একজন মুসলিম নারীর অবশ্যই যা জানা প্রয়োজন

একজন মুসলিম নারীর অবশ্যই যা জানা প্রয়োজন11%

একজন মুসলিম নারীর অবশ্যই যা জানা প্রয়োজন লেখক:
: মীর আশরাফ-উল-আলম
প্রকাশক: আল মুস্তাফা (সা.) আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, কোম-ইরান
বিভাগ: নারী বিষয়ক

একজন মুসলিম নারীর অবশ্যই যা জানা প্রয়োজন
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 87 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 44434 / ডাউনলোড: 5205
সাইজ সাইজ সাইজ
একজন মুসলিম নারীর অবশ্যই যা জানা প্রয়োজন

একজন মুসলিম নারীর অবশ্যই যা জানা প্রয়োজন

লেখক:
প্রকাশক: আল মুস্তাফা (সা.) আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, কোম-ইরান
বাংলা

1

পবিত্র কোরআনে হিজাব

) وَقُل لِّلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِ‌هِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُ‌وجَهُنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ‌ مِنْهَا وَلْيَضْرِ‌بْنَ بِخُمُرِ‌هِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا لِبُعُولَتِهِنَّ أَوْ آبَائِهِنَّ أَوْ آبَاءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ أَبْنَائِهِنَّ أَوْ أَبْنَاءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي أَخَوَاتِهِنَّ أَوْ نِسَائِهِنَّ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُنَّ أَوِ التَّابِعِينَ غَيْرِ‌ أُولِي الْإِرْ‌بَةِ مِنَ الرِّ‌جَالِ أَوِ الطِّفْلِ الَّذِينَ لَمْ يَظْهَرُ‌وا عَلَىٰ عَوْرَ‌اتِ النِّسَاءِ وَلَا يَضْرِ‌بْنَ بِأَرْ‌جُلِهِنَّ لِيُعْلَمَ مَا يُخْفِينَ مِن زِينَتِهِنَّ وَتُوبُوا إِلَى اللَّـهِ جَمِيعًا أَيُّهَ الْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ(

হে নবী! ঈমানদার নারীদেরকে বলে দাও যে , তাদের চক্ষুদ্বয়কে নিচের দিকে রাখতে (না-মাহরামদের প্রতি তাকানো থেকে নিজের চোখ ফিরিয়ে রাখা) এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত করতে আর কখনোই যেন তারা তাদের সৌন্দর্য্যকে প্রকাশ্যে উম্মুক্ত না করে । শুধুমাত্র ঐ পরিমান ব্যতীত যা স্বাভাবিক ভাবেই উম্মুক্ত থাকে । তাদের ওড়না যেন বুকের উপর পর্যন্ত আসে (যাতে করে ঘাড় ও বুক তা দিয়ে ঢেকে যায়) এবং তাদের সৌন্দর্য্যকে যেন উম্মুক্ত না করে , শুধুমাত্র তাদের স্বামী অথবা পিতাগণ (পিতা , দাদা , দাদার বাবা , দাদার বাবার বাবা...) অথবা স্বামীর পিতাগণ (পিতা , দাদা , দাদার বাবা , দাদার বাবার বাবা...) অথবা তাদের নিজেদের পুত্রগণ অথবা তাদের স্বামীদের অন্য স্ত্রীর পুত্রগণ অথবা নিজেদের ভ্রাতা , ভ্রাতুষ্পুত্র , ভগ্নীপুত্র , স্বজাতির নারীগণ , তাদের অধিকারভুক্ত বাঁদী অথবা নির্বোধ ব্যক্তি (অর্থাৎ এমন ব্যক্তি প্রাকৃতিক ভাবেই যার নারীর প্রতি কোন প্রকার আসক্তি থাকে না) অথবা শিশুগণ (এমন শিশু যাদের নারীদের গোপণ অঙ্গ সম্পর্কে কোন প্রকার ধারণাই নেই) ব্যতীত । আর পথ চলার সময় তারা যেন এমনভাবে পা মাটিতে না রাখে যাতে করে তাদের গোপন সৌন্দর্য্য প্রকাশ পেয়ে যায় (অর্থাৎ পায়ে নুপুর দিয়ে জোরে জোরে মাটিতে পা ফেলে হেটে যাওয়া যার শব্দ পুরুষের কানে পৌঁছায়) । হে মু ’ মিনগন! তোমাদের অতীত গোনাহর ব্যাপারে তওবা করো যাতে করে সফলতা লাভ করতে পারো ।১৫৪

يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُل لِّأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاءِ الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِن جَلَابِيبِهِنَّ ذَٰلِكَ أَدْنَىٰ أَن يُعْرَ‌فْنَ فَلَا يُؤْذَيْنَ وَكَانَ اللَّـهُ غَفُورً‌ا رَّ‌حِيمًا

হে নবী! তোমার স্ত্রী ও কন্যাগণকে এবং মু ’ মিনদের স্ত্রীগণকে বলে দাও যে , তারা যেন বড় ওড়না (চাদরের ন্যায়) দিয়ে নিজেদেরকে ঢেকে রাখে যাতে তাদেরকে (সম্মানিত বলে) চেনা যায় এবং নিপীড়নের শিকার না হয় । (আর যদি এখন পর্যন্ত তাদের কোন গোনাহ হয়ে থাকে তবে তাদের জানা প্রয়োজন যে) আল্লাহ্ তা ’ য়ালা সর্বদা পরম ক্ষমাশীল ও দয়াবান ।১৫৫

দ্রষ্টব্য :

১- উপরোল্লিখিত দু ’ টি আয়াতে খুমুর ’ ও জালাবিব ’ এর মধ্যে পার্থক্য :

ক)- খুমুর হচ্ছে খিমারের বহুবচন যার প্রকৃত অর্থ হচ্ছে আবৃত হওয়া বা আবৃত থাকা ইত্যাদি । কিন্তু সাধারণত বড় ওড়নাকে বলা হয়ে থাকে যা দ্বারা নারীরা তাদের মাথা , ঘাড় , গলা ও বুক ঢেকে রাখে । আর জালাবিব হচ্ছে জিলবাবের বহুবচন যার প্রকৃত অর্থ হচ্ছে বড় চাদর অথবা ঢিলা ঢালা পোশাক বিশেষ । অবশ্য এই জিলবাবের আবার বিভিন্ন অর্থ রয়েছে এবং স্থান , কাল , পাত্র ভেদে অর্থের পরিবর্তনও হয়ে থাকে তবে যেটা পরিস্কার তা হচ্ছে এমন কিছু যার মাধ্যমে নারীরা তাদের সম্পূর্ণ শরীরকে ঢেকে রাখতে পারে ।

খ)- উস্তাদ মুতাহহারী (রহ.) এই দু ’ টির পার্থক্যের ব্যাপারে বলেছেন যে : নারীদের জন্য দু ’ ধরনের ওড়না বা চাদরের প্রচলন ছিল যার একটি হচ্ছে ছোট যাকে খুমুর বলা হয়ে থাকে এবং বাড়ীর ভিতরে পরিধানের জন্যে । আর অন্যটি হচ্ছে বড় যাকে জিলবাব বলা হয়ে থাকে এবং তা নিঃসন্দেহে বাড়ীর বাইরে পরিধানের জন্যে ব্যবহৃত হয়ে থাকে । কেননা এই জিলবাব শব্দটি বিভিন্ন রেওয়ায়েতে উক্ত অর্থেই ব্যবহার করা হয়েছে ।১৫৬

২- নারীদের শরীর জিলবাব (বড় চাদর) দ্বারা আবৃত করার উদ্দেশ্য কী ?

উদ্দেশ্য হচ্ছে এটাই যে , এই জিলবাবের মাধ্যমে নারিগণ তাদের শরীরকে না-মাহরামের দৃষ্টি থেকে দূরে রাখতে পারে । তবে তা যেন তারা তাদের শরীরের সাথে সুন্দর করে আঁকড়ে রাখে , এমন যেন না হয় যে ; তারা বড় চাদর পরেছে ঠিকই কিন্তু শরীরের সাথে তা আঁকড়ে রাখে নি এবং বাতাসে তা এদিক ওদিক উড়ে যাচ্ছে ও তাদের শরীরের আকর্ষনীয় স্থানগুলো সহজেই নজরে পড়ছে । চাদর বা বোরকা পরাটা যদি শুধু নাম মাত্র হয়ে থাকে আর সে কারণে রাস্তা-ঘাটে তাদের সৌন্দর্য্যতা , শরীরের আকর্ষনীয় স্থান , মাথার চুল সব কিছুই প্রকাশিত হয় তবে এ ধরনের চাদর বা বোরকাপরিধানকারিনীকে দুর্বল ঈমানের অধিকারী বলা যায় ।

আবৃত করার প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে যে , নারীরা তাদের চাদর বা বোরকা এমনভাবে পরবে যাতে করে তাদের সৌন্দর্য্য ও সম্পূর্ণ শরীর ঢেকে থাকে এবং অসভ্য ও ইতর প্রকৃতির পুরুষরা তাদের শরীরের উপর নজর দেয়া থেকে নিরাশ হয় । আর বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করার লক্ষ্যে নারিগণ যেন চাদর পরার পরও একটি ছোট ওড়না যা তাদের মাথা , ঘাড় , গলা ও বুকের নিচ অংশ ঢেকে যায় পরিধান করবেন । কেননা কখনো যদি ভুলবশত বাতাসে চাদরটি শরীর থেকে সরে যায় সেক্ষেত্রেও যেন তাদের সৌন্দর্য্য প্রকাশ না পায় ।

৩- মাহরামদের (যাদের সাথে বিয়ে করা হারাম) সামনে সৌন্দর্য্য প্রকাশ করার ক্ষেত্রেও সীমা রয়েছে যা নিম্নলিখিত আয়াতে এসেছে । আল্লাহ সুবহানাহু তা ’ য়ালা উক্ত বিষয়ে পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেছেন :

) يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لِيَسْتَأْذِنكُمُ الَّذِينَ مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ وَالَّذِينَ لَمْ يَبْلُغُوا الْحُلُمَ مِنكُمْ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ مِّن قَبْلِ صَلَاةِ الْفَجْرِ وَحِينَ تَضَعُونَ ثِيَابَكُم مِّنَ الظَّهِيرَةِ وَمِن بَعْدِ صَلَاةِ الْعِشَاءِ ثَلَاثُ عَوْرَاتٍ لَّكُمْ لَيْسَ عَلَيْكُمْ وَلَا عَلَيْهِمْ جُنَاحٌ بَعْدَهُنَّ طَوَّافُونَ عَلَيْكُم بَعْضُكُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ اللَّـهُ لَكُمُ الْآيَاتِ وَاللَّـهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ(

হে ঈমানদারগণ! তোমাদের দাস-দাসীরা(ভৃত্যরা) ও (তোমাদের সন্তানদের মধ্যে) যারা এখনো বালেগ হয় নি তারা তোমাদের ঘুমানোর ঘরে প্রবেশ করার জন্য তিনটি সময়ে অনুমতি নিবে : ১- ফজরের নামাজের আগে , ২- দুপুর বেলা যখন সাধারণত পোশাক খুলে ফেল , ৩- এ ’ শার নামাজের পরে । এই বিশেষ তিনটি সময় তোমাদের জন্য , কিন্তু উক্ত তিনটি সময় ব্যতীত তোমাদের উপর কোন গোনাহ্ নেই এবং তাদের উপরেও নেই যদি তারা বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করে । (কারণ) তোমাদেরকে তো একে অপরের কাছে যাতায়াত করতেই হয় এবং তখন আন্তরিকতার সাথে একে অপরকে খেদমত কর । আল্লাহ তা ’ য়ালা এরূপেই তোমাদের জন্য আয়াতসমূহকে বর্ণনা করেছেন । কেননা আল্লাহ তা ’ য়ালা হচ্ছেন সর্বজ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান ।১৫৭

ফলাফল :

এটা ঠিক যে , পরিবারের সদস্যগণ সকলেই মাহরাম ও স্বাধীন , কিন্তু এই মাহরাম ও স্বাধীন থাকাটাও শর্তহীন নয় । মাহরাম ও স্বাধীন হওয়ার কারণে মা ও মেয়ে যেন সন্তানদের ও ভাইদের সামনে যে কোন পোশাক পরে আসা-যাওয়া না করে । কেননা শরীর অর্ধ প্রকাশ অথবা সম্পূর্ণ প্রকাশ এবং পা অনাবৃত থাকাটা সন্তানদের উপর খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে যা তাদের কুপ্রবৃত্তিকে উস্কে দিতে পারে । আর এটা বলা ঠিক হবে না যে , তারা তো বাচ্চা কিচ্ছু বোঝে না , বরং এটা অবশ্যই বলা যায় যে , তারা বেশী কৌতুহলী ও উৎসুক এবং এই পরিবেশই হয়তো তাদেরকে যৌন বিষয়ের আগ্রহী করে তুলতে পারে ।১৫৮

৪- যারা রাস্তা ও অলি-গলিতে নারীদের বিরক্ত করে থাকে অবশ্যই তাদের কঠিন শাস্তিপাওয়া উচিৎ , যেমনভাবে নিম্নের আয়াতে উল্লেখহয়েছে :

) لَّئِن لَّمْ يَنتَهِ الْمُنَافِقُونَ وَالَّذِينَ فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٌ وَالْمُرْجِفُونَ فِي الْمَدِينَةِ لَنُغْرِيَنَّكَ بِهِمْ ثُمَّ لَا يُجَاوِرُونَكَ فِيهَا إِلَّا قَلِيلًا(

যদি মুনাফিকরা ও যাদের অন্তরসমূহ হচ্ছে অসুস্থ এবং যারা মিথ্যা কথা ও অবাস্তব খবর মদীনায় ছড়িয়ে বেড়ায় এবং তারা যদি অপকর্ম থেকে সরে না দাঁড়ায় , তবে অবশ্যই তাদের উপর তোমাকে প্রতিপত্তি দান করবো , অতঃপর অল্প দিনের মধ্যেই তারা আর তোমার পাশে এই শহরে বাস করতে পারবে না ।১৫৯

সিদ্ধান্ত :

এই আয়াতের ভাষ্য অনুযায়ী এটা পরিস্কার হয়ে যায় যে , মদীনায় তিনটি দল চক্রান্ত করতো এবং প্রতিটি দলই বিভিন্নভাবে ইসলামের উপর আঘাত হানার জন্য পরিকল্পনা করতো । এই তিনটি দল হচ্ছে যথাক্রমে :

১- মুনাফিকরা ।

২- বখাটে ও ভবঘুরেরা ।

৩- আর একদল হচ্ছে যারা অবাস্তব খবর প্রচার করতো বিশেষত যখন নবী (সা.) ও তাঁর সাহাবীরা যুদ্ধে যেতেন তখন মদীনায় থাকা অন্যান্য মুসলমানদের মানসিকভাবে দুর্বল করার জন্য তারা এ কাজ করতো ।

আল্লাহ্ তা ’ য়ালা নির্দেশ দিলেন যে , উক্ত দলসমূহের সাথে যেন কঠোর আচরণ করা হয় । এ ধরনের ব্যক্তিদের জন্যে সর্বনিম্ন শাস্তি হচ্ছে তাদেরকে নির্বাসনে পাঠানো যাতে করে ইসলামী সমাজ পবিত্র থাকে । আর শাস্তির পরিমান যত কঠিন হবে ইসলামী সমাজে পবিত্রতা ও নৈতিকতা ততই বৃদ্ধি পাবে এবং এ ধরনের ব্যক্তিদের শাস্তির ব্যাপারে যতই বিলম্ব করা হবে ইসলামী সমাজের জন্য তা হবে ততই ক্ষতিকর । কেননা এর ফলে ইসলামী সমাজে নৈতিক অনাচার ও পাপের পরিমান বাড়তেই থাকবে । কারণ এ ধরনের ব্যক্তিরা যখনই ইসলামী সমাজে প্রবেশের সুযোগ পায় তখনই ঐ সমাজে ফিতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টির অপচেষ্টা চালায় যাতে করে পর্যায়ক্রমে ভাল ও নীতিবান মানুষ প্রথম কাতার থেকে দূরে সরে যায় । তাকওয়া ও পরহেজগার ব্যক্তিদেরকে এ কারণেই সরিয়ে দিতে চায় যে , তারা যদি সমাজের প্রথম সারিতে অবস্থান করে তবে সে সমাজের অন্যদেরকেও তাদের মতই তৈরী করবে । প্রকৃতপক্ষে ইসলামী হুকুমত তো বিপ্লবী ও মু ’ মিন ব্যক্তিদের সহযোগিতায় টিকে থাকে । আর তারা যদি না থাকে তবে ইসলামী হুকুমত তাদের হাত ছাড়া হবে । কেননা এ ধরনের খারাপ ব্যক্তিরা শুধুমাত্র পেট পুজা ও যৌন সম্ভোগ ব্যতীত অন্য কিছুর ব্যাপারেই চিন্তা করে না । তাই ইসলামী হুকুমতকে টিকিয়ে রাখার জন্য অবশ্যই সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে সৎ ও নীতিবান মানুষের দায়িত্বশীল হওয়া বিশেষ প্রয়োজন ।

রেওয়ায়েতে হিজাব

علی بن ﺍﺑﺮﺍﻫﻴﻢ فی تفسیره عن ابی ﺟﻌﻔﺮ (ﺍﻟﺴﻼﻡ ﻋﻠﻴﻪ) ﰱ ﻗﻮﻟﻪ : ﻻﻳﺒﺪﻳﻦ الا ﻣﺎ ﻇﻬﺮ ﻣﻨﻬﺎ، ﻓﻬﻰ ﺍﻟﺜﻴﺎﺏ ﻭ ﺍﻟﻜﺤﻞ ﻭ الخاتم و خضاب الکف و السوار و الزینت ثلاث : زینة للناس و زینة للمحرم و زینة للزوج. فأما رینة الناس، فقد ذکرناها، و اما زینة المحرم فموضع القلادة فما فوقها و الدملج و ما دونه و الخلخال و ما اسفل منه، و اما زینة الزوج فالجسد کله

ইমাম বাকির (আ.) পবিত্র এ আয়াতের ব্যাপারে বলেছেন : নারিগণ যেন তাদের সৌন্দর্য্য কে প্রকাশ না করেন , শুধুমাত্র যে স্থানগুলো স্বাভাবিক ভাবে বেরিয়ে থাকে । বাহ্যিক সৌন্দর্য্য হচ্ছে যথাক্রমে ; পোশাক , সুরমা , আংটি , মেহেদী ও চুড়ি । অতঃপর তিনি বলেন , সৌন্দর্য্য হচ্ছে তিন প্রকার যথা ; ১- সকলের জন্য যা উপরে বর্ণিত হয়েছে , ২- মাহরামদের জন্য -তা হচ্ছে গলা ও বুকের উপরের অংশ , কনুই হতে কব্জি পর্যন্ত এবং গোড়ালীর একটু উপর হতে নীচ পর্যন্ত , ৩- শুধুমাত্র স্বামীর জন্য -তা হচ্ছে নারীর সম্পূর্ণ শরীর ।১৬০

একজন হাদীস বর্ণনাকারী বলেন , হযরত ইমাম সাদিক (আ.)-এর কাছে প্রশ্ন করেছিলাম যে , একজন না-মাহরাম পুরুষের জন্য নারীর শরীরের কোন অংশ পর্যন্ত দেখা জায়েয ? ইমাম সাদিক (আ.) বললেন : মুখন্ডল , দু ’ হাতের কব্জি থেকে আঙ্গুল পর্যন্ত ও দু ’ পায়ের গিরা পর্যন্ত ।১৬১

যা ব্যতিক্রম করা হয়েছে তা হচ্ছে দু ’ হাত কব্জি থেকে আঙ্গুল পর্যন্ত ও মুখমন্ডল , তবে সেদিকে যাতে উপভোগ করার ইচ্ছায় তাকানো না হয় । ইমাম খোমেনী (রহ.) বলেছেন : নারীর মুখমণ্ডল ও দু ’ হাতের কব্জি থেকে আঙ্গুল পর্যন্ত দেখা যদি উপভোগ করার ইচ্ছায় হয়ে থাকে তবে তা হারাম হবে । সতর্কতা মূলক ওয়াজিব হচ্ছে উপভোগ না করার ইচ্ছায়ও যেন না তাকানো হয় । অনুরূপ পুরুষের শরীরের দিকে নারীর তাকানোটাও মুখমন্ডল ও দু ’ হাত (কনুই থেকে আঙ্গুল পর্যন্ত) ব্যতীত হারাম হবে ।১৬২

ইমাম সাদিক (আ.) আল্লাহর বাণী তা ব্যতীত যে সৌন্দর্য্য প্রকাশিত থাকে ’ সে ব্যাপারে বলেছেন : বাহ্যিক সৌন্দর্য্য (যা প্রকাশ করা যাবে তা) হচ্ছে সুরমা ও আংটি ।১৬৩

হযরত আবু বকরের কন্যা ও আয়েশার বোন আসমা নবী (সা.) -এর ঘরে প্রবেশ করে যখন তার পরনে ছিল পাতলা পোশাক যার মধ্য থেকে তার শরীর দেখা যাচ্ছিলো । রাসূলে আকরাম (সা.) তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন এবং তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন :

হে আসমা! যখনই কোন মেয়ে বালেগ হয়ে যায় তখন এটা উচিৎ নয় যে , তার শরীরের কোন অংশ দেখা যাক , শুধুমাত্র দু ’ হাতের কব্জি থেকে আঙ্গুল পর্যন্ত এবং মুখমণ্ডল ।১৬৪

ফুযাইল ইবনে ইয়াসার বলেন : ইমাম সাদিক (আ.)-এর কাছে প্রশ্ন করেছিলাম যে , নারীরা তাদের হাতের কনুই থেকে আঙ্গুল পর্যন্ত কী না-মাহরামদের সামনে অবশ্যই ঢেকে রাখবে ? ইমাম বললেন : হ্যাঁ , যা কিছু ওড়নার (মাথা থেকে বুকের উপর পর্যন্ত পড়ে এমন কাপড়) নিচে থাকে এবং চুড়ি পরার স্থান থেকে উপরের দিকে অবশ্যই ঢেকে রাখতে হবে ।১৬৫

রাসূল (সা.) হাউলাকে (আত্তারের স্ত্রী) উদ্দেশ্য করে বলেন :

হে হাউলা , তোমার সৌন্দর্য্য ও সাজ-সজ্জা স্বামী ব্যতীত অন্য করো সামনে প্রকাশ করো না । আর নারীর জন্যে এটাও জায়েয নয় যে , হাতের কব্জি ও পায়ের পাতা না-মাহরামদের (স্বামী ব্যতীত অন্য পুরুষ) সামনে উম্মুক্ত রাখবে । যদি কেউ এমন কাজ করেই ফেলে তবে প্রথমত আল্লাহ্ সুবহানাহু তা ’ য়ালা সব সময় তাকে অভিসম্পাত করেন , দ্বিতীয়ত আল্লাহ্ সুবহানাহু তা ’ য়ালার ক্রোধ ও গজবের কারণ হয় ; তৃতীয়ত আল্লাহ সুবহানাহু তা ’ য়ালার ফেরেশতাগণ অভিসম্পাত দিতে থাকে এবং চতুথর্ত কিয়মাতের দিনে তার জন্য কঠিন আজাবের ব্যবস্থা থাকবে ।১৬৬

হে হাউলা , যে নারিগণ আল্লাহ সুবহানাহু তা ’ য়ালা ও কিয়ামত দিনের প্রতি ঈমান রাখে তারা তাদের (দৈহিক) সৌন্দর্য্য স্বামী ব্যতীত অন্য কোন না- মাহরাম পুরুষের সামনে প্রকাশ করে না এবং সাথে সাথে তাদের মাথার চুল , হাতের কব্জি ও পায়ের পাতাও কারো সামনে উন্মুক্ত করে না । আর যে নারীরা তাদের স্বামী ব্যতীত অন্য কোন পুরুষের জন্য এই কাজগুলো করে থাকে সে তার ধর্মকে নষ্ট এবং আল্লাহ সুবহানাহু তা ’ য়ালাকে তার উপর রাগান্বিত করলো ।১৬৭

ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন : মুসলমান নারীদের জন্য জায়েয নয় যে , এমন ওড়না ও পোশাক পরিধান করে যা তাদের শরীরকে ঢেকে রাখে না ।১৬৮

দ্রষ্টব্য :

১- উপরে যতগুলো আয়াত ও রেওয়ায়েত উল্লিখিত হয়েছে তা থেকে একটি মূল বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায় আর তা হচ্ছে এই যে , নারী অবশ্যই নিজেকে না-মাহরামদের সামনে ঢেকে রাখবে । আর যে সব আচার-আচরণ , বাচন ভঙ্গি , পোশাক-আশাক না-মাহরামকে তার দিকে আকৃষ্ট করে তোলে তা সম্পূর্ণরূপে পরিহার করবে এবং পাতলা পোশাক পরিধান করা হতে দূরে থাকবে ।

২- ইমাম বাকির (আ.)-এর হাদীসটি থেকে যা তিনি আয়াতের তফসীর হিসেবে বলেছিলেন এটাই স্পষ্ট যে , নারীর যারা মাহরাম যেমন বাবা , ভাই , মামা , চাচা , নানা , দাদা ...তারাও তার পুরো শরীর দেখার অধিকার রাখে না বা ঐ নারীও যেন তাদেরকে তার গলা থেকে নিচের অংশ এবং বাহুবন্ধনী হতে উপরের অংশ ও পায়ের গোড়ালীর উপরের অংশ পর্যন্ত দেখতে না দেয় । এমনটি নয় যে , কোন নারী তার মাহরাম ব্যক্তির সামনে যে কোন ধরনের পোশাক পরে এবং সাজ-সজ্জা করে ও শরীরের আকর্ষণীয় স্থানসমূহ উম্মুক্ত করে চলা-ফেরা করতে পারবে । কেননা যদি কোন নারী তার মাহরাম ব্যক্তির সামনে ঐরূপভাবে চলা- ফেরা করে তবে তাদের মধ্যে কামভাব বৃদ্ধি পেতে পারে এবং এর পরিণতি খারাপ হতে পারে । তাই ইসলামী আদব- কায়দা ও সচ্চরিত্রতার দাবী হলো আমরা আমাদের পবিত্র ইমামদের (আ.) আদেশ-নিষেধকে সঠিকভাবে মেনে চলবো । কেননা ঐ আদেশ-নিষেধের প্রতি লক্ষ্য না রাখার ফলে পশ্চিমারা দুনিয়া পুজারী ও কামভাবী হয়ে উঠেছে ।

এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী ইংল্যান্ডে প্রতি বছর প্রায় এক লক্ষ শিশু ধর্ষণের স্বীকার হয় । গত বছরে এই দেশটিতে ৬৩০০ জন ধর্ষণের স্বীকার হয়েছে । এই বলাৎকার বা ধর্ষণের শতকরা অধিকাংশই পিতাদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে , এসব শিশুরা তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে এই ভয়ে ঘটনাগুলো গোপন রেখেছে । তবে সাম্প্রতিক রির্পোট অনুযায়ী এটা প্রমাণিত হয়েছে যে , পিতারা মায়েদের সাহায্য নিয়ে তাদের শিশুদেরকে বলাৎকার বা ধর্ষণ করেছে ।১৬৯

মানুষ যখন এই বিষয়গুলো পড়ে তখন প্রথমত এটা বুঝতে পারে যে , কারো যদি আল্লাহ সুবহানাহু তা ’ য়ালা ও কিয়ামত দিনের প্রতি ভয় না থাকে সে ব্যক্তি দুনিয়া ও যৌনতা ব্যতীত অন্য কিছু চিন্তা করে না এবং তার নষ্ট উদ্দেশ্যে পৌঁছানোর লক্ষ্যে যে কোন ধরনের কাজ আঞ্জাম দিতে পারে ; যদিও তা তার সন্তানদের উপর জুলুম ও অত্যাচার করেও হয় । দ্বিতীয়ত পবিত্র কোরআন ও ইসলামী আদেশ-নিষেধের প্রতি তার ঈমান বৃদ্ধি পাবে এবং অন্তরের অন্তস্তল থেকে চিৎকার ধ্বনিতে বলবে : হে আল্লাহ্! তোমার প্রতি অনেক শুকরিয়া যে , আমার অন্তরকে ইসলামী আদেশ-নিষেধ মেনে চলার তৌফিক দান এবং শিরক ও কুফরী থেকে আমাকে রক্ষা করেছো । তৃতীয়ত যারা বাহ্যিকভাবে মুসলমান কিন্তু আমল- আখলাকের ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের মত তারা বিচলিত হয়ে উঠবে যে , কেন ইসলামী বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখছে না ।

হিজাবের দর্শন

নিঃসন্দেহে বর্তমান যুগে পাশ্চাত্য মনস্ক ব্যক্তিরা নারীদের অশ্লীলতা ও বেহায়াপনাকে তাদের স্বাধীনতার অংশ বলে মনে করে এবং একে বিশেষ গুরুত্বও দিয়ে থাকে । তাই অনেকে এই যুগকে উলঙ্গপনা ও যৌন স্বাধীনতার যুগ বলে আখ্যায়িত করেছে । এ কারণে তাদের কাছে বর্তমান যুগে হিজাব সম্পর্কে কথা বলাটা হচ্ছে অসহনীয় একটি ব্যাপার এবং তা হচ্ছে অতীত যুগের কিচ্ছা-কাহিনী যা সেই যুগের জন্যেই প্রযোজ্য!

অবশ্য মাত্রাতিরিক্ত স্বাধীনতার ফলে যেহেতু সমাজে বিভিন্ন ধরনের ফ্যাসাদ , অশ্লীলতা ও নৈতিক অনাচারের সৃষ্টি হয়েছে সেহেতু কিছু কিছু আগ্রহী ব্যক্তি পর্দা সম্পর্কে শুনতে আগ্রহ প্রকাশ করছে । যদিও ইসলামী রাষ্ট্রগুলোতে বিশেষ করে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে এ সমস্যার সমাধান অনেক আগেই হয়েছে ও এ সম্পর্কে দলিল ভিত্তিক উত্তরও প্রদান করা হয়েছে । কিন্তু বিষয়টি অত্যন্তগুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় তা সম্পর্কে আরো ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা হওয়া বাঞ্ছনীয় । বিশেষ করে যখন বর্তমানে ইসলামের শত্রুরা বিভিন্ন আঙ্গিকে তাদের নষ্ট সংস্কৃতি প্রচারের মাধ্যমে ইসলামী সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার অপচেষ্টায় রত । তারা আমাদের কাছ থেকে ইসলামী সংস্কৃতিকে কেড়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে তাদের তৈরী অশ্লীল পর্নো ছবি , বিজাতীয় গান , প্রভৃতির সিডি , ভিডিও ক্যাসেট ইসলামী সমাজে প্রবেশ করিয়ে এদেশের পবিত্র ইসলামী রূপটিকেই ধ্বংস করে দিতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে । যুবকদের মধ্যে এসব প্রচারের জন্য তারা ইন্টারনেটকে ব্যবহার করছে ।

এখন নারীদের কাছেই প্রশ্ন যে , তারা কি সত্যিই পুতুলের মত বেশ-ভুষায় বাইরে আসতে চায় , যাতে তাদের উপর কিছু চরিত্রহীন , কামুক ব্যক্তিদের নোংরা দৃষ্টি পড়ে যা তাদের ব্যক্তিত্বকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয় ? নাকি তারা তাদের স্বামীদের জন্যেই শুধু সাজ-সজ্জা করবে ?

অন্যভাবে বললে বলতে হয় যে , নারীরা কি তাদের শরীরের আকর্ষণীয় অংশগুলো প্রদর্শন করে পুরুষের কামভাবকে উস্কে দেয়ার সীমাহীন এক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে , নাকি সমাজ থেকে তারা এরূপ বিষয়ের উচ্ছেদ ঘটিয়ে পারিবারিক পরিসরে তা করে সংসার , পরিবার- পরিজন ও স্বামী-সন্তানের প্রতি মনোযোগী ও যত্নবান হবে ?

পবিত্র ইসলাম দ্বিতীয় পথটিকে পছন্দ করে এবং হিজাবকেও এই প্রক্রিয়ার অংশ বলে মনে করে । যদিও পশ্চিমারা ঐ নোংরা প্রথম পথটিকে পছন্দ করে । ইসলাম বলে : দৈহিক চাহিদার সম্পূর্ণটাই হচ্ছে (সহবাস সহ অন্যান্য সব কিছু) স্বামী ও স্ত্রীর জন্যে এতে অন্য করো কোন অংশীদারিত্ব নেই । আর যদি কেউ এই সীমার বাইরে পা রাখতে চায় তবে তা হবে অন্যায় ও পাপ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ ।

মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে হিজাব

হিজাব হচ্ছে নারী এবং নামাহরাম ব্যক্তিদের মধ্যে সীমা নির্ধারণকারী একটি বিষয় এবং যৌন প্রবৃত্তিকে সংযতকরণের একটি উপকরণ । আর এই অগ্নি শিখা সঠিকভাবে নির্বাপিত হওয়া ও তার স্বাভাবিক পথে প্রবাহিত হওয়ার ফলে সমাজে বিদ্যমান অনেক সমস্যাই যেমন হত্যা , অপরাধ ও অন্যান্য অনাচার দূর হয়ে যাবে । আর যদি এই সীমাটিকে উঠিয়ে নেয়া হয় এবং বাঁধনহীন স্বাধীনতা আমাদের সমাজে ভিত গাড়তে পারে তবে সেক্ষেত্রে আমরা এক বন্য সমাজের মুখোমুখী হবো । যার ফলে সমাজে অস্থিরতা , সহিংসতা ও অরাজকতা আরো বৃদ্ধি পাবে । কেননা যৌন প্রবণতা প্রচন্ড শক্তিশালী লাগামহীন এক ছুটন্ত ঘোড়ার ন্যায় । তাই যতই কেউ তার আনুগত্য করবে ততই সে উদ্ধত হয়ে উঠবে এবং মানুষের জন্য ততই ক্ষতি বয়ে আনবে । অথবা তা হচ্ছে এমন আগুন , তাতে যত বেশী জ্বালানী দেয়া যাবে তার শিখাগুলো ততবেশী লেলিহান হবে । প্রকৃতপক্ষে মানুষকে যদি মুক্তভাবে ছেড়ে দেয়া হয় এবং তার অন্তরে আল্লাহর ভালবাসা ও ভয় না থাকে তবে দুনিয়ার বিষয়াদি যেমন : অর্থ , মর্যাদা , যৌনতা ইত্যাদির ক্ষেত্রে কখনোই পরিতৃপ্ত হবে না । আর এর ফলে সে দুনিয়াবী চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে এতটা নিমজ্জিত হয়ে যাবে যে নিজেকে ও অন্যদেরকেও ধ্বংস করবে । হিজাব হচ্ছে এমনই একটি বিষয় যা নারী ও পুরুষের মধ্যে বিশেষ সীমা টেনে দিয়েছে যা যৌন প্রবণতাকে নিয়ন্ত্রণ করে সীমালংঘন থেকে উভয়কে রক্ষা করে থাকে ।

নারীদের বেহায়াপনা যা তাদের সাজ-সজ্জা , পোশাক- আষাক , গোপন অভিসার প্রভৃতির মাধ্যমে প্রকাশিত হয় তা পুরুষদেরকে বিশেষ করে যুবকদেরকে সবসময়ের জন্য দৈহিকভাবে উত্তেজিত করে রাখে । আর তা এমনই এক উত্তেজনা যা তাদের মধ্যে বিষন্নতা ও অবসাদের সৃষ্টি করে এবং তাদের স্নায়ুবিকভাবে দুর্বল করে । যার পরিণতিতে বিভিন্ন মানসিক রোগের সৃষ্টি হয়ে থাকে । কেননা মানুষের স্নায়ুর ক্ষমতা কতই যে , সে এত পরিমান চাপ ও উত্তেজনা সহ্য করতে পারবে ? মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা কি এটা বলেন না যে , অবিরাম উত্তেজনা ও চাপ মানুষকে মানসিক রোগে আক্রান্ত করে ফেলে ? আর যদি তা যৌনতার মত একটি বিষয় হয়ে থাকে তবে তো কথাই নেই । কেননা ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে , মানুষের যৌন প্রবণতার কারণে কত বড় বড় অঘটন ঘটেছে যার পরিণতি ছিল খুবই ভয়ঙ্কর । কেউ কেউ বলেছেন , ইতিহাসে এমন কোন ঘটনাই খুঁজে পাওয়া যাবে না যে , যার পেছনে কোন এক নারী ছিল না । ”

অনবরত যৌন প্রবণতাকে উস্কে দেয়া , উলঙ্গপনা এবং বেহায়াপনার মাধ্যমে তাকে আরো প্রজ্জলিত করা কি আগুনের সাথে খেলা করা নয় ? এ কাজ কি বুদ্ধিবৃত্তি ও বিবেক সম্মত ? ইসলাম চায় যে , মুসলমান নারী-পুরুষ সুস্থ মানসিকতা ও মস্তিস্ক নিয়ে পবিত্র চক্ষু-কর্ণের অধিকারী হোক । আর এটা হচ্ছে হিজাবের একটি দর্শন ।

ইসলাম পূর্ব নারীগণ

ইসলামের ইতিহাসে ঈমানদার , সাহসী , জুলুম বিরোধী অনেক নারী ছিলেন , যাদের সম্পূর্ণ জীবনটাই ছিল আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গকৃত এবং আত্মত্যাগ ও শাহাদাতের চেতনাপূর্ণ তাদের সংখ্যা অনেক কিন্তু আমরা এখানে এরূপ কয়েকজনের কথা উল্লেখ করব :

1- হাযবিল নাজ্জারের (কাঠ মিস্ত্রি) স্ত্রী : এই মহিলার ঘটনাটি হচ্ছে হযরত মুসা (আ.) এর সময়কার । সে হযরত মুসা (আ.)-এর উপর ঈমান আনয়ন করে । ঘটনা বশত: সে ফেরাউনের প্রাসাদে তার কন্যার পরিচর্যার কাজে নিয়োগ প্রাপ্ত হয় । একদিন ফিরআউনের কন্যার চুল চিরুণী দিয়ে আচড়ে দেয়ার সময় তার হাত থেকে চিরুনিটি পড়ে যায় , যেহেতু সে সব সময় আল্লাহর যিকির করতো তাই চিরুনিটি পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে সে বলে উঠল : ইয়া আল্লাহ্! ফেরাউনের কন্যা তাকে জিজ্ঞাসা করলো যে , তোমার ইয়া আল্লাহ বলার উদ্দেশ্য কি আমার বাবা ?

সে বলল : না , বরং আমি এমন কাউকে উপাসনা করি যিনি তোমার বাবাকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে আবার ধ্বংসও করবেন ।

মেয়ে তার বাবাকে উক্ত ঘটনাটি বর্ণনা করলে ফেরাউন তাকে ডেকে পাঠালো । সে উপস্থিত হলে তাকে বলল : আমি যে খোদা এটা তুমি বিশ্বাস কর না ?

সে বলল : না , কখনই নয়! আমি প্রকৃত আল্লাহকে ছেড়ে তোমার উপাসনা করবো না ।

ফেরাউন এই কথায় অত্যন্ত রাগান্বিত হলো এবং সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ দিল আগুনের চুল্লী তৈরী করার এবং তা লাল রং ধারণ করলে ঐ মহিলার সব সন্তানকে আগুনের লেলিহান শিখায় ফেলে দিতে । মহিলার সব সন্তানকে তার চোখের সামনে আগুনে পুড়িয়ে মারা হল । শুধুমাত্র একটি দুধের শিশু তার কোলে অবশিষ্ট ছিল । জল্লাদ তার কোল থেকে ঐ দুধের শিশুটিকেও ছিনিয়ে নিয়ে বলল : তুই যদি মুসার দ্বীনকে অনুসরণ না করিস তাহলে তোর বাচ্চাকে বাচিয়ে রাখবো । দুধের শিশুটির অন্তর ধক-ধক করতে শুরু করলো । মহিলাটি বাহ্যিকভাবে এ কথা স্বীকার করে বলতে চাইল যে , ঠিক আছে কিন্তু হঠাৎ দুধের শিশুটি কথা বলে উঠলো । সে তার মাকে বলল : ধৈর্য ধারণ কর , তুমি সত্যের পথে আছো ।

মহিলাটি তাই করল । অবশেষে ঐ দুধের বাচ্চাটিকেও পুড়িয়ে মারা হল । তারপর তাকেও তারা পুড়িয়ে মারলো । এভাবেই এক সাহসী ও মু মিন মহিলা যতক্ষণ পর্যন্ত জীবিত ছিল বাতিলের কাছে মাথা নত করেনি , বরং বাতিলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে ।

নবী (সা.) বলেন : মি ’ রাজের রাতে একটি স্থান থেকে আকর্ষণীয় এক সুগন্ধ আমার নাকে আসছিল , আমি জিব্রাঈলকে (আ.) জিজ্ঞাসা করলাম যে , এই সুবাস কোথা থেকে আসছে ? জিব্রাঈল আমাকে উত্তরে বলল : এই গন্ধ হাযবিলের স্ত্রী ও তার সন্তানদের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া দেহের থেকে আসছে , যা এই পৃথিবীর সমান্তরাল মহাশূন্যে ছিটিয়ে দেয়া হয়েছে । আর ঐ স্থান থেকে এই সুগন্ধ কিয়ামতের দিন পর্যন্ত আসতে থাকবে ।34

2- হযরত ইব্রাহীম খালিলুল্লাহ্ (আ.)-এর মা :

এই ঘটনাটি অনেকটা উপরোল্লিখিত ঘটনার মতই । নমরুদ তার অধীনস্থ জ্যোতিষীদের মাধ্যমে জানতে পেরেছিল যে , একটি শিশু জন্মলাভ করে তাকে ধ্বংস করবে । এ কারণে সে (বর্ণনামতে) 77 হাজার থেকে এক লক্ষ শিশুকে হত্যা করে । এমন এক কঠিন পরিস্থিতিতে ইব্রাহীমের (আ.) আত্মত্যাগী মা বিরলভাবে নিজেকে নমরুদের লোক-লস্কর থেকে দূরে রাখতে সক্ষম হন । তিনি প্রসব বেদনা শুরু হলে ঋতুস্রাবের বাহানায় (কারণ তখন নিয়ম ছিল যে , কোন মহিলার ঋতুস্রাব হলে তাকে শহরের বাইরে চলে যেতে হত) শহর থেকে বেরিয়ে গেলেন এবং শহর থেকে অনেক দুরে একটি পাহাড়ের গুহা খুঁজে পেলেন । সেখানেই ইব্রাহীম (আ.) ভুমিষ্ট হন । ক্লান্তিহীন পরিশ্রমী এই মা 13 বছর ধরে নমরুদের লোকজনের চোখ ফাঁকি দিয়ে , কখনো রাতে আবার কখনো প্রত্যুষে সকালে পাহাড়ের ঐ গুহার মধ্যে যেতেন তার সন্তানের সাথে দেখা করতে । এ সময় তিনি গায়েবীভাবেও সাহায্যপ্রাপ্ত হতেন । যেহেতু তিনি আল্লাহর উপর নির্ভর করেছিলেন সেহেতু আল্লাহও তাকে সাহায্য করেছেন । অবশেষে 13 বছর পরে ইব্রাহীম (আ.) খোদায়ী বিশেষ প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত হয়ে সমাজে ফিরে এলেন এবং আস্তে আস্তে মূর্তিপুজকদের সাথে মুকাবিলা করতে শুরু করলেন । আর দিনের পর দিন তিনি সফলকাম হতে থাকলেন ।35

3- হযরত আইয়্যুবের স্ত্রী :

রুহামাহ (রাহিমাহ্) ছিলেন হযরত আইয়্যূবের স্ত্রী এবং হযরত শোয়াইবের কন্যা । তিনি এক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হন । তার সকল সন্তান বাড়ীর ছাদের নিচে চাপা পড়ে মারা যায় , বাগ-বাগিচা আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে যায় , সমস্ত সম্পত্তি এবং গৃহপালিত প্রাণী ধ্বংস হয়ে যায় । এত কিছুর পরে হযরত আইয়্যূব এক কঠিন রোগে আক্রান্ত হন । এমন পরিস্থিতিতে সবাই তাকে সান্তনা দেয়ার বদলে অপমান করলো এই বলে যে , নিঃশ্চয়ই তোমরা গোনাহ্গার ছিলে তাই আল্লাহ তোমাদেরকে এরূপ সাজা দিয়েছেন । সকলেই হযরত আইয়্যূবের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিল । আর সে কারণেই তিনি শহর ছেড়ে জঙ্গলে চলে গিয়েছিলেন । অতপর আল্লাহ্ তাদেরকে উত্তম সন্তান দান করেন এবং অবস্থা পুর্বের পর্যায়ে ফিরে যায় ।36

হযরত আইয়্যূবের স্ত্রী আমাদেরকে যে শিক্ষা দেন তা হচ্ছে নিম্নরূপ :

প্রথমত : আল্লাহর নবিগণও বিভিন্ন অবস্থার মাধ্যমে পরীক্ষিত হতে পারেন ।

দ্বিতীয়ত : মু ’ মিনদের চেষ্টা করা উচিৎ এরূপ পরিস্থিতিতে ধৈয ধরে সফলতার সাথে তা থেকে বেরিয়ে আসার ।

তৃতীয়ত : উত্তম স্ত্রী সেই যে , কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও তার স্বামীকে একা ত্যাগ করে না । আর হযরত আইয়্যূবের স্ত্রী ছিলেন তেমনই এক নারী । কারণ তিনি এই কঠিন পরিস্থিতিতেও তার স্বামীকে কোন প্রকার দোষারোপ করেন নি বরং সকল সময় তার পাশে পাশে থেকেছেন এবং এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে মুক্তি লাভের চেষ্টা করেছেন । যদিও পুরুষের দায়িত্ব হচ্ছে হালাল রুটি- রুজীর জন্য কষ্ট করা এবং পরিবারে স্বাচ্ছন্দ আনয়ন করা ।

ইসলাম পূর্ব ইতিহাসে আরো অনেক নারীই ছিলেন যেমন : হযরত শোয়াইবের কন্যাগণ , হযরত মুসা (আ.)-এর মা ও বোন , হযরত মারিয়াম (আ.) , আসিয়া , হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর মা হাজার , নবী (সা.) -এর মা আমেনা , নবী (সা.) -এর দুধ মাতা হালিমা ও আরো অনেকে যাদের নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি ।

ইসলামের প্রাথমিক পর্যায়ের নারীগণ

1- হযরত খাদিজা (আ.) : হযরত খাদিজাহ্ (আ.) প্রথম পর্যায়ে খৃষ্টান ছিলেন । যেহেতু তিনি খৃষ্টানদের বিভিন্ন গ্রন্থে নবী পাক (সা.) সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন এবং অতি নিকট থেকে ঐ মহামানবকে দেখেছিলেন । তাঁর প্রতি ঈমান আনেন এবং তাঁর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন । এই মহান নারী আল্লাহ তা ’ য়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে সমস্ত সম্পত্তি নবীর (সা.) হাতে সমর্পন করেছিলেন । নবী (সা.) ঐ বিশাল সম্পদকে দ্বীনের প্রচার-প্রসারের কাজে খরচ করেন । হযরত খাদিজাহ্ এ সম্পর্কে বলেন : আমার সম্পত্তি থেকে শুধূমাত্র দু ’ টি ভেড়ার চামড়া অবশিষ্ট ছিল , দিনের বেলা তার উপর ভেড়ার খাবার দিতাম এবং রাতে তা বিছিয়ে শুতাম ।

তিনি শুধুমাত্র তার সম্পদকেই দ্বীনের রাস্তায় দান করেননি বরং নবীকে (সা.) জীবন দিয়েও সাহায্য করেছিলেন । তিনি রাসূলের (সা.) শত দুঃখের সাথি ও সান্ত্বনাদানকারী ছিলেন । তিনি হচ্ছেন ইতিহাসের চারজন শ্রেষ্ঠ রমনীর একজন (যারা বেহেশ্তী নারী হিসেবে পরিচিত) । রাসূলে খোদা (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় কখনই হযরত খাদিজার ভালবাসা ও ত্যাগের কথা ভুলেন নি । আর যখনই তার কথা স্মরণ করতেন তখনই তার উপর দুরুদ পড়তেন ।

2 - প্রথম শহীদ নারী সুমাইয়্যা : সুমাইয়্যা , ইয়াসিরের স্ত্রী ছিলেন । তিনি এবং তার স্বামী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল বলে তাদেরকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল এবং শত্রুপক্ষ তাদেরকে শহীদ করেছিল । তারা সুমাইয়্যাকে বলেছিল : যদি তুমি নবীর (সা.) উপর ঈমান আনা থেকে বিরত না হও তবে তোমার দুই পায়ে দড়ি বেঁধে দুই উটের সাথে বেধে দিব এবং উট দু ’ টিকে দুই দিকে তাড়িয়ে দিব , ফলে তোমার শরীর দু ’ ভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে ।

সুমাইয়্যা তাদের কথায় ভয় না পাওয়ায় তারা তাদের উক্ত পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত করলো । তারা শুধু তাকেই নয় বরং তার স্বামীকেও হত্যা করলো । আম্মার ইয়াসির এই দুই মহান ব্যক্তির সন্তান জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত ইসলামের স্বার্থে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন । অবশেষে তিনিও সিফ্ফিনের যুদ্ধে ইমাম আলী (আ.)-এর সৈন্য দলের পক্ষ হয়ে মুয়া ’ বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হন ।37

3 - অন্যান্য নারীগণ : অন্যান্য মহিলাগণ যেমন , লুবাইনিহ্ , যিন্নিরিহ্ , নাহদিয়াহ্ , গাযযিয়াহ্ ও এরূপ আরো অনেকে যাদের নাম ইতিহাসে উল্লেখও হয় নি , ইসলামের প্রাথমিক যুগে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর প্রতি ঈমান আনার ফলে শত্রুর অত্যাচারে শহীদ হন ।38

4- ফাতিমা বিনতে আসাদ (হযরত আলী (আ.)-এর মা) : ফাতিমা বিনতে আসাদের জন্য এই মর্যাদাই যথেষ্ট যে , তিনি পবিত্র কা ’ বা গৃহের মধ্যে আমিরুল মু ’ মিনিন আলী (আ.) -এর মত সন্তানকে জন্মদান করেছেন । কোন মহিলাই এ মর্যাদা পায় নি এবং পাবেও না ।

যখনই নবী (সা.) ক্লান্ত থাকতেন ফাতিমা বিনতে আসাদের বাড়ীতে আসতেন বিশ্রাম নেয়ার জন্য।

যখন তিনি এ দুনিয়া থেকে চির বিদায় নিয়েছিলেন তখন নবী (সা.) কাঁদতে কাঁদতে মৃত দেহের পাশে উপস্থিত হয়ে বলেছিলেন : আল্লাহ্ তাঁকে বেহেশ্তবাসী করুন , তিনি শুধু আলীর মাতাই ছিলেন না বরং আমারও মা (সা.) ছিলেন । রাসূলে খোদা নিজের মাথার পাগড়ি ও আলখেল্লা খুলে দিয়েছিলেন তার কাফন করার জন্য । তার জানাজার নামাযে চল্লিশটি তাকবির বলেছিলেন । তারপর তিনি তার কবরে নেমে কিছু সময় সেখানে অবস্থান করেন এবং ইমাম আলী (আ.) ও ইমাম হাসানকে (আ.) অনুরূপ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন ।

আম্মার নবীকে (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন : কারো জন্যেই তো আপনি এরূপ করেন নি , ফাতিমা বিনতে আসাদের জন্য কেন এরূপ করলেন ?!

রাসূল (সা.) বললেন : তার জন্য এমনটা করাই উত্তম ছিল । কেননা তিনি নিজের সন্তানকে পেট ভরে খেতে না দিয়ে আমার পেট ভরাতেন । তার সন্তানদেরকে খালি পায়ে রাখতেন কিন্তু আমার পায়ে জুতা পরিয়ে দিতেন ।

আম্মার পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন : কেন তার নামাযে চল্লিশবার তাকবির দিলেন ?

তিনি বললেন : তার জানাজার নামাযে ফেরেশতাগণ চল্লিশ কাতারে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে নামায পড়ছিল তাই তাদের প্রত্যেকটি সারির জন্য একটি করে তাকবির বলেছি ।

আর এই যে , আমার মাথার পাগড়ি ও গায়ের আলখেল্লা দিয়েছি তাঁকে কাফন করার জন্য এটার কারণ এই যে , একদিন তাঁর সাথে আমি কিয়ামতের দিনে মানুষের বস্ত্রহীন থাকার ব্যাপারে কথা বলছিলাম , তিনি এ কথা শুনে চিৎকার করে উঠেছিলেন এবং কিয়ামাতের দিনে বস্ত্রহীন থাকার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন । তাই আমার মাথার পাগড়ি ও গায়ের আলখেল্লা দিয়ে তাকে কাফন করিয়েছি , যাতে করে কিয়ামতের দিনে তিনি বস্ত্রহীন না থাকেন আর তা যেন পচে না যায় । যেহেতু তিনি কবরের প্রশ্নের ব্যাপারে অনেক ভয় পেতেন তাই আমি তাকে কবর দেয়ার আগে কিছুক্ষণ তার মধ্যে অবস্থান করেছি । আর এই অবস্থানের ফলে আল্লাহ তার কবরকে বেহেশ্তের একটি অংশে পরিণত করছেন এবং তার কবর এখন বেহেশতের বাগানে পরিণত হয়েছে ।39

5 - চার শহীদের জননী , খানিসা : তিনি একজন অভিজ্ঞ ইসলাম প্রচারক ছিলেন । তিনি তার গোত্রের সকলকে ইসলামের পথে আনতে সমর্থ হয়েছিলেন এবং অন্যদেরকেও ইসলামের প্রতি দাওয়াত দিতেন । 14 হিজরীতে সংঘটিত কাদিসিয়া যুদ্ধে তিনি তার সন্তানদেরকে ঐ যুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন । তার সন্তানদের মধ্যে চারজন শহীদ হয় । তিনি তার সন্তানদের শহীদ হওয়াতে বলেন : আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া , কেননা তিনি তাদের শহীদ হওয়ার মাধ্যমে আমাকে সম্মানিত করেছেন । আরো বলেন : আমার আশা এটাই যে , আল্লাহ্ তা ’ য়ালা আমাকেও তাঁর রহমত ও কৃপা দান করে ধন্য করবেন (অর্থাৎ তাকে শহীদ হওয়ার তৌফিক দান করবেন) ।40

6 - চার শহীদের জননী , উম্মুল বানিন : উম্মুল বানিন ছিলেন ইমাম আলী (আ.)-এর একজন আল্লাহ্ প্রেমিক স্ত্রী । তিনি তার চারজন সন্তান যথাক্রমে : হযরত আব্বাস , আব্দুল্লাহ্ , জা ’ ফার ও উসমান , কারবালায় তাদের ভাই ও নেতা ইমাম হুসাইনের সাথে শাহাদাত বরণ করেন ।

যখন বাশির মদীনায় ফিরে এসে কারবালার ঘটনাকে মসজিদে নববীতে বর্ণনা করছিল তখন উম্মুল বানিন উপস্থিতদের মধ্যে থেকে সামনে (আ.) এসে বললেন : হে বাশির! আমাকে শুধু ইমাম হুসাইন সম্পর্কে বল । আর আমার চার সন্তান খোলা আকাশের নিচে ঘোড়ার পায়ের তলে পিষ্ট হয়েছে তাতে কিছু যায় আসে না , কেননা আমি তাদেরকে ইমাম হুসাইনের জন্য উৎসর্গ করেছি । যখন তিনি বাশিরের মুখে ইমাম হুসাইনের উদ্দেশ্যে শহীদ হয়ে যাওয়ার কথা শুনলেন তখন চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন : আমার অন্তরকে ক্ষত বিক্ষত করে দিয়েছে ।

ইমাম হুসাইনের প্রতি তাঁর এই ভালবাসাই তাঁকে পরিপূর্ণতায় পৌঁছিয়েছে , কেননা তিনি সন্তানদেরকে তাঁর নেতা ও দ্বীনের ইমামকে রক্ষার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন ।41

7- হযরত যয়নাব (আ.) আত্মত্যাগ,ধৈর্য ও দৃঢ়তার প্রতিচ্ছবি :

হযরত যয়নাবের মত এক মহিয়সী নারীর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আমরা কথা বলতে অক্ষম । কেননা তিনি হযরত ফাতিমার (আ.) গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং তাঁর হাতে প্রশিক্ষিত হয়েছেন , আর আলী (আ.)-এর মত পিতা ও ইমাম হাসান এবং ইমাম হুসাইনের মত ভাই যার ছিল । তবে আমরা এখানে আমাদের এই ক্ষুদ্র জ্ঞানে যতটুকু সম্ভব তাই উল্লেখ করার চেষ্টা করবো ।

যে সমস্যা ও কষ্ট তার উপর এসেছিল তা যদি কোন পাহাড়ের উপর আসতো তবে পাহাড় ঐ সমস্যা ও কষ্টের ভারে ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচুর্ণ হয়ে যেত । এই ধরনের এক মহিয়সী নারীর ব্যক্তিত্বকে কয়েকটি দিক থেকে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন ।

ক)- নিজের ইমাম বা নেতাকে সাহায্য করা :

ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তিনি তাকে প্রাণপণে সাহায্য করেছিলেন । ইমাম হুসাইনকে তিনি এত অধিক ভালবাসতেন যে , যখন তাঁর চাচাত ভাই আবদুল্লাহ ইবনে জা ’ ফর তাইয়ার তার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল তখন তিনি তাকে বলেছিলেন যে , আমি একটি শর্তে এ বিয়েতে রাজী হব তা হচ্ছে আমার ভাই হুসাইন যখনই কোন সফরে যাবে আমাকেও তাঁর সাথে যাওয়ার অনুমতি দিতে হবে । যেহেতু আবদুল্লাহ্ও ইমাম হুসাইন (আ.)-এর একজন ভক্ত ছিল তাই সে এ কথা মেনে নিল । হযরত যয়নাব (আ.) ইমাম হুসাইনের শাহাদাতের পরে , অসুস্থ ইমাম সাজ্জাদের সেবা-শুশ্রুষা করেন । আর যতবারই শত্রুপক্ষ ইমাম সাজ্জাদকে (আ.) হত্যা করতে এসেছিল ততবারই তিনি তাঁকে আগলে রেখেছিলেন এবং শত্রুদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন : যদি তোমরা তাকে হত্যা করতে চাও তবে প্রথমে আমাকে হত্যা কর ।

সাধারণত যে পুরুষ ও নারীই বেলায়াত ও ইমামতের পক্ষে কথা বলেছে তারাই কষ্ট , লাঞ্ছনা ও অপবাদের শিকার হয়েছে । যেমন : হযরত মারিয়ামকে ঈসা (আ.)-এর জন্য ব্যভিচারের অপবাদ দেয়া হয় , হযরত আসিয়া হযরত মূসা (আ.)-কে সাহায্য করতে গিয়ে এবং তাঁর উপর ঈমান আনাতে ফিরাউনের অত্যাচারের শিকার হয়ে শহীদ হন ।

হযরত ইব্রাহীম ও হযরত মূসা (আ.)-কে শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য তাদের মাতাদের কত কষ্টই না পোহাতে হয়েছিল । রাসূল (সা.) কে সাহায্য করতে গিয়ে হযরত খাদিজাহ (আ.)কতই না কষ্ট পেয়েছিলেন । ইমাম আলী (আ.)-এর ইমামতের পক্ষে কথা বলার কারণে হযরত ফাতিমাকে (আ.) দরজা ও দেয়ালের মধ্যে পিষ্ট হয়ে গুরুতর আহত হয়ে জীবন দিতে হয়েছে । তদ্রূপ ইমাম হুসাইন -কে সাহায্য করতে গিয়ে 55 বছর বয়সে হযরত যয়নাবকেও নিদারুণ কষ্টের শিকার হতে হয়েছে ।

খ)- শহীদদের সন্তানদেরকে দেখা-শুনা করা :

হযরত যয়নাব (আ.) কারবালার হৃদয় বিদারক ঘটনার পরে , অভিভাবকহীন ছোট ছোট বাচ্চাদেরকে দেখা-শুনা করতেন । তিনি নিজে না খেয়ে তাদেরকে খাওয়াতেন । যেহেতু বাচ্চারা তাদের পিতার জন্য কান্নাকাটি করতো , তাই তিনি তাদেরকে খুব বেশী মাত্রায় আদর করতেন এবং সান্ত্বনা দিতেন । আর এ দায়িত্বটি তিনি জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত সুন্দরভাবে পালন করেছিলেন ।

গ)- ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের পর :

ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের পরে , তিনি যেখানেই যেতেন এবং যখনই সুযোগ পেতেন তখনই কারবালার শহীদদের বার্তা পৌঁছে দিতেন এবং জালিম ও অত্যাচারীর বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ করতেন । যদি হযরত যয়নাব না থাকতেন তবে ইসলামের শত্রুরা কারবালার ঘটনাকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতো । তিনি নিজের চেষ্টায় কারবালার জালিম ও অত্যাচারীদের মুখোষ উম্মোচন করেন । আর এই পরিশ্রমের ফলশ্রুতিতে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর আত্মত্যাগ চূড়ান্তে পৌঁছায় । যদি তাঁর উৎসর্গতা ও সাহসিকতা না থাকতো তাহলে শত্রুরা ইমাম সাজ্জাদ (আ.) -কে হত্যা করতো এবং ইসলামের অস্তিত্বকে বিলীন করে দিত । প্রকৃতপক্ষে ইমাম হুসাইন (আ.) শত্রুর বিরুদ্ধে কিয়াম করেছিলেন আর হযরত যয়নাব (আ.) ঐ কিয়ামের ধারাকে টিকিয়ে রেখেছিলেন ।

ঘ)- হযরত যয়নাবের সাহসিকতা :

ফাসেক , অভিশপ্ত , মদখোর ও লম্পট ইবনে যিয়াদ তার প্রাসাদে বসে ছিল এবং ইমাম হুসাইন (আ.) -এর কাটা মাথাটি তার সামনে রাখা ছিল । সে হযরত যয়নাবকে (আ.) বলল : তোমার ভাইয়ের সাথে আল্লাহ্ যা করলেন তা কেমন দেখলে ? তিনি জবাবে বললেন

ﻣﺎﺭﺍﻳﺖ ﺍﻻ جمیلا আমি সুন্দর ছাড়া অন্য কিছু দেখি নি ।42 কেননা নবীর বংশধর এমন এক পরিবার যাদের জন্য আল্লাহ শাহাদাতকে মর্যাদা স্বরূপ করেছেন । আর তাঁরা স্বেচ্ছায়ই এ পথকে বেছে নিয়েছেন ।

হযরত যয়নাব এই কথার মাধ্যমে ইবনে যিয়াদকে এমনভাবে অপমান করলেন যে , যাতে করে সে তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা নেয় ।

হযরত যয়নাব (আ.) শামে (সিরিযায়) ইয়াযিদের প্রাসাদে তাকে দারুণভাবে অপমান করলেন । তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন : তুমি মনে করছো যে , আমাদেরকে বন্দী করে তোমার সম্মান বেড়েছে , তা নয় তারপর বললেন : আমি তোমাকে অনেক নীচ ও হীন মনে করি ।43

তিনি এই কথাটি ইয়াযিদকে এমন এক সময় বললেন যখন তাঁর এবং অন্যান্য বন্দীদের নিহত হওয়ার আশংকা ছিল । এমন কথা একজন নারীর পক্ষে ইয়াযিদের মত জালিম , অত্যাচারী , মদখোর , লম্পট লোকের সামনে কথা বলা কোন সহজ ব্যাপার নয় । হযরত যায়নাব তাকে এত বড় কথা বলার অর্থ এই যে , তিনি এমন এক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিলেন যা বুঝার ক্ষমতা আমাদের নেই ।

ঙ)- হযরত যয়নাবের ইবাদত :

কারবালার হৃদয় বিদারক ঘটনায় তার 6 জন ভাই যথা : ইমাম হুসাইন (আ.) , আব্বাস , জা ’ ফার , উসমান , আবদুল্লাহ্ ও মুহাম্মদ শহীদ হয়ে যাওয়া ছাড়াও তার দুই সন্তন আউন ও মুহাম্মদ এবং তার ভাইয়ের সন্তানগণ যথা : আলী আকবার , কাসিম , আবদুল্লাহ সহ চাচাত ভাইদের শহীদ হওয়ার ঘটনাকে স্বচক্ষে দেখেছিলেন । আর এদিকে ছোট ছোট শিশুরা উমর ইবনে সা ’ দ ও তার মত অপবিত্র লোকদের হাতে অত্যাচারিত হচ্ছিল এবং যে কোন সময় ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর শহীদ হওয়ার আশংকা ছিল এরূপ কঠিন মুসিবতের সময়ও অর্থাৎ মুহররমের 10 তারিখের দিবাগত রাতেও তিনি তাহাজ্জুতের নামায আদায় করেন ।


4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18