ইসলাম ও শীয়া মাযহাব

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব 11%

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 31 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 41871 / ডাউনলোড: 5857
সাইজ সাইজ সাইজ
ইসলাম ও শীয়া মাযহাব

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

‘ইসলাম ও শীয়া মাযহাব’ নামক এ গ্রন্থে ইসলামের দু’টি বৃহৎ উপদলের (শীয়া ও সুন্নী) অন্যতম শীয়া মাযহাবের প্রকৃত পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে । শীয়া মাযহাবের উৎপত্তি, বিকাশ ও চিন্তাধারার প্রকৃতি এবং ইসলামী জ্ঞানের ব্যাপারে শীয়া মাযহাবের দৃষ্টিভঙ্গী এ বইয়ে আলোচিত হয়েছে ।

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব

আল্লামা সাইয়্যেদ মুহাম্মদ হুসাইন তাবাতাবাঈ

এই বইটি আল হাসানাইন (আ.) ওয়েব সাইট কর্তৃক আপলোড করা হয়েছে ।

http://alhassanain.org/bengali

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

লেখক পরিচিতি

আল্লামা মুহাম্মদ হুসাইন তাবাতাবাঈ একটি অতীব সম্ভ্রান্ত আলেম পরিবারের জন্ম গ্রহণ করেন । যে পরিবারের চৌদ্দ পুরুষ বংশ পরস্পরায় তাব্রীজের আলেম হিসাবে প্রখ্যাত ছিলেন । তিনি হিজরী ১৩২১ সনের ২৯ শে জিলক্বদ জন্ম গ্রহণ করেন । প্রাথমিক শিক্ষা তিনি নিজের এলাকাতেই অর্জন করেন । অতঃপর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তির পর তিনি হিজরী ১৩৪৪ সনে ইরাকের নাজাফে আশরাফ নামক শহরে ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনে যান । শীয়াদের সর্ব বৃহৎ এই জ্ঞান কেন্দ্রে তিনি ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় পরিপূর্ণরূপে জ্ঞান অর্জনে মশগুল হন । তিনি ফিকহ্ ও উসুল শাস্ত্রদ্বয়কে আয়াতুল্লাহ শায়খ মুহাম্মদ হুসাইন নায়েনী ও আয়াতুল্লাহ শায়খ মুহাম্মদ হুসাইন গারাবী ইস্পাহানী কোম্পানী নামক প্রসিদ্ধ শিক্ষকদ্বয়ের নিকট এবং দর্শন শাস্ত্র আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ হুসাইন বদকুবী ও গণিতশাস্ত্র আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আবুল কাসিম খুনসারী নামক প্রসিদ্ধ শিক্ষকের নিকট থেকে শিক্ষা লাভ করেন । অন্যদিকে আধ্যাত্ম বা নিজেকে নৈতিক ভাবে গড়ে তোলার জন্যে হাজী মির্জা আলী কাজীর শিষ্যত্ব বরণ করেন । এই মহান ব্যক্তি প্রজ্ঞাশাস্ত্রের তত্ত্বগত ও ব্যবহারিক শাখায় উচ্চ পর্যায়ের মানুষ ছিলেন ।

উল্লেক্ষ্য যে ইসলামী বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনী (রহঃ) ও আত্মগঠনের ক্ষেত্রে জনাব কাজী (রহঃ)-এর শিষ্যত্ব বরণ করেছিলেন । অতঃপর তিনি হিজরী ১৩৫৪ সনে নিজের জন্ম স্থান তাব্রিজে ফিরে আসেন । আল্লামা তাবাতাবাঈর শিক্ষা কেবল মাত্র ফেকাহ্ শাস্ত্রের সাধারণ পর্যায়েই সীমাবদ্ধ ছিল না বরং তিনি আরবী ব্যাকারণ , অলংকার শাস্ত্র ও সাহিত্যে এবং ফেকহ্ ও উসুল শাস্ত্রে গভীর ভাবে জ্ঞান অর্জন করেন । একই ভাবে তিনি প্রাচীন গণিত ইউক্লিডের মুলনীতি থেকে টলেমীর লেখা জ্যোর্তি বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ (The Almagest ) টলেমী পদ্ধতি পর্যন্ত অধ্যয়ন করেছেন । অন্য দিকে তাফসীর , দর্শন শাস্ত্র , তর্কবিদ্যা ও ইরফান শাস্ত্রে এত গভীর ভাবে জ্ঞান অর্জন করেন যে , ইজতিহাদের পর্যায়ে উপনীত হন ।

জনাব আল্লামা হিজরী ১৩৬৫ সনে আপন জন্মভূমি ত্যাগ করে কোমে এসে অবস্থান নেন । কোমে তিনি নীরবে কোন হৈ চৈ ছাড়াই তাফসীর ও দর্শনের ক্লাশ নেয়া শুরু করেন । এ সময়ে তিনি তেহরান সহ আরো বিভিন্ন অঞ্চলের দর্শন বা ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানপ্রিয় লোকদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলেন । যাদের মধ্যে অবশ্যই ওস্তাদ হেনরী কার্বনের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য । জনাব আল্লামা কয়েক বছর যাবৎ জ্ঞানী-গুনী-পণ্ডিত ও ছাত্রদের উপস্থিতিতে হেনরী কার্বনের সাথে বৈঠক অব্যাহত রাখেন । উক্ত আলোচনায় ধর্ম , দর্শন ও আধুনিক বিশ্বের প্রেক্ষাপটে একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তি ও বাস্তবতা অনুসন্ধানীর করণীয় দায়িত্ব সম্পর্কে অতিগুরুত্ব পূর্ণ বিষয় উপস্থাপন করা হত । ঐ জাতীয় উচ্চ মার্গীয় উন্মুক্ত চিন্তার আলোচনা বর্তমান মুসলিম বিশ্বে অতি বিরল । এই আলোচনা সমষ্টি পরবর্তীতে দু খণ্ডে গন্থাকারে প্রকাশ করা হয় । কোমের ধর্মীয় শিক্ষা কেন্দ্র আল্লামার সবচেয়ে বড় অবদান হল বুদ্ধিবৃত্তিক ও কুরআনের তাফসীর সংক্রান্ত জ্ঞান চর্চায় পুনরুজ্জীবন সঞ্চার করা । তারই একান্ত প্রচেষ্টায় দর্শন শাস্ত্রের মৌলিক ও সর্বোচ্চ পর্যায়ের গ্রন্থ আশ্ শাফা আসফার এই গন্থদ্বয়ের শিক্ষার প্রসার ঘটে ।

আল্লামার বিশ্বাস ও আচার-আচারণ ছিল অতীব আকর্ষনীয় , একজন পরিশুদ্ধ মানবের ন্যায় । তাই জ্ঞান প্রিয় ব্যক্তিরা অতি সহজে তার আলোচনা সভার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়তেন । আল্লামা বিশ্বাস করতেন জ্ঞান অর্জনের সাথে সাথে আত্মশুদ্ধি ও নৈতিক গঠন একান্ত প্রয়োজন । এ জন্যেই তিনি আপন ছাত্রদের আত্মশুদ্ধি ও চরিত্র গঠনের ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করতেন । প্রকৃতপক্ষে নৈতিকতা ও জ্ঞানের সমন্বয়ে ব্যক্তি গঠনের এক সুনিপুন আদর্শ তিনি প্রতিষ্ঠা করেন।

ভূমিকা

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব নামক এ গ্রন্থে ইসলামের দু টি বৃহৎ উপদলের (শীয়া ও সুন্নী) অন্যতম শীয়া মাযহাবের প্রকৃত পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে । শীয়া মাযহাবের উৎপত্তি , বিকাশ ও চিন্তাধারার প্রকৃতি এবং ইসলামী জ্ঞানের ব্যাপারে শীয়া মাযহাবের দৃষ্টিভঙ্গী এ বইয়ে আলোচিত হয়েছে ।

ধর্ম : এখানে কোন সন্দেহ নেই যে , মানুষ তার স্বজাতীয় লোকদের সাথে সমাজবদ্ধ হয়ে একসংগে জীবন যাপন করে । মানুষ তার জীবনে সামাজিক পরিবেশে যে সব কাজ করে , সে সকল কাজ পরস্পর সম্পর্কহীন নয় । যেমনঃ মানুষের খাওয়া , পড়া , পান করা , চলা , ঘুমানো , জাগ্রত হওয়া , পরস্পরের সাথে মেলা মেশা ইত্যাদি কাজ বাহ্যতঃ পরস্পর সম্পর্কহীন বলে মনে হলেও প্রকৃত পক্ষে এগুলো সম্পূর্ণ রূপে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত । যে কোন কাজই ইচ্ছেমত যত্র-তত্র ও যখন ইচ্ছে তখন করা যায় না । বরঞ্চ যে কোন কাজের জন্যেই একটি নির্দিষ্ট নিয়ম কানুন রয়েছে । তাই মানুষ তার জীবনের প্রয়োজনীয় কাজ-কর্মগুলো সুনির্দিষ্ট একটি নিয়মতান্ত্রিকতার অধীনে সম্পন্ন করে , যা কখনই ঐ নিয়ম থেকে বিচ্যুত হয় না । আর মানব জীবনে সম্পাদিত সকল কাজের উদ্দেশ্যই বিশেষ একটি বিন্দু থেকে উৎসারিত । আর সেই কেন্দ্র বিন্দুটি হল , মানব জীবনের সাফল্য ও সৌভাগ্র লাভের আকাংখা , অর্থাৎ মানুষ তার অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্যে তার অভাব ও প্রয়োজন গুলোকে যথাসম্ভব পূর্ণ করার আকাংখা পোষণ করে ।

এ কারণেই মানুষ তার জীবনের সকল কাজকর্মকে তার স্বরচিত নিজের ইচ্ছেমত রচিত আইন বা অন্যের কাছ থেকে গৃহীত আইনের সাথে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করে । এ ভাবে সে আপন জীবন যাপনের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ জীবন পদ্ধতির অনুসরণ করে । তাই জীবন যাপনের স্বার্থে সে প্রয়োজনীয় জীবন উপ্রকরণ সংগ্রহের জন্যে আত্মনিয়োগ করে । কেননা , সে বিশ্বাস করে জীবন উপ্রকরণ সংগ্রহ জীবন যাপনের জন্যে প্রয়োজনীয় একটি বিধান । সে রসনার তৃস্তি সাধান এবং ক্ষুধা ও তৃষ্ণা নিবারণের জন্যে খাদ্য ও পানি পান করে থাকে । কেননা , সে সৌভাগ্যপূর্ণভাবে বেচে থাকার জন্যে খাওয়া ও পান করাকে সে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলে মনে করে । ঠিক এভাবেই সে প্রতিটি ক্ষেত্রে সাফল্যের লক্ষ্যে পূর্বনির্ধারিত কিছু নিয়ম মেনে চলে ।

মানব জীবনের উপর প্রভুত্ব বিস্তারকারী উল্লিখিত বিধি বিধানের ভিত্তিমূল একটি বিশেষ মৌলিক বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত । আর তার উপরই মানব জীবন নির্ভরশীল ।

মানুষ এই সৃষ্টি জগতেরই একটি অংশ বিশেষ এবং সমগ্র সৃষ্টি জগতের অস্তিত্বের মূলরহস্য সম্পর্কে প্রতিটি মানুষেরই একটি সুনির্দিষ্ট ধারণা বা বিশ্বাস রয়েছে । সৃষ্টি জগতের রহস্য সম্পর্কে মানুষের চিন্তা-ভাবনা বা ধারণার প্রকৃতি কেমন হতে পারে , একটু চিন্তা করলেই তা আমাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে । যেমন-যারা এ সৃষ্টি জগতর্ক শুধুমাত্র জড় বা বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে এবং মানুষকেও সস্পূর্ণরূপে (১০০%) জড় অস্তিত্ব (জন্মের মাধ্যমে জীবনের সূচনা এবং মৃত্যুর মাধ্যমে তার ধ্বংস) বলে বিশ্বাস করে , তাদের অনুসৃত জীবন পদ্ধতিও জড়বাদের উপর ভিত্তি করেই রচিত । অর্থাৎ স্বল্পকালীন এ পার্থিব জীবনের স্বাদ উপভোগই তাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আর এ জন্যেই সমগ্র বিশ্বজগৎ ও প্রকৃত্রিক বশে আনার জন্যে তারা তাদের জীবনের সকল প্রচেষ্টা ও সাধানা বিনিয়োগ করে ।

আবার অনেকেই (মূর্তি উপাসকরা) এ বিশ্ব জগৎ ও প্রকৃত্রিক তার চেয়ে উচ্চতর ও মহান এক অস্তিত্বের (আল্লাহ) সৃষ্টিকর্ম বলে বিশ্বাস করে । তারা বিশ্বাস করে মহান আল্লাহ মানুষকে তার অসংখ্য অনুগ্রহ মূলক দান ও নেয়ামতের মাঝে নিমজ্জিত রেখেছেন , যাতে মানুষ আল্লাহ প্রদত্ত অসীম অনুগ্রহ উপভোগ করে উপকৃত হতে পারে । সৃষ্টি জগতের অস্তিত্বের রহস্য সম্পর্কে এ ধরণের বিশ্বাসের অধিকারী ব্যক্তিগণ এমন এক জীবন পদ্ধতির অনুসরণ করেন , যার মাধ্যমে সর্বস্রষ্টা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা এবং তার ক্রোধ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় । কেননা , যদি তারা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে সমর্থ হন , তাহলে তিনি তাদের প্রতি তার অনুগ্রহের পরিমাণ বাড়িয়ে দিবেন এবং তাদেরকে অসীম ও চিরন্তন অনুগ্রহ বা নেয়ামতের অধিকারীও করবেন । আর মানুষ যদি তার কৃতকর্মের মাধ্যমে মহান স্রষ্টার ক্রোধের সঞ্চার করে , তাহলে তারা আল্লাহ প্রদত্ত অনুগ্রহ বা নেয়ামত থেকে বঞ্চিত হবে ।

অন্য দিকে যারা শুধুমাত্র আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ছাড়াও মানুষের জন্যে এক অনন্ত জীবনে বিশ্বাসী , এবং মানুষকে তার পার্থিব জীবনের কৃত সকল ভাল ও মন্দ কাজের জন্যে দায়ী বলে বিশ্বাস করে । ফলে তারা কেয়ামত দিনের প্রতিও বিশ্বাসী , যে দিন মানুষকে তার ভাল মন্দ সব কাজের জবাবদিহি করতে হবে এবং ভাল কাজের জন্যে পুরস্কৃত করা হবে ; এই কেয়ামতের দিনকে ইহুদী , খৃষ্টান , মাজুসী এবং মুসলমানরা ও বিশ্বাস করে । এ ধরণের বিশ্বাসের অধিকারী ব্যক্তিরা এমন এক জীবন পদ্ধতির অনুসরণ করে যা ঐ মৌলিক বিশ্বাসের সাথে সামঞ্জশ্যপূর্ণ এবং মানুষের ইহকাল ও পরকালীন উভয় জীবনেই সৌভাগ্যবান হওয়ার নিশ্চয়তা প্রদান করে । এ বিশ্ব জগতের সৃষ্টিরহস্য সম্পর্কিত মৌলিক বিশ্বাসসমূহ এবং তার ভিত্তিতে রচিত অনুকরণীয় জীবন পদ্ধতির নীতিমালা সমষ্টির অপর নামই দ্বীন দ্বীনের মধ্যে সৃষ্ট শাখা সমূহকে মাযহাব বলা হয় । উদাহরণ স্বরূপ যেমন : আহলুস সুন্নাহ ও আহলুস তাশাইয়ূ ইসলামের অন্যতম দু টি মাযহাব এবং খৃষ্টান ধর্মের মালেকানী ও নাসতুরী মাযহাবদ্বয় ।

ইতিপূর্বের আলোচনা থেকে সুস্পষ্টভাবে বলা যায় যে , মানুষ দ্বীনের (এক শ্রেণীর মৌলিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে রচিত জীবন পদ্ধতি) প্রতি নির্ভরশীলতা থেকে (যদি সে আল্লাহতে বিশ্বাসী নাও হয়) আদৌ মুক্ত নয় । সুতরাং দ্বীন মানুষের জন্যে প্রয়োজনীয় এমন এক জীবন পদ্ধতি , যা মানব জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ স্বরূপ । পবিত্র কুরআনের ভাষ্য অনুযায়ী দ্বীন কে এড়িয়ে যাওয়া মানুষের জন্যে অসম্ভব । এটা এমন এক পথ যা স্বয়ং মহান আল্লাহ মানব জাতির প্রতি প্রসারিত করেছেন এবং মহান আল্লাহতে গিয়েই এ পথের পরিসমাপ্তি ঘটেছে । অর্থাৎ সত্য দ্বীন (ইসলাম) গ্রহণের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে মানুষ আল্লাহর নৈকট্য লাভের পথেই ধাবিত হয় । আর যারা সত্য দ্বীন কে গ্রহণ করেনি প্রকৃতপক্ষে তারা ভ্রান্ত পথই অনুসরণ করেছে এবং পথভ্রষ্ট হয়েছে ।

ইসলাম : আত্মসমর্পণ ও মাথানত করাই ইসলাম শব্দের আভিধানিক অর্থ । পবিত্র কুরআনে যে দ্বীন অনুসরণের প্রতি মানব জাতিকে আহবান্ করা হয়েছে , তা হচ্ছে ইসলাম । ইসলাম নাম করণের মূল কারণ হচ্ছে , সমগ্র বিশ্ববাসী একমাত্র মহান আল্লাহর কাছে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমপণ করবে । এই আত্মসমর্পণের ফলশ্রুতিতে সে এক আল্লাহর নির্দেশ ব্যতীত অন্য কারো নির্দেশের আনুগত্য করবে না এবং একমাত্র তারই উপাসনা ব্যতীত অন্য কারো উপাসনা করবে না । আর এটাই হল ইসলামের মূল কর্মসূচী । পবিত্র কুরআনের বক্তব্য অনুযায়ী সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি এই দ্বীন কে ইসলাম ও এর অনুসারীদেরকে মুসলমান হিসেবে নাম করণ করেন , তিনি হলেন হযরত ইব্রাহীম (আ.) ।

শীয়া: শীয়া শব্দের আভিধানিক অর্থ হল অনুসারী । যারা মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পরিবারকে তার প্রকৃত ও একমাত্র উত্তরাধিকারী হিসেবে গণ্য করেন , তারাই শীয়া নামে পরিচিত । তারা ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পবিত্র আহলে বাইত (আ.)-এর আদর্শের অনুসারী ।

শীয়া মাযহাবের উৎপত্তি ও তার বিকাশ প্রক্রিয়া

সর্বপ্রথম যারা শীয়াতু-আলী বা হযরত আলী (আ.) [পবিত্র আহলে বাইতের (আ.) ইমামদের প্রথম ইমাম]-এর অনুসারী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল , তাদের আবির্ভাব মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবদ্দশাতেই ঘটেছিল । মহানবী (সা.)-এর দীর্ঘ ২৩ বছর যাবৎ নবুয়ত কাল ইসলামের আবির্ভাব , প্রচার ও অগ্রগতির ঘটনা অন্য উপলক্ষ্য বা হেতুর সৃষ্টি করেছিল । ঐসব উপলক্ষ্য বা হেতুগুলোই রাসূল (সা.)-এর সাহাবীদের মাঝে এ ধরণের একটি সম্প্রদায়ের (শীয়া) আবির্ভাব ঘটিয়ে ছিল ।

১. নবুয়ত প্রাপ্তির প্রথম দিনগুলোতে মহানবী (সা.) পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে সর্বপ্রথম নিকটআত্মীয়দের কাছে ইসলাম প্রচারের জন্যে আদিষ্ট হয়েছিলেন । তখন তিনি স্পষ্টভাবে তাদেরকে আহবান জানিয়ে বলেছিলেন , তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম আমার আহবানে সাড়া দিবে , সেই হবে আমার প্রতিনিধি এবং স্থলাভিষিক্ত ও উত্তরাধিকারী । তখন একমাত্র হযরত আলী (আ.)-ই সবার আগে মহানবী (সা.)-এর আহবানে সাড়া দিয়েছিলেন এবং ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন । মহানবী (সা.) ও হযরত আলী (আ.)-এর ঈমান আনয়নের বিষয়টিকে স্বাগত জানান এবং তাঁর ব্যাপারে স্বীয় প্রতিশ্রুত্রিকও তিনি রক্ষা করেছিলেন । এটা কখনই সম্ভব নয় যে , কোন একটি আন্দোলনের নেতা , আন্দোলনের সূচনা লেগে কোন একজন সহযোগীকে তার প্রতিনিধি ও উত্তরাধিকারী হিসেবে অন্য সবার কাছে পরিচিত করাবেন , অথচ তার একনিষ্ট ও আত্মত্যাগী সহযোগীদের কাছে তাকে তিনি পরিচিত করাবেন না । অথবা তাকে তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে পরিচিত করাবেন , কিন্তু তার সমগ্র জীবদ্দশায় তাকে তার দায়িত্ব থেকে অপসারণ করবেন , তার স্থলাভিষিক্তের পদমর্যাদাকে উপেক্ষা করবেন এবং অন্যান্যদের সাথে কোন পার্থক্যই রাখবেন না ।

১. শীয়া ও সুন্নী উভয় সূত্রে বর্ণিত অসংখ্য মুতাওয়াতির মুস্তাফিজ হাদীসে মহানবী (সা.) স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে , হযরত আলী (আ.) তার কথায় ও কাজে ভুল-ত্রুটি থেকে মুক্ত। তিনি যা কিছু বলেন এবং করেন , সবই ইসলামের প্রচার কাজের সাথে সম্পূর্ণ সংগতিপূর্ণ । ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শরীয়তের ক্ষেত্রে তিনিই সর্বাধিক জ্ঞানী ব্যক্তি ।

২. হযরত আলী (আ.) ইসলামের জন্যে অতীব মূল্যবান সেবামুলক কাজ করেছেন । ইসলামের পথে তিনি আশ্চর্যজনক আত্মত্যাগের প্রমাণ রেখেছেন । উদাহরণ স্বরূপ মদীনায় হিজরতের রাতে মহানবী (আ.)-এর বিছানায় শয়ন , বদর , ওহুদ , খন্দক ও খায়বারের যুদ্ধ তার দ্বারা অর্জিত বিজয়সমূহ উল্লেখযোগ্য । এ সব ঘটনার কোন একটিতেও যদি তিনি উপস্থিত না থাকতেন তাহলে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহ্ সেদিন আল্লাহর শত্রুদের হাতে ধ্বংস হয়ে যেত ।১০

৩. গাদিরে খুমের ঘটনা , এ ঘটনায় মহানবী (সা.) হযরত আলী (আ.) -কে জনসাধারণের মাঝে তাদের গণনেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত ও পরিচিত করিয়ে দেন । তিনি আলী (আ.)-কে নিজের মতই জনগণের অভিভাবকের পদে প্রতিষ্ঠিত করেন ।

৪ হযরত আলী (আ.)-এর এধরণের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও মহত্বের অধিকারী হওয়ার বিষয়টি ছিল একটি সর্বসম্মত ব্যাপার ।১১ এ ছাড়াও তাঁর প্রতি আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর ভালবাসা ছিল অপরিসীম ।১২ সব মিলিয়ে এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল যে , সত্য ও মহত্বের অনুরাগী রাসূল (সা.)-এর বেশ কিছু সংখ্যক সাহাবী আলী (আ.)-এর প্রেমে অনুরক্ত ও তার অনুসারীতে পরিণত হবেন । একইভাবে এ বিষয়টি বেশ কিছু সংখ্যক সাহাবীর ঈর্ষা ও বিদ্বেষের কারণও ঘটিয়েছিল , যা তাদেরকে আলী (আ.)-এর প্রতি শত্রুতায় উদ্বুদ্ধ করেছিল । এ সকল বিষয় ছাড়াও স্বয়ং আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর পবিত্র বাণীসমূহে শীয়াতুআলী [আলী (আ.)-এর অনুসারী] এবং শীয়াতু আহলুল বাইত (পবিত্র আহলে বাইতের অনুসারী) নামক শব্দগুলোর বহুল ব্যাবহার পরিলক্ষিত হয় ।১৩

সুন্নী জনগোষ্ঠী থেকে শীয়া জনগোষ্ঠীর পৃথক হওয়ার কারণ

রাসূল (সা.) সাহাবাবৃন্দ এবং মুসলমানদের কাছে হযরত আলী (আ.) উচ্চমর্যাদার অধিকারী ছিলেন । স্বাভাবিকভাবেই হযরত আলী (আ.)-এর ভক্ত ও অনুসারীদের এ ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে , মহানবী (সা.)-এর তিরোধনের পর মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব ও খেলাফতের অধিকার একমাত্র হযরত আলী (আ.)-এর-ই-রয়েছে । আর রাসূল (সা.)-এর মৃত্যুপূর্ব অসুস্থ অবস্থার সময়ে সংঘটিত কিছু ঘটনা ছাড়া অন্য সকল ঘটনা প্রবাহ তাদের এ ধারণারই সাক্ষ্য দিচ্ছিল ।১৪

কিন্তু পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ সম্পূর্ণরূপে তাদের ধারণার বিপক্ষে বইতে শুরু করল । আর এটা তখনই ঘটল , যখন বিশ্বনবী (সা.) সবেমাত্র শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন । তার পবিত্র দেহ এখনও দাফন হয়নি । রাসূল (সা.)-এর শোকগ্রস্থ পবিত্র আহলে বাইত (আ.) ও কিছু সংখ্যক সাহাবী যখন রাসূল (সা.)-এর দাফন কাফনের আয়োজন্য ব্যস্ত , ঠিক তখনই খবর এল , কিছু সংখ্যক সাহাবী খলিফা নির্বাচন করে ফেলেছেন । খলিফা নির্বাচনের ঘটনা এত দ্রুত ও তাড়াহুড়ার মধ্যে ঘটানো হয়েছিল যে , এ ব্যাপারে রাসূল (সা.) এর পবিত্র আহলে বাইত (রাসূলের পরিবার) , আত্মীয় স্বজন এবং ভক্ত ও অনুসারীদেরকে পরামর্শের জন্যেও কোন প্রকারে সংবাদ দেয়া হয়নি । এ ঘটনার মূল ব্যক্তিরা পরবর্তীতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও প্রথম অবস্থায় এদের সংখ্যা ছিল খুবই নগন্য । অথচ তারা বাহ্যত মুসলমানদের কল্যাণকামীতার দাবিদ্যার ছিল । এ ভাবেই হযরত আলী (আ.) ও তার অনুসারীরা এক অপ্রত্যাশিত ঘটনার মুখোমুখী হলেন ।১৫

হযরত সালমান ফারসী , হযরতুমিকদাদ , হযরত আবুযার , হযরত আব্বাস , হযরত যুবাইর , হযরত আম্মারসহ হযরত আলী (আ.) ও তার অন্যান্য অনুসারীরা রাসূল (সা.)-এর দাফন কাফনের অনুষ্ঠান শেষ করা এবং খলিফা নির্বাচনের ঘটনা সম্পর্কে পূর্ণ অবহিত হওয়ার পর এ ব্যাপারে তারা কঠোর সমালোচনা করেন । এ ছাড়াও তথাকথিত নির্বাচিত খলিফা এবং এ ঘটনার মূল ব্যক্তিদের কাছে এ ব্যাপারে তারা ব্যাপক প্রতিবাদ জানান । এমন কি এ ব্যাপারে তারা কিছু গণজমায়েতও করেন । কিন্তু এর উত্তরে তাদেরকে বলা হয় , এ ঘটনাকে মেনে নেয়ার মাঝেই মুসলমানদের কল্যাণ নিহিত রয়েছে ।১৬

প্রতিষ্ঠিত খলিফার প্রতি সমালোচনা ও বিরুদ্ধাচারণই হযরত আলী (আ.) ও তাঁর অনুসারীদেরকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী থেকে পৃথক ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে পরিণত হওয়ার কারণ ঘটিয়ে ছিল । আর তখন থেকেই হযরত আলী (আ.)-এর অনুসারীরা শীয়াতু আলী (আলীর অনুসারী) নামে সমাজে পরিচিতি লাভ করে । অবশ্য খলিফার প্রশাসনিক অঙ্গনে এমন এক সতর্কপূর্ণ প্রচেষ্টা ছিল যে , আলী (আ.)-এর অনুসারীরা এভাবে বিশেষ একটি নামে সমাজে পসিদ্ধি লাভ না করুক । মুসলিম সমাজ এভাবে সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগরিষ্ঠ দু টি দলে বিভক্ত না হোক । বরং তাদের প্রচেষ্টা ছিল খেলাফতর্ক একটি সর্বসম্মত বিষয় হিসেবে সমাজের কাছে তুলে ধরা । তাই খেলাফতের বিরোধীদেরকে তারা বাইয়াতের বিরোধী ও মুসলিম উম্মার বিরোধী হিসেবে সমাজে পরিচিতি করাতে খাকলেন । কখনও বা খেলাফতের বিরোধীদেরকে এর চেয়ে জঘণ্য ভাষায় সম্বোধন করা হত ।১৭

অবশ্য শীয়াদেরকে সেদিন তাদের জন্ম লেগেই প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তির দ্বারা পদদলিত হতে হয়েছিল । শুধুমাত্র মৌখিক প্রতিবাদ-কর্ম সূচীর মাধ্যমে তারা একপাও অগ্রসর হতে পারেনি । আর হযরত ইমাম আলী (আ.) ইসলাম ও মুসলমানদের বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষা এবং প্রয়োজনীয় শক্তি সামর্থের অভাবে একটি রক্তক্ষয়ী বিপ্লব থেকে বিরত রইলেন । কিন্তু খেলাফত বিরোধী পক্ষ তাদের মতাদর্শের ব্যাপারে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে আত্মসমর্পণ করেনি । রাসূল (সা.)-এর উত্তরাধিকার ও জ্ঞানগত নেতৃত্বের ব্যাপারে তারা একমাত্র হযরত ইমাম আলী (আ.)-কেই যোগ্য বলে বিশ্বাস করতেন ।১৮ তারা জ্ঞানগত ও আধ্যাত্মিক নেতৃত্বের গুণাবলী একমাত্র হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর মধ্যেই দেখতে পেয়েছিলেন । তাই তারা তাঁর দিকেই মুসলমানদেরকে আহবান জানাতেন ।১৯

রাসূল (সা.)-এর উত্তরাধিকার ও জ্ঞানগত নেতৃত্বের বিষয়

ইসলামের শিক্ষা থেকে শীয়ারা যে জ্ঞান লাভ করেছিল , তাতে শীয়ারা বিশ্বাস করত যে , যে বিষয়টি সমাজের জন্যে সর্বপ্রথম জরুরী তা হল , ইসলামের শিক্ষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সবার সুস্পষ্ট ধারণার অধিকারী হওয়া ।20 আর পরবর্তী পর্যায়ে সেই ইসলামী শিক্ষা সমূহকে পূর্ণ ভাবে সমাজে প্রয়োগ করা । অন্য কথায় ,

প্রথমতঃ সমাজের প্রত্যেককেই এ পৃথিবী ও মানব জাতিকে বাস্তব দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে একজন মানুষ হিসেবে নিজ দায়িত্ব সম্বন্ধে অবগত এবং তা পালনে বর্ত হওয়া উচিত । এমন কি তা যদি তার ইচ্ছার বিরোধীও হয় তবুও তা পালন করা উচিত ।

দ্বিতীয়তঃ একটি ইসলামী শাসন ব্যবস্থা সমাজে ইসলামের প্রকৃত বিধি বিধান সমূহকে সংরক্ষণ ও বাস্তবায়ন করবে । যাতে করে ঐ সমাজের কেউই যেন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উপাসনা না করে এবং সবাই পূর্ণ স্বাধীনতাসহ ব্যক্তি ও সামাজিক ন্যায়বিচার ভোগ করতে পারে । আর এদু টি মহান লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্যে এমন এক ব্যক্তির প্রয়োজন , যে সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে নিস্পাপ হওয়ার মত গুণের অধিকারী হবে । অন্যথায় হয়ত এমন কোন লোক সেই শাসন ব্যবস্থা ও জ্ঞানগত নেতৃত্বের আসনের অধিকারী হয়ে বসবে , যে তার ঐ গুরুদায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে চিন্তাগত পথভ্রষ্টতা বা বিশ্বাসঘাতকতার সম্ভবনা থেকে মুক্ত নয় । এর ফলে তখন ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতা ব্যহত হবে ও ইসলামী শাসন ব্যবস্থা একটি অত্যাচারী একনায়েক বা রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হবে । তখন ইসলামের পবিত্র জ্ঞানভান্ডার পৃথিবীর অন্যান্য ধর্মের মতই স্বেচ্ছাচারী ও স্বার্থান্বেষী পণ্ডিত মহলের দ্বারা বিকৃতির স্বীকার হবে । বিশ্বনবী (সা.)-এর সাক্ষ্য অনুযায়ী একমাত্র যে ব্যক্তি কথায় ও কাজে এ পদের জন্যে উপযুক্ত ছিল এবং যার পদ্ধতি সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর পবিত্র কুরআন ও রাসূল (সা.)-এর সুন্নাতের অনুরূপ ছিল , তিনি হচ্ছেন হযরত আলী (আ.) ।21

যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠদের বক্তব্য ছিল এই যে , কুরাইশরা খেলাফতের ব্যাপারে হযরত আলী (আ.)-এর ন্যায্য অধিকার প্রাপ্তির বিরোধী । তারপরও তাদের উচিত ছিল বিরোধীদেরকে সত্যের দিকে ফিরে আসতে বাধ্য করা এবং বিদ্রোহীদেরকে দমন করা । ঠিক যেমনটি যাকাত প্রদান অস্বীকারকারীদের সাথে করা হয়েছিল । এমনকি তাদের সাথে যুদ্ধও করা হয়েছিল । তবুও যাকাত আদায় থেকে তারা বিরত হয়নি । তাই কুরাইশদের বিরোধীতার ভয়ে সত্য প্রতিষ্ঠার কাজ থেকে হাত গুটিয়ে সত্যকে হত্যা করা তাদের কখনও উচিত হয়নি । নির্বাচিত খেলাফতর্ক সম্মতি প্রদান থেকে যে কারণটি শীয়াদের বিরত রেখে ছিল , তা হচ্ছে এ ঘটনার অনাকাংখিত পরিণতি , যা ইসলামী শাসন ব্যবস্থার জন্যে বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসত এবং ইসলামের সুমহান শিক্ষার ভিত্তিকে ধ্বংস করে দিত । বাস্তবিকই পরবর্তী ঘটনা প্রবাহে ক্রমেই এ ধারণার সত্যতা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় । এর ফলে শীয়াদের এ সংক্রান্ত বিশ্বাস আরও দৃঢ়তর হতে থাকে । যদিও প্রাথমিক পর্যায়ে শীয়ারা বাহ্যত হাতে গানা অল্প কয়েকজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল , যা বৃহত্তর জনসমুদ্রে হারিয়ে গিয়েছিল , তথাপি পবিত্র আহলে বাইতগণ (আ.) গোপনে ইসলামের শিক্ষাদান কর্মসূচী এবং নিজস্ব পদ্ধতিতে ইসলাম প্রচারের ব্যাপারে নিরন্তন চেষ্টা চালিয়ে যান । অন্যদিকে এর পাশাপাশি ইসলামী শক্তির উন্নতি ও সংরক্ষণের বৃহত্তর স্বার্থে তারা শ্বাসক গোষ্ঠির সাথে প্রকাশ্যে বিরোধীতা থেকে বিরত থাকেন । এমন কি শীয়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠদের সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে সকল জিহাদেরও অংশ গ্রহণ করতেন এবং গণ-স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে প্রয়োজনে হস্তক্ষেপও করতেন । স্বয়ং হযরত আলী (আ.) ইসলামের স্বার্থে সংখ্যাগরিষ্ঠদের পথ নির্দেশনা দিতেন ।22

নির্বাচিত খেলাফতের রাজনীতি ও শীয়াদের দৃষ্টিভঙ্গী

শীয়া মাযহাবের অনুসারীরা বিশ্বাস করতেন যে , ইসলামের ঐশী আইন বা শরীয়ত , যার উৎস পবিত্র কুরআন ও বিশ্বনবী (সা.)-এর সুন্নাত তা কেয়ামত পর্যন্ত সম্পূর্ণ অক্ষুন্ন ও অপরিবর্তীত অবস্থায় এবং স্বীয় মর্যাদায় টিকে থাকবে ।23 ইসলামী আইনসমূহের পূর্ণ বাস্তবায়নের ব্যাপারে এতটকু টাল-বাহানা করার অধিকার ইসলামী সরকারের নেই । ইসলামী সরকারের একমাত্র দায়িত্ব হচ্ছে পরামর্শ সভার পরামর্শ ও সমস্যামায়িক পরিস্থিতি অনুযায়ী ইসলামী শরীয়তের (আইন) ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ । কিন্তু রাসূল (সা.)-এর মৃত্যু পুর্ব অসুস্থ অবস্থার সময়ে সেই ঐতিহাসিক কাগজ কলম আনার ঘটনা খলিফা নির্বাচন ও রাজনৈতিক বাইয়াত গ্রহণসহ ইত্যাদি ঘটনা তদানিন্তন খেলাফতের উদ্দেশ্যকে স্পষ্ট করে তোলে । এ ব্যাপারটি পরিস্কার হয়ে যায় যে , নির্বাচিত খেলাফতের মূল ব্যক্তিবগ ও সমর্থকগণ পবিত্র কুরআনকে কেবল মাত্র একটি সংবিধান হিসাবে সংরক্ষণে বিশ্বাসী । কিন্তু রাসূল (সা.)-এর সুন্নাত ও আদর্শকে তারা অপরিবর্তনীয় বলে মনে করত না । বরং তাদের ধারণা ছিল ইসলামী সরকার নিজ স্বার্থের প্রয়োজনে রাসূল (সা.)-এর সুন্নাত বাস্তবায়ন থেকেও বিরত থাকতে পারে । তদানিন্তন খেলাফততন্ত্রের এ দৃষ্টি ভঙ্গীর প্রমাণ পরবর্তীতে রাসূল (সা.)-এর বহু সাহাবীদের কথা ও কাজে পরিলক্ষিত হয় (সাহাবীরা মুজতাহিদ । ইজতিহাদ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যদি সত্যে উপনীত হন , পুরস্কৃত হবেন । আর যদি ভুল করেন , ক্ষমা প্রাপ্ত হবেন) । এর স্পষ্ট উদাহরণ জনৈক সাহাবী ও সেনাপতি খালিদ বিন ওয়া লিদের ঐতিহাসিক ঘটনায় পাওয়া যায় । কোন এক রাতে খালিদ বিন ওয়ালিদ জনাব মালিক বিন নুওয়াইরা নামক জনৈক গণ্যমান্য মুসলমানের বাড়িতে আকস্মিকভাবে অতিথি হন । খালিদ বিন ওয়ালিদ তাকে অপ্রত্যাশিতভাবে হত্যা করেন এবং তাঁর কর্তিত মাথা চুলার আগুনে পুড়িয়ে ফেলেন ।

অতঃপর ঐ রাতেই নিহতের স্ত্রীকে ধর্ষণ করেন । কিন্তু , সামরিক বাহিনীর জন্যে খালিদ বিন ওয়ালিদের মত সুযোগ্য সেনাপতির প্রয়োজন । এই স্বার্থে খলিফা এ ধরণের জঘণ্য ও নৃশংস হত্যা কান্ডের বিচার ও প্রয়োজনীয় শাস্তি , খালিদ বিন ওয়ালিদের উপর প্রয়োগ থেকে বিরত খাকলেন ।24 একইভাবে খলিফার প্রশাসন মহানবী (সা.)-এর আত্মীয়- স্বজন ও পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) প্রতি নিয়মিত প্রদত্ত খুমস্ বন্ধ করে দেন ।25 রাসূল (সা.)-এর হাদীস লেখা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় । যদি কখনও লিপিবদ্ধ কোন হাদীস কোথাও কারো কাছে পাওয়া যেত তাহলে সাথে সাথেই তা বাজেয়াপ্ত করা হত এবং পুড়িয়ে ফেলা হত ।26 হাদীস লিপিবদ্ধকরণ নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি সমগ্র খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগে অব্যাহত ছিল । আর তা উমাইয়া খলিফা ওমর বিন আব্দুল আজিজের শাসন আমলে (হিঃ 99 - 102 হিঃ) পর্যন্ত বলবৎ থাকে ।27 দ্বিতীয় খলিফা ওমরের সময় (হিঃ 13 - 25 হিঃ) খেলাফত প্রশাসনের এ রাজনৈতিক পদক্ষেপটি আরও সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে । এ সময় দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইসলামী শরীয়তের বেশ কিছু আইনের পরিবর্তন সাধান করেন । যেমন : হজ্জে তামাত্তু মুতা বিবাহ্ এবং আযান হাইয়্যা আলা খায়রিল আমাল ব্যাক্যটির ব্যাবহার তিনি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন ।28 তিনিই একই বৈঠকে তিন তালাকসহ এজাতীয় আরো অন্য নীতির প্রচলন শুরু করেন ।29

দ্বিতীয় খলিফা ওমর সর্বপ্রথম বাইতুল মালের অর্থ জনগণের মধ্যে বন্টনের সময় বৈষম্যেরে সৃষ্টি করেন ।30 এ বিষয়টি পরবর্তীতে মুসলমানদের মাঝে আশ্চর্যজনক শ্রেণীবৈষম্য এবং ভয়ংকর ও রক্তাক্ত সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটায় । দ্বিতীয় খলিফা ওমরের খেলাফতের সময়েই মুয়াবিয়া সিরিয়ায় রাজপ্রাসাদে বসে শাসনকার্য পরিচালনার মাধ্যমে রাজতন্ত্রের সূচনা করেন । দ্বিতীয় খলিফা ওমর তাকে আরবের কাসূরা (জনৈক বিখ্যাত পারস্য সম্রাটের উপাধি) বা বাদশাহ্ বলে ডাকতেন । তিনি কখনো মুয়াবিয়ার এধরণের কাজের প্রতিবাদ করেননি ।

দ্বিতীয় খলিফা ওমর হিজরী 23 সনে জনৈক পারসিক ক্রীতদাসের হাতে নিহত হন । মৃত্যুর পূর্বে খলিফা ওমরের নির্দেশে 6 সদস্য বিশিষ্ট খলিফা নির্বাচন কমিটি গঠিত হয় । এ কমিটির সংখ্যাধিক্যের মতামতের ভিত্তিতে তৃতীয় খলিফা নির্বাচিত হন ও তার শাসনভার গ্রহণ করেন । তৃতীয় খলিফা ওসমান তার শাসন আমলে উমাইয়া বংশীয় আপন আত্মীয় স্বজনদের ব্যাপক হারে প্রশাসনে নিযুক্ত করার মাধ্যমে উমাইয়্যাদেরকে জনগণের উপর প্রভুত্ব বিস্তারে সহায়তা করেন । হিজাজ (বর্তমান সৌদি আরব) ইরাক ও মিশরসহ অন্যান্য ইসলামী প্রদেশগুলোর শাসনভার তিনি উমাইয়া বংশের লোকজনের উপর অর্পন করেন ।31 এরা সবাই প্রকাশ্যভাবে অন্যায়-অত্যাচার , দূর্নীতি , ইসলামী নীতিমালা লংঘন ও পাপাচার পচলনের মাধ্যমে ইসলামী প্রশাসনে চরম অরাজকতার সূত্রপাত ঘটায় ।32 তৎকালীন ইসলামী বিশ্বের চতুর্দিক থেকে জনগণের অভিযোগ ওসমানের কাছে পৌছতে লাগল । কিন্তু খলিফা ওসমান উমাইয়া বংশীয় ক্রীতদাসী এবং বিশেষ করে জনাব মারওয়ান বিন হাকামের (খলিফার চাচাতো ভাই এবং প্রধানমন্ত্রী) দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবান্বিত ছিলেন । ফলে জনগণের অভিযোগকে তিনি কখনই গুরুত্ব দিতেন না ।

শুধু তাই নয় , মাঝে মাঝে তিনি অভিযোগকারীদের শায়েস্তা করার নির্দেশ জারী করতেন ।33 অবশেষে হিজরী 35 সনে জনগণ খলিফার বিরূদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে । খলিফা ওসমানের বাড়ী বেশ ক দিন ঘেরাও রাখা হয় এবং কিছু সংঘর্ষের পর তারা খলিফাকে হত্যা করে । সিরিয়ার শাসনকর্তা মুয়াবিয়া ছিলেন উমাইয়া বংশের লোক এবং তৃতীয় খলিফা ওসমানের ঘনিষ্ট আত্মীয় । ওসমান তার শাসন আমলে সিরিয়ার প্রশাসনকে অধিক শক্তিশালী করেন । প্রকৃতপক্ষে খেলাফতের গুরুভার ক্রমেই সিরিয়ায় কেন্দ্রীভূত হতে থাকে । যদিও রাষ্ট্র পরিচালনার কাঠামোগত কেন্দ্র ছিল মদীনা । তবে তা একটি বাহ্যিকরূপ ছাড়া আর কিছুই ছিল না ।34

ইসলামের প্রথম খলিফা সাহাবীদের দ্বারা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হন । দ্বিতীয় খলিফা , প্রথম খলিফার ওসিয়াত নামার মাধ্যমে মনোনয়ন লাভ করে ক্ষমতায় আসেন । আর তৃতীয় খলিফা , দ্বিতীয় খলিফার দ্বারা মনোনিত ছয় সদস্য বিশিষ্ট কমিটির মাধ্যমে মনোনীত হন । ঐ কমিটির নির্বাচনের নীতিমালাও পূর্ব থেকেই দ্বিতীয় খলিফার দ্বারা নির্ধারিত হয়েছিল । যাই হোক , ইসলামের প্রথম তিন খলিফা , যাদের শাসনকাল প্রায় পচিশঁ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তাদের গৃহীত রাজনীতির স্বরূপ এটাই ছিল যে , তারা নিজস্ব ইজতিহাদু (গবেষণা) অনুসারে প্রয়োজনীয় যুগপোযাগী সিদ্ধান্ত নিবেন এবং সমাজে তা প্রয়োগ করবেন । ইসলামী জ্ঞান ও সংস্কৃতি প্রসারের ব্যাপারে তাদের নীতি ছিল এই যে , পবিত্র কুরআন , তাফসীর (ব্যাখা) বা গবেষণা ছাড়াই পঠিত হবে । আর রাসূল (সা.) এর হাদীস অলিখিত ভাবে প্রচারিত হবে এবং অবশ্যই তা মৌখিক বর্ণনা ও শবণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে । পবিত্র কুরআনের অনুলিপি তৈরী করণ অত্যন্ত সীমিত ও সুনিয়ন্ত্রিত ছিল । আর হাদীস লিখন ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ।35 হিজরী 12 সনে সংঘটিত ইয়ামামা র যুদ্ধ পর্যন্ত এ অবস্থা বলবৎ ছিল । ঐ যুদ্ধে বেশ কিছু সাহাবী নিহত হন যারা কুরআনের কারী ও হাফেজ ছিলেন । তখন দ্বিতীয় খলিফা ওমর , প্রথম খলিফা আবুব বকরকে সমগ্র কুরআনকে গ্রন্থবদ্ধ আকারে এক যায়গায় সংগৃহীত করার জন্য প্রস্তাব দেন । দ্বিতীয় খলিফা ওমর বিন খাত্তাব বলেন , ভবিষ্যতে যদি এ ভাবে কুরআনের আরও হাফিজ নিহত হন , তাহলে অদুর ভবিষ্যতে আমাদের মধ্যে আর কুরআনের অস্তিত্ব থাকবে না । সুতরাং কুরআনের সব আয়াতগুলো এক যায়গায় সংগ্রহ করে পুস্তক আকারে লিপিবদ্ধ করা প্রয়োজন ।36

এ সিদ্ধান্ত শুধু কুরআনের ক্ষেত্রেই গৃহীত হয় । অথচ রাসূল (সা.)-এর হাদীস , কুরআনের পরই যার অবস্থান , তাও একই বিপদের সম্মুখীন ছিল । কারণ , রাসূল (সা.)-এর হাদিসের ভাবার্থ মুলক বর্ণনা তার পরিবর্তন , পরিবর্ধন সংকোচন , বিস্মৃতি , বিকৃতি ও জালকৃত হওয়ার হাত থেকে আদৌ নিরাপদ ছিল না । কিন্তু রাসূল (সা.)-এর হাদীস সংরক্ষণের ব্যাপারে আদৌ কোন গুরুত্ব দেয়া হয়নি । এমন কি যেখানেই লিপিবদ্ধ কোন হাদীস পাওয়া যেত , সাথে সাথেই তা পুড়িয়ে ফেলা হত । পরিণতিতে অবস্থা এমন এক পর্যায়ে গিয়ে পৌছালো যে , খুব অল্প দিনের মধ্যেই নামায , রোযা.... ইত্যাদির মত ইসলামের অতীব প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর ব্যাপারেও পরস্পর বিরোধী মতামতের সৃষ্টি হল । একইভাবে এ যুগে ইসলামী জ্ঞানবিজ্ঞানের অন্যান্য শাখাগুলোর উন্নয়নের ব্যাপারেও আদৌ কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি । অথচ , পবিত্র কুরআনে ও হযরত রাসূল (সা.)-এর হাদীসে , জ্ঞান অর্জন ও তার প্রসারের ব্যাপারে যে প্রশংসা , অনুপ্রেরণা ও গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে , খেলাফতের যুগে এসে তা সম্পূর্ণ নিস্ক্রীয় ও স্থবির হয়ে পড়ে । অধিকাংশ মুসলমানই তখন একের পর এক রাজনৈতিক বিজয় নিয়ে মেতে ছিল । আর তখন তাদের যুদ্ধলদ্ধ গণিমতের সীমাহীন সম্পদের স্রোত সমগ্র আরব সাম্রাজ্যের দিকে ধাবিত হয়েছিল । যার ফলে নবীবংশের পবিত্র জ্ঞানের ঝর্ণাধারা থেকে উপকৃত হওয়ার ব্যাপারে মুসলমানরা আদৌ কোন গুরুত্ব দেয়নি । ঐ পবিত্র জ্ঞানধারার উৎসমুখ ছিলেন হযরত ইমাম আলী (আ.) তার ব্যাপারে মহানবী (সা.) বলেছেন যে , হযরত আলী (আ.)-ই ইসলাম এবং পবিত্র কুরআন সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানী ব্যক্তি । এমন কি কুরআন সংগ্রহের সময়ও খেলাফত প্রশাসন হযরত আলী (আ.)-কে সে ব্যাপারে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করার অধিকার দেয়নি । শুধু তাই নয় , এ ব্যাপারে তার নামটাও তারা উচ্চারণ করেনি সেদিন । অথচ খেলাফত প্রশাসন এটা ভাল করেই জানতেন যে , রাসূল (সা.)-এর মৃত্যুর পর হযরত আলী (আ.) বহুদিন পর্যন্ত নিজেকে ঘরে আবদ্ধ করে রাখেন । আর ঐ সময়ে তিনি কুরআনের সমগ্র লিপিসমূহকে একর্তিতে ভাবে সংগ্রহ করে ছিলেন ।37 খেলাফত প্রশাসনের এমনই ধরণের আরও অনেক কর্মকান্ড হযরত আলী (আ.) এর ভক্ত ও অনুসারীদের বিশাসকে অধিকতর সূদৃঢ় এবং সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সতর্ক হতে সাহায্য করেছিল । এর ফলে দিনের পর দিন তাদের কার্যক্রমের গতিও বহু গুণে বৃদ্ধি পেতে থাকে । ওদিকে ব্যাপক ভাবে গণ-প্রশিক্ষণের সুযোগ না থাকায় হযরত আলী (আ.) ব্যক্তিগত পর্যায়ে লোক তৈরীর কাজ চালিয়ে যান । এই দীর্ঘ 25 বছরের মধ্যে হযরত আলী (আ.)-এর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চারজন শিষ্য ও আপ্রাণ সহযোগীর তিনজনই পরলোক গমন করেন । যারা ছিলেন হযরত সালমান ফারসী (রা.) , হযরত আবুযার গিফারী (রা.) এবং হযরতুমিকদাদ কিন্তু ইতিমধ্যেই আরও বহু সংখ্যক সাহাবী এবং হেজাজ (বর্তমান সৌদি আরব) , ইয়ামান , ইরাক সহ বিভিন্ন স্থানের অসংখ্য তাবেয়ীন (যারা রাসূলের সাহাবীদের সাক্ষাত লাভ করেছেন) হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর অনুসারীতে পরিণত হন । যার ফলে তৃতীয় খলিফা নিহত হওয়ার পর প্রশাসন রাজ্যের চতুর্দিক থেকে গণসমর্থনের জোয়ার হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর দিকে ধাবিত হয় । সকলে গণভাবে হযরত আলী (আ.)-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন এবং তিনি খলিফা হিসেবে নির্বাচিত হন ।

হযরত আলী ( আ .)- এর খেলাফত ও তার প্রশাসনিক পদ্ধতি

হিজরী 35 সনের শেষ ভাগে হজরত আলী (আ.)-এর খেলাফত কাল শুরু হয় । প্রায় 4 বছর 5 মাস পর্যন্ত এই খেলাফত স্থায়ী ছিল । হযরত আলী (আ.) খেলাফত পরিচালনার ব্যাপারে হযরত রাসূল (সা.)-এর নীতির অনুসরণ করেন ।38 তার পূর্ববতী খলিফাদের যুগে যেসব (ইসলামী নীতি মালার) পরিবর্তন ঘটানো হয়েছিল , তিনি সেগুলোকে পুনরায় পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসেন । খেলাফত প্রশাসনে নিযুক্ত অযোগ্য লোকদের তিনি দায়িত্ব থেকে অপসারণ করেন ।39 তার এসব পদক্ষেপ প্রকৃতপক্ষে এক বৈপ্লবিক আন্দোলন ছিল , যা পরবর্তিতে প্রচুর সমস্যারও সৃষ্টি করেছে । হযরত ইমাম আলী (আ.) খেলাফতের প্রথম দিনে জনগণের উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দিয়েছিলেন সেখানে তিনি বলেন : হে জনগণ! জেনে রেখো নবুয়তের যুগে যে সমস্যায় তোমরা ভুগেছিলে আজ আবার সেই সমস্যাতেই জড়িয়ে পড়লে । তোমাদের মধ্যে একটা ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে । যে সকল মহৎ ব্যক্তিরা এতদিন পিছিয়ে ছিলেন তারা এখন সামনের সারিতে চলে আসবেন । একইভাবে যেসব অযোগ্য লোক এতদিন সামনের সারিতে অবস্থান নিয়েছিল আজ তারা পিছনে চলে যাবে । (সত্য ও মিথ্যা বিদ্যমান এবং এতদুভয়ের প্রত্যেকেরই অনুসারীও রয়েছে । তবে সবারই উচিত সত্যকে অনুসরণ করা) মিথ্যার পরিমাণ যদি অধিকও হয় , সেটা এমন নতুন কিছু নয় । সত্যের পরিমাণ যদি কমও হয় , হোক না! অনেক সময় কমওতো সবার চেয়ে অগ্রগামী হয়ে থাকে । আর উন্নতির আশাও এতের রয়েছে । তবে এমনটি খুব কমই দেখা যায় যে , যা একবার মানুষের হাতছাড়া হয়ে গেছে তা পনুরায় তার কাছে ফিরে এসেছে ।40

এ ভাবে হযরত আলী (আ.) তার বৈপ্লবিক প্রশাসনকে অব্যাহত রাখেন । কিন্তু বৈপ্লবিক আন্দোলন সমূহের স্বাভাবিক পরিণতি হচ্ছে , এই আন্দোলনের ফলে যাদের স্বার্থ বিঘ্নিত হয় , তারা এ ধারার বিরোধী হয়ে ওঠে । আমরা দেখতে পাই হযরত আলী (আ.)-এর খেলাফতের বৈপ্লবিক নীতি বহু স্বার্থন্বেষী মহলকে আঘাত করেছিল । তাই শুরুতেই সারা দেশের যত্রতত্র থেকে আলী (আ.)-এর খেলাফতের বিরোধী সূর বেজে ওঠে । বিরোধীরা তৃতীয় খলিফার রক্তের প্রতিশোধের ষড়যন্ত্র মুলক শ্লোগানের ধুয়া তুলে বেশ কিছু রক্তাক্ত যুদ্ধের অবতারণা করে । এ জাতীয় গৃহযুদ্ধ হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর সমগ্র খেলাফতকালব্যাপী অব্যাহত ছিল । শীয়াদের দৃষ্টিতে ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধার ছাড়া এসব যুদ্ধ সূচনাকারীদের অন্য কোন উদ্দেশ্যই ছিল না ।

তৃতীয় খলিফার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের শ্লোগান ছিল সম্পূর্ণরূপে গণপ্রতারণামূলক একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার । এমনকি কোন ভুল বোঝা বুঝির এখানে অবকাশ নেই ।41

হযরত আলী (আ.)-এর যুগে সংঘটিত প্রথম যুদ্ধ যা জংগে জামাল নামে পরিচিত , তা শুধুমাত্র শ্রেণী বৈষম্যগত মত পার্থক্যের জঞ্জাল বৈ আর কিছুই ছিল না । ঐ মতপার্থক্য দ্বিতীয় খলিফার দ্বারা বাইতুল মালের অর্থ বন্টনে শ্রেণীগত বৈষম্য সৃষ্টির ফলে উদ্ভুত হয়েছিল । হযরত ইমাম আলী (আ.) খলিফা হওয়ার পর ঐ সমস্যার সমাধান ঘটান এবং তিনি জনগণের মধ্যে সমতা ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে বাইতুল মালের অর্থের সুষম বন্টন করেন ।42 আর এটাই ছিল হযরত রাসূল (সা.)-এর জীবনাদর্শ । কিন্তু হযরত আলী (আ.)- এর এ পদক্ষেপ তালহা ও যুবাইরকে অত্যন্ত ক্রোধান্বিত করেছিল । যার ফলে তারা হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর বিরোধীতা করতে শুরু করেন । তারা যিয়ারতের নাম করে মদীনা ছেড়ে মক্কায় গেলেন । উম্মুল মুমেনীন হযরত আয়শা তখন মক্কায় অবস্থান করছিলেন । তারা এটা ভাল করেই জানতেন যে , ইমাম আলী (আ.)-এর সাথে উম্মুল মুমেনীন আয়শার সম্পর্কের টানা পোড়ন চলছে । এ অবস্থাকে তারা আপন স্বার্থে কাজে লাগান এবং নবীপত্মী আয়েশাকে খুব সহজেই হযরত আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে নিজ পক্ষে টেনে নিতে সমর্থ হন । অতঃপর তৃতীয় খলিফার হত্যার বিচারের দাবীর শ্লোগানে আন্দোলন গড়ে তোলেন । অবশেষে জংগে জামাল নামক এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধর সূচনা করেন ।43 অথচ এই প্রসিদ্ধ সাহাবীদ্বয় তালহা ও যুবায়ের বিপ্লবীদের দ্বারা ওসমানের বাড়ী ঘেরাওকালীন মুহুর্তে মদীনাতেই ছিলেন । কিন্তু তৃতীয় খলিফা ওসমানকে শত্রুদের হাত থেকে রক্ষার ব্যাপারে এতটুকু সাহায্যও তারা করেননি ।44 এমনকি খলিফা ওসমান নিহত হওয়ার পর মুহাজিরদের পক্ষ থেকে সর্বপ্রথম তিনিই হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন ।45 ওদিকে নবীপত্নী আয়শাও স্বয়ং ওসমানের বিরোধীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন । তিনি ওসমানকে হত্যার ব্যাপারে সব সময়ই বিরোধীদেরকে উদ্বুদ্ধ করতেন ।46 নবীপত্নী আয়শা ওসমানের নিহত হওয়ার সংবাদ শোনা মাত্রই তার প্রতি অপমান সূচক শব্দ উচ্চারণ করেন এবং আনন্দ প্রকাশ করেন । তৃতীয় খলিফাকে হত্যার ব্যাপারে মূলত রাসূল (সা.)-এর সাহাবীরাই জড়িত ছিলেন । তারা মদীনার বাইরে বিভিন্ন স্থানে চিঠি পাঠানোর মাধ্যমে জনগণকে খলিফার বিরুদ্ধে উত্তেজিত করেন ।

হযরত আলী (আ.)-এর খেলাফতের যুগে দ্বিতীয় যে যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল , তা হচ্ছে সিফফিনের যুদ্ধ । দীর্ঘ দেড়টি বছর এ যুদ্ধ অব্যাহত থাকে । এ যুদ্ধটি ছিল কেন্দ্রীয় খেলাফত প্রসাশন দখলের জন্যে মুয়াবিয়ার চরম লালসার ফসল । তৃতীয় খলিফার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের ছলনাময়ী শ্লোগানের ছত্রছায়ায় তিনি এ যুদ্ধের অবতারণা করেন । এ যুদ্ধে প্রায় এক লক্ষ্যেরও বেশী লোক অন্যায়ভাবে নিহত হন । এ যুদ্ধে মুয়াবিয়াই ছিলেন প্রথম আক্রমনকারী । এটা কোন আত্মরক্ষামুলক যুদ্ধ ছিল না । বরং এটা ছিল মুয়াবিয়ার পক্ষ থেকে একটি আক্রমনাত্মক যুদ্ধ । কারণ , প্রতিশোধ গ্রহণ মূলক যুদ্ধ কখনই আত্মরক্ষামূলক হতে পারে না । এ যুদ্ধের শ্লোগান ছিল তৃতীয় খলিফার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ । অথচ তৃতীয় খলিফা তার জীবনের শেষ দিনগুলোতে দেশের রাজনৈতিক অরাজকতা ও বিশৃংখলা দমনে মুয়াবিয়ার কাছে সাহা্য্য চেয়ে পাঠান । মুয়াবিয়াও তার সেনাবাহিনীসহ সিরিয়া থেকে মদিনার দিকে অগ্রসর হন । কিন্তু মুয়াবিয়া উদ্দেশ্য মূলক ভাবে পথিমধ্যে এত বেশী দেরী করেন যে , ততদিনে তৃতীয় খলিফা বিপ্লবীদের হাতে নিহত হন । এ সংবাদ পাওয়া মাত্রই মুয়াবিয়া তার বাহিনী সহ সিরিয়ায় ফিরে যান । এর পর সিরিয়ায় ফিরে গিয়ে তিনি তৃতীয় খলিফার হত্যার বিচারের দাবীতে বিদ্রোহ শুরু করেন ।47 সিফফিন যুদ্ধের পর নাহরাওয়ান যুদ্ধ সংঘটিত হয় । রাসূল (সা.)-এর বেশ কিছু সাহাবীও এ যুদ্ধে জড়িত ছিলেন । একদল লোক যারা সিফফিনের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিল , তারাই পরবর্তিতে আবার মুয়াবিয়ার প্ররাচণায় হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে । তারা তদানিন্তন ইসলামী খেলাফত বা রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক বিশৃংখলা সৃষ্টি করতে থাকে । তারা হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর অনুসারী বা সমর্থকদের সন্ধান পাওয়া মাত্রই তাদেরকে হত্যা করত । এমন কি গর্ভবতী মহিলাদের পেট চিরে গর্ভস্থ সন্তানকে বের করে তাদের মাথা কেটে হত্যা করত ।48

সিফফিন যুদ্ধের পর মুয়াবিয়ার প্ররাচণায় সংঘটিত এ-বিদ্রোহও হযরত ইমাম আলী (আ.) দমন করেন । কিন্তু এর কিছুদিন পরই একদিন কুফা শহরের এক মসজিদে নামাযরত অবস্থায় ঐসব খাওয়ারেজদের হাতেই তিনি শাহাদৎ বরণ করেন ।


3

4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18