বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)0%

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)

লেখক: দার রাহে হাক প্রকাশনীর লেখকবৃন্দ
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 15051
ডাউনলোড: 3080

পাঠকের মতামত:

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 87 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 15051 / ডাউনলোড: 3080
সাইজ সাইজ সাইজ
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

ওহী কি এক ধরনের অসুস্থতা ?

পাশ্চাত্যের কিছু কিছু লেখক উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে আমাদের মহানবী ( সা .)- এর উপর অবতীর্ণ ওহী সম্পর্কে প্রলাপ বকতে বাধ্য হয়েছেন এবং ওহীকে Hysteriaনামক একধরনের অসুস্থতা ও রোগ বলে পরিচয় দেয়ার চেষ্টা করেছেন। 46

তবে সৌভাগ্যবশতঃ এ ধরনের অপবাদ এতটা উদ্ভট ও ভিত্তিহীন যে , ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রয়োজন পড়ে না। কারণ এ রোগের অনেক লক্ষণ বিদ্যমান যেগুলোর কোনটিই আমাদের প্রিয় নবী (সা.) মধ্যে পরিলক্ষিত হয়নি। জন ডেভেন পোর্টের ভাষায় : বলা হয় যে , মুহাম্মদ (সা.) মৃগী রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন এটি হলো গ্রীকদের একটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও ভিত্তিহীন বক্তব্য। তারা এ ধরনের অপবাদের মাধ্যমে এক নব বিশ্বাসের প্রচারের ক্ষেত্রে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে এবং মহানবী (সা.)-এর চারিত্রিক বিশেষত্বের প্রতি খ্রিস্টবাদী সমাজে ঘৃণা ও ক্ষোভ সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। তারা মহানবী (সা.)-এর প্রতি যে অপবাদ দিতে চেয়েছিল , তা যে সন্দেহাতীত ভাবে ভিত্তিহীন তার প্রমাণ হলো : ঐ ধরনের অস্থিরতা , উৎকণ্ঠা ও হৃদয় বিদারী আহাজারী যা মৃগী রোগের লক্ষণ তা কখনোই , এমন কি ওহী অবতীর্ণ হওয়ার কঠিনতম অবস্থায়ও পরিলক্ষিত হয়নি।

এছাড়া , মৃগী রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির যে অস্বাভাবিক অবস্থার সৃষ্টি হয় , তা থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার পর , সে যা দেখেছে ও শুনেছে তার কিছুই তার স্মরণে থাকে না। আর তা হযরত রাসূল (সা.)-এর অবস্থার ঠিক বিপরীত অবস্থা। কারণ তিনি ওহী অবতীর্ণ হওয়া অবস্থায় কোন কথা বলতেন না। তবে এ অবস্থা শেষ হলে তিনি তাঁর উপর অবতীর্ণ ওহী সম্পর্কে বক্তব্য দিতেন এবং যা কিছু দেখেছিলেন ও শুনেছিলেন তা ঘোষণা করতেন। অথচ এক মৃগী রোগী যে সকল কথা বলে সাধারণতঃ তা হলো তার কল্পনা সম্পর্কিত যা তার ক্লান্ত অবসাদগ্রস্থ মস্তিস্কপ্রসূত। যেমন : রোগী এমন এক বিকট ও ভয়ঙ্কর চেহারা দেখতে পায় যে , তাকে হত্যা ও অত্যাচারের হুমকি দিচ্ছে। ফলে তার কথা বার্তা ও এ সম্পর্কিত হয়। অপরদিকে আজ অবধি কেডই দেখেনি যে , একজন মৃগী রোগীর কথায় কোন বৈজ্ঞানিক , বিধি নিয়মগত ও দিকনির্দেশনা সম্বলিত কোন কথা খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। অথচ এখন পর্যন্ত চতুর্দশ শতাব্দী অতিক্রম করলেও ইসলামী বিধানে কোন ক্ষুদ্র পরিমাণের ত্রুটিও খুঁজে পাওয়া যায় নি।

ওহী ও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান

আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও আবিষ্কারের ফলে অনেকে যা ধারণা করেন , তার ব্যতিক্রমে সত্য ধর্ম ইসলামের গুরুত্ব ও মর্যাদার কিঞ্চিত ঘাটতি তো হয়নি বরং বিপরীতক্রমে এর ভিত্তি , মূলনীতিসমূহকে স্বীকৃতি ও দৃঢ় প্রতিপন্ন করেছে।

রাডার , বেতার ও টেলিগ্রাফ ইত্যাদির আবিষ্কার প্রমাণ করেছে যে , ওহীর ব্যাপারটি প্রাকৃতিক নিয়ম ও সৃষ্টি রহস্যের সাথে কোন প্রকার বিরোধ রাখে না। কারণ যে মহান আল্লাহ্ এ যোগাযোগ ব্যবস্থা পদ্ধতি মানুষের হাতে তুলে দিয়েছেন , সে মহান আল্লাহ্ তাঁর ও তাঁর রাসূলের সাথে বিশেষ যোগাযোগ স্থাপন করতেও সক্ষম , যদিও তা এ আবিষ্কারের কোনটির মত নয় বা এগুলোর সাথে তুল্য নয়।

অনুরূপ আত্মা উপস্থিত করণ বিদ্যা ম্যাগনেটিক স্বপ্ন , টেলিপ্যাথি চিন্তা স্থানান্তর টেলি পিসিশি মানসিক প্রভাব ইত্যাদির আবিষ্কারে সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মাণ হয়েছে যে , জগতের সৃষ্টি কেবলমাত্র স্পর্শযোগ্য বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়।

ইসলামী বিশ্ব তার মহান নেতা হযরত মুহাম্মদের (সা.) জন্যে গর্বিত। কারণ তিনি ঐশী কর্মসূচীর মাধ্যমে কেবলমাত্র তদানিন্তন বিশ্বকেই মুক্তি দেননি ও সৌভাগ্যবান করেন নি ; বরং চৌদ্দ শতাব্দী পরও তা আধুনিক বিশ্ব সভ্যতার পথনির্দেশ দিয়ে যাচ্ছে। আজও বিশ্বের জ্ঞানীজন প্রতিনিয়ত তাঁর মহান ও সুদূর প্রসারী নিয়ম ও দিকনির্দেশনাকে উত্তর উত্তর , ততোধিক উত্তমরূপে অনুধাবন করছেন।

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রচার পদ্ধতি

যখন মহানবী (সা.) হেরা পর্বত থেকে নেমে আসলেন এবং গৃহ অভিমুখে যাত্রা করলেন তখন তিনি নিজেকে অন্য এক জগতে দেখতে পেলেন। হেরা পর্বতে যাওয়ার পূর্বে তিনি নবুওয়াতের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন না ; কিন্তু দীর্ঘ দশ বছর সেখানে বিশ্ব জগতের সৃষ্টিকর্তার গভীর ইবাদতে মগ্ন থাকার পর তিনি আজ তাঁর পক্ষ থেকে এক গুরুদ্বায়িত্ব স্কন্ধে ধারণ করলেন। এক্ষেত্রে তাঁর কোন উৎকণ্ঠা ও ভয়-ভীতি ছিল না। জিব্রাইল (আ.)-এর দর্শন ও তাঁর এ সুসংবাদ যে আপনি হলেন আল্লাহর রাসূল ,47 তা-ই তার রেসালাত লাভের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপনের জন্যে যথেষ্ট ছিল। হযরত জিব্রাইল (আ.)-এর দর্শন সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ বলেন:

রাসূলের অন্তর মিথ্যা প্রতিপন্ন করে নি যা সে দেখেছে। (সূরা নাজম : 11)

তাছাড়া মহান আল্লাহ্ যে কোন নবী অর্থাৎ যাকেই মানবতার মুক্তি ও পথনির্দেশনার জন্যে নির্বাচন করেন না কেন , তাকেই সুস্পষ্ট দলিল ও দৃঢ় প্রমাণের মাধ্যমে স্বীয় রেসালাত সম্পর্কে নিশ্চিত করে থাকেন , যাতে মানুষের সংস্কার ও উৎকর্ষের পথে মনোস্থির ও দৃঢ়তার সাথে চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারেন।

অতএব , একথা কতটা অনর্থক ও বিবেক বুদ্ধি বিবর্জিত যে বলা হয় , মুহাম্মদ (সা.) জানতেন না যে তিনি নবী হয়েছেন। অতঃপর যখন খাদিজার কাছে গেলেন ও তাঁর সাথে আলোচনা করলেন , তখন তিনি তাঁকে তাঁর নবুওয়াত প্রাপ্তি সম্পর্কে নিশ্চিত করেছিলন।

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অপেক্ষায় খাদিজা

নবুওয়াত লাভের দিনের ঘটনা প্রবাহের কারণে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে বিলম্বে ঘরে ফিরতে হয়েছিল। খাদিজা এ ধরনের বিলম্ব অতীতে কখনো লক্ষ্য করেন নি বলে অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। হঠাৎ দেখতে পেলেন যে , মুহাম্মদ (সা.) মলিন শ্রান্ত বদনে গৃহে প্রবেশ করলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন অদ্য কেন এত বিলম্বে গৃহে প্রত্যার্বতন করলেন ? মহানবী (সা.) ঐ দিনের সকল ঘটনা হযরত খাদিজাকে খুলে বললেন। খাদিজা বহুদিন থেকে এরূপ একটি দিবসের অপেক্ষায় ছিলেন। কারণ স্বীয় গোলাম মাইসারার নিকট শুনতে পেয়েছিলেন যে , শামের পথে সফরের সময় খ্রিস্টান যাজক বলেছিলেন : তিনি উম্মতের নবী।48

বিশ্বাস স্থাপনের ক্ষেত্রে হযরত আলী (আ.) ছিলেন প্রথম পুরুষ

যে বছর আরবে কঠিন দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল , সে বছর হযরত আবু তালিবের অর্থনৈতিক অবস্থা স্বচ্ছল ছিল না। মুহাম্মদ (সা.) অর্থনৈতিক ভাবে তার বোঝা লাঘব করার জন্যে আলী (আ.)-কে তাঁর আপন গৃহে নিয়ে আসলেন এবং একজন দয়ালু ও স্নেহাতুর পিতার ন্যায় তাঁকে লালনপালন করার চেষ্টা করেছিলেন। হযরত আলী (আ.) , যিনি মহানবী (সা.)-এর গৃহে বসবাস করতেন এবং প্রত্যুৎপন্নমতিতা ও যোগ্যতার ক্ষেত্রে অনন্য ছিলেন , তিনি অন্তরাত্মা দিয়ে মহানবীর অনুসরণ করতেন। আর ইতোমধ্যে মহানবীর সততা ও নিষ্ঠার সাথে সুপরিচিত ছিলেন। এ কারণেই দশ বছর বয়সেই তিনি পূর্ণ সচেতনতার সাথে রাসূল (সা.)-এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন। আর এ ভাবেই ইসলাম ও ঈমানের ক্ষেত্রে সকলকে পশ্চাতে ফেলে তিনি তার প্রথম স্থান অধিকার করে নিয়েছিলেন।

নামাযের আদেশ

তাওহীদ ও একত্ববাদের পর মহানবী (সা.) ও তাঁর অনুসারীদের উপর যে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল তা ছিল নামায। এখানেই নামায যা মহান প্রভুর সাথে মানুষের সম্পর্কের পদ্ধতি ও আল্লাহর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায়ের মাধ্যম , তার মর্যাদা ও মূল্য প্রকাশ পায়। সুতরাং ইসলামের নেতৃবর্গ , বিশেষ করে মহানবী (সা.) নামাযের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান ও উপদেশ দিয়েছেন। তিনি বলতেন : নামায হলো দীনের স্তম্ভ। যদি কেউ নামাযকে হালকা ভাবে নেয় তবে সে অনন্তকালীন জীবনে তথা আখেরাতে আমাদের শাফায়াত ও সাহায্য থেকে বঞ্চিত হবে। যাহোক , মহান আল্লাহ্ জিব্রাইলের মাধ্যমে নামাযের শর্ত ও পদ্ধতি সম্পর্কে মহানবী (সা.)-কে অবহিত করলেন এবং তিনি খাদিজা ও হযরত আলীকে শিক্ষা দিয়েছিলেন। রাসূল (সা.) সমবেত হয়ে নামায অর্থাৎ জামায়াতের সাথে নামায আদায় করলেন।49

তিন বছর যাবৎ কর্মকান্ডের মাধ্যমে প্রচার

ইসলামের নবী (সা.) নবুওয়াত লাভের পর তিন বছর যাবৎ প্রচারের ক্ষেত্রে গোপন তৎপরতা চালিয়েছিলেন। কারণ আরবের কলুষিত সমাজে যেখানে শতাব্দীর পর শতাব্দী মূর্তি পূজা ও অংশীবাদ প্রচলিত ছিল , প্রকাশ্যে প্রচারের জন্যে ঐ সমাজের কোন প্রস্তুতি ছিল না। হযরত মুহাম্মদ (সা.) যদি নবুওয়াত লাভের প্রারম্ভেই এরূপ কর্ম করতেন , তবে অপরিসীম সমস্যার সম্মুখীন হতেন যা তাঁকে প্রকৃত উদ্দেশ্য থেকে দূরে সরিয়ে নিত। ফলে মহানবী (সা.) মূর্তি পূজারীদের সম্মুখে (যারা একাধিক খোদার উপাসনা করত ও তাদের তুষ্টির জন্য করতালি ও বাঁশি বাজাত) একক প্রভুর উপাসনা করতেন এবং আত্মিক পরিচিতি , একক প্রভুর হামদ ও প্রশংসার সমাহার নামাযে মশগুল হতেন (তাদেরকে কিছু না বলে বা আহবান না করে)।

হযরত মুহাম্মদ (সা.) , আলী (আ.) ও হযরত খাদিজাকে সাথে নিয়ে জনাকীর্ণ স্থানে যেমন : মসজিদুল হারামে মিনায় আসতেন এবং বিরোধীদের চোখের সম্মুখে সম্মিলিতভাবে নামায পড়তেন। আর এভাবে একাধিক খোদার উপাসনাকারী ধর্মের বিরুদ্ধে নির্বাক সংগ্রাম চালিয়ে যেতেন।50

তদানিন্তন বণিকদের একজন আফিফ এরূপ বলে : আমি ব্যবসায়িক কাজে আবদুল মুত্তালিবের পূত্র আব্বাসের নিকট গিয়েছিলাম। হঠাৎ এক ব্যক্তি মসজিদুল হারামে প্রবেশ করলেন , আকাশে সূর্যের দিকে তাকালেন এবং কাবার দিকে নামাযে দাঁড়ালেন ; কিছুক্ষণ পর একজন রমণী , একজন বালকসহ সেখানে প্রবেশ করলেন এবং তাঁর সাথে নামায পড়লেন। আব্বাসকে জিজ্ঞাসা করলাম : এ কোন দীন , যা সম্পর্কে আমি অজ্ঞাত ?!

আব্বাস বললেন : এ ব্যক্তি হলেন হযরত মুহাম্মদ , আবদুল্লাহর সন্তান। তাঁর বিশ্বাস : তাঁর প্রভু তিনিই , যিনি আকাশসমূহ ও পৃথিবীর অধিপতি এবং মহান প্রভু তাঁকে মানুষের হিদায়াতের জন্যে নির্বাচন করেছেন। এখন পর্যন্ত এ তিনজন ব্যতীত এ দীনের অন্য কোন অনুসারী নেই। এ নারীকে যে দেখতে পাচ্ছ , তিনি হলেন খুয়াইলিদের কন্যা খাদিজা ; আর এ বালক হল আলী , আবু তালিবের পুত্র , তাঁর (মহানবীর) প্রতি অনুরক্ত হয়েছে।

মুহাম্মদ (সা.) এভাবেই এগিয়ে চললেন। ধীরে ধীরে মুসলমানরা সংখ্যায় বৃদ্ধি পেতে লাগল এবং ইসলাম বিরোধীদেরকে হতাশ করে দিয়ে বিস্তৃতি পেতে লাগল। যখন প্রকাশ্য প্রচারের ক্ষেত্র প্রস্তুত হলো তখন মুহাম্মদ (সা.) সে জন্যে আদিষ্ট হলেন।

নিকটাত্মীয়দেরকে নিমন্ত্রণ ও প্রথম মুজিযাহ

রাসূল (সা.)-এর নির্বাক প্রচারকার্য ও ভক্তদের উত্তর উত্তর সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে প্রকাশ্য প্রচারের ক্ষেত্র প্রস্তুত হলো। মহান আল্লাহ্ ইসলামের নবীকে তাঁর নিকটাত্মীয়দেরকে আহ্বান করতে নির্দেশ দিলেন51 যাতে ছিদ্রান্বেষীরা বলতে না পারে যে , কেন নিকটাত্মীয়দেরকে শাস্তির ভয় প্রদর্শন করছ না এবং তাদেরকে একক খোদার উপাসনার দিকে আহবান করছ না। এছাড়া তাদের সহযোগিতায় ইসলামের অগ্রগতিতে বিস্তৃত ক্ষেত্রের সৃষ্টি হতে পারে। সুতরাং মহানবী (সা.) হযরত আলীকে খাবার প্রস্তুত করতে এবং তাঁর নিকটাত্মীয়দের মধ্যে প্রায় চল্লিশজনকে নিমন্ত্রণ করার নির্দেশ দিলেন।

হযরত আলী (আ.) খাবার প্রস্তুত করার পর তাদেরকে দাওয়াত করলেন এবং সকলেই উপস্থিত হলে এমন পরিমাণে খাবার উপস্থিত করা হলো যা একজনের জন্যেও যথেষ্ট ছিল না। সকলেই তৃপ্তি সহকারে আহার গ্রহণ করল অথচ ঐ খাবারের কোন অংশ হ্রাস পেল না। এ বিষয়টি সকলের বিস্ময়ের কারণ হয়েছিল। কিন্তু আবু লাহাব নির্বোধের মত বলল : এ কর্মটি যাদু ব্যতীত কিছু নয় । অথচ যাদু কখনোই মানুষকে তৃপ্ত করতে পারে না।

মুহাম্মদ (সা.) ঐ দিন কোন কথা বলেন নি। সম্ভবত এ নীরবতা এজন্য ছিল যে , তাদের জন্যে যাতে মুজিযাহ ও যাদুর পার্থক্য নিজে থেকেই সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। কারণ যদি এটি যাদু হতো তবে গৃহ থেকে প্রস্থান করার সাথে সাথেই তারা ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ত।

যাহোক , যেহেতু এ সভাটি সফল হয়নি সেহেতু মহানবী (সা.) দ্বিতীয়বারের মত তাদেরকে আগামী দিনের জন্যে নিমন্ত্রণ করলেন এবং সেদিনের মতই তৃপ্তি সহকারে আহার করালেন ।

অতঃপর মহানবী (সা.) বললেন : ওহে আবদুল মুত্তালিবের সন্তানগণ , মহান আল্লাহ্ আমাকে তোমাদের জন্যে সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা হিসেবে নিযুক্ত করেছেন। তোমরা মুসলমানদের অন্তর্ভূক্ত হও এবং আমার অনুসরণ কর , যাতে কল্যাণ লাভ করতে পার। আল্লাহর শপথ , আমি আরবে এমন কাউকে চিনি না যে আমার চেয়ে উত্তম কোন কিছু তোমাদের জন্যে এনেছে। আমি তোমাদের জন্যে পৃথিবী ও আখেরাতের কল্যাণ এনেছি। মহান আল্লাহ্ তোমাদেরকে তাঁর দিকে আহ্বান করার জন্যে আমাকে আদেশ দিয়েছেন। তোমাদের মধ্যে এমন কে আছ যে আমাকে এ কর্মে সাহায্য করবে ? তোমাদের মধ্যে যে আমাকে এ কাজে সাহায্য করবে সে আমার ভাই , উত্তরাধিকারী ও আমার স্থলাভিষিক্ত হবে। আলী (আ.) ব্যতীত কেউই তাদের মধ্যে ইতিবাচক সাড়া দেয় নি। আলী (আ.) ছিলেন বয়সে তাদের সকলের কনিষ্ঠ। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন : হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনাকে সাহায্য করব। হযরত মুহাম্মদ (সা.) আলী (আ.)-কে বসিয়ে দিলেন এবং একই কথা তিনবার ঘোষণা করলেন কিন্তু আলী (আ.) ব্যতীত কেউই তাঁর আহ্বানে সাড়া দেয় নি।

অতঃপর মহানবী (সা.) আলী (আ.)-এর প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে বললেন : তোমাদের মধ্যে সে আমার ভাই , স্থলাভিষিক্ত প্রতিনিধি ও আমার উত্তরাধিকারী। তার কথা তোমরা শ্রবন করবে এবং তাকে অনুসরণ করবে।52

আর এ দিবসেই একদল লোক ইসলামের নবীর প্রতি ঈমান এনেছেন। কিন্তু অজ্ঞতা ও গোঁড়ামীর কারণে তাঁর আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে সকলেই ঈমান আনতে পারে নি , তা সত্ত্বেও মহানবীর প্রতি তাদের সহযোগিতা ও তার পক্ষ অবলম্বনের ক্ষেত্রে একেবারে নিস্ফল ছিল না।

এ ঘটনায় স্বল্প খাবারের মাধ্যমে চল্লিশ জনের পরিতৃপ্ত পানাহার ব্যতীতও অন্য একটি বিষয় লক্ষণীয় ছিল। আর তা হলো এই যে , ঐ দিন মহানবী (সা.) হযরত আলী (আ.) সম্পর্কে যে কথাগুলো বলেছিলেন তাতে সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয় যে , খেলাফত এবং উত্তরাধিকারের মর্যাদা একমাত্র হযরত আলী (আ.)-এর জন্যেই ছিল এবং তাঁকেই ইসলামের নবীর উত্তরাধিকারী বলে মনে করতে হবে।

আর এরূপেই সর্বজনীন ভাবে ও প্রকাশ্যে প্রচারকার্য সম্পাদনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হলো। হযরত মুহাম্মদ (সা.) অক্লান্ত পরিশ্রম চালিয়ে যেতে লাগলেন , একমুহূর্ত স্থির থাকেন নি। আর তখন থেকেই ইসলামের পতাকা সশব্দে উড্ডীয়মান হলো এবং সত্য অগ্রসরমান হতে শুরু করল ।

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সর্বজনীন প্রচার কার্য

মহানবীর নবুওয়াত লাভের তিন বছর অতিক্রান্ত হলো। তিনি এ সময়ে গোপনে ঐ সকল পথভ্রষ্ট , যারা পথনির্দেশনা পাওয়ার যোগ্য তাদের মধ্যে প্রচার কার্য সম্পাদনের ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করেন নি। যখনই দেখতেন কোন অসহায় চারিত্রিক অবক্ষয় ও বিচ্যুত বিশ্বাস ও অংশীবাদের কর্দমায় নিমজ্জিত , তাকেই মুক্তি দেয়ার জন্যে চেষ্টা করতেন। স্নেহ মমতার দ্বার দিয়ে প্রবেশ করতেন এবং আকর্ষণীয় যুক্তিতে তাকে একত্ববাদের দীনের প্রতি আহবান করতেন।53

কিন্তু যেহেতু তার দীন এক বিশ্বজনীন দীন এবং সংগত কারণেই এর আহবান বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছতে হবে , তাই প্রকাশ্যে প্রচার কার্য চালাতে শুরু করলেন এবং প্রকাশ্যে তাঁর উদ্দেশ্য ও কর্মসূচী ঘোষণা করলেন।

সাফা পর্বতে মহানবীর বক্তব্য

ইসলামের নবী (সা.) তাঁর দীনের প্রসারের জন্যে এবং আরবের সকল গোত্রের নিকট তা প্রচার করার জন্যে আল্লাহর আদেশক্রমে প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের জন্যে এবং সর্বসাধারণের অবগতির জন্যে স্বীয় দীনের সত্যতা সম্পর্কে ঘোষণা দিতে সিদ্ধান্ত নিলেন।

আর এ উদ্দেশ্যে তিনি সাফা পর্বতের দিকে রওয়ানা করলেন এবং এ পর্বতের সর্বোচ্চ স্থানে আরোহণ করলেন। অতঃপর সেখানে দাঁড়িয়ে উচ্চৈঃস্বরে বললেন : ইয়া সাবাহাহ!54

রাসূল (সা.)-এর কথা সাফা পর্বতে প্রতিধ্বনিত হলো এবং সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করল । বিভিন্ন গোত্র থেকে অসংখ্য জনসমষ্টি তাঁর দিকে ধাবিত হলো। মহানবীর বক্তব্য শুনার জন্যে তারা তাঁর প্রতি নিবদ্ধ করল। মহানবী (সা.) তাদের দিকে ফিরে বললেন :

হে লোক সকল! যদি তোমাদেরকে সংবাদ প্রদান করি যে , শত্রুরা দিবা অথবা রাত্রিতে তোমাদের অজ্ঞতাবশতঃ তোমাদের উপর আক্রমন করবে , তবে তা বিশ্বাস করবে কি ?

সকলেই জবাবে বলল : আমরা আপনার সমগ্র জীবনে আপনাকে কখনো মিথ্যা বলতে শুনি নি।

নবী (সা.) বললেন : ওহে কোরাইশ জনগণ! আমি তোমাদেরকে আল্লাহর আযাবের ভয় প্রদর্শন করছি। নিজেকে আগুন থেকে মুক্তি প্রদান কর...।

অতঃপর বললেন : আমার অবস্থান সে পাহারাদারের মত যে শত্রুকে দূর থেকে দেখতে পায় এবং স্বীয় গোত্রকে তাদের আক্রমন থেকে সতর্ক করে দেয় , ওহে! এমন কেউ কি কখনো তার গোত্রকে মিথ্যা বলতে পারে ?

হয়ত রাসূল (সা.)-এর কথাগুলো উপস্থিত মানুষের অন্তরে স্থান নিতে পারে , এ ভয়ে আবু লাহাব নীরবতা ভঙ্গ করল এবং হযরতকে উদ্দেশ্য করে এরূপ বলল : পরিতাপ! আমাদেরকে এ ধরনের কথা শুনানোর জন্যেই কি এখানে সমবেত করেছ ?

সে কঠোর ভাষায় অভদ্রোচিতভাবে মহানবীর কথায় বিঘ্ন সৃষ্টি করল এবং তার কথা শেষ করতে দিল না। এ সীমালঙ্ঘন , অসভ্য আচরণ এবং শত্রু ও মুশরিকদের সাথে সহযোগিতা করার শাস্তি হিসেবে মহান আল্লাহ্ তাকে অভিশম্পাত করে সূরা লাহাব অবতীর্ণ করলেন :

) تبّت يدا ابي لهب(

মহানবী (সা.)-এর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া

মহানবী (সা.)-এর যৌক্তিক ও উষ্ণ বক্তব্য শ্রোতাদের অনেকের উপরই প্রভাব বিস্তার করেছিল এবং সকল সভা সম্মেলনেই হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নতুন দীনের কথা আলোচিত হচ্ছিল। অত্যাচার ও নিপীড়নের যাঁতাকলের নীচে যাদের কোমর নূঁয়ে পড়েছিল এবং মক্কার শ্বাসরূদ্ধকর অবস্থা ও অন্যায়ের ফলে যাদের প্রাণ ওষ্ঠাধারে সংলগ্ন হয়েছিল , মহানবীর বক্তব্য তাদের সম্মুখে আশার নতুন দিগন্ত খুলে দিল যেন তারা নতুন প্রাণ ফিরে পেল। কিন্তু কুচক্রী কোরাইশ দলপতিরা অনঢ় থাকল। কারণ তারা দেখল যে , ইসলামের নবী (সা.) যখনই সুযোগ পান , তাদের ত্রুটি বিচ্যুতিগুলোকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেন। ফলে তারা সিদ্ধান্ত নিল যে , যেভাবেই হোক না কেন এ বিপ্লবের পথ রোধ করতে হবে।

তারা এটা খুব ভালভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন যে , অংশীবাদ ও মূর্তি পূজার মূল উৎপাটিত হলে এবং সকল মানুষ মহান প্রভু ও একত্ববাদের ছায়ায় আশ্রয় নিলে কিংবা কল্যাণময় দীন ইসলামের প্রতি ঝুঁকে পড়লে , অত্যাচার ও শোষণের আর কোন পথ খোলা থাকবে না।

ফলে তারা একটি সমিতি গঠন করল এবং মহানবীর আন্দোলনকে প্রতিহত করার উপায় ও পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনায় বসল।

এ আলোচনার মাধ্যমে তারা এ সিদ্ধান্তে উপণীত হলো যে , সকলেই কোরাইশের মান্যবর হযরত আবু তালিবের (যিনি রাসূলের পিতার মত ছিলেন) গৃহে যাবে এবং তাকে বলবে : যে ভাবেই তিনি ভাল মনে করেন সে ভাবেই যেন মুহাম্মদকে তাঁর পথে অগ্রসর হতে বাধা প্রদান করেন।

ফলে তারা এ উদ্দেশ্যে হযরত আবু তালিবের নিকট গেল এবং তিনি তাদের সাথে কথোপকথন করলে তারা স্বস্তি পেল।

কোরাইশদের হযরত আবু তালিবের নিকট অভিযোগ

দ্বিতীয় বারের মত কোরাইশের গোত্রপতিরা আবু তালিবের গৃহে গেল। সমিতির মুখপাত্র নিম্নরূপ বক্তব্য পেশ করল :

আপনি আমাদের মধ্যে এবং কোরাইশের সকলের মধ্যে অতি উচ্চ মর্যাদার অধিকারী। আপনি আমাদের নেতা , আমাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ও বয়োবৃদ্ধ । আপনার উচ্চ মর্যাদা ও সম্মানের প্রতি আমরা শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি। ইতোপূর্বেও আমরা আপনার নিকট চেয়েছিলাম যে , আপনার ভ্রাতুস্পুত্রের আচার-আচরণে ও কর্মকান্ডে বাঁধ সাধবেন।

আমরা আপনাকে বলেছিলাম : মুহাম্মদকে আমাদের পিতৃ পুরুষের দীনের প্রতি অকথ্য বলা থেকে ও আমাদের খোদাদের ত্রুটি তুলে ধরা থেকে এবং আমাদের বিশ্বাস ও চিন্তা-চেতনার অবাধ্য হওয়া থেকে বাধা প্রদান করতে। আপনি আমাদের এ আবেদনের প্রতি কোন প্রকার সাড়া প্রদান করেন নি এবং তাঁকে বাধা প্রদান করেন নি। খোদার শপথ! আমরা আমাদের পিতৃপুরুষের প্রতি অপবাদ দান ও আমাদের বিশ্বাসকে নীচ বলে গণনা করণ ও আমাদের খোদাদের দোষ-ত্রুটি অন্বেষণের ক্ষেত্রে নীরব থাকতে পারি না। মুহাম্মদকে এ কর্ম থেকে আপনাকে বিরত রাখতে হবে ; নতুবা আমরা তাঁর ও আপনার (তাঁর সাহায্যকারী) সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হব যাতে দু দলের এক দল ধ্বংস হয়ে যায়।

হযরত আবু তালিব সন্ধির দ্বারে পা রাখলেন এবং তারা প্রস্থান করার পর বিষয়টি মহানবী (সা.)-এর কর্ণগোচর করলেন। মহানবী (সা.) তাঁকে উদ্দেশ্য করে এরূপ বললেন :

আল্লাহর শপথ! যদি আমার ডান হাতে সূর্য আর বাম হাতে চন্দ্রকেও দেয়া হয় এ শর্তে যে , আমি ইসলামের প্রচার থেকে বিরত থাকব এবং আমার উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হব , তবে কখনোই আমি তা করব না। বরং এ পথে আমি আমার জীবন উৎসর্গ করব অথবা আমার লক্ষ্যে আমি পৌঁছব। অতঃপর হযরত মুহাম্মদ (সা.) মনক্ষুন্ন হয়ে চাচার নিকট থেকে বিদায় নিলেন।

আবু তালিব তাকে ডাকলেন এবং বললেন : আল্লাহর শপথ! তোমাকে সাহায্য করা থেকে এক মুহূর্তের জন্যেও বিরত থাকব না এবং তাদেরকে কখনোই তোমার ক্ষতি করতে দিব না।55

পুনরায় কোরাইশ আমারাত ইবনে ওয়ালীদকে সঙ্গে নিয়ে হযরত আবু তালিবের নিকট আসল এবং বলল যে , এ যুবক শক্তিশালী ও সুদর্শন , আমরা তাকে আপনার নিকট প্রদান করব , যাতে আপনি তাকে পালকপুত্র হিসেবে গ্রহণ করবেন এবং মুহাম্মদকে সাহায্য করা থেকে বিরত থাকবেন। হযরত আবু তালিব খুবই অসন্তুষ্ট হলেন এবং বললেন : খুব খারাপ কর্মের পরামর্শ আমাকে দিচ্ছ ; আমি তোমাদের সন্তানের রক্ষণাবেক্ষণ করব অথচ আমার নিজের সন্তানকে তোমাদেরকে দিব যাতে তোমরা তাকে হত্যা করতে পার। আল্লাহর শপথ! এমনটি কখনোই হবে না।56