ইমামিয়্যাহ শীয়াদের আকিদা-বিশ্বাস

ইমামিয়্যাহ শীয়াদের আকিদা-বিশ্বাস0%

ইমামিয়্যাহ শীয়াদের আকিদা-বিশ্বাস লেখক:
: মাওঃ মোঃ আবু সাঈদ
প্রকাশক: দাওয়াতী মিশন
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

ইমামিয়্যাহ শীয়াদের আকিদা-বিশ্বাস

লেখক: আয়াতুল্লাহ আল উযমা মাকারেম শিরাযী
: মাওঃ মোঃ আবু সাঈদ
প্রকাশক: দাওয়াতী মিশন
বিভাগ:

ভিজিট: 16329
ডাউনলোড: 3288

পাঠকের মতামত:

ইমামিয়্যাহ শীয়াদের আকিদা-বিশ্বাস
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 26 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 16329 / ডাউনলোড: 3288
সাইজ সাইজ সাইজ
ইমামিয়্যাহ শীয়াদের আকিদা-বিশ্বাস

ইমামিয়্যাহ শীয়াদের আকিদা-বিশ্বাস

লেখক:
প্রকাশক: দাওয়াতী মিশন
বাংলা

26. কোরআন বিকৃত হয়নি :

আমরা বিশ্বাস করি : বর্তমানে যে কোরআন বিশ্ব মুসলমানের হাতে রয়েছে , এটা সেই কোরআন যা বিশ্বনবীর প্রতি অবতীর্ণ হয়েছিল। তাতে না কোন কিছু সংযোজন হয়েছে আর না তা থেকে কোন কিছু ঘাটতি হয়েছে। ওহী নাযিলের প্রথম থেকেই একদল ওহী লেখক কোরআনের আয়াত অবতীর্ণের পরপরই লিখে রাখতেন। আর মুসলমানদের কর্তব্য ছিল , দিন- রাত তা পাঠ করা। পাঁচ ওয়াক্তের নামাযসমূহে তা পুনঃপুনঃ তিলাওয়াত করা। বিরাট একদল লোক তা স্মরণ রাখতেন ও মুখস্ত করতেন। কোরআনের হাফেজ ও কারীদের একটা বিশেষ মর্যাদা সব সময়ই ইসলামী সমাজে বিদ্যমান ছিল ও আছে। এ কারণগুলো ও অন্যান্য আরও কিছু কারণ ছিল , যে জন্যে আল-কোরআনে সামান্যতম পরিবর্তন আনাও সম্ভব হয়নি। এ ছাড়াও মহান আল্লাহ্ নিজেই পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ কোরআনকে সংরক্ষণ করার দায়-দায়িত্ব নিয়ে রেখেছেন। মহান আল্লাহর এ জিম্মাদারী গ্রহণকরার কারণে কোরআনে পরিবর্তন ও বিচ্যুতি ঘটানো একেবারেই অসম্ভব। এ মর্মে আল্লাহ্ বলেন :

) إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ(

আমরাই এ কোরআনকে অবতীর্ণ করেছি এবং আমরাই এর সংরক্ষণ করব (সূরা : আল- হিজর , আয়াত নং 9)।

শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে সমস্ত ওলামা ও গবেষকগণ এ ব্যাপারে ঐক্যমত পোষন করেছেন যে , কোন প্রকার বিকৃতির হাত আজও কোরআনের দিকে বাড়েনি। উভয় মাযহাবেরই মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোক কোরআনের তাহরিফ বা বিকৃতির পক্ষে কথা বলেছেন। তারা কয়েকটি হাদীসের প্রেক্ষিতে এ কথা বলেছেন। কিন্তু উভয় মাযহাবেরই বিজ্ঞ ওলামাগণ এ দৃষ্টিভঙ্গিকে সম্পূর্ণ রূপে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং উক্ত হাদীসগুলোকে জাল বা কৃত্রিম হাদীস বলে মনে করেন। অথবা , সে বিকৃতি অর্থগত বিকৃতি হতে পারে অর্থাৎ কোরআনের আয়াতের ভ্রান্ত ব্যাখ্যা কেউ দিয়েছেন। কিংবা কোরআনের মূল পরিভাষার ভুল বিশ্লেষণ করেছেন।

সীমিত চিন্তাশীল এসব লোকেরা -যারা কোরআনের বিকৃতি ঘটেছে বলে বিশ্বাস করে , তাদের এ বাড়াবাড়ি শিয়া ও সুন্নী উভয় পক্ষেরই বড় বড় বিজ্ঞ ও খ্যাতনামা ওলামাদের দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীত চিন্তাধারা। প্রকৃতপক্ষে এরা শিয়াও নয় সুন্নিও নয়। এরা কোরআনের উপর আঘাত হানে। এদের এ অন্যায় গোঁড়ামীর কারণে আল-কোরআনের উপর নির্ভরতার বিষয়টি প্রশ্নের সন্মুখীন করে তোলা এবং তা শত্রুদের চাপাকলে পানি ঢালারই নামান্তর।

ইতিহাস অধ্যয়ন করে দেখা যায় , কোরআন সংগ্রহ করার বিষয়টি স্বয়ং রাসূলে আকরাম (সাঃ) এর জীবদ্দশায়ই এক অসাধারণ উদ্যোগ ছিল-মুসলমানদের লিপিবদ্ধ করা , মুখস্ত বা হেফ্জ করা , পুনঃ পুনঃ পাঠ বা বিশেষতঃ একদল ওহী লেখকের প্রথম থেকে লিপিবদ্ধ করে রাখা ইত্যাদি ব্যবস্থাপনা এ সত্যটি সকলের জন্যেই স্পষ্ট ও পরিস্কার করে দেয় যে , কোরআনে বিকৃতি ঘটাবার ব্যাপারে হস্ত সম্প্রসারণ করা একটি অসম্ভব ব্যাপার ছিল। এ ছাড়াও সকলের নিকট পরিচিত এ কোরআন ব্যাতীত আর কোন কোরআনের অস্তিত্বও পরিলক্ষিত হয় না। এ দলিলটি একটি স্পষ্ট প্রমাণ। তা ছাড়া অনুসন্ধান ও গবেষণার দ্বার সবার জন্যেই উন্মুক্ত। কেননা , আজকে আমাদের ঘরে ঘরে , সমস্ত মসজিদসমূহে ও সমস্ত পাঠাগারগুলোতে সব দেশের কোরআন বর্তমান রয়েছে। এমনকি , হাতে লেখা কোরআনগুলো যা বহু শতাব্দীর পূরাতন এবং আমাদের যাদুঘর ও মিউজিয়াম গুলোতে সংরক্ষিত রয়েছে। এ সব কোরআন প্রমাণ করে দেয় যে , বর্তমানে সমগ্র বিশ্বে প্রচলিত কোরআনটাই সে সব কোরআনেরই অনুরূপ। অতীতে যদি এ বিষয়ে গবেষণা ও অনুসন্ধান করার অবকাশ না থেকে থাকে তাহলে এখন তো সে পথ রূদ্ধ নয় বরং সবার জন্যেই গবেষণার পথ খোলা। সংক্ষিপ্ত গবেষণা দ্বারাই পরিস্কার হয়ে যায় যে কোরআন বিকৃতির কথাটি ভিত্তিহীন ও অবৈধ। কোরআন নিজেই বলেছে :

) فَبَشِّرْ عِبَادِ (17) الَّذِينَ يَسْتَمِعُونَ الْقَوْلَ فَيَتَّبِعُونَ أَحْسَنَهُ(

আমার সেই বান্দাদেরকে সুসংবাদ দিন যারা এ কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনে , অতঃপর উত্তমভাবে তার অনুস্মরণ করে (সূরা : যুমার , আয়াত নং 17-18)।

আজকাল আমাদের হাওযায়ে ইলমিয়াসমূহে (দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে) ব্যাপকভাবে কোরআনের বিভিন্ন বিষয়ের উপর শিক্ষাদান চলছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হল : কোরআনে তাহ্রীফ বা বিকৃতি ঘটেনি।

27. কোরআন এবং মানুষের পার্থিব ও অধ্যাত্মিক চাহিদা :

আমরা বিশ্বাস করি : মানুষের পার্থিব ও অধ্যাত্মিক জীবন-যাপনের জন্যে যা কিছু প্রয়োজন , তার মৌলনীতিসমূহ এ কোরআনে বর্ণিত হয়েছে। সরকার পরিচালনা , রাজনৈতিক বিভিন্ন দিক , অন্যান্য জাতির সাথে সম্পর্ক , সহাবস্থাননীতি , যুদ্ধ ও সন্ধি , বিচার ব্যবস্থা , অর্থনীতি ইত্যাদির বিধি-বিধান ও আইন-কানূন এ কোরআনে এভাবে বর্ণিত হয়েছে , যা আমাদের জীবনযাত্রাকে বাঞ্চিত লক্ষ্যের দিকে পরিচালনার বিষয়টি উরল করে দিয়েছে।আল্লাহ্ বলেন : আমরা এ কিতাবকে তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি-যা সকল বিষয়ের বর্ণনাকারী এবং মুসলমানদের জন্যে হেদায়েত স্বরূপ , রহ্মত ও সুসংবাদ বাহক (সূরা : আন নাহল আয়াত নং 89)।

এ কারণে আমাদের বিশ্বাস হচ্ছে যে , ইসলাম কখনও রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি থেকে বিছিন্ন নয় এবং মুসলমানদেরকে এ মর্মে নির্দেশ দেয় যে , নিজ নিজ যুগের রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তগত কর ও এ কোরআনের সাহায্যে মহান ইসলামের মহামূল্যবান ঐতিহ্যকে উজ্জিবিত রাখ। আর ইসলামী সমাজকে এমনভাবে প্রশিক্ষণ দান কর যে , সাধারণ মানুষ যেন ন্যায়-ইনসাফ ও সুবিচার লাভ করতে পারে। এমনকি , ন্যায় বিচারের বিষয়টি যেনো বন্ধু ও দুশমন সকলের প্রতি সমভাবে কার্যকর হয়। যেমন :

হে ঈমানদার লোকেরা! ন্যায়-ইনসাফকে পূর্ণাঙ্গরূপে প্রতিষ্ঠা কর। আর কেবলমাত্র খোদার জন্যেই সাক্ষ্য প্রদান কর। যদিও (তোমার সাক্ষ্য) তোমার নিজের অথবা তোমার পিতা- মাতার কিংবা আত্মীয়-স্বজনের ক্ষতির কারণ হয় (সূরা : আন-নিসা আয়াত নং 135)।

আল্লাহ্ বলেন : কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের শক্রতা যেন তোমাদেরকে এ কাজে উদ্যত না করে যে , তোমরা ন্যায়-ইনসাফের নীতি অবলম্বন করবে না , ন্যায় বিচার কর , যা খোদা ভীতি ও পরহেযগারীর নিকটবর্তী ( সূরাঃ আল-মায়েদাহ্ আয়াত নং 8)।

28. তিলাওয়াত , চিন্তা-গবেষণা ও অনুশীলন :

আমরা বিশ্বাস করি : কোরআন তিলাওয়াত বা অধ্যয়ন করা শ্রেষ্ঠ ইবাদত। খুব কম ইবাদতই এমন আছে যা এর সম পযার্য়ের হতে পারে। কেননা , ঐশীবাণীর এ অধ্যয়ন ও কোরআনের উপর চিন্তা ভাবনা ও গবেষণাই হচ্ছে মানুষের সৎকর্মের উৎস কেন্দ্র। কোরআন রাসূলকে (সাঃ) উদ্দেশ্য করে বলছে :

রাত্রি জাগরণ কর , রাতের কিয়দংশ ব্যতীত , অর্ধ রাত্রি অথবা অর্ধেকের থেকে সামান্য কম কর , অথবা অর্ধেকের চাইতে কিছু বৃদ্ধি কর , আর কোরআনকে মনোযোগ ও সুদর্শিতার সাথে পাঠ কর ( সূরাঃ আল-মুযযাম্মিল 2-4)।

কোরআন সমস্ত মুসলমানদের উদ্দেশ্য করে বলছে : তোমাদের পক্ষে যতটুকু সম্ভব কোরআন পাঠ করো ( সূরাঃ আল-মুযযাম্মিল 20)।

কিন্তু যেমনভাবে বলা হয়েছে কোরআন তিলাওয়াত বা অধ্যয়ন করা , কোরআনের অর্থ , বিষয়বস্তু ও তাংপর্য বুঝার জন্যে চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা করতে হবে তেমনিভাবে চিন্তা-ভাবনা ও গবেষনা কোরআনের উপর আমল-অনুশীলনের ক্ষেত্রে ভূমিকা হিসাবে কাজ করবে। কোরআনেই বলা হয়েছে :

তারা কি কোরআনকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে না ? নাকি , তাদের অন্তরে তালা লেগে গেছে ? (সূরাঃ মুহাম্মাদ আয়াত নং 24)।

আল্লাহ্ আরো বলেন : আমরা কোরআনকে উপদেশ গ্রহণের জন্য সহজ করে দিয়েছি। এমন কেউ আছে কি তা থেকে উপদেশ গ্রহণ করবে এবং এর উপর আমল করবে ? (সূরা : আল-কামার আয়াত নং 17)।

আল্লাহ্ আরো বলেন : এটি একটি বরকতপূর্ণ ও কল্যাণময় কিতাব , যা আমি (তোমার প্রতি) অবতীর্ণ করেছি। অতএব এর অনুসরণ করো (সূরা : আল-আনআম , আয়াত নং 155)।

এ জন্যেই যারা শুধুমাত্র কোরআন পাঠ করে ও মুখস্ত করে , কিন্তু এর উপর চিন্তা-ভাবনা ও আমল-অনুশীলন করেনা , তারা যদি ও কোরআনের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের একটি সম্পাদন করল , অথচ গুরুত্বপূর্ণ দু টি আমল হাত ছাড়া করল। তাই তারা বিরাট ক্ষতির শিকার হল।

29. বিচ্যুতি বিষয়ক আলোচনা :

আমরা বিশ্বাস করি : সব সময়ই মুসলমানদেরকে কোরআনের আয়াতসমূহের উপর চিন্তা- গবেষণা ও এর উপর আমল করা থেকে দূরে সরিয়ে নেয়ার জন্যে এক শ্রেণীর লোক লিপ্ত আছে। এক সময় বনী উমাইয়্যা ও বনী আব্বাসীদের শাসনামলে কোরআনের বাণীসমূহ আদি ও চিরন্তন নাকি নতূন সৃষ্টি এ নিয়ে সমাজে একটা বিতর্কের সূচনা হয়েছে , ফলে মুসলমানরা দু দলে বিভক্ত হয়ে পরস্পরের দুশমনে পরিণত হয়েছে এবং এ পথে ব্যাপক খুনাখুনী ও রক্তপাত ঘটেছে। বিঃ দ্রঃ (কোন কোন ইতিহাসে দেখা যায় যে ,আব্বাসী খলীফা মা মুন তার এক বিচারপতির সহযোগিতায় নির্দেশ পাঠাল যে , যারা কোরআনকে নতূন সৃষ্ঠি বলে বিশ্বাস করবে না তাদেরকে সরকারী পদ থেকে পদচ্যুত করা হবে। আর আদালতে তার সাক্ষী গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে না )। (কোরআন সংগ্রহের ইতিহাস , পৃঃ 260)।

বস্তুতঃপক্ষে এখন আমরা জানি যে , এর সঠিক দৃষ্টিভঙ্গিটি বুঝার জন্যে রক্তপাত ও মানুষ বলিদানের দরকার নেই। কেননা আল্লাহর বাণীর উদ্দেশ্য যদি হয় কোরআনের অক্ষর , নকশা , লেখা ও কাগজ তাহলে নিঃশন্দেহে কোরআনের বাণীসমূহ নতুন সৃষ্টি। আর যদি এর উদ্দেশ্য হয় মহান আল্লাহর জ্ঞান-বিজ্ঞানের অর্থ ও তাৎপর্য , তাহলে নিঃসন্দেহে কোরআনের বাণীসমূহ আল্লাহর সহজাত চিরন্তন জ্ঞান (নতুন সৃষ্টি নয়)। কিন্তু ক্ষমতাধর শাসকবর্গ ও জালিম খলিফারা বছরের পর বছর ধরে মুসলমানদেরকে এ বিষয়ে ঝগড়ায় লিপ্ত রেখেছে। বস্তুতঃ আজকের এ যুগেও অপশক্তিধর লোকেরা ভিন্ন পন্থায় মুসলমানদেরকে কোরআনের উপর চিন্তা-গবেষণা ও এর উপর আমল করা থেকে বিরত রাখার নানান কৌশল অবলম্বন করছে।

30. কোরআনের তফসিরের বিধান :

আমরা বিশ্বাস করি : আল-কোরআনের শব্দসমূহকে প্রচলিত ও আভিধানিক অর্থে প্রয়োগ করতে হবে। কিন্তু যদি কোরআনের আয়াতের অভ্যন্তরে কিংবা এর বাইরে জ্ঞান-বুদ্ধিগত অথবা বর্ণনাগত কোন আলামত ও নির্দেশ পাওয়া যায় তাহলে অন্য অর্থ করা যেতে পারে। (কিন্তু সন্দেহজনক নিদর্শনাদির উপর ভরসা করা উচিৎ নয় বরং সেগুলোকে পরিহার করাই শ্রেয়। আর কোরআনের আয়াতের ব্যাখ্যা ধারণা প্রসূত হওয়া উচিৎ নয়)। যেমন কোরআন বলছে :

যে ব্যক্তি এ জগতে অন্ধ থাকবে সে পরকালেও অন্ধ ও দৃষ্টি হীন থাকবে (সূরা : বনী ইস্রাইল , আয়াত নং 72)।

আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস , এখানে অন্ধ এর বাহ্যিকভাবে যে আভিধানিক অর্থ রয়েছে প্রকৃত অর্থ তা নয়। কেননা , অনেক অনেক পূর্ণ্যবান ও পাক পবিত্র লোক এ জগতে অন্ধ ছিলেন ও আছেন। কাজেই এখানে অন্ধের বাহ্যিক অর্থ দৃষ্টিহীন লোকজন নয়। বরং কুটিল আত্মা সম্পন্ন তথা আত্মার দিক থেকে যারা অন্ধ ও পথভ্রষ্ট সে সব লোক। এখানে জ্ঞান-বুদ্ধি ও নির্দেশে এ ব্যাখ্যাই প্রকৃত ব্যাখ্যা। অনুরূপভাবে কোরআন , ইসলামের দুশমন-একদল লোক সম্পর্কে বলেছে : তারা বধির , বোবা ও অন্ধ। অতএব , তারা কিছুই বুঝে না (বাকারাহ্ : আয়াত নং 171)।

এ কথা স্পষ্ট যে , এ লোকগুলো বাহ্যিক দিক থেকে বধির , বোবা ও অন্ধ ছিল না বরং এটা তাদের আভ্যন্তরীন বৈশিষ্ট্য। (এ ব্যাখ্যাটি আমরা এখানে এ কারণে করলাম যে , এখানে আমাদের হাতে আলামত বা জ্ঞান-বুদ্ধিগত নির্দেশ ছিল)। এভাবে কোরআন যখন মহান আল্লাহ্ সম্পর্কে বলে : আল্লাহর দু 'হাতই প্রশস্ত (সূরা : আল-মায়েদাহ্ 64)।

কোরআন আরো বলে : (হে নূহ্!) তুমি আমাদের চোখের সামনেই নৌকা তৈরী করো (হুদ : 37)।

উপরোল্লেখিত আয়াত দু 'টির অর্থ কখনই আল্লাহর শরীরের চোখ , কান , হাত ইত্যাদি অঙ্গ- প্রত্যঙ্গের ব্যাপারে নয়। কেননা , প্রত্যেক শরীরেরই অঙ্গ-প্রতঙ্গ থাকে। আর সেগুলোর জন্যে স্থান-কাল ও কারণ থাকে এবং অবশেষে একদিন ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। সুতরাং এখানে আল্লাহর হাত ' এর উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর সেই পূর্ণাঙ্গ শক্তি , যার ক্ষমতাবলে তিনি সমগ্র জাহানকে নিজের প্রতিপত্তির আওতায় রেখেছেন। আর তাঁর চক্ষু এর অর্থ হচ্ছে তাঁর জ্ঞান-পরিজ্ঞান-যা সব কিছুর ব্যাপারেই তাঁর রয়েছে।

অতএব উপরোক্ত বক্তব্যের প্রেক্ষিতে , আমরা কখনো চাইনা যে , আল্লাহর বৈশিষ্ট্যের বিষয় হোক অথবা অন্য কোন ব্যাপার হোক জ্ঞান-বুদ্ধিগত ও বণর্নাগত আলামত ও নির্দেশকে কোরআনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অলক্ষ্যে বাদ যাক। কেননা , জগতের সমস্ত অভিজ্ঞ ও বিজ্ঞ মহল এ নীতিকে অবলম্বন করেছেন এবং এ নীতি-পদ্ধতিকে স্বীকার করে নিয়েছেন। আল্লাহ্ বলেন : আমরা কোন রাসূলকেই প্রেরণ করিনি ; কিন্তু তাদের জাতির ভাষাভাষী লোক ব্যতীত (সূরা : র্ইরাহীম , আয়াত নং 4)।

কিন্তু সে আলামত ও নির্দেশ সন্দেহমুক্ত ও নিশ্চিত হতে হবে , ধারণা প্রসুত নয়।

31. মনগড়া তফসিরের বিপদ :

আমরা বিশ্বাস করি : মনগড়া তফসির কোরআন সম্পর্কে বিপদজনক কর্মসূচীগুলোর একটি অন্যতম কর্মসূচী। ইসলামী বর্ণনা মতে এ কাজটি কবীরাহ্ গুনাহ্ তথা মহা পাপ বলে পরিগণিত এবং আল্লাহর দরবার থেকে বিতাড়িত হবার কারণ। এক হাদীসে আছে যে , মহান আল্লাহ্ বলেন : যে ব্যক্তি আমার বাণীকে তার নিজের ইচ্ছা মত ব্যাখ্যা- বিশ্লেষণ করে (অর্থাৎ নিজের প্রবৃওির চাহিদা মোতাবেক) সে আমার প্রতি ঈমান আনেনি (অসায়েল , 18শ খঃ , পৃঃ28 ,হাদীস নং22)।

এ কথা স্পষ্ট যে , যদি সত্যিকারের ঈমান তার মধ্যে থাকত তাহলে খোদার বাণীকে ঠিক যেভাবে আছে সেভাবেই গ্রহণ করে নিত। তার প্রবৃত্তির কথা মত নিত না। বিখ্যাত অনেক হাদীস গ্রন্থে যেমন : ছহীহ্ তিরমিযি , নাসাঈ ও আবুদাউদ গ্রন্থে এ হাদীসটি রাসূল (সাঃ) থেকে বর্ণিত : যারা কোরআনের বাণী কে নিজেদের ইচ্ছা মোতাবেক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে অথবা যে বিষয়ে সে জানেনা তা বলে , সে যেন প্রস্তত থাকে যে , তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম (রিয়াদের প্রখ্যাত বিজ্ঞ ব্যক্তি জনাব মান্নায়িল খলীল আল কাত্তান রচিত-কিতাবু মাবাহিছু ফী উ 'লুমিল কোরআন পৃঃ 304)।

মনগড়া তাফসীর করার অর্থ হচ্ছে কোরআনের বাণীকে কোন ব্যক্তির নিজের ইচ্ছা ও বিশ্বাস মত অথবা নিজের দলের চাহিদা ও বিশ্বাস মোতাবেক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা এবং তদানুযায়ী খাপ খাইয়ে ও মিলিয়ে দেয়া। অথচ , এ ব্যাপারে কোন আলামত বা নিদর্শন তাদের পক্ষে নেই। প্রকৃত পক্ষে এ ধরনের লোকেরা কোরআনের অনুসারী নয় বরং তারা চায় কোরআনকে তাদের অনুসারী বানাতে। তারা যদি কোরআনের প্রতি ঈমান বা বিশ্বাস পোষণ করত তাহলে কখনোই এমন কাজ করতে পারত না।

এতে কোন সন্দেহ নেই যে , যদি কোরআনের তফসিরের ক্ষেত্রে মনগড়া তফসির করার দরজা খুলে দেয়া হয় তাহলে কোরআন সার্বিকভাবে নির্ভরতা হারিয়ে ফেলবে। আর যে কেউ তখন নিজের ইচ্ছা মত ব্যাখ্যা করা শুরু করবে এবং সকল বাতিল পন্থীরাই নিজেদের বিশ্বাসের সাথে কোরআনের আয়াত মিলিয়ে নিবে।

অতএব , কোরআনের মনগড়া তফসিরের অর্থ হচ্ছে : আভিধানিক মানদন্ডের খেলাফ , আরবী সাহিত্যের পরিপন্থী , আরবী ভাষাভাষী লোকদের বুঝের বহির্ভুত , অনুমানের সাথে মিলিয়ে দেয়া , বাতিল ও ধারণা প্রসূত , ব্যক্তিগত ও দলগত ইচ্ছানুযায়ী ব্যাখ্যা দান করা , যা দ্বারা কোরআনের অর্থের বিকৃতি ঘটে।

কোরআনের মনগড়া ব্যাখ্যা দানের নানা রকম শাখা প্রশাখাও রয়েছে , তন্মধ্যে একটি হচ্ছে কোরআনের আয়াতকে বেছে নেয়া। এ অর্থে যে , যেমন শাফায়াত বা সুপারিশের বিষয় , তৌওহীদ বা একত্ববাদের ক্ষেত্রে ইমামত বা নেতৃত্বের পর্যায়ে ও অন্যান্য ব্যাপারে কেবলমাত্র সেই সব আয়াতের নিকটই যায় -যা তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের পথে সহায়ক হয়। আর অন্য যে আয়াতসমূহ তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় কিন্তু অন্য আয়াতের সম্পুরক ও বিশ্লেষক সে আয়াতসমূহকে অলক্ষ্যে বাদ দিয়ে দেয় অথবা সে আয়াতসমূহের প্রতি অমনোযোগ সহকারে পাশ কেটে যায়।

সার কথা হচ্ছে : কোরআনে ব্যবহৃত শব্দসমূহের উপর দৃঢ়ভাবে বসে থাকা এবং জ্ঞান- বুদ্ধিগত ও নির্ভরযোগ্য বণর্নাগত দলীল প্রমাণ ভিত্তিক আলামত ও নির্দেশের প্রতি দৃষ্টিপাত না করা , যেমন এক প্রকারের বিকৃতি , তেমনি মনগড়া তফসির তথা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও বিকৃতি হিসাবে পরিগণিত হবে। আর দু 'টি পন্থাই কোরআনের মহা মূল্যবান উচ্চ শিক্ষা থেকে দুরে নিক্ষিপ্ত হওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। চিন্তা করে দেখুন।

32. হাদীস , কোরআন কর্তৃক অনুমোদিত :

আমরা বিশ্বাস করি : কোন ব্যক্তিই একথা বলতে পারে না যে , অর্থাৎ আমাদের জন্যে আল্লাহর কিতাব কোরআনই যথেষ্ট। আর হাদীস ও নবীর সুন্নত , যা তফসির সম্পর্কীত , কোরআনের হকীকত বর্ণনাকারী , নাসেখ ও মানসুখ তথা বাতিলকারী ও বাতিলকৃত আয়াতের সনাক্তকারী এবং সাধারণ ও বিশেষ আয়াতের পার্থক্যকারী অথবা ইসলামের মৌলিক শাখা-প্রশাখার শিক্ষার সাথে সম্পর্কযুক্ত , তা অলক্ষ্যে উপেক্ষা করা যায় না। কেননা , কোরআনের আয়াতই রাসূলে আকরাম (সাঃ) এর আদর্শ-চরিত্র , তাঁর বলা-বক্তব্য ও তাঁর কৃতকর্মকে মুসলমানদের জন্যে হুজ্জাত তথা দলীল বলে গণনা করেছে এবং সে হাদীসসমূহকে ইসলাম জানা ও বুঝার এবং ইসলামী হুকুম-আহ্কাম নির্ণয় করার উৎস বলে ঘোষণা করেছে। কোরআন বলেছে :

যা কিছু রাসূলে আকরাম (সাঃ) তোমাদের জন্যে নিয়ে এসেছেন (ও তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন) তা গ্রহণ কর। (আমল কর) এবং তিনি যা নিষেধ করেছেন তা পরিহার করো (সূরা : আল হাশর আয়াত নং7)।

কোরআন আরো বলেছে :

ঈমানদার নর-নারী কারোই অধিকার নেই যে , যখন আল্লাহ্ ও রাসূল কোন বিষয়ে জরুরী মনে করেন ও নির্দেশ দান করেন তখন তা তারা নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী করবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ্ রাসূলের কথা অমান্য করলো সে তো স্পষ্ট পথভ্রষ্টতায় লিপ্ত হলো (সূরা : আল আহযাব , আয়াতনং 36)।

যারা রাসূলের হাদীসের প্রতি তোয়াক্কাহীন , প্রকৃতপক্ষে তারা কোরআনকেই উপেক্ষা করছে।

কিন্তু এ কথা স্পষ্ট যে , রাসূলের হাদীস অবশ্যই নির্ভরযোগ্য সূত্রে স্থির হতে হবে। যে কোন বক্তব্যই , যে কোন লোক রাসূলের সাথে সম্বন্ধযুক্ত করে দিলেই তা গ্রহণ করা যেতে পারে না। হযরত আলী (আঃ) একবার এক বক্তৃতায় এরূপ বলেন :

রাসূলের জীবদ্দশায়ই তার নামে মিথ্যা (হাদীস) বাঁধা হয়েছে , অবশেষে রাসূল (সঃ) একদিন দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করছিলেন। তাতে তিনি বললেন : যে ব্যক্তি আমার নামে মিথ্যা (হাদীস) ইচ্ছা করে বাঁধবে , সে যেন প্রস্তুত থাকে যে , তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম (নাহজুল বালাগাহ , খোৎবা নং210)।

অনুরূপ অর্থের একটি হাদীস ছহীহ্ বোখারীতেও আছে। (দেখুন , ছহীহ্ বোখারী , 1ম খঃ , পৃঃ 28 , বাবে ইসমুমান কাজিবা আলান্নাবী (সাঃ))।

33. আহলে বাইতের ইমামগণের হাদীস :

আমরা আরো বিশ্বাস করি : রাসূলের আহলে বাইতের ইমামগণের হাদীসসমূহ ও রাসূলের নির্দেশমতে মেনে চলা অপরিহার্য কর্তব্য। কেননা ,

প্রথমতঃ শিয়া-সুন্নী উভয় ফিরকার অধিকাংশ বিখ্যাত হাদীস গ্রন্থসমূহে হাদীসে মোতাওয়াতের '' রয়েছে যা এ কথারই বিশ্লেষণ করেছে। ছহীহ্ তিরমিযিতে বর্ণিত হয়েছে যে , রাসূলে আকরাম (সাঃ) বলেন : হে লোক সকল! আমি তোমাদের মাঝে এমন জিনিস রেখে যাচ্ছি , যদি তোমরা তা আঁকড়ে ধরে থাক তাহলে কখনই পথভ্রষ্ট-গোমরাহ্ হবে না। আর তা হলো আল্লাহর কিতাব (আল-কোরআন) ও আমার আহলে বাইতের বংশধারা (ছহীহ্ তিরমিযি , 5ম খঃ ,পৃঃ :662 ,বাবে মানাকিবে আহলে বাইতিন্নাবী (সঃ) , হাদীস নং 3786)।

এ হাদীসের বহু সংখ্যক সনদ ইমামতের অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।

দ্বিতীয়ত : আহলে বাইতের ইমামগণ নিজেদের সমস্ত হাদীসই রাসূলে আকরাম (সাঃ) থেকে বণর্না করেছেন। তাঁরা বলেন : আমরা যা কিছু বলি তা আমাদের পূর্বপুরুষদের মাধ্যমে রাসূল (সাঃ) থেকে আমাদের নিকট পৌছিয়েছে।

জী হ্যাঁ ; হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) মুসলমানদের ভবিষ্যত ও তাদের সমস্যাবলী ভালভাবেই বুঝতে পারছিলেন এবং তাদের এ অসংখ্য সমস্যা সমাধানের পথ পৃথিবীর মহাপ্রলয় অবধি কোরআন ও আহলে বাইতের অনুসরণের মধ্যে নিহিত আছে বলে ঘোষণা করেছেন।

যে হাদীসটি এত গুরুত্বের দাবীদার এবং যার মধ্যে এত সব বিষয়াদি শামিল আর যা এত সনদ সমৃদ্ধ তা কি উপেক্ষা করা যেতে পারে ? আর খুব সহজেই কি তার পাশ কেটে চলে যাওয়া যায় ? এ কারণেই আমরা বিশ্বাস করি : যদি এ ব্যাপারটিতে অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করা হত তাহলে আজকের মুসলমানরা আকীদা-বিশ্বাসের সব ক্ষেত্রে , কোরআনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ময়দানে ও ফীকাহ্ শাস্ত্রের মাসআলা-মাসায়েলের জগতে যে সমস্ত সমস্যার সন্মুখীন , তার কিছুই দেখা দিত না।