ইমাম আসকারী (আ.)

ইমাম আসকারী (আ.)0%

ইমাম আসকারী (আ.) লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ইমাম হাসান বিন আলী আল আসকারী (আ.)

  • শুরু
  • পূর্বের
  • 17 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 4368 / ডাউনলোড: 1984
সাইজ সাইজ সাইজ
ইমাম আসকারী (আ.)

ইমাম আসকারী (আ.)

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

ইমাম আসকারী (আ.)

দার রাহে হাক প্রকাশনীর লেখকবৃন্দ

ভূমিকা

হযরত মুহাম্মদ (সা.) - এর ইন্তেকালের পর উম্মতের জন্য তাঁর রেখে যাওয়া বারোজন ইমামের মধ্যে ইমাম আবু মুহাম্মদ হাসান বিন আলী আসকারী (আ.) হলেন একাদশ ইমাম। তাঁর পিতা হচ্ছেন দশম ইমাম হযরত হাদী (আ.) ও মাতা মহীয়সী নারী হুদাইসা , যিনি সুসান নামেও পরিচিত ছিলেন। যেহেতু ইমাম সামররা শহরের আসকার1 অঞ্চলে বসবাস করতেন সে কারণেই তিনি আসকারী নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তিনি যাকী ও নাকী উপাধিতে ভূষিত হন এবং আবু মুহাম্মদ হচ্ছে তাঁর উপনাম।

ইমামের 22 বছর বয়সে তাঁর পিতা হযরত হাদী (আ.) শাহাদাত বরণ করেন। তিনি 6 বছর ইমামতের দায়িত্ব পালন করেন ও 28 বছর বয়সে 260 হিজরী সনে শাহাদাত বরণ করেন। তাঁর একমাত্র সন্তান হযরত হুজ্জাত ইবনুল হাসান আল মাহ্দী দ্বাদশ ইমামের পদে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। মেঘের অন্তরালে লুকায়িত সূর্য্যরে ন্যায় আমাদের যুগের নেতা ও কর্তৃত্বশালী , ইমাম মাহ্দী (আ.) আল্লাহর ইচ্ছা ও অনুমতি ক্রমে আবির্ভূত হয়ে পৃথিবীকে করবেন ন্যায় বিচারে পরিপূর্ণ।

যারা ইমাম আসকারী (আ.) - এর সাক্ষাৎ পেয়েছেন তারা তাঁর ব্যাপারে বলেছেন যে , তিনি উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের , সুনয়ন ও আকর্ষণীয় চেহারা বিশিষ্ট ও তাঁর ব্যক্তিত্ব ও ভাবমূর্তি অন্যকে প্রভাবিত ও আচ্ছন্ন করে ফেলতো। চারিত্রকভাবেও তিনি সকল মহৎ গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন।

আব্বাসীয় খলিফা মুতাওয়াক্কেল , মুনতাসের , মোস্তা ইন , মো তায , মোহতাদি ও মো তামেদ এর শাসনামলে ইমাম তাঁর জীবন অতিবাহিত করেন এবং খলিফা মো তামেদের শাসনামলে শাহাদাত বরণ করেন।2

ইমামত

বারো ইমামের প্রত্যেকের নাম ও পরিচয় রাসূল (সা.)-এর বর্ণিত হাদিস থেকে স্পষ্টভাবে পাওয়া গেলেও প্রত্যেক ইমাম তাঁদের পরবর্তী ইমামকে নিজস্ব বন্ধুমহল ও অনুসারীদের নিকট পরিচয় করাতেন। ইমাম আসকারী (আ.)-এর ব্যাপারেও তদ্রুপ বহু রেওয়ায়েত বর্ণিত আছে যার কয়েকটি এখানে উল্লিখিত হলো :

1 আবু হাশেম জা ফরী ” (শিয়াদের নির্ভরযোগ্য ও প্রসিদ্ধ হাদিস বর্ণনাকারীদের একজন এবং কয়েকজন ইমামের বিশেষ সহযোগী ) বলেন : একদিন ইমাম হাদী (আ.) - এর সাক্ষাৎ লাভ করতে গেলে তিনি বললেন : আমার পুত্র হাসান আমার উত্তরাধিকারী , আমার উত্তরাধিকারীর উত্তরাধিকারীর সাথে তোমরা কেমন আচরণ করবে ?

বললাম : কেন , আল্লাহ্ আমাকে আপনার জন্য উৎসর্গ করুক।

বললেন : যেহেতু তাঁকে দেখবে না , তাই তার নাম (م ح م د ) উচ্চারণ করা সমীচীন নয়।3 জিজ্ঞেস করলাম : তাহলে কিভাবে তাঁকে স্মরণ করব ?

বললেন : বল (اَلْحُجَّةُ مِنْ آلِ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَ آلِهِ )4

2 সাকীর ইবনে আবি দালাফ ” বলেন : ইমাম হাদী (আ.) - এর কাছ থেকে শুনেছি যে , আমার পরবর্তী ইমাম আমার পুত্র হাসান এবং তারপর তার পুত্র মাহ্দী। আর সে অন্যায় অত্যাচারে ভরপুর পৃথিবীকে ন্যায় বিচারে পরিপূর্ণ করবেন।5

3 নওফেলী বলেন : ইমাম হাদী (আ.) - এর সাথে তাঁর বাড়ীর আঙ্গিনায় বসেছিলাম। এমন সময় তাঁর ছেলে মুহাম্মদ আমাদের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল , আমি ইমামকে বললাম : আপনার জন্য আমি উৎসর্গীত , আপনার পরবর্তী ইমাম কি ইনিই ?

না , আমার পর তোমাদের ইমাম হবে আমার জ্যেষ্ঠ ছেলে হাসান।6

4 ইয়াহিয়া ইবনে ইয়াসারবলেন : ইমাম হাদী ( আ.) - এর মৃত্যুর চার মাস পূর্বে তিনি আমাকে তাঁর কিছু সংখ্যক অনুসারী এবং বন্ধু মহলকে হাসান আসকারী ( আ.) - এর ইমামত খেলাফতের ব্যাপারে আমাদেরকে সাক্ষী রেখে ওসিয়ত করেছেন। 7

আবুবকর ফাহ্ফাকী বলেন : ইমাম আবুল হাসান আল হাদী ( আ.) আমাকে লিখেছিলেন : আমার সন্তান আবু মুহাম্মদ (ইমাম আসকারী ) রাসূল ( সা.) - এর অভিজাত বংশের শ্রেষ্ঠতর সন্তান আমার জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং আমার পরবর্তীতে আমার স্থলাভিষিক্ত। অতএব , আমার কাছে তোমাদের যা কিছু জানার ছিল তা তার কাছে জানতে চাইবে এবং তোমার যা কিছু প্রয়োজন সবই তার নিকট বিদ্যমান। 8

সমকালীন খলিফাদের সাথে ইমাম

ইমামের 6 বছরের স্বল্পকালীন ইমামতকালটি তিনজন আব্বাসীয় খলিফার (মো ’ তায , মোহ্তাদী ও মো ’ তামেদ ) শাসনামলে অতিবাহিত হয়।

আব্বাসীয় খলিফা মো তায তার পূর্ব খলিফা তারই চাচাতো ভাই মোস্তাইন এর পর খেলাফতে অধিষ্ঠিত হয়। আর ইমাম হাদী (আ.) এই খলিফার শাসনামলেই শহীদ হন। বেশ কিছু সংখ্যক আলাভী বংশের লোকদেরকেও তারই শাসনামলে বিষ প্রয়োগে ও অন্যভাবে শহীদ করা হয়। খলিফা মো তায একবার তার ভাই মুয়াইয়েদকে বন্দী করে এবং চল্লিশটি বেত্রাঘাত করার নির্দেশ দেয়। ফলে মুয়াইয়েদ স্বেচ্ছায় যুবরাজের পদ থেকে ইস্তফা দান করে মুক্তি লাভ করে । কিন্তু পরে যখন জানতে পারলো যে তুর্কীদের কিছু অংশ মুয়াইয়েদের যুবরাজ পদের প্রতি বিশ্বস্ত। তখন তাকে হত্যার আদেশ দেয়। অতঃপর মুয়াইয়েদকে বিষ মাখানো কম্বল দিয়ে পেচিয়ে কাফনের কাপড়ের ন্যায় উভয় প্রান্ত বেঁধে রাখে । এভাবে তার মৃত্যু হলে দরবারী কিছু ফকীহ্ ও বিচারকদেরকে আমন্ত্রণ করে উক্ত মৃতদেহ পর্যবেক্ষণ করায় তাদের থেকে স্বীকারোক্তি নেয় যে , কোন প্রকার নির্যাতন ব্যতীতই স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।9

মো তাযের পর মোহ্তাদী খলিফা পদে অধিষ্ঠিত হয়। সে মুনাফেকের মত ছদ্দবেশ ধারণ করে গোপনে অত্যাচার ও জুলুম করে কিন্তু প্রকাশ্যে সাধু মানুষের বেশে ইবাদত - বন্দেগীতে মগ্ন থেকে তার দরবার থেকে নর্তকীদের বিতাড়ন করে , পাপাচার নিষিদ্ধ করে , ন্যায়বিচারের ঘোষণা দেয় । অপরদিকে ইমাম আসকারী (আ.) - কে বন্দী করে। এমনকি ইমামকে হত্যার সিদ্ধান্তও নেয় কিন্তু মৃত্যু তাকে ফুরসত দিলো না। নিজেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। মোহ্তাদীর শাসনামলে বেশ কিছু আলাভী তার বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান করেন। তারা এই অভ্যুত্থানে সফল হয় নি। তাদের কেউ কেউ বন্দী হয় এবং বন্দী দশাতেই মৃত্যু বরণ করে।

আহমাদ ইবনে মুহাম্মদ বলেন : মোহ্তাদী যখন মাওয়ালীদের (অনারব মুসলমান ) হত্যা করতে লাগলো , ইমাম আসকারী (আ.) - কে লিখলাম : মহান আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি যিনি মোহ্তাদীর হাত থেকে আমাদের এখন পর্যন্ত রক্ষা করেছেন , আমার কাছে এই মর্মে খবর পৌঁছেছে যে , সে (মোহ্তাদী ) আপনাকে হত্যার হুমকি প্রদান করে বলেছে - আল্লাহর কসম , আমি মুহাম্মদ (সা.) - এর বংশধরকে দুনিয়ার মাটি থেকে সমূলে উৎপাটন করব। ”

ইমাম সেই চিঠির জবাবে নিজ হাতে লিখেন : কত সীমিত আয়ূ তার ! মাত্র পাঁচ দিন পর অপমান ও লাঞ্ছনাসহ মৃত্যু বরণ করবে। ”

ঠিক তাই ঘটলো যেমনটি ইমাম বলেছিলেন।10 এখানে একটি বিষয় বলে রাখা ভাল যে মোহ্তাদীও তুর্কী সৈন্যদের অভ্যুত্থানে নিহত হয়। মো তামেদ তার স্থলাভিষিক্ত হয়।11

মো তামেদও তার পূর্ব পরুষদের ন্যায় ভোগবিলাসিতা ও জুলুম - নির্যাতন ব্যতীত কিছুই বুঝতো না। ভোগবিলাসিতায় এতই মগ্ন থাকতো যে , এই সুযোগে তার ভাই মুয়াফ্ফাক ” ধীরে ধীরে তার স্থলাভিষিক্তের পদ দখল করে দেশ শাসনের সার্বিক কাজ পরিচালনা করতে থাকে । মো তামেদ পুতুলের ন্যায় নাম মাত্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকে । মুয়াফ্ফাকের মৃত্যুর পর তদীয় পুত্র মো তাযেদ তার পিতার পদে অধিষ্ঠিত হয় । অবশেষে 279 হিজরীতে মো তামেদের মৃত্যু হলে মো তাযেদ নিয়মতান্ত্রিক ভাবে খেলাফতে অধিষ্ঠিত হয়।12

মো তামেদের শাসনামলেই ইমাম হাসান আসকারী (আ.) শহীদ হন। বেশ কিছু সংখ্যক আলাভীও তার হাতেই নিহত হয়। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে নিকৃষ্টতম পন্থায় হত্যা করে। এমনকি হত্যার পর তাদের মৃতদেহ থেকে অঙ্গ - প্রত্যঙ্গ বিচ্ছিন্ন করে।13 কিছু ঐতিহাসিকদের মতে , মো ’ তামেদের শাসনামলে যথেষ্ট যুদ্ধ বিগ্রহ হয় যাতে প্রায় 5 লক্ষ লোক নিহত হয়।14

যা হোক , জনগণের দৃষ্টি সর্বদাই ইমামদের দিকে ছিল। তারা এও বুঝতে পারতো যে , জালিম খলিফাদের সাথে ইমামদের আপোষহীনতার ফলেই ইমামগণ তাদের রোষানল ও কঠোর নির্যাতনের শিকার হতেন । ইমাম আসকারী (আ.)ও তার পূর্ব পুরুষদের ন্যায় শাসকদের নির্যাতন ও নিয়ন্ত্রণের শিকার হন। ইমাম এশবার মোহ্তাদীর শাসনামলে সালেহ্ ইবনে ওয়াসিফের কারাগারে বন্দী হয়েছিলেন। খলিফা ইমামকে নির্যাতন করার জন্য দু ’ জন দুষ্কৃতকারী ব্যক্তিকে নিয়োজিত করে। কিন্তু ঐ দু ’ জন লোক ইমামের ইবাদতে আকৃষ্ট হয়ে নির্যাতন করা থেকে বিরত থাকে।

খলিফা আরও একবার ইমামকে নাহরীরের ( মোহ্তাদীর জনৈক কর্মচারী ) কারাগারে বন্দী করে কারাগারের প্রহরী ইমামের প্রতি রূঢ় আচরণ করে। নাহরীরের স্ত্রী প্রহরীকে বললেন , আল্লাহকে ভয় কর ,তুমি জানো না ,কতবড় মহান ব্যক্তি তোমার কারাগারে অবস্থান করছেনঅতঃপর ইমামের ইবাদত গুণাবলীর কথা বর্ণনা করে বললেন , আমার ভয় হয় ইমামের প্রতি তুমি যে অত্যাচার করছো তোমাকেই তার ফল ভোগ করতে হবে।15

মো তামেদ নিজেও তার শাসনামলে ইমাম আসকারী ( আ.) তার ভ্রাতা জাফর ( জাফর কাজ্জাব ) - কে আলী জারীনের কারাগারে বন্দী করে নিয়মিত ইমামের অবস্থার খবরা খবর রাখতো। সংবাদদাতাগণ তাকে জানাতো যে , ইমাম সারাদিন রোজা রাখে সারারাত নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন থাকেন।

কয়েকদিন পর আবার যখন ইমামের সম্পর্কে জানতে চাইলো আলী জারীন তার কাছে পূর্বে দেয়া সংবাদেরই পুনারাবৃত্তি করেন। খলিফা একথা শুনে আলী জারীনকে আদেশ করলো : এখনই ইমামের কাছে গিয়ে আমার সালাম জানিয়ে তাকে কারাগার থেকে মুক্ত করে তার বাড়ীতে পৌঁছে দাও।

আলী জারীন বলল : কারাগারে গিয়ে দেখলাম ইমাম পোশাক পরে রওয়ানা হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছেন । তিনি আমাকে দেখা মাত্রই উঠে দাঁড়ালেন। তাকে খলিফার দেয়া নির্দেশ সম্পর্কে অবহিত করলাম । ইমাম বাহনে আরোহণ করলেন কিন্তু রওয়ানা হলেন না ; এর কারন জিজ্ঞেস করলাম।

বললেন : যতক্ষণ জাফর না আসবে , আমি যাব না।

বললাম : খলিফা শুধুমাত্র আপনাকেই মুক্ত করে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। জাফরের ব্যাপারে কোন কথা বলেন নি।

বললেন : তোমার খলিফার কাছে গিয়ে বল , আমরা দু ’ জন একই পরিবার থেকে এসেছি , যদি তাকে না নিয়ে একা ফিরে যাই তাহলে এ রহস্য তার কাছে লুকিয়ে থাকবে না।

আলী জারীন খলিফার কাছে গেল এবং ফিরে এসে বলল : খলিফা জাফরকে আপনার সম্মানে মুক্তি দিয়েছেন। তিনি জাফরকে তার ও আপনার বিরুদ্ধে অপপ্রচার এবং খেয়ানতের কারণেই বন্দী করেছিলেন।

অতঃপর জাফর মুক্তি পেল এবং ইমামের সাথেই বাড়ী ফিরলো।16

এতক্ষণ খলিফাদের শাসনামলের অবস্থা ও ইমামের সাথে খলিফাদের আচরণের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা তুলে ধরা হলো। তাতে স্পষ্ট বুঝা যায় যে , ইমাম আসকারী (আ.) এক শাসরুদ্ধকর ও কঠিন পরিবেশে জীবন - যাপন করতেন। খলিফাগণ ইমামের প্রতি সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখতো , তাকে একাধিকবার বন্দীও করেছে। ইতিহাস এভাবে সাক্ষী দেয় : যখন ইমাম বন্দী দশা থেকে মুক্ত থাকতেন তখনও ইমামের গতিবিধি তাদের পক্ষ থেকে নিয়ন্ত্রিত হতো। ইমামের অনুসারী , সমর্থক ও বন্ধুমহল সহজভাবে তার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারতেন না। কিছু শিয়াগণ আলাভীদের সহযোগিতায় ইমামের বাড়ীর সন্ধান নিতেন। কাশফুল গুম্মাহ্ ” নামক গ্রন্থে পাওয়া যায় :

এক আলাভী জীবন ধারণের উদ্দেশ্যে সামাররা থেকে জাবাল (পশ্চিম ইরানের পাহাড়ী এলাকা থেকে হামাদান ও কাযভীন পর্যন্ত অঞ্চল) শহরে চলে যায়। হালওয়ান গোত্রের এক লোক তার সাক্ষাত লাভ করে জিজ্ঞেস করলো :

কোথা থেকে এসেছো ?

বলল : সামররা।

জিজ্ঞেস করলো : অমুক এলাকার অমুক গলি কোথায় বলতে পারো ?

বলল : হ্যাঁ।

জিজ্ঞেস করলো : হাসান ইবনে আলী (আ.) - এর সম্পর্কে কিছু বলতে পারবে ?

বলল : না।

জিজ্ঞেস করলো : কি কারণে জাবালে এসেছো ?

বলল : জীবন ধারণের জন্য।

হালওয়ানী বলল : আমার কাছে 50 দিনার আছে তা তোমাকে দিচ্ছি , তার বিনিময়ে আমাকে সামররায় হাসান আসকারী (আ.) - এর বাড়ীতে পৌঁছে দাও।

আলাভী বংশের লোকটি প্রস্তাবটি মেনে নিয়ে তাকে ইমামের বাড়ীতে পৌঁছে দিলো।17

এ ঘটনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে , বন্দী দশার বাইরে ইমামের জীবন - যাপন কেমন ছিল এবং এই মহান ব্যক্তি কতটা সীমাবদ্ধতা ও সতর্ক দৃষ্টির মধ্যে অবস্থান করতেন। যে অবস্থায় ইমামের সম্পর্ক ও যোগাযোগ রাখা মোটেই সহজ ছিল না। অনেক চেষ্টা তদবীর করে ইমামের সাক্ষাত লাভ সম্ভব হতো। এমনকি আলাভীগণ এবং তাঁর নিকট আত্মীয় - স্বজনও তাঁর সঙ্গে খুব একটা যোগাযোগ রাখতে পারতেন না।

ইমামের ব্যক্তিত্ব ও চারিত্রিক গুণাবলী

ইমামের চারিত্রিক গুণাবলী ও আধ্যাত্মিক সাধনার ফলে বন্ধুমহল এমনকি শত্রুরাও তাঁর মহত্ত্বও শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি দিয়েছেন। হাসান ইবনে মুহাম্মদ আ শআরী ও মুহাম্মদ ইয়াহিয়া এবং আরও অনেকে বর্ণনা করেছেন যে , আহমাদ ইবনে আবদুল্লাহ্ ইবনে খাকান আব্বাসীয় খলিফার কোম অঞ্চলের রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব ছিল। একদা তার এক আলোচনা সভায় শিয়াদের আকিদা বিশ্বাস সম্পর্কিত কথা উঠলে সে (কট্টর নাসেবী )18 বললো : সামেরায় আমি আলাভীদের মধ্যে হাসান ইবনে আলী ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আলী রেযা ( ইমাম আসকারী )- এর মত ভদ্র , অমায়িক , মহৎ ও মহান ব্যক্তিত্ব তার পরিবার ও হাশেমী বংশের মধ্যে অন্য কাউকে দেখি নি। তিনি যেমন তার পরিবারের মধ্যে সম্মানিত ছিলেন তেমনই জনসাধারণের মধ্যেও। আমার মনে আছে একদিন আমার পিতার19 সান্নিধ্যে ছিলাম এমন সময় রক্ষিগণ খবর দিল আবু মুহাম্মদ ইবনে রেযা (ইমাম আসকারী ) এসেছেন , বাবা বললেন , ঠিক আছে তাকে আসতে দাও। রক্ষীদের এমন সম্বোধন শুনে আমি বিস্মিত হলাম। কারণ ইতোপূর্বে খলিফা অথবা তার উত্তরাধিকারী অথবা তার প্রেরিত বিশিষ্ট ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কারো উপনামে20 বাবার সামনে সম্বোধন করতো না। তখন উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের উচা - লম্বা , সুন্দর চেহারার বলিষ্ঠ ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও ভাবমূর্তি সম্পন্ন এক যুবক প্রবেশ করলো। বাবার দৃষ্টি তার দিকে পড়া মাত্রই উঠে দাঁড়ালেন এবং এগিয়ে গিয়ে শুভেচ্ছা জানালেন। বাবা আগে কখনও কাউকে এভাবে সম্বোধন করেন নি। তার সাথে কোলাকুলি করলেন , তার মুখে ও বুকে চুমু খেলেন এবং তার হাত ধরে নিজের নামাজ পড়ার স্থানে বসালেন। নিজে ইমামের সামনা - সামনি বসে কথা বলতে লাগলেন। কথোপকথনের মাঝে প্রায়ই বলতে শুনলাম আমি আপনার জন্য উৎসর্গীত ” । সেখানে যা কিছুই দেখলাম বিস্মিত হলাম।

হঠাৎ দাররক্ষী এসে বললো খলিফা এসেছেন। প্রথা অনুযায়ী খলিফা আসলে তার সম্মুখে দেহরক্ষী ,কমান্ডার সৈন্যবহর সজ্জিত থাকত এবং বাবার আলোচনার স্থল থেকে প্রবেশদ্বার পর্যন্ত দুসারিতে সৈন্যবাহিনী অপেক্ষা করতে থাকতো যতক্ষণ পর্যন্ত খলিফা ফিরে না যেত। বাবা নির্দ্বিধায় ইমামের সাথে কথা বলতে লাগলেন। যখন খলিফার বিশেষ গোলাম তার সামনে এসে উপস্থিত হলো তখন বাবা বললেন ,আমি আপনার জন্য উৎসর্গীত। যদি চান চলে যেতে পারেন। অন্যদিকে নিজের দ্বাররক্ষীদের উদ্দেশ্যে বললেন ,ইমামকে সারিবদ্ধ সৈন্যদের পিছন দিক দিয়ে নিয়ে যেতে যাতে খলিফা ইমামকে দেখতে না পায়। ইমাম উঠে দাঁড়ালে বাবাও উঠে দাঁড়ান ,ইমামের সাথে কোলাকুলি করেন। অতঃপর ইমাম চলে গেলেন। বাবার দ্বাররক্ষিগণ ভৃত্যদের জিজ্ঞেস করলাম : আহ ! এই ব্যক্তি কে ছিল যে তার সম্মানে তার উপনামে সম্বোধন করলে এবং বাবাও এরূপ অকল্পনীয় সম্মান প্রদর্শন করলেন ?

বললেন : তিনি একজন আলাভী , হাসান ইবনে আলী ইবনে রেযা 21 নামে প্রসিদ্ধ।

আমার বিস্ময় আরও বেড়ে গেল। রাত পর্যন্ত উদ্বিগ্ন ছিলাম। বাবা সাধারণত রাতে এশার নামাজের পর বসে যে সংবাদগুলো খলিফার গোচরীভূত করা প্রয়োজন সেগুলোকে পর্যালোচনা করতেন। বাবা যখন নামাজ পড়ে বসলেন আমিও তার পাশে বসলাম। তখন সেখানে অন্য কেউ ছিল না। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন :

আহমাদ ! তুমি কি কিছু বলবে ?

বললাম : হ্যাঁ , যদি অনুমতি দেন।

বললেন : বল।

বললাম : বাবা ! সকালে যে লোকটা এসেছিল এবং যাকে আপনি এত সম্মান দেখালেন আর প্রায়ই বলতে শুনলাম আমি আপনার জন্য উৎসর্গীত , উৎসর্গীত আমার পিতা ও মাতা ” । লোকটা কে ছিল ?

বললেন : তিনি রাফেজীদের ইমাম22 হাসান ইবনে আলী , ইবনে রেযা নামে প্রসিদ্ধ।

অতঃপর বাবা কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললেন : খেলাফত যদি আব্বাসীয়দের হাত থেকে চলে যায় তাহলে তিনিই হচ্ছেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি খলিফা হওয়ার যোগ্য। এর কারণ তাঁর সততা , পরহেজগারী , উত্তম চরিত্র বৈশিষ্ট্য , ইবাদত ও দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্তি। তাঁর পিতাকে যদি দেখতে বুঝতে পারতে তিনি কত মহাজ্ঞানী ও মর্যাদা সম্পন্ন লোক ছিলেন।

এমন বক্তব্য শুনে আমার চিন্তা ও উদ্বিগ্নতা আরও বাড়তে লাগলো। একই সাথে বাবার প্রতি ক্রোধও বৃদ্ধি পেতে লাগলো। যে বিষয়টি আমার একমাত্র কর্মে পরিণত হলো তা হলো ইমাম সম্পর্কে যতদূর সম্ভব তথ্য সংগ্রহ ও অনুসন্ধান চালানো। বনি হাসেমের লোকজন , সৈন্যবাহিনীর কমান্ডার , লেখক ও বিচারক যার কাছেই ইমাম সম্পর্কে জানতে চেয়েছি মূলত তার মহত্ত্ব , সম্মান ও উচ্চ মর্যাদা ব্যতীত অন্য কিছুই শুনিনি। সবাই তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের কথা স্বীকার করেছেন এবং সকল বংশ ও গোত্র প্রধানদের চেয়ে তাঁকে শ্রেষ্ঠ মনে করতেন। এ কারণে ইমামের মর্যাদা আমার কাছে আরও স্পষ্ট হলো। কারণ এমন কোন বন্ধু অথবা শত্রু কাউকেই দেখিনি যারা ইমামের অনুগ্রহ ও বদান্নতার কথা স্বীকার করেন নি অধিকন্তু তাঁর প্রশংসা করেছেন।23