ইসলাম ও শীয়া মাযহাব

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব 16%

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 31 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 41887 / ডাউনলোড: 5859
সাইজ সাইজ সাইজ
ইসলাম ও শীয়া মাযহাব

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

‘ইসলাম ও শীয়া মাযহাব’ নামক এ গ্রন্থে ইসলামের দু’টি বৃহৎ উপদলের (শীয়া ও সুন্নী) অন্যতম শীয়া মাযহাবের প্রকৃত পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে । শীয়া মাযহাবের উৎপত্তি, বিকাশ ও চিন্তাধারার প্রকৃতি এবং ইসলামী জ্ঞানের ব্যাপারে শীয়া মাযহাবের দৃষ্টিভঙ্গী এ বইয়ে আলোচিত হয়েছে ।


1

2

3

4

5

ইমাম পরিচিতি

ইমাম শব্দের অর্থ

ইমাম বা নেতা তাকেই বলা হয় , যে একদল লোককে নির্দিষ্ট কোন সামাজিক , রাজনৈতিক , বৈজ্ঞানিক অথবা ধর্মীয় লক্ষ্যে পৌছানোর জন্যে নেতৃত্ব প্রদানের দায়িত্ব গ্রহণ করে । অবশ্য নেতা তার নেতৃত্বের পরিধির বিস্তৃতি ও সংকীর্ণতার ক্ষেত্রে সময় ও পরিবেশগত পরিস্থিতির অনুসারী পবিত্র ইসলাম ধর্ম (যেমনটি পূর্বে আলোচিত হয়েছে) মানব জীবনের সকল দিক পর্যবেক্ষণপূর্বক তার জন্যে নীতিমালা প্রণয়ন করেছে ।

ইসলাম মানুষের আধ্যাত্মিক জীবন বিশ্লেষণপূর্বক তার জন্যে প্রয়োজনীয় পথনির্দেশ দান করেছে । পার্থিব জীবনের ক্ষেত্রে এবং মানুষের ব্যক্তিগত জীবন যাপন ও তার পরিচালনার ব্যাপারেও ইসলামের হস্তক্ষেপ রয়েছে । ঠিক একইভাবে মানুষের সামাজিক (পার্থিব) জীবন ও তার পরিচালনার (রাষ্ট্রিয় ব্যবস্থা) ক্ষেত্রেও ইসলামের নির্দেশ রয়েছে ।

উপরে মানব জীবনের যেসব দিক সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে , তার ভিত্তিতে ইসলামী নেতৃত্ব তিনটি দিকে গুরুত্বের অধিকারী । সেই দিক গুলো হচ্ছে : ইসলামী শাসন ব্যবস্থা , ইসলামী জ্ঞানমালা ও আইন কানুন বর্ণনা এবং আধ্যাত্মিক জীবনে নেতৃত্ব ও পথ নির্দেশনার দিক । শীয়াদের দৃষ্টিতে ইসলামী সমাজের জন্যে উক্ত গুরুত্বপূর্ণ তিনটি দিকের নেতৃত্ব দানের জন্যে নেতার প্রয়োজন অপরিহার্য । যিনি ইসলামী সমাজের এ তিনটি দিকের উপযুক্ত নেতৃত্ব দেবেন অবশ্যই তাকে মহান আল্লাহ ও তার রাসূল (সা.)-এর দ্বারা মনোনীত হতে হবে । অবশ্য মহান আল্লাহর নির্দেশে বিশ্বনবী (সা.) এই মনোনয়ন কার্য সম্পন্নও করে গেছেন ।

ইমামত এবং ইসলামী শাসনব্যবস্থা ও মহানবী (সা.)-এর উত্তরাধিকার

মানুষ তার খোদাপ্রদত্ত স্বভাব দিয়ে অতি সহজেই এ বিষয়টি উপলদ্ধি করে যে , কোন দেশ , শহর গ্রাম বা গোত্র এবং এমনকি গুটি কয়েক লোক সম্বলিত কোন একটি সংসারও একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির নেতৃত্ব ছাড়া চলতে পারে না । একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির নেতৃত্ব ছাড়া সমাজের চাকা সচল রাখা সম্ভব নয় । একজন নেতার ইচ্ছাই সমাজের অসংখ্য ব্যক্তির ইচ্ছার উপর প্রভুত্ব করে । এভাবে সে সমাজের প্রতিটি ব্যক্তিকে তার সামাজিক দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করে । সুতরাং একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির নেতৃত্ব ছাড়া সমাজের গতি অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে না । তাই অতি অল্প সময়ের মধ্যেই নেতাহীন ঐ সমাজ ছত্রভঙ্গ হয়ে যেতে বাধ্য ।

যার ফলে এক ব্যাপক অরাজকতা ঐ সমাজকে ছেয়ে ফেলবে । সুতরাং , উক্ত যুক্তির উপর ভিত্তি করে নিঃসন্দেহে এ কথা বলা যায় যে , সমাজ পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত (সে সমাজ বৃহত্তরই হোক অথবা ক্ষুদ্র তরই হোক) নেতা , সমাজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে যার অবদান অনস্বীকার্য তিনি যদি কখনও অস্থায়ীভাবে অথবা স্থায়ীভাবে তার পদ থেকে অনুপস্থিত থাকেন , তাহলে অবশ্যই তার ঐ অনুপস্থিতকালীন সময়ের জন্যে অন্য কাউকে দায়িত্বশীল হিসেবে নিয়োজিত করে যাবেন । এধরণের দায়িত্বশীল কোন নেতা কোনক্রমেই এমন কাজ করতে প্রস্তুত হবেন না , যার ফলে নিজের দায়িত্বের পদ থেকে সরে দাড়ানোর কারণে নেতার অভাবে ঐ সমাজের অস্তিত্ব ধ্বংসোন্মুখ হয়ে পড়বে । কোন পরিবারের কর্তাব্যক্তিও যদি কিছুদিনের জন্যে অথবা কয়েক মাসের জন্যে পরিবারের সদস্যদের ত্যাগ করে দূরে কোথাও ভ্রমনে যান । তখন অবশ্যই তিনি তার অনুপস্থিতকালীন সময়ে সংসার পরিচালনার জন্যে পরিবারের কাউকে (অথবা তৃতীয় কোন ব্যক্তিকে) দায়িত্বশীল হিসাবে নিয়োগ করে যান । কোন প্রতিষ্ঠানের পরিাচালক বা স্কুলের প্রধান শিক্ষক অথবা দোকানের মালিক , যাদের অধীনে বেশ ক জন কর্মচারী কর্মরত , তারা যদি অল্প ক ঘন্টার জন্যেও কোন কারণে কর্মস্থল ত্যাগ করেন , তাহলে অধীনস্থ কাউকে তার অনুপস্থিতকালীন সময়ে তার দায়িত্ব পালনের জন্যে নিযুক্ত করে যান । আর অন্যদেরকে ঐ নবনিযুক্ত দায়িত্বশীলের আনুগত্য করার নির্দেশ দেন । ইসলাম এমন এক ধর্ম , যা খোদাপ্রদত্ত মানব প্রকৃতি অনুযায়ী পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত । ইসলাম একটি সামাজিক আদর্শ যার প্রকৃতি এমন এক দৃষ্টান্ত মূলক যে , পরিচিত ও অপরিচিত সবাই ঐ আদেশের দর্পন থেকে এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে বুঝতে পারে । মহান আল্লাহ ও বিশ্বনবী (সা.) এই আদেশের সামাজিকতার ক্ষেত্রে যে মহান অবদান রেখেছেন , তা সবার কাছেই অনস্বীকার্য । এই ঐশী আদর্শ পৃথিবীর অন্য কিছুর সাথেই তুলনাযোগ্য নয় । মহানবী (সা.)- ও ইসলামের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন সামাজিক বিষয়ই পরিত্যাগ করতেন না । যখনই কোন শহর বা গ্রাম মুসলমানদের দ্বারা বিজিত হত , সম্ভাব্য সংক্ষিপ্ত সময়ে বিশ্বনবী (সা.) তার পক্ষ থেকে কাউকে ঐ অঞ্চলের শাসনকর্তা ও স্বীয় প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে পাঠাতেন । এমনকি জিহাদ পরিচালনার উদ্দেশ্যে প্রেরিত সেনাবাহিনীর জন্যে প্রয়োজন বোধে (অত্যাধিক গুরুত্বের কারণে) একাধিক সেনাপতিও তিনি নিযুক্ত করতেন । এমনকি ঐতিহাসিক মুতার যুদ্ধে বিশ্বনবী (সা.) চারজন সেনাপতি নির্বাচন করেছিলেন । যাতে প্রথম সেনাপতি শাহাদত বরণ করলে দ্বিতীয় সেনাপতি দায়িত্ব গ্রহণ করবেন । দ্বিতীয়জন শাহাদত বরণ করলে তৃতীয়জন দায়িত্ব গ্রহণ করবেন । আর এইভাবে এ ধারা বাস্তবায়িত হবে । রাসূল (সা.)-এর এসকল কার্যের মাধ্যমেই নেতা নিয়োগের গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে যায় । একইভাবে বিশ্বনবী (সা.) তার স্বীয় উত্তরাধিকারের বিষয়েও সম্পূর্ণ সজাগ ছিলেন । তিনি স্বীয় উত্তরাধিকারী নির্ধারণের ব্যাপারে কখনোই পিছপা হননি । যখনই তিনি প্রয়োজন বোধে মদীনার বাইরে যেতেন , তখনই তিনি কাউকে তার স্থলাভিষিক্ত করে যেতেন । এমন কি যখন তিনি মদীনার উদ্দেশ্যে মক্কা নগরী ত্যাগ করে ছিলেন , যখন কেউই সে সংবাদ সম্পর্কে অবহিত ছিল না তখনও মাত্র অল্প ক দিনের জন্য স্বীয় ব্যক্তিগত দায়িত্ব পালন ও জনগণের গচ্ছিত আমানত দ্রব্যাদি মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার জন্যে মক্কায় হযরত ইমাম আলী (আ.)-কে নিজের স্থলাভিষিক্ত করে যান । এভাবেই বিশ্বনবী (সা.) মৃত্যুর পূর্বে স্বীয় ঋণ পরিশোধ ও বিশ্বাসগত অসমাপ্ত কার্যাবলী সম্পাদনের জন্যে ইমাম আলী (আ.)-কে নিজের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে নির্বাচিত করেছিলেন । তাই শীয়ারা বলে : উপরোক্ত দলিলের ভিত্তিতে এটা আদৌও কল্পনাপ্রসূত নয় যে , বিশ্বনবী (সা.) মৃত্যুর পূর্বে কাউকে তার উত্তরাধিকারী বা স্থলাভিষিক্ত ´ হিসেবে নির্বাচিত করে যাননি । মুসলমানদের প্রশাসনিক কাজ পরিচালনা এবং ইসলামী সমাজের চালিকা শক্তি নিয়ন্ত্রণের জন্যে কাউকেই মহানবী (সা.) মনোনীত করে যাননি , এটা এক কল্পনাতীত ব্যাপার বটে । এক শ্রেণীর আইন-কানুন ও কিছু সাধারণ আচার অনুষ্ঠান , যা সমাজের অধিকাংশ জনগণের দ্বারা বাস্তবে স্বীকৃত ও সমর্থিত , তার উপর ভিত্তি করেই একটি সমাজের সৃষ্টি হয় । আর ঐ সমাজের অস্তিত্ব টিকে থাকার বিষয়টি সম্পূর্ণ রূপে ন্যায়বিচার ভিত্তিক ও দায়িত্বশীল একটি প্রশসানের অস্তিত্বের উপরই নির্ভরশীল । এটা এমন কোন বিষয় নয় যে , মানব প্রকৃতি এর গুরুত্ব ও মূল্য সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করবে । কোন বিজ্ঞ ব্যক্তির কাছেও এটা কোন অজ্ঞাত বিষয় নয় এবং এটা ভোলার বিষয়ও নয় , কারণ , ইসলামী শরীয়তের (বিধান) সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ ও বিস্তৃতি একটি সন্দেহাতীত ব্যাপার । আর এ ব্যাপারটিও অনস্বীকার্য যে , বিশ্বনবী (সা.) এ ব্যাপারে অত্যাধিক গুরুত্বারোপ করতেন এবং এপথে তিনি নিজের সর্বস্ব উৎসর্গ করেছেন । তার ঐ আত্মত্যাগ , অসাধারণ চিন্তাশক্তি , প্রজ্ঞার শ্রেষ্ঠত্ব , সূক্ষ্ণ ও সঠিক দৃষ্টিভঙ্গী এবং সূক্ষ্ণ বিশ্লেষণ ক্ষমতার (ওহী ও নবুয়তের সাক্ষ্য ছাড়াও) বিষয়টি নিঃসন্দেহে বিতর্কের উর্ধ্বে । শীয়া ও সুন্নী উভয় দলেরই মত নির্বিশেষে বর্ণিত মুতাওয়াতির হাদীস অনুযায়ী ( ফিৎনা অধ্যায়ের হাদীস) বিশ্বনবী (সা.) তার অন্তর্ধানের পর ইসলামী সমাজ যেসব দূর্নীতিমূলক সমস্যায় আক্রান্ত হবে , তার ভবিষ্যৎবাণী করেছেন । ঐসব সমস্যার মধ্যে যেসব সমস্যাগুলো ইসলামকে অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্থ করেছে , উমাইয়া বংশ সহ আরও অন্যান্যদের খেলাফত লাভের বিষয়টি তার মধ্যে অন্যতম । কারণ : তারা ইসলামের পবিত্র আদর্শকে তাদের বিভিন্ন ধরণের অপবিত্রতা ও অরাজকতামূলক জঘণ্য কাজে ব্যাবহার করেছে । এ ব্যাপারে বিশ্বনবী (সা.) তার হাদীসে বিস্তারিতভাবে ভবিষ্যৎবাণী করেছেন । বিশ্বনবী (সা.) তার মৃত্যুর হাজার হাজার বছর পরের ইসলামী সমাজের খুটিনাটি বিষয়াদি ও সমস্যা সম্পর্কে তিনি অত্যন্ত সচেতন এবং সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ভবিষ্যৎবাণীও করে গেছেন । তাহলে এটা কি করে সম্ভব যে , যিনি তার পরবর্তী সুদুর ভবিষ্যতের ব্যাপারে এত সচেতন , অথচ স্বীয় মৃত্যু পরবর্তী মূহুর্তগুলোতে সংঘটিত ঘটনাবলীর ব্যাপারে আদৌ সচেতন নন ?! বিশ্বনবী (সা.)-এর পরবর্তী উত্তরাধিকারের মত এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি কি তাহলে তিনি ইচ্ছাকৃত ভাবে অবহেলা করেছেন , অথবা এটাকে গুরুত্বহীন একটি বিষয় হিসেবে গণ্য করেছেন ? এটা কেমন করে সম্ভব যে , খাওয়া পরা , ঘুমানো এবং যৌন বিষয়াদির মত মানব জীবনের শতশত খুটিনাটি বিষয়ের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশ তিনি জারী করেছেন , অথচ ঐ ধরণের একটি অতি মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তিনি সম্পূর্ণরূপে নীরবতা পালন করেছেন ? নিজের উত্তরাধিকারীকে তিনি মনোনীত করে যাননি ? ধরে নেয়া যাক (যদিও এটা অসম্ভব একটি ধারণা) যে , মহানবী (সা.) তার স্থলাভিষিক্ত নির্বাচনের দায়িত্বভার মুসলমানদের উপরে ছেড়ে দিয়েছেন , তাহলে এ ব্যাপারে অবশ্যই বিশ্বনবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট বর্ণনা থাকার কথা । এ ব্যাপারে অবশ্যই জনগণের প্রতি তার প্রয়োজনীয় নির্দেশনা থাকা উচিত । কারণঃ ইসলামী সমাজের অস্তিত্ব ও বিকাশ এবং ইসলামী নিদর্শনাবলীর অস্তিত্ব এ বিষয়টির উপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল । তাই এ ব্যাপারে সমগ্র মুসলিম উম্মতকে সদা সচেতন থাকতে হবে । অথচ , এ ব্যাপারে বিশ্বনবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট কোন নির্দেশনার অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যায় না । কারণ যদি এমন সুস্পষ্ট কোন নির্দেশনার অস্তিত্ব থাকত , তাহলে নিশ্চয়ই বিশ্বনবী (সা.)-এর পরে তার স্থলাভিষিক্তের পদাধিকারী নির্ধারণের ব্যাপারে এত মতভেদের সৃষ্টি হত না । অথচ আমরা দেখতে পাই যে , প্রথম খলিফা ওসিয়তের ( উইল ) মাধ্যমে দ্বিতীয় খলিফার কাছে খেলাফত হস্তান্তর করেছিলেন ।

দ্বিতীয় খলিফা তার মৃত্যু পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের ব্যাপারে একটি খলিফা নির্বাচন কমিটি গঠন করেছিলেন । ছয় সদস্য বিশিষ্ট ঐ কমিটির প্রতিটি সদস্যই দ্বিতীয় খলিফার দ্বারা মনোনীত হয়েছিলেন । ঐ কমিটির খলিফা নির্বাচন সংক্রান্ত মূলনীতিও তিনি নিজেই নির্ধারণ করেছিলেন । যার ভিত্তিতেই তৃতীয় খলিফা নির্বাচিত হন । তৃতীয় খলিফা নিহত হওয়ার পর চতুর্থ খলিফা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হন । ইমাম হাসান (পঞ্চম খলিফা) চতুর্থ খলিফার ওসিয়তের (উইল) মাধ্যমে নির্বাচিত হন । এরপর মুয়াবিয়া পঞ্চম খলিফা হযরত ইমাম হাসান (আ.)-কে বলপূর্বক সন্ধিচুক্তিতে বাধ্য করার মাধ্যমে খেলাফতের পদটি ছিনিয়ে নেন । তারপর থেকেই খেলাফত রাজতন্ত্রে রূপান্তরিত হয় । আর তখন থেকেই জিহাদ , সৎকাজে আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ , ইসলামী দন্ড বিধি প্রয়োগ , ইত্যাদি ইসলামী নির্দেশনাবলী একের পর এক ক্রমান্বয়ে ইসলামী সমাজ থেকে উধাও হতে থাকে । এভাবে বিশ্বনবী (সা.)- এর সারা জীবনের লালিত সাধানা ধুলিসাৎ হয়ে গেল ।১৫৭ শীয়ারা আল্লাহ প্রদত্ত মানব প্রকৃতি এবং জ্ঞানী ও প্রজ্ঞা সম্পন্ন ব্যক্তিদের জীবনাদর্শ অনুযায়ী এ বিষয়ে ব্যাপক পর্যালোচনা ও অনুসন্ধান চালায় । তারা ফিৎরাত বা মানব প্রকৃতি সঞ্জীবনী ইসলামী আদেশের মূল দৃষ্টিভঙ্গীর প্রতি গভীর দৃষ্টিপাত , মহানবী (সা.)-এর অনুসৃত সামাজিক পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ এবং মহানবী (সা.)-এর মৃত্যু পরবর্তী দুঃখজনক ঘটনাবলী অধ্যয়ন করে । মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুর পর ইসলাম ও মুসলমানরা যেসব দূর্দশা ও জটিল সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছিল তারও আদ্যোপান্ত আলোচনা করে । এছাড়াও ইসলামের প্রাথমিক যুগের ইসলামী প্রশাসকদের ইসলামের ব্যাপারে ইচ্ছাকৃত উদাসীনতার বিষয়টিও সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণভাবে বিশ্লেষণ করে । উক্ত গবেষণার মাধ্যমে শীয়ারা একটি সুনিশ্চিত ফলাফলে পৌছুতে সক্ষম হয় । আর তা হচ্ছে এই যে , বিশ্বনবী (সা.)-এর পরবর্তী স্থলাভিষিক্ত নির্ধারণের ব্যাপারে তার পক্ষ থেকে যথেষ্ট পরিমাণ বর্ণনার অস্তিত্ব ইসলামে বিদ্যমান । এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনের বহু আয়াত এবং বিশ্বনবী (সা.)-এর বর্ণিত অসংখ্য হাদীস রয়েছে , যার সত্যতা ও নির্ভরযোগ্যতা অকাট্যরূপে প্রমাণিত ও সর্বজনস্বীকৃত । এ ব্যাপারে বিলায়ত সংক্রান্ত আয়াত এবং গাদীরে খুমের হাদীস , সাফিনাতুন নুহ -এর হাদীস , হাদীসে সাকালাইন হাদীসে হাক্ক হাদীসে মানযিলাত নিকট আত্মীয়দের দাওয়াত সংক্রান্ত হাদীস সহ আরও অসংখ্য হাদীসের কথা উল্লেখযোগ্য ।১৫৮

উপরোক্ত আয়াত ও হাদীস সমূহের বক্তব্যে শীয়াদের বক্তব্যেরই সমর্থন পাওয়া যায় । অবশ্য ঐসব হাদীসের যথেষ্ট অপব্যাখা করা হয়েছে । আর এই অপব্যাখার মাধ্যমে ঐগুলোর মূল অর্থকে গোপন রাখার চেষ্টা করা হয়েছে ।

পূ্র্বোক্ত আলোচনার পক্ষে কিছু কথা

বিশ্বনবী (সা.) জীবনের শেষ দিনগুলো যখন অসুস্থ অবস্থায় কাটাচ্ছিলেন । তখন একদল সাহাবী রাসূল (সা.)-এর কাছে উপস্থিত ছিলেন । হযরত রাসূল (সা.) সাহাবীদেরকে নির্দেশ দিলেন : আমার জন্যে কাগজ ও কলম নিয়ে এসো । কারণ , আমি এমন কিছু তোমাদের জন্য লিখে রেখে যেতে চাই , যা মেনে চললে তোমারা কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না । উপস্থিত সাহাবীদের মধ্যে কিছু লোক বললো : এ লোক তো অসুস্থতার ফলে প্রলাপ ( ?) বকছে । কারণ , আল্লাহর কুরআনই তো আমাদের জন্যে যথেষ্ট !! এ নিয়ে উপস্থিত সাহাবীদের মধ্যে হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল । রাসূল (সা.)-এ অবস্থা দেখে বললেন : তোমারা এখান থেকে উঠে পড় । আমার কাছ থেকে দুর হয়ে যাও । আল্লাহর রাসূলের কাছে হৈ চৈ করা উচিত নয়১৫৯

পূ্র্বোক্ত অধ্যায়ের বিষয়বস্তু এবং এ অধ্যায়ে বর্ণিত ঘটনা প্রবাহ যদি আমরা আলোচনা করি , তাহলে দেখতে পাব যে , যারা রাসূল (সা.)-এর ঐ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সেদিন বাধা প্রদান করেছিল , তারাই রাসূল (সা.)-এর মৃত্যুর পর খেলাফত নির্বাচনের ঘটনা থেকে লাভবান হয়েছিল । বিশেষ করে তারা হযরত আলী (আ.) ও তার অনুসারীদের অজ্ঞাতসারেই খেলাফত নির্বাচনের পর্বটি সম্পন্ন করে ।

তারা হযরত আলী (আ.) ও তার অনুসারীদের বিপরীতে ঐ কাজটি সম্পন্ন করেছিল । এরপর সন্দেহের কোন অবকাশ থাকে না যে , উপরোক্ত হাদীসে বর্ণিত ঘটনায় মহানবী (সা.) তার পরবর্তী উত্তরাধিকারী বা স্থলাভিষিক্ত হিসেবে হযরত আলী (আ.)-এর নাম ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন । মহানবী (সা.)-এর নির্দেশ বাস্তবায়নে বাধা প্রদানপূর্বক ঐ ধরণের কথা বলার মাধ্যমে কথা কাটা-কাটি বা বিতর্ক সৃষ্টিই ছিল মূল উদ্দেশ্য , যাতে করে এর ফলে মহানবী (সা.) তার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন থেকে বিরত হতে বাধ্য হন । সুতরাং অসুস্থতাজনিত প্রলাপ বকার কারণে তার নির্দেশ বাস্তবায়নে বাধা দেয়াই তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল না । কারণ ,

প্রথমত : আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর পবিত্র মুখ থেকে অসুস্থ কালীন সময়ে অসংলগ্ন একটি কথাও শানা যায়নি । আর এ যাবৎ এ ধরণের কোন ঘটনাও (অসংলগ্ন কথাবার্তা) কেউই বর্ণনা করেনি । ইসলাম নির্ধারিত নীতিমালা অনুযায়ী কোন মুসলমানই মহানবী (সা.)- এর প্রতি প্রলাপ বকার ( ?) মত অপবাদ আরোপ করতে পারে না । কারণ , আল্লাহর রাসূল (সা.) ছিলেন ঐশী ইসমাত বা নিষ্পাপ হওয়ার গুণে গুণান্বিত ।

দ্বিতীয়ত : যদি তাদের কথা (প্রলাপ বকার মিথ্যা অভিযোগ সত্যই হত , তাহলে এর পরের কথাটি (কুরআনই আমাদের জন্যে যথেষ্ট) বলার কোন প্রয়োজন হত না । কারণঃ তাদের পরবর্তী কথার অর্থ হচ্ছে , কুরআনই তাদের জন্যে যথেষ্ট , এরপর রাসূল (সা.)-এর বক্তব্যের কোন প্রয়োজন নেই । কিন্তু রাসূল (সা.) এর সাহাবীরা ভাল করেই জানতেন যে , পবিত্র কুরআনই মহানবী (সা.) এর অনুসরণকে সবার জন্যে ফরজ হিসেবে ঘোষণা করেছে । রাসূল (সা.)-এর বাণীকে আল্লাহর বাণীরই মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে । পবিত্র কুরআনের সুস্পষ্ট দলিল অনুসারে আল্লাহ ও তার রাসূল (সা.)-এর নির্দেশের মোকাবিলায় মানুষের ইচ্ছার কোন স্বাধীনতা বা অধিকার নেই ।

তৃতীয়ত : প্রথম খলিফার মৃত্যুর সময় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল । তখন প্রথম খলিফা তার পরবর্তী খলিফা হিসেবে দ্বিতীয় খলিফার নামে খেলাফতের ওসিয়ত (উইল) লিখে যান । তৃতীয় খলিফা ওসমান যখন প্রথম খলিফার নির্দেশে উক্ত ওসিয়ত (উইল) লিখছিলেন , তখন প্রথম খলিফা সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন । কিন্তু , তখন বার দ্বিতীয় খলিফা প্রথম খলিফার ব্যাপারে মোটেই প্রতিবাদ করেননি , যে প্রতিবাদটি তিনি আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর ব্যাপারে করেছিলেন ।১৬০

এ ছাড়া হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণিত হাদীসে১৬১ দ্বিতীয় খলিফার যে স্বীকারোক্তি উল্লিখিত হয়েছে , তাতে তিনি বলেছেনঃ আমি বুঝতে পরে ছিলাম যে আল্লাহর রাসূল (সা.) আলীর খেলাফতের বিষয়টি লিখে দিতে চেয়েছিলেন । কিন্তু বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে তা আমি হতে দেইনি । তিনি আরও বলেন যে আলীই ছিল খেলাফতের অধিকারী ।১৬২ কিন্তু সে যদি খেলাফতের আসনে বসত , তাহলে জনগণকে সত্যপথে চলার জন্যে উদ্বুদ্ধ করত । কিন্তু কুরাইশরা তার আনুগত্য করত না । তাই আমি তাকে খেলাফতের পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছি !!!

ইসলামের নীতি অনুযায়ী সত্য প্রত্যাখানকারীদের জন্যে সত্যবাদীদেরক পরিত্যাগ না করে বরং সত্য প্রত্যাখানকারীদেরকে সত্য গ্রহণে বাধ্য করা উচিত । যখন প্রথম খলিফার কাছে সংবাদ পৌছলো যে মুসলমানদের একটি গোত্র যাকাত প্রদানে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে , তৎক্ষণাত তিনি তাদের সাথে যুদ্ধের নির্দেশ দিলেন এবং বললেন : আল্লাহ রাসূল (সা.) কে মাথার রূমাল বাধার যে দড়ি দেয়া হত , তা যদি আমাকে না দেয়া হয় , তাহলেও তাদের সাথে আমি যুদ্ধে অবতির্ণ হব ।১৬৩ অবশ্য এ বক্তব্যের উদ্দেশ্য হচ্ছে , যে কোন মূল্যের বিনিময়েই হোক না কেন , সত্যকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে । অথচ , সত্য ভিত্তিক খেলাফতের বিষয়টি মাথার রূমাল বাধার দড়ির চেয়ে অবশ্যই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান ছিল ।

আমরা এবং ইসলাম

ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুযায়ী আমরা ইরানীরা কয়েক সহস্রাব্দ ধরে বিশ্বের বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর সঙ্গে বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে কখনও বন্ধুত্বপূর্ণ আবার কখনও শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি করেছি। এ সম্পর্কের কারণে তাদের অনেক চিন্তা ও বিশ্বাস যেমন আমাদের মধ্যে এসেছে তেমনি আমাদের অনেক চিন্তা ও বিশ্বাসও তাদের ওপর প্রভাব ফেলেছে। যখনই অন্য জাতি ও গোষ্ঠীর জাতিসত্তা ও প্রভুত্বের কথা এসেছে আমরা তাদের মাঝে বিলুপ্ত হইনি ;বরং অন্য জাতিসত্তাকে প্রতিরোধ করেছি। তবে আমরা নিজ জাতিসত্তাকে ভালবাসার কারণে এটি করলেও এর মধ্যে কোন গোঁড়ামি বা অন্ধ বিশ্বাস ছিল না। কারণ মনের কোন অন্ধত্বই আমাদের সত্য হতে দূরে রাখতে এবং সত্যের বিরোধী ও শত্রু করতে পারেনি।

হাখামানেশী রাজত্বের সময় যখন ইরান বর্তমান সীমার বাইরেও পার্শ্ববর্তী কয়েকটি দেশসহ একই রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল তখন হতে বর্তমানে দু হাজার পাঁচশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। পঁচিশ শতাব্দীর মধ্যে চৌদ্দ শতাব্দী ধরে আমরা ইসলামের ছায়ায় বাস করছি এবং এ ধর্ম আমাদের জীবনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে। এ দীনের রীতি ও শিক্ষাতেই আমরা আমাদের শিশুদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেছি ,আমাদের জীবন পরিচালিত করেছি ,এক আল্লাহর ইবাদাত করেছি ,এ দীনের রীতিতেই আমাদের মৃতদের কবরস্থ করেছি। আমাদের ইতিহাস ,রাজনীতি ,বিচার ব্যবস্থা ,আইন ,সংস্কৃতি ,সভ্যতা ,সামাজিক আচার-এক কথায় সকল কিছু ইসলামের সঙ্গে মিশে গেছে। সকল জ্ঞানী ব্যক্তিই স্বীকার করেছেন ,ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে শতাব্দীকাল ধরে আমরা অসাধারণ ও মহা মূল্যবান অবদান রেখেছি যা ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না ,এমনকি অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে দীনের প্রচার-প্রসার এবং উন্নয়নে আরবদের চেয়েও অধিক অবদান রেখেছি। কোন জাতিই আমাদের মত এ দীনের প্রচার-প্রসার ও বিস্তৃতিতে ভূমিকা রাখতে পারেনি।

এ জন্যই ইসলাম ও ইরানের সম্পর্ককে বিভিন্ন আঙ্গিকে পর্যালোচনার অধিকার আমরা রাখি। ইসলামী জ্ঞানের প্রসারে আমাদের ভূমিকা এবং আমাদের আত্মিক ও বস্তুগত উন্নয়নে ইসলামের অবদান পূর্ণাঙ্গ ও যথার্থরূপে ঐতিহাসিক নির্ভরযোগ্য প্রমাণসহ স্পষ্ট করে তুলে ধরতেই আমাদের এ আলোচনা।

বর্তমান সময়ে জাতি আরাধনা

বর্তমান শতাব্দীর বহুল আলোচিত বিষয়গুলোর একটি হলো জাতীয়তা। সাম্প্রতিক সময়ে অনেক জাতিগোষ্ঠীই ,এমনকি মুসলমানদের মধ্যে ইরানী ও অ-ইরানী সকলেই এ বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। তাদের অনেকে এ আলোচনায় এতটা ডুবে গিয়েছেন ,যার কোন সীমা-পরিসীমা নেই।

বাস্তবতা হলো বর্তমান সময়ে জাতীয়তাবাদ মুসলিম বিশ্বের জন্য এক বিরাট সমস্যা। জাতীয়তাবাদের ধারণা ইসলামী মৌল প্রশিক্ষণের নীতির বিরোধী ও এ চিন্তাধারা মুসলিম ঐক্যের পথে বড় প্রতিবন্ধক।

আমরা জানি ইসলামী সমাজ বিভিন্ন জাতির সমন্বয়ে গঠিত এবং অতীতে ইসলাম বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে ইসলামী সমাজের ছায়ায় একত্রিত করেছে। এ একতা এখনও বাস্তবে বিদ্যমান। এটি বাস্তব সত্য ,এখনও সত্তর কোটি1 মানুষের বৃহত্তর একটি জনগোষ্ঠী এক চিন্তা ,মূল্যবোধ ,অনুভূতি এবং সহাবস্থানের ধারণায় বিশ্বাসী। তাদের মধ্যে যে বিচ্ছিন্নতা রয়েছে তা তাদের নিজস্ব নয় ;বরং তা সরকারসমূহ ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের কারণে এবং সাম্প্রতিক শতাব্দীগুলোতে যার কারণ আমেরিকা ও ইউরোপের শক্তিধর রাষ্ট্রসমূহ। তদুপরি এ সকল কারণ মানুষের অন্তরের এ ভিত্তিকে ধ্বংস করতে পারেনি। ইকবাল লাহোরীর ভাষায় :

সত্যের প্রমাণ মোদের নিকট রয়েছে একটিই ,

তাঁবুগুলো বিচ্ছিন্ন মোদের ,হৃদয় তো একটিই।

অধিবাসী মোরা কেউ হিজায ,চীন ,ইরান ও ভারতের ,

সকলে মোরা যেন শিশির একই প্রভাতের।

এই একক জনগোষ্ঠী হতেই প্রতি বছর হজ্বের মৌসুমে পনেরো লক্ষ মানুষের এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় ।

জাতীয়তাবাদ ও বর্ণবাদ এমন এক চিন্তা যা বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীকে একে অপরের বিপরীতে দাঁড় করায়। গত শতাব্দী2 হতে ইউরোপে এ চিন্তার ঢেউ উচ্চকিত হয়েছে । হয়তো বা সেখানে এটি স্বাভাবিক। কারণ ইউরোপে এমন কোন মতবাদ ছিল না যা সেখানকার বিভিন্ন জাতিকে উচ্চতর পর্যায়ে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে। পরবর্তীতে সাম্রাজ্যবাদীদের মাধ্যমে এ ঢেউয়ের ধাক্কা প্রাচ্যের জাতিগুলোর মধ্যেও লাগে। সাম্রাজ্যবাদ বিভেদের জন্ম দাও ও শাসন কর নীতি প্রয়োগ শুরু করে। এ নীতি বাস্তবায়নের জন্য সর্বোত্তম পথ হিসেবে ইসলামী জাতি-গোষ্ঠীসমূহকে নিজ নিজ বর্ণ ও জাতিসত্তার প্রতি মনোনিবেশের দিকে পরিচালিত করার প্রচেষ্টা নেয় এবং এক কাল্পনিক আত্মগর্বে নিমজ্জিত হতে উদ্বুদ্ধ করে ,যেমন ভারতীয়কে বলে ,তোমার অতীত এরূপ গৌরবময় ,তুর্কীকে বলে ,প্যানতুর্কী ইজম ধারণায় নব্য তুর্কী আন্দোলন শুরু কর ,আরবকে বলে ,তাদের মধ্যে পূর্ব হতেই গোত্রবাদের ধারণাসহ আরব জাতিত্বের ধারণা প্রকট ছিল-আরবী ভাষার ওপর ভিত্তি করে প্যান আরব ইজম আন্দোলনের সূচনা কর। ইরানীকে বলে ,তুমি আর্য জাতিভুক্ত এবং সেমিটিক জাতিভুক্ত আরব হতে ভিন্ন ,তোমার চিন্তা-ধারণা সবই ভিন্ন।

জাতীয়তাবাদী ধারণা জাতীয় চিন্তা ও অনুভূতির জাগরণের মাধ্যমে হয়তো অনেক জাতিরই স্বাধীন অস্তিত্বের বিষয়ে ইতিবাচক ও কল্যাণকর কিছু প্রভাব রাখতে পারে ,কিন্তু ইসলামী জাতিগুলোর মধ্যে এর কল্যাণকর কোন প্রভাব তো পড়েইনি ;বরং অনৈক্য ও বিচ্ছিন্নতার কারণ হয়ে দেখা দেয়। ইসলামী জাতিসমূহ শতাব্দীকাল পূর্বে ঐক্যের আরো উচ্চতর পর্যায় অতিক্রম করেছিল। কারণ ইসলাম শতাব্দীকাল পূর্বে একক চিন্তা ,বিশ্বাস ও আদর্শের ভিত্তিতে অনন্য ঐক্য সৃষ্টি করেছিল ,এমনকি বিংশ শতাব্দীতেও ইসলাম প্রমাণ করেছে এ ঐক্যের ভিত্তি উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কতটা কার্যকর!

বিংশ শতাব্দীতে মুসলমানরা উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে যে সব আন্দোলনের মাধ্যমে উপনিবেশবাদীদের প্রভাব হতে নিজেদের মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে তার পেছনে জাতিগত কারণ অপেক্ষা ইসলামী কারণই মুখ্য ও অধিকতর ফলপ্রসূ ছিল। উদাহরণস্বরূপ আলজিরিয়া ,ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানের কথা বলতে পারি।

হ্যাঁ ,এ জাতিসমূহ শতাব্দীকাল হতে প্রমাণ দিয়েছে এক চিন্তা ,বিশ্বাস ও মতাদর্শের ভিত্তি এমন এক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের সৃষ্টি করতে পারে যা তাদেরকে সাম্রাজ্যবাদের থাবা হতে মুক্ত করতে সক্ষম। তাই এরূপ জাতি-গোষ্ঠীকে জাতীয়তাবাদের মত চিন্তার দিকে পরিচালিত করা প্রতিক্রিয়াশীলতা ছাড়া অন্য কিছু নয়।

সুতরাং বর্ণ ও জাতীয়তাবাদের উদ্গাতা হলো ইউরোপ এবং এ চিন্তাধারা ইসলামী বিশ্বের জন্য অনেক বড় সমস্যার সৃষ্টি করেছে। সাইয়্যেদ জামালউদ্দীন আসাদাবাদীর (আফগানী) নিজ জাতিসত্তা গোপন করার কারণ সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে ,তিনি চান নি তাঁকে বিশেষ কোন জাতিভুক্ত বলে পরিচিত করানো হোক যা উপনিবেশবাদীদের হাতে একটি হাতিয়ার হতে পারে এবং অন্য জাতিভুক্তদের তাঁর বিরুদ্ধে প্ররোচিত করতে পারে।

আমরা যেহেতু এক ধর্ম ,একই মতাদর্শ ও পথের ওপর রয়েছি যার নাম ইসলাম এবং যার মধ্যে জাতিগত ধারণার উপাদান নেই সেহেতু এ মতাদর্শের বিপরীতে বর্ণ ও জাতিগত যে কোন ধারণার বিরুদ্ধে আমরা নিষ্ক্রিয় থাকতে পারি না। আমরা অবহিত ,সম্প্রতি অনেক ব্যক্তিই ইরানী জাতিসত্তা সংরক্ষণের নামে ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন শুরু করেছে এবং আরব ও আরবী ভাষার বিরুদ্ধে সংগ্রামের নামে ইসলামের পবিত্র অনুভূতির প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করছে।3

ইরানে ইসলামের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধের নমুনা আমরা বই-পুস্তক ,দৈনিক ,সাপ্তাহিক ও অন্যান্য পত্র-পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে লক্ষ্য করছি। এটি আকস্মিক কোন বিষয় নয় ;বরং একটি পরিকল্পিত নকশা ও লক্ষ্যের ফলশ্রুতি।

বর্তমানে যারথুষ্ট্র ( Zoroastrian)ধর্মের প্রচারণা বেড়ে গিয়েছে এবং এটি একটি পরিকল্পিত রাজনৈতিক কার্যক্রমে পরিণত হয়েছে। সকলেই জানেন আজকের ইরানীরা কখনই যারথুষ্ট্র ধর্মে ফিরে যাবে না এবং যারথুস্ট্র ধর্মের শিক্ষাও ইসলামের স্থান দখল করতে পারবে না। যে সকল ব্যক্তি মাযদাকী , মনী এবং যারথুষ্ট্র ধর্মের ব্যক্তিত্ব বলে পরিচিত তাদের সকলেই আজ জাতীয় মিথ্যাবাদী হিসেবে অভিহিত এবং ইসলামী শিক্ষা হতে বিচ্যুত চরিত্র বৈ তাদের ভিন্ন কোন চরিত্র ছিল না। এখানে তারা ইসলামের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই হোক বা আরব জাতির বাহানা এনেই হোক কার্যক্রম চালিয়ে ইরানীদের মন হতে ইসলামের প্রসিদ্ধ বীরদের স্মৃতি মুছে দিতে পারবে না। কখনই আল মুকান্না , মিনবাদ , ববাকে খুররামদীন এবং মজিয়ররা ইরানীদের অন্তরে আলী ইবনে আবি তালিব , হুসাইন ইবনে আলী , এমনকি সালমান ফারসীর স্থান অধিকারে সক্ষম নয়। সকলেই তা জানে।

যদিও এর মাধ্যমে হয়তো অপরিপক্ব ও বুদ্ধিহীন যুবকদের মধ্যে দেশ ,জাতি ও রাষ্ট্রীয় চেতনা ও অনুভূতি জাগরিত করা এবং তাদের সঙ্গে ইসলামের ব্যবধান ও সম্পর্কচ্ছেদ সৃষ্টি সম্ভব। অর্থাৎ যদিও ইসলামী অনুভূতির স্থলাভিষিক্ত হিসেবে অন্য ধর্মানুভূতি প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয় ,কিন্তু ইসলামী অনুভূতির পরিবর্তন ঘটিয়ে তার বিপরীত অনুভূতি সৃষ্টি করে সাম্রাজ্যবাদের সহযোগিতা করা সম্ভব। এজন্যই লক্ষ্য করি ধর্ম ও আল্লাহ্বিরোধী ব্যক্তিরা বুদ্ধিহীন মগজ হতে উৎসারিত অর্থহীন লেখাগুলোতে যারথুষ্ট্র এবং ইসলাম পূর্ববর্তী ইরানের অবস্থাকে সমর্থন করে চলেছে। তাদের লক্ষ্য আমাদের নিকট স্পষ্ট।

আমরা আমাদের এ আলোচনায় ঐ যুক্তি এ দৃষ্টিকোণ থেকেই আলোচনা করব যে যুক্তি ও দৃষ্টিকোণ থেকে এই ব্যক্তিরা বিষয়টিকে দেখে। আর তা হলো জাতীয়তা ,জাতীয় চেতনা এবং জাতীয়তাবাদ। হ্যাঁ ,এ দৃষ্টিকোণ থেকেই আমরা আলোচনা রাখব। যদিও আমরা ইকবাল লাহোরীর এ কথা ভুলে যাই নি- জাতিভক্তি ও আরাধনা এক প্রকার অসভ্যতা । এ বিষয়টির প্রতি আমাদের দৃষ্টি রয়েছে যে ,জাতীয় চেতনা ও অনুভূতির ইতিবাচকতা ততক্ষণ পর্যন্ত রয়েছে যতক্ষণ এর মাধ্যমে স্বদেশের মানুষের সেবা করা যায। কিন্তু কখনও কখনও অনুভূতি ও চেতনা নেতিবাচকতার জন্ম দেয় ,বৈষম্যের সৃষ্টি করে ,ভাল-মন্দ বিচারে অন্ধত্ব ও পক্ষপাতিত্ব এবং নৈতিকতা ও মানবিকতাবিরোধী চেতনার উৎপত্তি ঘটায়।

আমরা জানি জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় চেতনার যুক্তি অপেক্ষা উচ্চতর যুক্তি আমাদের নিকট রয়েছে যেখানে জ্ঞান ,দর্শন ও ধর্ম আবেগ-অনুভূতির ঊর্ধে অবস্থান করছে। জাতীয় অনুভূতির চেতনা সকল স্থানে গ্রহণীয় হলেও জ্ঞান ,দর্শন ও ধর্মের অনুসন্ধানে গ্রহণযোগ্য নয়। জ্ঞান ,দর্শন ও ধর্মীয় কোন বিষয়ে তা রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় হলেই গ্রহণযোগ্য হবে এমনটি নয়। তেমনিভাবে চিন্তাগত কোন বিষয় বিদেশী ও বিজাতীয় হলেই তা বর্জনীয় এমনও নয়। এ কথা সত্য যে ,জ্ঞান ,ধর্ম ও দর্শনের কোন রাষ্ট্র নেই । কারণ এগুলো সর্বজনীন। তাই ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ,বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদেরও কোন নির্দিষ্ট রাষ্ট্র নেই ,তাঁরাও বিশ্বজনীন। তাঁরা সমগ্র বিশ্বের ,সকল রাষ্ট্রই তাঁদের রাষ্ট্র এবং সকল মানুষই তাঁদের স্বদেশী।

যদিও বিষয়গুলো আমরা জানি তদুপরি এখানে মানবিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উচ্চতর এ যুক্তিকে আমরা আপাতত দূরে রাখছি এবং অপূর্ণাঙ্গ মানুষদের উপযোগী অনুভূতি ও আবেগকেন্দ্রিক যুক্তির ওপর নির্ভর করেই এ আলোচনা শুরু করছি।

আমরা দেখতে চাই জাতীয় চেতনা ও অনুভূতির দৃষ্টিতে যদি ইসলামকে যাচাই করি তা কি বিজাতীয় বলে পরিগণিত হবে ? আমরা দেখতে চাই জাতীয়তার মানদণ্ডে ইসলাম ইরানী জাতীয়তা ও ইরানী জাতীয়তাবাদী চেতনার অন্তর্ভুক্ত নাকি এর বহির্ভূত।

এ লক্ষ্যে আমাদের আলোচনাকে দু টি অংশে ভাগ করব। প্রথমত আমরা জাতীয়তার মানদণ্ড অর্থাৎ কোন বস্তুকে জাতীয়তার অন্তর্ভুক্ত ও বহির্ভূত বলার মানদণ্ড কি তা দেখব। দ্বিতীয়ত দেখব এ মানদণ্ডের আলোকে ইসলাম ইরানী জাতীয়তার অভ্যন্তরের বিষয় নাকি বিজাতীয় ? বাস্তবে আমাদের আলোচনায় দু টি প্রতিজ্ঞা রয়েছে। প্রথম অংশ বৃহত্তর প্রতিজ্ঞা ( major premise) এবং দ্বিতীয় অংশ ক্ষুদ্রতর প্রতিজ্ঞা ( minor premise) ।

প্রসঙ্গত ইসলাম ও যারথুষ্ট্র প্রবণতার (যারথুষ্ট্র ধর্ম প্রবণতা) মধ্যে একটি তুলনামূলক আলোচনা রাখব এবং তাতে প্রমাণিত হবে জাতীয়তার মানদণ্ডে ইসলাম ইরানী জাতিসত্তার অধিকতর নিকটবর্তী নাকি যারথুষ্ট্র প্রবণতা ?

আমরা এবং ইসলাম

ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুযায়ী আমরা ইরানীরা কয়েক সহস্রাব্দ ধরে বিশ্বের বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর সঙ্গে বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে কখনও বন্ধুত্বপূর্ণ আবার কখনও শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি করেছি। এ সম্পর্কের কারণে তাদের অনেক চিন্তা ও বিশ্বাস যেমন আমাদের মধ্যে এসেছে তেমনি আমাদের অনেক চিন্তা ও বিশ্বাসও তাদের ওপর প্রভাব ফেলেছে। যখনই অন্য জাতি ও গোষ্ঠীর জাতিসত্তা ও প্রভুত্বের কথা এসেছে আমরা তাদের মাঝে বিলুপ্ত হইনি ;বরং অন্য জাতিসত্তাকে প্রতিরোধ করেছি। তবে আমরা নিজ জাতিসত্তাকে ভালবাসার কারণে এটি করলেও এর মধ্যে কোন গোঁড়ামি বা অন্ধ বিশ্বাস ছিল না। কারণ মনের কোন অন্ধত্বই আমাদের সত্য হতে দূরে রাখতে এবং সত্যের বিরোধী ও শত্রু করতে পারেনি।

হাখামানেশী রাজত্বের সময় যখন ইরান বর্তমান সীমার বাইরেও পার্শ্ববর্তী কয়েকটি দেশসহ একই রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল তখন হতে বর্তমানে দু হাজার পাঁচশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। পঁচিশ শতাব্দীর মধ্যে চৌদ্দ শতাব্দী ধরে আমরা ইসলামের ছায়ায় বাস করছি এবং এ ধর্ম আমাদের জীবনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে। এ দীনের রীতি ও শিক্ষাতেই আমরা আমাদের শিশুদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেছি ,আমাদের জীবন পরিচালিত করেছি ,এক আল্লাহর ইবাদাত করেছি ,এ দীনের রীতিতেই আমাদের মৃতদের কবরস্থ করেছি। আমাদের ইতিহাস ,রাজনীতি ,বিচার ব্যবস্থা ,আইন ,সংস্কৃতি ,সভ্যতা ,সামাজিক আচার-এক কথায় সকল কিছু ইসলামের সঙ্গে মিশে গেছে। সকল জ্ঞানী ব্যক্তিই স্বীকার করেছেন ,ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে শতাব্দীকাল ধরে আমরা অসাধারণ ও মহা মূল্যবান অবদান রেখেছি যা ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না ,এমনকি অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে দীনের প্রচার-প্রসার এবং উন্নয়নে আরবদের চেয়েও অধিক অবদান রেখেছি। কোন জাতিই আমাদের মত এ দীনের প্রচার-প্রসার ও বিস্তৃতিতে ভূমিকা রাখতে পারেনি।

এ জন্যই ইসলাম ও ইরানের সম্পর্ককে বিভিন্ন আঙ্গিকে পর্যালোচনার অধিকার আমরা রাখি। ইসলামী জ্ঞানের প্রসারে আমাদের ভূমিকা এবং আমাদের আত্মিক ও বস্তুগত উন্নয়নে ইসলামের অবদান পূর্ণাঙ্গ ও যথার্থরূপে ঐতিহাসিক নির্ভরযোগ্য প্রমাণসহ স্পষ্ট করে তুলে ধরতেই আমাদের এ আলোচনা।

বর্তমান সময়ে জাতি আরাধনা

বর্তমান শতাব্দীর বহুল আলোচিত বিষয়গুলোর একটি হলো জাতীয়তা। সাম্প্রতিক সময়ে অনেক জাতিগোষ্ঠীই ,এমনকি মুসলমানদের মধ্যে ইরানী ও অ-ইরানী সকলেই এ বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। তাদের অনেকে এ আলোচনায় এতটা ডুবে গিয়েছেন ,যার কোন সীমা-পরিসীমা নেই।

বাস্তবতা হলো বর্তমান সময়ে জাতীয়তাবাদ মুসলিম বিশ্বের জন্য এক বিরাট সমস্যা। জাতীয়তাবাদের ধারণা ইসলামী মৌল প্রশিক্ষণের নীতির বিরোধী ও এ চিন্তাধারা মুসলিম ঐক্যের পথে বড় প্রতিবন্ধক।

আমরা জানি ইসলামী সমাজ বিভিন্ন জাতির সমন্বয়ে গঠিত এবং অতীতে ইসলাম বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে ইসলামী সমাজের ছায়ায় একত্রিত করেছে। এ একতা এখনও বাস্তবে বিদ্যমান। এটি বাস্তব সত্য ,এখনও সত্তর কোটি1 মানুষের বৃহত্তর একটি জনগোষ্ঠী এক চিন্তা ,মূল্যবোধ ,অনুভূতি এবং সহাবস্থানের ধারণায় বিশ্বাসী। তাদের মধ্যে যে বিচ্ছিন্নতা রয়েছে তা তাদের নিজস্ব নয় ;বরং তা সরকারসমূহ ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের কারণে এবং সাম্প্রতিক শতাব্দীগুলোতে যার কারণ আমেরিকা ও ইউরোপের শক্তিধর রাষ্ট্রসমূহ। তদুপরি এ সকল কারণ মানুষের অন্তরের এ ভিত্তিকে ধ্বংস করতে পারেনি। ইকবাল লাহোরীর ভাষায় :

সত্যের প্রমাণ মোদের নিকট রয়েছে একটিই ,

তাঁবুগুলো বিচ্ছিন্ন মোদের ,হৃদয় তো একটিই।

অধিবাসী মোরা কেউ হিজায ,চীন ,ইরান ও ভারতের ,

সকলে মোরা যেন শিশির একই প্রভাতের।

এই একক জনগোষ্ঠী হতেই প্রতি বছর হজ্বের মৌসুমে পনেরো লক্ষ মানুষের এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় ।

জাতীয়তাবাদ ও বর্ণবাদ এমন এক চিন্তা যা বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীকে একে অপরের বিপরীতে দাঁড় করায়। গত শতাব্দী2 হতে ইউরোপে এ চিন্তার ঢেউ উচ্চকিত হয়েছে । হয়তো বা সেখানে এটি স্বাভাবিক। কারণ ইউরোপে এমন কোন মতবাদ ছিল না যা সেখানকার বিভিন্ন জাতিকে উচ্চতর পর্যায়ে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে। পরবর্তীতে সাম্রাজ্যবাদীদের মাধ্যমে এ ঢেউয়ের ধাক্কা প্রাচ্যের জাতিগুলোর মধ্যেও লাগে। সাম্রাজ্যবাদ বিভেদের জন্ম দাও ও শাসন কর নীতি প্রয়োগ শুরু করে। এ নীতি বাস্তবায়নের জন্য সর্বোত্তম পথ হিসেবে ইসলামী জাতি-গোষ্ঠীসমূহকে নিজ নিজ বর্ণ ও জাতিসত্তার প্রতি মনোনিবেশের দিকে পরিচালিত করার প্রচেষ্টা নেয় এবং এক কাল্পনিক আত্মগর্বে নিমজ্জিত হতে উদ্বুদ্ধ করে ,যেমন ভারতীয়কে বলে ,তোমার অতীত এরূপ গৌরবময় ,তুর্কীকে বলে ,প্যানতুর্কী ইজম ধারণায় নব্য তুর্কী আন্দোলন শুরু কর ,আরবকে বলে ,তাদের মধ্যে পূর্ব হতেই গোত্রবাদের ধারণাসহ আরব জাতিত্বের ধারণা প্রকট ছিল-আরবী ভাষার ওপর ভিত্তি করে প্যান আরব ইজম আন্দোলনের সূচনা কর। ইরানীকে বলে ,তুমি আর্য জাতিভুক্ত এবং সেমিটিক জাতিভুক্ত আরব হতে ভিন্ন ,তোমার চিন্তা-ধারণা সবই ভিন্ন।

জাতীয়তাবাদী ধারণা জাতীয় চিন্তা ও অনুভূতির জাগরণের মাধ্যমে হয়তো অনেক জাতিরই স্বাধীন অস্তিত্বের বিষয়ে ইতিবাচক ও কল্যাণকর কিছু প্রভাব রাখতে পারে ,কিন্তু ইসলামী জাতিগুলোর মধ্যে এর কল্যাণকর কোন প্রভাব তো পড়েইনি ;বরং অনৈক্য ও বিচ্ছিন্নতার কারণ হয়ে দেখা দেয়। ইসলামী জাতিসমূহ শতাব্দীকাল পূর্বে ঐক্যের আরো উচ্চতর পর্যায় অতিক্রম করেছিল। কারণ ইসলাম শতাব্দীকাল পূর্বে একক চিন্তা ,বিশ্বাস ও আদর্শের ভিত্তিতে অনন্য ঐক্য সৃষ্টি করেছিল ,এমনকি বিংশ শতাব্দীতেও ইসলাম প্রমাণ করেছে এ ঐক্যের ভিত্তি উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কতটা কার্যকর!

বিংশ শতাব্দীতে মুসলমানরা উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে যে সব আন্দোলনের মাধ্যমে উপনিবেশবাদীদের প্রভাব হতে নিজেদের মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে তার পেছনে জাতিগত কারণ অপেক্ষা ইসলামী কারণই মুখ্য ও অধিকতর ফলপ্রসূ ছিল। উদাহরণস্বরূপ আলজিরিয়া ,ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানের কথা বলতে পারি।

হ্যাঁ ,এ জাতিসমূহ শতাব্দীকাল হতে প্রমাণ দিয়েছে এক চিন্তা ,বিশ্বাস ও মতাদর্শের ভিত্তি এমন এক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের সৃষ্টি করতে পারে যা তাদেরকে সাম্রাজ্যবাদের থাবা হতে মুক্ত করতে সক্ষম। তাই এরূপ জাতি-গোষ্ঠীকে জাতীয়তাবাদের মত চিন্তার দিকে পরিচালিত করা প্রতিক্রিয়াশীলতা ছাড়া অন্য কিছু নয়।

সুতরাং বর্ণ ও জাতীয়তাবাদের উদ্গাতা হলো ইউরোপ এবং এ চিন্তাধারা ইসলামী বিশ্বের জন্য অনেক বড় সমস্যার সৃষ্টি করেছে। সাইয়্যেদ জামালউদ্দীন আসাদাবাদীর (আফগানী) নিজ জাতিসত্তা গোপন করার কারণ সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে ,তিনি চান নি তাঁকে বিশেষ কোন জাতিভুক্ত বলে পরিচিত করানো হোক যা উপনিবেশবাদীদের হাতে একটি হাতিয়ার হতে পারে এবং অন্য জাতিভুক্তদের তাঁর বিরুদ্ধে প্ররোচিত করতে পারে।

আমরা যেহেতু এক ধর্ম ,একই মতাদর্শ ও পথের ওপর রয়েছি যার নাম ইসলাম এবং যার মধ্যে জাতিগত ধারণার উপাদান নেই সেহেতু এ মতাদর্শের বিপরীতে বর্ণ ও জাতিগত যে কোন ধারণার বিরুদ্ধে আমরা নিষ্ক্রিয় থাকতে পারি না। আমরা অবহিত ,সম্প্রতি অনেক ব্যক্তিই ইরানী জাতিসত্তা সংরক্ষণের নামে ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন শুরু করেছে এবং আরব ও আরবী ভাষার বিরুদ্ধে সংগ্রামের নামে ইসলামের পবিত্র অনুভূতির প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করছে।3

ইরানে ইসলামের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধের নমুনা আমরা বই-পুস্তক ,দৈনিক ,সাপ্তাহিক ও অন্যান্য পত্র-পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে লক্ষ্য করছি। এটি আকস্মিক কোন বিষয় নয় ;বরং একটি পরিকল্পিত নকশা ও লক্ষ্যের ফলশ্রুতি।

বর্তমানে যারথুষ্ট্র ( Zoroastrian)ধর্মের প্রচারণা বেড়ে গিয়েছে এবং এটি একটি পরিকল্পিত রাজনৈতিক কার্যক্রমে পরিণত হয়েছে। সকলেই জানেন আজকের ইরানীরা কখনই যারথুষ্ট্র ধর্মে ফিরে যাবে না এবং যারথুস্ট্র ধর্মের শিক্ষাও ইসলামের স্থান দখল করতে পারবে না। যে সকল ব্যক্তি মাযদাকী , মনী এবং যারথুষ্ট্র ধর্মের ব্যক্তিত্ব বলে পরিচিত তাদের সকলেই আজ জাতীয় মিথ্যাবাদী হিসেবে অভিহিত এবং ইসলামী শিক্ষা হতে বিচ্যুত চরিত্র বৈ তাদের ভিন্ন কোন চরিত্র ছিল না। এখানে তারা ইসলামের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই হোক বা আরব জাতির বাহানা এনেই হোক কার্যক্রম চালিয়ে ইরানীদের মন হতে ইসলামের প্রসিদ্ধ বীরদের স্মৃতি মুছে দিতে পারবে না। কখনই আল মুকান্না , মিনবাদ , ববাকে খুররামদীন এবং মজিয়ররা ইরানীদের অন্তরে আলী ইবনে আবি তালিব , হুসাইন ইবনে আলী , এমনকি সালমান ফারসীর স্থান অধিকারে সক্ষম নয়। সকলেই তা জানে।

যদিও এর মাধ্যমে হয়তো অপরিপক্ব ও বুদ্ধিহীন যুবকদের মধ্যে দেশ ,জাতি ও রাষ্ট্রীয় চেতনা ও অনুভূতি জাগরিত করা এবং তাদের সঙ্গে ইসলামের ব্যবধান ও সম্পর্কচ্ছেদ সৃষ্টি সম্ভব। অর্থাৎ যদিও ইসলামী অনুভূতির স্থলাভিষিক্ত হিসেবে অন্য ধর্মানুভূতি প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয় ,কিন্তু ইসলামী অনুভূতির পরিবর্তন ঘটিয়ে তার বিপরীত অনুভূতি সৃষ্টি করে সাম্রাজ্যবাদের সহযোগিতা করা সম্ভব। এজন্যই লক্ষ্য করি ধর্ম ও আল্লাহ্বিরোধী ব্যক্তিরা বুদ্ধিহীন মগজ হতে উৎসারিত অর্থহীন লেখাগুলোতে যারথুষ্ট্র এবং ইসলাম পূর্ববর্তী ইরানের অবস্থাকে সমর্থন করে চলেছে। তাদের লক্ষ্য আমাদের নিকট স্পষ্ট।

আমরা আমাদের এ আলোচনায় ঐ যুক্তি এ দৃষ্টিকোণ থেকেই আলোচনা করব যে যুক্তি ও দৃষ্টিকোণ থেকে এই ব্যক্তিরা বিষয়টিকে দেখে। আর তা হলো জাতীয়তা ,জাতীয় চেতনা এবং জাতীয়তাবাদ। হ্যাঁ ,এ দৃষ্টিকোণ থেকেই আমরা আলোচনা রাখব। যদিও আমরা ইকবাল লাহোরীর এ কথা ভুলে যাই নি- জাতিভক্তি ও আরাধনা এক প্রকার অসভ্যতা । এ বিষয়টির প্রতি আমাদের দৃষ্টি রয়েছে যে ,জাতীয় চেতনা ও অনুভূতির ইতিবাচকতা ততক্ষণ পর্যন্ত রয়েছে যতক্ষণ এর মাধ্যমে স্বদেশের মানুষের সেবা করা যায। কিন্তু কখনও কখনও অনুভূতি ও চেতনা নেতিবাচকতার জন্ম দেয় ,বৈষম্যের সৃষ্টি করে ,ভাল-মন্দ বিচারে অন্ধত্ব ও পক্ষপাতিত্ব এবং নৈতিকতা ও মানবিকতাবিরোধী চেতনার উৎপত্তি ঘটায়।

আমরা জানি জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় চেতনার যুক্তি অপেক্ষা উচ্চতর যুক্তি আমাদের নিকট রয়েছে যেখানে জ্ঞান ,দর্শন ও ধর্ম আবেগ-অনুভূতির ঊর্ধে অবস্থান করছে। জাতীয় অনুভূতির চেতনা সকল স্থানে গ্রহণীয় হলেও জ্ঞান ,দর্শন ও ধর্মের অনুসন্ধানে গ্রহণযোগ্য নয়। জ্ঞান ,দর্শন ও ধর্মীয় কোন বিষয়ে তা রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় হলেই গ্রহণযোগ্য হবে এমনটি নয়। তেমনিভাবে চিন্তাগত কোন বিষয় বিদেশী ও বিজাতীয় হলেই তা বর্জনীয় এমনও নয়। এ কথা সত্য যে ,জ্ঞান ,ধর্ম ও দর্শনের কোন রাষ্ট্র নেই । কারণ এগুলো সর্বজনীন। তাই ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ,বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদেরও কোন নির্দিষ্ট রাষ্ট্র নেই ,তাঁরাও বিশ্বজনীন। তাঁরা সমগ্র বিশ্বের ,সকল রাষ্ট্রই তাঁদের রাষ্ট্র এবং সকল মানুষই তাঁদের স্বদেশী।

যদিও বিষয়গুলো আমরা জানি তদুপরি এখানে মানবিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উচ্চতর এ যুক্তিকে আমরা আপাতত দূরে রাখছি এবং অপূর্ণাঙ্গ মানুষদের উপযোগী অনুভূতি ও আবেগকেন্দ্রিক যুক্তির ওপর নির্ভর করেই এ আলোচনা শুরু করছি।

আমরা দেখতে চাই জাতীয় চেতনা ও অনুভূতির দৃষ্টিতে যদি ইসলামকে যাচাই করি তা কি বিজাতীয় বলে পরিগণিত হবে ? আমরা দেখতে চাই জাতীয়তার মানদণ্ডে ইসলাম ইরানী জাতীয়তা ও ইরানী জাতীয়তাবাদী চেতনার অন্তর্ভুক্ত নাকি এর বহির্ভূত।

এ লক্ষ্যে আমাদের আলোচনাকে দু টি অংশে ভাগ করব। প্রথমত আমরা জাতীয়তার মানদণ্ড অর্থাৎ কোন বস্তুকে জাতীয়তার অন্তর্ভুক্ত ও বহির্ভূত বলার মানদণ্ড কি তা দেখব। দ্বিতীয়ত দেখব এ মানদণ্ডের আলোকে ইসলাম ইরানী জাতীয়তার অভ্যন্তরের বিষয় নাকি বিজাতীয় ? বাস্তবে আমাদের আলোচনায় দু টি প্রতিজ্ঞা রয়েছে। প্রথম অংশ বৃহত্তর প্রতিজ্ঞা ( major premise) এবং দ্বিতীয় অংশ ক্ষুদ্রতর প্রতিজ্ঞা ( minor premise) ।

প্রসঙ্গত ইসলাম ও যারথুষ্ট্র প্রবণতার (যারথুষ্ট্র ধর্ম প্রবণতা) মধ্যে একটি তুলনামূলক আলোচনা রাখব এবং তাতে প্রমাণিত হবে জাতীয়তার মানদণ্ডে ইসলাম ইরানী জাতিসত্তার অধিকতর নিকটবর্তী নাকি যারথুষ্ট্র প্রবণতা ?


9

10

11

12

13

14

15

16

17

18