জিহাদ আল আকবার : নফসের সাথে যুদ্ধ

জিহাদ আল আকবার : নফসের সাথে যুদ্ধ0%

জিহাদ আল আকবার : নফসের সাথে যুদ্ধ লেখক:
: নূরে আলম মাসুদ।
প্রকাশক: -
বিভাগ: চরিত্র গঠনমূলক বই

  • শুরু
  • পূর্বের
  • 16 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 10233 / ডাউনলোড: 2527
সাইজ সাইজ সাইজ
জিহাদ আল আকবার : নফসের সাথে যুদ্ধ

জিহাদ আল আকবার : নফসের সাথে যুদ্ধ

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

অধ্যায় 6

আত্মিক পবিত্রতা ও পরিশুদ্ধির গুরুত্ব

যারা নিত্য-নতুন ধর্ম তৈরী করেছে , অসংখ্য মানুষকে বিপথগামী করেছে , তাদের বেশিরভাগই স্কলার ছিলো। তাদের কেউ কেউ এমনকি ধর্মশিক্ষাকেন্দ্রে পড়াশুনা করেছে। এমনকি বিভ্রান্ত মাযহাবগুলির একটির প্রতিষ্ঠাতা আমাদেরই মাদ্রাসায় পড়াশুনা করেছে। কিন্তু যেহেতু জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি তার আত্মশুদ্ধি ও আত্মিক পবিত্রতা অর্জনের চেষ্টা ছিলো না , যেহেতু সে আল্লাহর রাস্তায় অগ্রসর হয়নি এবং যেহেতু সে নিজের কলুষ দূর করেনি , সুতরাং সে ধিক্কারজনক অবস্থা বয়ে এনেছে। মানুষ যদি তার আত্মার গভীর থেকে কলুষকে দূর না করে , তাহলে যে শুধু তার সকল পড়াশুনা-ই ব্যর্থ হয়ে যাবে তা নয় , বরং উল্টা তা ক্ষতিকর হবে। যখন এসব শিক্ষাকেন্দ্রে জ্ঞানের ভিতরে শয়তানের প্রবেশ ঘটবে , তখন সেখান থেকে কেবল খারাপ জিনিস-ই বেরিয়ে আসবে : শিকড় , শাখা-প্রশাখাসুদ্ধ এক বিষবৃক্ষ। নোংরা অপরিষ্কার হৃদয়ে এসব দ্বীনি জ্ঞান যত বেশিই জড়ো করা হোক না কেনো , সেটা কেবল অন্তরের উপরে কালো আবরণকেই গভীর করবে। যে আত্মা অপবিত্র , জ্ঞান তার উপরে এক কালো চাদর : আল ইলম হুয়া আল হিজাব আল আকবার (জ্ঞান হলো সবচেয়ে বড় আবরণ)।

তাই , একজন আলেমের নীতিহীনতা ইসলামের যে ক্ষতি করে , আর কারো নীতিহীনতা সে ক্ষতি করতে পারে না। জ্ঞান হলো আলো , কিন্তু কালো দূষিত হৃদয়ে সেটা কেবল অন্ধকার ও কলুষকেই বৃদ্ধি করে। যে জ্ঞান মানুষকে খোদার নিকটবর্তী করে , সেটাই আবার দুনিয়ালোভী মানুষকে সর্বশক্তিমান থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দেয়। এমনকি একত্ববাদ তাওহীদের জ্ঞান সেটাও যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে অর্জিত হয় , সেটা হয়ে যায় অন্ধকার এক আবরণ , কারণ সেটা আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো কিছুতে লিপ্ত হওয়ার জন্যে অর্জিত। কেউ যদি সুপরিচিত চৌদ্দ রকমের সবগুলি উপায়েই পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করে , কিন্তু সেটা যদি আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্যে হয় , তাহলে এই তেলাওয়াত তার জন্য কিছুই বয়ে আনবে না , আল্লাহর থেকে দূরত্ব ও (অন্তরের উপর) আবরণ ছাড়া। তুমি যদি কিছুটা কষ্ট করো , পড়াশুনা করো , তাহলে তুমি আলেম হতে পারবে বটে , কিন্তু জেনে রাখো যে আলেম হওয়া ও পরিশুদ্ধ হওয়ার মাঝে অনেক পার্থক্য আছে।

আমাদের প্রয়াত শিক্ষক শাইখ আবদুল করিম হায়েরী ইয়াযদী (র.) বলেছেন , লোকে বলে : 'মোল্লা হওয়া কতই না সহজ , আর মানুষ হওয়া কতই না কঠিন ' কথাটা আসলে ঠিক নয় । বরং বলা উচিত : 'মোল্লা হওয়া কতই না কঠিন , আর মানুষ হওয়া তো অসম্ভব ! '

পবিত্র মানবীয় গুণাবলী অর্জন করা তোমাদের এক গুরু দায়িত্ব। তোমরা এখন ধর্মতত্ত্ব পড়াশুনায় ব্যস্ত ; শিখছো ফিকাহ , যা খুব সম্মানজনক ব্যাপার মনে কোরো না যে এটা খুব সহজ একটা ব্যাপার , ভেবো না যে তোমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলি এমনি এমনিই পালন হয়ে যাবে। যদি আল্লাহর নিকটবর্তী হবার জন্য খাঁটি নিয়ত না থাকে , তাহলে এসব ধর্মশিক্ষা কোনোই কাজে আসবে না। আল্লাহ মাফ করুন , কিন্তু যদি তোমাদের এই পড়াশুনা আল্লাহর জন্যে না হয় , বরং আত্মতৃপ্তি , পদ-পদবী-ক্ষমতা , সম্মান ইত্যাদির লোভে হয় ; তাহলে তুমি নিজের জন্য ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই উপার্জন করবে না। এইযে এত ধর্মীয় টার্ম শেখা যদি এগুলো আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্যে হয় , তাহলে পুরোটাই ধ্বংস ছাড়া আর কিছু বয়ে আনবে না।

এত ধর্মীয় টার্ম শেখা যদি এর সাথে সাথে আত্মশুদ্ধি ও তাক্বওয়া অর্জন না হয় , তাহলে সেটা মুসলিম কমিউনিটির জন্য এই দুনিয়া ও পরকালে ক্ষতি-ই বয়ে আনবে। কেবলমাত্র কিছু টার্মিনোলজি শেখাটা কাজের নয়। এমনকি একত্ববাদের জ্ঞান (ইলম আত-তাওহীদ) যদি এই জ্ঞানের সাথে সাথে আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জন করা না যায় , তাহলে দুর্দশা ছাড়া আর কিছুই আসবে না। দুনিয়ায় কত মানুষ তাওহীদের জ্ঞান নিয়ে আলেম হয়েছে এবং অসংখ্য মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে ! তোমাদের যেই জ্ঞান আছে , আরো কত মানুষের এই একই জ্ঞান ছিলো , এমনকি হয়তো বেশিও , কিন্তু তারা পথচ্যুত ছিলো , নিজেদের সংস্কার করেনি ; সুতরাং যখন তারা সমাজে (আলেম পরিচিতি সহকারে) প্রবেশ করলো , তখন অসংখ্য মানুষকে নষ্ট করলো , বিভ্রান্ত করলো।

এই নিষ্প্রাণ ধর্মীয় টার্মিনোলজি , যদি এর পাশাপাশি তাক্বওয়া ও আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জন না হয় , তাহলে যত বেশি এসব ধর্মীয় জ্ঞান একজনের মাথায় ঢুকবে , ততই তার অহংকার বেড়ে যাবে। যেই হতভাগ্য আলেম নিজের অহংকারের কাছে পরাজিত হয়েছে , সে নিজের কিংবা সমাজের সংস্কার করতে পারে না ; এবং এর ফলাফল হিসেবে আসবে কেবলই ইসলাম ও মুসলমানদের ক্ষতি। বছরের পর বছর ধর্মীয় ফান্ডের টাকা নষ্ট করে পড়াশুনা করে , বেতন-ভাতা ইত্যাদি নিয়ে সে ইসলাম ও মুসলমানের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। জাতি তাদের দ্বারা বিভ্রান্ত হবে। মাদ্রাসায় এতসব আলোচনা , ক্লাস ইত্যাদি তখন প্রকৃত ইসলামের দুনিয়ায় প্রবেশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে , বাধা হয়ে দাঁড়াবে কুরআনের জ্ঞানার্জনের পথে : উপরন্তু এটাও সম্ভব যে তার (কলুষিত আলেমের) উপস্থিতি-ই সমাজকে ইসলাম ও আধ্যাত্মিকতা জানার পথে বাধা সৃষ্টি করবে।

আমি পড়াশুনা করতে নিষেধ করছি না , বলছি না যে তোমাদের জ্ঞানার্জনের প্রয়োজন নেই ; বরং তোমাদের সতর্ক থাকতে হবে ; কারণ যদি তোমরা সমাজের কাজে লাগতে চাও , ইসলামের জন্য কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে চাও , জাতিকে ইসলামের ব্যাপারে সচেতন করতে চাও , ইসলামের মৌলিক আক্বীদাকে রক্ষা করতে চাও , তাহলে ইসলামী আইনের মৌলিক জ্ঞানের ভিত্তি খুব দৃঢ় হতে হবে , এ বিষয়ে তোমাদের দক্ষতা অর্জন করতে হবে। আল্লাহ না করুন তোমরা যদি সে জ্ঞান অর্জন করতে ব্যর্থ হও , তাহলে মাদ্রাসায় থাকার কোনো অধিকার তোমাদের নেই। (সেক্ষেত্রে) তোমরা ধর্মশিক্ষার ছাত্রদের জন্য নির্ধারিত ভাতা গ্রহণ করতে পারবে না। অবশ্যই জ্ঞান অর্জনের দরকার আছে। ফিকাহ ও উসুল শিক্ষায় তোমরা যেমন কষ্ট করো , তেমনি নিজের সংস্কারের জন্যও কষ্ট করতে হবে। জ্ঞানার্জনের পথে নেয়া প্রতিটা পদক্ষেপের সাথে সাথে প্রবৃত্তির দমনের পথেও একটি করে পদক্ষেপ নিতে হবে : প্রবৃত্তিকে দমন করতে হবে আধ্যাত্মিক ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য , মহৎ চারিত্রিক গুণাবলী অর্জনের জন্য , আধ্যাত্মিকতা ও তাক্বওয়া অর্জনের জন্য।

ফিকাহ , উসুল ইত্যাদি বিষয় শিক্ষা করাটা হলো আত্মিক পরিশুদ্ধি , পবিত্র গুণাবলী , আচরণ ও ঐশী জ্ঞান অর্জনের সূচনা। গোটা জীবনটা কেবল সূচনায় পড়ে থেকো না যাতে তোমরা সমাপ্তিটা ভুলে যাও। তোমরা এসব জ্ঞান অর্জন করছো এক সুউচ্চ পবিত্র লক্ষ্য অর্জনের জন্য : খোদাকে জানা এবং নিজেকে বিশুদ্ধ করা। তোমাদের কাজের ফলাফল ও প্রভাব উপলব্ধি করার জন্য প্ল্যান করা উচিত , সেইসাথে মৌলিক লক্ষ্য অর্জনের ব্যাপারে সিরিয়াস হওয়া উচিত।

যখন তোমরা মাদ্রাসাজীবন শুরু করো , তখন আর সবকিছুর আগে নিজেকে সংস্কারের পরিকল্পনা করা উচিত। মাদ্রাসায় থাকাকালীন সময়ে পড়াশুনার পাশাপাশি নিজেদের বিশুদ্ধ করা উচিত , যাতে তোমরা যখন মাদ্রাসা ছেড়ে গিয়ে কোনো শহর বা জেলার ইমাম হও , তারা যেনো তোমার দ্বারা লাভবান হতে পারে , তোমার কাছ থেকে উপদেশ নিতে পারে , এবং তোমার নৈতিক গুণাবলী , আচরণ , কর্ম ইত্যাদি দেখে যেনো তারা নিজেদেরকে বিশুদ্ধ করতে পারে। মানুষের মধ্যে প্রবেশ করার আগে নিজেকে সংস্কার করার চেষ্টা করো। এখন , যখন তোমাদের সময়-সুযোগ আছে , এখন যদি তোমরা নিজেদের সংস্কার করতে না পারো , তাহলে যখন মানুষ তোমাদের কাছে আসতে শুরু করবে , তখন আর নিজেদের সংস্কারের সুযোগ পাবে না।

অনেক জিনিস মানুষকে ধ্বংস করে দেয় , অধ্যয়ন ও আত্মিক বিশুদ্ধি অর্জনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি এই দাড়ি আর পাগড়িও ! যখন পাগড়িটা একটু বড় হয় , দাড়ি একটু লম্বা হয় এমন মানুষ যদি নিজেকে পরিশুদ্ধ না করে , তাহলে এটাই অধ্যয়ন থেকে দূরে সরিয়ে নেবে , সীমাবদ্ধ করে ফেলবে। নিজের দাম্ভিক সত্তাকে পায়ে মাড়িয়ে শিক্ষাগ্রহণের উদ্দেশ্যে আরেকজনের পায়ের কাছে বসাটা খুব কঠিন। শাইখ তুসী (র.) বায়ান্ন বছর বয়সেও ক্লাসে যেতেন ; অথচ বিশ থেকে ত্রিশ বছর বয়সে তিনি বেশ কিছু বই লিখেছিলেন ! তাঁর তাহযীব সম্ভবত সেই সময়েই লিখিত হয়েছিলো।

তবুও বায়ান্ন বছর বয়সে তিনি প্রয়াত সাইয়্যিদ মুর্তাজার (র.) ক্লাসে যোগ দিতেন , এবং তাঁর সমান মর্যাদা অর্জন করেছিলেন। আল্লাহ না করুন সৎ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অর্জন ও আধ্যাত্মিক ক্ষমতাকে শক্তিশালী করার আগেই না কারো দাড়ি সাদা হয়ে যায় , পাগড়ি আকারে বড় হয়ে যায় ; আর সে জ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার আশীর্বাদ থকে বঞ্চিত হয়। সুতরাং দাড়ি সাদা হবার আগেই কাজে লেগে পড়ো ; মানুষের নজরে আসার আগে নিজের অবস্থা নিয়ে চিন্তা করো ! আল্লাহ না করুন কেউ না আবার এই উদ্দেশ্যে নিজেকে গড়ে তোলে যে সে লোকের নজরে পড়বে , মানুষের মাঝে বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠবে , প্রভাবশালী হবে আর এসব করে সে তার নিজের সত্তাকে হারিয়ে ফেলবে।

নফসের উপর কর্তৃত্ব হারানোর আগেই নিজেকে গড়ে তোলো , নিজের সংস্কার করো ! সুঅভ্যাস দ্বারা নিজেকে সাজিয়ে তোলো , নিজের দোষগুলি দূর করো ! তোমাদের শিক্ষাগ্রহণ ও আলোচনায় বিশুদ্ধ হয়ে ওঠো , যেনো আল্লাহর দিকে অগ্রসর হতে পারো ! যদি কারো সৎ নিয়ত না থাকে , তাহলে সে স্বর্গীয় গৃহ থেকে অনেক দূরে সরে পড়বে। আল্লাহ না করুন ; কখনো এমনটা যেনো না হয় যে সত্তর বছর ধরে তোমরা সর্বশক্তিমান খোদার থেকে দূরে ছিলে ! তোমরা কি সেই পাথর এর গল্প শুনেছো , যেটাকে দোযখে ফেলা হয়েছিলো ? সত্তর বছর পর সেটার পতনের শব্দ শোনা গিয়েছিলো। একটা বর্ণনা অনুযায়ী , আল্লাহর রাসূল (তাঁর ও তাঁর বংশধরের উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে শান্তি ও দয়া বর্ষিত হোক) বলেছেন : সেটা ছিলো এক বৃদ্ধ লোক , যে সত্তর বছর বয়সে মারা গিয়েছিলো , আর এই সত্তর বছর ধরেই সে জাহান্নামের ভিতরে পড়ছিলো। সাবধান থাকো , যেনো মাদ্রাসায় তোমার নিজের শ্রম আর কপালের ঘাম দিয়ে পঞ্চাশ বা তার কম-বেশি সময়ে তোমরা যেনো দোযখে পৌঁছে না যাও ! সময় থাকতে এখনই চিন্তা করো ! আত্মার পরিশুদ্ধি ও সংস্কারের পথে পরিকল্পনা করো , এবং নিজের চারিত্রিক সংস্কার সাধন করো।

নিজের জন্য একজন নৈতিক শিক্ষক নির্ধারণ করে নাও ; উপদেশ-পরামর্শ-সতর্কীকরণ সেশন আয়োজন করো। তুমি নিজে নিজের সংস্কার করতে পারবে না। নৈতিক শিক্ষাদান , উপদেশ ও আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জনের জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার কোনো স্থান যদি মাদ্রাসায় না থাকে , তাহলে মাদ্রাসাটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। ফিকাহ ও উসুল (আইন ও তার মূলনীতি) শিক্ষার জন্য শিক্ষক প্রয়োজন ; প্রতিটা বিশেষ পড়াশুনা ও দক্ষতা অর্জনের জন্যই শিক্ষক অপরিহার্য , এবং আত্মতুষ্টি ও নাক-উঁচু ভাব নিয়ে কেউ-ই কোনো বিশেষ বিদ্যায় পারদর্শী হতে পারে না অথচ এটা কী করে সম্ভব যে আত্মিক ও নৈতিক বিষয়ে , যা কিনা অত্যন্ত কঠিন একটি বিদ্যা , সেটার জন্য শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণের কোনো প্রয়োজন হবে না , মানুষ সেটা নিজে নিজে এমনি এমনিই পেরে যাবে , অথচ যেখানে এই আধ্যাত্মিকতার চর্চাই ছিলো নবীগণের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ! আমি বিভিন্ন সময়ে শুনেছি যে প্রয়াত শাইখ মুর্তাজা আনসারী ছিলেন সাইয়্যিদ আলী ইবনে সাইয়্যিদ মুহাম্মাদের ছাত্র , যিনি নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বিষয়ের শিক্ষক ছিলেন।

স্রষ্টার প্রেরিত পুরুষদের প্রেরণ করা হয়েছিলো মানুষকে প্রশিক্ষিত করার জন্য , মানবতাবোধ উন্নত করার জন্য , এবং মানুষের মাঝ থেকে কদর্যতা , কলুষতা , দূর্নীতি ও অনৈতিক কাজ দূর করার জন্য। তাঁদেরকে প্রেরণ করা হয়েছিলো মানুষকে সুন্দর আচরণ ও সদগুণাবলীর সাথে পরিচিত করানোর জন্য : আমার সৃষ্টি হয়েছে মহান গুণাবলী (মাকারিম আল আখলাক) পূর্ণ করার জন্য। (উল্লিখিত উক্তিটি সূরা কলম , 68:4 নং আয়াতের তাফসিরে মুহাম্মাদ (সা.) এর উক্তি অনুবাদক।) এই জ্ঞান সর্বশক্তিমান স্রষ্টার নিকট এতই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো যে এজন্যে তিনি নবীগণকের প্রেরণ করেছেন ; অথচ আমাদের মাদ্রাসায় আলেমদের মাঝে এই জ্ঞানের ব্যাপারে কোনো গুরুত্বই দেখা যায় না। কেউ এটাকে যোগ্য মর্যাদা দেয় না। মাদ্রাসায় আধ্যাত্মিকতা ও রহস্যজ্ঞান বিষয়ে পর্যাপ্ত চর্চার অভাবে বস্তুবাদী দুনিয়াবী বিষয় এত বেশি বেড়ে গিয়েছে যে সেটা এমনকি আলেমসমাজের ভিতরে ঢুকে পড়েছে এবং তাদের অনেককেই পবিত্রতা ও আধ্যাত্মিকতা (রুহানিয়াত) থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। ক্ষেত্রবিশেষে দুনিয়াবী বিষয় আলেমদেরকে এতটাই দূরে সরিয়ে দিয়েছে যে তাদের অনেকে এমনকি রুহানিয়াত অর্থ-ই জানে না ! জানে না আলেমগণেরর দায়িত্ব কী কী এবং তাদের কাজকর্ম কেমন হওয়া উচিত। তাদের কেউ কেউ পরিকল্পনা করে যে কেবল কয়েকটা শব্দ শিখবে , নিজেদের লোকালয়ে বা অন্য কোথাও ফিরে যাবে , বিভিন্ন পদ-পদবী দখল করে বসবে , আর সেজন্যে অন্যদের সাথে লড়াই করবে। যেমনটা এক লোক বলেছিলো : আমাকে আগে শরহে লুমআহ (শরীয়া সংক্রান্ত গ্রন্থ) শিখতে দাও , তারপর আমি জানি গ্রামের মোড়লের সাথে ঠিক ঠিক কী করতে হবে। এমন হোয়ো না যে প্রথম থেকেই তুমি পড়াশুনা করবে কারো পদ-পদবী দখল করার উদ্দেশ্যে ; পড়াশুনা করবে এই নিয়তে যে তুমি কোনো গ্রাম বা শহরের মোড়ল হয়ে বসবে। তুমি তোমার স্বার্থপর কামনা ও মন্দ ইচ্ছাগুলো পূরণ করতে পারবে হয়তো , কিন্তু নিজের ও ইসলামী সমাজের জন্য তুমি ক্ষতি আর দূর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছুই বয়ে আনবে না। মুয়াবিয়াহ-ও দীর্ঘদিন রাষ্ট্রপ্রধান ছিলো , কিন্তু নিজের জন্য সে অভিশাপ , ঘৃণা ও পরকালের অনন্ত শাস্তি ছাড়া উপকারী কোনো কিছু অর্জন করতে পারেনি।

নিজেদের সংস্কার করা তোমাদের জন্যে খুব জরুরি ; যাতে তোমরা যখন কোনো সমাজ বা গোত্রের প্রধান হও , তোমরা যেনো তাদেরকেও পরিশুদ্ধ করতে পারো। কোনো সমাজ সংস্কারের জন্য পদক্ষেপ নিতে হলে তোমাদের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত ইসলাম ও মুসলিমের খেদমত করা।

যদি তুমি খোদার তরে পদক্ষেপ নাও , তবে তিনিই তো হৃদয় পরিবর্তনকারী ! তিনিই তোমার দিকে মানুষের অন্তর পরিবর্তিত করে দেবেন : নিশ্চয়ই যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম সম্পাদন করে , করুণাময় (আল্লাহ) তাদের জন্য (মুমিনদের অন্তরে) ভালোবাসা দান করবেন। (সূরা মারইয়াম , 19:96)

আল্লাহর দিকে যাত্রার পথে কিছুটা কষ্ট করো , নিজেকে নিবেদিত করো। খোদা তোমাকে প্রতিদান দেবেন ; যদি এই দুনিয়ায় না হয় তো পরকালে তিনি তোমাকে পুরস্কৃত করবেন। যদি এই দুনিয়াতে তোমার আল্লাহ ছাড়া আর কোনো কিছুই চাওয়া পাওয়ার না থাকে , তাহলে এর চেয়ে উত্তম আর কী-ই বা হতে পারে ! এই দুনিয়া কিছুই না। এই জাঁকজমক , এই নাম-যশ এগুলো সবই কিছুদিন পর শেষ হয়ে যাবে , যেভাবে মানুষের চোখের সামনে দিয়ে স্বপ্ন পার হয়ে যায় ; কিন্তু অপর দুনিয়ার পুরস্কার অসীম , এবং তা কখনোই শেষ হবে না।