জিহাদ আল আকবার : নফসের সাথে যুদ্ধ

জিহাদ আল আকবার : নফসের সাথে যুদ্ধ0%

জিহাদ আল আকবার : নফসের সাথে যুদ্ধ লেখক:
: নূরে আলম মাসুদ।
প্রকাশক: -
বিভাগ: চরিত্র গঠনমূলক বই

  • শুরু
  • পূর্বের
  • 16 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 10234 / ডাউনলোড: 2527
সাইজ সাইজ সাইজ
জিহাদ আল আকবার : নফসের সাথে যুদ্ধ

জিহাদ আল আকবার : নফসের সাথে যুদ্ধ

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

অধ্যায়

অনুবাদকের মুখবন্ধ

নিউ ইয়র্ক সিটির ওয়েস্ট ব্রডওয়েতে তুর্কি সুফিদের এক বইয়ের দোকান আছে। 1993 সালের গ্রীষ্মকালে সেখান থেকে কিছু বই কিনেছিলাম আমি। সেখানেরই একজন কাস্টমার গায়ের রং কৃষ্ণবর্ণ , মাথায় ছোট সাদা টুপি আমার সাথে কথা বলা শুরু করলো। সালাম বিনিময়ের পর যখন বললাম যে আমি ইরানে কাজ করতাম , তখন সে জিজ্ঞাসা করলো আমি ইমাম খোমেইনীর জিহাদ আল আকবার নামক বইটা কখনো দেখেছি কিনা। তাকে বললাম যে যদিও আমি বইটি দেখিনি , আমার ধারণা হামিদ আলগার এটি অনুবাদ করেছেন তার অনুদিত ইমামের বক্তৃতাসমগ্রে ( Islam and Revolution, by Mizan Press)।সে ঐ বইটি পড়েনি , কিন্তু জোর দিয়ে বললো যে আমেরিকান মুসলিমদের মাঝে ইমামের লেখার খুব চাহিদা আছে , আর বিশেষভাবে জিহাদ আল আকবার বইটার ব্যাপারে তার আগ্রহ বেশি। বাসায় যাবার পর দেখলাম নাজাফে দেয়া ইমামের যেসব বক্তৃতা নিয়ে জিহাদ আল আকবার প্রকাশ করা হয়েছে , তার কিছু প্রফেসর আলগার অনুবাদ করেছেন।

এরপর শরৎকালে যখন ইরানে ফিরলাম , দেখলাম যে ছোট পুস্তিকা আকারে জিহাদ আল আকবার পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে। সুফি বইয়ের দোকানের সেই মুসলিমের কথা খেয়াল করে আমি পুরো বইটা অনুবাদ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ফার্সি ভাষায় প্রয়োজনীয় দক্ষতা না থাকায় বুনিয়াদ বাক্বির আল-উলুম , কোম এ আমার সহপাঠী ও সহ-অনুবাদকারী আযিম সারভ্দালির শরণাপন্ন হলাম। তিনি প্রজেক্টটি পেয়ে খুব খুশি হলেন এবং বুনিয়াদের উৎসাহে পরবর্তী জুনে কাজটি সমাপ্ত হলো : আলহামদুলিল্লাহ !

এই বইটি নৈতিকতার উপরে লেখা , ফার্সি এবং আরবীতে যাবে বলে আখলাক্ব। এটা কোনো দার্শনিক কাজ নয় , বরং নাজাফের মাদ্রাসার (হাওজা-এ-ইলম) ছাত্রদেরকে নৈতিকতায় উদ্বুদ্ধ করার এক প্রচেষ্টা। এই বইয়ে ইমাম খোমেইনীর নৈতিক সংবেদনশীলতা ফুটে উঠেছে , প্রকাশ পেয়েছে মাদ্রাসার প্রতি নিষ্ঠা ও পিতৃসুলভ শঙ্কা। এতে পাঠক ইমামের বৈপ্লবিক চেতনা ও বিদেশী সাম্রাজ্যবাদীদের প্রতি ঘৃণার পাশাপাশি আবিষ্কার করবে স্রষ্টার ধ্যানে ধ্যানমগ্ন এক ব্যক্তির আধ্যাত্মিক নিষ্ঠা। ইমাম খোমেইনীর চিন্তাধারার গভীরে ইরফানী (আধ্যাত্ম্যবাদ) প্রবাহ বিদ্যমান , যা তাঁর নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে গড়ে তুলেছে। ইরফান এবং নৈতিকতা উভয়েই চরিত্রের উন্নতি সাধন নিয়ে কাজ করে , কিন্তু ভিন্ন পারস্পেক্টিভ থেকে শহীদ মুতাহহারির এই মন্তব্যের প্রমাণ হলো এই বইটি। নৈতিক শিক্ষায় থাকে দোষ-গুণের বর্ণনা , আদেশ-নিষেধ ইত্যাদি ; অপরদিকে ইরফানি শিক্ষায় থাকে এমনসব পদ্ধতির বর্ণনা , যার মাধ্যমে মানুষের আত্মা আল্লাহর দিকে এগিয়ে যায় এবং সেই যাত্রায় স্বর্গীয় গুণাবলি অর্জন করে। নৈতিক পরিবর্তন সাধনের যে পথের কথা ইমাম খোমেইনী বলেছেন তা হলো আত্মিক উন্নয়নের এমন এক পথ , যাতে পারদর্শী ব্যক্তি দুনিয়াবি চাওয়া-পাওয়াকে জয় করে , অতঃপর এতে (দুনিয়াবি বিষয়ে) নিস্পৃহ হয়ে গিয়ে আল্লাহর প্রতি সম্পূর্ণরূপে নিবেদিত হয়ে যায়। এই পথকে আল্লাহর দিকে যাত্রা হিসেবে অভিহিত করা হয় , ইরফানে যা কেন্দ্রীয় আসন দখল করে আছে , এবং যাকে ইসলামের মূল-ও বলা যেতে পারে। সুফিদের কবিতায় এই যাত্রাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বর্ণনা করা হয়েছে ; বর্ণনা করা হয়েছে মোল্লা সদরা-এর অসাধারণ দর্শনে , এবং ইমাম খোমেইনীর কবিতা ও শিক্ষাতেও।

যদিও এই বইটি নাজাফের ছাত্রদের উদ্দেশ্যে দেয়া ব্ক্তব্যের সংকলন , কিন্তু এতে যে নৈতিক উপদেশ দেয়া হয়েছে তা সমসাময়িক বিভেদ ও বিভ্রান্তির পরিস্থিতিতে মুসলমানদের জন্য প্রাসঙ্গিক। ইমাম খোমেইনী মাদ্রাসা ছাত্রদেরকে তাদের ঝগড়া-বিবাদ পরিত্যাগ করতে বলেছেন : তাদের ঝগড়া-বিবাদ কেবল ইসলামের শত্রুদের হাতে আমাদের ক্ষতি করার সুযোগ-ই তুলে দেয়। বর্তমান ইসলামী দুনিয়ায় আমরা লক্ষ্য করি যে ইসলামী আন্দোলনের শত্রুরা মুসলিমদের এই বিভেদের সুযোগ নিচ্ছে। ইমাম খোমেইনী ছাত্রদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে , তাদের এত বেশি সম্পদ ও ক্ষমতাও নেই যে , এমনকি বস্তুবাদী মানদণ্ড অনুযায়ীও এসব ঝগড়া-বিবাদ করার কোনো অর্থ থাকবে। উম্মাহর মাঝে ব্যাপক দারিদ্র্য ও ক্ষমতাহীনতার কারণে সামগ্রিকভাবে মুসলিম বিশ্বের জন্যও একই মন্তব্য প্রযোজ্য। নবী ও ইমামগণের মূল লক্ষ্য ছিলো আত্মিক অভিযাত্রা ও নৈতিক উন্নতি , এবং কেবল ইসলামী শরীয়ার কিছু টার্ম শেখায় নিজেদের সন্তুষ্ট করলে চলবে না , ছাত্রদেরকে এই দিকে মনোযোগ দিতে বলেছেন ইমাম। এযুগের মুসলমানদেরও এই সতর্কবানীকে গুরুত্ব দেয়া উচিত। কেবলমাত্র গুটিকয়েক স্লোগান ও কিছু ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায় আমাদের সন্তুষ্ট হওয়া উচিত নয় , বরং আত্মিক ও নৈতিক অগ্রগতির জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। কেবল নাজাফের মাদ্রাসায় নয় , বরং যেখানেই হোক এবং যাকেই ইসলামের শিক্ষা দেয়া হোক , সেই শিক্ষাকে শুধুমাত্র মৌলিক বিশ্বাস ও প্রয়োজনীয় প্র্যাকটিসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত হবে না , বরং সাথে সাথে নৈতিক ও আত্মিক শিক্ষাও দিতে হবে , যা ছিলো নবী ও ইমামগণের প্রধান মনোযোগের বিষয়।

এই বইটাকে বিভিন্ন পারস্পেক্টিভ থেকে পড়া যেতে পারে। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের প্রতিষ্ঠাতার চিন্তাধারার গভীরে প্রবেশ করতে এই বইটা পড়া যেতে পারে। পড়া যেতে পারে তৎকালীন নাজাফের সমস্যাগুলির সাথে পরিচিত হতে। এ বইটা পড়া যেতে পারে এযুগের শ্রেষ্ঠ শিয়া শিক্ষকদের প্রচারিত নৈতিক শিক্ষার উদাহরণ হিসেবে। ইতিহাস , সমাজতত্ত্ব অথবা নৃতত্ত্ব সম্পর্কে কিছু জানতে এই বই পড়া যেতে পারে ; এসব ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা অর্জন করা যেতে পারে। কিন্তু এগুলোর যেকোনোটার চেয়েই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো মুসলিম কমিউনিটি থেকে পাওয়া নৈতিক শিক্ষা। আমরা যেনো নৈতিক সংস্কারকে উপেক্ষা করে কেবল আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব পালনে নিজেদের সন্তুষ্ট না রাখি। আমরা যেনো ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নৈতিক পথপ্রদর্শক নিযুক্ত করি , যাতে এগুলো সত্যিকার অর্থেই আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পনের প্রশিক্ষণকেন্দ্র হয়ে ওঠে। এবং আমরা যেনো নবী ও ইমামগণের শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে আল্লাহর দিকে মুমিনের যাত্রা শুরু করতে পারি , ইন-শা-আল্লাহ !

এই ভূমিকার বাকিটুকু হলো ইমাম খোমেইনীর জীবনী ও তার উপর কিছু মন্তব্য , বিশেষত তাঁর নৈতিক ও আত্মিক প্রশিক্ষণের উপরে আল্লাহ তাঁকে শান্তিতে রাখুন।

ইরানের রাজধানী তেহরান ও তার দক্ষিণ-পশ্চিমের আহওয়ায শহরের মাঝামাঝি অবস্থিত খোমেইন প্রদেশে 1902 সালে রুহুল্লাহ মুসাভি খোমেইনীর জন্ম হয়। যখন তাঁর ছয় মাস বয়স , তখন পিতা আয়াতুল্লাহ মুস্তাফা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাতে শহীদ হন। তাঁর মা 'হাজার ' ছিলেন ইসলামী স্কলার আক্বা মির্জা আহমাদ মুজতাহিদ খুআনসারি-র মেয়ে। বালক অবস্থায় তাঁকে বড় করেন তাঁর মা ও ফুফু , যারা তাঁর ছয় বছর বয়সের সময় কলেরায় মারা যান। এরপর তিনি বড় ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে পড়াশুনা করেন। উনিশ বছর বয়সে খোমেইন প্রদেশের উত্তর-পশ্চিমে আরাক নগরীতে গমন করেন রুহুল্লাহ , এবং সেখানে সেযুগের শীর্ষস্থানীয় ধর্মীয় নেতা শেইখ আবদুল করিম হায়েরী-র ছাত্র হন। পরবর্তী বছরেই ছাত্র রুহুল্লাহ সহ শেইখ হায়েরী কোম নগরীতে চলে যান এবং সেখানের বিখ্যাত ধর্মীয় শিক্ষা-কেন্দ্রে আমূল পরিবর্তন ও সংস্কার সাধন করেন। 1936 সালে শেইখ হায়েরী-র মৃত্যু পর্যন্ত কোমে পড়াশুনা করেন রুহুল্লাহ। এরপর তিনি নিজেই ধর্মতত্ত্ব , নৈতিকতা , দর্শন ও রহস্যজ্ঞানের উপর শিক্ষকতা শুরু করেন। আয়াতুল্লাহ খোমেইনী কোম-এ তাঁর জীবনের প্রথম চল্লিশ বছরে পরস্পর জড়িত দর্শন ও আধ্যাত্মিক রহস্যজ্ঞানের ( mysticism)সাথে পরিচিত লাভ করেন , যার স্ফূরণ ঘটেছিলো ইরানের সাফাভি শাসনকালে (ষোড়শ থেকে সপ্তদশ শতকে)। এই দর্শন এখন পর্যন্ত সমকালীন শিয়া চিন্তাধারায় ব্যাপক প্রভাব রেখে চলেছে।

কোমে আগমনের পর ইমাম খোমেইনী নৈতিকতা বিষয়ে আয়াতুল্লাহ মির্জা জাওয়াদ মালেকি তাবরিজির কাছে ব্যক্তিগতভাবে ক্লাস করা শুরু করেন। তিনি ছিলেন সুবিখ্যাত আশর আস-সালাত (নামাজের রহস্য) বইয়ের লেখক। নামাজের রহস্য নিয়ে ইমাম খোমেইনীও বই লিখেছিলেন : সির আস-সালাত : সালাত আল 'আরেফিন ইয়া মি 'রাজ আল-সালিকিন । 1925 সালে মির্জা জাওয়াদের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইমাম তাঁর নিকট শিক্ষা গ্রহণ করেন। মির্জা আবুল হাসান রাফিয়ী কাযভিনি কোমে থাকাকালীন (1923-1927) সময়ে তাঁর কাছেও আধ্যাত্মিক শিক্ষা গ্রহণ করেন ইমাম। রমজান মাসের ফজরের পূর্বে বহুল পঠিত একটি দোয়ার ব্যাখ্যার জন্য জনাব কাযভিনি বিখ্যাত। পরবর্তীতে ইমাম খোমেইনীও এই দোয়ার উপরে ব্যাখ্যা লেখেন। তাঁর আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শকদের মাঝে সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন রাশাহাত আল বাহার এর লেখক আক্বা মির্জা মুহাম্মাদ আলী শাহাবাদী , যিনি 1928 থেকে 1935 সাল পর্যন্ত কোমে ছিলেন। তাঁর এই আধ্যাত্মিক কাজ , সমুদ্রের ছাঁট কে ( spray from the sea রাশাহাত আল বাহার) তুলনা করা যেতে পারে স্রষ্টার পক্ষ থেকে অনুপ্রেরণার সাথে। বলা হয় যে শাহাবাদীর কাছেই ইমাম খোমেইনী ইবন আল আরাবীর (1240 খ্রি:) ফুসুস আল হিকাম (প্রজ্ঞার প্রান্তে) এবং এর উপরে ক্বায়সারী এর ব্যাখ্যা (1350 খ্রি:) নিয়ে অধ্যয়ন করেছিলেন।

1929 সালে ইমাম খোমেইনী বিয়ে করেন এবং এক বছর পর তাঁর প্রথম ছেলে মুস্তাফার জন্ম হয়। পরবর্তীতে তাঁর আরও দুই ছেলে ও চার মেয়ের জন্ম হয় (সংশোধন : মোট তিন ছেলে ও পাঁচ মেয়ে ছিলো ইমামের , যাদের মাঝে এক ছেলে ও দুই মেয়ে জন্মের পর মারা যায় বাংলা অনুবাদক)। পরবর্তীতে ইরাকে থাকাকালীন সময়ে তাঁর বড় ছেলে মুস্তাফা শাহের এজেন্টদের হাতে শহীদ হন। ছোট ছেলে সাইয়্যিদ আহমাদ প্রথমে তাঁর পিতার সহকারী ও পরবর্তীতে রাজনৈতিক নেতা হন।

অধ্যাত্মবাদ ও দর্শনশাস্ত্রের প্রতি কোমের যে বৈরী মনোভাব ছিলো , কোমের ছাত্রাবস্থার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ইমাম খোমেইনী নিজেই তা নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করেছেন। এখনও সেখানে কেউ কেউ এজাতীয় বৈরী মনোভাব লালন করে থাকে। (এ প্রসঙ্গে) প্রায়ই একটা ঘটনা বলা হয়। তখন ইমাম কোমে কেবল দর্শন পড়ানো শুরু করেছেন , তাঁর প্রথম ছেলে যখন ছোট। এমন সময় একদিন ইমামের ছেলে যে পেয়ালা থেকে পানি পান করেছিলো সেটা ব্যবহারের আগে মাদ্রাসার কয়েকজন ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা মনে করে পেয়ালাটা ধুয়ে নিয়েছিলো , কারণ তাতে এক অপবিত্র ছেলে পানি পান করেছে , যেহেতু তার পিতা দর্শনের শিক্ষক ! ইমাম বলেছেন যে তাঁর শিক্ষক শাহাবাদী এই বৈরিতার বিরোধিতা করেছিলেন মানুষকে আধ্যাত্মিক মতাদর্শের সাথে পরিচিত করানোর মাধ্যমে , যেনো তারা নিজেরাই বুঝতে পারে যে অধ্যাত্মবাদের সাথে ইসলামের বৈরিতা নেই। ইমাম বলেন : একবার মরহুম শাহাবাদীর (র.) কাছে একদল ব্যবসায়ী এসেছিলো , আর তিনি তাদের সাথে সেই একই আধ্যাত্মিক বিষয়ে কথা বলা শুরু করলেন , যেটা সবাইকে শিক্ষা দিতেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম যে তাদের সাথে এসব বিষয়ে কথা বলা উপযুক্ত হচ্ছে কিনা। তিনি জবাব দিলেন : তাদেরকে একবারের জন্য হলেও এই বিপ্লবী শিক্ষার সাথে পরিচিত হতে দাও ! মানুষকে বিভিন্ন ক্যাটেগরিতে ফেলে কাউকে কাউকে এসব বোঝার অযোগ্য বলাকে আমি নিজেও এখন অনুচিত মনে করি।

অধ্যাত্মবাদকে সর্বসাধারণের সামনে নিয়ে আসার জন্য ইমাম খোমেইনীর অন্যতম বিস্ময়কর প্রচেষ্টা ছিলো ইসলামী বিপ্লবের পরে সূরা আল ফাতিহার উপরে দেয়া তাঁর লেকচার। সেখান থেকেই উপরের ঘটনাটা উদ্ধৃত করা হয়েছে। বিপ্লবের পরে আয়াতুল্লাহ তালেক্বানি টেলিভিশনে কুরআনের তাফসির করতেন। বিপ্লবের প্রায় অর্ধবছর পর 10ই সেপ্টেম্বর 1979 সালে আয়াতুল্লাহ তালেক্বানির মৃত্যু হলে একজন অপেক্ষাকৃত তরুণ স্কলার টেলিভিশনে কুরআন তাফসিরের দায়িত্ব নেন। ইমাম খোমেইনী টিভি প্রোগ্রামটির জন্য অপেক্ষাকৃত সিনিয়র কাউকে নেয়ার প্রস্তাব দেন। টিভি ব্রডকাস্টের দায়িত্বে থাকা লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলেন যে ইমামকেই দায়িত্ব নিতে অনুরোধ জানাবেন। জবাবে ইমাম জানালেন যে তাঁর ঘরে ক্যামেরা ইত্যাদি নিয়ে এলে তিনি অনুরোধ রক্ষা করবেন। ফলস্বরূপ পাওয়া গেলো সূরা আল ফাতিহার উপর এক লেকচার : কুরআনের শুরুর আয়াতগুলির এক বিস্ময়কর আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা , যার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দাবী ছিলো যে গোটা দুনিয়া-ই আল্লাহর একটি নাম। এই লেকচারগুলোতে ইমাম আরো যুক্তি দেখান যে , ইসলামের দার্শনিকগণ , আধ্যাত্মিক সাধক এবং কবিগণ একই অন্তর্নিহিত বক্তব্য প্রকাশের জন্য বিভিন্ন টার্মিনোলজি ব্যবহার করেছেন। এবং তিনি দর্শকদের প্রবলভাবে অনুরোধ জানিয়েছেন যেনো না বুঝে এসব ব্যক্তিদের শিক্ষাকে প্রত্যাখ্যান না করা হয় , এমনকি যদিও তাদের ভাষা প্রচলিত মতাদর্শের বিপরীতে বলে সন্দেহ হয়। এভাবে , এই অঙ্গনে ইমামের শিক্ষা মূলত ছিলো সহনশীলতার অনুরোধ।

সহনশীলতার উপরে ইমামের জোর দেয়া কেবল অধ্যাত্ম ও কবিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো না। ইমাম খোমেইনীর ইসলামী শরীয়ার শিক্ষক শেইখ হায়েরী ছিলেন কোমে আয়াতুল্লাহ বুরুজারদীর উত্তরসুরী , যিনি এই বিষয়ের সর্বোচ্চ অথরিটি হিসেবে বিবেচিত হতেন। 1961 সালে আয়াতুল্লাহ বুরুজারদীরর মৃত্যুর পর ইমাম খোমেইনী ইসলামী শরীয়ার অন্যতম সর্বোচ্চ বিশেষজ্ঞ (মারজা-ই-তাক্বলিদ) হিসেবে পরিচিত লাভ করেন। এই পদলাভ করে ইমাম খোমেইনী বেশ কয়েকটি ফতোয়া জারি করেন , যেটাকে অধিকতর রক্ষণশীল আলেমগণ সন্দেহের চোখে দেখেন। শিয়া-সুন্নি উভয় ধারার শরীয়াতেই মিউজিক ও দাবা খেলাকে হারাম বলে ফতোয়া দেয়া হয়েছে। ইমাম খোমেইনী বলেন যে কয়েক ধরণের মিউজিক অনুমোদনযোগ্য , এবং দাবা খেলাও ইসলামী আইনের পরিপন্থী নয়। ফলস্বরূপ বিপ্লবের পর থেকে ঐতিহ্যবাহী ইরানী সঙ্গীত চর্চার উন্নতি ঘটে। অধিক রক্ষণশীল শরীয়া বিশেষজ্ঞদের অসন্তুষ্টির মুখেই ইমাম খোমেইনী সমাজে অধিক বিষয়ে ভূমিকা রাখার জন্য নারীদেরকে উৎসাহ দেন।

পশ্চিমা পর্যবেক্ষকদের কাছে এটা ধাঁধার মত লাগে যে , যেই একই ব্যক্তি কট্টর ধর্মীয় মতের বিপরীতে দর্শন , অধ্যাত্ম , কবিতা ও মিউজিকের ব্যাপারে সহনশীলতার প্রচার করে , সেই একই ব্যক্তি কিনা ওয়েস্টার্নাইজেশনের প্রবক্তাদের প্রতি এত অসহনশীল। অসহনশীল পিপলস মুজাহিদীন অর্গানাইজেশন অব ইরান ( PMOI)এর ইসলামের নামে প্রচারিত মার্কসবাদের প্রতি। অসহনশীল সালমান রুশদীর মত মানুষদের প্রতি , যারা ইসলামের নবী এবং তাঁর পরিবারকে অসম্মান করে। এই আপাতঃ বৈপরীত্য দূর হয়ে যায় যখন উপলব্ধি করা যায় যে , ইমাম খোমেইনী সহনশীলতাকে কেবলমাত্র সহনশীলতার জন্যেই গুরুত্ব দিতেন তা নয় , বরং তিনি সহনশীলতাকে গুরুত্ব দিতেন ইসলামের জন্যে। ইমাম খোমেইনীর ইসলামী দর্শনের কেন্দ্রে আছে অধ্যাত্ম , ইরফান। সুন্নী ধারায় ইসলামের বাহ্যিক ও আত্মিক দিককে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আলাদা করে রাখা হয়েছে , বিশেষত আত্মিক দিককে সুফি ধারার মাঝে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। অপরদিকে প্রতিষ্ঠিত শিয়া আলেমগণের একটা বড় অংশ কর্তৃক সুফিদের অনেক শিক্ষা ও চর্চাকে ধর্মীয় জীবন ও চিন্তায় আত্মস্থ করে নেয়ার এক দীর্ঘ ঐতিহ্য ধারায় আছে। এই ধরণের আধ্যাত্মিক চর্চা , বা অধ্যাত্মবাদ উৎসরিত হয়েছে ইবনুল আরাবীর সুফি তত্ত্ব , সদর উদ্দিন শিরাজী (1640 খ্রি) ও হাজী সাবযাওয়ারীর (1878 খ্রি.) দার্শনিক অধ্যাত্মবাদ , (যারা উভয়েই শিয়া আলেম ছিলেন) এবং মৌলভী জালাল উদ্দিন রূমী (1273 খ্রি) ও হাফিজের (1391 খ্রি.) আধ্যাত্মিকতার কাব্যিক বহিঃপ্রকাশ থেকে। এসব কবিতাকে প্রায়ই গান ও সূরে রূপ দেয়া হয়ে থাকে। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক প্রতিরোধের সম্মুখীন হওয়ায় ইরফানের চর্চাকারীরা প্রায়ই এই শিক্ষাকে গোপন রাখতে বাধ্য হয়েছে। ইমাম খোমেইনীর শিক্ষক শাহাবাদী যে ধরণের আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন , সে অনুযায়ী ইমাম খোমেইনী এমন পদ্ধতি অবলম্বন শুরু করলেন , যার মাধ্যমে ইরফান প্রকাশ্যরূপ লাভ করতে পারে। এই পথ কোনো আকস্মিক বিপ্লবের পথ ছিলো না। ইরফানের উপর তাঁর নিজের কাজই (বই) তাঁর জীবদ্দশায় খুব একটা প্রচারিত ছিলো না। কিন্তু শিয়া চিন্তাধারার আধ্যাত্মিক বিষয়গুলোর উপর যে জোর দেয়া হয়েছে , তা তাঁর রাজনৈতিক ঘোষণাগুলোর মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে , যেগুলো এই জিহাদ আল আকবার -এও পাওয়া যেতে পারে।

ইমাম খোমেইনীর নেতৃত্বে পরিচালিত বৈপ্লবিক ইসলামী আন্দোলনকে দেখা যেতে পারে ইসলামী অধ্যাত্মবাদকে প্রকাশ্যে আনার তাগিদের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে। ইসলামী বিপ্লবটা ছিলো ইসলামকে প্রকাশ্য জনজীবনে নিয়ে আসার উপায় : যেই ইসলামকে শাহের আমলে অবদমিত করে রাখা হয়েছিলো। অধিকতর রক্ষণশীল আলেমগণ ইসলামকে জনজীবনের কেন্দ্রে নিয়ে আসার পদ্ধতিটির বিরোধিতা করেছিলেন , কারণ তারা এই আন্দোলনকে দেখেছিলেন ইসলামী ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুতি হিসেবে। বিপরীতে ইমাম খোমেইনী যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে , ইসলামী শাসনকে বজায় রাখার জন্য আইনের প্রচলিত ধারণাকে পরিবর্তন করার এখতিয়ার সর্বোচ্চ ফকীহ (রাহবার) এর আছে।

রক্ষণশীলগণ বিরোধিতা করেছিলেন এই বলে যে ঐতিহ্যের যেকোনোরূপ ভঙ্গ-ই ইসলামী ধারা থেকে বিচ্যুতি ঘটাবে। ইমাম খোমেইনীর পরিকল্পিত ইসলামী সরকারের যে ধরণের নেতৃত্বের প্রয়োজন , তা ইসলামী আইনশাস্ত্রের প্রচলিত ধারার আলোচনারও উর্ধ্বে। বরং এটা এক প্রকার প্রজ্ঞা , যা কেবল বিশুদ্ধ মানব অর্থাৎ ইনসান কামিলের কাছ থেকেই আশা করা যায় , যার লক্ষ্য হলো আধ্যাত্মিক চর্চার মাধ্যমে ব্যক্তিগত উন্নতি।

রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তাঁর যে সহনশীলতা , যা কিনা অধিকতর রক্ষণশীল আলেমগণের মাঝে যা ছিলো না , তা পাওয়া যেতে পারে সুন্নি ইসলামের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির মাঝে। প্রচলিত শিয়া মহলে সুন্নির নেতৃত্বে নামাজে দাঁড়ানোর অনুমতি নেই। ইমাম খোমেইনী এ ধরণের নামাজকে বৈধ ঘোষণা করেন এবং নিজেও প্রকাশ্যে সুন্নী আলেমের নেতৃত্বে নামাজ আদায় করেন।

ইসলামে স্বাধীন চিন্তার যে দিকগুলো আছে , ইমাম খোমেইনীর চরিত্রের নমনীয়তা ও সহনশীলতার উৎস সেটা ছিলো না ; বরং এই নমনীয়তা ও সহনশীলতা ছিলো ইসলামকে অভ্যন্তরীণ দিক থেকে বাহ্যিক দিকে নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি। এমন এক আন্দোলন , যা একইসাথে ইসলামী আইনের বাস্তবায়ন ও আধ্যাত্মিক ধ্যান ধারণার প্রচার করে।

আধ্যাত্মিকতা ও পলিটিক্সের প্রতি ইমাম খোমেইনীর দৃষ্টিভঙ্গি খুব ভালো বোঝা যায় প্রেসিডেন্ট গর্বাচেভকে তাঁর ইসলামের দাওয়াত দেওয়া থেকে। 3রা জানুয়ারি , 1998 সালে ইমাম খোমেইনী মস্কোতে এক ডেলিগেশন প্রেরণ করেন , যার নেতৃত্বে ছিলেন আয়াতুল্লাহ জাওয়াদী আমুলি , যিনি ইমামের দাওয়াতের চিঠি গর্বাচেভকে পৌঁছে দেন। কমিউনিজমের ব্যর্থতা স্বীকার করে নেবার জন্য গর্বাচেভকে ইমাম খোমেইনী তাঁর চিঠিতে স্বাগত জানান , এবং কমিউনিস্ট আদর্শের বিপরীতে ইসলামের প্রস্তাবিত দর্শনকে বিবেচনা করে দেখার পরামর্শ দেন। রুশ নেতাকে ইসলামের সাথে পরিচিত করানোর জন্য ইমাম খোমেইনী দার্শনিক ফারাবী ও ইবনে সিনা , এবং আধ্যাত্মিক সাধক ইবনুল আরাবীর লেখা পড়ার পরামর্শ দেন। রক্ষণশীল আলেমগণ রাগান্বিত হয়েছিলেন যে ইমাম খোমেইনী ইসলামী আইনশাস্ত্র ও প্রচলিত ভক্তিমূলক সাহিত্যের পরিবর্তে ইসলামী চিন্তাধারাকে সুফি ও দার্শনিকদের কাজের মাধ্যমে (গর্বাচেভের কাছে) প্রকাশ করেছেন। প্রেসিডেন্ট গর্বাচেভ বিনয়ের সাথে ইসলাম গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান , যদিও তিনি বলেন যে সমাজে আধ্যাত্মিকতার গুরুত্ব নিয়ে তিনি ভেবে দেখবেন। গর্বাচেভের জবাব হাঁ-বোধক না হওয়ায় ইমামকে সত্যিই খুব অখুশি মনে হয়েছিলো : ইমামের চিঠির জবাব যখন একজন সোভিয়েত ডেলিগেট তেহরানে ইমাম খোমেইনীর কাছে পড়ে শুনাচ্ছিলেন , তখন ইমাম চিঠিতে প্রকাশিত গর্বাচেভের দৃষ্টিভঙ্গির বারবার সমালোচনা করছিলেন। আলেমগণের সমালোচনা জয় করে এধরণের অপ্রচলিত ডিপ্লোম্যাসি ইসলামী অধ্যাত্ম ও এর প্রচারের প্রতি ইমামের নিষ্ঠা-ই ফুটিয়ে তোলে। ইমাম খোমেইনীর চিন্তাধারায় অধ্যাত্মবাদ ও পলিটিক্সের যে বিরল সমাবেশ ঘটেছিলো , এটা তারও বহিঃপ্রকাশ বটে।

আধ্যাত্মিকতার উপরে ইমাম খোমেইনী বেশ কিছু বই লিখেছিলেন। কিংবা আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের ছোঁয়া আছে , এমন লেখাও পাওয়া যায় তাঁর। শিরোনাম দেখলেই তা বোঝা যায় :

ভোরের আগের দোয়ার ব্যাখ্যা (শরহে আদ-দুআ আশ-শাহার) , গার্ডিয়ানশিপ ও খেলাফতের পথে আলো (মিসবাহ আল-হিদায়াহ আলা আল-খালিফাত ওয়া আল-বেলায়াহ) , আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়া (লিক্বআ ' আল্লাহ) , নামাজের রহস্য: আধ্যাত্মিকদের প্রার্থনা অথবা অভিযাত্রিকের মিরাজ (সির আস-সালাত : সালাত আল-আরেফিন ইয়া মিরাজ আস-সালেকিন) , আল ফুসুস আল হিকাম এর মন্তব্য-ব্যাখ্যা (তালিক্বাত আলা শরহে আল ফুসুস আল হিকাম) , অন্তরঙ্গতার প্রদীপ এর মন্তব্য-ব্যাখ্যা (তালিক্বাত আলা শরহে আল-মিসবাহ আল-উনস) , রাস আল-জালুত নামে রাসূল (সা.) ও ইমাম-চরিতের উপর ব্যাখ্যা ও মন্তব্য-ব্যাখ্যা করে দুটি বই। এবং সূরা আল ফাতিহার উপর লেকচার , যাত্রা এর উপর নোট (হাশিয়েহ আলা আল-আসফার) , নামাজের আদব (আদাব আস-সালাত) , রাসূল (সা.) ও ইমামগণের হাদীসের উপর ব্যাখ্যা (চেহেল হাদীস)।

মারজা-ই-তাক্বলিদ হওয়ার পর পলিটিকাল বিভিন্ন ঘটনা ইমাম খোমেইনীর জীবনের উপর প্রভাব রেখেছে। 1963 সালে স্বৈরশাসনের বিরোধিতাকারী হাজার হাজার লোককে হত্যা করে শাহের বাহিনী। উষ্কানিমূলক বক্তব্য দেয়ার জন্য ইমাম খোমেইনীকে গ্রেফতার করে তেহরানে নিয়ে যাওয়া হয়। পরবর্তীতে ইমাম খোমেইনী পলিটিকাল ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করতে সম্মত হয়েছেন এমন সংবাদ প্রচার করে তাঁকে ছেড়ে দেয়া হয়। বের হয়ে ইমাম খোমেইনী এই কথা অস্বীকার করেন এবং পরবর্তীতে আবারও গ্রেফতার হন। গাড়িতে করে অজানা গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। গাড়ি প্রধান সড়ক ছাড়লে ইমাম খোমেইনী আশঙ্কা করেন যে তাঁকে দূর মরুভূমিতে নিয়ে গুপ্তহত্যা করা হবে। হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছে কিনা তা দেখার জন্য বুকে হাত দিলে তিনি নিজেকে শান্ত দেখতে পেলেন। ইমাম পরবর্তীতে বলেছিলেন যে তিনি কখনোই ভয় পাননি। তাঁকে বিমান চলাচলের একটি ছোট জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয় , যেখানে তাঁকে তুরস্কে নির্বাসনে পাঠানোর জন্য একটি প্লেন অপেক্ষমান ছিলো। পরবর্তী বছরে তাঁর নির্বাসনের জায়গা পরিবর্তন করে দক্ষিণ ইরাকে মাজারের শহর নাজাফে স্থানান্তরিত করা হয়। ইমাম খোমেইনী নাজাফে 14 বছর অবস্থান করেন , এবং জিহাদ আল-আকবার শিরোনামে সংকলিত লেকচারগুলি এই 14 বছরের মধ্যেই দেয়া হয়েছিলো। 1978 সালে আয়াতুল্লাহ খোমেইনীকে বহিস্কার করার জন্য ইরানের শাহ ইরাকের বাথ পার্টির (সাদ্দাম হোসেন এর দল) সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করে। কুয়েত এয়ারপোর্টে আশ্রয় প্রার্থনা করে প্রত্যাখ্যাত হবার পর ইমাম খোমেইনী বলেছিলেন যে প্রয়োজনে তিনি এক এয়ারপোর্ট থেকে আরেক এয়ারপোর্টে ঘুরে ঘুরে জীবন অতিবাহিত করবেন , কিন্তু তবুও চুপ করে থাকবেন না। শেষমেষ তিনি ফ্রান্সে প্রবেশ করার অনুমতি পান , এবং সেখানে প্যারিসের অদূরে নওফেল-এ-শ্যাতু-র এক বাড়িতে থাকেন। 1979 সালের ফেব্রুয়ারিতে বিজয়ীর বেশে তিনি ইরানে ফিরে আসেন এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন।

ইসলামী আচার অনুষ্ঠান পালনের ক্ষেত্রে নিতান্তই সূক্ষ্ম বিষয়ের দিকেও কঠোর মনোযোগ ও সাধারণ জীবনযাত্রার কারণে তিনি সুপ্রশংসিত ও পরম শ্রদ্ধেয়। বলা হয় যে ওজু করার সময় তিনি সর্বদা-ই কিবলামুখী হয়ে থাকতেন। কেনার সময় সবচেয়ে কমদামী জুতা পছন্দ করতেন। যদি তিনি অর্ধেক গ্লাস পানি খেতেন , তাহলে পরে পান করার জন্য বাকিটুকুকে ধুলা থেকে রক্ষা করতে এক টুকরা কাগজ দিয়ে ঢেকে রাখতেন। কেউ কেউ দাবী করে যে দ্বাদশ ইমাম , ইমাম মাহদী (আ.) এর সাথে তাঁর বিশেষ সম্পর্ক ছিলো। ইমাম মাহদী (আ.) প্রতীক্ষিত সেই ব্যক্তি , কেয়ামতের আগে যিনি অবিচারের বিরুদ্ধে লড়বেন। এ দাবীগুলো শিয়া ইসলামের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যেরও অংশ।