ইসলাম ও শীয়া মাযহাব

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব 16%

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 31 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 41883 / ডাউনলোড: 5859
সাইজ সাইজ সাইজ
ইসলাম ও শীয়া মাযহাব

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

‘ইসলাম ও শীয়া মাযহাব’ নামক এ গ্রন্থে ইসলামের দু’টি বৃহৎ উপদলের (শীয়া ও সুন্নী) অন্যতম শীয়া মাযহাবের প্রকৃত পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে । শীয়া মাযহাবের উৎপত্তি, বিকাশ ও চিন্তাধারার প্রকৃতি এবং ইসলামী জ্ঞানের ব্যাপারে শীয়া মাযহাবের দৃষ্টিভঙ্গী এ বইয়ে আলোচিত হয়েছে ।

কুরআনের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ দিক

ইতিপূর্বেই আমরা জেনেছি যে , পবিত্র কুরআন তার শাব্দিক বর্ণনার মাধ্যমে স্বীয় দ্বীনি উদ্দেশ্যকে সুস্পষ্ট রূপে তুলে ধরে মৌলিক বিশ্বাস ও ব্যবহারিক বিষয়ে জনগণকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে থাকে । তবে পবিত্র কুরআনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য কেবল এরই মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় । বরং পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত এসব বাহ্যিক শব্দাবলীর কাঠামোতে এবং ঐসব উদ্দেশ্যের অন্তরালে এক সুগভীর ও প্রশস্ততর আধ্যাত্মিক অর্থ ও উদ্দেশ্য বিরাজমান । কুরআনের ভিতর আপাতঃ লুকায়িত ঐসব গভীর আধ্যাত্মিক বিষয় শুধুমাত্র আত্মশুদ্ধিকৃত পবিত্র হৃদয়ের অধিকারীদের কাছেই বোধগম্য । পবিত্র কুরআনের ঐশী শিক্ষক মহানবী (সা.) বলেছেন : পবিত্র কুরআনে সুন্দর ও শুভপরিণতি সম্পন্ন একটি বাহ্যিক দিক ও সুগভীর এক আভ্যন্তরীণ দিক রয়েছে ।১১৪

মহানবী (সা.) আরও বলেছেন : পবিত্র কুরআনের একটি অভ্যন্তরীণ দিক রয়েছে , সেই অভ্যন্তরের ও অভ্যন্তরীণ দিক রয়েছে । এভাবে কুরআন সাতটি অভ্যন্তরীণ দিকের অধিকারী ।১১৫ পবিত্র আহলে বাইতগণও (আ.) তাদের হাদীসে কুরআনের ঐ আভ্যন্তরীণ দিক সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন ।১১৬ উপরোল্লিখিত হাদীস সমূহের মূলভিত্তি হচ্ছে কুরআনের সূরা আর রা দের ১৭ নম্বর আয়াত ,ঐ আয়াতে মহান আল্লাহ ঐশী রহমতর্ক বৃষ্টির সাথে তুলনা করেছেন , যা আকাশ থেকে অবতির্ণ হয় । আর ঐ বৃষ্টির উপরই নির্ভরশীল হল ভূপৃষ্ঠ ও তার অধিবাসীদের জীবন ধারণ শক্তি । ভূপৃষ্ঠের বর্ষিত ঐ বৃষ্টিধারা স্রোতাকারে প্রবাহিত হয় এবং তার প্রবাহ পথের স্থানসমূহ নিজ নিজ ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী ঐ জল প্রবাহ থেকে কিছুটা গ্রহণ ও ধারণ করে এবং প্রবাহ সৃষ্টি করে । ঐ জল প্রবাহের উপরিভাগ যদিও প্রচুর ফেনা দ্বারা আচ্ছাদিত থাকে তথাপি তার তলদেশে রয়েছে সেই মৃতসঞ্জীবনী পানি , যা মানব জাতির জন্য অত্যন্ত উপকারী । পবিত্র কুরআনে উদ্ধৃত এই উদাহরণটি সেই ঐশী জ্ঞানধারার প্রতি ইংগিত করছে । যা থেকে মানুষ তার নিজ নিজ বোধশক্তি অনুসারে অর্জন ও ধারণ করে উপকৃত হতে পারে । আর ঐ ঐশী জ্ঞান মানুষের আধ্যাত্মিক মৃতসঞ্জীবনী স্বরূপ , যা গ্রহণ ও ধারণের মাত্রা ব্যক্তি বিশেষে পার্থক্য হয় । এ পৃথিবীতে এমন অনেক লোক আছে যারা , সম্পূর্ণ রূপে জড়বাদী । জড়বস্তু এবং পৃথিবীর এ নশ্বর জড়জীবন ছাড়া আর কিছুর মৌলিকত্বেই তারা বিশ্বাস করে না । এ পার্থিব ষড়রিপুর তাড়নার দাসত্ব ছাড়া জীবনে অন্য কিছুতেই তারা মন দেয় না । পার্থিব ক্ষতি ছাড়া তারা আর কিছুকেই ভয় পায় না । অবশ্য এরা ব্যক্তি বিশেষে বিভিন্ন ধরণের অবস্থার অধিকারী । ঐশী জ্ঞানমালা থেকে এরা খুব বেশী যেটুক উপকৃত হয় , তা হল , মৌলিক বিশ্বাস সংক্রান্ত বিষয়ে এরা মোটামুটি ভাবে একটা ধারণা গ্রহণ বা বিশ্বাস করে । আর ইসলামের ব্যবহারিক আইনগুলোকে অত্যন্ত শুষ্কভাবে এরা পালন করে । অবশেষে এরা এক আল্লাহকে পরকালীন পুরুস্কারের লাভে এবং পরকালীন শাস্তির ভয়ে উপাসনা করে । আবার এমন অনেক লোকও আছে , যারা তাদের হৃদয়ের স্বচ্ছতা ও খোদাপ্রদত্ত স্বভাবজাত সততার কারণে পার্থিব জীবনের ক্ষণকালীন আরাম আয়েশের প্রতি কখনও আসক্ত হয় না । জীবনের লাভ-ক্ষতি , মিত্রতা ও তিক্ততা তাদের জন্য প্রতারণামূলক কল্পনা বৈ আর কিছুই নয় । প্রাগৈতিহাসিক জাতিসমূহের স্মরণ , যা অতীতের দুনিয়ালোভীদের ইতিহাস এবং আজকের গল্প স্বরূপ , তা তাদের জন্য গ্রহণযোগ্য শিক্ষা বৈ কিছুই নয় । আর ঐতিহাসিক শিক্ষা তাদের হৃদয়ে সবসময় এক প্রেরণাদায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে । স্বাভাবিকভাবেই তাদের পবিত্র হৃদয়গুলো সেই অবিনশ্বর জগতের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে থাকে । এ নশ্বর পৃথিবীর বৈচিত্রময় সৃষ্টিনিচয়কে তারা সর্ব শক্তিমান আল্লাহর নিদর্শনের দৃষ্টিতেই পর্যবেক্ষণ করে মাত্র । এছাড়া এসব পার্থিব বিষয়কে তারা কখনো মৌলিক ও সার্বভৌম বলে বিশ্বাস করে না । আর তখন এ আকাশ ও পৃথিবীতে অবস্থিত সব স্রষ্টার অন্তহীন ও মহত্বের নিদর্শনবাহী নতুন এক ঐশীজগতের রহস্যের দ্বার তাদের প্রানে খুলে যায় । তখনই তারা আত্মিক উপলদ্ধির চক্ষু দিয়ে সর্বস্ব অবলোকন করে । তাদের পবিত্র হৃদয়গুলো এ সৃষ্টিজগতের মূলরহস্য উপলদ্ধির প্রতি নিবদ্ধ হয়ে যায় । তখন এ পৃথিবীর লালসা আত্মলিপ্সার সংকীর্ণতায় বন্দী না হয়ে তাদের হৃদয়গুলো অন্তহীন ও মুক্ত মহাকাশে পাখা মেলে উড়তে থাকে । যখন তারা ঐশী ওহী মারফৎ শুনতে পায় যে , সর্বশক্তিমান আল্লাহ মূর্তি পূজাকে নিষিদ্ধ করেছেন ; তখন এ থেকে তারা বুঝতে পারে যে , একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো আনুগত্য করা যাবে না । কারণঃ দাসত্ব ও মাথানত করাই আনুগত্যের নিগুঢ় অর্থ । এছাড়া তারা এটাও বুঝে যে , একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় করা যাবে না এবং আর কারো প্রতি আশাও করা যাবে না । এর পর তারা এটাও বুঝতে সক্ষম হয় যে , প্রবৃত্তির চাহিদার কাছে আত্মসমর্পণ করা যাবে না । আর একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর অন্য কারো প্রতি মনোনিবেশ করা যাবে না । একইভাবে যখন তারা শুনতে পায় যে , পবিত্র কুরআন নামায আদায়ের নির্দেশ দিয়েছে , যার বাহ্যিকরূপ হচ্ছে একটি বিশেষ প্রকৃতির উপাসনা ; তখন তারা ঐ কুরআনের আদেশের মর্মার্থ স্বরূপ কায়মনো বাক্যে মহান আল্লাহর প্রতি আত্মনিবেদনের মাধ্যমে প্রার্থনা করাকেই বোঝায় , শুধু তাই নয় , তারা সত্যের সম্মুখে নিজেকে একেবারেরই হীন ও নগন্য মনে করে এবং সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে একমাত্র আল্লাহর স্মরণেই নিমগ্ন থাকাকে শ্রেয় বলে বিশ্বাস করে । এটা স্পষ্ট যে , উপরোল্লিখিত আদেশ ও নিষেধের উদাহরণই্ আধ্যাত্মিকতার অর্থ বহন করে না । তবে ঐ আধ্যাত্মিক তত্ব উপলদ্ধি একমাত্র তাদের দ্বারাই সম্ভব , যারা উদার দৃষ্টি ও চিন্তার অধিকারী এবং বিশ্ব দর্শনকে আত্মকেন্দ্রিক সংকীর্ণ দর্শনের উপর অগ্রাধিকার দেয় । পূ্র্বোক্ত আলোচনার মাধ্যমে পবিত্র কুরআনের বাহ্যিক ও আধ্যাত্মিক অর্থ অনেকটা স্পষ্ট হয়েছে । আর এটাও স্পষ্ট হয়েছে যে , কুরআনের নিগুঢ় আত্মিক অর্থ তার বাহ্যিক অর্থকে বাতিল করে না । বরং কুরআনের নিগূঢ় আধ্যাত্মিক অর্থ কুরআনের আত্মার মত । এটা দেহস্থিত আত্মার ন্যায় যা দেহের সঞ্জীবনী শক্তি স্বরূপ । ইসলাম একটি সার্বজনীন ও অনন্ত ধর্ম , ইসলাম সমাজ সংশোধনের বিষয়টিকে সবার উপরে অগধিকার দেয় । ইসলামের বাহ্যিক আইনসমূহ যা সমাজ সংস্কারক স্বরূপ । আর এর সহজ মৌলিক বিশ্বাস সমূহ যা এসব বাহ্যিক আইন সমূহের সংরক্ষকও প্রহরী স্বরূপ এগুলো সবই চির অপরিবর্তনশীল । আমরা দেখতে পাই যে , অনেক সমাজের লোকেরা বিশ্বাস করে যে , মানুষের হৃদয় পবিত্র হওয়াই বড় কথা তার কার্যক্রমের প্রকৃতির কোন গুরূত্ব নেই । তাই সে সমাজের লোকেরা এক অরাজকতাপূর্ণ ও উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করে । তাহলে এটা কি করে সম্ভব যে , এ ধরনের বিচ্ছৃঙ্খল জীবন-যাপনের মাধ্যমে তারা জীবনে সফল ও সৌভাগ্যবান হবে ? কিন্তু অপবিত্র কথন ও অসদাচরণের মাধ্যমে অন্তরের পবিত্রতা রক্ষা করা কি করে সম্ভব ? অপবিত্র ও নোংরা চরিত্র ও কথন থেকে পবিত্র হৃদয়ের পস্ফুটন সম্ভব কি ? তাই মহান আল্লাহ বলেছেন : উৎকৃষ্ট শহর , তার ফসল তারই প্রতিপালকের নির্দেশে (ভাল পরিমান) উৎপন্ন হয় এবং যা নিকৃষ্ট তাতে অল্পই ফসল উৎপন্ন হয় । (সূরা আল্ আ রাফ ৫৮ নং আয়াত) । অর্থাৎ পবিত্র উৎস থেকেই পবিত্রের জন্ম আর অপবিত্রদের উৎস হল অপবিত্র । পূ্র্বোক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে , পবিত্র কুরআনের একটি বাহ্যিক ও একটি আত্মিকরূপ রয়েছে । ঐ আত্মিকরূপেরও আবার বহু স্তর রয়েছে । একইভাবে পবিত্র কুরআনের ব্যাখাকারী হাদীসেরও ঐ একই ধরণের স্তর বিন্যাস রয়েছে ।

কুরআনের তা উইল

ইসলামের প্রাথমিক যুগে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অনুসারীদের অধিকাংশের মধ্যে কুরআনের ব্যাপারে একটি বিশ্বাস ব্যাপক ভাবে প্রচলিত ছিল । আর তা হল এই যে , কোথাও যদি উপযুক্ত দলিল পাওয়া যায় , তাহলে কুরআনের কোন আয়াতের প্রচলিত বাহ্যিক অর্থকে ত্যাগ করে তার বিরোধী অর্থকেও সেক্ষেত্রে গ্রহণ করা যেতে পারে । এভাবে কুরআনের কোন আয়াতের বাহ্যিক অর্থকে তার বিরোধী অর্থে রূপান্তরিত করাকেই তা উইল বলা হয় । আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের ধর্মীয়গ্রন্থ সমূহ এবং বিভিন্ন ধর্মীয় বিতর্কের ঘটনা সম্বলিত গ্রন্থসমূহে এ ঘটনাটি ব্যাপক হারে পরিলক্ষিত হয় । যেমন : ধর্মীয় কোন একটি বিষয়ে যদি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অধিকাংশ আলেমগণ একমত হন , আর তা যদি পবিত্র কুরআনের এক বা একাধিক আয়াতের বাহ্যিক অর্থের পরিপন্থিও হয় তাহলে কুরআনের ঐ আয়াত বা আয়াত সমূহের বাহ্যিক অর্থকে রূপান্তরিত করেন । এভাবে অন্য কোন দলিল দ্বারাও যদি কুরআনের আয়াত বা আয়াতসমূহের বাহ্যিক অর্থের পরিপন্থি কোন বিষয় প্রমাণিত হয় , তাহলে কুরআনের ঐ বাহ্যিক অর্থকে প্রয়োজনবোধে রূপান্তরিত করেন । এমনকি অন্য সময় দেখা গেছে যে , পরস্পর বিবাদমান দু পক্ষ নিজেদের মতামত প্রমাণের স্বার্থে এক বা একাধিক কুরআনের আয়াতর্ক পরস্পর বিরোধী অর্থে রূপান্তরিত (তা উইল) বা ব্যাখা করেছে । এমনকি দুঃখজনক ভাবে , এধরণের আচরণে শীয়ারাও কম-বেশী কিছুটা আক্রান্ত হয়েছে । যার উদাহরণ শীয়াদের বেশ কিছু কালাম (মৌলিক বিশ্বাস সংক্রন্ত) শাস্ত্র গ্রন্থে পরিলক্ষিত হয় । কিন্তু যে বিষয়টি পবিত্র কুরআন ও আহলে বাইতগণের (আ.) হাদীস সুগভীর ভাবে পর্যালোচনার মাধ্যমে অর্জিত হয় , তা হল পবিত্র কুরআনের সুস্পষ্ট , বোধগম্য ও সুমধুর বর্ণনা পদ্ধতির মধ্যে কখনও জটিল ও ধাধাঁ সদৃশ্য পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়নি । পবিত্র কুরআন তার বিষয়বস্তু শাব্দিক কাঠামোর গণ্ডি ছাড়া অন্য কোন মাধ্যমে তা জনগণের কাছে বর্ণনা করেনি । কিন্তু পবিত্র কুরআনের তা উইল বলতে যা বোঝানো হয়েছে , তা কোন শাব্দিক অর্থের ব্যাপার নয় । বরং তা এমন কিছু নিগুঢ় রহস্য , যা সাধারণ মানুষের উপলদ্ধির উর্দ্ধে । আর ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস ও ব্যবহারিক বিধান সংক্রান্ত জ্ঞান তা থেকেই উৎসরিত । হা , কুরআনের সর্বত্রই তা উইলের অস্তিত্ব বিদ্যমান । তবে সাধারণ চিন্তাভাবনার মাধ্যমে সরাসরি তা অনুধাবন করা সম্ভব নয় । আর শব্দের মাধ্যমে তা বর্ণনার যোগ্যও নয় । শুধুমাত্র আল্লাহর নবীগণ ও এবং সকল মানবীয় দোষ-ত্রুটি মুক্ত পবিত্র হৃদয়ের অধিকারী আল্লাহর নৈকট্য প্রাপ্ত আওলিয়াগণ কুরআনের তা উইল করতে সক্ষম । তারা আত্মিক দর্শনের মাধ্যমে কুরআনের তা উইলের নিগূঢ়তত্ব অর্জন করেন । কেয়ামতের দিন কুরআনের প্রকৃত তা উইলের বিষয়টি সকল মানুষের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে । ব্যাখ্যাঃ এটা সবারই জানা যে , মানুষ তার সামাজিক জীবনের বিভিন্ন পার্থিব প্রয়োজন মেটানোর স্বার্থে ভাষার বিভিন্ন শব্দসমূহ ব্যাবহার করতে বাধ্য হয়েছে । সামাজিক জীবন যাপনের ক্ষেত্রে মানুষ তার স্বজাতির কাছে নিজের মনোভাব প্রকাশ করতে বাধ্য । এ জন্যেই সে শব্দ ও তার কানের সাহায্য কামনা করতে বাধ্য হয় । কখনও বা কমবেশী চোখের ইশারার সাহায্যও তাকে নিতে হয় । আর এ কারণেই আমরা দেখতে পাই যে , একজন বধির ব্যক্তি কখনও একজন অন্ধব্যক্তির সাথে যোগাযোগ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় না । কারণঃ একজন অন্ধ যা কিছু বলে , বধির ব্যক্তি তা শুনতে পায় না । আবার বধির ব্যক্তি তার হাতের ইশারায় যা কিছু বুঝাতে চায় , অন্ধব্যক্তি তা দেখতে পায় না । তাই কোন জিনিসের নাম করণ ও ভাষা সৃষ্টির ক্ষেত্রে পার্থিব প্রয়োজন মেটানোর স্বার্থই কার্যকর ছিল । বিভিন্ন বস্তু , অবস্থা ও পরিবেশর জন্য শব্দ রচিত হয় , যা আমাদের পঞ্চেন্দ্রীয় শক্তি দ্বারা নির্ভরযোগ্য । তাই আমাদের প্রতিপক্ষ যদি পঞ্চেন্দ্রীয়ের কোন একটিরও অভাব ঘটে এবং আমারা যদি ঐ বিশেষ ইন্দ্রিয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত কোন একটি শব্দের অর্থ তাকে বোঝাতে চাই , তাহলে তা আমাদের জন্য সমস্যার কারণ হয়ে দাড়ায় । তখন ঐ নির্দিষ্ট বিষয়টি প্রতিপক্ষকে বোঝানোর জন্য আমরা বিভিন্ন ধরণের উদাহরণের আশ্রয় গ্রহণ করি । তবুও সংশ্লিষ্ট ইন্দ্রিয় বিহীন প্রতিপক্ষকে ঐ বিশেষ শব্দ বা বিষয়টি বোঝানো সহজ হয় না । যেমনঃ কোন জন্মান্ধকে যদি আমরা আলো বা রংয়ের ব্যাপারটি বোঝাতে চেষ্টা করি , বা কোন অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশুকে যদি যৌন সুখের বিষয়টি বোঝাতে চাই , তাহলে আমাদের বহু তুলনা মূলক উদাহরণের আশ্রয় নিতে হয় । তেমনি এ বিশ্ব জগতের এমন অনেক অজড় বিষয়ের অস্তিত্ব আছে , যা জড় জগতের সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত । আর প্রতি যুগেই এই মানবজাতির মধ্যে হাতে গোনা অল্প ক জন ছাড়া কেউই ঐ অজড় জগত অবলোকন ও উপলদ্ধি করতে সক্ষম হয়নি । আর ঐ অজড় জগতের বিষয়াদি শব্দাবলীর কাঠামোত বর্ণনা করা বা সাধারণ চিন্তাশক্তি দিয়ে তা অনুধাবন ও উপলদ্ধি করা আদৌ সম্ভব নয় । শুধুমাত্র তুলনামুলক ও সদৃশ্যসম কিছু উদাহরণ উত্থাপণ ছাড়া ঐসব বিষয়ের প্রতি ইংগিত করা সম্ভব নয় ।

মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন : আমি একে অবতির্ণ করেছি কুরআনরূপে , আরবী ভাষায় , যাতে তোমরা বুঝতে পার । নিশ্চয়ই এ কুরআন আমার কাছে সমুন্নত অটল রয়েছে লওহে -মাহফুজে । (সূরা আল্ যুখরূফ , ৩ ও ৪ নং আয়াত ।)

মহান আল্লাহ আরও বলেছেন : নিশ্চয়ই এটা সম্মানিত কুরআন , যা আছে গোপন কিতাবে , যারা পবিত্র তারা ব্যতীত অন্য কেউ একে স্পর্শ করবে না । (সূরা আল্ ওয়াকিয়াহ , ৭৭থেকে ৭৯ নং আয়াত ।)

একইভাবে মহানবী (সা.) ও তার পবিত্র আহলে বাইতগণ (আ.) সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেছেনঃ হে আহলে বাইত মহান আল্লাহ চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণ রূপে পূতপবিত্র করতে । (সূরা আল্ আহযাব , ৩৩ নং আয়াত ।)

উপরোল্লিখিত আয়াতসমূহের প্রকৃত ও গূঢ়অর্থ উপলদ্ধি করতে সাধারণ মানুষ অক্ষম । শুধুমাত্র আল্লাহর দ্বারা পবিত্র ব্যক্তিগণ ছাড়া রহস্য উপলদ্ধি অন্যদের দ্বারা সম্ভব নয় । আর আল্লাহর রাসূল ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতগণ (আ.)-ও আল্লাহর দ্বারা পবিত্র ব্যক্তিগণ ।

মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন : কিন্তু কথা হল এই যে , তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে আরম্ভ করেছে যা (তাদের জ্ঞান বহির্ভূত) বুঝতে তারা অক্ষম । অথচ এখনো এর (তাউইল) বিশ্লেষণ আসেনি । এমনি ভাবে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে তাদের পূর্ববতীরা অতএব লক্ষ্য করে দেখ যে কেমন হয়েছে পরিণতি । (সূরা আল্ ইউনুস ৩৯ নং আয়াত ।)

পবিত্র কুরআনের অন্যত্র আল্লাহ বলেছেনঃ তারা কি এখন এর তা উইলের অপেক্ষায় আছে যে , এর তা উইল প্রকাশিত হোক ? যেদিন এর তা উইল প্রকাশিত হবে সেদিন পূর্বে যারা ভুলে গিয়েছিল , তারা বলবে : বাস্তবিকই আমাদের প্রতিপালকের পয়গম্বরগ সত্যসহ আগমন করেছিলেন । (সূরা আল্ আ রাফ , ৫৩ নং আয়াত ।)

হাদীস সংক্রান্ত আলোচ্য বিষয়ের সমাপ্তি

পবিত্র কুরআন যে হাদীস সংক্রান্ত বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে , এ ব্যাপারে শীয়া মাযহাবসহ অন্যান্য মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে কোন বিতর্ক নেই । কিন্তু ইসলামের প্রাথমিক যুগে হাদীস সংরক্ষণের ব্যাপারে খলিফাদের দ্বারা যে বাড়াবাড়ীর সূত্রপাত ঘটে এবং হাদীসের প্রসারের ব্যাপারে সাহাবী ও তাবেঈনরা যে বাড়াবাড়ীর আশ্রয় নেন , ফলে হাদীস শাস্ত্র এক দুঃখজনক পরিণতির স্বীকার হয় । তার একদিকে খলিফা হাদীস লিখন ও সংরক্ষণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং লিপিবদ্ধ কোন হাদীস পাওয়া মাত্রই তা পুড়িয়ে ধ্বংস করে ফেলতেন , কখনও বা হাদীস বর্ণনাতেই বাধা প্রদান করতেন , এ কারণেই প্রচুর সংখ্যক হাদীস বিকৃতির স্বীকার হয়েছে । আবার অন্য দিকে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর সাহাবীগণ যারা মহানবী (সা.) এর উপস্থিতি উপলদ্ধি ও তার বক্তব্য শ্রবণের সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন এবং সাধারণ মুসলমান ও খলিফাদের সম্মান লাভে সক্ষম হয়েছিলেন তারা হাদীস প্রচার ও প্রসারে আত্মনিয়োগ করেন । এভাবে পরবর্তীতে তাদের কাজের পরিণতি এমন এক জায়গায় গিয়ে দাড়ায় যে , কুরআনের উপর হাদীসের শাসন ও প্রভুত্ব বিস্তৃত হয় । এমন কি কখনও কখনও হাদীসের মাধ্যমে কুরআনের নির্দেশও বাতিল হয়ে যেত ।১১৭

অন্য সময় দেখা গেছে শুধুমাত্র একটি হাদীস শ্রবণের জন্য হাজার হাজার কিলোমিটার পথ অতিক্রমের মত অসংখ্য ঘটনা সে যুগে ঘটেছে । সে সময় ইসলাম বিরোধী অসংখ্য ব্যক্তি বাহ্যত ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে ইসলামী চেহারার অন্তরালে ইসলামের গৃহশত্রুতে পরিণত হয় । তারা অসংখ্য হাদীসের বিকৃতি সাধান ও জাল হাদীস তৈরীর মাধ্যমে হাদীস শাস্ত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা ও নির্ভরযোগ্যতার বিলোপ সাধান করে ।১১৮ হাদীস শাস্ত্রকে ঐ দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি থেকে ঊদ্ধারের উদ্দেশ্যে ইসলামী পণ্ডিতগণ , ইলমে রিজাল ইলমে দিরায়াহ নামক দুটি শাস্ত্রের গোড়া পত্তন করেন । এ দুটো শাস্ত্রের মাধ্যমে সত্য হাদীসকে বিকৃত ও জাল হাদীস থেকে পৃথক করা যেতে পারে । কিন্তু শীয়া সম্প্রদায় হাদীসের সূত্র পরীক্ষার পূর্বে তাকে পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে যাচাই করাকে অবশ্য করণীয় বলে বিশ্বাস করে । শীয়া সূত্রে বর্ণিত মহানবী (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) অসংখ্য হাদীস (যার সূত্র সমূহ অকাট্য ও নির্ভরযোগ্য) আমাদের কাছে এসে পৌছেছে , যাতে বলা হয়েছে যে , কুরআন বিরোধী যে কোন হাদীসই মূল্যহীন ।১১৯ আর যে হাদীস কুরআনের বিষয়বস্তুর অনুকুলে একমাত্র তাই নির্ভরযোগ্য । আর এ ধরণের হাদীসের কারণে যেসব হাদীস কুরআনের পরিপন্থি , শীয়ারা তা মানা থেকে বিরত থাকে ।১২০ একইভাবে যেসব হাদীস পবিত্র কুরআনের পরিপন্থি বা অনুকুলে হওয়ার বিষয় সুস্পষ্ট নয় , পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) নির্দেশ অনুযায়ী সেসব হাদীস গ্রহণ বা বর্জনের ব্যাপারে তারা নীরবতা অবলম্বন করে । অবশ্য শীয়াদের মধ্যেও এমন কিছু লোক পাওয়া যায় , যারা আহলে সুন্নাতের অনেকের মতই কোন যাচাই বাচাই ছাড়াই যে কোন হাদীস পাওয়া মাত্রই তার অনুসরণ করে থাকে ।

হাদীস অনুসরণের ক্ষেত্রে শীয়াদের নীতি

মহানবী (সা.) অথবা পবিত্র আহলে বাইতের যেসব হাদীস কোন মাধ্যম ছাড়া সরাসরি তাদের কাছ থেকে শোনা হয়ে থাকে , তা কুরআনের নির্দেশের মতই মর্যাদা সম্পন্ন । কিন্তু যেসব হাদীস বিভিন্ন মাধ্যম পেরিয়ে আমাদের হাতে এসেছে , সে সব হাদীস অনুসরণের ক্ষেত্রে শীয়াদের নীতি নিম্নরূপ:

ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসগত জ্ঞানের ক্ষেত্রে পবিত্র কুরআনের নির্দেশ , মুতাওয়াতির হাদীস (যা সংশ্লিষ্ট কোন বিষয়ে দৃঢ় বিশ্বাসের জন্ম দেয়) অথবা যে হাদীস অত্যন্ত বিশ্বস্ত কোন সূত্রে অর্জিত হয়েছে , তাই অনুসরণযোগ্য । উপরোক্ত দু প্রকার হাদীস ছাড়া অন্য সব হাদীস (যেমন : খাবারে ওয়াহিদ) তেমন একটি নির্ভরযোগ্য নয় । তবে ইসলামী বিধানের কোন আইন প্রণয়ন১২১ বা প্রমাণের ক্ষেত্রে দলিল হিসাবে মুতাওয়াতির হাদীস ছাড়াও বিশ্বস্ত অ-মুতাওয়াতির (খাবারে ওয়হিদ) হাদীসও গৃহীত হয়ে থাকে । সুতরাং মুতাওয়াতির যা বিশ্বস্ত সূত্রে বর্ণিত হাদীস শীয়াদের নিকট সম্পূর্ণ রূপে প্রমাণ্য দলিল স্বরূপ । আর তা অবশ্য অনুসরণীয় । আর অনির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত হাদীস , যদি আস্থাযোগ্য হয় , তাহলে তা শুধুমাত্র ইসলামী আইনের ক্ষেত্রেই প্রমাণ্য দলিল হিসেবে গণ্য হবে ।

ইসলামে শিক্ষা গ্রহণ ও শিক্ষা প্রদান

জ্ঞান অর্জন ইসলামের একটি ধর্মীয় কর্তব্য । মহানবী (সা.) বলেছেনঃ জ্ঞান অর্জন করা প্রতিটি নর-নারীর জন্য ফরয১২২ আর এ ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রাপ্ত যেসব হাদীস রয়েছে , তা থেকে বোঝা যায় যে , জ্ঞান বলতে ইসলামের মৌলিক তিনটি বিষয় ও তদসংশ্লিষ্ট জ্ঞানের কথাই বোঝানো হয়েছে । আর তা হলঃ

১. তাওহীদ (আল্লাহর একত্ববাদ)

২. নবুয়ত

৩. কেয়ামত (পুনরূত্থান দিবস)

আর প্রতিটি ব্যক্তির জন্য তার প্রয়োজন মাফিক ইসলামী আইন ও তার ব্যখ্যাসহ সে সংক্রান্ত প্রয়াজনীয় বিস্তারিত জ্ঞান অর্জন করা তার অবশ্য কর্তব্য । অবশ্য এটা বলা বাহুল্য যে , ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস সংক্রান্ত জ্ঞানের ব্যাপারে মোটামুটিভাবে দলিল প্রমাণ সহ জ্ঞান অর্জন করা সবার জন্যেই সহজ । কিন্তু অকাট্য দলিল প্রমাণ সহকারে মূল কুরআন ও হাদীস থেকে ইসলামী আইন-কানুন প্রণয়ন ও প্রমাণ করার মত বিস্তারিত ও সুক্ষ্ণাতিসুক্ষ্ণ জ্ঞান অর্জন করা সবার জন্য সহজবোধ্য ব্যাপার নয় । এটা শুধুমাত্র অল্প কিছুসংখ্যক লোকের ক্ষেত্রেই সম্ভব । আর ইসলাম সাধ্যাতীত কোন কাজই দায়িত্ব হিসেবে মানুষের উপর চাপিয়ে দেয়নি । এ কারণেই দলিল প্রমাণ সহকারে ইসলামী আইন শাস্ত্রের বিস্তারিত জ্ঞান অর্জনের বিষয়টিকে ইসলামে ওয়াজিবে কিফায়ী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে । অর্থাৎ এ ধরণের ব্যাপক জ্ঞান অর্জনের যোগ্যতাসম্পন্ন অল্প কিছুসংখ্যক লোকের জন্যেই এটা দায়িত্ব স্বরূপহু আর অন্যান্য লোকদের দায়িত্ব হচ্ছে এ বিষয়ে তারা প্রয়োজন বোধে ঐসব ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞদের শরণাপন্ন হবে । জ্ঞানীর কাছে জ্ঞানহীনদের শরণাপন্ন হওয়া মূলনীতির উপরই উপরোক্ত নীতির মূলভিত্তি প্রতিষ্ঠিত । ইসলামী আইন-শাস্ত্রে পারদর্শী বিশেষজ্ঞরা মুজতাহীদ বা ফাকীহ নামে পরিচিত । মুজতাহিদদের কাছে ইসলামী আইন সংক্রান্ত বিষয়ে শরণাপন্ন হওয়ার মাধ্যমে মুজতাহীদদের অনুসরণকেই তাকলীদ (অনুসরণ) বলা হয় । অবশ্য এখানে মনে রাখা দরকার যে , ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস সংক্রান্ত বিষয়ে কারও অনুসরণ করাকে ইসলাম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছে ।

মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন : যে বিষয়ে তোমাদের কোন জ্ঞান নেই , তার অনুসরণ করো না । (সূরা আল ইসরা , ৩৬ নং আয়াত ।)

এটা সবার জানা থাকা প্রয়োজন যে , শীয়া মাযহাবে মৃতব্যক্তির তাকলীদের মাধ্যমে তাকলীদের সূচনা করা জায়েয নয় ।১২৩ অর্থাৎ যে ব্যক্তি ইজতিহাদ সংক্রান্ত জ্ঞানে পারদর্শী নয় , তাকে অবশ্যই ইসলামী আইন সংক্রান্ত ব্যাপারে কোন না কোন মুজতাহিদের শরণাপন্ন হতে হবে । কিন্তু এ ব্যাপারে অবশ্যই তাকে কোন জীবিত মুজতাহিদের মতামতের শরণাপন্ন হতে হবে । সেক্ষেত্রে কোন মৃত মুজতাহিদের মতামতের অনুসরণ করা তার জন্য বৈধ হবে না । ঐ মুজতাহিদ জীবিত থাকাকালীন সময়েই যদি ঐ ব্যক্তি কোন বিষয়ে তার মতানুসরণ করে থাকে তাহলে উক্ত মুজতাহিদের মৃত্যুর পরও সে ঐ পূর্বোক্ত মতের অনুসরণ অব্যাহত রাখতে পারবে । তবে এ ব্যাপারে তাকে সমসাময়িক জীবিত অন্য কোন মুজতাহিদের অনুমতি গ্রহণের প্রয়োজন হবে । আর এ বিষয়টি শীয়া মাযহাবের ইসলামী ফেকহ্ (আইন) শাস্ত্রের চিরঞ্জীব ও চিরন্তন হিসেবে টিকে থাকার ব্যাপারে একটি অন্যতম কারণ বটে । এ কারণে শীয়া মাযহাবের অসংখ্য ব্যক্তি একের পর এক ইজতিহাদি জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের প্রচেষ্টায় প্রতিনিয়ত ব্যস্ত থাকেন । কিন্তু আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের ব্যাপারটি ভিন্ন ধরণের । হিজরী পঞ্চম শতাব্দীর দিকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আলেমদের ইজমা (ঐক্যমত) অনুসারে চার জন মুজতাহিদের চার মাযহাবের কোন একটির অনুসরণকে ওয়াজীব হিসেবে ঘোষণা করা হয় । ঐ চার মাযহাব হচ্ছে: ইমাম আবু হানিফা , ইমাম মালেক , ইমাম শাফেয়ী এবং ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলের মাযহাব । তাদের মতে স্বাধীন ইজতিহাদ ও উপরোক্ত চারজন ফকীহ্ বা মুজতাহিদ ছাড়া অন্য কারও তাকলীদ বা অনুসরণ করা তাদের মতে বৈধ নয় । এর ফলে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের ফেকাহ্ বা আইন শাস্ত্রের গুণগতমান এখনও প্রায় সেই বারশত বছর পূর্বের অবস্থায় অবস্থান করছে । অবশ্য বর্তমানে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অনেক আলেমই তথাকথিত ইজমা র সিদ্ধান্ত মানেন না । তারা স্বাধীনভাবে ইজতিহাদের পক্ষপাতি এবং তার প্রচেষ্টাও চালাচ্ছেন ।

কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক জ্ঞান এবং শীয়া মাযহাব

ইসলামী জ্ঞান মোটামুটি দু শ্রেণীতে বিভক্ত : (১) বুদ্ধিবৃত্তিগত জ্ঞান এবং (২) বর্ণনা ভিত্তিক জ্ঞান ।

বর্ণনা ভিত্তিক জ্ঞান মূলতঃ কুরআন ও সুন্নাহ থেকে বর্ণিত জ্ঞানের উপরই নির্ভরশীল । যেমন : আরবী ভাষা , হাদীস , ইতিহাস ইত্যাদি । তবে বুদ্ধিগত জ্ঞান অন্য ধরণের । গণিত , দর্শন ইত্যাদি বুদ্ধিগত জ্ঞান বা বিদ্যার উদাহরণ । এতে কোন সন্দেহ নেই যে , পবিত্র কুরআনই ইসলামের বর্ণনা ভিত্তিক বিদ্যার মূল উৎস । অবশ্য এছাড়াও ইতিহাস , বংশ পরিচিতি শাস্ত্র এবং ভাষালংকার শাস্ত্রও এই ঐশী পুস্তকের এক অমূল্য অবদান । মুসলমানরা ইসলামী জ্ঞানের গবেষণা ও অনুসন্ধিৎসা মেটানোর লক্ষ্যে এসব শাস্ত্রের চর্চা ও গ্রন্থ রচনায় প্রয়াসী হন । ঐসব বিদ্যার মধ্যে মূলত্ঃ আরবী ভাষা ও সাহিত্য এবং তার ব্যাকারণ , ভাষা অলংকার , অভিধানসহ ইত্যাদি বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল । এছাড়াও তাজবীদ (কুরআন উচ্চারণ বিধিশাস্ত্র) , তাফসীর , হাদীস , রিজাল (হাদীস বর্ণনাকারীদের নির্ভরযোগ্যতা যাচাই শাস্ত্র) , দিরায়াহ্ (হাদীসের সত্যতা যাচাই শাস্ত্র) , উসুল (ইসলামী আইন প্রণয়নের মূলনীতি শাস্ত্র) , এবং ফিকহ ও (ইসলামী আইন শাস্ত্র) এসবের অন্তর্ভুক্ত । শীয়ারাও ইসলামী জ্ঞানের উপরোক্ত শাখাগুলোর বিকাশ ও উন্নয়নে যথেষ্ট অবদান রেখেছে । এমনকি উক্ত জ্ঞানের শাখাসমূহে অনেকগুলোর প্রতিষ্ঠাতাই ছিলেন শীয়া মাযহাবের অনুসারী । যেমন: আরবী ব্যাকারণের নাহু (শব্দের স্বরচিহ্ন নির্ণয়বিদ্যা) শাস্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জনাব আবুল আসাদ আদ দোয়ালী । ইনি ছিলেন রাসূল (সা.) এবং ইমাম আলী (আ.)-এর একজন সাহাবী । তিনি হযরত আলী (আ.)-এর নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধনে এই শাস্ত্র রচনা করেন । আরবী ভাষার অলংকার শাস্ত্রের একজন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আলে বুইয়া বংশীয় শীয়া রাজ্যের জনৈক শীয়া মন্ত্রী । তার নাম ছিল সাহেব বিন ই বাদ ।১২৪

জনাব খলির বিন আহমাদ বসরী নামক জনৈক বিখ্যাত শীয়া শিক্ষাবিদ সর্বপ্রথম আল আইন নামক আরবী ভাষার অভিধান রচনা করেন ।১২৫ তিনিই আরবী ভাষায় কাব্যের ছন্দপ্রকরণ শাস্ত্রও প্রথম আবিস্কার করেন । এ ছাড়াও আরবী ব্যাকারণের নাহু (শব্দের স্বরচিহ্ন নির্ণয় , পদবিন্যাস প্রকরণ) শাস্ত্রের অসাধারণ ও বিখ্যাত পণ্ডিত জনাব সিবাওয়াই ছিলেন শীয়া মাযহাবের অনুসারী । পবিত্র কুরআন পঠনের বিখ্যাত ও স্বতঃসিদ্ধ সাতটি পদ্ধতির মধ্যে কিরাআতে আসেম অন্যতম যার সূত্রও হযরত আলী (আ.) ।১২৬ পবিত্র কুরআনের তাফসীর (ব্যাখা) শাস্ত্রের অন্যতম মুফাচ্ছির ও বিখ্যাত সাহাবী হযরত ইবনে আব্বাস ছিলেন হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর শিষ্য । হাদীস ও ফিকাহ্ শাস্ত্রে আহলে বাইতগণ (আ.) ও শীয়াদের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । শীয়াদের পঞ্চম ইমাম [বাকের (আ.)] ও ষষ্ঠ [ইমাম জাফর সাদিক (আ.)] ইমামের সাথে আহলে সুন্নার মাযহাবের ইমামগণের জ্ঞানগত বিষয়ের সম্পর্ক সর্বজনবিদিত ব্যাপার । এমনকি উসুলে ফিকহ (ইসলামী আইন প্রণয়নের মূলনীতি বিষয়ক শাস্ত্র) শাস্ত্রে শীয়াদের আশ্চর্য জনক উন্নতিও বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় । জনাব ওয়াহীদ বেহবাহানীর (মৃত্যু -১২০৫ হিঃ) যুগে এই শাস্ত্রে সাধিত উন্নতি , বিশেষ করে জনাব শেইখ মুরতাদা আনসারীর (মৃত্যু -১২৮১ হিঃ) অবদান ইসলামী বিশ্বের এক নজির বিহীন ঘটনা , গুণগত মানের দিক থেকে যার সাথে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের উসুলে ফিকাহ শাস্ত্রের আদৌ কোন তুলনা করা চলে না ।

দ্বিতীয় পদ্ধতি

বুদ্ধিগত আলোচনা

15

ইমাম সাদিক ( আঃ ) ও একদল সুফী

সুফিয়ান সাওরী মদীনার একজন অধিবাসী। একদিন সে হযরত ইমাম জাফর সাদিক (আঃ)-এর খেদমতে উপস্থিত হলো। দেখতে পেলো ইমাম একটি খুব নরম ও সাদা পোশাক পরিধান করে আছেন। যেন ডিমের খোসা আর ভেতরের তরল অংশের মধ্যবর্তী পাতলা পর্দাটি। তাই সে ইমাম সাদিক (আঃ)-এর প্রতি আপত্তি করে বললো , এ পোশাকটি আপনার জন্য উপযোগী নয়। আপনার পক্ষে এটা কখনও সঙ্গত নয় যে , নিজেকে দুনিয়ার আরাম-আয়েশের সাথে জড়িয়ে ফেলবেন। আপনার কাছ থেকে এটাই আশা যে , খোদাভীতি ও পরহযেগারীর পথ অবলম্বন করে নিজেকে পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য থেকে দূরে রাখবেন।16

ইমাম সাদিক (আঃ) বললেন , আমি তোমাকে এমন একটি কথা বলতে চাই যা তোমার জন্য দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতে কল্যাণকর ও উপকারী হবে। তোমার উদ্দেশ্য যদি হয় এ ব্যাপারে ইসলামের হুকুম-আহকাম সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা তাহলে আমার কথা তোমার জন্য অত্যন্ত উপকারী হবে এবং তুমি এ ব্যাপারে জ্ঞান লাভ করতে পারবে। কিন্তু যদি তোমার উদ্দেশ্য হয় ইসলাম ধর্মে কোন বেদআত প্রবেশ করানো এবং সত্য ইসলাম থেকে সরলপ্রাণ মুসলমানদেরকে বিভ্রান্তির শিকারে পরিণত করা , তাহলে ভিন্ন কথা। কেননা পথভ্রষ্ট ও বেদাআত সৃষ্টিকারী লোকদের জন্য আমার কথা নিস্ফল হয়ে থাকে। সুতরাং তাতে আমার কথা তোমার কোন উপকারে আসবে না। সম্ভবত তোমার মনে রাসূলে আকরাম (সাঃ) ও তার সাহাবীবৃন্দের সহজ-সরল ও দারিদ্র্যের জীবন যাপনের কথা জেগে উঠেছে। আর তাতে তুমি এ কথা মনে করে নিয়েছো যে , কেয়ামত পর্যন্ত মুসলমানদের জন্য দারিদ্র্যের জীবন যাপন করা ফরজ করে দেয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ব্যাপার তা নয়। রাসূলে আকরাম (সাঃ) ও তাঁর অনুগত সাথীগণ এভাবে দারিদ্র্যের ও কষ্ট-ক্লেশের জীবন যাপন করেছিলেন তখন , যখন সমাজের চারদিকে অভাব-অনটন , দুঃখ-দারিদ্র্য , কষ্ট-ক্লেশ , অনাহার-অর্ধাহার ইত্যাদি ছড়িয়ে ছিল। আর তখন লোকেরা সে সব মৌলিক বস্তু থেকে বঞ্চিত ছিল যা সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অত্যন্ত জরুরী। তাই রাসূল (সাঃ) ও তাঁর অনুগত সাহাবীদের জীবন যাপনের মান তৎকালের সাধারণ মানুষের অবস্থার সাথে মিল ছিল। কিন্তু যে যুগে জীবন যাপনের যাবতীয় সামগ্রী সহজে পাওয়া যায় এবং আল্লাহর নেয়ামতসমূহ উপভোগের সুযোগ-সুবিধা বর্তমান থাকে তখন তো আল্লাহর নেয়ামতসমূহ থেকে উপকার লাভ করার সবচেয়ে বেশি অধিকার হচ্ছে তাঁর অনুগত প্রিয় বান্দাদেরই।

আল্লাহর সে সব নেয়ামতের উপর অসৎ ও ফাসেক লোকদের চাইতে তাঁর সৎ ও নেক বান্দাদের অধিকার কতোই না বেশি। নেয়ামতসমূহের অধিকার কাফেরদের লত নায়সম লমানদের কতোই না অধিক! তুমি কোন বিষয়টিকে আমার দোষের বিষয় হিসেবে নির্ণয় করেছো ? মহান আল্লাহর শপথ করে বলছি , যেভাবে তুমি দেখতে পাচ্ছো যে , আমি আল্লাহর দেয়া নেয়ামতসমূহ ব্যবহার করছি , ঠিক তেমনিভাবে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্তআমার জীবনে এমন একটি মুহূর্তও অতিবাহিত হয়নি যে , আমি আমার মাল-সম্পদ থেকে অন্যদের অধিকার পৌঁছে দেইনি। প্রতিটি সকাল-সন্ধ্যা এ চিন্তা-ভাবনায় নিমজ্জিত থাকি যে , আমার মাল-সম্পদে যার যে হক আছে তা যেন যথাসময়ে তার কাছে পৌঁছে দিতে পারি

সুফিয়ান সাওরী ইমামের যুক্তিসংগত কথার জবাব দিতে পারলো না এবং মাথা ঝুঁকিয়ে চলে গেল। তারপর সে তার বন্ধু-বান্ধব ও তার মতবাদে বিশ্বাসীদের সাথে সাক্ষাৎ করে সমস্তঘটনা তাদেরকে শোনালো। তাতে তারা সকলে মিলে ফয়সালা করলো যে , তারা সকলে সম্মিলিতভাবে ইমাম সাদিক (আঃ)-এর সাথে এ বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক করবে।

অবশেষে একদিন সুফিয়ান সাওরী ও তার সকল সাথী ইমাম সাদিক (আঃ)-এর খেদমতে হাজির হলো। তারা বললো , আমাদের বন্ধু তার কথাকে হক প্রমাণ করার ব্যাপারে উপযুক্ত দলিল-প্রমাণ পেশ করতে পারেনি। তাই আমরা এখন সুস্পষ্ট দলিল-প্রমাণের দ্বারা আপনাকে নিরুত্তর করতে এসেছি

ইমাম সাদিক (আঃ) বললেন , বলো! তোমাদের সে সমস্ত প্রমাণ কি যা দিয়ে তোমরা আমাকে নিরুত্তর করতে চাও

তারা বললো , আমরা কোরআনের আয়াত দিয়েই আমাদের দলিল-প্রমাণ পেশ করতে চাই

সাথে সাথেই ইমাম (আঃ) বললেন , কোরআনের চাইতে উত্তম দলিল আর কি হতে পারে ? সুতরাং তোমরা তোমাদের দলিল উপস্থাপন করো। আমি তোমাদের দলিলাদি শোনার জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত রয়েছি । তারা বললো , আমরা আমাদের মতবিশ্বাসের সত্যতা প্রমাণের জন্য কোরআনের দুটি আয়াত তুলে ধরবো। আর আমাদের কথা পরিষ্কার করার জন্য এ দুটি আয়াত যথেষ্ট। আল কোরআনের এক স্থানে মহান আল্লাহ রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর কোন কোন সাহাবাদের প্রশংসা এভাবে করেছেন :

যদিও তাদের নিজেদের প্রয়োজন মিটতো না এবং অভাব-অনটন ও দারিদ্র্য অবস্থায় ছিল নিমজ্জিত। তবুও অপর লোকদেরকে নিজেদের উপর প্রাধান্য দিয়েছে এবং তাদের প্রয়োজন মিটিয়েছে। আর যারা নিজেদেরকে কৃপণতা থেকে রক্ষা করেছে তারাই সফলকাম17

আল কোরআনের অন্য এক স্থা্নে বলা হয়েছে :

যদিও তাদের খাদ্য-খাবারের প্রয়োজন ও আগ্রহ ছিল সে অবস্থাতেও তারা নিজেদের খাবার ইয়াতিম , মিসকীন ও কয়েদিকে দান করে দিয়েছে18

তাদের বক্তব্য শেষ হওয়ার সাথেই সাথেই এ মজলিসে উপস্থিত এক ব্যক্তি যে এতোক্ষণ তাদের কথাবার্তাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছিল , সে নিজের পক্ষ থেকে বলে উঠলো , তোমাদের এতোক্ষণের আলাপ-আলোচনায় আমি যা বুঝতে পেরেছি তা হলো-তোমাদের কথাবার্তায় তোমাদের নিজেদেরই আত্মবল নেই। আসলে এ সমস্ত দলিল দ্বারা তোমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে যে , লোকেরা যেনো নিজেদের ধন-সম্পদ ও মালিকানার প্রতি কোন প্রকার মায়া-আকর্ষণ না রাখে এবং তার বেশির ভাগ অংশ যেনো তোমাদের মতো ফকির-মিসকিন লোকদেরকে দিয়ে দেয় যাতে তোমরা তাদের পরিবর্তে ভোগ করতে পারো।

এ কারণে বাস্তবে তোমাদেরকে দেখা যায়নি যে , তোমরা উত্তম উত্তম খাবার ত্যাগ করেছো। ইমাম (আঃ) বললেন , আপাতত এসব কথা বাদ দাও কোন ফল নেই । এরপর ইমাম (আঃ) সুফীদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন , তোমরা তো কোরআন মজীদ থেকে দলিলাদি পেশ করছো। কিন্তু তার আগে একটা কথা বলো , তোমরা কি আল-কোরআনের মোহকাম-মোতাশাবেহ নাসেখ-মানসুখ আয়াতগুলোর মাঝে পার্থক্য করতে পারো ? এই উম্মতের থেকে যারাই পথভ্রষ্ট হয়েছে তারা এ পথেই পথভ্রষ্ট হয়েছে। কারণ তারা কোরআনের সঠিক খবর না রেখেই তা আঁকড়ে ধরে।

সুফীরা বললো , এ বিষয়ে আমাদের জ্ঞান মোটামটি। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান আমাদের নেই । ইমাম বললেন , তোমাদের দুর্ভাগ্য এটাই। কোরআনের আয়াতের মতো রাসূলে পাক (সাঃ)-এর হাদীসও রয়েছে। এগুলোর উপর পূর্ণ অবগতি রাখা দরকার। কিন্তু তোমরা কোরআনের যে আয়াতগুলোকে পাঠ করেছ , তাতে তো আল্লাহর নেয়ামতসমূহ ব্যবহার করা হারাম বলা হয়নি। এ আয়াতগুলো বদান্যতা , দয়া-দান ও ত্যাগের সাথে সম্পৃক্ত। এ আয়াতগুলোতে আল-কোরআন সে সকল লোকের প্রশংস্রা করছে যারা একটা বিশেষ সময়ে অপরকে নিজেদের উপর প্রাধান্য দিয়েছেন। অন্যদের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিয়ে তারা নিজেদের হালাল মাল নিজেরা ব্যবহার করার পরিবর্তে অপরকে দান করে দিয়েছেন। যদি তারা এ মাল না দিতেন তাহলেও তাদের কোন গুণাহ হতো না। কেননা মহান আল্লাহ তাদেরকে হুকুম করেননি যে , অবশ্যই এটা করতে হবে। তেমনি আল্লাহ তাদেরকে এ কাজ করতে বাধাও দেননি। সুতরাং তারা নিজেরা দয়া ও সহানুভূতির বশবর্তী হয়ে নিজেরা কষ্ট করেছেন এবং তাদের মাল-সম্পদ অপরকে দিয়ে দিয়েছেন। যার প্রতিদান মহান আল্লাহ তাদেরকে দেবেন। অতএব এ আয়াতগুলো ও তোমাদের দাবির মধ্যে কোন মিল নেই। কেননা তোমরা সে সমস্ত লোকের তিরস্কার ও নিন্দা করছো যারা নিজেদের মাল-সম্পদ ও খোদার দেয়া নেয়ামত ভোগ করে থাকে।

তিনি বললেন , সে সমস্তলোক , [রাসূলে খোদা (সাঃ)-এর সাহাবাগণ] সেদিন এ ধরনের দান- খয়রাতের দৃষ্টান্ত রেখেছেন। কিন্তু পরবর্তীতে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে পরিপূর্ণ বিধান এসেছে যেখানে আল্লাহ এ কাজের একটা সীমা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। যেহেতু এ হুকুমটি পরে এসেছে তাই তাদের (সাহাবাদের) সে আমলকে রহিত করে দিয়েছে। সুতরাং আমাদেরকে এ হুকুম মেনে চলা উচিত। সে আমলকে নয়।

মহান আল্লাহ মমিন-মসলমানদের অবস্থার সংশোধনের জন্য এবং তার বিশেষ রহমতের দ্বারা এ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন যে , কোন লোক নিজের পরিবার-পরিজনকে কষ্টের মধ্যে রেখে তার সমস্ত সহায় অপরকে দান করে দেবে। কেননা তার পরিবারে এমন শিশু , বৃদ্ধ ও দূর্বল লোকজন থাকে যারা এ কষ্ট সহ্য করতে পারে না। ধরে নাও , আমার কাছে একটি রুটি আছে আর আমি তা অন্যকে দিয়ে দিলাম। তখন তার পরিণতি এই দাঁড়াবে যে , আমার পরিবার-পরিজন যাদের ভরণ-পোষণের দায়

দায়িত্ব আমার উপর রয়েছে তারা না খেয়ে ধ্বংসের মুখে পতিত হবে। এ জন্য রাসূলে আকরাম (সাঃ) বলেছেন , যদি কোন লোকের কাছে কিছু খোরমা অথবা কিছু রুটি কিংবা কিছু দিনার বা টাকা থাকে আর সে দান করতে চায় , তাহলে প্রথমে উচিত তার পিতামাতাকে দান করবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে নিজের ও তার স্ত্রী-সন্তানের জন্য দান করবে। তৃতীয় পর্যায়ে তার আত্মীয়-স্বজন ও মুমিন ভাইদেরকে দান করবে। আর চতুর্থ পর্যায়ে ভালো ও কল্যাণ কাজে দান করার পালা। এভাবে দান-খয়রাত ইত্যাদির পালা আসে সবার শেষে।

রসূলুলাহ (সাঃ) যখন শুনতে পেলেন যে , এক আনসার মারা গেছে , আর তার ছোট ছোট ছেলেমেয়ে বর্তমান রয়েছে , এদিকে মৃত্যুর পূর্বে সে তার সমস্ত সম্পদ আল্লাহর পথে দান করে দিয়েছে। তখন রাসূল (সাঃ) বললেন , এ সংবাদ যদি তোমরা আমাকে পূর্বেই দিয়ে দিতে তাহলে আমি তাকে মুসলমানদের কবরস্থানে দাফন করার অনুমতি দিতাম না। সে তার ছেলে-মেয়েদেরকে অসহায় অবস্থায় রেখে গেছে। এখন তারা অপরের সামনে হাত পাতছে।

আমার পিতা হযরত ইমাম বাকের (আঃ) আমার কাছে বর্ণনা করেন যে , রাসূলে পাক (সাঃ) বলেছেন , সব সময় দানখয়রাতের ব্যাপারে নিজের সন্তানদের থেকে শুরুকরবে। এরপর আত্মীয়- স্বজনের যে যত নিকটের হবে সে ততো প্রাধান্য পাবে।

এতসব কিছু ছাড়াও আল-কোরআন তোমাদের মতবিশ্বাসের বিপক্ষে রায় প্রদান করে থাকে। আল কোরআনের এক স্থানে এভাবে বলা হয়েছে :

মোত্তাকী , পরহেযগার ও খোদাভীরুলোক তারাই যারা দান করার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়িও করে না। কৃপণতাও করে না , বরং মধ্যম নীতি অবলম্বন করে।19 কোরআন মজীদের অনেক আয়াতেই যেমনিভাবে কৃপণতা করতে নিষেধ করা হয়েছে , ঠিক তেমনিভাবে খরচ ও দান করার ক্ষেত্রেও অতিরিক্ত ও অপাত্রে করতে বাধা দান করেছে। এ ব্যাপারে আল-কোরআন একটি মধ্যম নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে। এটা উচিত নয় যে , কোন লোক তার সমস্তসম্পদ অপর লোকদের মধ্যে বণ্টন করে দিয়ে নিজে দারিদ্র্য ও অভাবগ্রস্ত হয়ে মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করছে , হে পরোয়ারদিগার! আমাকে রিযিক দান করো । মনে রাখবে যে , মহান আল্লাহ এমন লোকদের দোয়া কখনো কবুল করেন না। আল্লাহর নবী (সাঃ) বলেছেন , মহান আল্লাহ কিছু সংখ্যক লোকদের দোয়া কখনো কবুল করেন না। তারা হলো :

(ক) যে ব্যক্তি আল্লাহর নিকটে নিজের পিতামাতার অকল্যাণ প্রার্থনা করে।

(খ) যে ব্যক্তি নিজের সম্পদ কাউকে ধার দেয়। কিন্তু কোন সাক্ষীও রাখে না আর লিখিত কোন প্রমাণও রেখে দেয় না। এদিকে ঋণগ্রহীতা টাকাগুলো মেরে দেয়। তখন সে হাত তুলে দোয়া করে আল্লাহর কাছ থেকে সমাধান চায়। তাহলে আল্লাহ তার দোয়া কখনো কবুল করেন না। কেননা সে কোন প্রকার সাক্ষ্য-প্রমাণ না রেখে অপরকে ঋণ দিয়ে নিজেই সমাধানের পথ বিনষ্ট করে ফেলেছে।

(গ) যে ব্যক্তি মহান আল্লাহর দরবারে এ দোয়া করে যে , তাকে যেনো তার স্ত্রীর অনিষ্টতা হতে মুক্তি দান করেন , তাহলে এমন ব্যক্তির দোয়া মহান আল্লাহ মোটেও শোনেন না। এ জন্য যে , স্ত্রীর অনিষ্টতা থেকে মুক্তি লাভের পন্থা ও পদ্ধতি তার নিজের হাতেই রয়েছে। যদি সত্য সত্যই সে স্ত্রীর ব্যাপারে অতিষ্ঠ হয়ে গেছে তাহলে তার অধিকার রয়েছে যে , এমন স্ত্রীকে তালাক দিয়ে নিজের মুক্তির পথ বেছে নেবে।

(ঘ) যে ব্যক্তি নিজের ঘরে হাতের উপর হাত রেখে বসে থাকে আর রিযিকের জন্য দোয়া করে আল্লাহর কাছে তখন এমন লোকের দোয়ার জবাবে আল্লাহ বলেন :

হে আমার বান্দা! আমি কি তোমার জন্যে নড়াচড়া ও চলাফেলার রাস্তা খোলা রাখিনি ? আমি কি তোমাকে নিখুঁত ও মজবুত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান করিনি ? আমি তোমাকে হাত-পা , কান-নাক ও আকল- বুদ্ধি দান করেছি যাতে করে তুমি এগুলো দিয়ে দেখে-শুনে ও চিন্তা-ভাবনা করে হাত-পা ইত্যাদি ব্যবহার করে রিযিকের সন্ধানে বেরিয়ে পড়তে পারো। এ সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সৃষ্টির একটা উদ্দেশ্য আছে। এ নেয়ামতগুলোর কৃতজ্ঞতা হচ্ছে যে , তুমি এগুলোর সদ্ব্যবহার করবে। এভাবে আমি আমার ও তোমার মাঝে উসিলা নির্ধারণ করেছি যাতে করে তুমি প্রতিটি জিনিস হাসিল করার জন্য তোমার মেহনতের দ্বারা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারো। আর শ্রম-সাধনার সাথে সম্পৃক্ত কাজগুলো পালন করতে পারো এবং অন্যের কাঁধের বোঝা যেনো তোমাকে হতে না হয়। তোমার চেষ্টা যদি আমার ইচ্ছা মোতাবেক হয় তাহলে আমি তোমাকে যথেষ্ট পরিমাণে রিযিক দান করবো । আর যদি সংগত কোন কারণে তোমার উন্নতি না হয় তাহলেও তুমি অন্তত এ প্রশান্তিলাভ করতে পারবে যে , তোমাকে চেষ্টা করতে বলা হয়েছিল , তুমিও চেষ্টা করেছো। এখানে তোমার কোনো দোষ নেই।

(ঙ) সে ব্যক্তি যাকে মহান আল্লাহ অনেক ধন-সম্পদ দিয়েছেন। আর সে দান করতে গিয়ে তার সমস্তসম্পদ শেষ করে দিয়েছে। এর পরে সে আল্লাহর কাছে এ দোয়া করে : হে আমার প্রভু! আমাকে রিযিক দান করো। তখন আল্লাহ এমন লোকের জবাবে বলেন :

আমি কি তোমাকে অনেক অনেক রিযিক দান করিনি ? তুমি কেন মধ্যম নীতি অবলম্বন করোনি ? আমি কি এ হুকুম দেইনি যে , দান করার ব্যাপারে মধ্যম নীতি অবলম্বন করো ? আমি কি দান-খয়রাতের বেলায় বেহিসাবে খরচ করার ব্যাপারে তোমাদেরকে নিষেধ করিনি ? (চ) সে ব্যক্তির দোয়াও কবুল হয় না , যে ব্যক্তি মহান আল্লাহর দরবারে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার ব্যাপারে দোয়া করে। আর যে আল্লাহর কাছে এমন জিনিস প্রার্থনা করে যা দ্বারা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন হওয়াটা অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে।

মহান আল্লাহ কোরআন পাকে বিশেষভাবে তাঁর রাসূলকে দান করার পদ্ধতি শিখিয়েছেন। একটি ঘটনা এভাবে বর্ণিত হয়েছে যে , আল্লাহর নবী (সাঃ)-এর নিকট কিছু স্বর্ণমূদ্রা ছিল। তিনি তা দরিদ্র লোকদের মধ্যে বন্টন করে দিতে চাচ্ছিলেন। তিনি চাননি যে , এক রাতের জন্যও সে স্বর্ণমুদ্রাগুলো তার ঘরে পড়ে থাকুক। তাই তিনি সারাদিন ধরে সে মুদ্রাগুলো লোকদের মধ্যে বণ্টন করে দিলেন। পরদিন সকালে একজন ভিক্ষুক তাঁর বাড়িতে আসলো এবং সাহায্য প্রার্থনা করলো। সে ভিক্ষুকটি তার প্রয়োজনের তাগিদে বার বার সাহায্যের প্রার্থনা করলো। সে ভিক্ষুকটি তার প্রয়োজনের তাগিদে বার বার সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছিল। কিন্তু নবী (সাঃ)-এর কাছে তাকে দেবার মতো কিছুই ছিল না। এতে তিনি খুবই দুঃখিত হলেন। তখন কোরআন মজীদের এ আয়াত অবতীর্ণ হলো যেখানে মহান আল্লাহ দান করার ব্যাপারে তাঁর বিধান জারি করেছেন :

নিজের হাতকে মুষ্টিবদ্ধ করো না। আর না এতোখানি খুলে রেখো , যাতে করে পরে খালি হাত হয়ে যেতে হয় এবং ভিক্ষুকের সাহায্য প্রার্থনার সময় লজ্জিত ও দুঃখিত হতে হয়।20

এগুলো সে সমস্ত হাদীস যা হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে। আর আল- কোরআনের আয়াতসমূহ এ হাদীসগুলোতে বর্ণিত বিষয়াদিকে সমর্থন করে। তাহলে আল-কোরআনে বিশ্বাসী ঈমানদার লোক যারা , তারা কোরআনে বর্ণিত বিষয়াদির প্রতি ও ঈমান রাখে।

মৃত্যুর সময়ে হযরত আবু বকরকে বলা হয়েছিল : আপনার ধন-সম্পদ সম্পর্কে অসিয়ত (অন্তিম উপদেশ) করুন। তিনি বললেন , আমার সম্পদের এক-পঞ্চমাংশ দান করে দিও। আর অবশিষ্টাংশ উত্তরাধিকারীদের জন্য রইলো। এক-পঞ্চমাংশ সম্পদ কম নয়। বস্তুত হযরত আব বকর স্বীয় সম্পদের এক-পঞ্চমাংশের ব্যাপারে অসিয়ত করেছেন। প্রকৃতপক্ষে একজন রোগীর অধিকার হচ্ছে মৃত্যু রোগের সময়ও সে তার সম্পদের এক-তৃতীয়াংশেরই অসিয়ত করবে। যদি জানতেন যে তার সমুদয় অধিকারকে কাজে লাগানো উত্তম হবে তাহলে এক-তৃতীয়াংশেরই ওসীয়ত করে যেতেন।

হযরত সালমান ফারসী ও হযরত আবু যার গিফারীর খোদাভীতি-পরহেযগারী ও অন্যান্য ফজিলত ও মর্যাদার কারণে সবাই তাদেরকে খবু ভালোভাবে চেনে। তাদের জীবন যাপনের পদ্ধতি ও চরিত্র- আখলাকও ছিল এরূপ।

হযরত সালমান ফারসী যখন বাইতুলমাল থেকে নিজের বাৎসরিক ভাতা গ্রহণ করতেন তখন সেখান থেকে এক বছরের খরচাদিকে বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় টাকা-পয়সা নিজের কাছে সংরক্ষিত রাখতেন যাতে করে পরবর্তী বছরের ভাতা পাওয়া পর্যন্তকোন অসুবিধায় পড়তে না হয়। লোকেরা সালমানকে জিজ্ঞাসা করলো :

আপনি এতো বড় একজন মোত্তাকী পরহেযগার লোক হয়েও এক বছরের পুঁজি জমা করে রাখার চিন্তা-ভাবনা করছেন! ধরুন আজকালের মধ্যেই আপনার মৃত্যু হয়ে গেল এবং বছরের শেষ পর্যন্তজীবিত থাকতে পারলেন না তাহলে এক বছরের পুঁজি জমা করে রাখার পেছনে ফায়দা কি ? তাদের প্রশ্নের জবাবে হযরত সালমান ফারসী বললেন , হতে পারে আমি মরবো না। তোমরা কেন এ কথা ধরে নিয়েছো যে , আমি মরেই যাবো। এর বদলে তোমরা এটাও ধরে নিতে পারো যে , আমি আগামী বছর পর্যন্তবেঁচে থাকবো। আর যদি আমি জীবিত থেকে যাই তাহলে আমার জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় খরচাদির সর্বাবস্থায় দরকার হবে। হে অজ্ঞ লোকেরা! তোমরা এ বাস্তব সত্য সম্পর্কে মোটেও ধারণা রাখো না যে , মানুষের কাছে যদি জীবন যাপনের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বর্তমান না থাকে তাহলে তার মন আল্লাহর আনুগত্য করার ব্যাপারে বেপরোয়া হয়ে যায় এবং আলার আনুগত্য করার জন্য অন্তরের যে স্বস্তিও প্রশান্তিদরকার তার মধ্যে সেটার অভাব দেখা দেয়। আর যদি জীবনযাপন সামগ্রী তার কাছে পুরোপুরি বর্তমান থাকে তাহলে সে আল্লাহর আনুগত্য করার ক্ষেত্রে মোটেও অবহেলা করে না।

কিন্তু হযরত আবু যার গিফারীর নিকট কিছু উট ও ভেড়া-বকরী ছিল , যেগুলোর দুধ পান করে তিনি জীবন যাপন করতেন। কখনো যদি তার গোশত খাবার ইচ্ছা হতো কিংবা বাড়িতে যদি কোন মেহমান আসতো অথবা কোন দরিদ্র-গরিব মানুষের অভাব-অনুভব করতেন তাহলে সে জন্তুগুলো দ্বারা প্রয়োজন মেটাতেন। অন্য লোকদের মাঝে গোশত বন্টন করার সময় নিজের অংশটুকুনও রেখে নিতেন।

তাদের চাইতে বড় মোত্তাকী ও পরহেযগার লোক আর কে ছিলেন ? মহানবী (সাঃ) তাদের সম্পর্কে যা কিছু বলেছেন তা তোমরা ভালো করে জানো। তারা তাকওয়া-পরহেযগারীর নামে নিজেদের সব কিছু বিলিয়ে দেননি। আজ তোমরা জীবন যাপনের যে পন্থা ও মতবাদ উদ্ভাবন করেছো এবং প্রচার করে বেড়াচ্ছো যে , লোকেরা যেন নিজেদের পরিবার-পরিজনের চিন্তা-ভাবনা না করে নিজেদের সমস্ত অর্থ সম্পদ থেকে হাত গুটিয়ে নেয় এবং দুনিয়া ত্যাগ করে বৈরাগ্যবাদ গ্রহণ করে। পক্ষান্তরে রাসূলে পাকের সাহাবাগণ কখনো এ পন্থা অবলম্বন করেননি।

আমি আনুষ্ঠানিকভাবে এ হাদীসটি বর্ণনা করছি , যা আমার পিতা ও তার পিতৃ পুরুষগণ রসুলুল্লাহর মাকবুল (সাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন। আমি তোমাদেরকে সতর্ক করে দিচ্ছি। রাসূলে আকরাম (সাঃ) বলেছেন :

ঈমানদার লোকেরা আশ্চর্যজনক গুণ-বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়ে থাকে। যদি তার দেহকে কেটে টুকরো টুকরো করা হয় তাতেও তার জন্য মঙ্গল ও কল্যাণ নিহিত রয়েছে। আর যদি তাকে পৃ থিবীর পূর্ব ও পশ্চিমের সমস্তদেশগুলোর রাজত্ব দান করা হয় তাহলে সেটাও তার জন্য মঙ্গল ও কল্যাণের ব্যাপারই হবে।

ঈমানদার লোকদের কল্যাণ ও মঙ্গল কি এতেই নিহিত যে , সে অবশ্যই দরিদ্র ও অভাবগ্রস্তহবে ? মুমিনদের উচ্চ মর্যাদা নিভর্র করে ঈমান ও আকীদা বিশ্বাসের উপর। তাই সে দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত অবস্থায় থাকুক অথবা সম্পদের প্রাচুর্যে ডুবে থাকুক , কর্তব্যগুলো যথারীতি আঞ্জাম দিয়ে থাকে। এটাই সে বিশেষ ও ব্যতিক্রম গুণ-বৈশিষ্ট্য যা একজন মর্দে মুমিনের মধ্যে পরিপূর্ণরূপে পাওয়া যায়। আর এ কারণেই যে কোন প্রকারের কষ্ট ও অভাব-অনটন এবং আরাম ও সুবিধা তার জন্য কল্যাণ ও মঙ্গল হয়ে যায়।

আমি জানি না এ বিষয়ে এতোক্ষণ পর্যন্ত আমি যে বক্তব্য রেখেছি , তা তোমাদের জন্য যথেষ্ট কিনা ? নাকি এ বিষয়ে আমাকে আরো কিছু বলতে হবে ? তোমরা জানো যে , ইসলামের প্রথম দিকে মুসলমানদের সংখ্যা খুবই কম ছিল। তখন জিহাদের বিধান ছিল এই যে , একজন মুসলমান দশজন কাফেরের মোকাবিলায় লড়াই করবে। আর যে এমনটা না করতো সে গুণাহগার , নাফরমান ও অপরাধী বলে বিবেচিত হতো। কিন্তু যখন মুসলমানদের সংখ্যা বেড়ে গেল এবং কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অস্ত্র-সরঞ্জাম ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি লাভ করলো তখন মহান আল্লাহ তাঁর দয়া ও মেহেরবানী দ্বারা সে বিধানের পরিবর্তন করে দিলেন। তখন প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব হলো সে দুইজন কাফেরের সাথে মোকাবিলা করবে। এর চেয়ে বেশির সাথে লড়াই করা তার কর্তব্য নয়।

আমি তোমাদেরকে ইসলামের বিচার আদালত এবং বিচার আইন বিষয়ে প্রশ্ন করবো। ইসলামে মজলুমের প্রতি ন্যায়-ইনসাফ করার এবং অপরাধীর শাস্তি প্রদার্নের ব্যাপারে কি বিধানের ব্যবস্থা্ রয়েছে ? ধরো তোমাদের মধ্যে থেকে কারো বিরুদ্ধে ইসলামী আদালতে তার স্ত্রীর খোরপোষের বিষয়ে মামলা দায়ের করা হয়েছে। আর বিচারক তার বিরুদ্ধে এ রায় প্রদান করলো যে , তাকে তার স্ত্রীর খোরপোষ দিতে হবে। তখন সে কি ওযর-আপত্তি পেশ করবে এবং নিজের স্ত্রীর খোরপোষের ব্যবস্থা কিভাবে করবে ? তখন কি সে এ ওযর-আপত্তি পেশ করবে যে , আমি একজন মোত্তাকী- পরহেযগার মানুষ এবং আমি দুনিয়ার অর্থ-সম্পদ পরিত্যাগ করার নীতি অবলম্বন করেছি ? তখন কি তার এ আপত্তি গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে ? আর এটা কি সঙ্গত হবে ? তোমাদের আকীদা বিশ্বাস মতে কি বিচারকের এ নির্দেশ ন্যায়-ইনসাফ ভিত্তিক নয় ? নাকি সেটা অন্যায়-অবিচার ভিত্তিক ? যদি তোমরা বলো যে , বিচারকের এ হুকুম অন্যায় ও অবিচার ভিত্তিক তাহলে তার অর্থ এ দাঁড়াবে যে , তোমরা পরিষ্কার মিথ্যা বলছো। শুধু তাই নয় , বরং তোমাদের এ মিথ্যা দ্বারা তোমরা সমস্ত মুসলমানের সাথে অন্যায় ও বেইনসাফীর কাজ করছো। আর যদি বলো যে , বিচারকের এ বিচার সঠিক তাহলে তার অর্থ হবে যে , তোমাদের ওযর-আপত্তি গ্রহণযোগ্য নয় এবং তা বাতিল। সুতরাং তোমরা এ কথা স্বীকার করে নাও যে , তোমাদের জীবন পদ্ধতি ও মতবাদ ভ্রান্তও বাতিল।

এখানে আরো একটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে যে , মানুষের জীবনে এমন অনেকগুলো অবস্থা আছে যেখানে মুসলমানরা অনেক জরুরি ও অজরুরি খরচ আঞ্জাম দিয়ে থাকে। যেমন কখনো যাকাত দিতে হয়। আবার কখনো কাফফারা (অপরাধের শরীয়তী মাশুল) দিতে হয় , তাহলে যদি তোমাদের মনগড়া সংশোধন মেনে নেয়া হয় এবং সমস্তলোক (তোমাদের মতের) মোত্তাকী পরহেযগার হয়ে যায় আর সকল লোকই যদি জীবনের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় , তখন এমন অবস্থায় এ সমস্ত ফরজ সদকা ও কাফফারার কি হবে ? সোনা-রূপা , ভেড়া-বকরী , গরু-মহিষ , উট- দুম্বা ও অন্যান্য জন্তু-জানোয়ার , খোরমা , কিশমিশ ইত্যাদির যাকাত দেয়া ফরজ। তাহলে এসব জিনিসের ফরজ যাকাতের কি হবে ? যাকাত কি এ জন্য ফরজ করা হয়নি যে , এর দ্বারা গরিব ও অসহায় লোকদের জীবনকে সুন্দর করে গড়া যায় ? আর গরিব লোকও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন যাপন করতে পারে ? দান-উপহারের দ্বারা সৌভাগ্যবান হতে পারে ? ইসলামের এ বিধানটি নিজেই এ কথার সাক্ষ্য-প্রমাণ বহন করে যে , ইসলামের সমস্ত আইন-কানুনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের জীবনযাত্রাকে সুখ-সমৃদ্ধির পান্তে পৌঁছে দেয়া এবং তার সুখ নিশ্চিত করা। আর যদি দ্বীনের উদ্দেশ্য হতো দারিদ্র্য ও দুনিয়া ত্যাগ এবং দ্বীনের শিক্ষা-দীক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যদি এটা হতো যে , মানুষ এ দুনিয়া ও তার ধন-সম্পদ থেকে দূরে থাকবে এবং ফকির ও দরিদ্রের জীবন বেছে নেবে , তাহলে তো তার অর্থ এ দাঁড়াবে যে , যারা গরিব-মিসকিন তারা জীবনের আসল ও উচ্চ লক্ষ্য হাসিল করে ফেলেছে। কাজেই তাদেরকে আর কোন কিছু দেয়া উচিত হবে না যাতে করে তাদের এ মঙ্গল ও কল্যাণকর অবস্থা থেকে সরে যেতে না পারে। এর সাথে সাথে গরিব-মিসকীনদের উচিত হবে যে , তারা কারো কাছ থেকে কোন দান ইত্যাদি কখনোই গ্রহণ করবে না যাতে করে তাদের কল্যাণ ও মঙ্গলকর অবস্থা স্থায়ী থেকে যায় ।

মূল কথা হলো যে , যদি তোমাদের কথা সত্য হিসাবে মেনে নেয়া হয় তাহলে তো কোন লোককেই তার ধন-সম্পদ তার কাছে রেখে দেয়া উচিত নয় , বরং তার সমস্ত সম্পদ অন্যদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া উচিত। ফলে যাকাতের কোন অবকাশই বাকি থাকে না।

তাহলে এখন এ কথা পরিষ্কারভাবে জানা গেল যে , তোমরা একটা মারাত্মক ও খারাপ রাস্তা অবলম্বন করেছো এবং একটা মন্দ পথে লোকদেরকে আহবান করছো। তোমরা যে মতবাদে বিশ্বাস করছো এবং অপরাপর লোকদেরকেও সে পথের দিকে আহবান করছো তার ভিত্তি হলো মুর্খতা , কোরআনী শিক্ষা সম্পর্কে এবং রাসূল (সাঃ)-এর হাদীস ও সুন্নত সম্পর্কে অজ্ঞতা। এ হাদীসগুলো সে হাদীস নয় যা সন্দেহের চোখে দেখা যেতে পারে , বরং এগুলো সে হাদীস যার সত্যতা ও বিশুদ্ধতার সাক্ষী স্বয়ং আল-কোরআন। কিন্তু তোমরা সে নির্ভরযোগ্য ও সনদ যুক্ত হাদীসগুলো গ্রহণ করতে অস্বীকার করছো কারণ সেগুলো তোমাদের মনগড়া মতাদর্শের মোতাবেক নয়। আর এটাও তোমাদের আরেকটা মুর্খতা। তোমরা আল-কোরআনের আয়াতের মধ্যে নিহিত উত্তম ও আশ্চর্যজনক ভেদগুলোর প্রতি চিন্তা-ভাবনা করো না। নাসেখ-মানসখ ও মোহকাম-মোতাশাবেহ আয়াতগুলোর মধ্যকার পার্থক্য নির্ণয় করতেও তোমরা অনভিজ্ঞ। আর আদেশ ও নিষেধগুলোও তোমরা নির্ণয় করতে পার না।

তোমরা আমাকে হযরত সুলাইমান ইবনে দাউদ (আঃ)-এর কাহিনীর ব্যাপারে জবাব দাও- যিনি মহান আল্লাহর দরবারে এমন একটি রাজত্ব চেয়েছিলেন যার চাইতে বৃহৎ আর কোন রাজ্য কেউ পেতে না পারে।21 আর মহান আল্লাহ তাকে ঠিক তেমনি একটি রাজত্ব দানও করেছিলেন। আর এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে , আল্লাহর নবী সুলাইমান (অঃ) তার প্রাপ্য অধিকার ব্যতীত প্রার্থনা করতে পারবে না। মহান আল্লাহ কোরআন মজীদে এটাকে সুলাইমানের দোষের বিষয় বলে সাব্যস্ত করেননি আর কোন মুমিন দোষের বিষয় বলে সাব্যস্ত করেননি। আজ পর্যন্ত কাউকে এ কথা বলতে দেখা যায়নি যে , হযরত সুলাইমান (আঃ) এ পৃথিবীতে এতো বিস্তৃত ও নজিরবিহীন রাজত্ব কেন প্রত্যাশা করলেন ? এমনিভাবে হযরত সুলাইমান (আঃ) এর পূর্বে (তার পিতা) হযরত দাউদ (আঃ) এর ঘটনা স্মরণযোগ্য। অনুরূপভাবে হযরত ইউসফু (আঃ)-এর ঘটনাতেও দেখা যায় হযরত ইউসুফ (আঃ) তৎকালীন বাদশার নিকট সরকারিভাবে একথা বলছেন : রাজ্যের কোষাগারের তথা অর্থনৈতিক বিষয়াদির দায়-দায়িত্বের কাজটি আমার উপরে ছেড়ে দিন। কেননা আমি নির্ভরযোগ্য , বিশ্বস্তও অভিজ্ঞ।22

অতঃপর অবস্থা এই দাঁড়ালো যে , মিশর থেকে ইয়ামেন পর্যন্ত বিস্তৃত বিরাট সাম্রাজ্যের সমস্তদায়- দায়িত্বই তার উপর ন্যস্ত হলো। তিনি হলেন সাম্রাজ্যের বাদশাহ। এ সময় আশপাশের দেশগুলোতে দেখা দিল দুর্ভিক্ষ। সে সব দেশের লোকেরা তার রাজ্য থেকে শাক-সবজি , খাদ্য-খাবার ইত্যাদি কিনে নিয়ে যেতো। কিন্তু না , হযরত ইউসুফ (অঃ) কোনদিন কারো সাথে বেইনসাফী ও অন্যায় কাজ করেছেন। আর না তার থেকে কোন দোষের কথা আল্লাহ কোরআনে বলেছেন। ঠিক তেমনিভাবে জনাব যুলকারনাইনের কাহিনীও কারো অজানা নয়। তিনি খোদার এমন এক বান্দা ছিলেন যে , মহান আল্লাহকে ভালোবাসতেন। আর আল্লাহও তাকে ভালোবাসতেন। তাই তো জাগতিক কারণসমূহ তার অধিকারে চলে আসে। তিনি পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত জগতের অধিপতি হন।

শোনো হে সুফীদল! এ ভ্রান্তপথ পরিত্যাগ করো এবং ইসলামের প্রকৃত ভিত্তিগুলো আঁকড়ে ধরো। মহান আল্লাহ যে সব বিষয়ে বিধি-নিষেধ আরোপ করেছেন তার সীমা লংঘন করো না। আর নিজেদের মনগড়া কোন কিছু আবিষ্কার করো না। যে সব বিষয়ে তোমাদের জ্ঞান নেই সেখানে হস্ত ক্ষেপ করো না। সে সব বিষয়ের জ্ঞান জ্ঞানী লোকদের কাছ থেকে অর্জন করো। নাসেখ ,মানসুখ ,মোহকাম , মোতাশাবেহ ও হালাল-হারামের জ্ঞান হাসিলের চেষ্টায় লিপ্ত থাকো। এতে কেবল তোমাদের জ্ঞান অর্জনের কল্যাণই নয় , বরং তোমাদেরকে অজ্ঞতা ও মুর্খতার অভিশাপ থেকে মুক্তি দেবে। অজ্ঞতা থেকে দূরে থাকো। কেননা অজ্ঞতার পক্ষপাতিত্বকারীদের সংখ্যা অনেক। তার বিপরীতে জ্ঞানের সমর্থক বড়ই কম। মহান আল্লাহ বলেন , জ্ঞান গরিমা ও বদ্ধিমত্তা , জ্ঞানী বুদ্ধিমানদের চাইতেও বড়।23

15

ইমাম সাদিক ( আঃ ) ও একদল সুফী

সুফিয়ান সাওরী মদীনার একজন অধিবাসী। একদিন সে হযরত ইমাম জাফর সাদিক (আঃ)-এর খেদমতে উপস্থিত হলো। দেখতে পেলো ইমাম একটি খুব নরম ও সাদা পোশাক পরিধান করে আছেন। যেন ডিমের খোসা আর ভেতরের তরল অংশের মধ্যবর্তী পাতলা পর্দাটি। তাই সে ইমাম সাদিক (আঃ)-এর প্রতি আপত্তি করে বললো , এ পোশাকটি আপনার জন্য উপযোগী নয়। আপনার পক্ষে এটা কখনও সঙ্গত নয় যে , নিজেকে দুনিয়ার আরাম-আয়েশের সাথে জড়িয়ে ফেলবেন। আপনার কাছ থেকে এটাই আশা যে , খোদাভীতি ও পরহযেগারীর পথ অবলম্বন করে নিজেকে পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য থেকে দূরে রাখবেন।16

ইমাম সাদিক (আঃ) বললেন , আমি তোমাকে এমন একটি কথা বলতে চাই যা তোমার জন্য দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতে কল্যাণকর ও উপকারী হবে। তোমার উদ্দেশ্য যদি হয় এ ব্যাপারে ইসলামের হুকুম-আহকাম সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা তাহলে আমার কথা তোমার জন্য অত্যন্ত উপকারী হবে এবং তুমি এ ব্যাপারে জ্ঞান লাভ করতে পারবে। কিন্তু যদি তোমার উদ্দেশ্য হয় ইসলাম ধর্মে কোন বেদআত প্রবেশ করানো এবং সত্য ইসলাম থেকে সরলপ্রাণ মুসলমানদেরকে বিভ্রান্তির শিকারে পরিণত করা , তাহলে ভিন্ন কথা। কেননা পথভ্রষ্ট ও বেদাআত সৃষ্টিকারী লোকদের জন্য আমার কথা নিস্ফল হয়ে থাকে। সুতরাং তাতে আমার কথা তোমার কোন উপকারে আসবে না। সম্ভবত তোমার মনে রাসূলে আকরাম (সাঃ) ও তার সাহাবীবৃন্দের সহজ-সরল ও দারিদ্র্যের জীবন যাপনের কথা জেগে উঠেছে। আর তাতে তুমি এ কথা মনে করে নিয়েছো যে , কেয়ামত পর্যন্ত মুসলমানদের জন্য দারিদ্র্যের জীবন যাপন করা ফরজ করে দেয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ব্যাপার তা নয়। রাসূলে আকরাম (সাঃ) ও তাঁর অনুগত সাথীগণ এভাবে দারিদ্র্যের ও কষ্ট-ক্লেশের জীবন যাপন করেছিলেন তখন , যখন সমাজের চারদিকে অভাব-অনটন , দুঃখ-দারিদ্র্য , কষ্ট-ক্লেশ , অনাহার-অর্ধাহার ইত্যাদি ছড়িয়ে ছিল। আর তখন লোকেরা সে সব মৌলিক বস্তু থেকে বঞ্চিত ছিল যা সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অত্যন্ত জরুরী। তাই রাসূল (সাঃ) ও তাঁর অনুগত সাহাবীদের জীবন যাপনের মান তৎকালের সাধারণ মানুষের অবস্থার সাথে মিল ছিল। কিন্তু যে যুগে জীবন যাপনের যাবতীয় সামগ্রী সহজে পাওয়া যায় এবং আল্লাহর নেয়ামতসমূহ উপভোগের সুযোগ-সুবিধা বর্তমান থাকে তখন তো আল্লাহর নেয়ামতসমূহ থেকে উপকার লাভ করার সবচেয়ে বেশি অধিকার হচ্ছে তাঁর অনুগত প্রিয় বান্দাদেরই।

আল্লাহর সে সব নেয়ামতের উপর অসৎ ও ফাসেক লোকদের চাইতে তাঁর সৎ ও নেক বান্দাদের অধিকার কতোই না বেশি। নেয়ামতসমূহের অধিকার কাফেরদের লত নায়সম লমানদের কতোই না অধিক! তুমি কোন বিষয়টিকে আমার দোষের বিষয় হিসেবে নির্ণয় করেছো ? মহান আল্লাহর শপথ করে বলছি , যেভাবে তুমি দেখতে পাচ্ছো যে , আমি আল্লাহর দেয়া নেয়ামতসমূহ ব্যবহার করছি , ঠিক তেমনিভাবে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্তআমার জীবনে এমন একটি মুহূর্তও অতিবাহিত হয়নি যে , আমি আমার মাল-সম্পদ থেকে অন্যদের অধিকার পৌঁছে দেইনি। প্রতিটি সকাল-সন্ধ্যা এ চিন্তা-ভাবনায় নিমজ্জিত থাকি যে , আমার মাল-সম্পদে যার যে হক আছে তা যেন যথাসময়ে তার কাছে পৌঁছে দিতে পারি

সুফিয়ান সাওরী ইমামের যুক্তিসংগত কথার জবাব দিতে পারলো না এবং মাথা ঝুঁকিয়ে চলে গেল। তারপর সে তার বন্ধু-বান্ধব ও তার মতবাদে বিশ্বাসীদের সাথে সাক্ষাৎ করে সমস্তঘটনা তাদেরকে শোনালো। তাতে তারা সকলে মিলে ফয়সালা করলো যে , তারা সকলে সম্মিলিতভাবে ইমাম সাদিক (আঃ)-এর সাথে এ বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক করবে।

অবশেষে একদিন সুফিয়ান সাওরী ও তার সকল সাথী ইমাম সাদিক (আঃ)-এর খেদমতে হাজির হলো। তারা বললো , আমাদের বন্ধু তার কথাকে হক প্রমাণ করার ব্যাপারে উপযুক্ত দলিল-প্রমাণ পেশ করতে পারেনি। তাই আমরা এখন সুস্পষ্ট দলিল-প্রমাণের দ্বারা আপনাকে নিরুত্তর করতে এসেছি

ইমাম সাদিক (আঃ) বললেন , বলো! তোমাদের সে সমস্ত প্রমাণ কি যা দিয়ে তোমরা আমাকে নিরুত্তর করতে চাও

তারা বললো , আমরা কোরআনের আয়াত দিয়েই আমাদের দলিল-প্রমাণ পেশ করতে চাই

সাথে সাথেই ইমাম (আঃ) বললেন , কোরআনের চাইতে উত্তম দলিল আর কি হতে পারে ? সুতরাং তোমরা তোমাদের দলিল উপস্থাপন করো। আমি তোমাদের দলিলাদি শোনার জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত রয়েছি । তারা বললো , আমরা আমাদের মতবিশ্বাসের সত্যতা প্রমাণের জন্য কোরআনের দুটি আয়াত তুলে ধরবো। আর আমাদের কথা পরিষ্কার করার জন্য এ দুটি আয়াত যথেষ্ট। আল কোরআনের এক স্থানে মহান আল্লাহ রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর কোন কোন সাহাবাদের প্রশংসা এভাবে করেছেন :

যদিও তাদের নিজেদের প্রয়োজন মিটতো না এবং অভাব-অনটন ও দারিদ্র্য অবস্থায় ছিল নিমজ্জিত। তবুও অপর লোকদেরকে নিজেদের উপর প্রাধান্য দিয়েছে এবং তাদের প্রয়োজন মিটিয়েছে। আর যারা নিজেদেরকে কৃপণতা থেকে রক্ষা করেছে তারাই সফলকাম17

আল কোরআনের অন্য এক স্থা্নে বলা হয়েছে :

যদিও তাদের খাদ্য-খাবারের প্রয়োজন ও আগ্রহ ছিল সে অবস্থাতেও তারা নিজেদের খাবার ইয়াতিম , মিসকীন ও কয়েদিকে দান করে দিয়েছে18

তাদের বক্তব্য শেষ হওয়ার সাথেই সাথেই এ মজলিসে উপস্থিত এক ব্যক্তি যে এতোক্ষণ তাদের কথাবার্তাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছিল , সে নিজের পক্ষ থেকে বলে উঠলো , তোমাদের এতোক্ষণের আলাপ-আলোচনায় আমি যা বুঝতে পেরেছি তা হলো-তোমাদের কথাবার্তায় তোমাদের নিজেদেরই আত্মবল নেই। আসলে এ সমস্ত দলিল দ্বারা তোমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে যে , লোকেরা যেনো নিজেদের ধন-সম্পদ ও মালিকানার প্রতি কোন প্রকার মায়া-আকর্ষণ না রাখে এবং তার বেশির ভাগ অংশ যেনো তোমাদের মতো ফকির-মিসকিন লোকদেরকে দিয়ে দেয় যাতে তোমরা তাদের পরিবর্তে ভোগ করতে পারো।

এ কারণে বাস্তবে তোমাদেরকে দেখা যায়নি যে , তোমরা উত্তম উত্তম খাবার ত্যাগ করেছো। ইমাম (আঃ) বললেন , আপাতত এসব কথা বাদ দাও কোন ফল নেই । এরপর ইমাম (আঃ) সুফীদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন , তোমরা তো কোরআন মজীদ থেকে দলিলাদি পেশ করছো। কিন্তু তার আগে একটা কথা বলো , তোমরা কি আল-কোরআনের মোহকাম-মোতাশাবেহ নাসেখ-মানসুখ আয়াতগুলোর মাঝে পার্থক্য করতে পারো ? এই উম্মতের থেকে যারাই পথভ্রষ্ট হয়েছে তারা এ পথেই পথভ্রষ্ট হয়েছে। কারণ তারা কোরআনের সঠিক খবর না রেখেই তা আঁকড়ে ধরে।

সুফীরা বললো , এ বিষয়ে আমাদের জ্ঞান মোটামটি। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান আমাদের নেই । ইমাম বললেন , তোমাদের দুর্ভাগ্য এটাই। কোরআনের আয়াতের মতো রাসূলে পাক (সাঃ)-এর হাদীসও রয়েছে। এগুলোর উপর পূর্ণ অবগতি রাখা দরকার। কিন্তু তোমরা কোরআনের যে আয়াতগুলোকে পাঠ করেছ , তাতে তো আল্লাহর নেয়ামতসমূহ ব্যবহার করা হারাম বলা হয়নি। এ আয়াতগুলো বদান্যতা , দয়া-দান ও ত্যাগের সাথে সম্পৃক্ত। এ আয়াতগুলোতে আল-কোরআন সে সকল লোকের প্রশংস্রা করছে যারা একটা বিশেষ সময়ে অপরকে নিজেদের উপর প্রাধান্য দিয়েছেন। অন্যদের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিয়ে তারা নিজেদের হালাল মাল নিজেরা ব্যবহার করার পরিবর্তে অপরকে দান করে দিয়েছেন। যদি তারা এ মাল না দিতেন তাহলেও তাদের কোন গুণাহ হতো না। কেননা মহান আল্লাহ তাদেরকে হুকুম করেননি যে , অবশ্যই এটা করতে হবে। তেমনি আল্লাহ তাদেরকে এ কাজ করতে বাধাও দেননি। সুতরাং তারা নিজেরা দয়া ও সহানুভূতির বশবর্তী হয়ে নিজেরা কষ্ট করেছেন এবং তাদের মাল-সম্পদ অপরকে দিয়ে দিয়েছেন। যার প্রতিদান মহান আল্লাহ তাদেরকে দেবেন। অতএব এ আয়াতগুলো ও তোমাদের দাবির মধ্যে কোন মিল নেই। কেননা তোমরা সে সমস্ত লোকের তিরস্কার ও নিন্দা করছো যারা নিজেদের মাল-সম্পদ ও খোদার দেয়া নেয়ামত ভোগ করে থাকে।

তিনি বললেন , সে সমস্তলোক , [রাসূলে খোদা (সাঃ)-এর সাহাবাগণ] সেদিন এ ধরনের দান- খয়রাতের দৃষ্টান্ত রেখেছেন। কিন্তু পরবর্তীতে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে পরিপূর্ণ বিধান এসেছে যেখানে আল্লাহ এ কাজের একটা সীমা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। যেহেতু এ হুকুমটি পরে এসেছে তাই তাদের (সাহাবাদের) সে আমলকে রহিত করে দিয়েছে। সুতরাং আমাদেরকে এ হুকুম মেনে চলা উচিত। সে আমলকে নয়।

মহান আল্লাহ মমিন-মসলমানদের অবস্থার সংশোধনের জন্য এবং তার বিশেষ রহমতের দ্বারা এ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন যে , কোন লোক নিজের পরিবার-পরিজনকে কষ্টের মধ্যে রেখে তার সমস্ত সহায় অপরকে দান করে দেবে। কেননা তার পরিবারে এমন শিশু , বৃদ্ধ ও দূর্বল লোকজন থাকে যারা এ কষ্ট সহ্য করতে পারে না। ধরে নাও , আমার কাছে একটি রুটি আছে আর আমি তা অন্যকে দিয়ে দিলাম। তখন তার পরিণতি এই দাঁড়াবে যে , আমার পরিবার-পরিজন যাদের ভরণ-পোষণের দায়

দায়িত্ব আমার উপর রয়েছে তারা না খেয়ে ধ্বংসের মুখে পতিত হবে। এ জন্য রাসূলে আকরাম (সাঃ) বলেছেন , যদি কোন লোকের কাছে কিছু খোরমা অথবা কিছু রুটি কিংবা কিছু দিনার বা টাকা থাকে আর সে দান করতে চায় , তাহলে প্রথমে উচিত তার পিতামাতাকে দান করবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে নিজের ও তার স্ত্রী-সন্তানের জন্য দান করবে। তৃতীয় পর্যায়ে তার আত্মীয়-স্বজন ও মুমিন ভাইদেরকে দান করবে। আর চতুর্থ পর্যায়ে ভালো ও কল্যাণ কাজে দান করার পালা। এভাবে দান-খয়রাত ইত্যাদির পালা আসে সবার শেষে।

রসূলুলাহ (সাঃ) যখন শুনতে পেলেন যে , এক আনসার মারা গেছে , আর তার ছোট ছোট ছেলেমেয়ে বর্তমান রয়েছে , এদিকে মৃত্যুর পূর্বে সে তার সমস্ত সম্পদ আল্লাহর পথে দান করে দিয়েছে। তখন রাসূল (সাঃ) বললেন , এ সংবাদ যদি তোমরা আমাকে পূর্বেই দিয়ে দিতে তাহলে আমি তাকে মুসলমানদের কবরস্থানে দাফন করার অনুমতি দিতাম না। সে তার ছেলে-মেয়েদেরকে অসহায় অবস্থায় রেখে গেছে। এখন তারা অপরের সামনে হাত পাতছে।

আমার পিতা হযরত ইমাম বাকের (আঃ) আমার কাছে বর্ণনা করেন যে , রাসূলে পাক (সাঃ) বলেছেন , সব সময় দানখয়রাতের ব্যাপারে নিজের সন্তানদের থেকে শুরুকরবে। এরপর আত্মীয়- স্বজনের যে যত নিকটের হবে সে ততো প্রাধান্য পাবে।

এতসব কিছু ছাড়াও আল-কোরআন তোমাদের মতবিশ্বাসের বিপক্ষে রায় প্রদান করে থাকে। আল কোরআনের এক স্থানে এভাবে বলা হয়েছে :

মোত্তাকী , পরহেযগার ও খোদাভীরুলোক তারাই যারা দান করার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়িও করে না। কৃপণতাও করে না , বরং মধ্যম নীতি অবলম্বন করে।19 কোরআন মজীদের অনেক আয়াতেই যেমনিভাবে কৃপণতা করতে নিষেধ করা হয়েছে , ঠিক তেমনিভাবে খরচ ও দান করার ক্ষেত্রেও অতিরিক্ত ও অপাত্রে করতে বাধা দান করেছে। এ ব্যাপারে আল-কোরআন একটি মধ্যম নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে। এটা উচিত নয় যে , কোন লোক তার সমস্তসম্পদ অপর লোকদের মধ্যে বণ্টন করে দিয়ে নিজে দারিদ্র্য ও অভাবগ্রস্ত হয়ে মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করছে , হে পরোয়ারদিগার! আমাকে রিযিক দান করো । মনে রাখবে যে , মহান আল্লাহ এমন লোকদের দোয়া কখনো কবুল করেন না। আল্লাহর নবী (সাঃ) বলেছেন , মহান আল্লাহ কিছু সংখ্যক লোকদের দোয়া কখনো কবুল করেন না। তারা হলো :

(ক) যে ব্যক্তি আল্লাহর নিকটে নিজের পিতামাতার অকল্যাণ প্রার্থনা করে।

(খ) যে ব্যক্তি নিজের সম্পদ কাউকে ধার দেয়। কিন্তু কোন সাক্ষীও রাখে না আর লিখিত কোন প্রমাণও রেখে দেয় না। এদিকে ঋণগ্রহীতা টাকাগুলো মেরে দেয়। তখন সে হাত তুলে দোয়া করে আল্লাহর কাছ থেকে সমাধান চায়। তাহলে আল্লাহ তার দোয়া কখনো কবুল করেন না। কেননা সে কোন প্রকার সাক্ষ্য-প্রমাণ না রেখে অপরকে ঋণ দিয়ে নিজেই সমাধানের পথ বিনষ্ট করে ফেলেছে।

(গ) যে ব্যক্তি মহান আল্লাহর দরবারে এ দোয়া করে যে , তাকে যেনো তার স্ত্রীর অনিষ্টতা হতে মুক্তি দান করেন , তাহলে এমন ব্যক্তির দোয়া মহান আল্লাহ মোটেও শোনেন না। এ জন্য যে , স্ত্রীর অনিষ্টতা থেকে মুক্তি লাভের পন্থা ও পদ্ধতি তার নিজের হাতেই রয়েছে। যদি সত্য সত্যই সে স্ত্রীর ব্যাপারে অতিষ্ঠ হয়ে গেছে তাহলে তার অধিকার রয়েছে যে , এমন স্ত্রীকে তালাক দিয়ে নিজের মুক্তির পথ বেছে নেবে।

(ঘ) যে ব্যক্তি নিজের ঘরে হাতের উপর হাত রেখে বসে থাকে আর রিযিকের জন্য দোয়া করে আল্লাহর কাছে তখন এমন লোকের দোয়ার জবাবে আল্লাহ বলেন :

হে আমার বান্দা! আমি কি তোমার জন্যে নড়াচড়া ও চলাফেলার রাস্তা খোলা রাখিনি ? আমি কি তোমাকে নিখুঁত ও মজবুত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান করিনি ? আমি তোমাকে হাত-পা , কান-নাক ও আকল- বুদ্ধি দান করেছি যাতে করে তুমি এগুলো দিয়ে দেখে-শুনে ও চিন্তা-ভাবনা করে হাত-পা ইত্যাদি ব্যবহার করে রিযিকের সন্ধানে বেরিয়ে পড়তে পারো। এ সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সৃষ্টির একটা উদ্দেশ্য আছে। এ নেয়ামতগুলোর কৃতজ্ঞতা হচ্ছে যে , তুমি এগুলোর সদ্ব্যবহার করবে। এভাবে আমি আমার ও তোমার মাঝে উসিলা নির্ধারণ করেছি যাতে করে তুমি প্রতিটি জিনিস হাসিল করার জন্য তোমার মেহনতের দ্বারা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারো। আর শ্রম-সাধনার সাথে সম্পৃক্ত কাজগুলো পালন করতে পারো এবং অন্যের কাঁধের বোঝা যেনো তোমাকে হতে না হয়। তোমার চেষ্টা যদি আমার ইচ্ছা মোতাবেক হয় তাহলে আমি তোমাকে যথেষ্ট পরিমাণে রিযিক দান করবো । আর যদি সংগত কোন কারণে তোমার উন্নতি না হয় তাহলেও তুমি অন্তত এ প্রশান্তিলাভ করতে পারবে যে , তোমাকে চেষ্টা করতে বলা হয়েছিল , তুমিও চেষ্টা করেছো। এখানে তোমার কোনো দোষ নেই।

(ঙ) সে ব্যক্তি যাকে মহান আল্লাহ অনেক ধন-সম্পদ দিয়েছেন। আর সে দান করতে গিয়ে তার সমস্তসম্পদ শেষ করে দিয়েছে। এর পরে সে আল্লাহর কাছে এ দোয়া করে : হে আমার প্রভু! আমাকে রিযিক দান করো। তখন আল্লাহ এমন লোকের জবাবে বলেন :

আমি কি তোমাকে অনেক অনেক রিযিক দান করিনি ? তুমি কেন মধ্যম নীতি অবলম্বন করোনি ? আমি কি এ হুকুম দেইনি যে , দান করার ব্যাপারে মধ্যম নীতি অবলম্বন করো ? আমি কি দান-খয়রাতের বেলায় বেহিসাবে খরচ করার ব্যাপারে তোমাদেরকে নিষেধ করিনি ? (চ) সে ব্যক্তির দোয়াও কবুল হয় না , যে ব্যক্তি মহান আল্লাহর দরবারে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার ব্যাপারে দোয়া করে। আর যে আল্লাহর কাছে এমন জিনিস প্রার্থনা করে যা দ্বারা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন হওয়াটা অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে।

মহান আল্লাহ কোরআন পাকে বিশেষভাবে তাঁর রাসূলকে দান করার পদ্ধতি শিখিয়েছেন। একটি ঘটনা এভাবে বর্ণিত হয়েছে যে , আল্লাহর নবী (সাঃ)-এর নিকট কিছু স্বর্ণমূদ্রা ছিল। তিনি তা দরিদ্র লোকদের মধ্যে বন্টন করে দিতে চাচ্ছিলেন। তিনি চাননি যে , এক রাতের জন্যও সে স্বর্ণমুদ্রাগুলো তার ঘরে পড়ে থাকুক। তাই তিনি সারাদিন ধরে সে মুদ্রাগুলো লোকদের মধ্যে বণ্টন করে দিলেন। পরদিন সকালে একজন ভিক্ষুক তাঁর বাড়িতে আসলো এবং সাহায্য প্রার্থনা করলো। সে ভিক্ষুকটি তার প্রয়োজনের তাগিদে বার বার সাহায্যের প্রার্থনা করলো। সে ভিক্ষুকটি তার প্রয়োজনের তাগিদে বার বার সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছিল। কিন্তু নবী (সাঃ)-এর কাছে তাকে দেবার মতো কিছুই ছিল না। এতে তিনি খুবই দুঃখিত হলেন। তখন কোরআন মজীদের এ আয়াত অবতীর্ণ হলো যেখানে মহান আল্লাহ দান করার ব্যাপারে তাঁর বিধান জারি করেছেন :

নিজের হাতকে মুষ্টিবদ্ধ করো না। আর না এতোখানি খুলে রেখো , যাতে করে পরে খালি হাত হয়ে যেতে হয় এবং ভিক্ষুকের সাহায্য প্রার্থনার সময় লজ্জিত ও দুঃখিত হতে হয়।20

এগুলো সে সমস্ত হাদীস যা হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে। আর আল- কোরআনের আয়াতসমূহ এ হাদীসগুলোতে বর্ণিত বিষয়াদিকে সমর্থন করে। তাহলে আল-কোরআনে বিশ্বাসী ঈমানদার লোক যারা , তারা কোরআনে বর্ণিত বিষয়াদির প্রতি ও ঈমান রাখে।

মৃত্যুর সময়ে হযরত আবু বকরকে বলা হয়েছিল : আপনার ধন-সম্পদ সম্পর্কে অসিয়ত (অন্তিম উপদেশ) করুন। তিনি বললেন , আমার সম্পদের এক-পঞ্চমাংশ দান করে দিও। আর অবশিষ্টাংশ উত্তরাধিকারীদের জন্য রইলো। এক-পঞ্চমাংশ সম্পদ কম নয়। বস্তুত হযরত আব বকর স্বীয় সম্পদের এক-পঞ্চমাংশের ব্যাপারে অসিয়ত করেছেন। প্রকৃতপক্ষে একজন রোগীর অধিকার হচ্ছে মৃত্যু রোগের সময়ও সে তার সম্পদের এক-তৃতীয়াংশেরই অসিয়ত করবে। যদি জানতেন যে তার সমুদয় অধিকারকে কাজে লাগানো উত্তম হবে তাহলে এক-তৃতীয়াংশেরই ওসীয়ত করে যেতেন।

হযরত সালমান ফারসী ও হযরত আবু যার গিফারীর খোদাভীতি-পরহেযগারী ও অন্যান্য ফজিলত ও মর্যাদার কারণে সবাই তাদেরকে খবু ভালোভাবে চেনে। তাদের জীবন যাপনের পদ্ধতি ও চরিত্র- আখলাকও ছিল এরূপ।

হযরত সালমান ফারসী যখন বাইতুলমাল থেকে নিজের বাৎসরিক ভাতা গ্রহণ করতেন তখন সেখান থেকে এক বছরের খরচাদিকে বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় টাকা-পয়সা নিজের কাছে সংরক্ষিত রাখতেন যাতে করে পরবর্তী বছরের ভাতা পাওয়া পর্যন্তকোন অসুবিধায় পড়তে না হয়। লোকেরা সালমানকে জিজ্ঞাসা করলো :

আপনি এতো বড় একজন মোত্তাকী পরহেযগার লোক হয়েও এক বছরের পুঁজি জমা করে রাখার চিন্তা-ভাবনা করছেন! ধরুন আজকালের মধ্যেই আপনার মৃত্যু হয়ে গেল এবং বছরের শেষ পর্যন্তজীবিত থাকতে পারলেন না তাহলে এক বছরের পুঁজি জমা করে রাখার পেছনে ফায়দা কি ? তাদের প্রশ্নের জবাবে হযরত সালমান ফারসী বললেন , হতে পারে আমি মরবো না। তোমরা কেন এ কথা ধরে নিয়েছো যে , আমি মরেই যাবো। এর বদলে তোমরা এটাও ধরে নিতে পারো যে , আমি আগামী বছর পর্যন্তবেঁচে থাকবো। আর যদি আমি জীবিত থেকে যাই তাহলে আমার জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় খরচাদির সর্বাবস্থায় দরকার হবে। হে অজ্ঞ লোকেরা! তোমরা এ বাস্তব সত্য সম্পর্কে মোটেও ধারণা রাখো না যে , মানুষের কাছে যদি জীবন যাপনের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বর্তমান না থাকে তাহলে তার মন আল্লাহর আনুগত্য করার ব্যাপারে বেপরোয়া হয়ে যায় এবং আলার আনুগত্য করার জন্য অন্তরের যে স্বস্তিও প্রশান্তিদরকার তার মধ্যে সেটার অভাব দেখা দেয়। আর যদি জীবনযাপন সামগ্রী তার কাছে পুরোপুরি বর্তমান থাকে তাহলে সে আল্লাহর আনুগত্য করার ক্ষেত্রে মোটেও অবহেলা করে না।

কিন্তু হযরত আবু যার গিফারীর নিকট কিছু উট ও ভেড়া-বকরী ছিল , যেগুলোর দুধ পান করে তিনি জীবন যাপন করতেন। কখনো যদি তার গোশত খাবার ইচ্ছা হতো কিংবা বাড়িতে যদি কোন মেহমান আসতো অথবা কোন দরিদ্র-গরিব মানুষের অভাব-অনুভব করতেন তাহলে সে জন্তুগুলো দ্বারা প্রয়োজন মেটাতেন। অন্য লোকদের মাঝে গোশত বন্টন করার সময় নিজের অংশটুকুনও রেখে নিতেন।

তাদের চাইতে বড় মোত্তাকী ও পরহেযগার লোক আর কে ছিলেন ? মহানবী (সাঃ) তাদের সম্পর্কে যা কিছু বলেছেন তা তোমরা ভালো করে জানো। তারা তাকওয়া-পরহেযগারীর নামে নিজেদের সব কিছু বিলিয়ে দেননি। আজ তোমরা জীবন যাপনের যে পন্থা ও মতবাদ উদ্ভাবন করেছো এবং প্রচার করে বেড়াচ্ছো যে , লোকেরা যেন নিজেদের পরিবার-পরিজনের চিন্তা-ভাবনা না করে নিজেদের সমস্ত অর্থ সম্পদ থেকে হাত গুটিয়ে নেয় এবং দুনিয়া ত্যাগ করে বৈরাগ্যবাদ গ্রহণ করে। পক্ষান্তরে রাসূলে পাকের সাহাবাগণ কখনো এ পন্থা অবলম্বন করেননি।

আমি আনুষ্ঠানিকভাবে এ হাদীসটি বর্ণনা করছি , যা আমার পিতা ও তার পিতৃ পুরুষগণ রসুলুল্লাহর মাকবুল (সাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন। আমি তোমাদেরকে সতর্ক করে দিচ্ছি। রাসূলে আকরাম (সাঃ) বলেছেন :

ঈমানদার লোকেরা আশ্চর্যজনক গুণ-বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়ে থাকে। যদি তার দেহকে কেটে টুকরো টুকরো করা হয় তাতেও তার জন্য মঙ্গল ও কল্যাণ নিহিত রয়েছে। আর যদি তাকে পৃ থিবীর পূর্ব ও পশ্চিমের সমস্তদেশগুলোর রাজত্ব দান করা হয় তাহলে সেটাও তার জন্য মঙ্গল ও কল্যাণের ব্যাপারই হবে।

ঈমানদার লোকদের কল্যাণ ও মঙ্গল কি এতেই নিহিত যে , সে অবশ্যই দরিদ্র ও অভাবগ্রস্তহবে ? মুমিনদের উচ্চ মর্যাদা নিভর্র করে ঈমান ও আকীদা বিশ্বাসের উপর। তাই সে দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত অবস্থায় থাকুক অথবা সম্পদের প্রাচুর্যে ডুবে থাকুক , কর্তব্যগুলো যথারীতি আঞ্জাম দিয়ে থাকে। এটাই সে বিশেষ ও ব্যতিক্রম গুণ-বৈশিষ্ট্য যা একজন মর্দে মুমিনের মধ্যে পরিপূর্ণরূপে পাওয়া যায়। আর এ কারণেই যে কোন প্রকারের কষ্ট ও অভাব-অনটন এবং আরাম ও সুবিধা তার জন্য কল্যাণ ও মঙ্গল হয়ে যায়।

আমি জানি না এ বিষয়ে এতোক্ষণ পর্যন্ত আমি যে বক্তব্য রেখেছি , তা তোমাদের জন্য যথেষ্ট কিনা ? নাকি এ বিষয়ে আমাকে আরো কিছু বলতে হবে ? তোমরা জানো যে , ইসলামের প্রথম দিকে মুসলমানদের সংখ্যা খুবই কম ছিল। তখন জিহাদের বিধান ছিল এই যে , একজন মুসলমান দশজন কাফেরের মোকাবিলায় লড়াই করবে। আর যে এমনটা না করতো সে গুণাহগার , নাফরমান ও অপরাধী বলে বিবেচিত হতো। কিন্তু যখন মুসলমানদের সংখ্যা বেড়ে গেল এবং কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অস্ত্র-সরঞ্জাম ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি লাভ করলো তখন মহান আল্লাহ তাঁর দয়া ও মেহেরবানী দ্বারা সে বিধানের পরিবর্তন করে দিলেন। তখন প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব হলো সে দুইজন কাফেরের সাথে মোকাবিলা করবে। এর চেয়ে বেশির সাথে লড়াই করা তার কর্তব্য নয়।

আমি তোমাদেরকে ইসলামের বিচার আদালত এবং বিচার আইন বিষয়ে প্রশ্ন করবো। ইসলামে মজলুমের প্রতি ন্যায়-ইনসাফ করার এবং অপরাধীর শাস্তি প্রদার্নের ব্যাপারে কি বিধানের ব্যবস্থা্ রয়েছে ? ধরো তোমাদের মধ্যে থেকে কারো বিরুদ্ধে ইসলামী আদালতে তার স্ত্রীর খোরপোষের বিষয়ে মামলা দায়ের করা হয়েছে। আর বিচারক তার বিরুদ্ধে এ রায় প্রদান করলো যে , তাকে তার স্ত্রীর খোরপোষ দিতে হবে। তখন সে কি ওযর-আপত্তি পেশ করবে এবং নিজের স্ত্রীর খোরপোষের ব্যবস্থা কিভাবে করবে ? তখন কি সে এ ওযর-আপত্তি পেশ করবে যে , আমি একজন মোত্তাকী- পরহেযগার মানুষ এবং আমি দুনিয়ার অর্থ-সম্পদ পরিত্যাগ করার নীতি অবলম্বন করেছি ? তখন কি তার এ আপত্তি গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে ? আর এটা কি সঙ্গত হবে ? তোমাদের আকীদা বিশ্বাস মতে কি বিচারকের এ নির্দেশ ন্যায়-ইনসাফ ভিত্তিক নয় ? নাকি সেটা অন্যায়-অবিচার ভিত্তিক ? যদি তোমরা বলো যে , বিচারকের এ হুকুম অন্যায় ও অবিচার ভিত্তিক তাহলে তার অর্থ এ দাঁড়াবে যে , তোমরা পরিষ্কার মিথ্যা বলছো। শুধু তাই নয় , বরং তোমাদের এ মিথ্যা দ্বারা তোমরা সমস্ত মুসলমানের সাথে অন্যায় ও বেইনসাফীর কাজ করছো। আর যদি বলো যে , বিচারকের এ বিচার সঠিক তাহলে তার অর্থ হবে যে , তোমাদের ওযর-আপত্তি গ্রহণযোগ্য নয় এবং তা বাতিল। সুতরাং তোমরা এ কথা স্বীকার করে নাও যে , তোমাদের জীবন পদ্ধতি ও মতবাদ ভ্রান্তও বাতিল।

এখানে আরো একটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে যে , মানুষের জীবনে এমন অনেকগুলো অবস্থা আছে যেখানে মুসলমানরা অনেক জরুরি ও অজরুরি খরচ আঞ্জাম দিয়ে থাকে। যেমন কখনো যাকাত দিতে হয়। আবার কখনো কাফফারা (অপরাধের শরীয়তী মাশুল) দিতে হয় , তাহলে যদি তোমাদের মনগড়া সংশোধন মেনে নেয়া হয় এবং সমস্তলোক (তোমাদের মতের) মোত্তাকী পরহেযগার হয়ে যায় আর সকল লোকই যদি জীবনের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় , তখন এমন অবস্থায় এ সমস্ত ফরজ সদকা ও কাফফারার কি হবে ? সোনা-রূপা , ভেড়া-বকরী , গরু-মহিষ , উট- দুম্বা ও অন্যান্য জন্তু-জানোয়ার , খোরমা , কিশমিশ ইত্যাদির যাকাত দেয়া ফরজ। তাহলে এসব জিনিসের ফরজ যাকাতের কি হবে ? যাকাত কি এ জন্য ফরজ করা হয়নি যে , এর দ্বারা গরিব ও অসহায় লোকদের জীবনকে সুন্দর করে গড়া যায় ? আর গরিব লোকও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন যাপন করতে পারে ? দান-উপহারের দ্বারা সৌভাগ্যবান হতে পারে ? ইসলামের এ বিধানটি নিজেই এ কথার সাক্ষ্য-প্রমাণ বহন করে যে , ইসলামের সমস্ত আইন-কানুনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের জীবনযাত্রাকে সুখ-সমৃদ্ধির পান্তে পৌঁছে দেয়া এবং তার সুখ নিশ্চিত করা। আর যদি দ্বীনের উদ্দেশ্য হতো দারিদ্র্য ও দুনিয়া ত্যাগ এবং দ্বীনের শিক্ষা-দীক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যদি এটা হতো যে , মানুষ এ দুনিয়া ও তার ধন-সম্পদ থেকে দূরে থাকবে এবং ফকির ও দরিদ্রের জীবন বেছে নেবে , তাহলে তো তার অর্থ এ দাঁড়াবে যে , যারা গরিব-মিসকিন তারা জীবনের আসল ও উচ্চ লক্ষ্য হাসিল করে ফেলেছে। কাজেই তাদেরকে আর কোন কিছু দেয়া উচিত হবে না যাতে করে তাদের এ মঙ্গল ও কল্যাণকর অবস্থা থেকে সরে যেতে না পারে। এর সাথে সাথে গরিব-মিসকীনদের উচিত হবে যে , তারা কারো কাছ থেকে কোন দান ইত্যাদি কখনোই গ্রহণ করবে না যাতে করে তাদের কল্যাণ ও মঙ্গলকর অবস্থা স্থায়ী থেকে যায় ।

মূল কথা হলো যে , যদি তোমাদের কথা সত্য হিসাবে মেনে নেয়া হয় তাহলে তো কোন লোককেই তার ধন-সম্পদ তার কাছে রেখে দেয়া উচিত নয় , বরং তার সমস্ত সম্পদ অন্যদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া উচিত। ফলে যাকাতের কোন অবকাশই বাকি থাকে না।

তাহলে এখন এ কথা পরিষ্কারভাবে জানা গেল যে , তোমরা একটা মারাত্মক ও খারাপ রাস্তা অবলম্বন করেছো এবং একটা মন্দ পথে লোকদেরকে আহবান করছো। তোমরা যে মতবাদে বিশ্বাস করছো এবং অপরাপর লোকদেরকেও সে পথের দিকে আহবান করছো তার ভিত্তি হলো মুর্খতা , কোরআনী শিক্ষা সম্পর্কে এবং রাসূল (সাঃ)-এর হাদীস ও সুন্নত সম্পর্কে অজ্ঞতা। এ হাদীসগুলো সে হাদীস নয় যা সন্দেহের চোখে দেখা যেতে পারে , বরং এগুলো সে হাদীস যার সত্যতা ও বিশুদ্ধতার সাক্ষী স্বয়ং আল-কোরআন। কিন্তু তোমরা সে নির্ভরযোগ্য ও সনদ যুক্ত হাদীসগুলো গ্রহণ করতে অস্বীকার করছো কারণ সেগুলো তোমাদের মনগড়া মতাদর্শের মোতাবেক নয়। আর এটাও তোমাদের আরেকটা মুর্খতা। তোমরা আল-কোরআনের আয়াতের মধ্যে নিহিত উত্তম ও আশ্চর্যজনক ভেদগুলোর প্রতি চিন্তা-ভাবনা করো না। নাসেখ-মানসখ ও মোহকাম-মোতাশাবেহ আয়াতগুলোর মধ্যকার পার্থক্য নির্ণয় করতেও তোমরা অনভিজ্ঞ। আর আদেশ ও নিষেধগুলোও তোমরা নির্ণয় করতে পার না।

তোমরা আমাকে হযরত সুলাইমান ইবনে দাউদ (আঃ)-এর কাহিনীর ব্যাপারে জবাব দাও- যিনি মহান আল্লাহর দরবারে এমন একটি রাজত্ব চেয়েছিলেন যার চাইতে বৃহৎ আর কোন রাজ্য কেউ পেতে না পারে।21 আর মহান আল্লাহ তাকে ঠিক তেমনি একটি রাজত্ব দানও করেছিলেন। আর এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে , আল্লাহর নবী সুলাইমান (অঃ) তার প্রাপ্য অধিকার ব্যতীত প্রার্থনা করতে পারবে না। মহান আল্লাহ কোরআন মজীদে এটাকে সুলাইমানের দোষের বিষয় বলে সাব্যস্ত করেননি আর কোন মুমিন দোষের বিষয় বলে সাব্যস্ত করেননি। আজ পর্যন্ত কাউকে এ কথা বলতে দেখা যায়নি যে , হযরত সুলাইমান (আঃ) এ পৃথিবীতে এতো বিস্তৃত ও নজিরবিহীন রাজত্ব কেন প্রত্যাশা করলেন ? এমনিভাবে হযরত সুলাইমান (আঃ) এর পূর্বে (তার পিতা) হযরত দাউদ (আঃ) এর ঘটনা স্মরণযোগ্য। অনুরূপভাবে হযরত ইউসফু (আঃ)-এর ঘটনাতেও দেখা যায় হযরত ইউসুফ (আঃ) তৎকালীন বাদশার নিকট সরকারিভাবে একথা বলছেন : রাজ্যের কোষাগারের তথা অর্থনৈতিক বিষয়াদির দায়-দায়িত্বের কাজটি আমার উপরে ছেড়ে দিন। কেননা আমি নির্ভরযোগ্য , বিশ্বস্তও অভিজ্ঞ।22

অতঃপর অবস্থা এই দাঁড়ালো যে , মিশর থেকে ইয়ামেন পর্যন্ত বিস্তৃত বিরাট সাম্রাজ্যের সমস্তদায়- দায়িত্বই তার উপর ন্যস্ত হলো। তিনি হলেন সাম্রাজ্যের বাদশাহ। এ সময় আশপাশের দেশগুলোতে দেখা দিল দুর্ভিক্ষ। সে সব দেশের লোকেরা তার রাজ্য থেকে শাক-সবজি , খাদ্য-খাবার ইত্যাদি কিনে নিয়ে যেতো। কিন্তু না , হযরত ইউসুফ (অঃ) কোনদিন কারো সাথে বেইনসাফী ও অন্যায় কাজ করেছেন। আর না তার থেকে কোন দোষের কথা আল্লাহ কোরআনে বলেছেন। ঠিক তেমনিভাবে জনাব যুলকারনাইনের কাহিনীও কারো অজানা নয়। তিনি খোদার এমন এক বান্দা ছিলেন যে , মহান আল্লাহকে ভালোবাসতেন। আর আল্লাহও তাকে ভালোবাসতেন। তাই তো জাগতিক কারণসমূহ তার অধিকারে চলে আসে। তিনি পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত জগতের অধিপতি হন।

শোনো হে সুফীদল! এ ভ্রান্তপথ পরিত্যাগ করো এবং ইসলামের প্রকৃত ভিত্তিগুলো আঁকড়ে ধরো। মহান আল্লাহ যে সব বিষয়ে বিধি-নিষেধ আরোপ করেছেন তার সীমা লংঘন করো না। আর নিজেদের মনগড়া কোন কিছু আবিষ্কার করো না। যে সব বিষয়ে তোমাদের জ্ঞান নেই সেখানে হস্ত ক্ষেপ করো না। সে সব বিষয়ের জ্ঞান জ্ঞানী লোকদের কাছ থেকে অর্জন করো। নাসেখ ,মানসুখ ,মোহকাম , মোতাশাবেহ ও হালাল-হারামের জ্ঞান হাসিলের চেষ্টায় লিপ্ত থাকো। এতে কেবল তোমাদের জ্ঞান অর্জনের কল্যাণই নয় , বরং তোমাদেরকে অজ্ঞতা ও মুর্খতার অভিশাপ থেকে মুক্তি দেবে। অজ্ঞতা থেকে দূরে থাকো। কেননা অজ্ঞতার পক্ষপাতিত্বকারীদের সংখ্যা অনেক। তার বিপরীতে জ্ঞানের সমর্থক বড়ই কম। মহান আল্লাহ বলেন , জ্ঞান গরিমা ও বদ্ধিমত্তা , জ্ঞানী বুদ্ধিমানদের চাইতেও বড়।23


4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18