বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)0%

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)

লেখক: দার রাহে হাক প্রকাশনীর লেখকবৃন্দ
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 15049
ডাউনলোড: 3080

পাঠকের মতামত:

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 87 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 15049 / ডাউনলোড: 3080
সাইজ সাইজ সাইজ
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

হযরত মুহাম্মদ (সা.) সর্বশেষ নবী

ইসলামের চিরন্তনতা ও হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে নবুওয়াতের পরিসমাপ্তি

ইসলামের নবী (সা.)-এর সর্বশেষ নবী হওয়ার বিষয়টি আল্লাহর একত্বের মতই সকলের নিকট সুস্পষ্ট ও প্রমাণিত। বলতে হয় : এ ব্যাপারে সকলেই একমত।

ইসলাম ধর্ম সর্বদা নতুন এবং দৃষ্টিভঙ্গির বিস্তৃতি যত বেশি হবে এর সামগ্রিকতা ততটা সুস্পষ্টতর হতে থাকবে এবং এর বিস্ময় কখনোই শেষ হবে না ।

এখন এ বিশ্বাসগত বিষয়ের বাস্তবরূপ বিশ্লেষণ করতে হবে।

প্রথমেই এক ধর্মের চিরন্তন হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ কারণসমূহ বিশ্লেষণ করব। অতঃপর ইসলামকে এ দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করব :

1.কোন ধর্মের ফেতরাতগত (মানুষের সহজাত প্রবণতার সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল) হওয়াটা ঐ ধর্মের চিরন্তনতার গুরুত্বপূর্ণ নির্বাহক। যে দীনের মূল ভিত্তি মানুষের ফেতরাত ও প্রকৃতির উপর প্রতিষ্ঠিত , সে দীন সময়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সর্বদা অগ্রসরমান হয়ে থাকে এবং কখনোই নিঃশেষ ও নিস্তব্ধ হয়ে যায় না কিংবা কখনোই নিস্ক্রিয় পুরোনো হয়ে পড়ে না।

2.যে সকল বিধি-নিষেধ স্থান ও কালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় সকল প্রকার অগ্রগতির সাথেই তার সামঞ্জস্য বজায় থাকে এবং কখনোই কালের পরিক্রমণ তার উপর পরিবর্জনের রেখা টানতে পারে না।

অপরদিকে যে বিধান কোন নির্দিষ্ট বিশেষ সময় ও স্থানের জন্যে নির্দিষ্ট তা , সর্বকালের জন্যে সকল মানুষের চাহিদা মিটাতে অক্ষম। যেমন : যদি বলা হয় যে , যাতায়াতের ক্ষেত্রে মানুষ কেবলমাত্র প্রাকৃতিক বাহন যথা : ঘোড়া , উট ব্যবহার করতে পারবে , তবে এ নিয়ম কখনো অপরিবর্তিত থাকতে পারবে না এবং নিজ থেকেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কারণ নতুন নতুন প্রয়োজন দেখা দিলে মানুষ নতুন মাধ্যম ব্যবহার করবেই।

পূর্ববর্তী দীনসমূহ বিদ্যমান ও অব্যাহত না থাকার একটি কারণ হলো এটাই যে , ঐগুলো বিশেষ সময়ের ও নির্দিষ্ট কোন সমাজের জন্যে ছিল।

3.সামগ্রিকতা : চিরন্তন দীনকে সর্বজনীন হতে হবে এবং মানবতার সকল সমস্যার সমাধান দিতে সক্ষম হতে হবে। মানবতার ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ আত্মার তৃষ্ণা এক শ্রেণীর ভ্রান্ত ও আচার সর্বস্ব অনুষ্ঠানাদি যেমন : সান্ধ্য অধিবেশন , রুটি ও মদ্য পানাহার ও গলায় ক্রুশ ঝুলানোর মাধ্যমে পিপাসা নিবারণ হয় না। কিংবা প্রকৃত প্রশান্তি লাভ করে না। বরং এক সর্বজনীন বিধি-বিধানের প্রয়োজন যা তাকে সারা জীবন পথ নির্দেশনা দিয়ে যাবে এবং তার সামাজিক সমস্যাসমূহের সমাধান দিবে।

4.অচলাবস্থার সময় পথ নিদের্শনা : সাধারণ নিয়মগুলো কখনো কখনো পারস্পরিক বিরোধ অথবা প্রয়োজন ও বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হওয়ার কারণে , মানুষকে অচলাবস্থার সম্মুখীন করে যেখানে সে জানে না কি করতে হবে!

এ কারণে চিরন্তন দীনে সাধারণ নিয়ম-কানুন ছাড়াও অন্যান্য নিয়মও থাকতে হবে যা জরুরী অবস্থায় বা সংকটময় মুহূর্তে কী করতে হবে সে বিষয়ের ব্যাখ্যা দিবে। আর কেবলমাত্র তখনই সকল সময় বা সর্বাবস্থার সাথে সাযুজ্যপূর্ণ হবে এবং সর্বদা ফলপ্রসূ হবে।

উপরোল্লিখিত বিষয়গুলো চিরন্তনতার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে পরিগণিত যেগুলো ইসলামী বিধানে বজায় থেকেছে। এখন আমরা সেগুলোকে ব্যাখ্যা করব।

ইসলাম এক চিরন্তন দীন

1.ইসলাম নীতি নির্ধারনের ক্ষেত্রে স্বয়ং মানুষের ফেতরাত ও প্রকৃতি যা সর্বদা বিদ্যমান থাকে তাকে বিবেচনা করেছে এবং এ ফেতরাতের প্রয়োজনে ইতিবাচক সারা দিয়েছে।

ইসলামের কর্মসূচী এমন ভাবে বিন্যস্ত হয়েছে যে , তাতে মানুষের সকল চাহিদা পূর্ণ হয়ে থাকে। যেমন : যৌন প্রয়োজন মিটানোর জন্যে একাধিক পদ্ধতি ও সহজ পরামর্শ দিয়েছে যেগুলোর মাধ্যমে সে তা পূরণ করতে পারে। অপরদিকে বাঁধনহারা স্বাধীনতার বিরোধিতা করে যাতে এর কুপ্রভাব ও অনাচার সমাজে বিস্তৃতি লাভ করতে না পারে।

2.ইসলামের মূল বিধি-বিধানসমূহ কোন বিশেষ কালের জন্যে নির্ধারিত নয় বলে কালের পরিবর্তনে বস্তুসমূহের পূর্ণতার সাথে পরিবর্তিত হয় না। বরং সকল কাল ও অবস্থার সাথে তা সামঞ্জস্য বজায় রাখে এবং যা কিছু সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় ও কল্যাণময় তা নির্ধারণ করে।

ইসলামের জিহাদ কর্মসূচীতে কখনোই দেখা যায় না যে , কোন নির্দিষ্ট সময়ের বিদ্যমান যুদ্ধাস্ত্রের (যেমন : তরবারী দিয়ে যুদ্ধ) উপর নির্ভর করতে। বরং সামগ্রিকভাবে এ নির্দেশ দেয় যে , শত্রুদের মোকাবিলায় শক্তি সঞ্চয় কর যাতে নিজেদের অধিকার রক্ষা করতে পার এবং তাদের বিরুদ্ধে জয়ী হতে পার। এটি একটি সামগ্রিক নীতি যা সকল প্রকার অগ্রগতির সাথে সামঞ্জস্য পূর্ণ এবং সর্বকালের জন্যে দিক নির্দেশনা। অন্যান্য কর্মসূচীর ক্ষেত্রেও এরূপ অবস্থা বিদ্যমান।

3.অচলাবস্থা ও জরুরী ক্ষেত্রে ইসলামের জরুরী আইন , অক্ষতি আইন (কায়েদায়ে লা যারার) ও অসংকীর্নতা আইন (কায়েদেয়ে লা হারায) ইত্যাদি আইন109 বিদ্যামান যেগুলোর মাধ্যমে যে কোন প্রকার সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। তাছাড়া ইমাম ও মহানবী (সা.) উত্তরাধিকারী এবং ফতোয়া দানকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে অচলাবস্থার সময় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতে পারেন।

4.ইসলামের কর্মসূচী অন্যান্য সকল প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বিস্তৃততর। ইসলামে আইনগত , অর্থনৈতিক , সামরিক শিষ্টাচারগত ইত্যাদি বিষয়গুলো উন্নততর প্রক্রিয়ায় বর্ণিত হয়েছে। আর এ বিষয়গুলোর উপর মুসলিম পণ্ডিতগণ সহস্র সহস্র কিতাব লিখেছেন যেগুলোর উৎস ছিল কোরআন , রাসূলের এবং তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের বক্তব্যসমূহ।

উপরোক্ত বিষয়গুলোর আলোকে প্রত্যেক জ্ঞানী ব্যক্তিই অনুধাবন করতে পারে যে ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা যা সর্বদা মানুষের প্রয়োজনে ইতিবাচক সারা দিতে পারে। ফলে এমতাবস্থায় কোন নতুন দীন বা নবীর কোন প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে না।

কোরআনের দৃষ্টিতে নবুওয়াতের পরিসমাপ্তি

ইসলামের পরিপূর্ণতা ও হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে নবুওয়াতের পরিসমাপ্তি সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে বর্নিত হয়েছে। এখন আমরা এগুলোর কিছু নমুনা তুলে ধরব :

) وتمّت كلمة ربّك صدقا و عدلا لا مبدّل لكلماته وهو السّميع العليم(

সত্য ও ন্যায়ের দিক দিয়ে তোমার প্রতিপালকের বাণী সম্পূর্ণ এবং তাঁর বাক্য পরিবর্তন করবার কেউ নেই , তিনি সর্বশ্রোতা , সর্বজ্ঞ ( সূরা আনআম : 115)।

) ماكان محمّد ابا احد من رجالكم ولكم رسول الله وخاتم النّبييّن(

মুহাম্মদ তোমাদের মধ্যে কোন পুরুষের পিতা নয় , বরং সে আল্লাহর রাসূল এবং শেষ নবী (সূরা আহযাব : 40)।

খাতাম (خاتم ) শব্দটি ت এর উপর ফাতহা (যবর )অথবা কাছরা (যের ) সহ যখন কোন বহুবচন বিশিষ্ট শব্দের সাথে যুক্ত হবে , তবে তার অর্থ হবে শেষ । তাহলে উল্লিখিত আয়াতে খাতামান্নাবিয়্যিন110 (خاتم النبين ) -এর অর্থ হলো আখিরান্নাবিয়্যিন (اخيرالنبين ) অর্থাৎ শেষ নবী। আর নবী শব্দটি রাসূল শব্দের চেয়ে ব্যাপক111 (যা রাসূলকে ও সমন্বিত করে)

অতএব , সমস্ত পয়গম্বরগণই নবী ছিলেন। সুতরাং উল্লিখিত আয়াতে যে বলা হয়েছে মুহাম্মদ খাতামান্নাবিয়্যিন অর্থাৎ মুহাম্মদ (সা.) নবীদের সর্বশেষ নবী এবং তার পর না কোন নবী আসবে , না কোন রাসূল কিংবা না কোন কিতাবের অধিকারী ; না অন্য কেউ।

) انّ هذا القران يهدي للّتي هي اقوم(

এই কোরআন সর্বশ্রেষ্ঠ পথ নির্দেশ করে। নিঃসন্দেহে এমতাবস্থায় অন্য কোন কর্মসূচীর প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে না ( সূরা ইসরা : 9) ।

হাদীসের দৃষ্টিতে নবুওয়াতের পরিসমাপ্তি

খাতামিয়্যাতের ব্যাপারটি ইসলামী সনদসমূহে এতটা বর্ণিত হয়েছে যে , ইসলামী বিশ্বাসমূহের একটি সুস্পষ্টতর বিষয় বলে পরিগণিত হয়।

এখন আমরা এর কিছু নমুনা সূধী পাঠকবৃন্দের জন্যে তুলে ধরব :

1.স্বয়ং মহানবী (সা.) বলেন : জেনে রাখ , আমার পর কোন নবী আসবে না এবং আমার শরীয়তের পর অন্য কোন শরীয়ত নেই। (মোস্তাদরাক , 2য় খণ্ড , পৃ. 262)

2.ইমাম বাকের (আ.) বলেন : মহান আল্লাহ্ তোমাদের কিতাবের মাধ্যমে সকল কিতাবকে ও তোমাদের নবীর মাধ্যমে সকল নবীর শেষ রেখা ও যবনিকা টেনেছেন (উসূলে কাফি , 1ম খণ্ড , পৃ. 177)।

3.আলী (আ.) বলেন : মহান আল্লাহ্ হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে সকল রাসূলের পর পাঠিয়েছেন এবং তাঁর মাধ্যমেই ওহীর পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন (নাহজুল বালাগা )।

4.মহানবী (সা.) আলী (আ.) বলেন : আমার সাথে তোমার সম্পর্ক মূসার সাথে হারুনের সম্পর্কের মত , পার্থক্য শুধু এটুকু যে , আমার পর কোন নবী আসবে না (কামিল , ইবনে আসির , 2য় খণ্ড , পৃ. 278)।

5.হযরত রেযা (আ.) বলেন : হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শরীয়াত কিয়ামত পর্যন্ত বিলুপ্ত হবে না এবং অনুরূপ কিয়ামত পর্যন্ত তার পর আর কোন নবী আসবেন না (উয়ূনু আখবারুর রেযা , 2য় খণ্ড , পৃ. 80)।

এছাড়া অন্যান্য অসংখ্য হাদীস বিদ্যমান যেগুলো হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর খাতামিয়্যাত ও ইসলামের চিরন্তনতার এবং ইসলামের পরিপূর্ণতা ও সত্যতার প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করে।

এ দীনের বিষয়বস্তুর পূর্ণাঙ্গতা ও সমুন্নত ভাবার্থ এবং এর বিধানের বিস্তৃতি ও ব্যাপকতা , এর চিরন্তনতা ও নিত্য নতুনতার নিশ্চয়তা প্রদান করে , যার ফলে তা কিয়ামত পর্যন্ত অব্যহত থাকবে।

অতএব , কতই না উত্তম যে , সে দীন ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্যে চেষ্টা করব এবং সকলকে এ পরিপূর্ণ ও সামগ্রিক দীন থেকে লাভবান হতে আহবান করব।

হাদীসে গাদীর এবং হযরত মুহম্মদ ( সা .)- এর স্থলাভিষিক্তি

রাসূল (সা.) আল্লাহর ঘর থেকে বিদায় গ্রহণ করলেন

হিজরী সনের দশম বর্ষ এবং হজের মৌসুম। হেজাযের মরুভূমি বিশাল জনসমষ্টির সাক্ষী যাদের সকলেই একই ধ্বনি দিতে দিতে একই লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছেন।

ঐ বৎসর হজের দৃশ্যে এক অন্যরকম উদ্দীপনা এবং উত্তেজনা বিরাজ করছিল। মুসলমানেরা অধীর আগ্রহে এবং দ্রুতবেগে পথের দু ধারে বাড়ী ঘর পেরিয়ে মক্কায় উপস্থিত হচ্ছিলেন।

মক্কা মরু প্রান্তরের লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক ধ্বনি কানে আসছিল। কাফেলা সমূহ পালাক্রমে শহরের নিকটবর্তী হচ্ছিল। হাজীগণ ইহরামের লেবাস পরে একই বেশে ধূলামেখে অশ্রু ঝরিয়ে আল্লাহর নিরাপদ হারামে উপস্থিত হচ্ছিলেন। আর যে গৃহ (কাবা) তৌহীদের মহান দৃষ্টান্ত হযরত ইবরাহীম (আ.) কতৃক নির্মিত তার চার পাশে তাওয়াফ করছিলেন।

ফরিদ ওয়াজদী দশম হিজরীতে অংশগ্রহণকারী হাজীদের সংখ্যা 90 হাজার বর্ণনা করেছেন112 কিন্তু কোন কোন বর্ণনায় 124000 বলা হয়েছে।113

রাসূল (সা.) দেখতে পেলেন : মসজিদুল হারাম পূর্ণ এবং সকলেই এই আয়াত অনুসারে

انّما المو منون اخوة নিশ্চয় প্রত্যেক মুমিন ব্যক্তি একে অপরের ভাই ; ভ্রাতৃত্বের সাথে ফেরেশতগুণে গুণান্বিত হয়ে ইবাদতে মশগুল।

রাসূল (সা.) খুশী হলেন যে তিনি এ বৃহৎ কার্য সম্পাদন করতে পেরেছেন এবং তাঁর রেসালতের দায়িত্বকে উত্তম ভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছেন।

কিন্তু মাঝে মধ্যেই দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতা তাঁর চেহারায় দৃশ্যমান হতো এবং আনন্দকে তাঁর জন্য অপ্রীতিকর করে তুলত।

তিনি ভয় পেতেন যে , তার মৃত্যুর পর হয়ত জনতার এ সমষ্টি ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়বে এবং তাদের মধ্যকার ভ্রাতৃত্ববোধ এবং ঐক্য লোপ পাবে ও পুনরায় অধঃপতিত হবে।

রাসূল (সা.) খুব ভাল করেই জানতেন যে , মুসলিম উম্মাহর জন্য এক ন্যায়পরায়ণ ও জ্ঞানী ইমামের পথ নির্দেশনা অতি জরুরী। আর এমনটি না হলে তাঁর দীর্ঘ দিনের মূল্যবান শ্রম বৃথা যাবে।

এ কারণেই মহানবী (সা.) যখনই সফর অথবা যুদ্ধের জন্যে মদীনার বাইরে যেতেন , এমনকি সে সফর সংক্ষিপ্ত হলেও তিনি বিশ্বস্ত এবং যোগ্য ব্যক্তিকে দায়িত্ব অর্পণ করতেন এবং মদীনার জনগণকে অভিভাবকহীন রেখে যেতেন না।114

সুতরাং কিরূপে বিশ্বাস করা সম্ভব যে , আমাদের প্রিয় ও সদয় নবী (সা.) বিশাল মুসলিম উম্মাহকে নিজের মৃত্যুর পর অভিভাবকহীন রেখে যাবেন। আর তিনি সবার চেয়ে ভাল জানেন যে এই পদমর্যাদার যোগ্য ব্যক্তি কে এবং খেলাফতের পোশাক কোন যোগ্য ব্যক্তির মাপে কাটা ও সেলাই করা হয়েছে।

তিনি সেই ব্যক্তি যাকে বহু সংখ্যক কুরাইশ সর্দার ও রাসূল (সা.)-এর আত্মীয়দের মাঝে ইসলামের দাওয়াতের জন্য যাদেরকে একত্রিত করা হয়েছিল , তাদের মাঝে নিজের উত্তরাধিকারী হিসাবে নিযুক্ত করেছিলেন।115

তিনি পবিত্র ও একত্ববাদী ছিলেন। তিনি বিন্দুমাত্র শিরক ও মূর্তি পূজা করেন নি।

তিনি দীনে মুবিনে ইসলামের অগ্রগতির ক্ষেত্রে ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। তাঁর জ্ঞানের ভিত্তি রাসূল (সা.)-এর জ্ঞানের উৎস থেকেই। মজলুমের ডাকে সাড়া দান তাঁর উত্তম বিচার কার্যেরই অন্তর্ভূক্ত।116

তিনি সবার নিকট পরিচিত। তিনি হলেন হযরত আলী ইবনে আবু তালিব (আ.)।

পবিত্র হজ পালন করে সকলে আপন শহর অভিমুখে যাত্রা করেন। হঠাৎ রাসূল (সা.) (গাদীরে খুম নামক স্থানে) সকল হাজীদেরকে যাত্রা বিরতির নির্দেশ দেন। কেননা জিবরাইল (আ.) অবতীর্ণ হলেন এবং এই আয়াতটি তাঁকে জানালেন :

) يا ايهّا الرّسول بلّغ ما انزل اليك من ربّك وان لّم تفعل فما بلّغت رسالته والله يعصمك من النّاس(

হে রাসূল! তোমার প্রভুর নিকট হইতে তোমার প্রতি যা নাযিল করা হয়েছে তা (লোকদের নিকট) পৌঁছিয়ে দাও এবং যদি তুমি এরূপ না কর তাহলে তুমি তাঁর বাণী আদৌ পৌঁছালে না। নিশ্চয় আল্লাহ্ আপনাকে মানুষের কবল হতে রক্ষা করবেন (মায়েদা : 67)।

যে বিষয়টি আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূলকে কড়া ভাষায় খেতাব করেছিলেন , তা ছিল আলী (আ.)-এর খেলাফতকে আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রচার করা। রাসূল (সা.) বিষয়টি প্রচারে বিরত থাকছিলেন , কেননা ভয় পেতেন বিষয়টি মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ ও ফাটলের কারণ হতে পারে। তিনি তা প্রচারের জন্য অনুকূল পরিবেশের প্রতীক্ষায় ছিলেন। আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার পর তিনি অনুধাবন করলেন এখনই উপযুক্ত সময়। আর এই লক্ষ্যেই জনগণকে গাদীরে খুম নামক ধুধু মরুভূমিতে একত্রিত করলেন , যার মাধ্যমে ইসলামের প্রাণ অর্থাৎ খেলাফত ও উত্তরাধিকারের ব্যাপারটি সম্পূর্ণরূপে স্পষ্ট হয়ে যায়।

জনগণ বুঝতে পারছিলেন না যে কেন থামতে বললেন এবং কী এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ঘটেছে। কিন্তু কিছু সময় না যেতেই যোহরের নামাজের জন্য আহবান করা হলো এবং নামাজ আদায় করার পর জনগণ রাসূল (সা.)-এর আকর্ষণীয় এবং আসমানী চেহারাকে মিম্বরের উপর (যা উটের হাউদায দিয়ে প্রস্তুত করা হয়েছিল) দেখতে পেলেন।

সর্বত্র নিস্তব্ধ অবস্থা বিরাজ করছিল এমন সময় রাসূল (সা.)-এর মনোরম ও অর্থবহ বাণী মরুভূমির নিস্তব্ধতার অবসান ঘটাল। আল্লাহর প্রশংসার পর নিজের আসন্ন মৃত্যুর মর্মান্তিক খবর ঘোষণা করে বললেন :

হে লোক সকল! আমি তোমাদের জন্য কেমন নবী ছিলাম ? সকলে সমস্বরে বলল : ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি আমাদেরকে সদুপদেশের ক্ষেত্রে কিঞ্চিত অবহেলা করেন নি। উপদেশ ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে উপেক্ষা করেন নি। আল্লাহ্ আপনাকে উত্তম পুরস্কার দান করুন (আপনি উত্তম রাসূল)। রাসূল (সা.) বললেন : আমার পর আল্লাহর কিতাব (কোরআান) ও পবিত্র মাসুমগণ (আমার আহলে বাইত) একত্রে তোমাদের পথ প্রদর্শক। তোমরা যদি এই দু টিকে দৃঢ় ও পরিপূর্ণ ভাবে আকড়ে ধর তাহলে কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না।

অতঃপর আলী (আ.)-এর হস্ত মোবারককে এমন ভাবে উচ্চে তুলে ধরলেন যে উপস্থিত সকলেই তাকে দেখতে পেলেন এবং বললেন :

লোকসকল! কোন সে ব্যক্তি যে মুমিনদের নিকট তাদের নিজেদের থেকে ও বেশি শ্রেয় এবং তাদের উপর বেলায়েত ও আধিপত্য রাখেন ?

জনগণ বললেন : আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলই ভাল জানেন।

রাসূল (সা.) বললেন : আল্লাহ্ হলেন আমার মাওলা (অভিভাবক) আর আমি মুমিনদের মাওলা এবং তাদের উপর তাদের নিজেদের চেয়েও বেশি অধিকার রাখি। অতঃপর বললেন : আমি যার মাওলা এবং যার প্রতি বেলায়েত ও আধিপত্ব রাখি। এই আলীও আমার পর তাদের মাওলা।

من كنت مو لاه فهذا علي مولاه

এই বাক্যটিকে তিনবার আবৃতি করলেন। সবশেষে বললেন : এখানে উপস্থিত সকলে এ সত্য অন্যদের কাছে পৌঁছে দিবে।

জনগণ তখনো বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েনি এমতাবস্থায় এ আয়াতটি অবতীর্ণ হলো :

) اليوم اكملت لكم دينكم واتممت عليكم نعمتي ورضيت لكم الا سلام دنيا(

আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের উপর আমার নেয়ামতকে (অনুগ্রহকে) সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দীনরূপে মনোনীত করলাম (মায়েদা : 3)।

আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তরাধিকারী মনোনীত হওয়ার পর উপস্থিত জনতা মরিয়া হয়ে রাসূল (সা.)-এর উত্তরাধিকারী হযরত আলী (আ.)-কে মোবারক বাদ জানালেন।

প্রথম যে ব্যক্তি আলী (আ.)-কে মোবারকবাদ জানায় সে হলো আবু বকর , অতঃপর ওমর। তারা এই বাক্যগুলি বলছিল এবং আমিরুল মুমিনিন আলী (আ.)-এর কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিল :

بخ بخ يا علي ابن ابي طالب اصبحت موليئ و مولي كل مومنين و المومنات

শুভ হোক , হে আলী ইবনে আবি তালিব , আজ থেকে আপনি আমার এবং সকল মুসলিম নর-নারীর মাওলা বা নেতা হয়ে গেলেন।117

হাদীসে গাদীরের বর্ণনাকারীগণ

প্রকৃত পক্ষে হাদীসে গাদীরের রাবীর সংখ্যা 120 ,000। কেননা রাসূল (সা.)-এর নির্দেশ অনুযায়ী সকলেই এই সফরের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসাবে এ হাদীসটি অন্যদের কাছে বর্ণনা করেন।118 আর এ কারণেই মুসলমানদের সর্বস্তরে গাদীরের ঘটনাটি প্রতিবারই নতুন করে জীবিত হয়েছিল।

গাদীরে খুমের ঘটনার প্রায় 25 বৎসর পর অর্থাৎ যখন রাসূল (সা.)-এর অধিকাংশ সাহাবীরা ইহধাম ত্যাগ করেছিলেন এবং তাদের মধ্যে অল্প সংখ্যক জীবিত ছিলেন ; আলী (আ.) জনগণকে বললেন : আপনাদের মধ্যে যারা গাদীরে খুমে উপস্থিত ছিলেন এবং রাসূল (সা.)-এর মুখ থেকে হাদীসে গাদীর শ্রবণ করেছিলেন , সাক্ষ্য দান করুন।

ঐ বৈঠকেই 30 জন রাবী উঠে দাঁড়িয়ে হাদীসে গাদীর সম্পর্কে সাক্ষ্য প্রদান করেছিলেন।119

মুয়াবিয়ার মৃত্যুর 1 বৎসর পূর্বে (অর্থাৎ 59 হিজরীতে) ইমাম হুসাইন (আ.) বনি হাশেম , আনসার এবং সকল হাজীদেরকে মিনায় একত্রিত করে বক্তৃতার এক পর্যায়ে বললেন : আপনাদেরকে আল্লাহর শপথ করে বলছি , জানেন কি রাসূল (সা.) গাদীরে খুমে আলীকে মুসলিম উম্মাহর নেতা ঘোষণা করেছিলেন এবং উপস্থিত সকলকে তা অন্যদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন ?

সকলে বলল : জী হ্যাঁ।120

আহলে সুন্নাতের পণ্ডিতরা তাদের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থসমূহে রাসূল (সা.)-এর 110 জন সাহাবী যারা স্বয়ং মহানবীর থেকে হাদীসে গাদীর শুনেছেন এবং অন্যদের কাছে বর্ণনা করেছেন তাদের নাম উল্লেখ করেছেন।121 আরও কিছু পণ্ডিতগণ হাদীসে গাদীর এবং গাদীরের ঘটনা সম্পর্কে বিশেষ কিতাবও রচনা করেছেন।122

হাদীসে গাদীরের তাৎর্পয

স্পষ্ট দলিল দ্বারা প্রমাণিত হয় যে মাওলা এবং ওয়ালী শব্দের অর্থ হলো মুসলিম উম্মাহর উত্তরাধিকারী ও অভিভাবক এবং অন্য অর্থের সাথে সংগতি রাখে না। এখন নিম্নের বিষয়গুলির প্রতি লক্ষ্য করুন :

1.ইতোমধ্যেই আমরা জেনেছি যে , রাসূল (সা.) হাদীসে গাদীর উপস্থাপন করতে ভয় পাচ্ছিলেন এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ না আসা পর্যন্ত তিনি তা ঘোষণা করেন নি।

তাহলে একথা বলা সম্ভব নয় যে হাদীসে গাদীরের উদ্দেশ্য হলো রাসূল (সা.)-এর সাথে আলী (আ.)-এর বন্ধুত্বকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া ? যদি উদ্দেশ্য তাই হতো , তাহলে তা প্রচার করাতে ভয়ের কোন কারণ ছিল না এবং তাতে মুসলমানদের ঐক্য বিনষ্ট হতো না। সুতরাং উদ্দেশ্য খেলাফত ও উত্তরাধিকারীর ব্যাপারই ছিল। আর এ ভীতি বিদ্যমান ছিল যে , এই বিষয়টি প্রচার করলে কিছু সংখ্যক স্বার্থান্বেষী ঔদ্ধ্যত্য প্রকাশ করতে পারে।

2.রাসূল (সা.) মান কুনতু মাওলা ফাহাযা আলীয়ুন মাওলা বলার পূর্বে জনগণের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি নিয়েছিলেন যে , তিনি মুমিনদের নিজেদের অপেক্ষা তাদের উপর অধিক অধিকার রাখেন এবং উম্মতের কর্ণধার। অতঃপর ঐ স্থানকে আলীর জন্যেও নির্ধারণ করলেন এবং বললেন : আমি যার মাওলা আলীও তার মাওলা।

3.হাসসান ইবনে ছাবেত গাদীরের ঘটনাটিকে রাসূল (সা.)-এর অনুমতিক্রমে কবিতার ভাষায় বর্ণনা করেন এবং রাসূল (সা.) তাতে অনুমোদন দেন। হাসসানের কবিতায় আলী (আ.)-এর খেলাফত ও ইমামতের মর্যদাকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হয়েছে কিন্তু ব্যাপক জনসমষ্টির কেউই প্রতিবাদ করেন নি যে কেন মাওলা শব্দের ভুল অর্থ করছ। বরং সকলেই তার প্রশংসা করেছিলেন এবং স্বীকৃতিদান করেছিলেন।

কবিতাটির কিছু অংশ এখানে তুলে ধরছি :

فقاله قم يا علي فا نّني

رضتيك من بعدي اماما وهاديا

فمن كنت مو لاه فهذ وليّه

فكونو له اتباع صر ق عوالي

অর্থাৎ রাসূল (সা.) আলীকে বললেন : ওঠ হে আলী আমার পর তুমিই হলে উম্মতের নেতা ও ইমাম। সুতরাং আমি যার মাওলা এবং যার দীনি ও ঐশী কর্ণধার এই আলীও তার মাওলা এবং অভিভাবক। অতএব , তোমরা সকলেই আলীর প্রকৃত অনুসারী হও।

4.অনুষ্ঠান শেষে রাসূল (সা.) হযরত আলী (আ.)-কে নিয়ে একটি তাঁবুর মধ্যে বসলেন এবং সকলকে এমনকি তাঁর স্ত্রীদেরকেও হযরত আলীকে অভিনন্দন জানাতে বললেন এবং তাঁর হাতে বাইয়াত করতে বললেন। আর আমিরুল মুমিনীন হিসাবে হযরত আলীকে সালাম জানাতে বললেন।123 এটা স্পষ্ট যে , এ অনুষ্ঠান শুধুমাত্র তাঁর খেলাফত ও ইমামতের সাথেই সামঞ্জস্যপূর্ণ।

5.রাসূল (সা.) দু বার বলেছিলেন :هنئوني অর্থাৎ আমাকে অভিনন্দন জানাও। কেননা আল্লাহ তায়ালা আমাকে শ্রেষ্ঠ নবী ও আমার আহলে বাইতকে উম্মতের জন্য ইমাম নির্বাচন করেছেন।124

এসকল দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করার পর হাদীসে গাদীর সম্পর্কে আর কোন রূপ সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না।