ইতিহাসের পৃষ্ঠা ওল্টানো কেন
অনেককেই ইসলামের প্রাথমিক যুগের ইতিহাসের বিরোধ
-
বিসম্বাদ সংক্রান্ত পৃষ্ঠাগুলো ওল্টানোর বিরোধিতা করতে দেখা যায়
।
তাঁদের মতে
,এর ফলে মুসলমানদের মধ্যে বিরাজমান বিভেদ
-
অনৈক্যই কেবল বৃদ্ধি পাবে এবং তা ফির্কাহ্ ও মায্হাবের উর্ধে
উঠে বৃহত্তর ইসলামী ঐক্য গড়ে তোলার বিষয়টিকে সুদূরপরাহত
করে তুলবে
।
আসলেও ইসলামের ইতিহাসের প্রাথমিক যুগের তিক্ত
বিষয়গুলোর স্মৃতিচারণ না করাই ভালো
।
প্রথমতঃ
এর সাথে যারা
জড়িত তাঁদের কেউই বেঁচে নেই এবং এখন ইতিহাসকে বদলে
দেয়া যাবে না
।
আর প্রত্যেকেই নিজ নিজ আমল সহকারে আল্লাহ্
তা
‘
আলার কাছে হাযির হবেন
।
আল্লাহ্ রাব্বুল
‘
আলামীন যেমন
এরশাদ করেছেন
:
)
تِلْكَ أُمَّةٌ قَدْ خَلَتْ لَهَا مَا كَسَبَتْ وَلَكُمْ مَا كَسَبْتُمْ وَلَا تُسْأَلُونَ عَمَّا كَانُوا يَعْمَلُون
(
“
তারা
ছিলো
একটি
জনগোষ্ঠী
যারা
অতীত
হয়ে
গিয়েছে
;
তারা
(
ভালো
)
যা
কিছু
অর্জন
করেছে
তা
তাদেরই
জন্য
এবং
তারা
(
মন্দ
)
যা
কিছু
অর্জন
করেছে
তা
তাদেরই
ওপরে
আপতিত
হবে
।
আর
তারা
যা
কিছু
করেছে
সে
জন্য
তোমরা
জিজ্ঞাসিত
হবে
না
।
”
(সূরা
আল্
-
বাক্বারাহ্
:
134
)
দ্বিতীয়তঃ
শিয়া মাযহাবের অনুসারীরা যে বারো জন বুযুর্গ ব্যক্তিকে আল্লাহ্ তা
‘
আলার পক্ষ থেকে মনোনীত ইমাম বলে
‘
আক্বীদাহ্ পোষণ করে তাঁদের মধ্য থেকে এগারো জন এ দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন এবং তাঁদের মধ্যকার দ্বাদশ ইমাম - শিয়া মাযহাবের অনুসারীরা যাকে ইমাম মাহ্দী (আ.) বলে
‘
আক্বীদাহ্ পোষণ করে
,তাদের
‘
আক্বীদাহ্ অনুযায়ীই আল্লাহ্ তা
‘
আলা তাঁকে দীর্ঘজীবী করলেও তিনি আল্লাহর ইচ্ছায়ই আত্মপরিচয় গোপন করে আছেন এবং উপযুক্ত সময়ে আত্মপ্রকাশ করবেন
।
যেহেতু শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে সকল মুসলমানই হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাব ও তাঁর দ্বারা বিশ্বব্যাপী ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার
‘
আক্বীদাহ্ পোষণ করে
,সেহেতু তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন কি করেন নি এ প্রশ্নে মতপার্থক্য থাকলেও তাঁর আত্মপ্রকাশের পর তাঁকে গ্রহণ-বর্জনের ওপরই যে কারো হেদায়াত ও গোমরাহী নির্ভর করবে
।
কিন্তু এখন যেহেতু উক্ত বারো জন বুযুর্গ ব্যক্তির কেউই আমাদের সামনে ইমামতের দাবী নিয়ে উপস্থিত নন
,এমতাবস্থায় তাঁদের ইমামত নিয়ে বিতর্ক প্রধানতঃ একটি তাত্ত্বিক বিতর্ক বৈ নয়
,যদিও শারী
‘
আতের গৌণ বিষয়াদিতে খবরে ওয়াহেদ হাদীছ ও রেওয়াইয়াত্ গ্রহণের ব্যাপারে এর ভূমিকা আছে
।
এর মানে হচ্ছে
,ইমামতের
‘
আক্বীদাহ্ পোষণ করলে যে কোনো হাদীছ ও রেওয়াইয়াতের রাভী বিচার শুরু হবে মা
‘
ছুম্ (আ.)-এর পর থেকে
।
অবশ্য এ ব্যাপারে কোনোই সন্দেহ নেই যে
,আসলেই আমাদের উচিত অতীত হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের আমলের সাথে নিজেদেরকে না জড়ানো
।
কারণ
,আমাদের বিতর্ক তাঁদের আমলের ভালো-মন্দ কোনো কিছুতেই কিছু হরাস-বৃদ্ধি ঘটাতে পারবে না
।
কিন্তু আমরা যখন নিজেদেরকে তাঁদের
‘
আমলের সাথে জড়িয়ে ফেলি তখন অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের
‘
আমলের পর্যালোচনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়
।
বিশেষ করে অনেক সময় বলা হয় যে
,অন্যান্য ছ্বাহাবায়ে কেরাম ও অতীতের মনীষীগণ ইসলাম সম্পর্কে ও কোরআন মজীদের তাৎপর্য আমাদের চেয়ে কম বুঝতেন না
।
অথচ এটা অনস্বীকার্য যে
,তাঁরা না মা
‘
ছুম্ ছিলেন
,না অকাট্যভাবে ঐশী ইলহামের অধিকারী ছিলেন
।
অতএব
,তাঁদের পক্ষে ভুল করা সম্ভব এবং পূর্বোল্লিখিত আয়াত অনুযায়ী
,তাঁরা ভুল করে থাকলে আমাদের জন্য তার অনুসরণ করা উচিত হবে না
।
এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের কথা ও কাজের বর্ণনা কতোখানি সঠিকভাবে আমাদের কাছে পৌঁছেছে তা-ও প্রশ্নের উর্ধে নয়
।
আরো বলা হয় যে
,আমরা তো কোরআন মজীদ ও ইসলাম ছ্বাহাবীদের মাধ্যমেই পেয়েছি
,সুতরাং তাঁদেরকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যাবে না
।
কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার হলো
,আমরা কোরআন ও ইসলাম তাঁদের ব্যক্তিবিশেষের কাছ থেকে পাই নি
,বরং মুতাওয়াতির সূত্রে
‘
তাঁদের সকলের কাছ থেকে
’
পেয়েছি - যার নির্ভুলতা ও গ্রহণযোগ্যতা সন্দেহাতীত
।
এর সাথে যে সব বিষয়ে তাঁদের নিজেদের মধ্যেই পারস্পরিক মতপার্থক্য ছিলো সে সব বিষয়ে ব্যক্তিগতভাবে তাঁদেরকে নির্ভুল গণ্য করা ঠিক হবে না
।
আর ইসলাম ও কোরআনকে পরবর্তী প্রজন্মসমূহের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন বলেই যে তাঁরা তা পরবর্তী প্রজন্ম সমূহের তুলনায় অধিকতর সঠিকভাবে বুঝেছিলেন এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই
।
কেননা
,হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) এরশাদ করেছেন যে
,জ্ঞানপূর্ণ কথা অনেক সময় কেউ এমন ব্যক্তির কাছে বহন করে নিয়ে যায় যে বহনকারীর তুলনায় অধিকতর সমঝদার
।
বস্তুতঃ আমরা যদি বিচারবুদ্ধির কাছে গ্রহণযোগ্য ইসলামের সর্বজনগ্রহণযোগ্য চারটি অকাট্য সূত্রের ওপর নির্ভর করে তার দাবী অনুযায়ী আমাদের জীবনে সকল ক্ষেত্রে চলার জন্য প্রয়োজনীয়
,হযরত রাসূলে কর্মনীতি ও বিধিবিধান লাভের ও তদনুযায়ী চলার চেষ্টা করতাম তাহলে উপরোল্লিখিত ঐতিহাসিক বিতর্ক এমনিতেই গুরুত্ব হারিয়ে ফেলতো
।
কিন্তু আমরা তা না করার কারণেই এ বিতর্কের উপযোগিতা থেকে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত রয়েছে
।
কারণ
,বিচারবুদ্ধি (
‘
আক্বল্)
,কোরআন মজীদ
,মুতাওয়াতির হাদীছ ও ইজমা-এ উম্মাহর মানদণ্ডে যেখানে হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর আহলে বাইতের পবিত্রতা ও পাপমুক্ততা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় এবং জ্ঞানগত যোগ্যতার সাথে পবিত্রতা ও পাপমুক্ততা যুক্ত হওয়ার কারণে কেবল তাঁদের কাছ থেকেই নির্ভুল দ্বীনী জ্ঞান লাভ করা যেতে পারে এমতাবস্থায় আমরা যদি অন্য কারো কাছ থেকে এ সব মানদণ্ডের কোনো না কোনোটির সাথে সাংঘর্ষিক কোনো ফয়ছ্বালা মেনে না চলতাম এবং তার ওপরে একগুঁয়েমি না করতাম তাহলে আজ আর ইতিহাস পর্যালোচনার প্রয়োজন হতো না
।
উদাহরণ স্বরূপ এক বৈঠকে তিন তালাক্ব সংক্রান্ত ফত্ওয়ার কথা বিবেচনা করা যেতে পারে
।
আল্লাহ্ তা
‘
আলা যেখানে ফেরতযোগ্য তালাক্ব (
طلاق رجعی
) সম্পর্কে এরশাদ করেছেন যে
,الطلاق مرتان
-তালাক্ব দুই বার (সূরা আল্-বাক্বারাহ্ : 229) অতঃপর ভালোভাবে রাখতে হবে অথবা (তৃতীয় দফা তালাক্ব দিয়ে) ভদ্রভাবে বিদায় করে দিতে হবে (সূরা আল্-বাক্বারাহ্ : 229) এমতাবস্থায় কেউ যে কোনো কথা বলেই (যেমন :
‘
তিন তালাক্ব
’
শব্দ উচ্চারণ করে বা
‘
তালাক্ব
’
শব্দটি তিন বার পুনরাবৃত্তি করে) স্ত্রীকে তালাক্ব দিক না কেন অবশ্যই তা
‘
এক বার
’
তালাক্ব হবে
,অতঃপর তাকে ফিরিয়ে না আনা পর্যন্ত তার পক্ষে ঐ স্ত্রীকে দ্বিতীয় বার তালাক্ব দেয়া সম্ভব নয়
।
কারণ
,প্রথম বার তালাক্ব দেয়ার সাথে সাথেই সে আর তার স্ত্রী থাকলো না এবং যে সব কাজের দ্বারা
‘
তালাক্ব দেয়া স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনা
’
প্রমাণিত হয় এমন কোনো কাজের মাধ্যমে তাকে ফিরিয়ে এনে স্ত্রীর মর্যাদায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার আগে তাকে
‘
দ্বিতীয় বার
’
তালাক্ব দেয়া সম্ভব নয়
।
কিন্তু এ সত্ত্বেও কেবল দ্বিতীয় খলীফাহর মতামতের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের লক্ষ্যে মুসলমানদের মধ্যকার বৃহত্তর অংশের মধ্যে এক বৈঠকে প্রদত্ত
‘
তিন তালাক্ব
’
কে ফেরত-অযোগ্য চূড়ান্ত তালাক্ব বলে গণ্য করা হচ্ছে
।
এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে এই যে
,প্রসিদ্ধ মত অনুযায়ী
,স্বয়ং হযরত ইমাম আবু হানীফাহ্ (রহ্ঃ) - যার নামে হানাফী মায্হাবের প্রচলন করা হয়েছে - যেখানে এক বৈঠকে প্রদত্ত
‘
তিন তালাক্ব
’
কে ফেরতযোগ্য
‘
এক বার
’
তালাক্ব বলে গণ্য করতেন সেখানে পরবর্তীকালে গৃহীত
‘
হানাফী মাযহাবের মত
’
হচ্ছে এই যে
,এক বৈঠকে প্রদত্ত
‘
তিন তালাক্ব
’
ফেরত-অযোগ্য চূড়ান্ত তালাক্ব বলে গণ্য হবে
।
আর এর ফলে যে কেবল আল্লাহর বিধানে মানুষের জীবনের জন্য প্রদত্ত প্রশস্ততা ও সহজতা থেকে মানুষকে বঞ্চিত করা হচ্ছে শুধু তা-ই নয়
,বরং অনেককে কঠিন ধরনের গুনাহে লিপ্ত হবার পথে ঠেলে দেয়া হচ্ছে
।
এখানে মাত্র একটি দৃষ্টান্ত দেয়া হলো
।
এ ধরনের আরো অনেক দৃষ্টান্ত দেয়া যেতে পারে
।
এভাবে অনেক ছ্বাহাবীর - যাদের নিষ্পাপ হওয়ার সপক্ষে কোনোই দলীল নেই - মতামতের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের লক্ষ্যে এ ধরনের আরো অনেক ভ্রান্ত ফত্ওয়া দেয়া হয়েছে - যা মুসলমানদের মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধির কারণ হয়েছে
।