ইমাম মাহদী (আ.)-এর আত্মপ্রকাশ(আসরে যুহুর)

ইমাম মাহদী (আ.)-এর আত্মপ্রকাশ(আসরে যুহুর)7%

ইমাম মাহদী (আ.)-এর আত্মপ্রকাশ(আসরে যুহুর) লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: ইসলামী সেবা দপ্তর,কোম,ইরান
বিভাগ: ইমাম মাহদী (আ.)

ইমাম মাহদী (আ.)-এর আত্মপ্রকাশ(আসরে যুহুর)
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 62 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 87360 / ডাউনলোড: 10545
সাইজ সাইজ সাইজ
ইমাম মাহদী (আ.)-এর আত্মপ্রকাশ(আসরে যুহুর)

ইমাম মাহদী (আ.)-এর আত্মপ্রকাশ(আসরে যুহুর)

লেখক:
প্রকাশক: ইসলামী সেবা দপ্তর,কোম,ইরান
বাংলা

1

2

3

4

১. হযরত মূসা (আ.) ও হযরত ইউশা (আ.) এর যুগ

হযরত মূসা (আ.) ১২০ বছর জীবিত ছিলেন । তিনি তাঁর জীবনের প্রায় প্রথম ৩০ বছর মিশরের ফিরআউনের প্রাসাদে এবং হযরত শুআইব (আ.)-এর কাছে ক্বাদাশ বারনী নামক স্থানে ১০ বছর অতিবাহিত করেছিলেন । উল্লেখ্য যে ,এ স্থানটি ফিলিস্তিনের দিক থেকে সীনাই পর্বতের শেষ প্রান্তে আরাবাহ্ উপত্যকার অদূরে অবস্থিত ।

বর্তমান তাওরাতের সিফরে খুরুজ পুস্তিকার ১২তম অধ্যায়ের ৩৭ নং আয়াতে এবং সিফরে আদাদ-এর ৩৩তম অধ্যায়ের ৩৬ নং আয়াতে যে সব ইসরাইলীয় হযরত মূসা (আ.)-এর সাথে হিজরত করেছিল তাদের সন্তানদেরকে বাদ দিয়ে তাদের সংখ্যা ছয় লক্ষ বলে উল্লেখ করা হয়েছে । তবে কতিপয় পাশ্চাত্য গবেষকের মতে ,তাদের সংখ্যা ছিল মাত্র ছয় হাজার ।

ঐতিহাসিকগণ অধিকতর সম্ভাবনার ভিত্তিতে বলেছেন : খ্রিস্টপূর্ব ১৩ শতাব্দী আগে অর্থাৎ প্রায় খ্রি.পূ. ১২৩০ সালে ফিরআউন মিনফাতাহ্-এর আমলে ইসরাইলীরা মিশর ত্যাগ করেছিল ।

হযরত মূসা (আ.) কাদাশ পর্বতের কাছে মারা যান এবং তাঁর উত্তরাধিকারী ইউশা বিন নূন তাঁকে ঐ স্থানে দাফন করেন এবং তিনি তা গোপন রাখেন । হযরত মূসা (আ.) তাঁর জীবদ্দশায় ,এমনকি তাঁর মৃত্যুর পরেও বনি ইসরাইলের কাছ থেকে বহু কষ্ট ও যাতনা পেয়েছিলেন । ইহুদীদের তাওরাতে তাঁর ও হযরত হারূন (আ.)-এর ব্যাপারে উল্লিখিত আছে যে ,আল্লাহ্ মূসা (আ.)-কে বলেছিলেন : যেমন করে তোমার ভাই হারূন হুর পর্বতে মৃত্যুবরণ করেছে ঠিক তেমনি তুমিও এ পর্বতে মৃত্যুবরণ করবে । কারণ তোমরা দু জন সীনাই দেশে কাদাশ ভূ-খণ্ডের জলাভূমিতে আমার পবিত্রতা ঘোষণা করনি আর এভাবে তোমরা দু জন আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছ!! অতএব ,তুমি যমীনকে ঠিক এর বিপরীত (দিক) থেকে দেখবে ,অথচ যে ভূ-খণ্ড আমি বনি ইসরাইলকে প্রদান করেছি সেখানে প্রবেশ করতে পারবে না । ৬১

আরো বলা হয়েছে : ইউশা বিন নূন সেখানে প্রবেশ করবেন । ৬২

মূসা (আ.)-এর মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরসূরি নবী ইউশা বনি ইসরাইলের নেতৃত্বের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন । তিনি তাদেরকে জর্দান নদীর পশ্চিম তীরে নিয়ে যান এবং আবীহা (জেরিকো) শহর থেকে শুরু করে আরো ৩১টি ক্ষুদ্র রাজ্য জয় করেন যার প্রতিটি ছিল শহর বা ছোট শহর এবং এগুলোর প্রতিটির অধীনে বেশ কিছু কৃষিনির্ভর গ্রাম ছিল । উল্লেখ্য যে ,এ সব নগররাজ্যের অধিবাসীরা ছিল কিনআন গোত্রীয় পৌত্তলিক ।

তখন তিনি ঐ অঞ্চলকে ইয়াকূব (আ.)-এর বংশধরদের মধ্যে বণ্টন করে দেন যারা একে অপরের প্রতি হিংসা-দ্বেষ পোষণ করত । ইউশার পুস্তিকায় ১৫ থেকে ১৯ অধ্যায়ে উক্ত অঞ্চলের নগর ও ক্ষুদ্র শহরের সংখ্যা ২১৬ বলে উল্লেখ করা হয়েছে । হযরত ইউশা (আ.) খ্রিস্টপূর্ব ১১৩০ সালে প্রায় ১১০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন ।

২ .বিচারকদের যুগ

অস্থিতিশীল যুগের বিচারকদের শাসন কর্তৃত্ব এবং ইহুদী জাতির ওপর স্থানীয় শাসক ও রাজন্যবর্গের কর্তৃত্ব ও আধিপত্য বিস্তার : হযরত ইউশা ইবনে নূনের পর বনি ইসরাইলের নেতৃত্ব বিচারকদের কাছে স্থানান্তরিত হয় এবং তাদের মধ্যে ১৫ জন শাসনকর্তা হয়েছিল । তাদের যুগের দু টি বৈশিষ্ট্য সবসময় বনি ইসরাইলের মাঝে লক্ষ্য করা যায় ।

একটি বৈশিষ্ট্য হলো মহান নবীদের পথ থেকে তাদের (বিচারকদের) বিচ্যুতি এবং অপর বৈশিষ্ট্য হলো মহান আল্লাহ্ কর্তৃক এমন সব ব্যক্তিকে তাদের ওপর কর্তৃত্বশীল করা যারা তাদের অত্যন্ত বেদনাদায়ক শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করাবে ;আর এ বিষয়টি পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে ।

তৃতীয় ও পঞ্চম অধ্যায়ে বিচারকদের পুস্তিকায় হযরত ইউশা (আ.)-এর পর বনি ইসরাইলের বিচ্যুতির কথা এভাবে বর্ণিত হয়েছে :

কিনাআনী ,হেইথী ,আমূরী ,ফার্যী ,হেভী ও ইয়াবুসীয়দের মাঝে তারা বসবাস করতে থাকে এবং ঐসব জাতির মেয়েদেরকে তারা স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করেছিল এবং নিজেদের কন্যাসন্তানদেরকে তারা তাদের ছেলেদের কাছে বিবাহ দিয়েছেল । তারা ঐ সব জাতির প্রতিমা এবং দেব-দেবীদেরও পূজা করত ।

তৃতীয় অধ্যায়ের ৮ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে : বিচারকদের মধ্য থেকে যে সর্বপ্রথম বনি ইসরাইলের ওপর শাসনকর্তৃত্ব লাভ করেছিল এবং তাদেরকে ৮ বছর শাসন করেছিল সে ছিল আরামুন নাহরাইনের শাসনকর্তা রাশ্তাআম ।

তখন বনি আম্মোন এবং আমালিকারা তাদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে আরীহা (জেরিকো) শহর দখল করে নেয় । ৬৩ এরপর কিনআন দেশের শাসনকর্তা ইযারীন হাসূর অঞ্চলে তাদের ওপর ১০ বছর শাসন করেছিল । ৬৪

এরপর বনি আমোন ও ফিলিস্তিনীরা তাদেরকে ১৮ বছর দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ রেখেছিল । ৬৫

এরপর ফিলিস্তিনীরা তাদেরকে শাস্তি দিয়েছিল এবং চল্লিশ বছর তাদেরকে নিজেদের আধিপত্যাধীন রেখেছিল । ৬৬

ইউশা ইবনে নূনের পর বিচারকদের শাসন নবী হযরত সামূঈল (আ.)-এর যুগ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল । হযরত সামূঈল (আ.) ছিলেন ঐ নবী পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ্ নিম্নোক্ত আয়াতে যাকে এভাবে স্মরণ করেছেন :

আপনি কি বনি ইসরাইলের ঐ গোত্রকে দেখেছেন যারা মূসার পরে তাদের নবীর (সামূঈল) কাছে এ প্রার্থনা করেছিল : আপনি আমাদের জন্য এমন একজন বাদশাহ্ নিযুক্ত করে দিন যাতে করে আমরা মহান আল্লাহর পথে জিহাদ করতে পারি । তাদের নবী বলেছিলেন : তোমাদের ওপর জিহাদ অবধারিত (ফরয) হয়ে গেলে কি তোমরা নাফরমানী করবে ?তারা বলেছিল : এটি কিভাবে সম্ভব যে ,আমরা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করব না । অথচ তারা আমাদেরকে এবং আমাদের সন্তানদেরকে আমাদের দেশ থেকে বহিষ্কার করেছে । অতঃপর যখন তাদের ওপর জিহাদ নির্ধারণ করা হলো তখন তাদের মধ্য থেকে মুষ্টিমেয় ব্যক্তি ব্যতীত সবাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল এবং মহান আল্লাহ্ অত্যাচারীদের ব্যাপারে পূর্ণ অবগত আছেন । ৬৭

ঐতিহাসিকরা এ যুগকে খ্রিস্টপূর্ব ১১৩০ সাল থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১০২৫ সাল পর্যন্ত একশ বছর অর্থাৎ হযরত তালুত ও হযরত দাউদ (আ.)-এর শাসনকালের শুরু পর্যন্ত বলে মনে করেন ,অথচ তাওরাতে বিচারকদের পুস্তিকায় এ সময় কাল (বিচারকদের শাসনকাল) একশ বছরের চেয়েও অধিক  বলে উল্লিখিত হয়েছে ।

৩. হযরত দাউদ (আ.) ও হযরত সুলাইমান (আ.)-এর শাসনামল

রাজা তালুতের যুগকে আমরা হযরত দাউদ (আ.) ও হযরত সুলাইমান (আ.)-এর শাসনামলের অংশবিশেষ বলে গণ্য করব । কারণ যদিও তালূত নবী ছিলেন না ,কিন্তু তিনি ছিলেন মহান নবীদের ধারার একজন শাসক । ঐতিহাসিকরা তাঁর শাসনামল খ্রি.পূ. ১০২৫ থেকে ১০১৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১০ বছর বলে উল্লেখ করেছেন । তারপর হযরত দাউদ (আ.) ও হযরত সুলাইমান (আ.) খ্রি.পূ. ১০১০ সাল থেকে খ্রি.পূ. ৯৩১ সাল পর্যন্ত শাসন করেছেন । হযরত সুলাইমান (আ.) খ্রি.পূ. ৯৩১ সালে ইন্তেকাল করেন ।

বর্তমান তাওরাত (পুরাতন নিয়ম)-এর রচয়িতারা হযরত মূসা (আ.) ,হযরত দাউদ (আ.) ও হযরত সুলাইমান (আ.)-এর ওপর জুলুম করেছে এবং জঘন্য চারিত্রিক ,রাজনৈতিক ও বিশ্বাসগত মিথ্যা অপবাদ আরোপ করেছে ।

পাশ্চাত্যের অধিকাংশ খ্রিস্টান ঐতিহাসিকরা কেবল এ সব রচয়িতার অনুসরণ করেই ক্ষান্ত হয় নি ,বরং তাঁদের বক্তব্যের সাথে আরো বেশ কিছু ভিত্তিহীন বিষয়ও যোগ করেছেন । অতঃপর পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সমর্থক মুসলমান নামধারীরাও পাশ্চাত্যের এসব লেখকের অনুসরণ করেছে । মহান আল্লাহর দরূদ ও সালাম তাঁর সকল নবী-রাসূলদের ওপর বর্ষিত হোক । আর যে সব ব্যক্তি এ সব মহামানবের ওপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করেছে মহান আল্লাহর দরবারে আমরা তাদের থেকে সম্পর্কোচ্ছেদ ঘোষণা করছি ।

হযরত দাউদ (আ.) ইসরাইলীদেরকে পৌত্তলিকতা ও মুশরিকদের আধিপত্য থেকে নাজাত দিয়েছিলেন এবং তাঁর ঐশ্বরিক শাসন পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহেও বিস্তার লাভ করেছিল । যে সব জাতি তাঁর শাসনাধীন ছিল তিনি তাদের সাথে এমন সদাচরণ করতেন যে ,মহান আল্লাহর পবিত্র কোরআনে এবং মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কণ্ঠে তা বর্ণনা করেছেন । হযরত দাউদ (আ.) আল কুদসে মারীয়া পাহাড়ের ওপর তাঁর শ্রদ্ধেয় প্রপিতামহ হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর ইবাদত-বন্দেগী করার স্থানে একটি মসজিদ নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন । কিন্তু সেখানে আরুনা নামের আল কুদসের ইয়াবূস বংশীয় একজন বাসিন্দার শস্যক্ষেত্র ছিল । হযরত দাউদ (আ.) ঐ লোকের কাছ থেকে ঐ জমি ৫০ শাকোল (ওজনের পিণ্ড) রূপার বিনিময়ে ক্রয় করেন । বর্তমান তাওরাতের বক্তব্য অনুসারে সেখানে তিনি একটি মসজিদ নির্মাণ এবং নামায কায়েম করেছিলেন । আর তিনি এর একটি অংশে মহান আল্লাহর জন্য কোরবানীও করতেন । ৬৮

হযরত সুলাইমান ( .) হযরত দাউদ ( .)- এর রাজত্ব ও শাসনকর্তৃত্বের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন তাঁর হুকুমত ও রাজত্ব ঐ পর্যায়ে বিস্তার লাভ করেছিল যার উল্লেখ পবিত্র কোরআন এবং মহানবী ( সা .)- এর সুন্নাহ্য় বিদ্যমান তিনি তাঁর শ্রদ্ধেয় পিতা হযরত দাউদ ( .) এবং শ্রদ্ধেয় প্রপিতামহ হযরত ইবরাহীম ( .)- এর মসজিদটিকে একটি জাঁকজমকপূর্ণ ইমারতে রূপান্তরিত করেছিলেন যা   মা বাদ - ই সুলাইমান অর্থাৎ The temple of King Solomon নামে প্রসিদ্ধ হয়েছে

হযরত সুলাইমান (আ.)-এর শাসনামল মহান নবীদের ইতিহাসে একটি ব্যতিক্রমধর্মী যুগ । এ যুগে মহান আল্লাহ্ তাঁর আশ্চর্যজনক ও বিচিত্র নেয়ামতসমূহের কিছু নমুনা মানব জাতির কাছে প্রকাশ করেছিলেন । যদি জাতিসমূহ মহান নবী এবং তাঁদের উত্তরাধিকারীদের নেতৃত্বের রাজনৈতিক ধারাটি বহাল রাখত এবং মহান আল্লাহর প্রদত্ত নেয়ামতসমূহ একে অপরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ,যুদ্ধ-বিগ্রহ ও দমন কার্যে ব্যবহার না করত ,তাহলে মহান আল্লাহ্ তাদেরকে এ সব নেয়ামত নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রদান করতে থাকতেন । মহান আল্লাহ্ পবিত্র কোরআনে বলেছেন :

মহান আল্লাহ্ যদি মানব জাতির জন্য অজস্র জীবিকার ব্যবস্থা করতেন ,তাহলে তারা পৃথিবীতে অন্যায়-অত্যাচার করত । কিন্তু মহান আল্লাহ্ যতটুকু চান কেবল ততটুকুই তিনি অবতীর্ণ করেন । আর তিনি তাঁর বান্দাদের ব্যাপারে জ্ঞাত এবং তাদের সব কিছু দেখেন । ৬৯

হযরত সুলাইমান (আ.) নিজ সিংহাসনের ওপর উপবিষ্টাবস্থায় প্রাণ ত্যাগ করেন । ঐতিহাসিকরা তাঁর মৃত্যুর তারিখ খ্রিস্টপূর্ব ৯৩১ সাল বলে উল্লেখ করেছেন ।

হযরত সুলাইমানের মৃত্যুর সাথে সাথেই বনি ইসরাইলের মধ্যে বিচ্যুতি এবং তাদের হুকুমত ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় বিভক্তি দেখা দেয় । আর এ কারণেই মহান আল্লাহ্ তাদের ওপর এমন ব্যক্তিকে কর্তৃত্বশীল করে দিয়েছিলেন যে তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি আস্বাদন করিয়েছিল ।

বর্তমান তাওরাতের রাজন্যবর্গ ও শাসকদের প্রথম পুস্তিকায় সুলাইমান (আ.)-এর ওপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করা হয়েছে এভাবে যে ,তিনি মহান আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী বর্জন করে মূর্তি পূজা করতেন । তাওরাতে উল্লিখিত হয়েছে : তিনি সুলাইমানকে বললেন : এ শাস্তির কারণ তুমি নিজেই । যে সব চুক্তি এবং ওয়াজিব বিধান পালন করার আদেশ আমি তোমাকে দিয়েছিলাম ,তুমি সেগুলো সংরক্ষণ কর নি । আমিও তোমার হাত থেকে রাজত্ব কেড়ে নিয়ে তা টুকরো টুকরো করে ফেলব । ৭০

৪. অভ্যন্তরীণ বিভক্তি ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের যুগ

তাদের অধঃপতন এতটাই হয়েছিল যে ,তারা একে অপরের বিরুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য তাদের মধ্যকার পৌত্তলিকরা মিশরের ফিরআউন ,আশুরীয় ও ব্যাবেলনীয়দের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছিল ।

হযরত সুলাইমান (আ.)-এর মৃত্যুর পর ইহুদীরা শেকীম (নাবলুস) নামক স্থানে সমবেত হয়ে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ইয়ারবাআম বিন নাবাত-এর হাতে বাইআত করে । উল্লেখ্য যে ,এ ইয়ারবাআম বিন নাবাত হযরত সুলাইমানের অন্যতম শত্রু ছিল । সে সুলাইমান (আ.)-এর শাসনামলে মিশরে পালিয়ে যায় এবং ফিরআউনদের কাছে আশ্রয় নেয় । হযরত সুলাইমান (আ.)-এর মৃত্যুর পর সে ফিরে আসলে ইহুদীরা তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছিল । সে জর্দান নদীর পশ্চিম তীরে ইসরাইল নামে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল যার রাজধানী ছিল শেকীম বা সামেরাহ্ । খুব অল্প সংখ্যক ইহুদী হযরত সুলাইমানের পুত্র রাহাবাআমের হাতে বাইআত করে । রাহাবাআমের রাজ্য ইয়াহুদা নামে পরিচিত ছিল । এ রাজ্যের রাজধানী ছিল আল কুদ্স (জেরুজালেম) । ৭১

কিন্তু আসিফ বিন বারখিয়া যিনি ছিলেন হযরত সুলাইমান (আ.)-এর উত্তরাধিকারী ,মহান আল্লাহ্ তাঁর সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলেছেন : ( عنده علم من الكتاب ) অর্থাৎ তার কাছে কিতাবের কিছু জ্ঞান ছিল । বনি ইসরাইল তাঁর ওপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করেছিল । তিনি বনি ইসরাইলের কাছ থেকে মিথ্যা অপবাদ লাভ করা ছাড়া আর কিছুই পান নি ।

তাওরাতে বর্ণিত হয়েছে : কুফর ও মূর্তিপূজা ইয়ারাবাআম-এর অনুসারীদের মধ্যে প্রকাশ্যে বিদ্যমান ছিল । সে স্বর্ণ দিয়ে দু টি গোবৎস মূর্তি বানিয়ে এগুলোর একটি আল কুদসে এবং অপরটি দানে স্থাপন করেছিল । সে প্রতিটি মূর্তির পাশে একটি করে কোরবানী করার জায়গাও নির্মাণ করেছিল এবং তাদেরকে বলেছিল : তোমাদের খোদারাই তোমাদেরকে মিশর থেকে বের করে শেকীমে এনেছেন । অতএব ,তাঁদের সামনে তোমরা কোরবানী করবে এবং ঊরশালিমে যাবে না । আর ইহুদী জাতিও তার কথা মেনে নিয়েছিল । ৭২

গোবৎস উপাসনা করার পাশাপাশি ইয়ারাবাআম তাদেরকে অন্যান্য দেব-দেবী ,যেমন- সাইদূনীদের দেবতা আশতারুত ( عشتروت ) ,মুআবীদের দেবতা কামুশ ( كموش ) এবং আমোনদের দেবতা মাকলুম ( مكلوم )-এর উপাসনা করার আদেশ দিয়েছিল । ৭৩

আদি রাজা ও শাসকবর্গের কাহিনীসমূহ সংক্রান্ত পুস্তিকার বক্তব্য অনুসারে ইয়াহুদা রাজ্যও তিন বছর পরে এই একই পরিণতি বরণ করেছিল (অর্থাৎ সেখানেও মূর্তিপূজা ,পৌত্তলিকতা এবং শিরকের প্রসার হয়েছিল) । ৭৪

মিশরের ফিরআউন শীশক ( شيشق ) এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ইয়ারাবাআমকে সাহায্য ও ইয়াহুদা রাজ্যের ধ্বংস সাধন করার জন্য খ্রি.পূ. ৯২৬ সালে হযরত সুলাইমান (আ.)-এর পুত্র রাহাবাআম ও তাঁর অনুসারীদেরকে পরাজিত করে আল কুদ্স দখল করে এবং বেথ-ঈল (মহান আল্লাহর গৃহ)-এর ধনভাণ্ডার ,শাসনকর্তার সিংহাসন ,এমনকি হযরত সুলাইমান (আ.) যে সব স্বর্ণের ঢাল বানিয়েছিলেন সেগুলো নিজের সাথে নিয়ে গিয়েছিল ।

সম্ভবত মিশরের ফিরআউনের নিজ রাজ্যে দুর্বল অবস্থানের কারণে নিজে অথবা তার সহযোগীর (ইয়ারাবাআম) মাধ্যমে ইয়াহুদা রাজ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখতে পারে নি ।

অতএব ,শীশকের পশ্চাদপসরণ করার পর এ ক্ষুদ্র রাজ্যটি নিজ অবস্থান কিছুটা ফিরে পেয়েছিল এবং তারা ইয়ারাবাআমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছিল । আরামীরা উক্ত রাজ্যদ্বয়ের দুর্বলতার সুযোগ নেয় এবং ইয়াহুদা রাজ্য আক্রমণ করে সেখানকার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরকে বন্দী করে নিজেদের রাজধানী দামেশকে নিয়ে যায় । তারা বিজিতদের ওপর জিযিয়া কর আরোপ করে । এ ঘটনা আরামী বিন হুদের রাজত্বকালে (খ্রি.পূ. ৮৭৯- খ্রি.পূ. ৮৪৩) ঘটেছিল । ৭৫

অতঃপর আখাব বিন আওমেরীর রাজত্বকালে খ্রি.পূ. ৮৭৪- খ্রি.পূ. ৮৫৩ সালের মধ্যে আরামীয়রা ইয়ারাবাআমের রাজ্যের ওপর জিযিয়া কর আরোপ করে সে দেশকেও তাদের করদ রাজ্যে পরিণত করেছিল ।

একইভাবে তাওরাতে ইয়েহুরামের শাসনকালে ইয়াহুদা রাজ্যের সাথে কোশেসীয়ীদের যুদ্ধে আরবদের সাথে ফিলিস্তিনীদের যুদ্ধ ও সংঘর্ষের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে ,তারা আল কুদ্স দখল করে শাসনকর্তার প্রাসাদে সংরক্ষিত ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করেছিল এবং তার স্ত্রী ও সন্তানদেরকে বন্দী করেছিল । ৭৬

তাওরাতে আরো বর্ণিত আছে : আরামীয় সেনাবাহিনী বাইতুল মুকাদ্দাসে যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং সেখানকার সকল নেতাকে হত্যা করতঃ সকল ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করে । অতঃপর তারা সে সব লুণ্ঠিত ধন-সম্পদ আরামীয়দের রাজা হাযাঈলের কাছে অর্পণ করে । ৭৭

ঠিক একইভাবে ইসরাইল রাজ্যের শাসনকর্তা ইউআশ ইয়াহুদা রাজ্য আক্রমণ করে নগরীর দুর্গ ধ্বংস করেছিল । সে মহান আল্লাহর ঘরে সংরক্ষিত যাবতীয় স্বর্ণ ,রৌপ্য ,বাসন-কোসন এবং রাজকীয় কোষাগার লুণ্ঠন করেছিল । ৭৮

আশুরীয়দের দখল করার আগ পর্যন্ত বনি ইসরাইলের মধ্যে এ ধরনের দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় অবস্থা এবং তাদের ওপর পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর কর্তৃত্ব অব্যাহত থাকে ।

৫. আশুরীয়দের আধিপত্য বিস্তারের যুগ

খ্রি. পূ. ৮৫৯ সাল থেকে খ্রি. পূ. ৮২৪ সাল পর্যন্ত আরামীয় রাজ্য ও ইসরাইলে আশুরীয় রাজ তৃতীয় শালমান্নাসরের আক্রমণের মাধ্যমে ইহুদীদের ওপর আশুরীয়দের আধিপত্যের সূত্রপাত ঘটে । পুরো অঞ্চলই তার এবং তার পরবর্তী আশুরীয় রাজন্যদের শাসনাধীনে চলে যায় । তবে সম্ভবত প্রথমে ইসরাইল রাজ্যের পরিবর্তে ইয়াহুদা রাজ্যটি আশুরীয়দের শাসনাধীনে এসেছিল ।

কারণ তাওরাতের বর্ণনানুসারে সেখানকার শাসনকর্তা আহায বিন ইউসাম আশুর রাজ্যের নৃপতি তাঘলিস ফালাসারকে ইসরাইল ও আরামীয়দের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালানোর জন্য আহবান করেছিল ;আর আশুর রাজও তার সর্বশেষ আবেদন গ্রহণ করে খ্রি.পূ. ৭৩২ সালে আক্রমণ করার উদ্যোগ নেন । আশুর রাজের উত্তরাধিকারী নৃপতি ৫ম শালমান্নাসরও তাঁর পূর্বসূরির কর্মপন্থা অব্যাহত রাখেন । কিন্তু তিনি ইসরাইলের রাজধানী শেকীম (নাবলুস) অবরোধকালে মৃত্যুবরণ করেন এবং তাঁর স্থলাভিষিক্ত নৃপতি দ্বিতীয় সিরজাওন সামেরাহ্ নগরী পুরোপুরি দখল করেছিলেন এবং এভাবে তিনি এ দেশটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন । ইসরাইল আক্রমণ করার মাধ্যমে ইহুদীদেরকে তাদের দেশ ও মাতৃভূমি থেকে বহিষ্কার করার পরিকল্পনাও বাস্তবায়ন করা হয় । তাঘলিস ফালাসার ইহুদীদেরকে বন্দী করে নিজ দেশে নিয়ে আসেন এবং আশুরীয়দেরকে তাদের দেশে আবাসন দেন । ৭৯

তারপর সুলতান ফাকাহ্ উক্ত পরিকল্পনা সমাপ্ত করেন এবং তিনি মানসীর বংশধরদের ও ইহুদী জনসংখ্যার অর্ধেকাংশকে বন্দী করেছিলেন । ৮০

দ্বিতীয় সিরজাওন প্রায় ত্রিশ হাজার ইহুদীকে হাররান ,খাবূর নদীর তীর এবং মিডিয়ায় নির্বাসিত করেন এবং তাদের স্থলে আরামীয়দেরকে আবাসন দেন । ৮১

হিযকিয়ার শাসনামলে ইয়াহুদা রাজ্য আশুরীয়দের হাত থেকে বের হয়ে আসে । বাহ্যত তিনি মিশরীয়দের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করার চেষ্টা করছিলেন । তাঁর এ উদ্যোগে আশুর রাজ্যের নৃপতি সিনহারীব তার ওপর খুব ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন এবং খ্রি. পূ. ৭০১ সালে ইয়াহুদা রাজ্যকে বশীভূত করার জন্য এবং আশুরীয়দের সর্বশেষ আক্রমণের মাধ্যমে উক্ত অঞ্চল নিজ শাসনাধীনে আনেন এবং আল কুদ্স দখল করেন । হিযকিয়া মহান আল্লাহর গৃহে বিদ্যমান যাবতীয় রৌপ্য এবং শাসনকর্তার প্রাসাদে গচ্ছিত সকল ধন-সম্পদ তাঁর কাছে অর্পণ করেছিলেন । ৮২

বর্তমান তাওরাতে আশুর দেশের যে সব নৃপতির বিবরণ প্রদান করা হয়েছে তাঁরা ব্যতীত আসরহাদ্দুন এবং তাদের সর্বশেষ নৃপতি আশুর বানিবাল সম্পর্কে উল্লেখ করে বলেছে : এ দু জন আশুর রাজ্য থেকে বেশ কিছু সম্প্রদায়কে সামেরাহ্ নগরীতে এনে আবাসন দিয়েছিলেন । ৮৩

৬. বাবেলীয়দের আধিপত্য বিস্তারের যুগ

মাদ ও বাবেলীয়দের (কালদানীদের) হাতে খ্রি.পূ. ৬১২ সালে আশুরীয়দের রাজধানী নেইনাভার পতন ঘটে এবং উক্ত রাজ্যকে বিজয়ীরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয় । ইরাক ,শাম ও ফিলিস্তিন বাবেলীয়দের ভাগে পড়ে । তাদের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ রাজা ছিলেন বাখতুন নাসর -যিনি শাম ও ফিলিস্তিনকে নিজ শাসনাধীনে আনার জন্য খ্রি.পূ. ৫৯৭ সালে প্রথম বার এবং খ্রি.পূ. ৫৮৬ সালে দ্বিতীয় বার সেখানে আক্রমণ করেছিলেন ।

প্রথম আক্রমণে তিনি আল কুদ্স অবরোধ ও জয় করেন । তিনি সেখানকার শাসনর্তার প্রাসাদের যাবতীয় ধন-রত্ন ও সম্পদ হস্তগত করেন । বিরাট সংখ্যক ইহুদী ,এমনকি সুলতান ইয়াহুভা ইয়াকীন ও তাঁর সমর্থকদেরকে বন্দী করেন এবং ধৃত সুলতানের পিতৃব্য সিদিকইয়াকে অবশিষ্ট ইহুদীদের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন । তিনি বন্দীদেরকে বাবিলের (ব্যাবিলনের) খাবূর নদীর কাছে নাইবূর এলাকায় নির্বাসিত করেন । ৮৪

দ্বিতীয় আক্রমণ : বাখতুন নাসর ও মিশরের ফিরআউন খোফরার মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সংঘাতকে কেন্দ্র করে দ্বিতীয় আক্রমণ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে । কারণ ,ফিরআউন খোফরা শাম ও ফিলিস্তিনের শাসনকর্তাদের ,যেমন আল কুদসের নয়া শাসক সিদিকইয়াকে বাবেলীয়দের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য প্ররোচিত করতে থাকে এবং তাদের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করে । তারাও তা মেনে নেয় এবং মিশরের ফিরআউন অত্র অঞ্চলে আক্রমণ পরিচালনা করতে থাকে । কিন্তু বাখতুন নাসর দ্রুত আরেকটি আক্রমণ পরিচালনা করে মিশরীয়দেরকে পরাজিত করেন এবং সমগ্র অঞ্চল তাঁর করায়ত্তে চলে আসে । ইহুদীদের উপাসনালয়ে আগুন লাগিয়ে ধ্বংস এবং তাদের ধন-ভাণ্ডারসমূহ লুণ্ঠন করা হয় । তাদের সব ঘর-বাড়ি ধ্বংস এবং প্রায় পঞ্চাশ হাজার ইহুদীকে বন্দী করা হয় । সিদিকইয়ার সন্তানদেরকে বাখতুন নাসরের সামনে জবাই এবং তারপর সিদিকইয়ার দু চোখ উপড়ে ফেলা হয় । তাকেও পায়ে বেড়ী পড়িয়ে বন্দীদের সাথে নিয়ে যাওয়া হয় । আর এভাবেই ইয়াহুদা রাজ্য বিলুপ্ত হয়ে যায় । ৮৫

৭. ইরানীদের আধিপত্য ও কর্তৃত্বের যুগ

পারস্য-সম্রাট সাইরাস (কোরুশ) বাবেল নগরী ও রাজ্য দখল করে খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৯ সালে সেখানকার সরকার ও প্রশাসনের পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটান । তিনি শাম ও ফিলিস্তিন আক্রমণ করে সে দেশগুলো নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন । তিনি বাখতুন নাসরের বন্দীদেরকে এবং যে সব ইহুদী বাবেলে বসবাস করত তাদেরকে আল কুদসে ফিরে যাওয়ার অনুমতি এবং সুলাইমান (আ.)-এর ইবাদতগাহের ধন-সম্পদসমূহ তাদের কাছে ফিরিয়ে দেন । তিনি তাদেরকে তাদের উপাসনালয় সংস্কার ও পুনঃনির্মাণ করার অনুমতি দেন এবং যেরবাবেলকে তাদের প্রশাসক নিযুক্ত করেন । ৮৬

সাইরাস কর্তৃক নিযুক্ত ইহুদী শাসনকর্তা ,হযরত সুলাইমান (আ.)-এর ইবাদতগাহ্ পুনঃনির্মাণ প্রক্রিয়ায় হাত দিলে তৎসংলগ্ন এলাকার জনগণ ভয় পেয়ে সম্রাট সাইরাসের উত্তরাধিকারী কামবুজিয়ার কাছে এ ব্যাপারে অভিযোগ করে । তিনি ইবাদতগাহ্ নির্মাণ কার্য বন্ধ রাখার নির্দেশ জারী করেন । অতঃপর ১ম দারা (দারায়ূশ) তাদেরকে ইবাদতগাহ্ পুনঃনির্মাণের অনুমতি দিলে খ্রি. পূ. ৫১৫ সালে ইবাদতগাহের ইমারত নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয় ।

খ্রি. পূ. ৫৩৯ সাল থেকে খ্রি. পূ. ৩৩১ সাল পর্যন্ত ইহুদীদের ওপর ইরানী জাতির আধিপত্য ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিল । এ দীর্ঘ সময় সম্রাট সাইরাস ,কামবুজিয়াহ্ ,প্রথম দারায়ূশ ,খেশার ইয়ার্শা এবং হযরত উযাইর (আ.)-এর সমসাময়িক আরদাশীর ইহুদীদের শাসন করেছেন । এদের পর আরো কতিপয় ইরানী সম্রাট ,যেমন দ্বিতীয় দারায়ূশ ,দ্বিতীয় ও তৃতীয় আরদাশীর রাজত্ব করেছেন । তৃতীয় আরদাশীর ছিলেন শেষ পারস্য সম্রাট যিনি গ্রীক সম্রাট ইস্কান্দারের (আলেকজান্ডার) ৮৭ হাতে পরাজিত ও নিহত হয়েছিলেন । বর্তমান তাওরাতে এ সব সম্রাট ও রাজা-বাদশার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে ।

৮. গ্রীকদের আধিপত্য ও কর্তৃত্বের যুগ

গ্রীকসম্রাট ইস্কান্দার আলেকজান্ডার মিশর ,শাম ও ফিলিস্তিনে সামরিক অভিযান পরিচালনা করে ঐ সব অঞ্চল পদানত ও নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন । ইরানী সামন্তরা ও আঞ্চলিক শক্তিগুলো তাঁর মুখোমুখি হলে তিনি তাদের পরাজিত করে আল কুদসে প্রবেশ করেন এবং উক্ত অঞ্চল পূর্ণরূপে নিজ শাসনাধীনে আনয়ন করেন । অতঃপর সম্রাট ইস্কান্দার উত্তর ইরাকের আরবীলে এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধে পারস্য সম্রাট তৃতীয় আরদাশীরের শাসনকর্তৃত্ব ও সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ নির্মূল করেন । এরপর তিনি সম্মুখপানে অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখে পারস্য ও আরো অন্যান্য অঞ্চল দখল করেন । আর এভাবে খ্রি.পূ. ৩৩১ সালে ইহুদীরা গ্রীকদের অধীন হয়ে যায় ।

ইস্কান্দারের মৃত্যুর পরে তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যের ওপর আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাঁর সেনাবাহিনীর সেনাপতিদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয় যা ২০ বছর স্থায়ী হয়েছিল । বাতালিসা (বাতলীমূসীয়রা) মিশর সরকারের অধিকাংশ অঞ্চলের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় এবং সেলূকীয়রা (সেলূকূস-এর সাথে সংশ্লিষ্ট) সিরিয়া ও অন্যান্য অংশের ওপর নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন ।

আর এভাবেই আল কুদ্স খ্রি.পূ. ৩১২ সালে বাতলীমূসীয়দের নিয়ন্ত্রণে আসে । কিন্তু তৃতীয় সেলূকীয় নৃপতি আনতিয়োকূস খ্রি. পূ. ১৯৮ সালে বাতলীমূসীয়দের নিয়ন্ত্রণ থেকে আল কুদ্স মুক্ত করেন । অতঃপর আবারও বাতলীমূসীয়রা আল কুদসের ওপর নিজেদের আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন এবং খ্রি. পূ. ৬৪ সালে রোম কর্তৃক উক্ত অঞ্চল বিজিত হওয়া পর্যন্ত তারা সেখানে নিজেদের শাসনকর্তৃত্ব অব্যাহত রাখে ।

বর্তমান তাওরাত ছয় জন বাতলীমূসীয়কে প্রথম ,দ্বিতীয় ,তৃতীয় এভাবে ষষ্ঠ বাতলীমূসীয় পর্যন্ত স্মরণ করে বলেছে : তাদের মধ্যকার প্রথম ব্যক্তি শনিবার ঊরশালিমে প্রবেশ করে বিপুল সংখ্যক ইহুদীকে বন্দী করে মিশরে প্রেরণ করেছিলেন । ৮৮

ঠিক একইভাবে তাওরাত পাঁচ জন সেলূকীয় শাসনকর্তাকে প্রথম ,দ্বিতীয় এভাবে পঞ্চম আনতিয়োকূস নামে উল্লেখ করেছে এবং বলেছে : তাদের মধ্যকার চতুর্থ ব্যক্তি খ্রি.পূ. ১৭৫ সাল থেকে খ্রি.পূ. ১৬৩ সাল পর্যন্ত আল কুদসে সেনাভিযান পরিচালনা করেন এবং হযরত সুলাইমান (আ.)-এর উপাসনালয়ের যাবতীয় মূল্যবান জিনিস লুণ্ঠন করেন এবং দু বছর পরে আল কুদসের ওপর এক বিরাট আঘাত হানেন । সেখানে যা কিছু ছিল তা লুণ্ঠন এবং উক্ত নগরীর বাড়ি-ঘর ও প্রাচীরসমূহ ধ্বংস করা হয় । আক্রমণকারী চতুর্থ আনতিয়োকূস নারী ও শিশুদেরকে বন্দী করেন । তিনি নিজেদের উপাস্য যিউসের প্রতিমা উক্ত ইবাদতগাহে স্থাপন করেন এবং ইহুদীদেরকে উক্ত প্রতিমার উপাসনা করার আহবান জানান । তাদের অনেকেই তাঁর এ আহবানে সাড়া দিয়েছিল । অথচ মেকাবী ইহুদীদের আন্দোলনের কারণে খ্রি. পূ. ১৬৮ সালে তাদের অনেকেই গোপন স্থান ও গুহাসমূহে আশ্রয় নিয়েছিল । ৮৯

ইহুদীরা নিজেদের যে বিপ্লব ও আন্দোলনের ব্যাপারে গর্ব করে তা গেরিলা গোষ্ঠীসমূহের যুদ্ধের সাথেই বেশি সদৃশ ছিল । ইহুদী ধর্মে বিশ্বাসীরা মূর্তিপূজারী গ্রীকদের বিরুদ্ধে এ সব যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল । তারা বিভিন্ন সময়ে সীমিত সাফল্য লাভ করেছিল এবং এ অবস্থা রোমীয়দের চূড়ান্ত আধিপত্য ও কর্তৃত্ব স্থাপন করা পর্যন্ত অব্যাহত থাকে ।

15। নবীগণের মোজেযা সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :

আমরা বিশ্বাস করি যে ,মহান আল্লাহ যখন কাউকে তার সৃষ্টির জন্য পথ প্রদর্শক ও সংবাদ বাহক রূপে প্রেরণ করেন তখন তিনি তাকে সুষ্পষ্ঠরূপে মানুষের নিকট পরিচয় করিয়ে দেন। আর এর একমাত্র উপায় হলো তার রেসালাতের স্বপক্ষে প্রমাণ উপস্থাপন করা যাতে করে মহান আল্লাহর দয়া ও করুণা মানুষের জন্য পরিপূর্ণরূপে সম্পাদিত হয়। আর সে দলিল এমন হতে হবে যে একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত কারো পক্ষে তা সম্ভব নয় এবং তা বাস্তবায়িত হবে হেদায়াতকারী রাসূলের হাতে যা হবে তার পরিচায়ক ও তার স্বপক্ষে প্রমাণ স্বরূপ। আর এ দলিল বা প্রমাণ হলো তা-ই যাকে আমরা মোজেযা (অপরকে অপারগ করা) বা মোজেযা নামকরণ করে থাকি। কারণ তা আনয়ন করতে মানুষ অক্ষম ও অপারগ।

একজন নবীও যখন নিজেকে নবী হিসেবে পরিচয় দেন তখন তার দলিল রূপে মোজেযার পন্থা অবলম্বন করা ব্যতীত কোন উপায় থাকে না। আর এ মোজেযা এমন হয় যে সমসাময়িককালের জ্ঞানী ও গুণীরাও যেখানে তা প্রদর্শন করতে অক্ষম সেখানে অন্যান্য সাধারণ মানুষের কথাতো বলাই বাহুল্য। তাছাড়া এ মোজেযা নবুওয়াতের দাবীর সাথে সংশ্লিষ্ট হতে হবে যা তার দাবীর স্বপক্ষে প্রমাণ স্বরূপ উপস্থাপিত হবে। যখন তা আনয়ন করতে নবী ব্যতীত অন্য কেউ অপারগ হবে তখন সে জানতে পারবে যে ,এটি মানুষের ক্ষমতার উর্ধে এবং অলৌকিক বিষয়। আর এভাবে তারা জানতে পারে যে ,এ মোজেযা আনয়নকারী হলেন একজন অতিমানব যার সাথে সমগ্র জগতের পরিচালকের আধ্যাত্মিক সম্পর্ক। অনুরূপভাবে যখন এমন কোন নবী যিনি মোজেযা প্রদর্শন করেছেন এবং মানুষকে তার নবুওয়াত ও রেসালাতের প্রতি আহবান জানান ,তখন সহজেই মানুষের নিকট তার কথার সত্যতা গ্রহণযোগ্য হয় এবং তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা ও তার আদেশ পালন করা প্রত্যেকের জন্য আবশ্যক। আরও আবশ্যক তিনি যাতে বিশ্বাস করেন তাতে বিশ্বাস করা এবং তিনি যাতে অবিশ্বাস করেন তাতে অবিশ্বাস করা।

অতএব আমরা দেখতে পাই যে ,প্রত্যেক নবীর মোজেযা তার সমসাময়িককালের বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক ,কলা ও প্রযুক্তিগত বিষয়ের উপর প্রদর্শিত হয়ে থাকে। আর এজন্য আমরা দেখতে পাই যে ,হযরত মুসার (আ.) মোজেযা হলো লাঠি যা যাদুকরদের সমস্ত মিথ্যাচারকে বিনাশ করেছিল। কারণ হযরত মুসার (আ.) সমসাময়িককালে যাদুবিদ্যা ছিল জনপ্রিয় কলা। তার এ লাঠি সমস্ত মিথ্যাকে অসার করে দিলে সকলের জানা হয়ে গেল যে এটি তাদের ক্ষমতা বর্হিভূত এবং তাদের কলা-কৌশলের উর্ধে। আর কোন মানুষের পক্ষে এমনটি প্রদর্শন করা অসম্ভব। সুতরাং তাদের সকল বিজ্ঞান ও কলা এর সম্মুখে মূল্যহীন ও অকার্যকর।

অনুরূপ হযরত ঈসার (আ.) মোজেযা ছিল জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ রোগীকে আরোগ্য প্রদান করা আর মৃতকে জীবিত করা। কারণ তিনি এমন এক সময় এসেছিলেন যখন চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীরা সমাজে সর্বাপেক্ষা সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে পরিগনিত হত। কিন্তু তাদের কোন জ্ঞানই ঈসার (আ.) প্রদর্শিত বিষয়ের মত নয়।

আর আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর রয়েছে চিরন্তন মোজেযা। আর তা হলো অভূতপূর্ব সাহিত্যমান সম্পন্ন ও চূড়ান্ত বাগ্মীতা সম্বলিত পবিত্র কোরআন (যাকে আরবী পরিভাষায় বলে ফাসাহাত ও বালাগাত) । কারণ তদানীন্তনকালে সাহিত্য ও বাগ্মীতা এর চূড়ান্ত শীর্ষে আরোহণ করেছিল। তখন সাহিত্যিকরা ছিল সমাজের অগ্রগণ্য ব্যক্তি ,তাদের সুন্দর বাচনভঙ্গি ও শ্রুতিমধুরতার কারণে। সুতরাং কোরআন বজ্রপাতের মত এসে তাদেরকে তুচ্ছ জ্ঞাপন করল ও বিস্মিত করল এবং বুঝিয়ে দিল যে ,তারা এমন কিছু করতে অক্ষম। তারা এর সম্মুখে পরাস্ত ও অবনত হলো। আর তাদের অপরাগতার প্রমাণ মেলে তখনই যখন পবিত্র কোরআন তাদেরকে এর দশটি সুরার মত সূরা আনয়নের প্রতিদ্বন্দ্বীতায় আহবান করল এবং তারা অক্ষমতা প্রকাশ করল। অতঃপর বলা হলো মাত্র একটি সূরা আনতে। তাতেও তারা অপারগ হলো। আমরা জানি যে ,তারা একটি সূরা আনয়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়েছিল। ফলে তারা বাকযুদ্ধের পরিবর্তে তরবারির যুদ্ধের আশ্রয় নিয়েছিল।

অতএব আমরা দেখতে পাই যে ,কোরআন হলো একটি মোজেযা যা হযরত মোহাম্মদ (সা.) তার নবুওয়াতের দাবীর সপক্ষে আনয়ন করেছেন। সুতরাং আমরা জানি যে ,তিনি হলেন আল্লাহর রাসূল(সা.) ,আর এ সত্য (পবিত্র কোরআন) তিনি নিয়ে এসেছেন।

16। নবীগণের পবিত্রতা সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :

আমরা বিশ্বাস করি যে ,নবীগণ হলেন সব দিক থেকে পবিত্র। তাদের মত ইমামগণও (আ.) পবিত্র। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে কেউ কেউ নবীগণের (আ.) পবিত্রতায় বিশ্বাস করে না ,ইমামগণের (আ.) পবিত্রতা তো দূরের কথা।

এসমাত বা পবিত্রতা হলো যে কোন প্রকার গুনাহ (হোক সে ছোট বা বড়) বা ভুল ত্রুটি থেকে মুক্ত থাকা যদিও তাদের দ্বারা এগুলো সংগঠিত হওয়ার সম্ভাবনাকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয় না। কিন্তু তাদের এগুলো থেকে মুক্ত থাকা আবশ্যক। এমনকি শিষ্টাচারগতভাবে যেগুলো দৃষ্টিকটু ও অপছন্দনীয় তা থেকেও মুক্ত থাকা আবশ্যক। যেমন- মানুষের সাথে অশিষ্ট আচরণ ,রাস্তায় দাড়িয়ে খাওয়া ,উচ্চস্বরে হাসা ,কিংবা এমন কিছু করা যা মানুষের নিকট অসুন্দর ও অপছন্দনীয়।

নবীগণের পবিত্র হওয়ার আবশ্যকীয়তার দলিল : যদি নবী কর্তৃক পাপ ও ভুল-ত্রুটি ইত্যাদি এ জাতীয় কাজগুলো সংগঠিত হয় ,তাহলে তা পালন করা (পাপ হোক বা ভুল-ত্রুটি) হয় আমাদের জন্য আবশ্যক হবে ,না হয় আবশ্যক হবে না। যদি তাদেরকে অনুসরণ করা আবশ্যক হয় ,তবে পাপ কাজ করা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের জন্য বৈধ হবে ,এমনকি তা করা আমাদের জন্য ওয়াজীব হবে। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে ও দ্বীনের সুষ্পষ্ট দলিলের উপস্থিতিতে তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আবার যদি তাদের অনুসরণ করা আমাদের জন্য আবশ্যক না হয় তবে নবুওয়াতই অস্বীকৃত হয়। কারণ একান্ত বাধ্যগতভাবেই নবীকে অনুসরণ করতে হবে। সুতরাং কথায় ও কাজে তিনি যা করবেন তাতে যদি পাপ ও ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাহলে তাকে অনুসরণ করা আমাদের জন্য অসম্ভব। ফলে তার নবুওয়াতের উদ্দেশ্যই ব্যহত হবে। এমনকি অন্যান্য সাধারণ মানুষের মতই হয়ে যাবেন নবী যার কথা বা কাজের সে সমুন্নত মূল্য থাকবে না যা আমরা সর্বদা আশাকরি। ফলে তার কোন কথা ও কাজ এবং আদেশই অনুসরণীয় হবে না এবং বিশ্বাসযোগ্য থাকবে না।

আর এ দলিল ইমামগণের পবিত্রতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কারণ আমরা মনে করি যে ,ইমামগণও (আ.) মহান আল্লাহ কর্তৃক মানুষের হেদায়াতের জন্য নবী (সা.) এর প্রতিনিধি বা উত্তরাধিকারী হিসেবে নিয়োগকৃত হবেন। (ইমামত অধ্যায়ে এ প্রসঙ্গে আলোচনা করা হবে)

17। নবীর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :

আমরা বিশ্বাস করি যে ,যেমনি করে তার পবিত্র হওয়া আবশ্যক তেমনি আবশ্যক সকল মানবীয় বৈশিষ্ট্যে পরিপূর্ণ থাকা। যেমন- বীরত্ব ,রাজনীতি ,প্রশাসন ,ধৈর্য ,বুদ্ধিবৃত্তি ,প্রত্যুৎপন্নমতিতা ইত্যাদি। অর্থাৎ কেউই এ সকল বৈশিষ্ট্যে তাকে ছাড়িয়ে যেতে পারবে না। কারণ যদি তা না হয় তবে সকল সৃষ্টির উপর তার সার্বজনীন প্রাধান্য থাকতে পারে না এবং সামগ্রিকভাবে জগতকে পরিচালনা করার মত সামর্থ্য তার থাকবে না।

অনুরূপ তাকে হতে হবে জন্মগতভাবে পবিত্র বংশদ্ভূত ,সৎ ,সত্যবাদী। এমনকি নবুওয়াতের ঘোষণার পূর্বেও তাকে সমস্ত প্রকার দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত থাকতে হবে যাতে মানুষ তাকে চূড়ান্তভাবে বিশ্বাস করতে পারে ,তার নিকট আশ্রয় পেতে পারে এবং সংগত কারণেই তিনি এ মহান ঐশী মর্যাদার (পবিত্রতা) উপযুক্ত।

18। পূর্ববর্তী নবীগণ ও তাদের ঐশী গ্রন্থ সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :

সামগ্রিকভাবে আমরা বিশ্বাস করি যে ,সমস্ত নবী ও রাসুল হলেন সত্য। তেমনি তাদের এসমাত বা পবিত্রতায়ও আমরা বিশ্বাস করি। আর তাদের নবুওয়াতকে অস্বীকার করা ,তাদের কুৎসা করা ,বিদ্রূপ করা হলো কুফরি ও নাস্তিকতা। আর এর মাধ্যমে প্রকারান্তরে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদকেই (সা.) অস্বীকার করা হয়। কারণ তিনিই তার পূর্ববর্তী নবীদের ব্যাপারে আমাদেরকে সংবাদ দিয়েছিলেন এবং সত্যায়িত করেছিলেন।

হযরত আদম (আ.) ,নূহ (আ.) ,ইব্রাহিম (আ.) ,দাউদ (আ.) ,সোলায়মান (আ.) এবং অন্যান্য যাঁদের নাম পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে অর্থাৎ যাঁদের নাম এবং শরীয়ত প্রসিদ্ধ ,বিশেষকরে তাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা আবশ্যক। আর যদি কেউ তাদের একজনকে অস্বীকার করে তবে সে যেন সকলকে অস্বীকার করল। বিশেষ করে আমাদের প্রিয় নবীর (সা.) নবুওয়াতকে অস্বীকার করল।

অনুরূপভাবে তাদের গ্রন্থসমূহ এবং তাদের উপর যা নাযিল হয়েছে তার উপর ঈমান আনাও আবশ্যক। কিন্তু বর্তমানে যে ইঞ্জিল ও তৌরাত মানুষের নিকট আছে তা যেরূপ নাযিল হয়েছিল সেরূপ আর নেই। বর্তমানে এতদ্ভয়ের মধ্যে বিকৃতি ও পরিবর্তন ,সংযোজন ও বিয়োজনের প্রমাণ মিলে যা হযরত মুসা (আ.) ও ঈসার (আ.) পর সংগঠিত হয়েছে। এক ধরনের লোভী ও স্বেচ্ছাচারী ব্যক্তিদের দ্বারা এ বিকৃতি সাধিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে যা আছে তার অধিকাংশই হযরত মূসা (আ.) ও ঈসার (আ.) পর তাদের অনুসারীদের দ্বারা সম্পাদিত হয়েছে।

19। ইসলাম ধর্মে আমাদের বিশ্বাস :

আমরা বিশ্বাস করি যে ,ইসলামই হলো মহান আল্লাহর নিকট একমাত্র মনোনীত ধর্ম। এটি সত্য ঐশী বিধান ,সর্বশেষ শরীয়ত ,পূর্ববর্তী সকল শরীয়তের রহিতকারী শরীয়ত ,পরিপূর্ণ ও বিস্তৃত বিধান যাতে সন্নিবেশিত আছে মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন সমস্ত কল্যাণ ও সফলতার উপায়। এ বিধান সমস্ত সময় ও কালের জন্য অবশিষ্ট থাকার উপযুক্ত এবং কখনো পরিবর্তন হবে না। মানুষের ব্যক্তিগত ,সামাজিক ও রাজনৈতিক সকল চাহিদার জবাবের সমাহার ঘটেছে এ বিধানে। এটি হলো সর্বশেষ শরীয়ত ,এরপর আর কোন শরীয়ত আসবে না। জুলুম ও ফেসাদে মুহ্যমান মানবতাকে এ শরীয়ত পরিশুদ্ধ করে। আর তাই এমন একদিন অবশ্যই আসবে যেদিন ইসলাম ধর্ম আরো শক্তিশালী হবে এবং এর ন্যায়-নীতি সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে।

যখন এ বিশ্বে সমগ্র মানুষ পরিপূর্ণরূপে ইসলামের বিধান মেনে চলবে ,তখন মানুষের সুখ-সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পাবে। জন কল্যাণ ,মান-সম্মান ,ঐশ্বর্য ,মানবীয় মূল্যবোধ ইত্যাদি ক্ষেত্রে মানুষ তার কাঙ্খিত লক্ষ্যের শীর্ষে আরোহন করবে। অপরদিকে জুলুম-অত্যাচার ,দারিদ্র ইত্যাদি মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ দ্বারা পৃথিবীর বুক থেকে বিদায় গ্রহণ করবে। বর্তমানে আমরা কিছু মুসলমান নামধারী মানুষের মাঝে যে লজ্জাকর পরিস্থিতি লক্ষ্য করছি তার কারণ হলো ,প্রথম থেকেই তাদের আচার ব্যবহার প্রকৃতার্থে ইসলামী বিধান মোতাবেক ছিল না। আর এ অবস্থা চলতে চলতে পরিস্থিতি খারাপ থেকে আরও খারাপ হয়ে আজকের পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। মুসলমানদের লজ্জাকর পশ্চাৎপদতার কারণ ইসলামকে গ্রহণ করা নয়। বরং এর কারণ হলো ইসলামের শিক্ষাকে অমান্য করা ,ইসলামী নিয়ম-নীতিকে অগ্রাহ্য করা ,তাদের শাসকবর্গ কর্তৃক অন্যায় এবং শত্রুতাকে দরিদ্র ও সাধারণ জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া ইত্যাদি। আর এগুলোর কারণে তাদের উন্নতি ও অগ্রগতিকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। তাদেরকে করেছে দুর্বল ,তাদের মনুষ্যত্বকে করেছে ধ্বংস। পরিশেষে তারা পতিত হয়েছে দুঃখ দূর্দশায়। আল্লাহ তাদেরকে তাদের পাপ দ্বারা ধ্বংস করে দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনের ভাষায়-

এটা এ কারণে যে ,আল্লাহ কোন জাতির উপর তার কর্তৃক বর্ষিত নেয়ামত পরিবর্তন করেন না ,যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা নিজেদের মধ্যে যা কিছু আছে তার পরিবর্তন করে। (সুরা আনফাল -53)

আর আল্লাহর সৃষ্টির জন্য এটাই তার বিধান। কোরআন আরও বলে-

অন্যায়কারীরা কখনোই সফল হবে না। (সুরা ইউনুস -17)

অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে-

নিশ্চয়ই তোমার প্রভু কোন জাতিকে তাদের অন্যায়ের জন্য ধ্বংস করেন না যারা নিজেদেরকে সংশোধন করার চেষ্টা করে। (সূরা হুদ - 117)

পুনরায় বর্ণিত হয়েছে-

আর এরকমই হলো শহরের জালিম নাগরিকদের জন্য তোমার প্রভুর শাস্তি। তোমার প্রভুর শাস্তি সত্যিই কঠোর। (সূরা হুদ - 102)

আমরা এমন এক দ্বীন থেকে কি করে আশা করতে পারি যে ,ধ্বংসের অতলে তলিয়ে যাওয়া তার অনুসারীদেরকে রক্ষা করবে যেখানে এর শিক্ষা শুধুমাত্র কাগজে কলমে শোভা পাচ্ছে এবং বিন্দুমাত্র এর শিক্ষার অনুশীলন নেই ?

ইসলামের ভিত্তিমূল হলো- বিশ্বাস ,সততা ,সত্যবাদিতা ,শিষ্টতা ,শালীনতা ও ত্যাগ। একজন মুসলমান তার ভাইয়ের জন্য তা-ই আশা করে যা সে নিজের জন্য করে। কিন্ত মুসলমানরা সুদীর্ঘ কাল পূর্বেই এগুলোকে পশ্চাতে ফেলে এসেছে।

সময় যতই গড়িয়ে যাচ্ছে ততই তারা বিভক্ত হয়ে পড়েছে বিভিন্ন দল ও উপদলে। পার্থিব বিষয় আশয়ের জন্য করছে তারা প্রতিযোগিতা। অনর্থক কোন বিষয়বস্তুর জন্য আপন খেয়ালে পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণ করছে কিংবা কাফের বলে আখ্যায়িত করছে। তারা ভুলে যাচ্ছে ইসলামকে এবং তাদের নিজেদের ও সমাজের কল্যাণকে। যে বিষয়গুলোর উপর তারা পারস্পরিক সংঘর্ষে লিপ্ত হয় সেগুলোর উদাহরণ হলো নিম্নরূপ- কোরআন কি সৃষ্টি না সৃষ্টি নয় ;বেহেশত ও দোযখ কি তৈরী করা হয়েছে না ভবিষ্যতে হবে ইত্যাদি। আর এগুলোর উপর ভিত্তি করেই তারা পরস্পরকে কাফের বলছে।

তাদের এ মতবিরোধের ধরন দেখে অনুধাবন করা যায় যে তারা প্রকৃত প্রদর্শিত পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে এবং ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। কালের প্রবাহে তাদের এ বিচ্যুতি উত্তর উত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। অজ্ঞতা ও বিপথগামিতা তাদেরকে ঘিরে ফেলেছে। কিন্তু তারা অকার্যকর তুচ্ছ কুসংস্কার ও কল্পিত বিষয়বস্তু নিয়ে বসে আছে। পারস্পরিক সংঘাত ,সংঘর্ষ ও আত্মম্ভরিতা তাদেরকে দিন দিন হতাশার অতল গহীনে নিমজ্জিত করছে। অপরদিকে ইসলামের চিরশত্রু পাশ্চাত্য উত্তর উত্তর শক্তিশালী হচ্ছে এবং মুসলমানরা যখন ঘুমে ,অর্ধঘুমে তখন তারা ইসলামী দেশগুলোকে নিজেদের উপনিবেশ বানিয়ে চলেছে। এ দূর্ভাগ্যের শেষ কোথায় তা একমাত্র মহান আল্লাহই জানেন।

নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ ঐ শহরের অধিবাসদেরকে তাদের পাপের জন্য ধ্বংস করেন না যারা নিজেদেরকে সংশোধন করে। (সুরা হুদ- 117)

আজ অথবা কাল যেদিনই হোক না কেন সুখ সমৃদ্ধির জন্য মুসলমাদেরকে তাদের নিজেদের কর্মকান্ডের পর্যালোচনা করতেই হবে এবং তা ব্যতীত কোন গত্যন্তর নেই। তাদেরকে এবং তাদের বংশধরদেরকে সঠিক ইসলামের শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে ও পরিশুদ্ধ করতে হবে এবং এভাবে হিংসা-বিদ্বেষ দূর করতে হবে। আর এ রূপেই তারা নিজেদেরকে এ ভয়ংকর দুঃখ দুর্দশা থেকে পবিত্রাণ করাতে পারবে। আর এরকমটি করলে ন্যায়-নীতিতে বিশ্ব সেরূপ পরিপূর্ণ হতে বাধ্য যেরূপ অন্যায় ও অত্যাচারে পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। মহান আল্লাহ ও তার রাসুলের (সা.) প্রতিশ্রুতি এমনটিই। কারণ এ দ্বীনই (ইসলাম) হলো সর্বশেষ ধর্ম যার অনুসরণ ব্যতীত পৃথিবীতে কল্যাণ ও শান্তি ফিরে আসবে না। এটা সত্য যে ,ইসলামকে কুসংস্কার ,বিকৃতি ও পথভ্রষ্টতা থেকে রক্ষা করার জন্য একজন ইমামের আবশ্যকতা রয়েছে। তিনি মানবতাকে রক্ষা করবেন এবং তাদেরকে পূর্ণ কলুষতা ,অব্যাহত অন্যায় অত্যাচার যা মানুষের আত্মা ও চারিত্রিক মূল্যবোধের জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত তা থেকে রক্ষা করবেন। মহান আল্লাহ সে ইমামের আবির্ভাব ত্বরান্বিত ও সহজ করুন।

20। ইসলামের মহানবী (সা.) সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :

আমরা বিশ্বাস করি যে ,ইসলামের বাণী বাহক হলেন মোহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ (সা.) যিনি সর্বশেষ নবী ,প্রেরিত পুরুষদের সর্দার এবং নিঃশর্তভাবে তাদের শ্রেষ্টতম। তেমনি তিনি সকল মানুষের শীর্ষে। তার (সা.) শ্রেষ্টত্বের সাথে কাউকে তুলনা করা যায় না। বদান্যতার দিক থেকে কেউ তাকে ছুতে পারে না। বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে কেউই তার নিকটবর্তী নয়। সৃষ্টিকুলে তার সমকক্ষ কেউ নেই। তিনিই হলেন সৃষ্টির সেরা। সৃষ্টির শুরু থেকে কিয়ামত পর্যন্ত কেউই তার সমকক্ষ নয়।

21। পবিত্র কোরআন সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :

আমরা বিশ্বাস করি যে ,পবিত্র কোরআন হলো আল্লাহর বানী যা তিনি মহানবী হযরত মোহাম্মদের (সা.) উপর নাযিল করেছেন। এতে সবকিছু বর্ণিত হয়েছে। এটি হলো একটি চিরন্তন মোজেযা। মানুষের পক্ষে এরূপ সাহিত্যমান ও বাগ্মীতাসম্পন্ন কিছু রচনা করা অসম্ভব । এতে রয়েছে উচ্চতর জ্ঞান ও সত্য। কখনোই এতে পরিবর্তন ,পরিবর্ধন ও বিকৃতি সাধিত হবে না। আমরা বিশ্বাস করি যে ,যে কোরআন এখন আমাদের নিকট আছে এবং যা আমরা এখন পাঠ করি তা সেই কোরআন যা মহানবীর (সা.) উপর নাযিল হয়েছিল। যদি কেউ এর ব্যতিক্রম দাবী করে তবে সে হয় দুষ্ট প্রকৃতির লোক অথবা কুচক্রী কিংবা পথভ্রষ্ট। আর এ ধরনের লোকেরা হেদায়াতপ্রাপ্ত নয়। মহান আল্লাহ বলেন-

অগ্র ও পশ্চাৎ (কোন দিক থেকেই) মিথ্যা এতে প্রবেশ করতে পারবে না। (সুরা হামীম সেজদাহ -42)

কোরআনের অলৌকিকত্বের (মোজেযা) স্বপক্ষে একটি উল্লেখযোগ্য প্রমাণ হলো এই যে ,সময় যতই গড়িয়ে যাচ্ছে ,বিজ্ঞান ও কলা ততই অগ্রসরমান হচ্ছে ,তথাপি কোরআন সমুন্নত চিন্তা-চেতনায় চির ভাস্বর ও মধুময়। এমন কোন বৈজ্ঞানিক মতবাদ এতে নেই যা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। সুনিশ্চিত দার্শনিক কোন সত্যের সাথেই কোরআন সাংঘর্ষিক নয়। অপরদিকে অনেক সনামধন্য বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক রয়েছেন যারা চিন্তা ও জ্ঞানের দিক থেকে চরম উৎকর্ষে পৌঁছেছেন অথচ তাদের গ্রন্থেও অন্ততঃপক্ষে কিঞ্চিত স্ববিরোধিতা কিংবা ন্যূনতম ভুল হলেও পাওয়া যায়। অধিকন্তু বৈজ্ঞানিক গবেষণার অগ্রগতি ও আধুনিক তথ্যের ফলে এমনকি সক্রেটিস ,প্লেটো এবং এ্যারিষ্টটলের মত প্রখ্যাত গ্রীক দার্শনিকদের যাদেরকে পরবর্তীরা বিজ্ঞানের জনক ও শিক্ষক হিসেবে স্বীকার করেছেন তাদের গ্রন্থেও কিছু ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

আমরা আরও বিশ্বাস করি যে ,কথায় ও কাজে কোরআনের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করতে হবে। সুতরাং কোরআনের কোন শব্দকে কিংবা শব্দাংশকে (অক্ষরকে) অপবিত্র করা অবৈধ। অনুরূপ অবৈধ হলো অপবিত্র অবস্থায় এর কোন শব্দ বা অক্ষর স্পর্শ করা। পবিত্র কোরআনের ভাষায়-

পবিত্রতা ব্যতীত কেউই একে স্পর্শ করতে পারে না। (সুরা ওয়াকিয়া - 79)

আর এ আদেশ বড় ধরনের অপবিত্রতা যেমন- জানাবাত ,হায়েজ ,নেফাস ইত্যাদির ক্ষেত্রেও যেমন প্রযোজ্য তেমনি ছোট ধরনের অপবিত্রতা যেমন- ঘুম ইত্যাদির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এসবের জন্য ফিকাহ শাস্ত্রে বর্ণিত ব্যাখ্যা মোতাবেক গোসল বা অজু করলে কোরআন স্পর্শ করা বৈধ হবে।

অনুরূপভাবে কোরআনকে অগ্নিদগ্ধ করা বৈধ নয়। সেরূপ বৈধ নয় অপমান করা তা যে কোন ভাবেই হোক না কেন। অর্থাৎ সাধারনের মধ্যে যেটা অপমান বলে পরিগনিত হয় তা করা যাবে না। যেমন- নিক্ষেপ করা ,অপরিস্কার করা ,পা দিয়ে ঠেলে দেয়া কিংবা অসম্মান জনক জায়গায় রাখা। যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে উপরোল্লিখিত যে কোন একটি কাজ অথবা এ ধরনের কোন কাজ করে তবে সে ইসলাম ও এর পবিত্রতাকে অস্বীকারকারীদের মধ্যে পরিগণিত হবে। সে দ্বীনে অবিশ্বাসী। প্রকারান্তরে সে বিশ্বাধিপতি আল্লাহকে অস্বীকার করেছে।

15। নবীগণের মোজেযা সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :

আমরা বিশ্বাস করি যে ,মহান আল্লাহ যখন কাউকে তার সৃষ্টির জন্য পথ প্রদর্শক ও সংবাদ বাহক রূপে প্রেরণ করেন তখন তিনি তাকে সুষ্পষ্ঠরূপে মানুষের নিকট পরিচয় করিয়ে দেন। আর এর একমাত্র উপায় হলো তার রেসালাতের স্বপক্ষে প্রমাণ উপস্থাপন করা যাতে করে মহান আল্লাহর দয়া ও করুণা মানুষের জন্য পরিপূর্ণরূপে সম্পাদিত হয়। আর সে দলিল এমন হতে হবে যে একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত কারো পক্ষে তা সম্ভব নয় এবং তা বাস্তবায়িত হবে হেদায়াতকারী রাসূলের হাতে যা হবে তার পরিচায়ক ও তার স্বপক্ষে প্রমাণ স্বরূপ। আর এ দলিল বা প্রমাণ হলো তা-ই যাকে আমরা মোজেযা (অপরকে অপারগ করা) বা মোজেযা নামকরণ করে থাকি। কারণ তা আনয়ন করতে মানুষ অক্ষম ও অপারগ।

একজন নবীও যখন নিজেকে নবী হিসেবে পরিচয় দেন তখন তার দলিল রূপে মোজেযার পন্থা অবলম্বন করা ব্যতীত কোন উপায় থাকে না। আর এ মোজেযা এমন হয় যে সমসাময়িককালের জ্ঞানী ও গুণীরাও যেখানে তা প্রদর্শন করতে অক্ষম সেখানে অন্যান্য সাধারণ মানুষের কথাতো বলাই বাহুল্য। তাছাড়া এ মোজেযা নবুওয়াতের দাবীর সাথে সংশ্লিষ্ট হতে হবে যা তার দাবীর স্বপক্ষে প্রমাণ স্বরূপ উপস্থাপিত হবে। যখন তা আনয়ন করতে নবী ব্যতীত অন্য কেউ অপারগ হবে তখন সে জানতে পারবে যে ,এটি মানুষের ক্ষমতার উর্ধে এবং অলৌকিক বিষয়। আর এভাবে তারা জানতে পারে যে ,এ মোজেযা আনয়নকারী হলেন একজন অতিমানব যার সাথে সমগ্র জগতের পরিচালকের আধ্যাত্মিক সম্পর্ক। অনুরূপভাবে যখন এমন কোন নবী যিনি মোজেযা প্রদর্শন করেছেন এবং মানুষকে তার নবুওয়াত ও রেসালাতের প্রতি আহবান জানান ,তখন সহজেই মানুষের নিকট তার কথার সত্যতা গ্রহণযোগ্য হয় এবং তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা ও তার আদেশ পালন করা প্রত্যেকের জন্য আবশ্যক। আরও আবশ্যক তিনি যাতে বিশ্বাস করেন তাতে বিশ্বাস করা এবং তিনি যাতে অবিশ্বাস করেন তাতে অবিশ্বাস করা।

অতএব আমরা দেখতে পাই যে ,প্রত্যেক নবীর মোজেযা তার সমসাময়িককালের বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক ,কলা ও প্রযুক্তিগত বিষয়ের উপর প্রদর্শিত হয়ে থাকে। আর এজন্য আমরা দেখতে পাই যে ,হযরত মুসার (আ.) মোজেযা হলো লাঠি যা যাদুকরদের সমস্ত মিথ্যাচারকে বিনাশ করেছিল। কারণ হযরত মুসার (আ.) সমসাময়িককালে যাদুবিদ্যা ছিল জনপ্রিয় কলা। তার এ লাঠি সমস্ত মিথ্যাকে অসার করে দিলে সকলের জানা হয়ে গেল যে এটি তাদের ক্ষমতা বর্হিভূত এবং তাদের কলা-কৌশলের উর্ধে। আর কোন মানুষের পক্ষে এমনটি প্রদর্শন করা অসম্ভব। সুতরাং তাদের সকল বিজ্ঞান ও কলা এর সম্মুখে মূল্যহীন ও অকার্যকর।

অনুরূপ হযরত ঈসার (আ.) মোজেযা ছিল জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ রোগীকে আরোগ্য প্রদান করা আর মৃতকে জীবিত করা। কারণ তিনি এমন এক সময় এসেছিলেন যখন চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীরা সমাজে সর্বাপেক্ষা সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে পরিগনিত হত। কিন্তু তাদের কোন জ্ঞানই ঈসার (আ.) প্রদর্শিত বিষয়ের মত নয়।

আর আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর রয়েছে চিরন্তন মোজেযা। আর তা হলো অভূতপূর্ব সাহিত্যমান সম্পন্ন ও চূড়ান্ত বাগ্মীতা সম্বলিত পবিত্র কোরআন (যাকে আরবী পরিভাষায় বলে ফাসাহাত ও বালাগাত) । কারণ তদানীন্তনকালে সাহিত্য ও বাগ্মীতা এর চূড়ান্ত শীর্ষে আরোহণ করেছিল। তখন সাহিত্যিকরা ছিল সমাজের অগ্রগণ্য ব্যক্তি ,তাদের সুন্দর বাচনভঙ্গি ও শ্রুতিমধুরতার কারণে। সুতরাং কোরআন বজ্রপাতের মত এসে তাদেরকে তুচ্ছ জ্ঞাপন করল ও বিস্মিত করল এবং বুঝিয়ে দিল যে ,তারা এমন কিছু করতে অক্ষম। তারা এর সম্মুখে পরাস্ত ও অবনত হলো। আর তাদের অপরাগতার প্রমাণ মেলে তখনই যখন পবিত্র কোরআন তাদেরকে এর দশটি সুরার মত সূরা আনয়নের প্রতিদ্বন্দ্বীতায় আহবান করল এবং তারা অক্ষমতা প্রকাশ করল। অতঃপর বলা হলো মাত্র একটি সূরা আনতে। তাতেও তারা অপারগ হলো। আমরা জানি যে ,তারা একটি সূরা আনয়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়েছিল। ফলে তারা বাকযুদ্ধের পরিবর্তে তরবারির যুদ্ধের আশ্রয় নিয়েছিল।

অতএব আমরা দেখতে পাই যে ,কোরআন হলো একটি মোজেযা যা হযরত মোহাম্মদ (সা.) তার নবুওয়াতের দাবীর সপক্ষে আনয়ন করেছেন। সুতরাং আমরা জানি যে ,তিনি হলেন আল্লাহর রাসূল(সা.) ,আর এ সত্য (পবিত্র কোরআন) তিনি নিয়ে এসেছেন।

16। নবীগণের পবিত্রতা সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :

আমরা বিশ্বাস করি যে ,নবীগণ হলেন সব দিক থেকে পবিত্র। তাদের মত ইমামগণও (আ.) পবিত্র। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে কেউ কেউ নবীগণের (আ.) পবিত্রতায় বিশ্বাস করে না ,ইমামগণের (আ.) পবিত্রতা তো দূরের কথা।

এসমাত বা পবিত্রতা হলো যে কোন প্রকার গুনাহ (হোক সে ছোট বা বড়) বা ভুল ত্রুটি থেকে মুক্ত থাকা যদিও তাদের দ্বারা এগুলো সংগঠিত হওয়ার সম্ভাবনাকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয় না। কিন্তু তাদের এগুলো থেকে মুক্ত থাকা আবশ্যক। এমনকি শিষ্টাচারগতভাবে যেগুলো দৃষ্টিকটু ও অপছন্দনীয় তা থেকেও মুক্ত থাকা আবশ্যক। যেমন- মানুষের সাথে অশিষ্ট আচরণ ,রাস্তায় দাড়িয়ে খাওয়া ,উচ্চস্বরে হাসা ,কিংবা এমন কিছু করা যা মানুষের নিকট অসুন্দর ও অপছন্দনীয়।

নবীগণের পবিত্র হওয়ার আবশ্যকীয়তার দলিল : যদি নবী কর্তৃক পাপ ও ভুল-ত্রুটি ইত্যাদি এ জাতীয় কাজগুলো সংগঠিত হয় ,তাহলে তা পালন করা (পাপ হোক বা ভুল-ত্রুটি) হয় আমাদের জন্য আবশ্যক হবে ,না হয় আবশ্যক হবে না। যদি তাদেরকে অনুসরণ করা আবশ্যক হয় ,তবে পাপ কাজ করা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের জন্য বৈধ হবে ,এমনকি তা করা আমাদের জন্য ওয়াজীব হবে। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে ও দ্বীনের সুষ্পষ্ট দলিলের উপস্থিতিতে তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আবার যদি তাদের অনুসরণ করা আমাদের জন্য আবশ্যক না হয় তবে নবুওয়াতই অস্বীকৃত হয়। কারণ একান্ত বাধ্যগতভাবেই নবীকে অনুসরণ করতে হবে। সুতরাং কথায় ও কাজে তিনি যা করবেন তাতে যদি পাপ ও ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাহলে তাকে অনুসরণ করা আমাদের জন্য অসম্ভব। ফলে তার নবুওয়াতের উদ্দেশ্যই ব্যহত হবে। এমনকি অন্যান্য সাধারণ মানুষের মতই হয়ে যাবেন নবী যার কথা বা কাজের সে সমুন্নত মূল্য থাকবে না যা আমরা সর্বদা আশাকরি। ফলে তার কোন কথা ও কাজ এবং আদেশই অনুসরণীয় হবে না এবং বিশ্বাসযোগ্য থাকবে না।

আর এ দলিল ইমামগণের পবিত্রতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কারণ আমরা মনে করি যে ,ইমামগণও (আ.) মহান আল্লাহ কর্তৃক মানুষের হেদায়াতের জন্য নবী (সা.) এর প্রতিনিধি বা উত্তরাধিকারী হিসেবে নিয়োগকৃত হবেন। (ইমামত অধ্যায়ে এ প্রসঙ্গে আলোচনা করা হবে)

17। নবীর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :

আমরা বিশ্বাস করি যে ,যেমনি করে তার পবিত্র হওয়া আবশ্যক তেমনি আবশ্যক সকল মানবীয় বৈশিষ্ট্যে পরিপূর্ণ থাকা। যেমন- বীরত্ব ,রাজনীতি ,প্রশাসন ,ধৈর্য ,বুদ্ধিবৃত্তি ,প্রত্যুৎপন্নমতিতা ইত্যাদি। অর্থাৎ কেউই এ সকল বৈশিষ্ট্যে তাকে ছাড়িয়ে যেতে পারবে না। কারণ যদি তা না হয় তবে সকল সৃষ্টির উপর তার সার্বজনীন প্রাধান্য থাকতে পারে না এবং সামগ্রিকভাবে জগতকে পরিচালনা করার মত সামর্থ্য তার থাকবে না।

অনুরূপ তাকে হতে হবে জন্মগতভাবে পবিত্র বংশদ্ভূত ,সৎ ,সত্যবাদী। এমনকি নবুওয়াতের ঘোষণার পূর্বেও তাকে সমস্ত প্রকার দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত থাকতে হবে যাতে মানুষ তাকে চূড়ান্তভাবে বিশ্বাস করতে পারে ,তার নিকট আশ্রয় পেতে পারে এবং সংগত কারণেই তিনি এ মহান ঐশী মর্যাদার (পবিত্রতা) উপযুক্ত।

18। পূর্ববর্তী নবীগণ ও তাদের ঐশী গ্রন্থ সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :

সামগ্রিকভাবে আমরা বিশ্বাস করি যে ,সমস্ত নবী ও রাসুল হলেন সত্য। তেমনি তাদের এসমাত বা পবিত্রতায়ও আমরা বিশ্বাস করি। আর তাদের নবুওয়াতকে অস্বীকার করা ,তাদের কুৎসা করা ,বিদ্রূপ করা হলো কুফরি ও নাস্তিকতা। আর এর মাধ্যমে প্রকারান্তরে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদকেই (সা.) অস্বীকার করা হয়। কারণ তিনিই তার পূর্ববর্তী নবীদের ব্যাপারে আমাদেরকে সংবাদ দিয়েছিলেন এবং সত্যায়িত করেছিলেন।

হযরত আদম (আ.) ,নূহ (আ.) ,ইব্রাহিম (আ.) ,দাউদ (আ.) ,সোলায়মান (আ.) এবং অন্যান্য যাঁদের নাম পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে অর্থাৎ যাঁদের নাম এবং শরীয়ত প্রসিদ্ধ ,বিশেষকরে তাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা আবশ্যক। আর যদি কেউ তাদের একজনকে অস্বীকার করে তবে সে যেন সকলকে অস্বীকার করল। বিশেষ করে আমাদের প্রিয় নবীর (সা.) নবুওয়াতকে অস্বীকার করল।

অনুরূপভাবে তাদের গ্রন্থসমূহ এবং তাদের উপর যা নাযিল হয়েছে তার উপর ঈমান আনাও আবশ্যক। কিন্তু বর্তমানে যে ইঞ্জিল ও তৌরাত মানুষের নিকট আছে তা যেরূপ নাযিল হয়েছিল সেরূপ আর নেই। বর্তমানে এতদ্ভয়ের মধ্যে বিকৃতি ও পরিবর্তন ,সংযোজন ও বিয়োজনের প্রমাণ মিলে যা হযরত মুসা (আ.) ও ঈসার (আ.) পর সংগঠিত হয়েছে। এক ধরনের লোভী ও স্বেচ্ছাচারী ব্যক্তিদের দ্বারা এ বিকৃতি সাধিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে যা আছে তার অধিকাংশই হযরত মূসা (আ.) ও ঈসার (আ.) পর তাদের অনুসারীদের দ্বারা সম্পাদিত হয়েছে।

19। ইসলাম ধর্মে আমাদের বিশ্বাস :

আমরা বিশ্বাস করি যে ,ইসলামই হলো মহান আল্লাহর নিকট একমাত্র মনোনীত ধর্ম। এটি সত্য ঐশী বিধান ,সর্বশেষ শরীয়ত ,পূর্ববর্তী সকল শরীয়তের রহিতকারী শরীয়ত ,পরিপূর্ণ ও বিস্তৃত বিধান যাতে সন্নিবেশিত আছে মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন সমস্ত কল্যাণ ও সফলতার উপায়। এ বিধান সমস্ত সময় ও কালের জন্য অবশিষ্ট থাকার উপযুক্ত এবং কখনো পরিবর্তন হবে না। মানুষের ব্যক্তিগত ,সামাজিক ও রাজনৈতিক সকল চাহিদার জবাবের সমাহার ঘটেছে এ বিধানে। এটি হলো সর্বশেষ শরীয়ত ,এরপর আর কোন শরীয়ত আসবে না। জুলুম ও ফেসাদে মুহ্যমান মানবতাকে এ শরীয়ত পরিশুদ্ধ করে। আর তাই এমন একদিন অবশ্যই আসবে যেদিন ইসলাম ধর্ম আরো শক্তিশালী হবে এবং এর ন্যায়-নীতি সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে।

যখন এ বিশ্বে সমগ্র মানুষ পরিপূর্ণরূপে ইসলামের বিধান মেনে চলবে ,তখন মানুষের সুখ-সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পাবে। জন কল্যাণ ,মান-সম্মান ,ঐশ্বর্য ,মানবীয় মূল্যবোধ ইত্যাদি ক্ষেত্রে মানুষ তার কাঙ্খিত লক্ষ্যের শীর্ষে আরোহন করবে। অপরদিকে জুলুম-অত্যাচার ,দারিদ্র ইত্যাদি মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ দ্বারা পৃথিবীর বুক থেকে বিদায় গ্রহণ করবে। বর্তমানে আমরা কিছু মুসলমান নামধারী মানুষের মাঝে যে লজ্জাকর পরিস্থিতি লক্ষ্য করছি তার কারণ হলো ,প্রথম থেকেই তাদের আচার ব্যবহার প্রকৃতার্থে ইসলামী বিধান মোতাবেক ছিল না। আর এ অবস্থা চলতে চলতে পরিস্থিতি খারাপ থেকে আরও খারাপ হয়ে আজকের পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। মুসলমানদের লজ্জাকর পশ্চাৎপদতার কারণ ইসলামকে গ্রহণ করা নয়। বরং এর কারণ হলো ইসলামের শিক্ষাকে অমান্য করা ,ইসলামী নিয়ম-নীতিকে অগ্রাহ্য করা ,তাদের শাসকবর্গ কর্তৃক অন্যায় এবং শত্রুতাকে দরিদ্র ও সাধারণ জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া ইত্যাদি। আর এগুলোর কারণে তাদের উন্নতি ও অগ্রগতিকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। তাদেরকে করেছে দুর্বল ,তাদের মনুষ্যত্বকে করেছে ধ্বংস। পরিশেষে তারা পতিত হয়েছে দুঃখ দূর্দশায়। আল্লাহ তাদেরকে তাদের পাপ দ্বারা ধ্বংস করে দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনের ভাষায়-

এটা এ কারণে যে ,আল্লাহ কোন জাতির উপর তার কর্তৃক বর্ষিত নেয়ামত পরিবর্তন করেন না ,যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা নিজেদের মধ্যে যা কিছু আছে তার পরিবর্তন করে। (সুরা আনফাল -53)

আর আল্লাহর সৃষ্টির জন্য এটাই তার বিধান। কোরআন আরও বলে-

অন্যায়কারীরা কখনোই সফল হবে না। (সুরা ইউনুস -17)

অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে-

নিশ্চয়ই তোমার প্রভু কোন জাতিকে তাদের অন্যায়ের জন্য ধ্বংস করেন না যারা নিজেদেরকে সংশোধন করার চেষ্টা করে। (সূরা হুদ - 117)

পুনরায় বর্ণিত হয়েছে-

আর এরকমই হলো শহরের জালিম নাগরিকদের জন্য তোমার প্রভুর শাস্তি। তোমার প্রভুর শাস্তি সত্যিই কঠোর। (সূরা হুদ - 102)

আমরা এমন এক দ্বীন থেকে কি করে আশা করতে পারি যে ,ধ্বংসের অতলে তলিয়ে যাওয়া তার অনুসারীদেরকে রক্ষা করবে যেখানে এর শিক্ষা শুধুমাত্র কাগজে কলমে শোভা পাচ্ছে এবং বিন্দুমাত্র এর শিক্ষার অনুশীলন নেই ?

ইসলামের ভিত্তিমূল হলো- বিশ্বাস ,সততা ,সত্যবাদিতা ,শিষ্টতা ,শালীনতা ও ত্যাগ। একজন মুসলমান তার ভাইয়ের জন্য তা-ই আশা করে যা সে নিজের জন্য করে। কিন্ত মুসলমানরা সুদীর্ঘ কাল পূর্বেই এগুলোকে পশ্চাতে ফেলে এসেছে।

সময় যতই গড়িয়ে যাচ্ছে ততই তারা বিভক্ত হয়ে পড়েছে বিভিন্ন দল ও উপদলে। পার্থিব বিষয় আশয়ের জন্য করছে তারা প্রতিযোগিতা। অনর্থক কোন বিষয়বস্তুর জন্য আপন খেয়ালে পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণ করছে কিংবা কাফের বলে আখ্যায়িত করছে। তারা ভুলে যাচ্ছে ইসলামকে এবং তাদের নিজেদের ও সমাজের কল্যাণকে। যে বিষয়গুলোর উপর তারা পারস্পরিক সংঘর্ষে লিপ্ত হয় সেগুলোর উদাহরণ হলো নিম্নরূপ- কোরআন কি সৃষ্টি না সৃষ্টি নয় ;বেহেশত ও দোযখ কি তৈরী করা হয়েছে না ভবিষ্যতে হবে ইত্যাদি। আর এগুলোর উপর ভিত্তি করেই তারা পরস্পরকে কাফের বলছে।

তাদের এ মতবিরোধের ধরন দেখে অনুধাবন করা যায় যে তারা প্রকৃত প্রদর্শিত পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে এবং ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। কালের প্রবাহে তাদের এ বিচ্যুতি উত্তর উত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। অজ্ঞতা ও বিপথগামিতা তাদেরকে ঘিরে ফেলেছে। কিন্তু তারা অকার্যকর তুচ্ছ কুসংস্কার ও কল্পিত বিষয়বস্তু নিয়ে বসে আছে। পারস্পরিক সংঘাত ,সংঘর্ষ ও আত্মম্ভরিতা তাদেরকে দিন দিন হতাশার অতল গহীনে নিমজ্জিত করছে। অপরদিকে ইসলামের চিরশত্রু পাশ্চাত্য উত্তর উত্তর শক্তিশালী হচ্ছে এবং মুসলমানরা যখন ঘুমে ,অর্ধঘুমে তখন তারা ইসলামী দেশগুলোকে নিজেদের উপনিবেশ বানিয়ে চলেছে। এ দূর্ভাগ্যের শেষ কোথায় তা একমাত্র মহান আল্লাহই জানেন।

নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ ঐ শহরের অধিবাসদেরকে তাদের পাপের জন্য ধ্বংস করেন না যারা নিজেদেরকে সংশোধন করে। (সুরা হুদ- 117)

আজ অথবা কাল যেদিনই হোক না কেন সুখ সমৃদ্ধির জন্য মুসলমাদেরকে তাদের নিজেদের কর্মকান্ডের পর্যালোচনা করতেই হবে এবং তা ব্যতীত কোন গত্যন্তর নেই। তাদেরকে এবং তাদের বংশধরদেরকে সঠিক ইসলামের শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে ও পরিশুদ্ধ করতে হবে এবং এভাবে হিংসা-বিদ্বেষ দূর করতে হবে। আর এ রূপেই তারা নিজেদেরকে এ ভয়ংকর দুঃখ দুর্দশা থেকে পবিত্রাণ করাতে পারবে। আর এরকমটি করলে ন্যায়-নীতিতে বিশ্ব সেরূপ পরিপূর্ণ হতে বাধ্য যেরূপ অন্যায় ও অত্যাচারে পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। মহান আল্লাহ ও তার রাসুলের (সা.) প্রতিশ্রুতি এমনটিই। কারণ এ দ্বীনই (ইসলাম) হলো সর্বশেষ ধর্ম যার অনুসরণ ব্যতীত পৃথিবীতে কল্যাণ ও শান্তি ফিরে আসবে না। এটা সত্য যে ,ইসলামকে কুসংস্কার ,বিকৃতি ও পথভ্রষ্টতা থেকে রক্ষা করার জন্য একজন ইমামের আবশ্যকতা রয়েছে। তিনি মানবতাকে রক্ষা করবেন এবং তাদেরকে পূর্ণ কলুষতা ,অব্যাহত অন্যায় অত্যাচার যা মানুষের আত্মা ও চারিত্রিক মূল্যবোধের জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত তা থেকে রক্ষা করবেন। মহান আল্লাহ সে ইমামের আবির্ভাব ত্বরান্বিত ও সহজ করুন।

20। ইসলামের মহানবী (সা.) সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :

আমরা বিশ্বাস করি যে ,ইসলামের বাণী বাহক হলেন মোহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ (সা.) যিনি সর্বশেষ নবী ,প্রেরিত পুরুষদের সর্দার এবং নিঃশর্তভাবে তাদের শ্রেষ্টতম। তেমনি তিনি সকল মানুষের শীর্ষে। তার (সা.) শ্রেষ্টত্বের সাথে কাউকে তুলনা করা যায় না। বদান্যতার দিক থেকে কেউ তাকে ছুতে পারে না। বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে কেউই তার নিকটবর্তী নয়। সৃষ্টিকুলে তার সমকক্ষ কেউ নেই। তিনিই হলেন সৃষ্টির সেরা। সৃষ্টির শুরু থেকে কিয়ামত পর্যন্ত কেউই তার সমকক্ষ নয়।

21। পবিত্র কোরআন সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :

আমরা বিশ্বাস করি যে ,পবিত্র কোরআন হলো আল্লাহর বানী যা তিনি মহানবী হযরত মোহাম্মদের (সা.) উপর নাযিল করেছেন। এতে সবকিছু বর্ণিত হয়েছে। এটি হলো একটি চিরন্তন মোজেযা। মানুষের পক্ষে এরূপ সাহিত্যমান ও বাগ্মীতাসম্পন্ন কিছু রচনা করা অসম্ভব । এতে রয়েছে উচ্চতর জ্ঞান ও সত্য। কখনোই এতে পরিবর্তন ,পরিবর্ধন ও বিকৃতি সাধিত হবে না। আমরা বিশ্বাস করি যে ,যে কোরআন এখন আমাদের নিকট আছে এবং যা আমরা এখন পাঠ করি তা সেই কোরআন যা মহানবীর (সা.) উপর নাযিল হয়েছিল। যদি কেউ এর ব্যতিক্রম দাবী করে তবে সে হয় দুষ্ট প্রকৃতির লোক অথবা কুচক্রী কিংবা পথভ্রষ্ট। আর এ ধরনের লোকেরা হেদায়াতপ্রাপ্ত নয়। মহান আল্লাহ বলেন-

অগ্র ও পশ্চাৎ (কোন দিক থেকেই) মিথ্যা এতে প্রবেশ করতে পারবে না। (সুরা হামীম সেজদাহ -42)

কোরআনের অলৌকিকত্বের (মোজেযা) স্বপক্ষে একটি উল্লেখযোগ্য প্রমাণ হলো এই যে ,সময় যতই গড়িয়ে যাচ্ছে ,বিজ্ঞান ও কলা ততই অগ্রসরমান হচ্ছে ,তথাপি কোরআন সমুন্নত চিন্তা-চেতনায় চির ভাস্বর ও মধুময়। এমন কোন বৈজ্ঞানিক মতবাদ এতে নেই যা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। সুনিশ্চিত দার্শনিক কোন সত্যের সাথেই কোরআন সাংঘর্ষিক নয়। অপরদিকে অনেক সনামধন্য বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক রয়েছেন যারা চিন্তা ও জ্ঞানের দিক থেকে চরম উৎকর্ষে পৌঁছেছেন অথচ তাদের গ্রন্থেও অন্ততঃপক্ষে কিঞ্চিত স্ববিরোধিতা কিংবা ন্যূনতম ভুল হলেও পাওয়া যায়। অধিকন্তু বৈজ্ঞানিক গবেষণার অগ্রগতি ও আধুনিক তথ্যের ফলে এমনকি সক্রেটিস ,প্লেটো এবং এ্যারিষ্টটলের মত প্রখ্যাত গ্রীক দার্শনিকদের যাদেরকে পরবর্তীরা বিজ্ঞানের জনক ও শিক্ষক হিসেবে স্বীকার করেছেন তাদের গ্রন্থেও কিছু ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

আমরা আরও বিশ্বাস করি যে ,কথায় ও কাজে কোরআনের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করতে হবে। সুতরাং কোরআনের কোন শব্দকে কিংবা শব্দাংশকে (অক্ষরকে) অপবিত্র করা অবৈধ। অনুরূপ অবৈধ হলো অপবিত্র অবস্থায় এর কোন শব্দ বা অক্ষর স্পর্শ করা। পবিত্র কোরআনের ভাষায়-

পবিত্রতা ব্যতীত কেউই একে স্পর্শ করতে পারে না। (সুরা ওয়াকিয়া - 79)

আর এ আদেশ বড় ধরনের অপবিত্রতা যেমন- জানাবাত ,হায়েজ ,নেফাস ইত্যাদির ক্ষেত্রেও যেমন প্রযোজ্য তেমনি ছোট ধরনের অপবিত্রতা যেমন- ঘুম ইত্যাদির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এসবের জন্য ফিকাহ শাস্ত্রে বর্ণিত ব্যাখ্যা মোতাবেক গোসল বা অজু করলে কোরআন স্পর্শ করা বৈধ হবে।

অনুরূপভাবে কোরআনকে অগ্নিদগ্ধ করা বৈধ নয়। সেরূপ বৈধ নয় অপমান করা তা যে কোন ভাবেই হোক না কেন। অর্থাৎ সাধারনের মধ্যে যেটা অপমান বলে পরিগনিত হয় তা করা যাবে না। যেমন- নিক্ষেপ করা ,অপরিস্কার করা ,পা দিয়ে ঠেলে দেয়া কিংবা অসম্মান জনক জায়গায় রাখা। যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে উপরোল্লিখিত যে কোন একটি কাজ অথবা এ ধরনের কোন কাজ করে তবে সে ইসলাম ও এর পবিত্রতাকে অস্বীকারকারীদের মধ্যে পরিগণিত হবে। সে দ্বীনে অবিশ্বাসী। প্রকারান্তরে সে বিশ্বাধিপতি আল্লাহকে অস্বীকার করেছে।


8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38