ইমামিয়্যাহ শীয়াদের আকিদা-বিশ্বাস

ইমামিয়্যাহ শীয়াদের আকিদা-বিশ্বাস0%

ইমামিয়্যাহ শীয়াদের আকিদা-বিশ্বাস লেখক:
: মাওঃ মোঃ আবু সাঈদ
প্রকাশক: দাওয়াতী মিশন
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

ইমামিয়্যাহ শীয়াদের আকিদা-বিশ্বাস

লেখক: আয়াতুল্লাহ আল উযমা মাকারেম শিরাযী
: মাওঃ মোঃ আবু সাঈদ
প্রকাশক: দাওয়াতী মিশন
বিভাগ:

ভিজিট: 16537
ডাউনলোড: 3376

পাঠকের মতামত:

ইমামিয়্যাহ শীয়াদের আকিদা-বিশ্বাস
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 26 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 16537 / ডাউনলোড: 3376
সাইজ সাইজ সাইজ
ইমামিয়্যাহ শীয়াদের আকিদা-বিশ্বাস

ইমামিয়্যাহ শীয়াদের আকিদা-বিশ্বাস

লেখক:
প্রকাশক: দাওয়াতী মিশন
বাংলা

74. শিয়া মাযহাবের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস :

আমরা বিশ্বাস করি : শিয়া মাযহাবের জন্ম লগ্ন রাসূলে আকরাম (সাঃ) এর জীবদ্দশায়ই এবং এ পর্যায়ে তাঁর বক্তব্যও রয়েছে। এর স্পষ্ট দলীল-প্রমাণও আমাদের হাতে রয়েছে।

বহু সংখ্যক মোফাস্সিরে কোরআন এ আয়াতের তাফসীর প্রসংগে লিখেছেন : নিঃসন্দেহে যেসব লোকেরা ঈমান এনেছে ও সৎ কর্ম আঞ্জাম দিয়েছে তাঁরা (আল্লাহর) সৃষ্টির মধ্যে উত্তম সৃষ্টি (সূরা : বাইয়্যেনাহ , আয়াত নং7)।

রাসূল (সাঃ) বলেন : এ আয়াতের উদ্দেশ্য হচ্ছে আলী ও তাঁর শিয়ারা। আল্লামা সুয়ূতী তাঁর তাফসীর গ্রন্থ আদ্দুররুল মানসূরে বর্ণনা করেছেন। জনাব ইবনে আসাকির জনাব জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণনা করেন যে , আমরা রাসূলের খেদমতে উপস্থিত ছিলাম , এমন সময় আলী (আঃ) আমাদের দিকে আসলেন রাসূল (সাঃ) তাঁকে দেখে বললেন :

সেই মহান সত্তার শপথ! যাঁর হাতের মুঠোয় রয়েছে আমার জীবন! এই (আলী) ও তাঁর শিয়ারা কিয়ামতের দিন সফলকাম

অতঃপর এ আয়াতإِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أُولَئِكَ هُمْ خَيْرُ الْبَرِيَّةِ অবতীর্ণ হলো। এরপর থেকে যখনই আলী (আঃ) রাসূলের সাহাবাদের বৈঠকে উপস্থিত হতেন তাঁরা বলতেন :অর্থাৎ খোদার সৃষ্টির মধ্যে উত্তম সৃষ্টি আগমন করেছেন (আদ্দুররিল মানছুর 6ষ্ঠ খঃ , পৃঃ নং 379)।

অনুরূপ অর্থে জনাব ইবনে আব্বাস , আবু বারাযাহ্ , ইবনে মাদুবিয়্যাহ্ ও আতিয়া উরফী (সামান্য পার্থক্য সহ) বর্ণনা করেছেন , (পয়ামে কোরআন , 9ম খঃ 259 পৃষ্ঠার পর)।

এভাবে দেখতে পাচ্ছি যে , শিয়া নামটি সে সমস্ত লোকদের জন্যে স্বয়ং রাসূল (সাঃ) চয়ন করেছেন যাঁরা হযরত আলী (আঃ) এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছিলেন। সুতরাং তাঁদের নামটি স্বয়ং আল্লাহর রাসূল দিয়েছেন। খলীফাদের সময়কালেও নয় আর ছাফাবিয়্যাদের আমলেও নয়। যদিও আমরা অন্যান্য ইসলামী ফেরকাসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শণ করি , তাদের সাথে এক কাতারে দাঁড়িয়ে জামায়াতের সাথে নামায পড়ি , একই সময়ে ও একই স্থানে হজ্বব্রত পালন করি ও ইসলামের অভিন্ন স্বার্থে সহযোগিতা করি ; তারপরও বিশ্বাস করি যে , যেহেতু হযরত আলীর অনুসারীদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং রাসূল (সাঃ) এর বিশেষ দৃষ্টি ও আনুকূল্য রয়েছে। এ কারণেই আমরা এ মতের অনুসরণকে বেছে নিয়েছি।

শিয়া বিরোধী একদল লোক অতি জোর দিয়ে বলে যে , এ মাযহাবের সাথে আব্দুল্লাহ্ ইবনে সাবার একটা যোগ সূত্র রয়েছে এবং শিয়ারা তার অনুসারী। সে ছিল আসলে একজন ইয়াহুদী ও পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করে। এটা একটা আশ্চর্য জনক কথা ব্যাতীত কিছু নয়। কেননা , শিয়া মাযহাবের সমস্তবই-পুস্তক , কিতাব-পত্র অনুসন্ধান করে দেখা যাচ্ছে যে , এ মাযহাবের কারো সাথে ঐ লোকটির বিন্দু মাত্র সম্পর্ক ছিল না। বরং শিয়া মাযহাবের সমস্ত ইলমে রিজালের কিতাবসমূহ আব্দুল্লাহ্ ইবনে সাবাহকে একজন পথভ্রষ্ট-গোমরাহ্ হিসাবে পরিচয় করিয়েছে। আমাদের কোন কোন বর্ণনা মোতাবেক দেখা যায় : মোরতাদ হওয়ার কারণে আলী (আঃ) তাকে হত্যা করার নির্দেশ জারি করেছিলেন। (দেখুন : তানকীহুল মাকাল ফী ইলমির রিজাল ,আব্দুল্লাহ্ ইবনে সাবা শিরোনাম)।

এ ছাড়াও ইতিহাসে আব্দুল্লাহ্ ইবনে সাবা নামে কোন লোকের অস্তিত্ব ছিল কি-না , তাই প্রশ্নবোধক! কোন কোন গবেষকদের বিশ্বাস হচ্ছে , আসলে সে একটা রূপকথা ও কল্পকাহিনী। তার অস্তিত্ব বলতে কিছু নেই। কিভাবে সম্ভব সে শিয়া মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা হবে ? (দেখুন : আল্লামা আসকারী রচিত-আব্দুল্লাহ্ ইবনে সাবা)।

যদিও ধরে নেই সে একজন কল্পকাহিনীর লোক নয় ; কিন্তু আমরা তো তাকে পথভ্রষ্ঠ- গোমরাহ্ বলে জানি।

75. শিয়া মাযহাবের ভৌগলিক অবস্থান :

এ কথাটি গুরুত্বের দাবী রাখে যে , সব সময় শিয়াদের কেন্দ্রস্থল ইরান ছিল না। বরং ইসলামের প্রথম যুগে বিভিন্ন স্থানে শিয়াদের কেন্দ্র ছিল। যেমন : কুফা , ইয়ামান , মদীনা ও সিরিয়ায়। উমাইয়্যাদের বিষাক্ত অপপ্রচার সত্বেও শিয়াদের বেশ কয়টি কেন্দ্র ছিল। যদিও ইরাকে তেমন প্রসার লাভ করতে পারেনি।

মিশরেও সবসময় শিয়াদের অনেক লোকজন বসবাস করত। এমনকি মিশরে ফাতেমী খলীফাদের আমলে রাষ্ট্র ক্ষমতা শিয়াদের হাতে ছিল। (সিরিয়ায় শিয়ারা যেমন উমাইয়্যাদের শাসনকালে এক ভয়ানক ও আতংকজনক চাপের মুখে ছিলেন তেমনি আব্বাসীয়দের আমলেও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন। সে সময় তাঁদের অনেককেই উমাইয়্যাহ্ ও আব্বাসীদের কারাগারে জীবন দিতে হয়েছে। তখন একদল লোক পূর্ব দিকে চলে যাবার পথ বেছে নিল। আরেকদল পশ্চিমদিকে পাড়ি দিল। তাঁদের থেকে জনাব ইদ্রিস ইবনে আব্দুল্লাহ্ বিন হাসান মিশরে চলে গেলেন। সেখান থেকে মারাকেশ (মাগরিব) এবং সেখানকার শিয়াদের সহযোগীতায় ইদ্রীসিয়ান নামে একটি সরকার গঠন করলেন , যা দ্বিতীয় হিজরীর শেষ হতে শুরু হয়ে 4র্থ হিজরীর শেষ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এ দিকে মিশরের শিয়ারা আরেকটি সরকার গঠন করলেন। এরা নিজেদেরকে ইমাম হোসাইনের বংশধর এবং রাসূল কন্যা হযরত ফাতিমা যাহরার আওলাদ বলে জানত। তারা যখন দেখতে পেল যে , মিশরের অধিবাসীরা শিয়াদের সরকার গঠনের পক্ষে সম্পূর্ণ প্রস্তুত তখন তারা এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করল এবং 4র্থ হিজরী শতাব্দীতে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার গঠন করে। কাহেরা শহরকে রাজধানী হিসাবে নির্দিষ্ট করল। ফাতিমী খলীফারা সর্বমোট চৌদ্দজন ছিলেন-যাদের দশজন সরকারের কেন্দ্রস্থল ছিল মিশরে এবং প্রায় তিনশ বছর মিশর ও সমগ্র আফ্রীকাতে হুকুমত চালায়। আল আযহার জামে মসজিদ ও জামেয়া আল আযহার (আল আযহার বিশ্ব বিদ্যালয়) এরাই প্রতিষ্ঠা করে। ফাতেমীয়ান নামটি হযরত ফাতেমা যাহরা (সালাঃ) থেকে চয়ন করেছে। দায়েরাতুল মাআ 'রেফ গ্রন্থকার জনাব দেহ্খোদা , ফরীদ ভিজরী রচিত দায়েরাতুল মাআরেফ , ওয়ালমুনজিদ ফিল এলাম , ফুতুম ও যুহর পরিভাষা)।

বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিয়া মুসলমানরা বসবাস করছে। যেমন : সউদী আরবের পূর্বাঞ্চলে বহু সংখ্যক শিয়া জীবন-যাপন করছে এবং অন্যান্য ফেরকার লোকদের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে চলছে। যদিও ইসলামের দুশমনরা সব সময় এ চেষ্টায় লিপ্ত ছিল ও আছে যে , মুসলমানদের শিয়া ও অশিয়াদের মাঝে শত্রুতা , ভুল বুঝাবুঝি , সন্দেহ , অবিশ্বাস , নিরাশা , মতবিরোধ ও ঝগড়া-লড়াই ইত্যাদি সৃষ্টি করবে এবং উভয় পক্ষকে দুর্বল করবে।

বিশেষ করে আজকের এ যুগে ইসলাম যখন এক বিরাট বিশ্ব শক্তির রূপ পরিগ্রহ করেছে এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মোকাবিলায় জোরালো ভূমিকা নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে , আর বিশ্ব মানবতাকে বস্তুবাদের হতাশা ও নিরাশার কবল থেকে মুক্তির জন্যে নিজের দিকে আহ্বান জানাচ্ছে। তখন মুসলমানদের এ শক্তিকে বিচূর্ণ করার ও ইসলামের অগ্রগতিকে রুখে দাঁড়াবার জন্যে ইসলামের দুশমনদের সবচেয়ে বড় আশার আলো হচ্ছে যে , মুসলমানদের মধ্যে মাযহাবগত মতবিরোধের আগুনকে প্রজ্বলিত করা । কিন্তু যদি মুসলমানদের সব মাযহাবের অনুসারীরা জেগে ওঠে ও সাবধান হয় তাহলে এ বিপদজনক ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দিতে পারে।

কথিত আছে যে , সুন্নীদের মত শিয়াদের মধ্যেও অনেক ফেরকা আছে। কিন্তু সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ও পরিচিত হচ্ছে শিয়া ইছনা আশারী (বার ইমামে বিশ্বাসী শিয়া) যারা শিয়া জগতের সবচেয়ে বেশী সংখ্যক লোক দ্বারা সংগঠিত।

যদিও শিয়া মুসলমানদের সংখ্যা অন্যান্য মুসলমানদের তুলনায় যথাযথভাবে স্পষ্ট নয় , কিন্তু কোন কোন পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে , প্রায় বিশ থেকে ত্রিশ কোটি শিয়া বিশ্বে আছে-যা সমগ্র মুসলিম জাতির প্রায় এক চতুর্থাংশ।

76. আহলে বাইত (আঃ) এর মিরাছ :

আমাদের এ মাযহাবের অনুসারীরা বহু সংখ্যক হাদীস আহলে বাইতের ইমামগণের মাধ্যমে রাসূলে আকরাম (সাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন এবং আরও বহু হাদীস হযরত আলী (আঃ) ও অন্যান্য ইমামগণের কাছ থেকে পেয়েছেন-যা শিয়াদের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা-দীক্ষা এবং তাদের ফীকাহ্ শাস্ত্রের মূল উৎস হিসাবে পরিগণিত এবং নিম্নে বর্ণিত চারটি হাদীস গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। এ গ্রন্থসমূহ কুতুবে আরবায়াহ্ নামে খ্যাত : কাফী , মান লা ইয়াহযুরুল ফাকীহ্ , তাহযীব , ও ইসতিবছার । কিন্তু একটি বিষয় পুনরাবৃত্তি করা জরুরী মনে করছি-সেটা হল এই যে , যে কোন হাদীস এ চারটি বিখ্যাত গ্রন্থে অথবা নির্ভরযোগ্য অন্য যে কোন গ্রন্থে বর্তমান থাকুক না কেন তার অর্থ এই নয় যে , সে হাদীসটি বিশেষভাবে নির্ভরযোগ্য। বরং প্রত্যেকটি হাদীসই সনদের ক্রমধারা বিশিষ্ট-যা প্রত্যেকটিকে পৃথকভাবে রেজাল গ্রন্থের সনদের ভিত্তিতে অনুসন্ধান করে দেখতে হবে। যখন তার সমস্ত রেজাল সনদ নির্ভরযোগ্য বলে প্রতিয়মান হবে তখন তা একটি ছহীহ্ হাদীস বলে গৃহিত হবে। তা না হলে , সেটি সন্দেহজনক বা দূর্বল হিসাবে পরিগণিত হবে। আর এ সন্ধান কাজ কেবলমাত্র হাদীস শাস্ত্রবিদ ও রিজাল শাস্ত্রবিদ ওলামারাই করতে পারেন।

এখান থেকে একটি বিষয় পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে যে , শিয়াদের হাদীস সংগ্রহের পদ্ধতি আহলে সুন্নাতের বিখ্যাত উৎসগুলোর পদ্ধতি থেকে পৃথক। এ কারণে যে , সুন্নীদের ছিহাহ্ গ্রন্থগুলো বিশেষতঃ ছহীহ্ বোখারী ও মুসলিমের লেখকদের ভিত্তি ছিল এই যে , তাঁরা যে সমস্ত হাদীস সংগ্রহ করেছেন সেটাই তাঁদের নিকট ছহীহ্ (বিশুদ্ধ) ও নির্ভরযোগ্য বলে মনে করেছেন। এ দলীলের ভিত্তিতে তারা তাদের সে হাদীস গ্রন্থগুলোর যে কোন হাদীসকে নিজেদের আকীদা- বিশ্বাসের দলীল হিসাবে উপস্থাপন করতে পারে , (ছহীহ্ মুসলিমের ভূমিকা ও ফতহুল বারী ফী ছহীহুল বোখারী দেখুন)।

পক্ষান্তরে শিয়াদের হাদীস সংগ্রহের ভিত্তি হচ্ছে যে , তারা রাসূলের আহলে বাইতের ইমামগণের সাথে সম্পর্কযুক্ত হাদীসসমূহকে সংগ্রহ করেছেন এবং তারা ছহীহ্ কি ছহীহ্ নয় তা জানার জন্যে ইলমে রিজালের উপর ছেড়ে দিয়েছেন।

77. দুটি বড় গ্রন্থ :

শিয়াদের উৎসগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি উৎস যা শিয়াদের উত্তরাধিকারী সূত্রে প্রাপ্ত নাহজুল বালাগাহ্ ; যা মরহুম শরীফ রাযী (রাঃ) প্রায় এক হাজার বছর পূর্বে হযরত আলী (আঃ) এর বক্তৃতা , চিঠি পত্র , ব্যাপক অর্থবহ স্মরণীয় বাণীসমূহ একত্রিত করে সাজিয়েছেন। এর অন্তর্নিহিত বিষয়সমূহ এতই উচ্চতর ও এর শব্দাবলী এতোই সৌন্দর্য ও শোভামন্ডিত যে , কোন ব্যক্তি যে কোন মাযহাব ও যে কোন মতবাদেরই অনুসারী হোক না কেন , যদি এ গ্রন্থটি অধ্যয়ন করে তাহলে তার উচ্চতর বিষয়বস্তুর প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়ে পড়বে। হায়! যদি শুধুমাত্র মুসলমানরাই নয় অমুসলমানরাও এ গ্রন্থের উচ্চ মানের বিষয়বস্তু সম্পর্কে অবগত হত তাহলে ইসলামের উচ্চতর জ্ঞান-বিজ্ঞান , মূলনীতি , একত্ববাদ , পরকাল , রাজনৈতিক , সামাজিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যাবলী সম্পর্কে বুঝতে পারত।

আমাদের দ্বিতীয় বড় একটি গ্রন্থ হচ্ছে : ছহীফায়ে সাজ্জাদিয়্যাহ্ -যা অত্যন্ত সুন্দর প্রাঞ্জল ভাষায় অতীব , উত্তম কতিপয় দোয়ার সমষ্টি। অত্যন্ত উন্নত মানের , উচ্চতর ও গভীর তাৎপর্যমন্ডিত বিষয়বস্তু সমৃদ্ধ একটি দোয়ার গ্রন্থ।বস্তুতঃ এ গ্রন্থ নাহ্জুল বালাগার বক্তব্যকেই অন্য রকম রীতি-পদ্ধতিতে তুলে ধরেছে। এর প্রতিটি বাক্য নতুন নতুন শিক্ষা দান করে। মানুষের আত্মায় সঞ্চারিত করে পবিত্রতা ও নূরানী পরিবেশ।

এ দোয়ার গ্রন্থটি এমন যে , নাম থেকেই জানা যাচ্ছে এ হচ্ছে শিয়াদের 4র্থ ইমাম হযরত আলী ইবনুল হোসাইন ইবনে আলী ইবনে আবী তালীব (যয়নুল আবেদীন) (আঃ) এর দোয়ার সমষ্টি-যার একটি বিখ্যাত লাকাব হচ্ছে সাজ্জাদ । এ কারণেই এর নামকরণ করা হয়েছে ছহীফায়ে সাজ্জাদিয়্যাহ্ । আমরা যখন চাই যে , দোয়া ও প্রার্থনার মাধ্যমে মহান আল্লাহর সাথে আমাদের একটা আত্মিক যোগসূত্র স্থাপন করব এবং মহান প্রভূর প্রতি আমাদের অন্তরে এক ভালবাসার ঢেউ-তরঙ্গ সৃষ্টি করব তখন এ দোয়ার কিতাবটি নিয়ে বসে যাই। আর তরু-তাজা উদ্ভিদ যেমন বসন্তের বরকতপূর্ণ বৃষ্টির পানি আহরণ করে পরিতৃপ্ত হয় , তেমনি আমরাও এ দোয়া-প্রার্থনার মাধ্যমে আত্মার তৃপ্তি ও প্রশান্তি লাভ করি।

শিয়াদের সর্বাধিক হাদীস , প্রায় দশ হাজার হাদীস পঞ্চম ও ষষ্ঠ ইমাম অর্থাৎ ইমাম মুহাম্মদ ইবনে আলী আল বাকের ও ইমাম জা 'ফর ইবনে মুহাম্মদ আস সাদিক (আঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে। অবশ্য উল্লেখযোগ্য একটা অংশ অষ্টম ইমাম হযরত আলী ইবনে মুসা আর রেযা (আঃ) থেকেও বর্ণিত হয়েছে। আর এটা এ কারণে সম্ভব হয়েছে যে , এ তিনজন মহান ইমাম স্থান- কালভেদে এমন পরিস্থিতি ও পরিবেশে অবস্থান করেছিলেন যে , বনী উমাইয়্যাহ্ ও বনী আব্বাসী শাসকগোষ্ঠির (রাজনৈতিক সংকটের কারণে) চাপের পরিমাণ তুলনামূলক কম ছিল। এ কারণে তাঁরা সক্ষম হয়েছিলেন অধিক সংখ্যক হাদীস-যা তাঁদের পিতা ও পিতামহগণের মাধ্যমে রাসূলে আকরাম (সাঃ) থেকে তাঁদের কাছে পৌঁছে ছিল , তা ইসলামের জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমস্ত অধ্যায়ে ও ফেকাহ্ শাস্ত্রের হুকুম-আহ্কামের পর্যায়ে স্মারকলিপির আকারে রেখে গেছেন। এ কারণেই শিয়া মাযহাবকে জা 'ফরী মাযহাব বলা হয়। এর কারণেই যে , সর্বাধিক হাদীস ষষ্ঠ ইমাম হযরত জাফর ইবনে মুহাম্মদ আস সাদিক (আঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি এমন এক যুগে বসবাস করতেন , যখন উমাইয়্যারা রাজনৈতিকভাবে খুবই দূর্বল অবস্থায় ছিল। এর পর আব্বাসীরা এসে চাপ সৃষ্টি করার মত পর্যাপ্ত শক্তি সঞ্চায় করতে পারেনি। আমাদের গ্রন্থাবলীতে লিপিবদ্ধ আছে যে , তিনি চার হাজার শিষ্য-শাগরিদকে হাদীস শাস্ত্রে , ইসলামের বিভিন্ন জ্ঞান-বিজ্ঞানে ও ফীকাহ্ শাস্ত্রে শিক্ষা-প্রশিক্ষণ দিয়ে যোগ্য করে গড়ে তুলেছেন। হানাফী মাযহাবের নেতা ইমাম আবু হানীফা একটি ছোট্ট কথায় ইমাম জা 'ফর ইবনে মুহাম্মদ আস সাদিক (আঃ) এর ব্যাপারে এভাবে প্রসাংশা করে বলেছেন :

আমি ইমাম জা 'ফর ইবনে মুহাম্মদ (আঃ) থেকে বড় ফকীহ্ আর কাউকে দেখিনি , (আল্লামা যাহবী রচিত তাযকেরাতুল হুফফায , খঃ-1ম , পৃঃ-166)।

মালেকী মাযহাবের বড় নেতা জনাব ইমাম মালেক ইবনে আনাস তাঁর বক্তব্যে এভাবে বলেছেন : আমি একটা দীর্ঘকাল যাবৎ ইমাম জা 'ফর ইবনে মুহাম্মদ (আঃ) এর নিকট আসা- যাওয়া করতাম । তাঁকে সর্বদা এ তিন অবস্থার যে কোন একটি অবস্থায় দেখতে পেতাম : হয় তিনি নামাজরত অবস্থায় থাকতেন কিংবা রোজা রাখার কৃচ্ছতা সাধনরত থাকতেন অথবা কোরআন পাঠে লিপ্ত থাকতেন। আমার বিশ্বাস মতে জ্ঞান-গরীমা ও ইবাদত-বন্দেগীর দিক থেকে ইমাম জা 'ফর ইবনে মুহাম্মদ আস সাদিক (আঃ) থেকে মর্যাদাবান ব্যক্তি আর কাউকে দেখেনি , (তাহ্যীবুওাহ্যীব , 2য় খঃ , পৃঃ নং 104। উদ্ধৃত গ্রন্থ : আসাদ হায়দার রচিত-আল- ইমামুছ্ছাদিক 1ম খঃপৃঃ , নং 53)।

যেহেতু এখানে আমাদের আলোচনা নিতান্ত সার-সংক্ষেপ ভিত্তিক , তাই আহলে বাইতের ইমামগণের সম্পর্কে অন্য সব বড় বড় বিজ্ঞ ওলামাদের বক্তব্য লিখলাম না।

78 ইসলামী জ্ঞান - বিজ্ঞানে শিয়াদের ভূমিকা :

আমরা বিশ্বাস করি : ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের সূচনা লগ্ন থেকেই শিয়াদের প্রভাব বিস্তারকারী ভূমিকা ছিল। অনেকেই বিশ্বাস করেন যে , ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান তাঁদের থেকেই উৎসারিত ও দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এমনকি এ ব্যাপারে বই-পুস্তকও রচিত হয়েছে-যাতে এ বিষয়ের দলীল প্রমাণও উপস্থাপন করেছে। কিন্তু আমরা বলব অন্ততঃপক্ষে এ জ্ঞান-বিজ্ঞান উৎসারণ পর্যায়ে তাঁদের ভূমিকা ছিল যথোপযুক্ত। এর সবচেয়ে উওম দলীল প্রমাণ হচ্ছে ইসলামের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বিভিন্ন কলা-কৌশলের উপর শিয়া ওলামাদের অনেক গ্রন্থাবলীর সমাহর পরিলক্ষিত হয়। ইলমে ফীকহ্ ও ইলমে উছুলের জগতে হাজার হাজার কিতাব রচনা করেছেন -যার কোন কোনটি ব্যাপক বিস্তৃত ও নিজ বিষয়ে অতুলনীয়। তাফসীর ও উলূমে কোরআনের জগতেও হাজার হাজার কিতাব রচিত হয়েছে। হাজার হাজার বই-পুস্তক আকীদা-বিশ্বাস ও ইলমে কালামের উপর লিখা হয়েছে। অন্যান্য বিষয়েও হাজার হাজার গ্রন্থ শিয়া ওলামাগণ রচনা করেছেন। এ সব গ্রন্থ ও কিতাবসমূহের অনেকগুলো এখনও আমাদের পাঠাগারে ও দুনিয়ার বিখ্যাত বিখ্যাত গ্রন্থাগারে বর্তমান রয়েছে এবং সাধারণ লোকদের দর্শণের জন্যে রাখা হয়েছে। যে কোন লোক এ দাবীর সত্যতা যাচাই করার জন্যে এসব গ্রন্থাগারগুলোতে দেখতে পারেন।

একজন বিজ্ঞ শিয়া ব্যক্তিত্ব এ সব কিতাবসমূহকে তালিকাবদ্ধ করেছেন এবং বিরাট বিরাট 26টি খন্ডে এ তালিকা গুলো বাঁধাই করেছেন।

এ খন্ড বা গ্রন্থ রাযীর নাম রাখা হয়েছে আযযারীআতু ইলা তাছানী ফিশ শিয়াতে , সংকলনে বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও মোফাসসির শেখ আগা বুযুর্গ তেহরানী। তালিকাভুক্ত এ সব গ্রন্থগুলোর সংখ্যা , লেখকের নাম ঠিকানাসহ মোট 68 হাজারে দাঁড়িয়েছে। তালিকা সমৃদ্ধ এ মোজাল্লাদসমূহ ছাপানোর ও প্রকাশনার পর বেশ সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। এ তালিকা প্রণীত হয়েছে কয়েকদশক পূর্বে। শেষের দিকে কয়েক দশক ধরে একদিকে অতীত শিয়া ওলামাদের ঐতিহ্যবাহী গ্রন্থসমূহকে পুনরুজ্জীবিত করার এবং পান্ডুলিপিসমূহের উদঘাটন পর্যায়ে প্রচেষ্টা চলছে। অপরদিকে নতুন নতুন রচনা ও সংকলনসমূহ সংগ্রহ করার কাজে লিপ্ত ছিল ; যেসব গ্রন্থগুলোর সঠিক পরিসংখ্যান সংগ্রহ করা এখনও সম্ভব হয়নি। কিন্তু স্বতঃসিদ্ধ যে , ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রত্যেক বিষয়েই শত শত ও হাজার হাজার গ্রন্থ রচিত ও প্রকাশিত হয়েছে।

79. সত্য-সত্যবাদীতা ও আমানতদারী , ইসলামের অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় :

আমরা বিশ্বাস করি : সত্য-সত্যবাদীতা ও আমানতদারী ইসলামের অতি গুরুত্বপূর্ণ ও ভিত্তিগত একটি রোক্ন বা স্তম্ভ। আল্লাহ্ বলেন :

আল্লাহ্ বলবেন! আজ সেদিন-যেদিন সত্যবাদীদের সত্যবাদীতা তাদের কল্যাণে আসবে (সূরা : আল মায়েদাহ্ আয়াত নং 119)।

বরং কোন কোন আয়াত থেকে জানা যায় যে , কিয়ামতের দিন প্রকৃত প্রতিদান এমন প্রতিদান-যা সত্যবাদিতার ভিত্তিতে প্রদান করা হবে। (সে সত্যবাদিতা ঈমানের ক্ষেত্রে , খোদার সাথে প্রতিশ্রুতি , আমলের পর্যায়ে ও জীবনের সর্বক্ষেত্রে )। আল্লাহ্ বলেন :

এ জন্যে যে , আল্লাহ্ সত্যপরায়ণদেরকে তাদের সত্যবাদিতার প্রতিদান দেবেন (সূরা : আল আহযাব , আয়াত নং 24)।

আগেও যেমন ইংগিত করেছি যে , কোরআনের নির্দেশ অনুযায়ী আমরা মুসলমাদের হিসেবে আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্য হচ্ছে যে , আমরা আমাদের জীবনটাকে মা সুম ও সত্যবাদীতার সাথে ও তাদের অনুসরণ করে অতিবাহিত করব। আল্লাহ্ বলেন :

হে ঈমানদার লোকেরা! আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথী ও তাদের অনুসারী হয়ে যাও ( সূরা : তাওবাহ্ আয়াত নং 119)।

এ বিষয়ের গুরুত্ব এত অপরিসীম যে , মহান আল্লাহ্ তাঁর রাসূলকে নির্দেশ দিচ্ছেন :

হে রাসূল! তুমি এরূপ প্রার্থনা কর! হে আমার প্রভু! আমাকে (সব কাজে) সত্যতা সহকারে উপনীত কর এবং সত্যতার সাথে বের করে নাও (সূরা : ইসরা , আয়াত নং 80)।

এ জন্যেই ইমাম জা 'ফর সাদিক (আঃ) বলেন :

অর্থাৎ মহান আল্লাহ্ কোন নবীকেই প্রেরণ করেননি কিন্তু সত্য ও সত্যতার সাথে এবং আমানত যথাস্থানে পরিশোধ করার জন্য (সে আমানত) পাপী লোকের হোক অথবা পূর্ণবান লোকের হোক (বিহারুল আনোয়ার 68তম খঃ , পৃঃ নং 2 ও অনুরূপ 2য় খঃ , পৃঃ নং 104)।

আমরাও আমাদের এ পুস্তকটি রচনার ক্ষেত্রে উল্লেখিত আয়াতসমূহ ও হাদীসের আলোকে চিন্তা-ভাবনা করতঃ আমাদের চেষ্টা-সাধনা ছিল যে , সমস্ত আলোচ্য বিষয়েই যেন সত্য ও সত্যতার সন্ধান করি এবং সত্য ও আমানতের খেলাফ কোন কথা না বলি। আর মহান আল্লাহর কাছে এ আশাই করব যে , তিনি যেন এর উপর স্থায়ী থাকার তৌফিক দান করেন : তিনিই তৌফিক দানের মালিক ।