ইসলাম ও শীয়া মাযহাব

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব 11%

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 31 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 41877 / ডাউনলোড: 5858
সাইজ সাইজ সাইজ
ইসলাম ও শীয়া মাযহাব

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

‘ইসলাম ও শীয়া মাযহাব’ নামক এ গ্রন্থে ইসলামের দু’টি বৃহৎ উপদলের (শীয়া ও সুন্নী) অন্যতম শীয়া মাযহাবের প্রকৃত পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে । শীয়া মাযহাবের উৎপত্তি, বিকাশ ও চিন্তাধারার প্রকৃতি এবং ইসলামী জ্ঞানের ব্যাপারে শীয়া মাযহাবের দৃষ্টিভঙ্গী এ বইয়ে আলোচিত হয়েছে ।


1

তৃতীয় পদ্ধতি

অর্ন্তদর্শন বা ( কাশফ )

মানুষ ও আধ্যাত্মিক উপলদ্ধি

বিশ্বের অধিকাংশ মানুষই জীবনের বস্তুগত চাহিদা মেটানোর স্বার্থে দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে অথচ আধ্যাত্মিক চাহিদা মেটানোর জন্য সামান্য পরিশ্রমও করছেনা । তবুও এর পাশাপাশি প্রতিটি মানুষের হৃদয়েই জন্মগত ভাবে সত্য দর্শনের প্রবল বাসনা নিহিত রয়েছে । আত্মিক এ বাসনার অনুভুতি অনেক মানুষের মধ্যেই সক্রিয় , যার ফলে তা তাদেরকে এক প্রকারের আত্মিক উপলদ্ধির ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধ করে । প্রতিটি মানুষই বাস্তবতায় বিশ্বাসী এমনকি বাস্তবতা অস্বীকারকারী সুফিষ্ট (যেমতে সত্যকে আপেক্ষিক গণ্য করা হয়) বা সংশয়বাদীরাও প্রকৃতপক্ষে বাস্তবতায় বিশ্বাসী । মানুষ যখন স্বচ্ছ ও পবিত্র হৃদয়ে এ সৃষ্টিজগত অবলোকন করে তখন সে এ সৃষ্টিজগতের নশ্বরতা উপলদ্ধি করে । এসময়ে সে এ বিশ্বের সৃষ্টিকূলকে আয়না স্বরূপ দেখতে পায় , যার মধ্যে অবিনশ্বর বাস্তবতার সৌন্দর্য প্রতিফলিত দৃশ্যের অসহ্য সৌন্দর্য , তার দৃষ্টি থেকে অন্য যে কোন সৌন্দর্যকেই নগণ্য ও অম্লান করে দেয় । এ আধ্যাত্মিক উপলদ্ধি পার্থিব জীবনের অস্থায়ী অথচ আপাত: মধুর বিষয়ের আস্বাদ গ্রহণ থেকে তাকে বিরত রাখে । এটাই সেই আধ্যাত্মিক (ইরফানি) আকর্ষণ , যার ফলে স্রষ্টার প্রতি অনুরাগী মানুষের মনোযোগ আরও উচ্চতর জগতের প্রতি আকৃষ্ট হয় । তখন তা ঐশী যৌক্তিকতাকে মানুষের হৃদয়ে স্থান দেয় এবং এ ছাড়া অন্যসব কিছুই তখন সে ভুলে যায় । এসময় তার মনের অন্তহীন কামনা-বাসনার বিচ্ছেদ ঘটে । তখন সে দর্শন ও শ্রবণের চেয়েও স্পষ্টতর উপলদ্ধিযোগ্য অথচ বাহ্যতঃ অদৃশ্য স্রষ্টার উপাসনায় নিমগ্ন হয়ে পড়ে । অবশ্য এটা মানুষের হৃদয়ে লুকায়িত স্রষ্টাপুজার এক জন্মগত স্বভাব , যা পৃথিবীর মানুষকে আল্লাহর উপাসনায় উদ্বুদ্ধ করে । সেই প্রকৃতপক্ষে আধ্যাত্মিক পুরুষ , যে মহান আল্লাহকে কোন পুরস্কার প্রাপ্তির আশা১২৯ অথবা শাস্তির ভয় ছাড়াই শুধুমাত্র ভালবাসার কারণেই আল্লাহর ইবাদত বা উপাসনা করে । অতএব , এখান থেকে এটাই স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে , ইরফান বা আধ্যাত্মিকতাকে অবশ্যই ইসলামের বিভিন্ন মাযহাবের মতই অন্য একটি মাযহাব হিসেবে গণ্য করা ঠিক হবে না । বরঞ্চ , ইরফান বা আধ্যাত্মিকতাতো আল্লাহর ইবাদতেরই একটি পন্থা । আর এটা (পুরস্কার প্রাপ্তির আশায় বা শাস্তির ভয়ে নয় , বরঞ্চ ভালবাসার ভিত্তিতে ইবাদতের পন্থা) হচ্ছে ধর্মের বাহ্যিকরূপ ও বুদ্ধিবৃত্তিক ধর্মীয় উপলদ্ধির মোকাবিলায় ধর্মের নিগূড় রহস্য উপলদ্ধির একটি পন্থা । এমনকি প্রতিটি ধর্মেই একটি আত্মিক পদ্ধতির অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকে । যেমন : মূর্তি পুজারী , অগ্নি উপাসক , ইহুদী ও খৃষ্টান ধর্মের অনুসারীদের মধ্যেও আধ্যাত্মবাদী ও অ-আধ্যাত্মবাদীদের অস্তিত্ব রয়েছে ।

ইসলামে ইরফান বা আধ্যাত্মিকতার অভ্যুদয়

মহানবী (সা.)-এর সাহাবীদের মধ্যে ( ইলমে রিজালে র গ্রন্থসমূহে প্রায় বারো হাজার সাহাবীর পরিচিতি লিপিবদ্ধ হয়েছে) একমাত্র হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর পাঞ্জল বর্ণনাই ইরফানি বা আধ্যাত্মিক নিগূঢ়তত্ব সম্পন্ন এবং আধ্যাত্মিক জীবনের স্তরসমূহের সাথে সংশ্লিষ্ট , যা ইসলামের এক অমূল্য সম্পদ ভান্ডার । কিন্তু অন্যান্য সাহাবীদের বক্তব্য বা রচনায় এধরণের বিষয়ের কোন সন্ধানই পাওয়া যায় না । এমনকি হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর শিষ্যদের মত মহান শিষ্যও আর কারও ছিল না । যাদের মধ্যে হযরত সালমান ফারসী (রা.) , হযরত রশিদ হাজারী (রা.) , হযরত মাইসাম তাম্মার (রা.) অন্যতম । এযাবৎ পৃথিবীতে যত আরেফ বা আধ্যাত্মিক পুরুষই এসেছেন , সবাই হযরত আলী (আ.) এর পর উপরোক্ত মহান শিষ্যদেরকে তাদের আধ্যাত্মিক গুরুদের তালিকার শীর্ষে স্থান দিয়েছেন । ইসলামে আধ্যাত্মিক পুরুষদের উপরোক্ত স্তরের পরবর্তী স্তর দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীতে যারা জন্ম গ্রহণ করেছেন , তাদের মতে তাউসে ইয়ামানী , মালিক বিন দিনার , ইব্রাহীম আদহাম , এবং শাকিক বালখীর নাম উল্লেখযোগ্য । তবে এরা আরেফ বা সুফী (আধ্যাত্মিক পুরুষ) হিসেবে আত্মপ্রকাশের পরিবর্তে কৃচ্ছতা সাধানকারী (যাহেদ) হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন । এবং জনগণের কাছে ওয়ালি আল্লাহ বা সতঃসিদ্ধ পুরুষ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন । কিন্তু এরা কোনক্রমেই নিজেদের আত্মগঠনের প্রক্রিয়ার বিষয়টিকে তাদের পূর্ববর্তী স্তরের মহান পুরুষদের সাথে কখনও সংশ্লিষ্ট করেননি । এর পরবর্তী স্তরে হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষভাগে এবং হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর প্রথমদিকে আরেকটি আধ্যাত্মবাদী দলের অভ্যুদয় ঘটে । জনাব বায়েজীদ বোস্তামী , মারূফ কিরখী , জুনাইদ বাগদাদী প্রমূখ এ স্তরের অন্তর্ভুক্ত এরা সবাই আধ্যাত্মবাদের প্রক্রিয়ার অনুসারী ছিলেন এবং আরেফ বা সুফী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন । এরা সবাই কাশফ (আত্মঃউপলদ্ধি) এবং শুহুদের (অর্ন্তদর্শন) ভিত্তিতে বক্তব্য প্রদান করেছেন । তাদের ঐধরণের কথা ইসলামে বাহ্যিকরূপের সাথে ছিল সাংঘর্ষিক । ফলে তাদের ঐসব কর্মকান্ড সমসাময়িক ফকীহ (ইসলামী আইন বিশারদ) ও মুতাকাল্লিমিন দের (ইসলামী বিশ্বাস শাস্ত্রবিদ) তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে তোলে । যার পরিণতিতে তারা অত্যন্ত জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হন । তাদের অনেকের জেলে বন্দীজীবন কাটাতে হয় । অনেকেই নৃশংস অত্যাচারের সম্মুখীন হন । আবার অনেকেরই ফাঁসির কাষ্ঠে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে । এতকিছুর পরও তারা তাদের আধ্যাত্মবাদী প্রক্রিয়ার স্বপক্ষে বিরোধীদের সাথে লড়াই করে যেতে থাকেন । আর একারণেই তাদের তরীকত বা আধ্যাত্মিকপন্থা ধীরে ধীরে প্রসার লাভ করতে থাকে । এভাবে সপ্তম ও অষ্টম হিজরী শতাব্দীতে এসে এই তরীকত বা আধ্যাত্মবাদ পূর্ণ শক্তিতে আত্মপ্রকাশ লাভ করে । এরপর তখন থেকে আজ পর্যন্ত আধ্যাত্মবাদ কখনওবা শক্তিমত্তার সাথে আবার কখনও দূর্বলাবস্থায় আত্মপ্রকাশ করেছে । আর এভাবে আজও সে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে ।১৩০

ইতিহাসের এই এরফান বা আধ্যাত্মবাদের অধিকাংশ মাশায়েখগণই (সিদ্ধপুরুষ) বাহ্যতঃ আহলে সুন্নাতের মাযহাবের অনুসারী ছিলেন । বর্তমান তরীকত পন্থীদের বিশেষ আচরণ বিধি ও সংস্কৃতি সবই তাদের পূর্ব পুরুষদেরই স্মৃতি বাহক , যার সাথে পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ নির্দেশিত পদ্ধতির তেমন কোন সংহতি নেই । অবশ্য তাদের বেশ কিছু নিয়মনীতি ও সংস্কৃতি শীয়াদের মধ্যেও কিছুটা সংক্রমিত হয়েছে । একদল লোক এব্যাপারে বলেছেন যে , ইসলামে আধ্যাত্মবাদের প্রক্রিয়া সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়নি । তবে মুসলমানরা নিজেরাই আত্মউপলদ্ধি ও আত্মশুদ্ধির প্রক্রিয়া আবিস্কার করেছে , যা আল্লাহর কাছেও গৃহীত হয়েছে । যেমনঃ খৃষ্টানদের মধ্যে চিরকুমার জীবন যাপনের ব্যাপারে হযরত ঈসা মসীহ্ (আ.) কিছুই বলেননি । বরং খৃষ্টানরাই তা আবিস্কার করেছে এবং তা সর্বজনগ্রাহ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে ।১৩১ এভাবে প্রত্যেক তরিকত পন্থী দলের প্রতিষ্ঠাতা মুর্শেদ যে বিশেষ নিয়মনীতি বা কর্মপদ্ধতিকে উপযোগী বলে নির্ধারণ করেছেন , তাই তার মুরিদগণকে অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন । আর সেটাই পরবর্তীতে একটি ব্যাপক ও স্বকীয় আধ্যাত্মিক পদ্ধতি হিসেবে গড়ে উঠেছে । উদাহরণ স্বরূপ , বিশেষ পদ্ধতিতে যিকিরের অনুষ্ঠান , আধ্যাত্মমূলক সংগীত চর্চা ও যিকিরকালীন চরম উল্লাসের বহিঃপ্রকাশ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য । এমনকি কোন কোন তরিকত পন্থীদের কার্যকলাপ কখনও কখনও এমন পর্যায়ে গিয়ে দাড়ায় যে , ইসলামী শরীয়ত একদিকে আর তরীকত পদ্ধতি তার বিপরীত দিকে অবস্থান গ্রহণ করে । এসব তরীকত পন্থীরা বাস্তবে বাতেনী বা গুপ্ত পন্থীদেরই দলভুক্ত হয়েছে । কিন্তু পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর মাপকাঠি অনুসারে শীয়াদের দৃষ্টিতে ইসলামের স্বরূপ তথাকথিত তরীকতপন্থীদের বিপরীত । যদি এপথই সঠিক হত , তাহলে ইসলামের নির্দেশাবলীও অবশ্যই মানুষকে এবাস্তব সত্যের দিকেই পরিচালিত করত । এটা কখনোই সম্ভব নয় যে , ইসলাম তার কিছু কর্মসূচীর ব্যাপারে অবহেলা করবে অথবা হারাম বা ওয়াজিব কোন বিষয় লংঘনের ব্যাপারে কাউকে ক্ষমা করে দেবে ।

কুরআন ও সুন্নাহ নির্দেশিত আত্মশুদ্ধিমূলক আধ্যাত্মিকতার কর্মসূচী

মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের বহুস্থানে বলেছেন যে , মানুষ কুরআনের অর্থ উপলদ্ধির জন্য যেন গভীর ভাবে চিন্তাভাবনা ও গবেষণা করে । সে সামান্য কিছু বাহ্যিক অর্থ বোঝার মাধ্যমেই যেন তুষ্ট না হয় । পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াতে এ সৃষ্টিজগতকে মহান আল্লাহর অসীম মহিমার নিদর্শন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন । পবিত্র কুরআনে উদ্ধৃত ঐসব নিদর্শনাবলীর প্রতি একটু গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করলেই বোঝা যাবে যে , নিদর্শনগুলো অন্য কিছুর প্রতিই নির্দেশ করছে , নিজের প্রতি নয় । যেমন : লাল বাতি সাধারণতঃ বিপদের সংকেত হিসেবে ব্যবহৃত হয় । কোন ব্যক্তি লাল বাতি দেখা মাত্রই বিপদের আশাংকা করে । তখন সে বিপদের আশাংকা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না । কারণ: তখন যদি সে ঐ বাতির রং , কাঁচ ইত্যাদি সম্পর্কে চিন্তা করে তাহলে সে সেখানে বিপদের কোন চিত্রও খুজে পাবে না । সুতরাং এ সৃষ্টিজগত যদি মহান আল্লাহর নিদর্শন হয়ে থাকে , তাহলে এ সৃষ্টিজগতের কোন স্বাধীন ও সার্বভৌম অস্তিত্ব থাকে না । তখন যেদিকেই আমরা তাকাই না কেন , শুধুমাত্র মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর অস্তিত্ব আমরা খুজে পাব না ।

তাই যে ব্যক্তি পবিত্র কুরআনের শিক্ষা ও হেদায়েতের দ্বারা আলোকিত হয়ে ঐ দৃষ্টিতে এ সৃষ্টিজগতের দিকে তাকাবে , সেও পবিত্র ও মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর অস্তিত্বই উপলদ্ধি করবে না । অন্যরা পৃথিবীর বাহ্যিক সৌন্দর্য অবলোকন করে । কিন্তু সে এই সংকীর্ণ পৃথিবীর জানালা দিয়ে সর্বস্রষ্টা আল্লাহর অনন্ত ও অনুপম সৌন্দর্য অবলোকন করে , যা এ সৃষ্টিজগতের মধ্যে আত্মপ্রকাশিত হয়ে আছে । তখন সে নিজের সমগ্র অস্তিত্বকে ভুলে গিয়ে একমাত্র আল্লাহর ভালবাসার কাছে স্বীয় হৃদয় সমর্পণ করে । এটা অত্যন্ত স্পষ্ট বিষয় যে , এই বিশেষ উপলদ্ধি নিঃসন্দেহে মানুষের পঞ্চোন্দ্রিয় বা কল্পনা বা বুদ্ধিবৃত্তির কাজ নয় । বরঞ্চ এসব মাধ্যম নিজেই আল্লাহর এক বিশেষ নিদর্শন স্বরূপ । আর ঐসব মাধ্যমের দ্বারা মানুষ প্রকৃত হেদায়েত পেতে সক্ষম নয় ।১৩২

আর আল্লাহর এ পথের সন্ধান প্রাপ্তি সম্পূর্ণ রূপে আত্মবিস্মৃত হয়ে শুধুমাত্র মহান আল্লাহকে স্মরণ করার মত যোগ্যতা অর্জন করা ছাড়া সম্ভব নয় । মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেছেনঃ হে মুমিনগণ , তোমরা তোমাদের আত্মার অবস্থা সম্পর্কে চিন্তা কর । তোমরা যখন সৎপথে রয়েছ , তখন কেউ পথভ্রষ্ট হলে তাতে তোমাদের কোন ক্ষতি নেই । (সূরা আল মায়েদা , ১০৫ নং আয়াত ।)

অর্থাৎ মানুষ তখন বুঝতে সক্ষম হবে যে , মহান আল্লাহর হেদায়েত প্রাপ্তির একমাত্র পথই হচ্ছে মানুষের নিজের বিবেকের প্রতি দৃষ্টিপাত করা । আর মহান আল্লাহ ই্ তার পথ নির্দেশকারী । তার বিবেক ও মহান আল্লাহ মানুষকে তখন তার নিজের প্রকৃতরূপকে ভালভাবে চিনতে ও উপলদ্ধি করতে উদ্বুদ্ধ করে । যাতে করে অন্যসকল পথত্যাগ করে একমাত্র আত্মউপলদ্ধির পথ সে অনুসরণ করে । তখন সে স্বীয় আত্মার সংকীর্ণ জানালা দিয়ে স্বীয় স্রষ্টার প্রতি দৃষ্টিপাত করতে সক্ষম হয় । আর এভাবেই সে নিজের অস্তিত্বের প্রকৃতপক্ষে রহস্যের সন্ধান প্রায় । এ ব্যাপারে আমাদের মহানবী (সা.) বলেছেন : যে নিজেকে চিনতে পেরেছে , সে আল্লাহকে-ও চিনতে পেরেছে ।১৩৩ মহানবী (সা.) আরও বলেছেন : তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আল্লাহকে ভালভাবে জানেন , যে নিজের আত্মাকে ভাল করে চিনেছে ।১৩৪

আর এপথ অনুসরণের কর্মসূচীর ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে অনেক আয়াত উদ্ধৃত হয়েছে । সেখানে মহান আল্লাহ তাকে স্মরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন । বলেছেনঃ তোমরা আমাকেই স্মরণ কর , তাহলে আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করব । (সূরা আল বাকারা , ১৫২ নং আয়াত) ।

এছাড়া পবিত্র কুরআনও সুন্নাহর সর্বত্র বিস্তারিত ভাবে সৎকাজের প্রতি আদেশ করা হয়েছে । অবশেষে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে : নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ । (সূরা আহজাব , ২১ নং আয়াত ।)

তাহলে এটা কি করে সম্ভব যে , ইসলাম আল্লাহর পথের সন্ধান দিয়েছে অথচ জনসাধারণের কাছে তা বর্ণনা করেনি । অথবা সেই সত্যপথের সন্ধানের বিষয়টি মানুষের কাছে বর্ণনা করার ব্যাপারে আদৌ গুরুত্ব দেয়নি ও এ ব্যাপারে অবহেলা করেছে ?

অথচ , পবিত্র কুরআনের অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেছেন যে , প্রত্যেক উম্মতের মধ্যে হতে আমি একজন বর্ণনাকারী দাড় করাব যে তাদের মধ্য থেকেই তাদের বিপক্ষে এবং তাদের বিষয়ে আপনাকে সাক্ষী স্বরূপ উপস্থাপন করব । আমি আপনার প্রতি গ্রন্থ নাযিল করেছি যেটি এমন যে তাতে প্রত্যেকটি বস্তুর সুস্পষ্ট বর্ণনা , হেদায়েত , রহমত এবং আত্মসমর্পণকারীদের জন্যে রয়েছে সুসংবাদ । (সূরা আল নাহল , ৮৯ নং আয়াত ।)

তৃতীয় অধ্যায়

দ্বাদশ ইমামপন্থী শীয়াদের দৃষ্টিতে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস

অস্তিত্ব ও বাস্তব জগতের প্রতি দৃষ্টিপাত

ইমাম আলী (আ.)-এর পাঁচ বছরের খেলাফতের ফসল

হযরত আলী (আ.) তার 4 বছর 9 মাসের শাসন আমলে খেলাফত প্রশাসনের স্তুপীকৃত অরাজকতা ও বিশৃংখলাকে সম্পূর্ণরূপে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে যদিও সমর্থ হননি তবুও এ ক্ষেত্রে তিনটি মৌলিক সাফল্য অর্জিত হয়েছিল ।

1 । নিজের অনুসৃত ন্যায়পরায়ণতা ভিত্তিক জীবনাদর্শের মাধ্যমে জনগণকে এবং বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে মহানবী (সা.)-এর পবিত্র ও আকর্ষনীয় জীবনাদর্শের সাথে পরিচিত করেন । মুয়াবিয়ার চোখ ধাধানো রাজকীয় জীবন যাপন পদ্ধতির সমান্তরাল তিনি জনগণের মাঝে অতি দরিদতেম জীবন যাপন করতেন । তিনি কখনো নিজের বন্ধু-বান্ধব , পরিবার বা আত্মীয় স্বজনকে অন্যায়ভাবে অন্যদের উপর অগ্রাধিকার দেননি । অথবা ধনীকে দরিদ্রের উপর বা সক্ষমকে অক্ষমের উপর কখনো তিনি অগ্রাধিকার দেননি ।

2 । পর্বতসম সমস্যাকীর্ণ দিনগুলো অতিবাহিত করা সত্ত্বেও জনগণের মাঝে তিনি ইসলামের সত্যিকারের অমূল্য জ্ঞান সম্ভার বা সম্পদ রেখে গেছেন ।

হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর বিরোধীরা বলত , ইমাম আলী (আ.) একজন মহাবীর ছিলেন । তিনি কোন রাজনীতিবিদ ছিলেন না । কেননা , তিনি বিরোধীদের সাথে সাময়িক বন্ধুত্ব স্থাপন ও তেলমর্দনের মাধ্যমে তিনি পরিস্থিত্রিক শান্ত করে , নিজের খেলাফতের ভিত্তিকে শক্তিশালী করতে পারতেন । অতঃপর সময় বুঝে তাদের দমন করতে পারতেন ।

কিন্তু বিরোধীরা একথাটি ভুলে গেছে যে হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর খেলাফত ছিল এক বৈপ্লবিক আন্দোলন । আর যে কোন বৈপ্লবিক আন্দোলনকেই সব ধরণের তৈল মর্দন ও মেকী আচরণ নীতিগুলো বর্জন করতে হয় । ঠিক একই পরিস্থিতি মহানবী (সা.)-এর নবুয়ত প্রাপ্তির যুগেও পরিলক্ষিত হয় । মহানবী (সা.)-কে মক্কার কাফের ও মুশরিকরা বহুবার আপোষের প্রস্তা দিয়েছিল । তাদের প্রস্তাব ছিল , মহানবী (সা.) যেন তাদের খোদাগুলোর ব্যাপারে প্রকাশ্যে বিরোধীতা না করেন , তাহলে তারাও মহানবী (সা.)-এর ইসলাম প্রচারের ব্যাপারে কোন বাধা দেবে না । কিন্তু মহানবী (সা.) তাদের এই প্রস্তাব আদৌ মেনে নেননি । অথচ নবুয়তের চরম দূযোগপূর্ণ সেই দিনগুলোতে তৈলমদন ও আপোষমুখী নীতি গ্রহণের মাধ্যমে তিনি নিজের রাজনৈতিক অবস্থানকে সুদৃঢ় করতে পারতেন । অতঃপর সময় সুযোগ মত শত্রুদের দমন করতে পারতেন । কিন্তু সত্যিকারের ইসলাম প্রচার নীতি কখনই একটি সত্যকে হত্যার মাধ্যমে অন্য একটি সত্যকে প্রতিষ্ঠা বা একটি মিথ্যাকে দিয়ে অন্য একটি মিথ্যাকে অপসারণ করার অনুমতি দেয় না । এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াত উল্লেখযোগ্য ।49

আবার অন্য দিকে হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর শত্রুরা তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য চরিতার্থের জন্যে যে কোন ধরণের অন্যায় অপরাধ এবং ইসলামের সুস্পষ্ট নীতিলংঘনের ব্যাপারেও কুন্ঠিত হয়নি । শুধু তাই নয় , নিজেদের চারিত্রিক কলঙ্ক গুলোকে সাহাবী বা মুজতাহীদ (ইসলামী গবেষক) উপাধি দিয়ে আড়াল করার প্রয়াস পেয়েছেন । অথচ হযরত ইমাম আলী (আ.) সব সময়ই ইসলামী নীতিমালার পুঙ্খানু পুঙ্খ অনুসরণের ব্যাপারে ছিলেন বদ্ধ পরিকর ।

হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর দ্বারা বর্ণিত জ্ঞান-বিজ্ঞান , বুদ্ধিবৃত্তিক প্রজ্ঞা এবং সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ক প্রায় এগারো হাজার অমূল্য সংক্ষিপ্ত হাদীস সংরক্ষিত হয়েছে ।50 তিনি ইসলামের সুগভীর জ্ঞানরাজীকে অত্যন্ত শুদ্ধ ও উন্নত অথচ প্রাঞ্জল ভাষার বক্তৃতামালায়51 বর্ণনা করেছেন ।52 তিনিই সর্বপ্রথম আরবী ভাষার ব্যাকারণ ও সাহিত্যের মূলনীতি রচনা করেন । তিনিই সর্বপ্রথম ব্যক্তি যিনি ইসলামের উচ্চতর দর্শনের সুদৃঢ় ভিত্তিস্থাপন করেন এবং উন্মুক্ত যুক্তি-বিন্যাস ও যৌক্তিক প্রত্যক্ষ প্রমাণের মাধ্যমে ইসলামকে ব্যাখার নীতি প্রচলন করেন । সে যুগের দার্শনিকরা তখনও যেসব দার্শনিক সমস্যার সমাধান দিতে ব্যর্থ হয়ে ছিলেন , তিনি সেসব সমস্যার সমাধান দিয়ে ছিলেন । এমন কি এ ব্যাপারে তিনি এতবেশী গুরুত্বারোপ করতেন যে , যুদ্ধের ভয়াবহ ডামাডোলের মাঝেও53 সুযোগ মত ঐসব জ্ঞানগর্ভ মুলক পর্যালোচনার প্রয়াস পেতেন ।

3 । হযরত ইমাম আলী (আ.) ব্যাপক সংখ্যক লোককে ইসলামী পণ্ডিত ও বিশেষজ্ঞ হিসেবে গড়ে তোলেন ।54 ইমাম আলী (আ.)-এর কাছে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ঐসব জ্ঞানী- পণ্ডিতদের মাঝে হযরত ওয়ায়েস কারানী (রা.) , হযরত কুমায়েল বিন যিয়াদ (রা.) , হযরত মেইসাম তাম্মার (রা.) ও রশীদ হাজারীর (রা.) মত অসংখ্য সাধুপুরুষও ছিলেন । যারা ইতিহাসে ইসলামী ইরফানের (আধ্যাত্মবাদ) উৎস হিসেবে পরিচিত । ইমাম আলী (আ.)-এর শিষ্যদের মধ্যে আবার অনেকেই ইসলামী ফিকাহ (আইন শাস্ত্র) , কালাম (মৌলিক বিশ্বাস সংক্রান্ত শাস্ত্র) , তাফসীর , কিরাআত (কুরআনের শুদ্ধপঠন শাস্ত্র) ও অন্যান্য বিষয়ের মুল উৎস হিসেবে পরিচিত ।


4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18