিক। এগুলোর রহস্য কেবল তাঁদের আবির্ভাবের পরই প্রকাশ পাবে। আর আমাদের যুগে অথবা পূর্ববর্তী যুগগুলোতে তাঁরা যে সব কাজ সম্পাদন করেছেন সেগুলোর গুটিকতক যদি তাঁরা নিজেরাই প্রকাশ করেন তাহলে তখনই কেবল সেগুলোর অন্তর্নিহিত রহস্য উদ্ঘাটিত হবে। ইতিহাসের গতিধারা এবং বড় বড় ঐতিহাসিক ঘটনার কথা বাদ দিলেও আমাদের মধ্য থেকে অনেকেই তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনে বিশেষ কোন ক্ষেত্রে বা ক্ষেত্রসমূহে এসব পুণ্যাত্মাদের হতে সাহায্য পেয়েছেন।

এখানে একটি বিষয়ে লক্ষ্য রাখা আবশ্যক। আর তা হলো মহান আল্লাহর গায়েব এবং ইমাম মাহ্দী (আ.) ,হযরত খিযির (আ.) ও আবদালদের (পুণ্যবান মুমিনদের) কর্মকাণ্ড সংক্রান্ত বিশ্বাস কুতুব ও পুণ্যবান ওলীদের ব্যাপারে সূফিদের বিশ্বাস ,দৃষ্টিভঙ্গি ও ধারণা হতে ভিন্ন যদিও কোন কোন ক্ষেত্রে এদের মধ্যে সাদৃশ্য বিদ্যমান। যদিও কতিপয় সূফী তাঁদের মত ও বিশ্বাস ইমাম মাহ্দী (আ.) ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের ওপর প্রয়োগ করার চেষ্টাও করেছেন।

আল কাফআমী (রহ.) মিসবাহ্ গ্রন্থের পাদটীকায় সাফীনাতুল বিহার গ্রন্থে যেমন বর্ণিত হয়েছে তদ্রূপ কাতাবা ( قطب ) ধাতু প্রসঙ্গে বলেছেন : বলা হয়েছে যে ,পৃথিবী একজন কুতুব ( قطب ) ,চার ওয়াতাদ ( وتد ) ,চল্লিশ বাদাল ( بدل ) ,সত্তর নাজীব ( نجيب ) এবং তিনশ ষাট সৎকর্মশীল ( صالح ) বান্দাবিহীন হয় না (অর্থাৎ ইহলৌকিক জীবন ও জগতের স্থায়িত্বের জন্য এসব আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বের সব সময় ও সার্বক্ষণিক উপস্থিতি আবশ্যক। এর অন্যথা হলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে)। তাই কুতুব হচ্ছেন মাহ্দী (আ.) এবং ওয়াতাদরা (দীনের স্থায়িত্বদানকারী) কখনোই চার জনের কম হন না। কারণ ,এ ইহজগৎ হচ্ছে তাঁবুসদৃশ। মাহ্দী (আ.) হচ্ছেন তার খুঁটি বা স্তম্ভ সদৃশ ;আর উক্ত চার ওয়াতাদ্ হচ্ছেন এর রশি। তবে কখনো কখনো ওয়াতাদদের সংখ্যা চারের বেশিও হতে পারে। আবদালদের সংখ্যা চল্লিশের ঊর্ধ্বে । নাজীবরা সত্তরের অধিক। সৎকর্মশীলদের সংখ্যা তিনশ ষাট জনেরও বেশি। আর হযরত খিযির (আ.) ও হযরত ইলিয়াস (আ.) ওয়াতাদদের অন্তর্ভুক্ত এবং তাঁরা দু জন সবসময় কুতুবের চার পাশে অবস্থান করেন।

ওয়াতাদদের (বহুবচন আওতাদ) বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে ,তাঁরা এক মুহূর্তের জন্যও মহান আল্লাহর ব্যাপারে গাফেল (অমনোযোগী) হন না। তাঁরা এ পৃথিবী ও পার্থিব জীবন থেকে যতটুকু প্রয়োজন কেবল ততটুকু গ্রহণ করেন। তাঁরা সাধারণ মানুষের মতো পদস্খলিত হন না অর্থাৎ কোন পাপ তাঁদের দ্বারা সংঘটিত হয় না। যদিও তাঁদের ক্ষেত্রে নিষ্পাপ হওয়া শর্ত নয়। কিন্তু নিষ্পাপ হওয়া কুতুবের ক্ষেত্রে আবশ্যক।

তবে আবদালগণের মর্তবা ওয়াতাদদের চেয়ে নিচে। তাঁরা কখনো কখনো মহান আল্লাহর ব্যাপারে অমনোযোগী হতে পারেন। কিন্তু কখনো এরূপ হলে তাঁরা যিকির (স্মরণ) করার দ্বারা তা পুষিয়ে নেন। তাঁরা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে পাপ করেন না।

আর সৎকর্মশীল বান্দারা হচ্ছেন পরহেজগার বান্দা যাঁরা ন্যায়পরায়ণ। তাঁদের দ্বারা কখনো পাপ সংঘটিত হতে পারে। তবে এরূপ হলে তাঁরাও অনুতাপ-পরিতাপের দ্বারা তা পুষিয়ে নেন। মহান আল্লাহ্ বলেছেন :

) إنّ الّذين اتّقوا إذا مسّهم طائف من الشّيطان تذكّروا فإذا هم مبصرون (

নিশ্চয়ই যারা তাকওয়া-পরহেজগারী অবলম্বন করেছে ,যখন তাদেরকে একদল শয়তান স্পর্শ করে (শয়তানদের প্ররোচনায় পাপ করে ফেলে) তখন তারা (সাথে সাথে) মহান আল্লাহকে স্মরণ করে। কারণ ,তারা চাক্ষুষমান ও অন্তর্দৃষ্টি শক্তিসম্পন্ন।

এরপর কাফআসী (রহ.) উল্লেখ করেছেন যে ,উপরিউক্ত পর্যায়সমূহের মধ্য থেকে যে কোন একটি পর্যায়ে সংখ্যা হ্রাস পেলে ঠিক এর নিম্নের পর্যায় হতে কেউ তার স্থলাভিষিক্ত হয়। সৎকর্মশীল বান্দাদের সংখ্যা হ্রাস পেলে সাধারণ মানুষদের মধ্য থেকে কোন ব্যক্তি তখন সৎকর্মশীল বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় (যার ফলে সৎকর্মশীল বান্দাদের সংখ্যা তিনশ ষাট সবসময় ধ্রুব থাকে। আর সাধারণ মানুষের কাতার থেকে ঐ ব্যক্তি সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হবে যে অন্য সকলের চেয়ে অধিক পরহেজগার ও সৎ)।

মহান আল্লাহর নবী ইলিয়াস (আ.) সম্পর্কে এবং তিনি যে ঐ সব জীবিত ব্যক্তির অন্তর্ভুক্ত যাঁদের জীবনকে মহান আল্লাহ্ তাঁর জানা কোন অন্তর্নিহিত প্রজ্ঞা বলে দীর্ঘায়িত করেছেন -এতৎসংক্রান্ত তিনি যা উল্লেখ করেছেন তা আসলে ইলিয়াস (আ.) সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে যে সব আয়াত বিদ্যমান সেগুলোর ব্যাখ্যা সংক্রান্ত কতিপয় মুফাসসিরের অভিমতেরই অনুরূপ। আর এ বিষয়টি আহলে বাইত থেকেও বর্ণিত হয়েছে। তাঁদের থেকে আরো বর্ণিত হয়েছে যে ,হযরত খিযির (আ.)-এর মতো মহান আল্লাহ্ তাঁর জীবন দীর্ঘায়িত করেছেন এবং তাঁরা প্রতি বছর আরাফাত ও অন্যান্য স্থানে মিলিত হন।

যা হোক ,রেওয়ায়েত ও হাদীসসমূহ থেকে যা বোঝা যায় তা হচ্ছে ,সুফিয়ানীর আবির্ভাব ও অভ্যুত্থান এবং আসমানী গায়েবী আহবান-ধ্বনি থেকে মুহররম মাসে তাঁর (ইমাম মাহ্দী) আবির্ভাব পর্যন্ত এ ছয় মাস কাল ইমাম মাহ্দী এবং তাঁর সঙ্গীদের কর্মকাণ্ড দিয়ে ভরপুর থাকবে। তাঁদের হাতে এবং তাঁদের সাথে যারা সংশ্লিষ্ট থাকবে তাদের হাতে জনগণের সামনে বহু কারামত ও অলৌকিক নিদর্শন প্রকাশ পেতে থাকবে। আর এটি তখন এক আন্তর্জাতিক মহা ঘটনায় পরিণত হবে যা সকল মানুষ ও রাষ্ট্রকে সমভাবে ব্যস্ত রাখবে।

তবে মুসলিম জাতিসমূহ সবসময় ইমাম মাহ্দী ,তাঁর কারামতসমূহ এবং তাঁর আবির্ভাবকাল অত্যাসন্ন হবার ব্যাপারে আলোচনা করতে থাকবে। আর এটি হবে তাঁর আবির্ভাবের জন্য একটি উপযুক্ত ক্ষেত্রস্বরূপ।

তবে ঐ সময়কালটি মিথ্যাবাদী ও ভণ্ডদের জন্য মাহ্দী হবার মিথ্যা দাবী এবং মানুষকে পথভ্রষ্ট করার উর্বর ক্ষেত্রও হবে। রেওয়ায়েতসমূহে বর্ণিত হয়েছে যে ,ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের আগে মাহ্দী হবার মিথ্যা দাবী নিয়ে বারোটি পতাকা উত্তোলিত হবে। আবু তালিবের বংশধর বারো ব্যক্তির প্রত্যেকেই একটি করে পতাকা উত্তোলন করে জনগণকে নিজেদের দিকে আহবান জানাবে (অর্থাৎ নিজেদেরকে মাহ্দী বলে দাবী করবে)। এ সব পতাকা হবে পথভ্রষ্টতার পতাকা এবং ইমাম মাহ্দীর আবির্ভাবের জন্য অপেক্ষমান বিশ্বকে (বিশেষ করে মুসলিম জাতিসমূহকে) নিজেদের হীন স্বার্থে ব্যবহার করার পার্থিব অপচেষ্টাস্বরূপ।

মুফাযযাল ইবনে আমর আল জু ফী ইমাম জাফর সাদিক (আ.) থেকে বর্ণনা করেছেন : আমি তাঁকে বলতে শুনেছি : তার (মাহ্দী) নাম উচ্চারণ করার ব্যাপারে তোমাদেরকে সতর্ক করে দিচ্ছি। মহান আল্লাহর শপথ ,তোমার ইমাম অবশ্যই দীর্ঘকাল তোমাদের দৃষ্টির অন্তরালে (গায়েব) থাকবেন যার ফলে বলা হতে থাকবে যে ,তিনি মারা গেছেন অথবা ধ্বংস হয়ে গেছেন অথবা তিনি কোথায় যে চলে গেছেন! (আর এভাবে তোমরা অবশ্য অবশ্যই পরীক্ষিত হতে থাকবে)। তার বিচ্ছেদের বেদনায় মুমিনদের নয়ন থেকে অশ্রু ঝরতে থাকবে। যেমনভাবে ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ সাগরের তরঙ্গমালায় জাহাজ ও তরী উল্টে গিয়ে নিমজ্জিত হয় তেমনি তোমরাও ধরাশায়ী হতে থাকবে। যে ব্যক্তির কাছ থেকে মহান আল্লাহ্ প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছেন ,যার হৃদয়ে ঈমান লিখে দিয়েছেন এবং নিজের পক্ষ থেকে রূহ দ্বারা যাকে সাহায্য করেছেন সে ব্যতীত আর কেউই মুক্তি পাবে না। আর তখন বারোটি অনুরূপ পতাকা উত্তোলিত হবে যার একটি থেকে আরেকটিকে পৃথক করা যাবে না।

মুফাযযাল বলেন : অতঃপর আমি কাঁদলাম। তিনি আমাকে বললেন : হে আবু আবদিল্লাহ্! তুমি কেন কাঁদছ ?আমি বললাম : কেমন করে আমি না কেঁদে থাকতে পারি যখন আপনিই বলছেন যে ,বারোটি পতাকা উত্তোলিত হবে অথচ সেগুলোর একটিকে আরেকটি থেকে পৃথক করা যাবে না ?তখন আমরা কী করতে পারব ?ইমাম তখন বারান্দার ভিতরে আলোদানকারী আলোকোজ্জ্বল সূর্যের দিকে তাকিয়ে বললেন : হে আবু আবদিল্লাহ্! তুমি কি এ সূর্যটি দেখতে পাচ্ছ ?আমি বললাম : জী ,হ্যাঁ। তখন তিনি বললেন : মহান আল্লাহর শপথ ,আমাদের কিয়ামকারীর অবস্থা এ সূর্যের চেয়েও স্পষ্ট ও অধিকতর উজ্জ্বল। 311

অর্থাৎ যারা মাহ্দী হবার মিথ্যা দাবী করবে তাদের কারণে ইমাম মাহ্দীর বিষয় তোমাদের কাছে অস্পষ্ট ও বোধগম্য না হবার ভয় তোমরা করো না। কারণ ,তার মর্যাদা আবির্ভাবের আগে এবং আবির্ভাবের সময়ে তার নিদর্শনাদি এবং অতুলনীয় ব্যক্তিত্বের কারণে উজ্জ্বল সূর্যের চেয়েও উজ্জ্বল ও স্পষ্ট হবে। উল্লেখ্য যে ,মিথ্যাবাদী ও ভণ্ডদের সাথে তাঁর ব্যক্তিত্বের কোন তুলনাই চলে না।

আরেকদিকে তাঁর আবির্ভাবের ক্ষেত্র প্রস্তুতকারী ইয়েমেনী ও ইরানী সরকার আন্তর্জাতিক ঘটনা প্রবাহ এবং বিশ্বের জাতিসমূহকে জাগ্রত করার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ভূমিকা গ্রহণ করতে থাকবে। আর এ কারণে ,এ দু রাষ্ট্র ইমাম মাহ্দীর দিক নির্দেশনার প্রতি আগের চেয়ে আরো বেশি মুখাপেক্ষী হবে।

এছাড়াও রেওয়ায়েত ও বাহ্যিক অবস্থাসমূহ থেকে বোঝা যায় যে ,ইমাম মাহ্দীর অনুকূলে বিশ্বব্যাপী গণজোয়ারের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া তাঁর শত্রুদের পক্ষ থেকে ,বিশেষ করে বিশ্ব-কুফরী চক্রের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ এবং তাদের সহযোগী সুফিয়ানীর পক্ষ থেকে প্রদর্শিত হবে। রেওয়ায়েতসমূহের ভাষ্য আনুসারে এ এলাকা (মধ্যপ্রাচ্য) অস্থিতিশীল ও স্পর্শকাতর অঞ্চল হবার কারণে ইরাক ও হিজাযের সার্বিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করার কাজে তারা নিয়োজিত থাকবে। বিশেষ করে এ দুটি দেশ তখন মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে দুর্বল দেশ বলে গণ্য হবে ।

বিধায় একদিকে তারা (ইমাম মাহ্দীর শত্রুপক্ষ) ইরাকে আবির্ভাবের ক্ষেত্র প্রস্তুতকারী ইরানীদের প্রভাব বৃদ্ধি এবং সে দেশের সরকারের দুর্বল হবার ব্যাপারে শংকিত হয়ে পড়বে।

আবার অন্যদিকে তারা হিজাযেও এক রাজনৈতিক শূন্যাবস্থা ,কর্তৃত্ব ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে গোত্রীয় সংঘাত এবং সেখানে আবির্ভাবের ক্ষেত্র প্রস্তুতকারী ইয়েমেনীদের প্রভাব-প্রতিপত্তির সম্মুখীন হবে। হিজাযে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হবে সমগু মুসলিম বিশ্বের দৃষ্টি সে দেশের দিকে নিবদ্ধ থাকবে। সকলেই সেখান থেকে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের অপেক্ষা করবে। তখন সবার মাঝে প্রচারিত হয়ে যাবে যে ,তিনি মদীনা শরীফে অবস্থান করছেন। আর পবিত্র মক্কা নগরী থেকে তাঁর আন্দোলনের শুভ সূত্রপাত হবে। তাই শত্রুদের ইমাম মাহ্দী (আ.) বিরোধী যাবতীয় রাজনৈতিক ও সমরিক তৎপরতা পবিত্র মক্কা ও মদীনাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে থাকবে। আর সুফিয়ানী পবিত্র মদীনার ওপর সামরিক আক্রমণ শুরু করবে এবং ইমাম মাহ্দী মদীনায় বনি হাশিমের মধ্যে আত্মগোপন করে আছেন -এ সন্দেহে ব্যাপক হারে তাদের বন্দী করবে।

এ এলাকার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গুরুত্ব থাকার কারণে ইরাক ও হিজাযে সুফিয়ানী বাহিনীর অনুপ্রবেশ ও আগ্রাসনের সাথে সাথে পারস্যোপসাগর ও ভূ-মধ্যসাগরে প্রাচ্য ও পাশ্চত্যের সামরিক বাহিনীও উপস্থিত হবে।

সবচেয়ে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয় হচ্ছে ঐ সময় অথবা এর কাছাকাছি সময় রামাল্লায় রোমের সেনাবাহিনী (পাশ্চাত্য বাহিনী) এবং জাযীরা অঞ্চলে তুর্কী (রুশ বা প্রাচ্য) বাহিনীর আগমন। আর এ বিষয়টি বেশ কয়কটি রেওয়ায়েতেও বর্ণিত হয়েছে।

হিজাযে প্রশাসনিক সংকট

শিয়া-সুন্নী হাদীস গ্রন্থ ও সূত্র সমূহে ঐকমত্য আছে যে ,হিজাযে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের শুভ সূচনা সেদেশে রাজনৈতিক শূন্যতা ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে গোত্রসমূহের মধ্যকার অন্তর্দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের উৎপত্তির মাধ্যমে সংঘটিত হবে।

আর একজন বাদশাহ অথবা খলীফার মৃত্যুর মাধ্যমে তা সংঘটিত হবে। তার মৃত্যুর মাধ্যমে মহামুক্তি বাস্তবায়িত হবে। কতিপয় রেওয়ায়েতে উক্ত বাদশাহ বা খলীফার নাম আবদুল্লাহ্ হবে বলা হয়েছে। আবার কতিপয় রেওয়ায়েতে আরাফাত দিবসে (9 যিলহজ্ব) তার মৃত্যু সংবাদ ঘোষণা করার বিষয়টি স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। তার মৃত্যুর পর থেকে সুফিয়ানীর আবির্ভাব ও অভ্যুত্থান ,আসমানী গায়েবী আহবান ,হিজাযে সামরিক হস্তক্ষেপ করার জন্য সিরীয় বাহিনীকে আমন্ত্রণ জানান এবং এরপর ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাব পর্যন্ত হিজাযে ঘটনাবলী একের এর এক ঘটতে থাকবে ।

ইমাম সাদিক (আ.) থেকে বর্ণিত : যে আমাকে আবদুল্লাহর মৃত্যু নিশ্চিত করবে আমি তাকে আল কায়েম আল মাহ্দীর আবির্ভাব সম্পর্কে নিশ্চয়তা প্রদান করব। এরপর তিনি বললেন : আবদুল্লাহর মৃত্যুর পর আর কোন ব্যক্তির ব্যাপারে জনগণ একমত হতে পারবে না (অর্থাৎ আর কেউ স্থায়ীভাবে হিজাযে শাসন ও রাজত্ব করতে পারবে না)। মহান আল্লাহ্ চাইলে তোমাদের নেতা (মাহ্দী) ব্যতীত এ বিষয়ের নিষ্পত্তি হবে না। বছরের পর বছর ধরে এক ব্যক্তির রাজ্য শাসনের দিন গত হবে এবং কয়েক মাস বা কয়েক দিনের শাসন ও রাজত্বের পালা আসবে। আমি (রাবী) বললাম : সেটাও কি দীর্ঘস্থায়ী হবে ?তিনি বললেন : না। 312

তাঁর থেকে বর্ণিত আছে : জনগণ (হাজীরা) যখন (9 যিলহজ্ব ,হজ্ব পালনের জন্য) আরাফাতের ময়দানে অবস্থান (উকূফ) করতে থাকবে তখন তাদের কাছে একটি শীর্ণ ও দ্রুত গতিসম্পন্ন উটের পিঠে আরোহণ করে এক ব্যক্তি এসে তাদেরকে একজন খলীফার মৃত্যু সংবাদ দেবে। তার মৃত্যুর মাধ্যমে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আহলে বাইত এবং মানব জাতির মহামুক্তি বাস্তবায়িত হবে। 313

রেওয়ায়েতে বর্ণিত النّاقة الذّعبلة এর অর্থ হচ্ছে দ্রুত গতিসম্পন্ন শীর্ণ উটনী। আর এটি হচ্ছে অতি দ্রুত সংবাদ পৌঁছানো এবং হাজীদেরকে সুসংবাদ প্রদান করার প্রতি ইঙ্গিতবহ। আর বাহ্যত প্রতীয়মান হয় যে ,সংবাদ জ্ঞাপন প্রক্রিয়াটিই হচ্ছে রেওয়ায়েতের কাঙ্ক্ষিত বিষয়। আরেকটি রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে ,শীর্ণ ও দ্রুত গতিসম্পন্ন উটনীর আরোহীকে হত্যা করা হবে যে আরাফাতের ময়দানে হাজীদের মাঝে এ সংবাদটি প্রচার করবে।

এ খলীফা যার মৃত্যু অথবা হত্যার সংবাদ আরাফাত দিবসে ঘোষণা করা হবে সে পূর্বোক্ত রেওয়ায়েতে উল্লিখিত বাদশাহ্ আবদুল্লাহ্ও হতে পারে। আর বছরের পর বছর ধরে রাজ্য শাসনের দিন গত হবে এবং কয়েক মাস বা কয়েক দিনের শাসন ও রাজত্বের পালা আসবে -এ কথার অর্থ হচ্ছে তার (আবদুল্লাহর) পর যাকেই শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হবে সে পূর্ণ এক বছর টিকে থাকতে পারবে না। কয়েক মাস বা কয়েক দিন গত না হতেই তাকে অপসারণ করে আরেক ব্যক্তিকে শাসনকর্তৃত্ব দেয়া হবে। আর এ অবস্থা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবকাল পর্যন্ত চলতে থাকবে।

কতিপয় রেওয়ায়েতে উল্লিখিত হয়েছে যে ,উক্ত বাদশাহ্ চারিত্রিক ও নৈতিক (চরিত্রহীন ও সমকামী হওয়ার) কারণে নিহত হবে এবং তাকে তারই এক ভৃত্য হত্যা করবে। আর হত্যাকারী হিজাযের বাইরে পালিয়ে যাবে। তার খোঁজে নিহত বাদশার নিকটবর্তী কিছু লোক (নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা) দেশের বাইরে যাবে এবং তাদের দেশে প্রত্যাবর্তন করার আগেই ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে সেখানে দ্বন্দ্ব-সংঘাত শুরু হয়ে যাবে।

ইমাম বাকির (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে : তার (বাদশাহ্) হত্যার কারণ হবে তারই এক নপুংসক ভৃত্যকে তার বিয়ে করা। আর সে তাকে জবাই করে হত্যা করবে এবং চল্লিশ দিন তার মৃত্যুর খবর গোপন রাখবে। অতঃপর ঐ পলাতক নপুংসকের খোঁজে যখন অশ্বরোহীরা (বিদেশ) যাত্রা করবে তখন তাদের রাজত্ব ও শাসন ধ্বংস হওয়া পর্যন্ত যারা তার সন্ধানে প্রথমে বের হবে তারা দেশে প্রত্যাবর্তন করবে না। 314

এ বাদশার হত্যাকাণ্ডের পর হিজাযে ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কথা যে সব রেওয়ায়েতে উল্লিখিত হয়েছে সেগুলোর সংখ্যা অগণিত। আমরা এখানে কয়েকটি রেওয়ায়েত নমূনাস্বরূপ উল্লেখ করছি :

বাযান্তী ইমাম রেয়া (আ.) থেকে বর্ণনা করেছেন : তিনি বলেছেন : নিশ্চয়ই মহামুক্তির নিদর্শনসমূহের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে একটি ঘটনা যা দুই হারামের মাঝখানে সংঘটিত হবে। আমি বললাম : ঐ ঘটনা কী হবে ?তখন তিনি বললেন : দুই হারামের মাঝখানে গোত্রীয় গোঁড়ামী ও সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব হবে। অমুক বংশীয় অমুক ব্যক্তি পনেরটি ভেড়া হত্যা করবে। 315 অর্থাৎ এক জন রাজা বা গোত্রপতি অপর কোন প্রসিদ্ধ রাজা বা গোত্রপতির বংশধরদের মধ্য থেকে পনের ব্যক্তিকে হত্যা করবে।

আবু বসীর থেকে বর্ণিত : আমি হযরত আবু আবদিল্লাহ্ (আ.)-কে (ইমাম সাদিক) বললাম : আবু জাফর (আ.) অর্থাৎ ইমাম বাকির কি বলতেন হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আহলে বাইতের কায়েম (মাহ্দী)-এর দু টি অন্তর্ধান আছে ,সেগুলোর একটি অপরটির চেয়ে দীর্ঘ ?তখন তিনি বললেন : হ্যাঁ। তবে মতভেদের কারণে অমুকের বংশধরদের তরবারি কোষমুক্ত হয়ে অবস্থা সংকীর্ণ হওয়া ,সুফিয়ানীর আবির্ভাব ,সংকট ও বিপদাপদ তীব্র আকার ধারণ করা ,ব্যাপক গণহত্যা যার ফলে মহান আল্লাহর হারাম (পবিত্র মক্কা নগরী) এবং রাসুলুল্লাহ্ (সা.)-এর হারামে (মদীনা শরীফ) জনগণের আশ্রয় নেয়া পর্যন্ত এ মহাঘটনা বাস্তবায়িত হবে না। 316

এ রেওয়ায়েত থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে ,হিজাযের কর্তৃত্বশীল গোত্রের মধ্যেই এ দ্বন্দ্বের সূচনা হবে।

আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) থেকে বর্ণিত আছে : এর (ইমাম মাহ্দীর আবির্ভাব ও বিপ্লবের) বেশ কিছু নিদর্শন আছে। এগুলোর প্রথমটি হচ্ছে পরিখা খনন ও ওঁৎ পাতার মাধ্যমে কুফা নগরী অবরুদ্ধ করা ,সর্ববৃহৎ মসজিদের চারপাশে পতাকাসমূহের পত্পত্ করে উড্ডীন হওয়া ,সেদিনের যুদ্ধের হত্যাকারী ও নিহত উভয়ই দোযখী হবে। 317

সর্ববৃহৎ মসজিদ বলতে মসজিদুল হারামকে বোঝানো হয়েছে এবং পবিত্র মক্কা নগরীর চারপাশে অথবা হিজাযে পতাকাবাহী গোষ্ঠী ও সেনাদলসমূহ পরস্পর সংঘর্ষে লিপ্ত হবে। আর সেগুলোর কোনটিই সত্যের পতাকা হবে না।

ইবনে হাম্মাদের হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপিতে (পৃ. 59) হিজাযের রাজনৈতিক সংকট সংক্রান্ত বিশটিরও অধিক রেওয়ায়েত বর্ণিত আছে। এ সব রেওয়ায়েতে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের বছরে শাসন-ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য গোত্রসমূহের মধ্যকার অন্তর্দ্বন্দ্ব ,সংঘাত ও সংঘর্ষের কথা বর্ণিত হয়েছে। এ সব রেওয়ায়েতের মধ্যে রয়েছে সাঈদ ইবনে মুসাইয়াব কর্তৃক বর্ণিত রেওয়ায়েতটি : মুসলিম উম্মাহর কাছে এমন  এক সময় (যুগ) আসবে যখন রমযান মাসে গায়েবী ধ্বনি শোনা যাবে। (রমযান পরবর্তী) শাওয়াল মাস তুলনামূলকভাবে শান্ত অবস্থা ও নীরবতার মধ্যেই অতিবাহিত হবে। কিন্তু যিলকদ মাসে গোত্রসমূহ একে অপরের প্রতি মৈত্রীসুলভ আচরণ ও বন্ধুত্ব প্রকাশ করবে। আর যিলহজ্ব মাসে হাজীদের সম্পদ লুণ্ঠিত হবে এবং (এর পরবর্তী) মুহররম মাস কেমন মুহররমই না হবে! আর তিনি এ কথা তিনবার উচ্চারণ করেন। 318

ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণিত। মহানবী (সা.) বলেছেন : যখন রমযান মাসে (আসমানী) গায়েবী ধ্বনি শোনা যাবে তখন শাওয়াল মাসে গোলযোগ দেখা দেবে। আর যিলকদ মাসে গোত্রসমূহে মতভেদ ও বিরোধ দেখা দেবে। যিলহজ্ব মাসে বক্তপাত হবে। আর এর পরবর্তী মুহররম কেমন মুহররমই না হবে! আর তিনি এ কথা তিনবার বললেন। 319

উক্ত গ্রন্থের 60 পৃষ্ঠায় আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর থেকে বর্ণিত : জনগণ এক সাথে হজ্ব করবে এবং নেতা ছাড়াই তারা আরাফাতের ময়দানে রওয়ানা হবে। যখন তারা মিনায় অবস্থান গ্রহণ করবে তখন তারা কুকুরের মতো একে অপরের ওপর অক্রমণ চালাবে। আর গোত্রসমূহ একে অপরের ওপর আক্রমণ চালিয়ে এতটা রক্তপাত করবে যে ,জামরা-ই আকাবাহ্ পর্যন্ত রক্তের বন্যা বয়ে যাবে। অর্থাৎ তাদের অবস্থা তখন ক্ষ্যাপা জলাতঙ্কগ্রস্ত কুকুরের অবস্থার মতো হয়ে যাবে। হজ্ব পালন করার পর তাদের মধ্যে শত্রুতা পুনরায় প্রকাশ পাবে এবং তারা পরস্পরকে হত্যা করতে থাকবে। অবস্থা এতদূর গড়াবে যে জামরা-ই আকাবার পাশ দিয়ে তাদের রক্ত প্রবাহিত হতে থাকবে।

ইবনে হাম্মাদের হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপিতে বর্ণিত এ সব রেওয়ায়েতে আসমানী গায়েবী আহবান ধ্বনির পরপরই হিজাযে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের উদ্ভব সম্পর্কে আলোচনা ও ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। তবে আরো কিছু রেওয়ায়েত আছে সেগুলোয় এ রাজনৈতিক সংকট প্রসঙ্গে আরো দু টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচিত হয়েছে।

এর প্রথমটি হচ্ছে সুফিয়ানীর আবির্ভাব ও অভ্যুত্থানের আগে এ সংকটের উৎপত্তি হবে ;আর আমরা ইতোমধ্যে এ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করেছি।

আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যকার মতবিরোধ অর্থাৎ প্রতিশ্রুত বিশ্বযুদ্ধের সাথে এ সংকটের উৎপত্তির একটা সম্পর্ক থাকবে। তাই ইবনে আবী ইয়াফূর থেকে বর্ণিত আছে : আমাকে আবু আবদিল্লাহ্ (ইমাম জাফর সাদিক) বলেছেন : নিজ হাতের আঙ্গুলগুলো গণনা কর। অমুকের ধ্বংস হওয়া ,সুফিয়ানীর আবির্ভাব ও অভ্যুত্থান এবং মানব হত্যা... অতঃপর তিনি বললেন : অমুকের ধ্বংস হওয়া ও নিহত হওয়ার মাধ্যমে মহামুক্তি পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হবে। 320

রেওয়ায়েতটিতে যে ধারাক্রমে এ ঘটনাগুলো বর্ণিত হয়েছে সেই ধারাক্রমে এগুলো সংঘটিত হওয়ার সময়কাল সম্পর্কে পর্যালোচনা ও বিতর্ক করা যেতে পারে। তবে কিছু সংখ্যক রেওয়ায়েত যেগুলোর কয়েকটি ইতোমধ্যে বর্ণিত হয়েছে সেগুলো থেকে প্রতীয়মান হয় যে ,সুফিয়ানীর আবির্ভাব ও অভ্যুত্থানের আগেই অমুকের হত্যা ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত শুরু হয়ে যাবে।

ইমাম বাকির (আ.) বলেছেন : আল কায়েম নয় ,এক ,তিন ,পাঁচ ইত্যাদির মতো বিজোড় সাল বা বছরে আবির্ভুত হবে । অতঃপর বনি আব্বাস (অমুকের বংশ) শাসন কর্তৃত্ব ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভ করবে এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে যখন তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার চরম শীর্ষে অবস্থান করতে এবং আরাম-আয়েশ ও বিলাসিতার মধ্যে নিমজ্জিত থাকবে তখনই তাদের মধ্যে মতবিরোধ শুরু হয়ে যাবে। (আর যেহেতু তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের উদ্ভব হবে সেহেতু) তাদের শাসনের পতন ঘটবে এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যেও মতবিরোধ দেখা দেবে । কিবলার অনুসারীরাও (মুসলিম উম্মাহ্) পরস্পর দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত হবে। মানব জাতি ভীত ও আতঙ্কগ্রস্ত হবার কারণে তীব্র দুঃখ-কষ্ট ও যাতনার সম্মুখীন হবে। আর আকাশ থেকে একজন আহবানকারীর আহবান পর্যন্ত জনগণ সর্বদা এ অবস্থার মধ্যেই থাকবে। তাই আহবানকারী যখন আহবান জানাবে তখন তোমরা হিজরত করতে থাকবে। 321

এ রেওয়ায়েতের উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে তা অমুক বংশের মধ্যকার মতবিরোধ ,দ্বন্দ্ব সংঘাত ও তাদের রাজত্বের পতন ,প্রাচ্য ও পশ্চাত্যের মধ্যকার বিরোধ এবং মুসলমানদেরকেও যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যকার বিরোধ গ্রাস করবে তার মধ্যে একটি যোগসূত্র স্থাপন করেছে। হিজাযে যে রাজনৈতিক সংকটের উদ্ভব হবে তার সাথে যেন এ আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সম্পর্ক থাকবে।

আর বনি আব্বাস যাদের মধ্যে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের কিছুকাল আগে মতবিরোধ ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত দেখা দেবে তাদের বলতে অমুকের বংশকে বোঝানো হয়েছে যাদের ব্যাপারে কতিপয় রেওয়ায়েতে উল্লিখিত হয়েছে যে ,তারা হবে ইমাম মাহ্দীর আগে হিজায শাসনকারী সর্বশেষ রাজবংশ।

হাদীসসমূহ থেকে গৃহীত ফলাফল হচ্ছে এই যে ,যে সব ঘটনা হিজাযে ইমাম মাহ্দীর আবির্ভাবের পূর্ব প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপস্বরূপ ঘটবে সেগুলোর ধারাক্রম হিজায অথবা পূর্ব দিকের কোন এক এলাকায় প্রকাণ্ড হলুদ-লাল অগ্নি প্রজ্বলনের মাধ্যমে শুরু হবে। আর ঐ আগুন বেশ কয়েকদিন ধরে প্রজ্বলিত থাকবে। এরপর অমুক বংশের শেষ বাদশাহ্ নিহত হবে এবং তার উত্তরাধিকারীর ব্যাপারে মতভেদ দেখা দেবে। আর এ মতভেদ হিজাযের রাজনৈতিক শক্তিসমূহের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে । আর এ সব রাজনৈতিক শক্তির শীর্ষে থাকবে সে দেশের গোত্রসমূহ। এরফলে শাসনকার্য পরিচালনা করার ক্ষেত্রে এমন এক রাজনৈতিক সংকট ও অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে যা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে বিশ্বযুদ্ধ বাঁধার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে।

এরপর সুফিয়ানীর আবির্ভাব ও অভ্যুত্থান ,আসমানী গায়েবী আহবান ধ্বনি ,এরপর হিজাযে সুফিয়ানী বাহিনীর অনুপ্রবেশ ,মদীনার ঘটনাবলী ও অতঃপর মক্কার ঘটনাসমূহ ধারাবাহিকভাবে ঘটতে থাকবে।

আহলে সুন্নাতের হাদীস গ্রন্থসমূহে বিদ্যমান বেশ কিছু হাদীসে হিজাযের এ আগুনের বিবরণ এসেছে। এ সব রেওয়ায়েতে উল্লিখিত হয়েছে যে ,তা হবে কিয়ামতের অন্যতম নিদর্শন। এগুলোর অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে সহীহ মুসলিমে বর্ণিত রেওয়ায়েত 322 । হিজাযে আগুনের উদ্ভব হওয়া পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবে না। এ আগুনের আলোয় বুসরায় অবস্থিত উটের গলা আলোকিত হবে অর্থাৎ এ আগুনের আলো সিরিয়ার বুসরা নগরী পর্যন্ত পৌঁছে যাবে।

এগুলোর মধ্য থেকে আরো কতিপয় হাদীস হাকিমের মুস্তাদারাকুস্ সহীহাইন গ্রন্থে 323 বিদ্যমান। এগুলোতে উল্লিখিত আছে যে ,এ আগুন জামাল আল ওয়াররাক অথবা হাব্স সাইল অথবা ওয়াদী হাসীল (হুসাইল) থেকে আবির্ভূত হবে। হাব্স সাইল পবিত্র মদীনা নগরীর অদূরে অবস্থিত একটি স্থানের নাম। তবে ওয়াদী হাসীল হাব্স সাইলের অপভ্রংশও হতে পারে (যা ভুলক্রমে লেখা হয়েছে)।

কতিপয় রেওয়ায়েতে উল্লিখিত আছে যে ,এ আগুন এডেনের হাদরামাউত থেকে আবির্ভূত হবে এবং তা মানুষকে হাশরের ময়দান অথবা পশ্চিমের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাবে ।

যেমনটি পরিদৃষ্ট হয় তাতে সহীহ মুসলিমের রেওয়ায়েতে তা দ্ব্যর্থহীনভাবে বর্ণিত হয় নি যে ,উক্ত আগুন কিয়ামত দিবসের অন্যতম আলামত। বরং ভবিষ্যতে যে এ আগুনের আবির্ভাব অবশ্যম্ভাবী তা এ রেওয়ায়েতে উল্লিখিত হয়েছে।

আমার কাছে প্রধান্যপ্রাপ্ত অভিমত হচ্ছে এই যে ,এ আগুন কিয়ামতের অন্যতম নিদর্শন হবে এবং তা হবে এডেন অথবা হাদরামাউতের আগুন। আর শিয়া-সুন্নী হাদীস সূত্রসমূহে এ আগুনের বিবরণ বিদ্যমান।

তবে হিজাযের আগুন যার উৎপত্তি হবে পবিত্র মদীনা নগরীতে তা বড় কোন কিছুর আলামত হওয়া ছাড়াই মহানবী (সা.) কর্তৃক প্রদত্ত একটি অলৌকিক ভবিষ্যদ্বাণী মাত্র। আর তা ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে। মদীনার নিকটে একটি আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের ঘটনা ঐতিহাসিকদের দ্বারা বর্ণিত হয়েছে। উল্লেখ্য যে ,উক্ত আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত বেশ কিছুদিন স্থায়ী হয়েছিল।

আর এ দু টি আগুন যে আগুন ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের অন্যতম নিদর্শন হবে তা থেকে ভিন্ন হবে। হাদীসে এ আগুনকে প্রাচ্যের আগুন বলে অভিহিত করা হয়েছে। আবার কিছু কিছু হাদীসে তা হিজাযের পূর্বাঞ্চলের আগুন বলে উল্লিখিত হয়েছে। ইবনে হাম্মাদের হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপির 21 পৃষ্ঠায় ইবনে মেদান থেকে বর্ণিত : যখন তোমরা রমযান মাসে আকাশে পূর্ব দিক থেকে আগুনের একটি স্তম্ভ প্রত্যক্ষ করবে তখন তোমরা তোমাদের সাধ্য অনুযায়ী খাদ্য-সামগ্রী প্রস্তুত করে রেখ। কারণ ,তা হবে দুর্ভিক্ষের বছর।

ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন : যখন তোমরা পূর্ব দিক থেকে একটি প্রকাণ্ড আগুন প্রত্যক্ষ করবে তখন মানব জাতির মহামুক্তি বাস্তবায়িত হবে। আর তা আল কায়েমের আবির্ভাবের কিছু আগে সংঘটিত হবে।

ইমাম বাকির (আ.) বলেছেন : তোমরা যখন পূর্ব দিকে সবুজ ও লাল বর্ণের কাপড় সদৃশ একটি আগুন প্রত্যক্ষ করবে যা তিন দিন অথবা সাত দিন ধরে প্রজ্বলিত থাকবে তখনই মহান আল্লাহর ইচ্ছায় হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আহলে বাইতের মহামুক্তির আশা করতে পারবে। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ্ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাবান। রেওয়ায়েতে বর্ণিত الهردي (আল হিরদী)-এর অর্থ হচ্ছে সবুজ ও লাল রঙে রঞ্জিত বস্ত্র।

আবার এ আগুন যেমন প্রাকৃতিক আগ্নেয়গিরিও হতে পারে তেমনি প্রেট্রোলের বা তেল খনির এক বিরাট বিস্ফোরণ হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। আবার তা ঐশ্বরিক কোন নিদর্শনও হতে পারে যা ইমাম মাহ্দীর আবির্ভারে অন্যতম নিদর্শন। ইমাম বাকির (আ.) বলেছেন : যে আগুন আকাশে আবির্ভূত হবে এবং যে রক্তিমাভা সমগ্র আকাশ ছেয়ে ফেলবে তা দেখে মানুষ ইমাম মাহ্দীর আবির্ভাব ও আন্দোলনের আগে পাপ কাজ করা থেকে বিরত থাকবে। 324

হিজাযের এ আগুন সে দেশের রাজনৈতিক সংকট শুরু হওয়ার আগে অথবা তা চলাকালে প্রকাশিত হবে। তবে মহান আল্লাহ্ই এ ব্যাপারে অধিক অবগত।

মদীনা থেকে ভীত-সন্ত্রস্ত্র অবস্থায় বের হওয়া

হাদীসসমূহে উল্লেখ আছে যে ,সুফিয়ানীর বাহিনী পবিত্র মদীনা নগরী দখল করবে এবং তিন দিনের জন্য সেখানে সব কিছু করা সৈন্যদের জন্য বৈধ ঘোষণা করবে। ইমাম মাহ্দীর খোঁজে বনি হাশিমের যাকেই তারা পাবে তাকেই তারা বন্দী করবে এবং তাদের মধ্য থেকে বেশ কিছু ব্যক্তিকে হত্যাও করবে।

ইবনে হাম্মাদের হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপিতে (88 পৃ.) লিখিত হয়েছে : সুফিয়ানীর বাহিনী মদীনায় যাবে এবং কুরাইশদের মধ্য থেকে বেশ কিছু ব্যক্তিকে এবং আনসারদের মধ্য থেকে চারশ ব্যক্তিকে হত্যা করবে। তারা গর্ভবতী নারীদের পেট চিড়ে তাদের গর্ভস্থ সন্তানদের হত্যা করবে। তারা কুরাইশ বংশীয় এক ব্যক্তি ও তার বোনকে হত্যা করবে যাদের নাম হবে যথাক্রমে মুহাম্মদ ও ফাতিমা। তাদের দু জনকে মদীনার মসজিদে নববীর দরজার ওপর ক্রুশ বিদ্ধ করে হত্যা করা হবে।

উক্ত গ্রন্থের একই পৃষ্ঠায় আবু রূমান থেকে বর্ণিত : সে (সুফিয়ানী) মদীনায় একটি সেনাবাহিনী প্রেরণ করবে। অতঃপর তারা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বংশধরদের মধ্য থেকে যাকে পাবে তাকে বন্দী করবে। তারা বনি হাশিমের বেশ কিছু সংখ্যক পুরুষ ও নারীকে হত্যা করবে । আর তখনই ইমাম মাহ্দী (আ.) ও মুবিয (আল মানসূর) মদীনা থেকে মক্কায় পালিয়ে যাবেন এবং তাঁদের সন্ধানে লোক প্রেরণ করা হবে কিন্তু তাঁরা দু জন মহান আল্লাহর নিরাপত্তার মধ্যে আশ্রয় নেবেন।

হাকিমের মুস্তাদরাকুস্ সহীহাইনে (4র্থ খণ্ড ,পৃ. 442) বর্ণিত আছে যে ,মদীনাবাসী সুফিয়ানী উক্ত নগরী দখল করার কারণে সেখান থেকে পালিয়ে যাবে।

জাবির ইবনে ইয়াযীদ আল জুফী থেকে বর্ণিত। ইমাম বাকির (আ.) বলেছেন : সে (সুফিয়ানী) মদীনায় একটি সেনাদল প্রেরণ করবে। তারা সেখানে এক ব্যক্তিকে হত্যা করবে। আর মাহ্দী ও আল মানসূর সেখান থেকে পালিয়ে যাবে। হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বংশধরদের মধ্য থেকে ছোট-বড় সবাইকে বন্দী করা হবে এবং তাদের মধ্য থেকে কাউকে বন্দী করা ব্যতীত ছেড়ে দেয়া হবে না। দু ব্যক্তির সন্ধানে সেনাদল প্রেরণ করা হবে। 325

যে লোককে সুফিয়ানী বাহিনী হত্যা করবে সে ঐ যুবক হতে ভিন্ন যার সম্পর্কে রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে ,সে মদীনায় নিহত হবে। ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন : হে যুরারাহ্! মদীনায় অবশ্যই একজন তরুণকে হত্যা করা হবে। আমি তাঁকে বললাম : আমি আপনার জন্য উৎসর্গীকৃত হই । সে কি ঐ ব্যক্তি নয় যাকে সুফিয়ানী-বাহিনী হত্যা করবে ?তিনি বললেন : না । তবে অমুকের বংশধরদের সেনাবাহিনী তাকে হত্যা করবে। ঐ বাহিনী মদীনায় ঢোকার আগেই সে সেখান থেকে বের হয়ে যাবে। তাই জনগণ জানবে না যে ,সে কোথায় আছে। তাই একজন যুবককে ধরে এনে হত্যা করবে। যখন তাকে অন্যায়ভাবে শত্রুতাবশত হত্যা করা হবে তখন মহান আল্লাহ্ তাদেরকে আর ছেড়ে দেবেন না। আর তখনই তোমরা মহামুক্তির আশা করতে পারবে। 326

কিছু কিছু রেওয়ায়েতে এ তরুণকে নাফসে যাকীয়াহ্ (পুণ্যাত্মা) বলা হয়েছে। আর সে হবে ঐ নাফসে যাকীয়াহ্ থেকে ভিন্ন যাঁকে ইমাম মাহ্দীর আবির্ভাবের কিছুকাল আগে পবিত্র মক্কা নগরীতে হত্যা করা হবে।

এ সব হাদীস ও অন্যান্য রেওয়ায়েত থেকে বাহ্যত বোঝা যায় যে ,হিজাযের দুর্বল ও ক্ষয়িষ্ণু প্রশাসন ,হিজাযে ,বিশেষ করে পবিত্র মদীনায় শিয়াদের গ্রেফতার করার ব্যাপারে তৎপর থাকবে এবং পুণ্যাত্মা যুবককে নিছক তাঁর নাম মুহাম্মদ ইবনুল হাসান হওয়ার জন্য অথবা ইমাম মাহ্দীর সাথে সম্পর্ক ও যোগাযোগ রক্ষাকারী ওলীদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে হত্যা করবে। উল্লেখ্য যে ,তখন মুহাম্মদ ইবনুল হাসান এ নামটি জনগণের কাছে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর নাম হিসেবে প্রসিদ্ধ লাভ করবে।

এরপর সুফিয়ানীর সেনাবাহিনী হিজাযে প্রবেশ করবে এবং সেখানে তারা আরো ব্যাপকভাবে সন্ত্রাস ও দমন নীতি চালাতে থাকবে। অতঃপর বনি হাশিমের সাথে যাদের সম্পর্ক থাকতে পারে বলে তারা মনে করবে তাদের সবাইকে বন্দী করবে এবং যে ব্যক্তির নাম মুহাম্মদ তাকে এবং তার বোনকে নিছক তার নাম মুহাম্মদ এবং তার পিতার নাম হাসান হওয়ার জন্য হত্যা করবে।

রেওয়ায়েতসমূহের বর্ণনা অনুযায়ী এ উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে ইমাম মাহ্দী (আ.) হযরত মূসা (আ.)-এর ন্যায় ভীত অবস্থায় সতর্কতার সাথে মদীনা নগরী থেকে বের হবেন। তাঁর সাথে তাঁরই এক সাঙ্গী থাকবেন যাঁর নাম পূর্ববর্তী রেওয়ায়েতে মানসূর এবং আরেক রেওয়ায়েতে মুনতাসির বলা হয়েছে। পূর্ববর্তী রেওয়ায়েতে উল্লিখিত আল মুবীয নামটি মুনতাসির নামের অপভ্রংশও হতে পারে।

আরেক রেওয়ায়েতে উল্লেখ করা হয়েছে যে ,তিনি মদীনা নগরী থেকে মহানবী (সা.)-এর উত্তরাধিকার সাথে নিয়ে বের হবেন। আর তাতে থাকবে মহানবী (সা.)-এর তরবারি ,বর্ম ,পতাকা ,পাগড়ী এবং চাদর।

পবিত্র মক্কার উদ্দেশ্যে মদীনা থেকে তিনি কখন বের হবেন তার সময়কাল শিয়া হাদীস সূত্রসমূহে আমি পাই নি। তবে রমযান মাসে আসমানী গায়েবী আহবানের পরই অর্থাৎ হজ্ব মৌসুমেই তা হওয়া যুক্তিসংগত। আমার মনে পড়ছে আমি একটি রেওয়ায়েতে দেখেছি যে ,রমযান মাসে মদীনায় সুফিয়ানী বাহিনী প্রবেশ করবে।

মুফাযযাল ইবনে আসর কর্তৃক বর্ণিত দীর্ঘ রেওয়ায়েতটিতে ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন : মহান আল্লাহর শপথ ,হে মুফাযযাল! আমি যেন তাকে দেখতে পাচ্ছি যে ,সে মক্কায় প্রবেশ করেছে। তার মাথায় হলুদ পাগড়ী। তার দু পায়ে মহানবী (সা.)-এর চপ্পল। তার হাতে তাঁর লাঠি রয়েছে। পবিত্র কাবা গৃহে পৌঁছে দেয়ার জন্য সে তার সামনে কতকগুলো বাছুর চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সেখানে কেউ নেই যে তাকে চেনে। 327

এ রেওয়ায়েতের সনদ দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর অনুসন্ধানরত শত্রুদের গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের বিস্তৃতি এবং তাঁর অন্তর্ধানে থাকার বিষয়টি যা তাঁর সংক্ষিপ্ত অন্তর্ধান এবং সে সময় তাঁর আত্মগোপন করে থাকার সাথে সদৃশ সেই পরিপ্রেক্ষিতে এ রেওয়ায়েত এবং এতদসদৃশ অন্যান্য রেওয়ায়েত যৌক্তিক হবে। আর আবির্ভাবের বছরের হজ্ব মৌসুম উষ্ণ ও প্রাণবন্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক।

রেওয়ায়েতসমূহে উল্লিখিত বিশ্বযুদ্ধ পরিস্থিতি ,ইসলামী দেশসমূহের অবস্থা ,হিজাযে পরিস্থিতির অবনতি ও সংকটজনক হওয়া ,সে দেশে সুফিয়ানী বাহিনীর অনুপ্রবেশের কারণে জরুরী অবস্থার ঘোষণা দান ইত্যাদির কারণে হিজাযের শাসকদের কাছে পবিত্র হজ্ব মৌসুম একটি বিপজ্জনক বিষয় বলে মনে হবে। তাই তারা হাজীদের সংখ্যা যতটা সম্ভব হ্রাস করবে এবং পবিত্র মক্কা ও মদীনায় নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন এবং সর্বোচ্চ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

তবে তা মুসলিম জাতিসমূহের পবিত্র মক্কার দিকে আকৃষ্ট হওয়ার পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করবে না। মুসলিম জাতিসমূহ প্রতিশ্রুত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের জন্য অপেক্ষা করতে থাকবে। তাই সম্ভবত লক্ষ লক্ষ বরং মিলিয়ন মিলিয়ন মুসলমান বিভিন্ন দেশ থেকে ঐ বছর হজ্ব পালন করার উৎসাহ নিয়ে ছুটে আসবে। তাদের সরকারসমূহ এবং হিজায সরকার কর্তৃক আয়োজিত প্রতিবন্ধকতাসমূহ থাকা সত্ত্বেও তাদের এক বিরাট অংশ পবিত্র মক্কা নগরীতে পৌঁছতে পারবে।

ঐ বছর হাজীদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রশ্ন হবে : ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর ব্যাপারে তুমি কী শুনেছ । তবে এটি হবে একটি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু বিপজ্জনক প্রশ্ন যা হাজীরা নিজেদের মাঝে আলোচনা করবে এবং ইমাম মাহ্দী সংক্রান্ত বিশেষ সংবাদ তারা গোপনে বর্ণনা করবে এবং সে সাথে তারা হিজায-সরকার ও সুফিয়ানী বাহিনীর সর্বশেষ পদক্ষেপ নিয়েও আলোচনা করবে।

নিম্নের রেওয়ায়েতটি ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর ব্যাপারে আগ্রহ এবং তাঁকে সন্ধান করার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের অবস্থা এবং বিশেষ করে মক্কা নগরীতে অবস্থানরত হাজীদের অবস্থার একটি সার্বিক চিত্র অংকন করে।

ইবনে হাম্মাদের হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপির 95 পৃষ্ঠায় বর্ণিত হয়েছে যে ,এ হাদীস আবু উমর ইবনে আবী লাহিয়াহ্ থেকে আমাদের কাছে পৌঁছেছে। তিনি আবদুল ওয়াহ্হাব ইবনে হুসাইন থেকে ,তিনি মুহাম্মদ ইবনে সাবিত থেকে ,তিনি তাঁর পিতা (সাবিত) থেকে ,তিনি আল হারিস ইবনে আবদিল্লাহ্ থেকে ,তিনি ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণনা করেছেন যে ,ইবনে মাসউদ (রা.) বলেছেন : যখন ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দাভাব দেখা দেবে ও পথসমূহ বন্ধ হয়ে যাবে এবং ফিতনা ব্যাপক আকার ধারণ করবে তখন বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চল থেকে কোন ধরনের পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচী ছাড়াই সাত জন আলেম বের হয়ে প্রত্যেকেই তিনশ র অধিক ব্যক্তির কাছ থেকে বাইআত গ্রহণ করবেন। অতঃপর তাঁরা পবিত্র মক্কা নগরীতে একত্রিত হবেন এবং পরস্পরের সাথে সাক্ষাৎ করবেন। তাঁরা পরস্পরকে প্রশ্ন করবেন : আপনারা কোন্ উদ্দেশ্যে এখানে এসেছেন ?তখন তাঁরা বলবেন : আমরা এমন এক ব্যক্তির সন্ধানে এসেছি যাঁর হাতে এ সব ফিতনার অবসান হওয়া উচিত এবং তাঁর মাধ্যমে মহান আল্লাহ্ কন্সট্যান্টিনোপল বিজয়ের দ্বার উন্মুক্ত করবেন। আর আমরা তাঁকে তাঁর নাম ,তাঁর পিতা ও মায়ের নাম এবং তাঁর বৈশিষ্ট্যসমূহ সমেত চিনি । অতঃপর ঐ সাত আলেম এ ব্যাপারে একমত হয়ে পবিত্র মক্কা নগরীতে তাঁকে খুঁজতে থাকবেন। (তাঁকে খুজে পাবার পর) তাঁরা তাঁকে বলবেন : আপনি কি অমুকের পুত্র অমুক ?তিনি বলবেন : না ;বরং আমি একজন আনসারী। এ কথা বলে তিনি তাঁদের কাছ থেকে পালিয়ে যাবেন। অতঃপর তাঁরা ইমাম মাহ্দী (আ.) সম্পর্কে জ্ঞাত ও বিশেষজ্ঞদের কাছে তাঁর কথা ব্যক্ত করবেন। তখন তাঁদেরকে বলা হবে যে ,তিনিই আপনাদের নেতা যাঁকে আপনারা খুঁজছেন এবং তিনি মদীনায় চলে গেছেন। অতঃপর তাঁরা তাঁকে মদীনায় খুঁজতে থাকবেন। কিন্তু তিনি তাঁদেরকে মদীনায় রেখে মক্কায় চলে আসবেন। তাঁরা আবার তাঁর সন্ধানে মক্কায় চলে আসবেন। তাঁকে সেখানে খুঁজতে থাকবেন। অতঃপর তাঁরা তাঁকে খুঁজে পেয়ে বলবেন : আপনি অমুকের পুত্র অমুক ?আর আপনার মা অমুকের কন্যা অমুক। আপনার মধ্যে অমুক অমুক নিদর্শন আছে। অথচ আপনি একবার আমাদের কাছ থেকে পালিয়ে চলে গেছেন। আপনি আপনার হাত প্রসারিত করুন যাতে আমরা আপনার হাতে বাইআত করতে পারি। তখন তিনি বলবেন : আমি আপনাদের নেতা নই। আমি আনসার বংশোদ্ভূত অমুকের পুত্র অমুক। আমাকে নির্দেশ দিলে আমি আপনাদের নেতাকে দেখিয়ে দেব। অতঃপর তিনি তাঁদের কাছ থেকে আবার পালিয়ে যাবেন। তাঁরা আবার তাঁকে মদীনায় খুঁজতে থাকবেন ,কিন্তু তিনি তাঁদেরকে মদীনায় ফেলে রেখে মক্কায় চলে আসবেন। অতঃপর তাঁরা তাঁকে পবিত্র মক্কা নগরীতে রুকনের কাছে খুঁজে পেয়ে বলবেন : যদি আপনি আপনার হাতে বাইআত করার জন্য আপনার হাত বাড়িয়ে না দেন তাহলে আমাদের পাপ এবং আমাদের রক্তের দায়-দায়িত্ব আপনার ওপর বর্তাবে। সুফিয়ানীর সেনাবাহিনী আমাদের সন্ধানে বের হয়েছে এবং আমাদের ধরার জন্য তৎপর হয়েছে। তাদের নেতৃত্বে রয়েছে এক জারজ ব্যক্তি। অতঃপর তিনি রুকন ও মাকামের মাঝখানে বসে বাইআতের জন্য নিজ হস্তদ্বয় প্রসারিক করবেন। অতঃপর তাঁর জন্য বাইআত গ্রহণ করা হবে। মহান আল্লাহ্ মানব জাতির অন্তরে তাঁর জন্য ভালোবাসা সৃষ্টি করে দেবেন। অতঃপর তিনি একদল ব্যক্তিসহ রওয়ানা হবেন যাঁরা হবেন দিবাভাগে সিংহের মতো বীর ও সাহসী এবং রাতের বেলা দুনিয়াত্যাগী তাপসের ন্যায়।

এ রেওয়ায়েতের সনদ ও মতনে (বর্ণনায়) বেশ কিছু দুর্বল দিক রয়েছে। এগুলোর একটি হচ্ছে কন্সট্যান্টিনোপল বিজয়। উল্লেখ্য যে ,এই কন্সট্যান্টিনোপল নগরী মুসলমানদের কাছে বেশ কয়েক শতাব্দীব্যাপী সামরিক ও রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে বিবেচিত ছিল এবং তা পাঁচশ বছর আগে সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতেহ্ কর্তৃক বিজিত হওয়ার আগে মুসলিম সাম্রাজ্যের একটি অংশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর এ নগরী বিজয়ের সুসংবাদদানকারী বেশ কিছু রেওয়ায়েতও মুসলমানরা মহানবী (সা.) থেকে বর্ণনা করেছে। এ সব রেওয়ায়েতের শুদ্ধ বা বানোয়াট হওয়ার ব্যাপারে গবেষণা করা প্রয়োজন।

তবে আমাদের আলোচ্য বিষয়বস্তুর সাথে এ সব রেওয়ায়েতের মধ্যে যেগুলো বিশেষভাবে সংশ্লিষ্ট সেগুলো হচ্ছে ঐ সব রেওয়ায়েত যেগুলোয় উল্লেখ করা হয়েছে যে ,কন্সট্যান্টিনোপল নগরী ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হাতে বিজিত হবে। আর ওপরে উল্লিখিত রেওয়ায়েতেও এটিই উল্লেখ করা হয়েছে। কতিপয় রাবী আরো উল্লেখ করেছেন যে ,কন্সট্যান্টিনোপল বিজয় মুসলমানদের বৃহৎ সমস্যাগুলোর সমাধান করবে। আর আসলেই এ নগরী মুসলমানদের বৃহৎ সমস্যাগুলোর মধ্যেই পরিগণিত হতো।

একইভাবে এ সম্ভাবনাও দেয়া যেতে পারে যে , ইমাম মাহ্দী ( .) সংক্রান্ত হাদীসসমূহে কন্সট্যান্টিনোপল বলতে রোমের ( পাশ্চাত্য ) রাজধানীকে বোঝানো হয়েছে যা তাঁর আবির্ভাবের যুগে বিদ্যমান থাকবে। আবার কিছু কিছু রেওয়ায়েতে এ নগরীকে (The Great Roman City) বৃহৎ রোমান নগরী বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। এ সব রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে , ইমাম মাহ্দী ( .) এবং তাঁর সঙ্গীরা ঐ নগরী তাকবীর ধ্বনি দিয়ে জয় করবেন।

তবে এ রেওয়ায়েতের অবস্থা যা-ই হোক না কেন ,এমনকি যদি তা বানোয়াটও হয় তবুও এটি হচ্ছে এক প্রসিদ্ধ গ্রন্থ প্রণেতার উক্তি যা তিনি প্রায় বারোশ বছর আগে লিখেছেন। কারণ ,ইবনে হাম্মাদ 227 হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। আর তিনি এ হাদীসটি তাঁর পূর্ববর্তী অর্থাৎ তাবেয়ীদের হতে বর্ণনা করেছেন। সুতরাং ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের বছরের সার্বিক রাজনৈতিক অবস্থা ,তাঁর আবির্ভাবের খবর মুসলমানদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া এবং তাঁকে খুঁজে পেতে তাদের গভীর অনুসন্ধানের বিষয়গুলো সম্পর্কিত চিত্র অন্ততপক্ষে রেওয়ায়েতটির বর্ণনাকারীদের দৃষ্টিতে ছিল। অধিকন্তু রেওয়ায়েতটিতে বর্ণিত অধিকাংশ বিষয় অন্যান্য রেওয়ায়েতেও উল্লিখিত হয়েছে অথবা অন্যান্য রেওয়ায়েতে যে বিষয়গুলো সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে তা থেকেও অনুরূপ সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায়।

ঐরূপ সংকটজনক পরিস্থিতিতে ঐ সাত জন আলেমের মক্কায় আসার বিষয়টি ইমাম মাহ্দীর আবির্ভাবের ব্যাপারে মুসলমানদের তীব্র আগ্রহকেই প্রমাণ করে। তেমনি ইমাম মাহ্দীকে খুঁজে পেতে মক্কায় প্রতিনিধিদল প্রেরণ এবং ঐ সাত জন আলেমের প্রত্যেকের নিজ দেশের মুমিন ব্যক্তিদের মধ্য থেকে ইমাম মাহ্দীর সঙ্গে জীবন দিতে প্রস্তুত এরূপ তিনশ তের ব্যক্তি হতে বাইআত গ্রহণ ইত্যাদি বিষয়গুলো মুসলমানদের মধ্যে ইমাম মাহ্দীর ব্যাপক জনপ্রিয়তা এবং তাঁর প্রতিশ্রুত তিনশ তের বিশেষ সঙ্গীর অন্তর্ভুক্ত (বদর যুদ্ধে রাসুলের সঙ্গীর সমান) হতে তাঁদের তীব্র আকঙ্ক্ষাকেই প্রমাণ করে।

তবে তাদের কাছ থেকে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর বারবার পালিয়ে যাওয়া ও সড়ে পড়ার বিষয়টি যা এ রেওয়ায়েতে উল্লেখ করা হয়েছে তা দুর্বলতামুক্ত নয়। তিনি যে পছন্দ না করা সত্ত্বেও বাইআত গ্রহণ করবেন এ বিষয়টি যা শিয়া-সুন্নী হাদীস গ্রন্থসমূহে বর্ণিত হযেছে তা সম্ভবত এ ধরনের ধারণার উৎস হতে পারে। এমনকি ইমাম সাদিক (আ.)-এর একজন উঁচু পর্যায়ের সাহাবী ধারণা পোষণ করতেন যে ,ইমাম মাহ্দী (আ.) বাইআত গ্রহণ করতে বাধ্য হবেন ;আর এ বিষয়টি (বাধ্য হয়ে বাইআত গ্রহণ) মহানবী (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের হাদীসেও বর্ণিত হয়েছে। তাই ইমাম সাদিক (আ.) হাদীসে উল্লিখিত إكراه (ইকরাহ্) বা অপছন্দ করা শব্দের অর্থ যে ,إجبار (ইজবার) বা বাধ্যকরণ নয় ,তা তাঁকে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে ছিলেন (যার ফলে তাঁর এ ভ্রান্ত ধারণা দূর হয়ে যায়) এবং এ ব্যাপারে তিনিও নিশ্চিত জ্ঞান লাভ করেন।

এটি সাধারণ মুসলিম উম্মাহর অবস্থা এবং ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর প্রতি তাদের আগ্রহ ও মনোযোগের সাথে সংশ্লিষ্ট। তবে তিনি পবিত্র মক্কা নগরীতে তাঁর সাহাবীদের কাছ থেকে বাইআত গ্রহণ করবেন -এতৎসংক্রান্ত রেওয়ায়েতগুলো যেভাবে তাঁর বাইআত গ্রহণ করার বিষয়টি চিত্রিত করেছে তা প্রাগুক্ত রেওয়ায়েত যেভাবে বর্ণিত হয়েছে তা থেকে ভিন্ন।

মহান আল্লাহ্ কর্তৃক ইমাম মাহ্দীর চারপাশে তাঁর সাহাবীদেরকে একত্রিতকরণ

ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সাহাবীদের ব্যাপারে বেশ কিছু বিষয় বিবেচনা করা উচিত। এগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে শিয়া-সুন্নী হাদীস সূত্রসমূহে তাঁদের সংখ্যা সম্বন্ধে বর্ণিত হয়েছে যে ,তাঁরা বদর যুদ্ধে মহানবী (সা.)-এর সাহাবীদের সংখ্যার অনুরূপ হবেন অর্থাৎ তাঁদের সংখ্যা হবে তিনশ তের জন । আর এ বিষয়টি থেকে প্রমাণিত হয় যে ,ইমাম মাহ্দীর হাতে ইসলাম ধর্মের পুনর্জাগরণ এবং তাঁর প্রপিতামহ মহানবী (সা.)-এর হাতে ইসলাম ধর্মের প্রবর্তনের মাঝে এক বিরাট সাদৃশ্য বিদ্যমান। অধিকন্তু হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে ,ইমাম মাহ্দীর সাহাবীদের মাঝে প্রথম দিককার নবীদের সাহাবীদের সময় প্রচলিত বেশ কিছু প্রথা (সুন্নাহ্) পুনরায় বাস্তবায়িত হবে।

তাই ইমাম সাদিক (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে : হযরত মূসা (আ.)-এর সাহাবীরা নদী দ্বারা পরীক্ষিত হয়েছিলেন যা إنّ الله مبتليكم بنهر (নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ্ তোমাদেরকে একটি নদী দ্বারা পরীক্ষিত করবেন) -মহান আল্লাহর এ বাণীতে বর্ণিত হয়েছে। আর আল কায়েমের সাহাবীরাও অনুরূপভাবে পরীক্ষিত হবে। 328

তবে কেবল তারাই তাঁর একমাত্র সাহায্যকারী ও সাহাবী নন। তাই তাঁর অন্তর্ধানকালে তাঁর সঙ্গী-সাথীরা পূর্বোল্লোখিত আবদালদের থেকে ভিন্ন হবে। বরং রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে ,তাঁর সৈন্যবাহিনী যারা তাঁর সাথে পবিত্র মক্কা নগরী থেকে বের হবে তাদের সংখ্যা হবে দশ হাজার অথবা ততোধিক । আর যে বাহিনী তাঁর সাথে ইরাকে প্রবেশ করবে এবং তিনি যাদের মাধ্যমে পবিত্র আল কুদ্স বিজয় করবেন তাদের সংখ্যা হবে লক্ষ-লক্ষ।

সুতরাং এরা সবাই হবে তাঁর সাহায্যকারী ও সাহাবী ;বরং ইসলামী বিশ্বের জাতিসমূহের মধ্য থেকে তাঁর কোটি কোটি একান্ত নিষ্ঠাবান সঙ্গী থাকবে।

দ্বিতীয় প্রণিধানযোগ্য বিষয় হচ্ছে ,তারা মুসলিম বিশ্বের প্রত্যন্ত এলাকা ও বিভিন্ন দেশের অধিবাসী হবে। রেওয়ায়েতসমূহ অনুসারে তাদের মধ্যে থাকবেন মিশরের সম্ভ্রান্ত বংশীয় ব্যক্তিরা ,শাম দেশের আবদালরা ,ইরাকের পুণ্যবান ব্যক্তিরা এবং তালেকান ও কোমের মূল্যবান রত্নসদৃশ মহৎ পুণ্যাত্মারা। ইবনে আরাবী তাঁর আল ফুতুহাতুল মাক্কীয়াহ্ গ্রন্থে তাদের (ইমাম মাহ্দীর সাথীদের) জাতীয়তা সম্পর্কে বলেছেন : তারা অনারব বা ইরাকী হবে ,তাদের মধ্যে কোন আরব থাকবে না। কিন্তু তারা কেবল আরবী ভাষায় কথা বলবে। আবার বিভিন্ন হাদীস থেকে প্রতীয়মান হয় যে ,তাদের মধ্যে বেশ কিছু আরবও থাকবে। এ সব হাদীসের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে এ মশহুর (প্রসিদ্ধ) হাদীসটি : তাদের মধ্যে থাকবে মিশরীয় সম্ভ্রান্ত (মহৎ) বংশীয় ব্যক্তিবর্গ ,শামদেশের অধিবাসী আবদালরা এবং ইরাকের পুণ্যবান ব্যক্তিরা। 329

আর ইবনে হাম্মাদের হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপির 95 পৃষ্ঠায় ও হাদীসের অন্যান্য গ্রন্থে বিদ্যমান রেওয়ায়েতসমূহও প্রাগুক্ত রেওয়ায়েতসদৃশ। রেওয়ায়েতসমূহ অনুসারে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সাথীদের মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক অনারব থাকবে। তবে তাঁর সেনাবাহিনীর প্রধান ও সিংহভাগই হবে ইরানী।

তৃতীয় প্রণিধানযোগ্য বিষয় হচ্ছে ,কতিপয় রেওয়ায়েতে উল্লেখ করা হয়েছে যে ,ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সাথীদের মধ্যে পঞ্চাশ জন মহিলাও থাকবে। আর বিষয়টি ইমাম বাকির (আ.) থেকে একটি রেওয়ায়েতেও বর্ণিত হয়েছে। তবে আরেকটি রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে দশ জন নারী থাকবে যারা আহতদের সেবা শুশ্রুষা করবে।

এ থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে ,ইসলাম ধর্মে ও ইমাম মাহ্দী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির অঙ্গনে নারীর গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ,মর্যাদা ও মহান ভূমিকা থাকবে। আর এ ভূমিকা হবে সবদিক থেকে ভারসাম্যপূর্ণ এবং বেদুইনী সহিংসতা এবং নারীর প্রতি সব ধরনের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মুক্ত। স্মর্তব্য যে ,নারীর প্রতি এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি ও নিষ্ঠুরতা এখনও আমাদের দেশে ও সমাজে বিদ্যমান। একইভাবে ,পাশ্চাত্য সভাতায় নারীর যে অসম্মান ও অবমাননা এবং তার ওপর কলঙ্কের যে কালিমা লেপন করা হয়েছে সেগুলো থেকেও উল্লিখিত এ ভূমিকা পবিত্র থাকবে।

চতুর্থ প্রণিধানযোগ্য বিষয় হচ্ছে ,কতিপয় রেওয়ায়েতে উল্লেখ করা হযেছে যে ,ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর অধিকাংশ সঙ্গী যুবক হবে। বরং এগুলোর মধ্য থেকে কয়েকটি রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে ,তাদের মধ্যে পৌঢ় ও বৃদ্ধদের সংখ্যা পথিকের ব্যঞ্জনের মধ্যে লবন যেমন সামান্য মাত্রায় থাকে ,তেমনি নগণ্য হবে।

যেমন আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) বর্ণিত নিম্নের হাদীসটিতে বলা হয়েছে :   আল মাহ্দীর সঙ্গীরা হবে যুবক। চোখের মধ্যে সুরমা এবং ব্যাঞ্জনে লবন যেমন সামান্য হয় ,তেমনি তাদের মধ্যে নগণ্য সংখ্যক পৌঢ় ও বৃদ্ধ ব্যক্তি থাকবে। আর পথিকের পাথেয়ের মধ্যে সবচেয়ে নগণ্য জিনিসই হচ্ছে লবন। 330

পঞ্চম প্রণিধানযোগ্য বিষয় হচ্ছে তাদের প্রশংসায় এবং তাদের উচ্চ মর্যাদা ও মহৎ গুণাবলীর বর্ণনায় বহু হাদীস বিদ্যমান। অগণিত হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে ,ইমাম মাহ্দীর কাছে একটি সহীফা আছে যার মধ্যে তাদের সংখ্যা ,নাম ,বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলীর উল্লেখ আছে। তারা নিমিষেই সমগ্র পৃথিবী ভ্রমণ করবে। তাদের জন্য সকল কঠিন ও দুরূহ বিষয় সহজ করে দেয়া হবে ,তারা মহান আল্লাহর ক্রোধ প্রকাশকারী সেনাবাহিনী হবে ;তারা হবে ভয়ঙ্কর শক্তি ও ক্ষমতার অধিকারী যাদেরকে মহান আল্লাহ্ নিম্নোক্ত আয়াতে ইহুদীদের ওপর বিজয়ী ও কর্তৃত্বশীল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আয়াতটি হলো :

) بعثنا عليكم عبادا لنا أولى بأس شديد (

আমরা তোমাদের ওপর (তোমাদেরকে শায়েস্তা করার জন্য) আমাদের কতিপয় প্রচণ্ড শক্তিধর ও ক্ষমতাশালী বান্দাকে প্রেরণ করেছিলাম।

আর তারাই হবে নিম্নোক্ত আয়াতে উল্লিখিত মুষ্টিমেয় প্রতিশ্রুত উম্মাহ্। আয়াতটি হলো :

) و لئن أخّرنا عنهم العذاب إلى أمّة معدودة ليقولنّ ما يحسبه ألا يوم يأتيهم ليس مصروفا عنهم (

আর তারাই হবে মহানবী (সা.)-এর পবিত্র বংশধর পুণ্যবানদের পর উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। তারাই ফকীহ্ ,বিচারক এবং প্রশাসক। মহান আল্লাহ্ তাদের অন্তঃকরণসমূহকে দৃঢ় ও মজবুত করে দেবেন। তাই তারা কাউকে ভয় করবে না এবং তাদের মাঝে কোন ব্যক্তির অন্তর্ভুক্তির কারণে তারা আনন্দিত হবে না অর্থাৎ তাঁদের চারপাশে জনতার আধিক্য ও সমর্থকদের সংখ্যা বৃদ্ধি মোটেও তাদের ঈমান ও স্রষ্টার প্রতি তাদের অন্তরঙ্গরতা বৃদ্ধি করবে না (আবার জনতার সমর্থন প্রত্যাহার ও তাদের সংখ্যা হ্রাস তাদের ঈমান ও স্রষ্টার প্রতি তাদের অন্তরঙ্গতা হ্রাস করবে না)। তারা পৃথিবীর যেখানেই থাকুক না কেন ,ইমাম মাহ্দীর অবস্থানকে দেখতে পাবে এবং তাঁর সাথে কথা বলবে। তাদের মধ্যকার প্রত্যেক ব্যক্তিকে চল্লিশ অথবা তিনশ পুরুষের দৈহিক শক্তি প্রদান করা হবে।

বরং রেওয়ায়েতে আরো বর্ণিত হয়েছে যে ,তারা সকল নবীর সাহাবীদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আস সাফ্ফার প্রণীত বাসাইরুদ দারাজাত গ্রন্থের 104 পৃষ্ঠায় ইমাম জাফর সাদিক (আ.) থেকে আবু বসীর রেওয়ায়েত করেছেন : একদিন মহানবী (সা.)-এর সামনে তাঁর একদল সাহাবী উপবিষ্ট ছিলেন। তিনি দু বার বললেন : হে আল্লাহ্! আপনি আমার ভাইদের সাথে আমাকে মিলিত করুন। তখন সাহাবীরা বললেন : হে রাসূলাল্লাহ্! আমরা কি আপনার ভাই নই ?তিনি বললেন : না ,তোমরা আমার সাহাবী। আমার ভাইয়েরা হবে সর্বশেষ যুগের একদল ব্যক্তি যারা আমাকে না দেখেও আমার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে। তারা তাদের পিতার ঔরস ও মাতৃজঠর থেকে হওয়ার পূর্বেই মহান আল্লাহ্ তাদেরকে তাদের পিতাদের নামসহ আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। তাদের প্রত্যেকেই ঈমানের ক্ষেত্রে এতটা দৃঢ় ও মজবুত যে ,তাদের ঈমানকে টলানো আঁধার রাতে অত্যন্ত দৃঢ় কাঁটাযুক্ত বৃক্ষ উপড়ানো অপেক্ষাও কঠিন অথবা তারা যেন অনির্বাপনীয় জ্বলন্ত কয়লাধারী।

সহীহ মুসলিমে (1ম খণ্ডের 150 পৃষ্ঠায়) বর্ণিত আছে : আমি আমাদের ভাইদেরকে দেখার ইচ্ছা করেছি। তখন সাহাবীরা বললেন : হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি আপনার দীনী ভাই নই ?তখন তিনি বললেন : তোমরা আমার সাহাবী। আর আমার ভাইয়েরা এখনো আসে নি (অর্থাৎ জন্মগ্রহণ করে নি)। সাহাবীরা বললেন : হে আল্লাহর রাসূল! আপনার উম্মতের মধ্য থেকে যারা এখনো আসে নি তাদেরকে আপনি কীভাবে চেনেন ?মহানবী বললেন : তোমরা কি মনে কর একপাল কালো চি হ্নধারী অশ্বের মধ্যে যদি কোন ব্যক্তির হাত ও পায়ে উজ্জ্বল সাদা চি ‎‎ হ্নধারী অশ্বসমূহ থাকে সে তার অশ্বগুলোকে চিনবে না ?তখন সবাই বলল : জী ,হ্যাঁ। হে রাসূলুল্লাহ্! মহানবী বললেন : তারা হাউসে কাওসারে আমার নিকট তাদের ওজুর কারণে অতি উজ্জ্বল ও শুভ্র মুখমণ্ডল ,হাত ও পা নিয়ে উপস্থিত হবে। আর আমি হাউসে কাওসারে তাদের অগ্র প্রতিনিধি হব। জেনে রাখ ,পথহারা উটকে যেভাবে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় সেভাবে একদল লোককে আমার হাউস থেকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। আমি তাদেরকে ডাকতে থাকব : তোমরা এদিকে এসো। তখন আমাকে বলা হবে : আপনার পরে তারা (ধর্মে) পরিবর্তন করে ফেলেছিল। তখন আমিও বলতে থাকব : দূর হয়ে যাও! তোমরা সবাই দূর হয়ে যাও!

এভাবেই হাদীসসমূহে তাদের বৈশিষ্ট্য ও কারামতের কথা বর্ণিত হয়েছে। কতিপয় রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে ,গুহাবাসীরা (আসহাবে কাহাফ) পুনরুজ্জীবিত হয়ে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সঙ্গী-সাথীদের অন্তর্ভুক্ত হবেন। আর তাঁদের মধ্যে থাকবেন হযরত খিযির (আ.) ও হযরত ইলিয়াস (আ.)। কতিপয় রেওয়ায়েতে উল্লিখিত হয়েছে যে ,মহান আল্লাহর নির্দেশে কতিপয় মৃত ব্যক্তি জীবিত হয়ে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত হবে।

ষষ্ঠ প্রণিধানযোগ্য বিষয় হচ্ছে রেওয়ায়েতসমূহ নির্দেশ করে যে ,ইমাম মাহ্দীর আবির্ভাবের কাছাকাছি সময়ে তাঁর সঙ্গীরা তিনটি দল বা গোষ্ঠীতে বিভক্ত হবেন। একটি দল তাঁর সাথে পবিত্র মক্কা নগরীতে প্রবেশ করবে অথবা অন্যদের আগেই সেখানে পৌঁছবে। দ্বিতীয় দলটি মেঘের ওপর আরোহণ করে বা বাতাসের মাধ্যমে তাঁর সাথে মিলিত হবে। তৃতীয় দলটি তাদের নিজ নিজ শহরে নিজেদের বাড়িতে রাত যাপন করবে কিন্তু তারা বুঝতেই পারবে না যে ,তারা পবিত্র মক্কায় উপনীত হয়েছে এবং সেখানে অবস্থান করছে।

ইমাম বাকির (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে : এ বিষয়ের অধিপতির জন্য এ কয়েকটি উপত্যকার মাঝে অন্তর্ধানের ঘটনা ঘটবে এবং তিনি যি তূয়া এলাকার (মক্কার একটি উপত্যকা এবং এ নগরীতে প্রবেশ করার একটি পথ) দিকে ইঙ্গিত করলেন ; (এরপর বললেন) এমনকি যখন তার আবির্ভাবের দু রাত অবশিষ্ট থাকবে তখন সে তার এক গোলামকে প্রেরণ করবে যেন সে তার কতিপয় সাহাবীর সাথে মিলিত হয়ে বলে : আপনারা এখানে ক জন আছেন ?তারা বলবে : প্রায় চল্লিশ জন। অতঃপর সে বলবে : যদি আপনারা আপনাদের নেতাকে দেখতে পান তাহলে আপনাদের অবস্থা কেমন হবে ?তারা বলবে : মহান আল্লাহর শপথ ,যদি তিনি পাহাড়-পর্বতে আশ্রয় নেন তাহলেও আমরা তার সাথে আশ্রয় নেব। অতঃপর সে তাদের সামনাসামনি এসে বলবে : আপনারা আপনাদের মধ্যকার দশ জন শ্রেষ্ঠ ও মনোনীত ব্যক্তির সাথে পরামর্শ করুন। অতঃপর তারা তাদের সাথে পরামর্শ করবে। এরপর সে তাদেরকে নিয়ে তোমাদের নেতার কাছে নিয়ে যাবে এবং সে তাদেরকে ঐ প্রতিশ্রুত রাত যা ঐ রাতের পরের রাত হবে তার প্রতিশ্রুতি প্রদান করবে। 331

বাহ্যত এ রেওয়ায়েতে উল্লিখিত অন্তর্ধানের অর্থ হচ্ছে ইমাম মাহ্দীর আবির্ভাবের আগের মুহূর্তে তাঁর যে স্বল্পমেয়াদী অন্তর্ধান থাকবে তা। আর এ সব সঙ্গী ঐ সব আবদাল নন যাঁরা তাঁর সাথে আছেন অথবা তাঁর সাথে যাঁদের যোগাযোগ আছে। আর তাঁরা ঐ বারো ব্যক্তিও নন যাঁদের প্রত্যেকেই একমত যে ,তাঁরা তাঁকে দেখেছেন অথচ তাঁদেরকে প্রত্যাখ্যান করা হবে। বরং এরা হবেন তাঁর সন্ধানকারী ঐ সাত আলেমের ন্যায় যাঁদের কথা এর আগে উল্লিখিত হয়েছে।

ইমাম সাদিক (আ.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন : আল কায়েম পৃথিবীর নয়টি অঞ্চলের পঁয়তাল্লিশ ব্যক্তিকে সাথে নিয়ে আবির্ভূত হবে। একটি এলাকা থেকে একজন ,আরেকটি এলাকা থেকে দু জন ,তৃতীয় এলাকা থেকে তিন জন ,চতুর্থ এলাকা থেকে চার জন ,পঞ্চম এলাকা থেকে পাঁচ জন ,ষষ্ঠ এলাকা থেকে ছয় জন ,সপ্তম এলাকা থেকে সাত জন ,অষ্টম এলাকা থেকে আট জন ,নবম এলাকা থেকে নয় জন। আর এভাবে তার (প্রতিশ্রুত) সাথীদের সংখ্যা পুরো হবে। 332

এ রেওয়ায়েতের উদ্দেশ্য হচ্ছে ইমাম মাহ্দী (আ.) আবির্ভাবের সূচনালগ্নে নিজেই সামনে এগিয়ে আসবেন অথবা তিনি মক্কা নগরী পানে এগিয়ে যাবেন। আর এও অসম্ভব নয় যে ,যে দু দলের কথা প্রাগুক্ত রেওয়ায়েতদ্বয়ে উল্লেখ করা হয়েছে আসলে তাঁরা এক দল এবং তাঁরা ইমাম মাহ্দীর অন্যান্য সাথীদের আগেই মক্কায় পৌঁছে যাবেন।

সম্ভবত যে সব সাহাবী আকস্মিকভাবে তাঁদের শয্যা থেকে উধাও হয়ে যাবেন এবং মহান আল্লাহর শক্তিবলে চোখের পলকেই নিজ নিজ দেশ ও জনপদ থেকে মক্কায় পৌঁছে যাবেন তাঁরা তাঁদের আগে যাঁরা মক্কায় পৌঁছবেন তাঁদের সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ হবেন।

তবে রেওয়ায়েত অনুসারে যাঁরা মেঘে চরে দিনের বেলা তাঁর কাছে আসবেন তাঁরা নিজ নিজ পিতার নামসহ বিখ্যাত হবেন। অর্থাৎ তাঁরা মক্কায় স্বাভাবিকভাবে (উড়োজাহাজে পাসপোর্ট ও ভিসা নিয়ে) আগমন করবেন। যার ফলে জনগণের মাঝে এর কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে না। তাই শর্তহীনভাবে তাঁরা তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত হবেন।

আর আবদালগণ যাঁরা তাঁর সাথে বসবাস করেন অথবা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁর নির্দেশিত কাজ ও দায়িত্বসমূহ পালন করছেন এবং সূক্ষ্মভাবে তাঁর আবির্ভাবকাল সম্পর্কে জ্ঞাত তাঁরা তাঁর আবির্ভাবকালে তাঁর কাছে পৌঁছে যাবেন।

ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন : নিশ্চয়ই এ বিষয়ের অধিপতির সাথীরা সংরক্ষিত আছে। সমগ্র মানব জাতিও যদি ধ্বংস হয়ে যায় তাহলেও মহান আল্লাহ্ তার সাহাবীদেরকে তার কাছে নিয়ে আসবেন। আর তাদের প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ বলেছেন : যদি তারা এ ব্যাপারে অবিশ্বাস করে তাহলে আমি এ ব্যাপারে এমন এক জাতিকে স্থলাভিষিক্ত করব যারা এ ব্যাপারে অবিশ্বাসী নয়। মহান আল্লাহ্ আর তাদের ব্যাপারে আরো বলেছেন : আর অচিরেই মহান আল্লাহ্ এমন এক জাতিকে আনবেন যাদেরকে তিনি ভালোবাসেন এবং তারাও তাঁকে ভালোবাসে। তারা মুমিনদের প্রতি বিনয়ী এবং কাফিরদের ওপর কঠোর হবে। 333

ইমাম বাকির (আ.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন : তাদের মধ্যে এমন কতিপয় ব্যক্তি থাকবে যারা রাতে নিজ শয্যা থেকে গায়েব হয়ে যাবে এবং প্রভাতে তারা পবিত্র মক্কায় অবস্থান করবে। তাদের মধ্য থেকে কতিপয় ব্যক্তিকে দিনের বেলা মেঘমালায় ভ্রমণ করতে দেখা যাবে। তারা তাদের পিতাদের নামসহ পরিচিত থাকবে। আমি (রাবী) বললাম : আপনার জন্য উৎসর্গীকৃত হই। তাদের মধ্যে কারা সর্বোত্তম ঈমানের অধিকারী ? তিনি বললেন : যে দিবাভাগে মেঘে ভ্রমণ করে সে। 334

দিনের বেলা মেঘমালায় চড়ে তাঁদের ভ্রমণ করার অর্থ হচ্ছে মহান আল্লাহ্ অলৌকিকভাবে তাঁদেরকে মেঘের ওপর সওয়ার করে তাঁদের নিজ নিজ দেশ থেকে পবিত্র মক্কায় নিয়ে আসবেন। তবে এর অর্থ অন্যান্য বিমানযাত্রীর মতো তাঁদেরও বিমানে মক্কায় আগমনও হতে পারে। পাসপোর্টে তাঁদের নাম ও তাঁদের পিতাদের নাম উল্লেখ থাকার কারণে তাঁদের পরিচিতি জ্ঞাত থাকবে। আর উক্ত হাদীসসমূহে হয়তো এটিই বলা হয়েছে। কারণ ,ঐ যুগে বিমানের অস্তিত্ব ছিল না।

যাঁরা রাতের বেলা নিজ নিজ শয্যা থেকে গায়েব হয়ে প্রভাতে মক্কায় উপস্থিত হবে অথবা ঐ সব সাহাবী যাঁদের সাথে অন্য সকলের আগে তিনি যোগাযোগ করে বিভিন্ন দায়িত্ব দেবেন তাঁদের সকলের চেয়ে মেঘমালার ওপর সওয়ার হয়ে যাঁরা দিনের বেলা ভ্রমণ করবেন তাঁদের শ্রেষ্ঠ হবার কারণ সম্ভবত এই যে ,তাঁরা প্রকৃত মুমিন হিসেবে ইমাম মাহ্দীর সাথে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড আঞ্জাম দিয়ে এসেছেন। যাঁরা নিজ নিজ শয্যা থেকে উধাও হয়ে যাবেন তাঁরা ঐ রাত এমতাবস্থায় যাপন করবেন যে ,তাঁদের মধ্যে কেউই জানবেন না যে ,তিনি মহান আল্লাহর কাছে ইমাম মাহ্দীর সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য। তবে তাঁদের তাকওয়া ও বিবেক-বুদ্ধি তাঁদেরকে এ মর্যাদার যোগ্য করবে। তাই মহান আল্লাহ্ তাঁদেরকে ইমাম মাহ্দীর সঙ্গী মনোনীত করবেন। আর সেখানে তাঁরা তাঁর সেবায় উপস্থিত হবেন।

কতিপয় রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে ,তাঁরা যখন নিজেদের বাড়ির ছাদে ঘুমিয়ে থাকবেন তখনই হঠাৎ তাঁরা গায়েব হয়ে যাবেন ও তাঁদের আত্মীয়রা তাঁদেরকে খুঁজে পাবে না। তাঁদেরকে মহান আল্লাহ্ মক্কায় নিয়ে যাবেন। আর এর মধ্যে ইঙ্গিত পাওয়া যাবে যে ,ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাব গ্রীষ্মকালে অথবা গ্রীষ্ম ও শরতের মাঝামাঝি সময়ে হবে। আর এ বিষয়টি আমরা পরে উল্লেখ করব। যাঁরা তাঁদের শয্যা থেকে গায়েব হয়ে যাবেন তাঁদের একটি অংশ গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চল ও দেশসমূহের অধিবাসী হবেন। সেখানকার অধিবাসীরা গ্রীষ্মকালে তাদের বাড়ির ছাদের ওপর অথবা উঠানে ঘুমায়।

রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে ,ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সাহাবীরা শুক্রবার রাতে 9 মুহররমের দিবাগত রাতে পবিত্র মক্কায় সমবেত হবেন। ইমাম সাদিক (আ.) থেকে বর্ণিত : মহান আল্লাহ্ তাদেরকে শুক্রবার রাতে পবিত্র মক্কায় একত্রিত করবেন। তাই তারা সবাই শুক্রবার প্রভাতে তার হাতে আনুগত্যের শপথ (বাইআত) করবে এবং তাদের কেউই বিরুদ্ধাচরণ করবে না। 335

এ রেওয়ায়েতটি শিয়া-সুন্নী সূত্রসমূহে বর্ণিত রেওয়ায়েতের সাথে সম্পূর্ণ মিলে যায় : মহান আল্লাহ্ মাহ্দীর বিষয় এক রাতের মধ্যেই ঠিক করে দেবেন।

এতদপ্রসঙ্গে মহানবী (সা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে :

المهدي منّا أهل البيت يُصلح الله أمره في ليلة

মাহ্দী আমাদের অর্থাৎ আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত। মহান আল্লাহ্ তার বিষয় এক রাতের মধ্যে ঠিক ও সমাধা করে দিবেন।

আরেকটি রেওয়ায়েতে বর্ণিত আছে : يُصلحه الله في ليلة মহান আল্লাহ্ তাঁকে এক রাতের মধ্যে প্রস্তুত করে দেবেন।

এ বিষয়টি আরো অনেক রেওয়ায়েতের সাথেও সামঞ্জস্যশীল যেগুলোয় 9 মুহররম শুক্রবারের দিবাগত সন্ধ্যায় ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের শুরু ,অতঃপর 10 মুহররম (আশুরার দিবস) শনিবারে তাঁর আত্মপ্রকাশের বিষয়টি নির্ধারণ করা হয়েছে।

পরীক্ষামূলক পদক্ষেপ ,নাফসে যাকীয়ার শাহাদাত

রেওয়ায়েতসমূহ অনুসারে এবং তখনকার সামাজিক পরিবেশ-পরিস্থিতির প্রকৃতি থেকে বোঝা যায় যে ,ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের সময় পবিত্র মক্কায় সক্রিয় শক্তিসমূহ বিদ্যমান থাকবে। যেমন হিজায সরকার যা দুর্বল ও পতন্মুখ হওয়া সত্ত্বেও ইমাম মাহ্দীর সম্ভাব্য আবির্ভাব মোকাবিলা করার জন্য শক্তি সঞ্চয় এবং সামরিক বাহিনী মোতায়েন করবে । আবির্ভাবের পর তাঁর প্রতি সকল মুসলমান ঝুঁকে পড়বে এবং তারা হজ্ব মৌসুমে তাঁর জন্য তাদের সকল কর্মকাণ্ড ও তৎপরতা প্রদর্শন করবে।

বৃহৎ শক্তি ও রাষ্ট্রসমূহের গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ : হিজায সরকার অথবা সুফিয়ানীর সেনাবাহিনীকে সহায়তা করার জন্য অথবা হিজায ,বিশেষ করে মক্কার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার জন্য স্বতন্ত্র এ সব সংস্থা তৎপর থাকবে।

সুফিয়ানীর গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক : তারা মদীনায় তাদের হাতের মুঠো থেকে যে দু ব্যক্তি পলায়ন করবে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করতে থাকবে এবং মক্কা থেকে ইমাম মাহ্দীর যে কোন আন্দোলন ও তৎপরতা দমন করার জন্য প্রয়োজনে হস্তক্ষেপ করার জন্য পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকবে।

এর বিপরীতে হিজাযে ,বিশেষ করে মক্কায় ইয়েমেনীদেরও অবশ্যই ভূমিকা থাকবে। আর তাদের আবির্ভাবের ক্ষেত্র প্রস্তুতকারী সরকার বেশ কয়েক মাস আগেই ইয়েমেনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকবে।

একইভাবে মক্কায় ইমাম মাহ্দীর ইরানী সাহায্যকারীরাও বিদ্যমান থাকবে। বরং হিজায ও মক্কার অধিবাসীদের মধ্য থেকে এবং হিজায প্রশাসনের অভ্যন্তরে মহান আল্লাহর সৎকর্মশীল বান্দাদের মধ্যেও তাঁর সাহায্যকারীরা থাকবে। এ ধরনের অনুকূল-প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে ইমাম মাহ্দী পবিত্র হারাম শরীফ থেকে তাঁর আন্দোলনের ঘোষণা দেবেন এবং মক্কার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করবেন।

আর স্বাভাবিকভাবে নিরাপত্তাজনিত কারণে রেওয়ায়েতসমূহে ইমাম মাহ্দীর এ পরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয় নি। তবে যে সব কিছু তাঁর পবিত্র আন্দোলন সফল করার ক্ষেত্রে সহায়ক ও উপকারী এবং এর জন্য ক্ষতিকারক নয় কেবল সেগুলোই ঐ সব রেওয়ায়েতসমূহে উল্লেখ করা হয়েছে।

রেওয়ায়েতসমূহে সবচেয়ে যে স্পষ্ট পদক্ষেপটি বর্ণিত হয়েছে তা হচ্ছে ইমাম তাঁর সাহাবী ও অত্মীয়দের মধ্য থেকে একজন যুবককে 24 অথবা 23 যিলহজ্ব অর্থাৎ তাঁর আবির্ভাবের 15 রাত আগে প্রেরণ করবেন যাতে সে মক্কাবাসীদের কাছে ইমামের বাণী পাঠ করে শোনায়।

তবে নামাযের পর হারাম শরীফে দাঁড়িয়ে মক্কাবাসীদের উদ্দেশে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর বাণী অথবা এর কয়েকটি প্যারা পাঠ করতে না করতেই তাঁর ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাঁকে মসজিদুল হারামের ভিতরে রুকন ও মাকামের মাঝখানে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হবে। আর তাঁর এ শাহাদাত আসমান ও জমীনে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে।

এ ঘটনাটি একটি পরীক্ষামূলক পদক্ষেপ হবে যা বিভিন্ন উপকারী দিকসম্বলিত। কারণ ,তা মুসলমানদের কাছে হিজায প্রশাসনের নিষ্ঠুরতা এবং এর পেছনে যে কুফরী শক্তিবর্গ আছে তা প্রকাশ করে দেবে।

এ তিক্ত ঘটনা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আন্দোলনের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে। স্মর্তব্য যে ,তাঁর আবির্ভাব এ ঘটনার পর দু সপ্তাহের বেশি বিলম্বিত হবে না। আরেক দিকে এ ধরনের ত্বরিৎ পরীক্ষামূলক ও নিষ্ঠুর পদক্ষেপ গ্রহণের কারণে হিজায প্রশাসনের অভ্যন্তরে পরিতাপ ও দুর্বলতার উদ্ভব হবে (অর্থাৎ এ হত্যাকাণ্ড ক্ষয়িষ্ণু হিজায প্রশসনকে আরো দুর্বল ও পতন্মুখ করে দেবে)।

পবিত্র মক্কা নগরীতে এ পুণ্যাত্মা যুবকের শাহাদাত সংক্রান্ত হাদীস ও রেওয়ায়েতসমূহ শিয়া-সুন্নী সূত্র ও গ্রন্থসমূহে বিদ্যমান এবং শিয়া গ্রন্থ ও সূত্রসমূহে এগুলো প্রচুর। আর এ সব রেওয়ায়েতে তাঁকে অল্পবয়স্ক যুবক ও আন নাফ্সূয্ যাকিয়াহ্ (পবিত্র পুণ্যাত্মা) বলে অভিহিত করা হয়েছে। তবে এ সব রেওয়ায়েতের মধ্যে কয়েকটিতে তাঁর নাম মুহাম্মদ ইবনুল হাসান বলেও উল্লিখিত হয়েছে।

ইমাম আমীরুল মু মিনীন আলী (আ.) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেছেন : ‘‘ আমি কি তোমাদেরকে অমুক বংশের রাজত্বের সর্বশেষ সময়কাল বলে দেব ?’’ আমরা (রাবী) বললাম ,‘‘ হে আমীরুল মু মিনীন ,জী হ্যাঁ , (বলুন)। ’’ তিনি বললেন ,‘‘ একজন সম্মানিত কুরাইশ বংশীয় ব্যক্তিকে হারাম শরীফে (মক্কা নগরীর মসজিদুল হারামের অভ্যন্তরে) হত্যা করা হবে যার রক্তপাত হারাম বলে গণ্য। যিনি বীজ সমূহকে বিদীর্ণ করে বৃক্ষরাজি সৃষ্টি এবং প্রাণের উম্মেষ ঘটিয়েছেন তার শপথ এ ঘটনার পর তাদের রাজত্ব পনের রাতের বেশী স্থায়ী হবে না। ’’ আমরা বললাম ,‘‘ এর আগে অথবা এর পরে কি কিছু ঘটবে অতঃপর তিনি বললেন ,‘‘ রমযান মাসে আসমানী গায়বী আহবান ধ্বনি যা জাগ্রত ব্যক্তিকে ভীত-দূর্বল করে দেবে এবং ঘুমন্ত ব্যক্তিকে জাগ্রত করবে এবং যুবতীকে তার বাসর ঘর থেকে বের করে আনবে। 336

عن قوم من قریش (কুরাইশ্  গোত্রের অমুক বংশীয়) এটি একটি ভুল বাক্য হতে পারে। কারণ কোন অর্থ এ থেকে বোধগম্য নয়।

ইমাম বাকির (আ.) থেকে আবু বসীর কর্তৃক বর্ণিত একটি দীর্ঘ রেওয়ায়েত বিদ্যমান আছে । ঐ রেওয়ায়েতে ইমাম বাকির (আ.) বলেছেন : আল-কায়েম (ইমাম মাহ্দী) তাঁর সাহাবাদেরকে বলবেন : ‘‘ হে লোক সকল ,মক্কাবাসীরা আমাকে চায় না। তবুও আমি তাদের কাছে আমাদের মত ব্যক্তির জন্য হুজ্জাত (দলীল-প্রমাণ) পেশ্ করার জন্য তাদের কাছে প্রতিনিধি (আমার সাহাবাদের মধ্যে থেকে এক ব্যক্তিকে) প্রেরণ করব। ’’ তিনি তার একজন সাহাবাকে ডেকে বলবেন ,‘‘ তুমি মক্কাবাসীদের কাছে গিয়ে বলবেঃ  হে মক্কার অধিবাসীবৃন্দ ,আমি তোমাদের কাছে অমুকের প্রেরিত দূত। আর তিনি তোমাদেরকে বলেছেন : নিশ্চয়ই আমরা মহান আল্লাহর ঐশী কৃপার আহলুল বাইত (আ.) এবং রিসালাত ও খিলাফতের খনি। আর আমরা মহানবী (সা.) এর বংশধর এবং মহান নবীদের পবিত্র রক্তজ বংশ ধারা। আমাদের ওপর অত্যাচার করা হয়েছে। আমাদের ওপর নির্যাতন চালান হয়েছে। আমাদেরকে দমন করা হয়েছে। যখন থেকে আমাদের নবী (সা.) ইন্তেকাল করেছেন তখন থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের ন্যায্য অধিকার থেকে আমাদের বঞ্চিত রাখা হয়েছে। তাই আমরা তোমাদের কাছে সাহায্য চাচ্ছি এবং তোমারাও আমাদেরকে সাহায্য করো। ’’ তাই ঐ যুবকটি যখন এ কথা বলবে ,তার ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাকে রুকন ও মাকামের মাঝখানে জবাই করা হবে। আর যুবকটি হবে নাফসে যাকিয়াহ্ (পবিত্র পূণ্যাত্মা)। যখন এ সংবাদ ইমাম মাহ্দী (আ.) এর কাছে পৌঁছবে তখন তিনি তার সাহাবাদেরকে বলবেন : ‘‘ আমি  তোমাদেরকে অবগত করি নি যে ,মক্কাবাসীরা আমাকে চায় না ?’’ অতঃপর আর (আ.) আবির্ভূত হওয়া পর্যন্ত মক্কাবাসীরা তাকে আহবান করবে না। অতঃপর তিনি তূওয়াব পাহাড়ের পেছন দিক থেকে 313 বদর যুদ্ধের মুজাহিদদের সংখ্যা অনুরুপ 313 জন সাথী সহকারে মক্কা নগরীতে অবতরণ করবেন। এরপর তিনি মসজিদুল হারামে এসে মকাম-ই ইব্রাহীমে 4 রাকাত্ নামায পড়বেন। এরপর তিনি হজরে আসওয়াদের দিকে পিঠ হেলান দিয়ে মহান আল্লাহর প্রশাংসা ও গুণকীর্তন করবেন এবং মহানবী (সা.)কে স্মরণ করে তাঁর ওপর দরূদ পাঠ করবেন। এরপর তিনি এমন কথা বলবেন যা জনগণের মধ্য থেকে কেউই কোন দিন বলে নি। 337

ইতিমধ্যে আমরা উল্লেখ করেছি এ রেওয়ায়েতটি মারফূ এবং তূওয়া হতে পবিত্র মক্কা নগরীর একটি পাহাড় এবং সেখানে প্রবেশ করা একটি পথ । আর নাফসে যাকিয়াহ্ সম্পর্কে যা কিছু রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে সেগুলো আসলে শক্তিশালী। তিনি হবেন শক্তিশালী অধিকারী। তবে ইমাম মাহ্দী (আ.) এর আবির্ভাবের ধরন-প্রক্রিয়ায় অধিক প্রাধান্য প্রাপ্ত বিষয় হচ্ছে এই যে ,তিনি এবং তাঁর সাহাবাগণ মসজিদুল হারামে একসংগে নয় বরং একাকী প্রবেশ করবেন। আর এ ব্যাপারে আমরা আলোচনা করব ।

ইবনে হাম্মাদ তার গ্রন্থের 89 ,91 ও 93 পৃষ্ঠায় যে নাফসে যাকিয়াহ্ মদীনায় এবং যে নাফসে যাকিয়াহ্ পবিত্র মক্কা নগরীতে নিহত হবে। তাদের সম্পর্কে বেশ কিছু রেওয়ায়েত উদ্ধৃত করেছেন। উক্ত গ্রন্থের 93 পূষ্ঠায় বর্ণিত রেওয়ায়েতটি এখানে উদ্ধৃত করা হলো : নাফসে যাকিয়াহ্ নিহত হওয়া পর্যন্ত ইমাম মাহ্দী (আ.) আবির্ভূত হবেন না। যখন ঐ নাফসে যাকীয়াহ্ নিহত হবে তখন আকাশ ও পৃথিবীতে যারা আছে তারা তার হত্যাকারীদের প্রতি ক্রদ্ধ হবে। অতঃপর জনগণ ইমাম মাহ্দী (আ.) এর কাছে এসে নববধূকে বাসর রাতে যেভাবে আর স্বামী-গৃহে নিয়ে যাওয়া হয় ঠিক সেভাবে তাঁর চারপাশে জড় ও সমবেত হবে। আর তিনি পৃথিবীকে ন্যায় বিচার দিয়ে পরিপূর্ণ করে দেবেন। তখন যমীনের বুকে বৃক্ষ ও উদ্ভিদরাজি জন্মবে এবং আকাশ থেকে বৃষ্টিবর্ষিত হবে। আর তাঁর বেলায়েত কালে (শাসন ও ইমামতকালে) আমার উম্মৎ যেভাবে নেয়ামত প্রাপ্ত হবে তারা অন্যসময় কখনো সেভাবে নেয়ামত প্রাপ্ত হয় নি। 338

91 পৃষ্ঠায় আম্মার ইবনে ইয়াসির থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন : যখন নাফসে যাকিয়াহ্ নিহত হবে এবং তার ভাই পবিত্র মক্কা নগরীতে নিহত হবে তখন এ ভয়ানক অপরাধের জন্য আসমান থেকে একজন আহবানকারী আহবান জানিয়ে বলবে : ‘‘ নিশ্চয়ই তোমাদের নেতা অমুক। আর তিনিই হচ্ছেন মাহ্দী যিনি সমগ্র পৃথিবী সত্যও ন্যায় পরায়ণতা দিয়ে পরিপূর্ণ করে দেবেন। ’’ 339

( و قل جاء الحق و زهق الباطل إنّ الباطل کان زهوقا )

আর (হে নবী !) আপনি বলে দিন : সত্য এসেছে এবং মিথ্যা বিদূরিত হয়েছে। নিশ্চয়ই মিথ্যা দূরীভূত ও ধ্বংস হবেই ।

ইমাম মাহ্দী (আ.) এর আবির্ভাব আন্দোলনের শুরুর ধরন ও প্রক্রিয়া এবং এর সময়কাল সংক্রান্ত রেওয়ায়েত ও হাদীস সমূহের মধ্যে সামান্য পার্থক্য আছে। তবে যা উত্তম বলে মনে হয় তা হচ্ছে এই যে ,ইমাম মাহ্দী (আ.) 313 জন সঙ্গী-সাথী (সাহাবী) সহকারে আবির্ভূত হবেন। তখন তিনি মুহররম মাসের 9 তারিখের সন্ধ্যায় একা একা মসজিদুল হারামে প্রবেশ করে এশার নামাযের পর মক্কাবাসীদের উদ্দেশ্যে বাণী প্রদানের মাধ্যমে তার পবিত্র আন্দোলনের ঘোষণা দেবেন। অতঃপর তাঁর সঙ্গী-সাথীগণ ঐ রাতে পবিত্র মক্কা নগরী ও হারামের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবেন। পরের দিন অর্থাৎ 10 মুহররমে তিনি তাঁর বাণী সমগ্র বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে তাদের নিজ নিজ ভাষায় প্রদান করবেন।

অতঃপর সুফিয়ানী বাহিনীর ভূমিধ্বসে ভূ-গর্ভে প্রোথিত হওয়ার মু জিয়া সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত তিনি পবিত্র মক্কা নগরীতে অবস্থান করতে থাকবেন। অতঃপর তিনি দশ হাজার বা ততোধিক সৈন্যসহ পবিত্র মদীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবেন।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, রেওয়ায়েত সমূহে পবিত্র মক্কা নগরী থেকে ইমাম মাহদী (আ.) এর আন্দোলনের সূচনা আবির্ভাব ( ظهور ) উত্থান ( قیام ) ও বের হওয়া ( خروج ) এ সব শব্দ সহযোগে বর্ণিত হয়েছে এবং মনে হচ্ছে যে ,এসব উক্তির অর্থ একই। তবে কতিপয় রেওয়ায়েতে আবির্ভাব ও বের হওয়া`র মাঝে পার্থক্য করা হয়েছে। আর মক্কায় ইমাম মাহ্দী (আ.) এর আন্দোলনকে আবির্ভাব এবং সেখান থেকে পবিত্র মদীনার দিকে তার গমন বা যাত্রাকে বের হওয়া বলা হয়েছে এবং উল্লেখ করা হয়েছে যে ইমামের আবির্ভাব পবিত্র মক্কা নগরীতে তার বিশেষ সঙ্গী-সাথীদের উপস্থিতিতে হবে। অথচ পবিত্র মক্কা থেকে মদীনা নগরীর উদ্দেশ্যে তার যাত্র ঐ সময় সংঘটিত হবে যখন তার সঙ্গী-সাথীদের সংখ্যা দশ হাজারে উন্নীত হবে এবং সুফিয়ানী বাহিনী ও ভূমি ধ্বসের মাধ্যমে ধ্বংস হবে।

হযরত আব্দুল আযীম হাসানী (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন : আমি হযরত ইমাম জাওয়াদ (আ.) কে বললাম ,‘‘ আমি আশা করি যে ,আপনিই হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর আহলুল বাইতের কায়েম যিনি যেভাবে পৃথিবী অন্যায়-অত্যাচার দিয়ে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে ঠিক তেমনি পৃথিবীকে ন্যায় ও সুবিচার দিয়ে পূর্ণ করে দেবেন। ’’ তিনি বললেন ,‘‘ হে আব্দুল কাসিম ,আমরা আহলুল বাইত (আ.) সবাই কায়েম বি আমরিল্লাহ্ (মহান আল্লাহর দ্বীন ও খিলাফতের তত্ত্বাবধায়ক) এবং মহান আল্লাহর ধর্মের দিকে পরিচালনাকারী। আমি সেই কায়েম নই যিনি পৃথিবীকে কাফির-নাস্তিকদের থেকে পবিত্র করবেন এবং ন্যায় ও সুবিচার দিয়ে তা পূর্ণ করে দেবেন। আর সেই কায়েম হবে সেই ব্যক্তি যাঁর জন্ম মানুষের কাছ থেকে গোপন থাকবে এবং যিনি স্বয়ং তাদের থেকে লুক্কায়িত অর্থাৎ অন্তর্ধানে থাকবেন। আর তাঁর নামে তাঁকে ডাকা তাদের ওপর তখন নিষিদ্ধ থাকবে। তাঁর নাম হবে মহানবীর (সা.) নামের অনুরূপ এবং কুনিয়াহ্ (পিতা ,পুত্র বা কন্যার নামসহ উপাধি) হবে মহানবী (সা.) এর কুনিয়াহ্ (অর্থাৎ আবুল কাসিম) তিনি নিমিষে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে সফর করবেন। তার জন্য সকল কষ্টসাধ্য ও দূরূহ বিষয় সহজসাধ্য করে দেয়া হবে। বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুজাহিদদের সংখ্যার অনুরূপ তাঁর সাহাবাদের মধ্যে থেকে 313 জন পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চল সমূহ থেকে তাঁর কাছে এসে মিলিত ও একত্রিত হবেন। আর এটা হচ্ছে মহান আল্লাহর এ বাণীটির মর্মার্থ :

( این ما تکونوا یأت بکم الله جمیعا إنّ الله علی کل شئ قدیر )

(তোমরা যেখানেই থাক না কেন তোমাদের সবাইকে মহান আল্লাহ একত্রিত করবেন। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান।) অএব, পৃথিবীবাসীদের মধ্য থেকে যখন 313 জন বিশিষ্ট ব্যক্তি তাঁর সাথে মিলিত হবে তখন তিনি আবির্ভূত হবেন। আর যখন তার সঙ্গী-সাথীদের সংখ্যা দশ হাজারে এ উন্নীত হবে তখন তিনি মহান আল্লাহ্ যে পর্যন্ত সন্তুষ্ট না হবেন সে পর্যন্ত তিনি আল্লাহ পাকের শত্রুদেরকে হত্যা ও নিধন করতে থাকবেন। আব্দুল আযীম বলেন : আমি তাঁকে বললাম ,হে আমার নেতা ,কিভাবে জানা যাবে যে ,মহান আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়েছেন ?তিনি বললেন ,‘‘ যখন মহান আল্লাহ্ তাঁর অন্তরে দয়া প্রবিষ্ট করিয়ে দেবেন । 340

আর আমাশও আবু ওয়ায়েল থেকে বর্ণনা করেছেন। একদা আমীরুল মু মিনীন্ আলী (আ.) ইমাম হুসাইন (আ.) এর দিকে তাকিয়ে বললেন ,‘‘ নিশ্চয়ই আমার এ পুত্রটি সাইয়েদ (নেতা)। আর মহানবীও (সা.) তাঁকে সাইয়েদ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর ঔরস (বংশধর) থেকে মহান আল্লাহ তোমাদের নবীর নামের অনুরূপ নাম বিশিষ্ট এক ব্যক্তিকে সৃষ্টি করবেন। অতঃপর সে চরিত্র ও শারীরিক গঠনের দিক দিয়ে ও তাঁর সদৃশ্য হবে। তিনি ঐ সময় বের হবেন যখন জনতা গাফলতির মধ্যে নিমজ্জিত থাকবে ,সত্যকে মিটিয়ে ফেলা হবে এবং প্রকাশ্যে অন্যায়-অত্যাচার করা হবে। মহান আল্লাহর শপথ যদি তিনি আবির্ভূত না হন তাহলে তার গর্দান-ই কেটে ফেলা হবে। আকাশ বাসীরা তার আবির্ভারের মাধ্যমে আনন্দ প্রকাশ করবে। যেভাবে পৃথিবী অন্যায়-অবিচার-অত্যাচার দিয়ে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে ঠিক সেভাবে তিনি পৃথিবীকে ন্যায় ও সুবিচার দিয়ে ভরে দেবেন । 341

যদি তিনি অবির্ভূত না হন তাহলে তাঁর গর্দানই কেটে ফেলা হবে। ইমাম (আ.) এর উক্তি থেকে প্রতীয়মান হয় যে ,আবির্ভাবের অল্প কিছুকাল আগে শত্রু পক্ষীয় নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক প্রকৃত ঘটনা যা ঘটতে যাচ্ছে তা বুঝতে পারবে এবং ইমাম মাহ্দী (আ.) এর পরিকল্পনা এমনভাবে ফাঁস হয়ে যাওয়ার উপক্রম হবে যে ,যদি তিনি আবির্ভুত না হন তাহলে তাঁকে হত্যা করার হুমকী দেয়া হবে।

ইব্রাহীম জারীরী নিজ পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন। যিনি বলেছেন : নাফসে যাকিয়াহ্ মহানবী (সা.) এর আহলুল বাইতের অন্তর্ভূক্ত। তার নাম মুহাম্মদ ইবনুল হাসান (আ.)। তাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হবে। আর যখন তাকে হত্যা করা হবে তখন আকাশ ও পৃথিবীতে তাদের আর কোন অজুহাতই আর বিদ্যমান থাকবেনা। এ সময়ই হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর বংশধারার কায়েমকে মহান আল্লাহ্ একদল লোকের মাঝে আবির্ভূত করবেন। তারা জনগণের দৃষ্টিতে চোখের সুরমার চেয়েও অধিকতর কঠিন অর্থাৎ স্বল্প হবে। যখন তারা আবির্ভূত হবেন তখন জনতা তাদের জন্য অশ্রুপাত করবে। কারণ তারা ভাববে যে তাঁদেরকে গ্রেপ্তার করা হবে। তবে মহান আল্লাহ্ তাদের জন্য প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উম্মুক্ত করে দেবেন। তাই তোমাদের জেনে রাখা উচিৎ যে তারাই হচ্ছে প্রকৃত মু মিন এবং তোমাদের আরও জানা থাকা দরকার যে ,সর্বোত্তম জিহাদ আখেরী যামানায় হবে। 342

এ রেওয়ায়ত থেকে প্রতীয়মান হয় যে ,হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.) শুরুতে অল্প কয়েকজন সঙ্গীসহ আবির্ভূত হবেন। জনগণ তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকবে এবং আশংকা করবে যে ,তাঁরা দ্রুত বন্দী ও নিহত হবে।

ইমাম বাকির (আ.) থেকে বর্ণিত : নিশ্চয়ই কায়েম যি তূওয়া পাহাড়ের পথ ধরে বদর যুদ্ধের মুজাহিদদের সংখ্যা অনুরুপ সংখ্যক অর্থাৎ 313 জন সাথীসহ আসবেন। অতঃপর তিনি হজরে আসওয়াদের ওপর দাঁড়াবেন এবং মহানবী (সা.) এর পতাকা উত্তোলন করবেন।

আলী ইবনে হামযাহ বলেনঃ এ বিষয়টা আমি আবুল হাসান মূসা ইবনে জাফর (আ.) এর কাছে উল্লেখ করলে তিনি আমাকে বলেছিলেন ,‘‘ এবং একটি লিখিত খোলা পত্র ’’343

এ রেওয়ায়েতের অর্থ এটি নয় যে ,ইমাম মাহদী (আ.) মসজিদুল হারামে প্রবেশ করার আগে যি তূওয়া থেকে নিজ সঙ্গীদের সাথে নিয়ে তাঁর আবির্ভাবের ঘোষণা দেবেন। বরং এর অর্থ হচ্ছে যে ,পবিত্র মক্কা নগরীতে তাদের আগমন যি তূওয়ার পথ ধরে হবে অথবা মসজিদুল হারামের দিকে তাদের অগ্রযাত্রা ও এগিয়ে যাওয়ার সূচনা সেখান থেকেই হবে। আর উত্তোলিত পতাকাটি হবে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এরই পতাকা ,রেওয়ায়েত সমূহে উল্লেখ করা হয়েছে যে ,তা হযরত মাহ্দী(আ.) এর সাথে থাকবে এবং জঙ্গে জামালের পর থেকে ইমাম মাহ্দী (আ.) কর্তৃক উত্তোলন করা পর্যন্ত তা আর উত্তোলন করা হয় নি।

আর ইমাম কাযিম (আ.) এর উক্তি এবং একটি লিখিত খোলা পত্র ’, যা রেওয়ায়েতটির পাদটীকায় উল্লেখ করা হয়েছে তার অর্থ হচ্ছে এই যে ,ইমাম মাহ্দী (আ.) জনগণের উদ্দেশ্যে লেখা একটি খোলা পত্র বের করবেন এবং সম্ভবতঃ লিখিত পত্রটি উক্ত প্রসিদ্ধ অঙ্গীকার পত্র হবে ,যা মহানবী (সা.) এর মুখনিঃসৃত বাণী এবং হযরত আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) এর হস্তাক্ষরে লিখিত। আর ঠিক এভাবেই একই উৎসে বিদ্যমান রেওয়ায়েতটিও এ দিকেই ঈঙ্গিত প্রদান করে।

রেওয়ায়েত সমূহে উল্লেখ করা হয়েছে যে ,তাঁর সাথে মহানবী (সা.) এর জীবন এবং সকল নবীরর সীরাত উত্তরাধিকার সমূহ বিদ্যমান থাকবে।

ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) বলেছেন : মাহ্দী (আ.) যী তূওয়া পর্বতের দূর্গম সরু (গিরি) পথ দিয়ে বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুজাহিদদের সংখ্যার অনুরূপ 313 ব্যক্তিসহ মক্কায় অবতরণ করে মসজিদুল হারামে প্রবেশ করবেন এবং মাকাম-ই ইব্রাহীমে চার রাকাত নামায পড়ে হজরে আসওয়াদে হেলান দিয়ে দাঁড়াবেন। এরপর তিনি মহান আল্লাহর প্রশংসা ,স্তুতি ও গুণকীর্তন করার পর মহানবী (সা.) নাম স্বরণ করে তাঁর (সা.) ওপর দরূদ ও সালাম পাঠ করবেন। অতঃপর তিনি জনগণের উদ্দেশ্যে এমন ভাষণ দেবেন যা কেউ কোন দিন বলে নি। প্রথম যাঁরা তার হাতে বাইআত করবে তারা হবে জিব্রাঈল ও মীকরাঈল। 344

তবে রেওয়ায়েত সমূহে হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.) এর দু টি ভাষণ যার প্রথমটি তিনি মক্কা বাসীদের উদ্দেশ্যে প্রদান করবেন এবং দ্বিতীয়টি সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্ ও বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে প্রদান করবেন। তার কিছু অংশ উল্লেখ করা হয়েছে ।

এ সব রেওয়ায়েতের মধ্যে ইবনে হাম্মাদের হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপির 95 পৃষ্ঠায় আবু জাফর (ইমাম বাকির) (আ.) থেকে বর্ণিত রেওয়ায়েতটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি (সা.) বলেন : অতঃপর মাহ্দী (আ.) এশার ওয়াক্তে আবির্ভূত হবেন। তাঁর সাথে থাকবে রসুলুল্লাহ্ (সা.) এর পতাকা ,পোষাক ও তরবারিসহ বেশ কিছু নিদর্শন ,আলোও বিবৃতি । এশার নামায পড়ার পর  সে উচ্চ কণ্ঠে ঘোষণা করবে : হে লোকসকল আমি তোমাদের মহান আল্লাহর কথা এবং তোমরা যে তোমাদের প্রভূর সামনে উপনিত ও দণ্ডায়মান তা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। নিশ্চয়ই তিনি তার ঐশি দলীল-প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন। নবীদেরকে প্রেরণ করেছেন এবং কিতাব অবতীর্ণ করেছেন। তার সাথে কোন কিছু শরীক না করতে ,তাঁর ও তাঁর রাসুলের অনুগত্যের ওপর অটল থাকতে। পবিত্র কোরআন যা প্রচলন করেছে তা প্রচলন এবং যা বিলুপ্ত ও উচ্ছেদ করেছে তা বিলুপ্ত ও উচ্ছেদ করতে ,হিদায়েতের ব্যাপারে পরষ্পর সহযোগিতা এবং তাকওয়ার ব্যাপারে একে অপরকে সাহায্য করতে তোমাদেরকে মহান আল্লাহ্ আদেশ দিয়েছেন। অতঃপএর এ পার্থিব জগতের ধ্বংস ও বিলুপ্তি আসন্ন হয়ে গেছে এবং তা বিদায় নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। তাই আমি তোমাদেরকে মহান আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের দিকে ,ঐশীগ্রন্থ কোরআন অনুযায়ী আমল করতে ,মিথ্যা-বাতিলের বিলোপ সাধন এবং মহান আল্লাহর বিধিবিধান পুনরুজ্জীবিত করতে আহবান জানাচ্ছি। ’’ অতঃপর তিনি বদর যুদ্ধের যোদ্ধাদের সংখ্যক অনুরূপ অর্থাৎ 313 জন সঙ্গীসহ পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা ছাড়াই আবির্ভূত হবেন। উল্লেখ্য যে তার সঙ্গীগণ শরৎকালীন ইতস্থতঃ বিক্ষিপ্ত মেঘমালার ন্যায় বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে। তারা হবে রাতের বেলা দুনিয়া ত্যাগী সাধক পুরুষ এবং দিনের বেলা সিংহ পুরুষ বীর। মহান আল্লাহ্ মাহ্দীর জন্য হিজাজ ভূখণ্ড বিজিত করে দেবেন এবং সেদেশে বনী হাশিমের যারাই কারাগারে বন্দী থাকবে তাদেরকে তিনি মুক্ত করবেন। তখন কালো পতাকাসমূহ কূফায় অবতরণ করবে এবং ইমাম মাহ্দী (আ.) এর কাছে বাইআত করার জন্য তারা প্রতিনিধিদল প্রেরণ করবে । তিনি সকল অন্যায় ও অত্যাচারের অবসান ঘটাবেন এবং অত্যাচারীদেরকে ধ্বংস করবেন। পরিশেষে বিশ্বের সকল দেশে তাঁর মাধ্যমে ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হবে।

হাদীসটিতে বর্ণিত قزع الخریف শরৎ কালের মেঘমালা যা ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্তবস্থায় আকাশে ভেসে বেড়ায় ও অতঃপর তা একত্রিত হয়। তবে যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম ইমাম মাহ্দী (আ.) এর সাহাবাদের একত্রিত হওয়ার বিষয়কে শরৎকালীন আকাশে ইতস্ততঃ ভাসমান ও বিক্ষিপ্ত মেঘমালার সাথে তুলনা করেছেন তিনি হচ্ছেন ইমাম আমীরুল মু মিনীন আলী (আ.) ।

একইভাবে নাহজুল বালাগাহর 166 নং ভাষণে এবং সম্ভবত তিনি তা মহানবী (সা.) এর কাছ থেকে গ্রহণ করে থাকবেন।

আর ইতোমধ্যে আমরা যেমন ঈঙ্গিত করেছি তদানুযায়ী পবিত্র মক্কা নগরীতে শরৎকাল অথবা গ্রীষ্মের শেষে ইমাম মাহ্দী (আ.) আবির্ভূত হওয়া এবং তা সঙ্গী-সাথীদের সমবেত ও একত্রিত হবার সম্ভাবনা আছে।

আবু খালিদ আল-কাবুলী থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন : ইমাম আবু জাফর (ইমাম বাকির) বলেছেন : মহান আল্লাহর শপথ আমি যেন অবশ্যই কায়েমের দিকে তাকিয়ে আছি। সে হাজরে আসওয়াদের ওপর পিঠ ঠেকিয়ে আছেন। এর পর সে নিজ অধিকারের ব্যাপারে মহান আল্লাহর নাম শপথ করে বলছেন : হে লোক সকল ,যে কেউই আমার ব্যাপারে তর্ক-বিতর্ক করবে সে যেন জেনে রাখে যে আমি মহান আল্লাহর কাছে সকল লোক অপেক্ষা সবচেয়ে যোগ্য ও অগ্রাধিকার প্রাপ্ত হে লোক সকল ,যে কেউ আদম (আ.) এর ব্যাপারে আমার সাথে তর্ক-বিতর্ক করবে তাহলে আমি আদম (আ.) এর ব্যাপারে সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি। হে লোক সকল ,যে কেউ নূহ (আ.) এর ব্যাপারে আমার সাথে তর্ক-বিতর্ক করবে তাহলে আমি নূহ (আ.) এর ব্যাপারে সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি। হে লোক সকল ,যে কেউ ইব্রাহীম (আ.) এর ব্যাপারে আমার সাথে তর্ক-বিতর্ক করবে তাহলে আমি ইব্রাহীম (আ.) এর ব্যাপারে সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি। হে লোক সকল ,যে কেউ মূসা (আ.) এর ব্যাপারে আমার সাথে তর্ক-বিতর্ক করবে তাহলে আমি মূসা (আ.) এর ব্যাপারে সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি। হে লোক সকল ,যে কেউ ঈসা (আ.) এর ব্যাপারে আমার সাথে তর্ক-বিতর্ক করবে তাহলে আমি ঈসা (আ.) এর ব্যাপারে সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি। হে লোক সকল ,যে কেউ হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর ব্যাপারে আমার সাথে তর্ক-বিতর্ক করবে তাহলে আমি হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর কাছে সবচেয়ে যোগ্য ও নৈকট্য প্রাপ্ত ব্যক্তি। হে লোক সকল ,যে কেউ মহান আল্লাহর ঐশী গ্রন্থ পবিত্র কোরআন নিয়ে আমার সাথে তর্ক-বিতর্ক করবে তাহলে আমি মহান আল্লাহর কিতাবের ব্যাপারে সবচেয়ে যোগ্য ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ব্যক্তি (অর্থাৎ এ ঐশী গ্রন্থ সম্পর্কে আমি সবচেয়ে জ্ঞাত ও জ্ঞানী)। এরপর সে মাকাম-ই ইব্রাহীমে গিয়ে দু রাকাত নামায পড়বে। 345

কতিপয় রেওয়ায়েতে কিছু কিছু বাড়তি বিষয় বা বক্তব্য সংযোজিত হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে যেমন নিম্নোক্ত রেওয়ায়েতটি উল্লেখ করা হল। তিনি (ইমাম মাহ্দী) বলবেন : হে লোক সকল ,নিশ্চয়ই আমরা মহান আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করছি। তাই লোকদের মধ্য থেকে কে আমাদের আহবানে সাড়া দেবে ?আমি তোমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর আহলে বাইতভূক্ত। আর আমরাই মহানবীর (সা.) কাছে সকল মানুষ অপেক্ষা অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ও নিকটবর্তী। আমি আদম (আ.) এর উত্তরসূরী ও তাঁর স্থলাভিষিক্ত। আমি নূহ (আ.) এর সঞ্চিত সম্পদের ভান্ডার ,ইব্রাহীমের বংশধারা থেকে মনোনীত এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর আহলে বাইতেরও মনোনীত (ব্যক্তি)। যে কোন ব্যক্তি আমার সাথে রসূলুল্লাহর (সা.) এর সুন্নাহ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করবে তাহলে আমি রসুলুল্লাহ্ (সা.) এর সুন্নাহর ব্যাপারে সবচেয়ে জ্ঞানী (অর্থাৎ সবচেয়ে অগ্রাধিকার প্রাপ্ত)। অতঃপর মহান আল্লাহ তার চারপাশে তার সঙ্গী-সাথীদেরকে একত্রিত করে দেবেন যাদের সংখ্যা হবে 313জন। আর তিনি তাদেরকে পূর্বহতে নির্ধারণ করা ছাড়াই একত্রিত করে দেবেন। তাঁরা রুকন ও মাকাম-ই ইব্রাহীমের মাঝখানে তার হাতে বাইআত করবে। আর তাঁর সাথে রসূলুল্লাহ (সা.) এর কাছ থেকে একটি প্রতীজ্ঞা পত্র থাকবে যা বংশ পরম্পরায় উত্তরাধিকার সূত্রে তাঁর কাছে বিদ্যমান। 346

কিছু কিছু রেওয়ায়েতে উল্লেখ করা হয়েছে যে ,ইমাম মাহ্দী (আ.) এর একজন সাহাবা সর্বপ্রথম মসজিদুল হারামে দাড়িয়ে জনতার সামনে তাঁকে (সা.) পরিচিতি করাবে এবং তাদেরকে তাঁর কথা শোনার এবং তাঁর প্রতি সাড়া দান করার আহবান জানাবে। এরপর তিনি দাঁড়াবেন এবং বক্তৃতা দেবেন। ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) বলেছেন ,‘‘ অতঃপর তাঁর পক্ষ থেকে এক ব্যক্তি দন্ডায়মান হয়ে জনতাকে সম্বোধন করে বলবে : হে লোক সকল ,এ ব্যক্তি তোমাদের কাঙ্ক্ষিত যিনি তোমাদের কাছে এসেছেন। তিনি তোমাদেরকে ঐ বিষয়ের দিকে আহবান জানাচ্ছেন যে ,বিষয়ের দিকে রসূলুল্লাহ্ (সা.) তোমাদেরকে আহবান জানিয়েছিলেন। তিনি বলেনঃ অতঃপর তারা সবাই দাঁড়াবে আর তিনি নিজেও দাঁড়িয়ে বলবেন ,‘‘ হে জনতা ,আমি অমুকের পুত্র অমুক রসূলুল্লাহ্ (সা.) এর বংশধর। মহানবী (সা.) তোমাদেরকে যে বিষয়ের দিকে আহবান জানিয়েছেন আমিও তোমাদেরকে সে একই বিষয়ের দিকে আহবান করছি। অতঃপর তাঁকে হত্যা করার জন্য লোকেরা উঠে দাঁড়াবে। কিন্তু তিন শতাধিক ব্যক্তি ইমাম মাহ্দী (আ.) এর বিশেষ সঙ্গী উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর ও হত্যাকারীদের মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। 347

‘‘ তাঁর পক্ষ থেকে এক ব্যক্তি ’’ এ বাক্যাংশের অর্থ তাঁর রক্ত সম্পর্কীয় এক ব্যক্তি। আর অতঃপর তারা সবাই দাঁড়াবে এ বাক্যটির অর্থ : অতঃপর তারা হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.) কে দেখার জন্য দাঁড়াবে যাঁর কথা জনগণের মুখে মুখে উচ্চারিত হবে এবং জনগণও যাঁর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষামাণ থাকবে।

অতঃপর তারা সবাই দাঁড়াবে এ কথার অর্থ এটি হবার সম্ভাবনা আছে যে ,হিজায প্রশাসন ও সরকারের ভয়ে তারা সেখান থেকে সরে পড়ার জন্য উঠে দাড়াবে। আর যারা তাঁকে হত্যা করার  জন্য দাঁড়াবে তারা অবশ্যই হিজায সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য হবে।

এ রেওয়ায়েতটিতে ইমাম মাহ্দী (আ.) এর প্রতি মুসলমানদের অধীর আগ্রহ ,তাঁকে তাদের সন্ধান এবং একই সময় ইমাম মাহ্দী (আ.) এর শত্রুপক্ষ কর্তৃক ধর পাকড় এবং তাদের সন্ত্রাসমূলক কর্মকাণ্ড ও তৎপরতায় তাদের ভীত সন্ত্রস্ত থাকার একটি সুক্ষ্ম চিত্র অংকিত হয়েছে।

আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে এই যে ইমামের বিশেষ সঙ্গীরা (তিনশ তের জন) যে রেওয়ায়েতে বর্ণিত ঐ ধরণের ভয়ঙ্কর শ্বাসরূদ্ধকর পরিবেশের থেকে হারাম শরীফ ও পবিত্র মক্কানগরীকে মুক্ত করার জন্য যথেষ্ট হবেন তা অসম্ভব বলেই মনে হয়। আর ‘‘ আমি মাহ্দীর প্রেরিত দূত- এ কথা বলার অপরাধে এবং ইমাম মাহ্দী (আ.) এর বাণীর কিছু অংশ পাঠ করার কারণে নাফসে যাকীয়াহ্ কে নৃশংসভাবে হত্যা করার ঘটনা থেকে হিজায বিশেষকরে পবিত্র মক্কায় বিরাজমান পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করা যায়। নিঃসন্দেহে মহান আল্লাহ ইমাম মাহ্দী (আ.) কে যে সব গায়েবী (আধ্যাত্মিক) উপায়-উপকরণ প্রদান করবেন যেগুলো ছাড়াও তার জন্য প্রকৃতিক উপকরণসমূহও প্রস্তুত করবেন । যারফলে তার বক্তৃতা অনুষ্ঠান যথাযথভাবে অনুষ্ঠিত হবে । এরপর তার সঙ্গীরা প্রথমে হারাম শরীফের ওপর এবং এর পর সমগ্র মক্কার ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে । আর এটি তাঁর শতশত অথবা হাজার হাজার ইয়েমেনী ,হিজাযী ও ইরানী সঙ্গী, যারা রেওয়ায়েতসমূহ মোতাবেক ইমাম মাহ্দী (আ.) এর হাতে বাইআত করবে তাদের হাতে সম্পন্ন হবে। আর এরাই হবে তাঁর জন ও সেনাশক্তি যারা হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.) এর পবিত্র আন্দোলন ও বিপ্লব  বিজয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরী পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করবে এবং তারা পবিত্র মক্কানগরীর সার্বিক বিষয় ও নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করবে। তারা ইমাম (আ.) এর প্রতি গণ সমর্থনকে একটি পূর্ণতা প্রাপ্ত বিপ্লবে রূপান্তরিত করবে। আর একইভাবে ,ইমামের তিনশ তের জন বিশেষ সঙ্গী তাঁর নিয়োজিত অধিনায়ক হিসেবে ইমামের সমর্থকদের কর্মতৎপরতাসমূহ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার ভূমিকা পালন করবেন।

এ কথার অর্থ এই নয় যে ,হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.) এর বিপ্লব ও আন্দোলন হবে একটি রক্তাত্ত বিপ্লব । কারণ মসজিদুল হারাম এবং এমনকি পবিত্র মক্কা নগরীতে কোন সংঘর্ষ বা রক্তপাত সংঘটিত হওয়ার রেওয়ায়েত সমূহে উল্লিখিত হয় নি। আমি (গ্রন্থকার) একজন আলেমের কাছে শুনেছি যে ,ইমাম মাহ্দী (আ.) এর সঙ্গীরা মসজিদুল হারামের জামায়াতের নামাযে ইমামকে ঐ রাতে (9 মুহররম) হত্যা করবে। তবে এ প্রসঙ্গে কোন রেওয়ায়েত আমার হস্তগত হয় নি । কিন্তু সর্বশেষ যে বিষয়টা আমার হস্তগত হয়েছে তা ছিল ইলযামুন নামের গ্রন্থের রচয়িতা কর্তৃক ঐ গ্রন্থের 2য় খণ্ডের 166 পৃষ্ঠায় একজন আলেমের উদ্ধিৃতি । তিনি বলেছেন : ‘‘ হুজ্জাত অর্থাৎ ইমাম মাহ্দী (আ.) 10 মুহররম আত্মপ্রকাশ করবেন এবং আটটি চিকন রোগা (বাছুর) সামনে চালিয়ে নিয়ে তিনি মসজিদুল হারামে প্রবেশ করে সেখানকার খতীবকে হত্যা করবেন। খতীব নিহত হলে তিনি জনগণের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে যাবেন। আর যখন শনিবার রাত চলে আসবে তখন তিনি কাবার ছাদের ওপর উঠে তাঁর 313 জন সঙ্গীকে ডাকবেন। তারা পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিম থেকে এসে তাঁর চারপাশে জড় হবেন এবং তিনি শনিবার দিবসের প্রভাতে জনগণকে তাঁর হতে বাইআত করার আহবান জানাবেন। ’’

কিন্তু এ উক্তিটি প্রথমতঃ হাদীস (রেওয়ায়েত) নয়। এছাড়াও এর মূল পাঠ যার কিছু অংশের প্রতি এখানে ঈঙ্গিত করেছি তা দূর্বল (যাঈফ) । আর এ কারণেই আমাদের কাছে সবচেয়ে প্রাধান্যপ্রাপ্ত অভিমত হচ্ছে এই যে ,গায়েবী খোদায়ী সাহায্য ,শত্রুদের অন্তরে ভয়-ভীতির উদ্রেক এবং ইমাম মাহ্দীর অনুসন্ধানকারী ও তাঁর আবির্ভাবের প্রত্যাশী গণজোয়ারের অস্তিত্বের কারণে তাঁর আবির্ভাবের আন্দোলন হবে রক্তপাতহীন আন্দোলন অর্থাৎ এতে কোন রক্তপাত সংঘটিত হবে না। এ ছাড়াও হারাম শরীফ এবং মক্কার প্রশাসনিক কেন্দ্র ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা সমূহের ওপর রক্তপাত ছাড়াই কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার দক্ষ পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা প্রয়োগ করার কারণে সেখানে রক্তপাত হবে না। মসজিদুল হারাম এবং মক্কা নগরীর সম্মান রক্ষা করার জন্য সেখানে রক্তপাত না করা ইমামের বিশেষ লক্ষ্য হতে পারে।

ঐ পবিত্র রাতে পবিত্র মক্কা নগরী মুক্তি ও স্বস্তির নিঃশ্বাস নিবে। প্রতিশ্রুত ইমাম মাহ্দী (আ.) এর বিজয় কেতন এ নগরীতে উড়তে থাকবে এবং এর আলোয় আলোকিত হয়ে যাবে। শত্রুরা এবং তাদের আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যম ইমাম মাহ্দী (আ.) এর আন্দোলনের সাফল্যের সংবাদ চেপে যাওয়া অথবা বিলম্বে তা প্রচার করার চেষ্টা করবে অথবা যেহেতু ইতোমধ্যে কতিপয় চরমপন্থী পবিত্র মক্কা ও অন্যান্য স্থানে মাহ্দী হওয়ার মিথ্যা দাবী করবে সেহেতু তারা দেখাতে চাইবে যে এটি হচ্ছে ইমাম মাহ্দী হওয়ার দাবীকারী এক চরমপন্থীর আন্দোলন।

শত্রুরা মক্কার ভিতরে তাদের চরদেরকে এ আন্দোলনের নেতা এবং তার শক্তি-সামর্থ্য ও দূর্বল দিকগুলোর ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করার জন্য নিয়োগ করবে। তারা এতৎসংক্রান্ত তথ্যাবলী সুফিয়ানী বাহিনীর কাছে অর্পন করার জন্য আদিষ্ট থাকবে যাতে করে যতদ্রুত সম্ভব ইমাম মাহ্দী (আ.) বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করার নির্দেশ দেয়া হয়।

তার আবির্ভাবের পরের দিন অর্থাৎ আশুরার দিবস যা হবে কতিপয় রেওয়ায়েত অনুযায়ী শনিবার সেদিন ইমাম মাহ্দী (আ.) তাঁর আন্দোলন যে বিশ্বজনীন তা প্রমাণের লক্ষ্যে মুসলিম জাতি ও সমগ্র বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে মসজিদুল হারামে প্রবেশ করে সব ভাষায় ভাষণ দিবেন। তিনি তাঁর ভাষণে কাফির ও জালিমদের বিরুদ্ধে তাদের কাছে সাহায্য চাইবেন।

ইমাম বাকির (আ.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন : কায়েম শনিবার অর্থাৎ আশুরার দিনে অর্থাৎ যে দিনে ইমাম হুসাইন (আ.) শহীদ হয়েছিলেন সে দিনে আবির্ভূত হবেন। 348

ইমাম মাহ্দী (আ.) যে শুক্রবার এশার নামাযের পর আবির্ভূত হবেন এতৎসংক্রান্ত রেওয়ায়েতটি ইতোমধ্যে বর্ণিত হয়েছে। আর এ রেওয়ায়েতদ্বয়ের মধ্যে আমরা এভাবে সমন্বয় করেছি যে ,ইমাম মাহ্দী (আ.) এর আবির্ভাব দুপর্যায়ে সংঘটিত হবে। শনিবার অর্থাৎ আশুরার দিবসে বিশ্বব্যাপী আর আবির্ভাবের ঘোষণা দেয়ার জন্য পূর্ব প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ হিসেবে আশুরার রাতে (10 মুহররমের রাতে) তিনি পবিত্র হারাম শরীফ ও মক্কা নগরীর ওপর তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবেন।

আর নিঃসন্দেহে এঘটনা রিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে পরিগণিত হবে এবং মুসলিম জাতি সমূহের মাঝে এর ব্যাপক ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব পরিলক্ষিত হবে। বিশেষ করে যখন ইমাম মাহ্দী (আ.) মুসলমানদেরকে মহানবী (সা.) এর প্রতিশ্রুতি মুজিযা অতি শীঘ্রই বাস্তবায়িত হবে বলে অবহিত করবেন এবং তাঁর আন্দোলন দমন ও নিশ্চিহ্ন করার জন্য মক্কাভিমুখে অগ্রসরমান সিরীয় সুফিয়ানী বাহিনী মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী স্থানে ভূমিধ্বসের মাধ্যমে ধ্বংস হবে।

যেসব রেওয়ায়েতে তার অবস্থান কাল এবং সেখানে তাঁর গৃহীত পদক্ষেপ সমূহের ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে সেগুলো সংখ্যায় অল্প। তন্মধ্যে একটি রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে : মহান আল্লাহ্ যতদিন চাইবেন ততদিন তিনি পবিত্র মক্কায় অবস্থান করবেন । 349

আরেকটি রেওয়ায়েতে বর্ণিত বর্ণিত হয়েছে : ইমাম মাহদী (আ.) পবিত্র কাবা শরীফের দস্যুদের ওপর শরীয়তের দণ্ড বিধি (হদ্দ) জারী করবেন। পবিত্র কাবা শরীফের দস্যুরা বলতে ইমাম মাহ্দীর আগে হিজাযের শাসকদেরকেও বোঝানো হতে পারে। নিঃসন্দেহে তাঁর গৃহীত পদক্ষেপসমূহের অন্তর্ভুক্ত হবে মুসলিম জাতিসমূহের উদ্দেশ্যে ভাষণ প্রদান এবং তার আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক নীতি অবস্থানের ঘোষণা দান।

রেওয়ায়েতসমূহের বর্ণনা অনুযায়ী ,ভূমিধ্বসের মাধ্যমে সুফিয়ানী বাহিনীর ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মুজিযা সংঘটিত হবার পরপরই তিনি পবিত্র মক্কা থেকে বের হবেন। সম্ভবত এ সেনাবাহিনী ইমাম মাহ্দী (আ.) এর আন্দোলন স্পষ্ট প্রকাশিত হবার পরপরই তা দমন করার জন্য দ্রুত মক্কাভিমুখে প্রেরিত হবে এবং পবিত্র মক্কায় পৌঁছানোর আগেই মহান আল্লাহ্ তাদেরকে ভূ-গর্ভে প্রোথিত করে ধ্বংস করবেন।

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের কুফরী শক্তিসমূহের নেতৃবর্গ ইমাম মাহ্দী (আ.) এর আন্দোলনের সাফল্য ও বিজয়ের বিপক্ষে নিজেদের তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে। তারা এতটা ক্রদ্ধ হয়ে যাবে যে তারা নিজেদের স্নায়ুবিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে।

ইমাম জাফর আস সাদিক (আ.) এ প্রসংগে বলেছেন : ‘‘ যখন সত্যের পতাকা প্রকাশিত হবে তখন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অধিবাসীরা একে অভিশাপ দিতে থাকবে। ’’ আমি (বর্ণনাকারী) তখন ইমামকে জিজ্ঞেস করলাম ,‘‘ কেন ?’’ তখন তিনি বললেন ,‘‘ বনী হাশিমের কাছ থেকে তারা যা পেয়েছে সেজন্য। ’’ 350

এ রেওয়ায়েত থেকে বোঝা যায় যে, ইমাম মাহ্দী (আ.) এর আগে তাঁর আবির্ভাবের ক্ষেত্রপ্রস্তুতকারী আন্দোলন সমূহ প্রধানতঃ বনী হাশিমের সাইয়্যেদদের দ্বারা পরিচালিত হবে এবং আন্তর্জাতিক কুফরীচক্র এ আন্দোলনগুলোর দ্বারা যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

ইমাম মক্কার জন্য একজন শাসনকর্তা নিযুক্ত করে দশ হাজার বা ততোধিক সৈন্য নিয়ে মদীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবেন। ইমাম বাকির (আ.) বলেন : পবিত্র মক্কানগরীতে পবিত্র কোরআন ও রাসূলুল্লাহর সুন্নাতের ভিত্তিতে কায়েমের হাতে বাইআত করা হবে। আর ইমাম মাহ্দী (আ.) তাঁর নিজের পক্ষ থেকে পবিত্র মক্কা নগরীতে একজন শাসনকর্তা নিযুক্ত করবেন। এরপর তিনি মদীনা অভিমুখে রওয়ানা হবেন এবং পথিমধ্যে তাঁর কাছে সংবাদ পৌঁছবে যে তাঁর প্রতিনিধিকে হত্যা করা হয়েছে। ইমাম মাহ্দী (আ.) পবিত্র মক্কা নগরীতে ফিরে আসবেন এবং কেবল তার প্রতিনিধির হত্যাকারী অথবা হত্যাকারীদেরকে হত্যা করবেন। 351

ইমাম সাদিক (আ.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন : তিনি মক্কাবাসীদেরকে প্রজ্ঞা ও সদুপদেশসহ সত্যের দিকে আহবান জানাবেন এবং তারাও তাঁর আনুগত্য করবে। তখন তিনি তাঁর বংশধরদের থেকে এক ব্যক্তিকে তাদের কাছে তার প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত করে পবিত্র মদীনা নগরীর দিকে রওয়ানা হবেন। ইমাম যখনই পবিত্র মক্কানগরী ত্যাগ করবেন ঠিক তখনই তাঁর প্রতিনিধির ওপর আক্রমণ চালানো হবে। আর এ কারণেই ইমাম তাদের কাছে ফিরে আসবেন। তারা মাথা অবনত করে কাঁদতে কাঁদতে ইমামের কাছে এসে বলতে থাকবেঃ ‘‘ হে মুহাম্মদ (সা.) এর বংশোদ্ভূত মাহ্দী ,আমাদের কৃতকর্মের জন্য আমরা অনুশোচনা প্রকাশ করছি এবং আমাদেরকে ক্ষমা করে দিন । ’’ আর তখন ইমাম তাদেরকে সদুপদেশ দিয়ে তাদের ধ্বংসাত্মক কার্যকলপের জন্য তাদেরকে সতর্ক করে দেবেন এবং তাদের মধ্য থেকে আরেক ব্যক্তিকে তাঁর প্রতিনিধি নিযুক্ত করে পুনরায় পবিত্র মদীনাভিমুখে রওয়ানা হয়ে যাবেন। 352

অবশ্য পবিত্র মক্কায় ইমাম মাহ্দী (আ.) এর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার মত কোন আন্দোলন বা বিদ্রোহের অস্তিত্বের ঈঙ্গিত এ রেওয়ায়েতে বিদ্যমান নেই। আর প্রথম রেওয়ায়েতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তিনি হত্যাকারীদেরকে হত্যা করবেন। এতে হত্যাকারীদের বলতে ঐসব ব্যক্তিদের বোঝানো হতে পারে যারা পবিত্র মক্কায় নিযুক্ত তাঁর প্রতিনিধিকে হত্যা করবে।

পবিত্র মদীনাভিমুখে যাওয়ার পথে তিনি সুফিয়ানী বাহিনীর ভূমিধ্বসে ধ্বংস প্রাপ্ত হওয়ার স্থান অতিক্রম করবেন।

আইয়াশীর তাফসীরে একটি রেওয়ায়েতে হযরত ইমাম বাকির (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ তাঁদের (রাসূলের বংশধারা) থেকে এক ব্যক্তি (মাহ্দী) যখন তিনশ র বেশী সঙ্গী এবং রসূলুল্লাহর (সা.) পতাকা সাথে নিয়ে মদীনাভিমুখে রওয়ানা হবেন তখন তিনি বলবেন ,‘‘ এটি ঐ সম্প্রদায়ের স্থান যাদেরকে সেখানে মহান আল্লাহ ভূ-গর্ভে প্রোথিত করেছেন। ’’ আর এটি হচ্ছে সেই আয়াতের ব্যাখ্যা যাতে মহান আল্লাহ বলেছেন ,

‘‘ যারা খারাপ কর্মের দ্বারা ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত করেছিল তারা কি মহান আল্লাহ কর্তৃক ভূমিধ্বসের মাধ্যমে ধ্বংস হওয়া অথবা সে স্থান থেকে তারা বুঝতেও পারবেনা সেখান থেকে তাদের কাছে শাস্তি আসা হতে নিরাপদ হয়েছে ?আর তারা তো তা (শাস্তি) ব্যর্থ করতে পারবেনা। 353

মদীনা শরীফ ও হিজায মুক্ত করন

রেওয়ায়েত সমূহে উল্লেখ করা হয়েছে যে ,ইমাম মাহ্দী (আ.) পবিত্র মক্কার অবস্থার (বিনাযুদ্ধে জয়) সম্পূর্ণ বিপরীতে পবিত্র মদীনায় এক বা একাধিক যুদ্ধে অবতীর্ণ হবেন।

একটি দীর্ঘ হাদীসে ইমাম বাকির (আ.) বলেছেন : যখন তিনি পবিত্র মদীনা নগরীতে প্রবেশ করবেন তখন কুরাইশগণ তাদের কাছে থেকে আত্মগোপন করবে। আর তাদের ব্যাপারে এটি হচ্ছে আলী ইবনে আবী তালিবের (আ.) উক্তি : মহান আল্লাহর শপথ কুরাইশগণ আশা করবে যে ,আমি এমনকি একটি মাদী উট কোরবানী বা জবাই করতে যে পরিমাণ সময় লাগে ততটুকু সময়ও তাদের কাছে তাদের যাবতীয় সহায়-সম্পত্তি এবং যা কিছুর ওপর সূর্যালোক পতিত হয়েছে সেগুলোর বিনিময়ে হলেও থাকতাম। ’’ অতঃপর ইমাম মাহ্দী (আ.) এমন এক পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন এবং এমন এক অবস্থার উদ্ভব ঘটাবেন যে কুরাইশগণ তখন বলবে যে আমাদেরকে এ সীমালংঘনকারীর কাছে নিয়ে যাও। মহান আল্লাহর শপথ ,সে যদি হযরত মুহাম্মদ (সা.) হযরত আলী (আ.) এবং হযরত ফাতেমা (আ.) বংশধর হত তাহলে সে এ ধরনের কাছে হাত দিত না। ’’ তখন মহান আল্লাহ্ কুরাইশদেরকে হযরত মাহ্দীর কাছে আত্মসমর্পণ করাবেন (করতে বাধ্য করবেন।)। আর তিনি হত্যাকারীদেরকে হত্যা করবেন এবং তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তিকে বন্দী করবেন। এরপর তিনি অগ্রসর হয়ে শাকরাহ্ নামক এলাকায় অবতরণ করবেন। (শাকরাহ্ : ইরান ও ইরাকের দিক থেকে হিজাযের একটি এলাকার নাম) সেখানে তাঁর কাছে সংবাদ পৌঁছবে যে তাঁর প্রতিনিধিকে হত্যা করা হয়েছে। তখন তিনি তাদের কাছে প্রত্যাবর্তন করবেন এবং এতটা হত্যাকান্ড চালাবেন  যে হাররাহ দিবসের হত্যাকাণ্ডও তাদের কাছে অতিনগণ্য ও তুচ্ছ গণ্য হবে। অতঃপর তিনি জনগণকে মহান আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসুলের সুন্নাতের দিকে আহবান জানাবেন। 354

এ রেওয়ায়েতে মদীনায় দু টি যুদ্ধের কথা বর্ণিত হয়েছে। যে ঘটনা ইমাম মাহদী (আ.) এর হাতে সংঘটিত হবে এবং কুরাইশ ও অন্যান্যরা যার জন্য তাঁকে তিরস্কার ও নিন্দা করবে তার পরপরই প্রথম যুদ্ধ বেঁধেঁ যাবে আর মনে হচ্ছে যে ঐ ঘটনাটা ,মসজিদে নববী ও মহানবীর (সা.) পবিত্র কবর ধ্বংস করে পুনঃনির্মাণ করার সাথেই সংশ্লিষ্ট হবে। আর কতিপয় রেওয়ায়েত ও এতদর্থেই বর্ণিত হয়েছে। ইমাম মাহ্দী (আ.) এর শত্রুরা এ ঘটনাকে তাঁর বিরুদ্ধে জনগণকে বিদ্রোহ্ ও উত্তেজিত করার মোক্ষম সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করবে। হযরত মাহ্দী (আ.) তাদের বিরদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবেন এবং অন্য একটি রেওয়ায়েতানুসারে তাদের শতশত ব্যক্তিকে হত্যা করবেন। আর তখনই কুরাইশগণ অর্থাৎ কুরাইশ গোত্র ও শাখা সমূহের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ আশা করতে থাকবে যে ,হায় যদি আমীরুল মু মিনীন আলী (আ.) তাদের মাঝে এমনকি একটি মাদী উট জবাই করা পরিমাণ সময়ও উপস্থিত থাকতেন তাহলে তিনি তাদেরকে ইমাম মাহ্দী (আ.) এর প্রতিশোধ গ্রহণ করা থেকে রক্ষা করতে পারতেন। কারণ ,তাদের ব্যাপারে আমীরুল মু মিনীন আলী (আ.) ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতা অবলম্বন এবং তাদেরকে ক্ষমা করতেন।

তবে দ্বিতীয় যুদ্ধটি মদীনাবাসীদের এ প্রতিবিপ্লবী তৎপরতা ও বিদ্রোহের অবসান এবং ইমাম মাহ্দীর পক্ষ থেকে মদীনা নগরীর জন্য একজন শাসনকর্তা নিযুক্ত করার পর ইরাক ও ইরানের দিকে তাঁর যাত্রা করে শাক্য়াহ্ অথবা শাক্বারাত অঞ্চলে অবতরণ করার পরপর সংঘটিত হবে। এই শাকারাহ্ অঞ্চল খুব সম্ভবতঃ ইমাম মাহ্দী (আ.) এর সেনাবাহিনীর শিবির হবে। মদীনাবাসীরা ইমামের রওয়ানা হয়ে যাওয়ার পর আবারও বিদ্রোহ করে ইমামের নিযুক্ত প্রতিনিধিকে হত্যা করবে। সংবাদ পেয়ে ইমাম মাহ্দী (আ.) সেখানে ফিরে আসবেন এবং হারারাহর প্রসিদ্ধ ঘটনায় উমাইয়্যা সেনাবাহিনী কর্তৃক যে পরিমাণ হত্যা করা হয়েছিল তার চেয়েও বেশী মদীনাবাসীদেরকে হত্যা করবেন। পুনরায় তিনি মদীনা নগরীকে তার নিয়ন্ত্রণাধীন নিয়ে আসবেন। ইতিহাসে হারারাহর ঘটনায় নিহতদের সংখ্যা 700 এর বেশী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর ইমাম হুসাইন (আ.) এর শাহাদতের পর মদীনাবাসীগণ ইয়াযীদ ইবনে মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং তাদের বিদ্রোহ ছিল যথার্থ ও শরিয়ত সম্মত। কিন্তু মদীনাবাসীদের এ বিদ্রোহটা হবে ইমাম মাহ্দী (আ.) এর বিরুদ্ধে ও শরীয়ত বিরুদ্ধ। আর মদীনাবাসীদের সাথে ইমাম মাহ্দী (আ.) এর সেনাবাহিনীর আচরণের মধ্যেকার তুলনার দিক হল কেবল নিহতদের সংখ্যার পরিমাণ।

ইয়াওমুল খালাস গ্রন্থের রচয়িতা উক্ত গ্রন্থের 265 পৃষ্ঠায় তফসীরে আইয়াশীর পূর্বোক্ত হাদীসটির কিছু অংশ উল্লেখ করেছেন। তা থেকে প্রতীয়মান হয় যে হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.) মদীনায় প্রবেশ কালে যুদ্ধে লিপ্ত হবেন অথচ পাঠকরা লক্ষ্য করতে পারছেন যে এ রেওয়ায়েতে মদীনায় ইমাম মাহ্দীর প্রবেশ করার পর দুটো যুদ্ধের কথা উল্লিখিত হয়েছে। ইয়াওমুল খালাস গ্রন্থের রেওয়ায়েতসমূহকে উৎসের দিক থেকে সুক্ষ্মভাবে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন । কারণ উক্ত গ্রন্থের লেখক রেওয়ায়েত সমূহকে খণ্ড খণ্ড করে একটি রেওয়ায়েতের অংশ বিশেষকে অন্য রেওয়ায়েতের সাথে যুক্ত করেছেন এবং এরপর তিনি উক্ত সংযোজিত রেওয়ায়েতকে কোন একটি উৎস্য বা সূত্রের সাথে সম্পর্কিত করেছেন।

এ সম্ভাবনাও বিদ্যমান যে ,ইমাম মাহ্দী (আ.) যখন তার সেনাবাহিনী নিয়ে মদীনায় প্রবেশ করাবেন তখন হিজায সরকার অথবা সুফিয়ানী বাহিনীর অবশিষ্ট অংশের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হবার কারণে প্রতিরোধের সৃষ্টি হতে পারে। অথবা তাদের মধ্যে একটা যুদ্ধেও বেঁধে যেতে পারে। আর ইমাম মাহ্দী (আ.) তাদের ওপর বিজয়ী হবেন।

তবে এতদর্থ সম্বলিত কোন রেওয়ায়েত আমি পাই নি। কিন্তু আমি এমন একটা রেওয়ায়েতের সন্ধান পেয়েছি যাতে মদীনাবাসীদের সন্তুষ্টচিত্তে ইমামকে বরণ এবং তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ না করার প্রতি ঈঙ্গিত রয়েছে। যেমনঃ আল-কাফী গ্রন্থে ইমাম সাদিক (আ.) থেকে একটি দীর্ঘ বিস্তারিত হাদীসে বর্ণিত হয়েছে : ‘‘ তখন (সুফিয়ানী বাহিনীর মদীনায় প্রবেশ ও দখল করার পর) মদীনায় বসবাসরত হযরত আলীর (আ.) বংশধররা সবাই মক্কায় পালিয়ে গিয়ে এ বিষয়ের অধিপতির (ইমাম মাহদীর) সাথে যোগ দেবে। এ বিষয়ের অধিপতি ইরাক অভিমুখে যাত্রা করবেন এবং মদীনায় একটি সেনাবাহিনী প্রেরণ করবেন । যার ফলে মদীনাবাসীগণ নিরাপদ হবে এবং তারা সেখানে প্রত্যাবর্তন করবে। ’’

এ হাদীসের বিষয়বস্তু অনুসারে মদীনার অধিবাসী সুফিয়ানী বাহিনীর পক্ষ থেকে কঠোরতার সম্মুখীন হবে ,অতঃপর তারা ঐ বাহিনীর ভূ-গর্ভে প্রোথিত হওয়া ও হিজায সরকারের পতন প্রত্যক্ষ করবে । সম্ভবত সফিয়ানী বিাহিনীর ধ্বংস হওয়ার পরপরই হিজায সরকারের পতন ঘটবে ।তা ছাড়া বিশ্বব্যাপী ইমাম মাহদীর পক্ষে গণজোয়ারের ধারা লক্ষ্য করে মদীনাবাসী গর্ব বোধ করবে যে ,তিনি তাদের মধ্য থেকেই ।

পাঠকবর্গ লক্ষ্য করবেন, এ রেওয়ায়েত ঈঙ্গিত করে যে ,ইমাম মাহ্দী (আ.) ঐ সময় সরাসরি মদীনায় আগমন করবেন না বরং তিনি মদীনাভিমুখে একটি সেনাবাহিনী প্রেরণ করবেন।

যাহোক ,রেওয়ায়েতসমূহে উল্লিখিত আছে যে, মহান আল্লাহ্ তার জন্য হিজায বিজিত করে দেবেন। এর অর্থ হবে ক্ষয়িষ্ণু ও দূর্বল হিজায সরকারের অবশিষ্টাংশের পতন এবং সুফিয়ানী বাহিনীর অবশিষ্টাংশের পশ্চাদপসরণ।

আবার পবিত্র মক্কার উপর তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং সুফিয়ানী বাহিনীর ভূমিধ্বসে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরপর হিজায বিজয় হতে পারে এবং তখন হিজায বাসীগণ তাঁর হাতে বাইআত করবে।

আর হিজায ইমাম মাহ্দীর (আ.) শাসনাধীনে আসার পর ইয়ামান ,ইরান ও এমনকি ইরাকও (সেখানে তাঁর বিরোধীরা থাকা সত্ত্বেও) তাঁর প্রতিষ্ঠিত সরকার ও প্রশাসনের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাবে। আর শক্তিশালী সম্ভাবনার ভিত্তিতে বলা যায় যে ,হিজাযের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কারণে অথবা উপসাগরীয় দেশগুলোর জনগণ এবং তাঁর ইরানী ও ইয়েমেনী সাহায্যকারীদের সহায়তায় পারস্যোপসাগরীয় দেশগুলোও তার শাসনকর্তৃত্বে চলে আসবে।

এটিই স্বাভাবিক যে ,ইমাম মাহ্দী (আ.) এর নেতৃত্বে এত বিশাল একক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবার কারণে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে । কারণ বাব আল মান্দাব ও হরমুজ প্রণালীদ্বয়ের ওপর এ নবরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার ফলে এ বিষয়টি তাদের জন্য এক মৌলিক সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। আর এর চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এ সরকারের সাংস্কৃতিক হুমকী এবং এর ইসলামী সভ্যতার ব্যাপক বিস্তৃতি ও প্রসার যা প্রাচ্য ,পাশ্চাত্য ও ইহুদীদের যাবতীয় ধারণাকে পাল্টে দেবে। ইমাম জাফর আস-সাদিক (আ.) থেকে ইতোমধ্যে বর্ণিত রেওয়ায়েতে উল্লিখিত আছে যে ,প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.) এর পতাকাকে অর্থাৎ তাঁর বিপ্লব ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রকে অভিশম্পাত করবে।

আর এ সম্ভাবনাও খুব বেশী যে ,প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য এ মুক্ত এলাকাসমূহে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি হারানোর পর পারস্যোপসাগর ও নিকটবর্তী অন্যান্য সমূদ্রে তাদের রণতরীসমূহ প্রেরণ ও মোতায়েন করবে। তাই তখন সাগর-মহাসাগরসমূহে নৌবহরের সমাবেশ এবং নৌশক্তি ও বিমান বাহিনীর দ্বারা হুমকী প্রদর্শন করা ব্যতীত তাদের সামনে আর কোন পথ খোলা থাকবে না।

সম্ভবত তারাই বসরা ও বাইয়া-ই ইস্তাখরের যুদ্ধের ইন্ধন যোগাবে। আর এ দু টি যুদ্ধের বিবরণ সামনে দেয়া হবে।