ইসলাম ও শীয়া মাযহাব

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব 16%

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 31 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 41876 / ডাউনলোড: 5858
সাইজ সাইজ সাইজ
ইসলাম ও শীয়া মাযহাব

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

‘ইসলাম ও শীয়া মাযহাব’ নামক এ গ্রন্থে ইসলামের দু’টি বৃহৎ উপদলের (শীয়া ও সুন্নী) অন্যতম শীয়া মাযহাবের প্রকৃত পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে । শীয়া মাযহাবের উৎপত্তি, বিকাশ ও চিন্তাধারার প্রকৃতি এবং ইসলামী জ্ঞানের ব্যাপারে শীয়া মাযহাবের দৃষ্টিভঙ্গী এ বইয়ে আলোচিত হয়েছে ।

প্রথম অধ্যায়ের দ্বিতীয় অংশ

শীয়া মাযহাবের গোত্রসমূহ

দল বিভক্তির মূলকারণ :

প্রত্যেক মাযহাবেই কম বেশী এমন কিছু বিষয় রয়েছে , যা ঐ মাযহাবের মূলভিত্তি রচনা করে । ঐ বিষয়গুলোর পরে অন্যসব বিষয় দ্বিতীয় শ্রেণীর পর্যায়ভূক্ত । তাই মাযহাবের মূলনীতির উপর পূর্ণ আস্থা রেখে দ্বিতীয় শ্রেণীর খুঁটি-নাটি বিষয়ের মত পার্থক্যের ভিত্তিতে অন্য যেসব দল গঠিত , সেসব দল ঐ মূল মাযহাবের উপদল হিসেবে পরিচিত । পৃথিবীর সকল ঐশী ধর্মেই (ইহুদী , খৃষ্টান , মাজুসী ও ইসলাম) এ ধরণের দল ও উপদলের উপস্থিতি বিদ্যমান । প্রথম তিন ইমামের {হযরত ইমাম আলী (আ.) , হযরত ইমাম হাসান (আ.) ও হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) } যুগে শীয়া মাযহাবের কোন উপদলের সৃষ্টি হয়নি । হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদতের পর অধিকাংশ শীয়াই ইমাম হুসাইন (আ.)-এর পুত্র হযরত ইমাম সাজ্জাদ (জয়নুল আবেদীন) (আ.)-কে ইমাম হিসাবে গ্রহণ করে । কিন্তু কিছু সংখ্যক লোক , যারা কিসানিয়া নামে পরিচিত ছিল , ইমাম আলী (আ.)-এর তৃতীয় পুত্র হযরত মুহাম্মদ বিন হানাফিয়াকে তাদের ৪র্থ ইমাম হিসাবে গ্রহণ করে । তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী হযরত মুহাম্মদ বিন হানাফিয়াই ছিলেন সেই প্রতীক্ষিত মাহদী (আ.) । যিনি রোযাভী নামক পাহাড়ে অদৃশ্য হয়েছিলেন এবং কোন একদিন আত্মপ্রকাশ করবেন! হযরত ইমাম সাজ্জাদ (জয়নুল আবেদীন) (আ.)-এর শাহাদতের পর অধিকাংশ শীয়ারাই তদীয় পুত্র হযরত ইমাম বাকের (আ.)-এর নেতৃত্ব গ্রহণ করে । কিন্তু কিছু সংখ্যক শীয়া হযরত ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.)-এর শাহাদত প্রাপ্ত অন্য এক পুত্র যাইদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন । যারা পরবর্তীতে যাইদিয়া নামে পরিচিতি লাভ করে ।

হযরত ইমাম মুহাম্মদ বাকের (আ.)-এর শাহাদতের পর তার অনুসারী শীয়ারা তদীয় পুত্র হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-এর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন । হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-এর শাহাদতের পর অধিকাংশ শীয়ারাই তদীয় পুত্র হযরত ইমাম মুসা কাজেম (আ.)-কে তাদের সপ্তম ইমাম হিসাবে গ্রহণ করেন । তবে কিছু সংখ্যক শীয়া হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-এর প্রথম পুত্র ইসমাঈলকে ইমাম হিসাবে গ্রহণ করে । যদিও হযরত ইসমাঈল তার পিতার জীবদ্দশাতেই মৃত্যু বরণ করে ছিলেন । এভাবে হযরত ইসমাঈলকে ইমাম হিসাবে গ্রহণের মাধ্যমে তারা নিজেদেরকে বৃহত্তর শীয়া জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এবং পরবর্তীতে ইসমাঈলীয়া হিসেবে পরিচিতি লাভ করে । আবার শীয়াদের কেউ কেউ হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-এর অন্য পুত্র হযরত আবদুল্লাহ আফতাহকে ইমাম হিসেবে গ্রহণ করে । শীয়াদের অন্য একটি অংশ ৬ষ্ঠ ইমামের অন্য এক পুত্র মুহাম্মদকে তাদের ইমাম হিসাবে গ্রহণ করে । শীয়াদের আরেকটি অংশ ৬ষ্ঠ ইমাম হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-ই তাদের সর্বশেষ ইমাম হিসেবে বিশ্বাস করে । হযরত ইমাম মুসা কাজিমের শাহাদতের পর অধিকাংশ শীয়াই তদীয় পুত্র হযরত ইমাম রেজা (আ.)-কে তাদের অষ্টম ইমাম হিসাবে গ্রহণ করে । শীয়াদের একটি অংশ সপ্তম ইমাম হযরত ইমাম মুসা কাজেম (আ.)-কেই তাদের সর্বশেষ ইমাম হিসাবে বিশ্বাস করে । আর পরবর্তীতে তারা ওয়াকিফিয়াহ নামে পরিচিতি লাভ করে । কিন্তু অষ্টম ইমাম হযরত ইমাম রেজা (আ.) থেকে দ্বাদশ ইমাম হযরত মাহদী (আ.) পর্যন্ত শীয়াদের মধ্যে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য উপদলের সৃষ্টি হয়নি । যদিও এসময়ে উপদল সৃষ্টির মত বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটেছিল , কিন্তু খুব বেশীদিন তা টিকে থাকেনি । বরং এমনিতেই সে সমস্যা মিটে গিয়েছিল । যেমনঃ দশম ইমাম হযরত নাকী (আ.)-এর পুত্র জাফর একাদশ ইমাম হযরত ইমাম আসকারী (আ.)-এর শাহাদতের পর ইমামতের দাবী করেন । ফলে শীয়াদের একটি অংশ তার অনুসারীও হয়ে পড়ে । কিন্তু অল্প কিছু দিন পরই তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে । ওদিকে জাফরও ইমামতের দাবী নিয়ে আর তেমন একটা উচ্চবাচ্য করেনি । ফলে ব্যাপারটা ওখানেই ধামা চাপা পড়ে । এ ছাড়াও ইসলামী আইন (ফিকাহ) ও মৌলিক বিশ্বাস সমূহে শীয়া পন্ডিতদের মধ্যে জ্ঞানগত খুঁটিনাটি বিষয়ে কিছু মতভেদ রয়েছে , যেগুলোকে সঠিক অর্থে শীয়াদের উপদল হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না । উপরোল্লিখিত অধিকাংশ শীয়া উপদলগুলো বেশ অল্পদিনের মধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে যায় । পরবর্তীতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুল শীয়া জনগোষ্ঠীর মোকাবিলায় মুলতঃ মাত্র দু টি দলই টিকে থাকে । এরা হচ্ছে যাইদিয়াহ ইসমাঈলীয়াহ দল । এদের অস্তিত্ব বর্তমানে ইয়ামান , ভারত এবং লেবাননসহ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে পরিলক্ষিত হয় । এ কারণেই দ্বাদশ ইমামপন্থী শীয়াদের পাশাপাশি শুধুমাত্র যাইদিয়াহ ও ইসমাঈলীয়াহ্ শীয়াদের আলোচনাই যথেষ্ট বলে মনে করছি ।

যাইদিয়াহ্ শীয়া উপদল

চতুর্থ ইমাম হযরত ইমাম সাজ্জাদ (জয়নুল আবেদীন) (আ.)-এর শাহাদত প্রাপ্ত পুত্র হযরত যাইদের অনুসারীরাই যাইদিয়াহ নামে পরিচিত । হিজরী ১২১ সনে হযরত যাইদ , উমাইয়া খলিফা হিশাম বিন আব্দুল মালিকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন । একদল লোক তার হাতে এ উপলক্ষ্যে বাইয়াতও করে । ইরাকের কুফা শহরে খলিফার বাহিনীর সাথে যুদ্ধের সময়ে হযরত যাইদ শাহাদত বরণ করেন । হযরত যাইদের অনুসারীরা তাকে পবিত্র আহলে বাইতের পঞ্চম ইমাম হিসাবে বিশ্বাস করে । হযরত যাইদের পর তদীয় পুত্র ইয়াহ্ইয়া বিন যাইদ তার স্থলাভিষিক্ত ´ হন । তিনিও উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ বিন ইয়াযিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং শহীদ হন । এর পর মুহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ আব্বাসীয় খলিফা মানসুর দাওয়ানিকির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং শহীদ হন । ইয়াহইয়া বিন যাইদের শাহাদতের পর উপরোক্ত দু জনকেও যাইদিয়াহগণ্ ইমাম হিসেবে বিশ্বাস করেন । কিন্তু এর পর বেশ কিছু যুগ পর্যন্ত যাইদিয়াদের কার্যক্রমে বিশৃংখলা বিরাজ করে । অতঃপর নাসের অতরুশ নামে হযরত যাইদের ভ্রাতৃবংশীয় জনৈক ব্যক্তি খোরাসানে আত্মপ্রকাশ করেন । কিন্তু স্থানীয় শ্বাসকগোষ্ঠির উৎপীড়নের কারণে সেখান থেকে পালিয়ে মাযেন্দারান গিয়ে আশ্রয় নেন । মাযেন্দারানবাসী তখনও ইসলাম গ্রহণ করেনি । জনাব নাসের অতরুশ দীর্ঘ ১৩ বছর যাবৎ মাযেন্দারান ইসলামের প্রচার কার্যচালান এবং প্রচুর সংখ্যক লোককে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন এবং এরা সবাই যাইদিয়াহ পন্থী শীয়ায় পরিণত হয় । এর পর তাদের সহযোগীতায় তাবারিস্থানের একটি অংশ দখল করে জনগণের ইমাম হিসাবে সেখানে রাজ্য পরিচালনা করতে থাকেন । তার পর বহুযুগ ধরে তার বংশের উত্তরাধিকারীরা একের পর এক ঐ অঞ্চলে ইমাম হিসেবে রাজ্য শ্বাসনের কাজ চালিয়ে যান । যাইদিয়া দের বিশ্বাস অনুসারে হযরত ফাতেমা (আ.)-এর বংশের যে কোন আলেম , বীর , উদার ও সাধুপুরুষ যদি সত্যের পক্ষে রাজনৈতিক বিদ্রোহ পরিচালনা করেন তাহলে , তিনিই ইমাম হওয়ার যোগ্যতার অধিকারী হবেন । যাইদিয়ারা তাদের প্রাথমিক অবস্থায় ইসলামের প্রথম দু খলিফা আবু বকর ও ওমরকেও তাদের ইমাম হিসেবে গ্রহণ করত । কিন্তু পরবর্তীতে যাইদিয়া দের কিছু লোক প্রথম দু খলিফাকে তাদের ইমামের লিষ্ট থেকে বাদ দেন এবং হযরত ইমাম আলী (আ.)-কে তাদের সর্বপ্রথম ইমাম হিসেবে ঘোষণা করেন । মৌলিক বিশ্বাসের দিক থেকে যাইদিয় রা মু তাযিলাদের সদৃশ্য । কিন্তু ফিকহের ব্যাপারে তারা আহলে সুন্নাতের (চার মাজহাবের একটি) হানাফি মাযহাবের অনুসারী , যার নেতা হল ইমাম আবু হানিফা । অবশ্য জ্ঞানগত বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয়ে তাদের মধ্যে আভ্যন্তরীণ মত পর্থক্যও রয়েছে ।১০০

ইসমাঈলীয়া সম্প্রদায় ও তার গোত্র সমূহ

বাতেনী দল: ৬ষ্ঠ ইমাম হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-এর প্রথম পুত্রের নাম ছিল ইসমাঈল ।১০১ তিনি তার পিতা হযরত জাফর সাদেক (আ.)-এর জীবদ্দশাতেই মৃত্যু বরণ করেন । পুত্র ইসমাঈলের মৃত্যুর ব্যাপারে স্বয়ং হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.) নিজে সাক্ষী দেন এবং মদীনার তদানিন্তন শ্বাসকও এ ব্যাপারে সাক্ষী দেন । তথাপি শীয়াদের একটি দল বিশ্বাস করত যে , তিনি মৃত্যু বরণ করেননি , বরং আত্মগোপন করেছেন এবং তিনি পুনরায় আত্মপ্রকাশ করবেন! আর তিনি হচ্ছেন সেই প্রতিশ্রুত ইমাম মাহদী (আ.) । পুত্র ইসমাঈলের মৃত্যুর ব্যাপারে ৬ষ্ঠ ইমামের সাক্ষ্য প্রদানের বিষয়টি এক প্রকারের তা মিদ (পবিত্র পানি দিয়ে অভিসিঞ্চন করানো) ছিল , যা আব্বাসীয় খলিফা মানসুরের ভয়ে সম্পন্ন করা হয়েছিল । শীয়াদের একটি অংশ বিশ্বাস করতে শুরু করল যে , ইমামতের অধিকার ইসমাঈলেরই । কিন্তু পিতার জীবদ্দশায় মৃত্যুর কারণে ইমামত তার ভাই মুহাম্মদের কাছে স্থানান্তরিত হয়েছে । শীয়াদের অন্য একটি অংশ বিশ্বাস করত যে , ইসমাঈল যদিও পিতার জীবদ্দশাতেই মৃত্যু বরণ করেছেন , তথাপি সেই ইমাম এবং তার মৃত্যুর পর আপন পুত্র মুহাম্মদ বিন ইসমাঈলই পরবর্তী ইমাম হয়েছেন এবং এভাবে ইমামত ইসমাইল বংশেই সীমিত থাকবে । প্রথম দু টি উপদল অল্প দিনের মধ্যেই অবলুপ্ত হয়ে যায় । তবে তৃতীয় উপদলটি এখনও টিকে আছে এবং তার আরও কিছু উপদল সৃষ্টি হয়েছে । ইসমাঈলীয়াগণ বিশ্বাসগত দিক থেকে একটি বিশেষ দর্শনের অধিকারী তা বেশ কিছুটা নক্ষত্র পুজারীদের মত যা ভারতীয় আধ্যাত্মবাদের সাথে মিশ্রিত । ইসলামী আইন ও জ্ঞানের ব্যাপারে ইসমাঈলীয়াগণের বিশ্বাস হচ্ছে , প্রতিটি বাহ্যিক বিষয়েরই একটি অর্ন্তদিক রয়েছে এবং কুরআনের প্রতিটি আয়াতেরই তা উইল (পরিবর্তনশীল ব্যাখা)রয়েছে ।

এ ছাড়াও তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী এ বিশ্ব কখনও হুজ্জাত বা ঐশী প্রমাণ বা প্রতিনিধি শূণ্য হতে পারে না । আল্লাহর সেই হুজ্জাত বা প্রমাণ দু ধরণের : (১) সবাক ও (২) নির্বাক ।

আল্লাহর রাসূল (সা.) তার সবাক প্রমাণ । আর রাসূল (সা.)-এর প্রতিনিধি বা ইমামগণ হচ্ছেন আল্লাহর নির্বাক প্রমাণ । ইমামগণ মহানবী (সা.)-এর উত্তরাধিকারী তথা মহান আল্লাহর সামগ্রিক প্রভূত্বের বহিঃপ্রকাশ ও প্রমাণ স্বরূপ । আল্লাহর এই প্রমাণ বা হুজ্জাতের ভিত্তি সাতটি সংখ্যার মধ্যে আবর্তিত । অর্থাৎ একজন নবী আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত হন , যিনি শরীয়ত ও বিলায়াতের (কর্তৃত্ব ) ক্ষমতার অধিকারী । তার পর তার ওসিয়াত (উইল) অনুসারে সাতজন তার উত্তরাধিকারী হবেন , যাদের সবাই সমমর্যাদা সম্পন্ন হবেন । কিন্তু এদের মধ্যে সপ্তমব্যক্তি নবুয়তের অধিকারীও হবেন এবং তিনি তিনটি পদের অধিকারী হবেন । নবুয়ত , ওসিয়ত , বিলায়াত । পুনরায় তার পর তাঁর ওসিয়ত (উইল) অনুযায়ী সাত জন ব্যক্তি তার উত্তরাধিকারী হবেন । এদের সপ্তম পূর্বের মতই তিনটি পদ বা মর্যাদার অধিকারী হবেন । আর এ ভাবেই এই ধারা অব্যাহত থাকবে । তারা বলে থাকেন : হযরত আদম (আ.) সর্বপ্রথম নবুয়ত ও বিলায়াত সহ আল্লাহর পক্ষথেকে অবতির্ণ হয়েছেন । তার পর , তার সাত জন উত্তরাধিকারী ছিলেন । এদের মধ্যে সপ্তম ব্যক্তি হচ্ছেন হযরত নুহ (আ.) । আর হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর সাতজন উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সপ্তম বিশ্বাস হচ্ছেন হযরত মুসা (আ.) । হযরত ঈসা (আ.) , হযরত মুসা (আ.)-এর উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সপ্তম বিশ্বাস ছিলেন । মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) , হযরত ঈসা (আ.)-এর সাতজন উত্তরাধিকারীর মধ্যে ছিলেন সপ্তম । আর জনাব মুহাম্মদ বিন ইসমাইল ছিলেন রাসূল (সা.)-এর উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সপ্তম । নিয়মানুযায়ী যথাক্রমে হযরত মুহাম্মদ (সা.) হযরত আলী (আ.) , হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) , হযরত ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) , ইমাম মুহাম্মদ বাকের (আ.) , হযরত জাফর সাদিক (আ.) এবং ইসমাইল ও মুহাম্মদ বিন ইসমাইল হচ্ছেন ইমাম । {দ্বিতীয় ইমাম হাসান (আ.)-কে তারা ইমাম হিসেবে গণ্য করেন না } জনাব মুহাম্মদ বিন ইসমাঈলের পর তদ্বংশীয় সাতজন উত্তরাধিকারীর নাম আজও গোপন রয়েছে । তারপর সাতজন উত্তরাধিকারী হচ্ছেন মিশরের ফাতেমী বংশীয় বাদশাহগণ । এদের প্রথম ব্যক্তি হচ্ছেন উবাইদুলাহ্ মাহদী । যিনি সর্বপ্রথম মিশরে ফাতেমী বংশের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন ।

ইসমাঈলীয়াগণ আরও বিশ্বাস করেন যে , আল্লাহর হুজ্জাত বা প্রমাণ ছাড়াও আরও বারজন নেতা রয়েছেন , যাঁরা আল্লাহর হুজ্জাত বা ঐশী প্রতিনিধির বিশেষ ঘনিষ্ট ব্যক্তি । ইসমাঈলীয়াদের কিছু উপদল যেমন দ্রুযদের বিশ্বাস অনুযায়ী ঐ বারজন নেতার মধ্যে পবিত্র আহলে বাইতের ছয়জন ইমামও অন্তর্ভুক্ত । বাকী ছয়জন অন্যান্য ব্যক্তি । হিজরী ২৮৮ সনে (মিশরে উবাইদুলাহ্ মাহদীর আবির্ভাবের ক বছর পূর্বে ) কুফা শহরের নিকটে ইরানের খুজিস্তানেরর অধিবাসী জনৈক ব্যক্তির অভুদ্বয় ঘটে , সে কখনও তার আত্ম পরিচয় দেননি । ঐ ব্যক্তি সারা দিন রোযা রাখত ও সারা রাতব্যাপী ইবাদতে নিমগ্ন থাকত এবং কষ্ট করে জীবিকা নির্বাহ করত । আর জনগণের মধ্যে ইসমাঈলীয়া মাযহাব প্রচার করত । এভাবে প্রচুর সংখ্যক লোক তার মাধ্যমে ইসমাঈলীয়া মাযহাবে দীক্ষিত হয় । ঐ ব্যক্তি তার অনুসারীদের মধ্যে বারজনকে নেতা হিসেবে নির্বাচন করে । এর পর সে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে কুফা ত্যাগ করে । তার পর থেকে তার কোন সংবাদ আর পাওয়া যায়নি । তারপর আহমাদ ওরফে কিরমিত নামক জনৈক অখ্যাত ব্যক্তি ইরাকে তার স্থলাভিষিক্ত হয় এবং গুপ্ত বিশ্বাস শিক্ষার প্রসার ঘটাতে থাকে । ঐতিহাসিকদের বক্তব্য অনুসারে ঐ ব্যক্তি ইসলামের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের স্থলে নতুন নামাজের প্রবর্তন করে । জানাবাতের গোসলের আইন সে রহিত করে এবং মদ পানকে হালাল বলে ঘোষণা করে । পাশাপাশি অন্যান্য গুপ্তপন্থী (ইসমাঈলীয়া) গোত্রেরর নেতাদেরকে বিদ্রোহ করার আহবান জানায় । এ উপলক্ষ্যে একদল লোককে তার চতুর্পাশ্বে সমবেত করে । এরা গুপ্তপন্থী মাযহাবের অনুসারী ছাড়া অন্য কারো জান মালের প্রতি এতটকু সম্মানেও বিশ্বাসী ছিল না । এর ফলে তারা ইরাক , সিরিয়া , বাহরাইন্ ও ইয়ামানে আন্দোলন চালানোর নামে অসংখ্য জনগণকে হত্যা করে এবং তাদের সকল সম্পদ লুন্ঠন করে । তারা বহুবার হজ্জ যাত্রীদের কাফেলায় আক্রমণ চালিয়ে হাজার হাজার হাজীকে হত্যা এবং তাদের সর্বস্ব লুন্ঠন করে । গুপ্তপন্থীদের (ইসমাঈলীয়া) জনৈক নেতা আবু তাহের কিরমিত হিজরী ৩১১ সনে বসরা শহর দখল করে সেখানে ব্যাপক গণহত্যা ও লুটতরাজ চালায় । হিজরী ৩১৭ সনে গুপ্তপন্থী দের বিরাট এক বাহিনী সহ হজ্জ মৌসুমে সে মক্কাভিমুখে যাত্রা করে । সে সামান্য চেষ্টাতেই মক্কা নগরীর প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের বুহ্য ভেদ করে মক্কায় প্রবেশ করতে সমর্থ হয় । আবু তাহের কিরমিতির নেতৃত্বে মক্কায় প্রবেশ করে তার বাহিনী মক্কার অধিবাসী ও নবাগত হাজীদের মধ্যে ব্যাপক গণহত্যা চালায় । এমন কি তারা মসজিদুল হারাম এবং পবিত্র কাবা ঘরের ভেতর রক্তের বন্যা প্রবাহিত করে । এরপর পবিত্র কা বা ঘরের গিলাফ বা আচ্ছাদনটি টুকরা টুকরা করে নিজেদের মধ্যে বন্টন করে নেয় । এমন কি পবিত্র কা বা ঘরের দেয়াল ভেঙ্গে সেখানে সংরক্ষিত ঐতিহাসিক হাজরে আসওয়াদ নামক পবিত্র কালো পাথরটি বের করে ইয়ামানে নিয়ে যায় । প্রায় ২২ বাছর যাবৎ ঐ পবিত্র হাজরে আসওয়াদ পাথরটি কিরমিতি বংশীয় লোকদের কাছে সংরক্ষিত ছিল । এ জাতীয় কার্য কলাপের কারণেই বিশ্বে ও মুসলমানরা ইসমাঈলীয়া দের (গুপ্তপন্থী) সাথে সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা দেয় এবং তাদের ইসলামী মাযহাবসমূহের বহিঃর্ভূত বলে ঘোষণা করে । এমন কি ঐ যুগে উবাইদলাহ মাহদী যখন মিসরে ফাতেমী বংশের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে নিজেকে মাহদী মাওউদ (প্রতিশ্রুত মাহদী) এবং ইসমাঈলীয়া দের ইমাম হিসাবে ঘোষণা করেছিল সেও আবু তাহের কিরমিতির এহেন জঘণ্য কার্য কলাপের তীব্র নিন্দা ও অসন্তুষ্টি জ্ঞাপন করে । ঐতিহাসিকদের মতানুসারে , ইসমাঈলীয়া (গুপ্তপন্থী) মাযহাবের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে , তারা ইসলামের সকল বাহ্যিক আইন-কানুনকেই তাদের তথাকথিত গুপ্ত ও আধ্যাত্মিক পন্থায় ব্যাখার মাধ্যমে তা উইল বা পরিবর্তিত করে । তাদের মতে ইসলামী শরীয়তের এসব বাহ্যিক আইন-কানুন শুধুমাত্র তাদের জন্যেই নির্দিষ্ট , যারা তুলনা মূলক ভাবে কম প্রজ্ঞার অধিকারী এবং আধ্যাত্মিক উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত । তাদের বেশ কিছু ধর্মীয় আইন তাদের ইমামের দ্বারা প্রণীত হয়ে থাকে ।

নাযারিয়া , মুসতাআ লিয়া , দ্রুযিয়া ও মুকনিয়া উপদল সমুহ

হিজরী ২৯৬ সনে আফ্রিকা মহাদেশে যখন উবাইদুলাহ মাহদীর অভ্যুদয় ঘটে , তখন সে ইসমাঈলীয়াদেরকে তার ইমামত গ্রহণের আহবান জানায় এবং মিশরে তার ফাতেমী বংশের শাসন প্রতিষ্ঠা করে । তারপর তার বংশের লোকেরা মিশরকে তাদের খেলাফতের রাজধানী হিসেবে পরপর সাত পুরুষ যাবৎ রাজত্ব অব্যাহত রাখে । ফাতেমী বংশের ঐ শাসন আমলে কোন ধরণের উপদলে বিভক্ত না হয়েই তারা ইসমাঈলীয়া ইমামতের পদ ও স্বীয় রাজত্ব সংরক্ষণ করে যেতে সক্ষম হয় । ফাতেমী বংশের সপ্তম পুরুষ বাদশাহ মুসতানসীর বিল্লাহ সাদ বিন আলীর নাযার ও মুসতাআ লি নামক দু পুত্র ছিল । খেলাফত ও ইমামতের পদাধিকার দখল নিয়ে দু ভাবইয়ের মধ্যে চরম বিভেদ শুরু হয় । অতঃপর সুদীর্ঘ সংঘর্ষ ও বেশ কিছু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর মুসতাআ লী , নাযারকে পরাজিত করতে সক্ষম হয় । এর পর সে নাযারকে বন্দী করে এবং পরিশেষে জেলেই তার মৃত্যু ঘটে । দু ভাইয়ের এ জাতীয় বিবাদের ফলে ফাতেমীয় অনুসারীদের মধ্যে নাযারিয়া এবং মুসতাআ লী নামক দু টি নতুন দলের সূত্রপাত ঘটে ।

( ক ) নাযারিয়া : নাযারিয়াগণ মুলত: হাসান সাবাহর অনুসারী ছিল , যে মুসতানসির বিল্লাহর অত্যন্ত ঘনিষ্ট ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের অন্যতম ছিলেন । মুসতানসির বিল্লাহর মৃত্যুর পর সে নাযারকে সমর্থন করে । একারণে মুসতাআ লী ক্ষমতাসীন হওয়ার পর হাসান সাবাহকে মিশর থেকে বহিস্কার করে । মিশর থেকে বহিস্কৃত হয়ে হাসান সাবাহ্ ইরানের আগমন করে । কিছু কাল পরই সে ইরানের কাজভীন আল মউত প্রাসাদ সহ আ্রশ প্রাশর প্রাসাদ সমূহ দখল করে বসে এবং সেখানে রাজত্ব করা শুরু করে । হিজরী ৫১৮ সনে হাসান সাবাহর মৃত্যুর পর বুযুর্গ উমিদ রুদবারী এবং তার মৃত্যুর পর তদ্বীয় পুত্র কিয়া মুহাম্মদ , হাসান সাবাহর ধর্মীয় ও রাজনৈতিক আদর্শ অনুসারেই শাসন কার্য চালিয়ে যায় । তার মৃত্যুর পর চতুর্থ বাদশাহ্ হাসান আলা যিকরিহিস্ সালাম পৈত্রিক আদর্শ নাযারিয়া মাযহাব ত্যাগ করে এবং গুপ্তপন্থী (ইসমাঈলীয়া) মাযহাবের অনুসারী হয় । এরপর হালাকু খান ইরান আক্রমণ করে ইসমাঈলীয়াদের রাজ প্রাসাদ দখল করে তা ধ্বংস করে ধুলিসাৎ করে দেয় এবং ইসমাঈলীয়াদের নির্বিচারে হত্যা করে । এরপর হিজরী ১২৫৫ সনে আগাখান মাহালাতি নামক জনৈক নাযারিয়াপন্থী ইরানের কেরমানশাহ্ অঞ্চলে মুহাম্মদ শাহ্ কাজরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং পরাজিত হয় । অতঃপর সে ভারতের বোম্বাই শহরে পালায়ন করে । এরপর সে বোম্বাইতে গুপ্তপন্থী নাযারিয়া মাযহাবের ইমাম হিসাবে নিজেকে ঘোষণা করে এবং তার মাযহাবের প্রচার ও প্রসারের কাজ চালাতে থাকে । তাদের ঐ প্রচার কার্য এখনও অব্যাহত আছে । তারা বর্তমানে আগাখানী হিসাবে পরিচিত ।

( খ ) মুসতাআ লীয়া : এ মাযহাবের অনুসারীরা সবাই ফাতেমীয় ছিলেন এবং ফাতেমীয় খলিফাদের মধ্যেই এ মাযহাব অব্যাহত ছিল । প্রায় হিজরী ৫৫৭ সন পর্যন্ত এ মাযহাব টিকে ছিল । এর পরই এ মাযহাবের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায় । কিন্তু কিছু দিন পরই বোহরা নামে এ মাযহাব পুনরায় ভারতে আবির্ভূত হয় , যা আজও সেখানে টিকে আছে ।

( গ ) দ্রুযিয়া : এ উপদলের অনুসারীরা সিরিয়া সীমান্ত সংলগ্ন দ্রুয পর্বতমালার অধিবাসী । এরা মূলতঃ মিশরে ফাতেমীয় খলিফাদের অনুসারী ছিল । কিন্তু ফাতেমীয় ৬ষ্ঠ খলিফার শাসন আমলে জনৈক নেশতেগীন দ্রুযির আহবানে গুপ্তপন্থী (ইসমাঈলীয়া বা বাতেনী) সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত হয় । দ্রুযিয়ারা তাদের ইমাম আল হাকিম বিল্লাহ নিহত হওয়ার পর তার ইমামতের প্রতিই স্থির থাকে । তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী , তিনি মৃত্যু বরণ করেননি বরং আত্মগোপন করে উর্দ্ধাকাশে গমণ করেছেন । তিনি ভবিষ্যতে পুনরায় জনগণের মাঝে ফিরে এসে আত্মপ্রকাশ করবেন ।

( ঘ ) মুকনিয়া : মূলতঃ জনাব আতা মারউই মুকনিয়ার অনুসারীরাই মুকনিয়া নামে পরিচিত । ঐতিহাসিকদের মতানুসারে এরা আবু মুসলিম খোরাসানির অনুসারী ছিল । আবু মুসলিমের মৃত্যুর পর আতা মারউই দাবী করে যে , আবু মুসলিমের আত্মা তার দেহে প্রবেশ করেছে । এর কিছুদিন পর সে নবুয়তের দাবী করে বসে । তার কিছু কাল পর সে খোদা হওয়ার দাবী করে । অবশেষে হিজরী ১৬২ সনে মাওয়ারাইন নাহার অঞ্চলের কিশ প্রাসাদে তাকে ঘেরাও করা হয় । নিজের গ্রেফতার ও নিহত হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর সে আগুন জ্বালিয়ে কিছু সংখ্যক ভক্ত অনুরাগী সহ সেই আগুনে প্রবেশ করে আত্মহত্যা করে । এরপর মুকনিয়ার অনুসারীরা ইসমাঈলীয়া মাযহাব গ্রহণের মাধ্যমে গুপ্তপন্থী দের দলে সামিল হয় ।

দ্বাদশ ইমাম পন্থী শীয়া এবং যাইদিয়া ও ইসমাঈলীয়া

শীয়া মাযহাবের বৃহত্তর জনগোষ্ঠি , যা থেকে উপরোল্লিখিত সংখ্যালঘু উপদল সমুহ সৃষ্টি হয়েছে , তা মূলতঃ ইমামিয়া বা দ্বাদশ ইমাম পন্থী শীয়া মাযহাব নামে পরিচিত । যেমনটি ইতিপূর্বে বলা হয়েছে , মহানবী (সা.)-এর পরে তার সাহাবীদের মধ্যে দু টি বিষয় নিয়ে মতভেদের সৃষ্টি হয়েছিল , যা মহানবী (সা.)-এর শিখানো সুন্নাতের প্রতি গুরুত্ব না দেয়ারই প্রতিফল ছিল । সে দু টি বিষয় ছিল ইসলামী রাষ্ট্রের শ্বাসক ও ইসলামী জ্ঞানের নেততৃ এ ব্যাপারে শীয়াদের দৃষ্টিতে মহানবী (সা.)-এর পবিত্র আহলে বাইতগণই (আ.) ঐ দু টি বিষয়ে নেতৃত্বের ন্যায্য অধিকারী ছিলেন । শীয়াদের বক্তব্য ছিল , ইসলামী খেলাফত পদের জন্য বিলায়াত ও আধ্যাত্মিক নেতৃত্বের যোগ্যতা একান্ত অপরিহার্য শর্ত । আর এ শর্ত একমাত্র হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর পবিত্র সন্তানদের মধ্যে বিদ্যমান । কেননা , এ ব্যাপারে স্বয়ং মহানবী (সা.) এবং তার পবিত্র আহলে বাইতের বারজন ইমামের (আ.) সুস্পষ্ট ব্যাখা রয়েছে । শীয়ারা বলতঃ পবিত্র কুরআনের বাহ্যিক শিক্ষা অর্থাৎ ইসলামী শরীয়ত ও আইন কানুন , এবং একই ভাবে মানুষের পূর্ণাঙ্গ আধ্যাত্মিক জীবন বিধান সম্বলিত , যা মৌলিকত্ব ও একান্ত গুরুত্বের দাবীদার । কেয়ামত পর্যন্ত এই কুরআন ও শরীয়ত কখনও বাতিল হবে না । ইসলামী শরীয়তের এই আইন কানুন একমাত্র রাসূল (সা.)-এর আহল বাইতের মাধ্যমে অর্জন করা উচিত ।

এখান থেকেই দ্বাদশ ইমামপন্থী শীয়া ও যাইদিয়াদের মূল পর্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে । যাইদিয়াগণ মূলত ইমামতের বিষয়টিকে পবিত্র আহলে বাইতের মধ্যে সীমাবদ্ধ বলে মনে করে না এবং ইমামদের সংখ্যা বারজনের মধ্যে নির্ধারিত বলেও বিশ্বাস করে না । একই ভাবে তারা পবিত্র আহলে বাইতের ফেকাহর অনুসরণ করে না যা দ্বাদশ ইমামপন্থী শীয়াদের সম্পূর্ণ বিরোধী বিশ্বাস । অপর দিকে যাইদিয়াগণ বিশ্বাস করেন যে , ইমামত ও নবুয়ত সাতটি সংখ্যার মধ্যে নিয়মিত আবর্তিত হয় এবং নবুয়ত মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মধ্যে এসে শেষ হয়নি । ইসলামী শরীয়তের আইন-কানুন পরিবর্তন ও বাতিলের যোগ্য এবং ইসলামের ব্যাপারে মানুষের মূল দায়িত্ব রহিত হওয়ার ব্যাপারে গুপ্তপন্থী দের (বাতেনী) দৃষ্টিতে কোন অসুবিধা নেই! অথচ দ্বাদশ ইমামপন্থী শীয়াদের বিশ্বাস হচ্ছে : মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-ই সর্বশেষ নবী এবং বারজন ব্যক্তি রাসূল (সা.)-এর পরে তার উত্তরাধিকারী বা স্থলাভিষিক্ত ´ হবেন । শরীয়তের বাহ্যিক কাঠামোই নির্ভরযোগ্য এবং চির অপরিবর্তনশীল । আর তারা কুরআনের বাহ্যিক ও অন্তস্থ রূপ , দুটোতেই বিশ্বাসী । আলোচনার পরিসমাপ্তি: শেইখিয়ে ও কারিম খান গোষ্ঠিদ্বয় গত দু শতাব্দী থেকে দ্বাদশপন্থী শীয়াদের মাঝে আবির্ভূত হয়েছে । উপরোক্ত উপদল সমূহের সাথে সূত্রগত সামান্য কিছু বিরোধ ছাড়া মৌলিক কোন পার্থক্য না থাকায় তাদেরকে এখানে একটি স্বতন্ত্র উপদল হিসেবে পরিগণিত করা হয়নি । একই ভাবে দ্বাদশ ইমামপন্থী শীয়াদের আরেকটি উপদল যাদেরকে গুপ্তপন্থী ইসমাঈলীয়া শীয়াদের মত গুলাত বা বিচ্যুত বলা হয়ে থাকে । যারা কেবল মাত্র শরীয়তের অন্তস্থরূপে বিশ্বাসী তাদের এ জাতীয় বিশ্বাসের পক্ষে কোন প্রকারের সুশৃংঙ্খল যুক্তি উপস্থাপন করতে তারা অক্ষম । তাই তাদেরকেই এখানে একটি স্বতন্ত্র উপদল হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি ।

দ্বাদশ ইমামপন্থী শীয়াদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

পূর্ববর্তী দুটো অধ্যায়ে এ বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে , শীয়াদের বৃহত্তর জন গোষ্ঠিই দ্বাদশ ইমামপন্থী শীয়া মাযহাবের অনুসারী । এরা মূলতঃ হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর একান্ত ভক্ত ও অনুসারী ছিলেন । মহানবী (সা.)-এর পরলোক গমনের পর রাষ্ট্রিয় ক্ষমতা ও ইসলামী জ্ঞানগত নেতৃত্বের বিষয়ে রাসূল (সা.)-এর আহলে বাইতের ন্যায্য অধিকার আদায়ের ব্যাপারে ক্ষমতাসীন শ্বাসকগোষ্ঠির বিরুদ্ধে সমালোচনা ও প্রতিবাদ করার মাধ্যমে এরা বৃহত্তর জনগোষ্ঠী থেকে পৃথক হয়ে পড়ে । খেলাফায়ে রাশেদীনের যুগে (হিজরী ১১-৩৫ সন) শ্বাসক গোষ্ঠির দ্বারা শীয়ারা প্রচন্ড রাজনৈতিক চাপের মুখে দিনাতিপাত করে । এরপর উমাইয়া খলিফাদের যুগে (হিজরী ৪০-১৩২ সন) শীয়ারা জান-মাল ও সম্মানের নিরাপত্তা সার্বিক ভাবে হারিয়ে ফেলে । কিন্তু অত্যাচার ও অবিচারের মাত্রা যতই বাড়তে থাকে , তাদের মৌলিক বিশ্বাসও ততই দৃঢ়তর হতে থাকে । বিশেষ করে তাদের ঐ অসহায়ত্ব ও অত্যাচারীত অবস্থা তাদের নিজস্ব মতাদর্শগত উন্নয়নে যথেষ্ট অবদান রাখতে সমর্থ হয় । এরপর হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে আব্বাসিয়রা যখন খেলাফতের মসনদ দখল করে , শীয়ারা রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ঐ মধ্যবর্তী সুযোগে কিছুটা হলেও স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলার প্রয়াস প্রায় । কিন্তু কিছু দিন না যেতেই তাদের ভাগ ্য আবার সংকুচিত হয়ে এলো । আর এ অবস্থা হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর শেষ ভাগ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে ।

হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর প্রথম ভাগে যখন শীয়া মতাদর্শের অধিকারী আলে-বুইয়া বংশ শাসন ক্ষমতা দখল করে , শীয়ারা এই প্রথম বারের মত শক্তি অর্জন করার প্রয়াস প্রায় । ঐ সময় তারা ইচ্ছেমত কাজ করার স্বাধীনতা ও সুযোগ ভোগ করে । তখন তারা প্রকাশ্যে ভাবে স্বীয় মতাদর্শ রক্ষার সংগ্রামে অবতির্ণ হয় । এ অবস্থা হিজরী পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত অব্যাহত থাকে । আর হিজরী ৬ষ্ঠ শতাব্দীর প্রথম দিকে মোগলদের ইসলামী দেশ সমূহ আক্রমন , বিভিন্ন রাজনৈতিক সমস্যা এবং দীর্ঘদিন ব্যাপী ক্রসেডের যুদ্ধ অব্যাহত থাকার কারণে তদানিন্তন ইসলামী শ্বাসকগোষ্ঠি শীয়া বিশ্বের উপর রাজনৈতিক বা সামরিক চাপ প্রয়োগের তেমন একটা সুযোগ পায়নি । এ ছাড়াও ইরানের বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ কিছু মোগল সম্রাটের শীয়া মাযহাবে দীক্ষিত হওয়া , মাযেন্দারান শীয়াপন্থী মারআশী বংশীয় রাজত্ব এবং সর্বত্র শীয়া জনগোষ্ঠীর ব্যাপক বিস্তৃতি শীয়া মাযহাবকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে ব্যাপক ভাবে সাহায্য করে । যার ফলে ইসলামী বিশ্বের আনাচে কানাচে এবং বিশেষ করে ইরানের লক্ষ লক্ষ শীয়া জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব অনুভুত হতে থাকে । আর এ অবস্থা হিজরী নবম শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল । এরপর হিজরী দশম শতাব্দীর শুরুতে ইরানের শীয়াপন্থী সাফাভী বংশীয় রাজত্বের উত্থান ঘটে । তারা বৃহত্তর ইরানের শ্বাসনের সুযোগ পায় । এই সময়ে শীয়া মাযহাব রাষ্ট্রিয় ভাবে স্বীকৃতি ও প্রতিষ্ঠা লাভ করে , যা এখনও (হিজরীর চতুর্দশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত) অব্যাহত আছে । এ ছাড়াও বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোটি কোটি শীয়া বাস করছে ।

খোৎবা - ১

يَذْكُرُ فِيهَا أبْتِدأ خَلْقِ ألسَّمأ وَ الاَرْضِ وَ خَلْقِ آدَمَ عليه‌السلام

الْحَمْدُ لِلَّه الَّذِي لَا يَبْلُغُ مِدْحَتَه الْقَائِلُونَ، ولَا يُحْصِي نَعْمَاءَه الْعَادُّونَ، ولَا يُؤَدِّي حَقَّه الْمُجْتَهِدُونَ، الَّذِي لَا يُدْرِكُه بُعْدُ الْهِمَمِ، ولَا يَنَالُه غَوْصُ الْفِطَنِ، الَّذِي لَيْسَ لِصِفَتِه حَدٌّ مَحْدُودٌ، ولَا نَعْتٌ مَوْجُودٌ ولَا وَقْتٌ مَعْدُودٌ، ولَا أَجَلٌ مَمْدُودٌ، فَطَرَ الْخَلَائِقَ بِقُدْرَتِه، ونَشَرَ الرِّيَاحَ بِرَحْمَتِه، ووَتَّدَ بِالصُّخُورِ مَيَدَانَ أَرْضِه.

أَوَّلُ الدِّينِ مَعْرِفَتُه وكَمَالُ مَعْرِفَتِه التَّصْدِيقُ بِه، وكَمَالُ التَّصْدِيقِ بِه تَوْحِيدُه، وكَمَالُ تَوْحِيدِه الإِخْلَاصُ لَه، وكَمَالُ الإِخْلَاصِ لَه نَفْيُ الصِّفَاتِ عَنْه، لِشَهَادَةِ كُلِّ صِفَةٍ أَنَّهَا غَيْرُ الْمَوْصُوفِ، وشَهَادَةِ كُلِّ مَوْصُوفٍ أَنَّه غَيْرُ الصِّفَةِ، فَمَنْ وَصَفَ اللَّه سُبْحَانَه فَقَدْ قَرَنَه، ومَنْ قَرَنَه فَقَدْ ثَنَّاه ومَنْ ثَنَّاه فَقَدْ جَزَّأَه، ومَنْ جَزَّأَه فَقَدْ جَهِلَه ومَنْ جَهِلَه فَقَدْ أَشَارَ إِلَيْه، ومَنْ أَشَارَ إِلَيْه فَقَدْ حَدَّه ومَنْ حَدَّه فَقَدْ عَدَّه، ومَنْ قَالَ فِيمَ فَقَدْ ضَمَّنَه، ومَنْ قَالَ عَلَا مَ فَقَدْ أَخْلَى مِنْه: كَائِنٌ لَا عَنْ حَدَثٍ مَوْجُودٌ لَا عَنْ عَدَمٍ، مَعَ كُلِّ شَيْءٍ لَا بِمُقَارَنَةٍ وغَيْرُ كُلِّ شَيْءٍ لَا بِمُزَايَلَةٍ ، فَاعِلٌ لَا بِمَعْنَى الْحَرَكَاتِ والآلَةِ، بَصِيرٌ إِذْ لَا مَنْظُورَ إِلَيْه مِنْ خَلْقِه، مُتَوَحِّدٌ إِذْ لَا سَكَنَ يَسْتَأْنِسُ بِه ولَا يَسْتَوْحِشُ لِفَقْدِه.

আকাশ , পৃথিবী ও আদম সৃষ্টি সম্পর্কে

প্রতিষ্ঠিত প্রশংসা আল্লাহর। তাঁর গুণরাজী কোন বর্ণনাকারী বর্ণনা করে শেষ করতে পারে না। তার নেয়ামতসমূহ গণনাকারীগণ গুনে শেষ করতে পারে না। প্রচেষ্টাকারীগণ তাঁর নেয়ামতের হক আদায় করতে পারে না। আমাদের সমুদয় প্রচেষ্টা ও জ্ঞান দ্বারা তাঁর পরিপূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করা সম্ভব নয় এবং আমাদের সমগ্র বোধশক্তি দ্বারা তার মাহাত্ম্য অনুভব করা সম্ভব নয়। তাঁর সিফাত বর্ণনার কোন পরিসীমা নির্ধারিত নেই এবং সেজন্য কোন লেখা বা বক্তব্য ,কোন সময় বা স্থিতিকাল নির্দিষ্ট করা হয়নি । তিনি নিজ কুদরতে সৃষ্টিকে অস্তিত্বশীল করেছেন ,আপন করুণায় বাতাসকে প্রবাহিত করেছেন এবং শিলাময় পাহাড় দ্বারা কম্পমান পৃথিবীকে সুদৃঢ় করেছেন।

আল্লাহর মা রেফাতেই দ্বীনের ভিত্তি । এ মা রেফাতের পরিপূর্ণতা আসে তাকে সত্য বলে সাক্ষ্য দেয়ায় ; সাক্ষ্যের পরিপূর্ণত হয় তাঁর ঐকল্যের বিশ্বাসে ; বিশ্বাসের পরিপূর্ণত হয় তাঁকে পরম পবিত্ররূপে নিরীক্ষণ করার জন্য আমল করায় ; আমলের পরিপূর্ণতা অর্জিত হয় তাঁর প্রতি কোন সিফাত ( গুণ ) আরোপ না করায়। কারণ কোন কিছুতে গুণ আরোপিত হলে এটাই প্রমাণিত হয় যে ,আরোপিত বিষয় থেকে গুণ পৃথক এবং যার ওপর গুণ আরোপিত হয় সে নিজে সেই গুণ থেকে পৃথক। যারা আল্লাহতে সত্তা বহির্ভূত কোন সিফাত বা গুণ আরোপ করে তারা তাঁর সদৃশতার স্বীকৃতি দেয় ; যারা তাঁর সদৃশতা স্বীকার করে তারা দ্বৈতবাদের স্বীকৃতি দেয় ; যারা তাঁর দ্বৈতের স্বীকৃতি দেয় তারা তাঁকে খণ্ডভাবে দেখে ; যারা তাকে খণ্ডভাবে দেখে তারা তাঁকে ভুল বুঝে ; যারা তাঁকে ভুল বুঝে তারা তাঁকে চিনতে অক্ষম ; যারা তাকে চিনতে অক্ষম তারা তার ত্রুটি স্বীকার করে ; যারা তার ত্রুটি স্বীকার করে তারা তাকে সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ করে।

যদি কেউ বলে তিনি কি ,সে জেনে রাখুক ,তিনি সবকিছু ধারণ করে আছেন ; এবং যদি কেউ বলে তিনি কিসের ওপর আছেন ,সে জেনে নাও ,তিনি নির্দিষ্ট কোন কিছুর ওপর নেই। যদি কেউ তাঁর অবস্থিতি নির্দিষ্ট কোন স্থানে মনে করে তবে সে কিছু কিছু স্থানকে আল্লাহবিহীন মনে করলো। তিনি ওই সত্তা যাঁর আগমন সৃষ্টি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটে নি। তিনি অস্তিত্বশীল ,কিন্তু অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ত্বে আসেন নি। তিনি সব কিছুতেই আছেন ,কিন্তু কোন প্রকার ভৌত নৈকট্য দ্বারা নয়। তিনি সব কিছু থেকে ভিন্ন ,কিন্তু বস্তুগত দ্বান্দ্বিকতা ও বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে নয়। তিনি কর্ম সম্পাদন করেন। কিন্তু সঞ্চলন ও হাতিয়ারের মাধ্যমে নয়। তিনি তখনও দেখেন যখন তাঁর সৃষ্টির মধ্যে কেউ দেখার মতো থাকে না। তিনিই একমাত্র একক ,কেন না। এমন কেউ নেই যার সাথে তিনি সঙ্গ রাখতে পারেন অথবা যার অনুপস্থিতি তিনি অনুভব করেন।

خلق العالم

أَنْشَأَ الْخَلْقَ إِنْشَاءً وابْتَدَأَه ابْتِدَاءً، بِلَا رَوِيَّةٍ أَجَالَهَا ولَا تَجْرِبَةٍ اسْتَفَادَهَا، ولَا حَرَكَةٍ أَحْدَثَهَا ولَا هَمَامَةِ نَفْسٍ اضْطَرَبَ فِيهَا، أَحَالَ الأَشْيَاءَ لأَوْقَاتِهَا ولأَمَ بَيْنَ مُخْتَلِفَاتِهَا، وغَرَّزَ غَرَائِزَهَا وأَلْزَمَهَا أَشْبَاحَهَا، عَالِماً بِهَا قَبْلَ ابْتِدَائِهَا، مُحِيطاً بِحُدُودِهَا وانْتِهَائِهَا عَارِفاً بِقَرَائِنِهَا وأَحْنَائِهَا : ثُمَّ أَنْشَأَ سُبْحَانَه فَتْقَ الأَجْوَاءِ، وشَقَّ الأَرْجَاءِ وسَكَائِكَ الْهَوَاءِ، فَأَجْرَى فِيهَا مَاءً مُتَلَاطِماً تَيَّارُه ، مُتَرَاكِماً زَخَّارُه حَمَلَه عَلَى مَتْنِ الرِّيحِ الْعَاصِفَةِ، والزَّعْزَعِ الْقَاصِفَةِ فَأَمَرَهَا بِرَدِّه، وسَلَّطَهَا عَلَى شَدِّه وقَرَنَهَا إِلَى حَدِّه، الْهَوَاءُ مِنْ تَحْتِهَا فَتِيقٌ والْمَاءُ مِنْ فَوْقِهَا دَفِيقٌ ، ثُمَّ أَنْشَأَ سُبْحَانَه رِيحاً اعْتَقَمَ مَهَبَّهَا ، وأَدَامَ مُرَبَّهَا وأَعْصَفَ مَجْرَاهَا، وأَبْعَدَ مَنْشَأَهَا فَأَمَرَهَا بِتَصْفِيقِ الْمَاءِ الزَّخَّارِ، وإِثَارَةِ مَوْجِ الْبِحَارِ فَمَخَضَتْه مَخْضَ السِّقَاءِ، وعَصَفَتْ بِه عَصْفَهَا بِالْفَضَاءِ، تَرُدُّ أَوَّلَه إِلَى آخِرِه وسَاجِيَه إِلَى مَائِرِه حَتَّى عَبَّ عُبَابُه ورَمَى بِالزَّبَدِ رُكَامُه ، فَرَفَعَه فِي هَوَاءٍ مُنْفَتِقٍ وجَوٍّ مُنْفَهِقٍ، فَسَوَّى مِنْه سَبْعَ سَمَوَاتٍ، جَعَلَ سُفْلَاهُنَّ مَوْجاً مَكْفُوفاً ، وعُلْيَاهُنَّ سَقْفاً مَحْفُوظاً وسَمْكاً مَرْفُوعاً، بِغَيْرِ عَمَدٍ يَدْعَمُهَا ولَا دِسَارٍ يَنْظِمُهَا ثُمَّ زَيَّنَهَا بِزِينَةِ الْكَوَاكِبِ وضِيَاءِ الثَّوَاقِبِ ، وأَجْرَى فِيهَا سِرَاجاً مُسْتَطِيراً وقَمَراً مُنِيراً، فِي فَلَكٍ دَائِرٍ وسَقْفٍ سَائِرٍ ورَقِيمٍ مَائِرٍ.

নিখিল বিশ্ব সৃষ্টি

তিনি সৃষ্টির সূত্রপাত করলেন একান্তই মৌলিকভাবে- কোন প্রকার প্রতিরূপ ব্যতীত ,কোন প্রকার পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ ব্যতীত ,কোনরূপ বিচলন ব্যতীত এবং ফলাফলের জন্য কোনরূপ ব্যাকুলতা ব্যতীত। সব কিছুকে তিনি নির্দিষ্ট সময় দিলেন ,তাদের বৈচিত্র্যে সামঞ্জস্য বিধান করলেন এবং তাদের বৈশিষ্ট্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করলেন। সৃষ্টির পূর্বেই তিনি সব কিছুর প্রবণতা ,জটিলতা ,সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন।

অতঃপর পবিত্র সত্তা অনন্ত শূন্য সৃষ্টি করলেন এবং প্রসারিত করলেন নভোমণ্ডল ও বায়ু স্তর। তিনি উচ্ছল তরঙ্গবিক্ষুব্ধ পানি প্রবাহিত করলেন। তরঙ্গগুলো এত ঝঞ্জা - বিক্ষুব্ধ ছিল যে ,একটা আরেকটার ওপর দিয়ে গড়িয়ে যেতো। তরঙ্গাঘাতের সাথে তিনি প্রবল বায়ুপ্রবাহ যুক্ত করলেন এবং প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের প্রকম্পন সৃষ্টি করলেন। পানির বাষ্পীয় অবস্থাকে তিনি বৃষ্টিরূপে পতিত হবার নির্দেশ দিলেন এবং বৃষ্টির প্রাবল্যের ওপর বায়ুকে নিয়ন্ত্রণাধিকার দিলেন। মেঘের নিচে বাতাস প্রবাহিত হতে লাগলো এবং পানি বাতাসের ওপর প্রচণ্ড বেগে প্রবাহিত হতে লাগলো।

অতঃপর সর্বশক্তিমান আল্লাহ বাতাস সৃষ্টি করে উহাকে নিশ্চল করলেন ,উহার অবস্থান স্থায়ী করলেন ,তার গতিতে প্রচণ্ডতা দিলেন এবং তাকে সর্বত্র ছড়িয়ে দিলেন। তারপর তিনি বাতাসকে আদেশ করলেন গভীর পানিকে গতিশীল ও চঞ্চল এবং সমুদ্র তরঙ্গকে তীব্রতর করার জন্য। ফলে বাতাস দধি তৈরির মতো পানিকে মন্থন করতে লাগলো এবং এমন জোরে মহাশূন্যে প্রক্ষেপ করলো যাতে সম্মুখ পশ্চাতে ও পশ্চাত সম্মুখে চলে গেলো। এতে ওপরের স্তরে বিপুল ফেনপুঞ্জ সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত স্থিরকে অস্থির করে রাখলো। সর্বশক্তিমান তখন ফেনপুঞ্জকে অনন্ত শূন্যে উত্তোলন করে তা থেকে সপ্ত আকাশ সৃষ্টি করলেন যার সর্বনিম্ন স্তর স্ফীত অথচ অনড় এবং ওপরের স্তর আচ্ছাদনের মতো বিদ্যমান যেন এক সুউচ্চ বৃহৎ অট্টালিকা যাতে কোন স্তম্ভ নেই অথবা একত্রে জোড়া লাগাবার পেরেক নেই। তখন তিনি ওপরের স্তরকে তারকা ও উজ্জ্বল উল্কা দিয়ে সুশোভিত করলেন এবং আবর্তিত আকাশ ,চলমান আচ্ছাদন ও ঘূর্ণায়মান নভোমণ্ডলে তিনি দেদীপ্যমান সূর্য ও দীপ্তিময় চন্দ্রকে স্থাপন করলেন।

خلق الملائكة

ثُمَّ فَتَقَ مَا بَيْنَ السَّمَوَاتِ الْعُلَا، فَمَلأَهُنَّ أَطْوَاراً مِنْ مَلَائِكَتِه، مِنْهُمْ سُجُودٌ لَا يَرْكَعُونَ ورُكُوعٌ لَا يَنْتَصِبُونَ، وصَافُّونَ لَا يَتَزَايَلُونَ ومُسَبِّحُونَ لَا يَسْأَمُونَ، لَا يَغْشَاهُمْ نَوْمُ الْعُيُونِ ولَا سَهْوُ الْعُقُولِ، ولَا فَتْرَةُ الأَبْدَانِ ولَا غَفْلَةُ النِّسْيَانِ، ومِنْهُمْ أُمَنَاءُ عَلَى وَحْيِه وأَلْسِنَةٌ إِلَى رُسُلِه، ومُخْتَلِفُونَ بِقَضَائِه وأَمْرِه، ومِنْهُمُ الْحَفَظَةُ لِعِبَادِه والسَّدَنَةُ لأَبْوَابِ جِنَانِه، ومِنْهُمُ الثَّابِتَةُ فِي الأَرَضِينَ السُّفْلَى أَقْدَامُهُمْ، والْمَارِقَةُ مِنَ السَّمَاءِ الْعُلْيَا أَعْنَاقُهُمْ، والْخَارِجَةُ مِنَ الأَقْطَارِ أَرْكَانُهُمْ، والْمُنَاسِبَةُ لِقَوَائِمِ الْعَرْشِ أَكْتَافُهُمْ، نَاكِسَةٌ دُونَه أَبْصَارُهُمْ مُتَلَفِّعُونَ تَحْتَه بِأَجْنِحَتِهِمْ، مَضْرُوبَةٌ بَيْنَهُمْ وبَيْنَ مَنْ دُونَهُمْ حُجُبُ الْعِزَّةِ، وأَسْتَارُ الْقُدْرَةِ، لَا يَتَوَهَّمُونَ رَبَّهُمْ بِالتَّصْوِيرِ، ولَا يُجْرُونَ عَلَيْه صِفَاتِ الْمَصْنُوعِينَ، ولَا يَحُدُّونَه بِالأَمَاكِنِ ولَا يُشِيرُونَ إِلَيْه بِالنَّظَائِرِ.

ফেরেশতা সৃষ্টি

তৎপর পরম বিধাতা বিভিন্ন আকাশের মধ্যে উন্মুক্ততা বিধান করলেন এবং বিভিন্ন শ্রেণির ফেরেশতা দ্বারা সেই উন্মুক্ততা পরিপূর্ণ করলেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সেজদাবনত ,যারা কখনো রুকু করে না ; কেউ কেউ রুকু অবস্থায় ,যারা কখনো দাঁড়ায় না এবং কেউ কেউ সুবিন্যস্তভাবে অবস্থান করছে ,যারা কখনো তাদের স্থান পরিত্যাগ করে না। অন্যরা সর্বক্ষণ আল্লাহর তসবিহু পাঠ করে এবং তারা ক্লান্ত হয় না। নয়নের নিদ্রা ,বুদ্ধির বিভ্রান্তি ,শরীরের অবসন্নতা অথবা বিস্মৃতির প্রভাব এদেরকে স্পর্শও করে না।

ফেরেশতাদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁর বিশ্বস্ত অহিবাহক ,যারা নবীদের কাছে আল্লাহর মুখপাত্র হিসাবে কাজ করে এবং তাঁর আদেশ নির্দেশকে সর্বত্র পৌছে দেয়। কেউ কেউ আল্লাহর সৃষ্টি রক্ষার কাজে নিযুক্ত। আবার কেউ কেউ বেহেশতের দরজায় প্রহরী হিসাবে নিযুক্ত। আরো অনেক আছে যাদের পদদ্বয় ভূ - মণ্ডলের সর্বনিম্ন স্তরে স্থিরভাবে স্থাপিত এবং তাদের শিরোদেশ আকাশের সর্বোচ্চ স্তরে প্রসারিত এবং তাদের বাহু চতুর্দিকে সম্প্রসারিত। তাদের স্কন্ধ আরশের স্তম্ভের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ; তাদের চোখে আরাশের প্রতি নিবদ্ধ এবং তাদের পাখা আরাশের নিচে বিস্তৃত। তাদের নিজেদের মধ্যে এবং অন্য সকল কিছুর মধ্যে সম্মানিত পর্দা ও কুদরতের আবরণ সৃষ্টি করা হয়েছে। তারা তাদের মহান স্রষ্টাকে আকৃতির মাধ্যমে ধারণা করে না। তারা স্রষ্টার প্রতি সৃষ্টির কোন গুণারোপ করে না ,তাঁকে কোন নির্দিষ্ট স্থানে সীমাবদ্ধ করে না এবং উপমার মাধ্যমে তার প্রতি ইঙ্গিত করে না ।

خلق آدمعليه‌السلام

ثُمَّ جَمَعَ سُبْحَانَه مِنْ حَزْنِ الأَرْضِ وسَهْلِهَا، وعَذْبِهَا وسَبَخِهَا ، تُرْبَةً سَنَّهَا بِالْمَاءِ حَتَّى خَلَصَتْ، ولَاطَهَا بِالْبَلَّةِ حَتَّى لَزَبَتْ ، فَجَبَلَ مِنْهَا صُورَةً ذَاتَ أَحْنَاءٍ ووُصُولٍ وأَعْضَاءٍ، وفُصُولٍ أَجْمَدَهَا حَتَّى اسْتَمْسَكَتْ، وأَصْلَدَهَا حَتَّى صَلْصَلَتْ لِوَقْتٍ مَعْدُودٍ وأَمَدٍ مَعْلُومٍ، ثُمَّ نَفَخَ فِيهَا مِنْ رُوحِه، فَمَثُلَتْ إِنْسَاناً ذَا أَذْهَانٍ يُجِيلُهَا، وفِكَرٍ يَتَصَرَّفُ بِهَا وجَوَارِحَ يَخْتَدِمُهَا ، وأَدَوَاتٍ يُقَلِّبُهَا ومَعْرِفَةٍ يَفْرُقُ بِهَا بَيْنَ الْحَقِّ والْبَاطِلِ، والأَذْوَاقِ والْمَشَامِّ والأَلْوَانِ والأَجْنَاسِ، مَعْجُوناً بِطِينَةِ الأَلْوَانِ الْمُخْتَلِفَةِ، والأَشْبَاه الْمُؤْتَلِفَةِ والأَضْدَادِ الْمُتَعَادِيَةِ، والأَخْلَاطِ الْمُتَبَايِنَةِ مِنَ الْحَرِّ والْبَرْدِ، والْبَلَّةِ والْجُمُودِ، واسْتَأْدَى اللَّه سُبْحَانَه الْمَلَائِكَةَ وَدِيعَتَه لَدَيْهِمْ، وعَهْدَ وَصِيَّتِه إِلَيْهِمْ فِي الإِذْعَانِ بِالسُّجُودِ لَه، والْخُنُوعِ لِتَكْرِمَتِه، فَقَالَ سُبْحَانَه:( اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ اعْتَرَتْه الْحَمِيَّةُ، وغَلَبَتْ عَلَيْه الشِّقْوَةُ، وتَعَزَّزَ بِخِلْقَةِ النَّارِ واسْتَوْهَنَ خَلْقَ الصَّلْصَالِ، فَأَعْطَاه اللَّه النَّظِرَةَ اسْتِحْقَاقاً لِلسُّخْطَةِ، واسْتِتْمَاماً لِلْبَلِيَّةِ وإِنْجَازاً لِلْعِدَةِ، فَقَالَ:( فَإِنَّكَ مِنَ الْمُنْظَرِينَ إِلى يَوْمِ الْوَقْتِ الْمَعْلُومِ ) .

ثُمَّ أَسْكَنَ سُبْحَانَه آدَمَ دَاراً أَرْغَدَ فِيهَا، عَيْشَه وآمَنَ فِيهَا مَحَلَّتَه وحَذَّرَه إِبْلِيسَ وعَدَاوَتَه، فَاغْتَرَّه عَدُوُّه نَفَاسَةً عَلَيْه بِدَارِ الْمُقَامِ، ومُرَافَقَةِ الأَبْرَارِ، فَبَاعَ الْيَقِينَ بِشَكِّه والْعَزِيمَةَ بِوَهْنِه، واسْتَبْدَلَ بِالْجَذَلِ وَجَلًا وبِالِاغْتِرَارِ نَدَماً، ثُمَّ بَسَطَ اللَّه سُبْحَانَه لَه فِي تَوْبَتِه، ولَقَّاه كَلِمَةَ رَحْمَتِه ووَعَدَه الْمَرَدَّ إِلَى جَنَّتِه، وأَهْبَطَه إِلَى دَارِ الْبَلِيَّةِ وتَنَاسُلِ الذُّرِّيَّةِ.

আদম সৃষ্টি

আল্লাহ্ কঠিন ,কোমল ,মধুর ও তিক্ত মৃত্তিকা সংগ্রহ করলেন। তিনি এ মৃত্তিকাকে পানি দিয়ে কর্দমে পরিণত করলেন এবং পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত ফোটায় ফোঁটায় পানির পতন ঘটালেন এবং আঠাল না হওয়া পর্যন্ত আদ্রতা দ্বারা পিণ্ড প্রস্তুত করলেন। এ পিণ্ড থেকে তিনি আদল ,জোড়াসমূহ ,অঙ্গ - প্রত্যঙ্গ ও বিভিন্ন অংশসহ একটা আকৃতি তৈরি করলেন। একটা নির্দিষ্ট সময় ও জ্ঞাত স্থায়িত্ব পর্যন্ত তিনি এটাকে শুকিয়ে কাঠিন্য প্রদান করলেন। অতঃপর এ আকৃতির মধ্যে তিনি তাঁর রূহ ফুৎকার করে দিলেন। ফলে এটা প্রাণ - চৈতন্য লাভ করে মানবাকৃতি ধারণ করলো এবং এতে মন সন্নিবেশ করা হলো ,যা তাকে নিয়ন্ত্রণ করে ; বুদ্ধিমত্তা দেয়া হলো ,যা তার উপকারে আসে ; অঙ্গ - প্রত্যঙ্গ দেয়া হলো ,যা তার কাজে লাগে ; ইন্দ্রিয় দেয়া হলো ,যা তার অবস্থার পরিবর্তন ঘটায় এবং জ্ঞান দেয়া হলো ,যা সত্য - অসত্য ,স্বাদ - গন্ধ ও বর্ণ - প্রকারের পার্থক্য বুঝাতে শেখালো। আদম হলো বিভিন্ন বর্ণের ,আসঞ্জক পদার্থের ,বিভিন্ন পরস্পর বিরোধী উপকরণের এবং বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য যেমন - উষ্ণতা ,শীতলতা ,কোমলতা ,কাঠিন্য ,খুশি - অখুশি ইত্যাদির সংমিশ্রনের কর্দম।

আল্লাহ তখন ফেরেশতাদের প্রতি তাঁর প্রতিশ্রুতি পূরণার্থে এবং তাদের প্রতি তাঁর নির্দেশের আনুগত্য পরিপূরণ করণার্থে আত্মসমর্পণের স্বীকৃতি স্বরূপ ও তাঁর মহিমার প্রতি সম্মান স্বরূপ সেজদাবনত হতে বললেন। তিনি বলেনঃ

আদমকে সেজদা কর এবং ইবলিস ব্যতীত সকলেই সেজদা করলো। (কুরআন - ২ - ৩৪ ,৭ - ১১ ,১৭ - ৬১ ,১৮ - ৫০ ,২০ - ১১৬) আত্মম্ভরিতা ইবলিসকে আল্লাহর আদেশ পালনে বিরত করলো এবং ঔদ্ধত্য দ্বারা সে আক্রান্ত হয়েছিল। সুতরাং সে আগুনের তৈরি বলে অহংবোধ করলো এবং মাটির তৈরি বলে আদমকে অবজ্ঞা করলো। ফলে আল্লাহ ইবলিসকে তাঁর রোষের পূর্ণ প্রতিফল প্রদানের এবং মানুষকে পরীক্ষা করার ও শয়তানের প্রতি তাঁর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করার জন্য যথেষ্ট সময় দিলেন। আল্লাহ বলেনঃ

তা হলে নিশ্চয় তুমি অবকাশ প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত - নির্ধারিত সময়ের দিন পর্যন্ত (কুরআন ১৫ - ৩৭ - ৩৮ ,৩৮ - ৮০ - ৮১)

তৎপর আল্লাহ্ আদমকে একটা ঘরে অধিষ্ঠান করলেন যেখানে তিনি মহানন্দে ও পূর্ণ নিরাপত্তায় বসবাস করতে লাগলেন। তিনি আদমকে ইবলিস ও তার শত্রুতা সম্পর্কে সাবধান করে দিলেন। কিন্তু ইবলিস আদমের বেহেশত - বাস ও ফেরেশতাদের সংসর্গের জন্য ঈর্ষান্বিত হলো। সুতরাং সে আদমের "ইয়াকিন ’ শিথিল করলে এবং তার প্রতিশ্রুতি দুর্বল করলো। এতে আদমের আনন্দ ভয়ে পরিণত হলো এবং মর্যাদা লজ্জায় পরিণত হলো। তখন আল্লাহ আদমকে তওবা ’ করার সুযোগ দিলেন এবং তাঁর রহমতের বাক্য শেখালেন। তিনি আদমকে বেহেশতে প্রত্যাবর্তনের ওয়াদা দিলেন এবং তাকে কষ্টভোগ করা ও বংশ বিস্তারের স্থলে অবতরণ করালেন ।

اختيار الأنبياء

واصْطَفَى سُبْحَانَه مِنْ وَلَدِه أَنْبِيَاءَ، أَخَذَ عَلَى الْوَحْيِ مِيثَاقَهُمْ وعَلَى تَبْلِيغِ الرِّسَالَةِ أَمَانَتَهُمْ، لَمَّا بَدَّلَ أَكْثَرُ خَلْقِه عَهْدَ اللَّه إِلَيْهِمْ، فَجَهِلُوا حَقَّه واتَّخَذُوا الأَنْدَادَ مَعَه، واجْتَالَتْهُمُ الشَّيَاطِينُ عَنْ مَعْرِفَتِه، واقْتَطَعَتْهُمْ عَنْ عِبَادَتِه فَبَعَثَ فِيهِمْ رُسُلَه، ووَاتَرَ إِلَيْهِمْ أَنْبِيَاءَه لِيَسْتَأْدُوهُمْ مِيثَاقَ فِطْرَتِه، ويُذَكِّرُوهُمْ مَنْسِيَّ نِعْمَتِه، ويَحْتَجُّوا عَلَيْهِمْ بِالتَّبْلِيغِ، ويُثِيرُوا لَهُمْ دَفَائِنَ الْعُقُولِ، ويُرُوهُمْ آيَاتِ الْمَقْدِرَةِ، مِنْ سَقْفٍ فَوْقَهُمْ مَرْفُوعٍ ومِهَادٍ تَحْتَهُمْ مَوْضُوعٍ، ومَعَايِشَ تُحْيِيهِمْ وآجَالٍ تُفْنِيهِمْ وأَوْصَابٍ تُهْرِمُهُمْ، وأَحْدَاثٍ تَتَابَعُ عَلَيْهِمْ، ولَمْ يُخْلِ اللَّه سُبْحَانَه خَلْقَه مِنْ نَبِيٍّ مُرْسَلٍ، أَوْ كِتَابٍ مُنْزَلٍ أَوْ حُجَّةٍ لَازِمَةٍ أَوْ مَحَجَّةٍ قَائِمَةٍ، رُسُلٌ لَا تُقَصِّرُ بِهِمْ قِلَّةُ عَدَدِهِمْ، ولَا كَثْرَةُ الْمُكَذِّبِينَ لَهُمْ، مِنْ سَابِقٍ سُمِّيَ لَه مَنْ بَعْدَه،

أَوْ غَابِرٍ عَرَّفَه مَنْ قَبْلَه عَلَى ذَلِكَ نَسَلَتِ الْقُرُونُ ومَضَتِ الدُّهُورُ، وسَلَفَتِ الآبَاءُ وخَلَفَتِ الأَبْنَاءُ.

পয়গম্বর মনোনয়ন

আল্লাহ্ আদমের বংশধর থেকে অনেক পয়গম্বর মনোনীত করলেন এবং তাঁর প্রত্যাদেশ ও বাণী বিশ্বস্ততার সাথে মানুষের কাছে পৌছানোর জন্য তাদের নিকট থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করলেন। কালক্রমে অনেক লোক আল্লাহকে দেয়া প্রতিশ্রুতি পরিবর্তন করে ফেললো এবং আল্লাহর প্রতি কর্তব্য বিষয় ভুলে গিয়ে তাঁর সমকক্ষ দাঁড় করাতে লাগলো। শয়তান তাদেরকে আল্লাহর মা রেফাত থেকে ফিরিয়ে নিল এবং তার ইবাদত থেকে বিচ্ছিন্ন করলো। তখনই আল্লাহ তাদের কাছে রাসূলগণকে প্রেরণ করলেন এবং একের পর এক নবী পাঠালেন যেন তাঁরা পূর্ব - প্রতিশ্রুতি পরিপূর্ণ করার দিকে মানুষকে আহবান করেন এবং ভুলে যাওয়া নেয়ামতসমূহ স্মরণ করিয়ে দেন ; যেন তারা তবলিগের মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহর দিকে প্রণোদিত করেন ,যেন তাদের কাছে প্রজ্ঞার গুপ্ত রহস্য উন্মোচন করে দেন এবং আল্লাহর কুদরতের নিদর্শনসমূহ যেমন- সমুচ্চ আকাশ ,বিছানো পৃথিবী ,তাদের বাঁচিয়ে রাখার জীবনোপকরণ ,মৃত্যু ,বার্ধক্যের জরা ও ক্রমান্বয়ে আগত ঘটনা প্রবাহ- তাদেরকে দেখিয়ে দেন।

আল্লাহ্ তাঁর সৃষ্টিকে কখনো পয়গম্বরবিহীন অথবা নাজেলকৃত বাণী অথবা বাধ্যতামূলক প্রত্যাদেশ অথবা সরল সহজ পথ ব্যতীত রাখেননি। পয়গম্বরগণ এমনভাবে তাদের দায়িত্বে অটল ছিলেন যে ,তাদের সহচরের সংখ্যাল্পতা বা তাদেরকে মিথ্যা প্রমাণকারীর দল অধিক হওয়া সত্ত্বেও তাদের মিশন থেকে কখনো তারা বিরত হননি এবং কোন কিছুই তাদেরকে কর্তব্য থেকে বিরত রাখতে পারেনি । পয়গম্বরগণের প্রত্যেকেই তাঁর পূর্ববর্তী জনের কথা বলে গেছেন এবং পরবর্তী জনের আগমন বার্তা জ্ঞাপন করেছেন ।

مبعث النبي

إِلَى أَنْ بَعَثَ اللَّه سُبْحَانَه مُحَمَّداً، رَسُولَ اللَّهصلى‌الله‌عليه‌وآله لإِنْجَازِ عِدَتِه وإِتْمَامِ نُبُوَّتِه، مَأْخُوذاً عَلَى النَّبِيِّينَ مِيثَاقُه، مَشْهُورَةً سِمَاتُه كَرِيماً مِيلَادُه، وأَهْلُ الأَرْضِ يَوْمَئِذٍ مِلَلٌ مُتَفَرِّقَةٌ، وأَهْوَاءٌ مُنْتَشِرَةٌ وطَرَائِقُ مُتَشَتِّتَةٌ، بَيْنَ مُشَبِّه لِلَّه بِخَلْقِه أَوْ مُلْحِدٍ فِي اسْمِه، أَوْ مُشِيرٍ إِلَى غَيْرِه، فَهَدَاهُمْ بِه مِنَ الضَّلَالَةِ وأَنْقَذَهُمْ بِمَكَانِه مِنَ الْجَهَالَةِ، ثُمَّ اخْتَارَ سُبْحَانَه لِمُحَمَّدٍصلى‌الله‌عليه‌وآله لِقَاءَه، ورَضِيَ لَه مَا عِنْدَه وأَكْرَمَه عَنْ دَارِ الدُّنْيَا، ورَغِبَ بِه عَنْ مَقَامِ الْبَلْوَى، فَقَبَضَه إِلَيْه كَرِيماً،صلى‌الله‌عليه‌وآله وخَلَّفَ فِيكُمْ مَا خَلَّفَتِ الأَنْبِيَاءُ فِي أُمَمِهَا، إِذْ لَمْ يَتْرُكُوهُمْ هَمَلًا بِغَيْرِ طَرِيقٍ وَاضِحٍ ولَا عَلَمٍ قَائِمٍ

নবী মুহাম্মদ (সা.)

এভাবে সময় গড়িয়ে যুগের পর যুগ অতিক্রান্ত হলো। পিতারা মৃত্যুবরণ করলো এবং সন্তানেরা তাদের স্থানে এলো - সুদীর্ঘ সময় পার হবার পর আল্লাহ তাঁর অঙ্গীকার পূরণার্থে ও পয়গম্বর - ধারা সমাপ্তি করে মুহাম্মদকে (সা.) নবী ও রাসূল করে পৃথিবীতে প্রেরণ করলেন। অন্যান্য পয়গম্বরদের কাছ থেকে মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে অঙ্গীকার গ্রহণ করা হয়েছিল। মুহাম্মদের (সা.) জন্ম ছিল অতীব সম্মানজনক এবং চরিত্র বৈশিষ্ট্য ছিল সুখ্যাতিপূর্ণ। সে সময়ে পৃথিবীর মানুষ বিভিন্ন ধর্মে দলভুক্ত (মাজহাব) ছিল। তাদের মতো ও পথ ছিল বিবিধ ; চিন্তাধারা ছিল বিক্ষিপ্ত এবং একে অপরের সাথে বিবাদমান ছিল। তারা সৃষ্টিকে আল্লাহর সাদৃশ্য করতো অথবা তার মহিমান্বিত নামসমূহ বিকৃত করতো অথবা তিনি ব্যতীত অন্য কিছুকে ক্রিয়া - কর্ম সম্পাদনকারী মনে করতো। মুহাম্মদের (সা.) মাধ্যমে আল্লাহ তাদেরকে সুপথ দেখালেন এবং তার অক্লান্ত প্রচেষ্টা দ্বারা তিনি তাদেরকে অজ্ঞতা থেকে ফিরিয়ে আনলেন ।

অতঃপর আল্লাহ মুহাম্মদকে (সা.) তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য মনোনীত করে তার মহিমান্বিত নৈকট্য দান করলেন এবং এ পৃথিবীতে থাকার অনেক অনেক উর্দ্ধের মর্যাদাশীল বিবেচনা করে তাকে এ পৃথিবী থেকে তুলে নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। ফলে তিনি মহাসম্মানের সাথে তাঁকে নিজের সান্নিধ্যে নিয়ে গেলেন। মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর বংশধরগণের ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক ।

القرآن والأحكام الشرعية

كِتَابَ رَبِّكُمْ فِيكُمْ مُبَيِّناً حَلَالَه وحَرَامَه، وفَرَائِضَه وفَضَائِلَه ونَاسِخَه ومَنْسُوخَه ورُخَصَه وعَزَائِمَه وخَاصَّه وعَامَّه، وعِبَرَه وأَمْثَالَه ومُرْسَلَه ومَحْدُودَه ومُحْكَمَه ومُتَشَابِهَه مُفَسِّراً مُجْمَلَه ومُبَيِّناً غَوَامِضَه، بَيْنَ مَأْخُوذٍ مِيثَاقُ عِلْمِه ومُوَسَّعٍ

عَلَى الْعِبَادِ فِي جَهْلِه، وبَيْنَ مُثْبَتٍ فِي الْكِتَابِ فَرْضُه، ومَعْلُومٍ فِي السُّنَّةِ نَسْخُه، ووَاجِبٍ فِي السُّنَّةِ أَخْذُه، ومُرَخَّصٍ فِي الْكِتَابِ تَرْكُه، وبَيْنَ وَاجِبٍ بِوَقْتِه وزَائِلٍ فِي مُسْتَقْبَلِه، ومُبَايَنٌ بَيْنَ مَحَارِمِه مِنْ كَبِيرٍ أَوْعَدَ عَلَيْه نِيرَانَه، أَوْ صَغِيرٍ أَرْصَدَ لَه غُفْرَانَه، وبَيْنَ مَقْبُولٍ فِي أَدْنَاه مُوَسَّعٍ فِي أَقْصَاه.

পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ

মুহাম্মদ (সা.) তোমাদের মাঝে ওই একই জিনিস রেখে গেছেন যা অন্য পয়গম্বরগণও তাদের উম্মতের কাছে রেখে গিয়েছিলেন। পয়গম্বরগণ মানুষকে অন্ধকারে রেখে যান নি । তাঁরা সুনির্দিষ্ট সঠিক পথের সন্ধান দিয়েছিলেন এবং আল্লাহর স্থায়ী নিদর্শনাবলীর তত্ত্বাবধান করেছিলেন। মুহাম্মদ (সা.) তোমাদের কাছে রেখে গেছেন তোমাদের প্রতিপালকের কিতাব যা নির্ধারিত হালাল ও হারাম বর্ণনাকরে ; ফরজ ও মোস্তাহাবসমূহ বর্ণনা করে ; মনসুখ ও নাসেখ বর্ণনা করে ; বাধ্যতামূলক ও ঐচ্ছিক বিষয়াদি ,বিশেষ ও সাধারণ বিষয়াদি ,উপদেশ ও উপমা ,সীমিত ও অসীম ,স্পষ্ট ও অস্পষ্ট বর্ণনা করে এবং শব্দ সংক্ষেপের (মুকাত্তাআত) ব্যাখ্যা ও গুপ্ত বিষয়ের স্পষ্ট বর্ণনা করে।

কুরআনে কিছু কিছু আয়াত আছে যে বিষয়ে জ্ঞানার্জন বাধ্যতামূলক আবার এমন কিছু আয়াত আছে যেগুলোর রহস্য বিষয়ে মানুষের অজ্ঞতা মার্জনীয়। রাসূলের সুন্নাহ কুরআনের বাধ্যতামূলক বিষয়াদি প্রকাশক। রাসূলের সুন্নাহর মাধ্যমে বাধ্যতামূলক বিষয়ের রাদ - বদলও প্রতিফলিত হয়েছে অথবা সুন্নাহতে এমন বিষয়াদি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে যা পবিত্র গ্রন্থে হয়ত অনুসরণ না করার অনুমতি রয়েছে। এছাড়াও কিছু কিছু আয়াত আছে যা একটা বিশেষ সময় পর্যন্ত বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু ওই সময়ের পর তদ্রুপ নেই। কুরআনের নিষেধাজ্ঞাসমূহও বিভিন্ন - কিছু এমন যাতে জাহান্নামের ভীতি প্রকট এবং কিছু এমন যাতে ক্ষমার প্রত্যাশা অধিক ব্যক্ত হয়েছে। কুরআনে এমন আয়াতও আছে যার একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রাংশও আল্লাহর নিকট বর্ধিত আকারে গ্রহণযোগ্য।

ومنها في ذكر الحج

وفَرَضَ عَلَيْكُمْ حَجَّ بَيْتِه الْحَرَامِ، الَّذِي جَعَلَه قِبْلَةً لِلأَنَامِ، يَرِدُونَه وُرُودَ الأَنْعَامِ ويَأْلَهُونَ إِلَيْه وُلُوه الْحَمَامِ، وجَعَلَه سُبْحَانَه عَلَامَةً لِتَوَاضُعِهِمْ لِعَظَمَتِه، وإِذْعَانِهِمْ لِعِزَّتِه، واخْتَارَ مِنْ خَلْقِه سُمَّاعاً أَجَابُوا إِلَيْه دَعْوَتَه، وصَدَّقُوا كَلِمَتَه ووَقَفُوا مَوَاقِفَ أَنْبِيَائِه، وتَشَبَّهُوا بِمَلَائِكَتِه الْمُطِيفِينَ بِعَرْشِه، يُحْرِزُونَ الأَرْبَاحَ فِي مَتْجَرِ عِبَادَتِه، ويَتَبَادَرُونَ عِنْدَه مَوْعِدَ مَغْفِرَتِه، جَعَلَه سُبْحَانَه وتَعَالَى لِلإِسْلَامِ عَلَماً، ولِلْعَائِذِينَ حَرَماً فَرَضَ حَقَّه وأَوْجَبَ حَجَّه، وكَتَبَ عَلَيْكُمْ وِفَادَتَه ، فَقَالَ سُبْحَانَه:( ولِلَّه عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطاعَ إِلَيْه سَبِيلًا، ومَنْ كَفَرَ فَإِنَّ الله غَنِيٌّ عَنِ الْعالَمِينَ ) .

হজ্জ সম্পর্কে

আল্লাহ তাঁর পবিত্র গৃহে হজ্জ করা তোমাদের জন্য ফরজ করেছেন এবং সে গৃহকে মানুষের জন্য কেবলা হিসাবে নির্ধারিত করেছেন। প্রাণীকুল অথবা কবুতর তৃষিত অবস্থায় যেভাবে ঝরনার পানির দিকে ছুটে যায় মানুষও তেমনি যেন কাবার দিকে ধাবমান হয়। মহিমান্বিত আল্লাহ তাঁর আজমতের সামনে বান্দাদের তাওয়াজু (বিনয়) প্রকাশের জন্য এবং তাঁর ইজ্জতের প্রতি তাস্দিক (দৃঢ় বিশ্বাস) প্রকাশের জন্য সম্মানিত ঘরকে প্রতীক হিসাবে নির্ধারিত করেছেন। সৃষ্টির মধ্য থেকে তিনি এমন কিছু শ্রবণকারী মনোনীত করেছেন যারা তার ডাকে সাড়া প্রদান করে এবং তার বাণী বাস্তবে পরিণত করে। এসব লোকেরা পয়গম্বরগণের মর্যাদার পর্যায়ে অবস্থান করে এবং তারা ওই সমস্ত ফেরেশতাগণের প্রতিরূপ যারা আরাশের চতুর্দিকে তওয়াফ করে আল্লাহর ইবাদতের সার্বিক মর্যাদা ও তার প্রতিশ্রুত ক্ষমার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। মহিমান্বিত আল্লাহ্ পবিত্র গৃহকে ইসলামের জন্য একটা প্রতীক করেছেন এবং আশ্রয় গ্রহণকারীদের জন্য উহা নিরাপদ স্থান। তিনি কাবার হক আদায়কে ওয়াজেব করেছেন এবং উহার দিকে সফরকে বাধ্যতামূলক করেছেন। আল্লাহ্ বলেনঃ এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে এ গৃহের হজ্জ করা সেসকল লোকের জন্য বাধ্যতামূলক যারা কাবা পর্যন্ত যাবার সামর্থ্য রাখে । কিন্তু কেহ অস্বীকার করলে ,জেনে রাখুক ,আল্লাহ বিশ্বজগতের মুখাপেক্ষী নন (কুরআন - ৩:৯৭) ।

____________________

১ । আল্লাহর মা রেফাতেই দ্বিনের ভিত্তি। দ্বিনের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে আনুগত্য স্বীকার করা এবং সাধারণভাবে দ্বীন বলতে বিধান বুঝায়। যে কোন অর্থই গ্রহণ করা হোক না কেন অন্তর যদি আল্লাহর মা রেফাতের ধারণাবিহীন হয় তবে আনুগত্যের প্রশ্নই ওঠেনা এবং সেক্ষেত্রে বিধান অনুসরণের প্রশ্নও বাতুলতা মাত্র। কারণ যখন কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে না তখন লক্ষ্যে পৌছার জন্য অগ্রযাত্রারও কোন দিক নির্দেশনা থাকে না । কোন লক্ষ্য বিষয়ের ধারণা না থাকলে তা পাবার প্রচেষ্টাও করা যায় না। এতদসত্ত্বেও মানুষ যখন কোন উন্নত ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে আসে তখন তাঁর আনুগত্যের উপলব্ধি ও প্রেরণা মানুষের স্বভাব ও ব্যক্তিগত গুণাবলীকে প্রভাবিত করে মানুষের বাতেনকে উচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করে।

আল্লাহর মা রেফাত সম্পর্কীয় অত্যাবশ্যকীয় বিষয়সমূহ বর্ণনার পর আমিরুল মোমেনিন উহার মূল উপাদান ও শর্তসমূহ ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন যে ,মানুষ যদিও মা রেফাত জ্ঞানকে উচু স্তরের চিন্তা ভাবনা মনে করে এড়িয়ে যেতে চায়। তবুও এর প্রাথমিক ধাপ হলো অজানাকে জানার সহজাত আকাঙ্ক্ষা ও বিবেকের তাড়না অথবা মোমিনের কাছে দীক্ষা গ্রহণ করে অদৃশ্য সত্তা সম্পর্কে একটা ধারণা মনের মধ্যে গড়ে তোলা। বস্তৃত এ ধারণাটাই আল্লাহর মা রেফাত অন্বেষণের পথিকৃত হিসাবে কাজ করে। কিন্তু যারা গাফেল অথবা পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে গবেষণায় নিমগ্ন হতে পারে না তাদের মনে ধারণার সৃষ্টি হলেও তারা মা রেফাতের গভীর সমুদ্রে ডুব দিতে পারে না এবং তাদের কাছে মা রেফাতের ধারণা বদ্ধমূল হতে পারে না। এক্ষেত্রে তারা আল্লাহর অস্তিত্ব জ্ঞান থেকে বঞ্চিত থাকে এবং এ পর্যায়ে যেহেতু সাক্ষ্য বহনের স্তর তাদের কাছে অনভিগম্য ,সেহেতু এ বিষয়ে তারা প্রশ্নযোগ্য হয়ে পড়ে। কিন্তু যদি কেউ মা রেফাত সম্পর্কে অর্জিত মানসচিত্র দ্বারা পরিচালিত হয়ে এগিয়ে যায় সে বুঝতে পারে এতে গভীর চিন্তা ও গবেষণা অত্যাবশ্যক। এভাবেই মানুষ আল্লাহর মা রেফাত লাভের পরবর্তী স্তরে উপনীত হয়। এ স্তর হলো সৃষ্টির বৈচিত্র্যের মাঝে স্রষ্টার খোজ করা। কারণ প্রতিটি শিল্পকর্ম শিল্পীর অস্তিত্বের সর্বসম্মত ও দৃঢ় প্রমাণ এবং প্রতিটি ক্রিয়ায় কোন না কোন প্রতিক্রিয়া বিদ্যমান। মানুষ যেদিকে দৃষ্টিপাত করুক না কেন সে এমন কোন কিছুর অস্তিত্ব বের করতে পারবে না। যা কেউ না কেউ তৈরি করেনি ; এমন কোন পদচিহ্ন দেখাতে পারবে না যেখানে কেউ হাঁটে নি ; এমন কোন নির্মাণ কাজ দেখাতে পারবে না। যার কোন নির্মাতা নেই। এরপরও মানুষ কিভাবে ভাবতে পারে চন্দ্র ,সূর্য ,গ্রহ ,নক্ষত্র খচিত বিস্তীর্ণ নীলাকাশ ও তৃণফুল সুশোভিত। এ সুন্দর পৃথিবী সৃষ্টিকর্তা ছাড়াই সৃষ্টি হয়েছে ? সুতরাং বস্তুনিচয় আর সৃষ্টির নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া দেখার পরও কি কেউ এ কথা বলতে পারে যে ,এ বৈচিত্র্যময় বিশ্বচরাচরের সৃষ্টিকর্তা নেই ? কারণ বস্তুসত্তা অনস্তিত্ব থেকে আসতে পারে না বা অসত্তাত্ব (nothingness ) অস্তিত্বের কারণ হতে পারে না। এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনের যুক্তিবিন্যাস হলোঃ

আল্লাহ সম্বন্ধে কি কোন সন্দেহ আছে যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর মৌলিক সৃষ্টিকর্তা (১৪:১০)

কিন্তু মা রেফাতের এ স্তরটিও অপর্যাপ্ত হয়ে পড়ে যখন আল্লাহর অস্তিত্বের সাক্ষ্য বহন তাগুতের প্রতি বিশ্বাস দ্বারা কলঙ্কিত করা হয় ।

মা রেফাতের পথে তৃতীয় স্তর হলো আল্লাহর ঐক্য ও একত্বে গভীর বিশ্বাসসহ তাঁর অস্তিত্বের স্বীকৃতি অর্থাৎ তৌহিদে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। তৌহিদে প্রতিষ্ঠিত হতে না পারলে আল্লাহর অস্তিত্বের সাক্ষ্য বহন পরিপূর্ণ হয় না ,কারণ তাগুতে বিশ্বাস করলে আল্লাহতে বহুত্ব আরোপ করা হয়। অথচ মা রেফাত অর্জনের জন্য আল্লাহকে একক হিসাবে গ্রহণ করা অপরিহার্য। একাধিক আল্লাহর ধারণা করলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে যে ,এ বিশ্বচরাচর কি তাদের একজন সৃষ্টি করেছে ,নাকি তারা সকলে সম্মিলিতভাবে করেছে ? যদি তাদের কেউ একজন সৃষ্টি করতো তাহলে অপরজন নিজকে প্রভেদ করে দেখানোর জন্য অন্য রকম সৃষ্টি করতো। আবার যদি তারা সকলে সমষ্টিগতভাবে সৃষ্টি করতো তা হলে দুটো অবস্থার সৃষ্টি হতো - হয় তারা একে অপরের সহায়তা ব্যতীত কর্ম সম্পাদন করতে পারতো না ,না হয়। কারোই অপরের সহায়তার প্রয়োজন হতো না। প্রথম অবস্থাটি অক্ষমতা প্রকাশক যাতে দেখা যায়। একজন অপরজনের উপর নির্ভরশীল এবং অপর অবস্থাটিতে দেখা যায় তারা প্রত্যেকে নিয়মিত আলাদা আলাদা ক্রিয়া সম্পাদক। ধরা যাক ,সকল স্রষ্টা তাদের সৃষ্টিকর্ম নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে সম্পাদন করছেন। সেক্ষেত্রে অবস্থাটা এমন হতো যে ,প্রতিটি সৃষ্টি শুধুমাত্র তার নিজস্ব স্রষ্টার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখতো - সমগ্র সৃষ্টি একই স্রষ্টার সাথে সম্পর্ক রক্ষা করতো না। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা তা নয়। প্রতিটি সৃষ্টজীব স্রষ্টার সাথে একই সম্পর্ক রক্ষা করে চলছে এবং বিশ্বচরাচরের সবকিছু একই নিয়মে চলছে। মোট কথা ,আল্লাহর একত্বের স্বীকৃতি না দিয়ে কোন উপায় নেই ,কারণ একাধিক সৃষ্টিকর্তার ধারণা গ্রহণ করলে কোন কিছুর অস্তিত্বের সম্ভাব্যতা থাকে না এবং নিঃসন্দেহে পৃথিবী ও নভোমণ্ডলসহ সৃষ্টির সবকিছু ধ্বংস হয়ে যেতো। মহিমান্বিত আল্লাহ নিম্নরূপ যুক্তি প্রদর্শন করেনঃ

যদি আল্লাহ্ ব্যতীত আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী এবং এতদুভয়ের মধ্যে বহু ইলাহ থাকতো ,তবে উভয়ই ধ্বংস হয়ে যেতো ...(কুরআন - ২১ ? ২২) ।

মা রেফাতের চতুর্থ স্তর হলো আল্লাহকে সকল দোষ - ত্রুটি ও বিচূতি মুক্ত ,দেহ ও আকার নিরপেক্ষ ,বস্তুমোহ নিরপেক্ষ ,কোন প্রকার উপমা ও সাদৃশ্য মুক্ত ,স্থান ও কালের সীমাবদ্ধতা মুক্ত ,গতি ও নিশ্চলতা মুক্ত এবং অক্ষমতা ও অজ্ঞতা মুক্ত মনে করতে হবে। কারণ পরম পবিত্র সত্তায় কোন দোষ - ত্রুটি থাকতে পারে না বা কেউ তার সদৃশ হতে পারে না। এসব অবস্থা স্রষ্টার মহান মর্যাদা থেকে একটা সত্তাকে সৃষ্টির পর্যায়ে নামিয়ে আনে। এ কারণেই আল্লাহ তার একত্বসহ সকল ত্রুটি - বিচূতি থেকে পরম পবিত্রতা ধারণ করেছেন। আল্লাহ বলেনঃ

তিনিই আল্লাহ ,একক। আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন । তিনি কাউকে জন্ম দেন নি এবং তাঁকেও কেউ জন্ম দেয়নি । এবং তাঁর সমতুল্য কেউ নেই। (কুরআন - ১.১২ :১ - ৪)

তিনি দৃষ্টির অধিগম্য নহেন। কিন্তু দৃষ্টিশক্তি তাঁর অধিগত এবং তিনিই সূক্ষ্মদর্শী সম্যক পরিজ্ঞাতা (কুরআন - ৬:১০৩)

সুতরাং আল্লাহর কোন সদৃশ উদ্ভাবন করো না । আল্লাহ্ (সর্ব বিষয়ে) পরিজ্ঞাত এবং তোমরা কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয় ,তিনি সর্বশ্রোতা ,সর্বদ্রষ্টা / (কুরআন - ৪২:১১)

মা রেফাতের পঞ্চম স্তর হলো আল্লাহর প্রতি বাইরের কোন গুণারোপ করা যাবে না পাছে তাঁর এককত্বে দ্বৈততা এসে যায় এবং একের মধ্যে তিন ও তিনের মধ্যে একের গোলক ধাধায় এককত্বের গূঢ়ার্থ হারিয়ে যায়। কারণ তাঁর সত্তা আকার ও সত্তাসারের সংমিশ্রণ নয়। সে কারণে আল্লাহতে গুণ এমনভাবে জড়ানো যেমন ফুলে ঘাণ অথবা তারকারাজীতে দীপ্তি। বরং তিনিই সকল গুণের ঝরনাধারা এবং তার যথার্থ গুণাবলী প্রকাশের জন্য কোন মাধ্যমের প্রয়োজন হয় না। তাকে সর্বজ্ঞ বলা হয় কারণ তাঁর জ্ঞানের চিহ্নসমূহ স্পষ্টত প্রতীয়মান। তাঁকে সর্বশক্তিমান বলা হয়। কারণ প্রতিটি অণু পরমাণু তাঁর সর্বশক্তিমান হওয়া ও সক্রিয়তার নির্দেশক। যদি আল্লাহর প্রতি এ গুণারোপ করা হয় যে তার শ্রবণ ও দর্শন করার ক্ষমতা আছে। তবে এটা যথার্থ যে ,দর্শন ও শ্রবণ ব্যতীত সমগ্র সৃষ্টির সুসঙ্গত প্রশাসন রক্ষা করা সম্ভব নয়। কিন্তু এসব গুণাবলী সৃষ্টজীবে যেভাবে আছে (যেমন কর্ণ দ্বারা শুনা বা চক্ষু দ্বারা দেখা) আল্লাহর ক্ষেত্রে অনুরূপ মনে করা যাবে না। তদুপরি এমনটিও ধারণা করা যাবে না যে ,তিনি জ্ঞানার্জনের পর জানতে সক্ষম হয়েছেন বা তার অঙ্গ - প্রত্যঙ্গে শক্তি সঞ্চালনের পর তিনি শক্তিমান হয়েছেন। আল্লাহর সত্তা থেকে গুণকে আলাদা চিন্তা করলে দ্বিত্ব প্রকাশ করা হয় ,আর যখনই দ্বিত্ব প্রকাশ পাবে তখনই একত্ব অন্তর্ধান হবে। এ কারণে আমিরুল মোমেনিন আল্লাহর সত্তা থেকে গুণ আলাদা ,এমন ধারণা বাতিল করে দিয়েছেন। তিনি এককত্বকে উহার প্রকৃত গূঢ়ার্থে ব্যক্ত করেছেন এবং বহুত্বের কলঙ্ক দ্বারা এককত্বকে কলঙ্কিত করেন নি। এ কথায় এটা বুঝায় না যে ,আল্লাহর প্রতি কোন বিশেষণ প্রয়োগ করা যাবে না। নাস্তিক্যের অতল অন্ধকারে যারা ডুবে আছে তারাই আল্লাহর বিশেষণহীনতার ধারণা পোষণ করে। অথচ সৃষ্টিচরাচর আল্লাহর গুণরাজীতে কানায় কানায় পরিপূর্ণ ; সৃষ্টির প্রতিটি অণু সাক্ষ্য দেয় - তিনি সর্বজ্ঞ ,তিনি সর্বশক্তিমান ,তিনি সর্বশ্রোতা ,তিনি সর্বদ্রষ্টা এবং তিনি সযত্নে সৃষ্টিকে প্রতিপালন করেন ও অনুকম্পা দ্বারা ক্রমবৃদ্ধি করেন। বিষয়টি হলো এই যে ,কোন কিছু করার জন্য অন্যের পরামর্শ তার প্রয়োজন হয় না ; কারণ নিজ সত্তায় তিনি গুণ পরিবেষ্টিত এবং তার গুণরাজীই তাঁর সত্তার জাত্যর্থ ইমাম জাফর আস - সাদিক অন্যান্য ধর্মে বর্ণিত আল্লাহর এককত্বের বিষয়টি তুলনা করে বলেনঃ

আমাদের মহিমান্বিত ও পরম দয়ালু আল্লাহ নিজ সত্তায় জ্ঞানান্বিত ছিলেন যখন জানার মতো কিছুই ছিল না ,নিজ সত্তায় দৃষ্টিমান ছিলেন যখন দেখার মতো কোন কিছুই ছিল না ,নিজ সত্তায় শ্রুতিমান ছিলেন যখন শোনার মতো কোন কিছু ছিল না ,নিজ সত্তায় শক্তিমান ছিলেন যখন তাঁর শক্তির অধীন কোন কিছুই ছিল না । যখন তিনি বস্তুনিচয় সৃষ্টি করলেন এবং জ্ঞানেন্দ্রিয় অস্তিত্বশীল হলো তখন তাঁর জ্ঞান জ্ঞায়ের সাথে ,শ্রুতি শ্রাব্যের সাথে ,দৃষ্টি দৃশ্যমানের সাথে এবং শক্তি বস্তুর সাথে সম্বন্ধযুক্ত হলো (সাদুক ,পৃঃ ১৩৯) ।

আহলুল বাইতের ইমামদের এ বিশ্বাস সর্বসম্মত। কিন্তু ইমামগণ ব্যতীত বিভিন্ন দল আল্লাহর জাত ও সিফাতের মধ্যে পার্থক্যের ধারণা সৃষ্টি করে ভিন্ন ধারা গ্রহণ করেছে। আবুল হাসান আল - আশারীর মতে আল্লাহ্ জ্ঞানের মাধ্যমে জানেন ; ক্রিয়ার মাধ্যমে শক্তিশালী ,উক্তির মাধ্যমে কথা বলেন ; শ্রুতির মাধ্যমে শোনেন এবং দৃষ্টির মাধ্যমে দেখেন (শাহরাস্তানী ,১ম খণ্ড ,পৃঃ ৪২) ।

আশারীর উপরোক্ত ধারণানুযায়ী যদি জাত আর সিফাতকে আলাদা ধরা হয় তবে দুটি বিকল্প দাঁড়ায় - হয় সিফাত আদি থেকেই আল্লাহতে রয়েছে ,না হয় তা পরবর্তীতে সংঘটিত হয়েছে। প্রথম ক্ষেত্র মেনে নিলে একথাই স্বীকার করা হবে যে ,আল্লাহর অনাদি - অনন্ত অস্তিত্বকাল থেকেই গুণরাজীর সমসংখ্যক বস্তুনিচয় বিরাজিত ছিল যা তার অনন্ততার অংশীদার হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু মানুষ তাকে যা কিছুর সমতুল্য মনে করুক না কেন তিনি এসবের উর্দ্ধে (কুরআন) । দ্বিতীয় ক্ষেত্র মেনে নিলে আল্লাহকে শুধুমাত্র পরিবর্তনের শর্তাধীনই করা হয় না। বরং এটাও বুঝানো হয় যে ,গুণরাজী অর্জনের পূর্বে তিনি বিজ্ঞানপ্রাপ্ত ছিলেন না ; শক্তিশালী অথবা শ্রোতা অথবা দ্রষ্টা ছিলেন না। এহেন ধারণাসমূহ ইসলামের মূল দর্শনের বিপরীত।

বাংলা অনুবাদকের মন্তব্য

আমিরুল মোমেনিন আলী ইবনে আবি তালিবের এ খোৎবাটি অত্যন্ত তাত্ত্বিক। এতে তিনি আল্লাহতত্ত্ব ,মহাবিশ্ব সৃষ্টিতত্ত্ব ,মানব সৃষ্টিতত্ত্ব ,নবীতত্ত্ব ,ফেরেশতা তত্ত্ব অতি চমৎকার আলঙ্কারিক ভাষায় সংক্ষিপ্তাকারে ব্যক্ত করেছেন। এ বিষয়গুলো দর্শনশাস্ত্রের মৌলিক বিষয় বলে চিহ্নিত। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই দার্শনিকগণ এ বিষয়গুলোর ওপর নানা প্রকার মতো ও তত্ত্ব প্রদান করে আসছেন। আধুনিক বিশ্বের মহান দার্শনিকগণও তাদের চিন্তা ,ধ্যান - ধারণা ও অভিমত এ বিষয়গুলোর ওপর ব্যক্ত করে যাচ্ছেন। কিন্তু প্রত্যেক দার্শনিকের প্রদত্ত তত্ত্ব অন্যজন হয় পরিমার্জিত করেন ,না হয় বাতিল করে দেন। কেউ এখনো এ বিষয়গুলোতে সুনির্দিষ্ট কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন নি। এটা মনে হচ্ছে একটাEndless Belt . আজ থেকে প্রায় ১৪০০ বছর পূর্বে আমিরুল মোমেনিন স্রষ্টা - জগৎ - জীবনের যে তত্ত্বগত দার্শনিক যুক্তি প্রদর্শন করে গেছেন তা সারা বিশ্বের দার্শনিকের তাত্ত্বিক দর্শনের প্রধান উদ্দেশ্য বলে স্বীকৃতি লাভ করেছে। শুধু এ খোৎবাতেই নয় ,তাঁর অধিকাংশ খোৎবায় তিনি এমনভাবে আল্লাহতত্ত্ব প্রকাশ করেছেন যা দার্শনিকগণের উপজীব্য।

আল্লাহতত্ত্বঃ সক্রেটিস প্রাকৃতিক নিয়মানুবর্তিতা এবং জগৎসমূহের সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা ও রূপবৈচিত্র্যের পেছনে এক প্রজ্ঞাবান ঐশী সত্তার সন্ধান পেয়েছেন। জগতের প্রতীয়মান উদ্দেশ্য থেকে তিনি পরম জ্ঞানবান ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুমান করেছেন। তিনি বলেছিলেন ,রাষ্ট্রিয় কর্মকর্তাদের দ্বারা নয় ,ইশ্বর দ্বারাই আমি পরিচালিত হব। ঈশ্বর বলতে তিনি এক সর্বব্যাপক পরিণামদর্শী আধ্যাত্মিক সত্তাকে বুঝেছেন ,কোন জড়ীয় সত্তাকে নয় (ইসলাম ,পৃঃ ১৮১) । সক্রেটিসেরKnow thyself ,তত্ত্ব পরবর্তীতে ইসলামের মান আরাফা নাফসাহু ,ফাকাদ আরাফা রাব্বাহু (যে নিজকে চিনেছে সে তার প্রভুকে চিনেছে) তত্ত্বে রূপান্তরিত হয়ে এক গভীর অন্তর্ব্যাপী সূক্ষ্ম পরিণামদর্শী ভাবধারার জন্ম দিয়েছে। প্লেটো স্রষ্টাকে অনন্ত বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি হোমারিয় দেবতা তত্ত্ব বাতিল করে দিয়ে বলেছেন , নক্ষত্রপুঞ্জ ও দেবতাগণ একই ঈশ্বরের সৃষ্টি। এরিষ্টটল ঈশ্বর বলতে বুঝেছেন অচালিত চালক ,জড়াতীত চেতনা বা উপাদানহীন পরম সত্তাকে। তাঁর মতে ঈশ্বর নিরপেক্ষ ফর্ম বা রূপ। আর রূপ মানেই সার্বিক বা অতিবর্তী উপাদানহীন রূপ। ক্টোয়িক দার্শনিকগণ জগৎ সৃষ্টি ও নিয়ন্ত্রণের মূলে ঈশ্বরকে দেখেছেন এবং তাকে সর্বদর্শী ,সর্বশক্তিমান ও প্রেমময় বলে বর্ণনা করেন। তাদের মতে জগৎ এক পরম কল্যাণগুণনিদান সত্তা ,তথা এক মহান উদ্দেশ্যের অভিব্যক্তি স্বরূপ। মানবাত্মা যেমন ব্যক্তির সারা দেহ জুড়ে বিদ্যমান ,তেমনি স্টোয়িকদের ঈশ্বরও জগতের সর্বত্র বিদ্যমান (ইসলাম ,পৃঃ ১৮২) । এ মতবাদই মুসলিম দার্শনিকদের ওয়াহদাতুল ওজুদ (সত্তার ঐক্য বা সর্বেশ্বরবাদ) তত্ত্বের রূপ পরিগ্রহ করেছে।

মধ্যযুগের দার্শনিক অগাস্টিন যুক্তিবুদ্ধির চেয়ে অনাবিল বিশ্বাসের ওপর বেশি জোর দেন। তাঁর মতে ,ঈশ্বর ছাড়া অন্য কোন চূড়ান্ত বাস্তব সত্তা নেই। ঈশ্বর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া মাত্রই মানুষ চির অভিশাপে নিপতিত হয়। তাঁর মতে ,শুধু ঈশ্বরকে জানাই যথেষ্ট নয় ,ঈশ্বর প্রাপ্তির জন্য ঐশী প্রেম ও ভক্তি অপরিহার্য। প্লোটিনাসের মতে ,ঈশ্বর দেহ ও মনের ,রূপ ও উপাদানের ,তথা সকল অস্তিত্বের উৎস। তবে তিনি নিজে বহুত্বের উর্দ্ধে। তিনি পরম একক সত্তা এবং সবকিছুই তাঁর মহা একত্বের অন্তর্ভুক্ত। ঈশ্বর থেকেই সব কিছুর উৎপত্তি ও বিকিরণ। আমরা ঈশ্বরে সৌন্দর্য ,মহত্ত্ব ,চিন্তা ,বাসনা ,ইচ্ছা ,অভীপ্সা ইত্যাদি কোন গুণই আরোপ করতে পারি না ; কারণ এসব গুণ সীমিতশক্তি ও অপূর্ণতার আকর। ঈশ্বর যে আসলে কী তা আমরা বলতে পারি না। আমরা তাকে অচিন্তনীয় সত্তা বলতে পারি। তিনি চিন্তনীয় নন। যা চিন্তনীয় তার সঙ্গে বিষয় ও বিষয়ীর দ্বৈততা বিজড়িত। সুতরাং ঈশ্বরে কোন গুণ আরোপ করা যায় না। কারণ সসীম গুণ আরোপের মানেই অসীম সত্তাকে সীমিত করে ফেলা।(ইসলাম ,পৃঃ১৮৩) ।

এভাবে ভাববাদী দার্শনিক হেগেল ঈশ্বরকে পরম ধারণা বা সার্বিক প্রজ্ঞা বলে অভিহিত করেন। তিনি বলতেন - ঈশ্বর জগতে নিমজ্জিত নন ,আবার জগৎ ঈশ্বরে নিমজ্জিত নয়। জগৎকে বাদ দিয়ে ঈশ্বর আর ঈশ্বর থাকেন না। একইভাবে বার্কলে ,ব্র্যাডলি ,রয়েস ,জেমস প্রভৃতি ভাববাদী দার্শনিকগণ আল্লাহকে পরম সত্তা ,প্রান্তিক একত্ব ,অনুত্তর পরমসত্তা ,অসীম পরমসত্তা ইত্যাদি রূপে ব্যাখ্যা করে আল্লাহর একত্বের প্রকাশ করেছেন (ইসলাম ,পৃঃ ১৮৪ - ১৮৫) । মুসলিম ভাববাদী ও প্রেমবাদী দার্শনিকগণের ধ্যান ধারণায় একই কথা অর্থাৎ আমি তুমি নই ,আবার তোমা থেকে জুদা (আলাদা) নই। তত্ত্বের সমাবেশ ঘটেছে।

খৃষ্টপূর্ব ৫৪৮ অব্দে থেলিস নামক এক গ্রিক পণ্ডিত - প্রকৃতির মধ্যে পরম ঐক্যনীতি বা পরম একত্বের সন্ধান লাভ করেন। তিনি বলেন যে ,বিশ্বজগতে কোন কিছুর কারণ হিসাবে কোন কিছুকে ধরা হলে দেখা যায় তা প্রকৃত কারণ নয় ,তার পশ্চাতে অন্য একটি কারণ রয়েছে। এভাবে কারণ পরম্পরা শৃঙ্খলের ন্যায় প্রসারিত হতে থাকে। তিনি বলেন ,এভাবে কারণ অনুসন্ধান করে যতই মূলের দিকে যাওয়া যায় ততই কারণের পিরামিডের চূড়া সরু হয়ে আসছে। এতে তিনি মনে করেন যে ,কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যাবে একটা মাত্র কারণ থেকে সকল বস্তুর উৎপত্তি হয়েছে ,যাকে তিনি মূল কারণ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর এ সূত্র ধরে এনাক সিমেনিস ,পিথাগোরাস এবং পরবর্তীতে ডেমোক্রিটাস ,হিউম ,লক ও বার্কলে অবিভাজ্য পরমাণু এর মধ্যে পরম ঐক্যের সন্ধান পান (সরকার ,পৃঃ৪৮ - ৪৯) । এ ধারণা থেকেই মুসলিম দার্শনিকগণ আল্লাহ্ সম্পর্কেCause of all causes তত্ত্বের উন্নতি সাধন করেন। বিংশ শতাব্দীর দার্শনিক বাট্র্যাণ্ড রাসেল অভিজ্ঞতাবাদী ও বাস্তববাদী হওয়া সত্ত্বেও জড়বাদ ও আধ্যাত্মবাদের মাঝামাঝি নিরপেক্ষ একত্ববাদ '- এর প্রচারক ছিলেন। তিনি প্রেমকে জীবনদর্শনের মূল নৈতিক প্রেরণা হিসাবে মেনে নিয়ে এক কল্যাণমুখী বিশ্বমানবতাবাদের বাণী বাহক ছিলেন।(মতীন ,পৃঃ৫)

মুসলিম দর্শনে আল্লাহতত্ত্ব কুরআন থেকেই উদ্ভূত। সাহাবাদের মধ্যে আমিরুল মোমেনিন ব্যতীত আর কেউ সৃষ্টিতত্ত্ব ,আল্লাহ্ তত্ত্ব ইত্যাদি গৃঢ় রহস্যাবৃত বিষয়গুলো নিয়ে দার্শনিক দৃষ্টি ভঙ্গী সম্বলিত বর্ণনা প্রদান করেননি। কুরআনের রহস্যাবৃত আয়াতগুলোতে এসব বিষয়ের ইঙ্গিত রয়েছে। রাসূল (সা.) এ বিষয়গুলো সবিশেষ অবহিত ছিলেন। তাঁর জ্ঞান নগরীর দ্বার আলী ইবনে আবি তালিবকে তিনি নিশ্চয়ই এসব তাত্ত্বিক বিষয়গুলো শিক্ষা দিয়েছিলেন। আলী তাঁর সময়ে এসব তত্ত্ব অতি সংক্ষিপ্তাকারে ব্যক্ত করেছে। এরপর আলীর শিষ্যগণ তাত্ত্বিক বিষয়গুলোর আলোচনায় ব্যাপৃত হতে লাগলো। কুরআনের বেশ কিছু সংখ্যক আয়াতের আধ্যাত্মিক ও ভাববাদী মর্মার্থ নিয়েই তাসাউফের সূচনা হয় এবং তাতে সুফি দর্শনের ধ্যান - ধারণা কতিপয় সাধকের মাধ্যমে তাদের ভক্তগণের তালিমের মধ্য দিয়ে ঐকে বেঁকে চলছিলো। অষ্টম শতকের শেষ দিকে জুনুনুন মিসরি ও জুনায়েদ বাগদাদি নামক দুজন সুফি সাধক এসব বিক্ষিপ্ত ভাবধারাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে সুবিন্যস্ত করেন (রশীদ ,পৃঃ ১০৬ - ১১১) । নবম শতকের প্রথম দিকে বায়েজিদ বোস্তামি ও মনসুর হাল্লাজ সুফি দর্শনের উৎকর্ষ সাধন করেন। বায়েজিদের ফানাতত্ত্ব (বিনাশন) ও হাল্লাজের আনালহকতত্ত্ব আল্লাহ্তত্ত্ব সম্পর্কে আলোড়ন সৃষ্টি করে।(সরকার ,পৃঃ৫ - ৭ ;আলম ,পৃঃ৪৮ - ৬৪) ।

এরপর শায়খুল আকবর ইবনুল আরাবী ওয়াহদাতুল ওজুদ তত্ত্ব ও লগসতত্ত্ব দ্বারা আল্লাহতত্ত্ব ও প্রজ্ঞাতত্ত্বের ব্যাপক যুক্তিতর্ক সম্বলিত আলোচনা তুলে ধরে মুসলিম চিন্তাবিদদের মাঝে প্রবল আলোড়নের সৃষ্টি করেন। তাঁর পূর্বে কোন মুসলিম চিন্তাবিদ লগসতত্ত্ব প্রকাশ করেনি । ইবনুল আরাবীর মতে ,সমগ্র অস্তিত্বশীল সত্তাসমূহের মূলসত্তা একটি - যা ধর্মীয় ভাষায় আল্লাহ। আল্লাহ্ একমাত্র পরম সত্তা। তাঁর মতবাদ সর্বেশ্বরবাদ বলে খ্যাত। তিনি বলেন ,এ বিশ্ব জগৎ আল্লাহ - সত্তাময় ,আল্লাহর নাম ও গুণের প্রকাশ এবং আল্লাহ ও বিশ্বজগৎ অভিন্ন (সরকার ,পৃঃ ৪৬ - ১২০) ,রশীদ ,পৃঃ ২৪২ - ২৪৮ ; আলম ,পৃঃ ৫০১ - ৫১৯ ; ইসলাম ,পৃঃ ১৮৯ - ১৯০) ।

অতঃপর জালালুদ্দিন রূমী প্রেমতত্ত্বের মাধ্যমে সৃফি দর্শনের উৎকর্ষ সাধন করে বলেন ,আল্লাহ সৃষ্টিতে লীন কি সৃষ্টি বহির্ভুত কি এ দুয়ের মধ্যাবস্থা এসব কিছুই নয়। এসব তত্ত্ব দিয়ে আল্লাহর পূর্ণ স্বরূপ জনা যায় না। এসব বিষয়ে বিচার - বুদ্ধি ও বিতর্কমূলক জ্ঞানের প্রয়োজন হয়। ফলে আল্লাহর পূর্ণ স্বরূপ খণ্ডভাবে প্রতিভাত হয়। তাই তিনি জ্ঞানের পথ পরিত্যাগ করে প্রেমের পথ ধরে পরম সত্তার সন্ধান লাভ করেছেন। তিনি বলেন প্রেম ছাড়া আল্লাহকে সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করা অসম্ভব। তাকে পরম প্রেমসত্তারূপেই দেখা যায় (সরকার ,পৃঃ ৩৫৫) । মুসলিম দার্শনিকগণের মধ্যে যারা আল্লাহতত্ত্ব ও সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে বিভিন্নভাবে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন তাদের মধ্যে আল - কিন্দি ,আল - ফারাবী ,ইবনে মাশকাওয়াহ ,ইবনে সিনা ,ইবনে আল -- হায়ছাম ,ইবনে হাজাম ,ইবনে বাজা ,ইবনে রুশদ ,ইমাম গাজ্জালী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

মধ্যযুগে এ উপমহাদেশে খাজা মুঈন উদ্দিন হাসান চিশতি প্রেমতত্ত্বের চূড়ান্ত পর্যায়ে তার 'বাকা ' (One with Allah ) তত্ত্ব প্রচার করেন। তার পরবর্তী সাধক কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকি ,ফরিদ উদ্দিন গঞ্জে শকর ,নিজামুদ্দিন মাহবুবে এলাহি একই তত্ত্ব প্রচার করেন। খাজা মুঈন উদ্দিন হাসান চিশতি এসব তত্ত্ব সর্ব সাধারণ্যে প্রকাশ না করে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্তদের নিকট প্রকাশ করার পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি বলেনঃ

খাল গুইয়ান্দাম মুঈন ইন রমজ বর মিম্বার মাগো ,

আকিন হাজারান ওয়ায়েজ ওয়া মিম্বার বেচুখত ।

অর্থ ? আমি মুঈন পৃথিবীকে বলে দিলাম ,মিম্বারে ওঠে এসব রহস্য প্রকাশ করোনা ,

কারণ এ আগুনেই হাজার হাজার বক্তা ও মিম্বার পুড়ে ছাই হয়ে গেছে (চিশতি ,দেওয়ান - ১৫) ।

বিংশ শতাব্দীর মুসলিম দার্শনিক আল্লামা মোহাম্মদ ইকবাল আল্লাহকে বর্ণনা করেছেন অনন্ত আধ্যাত্মিক পরম অহং (ego ) বলে। এ জগত তাঁর আংশিক অভিব্যক্তি মাত্র। তাঁর মতে আল্লাহ্ একাধারে পরমসত্তা ও পরম স্রষ্টা। আল্লাহ নিজেই পরিপূর্ণ অহং ও পরম আত্মসত্তা স্বরূপ (ইসলাম ,পৃঃ ১৮৬) । বাংলাদেশের দার্শনিক মোহাম্মদ বরকতুল্লাহর ভাষ্যে আল্লামা ইকবালের আল্লাহ্তত্ত্বের চমৎকার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তিনি বলেন ,মানুষ সসীম জ্ঞানের মধ্য দিয়ে অসীমে আত্মসম্প্রসারণের জন্য বড়ই ব্যাকুল। একই বিদ্যুৎপ্রবাহ যেভাবে নগরীর লক্ষ প্রদীপের ভেতর দিয়ে আপনাকে ব্যক্ত করে তেমনি একই মহাপ্রেরণা সমগ্র মানব সমষ্টির ভেতর দিয়ে এক দূর লক্ষ্যের পানে ছুটে চলছে। এই একই চেতনা সত্তা দেশ কালের প্রেক্ষিতে পরিগ্রহ করেছে বহু রূপ ও বিচিত্র প্রকাশ ভঙ্গিমা। একেই নবী - পয়গম্বর ও ভাবুক - সাধকেরা সনাক্ত করেছে। সব কিছুর আদি উৎস ও চূড়ান্ত লক্ষ্য বলে। (ইসলাম ,পৃঃ ১৮৬) ।

যা হোক ,আল্লাহতত্ত্ব নিয়ে দার্শনিকগণের তত্ত্বকথার পর্যালোচনা করা এখানকার বিষয়বস্তু নয় এবং এখানে তা সম্ভবও নয়। এখানে বিষয়টি এজন্য উপস্থাপন করা হয়েছে যে ,নাহাজ আল - বালাঘার বিভিন্ন খোৎবায় আমিরুল মোমেনিন আলী ইবনে আবি তালিব যেভাবে আল্লাহতত্ত্ব ব্যক্ত করেছেন তারই সারকথা বিভিন্ন আঙ্গিকে দার্শনিকগণ ব্যক্ত করেছেন ।

খোৎবা - ২

بَعْدَ انْصِرافِهِ مِن صِفِّينَ:

فلسفه الحمد

أَحْمَدُهُ اسْتِتْماماً لِنِعْمَتِهِ، وَ اسْتِسْلاماً لِعِزَّتِهِ، وَ اسْتِعْصاماً مِنْ مَعْصِيَتِهِ. وَ أَسْتَعِينُهُ فاقَهً الى كِفايَتِهِ؛ انَّهُ لا يَضِلُّ مَنْ هَداهُ، وَ لا يَئِلُ مَنْ عاداهُ، وَ لا يَفْتَقِرُ مَنْ كَفاهُ. فَانَّهُ أَرْجَحُ ما وُزِنَ، وَ أَفْضَلُ ما خُزِنَ. وَ أَشْهَدُ أَنْ لا الهَ الا اللّهُ وَحْدَهُ لا شَرِيكَ لَهُ، شَهادَهً مُمْتَحَنا اخْلاصُها، مُعْتَقَدا مُصاصُهِّا، نَتَمَسَّكُ بِها أَبَدا ما أبْقانا، وَنَدَّخِرُها لأَهاوِيلِ ما يَلْقانا، فِانَّها عَزِيمَهُ الايمانِ، وَ فاتِحَهُ الاحْسانِ وَ مَرْضاةُ الرّحمنِ، وَ مَدْحَرَةُ(مهلکة) الشِّيْطانِ.

خصئص رسول اللهصلى‌الله‌عليه‌وآله‌وسلم

وَ أَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدا عَبْدُهُ وَ رَسُولُهُ، أَرْسَلَهُ بِالدِّينِ الْمَشْهُورِ، وَ الْعِلْمِ المَأثُورِ وَ الْكِتابِ الْمَسْطُورِ، وَ النُّورِ السّاطِعِ، وَ الضِّيأِ اللامِعِ، وَ الْأَمْرِ الصّادِعِ، اِزاحَهً لِلشُّبُهاتِ، وَ احْتِجاجا بِالبَيِّناتِ، وَ تَحْذِيرا بِالْآياتِ، وَ تَخْوِيفا بِالمُثلاتِ

وصف الجاهلیّة

وَ النّاسُ فِى فِتَنٍ انْجَذَمَ(انحدم) فِيها حَبْلُ الدِّينِ، وَ تَزَعْزَعَتْ سَوارِى الْيَقينِ، وَ اخْتَلَفَ النَّجْرُ وَ تَشَتَّتَ الْأَمْرُ، وَ ضاقَ الْمَخْرَجُ وَ عَمِىَ الْمَصْدَرُ، فَالْهُدى خامِلٌ، وَ الْعَمى شامِلٌ. عُصِىَ الرَّحْمنُ، وَ نُصِرَ الشَّيْطانُ، وَ خُذِلَ الْإ يمانُ، فَانْهارَتْ دَعائِمُهُ، وَ تَنَكَّرَتْ مَعالِمُهُ،(اعلامه) وَ دَرَسَتْ سُبُلُهُ، وَ عَفَتْ شُرُكُهُ. أَطاعُوا الشَّيْطانَ فسَلكُوا مَسالِكَهُ، وَ وَرَدُوا مَناهِلَهُ، بِهِمْ سارَتْ أَعْلامُهُ، وَ قامَ لِواؤُهُ فِى فِتَنٍ داسَتْهُمْ بِأَخْفافِها، وَ وَطِئَتْهُمْ بِأَظْلافِها، وَ قامَتْ عَلى سَنابِكِها، فَهُمْ فِيها تائِهُونَ حائِرونَ جاهِلُونَ مَفْتُونُونَ، فِى خَيْرِ دارٍ، وَ شَرِّ جِيرانٍ. نَوْمُهُمْ سُهُودٌ(سهاد) ، وَ كُحْلُهُمْ دُمُوعٌ، بِأَرْضٍ عالِمُها مُلْجَمٌ، وَ جاهِلُها مُكْرَمٌ.

فضائل عترة النَّبِىَصلى‌الله‌عليه‌وآله‌وسلم

هُمْ مَوْضِعُ سِرِّهِ، وَ لَجَأُ أَمّرِهِ، وَ عَيْبَهُ عِلْمِهِ، وَ مَوئِلُ حُكْمِهِ، وَ كُهُوفُ كُتُبِهِ، وَ جِبالُ دِينِه، بِهِمْ أَقامَ انْحِنأَ ظَهْرِهِ، وَ أَذْهَبَ ارْتِعادَ فَرائِصِهِ.

أعمال الْمُنحرفین

زَرَعُوا الْفُجُورَ، وَ سَقَوْهُ الْغُرُورَ، وَ حَصَدُوا الثُّبُورَ.

لا يُقاسُ بِآلِ مُحَمَّدٍصلى‌الله‌عليه‌وآله‌وسلم مَنْ هذِهِ الامَّهِ أَحَدٌ، وَ لا يُسوَّى بِهِمْ مَنْ جَرَتْ نِعْمَتُهُمْ عَلَيْهِ أَبَداً. هُمْ أَساسُ الدِّينِ، وَ عِمادُ الْيَقينِ. إلَيْهِمْ يَفِى ءُ الْغالِى، وَ بِهِمْ يِلْحَقُ التّالِى. وَ لَهُمْ خَصائِصُ حَقِّ الْوِلايَةِ، وَ فِيهِمْ الْوَصِيَّةُ وَ الْوِراثَةُ؛ الآنَ إذْرَجَعَ الْحَقُّ إلَى أهلِهِ، وَ نُقِلَ الى مُنتَقَلِهِ!

সিফফিন থেকে ফেরার পর এ খোৎবা দিয়েছিলেন।

আল্লাহর প্রশংসা

আমি আল্লাহর প্রশংসা করি তাঁর পরিপূর্ণ নেয়ামতের আশায় ,তার ইজ্জতের প্রতি আত্মসমর্পণের জন্য এবং পাপ থেকে নিরাপত্তা পাওয়ার আশায়। আমি তার সাহায্যের জন্য মিনতি করি যেহেতু প্রয়োজনে তার সাহায্যই যথেষ্ট ! তিনি যাকে হেদায়েত প্রদান করেন। সে কখনো বিপথগামী হয় না ; আর যার প্রতি তিনি বিরূপ হন তার কোন প্রতিরক্ষা নেই। যাকে তিনি দয়া করেন সে সকল প্রয়োজনের উর্দ্ধে থাকে। তাঁর প্রশংসা সব কিছু থেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং সকল সম্পদ থেকে মূল্যবান।

নবী (সা .)এর বৈশিষ্ট্য

আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে ,এক আল্লাহ্ ব্যতীত আর কোন মা ’ বুদ নেই। তাঁর কোন সাদৃশ্য নেই। এ সাক্ষ্য এমন এক ব্যক্তির যার এখলাছ পরীক্ষিত এবং এর মূল উপাদান আমাদের ইমান যা বিশ্বস্ত (মো ’ তাকাদ) হয়েছে। যত দিন তিনি আমাদের জীবিত রাখেন। ততদিন আমরা এ বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে রাখবো এবং কঠোর দুঃখ - দুর্দশা দ্বারা আমরা আক্রান্ত হলে তা মোকাবেলা করার জন্য এ বিশ্বাস পুঞ্জিভূত করে রাখবো। কারণ এটা ইমানের মূল ভিত্তি এবং কল্যাণকর কর্ম ও ঐশী সন্তুষ্টির প্রথম সোপান। এটা শয়তানকে দূরে সরিয়ে রাখার উপায়।

আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে ,মুহাম্মদ (সা.) তার বান্দা ও রাসূল। অতি বিশিষ্ট দ্বীন ,মো ’ জেজা ,সংরক্ষিত দলিল ,দীপ্তিশীল নূর ,জ্বলজ্বলে ঔজ্জ্বল্য ,সন্দেহ - নাশক চুড়ান্ত নির্দেশাবলী ,বিদ্যমান সুস্পষ্ট প্রমাণাদি ,আল্লাহর আয়াতসমূহ দ্বারা ভীতি প্রদর্শন ও পাপের শাস্তির সতর্কাদেশসহ আল্লাহ তাকে প্রেরণ করেছেন। সে সময়ে মানুষ ছিল ফেতনা - ফ্যাসাদে লিপ্ত এবং তাতে দ্বীনের রাজ্জু ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল ,ইয়াকিনের স্তম্ভসমূহ আলোড়িত হয়ে পড়েছিল ,নৈতিক মূল্যবোধ অন্ধকারের অতল তলে তলিয়ে গিয়েছিল ,নিয়ম - শৃংখলা ওলট - পালট হয়ে পড়েছিল ,প্রারম্ভ ছিল ক্ষীণ ,পথ ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন ,হেদায়েত ছিল অজানা এবং অজ্ঞতা (জাহেলিয়াত) ছিল বিরাজমান।

জাহেলী যুগের পরিচয়

মানুষ আল্লাহর অবাধ্য হয়ে শয়তানের সমর্থক হয়ে পড়েছিল এবং ইমান পরিত্যক্ত বিষয় ছিল। ফলে দ্বীনের স্তম্ভ ধ্বসে পড়েছিল। ইমানের সামান্য চিহ্নও দেখা যাচ্ছিলো না ; এর সকল পথ বিনষ্ট হয়ে পড়েছিল এবং প্রকাশ্য রাস্তাসমূহ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছিল। মানুষ আল্লাহর নাফরমানি করে শয়তানের অনুগত হয়ে পড়েছিল এবং শয়তানের পথ অনুসরণ করছিলো। শয়তানের জলাধার থেকে পানি সংগ্রহে মানুষ আগ্রহান্বিত ছিল। এসব মানুষের মাধ্যমে শয়তানের বিজয় পতাকা উড্ডিয়মান হয়েছিল এবং এরাই মানুষকে ফেতনা - ফ্যাসাদের দিকে ঠেলে দিয়েছিলো। ফলে মানুষ এদের খুরের নিচে দলিত হয়েছিল এবং এরা মানুষের ওপর দাম্ভিক পদভরে দাঁড়িয়েছিলো। অনৈতিকতা পায়ের আঙ্গুলে ভর করে দাঁড়িয়েছিলো। মানুষ সম্পূর্ণরূপে পথভ্রষ্ট ,জটিল ,অজ্ঞ ও বিপথগামী হয়ে পড়েছিল ; যেন তারা কল্যাণকর ঘরের (কাবা) । কুপ্রতিবেশী (কুরাইশ) । নিদ্রার পরিবর্তে তারা ছিল জাগ্রত এবং তাদের চোখে সুর্মার পরিবর্তে ছিল পানি। তারা এমন এক সমাজ ব্যবস্থায় ছিল যেখানে জ্ঞানীগণ ছিল লাগাম পরিহিত এবং অজ্ঞরা ছিল সম্মানিত ।

আহলে বাইতের মর্যাদা

জেনে রাখো - রাসূলের আহলুল বাইত হলো আল্লাহর গুপ্ত বিষয়ের (সির্র) ধারক ,আল্লাহ সম্পর্কীয় জ্ঞানের মূলাধার ,প্রজ্ঞার কেন্দ্রবিন্দু ,আল্লাহর কিতাবের উপত্যকা ও তাঁর দ্বীনের পর্বত। তাদের মাধ্যমেই আল্লাহ তার দ্বীনের বক্রপিঠ সোজা করলেন এবং দ্বীনের অঙ্গ - প্রত্যঙ্গের কম্পমান অবস্থা দূরীভূত করলেন।

দুষ্কৃতকারীদের বৈশিষ্ট্য

মনে রেখো - মোনাফেকগণ পাপ কর্ম ও অধার্মিকতা বপন করেছে এবং তাতে প্রবঞ্চনারূপ পানি সিঞ্চন করেছে ; ফলতঃ নিজেদের ধ্বংস রূপ ফসল কর্তন করেছে। ইসলামি উম্মাহর কাউকে আহলুল বাইতের সমকক্ষ হিসাবে গ্রহণ করা যাবে না। কেউ তাদের অনুগ্রহভাজন হয়ে থাকলেও তাকে তাদের সমতুল্য মনে করা যাবে না। তাঁরা হলেন দ্বীনের ভিত্তিমূল ও ইমানের স্তম্ভ। তাদেরকে কেউ ডিঙ্গিয়ে যেতে চাইলে আবার ফিরে আসতে হয় তাদের কাছে। আবার যারা পশ্চাতে পড়ে থাকে তারা তাদেরকে অনুসরণ করতে হয়। মূলত তাঁরা রাসূলের বেলায়েতের অধিকারের প্রধান বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। রাসূলের আমানত ও উত্তরাধিকার তাঁদেরই অনুকূলে। কাজেই ন্যায় ও সত্যের অনুসারীগণকে তাদের দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে।

__________________

১। রাসূলের (সা.) আহলুল বাইত সম্পর্কে আমিরুল মোমেনিন বলেন যে ,বিশ্বের কোন ব্যক্তিকে আহলুল বাইতের সমকক্ষতায় আনা যাবে না এবং মহত্ত্বে তাদের সমতুল্য কাউকে মনে করা যাবে না। কারণ এ বিশ্ব তাদের অনুগ্রহে ভরপুর। তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত হেদায়েত ও দিক নির্দেশনার মাধ্যমেই বিশ্ব চিরন্তন নেয়ামত পেতে পারে। তারা হলেন দ্বিনের ভিত্তি ও দু দেয়ালের সংযোগ স্থাপক প্রস্তর। তাঁরা হলেন দ্বিনের বাঁচার জন্য পুষ্টিকর খাদ্য স্বরূপ। তারা ইমান ও প্রজ্ঞার এমন শক্তিধর স্তম্ভ যে ,সংশয় ও অজ্ঞতার যে কোন ঝড় ফিরিয়ে দিতে পারেন। তাঁরা অতিবর্তী ও পশ্চাদবর্তী পথ সমূহের মধ্যে এমন এক মধ্যপথ যে পথে না আসা পর্যন্ত কেউ ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। বেলায়েত ও নেতৃত্রে অধিকারের বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্ব তাদের আছে। ফলে উম্মাহর অভিভাবকত্ব ও পৃষ্ঠপোষকতা করার অধিকার আর কারো নেই। এ কারণেই রাসূল (সা.) তাদেরকে তাঁর উত্তরাধিকারী ও তার বেলায়েতের অধিকারী বলে ঘোষণা করেছিলেন। ইবনে আবিল হাদীদ লেখেছেন যে ,উত্তরাধিকার বুঝায় না ; যদিও শিয়াগণ এরকম ব্যাখ্যাই করে থাকেন। এ উত্তরাধিকার দ্বারা রাসূলের শিক্ষার উত্তরাধিকার বুঝায়। হাদীদের মতো গ্রহণ করলেও রাসূলের শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনের প্রয়োজনীয়তার কারণে খেলাফতের দায়িত্ব অন্য কারো ওপর বর্তায় না। কারণ শিক্ষা প্রদান খেলাফতের অত্যাবশ্যকীয় শর্ত। রাসূলের (সা.) খলিফার প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ন্যায় বিধান করা ,ধর্মীয় আইনে সমস্যাদির সমাধান করা ,জটিল বিষয়ের ব্যাখ্যা প্রদান ও ধর্মীয় দণ্ডসমূহের প্রয়োগ করা। যদি রাসূলের ডেপুটি থেকে এ সমস্ত বিষয় সরিয়ে নেয়া হয় তবে তার অবস্থান রাজ্য শাসকের (দুনিয়াদার শাসক) পর্যায়ে নেমে আসবে। ধর্মীয় কর্তৃত্বের কিলক হিসাবে তাকে আর গ্রহণ করা যাবে না। সুতরাং হাদীদের ব্যাখ্যা ভিত্তিহীন। রাসূলের (সা.) আছিয়াত খেলাফত ব্যতীত অন্য কিছুর জন্য নয়। বেলায়েত দ্বারা সম্পদ ও জ্ঞানের উত্তরাধিকার বুঝায় না - সঠিক নেতৃত্বকে বুঝায় ; যা আহলুল বাইত হওয়ার কারণে আল্লাহ নিজেই গুণাবলীর পরিপূর্ণতা দান করেছেন।

খোৎবা - ১

يَذْكُرُ فِيهَا أبْتِدأ خَلْقِ ألسَّمأ وَ الاَرْضِ وَ خَلْقِ آدَمَ عليه‌السلام

الْحَمْدُ لِلَّه الَّذِي لَا يَبْلُغُ مِدْحَتَه الْقَائِلُونَ، ولَا يُحْصِي نَعْمَاءَه الْعَادُّونَ، ولَا يُؤَدِّي حَقَّه الْمُجْتَهِدُونَ، الَّذِي لَا يُدْرِكُه بُعْدُ الْهِمَمِ، ولَا يَنَالُه غَوْصُ الْفِطَنِ، الَّذِي لَيْسَ لِصِفَتِه حَدٌّ مَحْدُودٌ، ولَا نَعْتٌ مَوْجُودٌ ولَا وَقْتٌ مَعْدُودٌ، ولَا أَجَلٌ مَمْدُودٌ، فَطَرَ الْخَلَائِقَ بِقُدْرَتِه، ونَشَرَ الرِّيَاحَ بِرَحْمَتِه، ووَتَّدَ بِالصُّخُورِ مَيَدَانَ أَرْضِه.

أَوَّلُ الدِّينِ مَعْرِفَتُه وكَمَالُ مَعْرِفَتِه التَّصْدِيقُ بِه، وكَمَالُ التَّصْدِيقِ بِه تَوْحِيدُه، وكَمَالُ تَوْحِيدِه الإِخْلَاصُ لَه، وكَمَالُ الإِخْلَاصِ لَه نَفْيُ الصِّفَاتِ عَنْه، لِشَهَادَةِ كُلِّ صِفَةٍ أَنَّهَا غَيْرُ الْمَوْصُوفِ، وشَهَادَةِ كُلِّ مَوْصُوفٍ أَنَّه غَيْرُ الصِّفَةِ، فَمَنْ وَصَفَ اللَّه سُبْحَانَه فَقَدْ قَرَنَه، ومَنْ قَرَنَه فَقَدْ ثَنَّاه ومَنْ ثَنَّاه فَقَدْ جَزَّأَه، ومَنْ جَزَّأَه فَقَدْ جَهِلَه ومَنْ جَهِلَه فَقَدْ أَشَارَ إِلَيْه، ومَنْ أَشَارَ إِلَيْه فَقَدْ حَدَّه ومَنْ حَدَّه فَقَدْ عَدَّه، ومَنْ قَالَ فِيمَ فَقَدْ ضَمَّنَه، ومَنْ قَالَ عَلَا مَ فَقَدْ أَخْلَى مِنْه: كَائِنٌ لَا عَنْ حَدَثٍ مَوْجُودٌ لَا عَنْ عَدَمٍ، مَعَ كُلِّ شَيْءٍ لَا بِمُقَارَنَةٍ وغَيْرُ كُلِّ شَيْءٍ لَا بِمُزَايَلَةٍ ، فَاعِلٌ لَا بِمَعْنَى الْحَرَكَاتِ والآلَةِ، بَصِيرٌ إِذْ لَا مَنْظُورَ إِلَيْه مِنْ خَلْقِه، مُتَوَحِّدٌ إِذْ لَا سَكَنَ يَسْتَأْنِسُ بِه ولَا يَسْتَوْحِشُ لِفَقْدِه.

আকাশ , পৃথিবী ও আদম সৃষ্টি সম্পর্কে

প্রতিষ্ঠিত প্রশংসা আল্লাহর। তাঁর গুণরাজী কোন বর্ণনাকারী বর্ণনা করে শেষ করতে পারে না। তার নেয়ামতসমূহ গণনাকারীগণ গুনে শেষ করতে পারে না। প্রচেষ্টাকারীগণ তাঁর নেয়ামতের হক আদায় করতে পারে না। আমাদের সমুদয় প্রচেষ্টা ও জ্ঞান দ্বারা তাঁর পরিপূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করা সম্ভব নয় এবং আমাদের সমগ্র বোধশক্তি দ্বারা তার মাহাত্ম্য অনুভব করা সম্ভব নয়। তাঁর সিফাত বর্ণনার কোন পরিসীমা নির্ধারিত নেই এবং সেজন্য কোন লেখা বা বক্তব্য ,কোন সময় বা স্থিতিকাল নির্দিষ্ট করা হয়নি । তিনি নিজ কুদরতে সৃষ্টিকে অস্তিত্বশীল করেছেন ,আপন করুণায় বাতাসকে প্রবাহিত করেছেন এবং শিলাময় পাহাড় দ্বারা কম্পমান পৃথিবীকে সুদৃঢ় করেছেন।

আল্লাহর মা রেফাতেই দ্বীনের ভিত্তি । এ মা রেফাতের পরিপূর্ণতা আসে তাকে সত্য বলে সাক্ষ্য দেয়ায় ; সাক্ষ্যের পরিপূর্ণত হয় তাঁর ঐকল্যের বিশ্বাসে ; বিশ্বাসের পরিপূর্ণত হয় তাঁকে পরম পবিত্ররূপে নিরীক্ষণ করার জন্য আমল করায় ; আমলের পরিপূর্ণতা অর্জিত হয় তাঁর প্রতি কোন সিফাত ( গুণ ) আরোপ না করায়। কারণ কোন কিছুতে গুণ আরোপিত হলে এটাই প্রমাণিত হয় যে ,আরোপিত বিষয় থেকে গুণ পৃথক এবং যার ওপর গুণ আরোপিত হয় সে নিজে সেই গুণ থেকে পৃথক। যারা আল্লাহতে সত্তা বহির্ভূত কোন সিফাত বা গুণ আরোপ করে তারা তাঁর সদৃশতার স্বীকৃতি দেয় ; যারা তাঁর সদৃশতা স্বীকার করে তারা দ্বৈতবাদের স্বীকৃতি দেয় ; যারা তাঁর দ্বৈতের স্বীকৃতি দেয় তারা তাঁকে খণ্ডভাবে দেখে ; যারা তাকে খণ্ডভাবে দেখে তারা তাঁকে ভুল বুঝে ; যারা তাঁকে ভুল বুঝে তারা তাঁকে চিনতে অক্ষম ; যারা তাকে চিনতে অক্ষম তারা তার ত্রুটি স্বীকার করে ; যারা তার ত্রুটি স্বীকার করে তারা তাকে সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ করে।

যদি কেউ বলে তিনি কি ,সে জেনে রাখুক ,তিনি সবকিছু ধারণ করে আছেন ; এবং যদি কেউ বলে তিনি কিসের ওপর আছেন ,সে জেনে নাও ,তিনি নির্দিষ্ট কোন কিছুর ওপর নেই। যদি কেউ তাঁর অবস্থিতি নির্দিষ্ট কোন স্থানে মনে করে তবে সে কিছু কিছু স্থানকে আল্লাহবিহীন মনে করলো। তিনি ওই সত্তা যাঁর আগমন সৃষ্টি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটে নি। তিনি অস্তিত্বশীল ,কিন্তু অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ত্বে আসেন নি। তিনি সব কিছুতেই আছেন ,কিন্তু কোন প্রকার ভৌত নৈকট্য দ্বারা নয়। তিনি সব কিছু থেকে ভিন্ন ,কিন্তু বস্তুগত দ্বান্দ্বিকতা ও বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে নয়। তিনি কর্ম সম্পাদন করেন। কিন্তু সঞ্চলন ও হাতিয়ারের মাধ্যমে নয়। তিনি তখনও দেখেন যখন তাঁর সৃষ্টির মধ্যে কেউ দেখার মতো থাকে না। তিনিই একমাত্র একক ,কেন না। এমন কেউ নেই যার সাথে তিনি সঙ্গ রাখতে পারেন অথবা যার অনুপস্থিতি তিনি অনুভব করেন।

خلق العالم

أَنْشَأَ الْخَلْقَ إِنْشَاءً وابْتَدَأَه ابْتِدَاءً، بِلَا رَوِيَّةٍ أَجَالَهَا ولَا تَجْرِبَةٍ اسْتَفَادَهَا، ولَا حَرَكَةٍ أَحْدَثَهَا ولَا هَمَامَةِ نَفْسٍ اضْطَرَبَ فِيهَا، أَحَالَ الأَشْيَاءَ لأَوْقَاتِهَا ولأَمَ بَيْنَ مُخْتَلِفَاتِهَا، وغَرَّزَ غَرَائِزَهَا وأَلْزَمَهَا أَشْبَاحَهَا، عَالِماً بِهَا قَبْلَ ابْتِدَائِهَا، مُحِيطاً بِحُدُودِهَا وانْتِهَائِهَا عَارِفاً بِقَرَائِنِهَا وأَحْنَائِهَا : ثُمَّ أَنْشَأَ سُبْحَانَه فَتْقَ الأَجْوَاءِ، وشَقَّ الأَرْجَاءِ وسَكَائِكَ الْهَوَاءِ، فَأَجْرَى فِيهَا مَاءً مُتَلَاطِماً تَيَّارُه ، مُتَرَاكِماً زَخَّارُه حَمَلَه عَلَى مَتْنِ الرِّيحِ الْعَاصِفَةِ، والزَّعْزَعِ الْقَاصِفَةِ فَأَمَرَهَا بِرَدِّه، وسَلَّطَهَا عَلَى شَدِّه وقَرَنَهَا إِلَى حَدِّه، الْهَوَاءُ مِنْ تَحْتِهَا فَتِيقٌ والْمَاءُ مِنْ فَوْقِهَا دَفِيقٌ ، ثُمَّ أَنْشَأَ سُبْحَانَه رِيحاً اعْتَقَمَ مَهَبَّهَا ، وأَدَامَ مُرَبَّهَا وأَعْصَفَ مَجْرَاهَا، وأَبْعَدَ مَنْشَأَهَا فَأَمَرَهَا بِتَصْفِيقِ الْمَاءِ الزَّخَّارِ، وإِثَارَةِ مَوْجِ الْبِحَارِ فَمَخَضَتْه مَخْضَ السِّقَاءِ، وعَصَفَتْ بِه عَصْفَهَا بِالْفَضَاءِ، تَرُدُّ أَوَّلَه إِلَى آخِرِه وسَاجِيَه إِلَى مَائِرِه حَتَّى عَبَّ عُبَابُه ورَمَى بِالزَّبَدِ رُكَامُه ، فَرَفَعَه فِي هَوَاءٍ مُنْفَتِقٍ وجَوٍّ مُنْفَهِقٍ، فَسَوَّى مِنْه سَبْعَ سَمَوَاتٍ، جَعَلَ سُفْلَاهُنَّ مَوْجاً مَكْفُوفاً ، وعُلْيَاهُنَّ سَقْفاً مَحْفُوظاً وسَمْكاً مَرْفُوعاً، بِغَيْرِ عَمَدٍ يَدْعَمُهَا ولَا دِسَارٍ يَنْظِمُهَا ثُمَّ زَيَّنَهَا بِزِينَةِ الْكَوَاكِبِ وضِيَاءِ الثَّوَاقِبِ ، وأَجْرَى فِيهَا سِرَاجاً مُسْتَطِيراً وقَمَراً مُنِيراً، فِي فَلَكٍ دَائِرٍ وسَقْفٍ سَائِرٍ ورَقِيمٍ مَائِرٍ.

নিখিল বিশ্ব সৃষ্টি

তিনি সৃষ্টির সূত্রপাত করলেন একান্তই মৌলিকভাবে- কোন প্রকার প্রতিরূপ ব্যতীত ,কোন প্রকার পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ ব্যতীত ,কোনরূপ বিচলন ব্যতীত এবং ফলাফলের জন্য কোনরূপ ব্যাকুলতা ব্যতীত। সব কিছুকে তিনি নির্দিষ্ট সময় দিলেন ,তাদের বৈচিত্র্যে সামঞ্জস্য বিধান করলেন এবং তাদের বৈশিষ্ট্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করলেন। সৃষ্টির পূর্বেই তিনি সব কিছুর প্রবণতা ,জটিলতা ,সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন।

অতঃপর পবিত্র সত্তা অনন্ত শূন্য সৃষ্টি করলেন এবং প্রসারিত করলেন নভোমণ্ডল ও বায়ু স্তর। তিনি উচ্ছল তরঙ্গবিক্ষুব্ধ পানি প্রবাহিত করলেন। তরঙ্গগুলো এত ঝঞ্জা - বিক্ষুব্ধ ছিল যে ,একটা আরেকটার ওপর দিয়ে গড়িয়ে যেতো। তরঙ্গাঘাতের সাথে তিনি প্রবল বায়ুপ্রবাহ যুক্ত করলেন এবং প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের প্রকম্পন সৃষ্টি করলেন। পানির বাষ্পীয় অবস্থাকে তিনি বৃষ্টিরূপে পতিত হবার নির্দেশ দিলেন এবং বৃষ্টির প্রাবল্যের ওপর বায়ুকে নিয়ন্ত্রণাধিকার দিলেন। মেঘের নিচে বাতাস প্রবাহিত হতে লাগলো এবং পানি বাতাসের ওপর প্রচণ্ড বেগে প্রবাহিত হতে লাগলো।

অতঃপর সর্বশক্তিমান আল্লাহ বাতাস সৃষ্টি করে উহাকে নিশ্চল করলেন ,উহার অবস্থান স্থায়ী করলেন ,তার গতিতে প্রচণ্ডতা দিলেন এবং তাকে সর্বত্র ছড়িয়ে দিলেন। তারপর তিনি বাতাসকে আদেশ করলেন গভীর পানিকে গতিশীল ও চঞ্চল এবং সমুদ্র তরঙ্গকে তীব্রতর করার জন্য। ফলে বাতাস দধি তৈরির মতো পানিকে মন্থন করতে লাগলো এবং এমন জোরে মহাশূন্যে প্রক্ষেপ করলো যাতে সম্মুখ পশ্চাতে ও পশ্চাত সম্মুখে চলে গেলো। এতে ওপরের স্তরে বিপুল ফেনপুঞ্জ সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত স্থিরকে অস্থির করে রাখলো। সর্বশক্তিমান তখন ফেনপুঞ্জকে অনন্ত শূন্যে উত্তোলন করে তা থেকে সপ্ত আকাশ সৃষ্টি করলেন যার সর্বনিম্ন স্তর স্ফীত অথচ অনড় এবং ওপরের স্তর আচ্ছাদনের মতো বিদ্যমান যেন এক সুউচ্চ বৃহৎ অট্টালিকা যাতে কোন স্তম্ভ নেই অথবা একত্রে জোড়া লাগাবার পেরেক নেই। তখন তিনি ওপরের স্তরকে তারকা ও উজ্জ্বল উল্কা দিয়ে সুশোভিত করলেন এবং আবর্তিত আকাশ ,চলমান আচ্ছাদন ও ঘূর্ণায়মান নভোমণ্ডলে তিনি দেদীপ্যমান সূর্য ও দীপ্তিময় চন্দ্রকে স্থাপন করলেন।

خلق الملائكة

ثُمَّ فَتَقَ مَا بَيْنَ السَّمَوَاتِ الْعُلَا، فَمَلأَهُنَّ أَطْوَاراً مِنْ مَلَائِكَتِه، مِنْهُمْ سُجُودٌ لَا يَرْكَعُونَ ورُكُوعٌ لَا يَنْتَصِبُونَ، وصَافُّونَ لَا يَتَزَايَلُونَ ومُسَبِّحُونَ لَا يَسْأَمُونَ، لَا يَغْشَاهُمْ نَوْمُ الْعُيُونِ ولَا سَهْوُ الْعُقُولِ، ولَا فَتْرَةُ الأَبْدَانِ ولَا غَفْلَةُ النِّسْيَانِ، ومِنْهُمْ أُمَنَاءُ عَلَى وَحْيِه وأَلْسِنَةٌ إِلَى رُسُلِه، ومُخْتَلِفُونَ بِقَضَائِه وأَمْرِه، ومِنْهُمُ الْحَفَظَةُ لِعِبَادِه والسَّدَنَةُ لأَبْوَابِ جِنَانِه، ومِنْهُمُ الثَّابِتَةُ فِي الأَرَضِينَ السُّفْلَى أَقْدَامُهُمْ، والْمَارِقَةُ مِنَ السَّمَاءِ الْعُلْيَا أَعْنَاقُهُمْ، والْخَارِجَةُ مِنَ الأَقْطَارِ أَرْكَانُهُمْ، والْمُنَاسِبَةُ لِقَوَائِمِ الْعَرْشِ أَكْتَافُهُمْ، نَاكِسَةٌ دُونَه أَبْصَارُهُمْ مُتَلَفِّعُونَ تَحْتَه بِأَجْنِحَتِهِمْ، مَضْرُوبَةٌ بَيْنَهُمْ وبَيْنَ مَنْ دُونَهُمْ حُجُبُ الْعِزَّةِ، وأَسْتَارُ الْقُدْرَةِ، لَا يَتَوَهَّمُونَ رَبَّهُمْ بِالتَّصْوِيرِ، ولَا يُجْرُونَ عَلَيْه صِفَاتِ الْمَصْنُوعِينَ، ولَا يَحُدُّونَه بِالأَمَاكِنِ ولَا يُشِيرُونَ إِلَيْه بِالنَّظَائِرِ.

ফেরেশতা সৃষ্টি

তৎপর পরম বিধাতা বিভিন্ন আকাশের মধ্যে উন্মুক্ততা বিধান করলেন এবং বিভিন্ন শ্রেণির ফেরেশতা দ্বারা সেই উন্মুক্ততা পরিপূর্ণ করলেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সেজদাবনত ,যারা কখনো রুকু করে না ; কেউ কেউ রুকু অবস্থায় ,যারা কখনো দাঁড়ায় না এবং কেউ কেউ সুবিন্যস্তভাবে অবস্থান করছে ,যারা কখনো তাদের স্থান পরিত্যাগ করে না। অন্যরা সর্বক্ষণ আল্লাহর তসবিহু পাঠ করে এবং তারা ক্লান্ত হয় না। নয়নের নিদ্রা ,বুদ্ধির বিভ্রান্তি ,শরীরের অবসন্নতা অথবা বিস্মৃতির প্রভাব এদেরকে স্পর্শও করে না।

ফেরেশতাদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁর বিশ্বস্ত অহিবাহক ,যারা নবীদের কাছে আল্লাহর মুখপাত্র হিসাবে কাজ করে এবং তাঁর আদেশ নির্দেশকে সর্বত্র পৌছে দেয়। কেউ কেউ আল্লাহর সৃষ্টি রক্ষার কাজে নিযুক্ত। আবার কেউ কেউ বেহেশতের দরজায় প্রহরী হিসাবে নিযুক্ত। আরো অনেক আছে যাদের পদদ্বয় ভূ - মণ্ডলের সর্বনিম্ন স্তরে স্থিরভাবে স্থাপিত এবং তাদের শিরোদেশ আকাশের সর্বোচ্চ স্তরে প্রসারিত এবং তাদের বাহু চতুর্দিকে সম্প্রসারিত। তাদের স্কন্ধ আরশের স্তম্ভের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ; তাদের চোখে আরাশের প্রতি নিবদ্ধ এবং তাদের পাখা আরাশের নিচে বিস্তৃত। তাদের নিজেদের মধ্যে এবং অন্য সকল কিছুর মধ্যে সম্মানিত পর্দা ও কুদরতের আবরণ সৃষ্টি করা হয়েছে। তারা তাদের মহান স্রষ্টাকে আকৃতির মাধ্যমে ধারণা করে না। তারা স্রষ্টার প্রতি সৃষ্টির কোন গুণারোপ করে না ,তাঁকে কোন নির্দিষ্ট স্থানে সীমাবদ্ধ করে না এবং উপমার মাধ্যমে তার প্রতি ইঙ্গিত করে না ।

خلق آدمعليه‌السلام

ثُمَّ جَمَعَ سُبْحَانَه مِنْ حَزْنِ الأَرْضِ وسَهْلِهَا، وعَذْبِهَا وسَبَخِهَا ، تُرْبَةً سَنَّهَا بِالْمَاءِ حَتَّى خَلَصَتْ، ولَاطَهَا بِالْبَلَّةِ حَتَّى لَزَبَتْ ، فَجَبَلَ مِنْهَا صُورَةً ذَاتَ أَحْنَاءٍ ووُصُولٍ وأَعْضَاءٍ، وفُصُولٍ أَجْمَدَهَا حَتَّى اسْتَمْسَكَتْ، وأَصْلَدَهَا حَتَّى صَلْصَلَتْ لِوَقْتٍ مَعْدُودٍ وأَمَدٍ مَعْلُومٍ، ثُمَّ نَفَخَ فِيهَا مِنْ رُوحِه، فَمَثُلَتْ إِنْسَاناً ذَا أَذْهَانٍ يُجِيلُهَا، وفِكَرٍ يَتَصَرَّفُ بِهَا وجَوَارِحَ يَخْتَدِمُهَا ، وأَدَوَاتٍ يُقَلِّبُهَا ومَعْرِفَةٍ يَفْرُقُ بِهَا بَيْنَ الْحَقِّ والْبَاطِلِ، والأَذْوَاقِ والْمَشَامِّ والأَلْوَانِ والأَجْنَاسِ، مَعْجُوناً بِطِينَةِ الأَلْوَانِ الْمُخْتَلِفَةِ، والأَشْبَاه الْمُؤْتَلِفَةِ والأَضْدَادِ الْمُتَعَادِيَةِ، والأَخْلَاطِ الْمُتَبَايِنَةِ مِنَ الْحَرِّ والْبَرْدِ، والْبَلَّةِ والْجُمُودِ، واسْتَأْدَى اللَّه سُبْحَانَه الْمَلَائِكَةَ وَدِيعَتَه لَدَيْهِمْ، وعَهْدَ وَصِيَّتِه إِلَيْهِمْ فِي الإِذْعَانِ بِالسُّجُودِ لَه، والْخُنُوعِ لِتَكْرِمَتِه، فَقَالَ سُبْحَانَه:( اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ اعْتَرَتْه الْحَمِيَّةُ، وغَلَبَتْ عَلَيْه الشِّقْوَةُ، وتَعَزَّزَ بِخِلْقَةِ النَّارِ واسْتَوْهَنَ خَلْقَ الصَّلْصَالِ، فَأَعْطَاه اللَّه النَّظِرَةَ اسْتِحْقَاقاً لِلسُّخْطَةِ، واسْتِتْمَاماً لِلْبَلِيَّةِ وإِنْجَازاً لِلْعِدَةِ، فَقَالَ:( فَإِنَّكَ مِنَ الْمُنْظَرِينَ إِلى يَوْمِ الْوَقْتِ الْمَعْلُومِ ) .

ثُمَّ أَسْكَنَ سُبْحَانَه آدَمَ دَاراً أَرْغَدَ فِيهَا، عَيْشَه وآمَنَ فِيهَا مَحَلَّتَه وحَذَّرَه إِبْلِيسَ وعَدَاوَتَه، فَاغْتَرَّه عَدُوُّه نَفَاسَةً عَلَيْه بِدَارِ الْمُقَامِ، ومُرَافَقَةِ الأَبْرَارِ، فَبَاعَ الْيَقِينَ بِشَكِّه والْعَزِيمَةَ بِوَهْنِه، واسْتَبْدَلَ بِالْجَذَلِ وَجَلًا وبِالِاغْتِرَارِ نَدَماً، ثُمَّ بَسَطَ اللَّه سُبْحَانَه لَه فِي تَوْبَتِه، ولَقَّاه كَلِمَةَ رَحْمَتِه ووَعَدَه الْمَرَدَّ إِلَى جَنَّتِه، وأَهْبَطَه إِلَى دَارِ الْبَلِيَّةِ وتَنَاسُلِ الذُّرِّيَّةِ.

আদম সৃষ্টি

আল্লাহ্ কঠিন ,কোমল ,মধুর ও তিক্ত মৃত্তিকা সংগ্রহ করলেন। তিনি এ মৃত্তিকাকে পানি দিয়ে কর্দমে পরিণত করলেন এবং পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত ফোটায় ফোঁটায় পানির পতন ঘটালেন এবং আঠাল না হওয়া পর্যন্ত আদ্রতা দ্বারা পিণ্ড প্রস্তুত করলেন। এ পিণ্ড থেকে তিনি আদল ,জোড়াসমূহ ,অঙ্গ - প্রত্যঙ্গ ও বিভিন্ন অংশসহ একটা আকৃতি তৈরি করলেন। একটা নির্দিষ্ট সময় ও জ্ঞাত স্থায়িত্ব পর্যন্ত তিনি এটাকে শুকিয়ে কাঠিন্য প্রদান করলেন। অতঃপর এ আকৃতির মধ্যে তিনি তাঁর রূহ ফুৎকার করে দিলেন। ফলে এটা প্রাণ - চৈতন্য লাভ করে মানবাকৃতি ধারণ করলো এবং এতে মন সন্নিবেশ করা হলো ,যা তাকে নিয়ন্ত্রণ করে ; বুদ্ধিমত্তা দেয়া হলো ,যা তার উপকারে আসে ; অঙ্গ - প্রত্যঙ্গ দেয়া হলো ,যা তার কাজে লাগে ; ইন্দ্রিয় দেয়া হলো ,যা তার অবস্থার পরিবর্তন ঘটায় এবং জ্ঞান দেয়া হলো ,যা সত্য - অসত্য ,স্বাদ - গন্ধ ও বর্ণ - প্রকারের পার্থক্য বুঝাতে শেখালো। আদম হলো বিভিন্ন বর্ণের ,আসঞ্জক পদার্থের ,বিভিন্ন পরস্পর বিরোধী উপকরণের এবং বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য যেমন - উষ্ণতা ,শীতলতা ,কোমলতা ,কাঠিন্য ,খুশি - অখুশি ইত্যাদির সংমিশ্রনের কর্দম।

আল্লাহ তখন ফেরেশতাদের প্রতি তাঁর প্রতিশ্রুতি পূরণার্থে এবং তাদের প্রতি তাঁর নির্দেশের আনুগত্য পরিপূরণ করণার্থে আত্মসমর্পণের স্বীকৃতি স্বরূপ ও তাঁর মহিমার প্রতি সম্মান স্বরূপ সেজদাবনত হতে বললেন। তিনি বলেনঃ

আদমকে সেজদা কর এবং ইবলিস ব্যতীত সকলেই সেজদা করলো। (কুরআন - ২ - ৩৪ ,৭ - ১১ ,১৭ - ৬১ ,১৮ - ৫০ ,২০ - ১১৬) আত্মম্ভরিতা ইবলিসকে আল্লাহর আদেশ পালনে বিরত করলো এবং ঔদ্ধত্য দ্বারা সে আক্রান্ত হয়েছিল। সুতরাং সে আগুনের তৈরি বলে অহংবোধ করলো এবং মাটির তৈরি বলে আদমকে অবজ্ঞা করলো। ফলে আল্লাহ ইবলিসকে তাঁর রোষের পূর্ণ প্রতিফল প্রদানের এবং মানুষকে পরীক্ষা করার ও শয়তানের প্রতি তাঁর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করার জন্য যথেষ্ট সময় দিলেন। আল্লাহ বলেনঃ

তা হলে নিশ্চয় তুমি অবকাশ প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত - নির্ধারিত সময়ের দিন পর্যন্ত (কুরআন ১৫ - ৩৭ - ৩৮ ,৩৮ - ৮০ - ৮১)

তৎপর আল্লাহ্ আদমকে একটা ঘরে অধিষ্ঠান করলেন যেখানে তিনি মহানন্দে ও পূর্ণ নিরাপত্তায় বসবাস করতে লাগলেন। তিনি আদমকে ইবলিস ও তার শত্রুতা সম্পর্কে সাবধান করে দিলেন। কিন্তু ইবলিস আদমের বেহেশত - বাস ও ফেরেশতাদের সংসর্গের জন্য ঈর্ষান্বিত হলো। সুতরাং সে আদমের "ইয়াকিন ’ শিথিল করলে এবং তার প্রতিশ্রুতি দুর্বল করলো। এতে আদমের আনন্দ ভয়ে পরিণত হলো এবং মর্যাদা লজ্জায় পরিণত হলো। তখন আল্লাহ আদমকে তওবা ’ করার সুযোগ দিলেন এবং তাঁর রহমতের বাক্য শেখালেন। তিনি আদমকে বেহেশতে প্রত্যাবর্তনের ওয়াদা দিলেন এবং তাকে কষ্টভোগ করা ও বংশ বিস্তারের স্থলে অবতরণ করালেন ।

اختيار الأنبياء

واصْطَفَى سُبْحَانَه مِنْ وَلَدِه أَنْبِيَاءَ، أَخَذَ عَلَى الْوَحْيِ مِيثَاقَهُمْ وعَلَى تَبْلِيغِ الرِّسَالَةِ أَمَانَتَهُمْ، لَمَّا بَدَّلَ أَكْثَرُ خَلْقِه عَهْدَ اللَّه إِلَيْهِمْ، فَجَهِلُوا حَقَّه واتَّخَذُوا الأَنْدَادَ مَعَه، واجْتَالَتْهُمُ الشَّيَاطِينُ عَنْ مَعْرِفَتِه، واقْتَطَعَتْهُمْ عَنْ عِبَادَتِه فَبَعَثَ فِيهِمْ رُسُلَه، ووَاتَرَ إِلَيْهِمْ أَنْبِيَاءَه لِيَسْتَأْدُوهُمْ مِيثَاقَ فِطْرَتِه، ويُذَكِّرُوهُمْ مَنْسِيَّ نِعْمَتِه، ويَحْتَجُّوا عَلَيْهِمْ بِالتَّبْلِيغِ، ويُثِيرُوا لَهُمْ دَفَائِنَ الْعُقُولِ، ويُرُوهُمْ آيَاتِ الْمَقْدِرَةِ، مِنْ سَقْفٍ فَوْقَهُمْ مَرْفُوعٍ ومِهَادٍ تَحْتَهُمْ مَوْضُوعٍ، ومَعَايِشَ تُحْيِيهِمْ وآجَالٍ تُفْنِيهِمْ وأَوْصَابٍ تُهْرِمُهُمْ، وأَحْدَاثٍ تَتَابَعُ عَلَيْهِمْ، ولَمْ يُخْلِ اللَّه سُبْحَانَه خَلْقَه مِنْ نَبِيٍّ مُرْسَلٍ، أَوْ كِتَابٍ مُنْزَلٍ أَوْ حُجَّةٍ لَازِمَةٍ أَوْ مَحَجَّةٍ قَائِمَةٍ، رُسُلٌ لَا تُقَصِّرُ بِهِمْ قِلَّةُ عَدَدِهِمْ، ولَا كَثْرَةُ الْمُكَذِّبِينَ لَهُمْ، مِنْ سَابِقٍ سُمِّيَ لَه مَنْ بَعْدَه،

أَوْ غَابِرٍ عَرَّفَه مَنْ قَبْلَه عَلَى ذَلِكَ نَسَلَتِ الْقُرُونُ ومَضَتِ الدُّهُورُ، وسَلَفَتِ الآبَاءُ وخَلَفَتِ الأَبْنَاءُ.

পয়গম্বর মনোনয়ন

আল্লাহ্ আদমের বংশধর থেকে অনেক পয়গম্বর মনোনীত করলেন এবং তাঁর প্রত্যাদেশ ও বাণী বিশ্বস্ততার সাথে মানুষের কাছে পৌছানোর জন্য তাদের নিকট থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করলেন। কালক্রমে অনেক লোক আল্লাহকে দেয়া প্রতিশ্রুতি পরিবর্তন করে ফেললো এবং আল্লাহর প্রতি কর্তব্য বিষয় ভুলে গিয়ে তাঁর সমকক্ষ দাঁড় করাতে লাগলো। শয়তান তাদেরকে আল্লাহর মা রেফাত থেকে ফিরিয়ে নিল এবং তার ইবাদত থেকে বিচ্ছিন্ন করলো। তখনই আল্লাহ তাদের কাছে রাসূলগণকে প্রেরণ করলেন এবং একের পর এক নবী পাঠালেন যেন তাঁরা পূর্ব - প্রতিশ্রুতি পরিপূর্ণ করার দিকে মানুষকে আহবান করেন এবং ভুলে যাওয়া নেয়ামতসমূহ স্মরণ করিয়ে দেন ; যেন তারা তবলিগের মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহর দিকে প্রণোদিত করেন ,যেন তাদের কাছে প্রজ্ঞার গুপ্ত রহস্য উন্মোচন করে দেন এবং আল্লাহর কুদরতের নিদর্শনসমূহ যেমন- সমুচ্চ আকাশ ,বিছানো পৃথিবী ,তাদের বাঁচিয়ে রাখার জীবনোপকরণ ,মৃত্যু ,বার্ধক্যের জরা ও ক্রমান্বয়ে আগত ঘটনা প্রবাহ- তাদেরকে দেখিয়ে দেন।

আল্লাহ্ তাঁর সৃষ্টিকে কখনো পয়গম্বরবিহীন অথবা নাজেলকৃত বাণী অথবা বাধ্যতামূলক প্রত্যাদেশ অথবা সরল সহজ পথ ব্যতীত রাখেননি। পয়গম্বরগণ এমনভাবে তাদের দায়িত্বে অটল ছিলেন যে ,তাদের সহচরের সংখ্যাল্পতা বা তাদেরকে মিথ্যা প্রমাণকারীর দল অধিক হওয়া সত্ত্বেও তাদের মিশন থেকে কখনো তারা বিরত হননি এবং কোন কিছুই তাদেরকে কর্তব্য থেকে বিরত রাখতে পারেনি । পয়গম্বরগণের প্রত্যেকেই তাঁর পূর্ববর্তী জনের কথা বলে গেছেন এবং পরবর্তী জনের আগমন বার্তা জ্ঞাপন করেছেন ।

مبعث النبي

إِلَى أَنْ بَعَثَ اللَّه سُبْحَانَه مُحَمَّداً، رَسُولَ اللَّهصلى‌الله‌عليه‌وآله لإِنْجَازِ عِدَتِه وإِتْمَامِ نُبُوَّتِه، مَأْخُوذاً عَلَى النَّبِيِّينَ مِيثَاقُه، مَشْهُورَةً سِمَاتُه كَرِيماً مِيلَادُه، وأَهْلُ الأَرْضِ يَوْمَئِذٍ مِلَلٌ مُتَفَرِّقَةٌ، وأَهْوَاءٌ مُنْتَشِرَةٌ وطَرَائِقُ مُتَشَتِّتَةٌ، بَيْنَ مُشَبِّه لِلَّه بِخَلْقِه أَوْ مُلْحِدٍ فِي اسْمِه، أَوْ مُشِيرٍ إِلَى غَيْرِه، فَهَدَاهُمْ بِه مِنَ الضَّلَالَةِ وأَنْقَذَهُمْ بِمَكَانِه مِنَ الْجَهَالَةِ، ثُمَّ اخْتَارَ سُبْحَانَه لِمُحَمَّدٍصلى‌الله‌عليه‌وآله لِقَاءَه، ورَضِيَ لَه مَا عِنْدَه وأَكْرَمَه عَنْ دَارِ الدُّنْيَا، ورَغِبَ بِه عَنْ مَقَامِ الْبَلْوَى، فَقَبَضَه إِلَيْه كَرِيماً،صلى‌الله‌عليه‌وآله وخَلَّفَ فِيكُمْ مَا خَلَّفَتِ الأَنْبِيَاءُ فِي أُمَمِهَا، إِذْ لَمْ يَتْرُكُوهُمْ هَمَلًا بِغَيْرِ طَرِيقٍ وَاضِحٍ ولَا عَلَمٍ قَائِمٍ

নবী মুহাম্মদ (সা.)

এভাবে সময় গড়িয়ে যুগের পর যুগ অতিক্রান্ত হলো। পিতারা মৃত্যুবরণ করলো এবং সন্তানেরা তাদের স্থানে এলো - সুদীর্ঘ সময় পার হবার পর আল্লাহ তাঁর অঙ্গীকার পূরণার্থে ও পয়গম্বর - ধারা সমাপ্তি করে মুহাম্মদকে (সা.) নবী ও রাসূল করে পৃথিবীতে প্রেরণ করলেন। অন্যান্য পয়গম্বরদের কাছ থেকে মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে অঙ্গীকার গ্রহণ করা হয়েছিল। মুহাম্মদের (সা.) জন্ম ছিল অতীব সম্মানজনক এবং চরিত্র বৈশিষ্ট্য ছিল সুখ্যাতিপূর্ণ। সে সময়ে পৃথিবীর মানুষ বিভিন্ন ধর্মে দলভুক্ত (মাজহাব) ছিল। তাদের মতো ও পথ ছিল বিবিধ ; চিন্তাধারা ছিল বিক্ষিপ্ত এবং একে অপরের সাথে বিবাদমান ছিল। তারা সৃষ্টিকে আল্লাহর সাদৃশ্য করতো অথবা তার মহিমান্বিত নামসমূহ বিকৃত করতো অথবা তিনি ব্যতীত অন্য কিছুকে ক্রিয়া - কর্ম সম্পাদনকারী মনে করতো। মুহাম্মদের (সা.) মাধ্যমে আল্লাহ তাদেরকে সুপথ দেখালেন এবং তার অক্লান্ত প্রচেষ্টা দ্বারা তিনি তাদেরকে অজ্ঞতা থেকে ফিরিয়ে আনলেন ।

অতঃপর আল্লাহ মুহাম্মদকে (সা.) তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য মনোনীত করে তার মহিমান্বিত নৈকট্য দান করলেন এবং এ পৃথিবীতে থাকার অনেক অনেক উর্দ্ধের মর্যাদাশীল বিবেচনা করে তাকে এ পৃথিবী থেকে তুলে নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। ফলে তিনি মহাসম্মানের সাথে তাঁকে নিজের সান্নিধ্যে নিয়ে গেলেন। মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর বংশধরগণের ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক ।

القرآن والأحكام الشرعية

كِتَابَ رَبِّكُمْ فِيكُمْ مُبَيِّناً حَلَالَه وحَرَامَه، وفَرَائِضَه وفَضَائِلَه ونَاسِخَه ومَنْسُوخَه ورُخَصَه وعَزَائِمَه وخَاصَّه وعَامَّه، وعِبَرَه وأَمْثَالَه ومُرْسَلَه ومَحْدُودَه ومُحْكَمَه ومُتَشَابِهَه مُفَسِّراً مُجْمَلَه ومُبَيِّناً غَوَامِضَه، بَيْنَ مَأْخُوذٍ مِيثَاقُ عِلْمِه ومُوَسَّعٍ

عَلَى الْعِبَادِ فِي جَهْلِه، وبَيْنَ مُثْبَتٍ فِي الْكِتَابِ فَرْضُه، ومَعْلُومٍ فِي السُّنَّةِ نَسْخُه، ووَاجِبٍ فِي السُّنَّةِ أَخْذُه، ومُرَخَّصٍ فِي الْكِتَابِ تَرْكُه، وبَيْنَ وَاجِبٍ بِوَقْتِه وزَائِلٍ فِي مُسْتَقْبَلِه، ومُبَايَنٌ بَيْنَ مَحَارِمِه مِنْ كَبِيرٍ أَوْعَدَ عَلَيْه نِيرَانَه، أَوْ صَغِيرٍ أَرْصَدَ لَه غُفْرَانَه، وبَيْنَ مَقْبُولٍ فِي أَدْنَاه مُوَسَّعٍ فِي أَقْصَاه.

পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ

মুহাম্মদ (সা.) তোমাদের মাঝে ওই একই জিনিস রেখে গেছেন যা অন্য পয়গম্বরগণও তাদের উম্মতের কাছে রেখে গিয়েছিলেন। পয়গম্বরগণ মানুষকে অন্ধকারে রেখে যান নি । তাঁরা সুনির্দিষ্ট সঠিক পথের সন্ধান দিয়েছিলেন এবং আল্লাহর স্থায়ী নিদর্শনাবলীর তত্ত্বাবধান করেছিলেন। মুহাম্মদ (সা.) তোমাদের কাছে রেখে গেছেন তোমাদের প্রতিপালকের কিতাব যা নির্ধারিত হালাল ও হারাম বর্ণনাকরে ; ফরজ ও মোস্তাহাবসমূহ বর্ণনা করে ; মনসুখ ও নাসেখ বর্ণনা করে ; বাধ্যতামূলক ও ঐচ্ছিক বিষয়াদি ,বিশেষ ও সাধারণ বিষয়াদি ,উপদেশ ও উপমা ,সীমিত ও অসীম ,স্পষ্ট ও অস্পষ্ট বর্ণনা করে এবং শব্দ সংক্ষেপের (মুকাত্তাআত) ব্যাখ্যা ও গুপ্ত বিষয়ের স্পষ্ট বর্ণনা করে।

কুরআনে কিছু কিছু আয়াত আছে যে বিষয়ে জ্ঞানার্জন বাধ্যতামূলক আবার এমন কিছু আয়াত আছে যেগুলোর রহস্য বিষয়ে মানুষের অজ্ঞতা মার্জনীয়। রাসূলের সুন্নাহ কুরআনের বাধ্যতামূলক বিষয়াদি প্রকাশক। রাসূলের সুন্নাহর মাধ্যমে বাধ্যতামূলক বিষয়ের রাদ - বদলও প্রতিফলিত হয়েছে অথবা সুন্নাহতে এমন বিষয়াদি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে যা পবিত্র গ্রন্থে হয়ত অনুসরণ না করার অনুমতি রয়েছে। এছাড়াও কিছু কিছু আয়াত আছে যা একটা বিশেষ সময় পর্যন্ত বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু ওই সময়ের পর তদ্রুপ নেই। কুরআনের নিষেধাজ্ঞাসমূহও বিভিন্ন - কিছু এমন যাতে জাহান্নামের ভীতি প্রকট এবং কিছু এমন যাতে ক্ষমার প্রত্যাশা অধিক ব্যক্ত হয়েছে। কুরআনে এমন আয়াতও আছে যার একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রাংশও আল্লাহর নিকট বর্ধিত আকারে গ্রহণযোগ্য।

ومنها في ذكر الحج

وفَرَضَ عَلَيْكُمْ حَجَّ بَيْتِه الْحَرَامِ، الَّذِي جَعَلَه قِبْلَةً لِلأَنَامِ، يَرِدُونَه وُرُودَ الأَنْعَامِ ويَأْلَهُونَ إِلَيْه وُلُوه الْحَمَامِ، وجَعَلَه سُبْحَانَه عَلَامَةً لِتَوَاضُعِهِمْ لِعَظَمَتِه، وإِذْعَانِهِمْ لِعِزَّتِه، واخْتَارَ مِنْ خَلْقِه سُمَّاعاً أَجَابُوا إِلَيْه دَعْوَتَه، وصَدَّقُوا كَلِمَتَه ووَقَفُوا مَوَاقِفَ أَنْبِيَائِه، وتَشَبَّهُوا بِمَلَائِكَتِه الْمُطِيفِينَ بِعَرْشِه، يُحْرِزُونَ الأَرْبَاحَ فِي مَتْجَرِ عِبَادَتِه، ويَتَبَادَرُونَ عِنْدَه مَوْعِدَ مَغْفِرَتِه، جَعَلَه سُبْحَانَه وتَعَالَى لِلإِسْلَامِ عَلَماً، ولِلْعَائِذِينَ حَرَماً فَرَضَ حَقَّه وأَوْجَبَ حَجَّه، وكَتَبَ عَلَيْكُمْ وِفَادَتَه ، فَقَالَ سُبْحَانَه:( ولِلَّه عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطاعَ إِلَيْه سَبِيلًا، ومَنْ كَفَرَ فَإِنَّ الله غَنِيٌّ عَنِ الْعالَمِينَ ) .

হজ্জ সম্পর্কে

আল্লাহ তাঁর পবিত্র গৃহে হজ্জ করা তোমাদের জন্য ফরজ করেছেন এবং সে গৃহকে মানুষের জন্য কেবলা হিসাবে নির্ধারিত করেছেন। প্রাণীকুল অথবা কবুতর তৃষিত অবস্থায় যেভাবে ঝরনার পানির দিকে ছুটে যায় মানুষও তেমনি যেন কাবার দিকে ধাবমান হয়। মহিমান্বিত আল্লাহ তাঁর আজমতের সামনে বান্দাদের তাওয়াজু (বিনয়) প্রকাশের জন্য এবং তাঁর ইজ্জতের প্রতি তাস্দিক (দৃঢ় বিশ্বাস) প্রকাশের জন্য সম্মানিত ঘরকে প্রতীক হিসাবে নির্ধারিত করেছেন। সৃষ্টির মধ্য থেকে তিনি এমন কিছু শ্রবণকারী মনোনীত করেছেন যারা তার ডাকে সাড়া প্রদান করে এবং তার বাণী বাস্তবে পরিণত করে। এসব লোকেরা পয়গম্বরগণের মর্যাদার পর্যায়ে অবস্থান করে এবং তারা ওই সমস্ত ফেরেশতাগণের প্রতিরূপ যারা আরাশের চতুর্দিকে তওয়াফ করে আল্লাহর ইবাদতের সার্বিক মর্যাদা ও তার প্রতিশ্রুত ক্ষমার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। মহিমান্বিত আল্লাহ্ পবিত্র গৃহকে ইসলামের জন্য একটা প্রতীক করেছেন এবং আশ্রয় গ্রহণকারীদের জন্য উহা নিরাপদ স্থান। তিনি কাবার হক আদায়কে ওয়াজেব করেছেন এবং উহার দিকে সফরকে বাধ্যতামূলক করেছেন। আল্লাহ্ বলেনঃ এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে এ গৃহের হজ্জ করা সেসকল লোকের জন্য বাধ্যতামূলক যারা কাবা পর্যন্ত যাবার সামর্থ্য রাখে । কিন্তু কেহ অস্বীকার করলে ,জেনে রাখুক ,আল্লাহ বিশ্বজগতের মুখাপেক্ষী নন (কুরআন - ৩:৯৭) ।

____________________

১ । আল্লাহর মা রেফাতেই দ্বিনের ভিত্তি। দ্বিনের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে আনুগত্য স্বীকার করা এবং সাধারণভাবে দ্বীন বলতে বিধান বুঝায়। যে কোন অর্থই গ্রহণ করা হোক না কেন অন্তর যদি আল্লাহর মা রেফাতের ধারণাবিহীন হয় তবে আনুগত্যের প্রশ্নই ওঠেনা এবং সেক্ষেত্রে বিধান অনুসরণের প্রশ্নও বাতুলতা মাত্র। কারণ যখন কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে না তখন লক্ষ্যে পৌছার জন্য অগ্রযাত্রারও কোন দিক নির্দেশনা থাকে না । কোন লক্ষ্য বিষয়ের ধারণা না থাকলে তা পাবার প্রচেষ্টাও করা যায় না। এতদসত্ত্বেও মানুষ যখন কোন উন্নত ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে আসে তখন তাঁর আনুগত্যের উপলব্ধি ও প্রেরণা মানুষের স্বভাব ও ব্যক্তিগত গুণাবলীকে প্রভাবিত করে মানুষের বাতেনকে উচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করে।

আল্লাহর মা রেফাত সম্পর্কীয় অত্যাবশ্যকীয় বিষয়সমূহ বর্ণনার পর আমিরুল মোমেনিন উহার মূল উপাদান ও শর্তসমূহ ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন যে ,মানুষ যদিও মা রেফাত জ্ঞানকে উচু স্তরের চিন্তা ভাবনা মনে করে এড়িয়ে যেতে চায়। তবুও এর প্রাথমিক ধাপ হলো অজানাকে জানার সহজাত আকাঙ্ক্ষা ও বিবেকের তাড়না অথবা মোমিনের কাছে দীক্ষা গ্রহণ করে অদৃশ্য সত্তা সম্পর্কে একটা ধারণা মনের মধ্যে গড়ে তোলা। বস্তৃত এ ধারণাটাই আল্লাহর মা রেফাত অন্বেষণের পথিকৃত হিসাবে কাজ করে। কিন্তু যারা গাফেল অথবা পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে গবেষণায় নিমগ্ন হতে পারে না তাদের মনে ধারণার সৃষ্টি হলেও তারা মা রেফাতের গভীর সমুদ্রে ডুব দিতে পারে না এবং তাদের কাছে মা রেফাতের ধারণা বদ্ধমূল হতে পারে না। এক্ষেত্রে তারা আল্লাহর অস্তিত্ব জ্ঞান থেকে বঞ্চিত থাকে এবং এ পর্যায়ে যেহেতু সাক্ষ্য বহনের স্তর তাদের কাছে অনভিগম্য ,সেহেতু এ বিষয়ে তারা প্রশ্নযোগ্য হয়ে পড়ে। কিন্তু যদি কেউ মা রেফাত সম্পর্কে অর্জিত মানসচিত্র দ্বারা পরিচালিত হয়ে এগিয়ে যায় সে বুঝতে পারে এতে গভীর চিন্তা ও গবেষণা অত্যাবশ্যক। এভাবেই মানুষ আল্লাহর মা রেফাত লাভের পরবর্তী স্তরে উপনীত হয়। এ স্তর হলো সৃষ্টির বৈচিত্র্যের মাঝে স্রষ্টার খোজ করা। কারণ প্রতিটি শিল্পকর্ম শিল্পীর অস্তিত্বের সর্বসম্মত ও দৃঢ় প্রমাণ এবং প্রতিটি ক্রিয়ায় কোন না কোন প্রতিক্রিয়া বিদ্যমান। মানুষ যেদিকে দৃষ্টিপাত করুক না কেন সে এমন কোন কিছুর অস্তিত্ব বের করতে পারবে না। যা কেউ না কেউ তৈরি করেনি ; এমন কোন পদচিহ্ন দেখাতে পারবে না যেখানে কেউ হাঁটে নি ; এমন কোন নির্মাণ কাজ দেখাতে পারবে না। যার কোন নির্মাতা নেই। এরপরও মানুষ কিভাবে ভাবতে পারে চন্দ্র ,সূর্য ,গ্রহ ,নক্ষত্র খচিত বিস্তীর্ণ নীলাকাশ ও তৃণফুল সুশোভিত। এ সুন্দর পৃথিবী সৃষ্টিকর্তা ছাড়াই সৃষ্টি হয়েছে ? সুতরাং বস্তুনিচয় আর সৃষ্টির নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া দেখার পরও কি কেউ এ কথা বলতে পারে যে ,এ বৈচিত্র্যময় বিশ্বচরাচরের সৃষ্টিকর্তা নেই ? কারণ বস্তুসত্তা অনস্তিত্ব থেকে আসতে পারে না বা অসত্তাত্ব (nothingness ) অস্তিত্বের কারণ হতে পারে না। এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনের যুক্তিবিন্যাস হলোঃ

আল্লাহ সম্বন্ধে কি কোন সন্দেহ আছে যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর মৌলিক সৃষ্টিকর্তা (১৪:১০)

কিন্তু মা রেফাতের এ স্তরটিও অপর্যাপ্ত হয়ে পড়ে যখন আল্লাহর অস্তিত্বের সাক্ষ্য বহন তাগুতের প্রতি বিশ্বাস দ্বারা কলঙ্কিত করা হয় ।

মা রেফাতের পথে তৃতীয় স্তর হলো আল্লাহর ঐক্য ও একত্বে গভীর বিশ্বাসসহ তাঁর অস্তিত্বের স্বীকৃতি অর্থাৎ তৌহিদে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। তৌহিদে প্রতিষ্ঠিত হতে না পারলে আল্লাহর অস্তিত্বের সাক্ষ্য বহন পরিপূর্ণ হয় না ,কারণ তাগুতে বিশ্বাস করলে আল্লাহতে বহুত্ব আরোপ করা হয়। অথচ মা রেফাত অর্জনের জন্য আল্লাহকে একক হিসাবে গ্রহণ করা অপরিহার্য। একাধিক আল্লাহর ধারণা করলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে যে ,এ বিশ্বচরাচর কি তাদের একজন সৃষ্টি করেছে ,নাকি তারা সকলে সম্মিলিতভাবে করেছে ? যদি তাদের কেউ একজন সৃষ্টি করতো তাহলে অপরজন নিজকে প্রভেদ করে দেখানোর জন্য অন্য রকম সৃষ্টি করতো। আবার যদি তারা সকলে সমষ্টিগতভাবে সৃষ্টি করতো তা হলে দুটো অবস্থার সৃষ্টি হতো - হয় তারা একে অপরের সহায়তা ব্যতীত কর্ম সম্পাদন করতে পারতো না ,না হয়। কারোই অপরের সহায়তার প্রয়োজন হতো না। প্রথম অবস্থাটি অক্ষমতা প্রকাশক যাতে দেখা যায়। একজন অপরজনের উপর নির্ভরশীল এবং অপর অবস্থাটিতে দেখা যায় তারা প্রত্যেকে নিয়মিত আলাদা আলাদা ক্রিয়া সম্পাদক। ধরা যাক ,সকল স্রষ্টা তাদের সৃষ্টিকর্ম নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে সম্পাদন করছেন। সেক্ষেত্রে অবস্থাটা এমন হতো যে ,প্রতিটি সৃষ্টি শুধুমাত্র তার নিজস্ব স্রষ্টার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখতো - সমগ্র সৃষ্টি একই স্রষ্টার সাথে সম্পর্ক রক্ষা করতো না। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা তা নয়। প্রতিটি সৃষ্টজীব স্রষ্টার সাথে একই সম্পর্ক রক্ষা করে চলছে এবং বিশ্বচরাচরের সবকিছু একই নিয়মে চলছে। মোট কথা ,আল্লাহর একত্বের স্বীকৃতি না দিয়ে কোন উপায় নেই ,কারণ একাধিক সৃষ্টিকর্তার ধারণা গ্রহণ করলে কোন কিছুর অস্তিত্বের সম্ভাব্যতা থাকে না এবং নিঃসন্দেহে পৃথিবী ও নভোমণ্ডলসহ সৃষ্টির সবকিছু ধ্বংস হয়ে যেতো। মহিমান্বিত আল্লাহ নিম্নরূপ যুক্তি প্রদর্শন করেনঃ

যদি আল্লাহ্ ব্যতীত আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী এবং এতদুভয়ের মধ্যে বহু ইলাহ থাকতো ,তবে উভয়ই ধ্বংস হয়ে যেতো ...(কুরআন - ২১ ? ২২) ।

মা রেফাতের চতুর্থ স্তর হলো আল্লাহকে সকল দোষ - ত্রুটি ও বিচূতি মুক্ত ,দেহ ও আকার নিরপেক্ষ ,বস্তুমোহ নিরপেক্ষ ,কোন প্রকার উপমা ও সাদৃশ্য মুক্ত ,স্থান ও কালের সীমাবদ্ধতা মুক্ত ,গতি ও নিশ্চলতা মুক্ত এবং অক্ষমতা ও অজ্ঞতা মুক্ত মনে করতে হবে। কারণ পরম পবিত্র সত্তায় কোন দোষ - ত্রুটি থাকতে পারে না বা কেউ তার সদৃশ হতে পারে না। এসব অবস্থা স্রষ্টার মহান মর্যাদা থেকে একটা সত্তাকে সৃষ্টির পর্যায়ে নামিয়ে আনে। এ কারণেই আল্লাহ তার একত্বসহ সকল ত্রুটি - বিচূতি থেকে পরম পবিত্রতা ধারণ করেছেন। আল্লাহ বলেনঃ

তিনিই আল্লাহ ,একক। আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন । তিনি কাউকে জন্ম দেন নি এবং তাঁকেও কেউ জন্ম দেয়নি । এবং তাঁর সমতুল্য কেউ নেই। (কুরআন - ১.১২ :১ - ৪)

তিনি দৃষ্টির অধিগম্য নহেন। কিন্তু দৃষ্টিশক্তি তাঁর অধিগত এবং তিনিই সূক্ষ্মদর্শী সম্যক পরিজ্ঞাতা (কুরআন - ৬:১০৩)

সুতরাং আল্লাহর কোন সদৃশ উদ্ভাবন করো না । আল্লাহ্ (সর্ব বিষয়ে) পরিজ্ঞাত এবং তোমরা কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয় ,তিনি সর্বশ্রোতা ,সর্বদ্রষ্টা / (কুরআন - ৪২:১১)

মা রেফাতের পঞ্চম স্তর হলো আল্লাহর প্রতি বাইরের কোন গুণারোপ করা যাবে না পাছে তাঁর এককত্বে দ্বৈততা এসে যায় এবং একের মধ্যে তিন ও তিনের মধ্যে একের গোলক ধাধায় এককত্বের গূঢ়ার্থ হারিয়ে যায়। কারণ তাঁর সত্তা আকার ও সত্তাসারের সংমিশ্রণ নয়। সে কারণে আল্লাহতে গুণ এমনভাবে জড়ানো যেমন ফুলে ঘাণ অথবা তারকারাজীতে দীপ্তি। বরং তিনিই সকল গুণের ঝরনাধারা এবং তার যথার্থ গুণাবলী প্রকাশের জন্য কোন মাধ্যমের প্রয়োজন হয় না। তাকে সর্বজ্ঞ বলা হয় কারণ তাঁর জ্ঞানের চিহ্নসমূহ স্পষ্টত প্রতীয়মান। তাঁকে সর্বশক্তিমান বলা হয়। কারণ প্রতিটি অণু পরমাণু তাঁর সর্বশক্তিমান হওয়া ও সক্রিয়তার নির্দেশক। যদি আল্লাহর প্রতি এ গুণারোপ করা হয় যে তার শ্রবণ ও দর্শন করার ক্ষমতা আছে। তবে এটা যথার্থ যে ,দর্শন ও শ্রবণ ব্যতীত সমগ্র সৃষ্টির সুসঙ্গত প্রশাসন রক্ষা করা সম্ভব নয়। কিন্তু এসব গুণাবলী সৃষ্টজীবে যেভাবে আছে (যেমন কর্ণ দ্বারা শুনা বা চক্ষু দ্বারা দেখা) আল্লাহর ক্ষেত্রে অনুরূপ মনে করা যাবে না। তদুপরি এমনটিও ধারণা করা যাবে না যে ,তিনি জ্ঞানার্জনের পর জানতে সক্ষম হয়েছেন বা তার অঙ্গ - প্রত্যঙ্গে শক্তি সঞ্চালনের পর তিনি শক্তিমান হয়েছেন। আল্লাহর সত্তা থেকে গুণকে আলাদা চিন্তা করলে দ্বিত্ব প্রকাশ করা হয় ,আর যখনই দ্বিত্ব প্রকাশ পাবে তখনই একত্ব অন্তর্ধান হবে। এ কারণে আমিরুল মোমেনিন আল্লাহর সত্তা থেকে গুণ আলাদা ,এমন ধারণা বাতিল করে দিয়েছেন। তিনি এককত্বকে উহার প্রকৃত গূঢ়ার্থে ব্যক্ত করেছেন এবং বহুত্বের কলঙ্ক দ্বারা এককত্বকে কলঙ্কিত করেন নি। এ কথায় এটা বুঝায় না যে ,আল্লাহর প্রতি কোন বিশেষণ প্রয়োগ করা যাবে না। নাস্তিক্যের অতল অন্ধকারে যারা ডুবে আছে তারাই আল্লাহর বিশেষণহীনতার ধারণা পোষণ করে। অথচ সৃষ্টিচরাচর আল্লাহর গুণরাজীতে কানায় কানায় পরিপূর্ণ ; সৃষ্টির প্রতিটি অণু সাক্ষ্য দেয় - তিনি সর্বজ্ঞ ,তিনি সর্বশক্তিমান ,তিনি সর্বশ্রোতা ,তিনি সর্বদ্রষ্টা এবং তিনি সযত্নে সৃষ্টিকে প্রতিপালন করেন ও অনুকম্পা দ্বারা ক্রমবৃদ্ধি করেন। বিষয়টি হলো এই যে ,কোন কিছু করার জন্য অন্যের পরামর্শ তার প্রয়োজন হয় না ; কারণ নিজ সত্তায় তিনি গুণ পরিবেষ্টিত এবং তার গুণরাজীই তাঁর সত্তার জাত্যর্থ ইমাম জাফর আস - সাদিক অন্যান্য ধর্মে বর্ণিত আল্লাহর এককত্বের বিষয়টি তুলনা করে বলেনঃ

আমাদের মহিমান্বিত ও পরম দয়ালু আল্লাহ নিজ সত্তায় জ্ঞানান্বিত ছিলেন যখন জানার মতো কিছুই ছিল না ,নিজ সত্তায় দৃষ্টিমান ছিলেন যখন দেখার মতো কোন কিছুই ছিল না ,নিজ সত্তায় শ্রুতিমান ছিলেন যখন শোনার মতো কোন কিছু ছিল না ,নিজ সত্তায় শক্তিমান ছিলেন যখন তাঁর শক্তির অধীন কোন কিছুই ছিল না । যখন তিনি বস্তুনিচয় সৃষ্টি করলেন এবং জ্ঞানেন্দ্রিয় অস্তিত্বশীল হলো তখন তাঁর জ্ঞান জ্ঞায়ের সাথে ,শ্রুতি শ্রাব্যের সাথে ,দৃষ্টি দৃশ্যমানের সাথে এবং শক্তি বস্তুর সাথে সম্বন্ধযুক্ত হলো (সাদুক ,পৃঃ ১৩৯) ।

আহলুল বাইতের ইমামদের এ বিশ্বাস সর্বসম্মত। কিন্তু ইমামগণ ব্যতীত বিভিন্ন দল আল্লাহর জাত ও সিফাতের মধ্যে পার্থক্যের ধারণা সৃষ্টি করে ভিন্ন ধারা গ্রহণ করেছে। আবুল হাসান আল - আশারীর মতে আল্লাহ্ জ্ঞানের মাধ্যমে জানেন ; ক্রিয়ার মাধ্যমে শক্তিশালী ,উক্তির মাধ্যমে কথা বলেন ; শ্রুতির মাধ্যমে শোনেন এবং দৃষ্টির মাধ্যমে দেখেন (শাহরাস্তানী ,১ম খণ্ড ,পৃঃ ৪২) ।

আশারীর উপরোক্ত ধারণানুযায়ী যদি জাত আর সিফাতকে আলাদা ধরা হয় তবে দুটি বিকল্প দাঁড়ায় - হয় সিফাত আদি থেকেই আল্লাহতে রয়েছে ,না হয় তা পরবর্তীতে সংঘটিত হয়েছে। প্রথম ক্ষেত্র মেনে নিলে একথাই স্বীকার করা হবে যে ,আল্লাহর অনাদি - অনন্ত অস্তিত্বকাল থেকেই গুণরাজীর সমসংখ্যক বস্তুনিচয় বিরাজিত ছিল যা তার অনন্ততার অংশীদার হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু মানুষ তাকে যা কিছুর সমতুল্য মনে করুক না কেন তিনি এসবের উর্দ্ধে (কুরআন) । দ্বিতীয় ক্ষেত্র মেনে নিলে আল্লাহকে শুধুমাত্র পরিবর্তনের শর্তাধীনই করা হয় না। বরং এটাও বুঝানো হয় যে ,গুণরাজী অর্জনের পূর্বে তিনি বিজ্ঞানপ্রাপ্ত ছিলেন না ; শক্তিশালী অথবা শ্রোতা অথবা দ্রষ্টা ছিলেন না। এহেন ধারণাসমূহ ইসলামের মূল দর্শনের বিপরীত।

বাংলা অনুবাদকের মন্তব্য

আমিরুল মোমেনিন আলী ইবনে আবি তালিবের এ খোৎবাটি অত্যন্ত তাত্ত্বিক। এতে তিনি আল্লাহতত্ত্ব ,মহাবিশ্ব সৃষ্টিতত্ত্ব ,মানব সৃষ্টিতত্ত্ব ,নবীতত্ত্ব ,ফেরেশতা তত্ত্ব অতি চমৎকার আলঙ্কারিক ভাষায় সংক্ষিপ্তাকারে ব্যক্ত করেছেন। এ বিষয়গুলো দর্শনশাস্ত্রের মৌলিক বিষয় বলে চিহ্নিত। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই দার্শনিকগণ এ বিষয়গুলোর ওপর নানা প্রকার মতো ও তত্ত্ব প্রদান করে আসছেন। আধুনিক বিশ্বের মহান দার্শনিকগণও তাদের চিন্তা ,ধ্যান - ধারণা ও অভিমত এ বিষয়গুলোর ওপর ব্যক্ত করে যাচ্ছেন। কিন্তু প্রত্যেক দার্শনিকের প্রদত্ত তত্ত্ব অন্যজন হয় পরিমার্জিত করেন ,না হয় বাতিল করে দেন। কেউ এখনো এ বিষয়গুলোতে সুনির্দিষ্ট কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন নি। এটা মনে হচ্ছে একটাEndless Belt . আজ থেকে প্রায় ১৪০০ বছর পূর্বে আমিরুল মোমেনিন স্রষ্টা - জগৎ - জীবনের যে তত্ত্বগত দার্শনিক যুক্তি প্রদর্শন করে গেছেন তা সারা বিশ্বের দার্শনিকের তাত্ত্বিক দর্শনের প্রধান উদ্দেশ্য বলে স্বীকৃতি লাভ করেছে। শুধু এ খোৎবাতেই নয় ,তাঁর অধিকাংশ খোৎবায় তিনি এমনভাবে আল্লাহতত্ত্ব প্রকাশ করেছেন যা দার্শনিকগণের উপজীব্য।

আল্লাহতত্ত্বঃ সক্রেটিস প্রাকৃতিক নিয়মানুবর্তিতা এবং জগৎসমূহের সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা ও রূপবৈচিত্র্যের পেছনে এক প্রজ্ঞাবান ঐশী সত্তার সন্ধান পেয়েছেন। জগতের প্রতীয়মান উদ্দেশ্য থেকে তিনি পরম জ্ঞানবান ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুমান করেছেন। তিনি বলেছিলেন ,রাষ্ট্রিয় কর্মকর্তাদের দ্বারা নয় ,ইশ্বর দ্বারাই আমি পরিচালিত হব। ঈশ্বর বলতে তিনি এক সর্বব্যাপক পরিণামদর্শী আধ্যাত্মিক সত্তাকে বুঝেছেন ,কোন জড়ীয় সত্তাকে নয় (ইসলাম ,পৃঃ ১৮১) । সক্রেটিসেরKnow thyself ,তত্ত্ব পরবর্তীতে ইসলামের মান আরাফা নাফসাহু ,ফাকাদ আরাফা রাব্বাহু (যে নিজকে চিনেছে সে তার প্রভুকে চিনেছে) তত্ত্বে রূপান্তরিত হয়ে এক গভীর অন্তর্ব্যাপী সূক্ষ্ম পরিণামদর্শী ভাবধারার জন্ম দিয়েছে। প্লেটো স্রষ্টাকে অনন্ত বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি হোমারিয় দেবতা তত্ত্ব বাতিল করে দিয়ে বলেছেন , নক্ষত্রপুঞ্জ ও দেবতাগণ একই ঈশ্বরের সৃষ্টি। এরিষ্টটল ঈশ্বর বলতে বুঝেছেন অচালিত চালক ,জড়াতীত চেতনা বা উপাদানহীন পরম সত্তাকে। তাঁর মতে ঈশ্বর নিরপেক্ষ ফর্ম বা রূপ। আর রূপ মানেই সার্বিক বা অতিবর্তী উপাদানহীন রূপ। ক্টোয়িক দার্শনিকগণ জগৎ সৃষ্টি ও নিয়ন্ত্রণের মূলে ঈশ্বরকে দেখেছেন এবং তাকে সর্বদর্শী ,সর্বশক্তিমান ও প্রেমময় বলে বর্ণনা করেন। তাদের মতে জগৎ এক পরম কল্যাণগুণনিদান সত্তা ,তথা এক মহান উদ্দেশ্যের অভিব্যক্তি স্বরূপ। মানবাত্মা যেমন ব্যক্তির সারা দেহ জুড়ে বিদ্যমান ,তেমনি স্টোয়িকদের ঈশ্বরও জগতের সর্বত্র বিদ্যমান (ইসলাম ,পৃঃ ১৮২) । এ মতবাদই মুসলিম দার্শনিকদের ওয়াহদাতুল ওজুদ (সত্তার ঐক্য বা সর্বেশ্বরবাদ) তত্ত্বের রূপ পরিগ্রহ করেছে।

মধ্যযুগের দার্শনিক অগাস্টিন যুক্তিবুদ্ধির চেয়ে অনাবিল বিশ্বাসের ওপর বেশি জোর দেন। তাঁর মতে ,ঈশ্বর ছাড়া অন্য কোন চূড়ান্ত বাস্তব সত্তা নেই। ঈশ্বর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া মাত্রই মানুষ চির অভিশাপে নিপতিত হয়। তাঁর মতে ,শুধু ঈশ্বরকে জানাই যথেষ্ট নয় ,ঈশ্বর প্রাপ্তির জন্য ঐশী প্রেম ও ভক্তি অপরিহার্য। প্লোটিনাসের মতে ,ঈশ্বর দেহ ও মনের ,রূপ ও উপাদানের ,তথা সকল অস্তিত্বের উৎস। তবে তিনি নিজে বহুত্বের উর্দ্ধে। তিনি পরম একক সত্তা এবং সবকিছুই তাঁর মহা একত্বের অন্তর্ভুক্ত। ঈশ্বর থেকেই সব কিছুর উৎপত্তি ও বিকিরণ। আমরা ঈশ্বরে সৌন্দর্য ,মহত্ত্ব ,চিন্তা ,বাসনা ,ইচ্ছা ,অভীপ্সা ইত্যাদি কোন গুণই আরোপ করতে পারি না ; কারণ এসব গুণ সীমিতশক্তি ও অপূর্ণতার আকর। ঈশ্বর যে আসলে কী তা আমরা বলতে পারি না। আমরা তাকে অচিন্তনীয় সত্তা বলতে পারি। তিনি চিন্তনীয় নন। যা চিন্তনীয় তার সঙ্গে বিষয় ও বিষয়ীর দ্বৈততা বিজড়িত। সুতরাং ঈশ্বরে কোন গুণ আরোপ করা যায় না। কারণ সসীম গুণ আরোপের মানেই অসীম সত্তাকে সীমিত করে ফেলা।(ইসলাম ,পৃঃ১৮৩) ।

এভাবে ভাববাদী দার্শনিক হেগেল ঈশ্বরকে পরম ধারণা বা সার্বিক প্রজ্ঞা বলে অভিহিত করেন। তিনি বলতেন - ঈশ্বর জগতে নিমজ্জিত নন ,আবার জগৎ ঈশ্বরে নিমজ্জিত নয়। জগৎকে বাদ দিয়ে ঈশ্বর আর ঈশ্বর থাকেন না। একইভাবে বার্কলে ,ব্র্যাডলি ,রয়েস ,জেমস প্রভৃতি ভাববাদী দার্শনিকগণ আল্লাহকে পরম সত্তা ,প্রান্তিক একত্ব ,অনুত্তর পরমসত্তা ,অসীম পরমসত্তা ইত্যাদি রূপে ব্যাখ্যা করে আল্লাহর একত্বের প্রকাশ করেছেন (ইসলাম ,পৃঃ ১৮৪ - ১৮৫) । মুসলিম ভাববাদী ও প্রেমবাদী দার্শনিকগণের ধ্যান ধারণায় একই কথা অর্থাৎ আমি তুমি নই ,আবার তোমা থেকে জুদা (আলাদা) নই। তত্ত্বের সমাবেশ ঘটেছে।

খৃষ্টপূর্ব ৫৪৮ অব্দে থেলিস নামক এক গ্রিক পণ্ডিত - প্রকৃতির মধ্যে পরম ঐক্যনীতি বা পরম একত্বের সন্ধান লাভ করেন। তিনি বলেন যে ,বিশ্বজগতে কোন কিছুর কারণ হিসাবে কোন কিছুকে ধরা হলে দেখা যায় তা প্রকৃত কারণ নয় ,তার পশ্চাতে অন্য একটি কারণ রয়েছে। এভাবে কারণ পরম্পরা শৃঙ্খলের ন্যায় প্রসারিত হতে থাকে। তিনি বলেন ,এভাবে কারণ অনুসন্ধান করে যতই মূলের দিকে যাওয়া যায় ততই কারণের পিরামিডের চূড়া সরু হয়ে আসছে। এতে তিনি মনে করেন যে ,কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যাবে একটা মাত্র কারণ থেকে সকল বস্তুর উৎপত্তি হয়েছে ,যাকে তিনি মূল কারণ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর এ সূত্র ধরে এনাক সিমেনিস ,পিথাগোরাস এবং পরবর্তীতে ডেমোক্রিটাস ,হিউম ,লক ও বার্কলে অবিভাজ্য পরমাণু এর মধ্যে পরম ঐক্যের সন্ধান পান (সরকার ,পৃঃ৪৮ - ৪৯) । এ ধারণা থেকেই মুসলিম দার্শনিকগণ আল্লাহ্ সম্পর্কেCause of all causes তত্ত্বের উন্নতি সাধন করেন। বিংশ শতাব্দীর দার্শনিক বাট্র্যাণ্ড রাসেল অভিজ্ঞতাবাদী ও বাস্তববাদী হওয়া সত্ত্বেও জড়বাদ ও আধ্যাত্মবাদের মাঝামাঝি নিরপেক্ষ একত্ববাদ '- এর প্রচারক ছিলেন। তিনি প্রেমকে জীবনদর্শনের মূল নৈতিক প্রেরণা হিসাবে মেনে নিয়ে এক কল্যাণমুখী বিশ্বমানবতাবাদের বাণী বাহক ছিলেন।(মতীন ,পৃঃ৫)

মুসলিম দর্শনে আল্লাহতত্ত্ব কুরআন থেকেই উদ্ভূত। সাহাবাদের মধ্যে আমিরুল মোমেনিন ব্যতীত আর কেউ সৃষ্টিতত্ত্ব ,আল্লাহ্ তত্ত্ব ইত্যাদি গৃঢ় রহস্যাবৃত বিষয়গুলো নিয়ে দার্শনিক দৃষ্টি ভঙ্গী সম্বলিত বর্ণনা প্রদান করেননি। কুরআনের রহস্যাবৃত আয়াতগুলোতে এসব বিষয়ের ইঙ্গিত রয়েছে। রাসূল (সা.) এ বিষয়গুলো সবিশেষ অবহিত ছিলেন। তাঁর জ্ঞান নগরীর দ্বার আলী ইবনে আবি তালিবকে তিনি নিশ্চয়ই এসব তাত্ত্বিক বিষয়গুলো শিক্ষা দিয়েছিলেন। আলী তাঁর সময়ে এসব তত্ত্ব অতি সংক্ষিপ্তাকারে ব্যক্ত করেছে। এরপর আলীর শিষ্যগণ তাত্ত্বিক বিষয়গুলোর আলোচনায় ব্যাপৃত হতে লাগলো। কুরআনের বেশ কিছু সংখ্যক আয়াতের আধ্যাত্মিক ও ভাববাদী মর্মার্থ নিয়েই তাসাউফের সূচনা হয় এবং তাতে সুফি দর্শনের ধ্যান - ধারণা কতিপয় সাধকের মাধ্যমে তাদের ভক্তগণের তালিমের মধ্য দিয়ে ঐকে বেঁকে চলছিলো। অষ্টম শতকের শেষ দিকে জুনুনুন মিসরি ও জুনায়েদ বাগদাদি নামক দুজন সুফি সাধক এসব বিক্ষিপ্ত ভাবধারাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে সুবিন্যস্ত করেন (রশীদ ,পৃঃ ১০৬ - ১১১) । নবম শতকের প্রথম দিকে বায়েজিদ বোস্তামি ও মনসুর হাল্লাজ সুফি দর্শনের উৎকর্ষ সাধন করেন। বায়েজিদের ফানাতত্ত্ব (বিনাশন) ও হাল্লাজের আনালহকতত্ত্ব আল্লাহ্তত্ত্ব সম্পর্কে আলোড়ন সৃষ্টি করে।(সরকার ,পৃঃ৫ - ৭ ;আলম ,পৃঃ৪৮ - ৬৪) ।

এরপর শায়খুল আকবর ইবনুল আরাবী ওয়াহদাতুল ওজুদ তত্ত্ব ও লগসতত্ত্ব দ্বারা আল্লাহতত্ত্ব ও প্রজ্ঞাতত্ত্বের ব্যাপক যুক্তিতর্ক সম্বলিত আলোচনা তুলে ধরে মুসলিম চিন্তাবিদদের মাঝে প্রবল আলোড়নের সৃষ্টি করেন। তাঁর পূর্বে কোন মুসলিম চিন্তাবিদ লগসতত্ত্ব প্রকাশ করেনি । ইবনুল আরাবীর মতে ,সমগ্র অস্তিত্বশীল সত্তাসমূহের মূলসত্তা একটি - যা ধর্মীয় ভাষায় আল্লাহ। আল্লাহ্ একমাত্র পরম সত্তা। তাঁর মতবাদ সর্বেশ্বরবাদ বলে খ্যাত। তিনি বলেন ,এ বিশ্ব জগৎ আল্লাহ - সত্তাময় ,আল্লাহর নাম ও গুণের প্রকাশ এবং আল্লাহ ও বিশ্বজগৎ অভিন্ন (সরকার ,পৃঃ ৪৬ - ১২০) ,রশীদ ,পৃঃ ২৪২ - ২৪৮ ; আলম ,পৃঃ ৫০১ - ৫১৯ ; ইসলাম ,পৃঃ ১৮৯ - ১৯০) ।

অতঃপর জালালুদ্দিন রূমী প্রেমতত্ত্বের মাধ্যমে সৃফি দর্শনের উৎকর্ষ সাধন করে বলেন ,আল্লাহ সৃষ্টিতে লীন কি সৃষ্টি বহির্ভুত কি এ দুয়ের মধ্যাবস্থা এসব কিছুই নয়। এসব তত্ত্ব দিয়ে আল্লাহর পূর্ণ স্বরূপ জনা যায় না। এসব বিষয়ে বিচার - বুদ্ধি ও বিতর্কমূলক জ্ঞানের প্রয়োজন হয়। ফলে আল্লাহর পূর্ণ স্বরূপ খণ্ডভাবে প্রতিভাত হয়। তাই তিনি জ্ঞানের পথ পরিত্যাগ করে প্রেমের পথ ধরে পরম সত্তার সন্ধান লাভ করেছেন। তিনি বলেন প্রেম ছাড়া আল্লাহকে সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করা অসম্ভব। তাকে পরম প্রেমসত্তারূপেই দেখা যায় (সরকার ,পৃঃ ৩৫৫) । মুসলিম দার্শনিকগণের মধ্যে যারা আল্লাহতত্ত্ব ও সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে বিভিন্নভাবে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন তাদের মধ্যে আল - কিন্দি ,আল - ফারাবী ,ইবনে মাশকাওয়াহ ,ইবনে সিনা ,ইবনে আল -- হায়ছাম ,ইবনে হাজাম ,ইবনে বাজা ,ইবনে রুশদ ,ইমাম গাজ্জালী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

মধ্যযুগে এ উপমহাদেশে খাজা মুঈন উদ্দিন হাসান চিশতি প্রেমতত্ত্বের চূড়ান্ত পর্যায়ে তার 'বাকা ' (One with Allah ) তত্ত্ব প্রচার করেন। তার পরবর্তী সাধক কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকি ,ফরিদ উদ্দিন গঞ্জে শকর ,নিজামুদ্দিন মাহবুবে এলাহি একই তত্ত্ব প্রচার করেন। খাজা মুঈন উদ্দিন হাসান চিশতি এসব তত্ত্ব সর্ব সাধারণ্যে প্রকাশ না করে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্তদের নিকট প্রকাশ করার পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি বলেনঃ

খাল গুইয়ান্দাম মুঈন ইন রমজ বর মিম্বার মাগো ,

আকিন হাজারান ওয়ায়েজ ওয়া মিম্বার বেচুখত ।

অর্থ ? আমি মুঈন পৃথিবীকে বলে দিলাম ,মিম্বারে ওঠে এসব রহস্য প্রকাশ করোনা ,

কারণ এ আগুনেই হাজার হাজার বক্তা ও মিম্বার পুড়ে ছাই হয়ে গেছে (চিশতি ,দেওয়ান - ১৫) ।

বিংশ শতাব্দীর মুসলিম দার্শনিক আল্লামা মোহাম্মদ ইকবাল আল্লাহকে বর্ণনা করেছেন অনন্ত আধ্যাত্মিক পরম অহং (ego ) বলে। এ জগত তাঁর আংশিক অভিব্যক্তি মাত্র। তাঁর মতে আল্লাহ্ একাধারে পরমসত্তা ও পরম স্রষ্টা। আল্লাহ নিজেই পরিপূর্ণ অহং ও পরম আত্মসত্তা স্বরূপ (ইসলাম ,পৃঃ ১৮৬) । বাংলাদেশের দার্শনিক মোহাম্মদ বরকতুল্লাহর ভাষ্যে আল্লামা ইকবালের আল্লাহ্তত্ত্বের চমৎকার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তিনি বলেন ,মানুষ সসীম জ্ঞানের মধ্য দিয়ে অসীমে আত্মসম্প্রসারণের জন্য বড়ই ব্যাকুল। একই বিদ্যুৎপ্রবাহ যেভাবে নগরীর লক্ষ প্রদীপের ভেতর দিয়ে আপনাকে ব্যক্ত করে তেমনি একই মহাপ্রেরণা সমগ্র মানব সমষ্টির ভেতর দিয়ে এক দূর লক্ষ্যের পানে ছুটে চলছে। এই একই চেতনা সত্তা দেশ কালের প্রেক্ষিতে পরিগ্রহ করেছে বহু রূপ ও বিচিত্র প্রকাশ ভঙ্গিমা। একেই নবী - পয়গম্বর ও ভাবুক - সাধকেরা সনাক্ত করেছে। সব কিছুর আদি উৎস ও চূড়ান্ত লক্ষ্য বলে। (ইসলাম ,পৃঃ ১৮৬) ।

যা হোক ,আল্লাহতত্ত্ব নিয়ে দার্শনিকগণের তত্ত্বকথার পর্যালোচনা করা এখানকার বিষয়বস্তু নয় এবং এখানে তা সম্ভবও নয়। এখানে বিষয়টি এজন্য উপস্থাপন করা হয়েছে যে ,নাহাজ আল - বালাঘার বিভিন্ন খোৎবায় আমিরুল মোমেনিন আলী ইবনে আবি তালিব যেভাবে আল্লাহতত্ত্ব ব্যক্ত করেছেন তারই সারকথা বিভিন্ন আঙ্গিকে দার্শনিকগণ ব্যক্ত করেছেন ।

খোৎবা - ২

بَعْدَ انْصِرافِهِ مِن صِفِّينَ:

فلسفه الحمد

أَحْمَدُهُ اسْتِتْماماً لِنِعْمَتِهِ، وَ اسْتِسْلاماً لِعِزَّتِهِ، وَ اسْتِعْصاماً مِنْ مَعْصِيَتِهِ. وَ أَسْتَعِينُهُ فاقَهً الى كِفايَتِهِ؛ انَّهُ لا يَضِلُّ مَنْ هَداهُ، وَ لا يَئِلُ مَنْ عاداهُ، وَ لا يَفْتَقِرُ مَنْ كَفاهُ. فَانَّهُ أَرْجَحُ ما وُزِنَ، وَ أَفْضَلُ ما خُزِنَ. وَ أَشْهَدُ أَنْ لا الهَ الا اللّهُ وَحْدَهُ لا شَرِيكَ لَهُ، شَهادَهً مُمْتَحَنا اخْلاصُها، مُعْتَقَدا مُصاصُهِّا، نَتَمَسَّكُ بِها أَبَدا ما أبْقانا، وَنَدَّخِرُها لأَهاوِيلِ ما يَلْقانا، فِانَّها عَزِيمَهُ الايمانِ، وَ فاتِحَهُ الاحْسانِ وَ مَرْضاةُ الرّحمنِ، وَ مَدْحَرَةُ(مهلکة) الشِّيْطانِ.

خصئص رسول اللهصلى‌الله‌عليه‌وآله‌وسلم

وَ أَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدا عَبْدُهُ وَ رَسُولُهُ، أَرْسَلَهُ بِالدِّينِ الْمَشْهُورِ، وَ الْعِلْمِ المَأثُورِ وَ الْكِتابِ الْمَسْطُورِ، وَ النُّورِ السّاطِعِ، وَ الضِّيأِ اللامِعِ، وَ الْأَمْرِ الصّادِعِ، اِزاحَهً لِلشُّبُهاتِ، وَ احْتِجاجا بِالبَيِّناتِ، وَ تَحْذِيرا بِالْآياتِ، وَ تَخْوِيفا بِالمُثلاتِ

وصف الجاهلیّة

وَ النّاسُ فِى فِتَنٍ انْجَذَمَ(انحدم) فِيها حَبْلُ الدِّينِ، وَ تَزَعْزَعَتْ سَوارِى الْيَقينِ، وَ اخْتَلَفَ النَّجْرُ وَ تَشَتَّتَ الْأَمْرُ، وَ ضاقَ الْمَخْرَجُ وَ عَمِىَ الْمَصْدَرُ، فَالْهُدى خامِلٌ، وَ الْعَمى شامِلٌ. عُصِىَ الرَّحْمنُ، وَ نُصِرَ الشَّيْطانُ، وَ خُذِلَ الْإ يمانُ، فَانْهارَتْ دَعائِمُهُ، وَ تَنَكَّرَتْ مَعالِمُهُ،(اعلامه) وَ دَرَسَتْ سُبُلُهُ، وَ عَفَتْ شُرُكُهُ. أَطاعُوا الشَّيْطانَ فسَلكُوا مَسالِكَهُ، وَ وَرَدُوا مَناهِلَهُ، بِهِمْ سارَتْ أَعْلامُهُ، وَ قامَ لِواؤُهُ فِى فِتَنٍ داسَتْهُمْ بِأَخْفافِها، وَ وَطِئَتْهُمْ بِأَظْلافِها، وَ قامَتْ عَلى سَنابِكِها، فَهُمْ فِيها تائِهُونَ حائِرونَ جاهِلُونَ مَفْتُونُونَ، فِى خَيْرِ دارٍ، وَ شَرِّ جِيرانٍ. نَوْمُهُمْ سُهُودٌ(سهاد) ، وَ كُحْلُهُمْ دُمُوعٌ، بِأَرْضٍ عالِمُها مُلْجَمٌ، وَ جاهِلُها مُكْرَمٌ.

فضائل عترة النَّبِىَصلى‌الله‌عليه‌وآله‌وسلم

هُمْ مَوْضِعُ سِرِّهِ، وَ لَجَأُ أَمّرِهِ، وَ عَيْبَهُ عِلْمِهِ، وَ مَوئِلُ حُكْمِهِ، وَ كُهُوفُ كُتُبِهِ، وَ جِبالُ دِينِه، بِهِمْ أَقامَ انْحِنأَ ظَهْرِهِ، وَ أَذْهَبَ ارْتِعادَ فَرائِصِهِ.

أعمال الْمُنحرفین

زَرَعُوا الْفُجُورَ، وَ سَقَوْهُ الْغُرُورَ، وَ حَصَدُوا الثُّبُورَ.

لا يُقاسُ بِآلِ مُحَمَّدٍصلى‌الله‌عليه‌وآله‌وسلم مَنْ هذِهِ الامَّهِ أَحَدٌ، وَ لا يُسوَّى بِهِمْ مَنْ جَرَتْ نِعْمَتُهُمْ عَلَيْهِ أَبَداً. هُمْ أَساسُ الدِّينِ، وَ عِمادُ الْيَقينِ. إلَيْهِمْ يَفِى ءُ الْغالِى، وَ بِهِمْ يِلْحَقُ التّالِى. وَ لَهُمْ خَصائِصُ حَقِّ الْوِلايَةِ، وَ فِيهِمْ الْوَصِيَّةُ وَ الْوِراثَةُ؛ الآنَ إذْرَجَعَ الْحَقُّ إلَى أهلِهِ، وَ نُقِلَ الى مُنتَقَلِهِ!

সিফফিন থেকে ফেরার পর এ খোৎবা দিয়েছিলেন।

আল্লাহর প্রশংসা

আমি আল্লাহর প্রশংসা করি তাঁর পরিপূর্ণ নেয়ামতের আশায় ,তার ইজ্জতের প্রতি আত্মসমর্পণের জন্য এবং পাপ থেকে নিরাপত্তা পাওয়ার আশায়। আমি তার সাহায্যের জন্য মিনতি করি যেহেতু প্রয়োজনে তার সাহায্যই যথেষ্ট ! তিনি যাকে হেদায়েত প্রদান করেন। সে কখনো বিপথগামী হয় না ; আর যার প্রতি তিনি বিরূপ হন তার কোন প্রতিরক্ষা নেই। যাকে তিনি দয়া করেন সে সকল প্রয়োজনের উর্দ্ধে থাকে। তাঁর প্রশংসা সব কিছু থেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং সকল সম্পদ থেকে মূল্যবান।

নবী (সা .)এর বৈশিষ্ট্য

আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে ,এক আল্লাহ্ ব্যতীত আর কোন মা ’ বুদ নেই। তাঁর কোন সাদৃশ্য নেই। এ সাক্ষ্য এমন এক ব্যক্তির যার এখলাছ পরীক্ষিত এবং এর মূল উপাদান আমাদের ইমান যা বিশ্বস্ত (মো ’ তাকাদ) হয়েছে। যত দিন তিনি আমাদের জীবিত রাখেন। ততদিন আমরা এ বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে রাখবো এবং কঠোর দুঃখ - দুর্দশা দ্বারা আমরা আক্রান্ত হলে তা মোকাবেলা করার জন্য এ বিশ্বাস পুঞ্জিভূত করে রাখবো। কারণ এটা ইমানের মূল ভিত্তি এবং কল্যাণকর কর্ম ও ঐশী সন্তুষ্টির প্রথম সোপান। এটা শয়তানকে দূরে সরিয়ে রাখার উপায়।

আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে ,মুহাম্মদ (সা.) তার বান্দা ও রাসূল। অতি বিশিষ্ট দ্বীন ,মো ’ জেজা ,সংরক্ষিত দলিল ,দীপ্তিশীল নূর ,জ্বলজ্বলে ঔজ্জ্বল্য ,সন্দেহ - নাশক চুড়ান্ত নির্দেশাবলী ,বিদ্যমান সুস্পষ্ট প্রমাণাদি ,আল্লাহর আয়াতসমূহ দ্বারা ভীতি প্রদর্শন ও পাপের শাস্তির সতর্কাদেশসহ আল্লাহ তাকে প্রেরণ করেছেন। সে সময়ে মানুষ ছিল ফেতনা - ফ্যাসাদে লিপ্ত এবং তাতে দ্বীনের রাজ্জু ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল ,ইয়াকিনের স্তম্ভসমূহ আলোড়িত হয়ে পড়েছিল ,নৈতিক মূল্যবোধ অন্ধকারের অতল তলে তলিয়ে গিয়েছিল ,নিয়ম - শৃংখলা ওলট - পালট হয়ে পড়েছিল ,প্রারম্ভ ছিল ক্ষীণ ,পথ ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন ,হেদায়েত ছিল অজানা এবং অজ্ঞতা (জাহেলিয়াত) ছিল বিরাজমান।

জাহেলী যুগের পরিচয়

মানুষ আল্লাহর অবাধ্য হয়ে শয়তানের সমর্থক হয়ে পড়েছিল এবং ইমান পরিত্যক্ত বিষয় ছিল। ফলে দ্বীনের স্তম্ভ ধ্বসে পড়েছিল। ইমানের সামান্য চিহ্নও দেখা যাচ্ছিলো না ; এর সকল পথ বিনষ্ট হয়ে পড়েছিল এবং প্রকাশ্য রাস্তাসমূহ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছিল। মানুষ আল্লাহর নাফরমানি করে শয়তানের অনুগত হয়ে পড়েছিল এবং শয়তানের পথ অনুসরণ করছিলো। শয়তানের জলাধার থেকে পানি সংগ্রহে মানুষ আগ্রহান্বিত ছিল। এসব মানুষের মাধ্যমে শয়তানের বিজয় পতাকা উড্ডিয়মান হয়েছিল এবং এরাই মানুষকে ফেতনা - ফ্যাসাদের দিকে ঠেলে দিয়েছিলো। ফলে মানুষ এদের খুরের নিচে দলিত হয়েছিল এবং এরা মানুষের ওপর দাম্ভিক পদভরে দাঁড়িয়েছিলো। অনৈতিকতা পায়ের আঙ্গুলে ভর করে দাঁড়িয়েছিলো। মানুষ সম্পূর্ণরূপে পথভ্রষ্ট ,জটিল ,অজ্ঞ ও বিপথগামী হয়ে পড়েছিল ; যেন তারা কল্যাণকর ঘরের (কাবা) । কুপ্রতিবেশী (কুরাইশ) । নিদ্রার পরিবর্তে তারা ছিল জাগ্রত এবং তাদের চোখে সুর্মার পরিবর্তে ছিল পানি। তারা এমন এক সমাজ ব্যবস্থায় ছিল যেখানে জ্ঞানীগণ ছিল লাগাম পরিহিত এবং অজ্ঞরা ছিল সম্মানিত ।

আহলে বাইতের মর্যাদা

জেনে রাখো - রাসূলের আহলুল বাইত হলো আল্লাহর গুপ্ত বিষয়ের (সির্র) ধারক ,আল্লাহ সম্পর্কীয় জ্ঞানের মূলাধার ,প্রজ্ঞার কেন্দ্রবিন্দু ,আল্লাহর কিতাবের উপত্যকা ও তাঁর দ্বীনের পর্বত। তাদের মাধ্যমেই আল্লাহ তার দ্বীনের বক্রপিঠ সোজা করলেন এবং দ্বীনের অঙ্গ - প্রত্যঙ্গের কম্পমান অবস্থা দূরীভূত করলেন।

দুষ্কৃতকারীদের বৈশিষ্ট্য

মনে রেখো - মোনাফেকগণ পাপ কর্ম ও অধার্মিকতা বপন করেছে এবং তাতে প্রবঞ্চনারূপ পানি সিঞ্চন করেছে ; ফলতঃ নিজেদের ধ্বংস রূপ ফসল কর্তন করেছে। ইসলামি উম্মাহর কাউকে আহলুল বাইতের সমকক্ষ হিসাবে গ্রহণ করা যাবে না। কেউ তাদের অনুগ্রহভাজন হয়ে থাকলেও তাকে তাদের সমতুল্য মনে করা যাবে না। তাঁরা হলেন দ্বীনের ভিত্তিমূল ও ইমানের স্তম্ভ। তাদেরকে কেউ ডিঙ্গিয়ে যেতে চাইলে আবার ফিরে আসতে হয় তাদের কাছে। আবার যারা পশ্চাতে পড়ে থাকে তারা তাদেরকে অনুসরণ করতে হয়। মূলত তাঁরা রাসূলের বেলায়েতের অধিকারের প্রধান বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। রাসূলের আমানত ও উত্তরাধিকার তাঁদেরই অনুকূলে। কাজেই ন্যায় ও সত্যের অনুসারীগণকে তাদের দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে।

__________________

১। রাসূলের (সা.) আহলুল বাইত সম্পর্কে আমিরুল মোমেনিন বলেন যে ,বিশ্বের কোন ব্যক্তিকে আহলুল বাইতের সমকক্ষতায় আনা যাবে না এবং মহত্ত্বে তাদের সমতুল্য কাউকে মনে করা যাবে না। কারণ এ বিশ্ব তাদের অনুগ্রহে ভরপুর। তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত হেদায়েত ও দিক নির্দেশনার মাধ্যমেই বিশ্ব চিরন্তন নেয়ামত পেতে পারে। তারা হলেন দ্বিনের ভিত্তি ও দু দেয়ালের সংযোগ স্থাপক প্রস্তর। তাঁরা হলেন দ্বিনের বাঁচার জন্য পুষ্টিকর খাদ্য স্বরূপ। তারা ইমান ও প্রজ্ঞার এমন শক্তিধর স্তম্ভ যে ,সংশয় ও অজ্ঞতার যে কোন ঝড় ফিরিয়ে দিতে পারেন। তাঁরা অতিবর্তী ও পশ্চাদবর্তী পথ সমূহের মধ্যে এমন এক মধ্যপথ যে পথে না আসা পর্যন্ত কেউ ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। বেলায়েত ও নেতৃত্রে অধিকারের বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্ব তাদের আছে। ফলে উম্মাহর অভিভাবকত্ব ও পৃষ্ঠপোষকতা করার অধিকার আর কারো নেই। এ কারণেই রাসূল (সা.) তাদেরকে তাঁর উত্তরাধিকারী ও তার বেলায়েতের অধিকারী বলে ঘোষণা করেছিলেন। ইবনে আবিল হাদীদ লেখেছেন যে ,উত্তরাধিকার বুঝায় না ; যদিও শিয়াগণ এরকম ব্যাখ্যাই করে থাকেন। এ উত্তরাধিকার দ্বারা রাসূলের শিক্ষার উত্তরাধিকার বুঝায়। হাদীদের মতো গ্রহণ করলেও রাসূলের শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনের প্রয়োজনীয়তার কারণে খেলাফতের দায়িত্ব অন্য কারো ওপর বর্তায় না। কারণ শিক্ষা প্রদান খেলাফতের অত্যাবশ্যকীয় শর্ত। রাসূলের (সা.) খলিফার প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ন্যায় বিধান করা ,ধর্মীয় আইনে সমস্যাদির সমাধান করা ,জটিল বিষয়ের ব্যাখ্যা প্রদান ও ধর্মীয় দণ্ডসমূহের প্রয়োগ করা। যদি রাসূলের ডেপুটি থেকে এ সমস্ত বিষয় সরিয়ে নেয়া হয় তবে তার অবস্থান রাজ্য শাসকের (দুনিয়াদার শাসক) পর্যায়ে নেমে আসবে। ধর্মীয় কর্তৃত্বের কিলক হিসাবে তাকে আর গ্রহণ করা যাবে না। সুতরাং হাদীদের ব্যাখ্যা ভিত্তিহীন। রাসূলের (সা.) আছিয়াত খেলাফত ব্যতীত অন্য কিছুর জন্য নয়। বেলায়েত দ্বারা সম্পদ ও জ্ঞানের উত্তরাধিকার বুঝায় না - সঠিক নেতৃত্বকে বুঝায় ; যা আহলুল বাইত হওয়ার কারণে আল্লাহ নিজেই গুণাবলীর পরিপূর্ণতা দান করেছেন।


4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18