ইমামিয়্যাহ শীয়াদের আকিদা-বিশ্বাস

ইমামিয়্যাহ শীয়াদের আকিদা-বিশ্বাস0%

ইমামিয়্যাহ শীয়াদের আকিদা-বিশ্বাস লেখক:
: মাওঃ মোঃ আবু সাঈদ
প্রকাশক: দাওয়াতী মিশন
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

ইমামিয়্যাহ শীয়াদের আকিদা-বিশ্বাস

লেখক: আয়াতুল্লাহ আল উযমা মাকারেম শিরাযী
: মাওঃ মোঃ আবু সাঈদ
প্রকাশক: দাওয়াতী মিশন
বিভাগ:

ভিজিট: 16325
ডাউনলোড: 3286

পাঠকের মতামত:

ইমামিয়্যাহ শীয়াদের আকিদা-বিশ্বাস
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 26 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 16325 / ডাউনলোড: 3286
সাইজ সাইজ সাইজ
ইমামিয়্যাহ শীয়াদের আকিদা-বিশ্বাস

ইমামিয়্যাহ শীয়াদের আকিদা-বিশ্বাস

লেখক:
প্রকাশক: দাওয়াতী মিশন
বাংলা

ষষ্ঠ অধ্যায়

বিবিধ বিষয়

56. বুদ্ধি বৃত্তিক সৌন্দর্য ও কদর্যতা :

আমরা বিশ্বাস করি : মানুষ তার বিবেক-বুদ্ধি ও বিচক্ষনতা দিয়ে ভাল-মন্দ , সৌন্দর্য ও কদর্যতা এরূপ অনেক কিছুকেই উপলব্দি করে। আর তা ভাল-মন্দ চেনার জ্ঞানের মাধ্যমে করে থাকে -যা আল্লাহ্ মানুষকে দান করেছেন। এ কারণেই , এমনকি আসমানী শারীয়াত অবতীর্ণ হবার পূর্বে কোন কোন বিষয় বিবেক-বুদ্ধির দ্বারা মানুষের নিকট স্পষ্ট হত। ন্যায়-ইনসাফ ও সৎকর্মের সৌন্দর্য , জুলুম ও অবিচারের কদর্যতা , অনেক চরিত্র-আখলাক জনিত বৈশিষ্ট্যের সৌন্দর্য। যেমন , সত্য কথা বলা , আমানত বা গচ্ছিত সম্পদের সংরক্ষণ , বীরত্ব , দানশীলতা ও এ জাতীয় অন্যন্য গুণাবলী , আবার মন্দ জনিত বৈশিষ্ট্যাবলী যেমন , মিথ্যা কথা বলা , খেয়ানত , কৃপণতা ও এ জাতীয় মন্দ বৈশিষ্ট্যাবলী। আর মানুষের বিবেক-বুদ্ধি সব ক্ষেত্রে সৌন্দর্য ও কদর্যতা অনুধাবন করতে অক্ষম এবং মানুষের জ্ঞান যেখানে সব সময়ই সীমিত সেখানে খোদার দ্বীন , আসমানী কিতাব ও নবী-রাসূলগণ এ ঘাটতি পূর্ণ করার জন্যে খোদার পক্ষ থেকে প্রেরিত হয়েছেন -যাতে করে মানুষের বিবেক-বুদ্ধিগত অনুধাবনের ব্যাপারেও গুরুত্ব আরোপ করবেন এবং এ প্রকারের নানান দিকগুলো যা বিবেক-বুদ্ধি অনুধাবন করতে অক্ষম সেগুলোকেও মানুষের জন্যে পরিস্কার করে দিবেন।

আমরা যদি সত্য ও বাস্তবতা নিরূপণের ক্ষেত্রে বিবেক-বুদ্ধির স্বাধীনতাকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করি তাহলে তো একত্ববাদ , খোদা পরিচিতি , নবীগণের প্রেরণ ও ঐশী দ্বীন এবং মতবাদ সমূহ দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাবে। কেননা , খোদার অস্তিত্বের প্রমাণ ও বাস্ত বায়ন , নবী-রাসূলগণের আহ্বানের সত্যতা বুঝা বিবেক-বুদ্ধির পথ ছাড়া অন্য কোন পথে সম্ভব নয়। এটা স্বতঃসিদ্ধ কথা যে , ইসলামী শরীয়াতের বর্ণনাবলী ঠিক তখনি গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে যখন একত্ববাদ ও নবুয়্যতের মত গুরুত্বপূর্ণ দু 'টি মৌলিক বিষয় বিবেক- বুদ্ধির যুক্তি-প্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত করা যেতে পারে। এ দু 'টি বিষয়ের সত্যতার প্রমাণ শুধুমাত্র শারীয়াতের দলীল-প্রমাণ দ্বারা সম্ভব নয়।

57. আল্লাহর আদল্ বা ন্যায়পরায়নতা :

কারণেই আমরা মহান আল্লাহর আদল বা ন্যায়পরায়নতার ব্যাপারে পূর্ণবিশ্বাসী এবং একথা বলে থাকি যে : মহান আল্লাহর পক্ষে অসম্ভব যে , তিনি তাঁর বান্দাদের প্রতি জুলুম বা অবিচার করবেন। বিনা কারণে কাউকে শাস্তি দিবেন অথবা বিনা কারণে কাউকে ক্ষমা করে দিবেন। তাঁর পক্ষে অসম্ভব যে , তিনি যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা রক্ষা করবেন না। তাঁর পক্ষে সম্ভব নয় যে , অসৎ ও পাপীদেরকে নিজের পক্ষ থেকে নবুয়্যত ও রিসালতের পদে মনোনয়ন দিবেন ও মু 'জিযাহ্ বা আলৌকিক ঘটনা তাঁর অধিকারে দিয়ে দিবেন।

আর এটাও তাঁর পক্ষে সম্ভব ব্যাপার নয় যে , তাঁর বান্দাদেরকে যেখানে পরম কল্যাণ , সফলতা ও পূর্ণাঙ্গতার শীর্ষে পৌঁছার জন্যে সৃষ্টি করেছেন সেখানে তাদেরকে পথ প্রদর্শক ও নেতাহীন ছেড়ে দিবেন! কেননা , এ কাজ তাঁর পক্ষে বেমানান ও বিশ্রী। আর কদর্য ও বিশ্রী কাজ আল্লাহর জন্যে কোন অবস্থাতেই বৈধ নয়।

58. মানুষের স্বাধীনতা :

ঠিক একই কারণে আমরা বিশ্বাস করি যে , মহান আল্লাহ্ মানুষকে স্বাধীনতার অধিকার দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের কাজ-কর্ম ও ভূমিকা তার ইচ্ছা ও স্বাধীনতার ভিত্তিতে উৎসারিত হয়। কেননা , যদি এরূপ না হয় অর্থাৎ আমরা যদি মানুষের কাজ-কর্মের বা আমলের ক্ষেত্রে জোর-জবরদস্তির নীতিতে বিশ্বাসী হই তাহলে অসৎকর্মশীল লোকদেরকে শাস্তি প্রদান প্রকাশ্য ও স্পষ্ট অবিচার এবং সৎকর্মশীল লোকদের প্রতি পুরস্কার প্রদান অহেতুক ও নিরর্থক হয়ে দেখা দিবে। আর এ জাতীয় কাজ আল্লাহর পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার ভিন্ন কিছুই নয়।

সার কথা হচ্ছে যে , বিবেক-বুদ্ধি বৃত্তিক সৌন্দর্য ও কদর্যতার বিষয়টি মেনে নেয়া এবং অনেক সত্য ও বাস্তবতা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে মানুষের চিন্তার স্বাধীনতা ও বিচক্ষণতার বিষয়টি স্বীকার করে নেওয়া দিন ও ইসলামী শারীয়াতের মূল ভিত্তিসমূহ , নবী-রাসূলগণের নবুয়্যাত , রেসালত ও আসমানী কিতাবসমূহকে গ্রহণ করে নেয়ারই নামান্তর। কিন্তু আগেও যেমন বলা হয়েছে যে , মানুষের অবগতি ও উপলব্দি ক্ষমতা সীমিত। এ কারণে , শুধুমাত্র এর দ্বারাই মানুষের মূল লক্ষ্য- কল্যাণ ও পূর্ণাঙ্গতার সাথে সম্পর্ক যুক্ত সমস্ত বাস্তবতা ও সত্যকে উপলব্দি করতে পারেনা। আর এ কারণেই আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী-রাসূল প্রেরণ ও আসমানী কিতাব অবশ্য প্রয়োজনীয়।

59. ফীকাহ্গত মাসায়েল নির্ধারণের একটি উৎস হল , আক্বল :

ইতিপূর্বে যা বলা হলো তার আলোকে আমাদের বিশ্বাস হচ্ছে যে , ইসলামী জীবন বিধানের আইন-কানুন নির্ধারণের জন্যে যে মৌলিক উৎসগুলো রয়েছে তার মধ্যে একটি হল আকল (তথা জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিবেক)। অর্থাৎ আক্বল , মাসয়ালা-মাসায়েল নির্ণয়ের আরেকটি দলীল। এখানে আক্বল এর উদ্দেশ্য হচ্ছে যে , আকল যখন কোন বিষয়কে নিশ্চিত ও দৃঢ়ভাবে অনুধাবণ করতে পারে তখন সে বিষয়ে বিচার-ফয়সালাও দিতে পারে ; যেমন : যদি ধরে নেয়া যায় যে , জুলুম- অত্যাচার , আমানতের খিয়ানত , মিথ্যা কথা বলা , আত্ম হত্যা করা , ধন-সম্পদ চুরি করা , মানুষের হক-অধিকার নস্যাত করা ইত্যাদি হারাম হওয়ার বিষয়টির দলীল কোরআন , হাদীস ও আলেম-ওলামাদের ঐক্যমতের কথা কোথাও খুঁজে না পেতাম ; তখন আমরা আক্বল এর দলীল দ্বারা ঐ বিষয়গুলোকে হারাম বলে ঘোষনা করতাম ; আর দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করতাম যে , মহা জ্ঞানী আল্লাহ্ এ বিষয়গুলোকে আমাদের জন্যে হারাম হিসাবে গণনা করেছেন এবং এ সমস্ত কাজ আঞ্জাম দিবার ক্ষেত্রে তিনি কখনো রাজি ও সম্মত নন। আর এ (আক্বল দ্বারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ) আমাদের জন্যে একটি দলীল বা হুজ্জাত।

আল-কোরআনে অসংখ্য আয়াত আছে যার ব্যখ্যা-বিশ্লেষণে আকল এর প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। আর এ আয়াতসমূহ বর্ণনা করছে যে , আকল একটি দলীল।

একত্ববাদের রাস্তা সন্ধানের জন্যে আল-কোরআন আকল ও বিচক্ষণতাকে আহ্বান জানাচ্ছে যেনো আসমান ও যমীনের সৃষ্টি নিপুনতায় আল্লাহর নিদর্শণাবলীর উপর গবেষণা করে। আল্লাহ্ বলেন : নিশ্চয়ই আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টির (নিপুনতার) মধ্যে বিবেকবান লোকদের জন্যে আল্লাহর নিদর্শনাবলী বিদ্যমান (সূরা : আলে ইমরান-190)।

অপর পক্ষে আল্লাহর এ নিদর্শনাদি বর্ণনা করার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের বিবেক-বুদ্ধি ও হৃদয়ঙ্গম শক্তিকে বৃদ্ধি করা। যেমন : মহান আল্লাহ্ বলেন : লক্ষ্য করে দেখো ; আমরা আমাদের নিদর্শনাবলীকে কিরূপে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করেছি- যাতে করে তারা অনুধারন করতে পারে (সূরা : আনআম 65)।

আরেক পক্ষে সমস্ত মানুষকে আহ্বান জানাচ্ছে যেন মন্দ ও কদর্য থেকে ভাল ও সুন্দরকে পৃথক এবং এ পথে চিন্তা শক্তিকে কাজে লাগায়। যেমন , আল্লাহ্ বলেন :

তুমি বল! চক্ষুষ্মান ও দৃষ্টি শক্তিহীন (জ্ঞানী-বিজ্ঞ ও অজ্ঞ-জাহেল) লোকেরা কি এক সমান ? তোমরা কি চিন্তা-ভাবনা কর না ? (আল-আনআম : 50)।

অবশেষে সমস্ত সৃষ্টিকুলের মধ্যে নিকৃষ্টতম প্রাণী হিসাবে সে সমস্ত লোকদের গণনা করা হয়েছে -যারা নিজেদের চোখ , কান , জিহ্বা ইত্যাদিকে কাজে লাগায় না এবং বিবেক ও বিচক্ষণতা শক্তি ব্যবহার করে না। যেমন , আল্লাহ্ বলেন :

নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই সৃষ্টির মধ্যে নিকৃষ্টতম প্রাণী আল্লাহর নিকট সে সমস্ত মুক ও বধির লোকেরা-যারা আক্বল বা বিবেক-বুদ্ধি খরচ করে বুঝার চেষ্টা করে না (সূরা : আল-আনফাল , আয়াত নং 22)।

এভাবে আক্বল , বিবেক-বুদ্ধি ও বিচক্ষণতাকে চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে কাজে লাগানোর ব্যাপারে আল-কোরআনে আরো অসংখ্য-অগণিত আয়াত রয়েছে। এমতাবস্থায় কি করে সম্ভব হতে পারে যে , বিবেক-বুদ্ধি , আক্বল , বিচক্ষণতা ও চিন্তা শক্তিকে ইসলামের মৌলিক ও শাখা- প্রশাখার ক্ষেত্রে অলক্ষে বাদ দেয়া যায় ?

60. আবারও আল্লাহর আদ্ল :

আগেও যেমন ইংগিত করেছি যে , আমরা আদ্ল বা ন্যায়পরায়নতায় বিশ্বাসী এবং দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করি যে , আল্লাহ্ তাঁর কোন বান্দার প্রতি বিন্দুমাত্র অন্যায় ও জুলুম করা বৈধ মনে করেন না। কেননা , জুলুম কদর্য ও অপছন্দনীয় কাজ। আর আল্লাহর মহান সত্তা এ জাতীয় কাজ- কর্ম থেকে পাক-পবিত্র।

আর আল্লাহ্ বলেন :

তোমার প্রভু কারো প্রতি জুলুম করেন না (সূরা : কাহাফ আয়াত নং 49)।

দুনিয়া বা আখেরাতে কেউ যদি কোন শাস্তির মধ্যে লিপ্ত হয় তাহলে তার কারণ সে নিজেই। যেমন আল্লাহ্ বলেন :

আল্লাহ্ (পূর্বের জাতী সমূহের যারা-আল্লাহর শাস্তিতে নিপতিত হয়েছিল) তাদের প্রতি কোন অবিচার করেননি বরং তারা নিজেরাই নিজেদের আত্মার প্রতি জুলুম করেছিল (সূরা : তাওবাহ , আয়াত নং 70)।

শুধুমাত্র মানুষই নয় বরং কোন সৃষ্টিই এ পৃথিবীতে আল্লাহর পক্ষ থেকে অবিচারের শিকারে পরিণত হবে না। আল্লাহ্ বলেন :

আল্লাহ্ কখনো বিশ্ববাসীর কারো উপর কোন প্রকার জুলুম করতে চান না (সূরা : আলে ইমরান 108)।

অবশ্য এ সমস্ত আয়াতসমূহ আকলের বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ ও দিক নির্দেশনা করছে।

অসাধ্য কাজকর্ম বর্জনীয় :

এ কারণেই আমরা বিশ্বাস করি : যে কাজ সম্পাদন করা মানুষের পক্ষে দুঃসাধ্য ব্যাপার তা করা বাঞ্ছনীয় নয়। এ পর্যায়ে আল্লাহ্ বলেন :

আল্লাহ্ কারো উপর কোন দায়িত্ব চাপিয়ে দেননা কিন্তু যা সে করতে সক্ষম (সূরা : আল- বাকারাহ , আয়াতনং 285)।

61. বিপদজনক ঘটনাবলীর দর্শন :

একই কারণে আমরা আরো বিশ্বাস করি : এ জগতে যে সমস্ত বিপদজনক ঘটনা সংঘটিত হয় ; যেমন ভূমিকম্প ও নানা প্রকার বালা-মুসিবত , সে গুলো কখনো কখনো আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি হিসাবে আসে। এভাবে যে , যেমন হযরত লূত (আঃ) এর জাতি সম্পর্কে কোরআনে এসেছে : যখন আমাদের নির্দেশ এসে পৌঁছালো , আমরা তাদের শহরগুলোকে (আবাদি গুলোকে) উলোটপালোট করে দিলাম এবং তাদের উপর মুষলধারে ঝামা পাথরের বৃষ্টি বর্ষণ করতে লাগলাম (সূরা : হুদ আয়াত নং 82)।

অকৃতজ্ঞ বিদ্রোহী লোকদের সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেন :

তারা (আল্লাহর আনুগত্যতার ব্যাপারে) অবাধ্যতা করলো , সুতরাং আমরা তাদের প্রতি ধংসকারী প্লাবন পাঠালাম (সূরা : আস সাবা , আয়াত নং 16)।

এভাবে দূর্যোগপূর্ণ ঘটনাবলীর আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে জাগ্রত করা-যাতে করে তারা সঠিক পথে ফিরে আসে। আল্লাহ্ বলেন :

স্থলভাগ ও জলভাগে যে সমস্ত ধবংসলীলা ও দূর্যোগ ছড়িয়ে পড়ছে তা এ কারণে যে তারা নিজেরা নিজেদের কৃতকর্ম দ্বারা অর্জন করেছে। আর আল্লাহ্ চাচ্ছেন যে , তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের কিয়দাংশের স্বাদ আস্বাদন করাবেন ; তাতে হয়তো তারা (মন্দ থেকে) ফিরে আসবে (সূরা : আর রোম , আয়াত নং 41)।

বিপদজনক ঘটনাবলীর আরেকটি দিক হচ্ছে এমন সব বালা-মুছিবত-যা মানুষ নিজের হাতে নিজেই যোগান দেয়। অন্য কথায় , এ সব বালা-মুছিবত তাদের নিজেদেরই কৌশলহীন ও অযৌক্তিক কৃতকর্মের পরিণতি। আল্লাহ্ বলেন :

নিশ্চয়ই আল্লাহ্ কোন জাতির অবস্থার পরিবর্তন করেননা যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা নিজেরাই নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন আনয়ন করে (আর রাদ : 11)। আল্লাহ্ বলেন :

তোমাদের প্রতি যে কল্যাণ ও সফলতা এসে উপস্থিত হয় তা আল্লাহরই পক্ষ থেকে , আর অমঙ্গল ও বিপদাপদ যা কিছু আসে সেগুলো তোমাদের নিজেদেরই (মন্দ কর্মের) পরিণতি (সূরা : আন-নিসা , আয়াত নং 79)।

62. বিশ্ব-জাহান সুবিন্যস্ত :

আমরা বিশ্বাস করি : সমস্ত সৃষ্টি জগতই সুবিন্যস্ত ভাবে সাজানো এক অনুপম পরিবেশ। সব কিছু প্রয়োজন মোতাবেক সুশৃংখলভাবে পরিচালিত হচ্ছে। কোথাও কোন বিষয়ই ন্যায়-নিষ্ঠা , ইনসাফ ও কল্যাণ বিরোধী দেখা যায় না। আর মানব সমাজে যদি কোন প্রকার অকল্যাণকর ও মন্দ পরিবেশ দেখা যায় তাহলে তা মানুষদের নিজেদেরই সৃষ্টি।

আবারও বলছি , আমরা বিশ্বাস করি : আল্লাহর আদ্ল বা ন্যায় পরায়নতা আমাদের আকীদা-বিশ্বাসের অন্যতম একটি স্তম্ভ ও ভিত্তি। এটা ব্যতীত একত্ববাদ , নবুয়্যত ও পরকালের বিষয়টিও হুমকীর সন্মুখীন। এ পর্যায়ে ইমাম জা 'ফর ছাদিক (আঃ) বলেন : একত্ববাদ ও আল্লাহর আদ্ল হচ্ছে দ্বীনের মৌলিক ভিত্তি । এরপর তিনি আরো বললেন : তাওহীদ বা একত্ববাদ হচ্ছে , যে সব জিনিষ (অন্যায় কাজ) তোমার জন্যে করা সম্ভব (অর্থাৎ তোমার মধ্যে যেসব বৈশিষ্ট্যাবলী পাওয়া যায়) সেগুলো তোমার প্রভুর মধ্যে পাবে না। (তিনি সে সব থেকে পাক ও পবিত্র) কিন্তু আল্লাহর আদ্ল হচ্ছে এমন কোন কাজ খোদার প্রতি সম্পর্কযুক্ত ও আরোপ করনা-যা তুমি নিজে যদি আঞ্জাম দাও তাহলে তোমাকে সে কাজের জন্যে তিরস্কার করা হবে (বিহারুল আনোয়ার , খঃ-5ম , পৃঃ-17 , হাদীস নং 23)।

63. ফীকাহ্গত মাসায়েল নির্ধারনের চারটি উৎস :

আমাদের ফীকাহ্গত মাসয়ালা-মাসায়েল নির্ণয় করার ক্ষেত্রে আগেও যেমন ইশারা করেছি যে , এ পর্যায়ে আমাদের চারটি উৎস স্থল রয়েছে :

প্রথম : কিতাবুল্লাহ্ বা আল্লাহর কিতাব আল-কোরআন-যা ইসলামের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা-দীক্ষা এবং হুকুম-আহ্কাম নির্ণয়ের মূল উৎস।

দ্বিতীয় : সুন্নাতে রাসূল আহলে বাইতের মা সুম ইমামগণের সুন্নাত

তৃতীয় : ইজমা ও ইত্তেফাকে ওলামা ও ফোকাহা যা মা সুমগণের দৃষ্টিভঙ্গিকেই উম্মোচন ও প্রকাশ করে।

চতুর্থ : দলীলে আক্বল । দলীলে আক্বলের দ্বারা আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে আকল যখন কোন বিষয় পরিপূর্ণ রূপে অনুধাবন করতে পারে এবং নিশ্চয়তা ও দৃঢ়তার সাথে ফয়সালা দিতে পারে তখন আকল আমাদের জন্যে দলীল ও হুজ্জাত। কিন্তু আক্বলের দলীল যদি ধারণা প্রসূত হয় যেমন কিয়াস ইসতেহ্সান তাহলে আমাদের ফীকাহ্গত মাসয়ালা-মাসায়েলের কোন একটির ক্ষেত্রেও গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে না। এ কারণে যে , কোন ফকীহ যখন নিজের ধারণার উপর ভিত্তি করে কোন বিষয়কে কল্যাণকর হিসাবে দেখে অথচ কোরআন ও হাদীসে যে ব্যাপারে কোন নির্দেশ আসেনি , তাহলে এ ধরণের দলীলে আক্বলীকে আল্লাহর হুকুম হিসাবে বলতে পারেন না। অনুরূপভাবে ধারণা প্রসূত কিয়াসের আশ্রয় নেয়া শারীয়াতের হুকুম- আহ্কাম নির্ণয়ের জন্যে আমাদের নিকট বৈধ নয়। কিন্তু মানুষ যেসব ক্ষেত্রে দৃঢ়তা অর্জন করবে , যেমন জুলুম করা , মিথ্যা কথা বলা , চুরি করা , খিয়ানত করা ইত্যাদি পর্যায়ে আক্বলের দলীল নির্ভরযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। আর তা এ দাবীর ভিত্তিতে : আক্বল যা হুকুম করে শারীয়াতের নির্দেশ ও তাই তথা আক্বল শারীয়াতের হুকুমেরই বর্ণনাকারী।

প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে এই যে , আমরা হুকুম-আহ্কাম ও বিধি-বিধান সম্পর্কে মুকাল্লাফদের (যাদের উপর শারীয়াতের হুকুম পালন অপরিহার্য কর্তব্য) প্রয়োজনের ক্ষেত্রে তাদের ইবাদতগত , রাজনৈতিক , অর্থনৈতিক ও সমাজনৈতিক বিষয়াবলীর পর্যায়ে রাসূলে আকরাম (সাঃ) ও মা সুম ইমামগণের কাছ থেকে যথেষ্ট পরিমান হাদীস ও বর্ণনা আমাদের হাতে রয়েছে। কাজেই এ জাতীয় ধারণা জনিত দলীল-প্রমাণের আশ্রয় নেয়ার প্রয়োজন আছে বলে আমরা দেখতে পাই না। এমনকি আমরা বিশ্বাস করি যে , কালের আবর্তনের কারণে নব উদ্ভাবিত বিষয়াবলীর হুকুম-আহ্কাম বের করার জন্য কোরআন ও রাসূল (সাঃ) এবং মা সুমগণের হাদীস ও বর্ণনাগুলোতে মূলনীতি ও সামগ্রিক দিকগুলো বর্তমান রয়েছে-যা আমাদেরকে ধারনা জনিত দলীল-প্রমাণ থেকে অমুখাপেক্ষী করে দেয়।