ইসলাম ও শীয়া মাযহাব

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব 0%

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব

লেখক: আল্লামা সাইয়্যেদ মুহাম্মদ হুসাইন তাবাতাবাঈ
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 38252
ডাউনলোড: 4760

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 31 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 38252 / ডাউনলোড: 4760
সাইজ সাইজ সাইজ
ইসলাম ও শীয়া মাযহাব

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

‘ইসলাম ও শীয়া মাযহাব’ নামক এ গ্রন্থে ইসলামের দু’টি বৃহৎ উপদলের (শীয়া ও সুন্নী) অন্যতম শীয়া মাযহাবের প্রকৃত পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে । শীয়া মাযহাবের উৎপত্তি, বিকাশ ও চিন্তাধারার প্রকৃতি এবং ইসলামী জ্ঞানের ব্যাপারে শীয়া মাযহাবের দৃষ্টিভঙ্গী এ বইয়ে আলোচিত হয়েছে ।

মুয়াবিয়ার কাছে খেলাফত হস্তান্তর ও রাজতন্ত্রের উত্থান

আমিরুল মু মিনীন হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর শাহাদতের পর তার ওসিয়ত (উইল) এবং জনগণের বাইয়াতের (আনুগত্য জ্ঞাপন) মাধ্যমে হযরত ইমাম হাসান (আ.) পরবর্তী খলিফা হিসেবে নির্বাচিত হন । বারজন ইমামের অনুসারী শীয়াদের মতে হযরত ইমাম হাসান (আ.) ছিলেন দ্বিতীয় ইমাম ।

ওদিকে মুয়াবিয়াও এ ব্যাপারে চুপ করে বসে থাকেননি । মুয়াবিয়া , হযরত ইমাম হাসান (আ.)-এর বিরুদ্ধে তদানিন্তন খেলাফতের রাজধানী ইরাকের দিকে সেনা অভিযান পরিচালনা করলেন । বিভিন্ন ধরণের ষড়যন্ত্র ও ইমাম হাসান (আ.)-এর সমর্থকে ও সেনাপতিদের বিপুল পরিমাণ ঘষু প্রদানের মাধ্যমে মুয়াবিয়া তাদেরকে দূর্নীতির সমুদ্রে ভাসিয়ে দেন । এর ফলে হযরত ইমাম হাসান (আ.) মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধি চুক্তিতে বাধ্য হন । চুক্তি অনুসারে খেলাফতের ক্ষমতা মুয়াবিয়ার কাছে এই শর্তে হস্তান্তর করা হয় যে , মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর খেলাফত পুনরায় ইমাম হাসান (আ.)-এর কাছে হস্তান্তর করা হবে । আর তারা ইমাম আলী (আ.) ও ইমাম হাসান (আ.)-এর অনুসারীদেরকে উৎপীড়ন করবেন না । এভাবেই খেলাফতের কেন্দ্রীয় ক্ষমতা মুয়াবিয়ার কাছে হস্তান্তরিত হয় ।55

হিজরী 40 সনে মুয়াবিয়া খেলাফতের কেন্দ্রীয় ক্ষমতা লাভ করার পর পরই ইরাকে এসে জনগণের উদ্দেশ্যেএকটি বক্তৃতা দেয় । ঐ বক্তৃতায় তিনি জনগণের প্রতি হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেনঃ আমি নামায রোযার জন্যে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিনি । বরং আমি তোমাদের শাসন ক্ষমতা দখল করার জন্যে যুদ্ধ করেছি এবং শেষপর্যন্ত আমি তা লাভও করেছি !!56 মুয়াবিয়া আরো ব্যক্ত করে : হাসানের সাথে যে মর্মে আমি চুক্তি সাক্ষর করেছিলাম , তা আমি বাতিল বলে ঘোষণা করছি এবং ঐ চুক্তি আমি পদদলিত করলাম!!57

মুয়াবিয়া তার সেই বক্তব্যের মাধ্যমে ধর্ম থেকে রাজনীত্রিক পৃথক করার আভাস দেয় । উক্ত বক্তব্যে আরো ইঙ্গিত দেয় যে , ধর্মীয় নীতিমালার ক্ষেত্রে কোন প্রকার প্রতিশ্রুতি দেয়া হবে না এবং রাষ্ট্রিয় ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে তিনি সর্বশক্তি নিয়োগ করবেন । আর এটা খুবই স্পষ্ট যে , এ জাতীয় রাজনৈতিক পদ্ধতি আদৌ কোন ইসলামী খেলাফত বা রাসূল (সা.)-এর উত্তরাধিকারী প্রশাসন ছিল না । বরং ওটা (মুয়াবিয়া প্রশাসন) ছিল সম্পূর্ণ রাজতান্ত্রিক প্রশাসন । এ জন্যে যখন কেউ তার (মুয়াবিয়া) সাক্ষাতে আসতো তখন ঐ ব্যক্তিকে (মুয়াবিয়াকে) বাদশাহী পদ্ধতিতে সালাম দিতে হত ।58 এমন কি স্বয়ং মুয়াবিয়াও বিশেষ বৈঠকগুলোতে নিজেকে রাজা বা বাদশাহ্ হিসেবে পরিচিত করতেন ।59 অবশ্য জনসমক্ষে তিনি নিজেকে ইসলামী খলিফা উপাধিতে ভূষিত করতেন । অবশ্য যেসব প্রশাসন ব্যবস্থার ভিত্তি কেবল স্বেচ্ছাচারীতার উপর প্রতিষ্ঠিত সেসকল প্রশাসন ব্যবস্থা সাধারণত রাজতন্ত্রের জনক । আর শেষপর্যন্ত মুয়াবিয়াও তার হৃদয়ে লালিত আকাংখা বাস্তবায়িত করেন ।

মৃত্যুর পূর্বে তিনি তার যুবক পুত্র ইয়াযিদকে রাষ্ট্রিয় ক্ষমতার উত্তরাধিকার অর্পণ করেন ।60 চারিত্রিক দিক থেকে ইয়াযিদ ছিল লম্পট ও অনৈসলামী ব্যক্তিত্বের আধিকারী । এই ইয়াযিদই ইতিহাসে অনেক লজ্জাষ্কর ঘটনার সূত্রপাত করে । মুয়াবিয়া তার পূর্ববতী বক্তব্যে ইঙ্গিত করেন যে , কোনক্রমেই তিনি খেলাফতের ক্ষমতা ইমাম হাসান (আ.)-এর কাছে হস্তান্তরিত হতে দিবেন না । কারণ , তার পরবর্তী খেলাফতের ব্যাপারে ভিন্ন চিন্তা পোষণ করতেন । যে চিন্তার ফলশ্রুতিতে তিনি হযরত ইমাম হাসান (আ.)-কে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে শহীদ করেন ।61 এভাবেই তিনি স্বীয় পুত্র ইয়াযিদের রাষ্ট্রিয় ক্ষমতা লাভের পথকে কন্টকমুক্ত করেন । ইমাম হাসান (আ.)-এর সাথে সম্পাদিত চুক্তি বাতিলের ঘোষণার মাধ্যমে মুয়াবিয়া সবাইকে এটাই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে পবিত্র আহলে বাইতের (নবীবংশ) অনুসারী শীয়াদেরকে তিনি কখনও শান্তি ও নিরাপদে বাস করতে দেবেন না যে তারা (শীয়া) তাদের নিজস্ব ধর্মীয় কর্মকান্ড পূর্বের মতই চালিয়ে যাবে । আর এ বিষয়টি তিনি কঠোরভাবে বাস্তবায়িত করেন ।62 তিনি প্রকাশ্যভাবে ঘোষণা দেন : যে ব্যক্তি পবিত্র আহলে বাইতের ফযিলত বা গুরুত্ব ও মহত্ত্ব সম্পর্কে কোন হাদীস বর্ণনা করবে , তার জান-মাল বা সম্মানের নিরাপত্তা বলতে কিছুই থাকবে না63 এর পাশাপাশি আরো ঘোষণা দেন , যে ব্যক্তি কোন সাহাবী বা খলিফার মহত্ব ও পদ মর্যাদার ব্যাপারে কোন হাদীস বর্ণনা করবে , তাকে বিপলু ভাবে পুরস্কৃত করা হবে । এ ঘোষণার পরিণতিতে উক্ত বিষয়ের উপর অসংখ্য বানোয়াট ও জাল হাদীস সৃষ্টি হয় ।64 মুয়াবিয়া আরো ঘোষণা দেয় যে , রাষ্ট্রের সকল মসজিদের মিম্বারগুলোতে বক্তারা যেন নিয়মিত ভাবে হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে গালি দেয় ও কুৎসা রটনা করে । (এই ঘোষণার বাস্তবায়ন খলিফা ওমর বিন আব্দুল আজিজের {হিঃ -99-হিঃ-101 } পূর্ব পর্যন্ত অব্যাহত ছিল) । মুয়াবিয়ার সহকারীদের মধ্যে রাসূল (সা.)-এর বেশ কিছু সাহাবীও ছিলেন । মুয়াবিয়া তার ঐসব সাহাবী ও সহকারীদের সহযোগিতায় হযরত আলী (আ.)-এর অনুসারী অসংখ্য শীয়াকে হত্যা করে । এমন কি এসব নিহতদের অনেকের কর্তিত মস্তক বিভিন্ন শহরে গণপ্রদর্শনের জন্যে প্রদক্ষিন করানো হত । সর্বত্র শীয়াদেরকে হযরত আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা বা অকথ্য ভাষা ব্যাবহার করতে বাধ্য করা হত । আর যে কেউ এ আদেশ লংঘন করত , তাকেই হত্যা করা হত ।65

শীয়াদের দূর্যোগপূর্ণ ও কঠিনতম দিনগুলো

মুয়াবিয়ার দীর্ঘ বিশ বছরের শাসনকালই শীয়াদের ইতিহাসের দূর্যোগপূর্ণ ও কঠিনতম দিন ছিল । ঐ সময় নিরাপত্তা বলতে শীয়াদের কিছুই ছিল না । শীয়াদের অধিকাংশই ছিল সর্বজন পরিচিত ও জনসমক্ষে চিহ্নিত ব্যক্তিত্ব । শীয়াদের দু জন ইমাম [ইমাম হাসান (আ.) ও ইমাম হুসাইন (আ.)] স্বয়ং মুয়াবিয়ার শাসনামলে জীবন যাপন করেছেন । ইসলামী রাষ্ট্রে এহেন অরাজক পরিস্থিতি পরিবর্তনের সামান্যতম সুযোগও তাদের ছিল না । এমন কি তৃতীয় ইমাম [হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)] , যিনি ইয়াযিদের শাসন আমলের প্রথম 6 মাসের মধ্যে তার বিরূদ্ধে বিদ্রোহ পরিচালনা করেন , যার পরিণতিতে তিনি স্বপরিবারে শাহাদত বরণ করেন । কিন্তু মুয়াবিয়ার শ্বাসনের প্রথম দশ বছর জীবন- যাপনকালীন সময়ে এ (বিদ্রোহ) সুযোগটিও পাননি । রাসূল (সা.)-এর বিভিন্ন সাহাবী , বিশেষ করে মুয়াবিয়া ও তার সহকর্মীরা ইসলামী রাষ্ট্রে অন্যায়ভাবে হত্যা ও নির্যাতনসহ যে অরাজক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটিয়ে ছিলেন , আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অধিকাংশই ঐসব অপকর্মের যুক্তিযুক্ত ব্যাখা দেয়ার চেষ্টা করে থাকেন । এ ব্যাপারে তাদের প্রধান যুক্তি হল , তারা ছিলেন রাসূল (সা.)-এর সাহাবী । আর সাহাবীদের সম্পর্কে মহানবী (সা.)-এর যেসব হাদীস আমাদের কাছে পৌছেছে , সে অনুযায়ী সাহাবীরা মুজতাহিদ (ইসলামী গবেষক) তাদের ভুলত্রুটি ক্ষমার যোগ্য । মহান আল্লাহ তাদের ওপর সন্তুষ্ট তাই তারা যে কোন ধরণের অন্যায়-অপরাধই করুক না কেন , সে ব্যাপারে তারা ক্ষমা প্রাপ্ত! কিন্তু শীয়াদের দৃষ্টিতে এ যুক্তি আদৌ গ্রহণযোগ্য নয় । কারণ :

প্রথমত : মহানবী (সা.) সত্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যে আন্দোলন করেছেন । এক দল লোককে নিজ বিশ্বাসে ঐক্যবদ্ধ করেছেন এবং নিজের সমগ্র অস্তিত্বকে ঐ পবিত্র লক্ষ্য বাস্তবায়নের স্বার্থে বিলীন করে দিয়েছেন । এ জাতীয় যুক্তি আদৌ বুদ্ধিমত্তা প্রসূত ব্যাপার নয় যে , এত কষ্টের বিনিময়ে স্বীয় পবিত্র লক্ষ্য অর্জিত হওয়ার পর মহানবী (সা.) জনগণ ও ইসলামের পবিত্র নীতিমালার ব্যাপারে তার সঙ্গী বা সাহাবীদেরকে যা ইচ্ছে করার মত পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে যাবেন ? স্বীয় সহকর্মীদের দ্বারা সংঘটিত সত্যের অপ্রলাপ , ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড ও অরাজতাকে তিনি ক্ষমা করবেন! এ জাতীয় কথার অর্থ হচ্ছে যাদের সহযোগীতায় তিনি সত্যের ভিত্তিরপস্তর স্থাপন করেছেন , তাদের দ্বারাই আবার তা ধ্বংস করবেন । এটা মোটেই যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাপার নয় ।

দ্বিতীয়ত : যেসব হাদীসে সাহাবীদের নিষ্কলুষতা ও অপরাধ মুলক শরীয়ত বিরোধী কার্যকলাপকে পরিশুদ্ধতার আবরণ দেওয়া হয়েছে এবং তাদের জন্যে অগ্রিমভাবে ক্ষমার ঘোষণা দেয়া হয়েছে , প্রকৃতপক্ষে পক্ষে ওগুলো সাহাবীদের দ্বারাই বর্ণিত হয়ে আমাদের কাছে পৌছেছে এবং রাসূল (সা.)-এর সাথে তা সম্পর্কিত করা হয়েছে । অথচ ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুযায়ী স্বয়ং সাহাবীরাই একে অন্যের অন্যায়কে কখনও ক্ষমা করেননি । সাহাবীদের অনেকেই একে অনেকে হত্যা করেছেন , পরস্পরকে গালিগালাজ ও অভিশাপ দিয়েছেন এবং একে অনেকে অপদস্থ করতেও ছাড়েননি । প্রতিপক্ষের সামান্যতম ভুলকেও তারা এতটকু ক্ষমার চোখেও দেখেননি । সুতরাং সাহাবীদের কার্যকলাপের সাক্ষ্য অনুযায়ী-ও ঐসব হাদীসের অসত্যতা প্রমাণীত হয় । যদি ঐসব হাদীসকে সত্য বলে ধরে নেয়া হয় , তাহলে তার অর্থ অন্যকিছু হবে । আর তা অবশ্যই সাহাবীদের কলংকহীনতা বা আইনগত বৈধতা সংক্রান্ত নয় । যদি ধরে নেয়া যায় যে , মহান আল্লাহর পবিত্র কুরআনে সাহাবীদের কোন কাজের ব্যাপারে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন ,66 তাহলে সেটা তাদের পূর্ববর্তী কার্যকলাপের প্রশংসারই প্রমাণ । এর অর্থ এই নয় যে , ভবিষ্যতে যা ইচ্ছে তাই করা বা আল্লাহর আদেশ বিরোধী কার্যকলাপও তারা করতে পারবেন ।

উমাইয়া বংশের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা

হিজরী 60 সনে মুয়াবিয়া মৃত্যু বরণ করে । মৃত্যুর পূর্বে সে জনগণের কাছ থেকে আপন পুত্র ইয়াযিদের খেলাফতের ব্যাপারে বাইয়াত গ্রহণ করিয়ে নেয় । সে অনুযায়ী পিতার মৃত্যুর পর ইয়াযিদ ইসলামী রাষ্ট্রের খেলাফতের আসনে অধিষ্ঠিত হয় । ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুযায়ী ইয়াযিদ মোটেও ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিল না । এমন কি পিতার জীবদ্দশাতেও এই যুবক ইসলামী নীতিমালার প্রতি এতটুকু তোয়াক্কাও করত না । বিলাসিতা , উচ্ছৃংখলতা ও লাম্পট্য চারিতার্থ করা ছাড়া আর কোন কাজ তার ছিল না । তার তিন বছরের শাসন আমলে এত অধিক পরিমাণে জঘণ্য অপরাধ সে ঘটিয়েছিল যা ইসলামের ইতিহাসে বিরল । প্রাথমিক যুগে ইসলামকে অসংখ্য জঘণ্য সামাজিক দুর্নীতিকে অতিক্রম করতে হয়েছিল । কিন্তু সেযুগে ইয়াযিদের দ্বারা সাধিত অপকর্মের কোন উদাহরণ ইতিহাসে খু্জে পাওয়া যায় না । ইয়াযিদ তার শাসন আমলের প্রথম বছরই রাসূল (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-কে সংগী-সাথী সহ স্বপরিবারে অত্যন্ত নৃশংস ভাবে হত্যা করে । অতঃপর ইমাম হুসাইন (আ.)-এর পরিবারের মহিলা , শিশু ও আহলে বাইতগণকে (নবীবংশ) শহীদদের কর্তিত মস্তক সহ গণ প্রদর্শনীর জন্যে বিভিন্ন শহরে প্রদক্ষিণ করানো হয় ।67 ইয়াযিদ তার খেলাফতের দ্বিতীয় বছর পবিত্র মদীনা নগরীতে গণহত্যা চালায় এবং তিন দিন পর্যন্ত সে তার সেনাবাহিনীকে ব্যাপক লুটতরাজ ও গণধর্ষনের অনুমতি দিয়েছিল ।68 খেলাফতের তৃতীয় বছর ইয়াযিদ পবিত্র কাবাঘর ধ্বংস করে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়!69 ইয়াযিদের মৃত্যুর পর উমাইয়া বংশীয় মারওয়ান পরিবারের লোকেরা ইসলামী রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতা অধিকার করে । ইতিহাস অনুযায়ী উমাইয়া বংশীয় এগারো জন ব্যক্তি প্রায় সত্তর বছর যাবৎ খেলাফতের শাসন কার্য পরিচালনা করে । ইতিহাসের এ অধ্যায়ই ছিল ইসলাম ও মুসলমানদের জন্যে সবচেয়ে দূর্যোগপূর্ণ ও তিক্ত । যেসময় ইসলামী সমাজের শাসন ক্ষমতায় একজন খলিফা নামধারী অত্যাচারী আরবীয় সম্রাট ছাড়া অন্য কিছুর অস্তিত্ব ছিল না । অবস্থা এক সময় এমন পর্যায়ে গিয়ে দাড়ালো যে , রাসূল (সা.)-এর উত্তরাধিকারী ও দ্বীনের ধারক-বাহক হিসেবে খ্যাত খলিফা অলিদ বিন ইয়াযিদু নির্ভয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন যে , পবিত্র কাবা ঘরের ছাদে একটি ঘর তৈরী করবেন!! হজ্জের সময় তিনি সেখানে বিলাস যাপন করবেন!!70 খলিফা অলিদ বিন ইয়াযিদু পবিত্র কুরআনকে লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করে । তীর নিক্ষেপের সময় কুরআনকে লক্ষ্য করে কবিতার সুরে বিদ্রূপ করে বলে কেয়ামতের দিন যখন তোর খোদার কাছে উপস্থিত হবি , বলিস খলিফা আমাকে ছিন্ন- ভিন্ন করেছে!! 71 শীয়ারা খেলাফতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও ধর্মীয় নেতৃত্ব এ দু টো বিষয়ে অধিকাংশ আহলে-সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের সাথে মৌলিকভাবে ভিন্ন মত পোষণ করত । তারা ইতিহাসের এ অন্ধকারাচ্ছন্ন অধ্যায়ে চরম কষ্ট ও তিক্ততাপূর্ণ দিন যাপন করেছেন । খেলাফত প্রসাশনের অবিচার , অত্যাচার ও অরাজকতা এবং নির্যাতিত আহলে বাইতের ইমামগণের তাকওয়া ও পবিত্রতা দিনের পর দিন তাদের ধর্মীয় বিশাসকে অধিকতর সুদৃঢ় করে তোলে । বিশেষ করে তৃতীয় ইমাম হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদতের হৃদয় বিদ্যারক ঘটনা রাজধানীর বাইরে বিশেষ করে ইরাক , ইয়ামান ও ইরানে শীয়া মতাদর্শের সম্প্রসারণে যথেষ্ট সহযোগিতা করে । উপরোক্ত বক্তব্যর প্রমাণ শীয়াদের পঞ্চম ইমামের (হযরত ইমাম বাকের (আ.)) যুগের ঘটনায় দেখতে পাওয়া যায় । হিজরী বর্ষের এক শতাব্দী তখনও পূর্ণ হয়নি । তৃতীয় ইমাম হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদতের পর 40 বছরও তখন পূর্ণ হয়নি । ইতিমধ্যেই উমাইয়া খলিফার প্রশাসনে বিশৃংখলার সূত্রপাত ঘটে এবং এর ফলে প্রশাসন দুর্বল হয়ে পড়ে । এ সুযোগে খেলাফত বা রাজ্যের চতুর্দিক থেকে শীয়ারা বন্যার বেগে পঞ্চম ইমাম হযরত ইমাম বাকের (আ.)-এর দিকে ধাবিত হয় । তার চর্তুপার্শ্বে ভক্তদের ভীড় জমতে থাকে । তারা ইমাম বাকের (আ.)-এর কাছে হাদীস ও ইসলামের জ্ঞান অর্জন করতে শুরু করে ।72 ইতিমধ্যে হিজরী প্রথম শতাব্দী শেষ হবার পূর্বেই প্রশাসনের ক জন শীর্ষ স্থানীয় ব্যক্তি ইরানের কোম শহরের ভিত্তি স্থাপন করেন এবং তাকে শীয়া প্রধান শহরে রূপান্তরিত করেন ।73 তথাপি শীয়াদেরকে সে যুগে তাদের ইমামগণের (আ.) নির্দেশে তাকিয়া পালন করে অর্থাৎ নিজের ধর্মীয় বিশ্বাস গোপন করে থাকতে হয়েছিল । এরপরও রাসূল (সা.)-এর বংশের সাইয়্যেদগণ ইতিহাসে বহু বার ক্ষমতাসীন শ্বাসক গোষ্ঠির অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে বাধ্য হয়ে ছিলেন । কিন্তু প্রতিবারই তাদেরকে পরাজয় বরণ করতে হয়েছে । অবশেষে নিজেদের প্রাণও তারা এ পথে উৎসর্গ করেছেন । তদানিন্তন স্পর্ধাপূর্ণ শ্বাসকগোষ্ঠি তাদের পবিত্র দেহ পদদলিত করতেও কন্ঠা বোধ করেনি । যায়েদীপন্থী শীয়াদের নেতা জনাব যায়েদের মৃত্যু দেহকে কবর খুড়ে বের করে ফাসির কাষ্ঠে ঝুলানো হয় । অতঃপর ঐ মৃত্যু দেহকে দীর্ঘ তিন বছর যাবৎ ঐ অবস্থায় ঝুলিয়ে রাখা হয় । এরপর ঐ মৃত্যু দেহ ফাসিঁ কাষ্ঠ থেকে নামিয়ে আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয় এবং তার ভষ্মীভূত ছাই বাতাসে উড়িয়ে দেয়া হয়!74 শীয়াদের বিশ্বাস অনুসারে তাদের চতুর্থ (হযরত ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) ও পঞ্চম (হযরত ইমাম বাকের (আ.) ইমামকেও উমাইয়া খলিফারা বিষ প্রয়োগে হত্যা করে ।75 দ্বিতীয় ইমাম হাসান (আ.) ও তৃতীয় ইমাম হুসাইন (আ.)-ও তাদের হাতেই শাহাদত বরণ করে ছিলেন । উমাইয়া খলিফাদের প্রকাশ্যে নীতিহীন কার্যকলাপ এতই জঘণ্য পর্যায়ে গিয়ে পৌছে ছিল যে আহলে-সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অনুসারীরা যারা সাধারণত খলিফাদের আনুগত্যকে ফরয বলে বিশ্বাস করে , তারাও খলিফাদেরকে দু টো শ্রেণীতে ভাগ করতে বাধ্য হয় । ঐ দু শ্রেণী হল খুলাফায়ে রাশেদীন এবং খুলাফায়ে রাশেদীনদের পরবর্তী যুগ । রাসূল (সা.)-এর মৃত্যু পরবর্তী ইসলামের প্রথম চার খলিফা [আবু বকর , ওমর , ওসমান ও হযরত আলী (আ.) ] প্রথম শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত । আর মুয়াবিয়া থেকে শুরু করে বাকী সব খলিফাই দ্বিতীয় শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত । শাসন ক্ষমতায় থাকা কালীন উমাইয়া খলিফা তাদের নিপীড়ন মুলক নীতির কারণে জনগণের চরম ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছিল । এর প্রমাণ পাওয়া যায় যখন সর্বশেষ উমাইয়া খলিফা ক্ষমতাচ্যুত ও নিহত হন । নিহত হবার পর তার দু পুত্র সহ খলিফা পরিবারের বেশ কিছু সদস্য রাজ প্রাসাদ থেকে পলায়ন করে । কিন্তু পালানোর পর যেখানেই তারা আশ্রয় প্রার্থনা করেছে ব্যর্থ হয়েছে । কোথাও আশ্রয় না পেয়ে নওবা , ইথিওপিয়া এবং বেজাওয়ার ও মরুভূমিতে লক্ষ্যহীনভাবে তাদের ঘুরে বেড়াতে হয়েছে । এর ফলে তাদের অধিকাংশই ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় প্রাণ হারায় । অবশিষ্টরা ইয়ামানের দক্ষিণ অঞ্চলে এসে পৌছে । সেখানে ভিক্ষার মাধ্যমে পথ খরচ যোগাড় করে এবং কুলিদের ছদ্মবেশে মক্কার দিকে রওনা হয় । কিন্তু সেখানে মানুষের মাঝে তারা নিখোজ হয়ে যায় ।76

হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীতে শীয়াদের অবস্থা

হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীর প্রথম তৃতীয়াংশের শেষদিকে উমাইয়া খলিফাদের চরম নির্যাতন ও অসদাচরণের পরিণতিতে সকল ইসলামী দেশ গুলোতে উমাইয়াদের বিরুদ্ধে একের পর এক বিদ্রোহ , বিপ্লব ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হতে থাকে । এর পাশাপাশি ইরানের খোরাসান প্রদেশে একদল লোক জনগণকে আহলে-বাইতের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের আহবান জানাতে থাকে । জনাব আবু মুসলিম মারওয়াযি নামক জনৈক ইরানী সর্দার ছিলেন ঐ আন্দোলনের নেতা । তারা উমাইয়া খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং ক্রমেই তাদের আন্দোলন অগ্রগতি লাভ করতে থাকে । অবশেষে তারা উমাইয়াদেরক ক্ষমতাচ্যুত করতে সমর্থ হয় ।77 ঐ আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে পক্ষে শীয়াদের সুগভীর প্রচার অভিযান থেকেই উৎসরিত হয়েছিল । আহলে-বাইতের শহীদদের রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণের নামেই ঐ আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল । এমন কি জনগণ নবীবংশের জনৈক জনপ্রিয় ব্যক্তির হাতে গোপনে বাইয়াত (আনুগত্যের শপথ) গ্রহণ করেছিল । কিন্তু এতদসত্ত্বেও এ ব্যাপারে শীয়া ইমামগণের (আ.) সরাসরি কোন নির্দেশ বা ইংগিত ছিল না । এর প্রমাণ পাওয়া যায় , যখন জনাব আবু মুসলিম মদিনায় ইমামিয়াপন্থী শীয়াদের 6ষ্ঠ ইমামের (হযরত ইমাম জাফর সাদিক (আ.)) কাছে খেলাফতের জন্যে গৃহীত বাইয়াত সম্পূর্ণ করতে চান ।

হযরত ইমাম জাফর সাদিক (আ.) তৎক্ষনাৎ ঐ প্রস্তাব পত্যাখ্যান করেন । তিনি বলেনঃ তুমি আমার লোকদের অন্তর্ভুক্ত নও । আর সময়ও এখনও আসেনি78 অবশেষে আব্বাসীয় বংশের লোকেরা আহলে-বাইতের নাম ভাংগিয়ে খেলাফতের ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয় ।79 তারা শাসন ক্ষমতা লাভের পর প্রথম দিকে জনগণ ও হযরত আলী (আ.)-এর অনুসারী শীয়াদের সাথে সদাচরণ করতে থাকে । এমন কি আলাভীদের (শীয়াদের) শহীদদের রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণের নামে তারা উমাইয়া বংশীয় লোকদের গণহত্যা চালায় । তারা উমাইয়া খলিফাদের কবর খুড়ে তাদের দেহাবশেষে যা কিছু পেত অগ্নিদগ্ধ করত ।80 কিছুদিন কাটতে না কাটতেই তারা উমাইয়া খলিফাদের মতই নিপীড়নমূলক নীতি গ্রহণ করে । অন্যায় অত্যাচার মূলক ও নীতিহীন কার্যকলাপ ঘটাতে তাদের এতটকু কন্ঠাবোধও হল না । আব্বাসীয় খলিফা মানসুরের দ্বারাই আহলে সুন্নাতের ইমাম আবু হানিফা জেল বন্দী হন ।81 ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বালও জনৈক আব্বাসীয় খলিফার দ্বারা চাবুকে প্রহৃত হন ।82 শীয়াদের 6ষ্ঠ ইমাম হযরত ইমাম জাফর সাদিক (আ.) ও আব্বাসীয় খলিফার দ্বারা নির্যাতিত হন এবং বিষ প্রয়োগে নিহত হন ।83 আব্বাসীয় খলিফারা শীয়াদের দলে দলে হত্যা করে । অনেক শীয়াকেই জীবন্ত কবর দিয়ে তারা হত্যা করেছে । অসংখ্য শীয়াকে হত্যা করে তাদের উপর দেয়াল এবং বিভিন্ন সরকারী ভবন তৈরী করা হয় । আব্বাসীয় খলিফা হারুনের শাসন আমলে ইসলামী সমাজ , ক্ষমতা ও পরিধি ব্যাপক আকারে বিস্তৃতি লাভ করে । খলিফা মাঝে মাঝে সূযের দিকে লক্ষ্য করে বলতেন : হে সূর্য ! যেথায় খুশি জাতি ছড়িয়ে যা কিন্তু তা যেন আমার সাম্রাজ্যের বাইরে না হয়! খলিফার সেনা বাহিনী মধ্যপ্রাচ্য ছাড়িয়ে বিশ্বে সর্বত্র বিজয়ী বেশে এগিয়ে যাচ্ছিলো । অথচ খলিফার রাজ প্রাসাদের মাত্র কয়েক কদম দূরে বাগদাদ সেতুর উপর খলিফার অজান্তে এবং বিনা অনুমতিতে কিছু লোক পথচারীদের কাছ থেকে টোল আদায় করতে থাকে । এমনকি একদিন স্বয়ং খলিফা ঐ সেতু অতিক্রম করার সময় টোল আদায়ের জন্য তার পথরোধ করা হয়েছিল ।84 জনৈকা গায়িকার যৌন আবেদনময়ী গানের মাত্র দু টি চরণ শুনেই আব্বাসীয় খলিফা আমিন উত্তেজিত হয়ে উঠেন এবং সাথে সাথেই ঐ গায়িকাকে 30 লক্ষ দিরহাম উপহার দেন । গায়িকা ঐ অপ্রত্যাশিত ঘটনায় আবেগ আপ্লুত হয়ে খলিফা আমিনের পায়ে লুটিয়ে পড়ে জিজ্ঞেস করে : এতোগুলো অর্থ সবই কি আমাকে দান করলেন ? খলিফা উত্তরে বলে: এটা তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয় । এ টাকা পুনরায় সাম্রাজ্যের অচেনা অন্য আরেক অঞ্চল থেকে আদায় করে নেব!85 বাইতুল মালে র (রাজকোষ) নামে পাহাড় পরিমাণ অর্থ সম্পদ সমগ্র ইসলামী সাম্রাজ্য থেকে খলিফাদের কাছে নিয়মিত এসে জমত । আর খলিফারা ঐ অর্থ তাদের বিলাসিতা , লাম্পট্য ও সত্য নিধনের কাজে ব্যয় করতেন । হাজার হাজার রূপসী ক্রীতদাসী ও সুন্দর চেহারার তরুণ-তরুণীতে আব্বাসীয় খলিফাদের দরবার ছিল পরিপূর্ণ !!

উমাইয়া বংশের পতন ও আব্বাসীয় বংশের শাসনক্ষমতা লাভের মাধ্যমে অত্যাচারী শ্বাসকগোষ্ঠির নাম পাল্টানো ছাড়া শীয়াদের অবস্থার এতটুকও উন্নতি ঘটেনি ।

হিজরী তৃতীয় শতাব্দীতে শীয়াদের অবস্থা

হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর প্রথম দিকে শীয়ারা সর্বপ্রথম কিছুটা স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পায় । কারণ

প্রথমতঃ ইতিমধ্যে সুরিয়ানী ও গ্রীক ভাষার প্রচুর বিজ্ঞান ও দর্শনের বই আরবীতে অনুদিত হয়েছিল । জনগণের মাঝে বুদ্ধিবৃত্তিক (দার্শনিক) ও প্রমাণ্য জ্ঞান চর্চা ও শিক্ষার হিড়িক পড়ে গিয়েছিল । এ ছাড়াও আব্বাসীয় খলিফা মামুন (195-218 হিজরী) মু তাযিলা মাযহাবের অনুসারী ছিলেন । তিনি যুক্তিভিত্তিক প্রমাণ্য মাযহাবের প্রতি অনুরাগী ছিলেন । এ কারণেই তিনি যুক্তিযুক্ত প্রমাণভিত্তিক বিভিন্ন ধর্ম ও মাযহাব চর্চার পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে ছিলেন । শীয়া আলেম ও দার্শনিকগণও এ সুযোগটি লুফে নেয় । জ্ঞান চর্চাসহ আহলে- বাইতের মাযহাব প্রচারের সার্বিক কর্মসূচী পূর্ণদ্দোমে চালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে তারা এ 2 সুযোগের পূর্ণ সদ্বব্যাবহার করেন ।86

দ্বিতীয়তঃ এ ছাড়াও আব্বাসীয় খলিফা মামুন তার নিজের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের স্বার্থে শীয়াদের অষ্টম ইমাম , হযরত ইমাম রেজা (আ.) কে তার সিংহাসনের উত্তরাধিকার প্রদানের অংগীকার করেছিলেন ।87 এফেলে আহলে- বাইতের অনুসারী ও ভক্তরা শ্বাসকগোষ্ঠির অত্যাচার ও উৎপীড়ন থেকে কিছুটা রক্ষা পেয়েছিল । সেদিন কিছুটা রাজনৈতিক স্বাধীনতাও তাদের ভাগ্যে জুটে ছিল । কিন্তু না , সে ভাগ্য আর বেশী দিন দীর্ঘায়িত হয়নি । তলোয়ারের ধারালো অগ্রভাগ আবারও তাদের দিকেই ফেরানো হল । পাক্তন শ্বাসকগোষ্ঠির বিস্মৃত প্রায় শোষণ ও নির্যাতন নীতি আবার তাদের উপর চালানো হয় । বিশেষ করে আব্বাসীয় খলিফা মুতাওয়াক্কিল (232 হিঃ -247 হিঃ) আলী (আ.) ও তার শীয়াদের প্রতি চরম বিদ্বেষী ছিলেন । এমন কি তার নির্দেশেই কারবালা প্রান্তরে অবস্থিত হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর পবিত্র মাযার সম্পূর্ণ রূপে ভেঙ্গে- গুড়িয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয় ।88

হিজরী চতুর্থ শতাব্দীতে শীয়াদের অবস্থা

হিজরী চতুর্থ শতাব্দীতে এমন বেশ কিছু কারণের উদ্ভব ঘটে , যা শীয়াদেরকে শক্তিশালী ও সম্প্রসারিত হবার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সহযোগিতা করে । আব্বাসীয় খেলাফতের রাজনৈতিক ও প্রসাশনিক দূর্বলতা ও বুইয়া বংশীয় বাদশাহের অভ্যুদয় ছিল ঐসব কারণের মধ্যে অন্যতম ।

বুইয়া বংশীয় বাদশারা ছিলেন শীয়া মাযহাবের অনুসারী । রাজধানী বাগদাদের খেলাফত প্রশাসনের কেন্দ্র এবং স্বয়ং খলিফার উপর তাদের প্রচন্ড প্রভাব ছিল । ঐ দৃষ্টিগ্রাহ্য রাজনৈতিক শক্তির ছত্রছায়ায় শীয়ারা সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে স্বীয় মতাদর্শ প্রচারের সুযোগ পায় , যা ইতোপূর্বে ক্ষমতাসীন খলিফাদের উৎপীড়নের কারণে কখনও বাস্তবতার মুখ দেখতে পায়নি । ঐতিহাসিকদের বর্ণনা অনুসারে ঐ (4র্থ শতাব্দীতে) বড় শহরগুলো ছাড়া আরবের অধিকাংশ অঞ্চল শীয়া অধ্যুষিত ছিল । এ ছাড়াও হাজার , ওমান ও সা য়াদাসহ বেশ কিছু শহরও ছিল শীয়া অধ্যুষিত । ইরাকের বসরা শহর যুগের পর যুগ সুন্নীদের এবং কুফা শহর শীয়াদের কেন্দ্র হিসেবে গণ্য হত । এ দু শহরের মাঝে সব সময়ই মাজহাবগত প্রতিযোগিতা লেগেই থাকত । এভাবে তারাবলুস , নাবলস , তাবারীয়া , হালাব , হেরাত , আহওয়ায , ও ইরানের পারস্য উপসাগরীয় তীরবর্তী অঞ্চল সমূহ ছিল শীয়া অধ্যুষিত ।89 হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর প্রারম্ভে জনাব নাসের আতরুশ নামক জনৈক ব্যক্তি বহু বছর যাবৎ ইরানের উত্তরাঞ্চলে (শীয়া মতাদর্শ) প্রচার অভিযান চালায় । পরবর্তীতে তাবারিস্থান নামক অঞ্চলের শাসন ক্ষমতা তিনি লাভ করেন এবং ঐ শাসন ক্ষমতা তার বংশের বেশ কয়েক প্রজন্ম পর্যন্ত অব্যাহত থাকে । অবশ্য জনাব আতরুশের পূর্বে ও হাসান বিন যায়েদ আলাভী (শীয়া) বহু বছর তাবারিস্থানের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন ।90 হিজরী চতুর্থ শতাব্দীতেই ফাতেমী বংশীয় ইসমাঈলীপন্থী শীয়ারা মিসরের শাসন ক্ষমতা লাভ করে এবং বেশ কয়েক প্রজন্ম পর্যন্ত তাদের রাজত্ব অব্যাহত (292-527 হিজরী বর্ষ) থাকে ।91 ইতিহাসে বহুবার বাগদাদ , বসরা , নিশাপুর ইত্যাদি বড় বড় শহরে শীয়া-সুন্নী সাম্প্রদায়িক বিতর্ক ও সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটেছিল , যার অনেক গুলোতেই শীয়ারা বিজয়ী হয়েছিল ।

হিজরী নবম শতাব্দীতে শীয়াদের অবস্থা

হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর মতই হিজরী পঞ্চম থেকে নবম শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্তও শীয়ারা তাদের বিস্তার লাভের গতি অব্যাহত রাখে । ঐ যুগে ক্ষমতাসীন বাদশারা ছিলেন শীয়া মতাদর্শের অনুসারী । ফলে তারাও শীয়া মতাদর্শের বিস্তৃতিতে যথেষ্ট সাহায্য করেন । হিজরী পঞ্চম শতাব্দীর শেষ ভাগে কিলাউল মাউত নামক স্থানে ইসমাঈলীপন্থী শীয়া মতাদর্শ প্রচারের অভ্যুদয় ঘটে । ইসমাঈলীরা প্রায় দেড় শতাব্দী পর্যন্ত ইরানের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করে ।92 মারআ শী বংশীয় সাইয়্যেদগণ (রাসূল (সা.)-এর বংশের লোক) বহু বছর যাবৎ ইরানের মাযেন্দারানে রাজত্ব করেন ।93 শাহ্ খোদা বান্দেহ নামক জনৈক মোগল সম্রাট শীয়া মাযহাব গ্রহণ করেন এবং তারপরও বহু বছর যাবৎ তার উত্তরাধিকারীরা (শীয়া) ইরানের রাজত্ব করেন এবং শীয়া মাযহাবের উন্নতি ও সম্প্রসারণে সাহায্য করেন । একইভাবে ইরানের তাব্রিজ অকে কুইউ নালু কোররে কুইউ নালু বংশীয় শীয়া সম্রাটরাও বহু বছর ঐ অঞ্চলে শাসন করে ।94 যাদের রাজ্যসীমা ইরানের (তাব্রিজ থেকে) ফার্স প্রদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল । ঐ একই সময় মিসরে ফাতেমীয়রা বহু বছর যাবৎ শাসন করে । অবশ্য মাযহাবগত শক্তি বিভিন্ন বাদশাহদের যুগে বিভিন্ন রকম ছিল । যেমন মিসরে ফাতেমীয়দেরকে ক্ষমতাচ্যুত করে আইয়ূবীয় বংশ যখন শাসন ক্ষমতা লাভ করে তখন , মিশরের অবস্থা সম্পূর্ণ প্রাল্টে যায় । মিশর ও সিরিয়ার শীয়ারা সম্পূর্ণ রূপে তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলে । ফলে তলোয়ারের সম্মুখে অসংখ্য শীয়াদের প্রাণ বিসর্জন দিতে হয় ।95 বিখ্যাত শহীদলু আওয়াল (প্রথম শহীদ) জনাব মুহাম্মদ বিন মুহাম্মদ মাক্কীর শাহাদতের ঘটনা এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য । তিনি ইতিহাসের এক অসাধারণ মেধাসম্পন্ন শীয়া ফকীহ্ (ইসলামী আইন বিশারদ) ছিলেন । শুধুমাত্র শীয়া মাযহাবের অনুসারী হওয়ার অপরাধে হিজরী 786 সনে দামেস্কে তাকে হত্যা করা হয়েছিল!96 একইভাবে সিরিয়ার হালাব শহরে জনাব শেইখ এশরাক শাহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দি নামক জনৈক বিখ্যাত দার্শনিককে শীয়া হওয়ার অপরাধে হত্যা করা হয়!!97

মোটকথা , এই পাঁচ শতাব্দী যাবৎ ক্ষমতাসীন মৈত্রী শ্বাসকগোষ্ঠি কতৃক প্রদত্ত ক্ষমতা ও স্বাধীনতা ভোগ করায় শীয়া মতাদর্শের অনুসারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি প্রায় । আবার কখনও বা তারা বৈরী শ্বাসক গোষ্ঠির কোনপানলেও প্রতিত হয় । কিন্তু ঐ দীর্ঘ সময়ে কোন ইসলামী দেশে শীয়া মাযহাব কখনও রাষ্ট্রিয় মাযহাব হিসেবে ঘোষিত হয়নি ।

হিজরী দশম ও একাদশ শতাব্দীতে শীয়াদের অবস্থা

জনাব শেখ সাফী আর্দেবিলী (মৃত্যু হিজরী 735 সনে) নামক জনৈক ব্যক্তি ছিলেন শীয়া মাযহাবের অনুসারী তরিকতপন্থী সুফী সাধাক । হিজরী 906 সনে ঐ পরিবারের জনৈক 13 বছর বয়সী এক তরুণ তার বাবার ভক্ত মুরীদদের মধ্য থেকে 300 জন দরবেশের সহযোগীতায় একটি শক্তিশালী ও স্বাধীন শীয়ারাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে আর্দেবীলে বিদ্রোহ করেন । এরপর তারা একের পর এক দেশ দখল করতে থাকে এবং ইরানের গোত্রীয় প্রশাসন পদ্ধতি ধ্বংস করে চলে । এভাবে স্থানীয় রাজা-বাদশাহ্ এবং বিশেষ করে ওসমানী সাম্রাজ্যের অধীন ওসমান বংশীয় বাদশাদেরকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে পরাজিত করে খণ্ড- বিখণ্ড ইরানকে পূর্ণাঙ্গ একটি দেশে রূপ দেয় । তিনি স্বীয় অধিকৃত অঞ্চলে শীয়া মাযহাবকে রাষ্ট্রিয় মর্যাদা প্রদান করেন ।98 বাদশাহ্ ইসমাইল সাফাভীর মৃত্যুর পর দ্বাদশ হিজরী শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত সাফাভী বংশীয় বাদশাগণ একের পর এক রাজত্ব চালিয়ে যান । তারা প্রত্যেকেই বংশানুক্রমে ইমামিয়া শীয়া মাযহাবকে রাষ্ট্রিয় মর্যাদা প্রদান করেন এবং তা সমর্থন ও প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পান । এ অবস্থা মহাসম্রাট শাহ আব্বাস কবীর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে , যখন সাফাভী বংশীয় রাজত্ব ক্ষমতার চুড়ান্ত পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল এবং তাদের রাজ্যসীমা বর্তমান ইরানের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণে (হিজরী 1384 সন) পৌছে ছিল ।

হিজরী দ্বাদশ থেকে চতুর্দশ শতাব্দীতে শীয়াদের অবস্থা

পূর্ববর্তী তিন শতাব্দী যাবৎ শীয়া সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উন্নতি প্রাকৃতিক গতিতে অব্যাহত ছিল । অবশেষে হিজরী চতুর্দশ শতাব্দীর শেষভাগে এসে শীয়া মাযহাব আনুষ্ঠানিক ভাবে গণপরিচিতি লাভ করে । ইয়ামান ও ইরাকের সংখ্যা গরিষ্ঠ জনসাধারণ শীয়া মাযহাবের অনুসারী । এ ছাড়াও মুসলিম বিশ্বের সর্বত্রই কমবেশী শীয়াদের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয় । বর্তমানে সমগ্র বিশ্বে শীয়া জনসংখ্যা 10 কোটি ছাড়িয়ে গেছে ।99