বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)0%

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)

লেখক: দার রাহে হাক প্রকাশনীর লেখকবৃন্দ
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 15048
ডাউনলোড: 3080

পাঠকের মতামত:

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 87 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 15048 / ডাউনলোড: 3080
সাইজ সাইজ সাইজ
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

কোরাইশ কর্তৃক লোভ প্রদর্শন

কোরাইশবর্গ মনে করেছিল যে , বস্তুগত চাওয়া পাওয়া ও দেরহাম বা দিনারের মাধ্যমে ইসলামের সম্মানিত নবীকে তাঁর কর্মকান্ড থেকে বিরত রাখতে পারবে। তাই তারা মহানবীর নিকট আসল এবং বলল : যদি অর্থ ও সম্পদ চাও তবে তোমাকে আরবের সম্পদশালী ব্যক্তিতে পরিণত করব , যদি মর্যাদা ও নেতৃত্ব চাও তবে আমরা সকলেই নিঃশর্ত ভাবে তোমার নেতৃত্ব মেনে নিতে প্রস্তুত ; যদি রাজত্ব চাও তবে আমরা তোমাকে আমাদের বাদশা হিসেবে মেনে নিব। তোমার যে অবস্থা হয় এবং যাকে তুমি ওহী বলে বর্ণনা কর যদি বল যে , তুমি এ থেকে মুক্ত হতে অক্ষম , তবে তোমার চিকিৎসার জন্যে আমরা শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক তোমার জন্য উপস্থিত করব। তবে শর্ত হলো এই যে , তোমার প্রচারকার্য থেকে বিরত হও এবং মানুষের মধ্যে এর চেয়ে বেশী বিরোধ সৃষ্টি করো না। আমাদের খোদাদের বিশ্বাসের ও পূর্ব পূরুষের চিন্তা চেতনাকে তুচ্ছ জ্ঞাপন করো না।

মহানবী (সা.) জবাবে তাদেরকে বললেন :

তোমাদের সম্পদের প্রতি না আমার কোন লোভ আছে , না পদ মর্যাদার প্রতি , না তোমাদের উপর কর্তৃত্ব করার প্রতি। মহান আল্লাহ্ আমাকে নবী হিসেবে নিযুক্ত করেছেন এবং আমার উপর কিতাব নাযিল করেছেন। আমি তাঁর পক্ষ থেকে তোমাদেরকে সুসংবাদ দান ও সতর্ক করার জন্যে আদিষ্ট হয়েছি। আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি ; যদি তোমরা আমাকে অনুসরণ কর তবে কল্যাণ লাভ করবে। আর যদি গ্রহণ না কর , তবে ততক্ষণ পর্যন্ত ধৈর্য্য ও স্থৈর্য অবলম্বন করব , যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমাদের ও আমাদের মধ্যে তাঁর সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন।

অবশেষে কোরাইশের গোত্রপতিরা এ মর্মে সিদ্ধান্ত নিল যে , হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে প্রস্তাব দিবে যাতে করে তিনি তাদের খোদাদের থেকে নিস্ক্রিয় থাকেন , এতে তারাও হযরতের কাজে বাধা প্রদান করবে না। সুতরাং তারা হযরত আবু তালিবের নিকট গেল এবং তার নিকট চাইল , তিনি যাতে তাদের প্রস্তাবটি মহানবীর নিকট উপস্থাপন করেন। মহানবী (সা.) তাদেরকে জবাবে বললেন :

যা তাদের জন্য উত্তম , যাতে তাদের জন্যে কল্যাণ নিহিত , যার মাধ্যমে তারা সৌভাগ্যের অধিকারী হবে আমি কি সে কথাটি বলা থেকে বিরত থাকব ?

আবু জেহেল বলল : এক কথা তো ভাল কথা , আমরা দশটি কথা বলতেও প্রস্তুত। অতঃপর সে জিজ্ঞাসা করল সে কথাটি কী ?

মহানবী (সা.) বললেন : বল ,لا اله الا الله (আল্লাহ্ ব্যতীত কোন মা বুদ নেই রাসূল (সা.)-এর কথায় কোরাইশের গোত্রপতিরা খুব ক্ষুদ্ধ হলো এবং তারা হতাশ হয়ে পড়ল।

আবু জেহেল বলল : এ কথাটি ব্যতীত অন্য কোন কথা বল। রাসূল (সা.) দৃঢ় কণ্ঠে বললেন :

যদি সূর্যকেও আমার হাতে এনে দাও , তারপরও তোমাদের নিকট এ কথা ব্যতীত আমার আর কিছু চাওয়ার থাকবে না।

কোরাইশ গোত্রপতিরা যখন বুঝতে পারল , মহানবীর সাথে সংলাপে কোন ফল হবে না এবং লোভ দেখানো , হুমকি সত্ত্বেও তিনি যে পথ বেছে নিয়েছেন , তা থেকে বিরত হবেন না। ফলে তারা সিদ্ধান্ত নিল যে , মহানবীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

চলার পথে প্রতিবন্ধতকা এবং কুরাইশদের নির্যাতন

রাসূল (সা.) যে দিন থেকে প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার শুরু করেন , সে দিন থেকেই কোরাইশরা হযরতের প্রচার কার্যকে স্থগিত করার জন্যে সকল প্রকার পন্থা কাজে লাগায়।

সাধারণ নিয়মানুযায়ী তারা প্রথমে প্রলোভন দেখিয়ে এবং পার্থিব মর্যাদা , ধনসম্পদ ইত্যাদির ওয়াদা দিয়ে শুরু করেছিল। অতঃপর এ পথে ব্যর্থ হয়ে হুমকি প্রদান এবং অত্যাচার ও নির্যাতনের পথ বেছে নিয়েছিল।

এভাবে হযরত মুহম্মাদ (সা.)-এর জীবনের এক নতুন অধ্যায় সূচিত হয়। সম্মান , শ্রদ্ধা , আখলাক-চরিত্র সমাজ থেকে উঠে গিয়ে হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতায় পরিপূর্ণ হয়ে পড়েছিল। যার মাধ্যমে তারা কাপুরুষোচিত ভাবে ইসলামের প্রচার প্রসারে বাঁধ সাধন করতঃ কোরাইশ নেতাদের সম্মান অটুট রাখার চেষ্টা করেছিল।

অবশ্য এটা অস্বীকার করা যায় না যে , অজ্ঞতা এবং চিন্তার অপরিপক্কতার কারণেই তারা সত্য পথ ও রাসূল (সা.)-এর দাওয়াতের বিরোধিতা করত। তবে কোরাইশদের অত্যাচার আরো বৃদ্ধি পেয়েছিল তখন , যখন শুনেছিল যে রাসূল (সা.) তাদের কাঠ ও পাথর নির্মিত মূর্তিসমূহকে অবজ্ঞা করেন এবং বলেন : এই নিস্পাণ পাথরের টুকরার কাছে তোমরা কি চাও ?

কাষ্ঠ ও প্রস্তর নির্মিত খোদাসমূহ যা কোরাইশরা (মুশরিক) তাদের পৈত্রিক সূত্রে পেয়েছিল তার প্রতি রাসূল (সা.)-এর প্রতিবাদ তাদেরকে বেশী অসন্তুষ্ট করেছিল।

অপর দিকে নতুন নবীর আধুনিক শিক্ষা-দীক্ষা তাদের শ্রেণী বৈষম্যের স্বার্থের সাথে সামঞ্জস্যশীল ছিল না। কোরাইশ নেতারা এবং গোত্রপতিরা একাধারে দুর্বল শ্রেণী ও দাসদের উপর অত্যাচার চালিয়ে যেতে চেয়েছিল। সুদখোর সম্পদশালীরাও চেয়েছিল সুদ গ্রহণের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণীর লোকদের রক্তচুষে খাওয়াকে অব্যাহত রাখতে।

শক্তিশালী এবং উদ্ধত লোকেরা চেয়েছিল তলোয়ার এবং বর্শার জোরে অসহায় ও দুর্বল মানুষের সম্পদ ও সম্ভ্রম হরন করাকে অব্যাহত রাখতে। সামাজিক এ ভ্রান্ত প্রথার বিরুদ্ধে নতুন আইনের যে সংগ্রাম ইচ্ছা অথবা অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদের ব্যাপক বিরোধিতার সম্মুখীন হয়। কেননা এর মাধ্যমে তাদের স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটেছিল।

আধুনিক দাওয়াতের বিরোধীদের শীর্ষে ছিল নামধারী গোত্রপতিরা যেমন : আবু জেহেল , আবু সুফিয়ান , আবু লাহাব , আসওয়াদ ইবনে আবদে ইয়াগুছ , আস ইবনে ওয়ায়েল , উতবা , শাইবা , ওয়ালিদ ইবনে মুগাইরা এবং উকবা ইবনে আবি মুয়িত।

কাপুরুষোচিত অপবাদ , শারীরিক নির্যাতন কটু ভাষায় গালাগাল , অর্থনৈতিক চাপ ইত্যাদি নির্লজ্জ উপায়ে তারা রাসূল (সা.) ও তাঁর সাহায্যকারীদের বিরোধিতা করত। নিম্নে এর কিছু নমুনা তুলে ধরা হলো :

1.একদা কিছু সংখ্যক কোরাইশ নেতা তাদের চাটুকারদেরকে দুম্বার নাড়ি ভূড়ি নিয়ে রাসূল (সা.)-এর মাথা ও মুখে ফেলার নির্দেশ দেয়। তারাও তাদের পাপিষ্ঠ নেতাদের নির্দেশ অনুযায়ী এ জঘন্য কার্য সম্পাদন করে ,57 আর এভাবে মহানবী (সা.)-কে ব্যথিত করে।

2 তারেক মুহারেবী বলেন : রাসূল ( সা .)- কে দেখলাম জনগণের মধ্যে উচ্চৈঃস্বরে বলছিলেন :

ياانهّا النّاس قو لوا لا اله الا الله تفلحوا

হে লোক সকল , বল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ তাহলে মুক্তি প্রাপ্ত হবে।

তিনি জনগণকে ইসলাম ও একত্ববাদের দিকে আহবান করছিলেন। আবু লাহাব রাসূল (সা.)-এর পিছন পিছন আসছিল এবং তাঁকে পাথর ছুড়ে মারছিল। এত বেশী পাথর মেরেছিল যে , রাসূল (সা.)-এর পা দিয়ে রক্ত ঝরে পড়ছিল। রাসূল (সা.) এসব উপেক্ষা করে একাধারে জনগণকে সরল পথ প্রদর্শন করে যাচ্ছিলেন। আবু লাহাবও চিৎকার দিয়ে বলছিল : লোক সকল , এ ব্যক্তি মিথ্যাবাদী। তার কথায় কর্ণপাত করো না।58 রাসূল (সা.) ব্যতীত অন্যান্য নব্য মুসলমানরা ও অমানবিক নির্যাতনের শিকার হতেন।

3.একদা রাসূল (সা.) আম্মার ইয়াসির ও তার পরিবারকে দুশমনদের হাতে নির্যাতিত হতে দেখে বললেন :

হে আম্মার পরিবার , তোমাদের প্রতি সুখবর হলো যে তোমাদের স্থান বেহেশত।59 ইবনে আসির লিখেছেন যে , আম্মার ও তার পিতা-মাতা মুশরিকদের কঠোর নির্যাতনে পতিত হয়েছিল। মুশরিকরা তাদেরকে প্রচণ্ড গরম আবহাওয়ায় ঘর থেকে বের করে সূর্যের প্রচণ্ড তাপে শাস্তি দিত , যেন তারা নতুন দীন থেকে হাত গুটিয়ে নেয়।

আম্মারের মাতা সুমাইয়া হলেন ইসলামের প্রথম শহীদ। তিনি আবু জেহেলের হাতিয়ারের আঘাতে শহীদ হয়েছিলেন। আম্মারের পিতা ইয়াসিরও অবশেষে প্রচণ্ড নির্যাতনের মধ্যে শাহাদাত বরণ করেন। আম্মার নিজেও প্রচণ্ড নির্যাতনের শিকার হয় কিন্তু তাকিয়ার (স্বীয় বিশ্বাসকে গোপন করার) মাধ্যমে মৃত্যুর কবল থেকে মুক্তি পায়।

4.বেলাল হাবশী কৃতদাস ছিলেন। তিনিও মহানবী (সা.)-এর অনুসারী ছিলেন। আর এ কারণে তার মনিব তাকে খুবই নির্যাতন করত। প্রখর রোদ্রের মধ্যে উত্তপ্ত বালির উপর শুইয়ে বুকের উপর বিরাটকায় পাথর চাপা দিয়ে রাখত। যেন এর মাধ্যমে সে রাসূলকে ত্যাগ করে মূর্তি পূজায় লিপ্ত হয়।

বেলাল সকল হুমকি এবং নির্যাতনের বিরুদ্ধে তাদেরকে বার বার একই জবাব দিত : আহাদ , আহাদ! অর্থাৎ (একত্ব , একত্ব) আল্লাহ্ এক এবং আমি আর কখনোই শিরক ও মূর্তি পূজায় প্রত্যাবর্তন করব না।

পরিতাপের বিষয় হলো এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে আমরা রাসূল (সা.) ও মুসলমানদের প্রতি যে নির্যাতন হয়েছেল তার বিশদ বিবরণ দিতে পারব না। মোটের উপর এ ভাবে বলা যায় যে , ইসলামের শত্রুরা ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সকল পন্থাই কাজে লাগিয়েছিল। মোটামুটি ভাবে সেগুলোকে এ ভাবে তুলে ধরা যেতে পারে :

1 অর্থনৈতিক অবরোধ : কোরাইশরা রাসূল (সা.) ও তাঁর সাথীদের উপর এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক অবরোধ চাপিয়ে দিয়েছিল। অর্থনৈতিক চাপ এবং মুসলমানদের সাথে যে কোন প্রকার লেনদেন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা ছিল মুসলমানদের সাথে তাদের অপর এক কাপুরুষোচিত আচরণ।

2 মানসিক উৎপীড়ন : কোরাইশদের পক্ষ থেকে মুসলমানদের সাথে বিবাহ নিষিদ্ধ এবং যে কোন প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করার নির্দেশ। আর মহানবী (সা.)-কে জাদুকর ও মিথ্যাবাদী হিসাবে চিহ্নিত করা। এর সবই ছিল মুসলমানদের অবিচলতাকে নষ্ট করার পথে এক মনস্তাত্ত্বিক সংগ্রাম।

3 অত্যাচার এবং দৈহিক নির্যাতন : এটা অপর এক অমানবিক মাধ্যম যা কোরাইশরা মুসলমানদের আন্দোলনকে থামিয়ে দিতে এবং তাদের নেতাকে নির্মূল করতে ব্যবহার করেছিল।

এই কাপুরুষোচিত মাধ্যম যা ইসলামের প্রথম দিকের কিছু সংখ্যক মুসলমানের মৃত্যুর কারণ হয়েছিল। প্রকৃত পক্ষে ইসলামের অগ্রগতির সাথে সংগ্রাম করতে এটা ছিল আর এক পন্থা।

কোরাইশরা ইসলাম , রাসূল (সা.) এবং মুসলমানদের সাথে সংগ্রামে সকল প্রকার অমানবিক উপায় ব্যাবহার করা সত্ত্বেও ইসলাম একই ভাবে উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। হযরত মুহাম্মদ (সা.) সঠিক পথে দাওয়াত চালিয়ে যান এবং মুসলমানরাও সঠিক পথে চলতে থাকেন।

তাঁরা এ গৌরবময় পথে অসংখ্য সমস্যা , নিদারুণ যন্ত্রণা , নির্যাতন , অপ্রীতিকর যন্ত্রণা , কষ্ট , হিজরত ইত্যাদির সম্মুখীন হয় ; আর এর মাধ্যমে তাদের ঈমান ও আকিদা রক্ষা করেন।

যে লক্ষণীয় বিষয়টি ইসলামের প্রথম যুগের মুসলমানদের অবস্থা সম্পর্কে পাওয়া যায় তা হলো ইসলামের শত্রুদের অপপ্রচারের বিপরীত। ইসলামের অগ্রগতি তরবারীর জোরে হয় নি। বরং 13 বৎসর ধরে শত্রুর চাপে এবং বর্শার মুখে তাদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করে অগ্রগতি সাধন করেছে।

হিজরতেরঘটনা প্রবাহ

উদ্দেশ্যের পথে জন্মভূমি ত্যাগ

ইসলামের নবী (সা.) মক্কাবাসীদের বিরোধিতা এবং দলবদ্ধ হয়ে বাধা প্রদানকে তাদের কপালের দাগ থেকেই বুঝে নিয়েছিলেন যে , তারা ভ্রান্ত গোঁড়ামী , কুসংস্কার এবং মুর্খতায় নিমজ্জিত। অতি সহজে তারা এ পঙ্কিল বিশ্বাস ও অহেতুক কার্যকলাপ থেকে দূরে সরবার নয়। তাদেরকে মুক্তি দেওয়ার জন্যে ত্যাগ , কঠোর পরিশ্রম এবং ব্যাপক সংগ্রামের প্রয়োজন রয়েছে।

রাসূল (সা.) তাঁর দূরদর্শিতার মাধ্যমে এই চড়াই উৎরাই পটভূমিকে দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি তাঁর এ অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে ইসলামের ঝাণ্ডা ও প্রচারকে কাঁধে তুলে নেন এবং ধৈর্য্য ও সহনশীলতাকে তাঁর ব্রত হিসাবে গ্রহণ করেন। রাসূল (সা.) ইসলামের বিরোধীদের প্রতিবন্ধকতার সাথে মক্কায় 13 বৎসর সংগ্রাম করেন।60 কিন্তু ইসলামের শত্রুরা তাদের শয়তানী কার্যাবলী থেকে হাত গুটিয়ে নেয় নি বরং সর্বশক্তি দিয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে লড়েছে। এ পরিস্থিতিতে মহানবীর বিশ্বজনীন রেসালতের দাবি ছিল এটাই যে , তিনি তার ইসলাম প্রচারের স্থান পরিবর্তন করে কোন এক উপযুক্ত ও শান্তিপূর্ণ স্থানে চলে যান।

আওস ও খাযরাজ গোত্রের ইসলাম গ্রহণ

খাযরাজ গোত্রের কিছু নেতৃবৃন্দ হজের মৌসুমে মক্কায় এসে মসজিদুল হারামে রাসূল (সা.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। রাসূল (সা.) তাদেরকে শান্তি ও ভ্রাতৃত্বের দীন , ইসলামে দাওয়াত করেন। তারাও যেহেতু আওস গোত্রের সাথে দীর্ঘদিনের মতপার্থক্যের কারণে অতিষ্ট হয়ে পড়েছিল , (রাসূলের এ দাওয়াতের মধ্যে) তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত বস্তুকে ফিরে পেল এবং আন্তরিক ভাবে ইসলাম গ্রহণ করল।

খাযরাজরা ফেরার সময় রাসূল (সা.)-এর কাছে একজন মোবাল্লেগ এবং পথ প্রদর্শক চাইল। রাসূল (সা.) মুসআব ইবনে উমাইরকে তাদের সাথে পাঠান এবং এরই মাধ্যমে মদীনা শহর ইসলামের উদিত সূর্যের সাথে পরিচিত হয় এবং নতুন দীনের পর্যালোচনা করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। কোরআনের আকর্ষণীয় ও নূরানী আয়াত শ্রবণের মাধ্যমে মানুষ ইসলামের দিকে সবচেয়ে বেশী আকর্ষিত হতো। মুসআব আওস ও খাযরাজ গোত্রের নেতাদের ইসলাম গ্রহণের খবর রাসূল (সা.)-কে পাঠায়। পরর্বতীতে মদীনা থেকে যারা হজ পালন করতে মক্কায় এসেছিল তারা গোপনে রাসূল (সা.)-এর সাথে দেখা করেন। মদীনার মুসলমানরা ইসলামের বৃক্ষকে ফলবান হওয়ার জন্য রাসূল (সা.)-এর সাথে বাইয়াত করেন। তারা শপথ করেন যে , যেভাবে তারা তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের সমর্থন ও প্রতিরক্ষা করে ঠিক তেমনিভাবেই রাসূল (সা.) ও ইসলামকে সমর্থন করবে।61

মহানবী (সা.)-কে হত্যা করার ষড়যন্ত্র

পূর্বগগন ফর্সা হওয়ার পূর্বেই কোরাইশরা মদীনাবাসী মুসলমানদের চুক্তি সম্পর্কে অবহিত হয় এবং তা নিস্ফল করতে ও রাসূল (সা.)-এর অগ্রগতিকে ব্যাহত করতে উঠে পড়ে লেগে যায়। এ কারণেই তারা দারুন নুদবায় (কোরাইশদের বৈঠক খানা) আলোচনায় বসে। আলোচনা শেষে তারা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে প্রত্যেক গোত্র থেকে একজন করে এসে সম্মিলিতভাবে রাসূল (সা.)-এর ঘরে এসে তাঁকে হত্যা করবে। যার মাধ্যমে ইসলামের দাওয়াতের ভিত্তি বিধ্বস্ত হয়ে যাবে।62

আল্লাহ তায়ালা মহানবী (সা.)-কে দুশমনদের চক্রান্ত সম্পর্কে অবহিত করেন এবং রাত্রেই মক্কা থেকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন।63

হযরত মুহাম্মদ (সা.) ওহী প্রাপ্ত হয়ে জন্মভূমি থেকে হিজরত করার সিদ্ধান্ত নেন।

আলী (আ.)-এর আত্মত্যাগ

রাসূল (সা.) আল্লাহর পক্ষ থেকে হিজরতের নির্দেশ প্রাপ্ত হয়ে হযরত আলী (আ.)-কে ডাকলেন এবং সকল রহস্য খুলে বললেন। জনগণের আমানতসমূহ তাঁকে দিয়ে বললেন : এগুলোকে তাদের মালিকদেরকে বুঝিয়ে দিবে। অতঃপর বললেন : অনিবার্য কারণবশতঃ আমাকে হিজরত করতে হচ্ছে , কিন্তু তোমাকে আমার বিছানায় ঘুমাতে হবে। আলী (আ.) এক বাক্যে রাজী হয়ে গেলেন এবং রাসূলের জীবন রক্ষা করার নিমিত্তে নিশ্চিত মৃত্যুকে স্বাগত জানালেন।64

হযরত আলী (আ.)-এর আত্মত্যাগ এতটা নিষ্ঠাপূর্ণ ছিল যে , মহান আল্লাহ্ কোরআনে তাঁর প্রশংসা করেছেন।65 (মানুষের মধ্যে অনেকেই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভার্থে আত্ম উৎসর্গ করে থাকেন। সূরা বাকারা : 207)

রাসূল (সা.) সাউর গুহায়

রাত্র গভীর হলে দুশমনরা তাদের কুঅভিপ্রায় বাস্তবায়ন করার জন্যে রাসূল (সা.)-এর গৃহের চার পাশ ঘিরে ফেলে। কিন্তু যেহেতু মহান আল্লাহ্ নিজেই রাসূল (সা.)-এর সহায়ক ছিলেন , তাকে এ বিপদ থেকেও রক্ষা করেন। রাসূল (সা.) সূরা ইয়াসীন পাঠ করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে ভিন্ন পথে মক্কার বাইরে সাউর গুহায় যান। হযরত আবু বকরও (রা .) জানতে পেরে রাসূল (সা.)-এর সাথে গেল।

কাফেররা উন্মুক্ত তলোয়ার নিয়ে রাসূল (সা.)-এর বিছানার দিকে হামলা করে কিন্তু বিস্ময়ের চোখে রাসূল (সা.)-এর বিছানায় হযরত আলীকে দেখতে পেল এবং অপ্রস্তুত হয়ে জিজ্ঞাসা করল : মুহাম্মদ কোথায় গিয়েছে ? আলী (আ.) জবাব দিলেন : আমি কি তোমাদের পক্ষ থেকে তাঁর পাহারায় নিয়েজিত ছিলাম ? তোমরা তাকে শহর থেকে বের করে দিতে চেয়েছিল , তিনিও শহর ছেড়ে চলে গেছেন।66 কোরাইশরা তাদের সকল চক্রান্ত ভেস্তে যেতে দেখে তারা তাঁকে খুঁজে পেতে চতুর ও সূক্ষ এক পরিকল্পনা নিল কিন্তু তাও নিস্ফল হলো।

ইয়াসরেব (মদীনা) অভিমুখে যাত্রা

মহানবী (সা.) তিনদিন সাউর গুহায় অবস্থান করার পর ইয়াসরেব অভিমুখে রওনা হন।67 সোরাকা ইবনে মালেক নামে এক ব্যক্তি মক্কা থেকে মহানবীর পিছু ধাওয়া করে কিন্তু তার ঘোড়ার পা তিন বার মাটিতে পুতে যায় এবং ঘোড়া তাকে ফেলে দেয়। ফলে সে তওবা করে ফিরে আসে।68

রাসূল (সা.) 12ই রবিউল আউয়াল কোবায় পৌঁছান69 এবং কয়েক দিন সেখানে অবস্থান করেন।70

হযরত আবু বকর মহানবীকে পীড়াপীড়ি করতে থাকে যে চলুন মদীনায় চলে যাই । কিন্তু রাসূল (সা.) তা গ্রহণ না করে তাকে বললেন :

আলী তাঁর জীবন বাজী রেখে আমাকে রক্ষা করেছে এবং সে আমার আহলে বাইতের সর্বোত্তম ও চাচাত ভাই। আলী এখানে না পৌঁছা পর্যন্ত আমি এখান থেকে নড়ব না।71

রাসূল (সা.) হযরত আলীকে যে দায়িত্ব দিয়ে এসেছিলেন তা তিনি যথার্থভাবে পালন করে স্বীয় মাতা ও রাসূলের কন্যা ফাতেমাকে নিয়ে রাসূলের নিকট পৌঁছেন। কিন্তু বন্ধুর পথে উটের রশি টেনে অতিক্রম করতে তাঁর পা ক্ষত বিক্ষত হয়েছিল। ফলে তিনি অতি কষ্টে হাঁটছিলেন। রাসূল (সা.) স্নেহের সাথে হযরত আলীকে আলিঙ্গন করেন এবং তাঁর পায়ের ক্ষত স্থানে নিজের মুখের পবিত্র থুতু লাগিয়ে দিলেন। আর এর মাধ্যমে আলী (আ.) সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেন। অতঃপর একত্রে মদীনা অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন।72

ইয়াসরেব (মদীনা) রাসূলের প্রতীক্ষায়

ইয়াসরেব অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল এবং শহরে এক বিশেষ উত্তেজনা বিরাজ করছিল। জনগণ রাসূল (সা.)-এর প্রতীক্ষায় প্রহর গুণছিল।

রাসূল (সা.) শুক্রবারে ইয়াসরেবে প্রবেশ করেন। জনগণ মরিয়া হয়ে রাসূল (সা.)-এর নূরানী চেহারার দিকে তাকিয়ে ছিল।

রাসূল (সা.) ইয়াসরেবে স্থায়ী হন এবং ন্যায়বিচার ও ঈমানের ভিত্তিতে ইসলামের মহান সংস্কৃতির ভিত্তি রচনা করেন।

রাসূল (সা.)-এর প্রবেশের পর ইয়াসরেবের নাম পরিবর্তন করে মদীনাতুন নাবী অর্থাৎ নবী (সা.)-এর শহর নাম করণ করা হয়। এ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কারণে অর্থাৎ মিথ্যার উপর সত্যের বিজয় হওয়াতে এ দিনকে ইতিহাসের সূচনা হিসাবে গণ্য করা হয়। জনগণ ইসলামের সূর্য কিরণে যেন এক নতুন জীবন ফিরে পেয়েছিল। আর জাহেলী যুগের জরাজীর্ণ এবং নষ্ট চরিত্র ও বিশ্বাস পরিবর্তন হয়ে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হয়।

হিজরতের শিক্ষা

মহান হিজরতের 14 শত বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে। ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখতে পাব যে মুসলমানরা হিজরত এবং ইসলামের ভিত্তি রচনা করতে কতই না কষ্ট সহ্য করেছিলেন।

মুসলমানরা কুরাইশদের অত্যাচার ও নির্যাতন থেকে মুক্ত হয়ে শান্তিময় স্থানে এসে নিজেদেরকে গড্ডালিকা প্রবাহে ভাসিয়ে দেন নি। বরং ইসলামী সংস্কৃতি বাস্তবায়ন ও তার সম্প্রসারণের জন্যে দিবা রাত্র পরিশ্রম করেছিলেন।

এ ত্যাগ ও কঠোর পরিশ্রমই তাদেরকে দাসত্বের শৃংখল থেকে মুক্তি দিয়েছিল এবং তাদেরকে কল্যাণ ও মহত্ব দান করেছিল।

এ স্মৃতিকে প্রতি বৎসর হিজরতের বার্ষিকী পালন করে জীবিত রাখতে হবে। যে কষ্ট ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে ইসলামের প্রথম যুগের মুসলমানরা আল্লাহর প্রতি ঈমান ও রাসূল (সা.)-এর নির্দেশ পালনের মাধ্যমে পবিত্র ইসলামী বিপ্লব অর্জন করেন ও তার উন্নতি সাধন করেন , তাকে আমাদের আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করতে হবে।

আমাদেরকে অবশ্যই এ বিষয়টিকে পরবর্তী প্রজন্মের নিকট পৌঁছে দিতে হবে যে , সে যুগের মুসলমানদের যে সম্মান ও মহত্ব ছিল তা তাদের ঈমান ও প্রচেষ্টার মধ্যেই নিহিত ছিল। আমরা যদি পুনরায় সে মর্যাদা অর্জন করতে চাই তাহলে আমাদেরকে অবশ্যই কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।

মদীনায় ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধের গোড়াপত্তন

জীবন্ত সমাজ একমাত্র সমচিন্তা , আন্তরিকতা , সহমর্মিতা এবং পারস্পরিক সমন্বয়ের এরূপ সমাজেই সকলে তাদের কল্যাণ ও অগ্রগতি অর্জন করতে পারে এবং সমন্বিত ভাবে তাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে।

ইসলাম এরূপ সমাজ গড়ে তোলার জন্যে গোত্র , ভাষা , গায়ের রং এবং ভৌগোলিক অবস্থানের প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপই করে নি। বরং সকলকে মুসলমান , সংগতিপূর্ণ এবং সুসংহত মনে করে।73 ইসলামের একমাত্র দৃষ্টি ছিল আল্লাহর প্রতি ঈমান , যা সকল সংগতি ও সুসংহতির মূল।

ইসলামী ভ্রাতৃত্ব হলো সর্বোত্তম বাক্য , যা ঐক্য ও সর্বাত্মক সংগতিকে স্পষ্ট করে। পবিত্র কোরআন সুন্দর ও স্পষ্ট ভাষায় বলছে :

) انما المومنون اخوة فاصلحوا بين اخويكم(

অর্থাৎ নিশ্চয় মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই , অতএব তোমরা তোমাদের ভ্রাতৃগণের মধ্যে সংশোধন পূর্বক শান্তি স্থাপন কর।74

ইসলামে ভ্রাতৃত্ব বোধ স্থাপনে মহানবী (সা.)-এর বিরল কৃতিত্ব

মহানবী (সা.) মদীনায় প্রবেশ করে সেখানে মসজিদ তৈরী করেন - যা ছিল মুসলমানদের সদর দফতর বা ঘাঁটি নির্মানের পর সর্ব প্রথম যে মৌলিক কাজটি করেন তা হলো ইসলামী ভ্রাতৃত্ব স্থাপন। এর মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে পূর্বের চেয়ে বেশী ঐক্য ও আন্তরিকতার সৃষ্টি হয়। যদিও তারা তাদের জন্মভূমি এবং আত্মীয়-স্বজন হারিয়ে ছিলেন , কিন্তু তার পরিবর্তে তারা এমন ভাই পেয়েছিলেন যারা সার্বিক দিক থেকে অনেক বেশী বিশ্বস্ত এবং সহানুভূতিশীল ছিলেন।

যদিও প্রত্যেক মুসলমানই একে অপরের ভাই , তা সত্ত্বেও রাসূল (সা.) তাঁর অনুসারীদের মধ্যে আকদে উখুওয়াত (ভ্রাতৃত্ব বন্ধন) সৃষ্টি করেন এবং হযরত আলীকে নিজের ভাই হিসাবে গ্রহণ করে বলেন : আলী হচ্ছে আমার ভাই।75

ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে সম্মানের সাথে স্মরণ করে পবিত্র কোরআন বলছে :

) و عتصموا بحبل الله جميعا و لا تفرقوا واذكروا نعمت الله عليكم اذ كنتم اعداء فالّف بين قلوبكم فاصبحتم بنعمه اخوانا و كنتم علي شفا حفرة من النار فانقذكم منها كذلك يبيّن الله لكم اياته لعلكم تهتدون(

অর্থাৎ এবং তোমরা সকলে সমবেত ভাবে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধর এবং পরস্পর বিভক্ত হয়ো না ; এবং স্মরণ কর তোমাদের উপর আল্লাহর নেয়ামতকে যখন তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে তখন তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতি সঞ্চার করলেন এবং তোমরা তারই নেয়ামতের ফলে পরস্পর ভাই ভাই হয়ে গেলে এবং তোমরা এক অগ্নিকুন্ডের কিনারায় ছিলে তখন তিনি তোমাদেরকে তা হতে রক্ষা করলেন। এভাবে আল্লাহ্ তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ বর্ণনা করেন যেন তোমরা হেদায়াত প্রাপ্ত হও। (সূরা আলে ইমরান : 103)