জীবন জিজ্ঞাসা

জীবন জিজ্ঞাসা0%

জীবন জিজ্ঞাসা লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

জীবন জিজ্ঞাসা

লেখক: নূর হোসেন মজিদী
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 37319
ডাউনলোড: 3173

পাঠকের মতামত:

জীবন জিজ্ঞাসা
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 58 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 37319 / ডাউনলোড: 3173
সাইজ সাইজ সাইজ
জীবন জিজ্ঞাসা

জীবন জিজ্ঞাসা

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

খাতমে নবুওয়াত্ঃ ইসলাম-গৃহের ভিত্তি

ইসলামের তাত্ত্বিক মৌলিক ভিত্তি তিনটি: তাওহীদ , আখেরাত ও নবুওয়াত। এ তিনটির কোনো একটিকে প্রত্যাখ্যান মানে গোটা দ্বীন ইসলামকেই প্রত্যাখ্যান। কারণ , আল্লাহর অস্তিত্ব ও একত্বের অনুভূতি থেকেই তাঁর সাথে মানুষের সম্পর্ক এবং তাঁর প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্যের অনুভূতি সৃষ্টি হয়। এ অনুভূতিরই জবাব হচ্ছে খোদায়ী দ্বীন বা ইসলামী জীবনবিধান যা কেবল নবী-রাসূলগণের (আঃ) মাধ্যমেই মানুষের নিকট আসা সম্ভব। অন্যদিকে মৃত্যুর পরে শাস্তি ও পুরষ্কারের কোনো জগৎ না থাকলে দ্বীন পালনের কোনো অপরিহার্যতাই থাকে না। তাই এ তিনটি মৌলিক ভিত্তির কোনো একটির প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করা হলে বাকী দু টিকে গ্রহণ ও বর্জন সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়।

ইসলামের এ তিনটি মৌলিক ভিত্তিকে আরো কিছুটা বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করলে এ সংখ্যা দাঁড়ায় সাতটিতে। তা হচ্ছে: তাওহীদ , আখেরাত , নবুওয়াত , নবুওয়াতে মুহাম্মাদী (ছ্বাঃ) , কোরআন মজীদের ঐশিতা , খাতমে নবুওয়াত ও অভিন্ন ক্বিবলাহ্। অবশ্য এ সব ভিত্তির মধ্যকার এক বা একাধিক ভিত্তি অন্য অনেক ধর্মেই পাওয়া যায়। বিশেষ করে অতীতের নবী-রাসূলগণের (আঃ) অনুসারী হবার দাবীদারদের দ্বারা তাঁদের নামে তৈরী কতক ধর্মে তাওহীদ , আখেরাত ও নবুওয়াতের মূলনীতি রয়েছে। এ ক্ষেত্রে যে ভিত্তিটি অন্য সমস্ত ধর্ম থেকে ইসলামকে স্বতন্ত্র করেছে তা হচ্ছে রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর শেষ নবী হওয়া বা খাতমে নবুওয়াত। এক হিসেবে যদি বলা হয় যে , খাতমে নবুওয়াতই হচ্ছে ইসলাম তাহলে ভুল বলা হবে না। কারণ , কেউ এই একটি বিষয়কে গ্রহণ করলে তার কাছে ইসলামের বাকী সবগুলো মূলনীতিই গ্রহণযোগ্য হতে বাধ্য।

বস্তুতঃ রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর শেষ নবী হওয়ার মানেই হচ্ছে তিনি আল্লাহর নবী , আর যেহেতু তিনি এ গ্রন্থটিকে আল্লাহর কিতাব হিসেবেই পেশ করেছেন সেহেতু তাঁর উপস্থাপিত গ্রন্থ কোরআন মজীদ আল্লাহর কিতাব। আর যেহেতু এ গ্রন্থ নিজেকে সকল প্রকার বিকৃতি থেকে সংরক্ষিত বলে দাবী করেছে এবং রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-কে সকল মানুষের জন্য আল্লাহর রাসূল বলে ঘোষণা করেছে , সেহেতু তাঁর পরে আর কোনো নবী আসার কোনো উপযোগিতাই থাকে না। তাই বিচারবুদ্ধির দাবী অনুযায়ী তাঁর জন্য শেষ নবী হওয়া অপরিহার্য। অতএব , তাঁর পরে কেউ যদি নিজেকে নবী বলে দাবী করে তো সে ব্যক্তি ও তার অনুসারীরা অনিবার্যভাবেই ইসলাম-গৃহের বাইরে চলে গেছে।

অনেকে মনে করে যে , নতুন নবীর আগমনে বিশ্বাসী লোকেরা যদি রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-কে সর্বশ্রেষ্ঠ নবী বলে স্বীকার করে এবং নিজেদেরকে মুসলমান বলে পরিচয় দেয় তাহলে তাদেরকে জোর করে অমুসলিম বলা উচিত নয়। তারা আরো মনে করে যে , ইসলামের অন্য সকল ব্যাপারেই যখন তারা একমত , এমতাবস্থায় একটি বিষয়ে মতপার্থক্যের কারণে নতুন নবীর আগমনে বিশ্বাসী লোকদেরকে অমুসলিম গণ্য করা ঠিক হবে না।

কাউকে নবী মানা-নামানা ধর্ম পৃথক হওয়ার কারণ

উপরোক্ত ধারণাটি যারা পোষণ করে করে তারা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাস্তব সমস্যার প্রতি দৃষ্টি না দেয়ার কারণে এরূপ ধারণা পোষণ করে থাকে। তা হচ্ছে , দু টি জনগোষ্ঠী দু টি স্বতন্ত্র ধর্মের অনুসারী হিসেবে পরিগণিত হয় নবুওয়াতের দাবীদার কোনো ব্যক্তিকে নবী হিসেবে মানা ও না-মানার ভিত্তিতে। এ কারণেই খৃস্টানরা ইয়াহূদীদের মতোই হযরত ঈসা (আঃ)-এর পূর্ববর্তী সকল নবীর [হযরত মূসা (আঃ) সহ] নবুওয়াত স্বীকার করা সত্ত্বেও হযরত ঈসা (আঃ)-কে নবী হিসেবে মানা-নামানার ভিত্তিতে তারা ও ইয়াহূদীরা দু টি স্বতন্ত্র ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। অনুরূপভাবে মুসলমানরা রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর পূর্ববর্তী সকল নবী-রাসূল (আঃ)-এর [হযরত মূসা ও হযরত ঈসা (আঃ) সহ] নবুওয়াত স্বীকার করা সত্ত্বেও হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর নবুওয়াত স্বীকার করা-নাকরার ভিত্তিতে তারা ইয়াহূদী ও খৃস্টানদের থেকে স্বতন্ত্র ধর্মাবলম্বীতে পরিণত হয়েছে। অতএব , রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর পরে নবুওয়াত দাবীকারী কোনো ব্যক্তিকে যারা নবী বলে স্বীকার করে তারা হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-কে শ্রেষ্ঠতম নবী বলে স্বীকার করলেও যেহেতু মুসলমানরা নবুওয়াতের দাবীদার নতুন ব্যক্তিকে নবী বলে স্বীকার করে না সেহেতু তারা ও মুসলমানরা স্বতন্ত্র ধর্মাবলম্বী। এমতাবস্থায় নতুন নবুওয়াত দাবীকারীকে নবী বলে গ্রহণকারীদেরকে মুসলমান বলে স্বীকার করতে হলে অনিবার্যভাবেই মুসলমানদের জন্য অন্য কোনো পরিচিতিবাচক নাম খুঁজতে হবে। তবে সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত রীতি হচ্ছে এই যে , নতুন জনগোষ্ঠীই নতুন নাম গ্রহণ করবে ; পুরনো নামটি যারা ধারাবাহিকভাবে ব্যবহার করে আসছে তারাই তা ব্যবহার করতে থাকবে।

যে ব্যক্তি নবুওয়াতের নতুন দাবীদার তার অনুসারীরা ও তাকে প্রত্যাখ্যানকারীরা স্বতন্ত্র ধর্মাবলম্বী - এ অকাট্য সত্যটি যে কোনো সুস্থ বিচারবুদ্ধি গ্রহণ করে নিতে বাধ্য। এটা স্বীকার করে নিয়েও আমরা কেবল যুক্তির খাতিরে বিচার করে দেখতে পারি যে , কোনো কোনো গোষ্ঠী যে রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর পরে নতুন নবুওয়াত দাবীকারীদের নবী বলে স্বীকার করেছে সুস্থ বিচারবুদ্ধির আলোকে এর আদৌ কোনো সুযোগ আছে কিনা।

এ প্রসঙ্গে কয়েকটি বিষয় বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তা হচ্ছে: প্রথমতঃ যে সব কারণে নবী প্রেরণ করা হয় রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর পরে আর সে ধরনের কোনো কারণই বর্তমান নেই। কারণ , তিনি যে দ্বীন নিয়ে এসেছেন , কোরআন মজীদের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা অনুযায়ী , তা পূর্ণাঙ্গ ও সংরক্ষিত। দ্বিতীয়তঃ পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণের (আঃ) ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) ছিলেন প্রতিশ্রুত নবী ও ত্রাণকর্তা তথা শ্রেষ্ঠতম নবী। শ্রেষ্ঠতম নবীর আগমনের পর আর তাঁর চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ কোনো নবীর আগমনের যৌক্তিকতা থাকে না। তৃতীয়তঃ বিচারবুদ্ধির রায় অনুযায়ী নবীর অবর্তমানে পূর্ণাঙ্গ দ্বীন ও অবিকৃত ঐশী কিতাব বিদ্যমান থাকলে তার প্রচার-প্রসার ও প্রতিষ্ঠার জন্য ঐ নবীর কতক সুযোগ্য অনুসারী থাকাই যথেষ্ট , নবীর প্রয়োজন থাকে না। কারণ , যে নবীর কাছে আদৌ কোনো ওয়াহী নাযিল হবে না ও তিনি কোনো ঐশী বিধান আনবেন না (কারণ , আনলে তা বিদ্যমান দ্বীনের পূর্ণতার বরখেলাফ হবে) এমন নবীর ধারণা অভিনব।

এতদসত্ত্বেও যুক্তির খাতিরে যদি এ ধরনের কোনো নবীর আগমনের সম্ভাব্যতা স্বীকার করে নেয়া হয় , সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন জাগে যে , নতুন নবুওয়াত দাবীকারী ব্যক্তি যে ভণ্ড - প্রতারক নয় তার কী নিশ্চয়তা আছে ? এ ক্ষেত্রে একটি অপযুক্তি ( fallacy -مغالطة )উপস্থাপন করা হয় যে , রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ ( ছ্বাঃ )- কে শ্রেষ্ঠতম নবী বলে স্বীকার করে তাঁর চেয়ে কম মর্যাদার অধিকারী যিল্লী নবী ( ছায়া নবী ) র আগমন ঘটতে পারে।

এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন হচ্ছে , যুক্তির খাতিরে যদি কথিত যিল্লী নবী আগমনের সম্ভাব্যতা স্বীকার করে নেয়া হয় তারপর প্রশ্ন আসে যে , নবুওয়াতের দাবীদার ব্যক্তি যে সত্যিই যিল্লী নবী , নবুওয়াতের ভণ্ড দাবীদার নয় , তার প্রমাণ কী ? কারণ , কেবল রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-কে শ্রেষ্ঠতম নবী বলে স্বীকার করাই যদি কারো যিল্লী নবী হওয়ার জন্য যথেষ্ট হয় তাহলে যে কোনো ভণ্ড-প্রতারকই তাঁকে স্বীকার করে নিয়ে নিজের জন্য নবুওয়াতের মর্যাদা দাবী করতে পারে।

এমতাবস্থায় নতুন নবীর আগমনের সম্ভাবনা থাকলে এ জন্য রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) কর্তৃক এরূপ কাউকে পরিচিত করিয়ে যাওয়া বা কোরআন মজীদে এরূপ ব্যক্তির পরিচয় উল্লেখ থাকা অপরিহার্য ছিলো। বলা বাহুল্য যে , না তিনি এরূপ কাউকে পরিচিত করিয়ে দিয়ে গেছেন , না পরে কোনো নবী আসার কথা কোরআন মজীদে উল্লিখিত আছে।

এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ করা প্রয়োজন যে , কোরআন মজীদের সূরা আল্-বাক্বারাহর শুরুর দিকে কোরআন থেকে হেদায়াত লাভকারী মুত্তাকী-পরহেযগার লোকদের যে পরিচয় দেয়া হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) ও তাঁর পূর্ববর্তী নবী-রাসূলদের (আঃ) ওপর যা নাযিল হয়েছে তার সত্যতায় ঈমান পোষণ করা ; তাঁর পরবর্তী কারো নবুওয়াত বা ওয়াহীর ওপরে ঈমান পোষণের কথা বলা হয় নি। অথচ কোরআন মজীদের ঘোষণা অনুযায়ী পূর্ববর্তী নবীগণ (আঃ) তাঁদের অনুসারীদের বলে গেছেন যে , রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর আবির্ভাব ঘটলে তারা যেন তাঁর ওপরে ঈমান আনে ও তাঁর আনুগত্য করে। এমতাবস্থায় তাঁর পরে কোনো নবী আসার সম্ভাবনা থাকলে তার প্রতি ঈমান আনার ব্যাপারে কোরআন মজীদে অবশ্যই অনুরূপ নির্দেশ থাকতো।

মোহর ধারণের অপযুক্তি

এ প্রসঙ্গে নতুন নবুওয়াত দাবীকারীকে নবী বলে স্বীকার-কারীদের উপস্থাপিত একটি কূটযুক্তির বিভ্রান্তি অপনোদন করা প্রয়োজন মনে করি।

যেহেতু কোরআন মজীদে রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-কে খাতামুন্নাবিয়্যীন (নবীদের খাতাম্ বা মোহর) বলা হয়েছে এবং মুসলমানরা এর ভিত্তিতে তাঁকে শেষ নবী বলে দাবী করে , তার বিপরীতে এরা দাবী করে যে , এর মানে হচ্ছে পরবর্তীতে কোনো নবীর আগমন ঘটলে তাকে অবশ্যই হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর মোহর ধারণ করে আসতে হবে। তারা হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর মোহর ধারণ-এর অর্থ করেছে তাঁকে শ্রেষ্ঠতম নবী বলে স্বীকার করা। কিন্তু এটা মেনে নিলে যে কোনো ভণ্ড-প্রতারকের জন্যই নবুওয়াত-দাবীর দরযা উন্মুক্ত হয়ে যায় তা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি।

অধিকন্তু তাদের এ যুক্তি শুধু অপযুক্তিই নয় , বরং উদ্ভটও বটে। কারণ , কোনো নবীর রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর মোহর ধারণ-এর প্রকৃত অর্থ হচ্ছে তিনি যাকে নবী বলে মোহরাঙ্কিত তথা অভিহিত করেছেন তিনিই নবী। অতএব , যাদের নাম কোরআন মজীদে ও অকাট্যভাবে নির্ভরযোগ্য হাদীছে নবী হিসেবে উল্লিখিত হয়েছে তাঁরাই নবী। যে ব্যক্তি রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-কে শ্রেষ্ঠতম নবী বলে স্বীকার করলো কার্যতঃ রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) তাকে নবী বলে মোহরাঙ্কিত করেন নি। ঐ ব্যক্তির এ কাজকে মোহরাঙ্কিতকরণ বলে গণ্য করলে বলতে হবে যে , বরং সে-ই হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-কে শ্রেষ্ঠ নবী হিসেবে মোহরাঙ্কিত করলো , যদিও তিনি যে কোনো ভণ্ড নবী কর্তৃক মোহরাঙ্কিত হওয়া বা তার স্বীকৃতি থেকে বেনিয়ায।

এরপরও যদি কেউ নতুন নবীর আগমনের সম্ভাবনা স্বীকার করে তো বলতে হবে যে , যেহেতু কোরআন মজীদে এরূপ কোনো নবীর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী ও তার আনুগত্যের নির্দেশ নেই , সেহেতু এরূপ ব্যক্তিকে মেনে নেয়ার কোনো দায়িত্ব মুসলমানদের ওপর নেই এবং তাকে প্রত্যাখ্যান করলে আদৌ কোনো অপরাধ হবে না। বরং ভণ্ড নবীর প্রতারণার আশঙ্কা এড়াতে তাকে প্রত্যাখ্যান করাই হবে অপরিহার্য কর্তব্য। তেমনি একজন নবুওয়াত-দাবীকারীকে মানা ও না-মানার ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট দু টি জনগোষ্ঠীকে অবশ্যই দু টি ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় জনগোষ্ঠী বলে গণ্য করতে হবে।

বিচারবুদ্ধির আলোকে হযরত মুহাম্মাদের ( ছ্বাঃ ) উত্তরাধিকারিত্ব

হযরত মুহাম্মাদ ( ছ্বাঃ ) শেষ নবী - এ সত্যটি যেমন বিচারবুদ্ধির (عقل - Reason)দ্বারা উদ্ঘাটিত হয় , তেমনি তা কোরআন মজীদের দলীল দ্বারাও প্রমাণিত। এখন প্রশ্ন হচ্ছে , তাঁর ইন্তেকালের অব্যবহিত পরে ও পরবর্তীকালে মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব , পথনির্দেশ ও শাসনকর্তৃত্বের দায়িত্ব কে বা কা রা পালন করবেন ? অন্য কথায় , হযরত মুহাম্মাদ ( ছ্বাঃ )- এর উত্তরাধিকারী কে বা কা রা হবেন ?

বস্তুতঃ মুসলিম উম্মাহর সামনে বিরাজমান গুরুত্বপূর্ণ দ্বীনী-রাজনৈতিক প্রশ্নগুলোর মধ্যে এটিই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।

কেন এ বিষয়ে আলোচনা

হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর স্থলাভিষিক্ততা নিয়ে যে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয় তার ফলে ইসলামের ইতিহাসে বহু তিক্ত ঘটনার অবতারণা হয় এবং মুসলমানরা প্রথমতঃ দুই ভাগে ও পরে আরো বহু ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে এ বিষয়কে কেন্দ্র করে ইসলামের ইতিহাসের বহু সম্মানিত ব্যক্তির কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে - যা ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য বিব্রতকরও বটে। তাই অনেকে মনে করেন যে , দীর্ঘ চৌদ্দ শতাব্দীর বেশী কাল আগে সংঘটিত এ মতপার্থক্য নিয়ে আজ নতুন করে আলোচনা করা ও ইসলামের ইতিহাসের তিক্ত পাতাগুলো ওল্টানো কিছুতেই উচিত নয়।

কোনো মুসলমানের পক্ষেই এ ব্যাপারে দ্বিমত করা উচিত হতো না যদি না বিষয়টি বর্তমান কালেও মুসলমানদের দ্বীনী ও রাজনৈতিক জীবনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে থাকতো। অতীতের দ্বীনী নেতৃবৃন্দ যদি এতদসংক্রান্ত ভুলত্রুটির প্রভাব কে এড়িয়ে চলতেন তাহলে সংশ্লিষ্ট মতপার্থক্যের বিষয়টি গুরুত্ব হারিয়ে ফেলতো।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে , অতীতে ভুলগুলো শোধরানো হয় নি ; তখন সম্মানিত ব্যক্তিদের সম্মান রক্ষার্থে দ্বীনী মতামতগুলোর ক্ষেত্রে তাঁদের ভুলগুলোকে আঁকড়ে থাকা হয়েছে। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে কোরআন মজীদের সাথে সাংঘর্ষিক মতামতকেও বর্জন করা হয় নি। পরবর্তীকালে এই সাথে আরো অনেক ভুল যোগ করা হয়েছে। এর ফলে উম্মাহর ভিতরে আক্বাএদের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় বহু চরমপন্থী (ইফরাতী) ভ্রান্ত অন্ধ বিশ্বাসের সৃষ্টি হয়েছে যেগুলোর ভিত্তিতে এক মুসলমান অন্য মুসলমানকে বিদ্ আতী , ফাসেক্ব , এমনকি কাফের ও হত্যাযোগ্য মনে করছে এবং বাস্তবেও - আজও - হত্যা করছে। উদাহরণস্বরূপ , অনেকে মনে করছে , নবী-রাসূলগণ (আঃ) নিষ্পাপ ছিলেন না , অথচ বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে , ছ্বাহাবীদেরকে সমালোচনার উর্ধে গণ্য করছে এবং তাঁদের সমালোচনাকারীদেরকে কাফের ও মুরতাদ্ গণ্য করছে। এমনকি কোনো কোনো গোষ্ঠী আল্লাহ্ তা আলার শরীর আছে বলেও বিশ্বাস করছে। কেউ কেউ মাযার যিয়ারতকে শির্ক্ গণ্য করছে। এ ধরনের আরো অনেক অন্ধ বিশ্বাস বিরাজ করছে।

অন্যদিকে আমলের ক্ষেত্রে মতপার্থক্য কেবল মুস্তাহাব ও মাকরূহর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে নি , বরং কতক ফরয ও হারামের বিষয়েও মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে , অথচ আমরা জানি যে , নবী-রাসূলগণের (আঃ) আগমনের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো ফরয ও হারাম সম্পর্কে আল্লাহ্ তা আলার ফয়সালা পৌঁছে দেয়া এবং এ ব্যাপারে মতপার্থক্য সৃষ্টি হবার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। তারপরও এ বিষয়ে মতপার্থক্য হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ , এক বৈঠকে তিন ত্বালাক্ব দেয়া হলে তা কি ফেরৎযোগ্য একবার ত্বালাক্ব হিসেবে পরিগণিত হবে , নাকি ফেরৎ-অযোগ্য চূড়ান্ত ত্বালাক্ব হিসেবে গণ্য হবে ; অস্থায়ী বিবাহ কি হালাল , নাকি ব্যভিচারতুল্য হারাম ; ইফতার কি সূর্যাস্তের সাথে সাথে করতে হবে , নাকি রাত হওয়া পর্যন্ত রোযা পূর্ণ করতে হবে - নইলে রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে ; ওযূতে কি পা ধু তে হবে , নাকি মাসেহ্ করতে হবে ; মাসেহর ক্ষেত্রে মোযার ওপর মাসেহ্ করতে হবে , নাকি মোযা খুলে খালি পায়ের ওপর করতে হবে ; কুকুরের মাংস খাওয়া কি হালাল , নাকি হারাম ; নিখোঁজ স্বামীর স্ত্রী কি অন্যত্র বিবাহ করতে পারবে , নাকি পারবে না এবং পারলে কতোদিন পরে পারবে ; খুমস্ কোন্ কোন্ খাতে প্রযোজ্য হবে ; ওয়াছ্বীয়াত্ করা কি ফরয , নাকি মুস্তাহাব এবং তা উত্তরাধিকারীর জন্য করা যাবে কিনা ; মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া বসতগৃহের মীরাছ কি কেবল তাতে বসবাসকারীদের প্রাপ্য , নাকি অন্য উত্তরাধিকারীদেরও প্রাপ্য এবং এ ধরনের আরো অনেক ফরয ও হারাম সম্পর্কে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে।

যেহেতু এ সব মতপার্থক্য ছ্বাহাবীদের পারস্পরিক মতপার্থক্য এবং তাঁদের অনেকের মতের সাথে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর আহলে বাইতের (আঃ) ইমামগণের মতের পার্থক্য থেকে বা সতর্কভাবে বলতে গেলে , আমাদের কাছে রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর , ছ্বাহাবীদের ও ইমামগণের মত হিসেবে দাবী করে যা পৌঁছানো হয়েছে সে সবের মধ্যকার সাংঘর্ষিকতা থেকে উদ্ভূত।

এমতাবস্থায় পারস্পরিক সাংঘর্ষিক মতামতসমূহের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ছ্বাহাবীর নামে বর্ণিত হাদীছ ও মতামতের মধ্যে এবং তাঁদের ও হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর আহলে বাইতের ইমামগণের (আঃ) নামে বর্ণিত হাদীছ ও মতামতের মধ্যে ( আক্ব্ল্ , কোরআন মজীদ , মুতাওয়াতির্ হাদীছ্ ও ইজমা এ উম্মাহর সাথে সাংঘর্ষিক না হওয়া সাপেক্ষে) অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা অপরিহার্য।10

ফয়সালার মানদণ্ড

এক দৃষ্টিতে বিচারবুদ্ধির দলীল দ্বারা নয় , বরং উদ্ধৃতিযোগ্য দলীল অর্থাৎ কোরআন মজীদ ও অকাট্য প্রত্যয় উৎপাদক হাদীছের সাহায্যে ইসলামের মৌল নীতিমালা নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনার মাধ্যমেই রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর স্থলাভিষিক্ততা সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাব উদ্ঘাটন করা প্রয়োজন - যেখানে অবশ্য বিচারবুদ্ধি সহায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন করবে মাত্র। সে হিসেবে এ বিষয়টি বিচারবুদ্ধির আলোকে জীবনজিজ্ঞাসা সমূহের জবাব উদ্ঘাটনকারী অত্র গ্রন্থের আলোচ্য বিষয়ের আওতাভুক্ত নয় , বরং পরবর্তী পর্যায়ে আলোচ্য বিষয়।

তবে দু টি কারণে আমরা বর্তমান পর্যায়ে অর্থাৎ বিচারবুদ্ধির দলীলের ভিত্তিতে এ ব্যাপারে আলোচনা করছি। প্রথমতঃ কোরআন-হাদীছ বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও এ প্রশ্নের জবাব সন্ধান সংক্রান্ত জ্ঞান-গবেষণার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত কিছু দুর্বলতার কারণে মতপার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। এ মতপার্থক্য পুরোপুরি নিরসন করতে হলে বিস্তারিত ও বিশেষজ্ঞত্ব পর্যায়ের আলোচনা প্রয়োজন - যা বিশেষজ্ঞ গবেষকগণের দায়িত্ব। যদিও এ ধরনের গবেষণা স্বতন্ত্রভাবে সম্পাদনীয় - অত্র গ্রন্থে তার অবকাশ নেই , তবে এ ক্ষেত্রেও নীতিগত ও গবেষণার পদ্ধতিগত প্রশ্নে বিচারবুদ্ধি আমাদেরকে পথ দেখাতে সক্ষম। দ্বিতীয়তঃ বিচারবুদ্ধি যদি এমন কোনো ফয়সালায় উপনীত হতে পারে যা প্রত্যাখ্যান করা কোনো সুস্থ বিচারবুদ্ধির পক্ষে সম্ভব নয় , সে ক্ষেত্রে সে সর্বজনীন সমাধান অবশ্যই পেশ করা উচিত।