রাসূলুল্লাহর (সা.) আহলে বাইত ও বিবিগণ

রাসূলুল্লাহর (সা.) আহলে বাইত  ও  বিবিগণ 0%

রাসূলুল্লাহর (সা.) আহলে বাইত  ও  বিবিগণ লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ইতিহাস

রাসূলুল্লাহর (সা.) আহলে বাইত  ও  বিবিগণ

লেখক: নূর হোসেন মজিদী
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 12737
ডাউনলোড: 2713

পাঠকের মতামত:

বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 22 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 12737 / ডাউনলোড: 2713
সাইজ সাইজ সাইজ
রাসূলুল্লাহর (সা.) আহলে বাইত  ও  বিবিগণ

রাসূলুল্লাহর (সা.) আহলে বাইত ও বিবিগণ

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

সতর্কতার নীতি যা দাবী করে

কেউ যদি মনে করে যে ,হযরত আলী (আ.) কে হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর অব্যবহিত পরবর্তী নেতৃত্বের জন্য মনোনীত করার বিষয়টি আল্লাহ্ তা ‘ আলার পক্ষ থেকে ছিলো না ,বরং রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তা নিজের পক্ষ থেকে করেছিলেন তাহলেও তা মেনে নেয়া উম্মাহর জন্য অপরিহার্য ছিলো । কারণ ,সে ক্ষেত্রে নবী যে তাঁর অনুসারীদের ওপর তাঁদের নিজেদের চেয়েও অধিকতর অধিকার রাখেন (সূরা আল্-আহযাব্ : 6) সে কারণে তাঁর সিদ্ধান্তের কাছে আত্মসমর্পণ করা অপরিহার্য ছিলো । কারণ ,তিনি ( ভাত খাবেন ,নাকি রুটি খাবেন ’ -এ জাতীয় নেহায়েতই পার্থিব মোবাহ্ বিষয়াদি ব্যতীত) স্বীয় দায়িত্ব পালনের সাথে সম্পৃক্ত যে কোনো বিষয়ে আল্লাহ্ তা ‘ আলার প্রত্যক্ষ ওয়াহী ( وحی متلو ) বা পরোক্ষ ওয়াহী ( وحی غیر متلو )-এর ভিত্তিতে ছাড়া কখনো কিছু বলতেন না বা করতেন না । আর বলা বাহুল্য যে ,নেতা বা উত্তরাধিকারী মনোনয়ন একটি অত্যন্ত গুরুত্ববহ দায়িত্বপূর্ণ কাজ । আল্লাহ্ তা আলা এরশাদ করেন :

) وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى عَلَّمَهُ شَدِيدُ الْقُوَى (

তিনি ( রাসূল ) স্বীয় প্রবৃত্তি থেকে কোনো কথা বলেন না ;তা ( তিনি যা বলেন ) তো ওয়াহী ছাড়া আর কিছু নয় - যা তাঁকে পরম শক্তিধর শিক্ষা দান করেন । ” (সূরা আন্ - নাজম : 3 - 5 )

এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা ‘ আলা মু ’ মিনদেরকে আরো নির্দেশ দিয়েছেন :

) آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا (

আর রাসূল তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তা গ্রহণ করো এবং তিনি যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকো । ” ( সূরা আল - হাশর : 7 )

আর , খোদা না করুন , কেউ যদি মনে করে যে , হযরত রাসূলে আকরাম ( সা .) আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারণ ছাড়াই , বা ( এরূপ নির্ধারণ না থাকার ক্ষেত্রে ) সর্বোচ্চ যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও , কেবল স্বীয় জামাতা হওয়ার কারণেই হযরত আলী ( আ .) কে উম্মাহর জন্য পরবর্তী নেতা ও শাসক মনোনীত করে গেছেন তাহলে রিসালাত সম্পর্কে এরূপ ভ্রান্ত আক্বীদাহ্ পোষণের কারণে তার ঈমানই বিনষ্ট হয়ে যেতে বাধ্য । কারণ , পক্ষপাতিত্ব অত্যন্ত খারাপ ধরনের একটি বৈশিষ্ট্য হযরত রাসূলে আকরাম ( সা .) সহ সকল নবী - রাসূল ( আ .) ই যা থেকে পুরোপুরি মুক্ত ছিলেন ।

অন্যদিকে কারো কাছে যদি ইখ্লাছ্ব সত্ত্বেও এরূপ মনে হয় যে , হযরত রাসূলে আকরাম ( সা .) গ্বাদীরে খুমের ভাষণে হযরত আলী ( আ .) কে যে উম্মাহর জন্য مولی বলে ঘোষণা করেছেন তাতে তিনি এ শব্দ দ্বারা বন্ধু বুঝাতে চেয়েছেন , সে ক্ষেত্রেও যেহেতু এ শব্দের অন্যতম অর্থ শাসক এবং স্বয়ং হযরত আলী ( আ .) সহ কতক ছ্বাহাবী এ থেকে এই শেষোক্ত অর্থই গ্রহণ করেছিলেন এবং এর ভিত্তিতে খেলাফতকে তাঁর হক বলে গণ্য করতেন সেহেতু ইসলামের সকল মাযহাব ও ফির্কাহর কাছে গৃহীত সতর্কতার নীতি র দাবী অনুযায়ী তাঁকেই খেলাফত প্রদান করা কর্তব্য ছিলো । কারণ , যেহেতু , তাঁদের কাছে এ ব্যাপারে কোনো অকাট্য দলীল ছিলো না যে , হযরত রাসূলে আকরাম ( সা .) এর দ্বারা বন্ধু বুঝিয়েছেন সেহেতু এতে বন্ধু বুঝানো হলেও হযরত আলী ( আ .) কে খলীফাহ্ করা হলে কোনো সমস্যা ছিলো না , কিন্তু রাসূলুল্লাহ্ ( সা .) যদি এর দ্বারা শাসক বুঝিয়ে থাকেন সে ক্ষেত্রে তাঁকে শাসকের দায়িত্ব প্রদান না করায় রাসূলুল্লাহ্ ( সা .)- এর সিদ্ধান্ত কার্যকর করা থেকে বিরত থাকা হয়েছে এবং এর মাধ্যমে আল্লাহ্ তা আলার সুস্পষ্ট নির্দেশ অমান্য করা হয়েছে ।

এছাড়া আহলে বাইতের পাপমুক্ততার অকাট্যতার কারণে বিচারবুদ্ধির অকাট্য রায় অনুযায়ী ইসলামের পরবর্তী নেতৃত্ব - কর্তৃত্বও আহলে বাইতের ধারাবাহিকতায় থাকা অপরিহার্য ছিলো । এমনকি নেতৃত্ব - কর্তৃত্ব তাঁদেরকে অর্পণের বিষয়টি কারো কাছে যদি ফরয বলে পরিগণিত না - ও হয়ে থাকে সে ক্ষেত্রেও সতর্কতার নীতির দাবী অনুযায়ী তা তাঁদেরকে অর্পণের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার প্রদান করা জরূরী ছিলো ।

ইতিপূর্বে আমরা ইসলামের চারটি অকাট্য দ্বীনী জ্ঞানসূত্রের কথা উল্লেখ করেছি এবং খবরে ওয়াহেদ্ হাদীছ সমূহ গ্রহণকে এ চার জ্ঞানসূত্রের সাথে সাংঘর্ষিক না হওয়ার শর্তসাপেক্ষ বলে উল্লেখ করেছি । এর মানে হচ্ছে , খবরে ওয়াহেদ হাদীছ চোখ বুঁজে গ্রহণ করা যাবে না , তেমনি তা চোখ বুঁজে বর্জন করাও যাবে না ; কেবল চারটি অকাট্য সূত্রের কোনোটির সাথে সাংঘর্ষিক হলেই তা বর্জন করা যাবে ।

আমরা যেমন দেখেছি আহলে বাইতের ( চার ব্যক্তিত্বের ) পবিত্রতা ও পাপমুক্ততা এবং নেতৃত্ব - কর্তৃত্বের অধিকার - অন্ততঃ অগ্রাধিকার - কোরআন মজীদ , মুতাওয়াতির হাদীছ ও ( সতর্কতার নীতি সহ ) আক্বলের অকাট্য রায়ের দ্বারা প্রমাণিত । অনুরূপভাবে যেহেতু হযরত আলী ( আ .)- এর মাওলা হবার বিষয়টিও মুতাওয়াতির সূত্রে প্রমাণিত এবং প্রাপ্ত আক্বলী ( বিচারবুদ্ধিজাত ) ও নাক্বলী ( বর্ণিত ) সকল নিদর্শন থেকে এখানে এ পরিভাষাটির নেতৃত্ব ও শাসনকর্তৃত্ব তাৎপর্য প্রমাণিত হয় , সেহেতু অন্ততঃ সতর্কতার নীতির দাবী অনুযায়ী এ তাৎপর্যের ভিত্তিতে আমল করা অপরিহার্য ছিলো ।

এর সাথে যোগ করতে হয় যে , আরো বিভিন্ন হাদীছে , বিশেষ করে আহলে সুন্নাতের ধারাবাহিকতার অনেক হাদীছে হযরত রাসূলে আকরাম ( সা .)- এর ওফাতের পরে হযরত আলী ( আ .) , হযরত ইমাম হাসান ( আ .) ও হযরত ইমাম হোসেন ( আ .) এবং হযরত ইমাম হোসেন ( আ .)- এর অধস্তন পুরুষ নয়জন পবিত্র ব্যক্তিত্বের নামোল্লেখ সহ পর্যায়ক্রমিক ইমামতের কথা বর্ণিত হয়েছে ।

অনেক হাদীছ বিশেষজ্ঞের মতে এ সব হাদীছের মূল বক্তব্য মুতাওয়াতির পর্যায়ের । অবশ্য এর তাওয়াতুরের বিষয়টি গ্বাদীরে খুমে হযরত রাসূলে আকরাম ( সা .) কর্তৃক হযরত আলী ( আ .) কে উম্মাহর জন্য মাওলা ঘোষণার তাওয়াতুরের ন্যায় সর্বোচ্চ পর্যায়ের নয় । এমতাবস্থায় অপর এগারো জন ব্যক্তিত্বের ইমামত সংক্রান্ত হাদীছ মুতাওয়াতির কিনা এ ব্যাপারে কারো পক্ষ থেকে প্রশ্ন তোলার অবকাশের কথা মাথায় রেখে এ সব হাদীছকে যুক্তির খাতিরে খবরে ওয়াহেদ্ বলে গণ্য করলেও একই বিষয়বস্তুতে এর সাথে সাংঘর্ষিক অনুরূপ পর্যায়ের হাদীছ না থাকায় এর ভিত্তিতে আমল করা অপরিহার্য । অর্থাৎ যেহেতু হযরত রাসূলে আকরাম ( সা .) থেকে অন্য কোনো লোকদের সম্পর্কে তাঁর পরে পর্যায়ক্রমিক ইমামতের কথা বর্ণিত হয় নি সেহেতু সতর্কতার নীতি অনুযায়ী তাঁদের ইমামতের বিষয়টি মেনে নেয়া অপরিহার্য ।

আহলে সুন্নাতের ধারাবাহিকতার শীর্ষস্থানীয় অনেক দ্বীনী ব্যক্তিত্বই আহলে বাইতের ধারাবাহিকতার উক্ত বারো জন পবিত্র ব্যক্তিত্বের ইমামতকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে না নিলেও তাঁদের অনেকের উক্তি ও আচরণে আমরা দেখতে পাই যে , তাঁরা উক্ত ব্যক্তিত্ববর্গকে উম্মাহর মধ্যে বিশিষ্ট দ্বীনী মর্যাদার অধিকারী বলে গণ্য করতেন । তাঁরা কখনোই উক্ত বারো জন ব্যক্তিত্বের সমালোচনা করতেন না এবং তাঁদের নিষ্পাপত্ব ( عصمة ) কে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার না করলেও কখনোই বলেন নি যে , তাঁরা মা ছুম ছিলেন না বা আর দশজন দ্বীনী বুযুর্গ ব্যক্তিত্বের অনুরূপ ছিলেন । এর ফলে সামগ্রিকভাবে আহলে সুন্নাতের অনুসারীদের কাছে তাঁরা অনুরূপ মর্যাদা লাভ করেছেন ।

বিশেষ করে আমরা হযরত ইমাম আবু হানীফাহ্ (রহ্ঃ) কে - যার নামে পরবর্তীকালে হানাফী মাযহাব্ তৈরী ও প্রবর্তন করা হয় - আহলে বাইতের ধারাবাহিকতার ষষ্ঠ ইমাম হযরত জাফর সাদেক (আ.)-এর নিকট দ্বীনী শিক্ষা গ্রহণ করতে ও তাঁর ভূয়সীপ্রশংসা করতে দেখি । হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.) সম্পর্কে হযরত ইমাম আবু হানীফাহর একটি উক্তি খুবই বিখ্যাত ,তা হচ্ছে ,তিনি বলেন : আমি জাফর ইবনে মুহাম্মাদের চেয়ে বড় কোনো আলেমের সাক্ষাৎ পাই নি । ” এছাড়াও তিনি যে ইমাম সাদেক (আ.)- এর কাছে দুই বছর দ্বীনী ইলম শিক্ষা করেন সে সম্পর্কে তিনি বলেন : ঐ দুই বছর না হলে নু মান 9 ধ্বংস হয়ে যেতো । এছাড়া হযরত ইমাম মালেকও ইমাম সাদেক (আ.)-এর কাছে দ্বীনী ইলম শিক্ষা করেন এবং তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেন ।

ইমাম আবু হানীফাহ্ ও ইমাম মালেক যে আহলে বাইত-কে কোন্ দৃষ্টিতে দেখতেন তা তাঁদের আরো কোনো কোনো আচরণ থেকে প্রকাশ পায় । তা হচ্ছে ,এমনকি আহলে বাইতের ধারাবাহিকতার যে সব বুযুর্গ ব্যক্তিত্বের জন্য উক্ত বারো জন ব্যক্তিত্বের ন্যায় আল্লাহ্ তা ‘ আলার পক্ষ থেকে মনোনীত ইমাম হওয়া সংক্রান্ত হাদীছের বর্ণনা বিদ্যমান নেই কেবল আহলে বাইতের ধারাবাহিকতার অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে তাঁরা অন্যদের তুলনায় তাঁদেরকে বিশেষ মর্যাদা প্রদান করতেন ।

উদাহরণস্বরূপ ,উমাইয়াহ্ শাসনামলের শেষ দিকে হযরত ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর পুত্র ও হযরত ইমাম বাক্বের (আ.)-এর ভ্রাতা হযরত ইমাম যায়দ (রহ্ঃ) স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করলে হযরত ইমাম আবু হানীফাহ্ তাঁকে সত্যিকারের ইমাম ’ (ইমামে হাক্ব) বলে ঘোষণা করেন এবং এ জিহাদে অংশগ্রহণের জন্যে লোকদেরকে উৎসাহিত করেন । এছাড়া তিনি এ জিহাদে হযরত ইমাম যায়দকে দশ হাজার দেরহাম আর্থিক সাহায্য দেন এবং বলেন যে ,তাঁর নিকট লোকদের বহু আমানত না থাকলে তিনি এ জিহাদে সশরীরে অংশগ্রহণ করতেন । এছাড়া পরবর্তীকালে হযরত ইমাম হাসান (আ.)-এর বংশধর হযরত ইমাম মুহাম্মাদ নাফ্সে যাকীয়্যাহ্ (রহ্ঃ) ও হযরত ইমাম ইব্রাহীম্ (রহ্ঃ) - দুই ভাই - আব্বাসী স্বৈরশাসক মানছুরের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করলে হযরত ইমাম আবু হানীফাহ্ এ জিহাদের পক্ষে ফত্ওয়া দেন ও এতে অংশগ্রহণের জন্যে লোকদেরকে উৎসাহিত করেন । বিশেষ করে মানছুরের একজন সেনাপতি পর্যন্ত হযরত ইমাম আবু হানীফাহর নির্দেশে উক্ত ভ্রাতৃদ্বয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে অস্বীকৃতি জানান ।

অনুরূপভাবে হযরত ইমাম মালেকও আব্বাসী স্বৈরশাসক মানছুরের বিরুদ্ধে হযরত ইমাম মুহাম্মাদ নাফ্সে যাকীয়্যাহ্ ঘোষিত জিহাদকে সমর্থন করে ফত্ওয়া দেন । শুধু তা-ই নয় ,স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এ জিহাদের যথার্থতা জানা সত্ত্বেও মানছুরের অনুকূলে ইতিপূর্বে কৃত বাই ‘ আত্ ভঙ্গ করা জায়েয হবে কিনা এ ব্যাপারে অনেকের মনে সংশয় দেখা দিলে তাঁরা যখন হযরত ইমাম মালেকের মত জানতে চান তখন তিনি ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত ফয়ছ্বালার দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন : যাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাধ্য করা হয়েছে তার জন্যে অঙ্গীকার নেই । ” অর্থাৎ বলপ্রয়োগ বা চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে যে বাই ‘ আত্ আদায় করা হয়েছে অথবা ভয়ের কারণে লোকেরা যে বাই ‘ আত করেছে তা আদৌ বাই ‘ আত নয় ,অতএব ,তা রক্ষা করা অপরিহার্য নয় এবং তা ভঙ্গ করলে গুনাহ্ হবে না । তাঁর এ ফত্ওয়ার ভিত্তিতে বহু লোক মানছুরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ইমাম নাফ্সে যাকীয়্যাহ্ (রহ্ঃ)-এর সাথে জিহাদে যোগদান করেন । এ ফত্ওয়া দেয়ার কারণে ইমাম মালেককে গ্রেফতার করা হয় এবং তাঁর শরীর থেকে পোশাক খুলে নিয়ে তাঁকে চাবূক মারা হয় । এর ফলে কাঁধ থেকে তাঁর হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় । [অবশ্য পরে তিনি (হয়তোবা জীবন বাঁচানোর লক্ষ্যে) মানছুরের সাথে আপোস করেন ও তার সাথে সহযোগিতা করেন । ]

এ থেকে সুস্পষ্ট যে ,হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.) ক্ষমতাসীন স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে জিহাদের ঘোষণা দিলে ও হুকুমতের ওপর স্বীয় দাবী উপস্থাপন করলে হযরত ইমাম আবু হানীফাহ্ ও হযরতে ইমাম মালেক একইভাবে তা সমর্থন করতেন ,যদিও হযরত ইমাম হোসেন (আ.)-এর পরবর্তী আহলে বাইতের ইমামগণ হুকুমতের ওপর স্বীয় অধিকারের প্রবক্তা হওয়া সত্ত্বেও স্বীয় বাছ্বীরাত্ (বিচক্ষণতা) দ্বারা পর্যালোচনা করে নিজ নিজ সমকালীন পরিস্থিতিকে বিপ্লবের পতাকা উত্তোলনের জন্য উপযোগী মনে করেন নি এবং সশস্ত্র যুদ্ধকে তখনকার পরিবেশে ইসলামের স্বার্থের জন্য সহায়ক গণ্য করেন নি বলে জিহাদ ঘোষণা করেন নি ।

হযরত ইমাম শাফে ‘ ঈ ও হযরত ইমাম আহমাদ ইব্নে হাম্বালও আহলে বাইতকে ভালোবাসতেন এবং তাঁদের সাথে যোগাযোগ ও সুসম্পর্ক রাখতেন । আর এ জন্য তাঁদের উভয়কেই আহলে বাইতের প্রতি শত্রুতা ও বিদ্বেষ পোষণকারীদের পক্ষ থেকে সৃষ্ট বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় । আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা পোষণের কারণে ইমাম শাফে ‘ ঈকে রাফেযী ” ( শিয়া ’ বুঝাতে গালি) বলে অভিহিত করা হয় এবং ইমাম আহমাদ ইব্নে হাম্বালের গৃহে তল্লাশী চালানো হয় ।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে ,হযরত ইমাম আবু হানীফাহ্ সহ আহলে সুন্নাতের চার ইমাম ও শীর্ষস্থানীয় দ্বীনী মনীষীগণের অনেকেই আহলে বাইত (আ.) সম্পর্কে ,বিশেষ করে আহলে বাইতের ইমামগণ সম্পর্কে স্বীয় কথা ও কাজে যে সম্মান ,সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধার পরিচয় দিয়েছেন তা কী প্রমাণ করে ?তাঁরা কি সংশ্লিষ্ট হাদীছগুলোর ভিত্তিতে তাঁদেরকে আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত ইমাম ’ বলে গণ্য করতেন ,কিন্তু সমকালীন পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে তা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা না করাকেই নিজেদের জন্য কল্যাণকর বিবেচনা করেছিলেন ?নাকি এ ব্যাপারে অকাট্য আক্বীদায় উপনীত হতে না পারলেও এমনটি হবার সম্ভাবনায় সতর্কতার নীতি ’ অনুযায়ী তাঁদের প্রতি সম্মান ,সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধার পরিচয় দিয়েছিলেন ?

এ প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বিশেষভাবে মনে রাখা প্রয়োজন ।

প্রথমতঃ বিশেষ করে হযরত ইমাম আবু হানীফাহ্ সহ আহলে সুন্নাতের ইমামগণ ফিক্বহী বিষয়াদিতে স্বীয় মতামত ব্যক্ত করলেও বর্তমানে মাযহাব্ বলতে যা বুঝায় সেভাবে তাঁরা নিজেরা কোনো মাযহাবের প্রচলন করে যান নি । বরং পরবর্তীকালে তাঁদের নামে মাযহাবের প্রচলন করা হয়েছে এবং এর ভিত্তিতে মুসলমানদের বিভক্ত করা হয়েছে ।

দ্বিতীয়তঃ উক্ত ইমামগণ তাঁদের সমসাময়িক রাজতান্ত্রিক স্বৈরাচারী সরকারগুলোর বিরোধী ছিলেন এবং তাদের সাথে সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানানোর ও আহলে বাইতের সাথে সম্পর্কের কারণে তাঁদের কাউকে কাউকে নির্যাতনের শিকার হতে হয় 10 এবং এ কারণে তাঁদের কেউ কেউ ,তাঁদের বিবেচনায় ,ইসলামের বৃহত্তর স্বার্থে ,সরকারের সাথে বাহ্যতঃ সমঝোতার নীতি অনুসরণ করেন । কিন্তু তাঁদের পরবর্তীকালে তাঁদের শিষ্য - শাগরিদগণ তাঁদের নামে বিভিন্ন মাযহাবের প্রচলন করে স্বৈরাচারী সরকারগুলোর সাথে সার্বিক সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করেন । এর ফলে ,আহলে বাইতের ইমামগণের সাথে ক্ষমতাসীনদের দুশমনীর প্রেক্ষাপটে দলীয় অনুভূতি ও শিয়া - সুন্নী পার্থক্য ক ্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে ।

তৃতীয়তঃ বহুলাংশে সরকারের সাথে সুন্নী মায্হাব্গুলোর ইমাম - পরবর্তী নেতৃবৃন্দের সর্বাত্মক সহযোগিতার প্রভাবেই পরবর্তীকালে ফিক্ব্হী ক্ষেত্রে আহলে বাইতের সাথে এ সব মায্হাবের পার্থক্য ব্যাপকতর হয়ে ওঠে । 11

চতুর্থতঃ একান্তই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আহলে বাইতের ইমামগণের অনুসারীদেরকে সুন্নাতে রাসূল ( সা .)- এর অনুসারী নয় বলে জনমনে ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টির রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আহলে সুন্নাত্ ওয়াল্ জামা আত্ নাম তৈরী করে সে নামে চার মায্হাবকে অভিহিত করা হয় ।

পঞ্চমতঃ ছ্বিহাহ্ সিত্তাহ্ 12 নামে পরিচিত হাদীছ - গ্রন্থ সমূহ সহ আহলে সুন্নাতের অন্যান্য হাদীছ - গ্রন্থ হযরত ইমাম আবু হানীফাহ্ ও হযরত ইমাম মালেকের শতাব্দীকাল পরে বা তারও বেশী পরে সংকলিত হলেও সেগুলোকে গ্রহণ করার ফলে শিয়া - সুন্নী ব্যবধান আরো বেশী ব্যাপকতা লাভ করে । বিশেষ করে হযরত ইমাম আবু হানীফাহ্ যেখানে ফিক্বহী ব্যাপারে খবরে ওয়াহেদ্ হাদীছকে নির্ভরযোগ্য বলে গণ্য করতেন না 13 ,সেখানে পরবর্তীকালে খবরে ওয়াহেদ্ হাদীছ ব্যাপকভাবে গ্রহণের ফলে বিশেষ করে হানাফী মাযহাবের চেহারা অনেক বেশী পরিবতিরত হয়ে যায় এবং বিভিন্ন মাযহাবের মধ্যে পার্থক্য তীব্রতর হয়ে ওঠে । 14