জিহাদ আল আকবার : নফসের সাথে যুদ্ধ

জিহাদ আল আকবার : নফসের সাথে যুদ্ধ25%

জিহাদ আল আকবার : নফসের সাথে যুদ্ধ লেখক:
: নূরে আলম মাসুদ।
প্রকাশক: -
বিভাগ: চরিত্র গঠনমূলক বই

  • শুরু
  • পূর্বের
  • 16 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 11449 / ডাউনলোড: 3050
সাইজ সাইজ সাইজ
জিহাদ আল আকবার : নফসের সাথে যুদ্ধ

জিহাদ আল আকবার : নফসের সাথে যুদ্ধ

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

1

2

অধ্যায়

ধর্মশিক্ষাকেন্দ্রের প্রতি সতর্কবাণী

এটা খুবই সম্ভব যে নোংরা প্রোপাগান্ডা চালিয়ে শয়তানি চক্র নৈতিক ও আত্ম-সংস্কারমূলক কর্মসূচীকে মূল্যহীন হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করবে ; মিম্বরে বসে উপদেশ দেয়া , খুৎবা দেয়া ইত্যাদিকে স্কলারদের জন্য বেমানান হিসেবে উপস্থাপন করবে ; এবং যেসব পণ্ডিত ব্যক্তিত্বের যোগ্যতা আছে মাদ্রাসাগুলোর সংস্কার সাধন করার , তাদের কাজকর্মকে বাধাগ্রস্ত করবে , তাদেরকে মিম্বরী (অর্থাৎ খুৎবা-অলা) বলে উপহাস করবে। আজকে এমনকি কোনো কোনো মাদ্রাসায় মিম্বরে বসে খুৎবা দেয়াকে অপমানজনক মনে করা হয় ! তারা ভুলে যায় যে বিশ্বাসীদের নেতা ইমাম আলী (আ.) নিজে একজন মিম্বরী (খুৎবা দানকারী) ছিলেন। মিম্বরে বসেই তিনি মানুষকে তিরস্কার করতেন , সতর্ক করতেন , সচেতন করতেন , দিকনির্দেশনা দিতেন। অন্যান্য ইমামগণও (আ.) এমনটাই ছিলেন।

সম্ভবত গোপন এজেন্টরা মাদ্রাসা থেকে নীতি ও আধ্যাত্মিকতাকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য এই খারাপ জিনিসটি ঢুকিয়ে দিয়েছে ; ফলশ্রুতিতে মাদ্রাসাগুলো দুর্বল ও নীতিহীন হয়ে পড়েছে। আল্লাহ না করুন ; দল তৈরী করা , স্বার্থপরতা , ভণ্ডামি ও দ্বন্দ্ব যেনো মাদ্রাসায় অনুপ্রবেশ না করে। মাদ্রাসার লোকেরা একে অপরের সাথে মারামারি করছে , একদল আরেক দলের বিরুদ্ধে লাগছে , একে অপরকে অপমান করছে ও বিকৃতভাবে উপস্থাপন করছে। ইসলামী কমিউনিটিতে তারা অসম্মানিত , তাই শত্রুরা এবং বিদেশীরা মাদ্রাসার উপর প্রভাব খাটাতে পারছে এবং মাদ্রাসাকে শেষ করে দিচ্ছে। এই খারাপ লোকগুলো জানে যে মাদ্রাসার প্রতি এদেশের মানুষের সমর্থন আছে। আর যতদিন জাতি সমর্থন দিচ্ছে মাদ্রাসাকে , ততদিন তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা কিংবা তাদের বিরুদ্ধে লড়ে জেতা যাবে না।

কিন্তু যখন একটা সময়ে মাদ্রাসার লোকজন ও ছাত্রদের মাঝে ইসলামী আচরণ ও নৈতিকতার অভাব প্রকাশ পাবে , তারা পরস্পরের সাথে মারামারি করবে , পরস্পরবিরোধী দল তৈরী করবে , আত্ম-সংস্কার ও পরিশুদ্ধি অর্জনের চেষ্টা করবে না , অনুপযুক্ত কাজে নিজেদের হাত নোংরা করবে , তখন স্বাভাবিকভাবেই মাদ্রাসা ও আলেমগণ সম্পর্কে মুসলিম জাতি খারাপ ধারণা করবে। ফলশ্রুতিতে তাদের জনসমর্থন হারিয়ে যাবে , এবং একটা পর্যায়ে শত্রুরা এখানে প্রভাব খাটানো সুযোগ পেয়ে যাবে। যদি দেখো যে কোনো আলেম বা মারজা 'কে (মারজা-ই-তাক্বলিদ = সকল বিষয়ে অনুসরণযোগ্য আলেম) সরকার ভয় পাচ্ছে , গুরুত্ব দিচ্ছে , তখন বুঝবে যে এর কারণ হলো এরা (সরকার) জনগণের থেকে লাভ উঠায় , আবার একইসাথে জনগণকে ভয়ও পায়। তারা আশঙ্কা করে যে , যদি তারা কোনো আলেমের প্রতি ঘৃণা , ঔদ্ধত্য ইত্যাদি প্রকাশ করে , তাহলে জনগণ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে। কিন্তু যদি আলেমরাই একে অপরের বিরোধিতা করে , একজন আরেকজনকে অসম্মান করে , এবং ইসলামী নৈতিক আচরণবিধি অনুযায়ী আচরণ না করে , তাহলে সমাজে তাদের যে অবস্থান রয়েছে , তা থেকে তারা বিচ্যুত হয়ে পড়বে , জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করবে। মানুষ তোমাদেরকে রুহানি (আলেম , আধ্যাত্মিক ব্যক্তি) হিসেবে দেখতে চায়। দেখতে চায় ইসলামী আদব-কায়দা পালনকারী হিসেবে , দেখতে চায় হিজবুল্লাহ (আল্লাহর দল) হিসেবে। এইসব মেকি জাঁকজমক , চাকচিক্য থেকে নিজেকে সংযত করো ; ইসলামী আদর্শ প্রচারের অগ্রযাত্রায় ও মুসলিম জাতির স্বার্থে কোনো আত্মত্যাগকেই না কোরো না। সর্বশক্তিমান আল্লাহকে সন্তুষ্ট করতে তাঁর পথে অগ্রসর হও এবং অনন্য স্রষ্টা ছাড়া আর কোনো কিছুতেই মনোযোগ দিও না।

যাইহোক , যদি প্রত্যাশার বিপরীতে মানুষ দেখে যে , আধ্যাত্মিকতার দিকে মনোযোগ দেয়ার বদলে তোমরা কেবল দুনিয়াবি বিষয়েই মশগুল , এবং অন্যদের মত তোমরাও ব্যক্তিগত ও দুনিয়াবি স্বার্থ হাসিলের পিছনে ছুটছো , দুনিয়াবি সুখের জন্য লড়াই করছো ; এবং আল্লাহ না করুন নিজেদের নোংরা , নীচ দুনিয়াবি স্বার্থ হাসিলের জন্য ইসলাম ও কুরআনকে খেলাচ্ছলে গ্রহণ করছো , ধর্মকে ব্যবসায় পরিণত করেছো তাহলে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেবে , সন্দিগ্ধ হয়ে পড়বে। তোমরাই এর জন্য দায়ী হবে। যদি মাদ্রাসার পাগড়িধারী লোকেদের কেউ কেউ পদ-পদবী , দুনিয়াবী বিষয় , ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা ইত্যাদির কারণে পরস্পর মারামারি করে , একে অপরের বিরুদ্ধে কুৎসা রটায় ও গিবত করে , তাহলে তারা ইসলাম ও কুরআনের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করলো , এবং পবিত্র আস্থার ভঙ্গ করলো। সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালা আমাদের উপর আস্থা রেখে তাঁর দেয়া পবিত্র ধর্মকে রক্ষার দায়িত্ব দিয়েছেন। পবিত্র কুরআন হলো এক মহান ঐশী আস্থার নিদর্শন। উলামা এবং রুহানিগণ হলেন এই স্বর্গীয় আস্থার বাহক , আর এই আস্থার যেনো ভঙ্গ না হয় , সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্বও তাদেরই। (ইসলাম নিয়ে বিবদমান আলেমগণের) এই একগুঁয়েমি , দুনিয়াবী ও ব্যক্তিগত বিরোধ এগুলো সবই ইসলাম ও তার মহান নবীর বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা।

আমি জানি না এইসব বিরোধিতা , হীন স্বার্থ হাসিলের জন্য দল তৈরী করা , পারস্পরিক শত্রুতা ইত্যাদির মাধ্যমে কী লক্ষ্য অর্জিত হয়। যদি সেটা তোমাদের দুনিয়াবী স্বার্থে হয়ে থাকে , তাহলে তোমাদের তো দুনিয়াবী তেমন কিছুই নেই! যদি তোমরা দুনিয়াবী আনন্দ-সুখ অর্জন করে থাকো , তাহলে তো এত দ্বন্দ্ব থাকার কথা না ! অবশ্য যদিনা তোমরা সেইসব রুহানি হও , যারা রুহানিয়াত বলতে বোঝে কেবল আলখাল্লা আর পাগড়ি। যেই রুহানি (আলেম , আধ্যাত্মিক ব্যক্তি) আধ্যাত্মিক বিষয়ে মশগুল , যার মধ্যে ইসলামের সংস্কারমূলক গুণাবলী আছে , যে নিজেকে আলী ইবনে আবি তালিবের (আ.) অনুসারী মনে করে , সেতো দুনিয়ার লোভে পড়তে পারে না ! এবং দুনিয়াবী বিষয়কে সে পারস্পরিক দ্বন্দ্বের কারণও হতে দেবে না। তোমরা যারা নিজেদেরকে বিশ্বাসীদের নেতার (আ.) অনুসারী বলে দাবী করো এই মহান মানুষটার জীবন সম্পর্কে তোমাদের কিঞ্চিৎ হলেও গবেষণা করে দেখা উচিত , আর ভেবে দেখা উচিত , আসলেই কি তোমরা তাঁর অনুসারী ! তোমরা কি তাঁর তাক্বওয়া , কঠোর সংযম , সাধারণ অনাড়ম্বর জীবন যাপন সম্পর্কে জানো ? তোমরা কি সেটা অনুসরণ করো ? অত্যাচার-অবিচার , শ্রেণী বৈষম্যের বিরুদ্ধে এই মহান মানুষটির লড়াই সম্পর্কে কি তোমরা কিছু জানো ? জানো কিভাবে তিনি নির্যাতিত মানুষকে নির্দ্বিধায় সমর্থন দিতেন , সমাজের বাস্তুহারা দুর্দশাগ্রস্ত শ্রেণীর প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতেন ? তোমরা কি সেটা চর্চা করো ? শিয়া শব্দটা কি কেবলই ইসলামের এক আলঙ্কারিক রূপ ? তাহলে , তোমাদের সাথে সেইসব মানুষের পার্থক্য কোথায় , যারা সদগুণের দিক থেকে শিয়াদের তুলনায় অনেক বেশি অগ্রসর ? তাদের তুলনায় তোমাদের কী-ই বা বিশেষত্ব আছে ?

যারা আজকে দুনিয়ার একটা অংশকে জ্বালিয়ে দিচ্ছে , হত্যা-রক্তপাত করছে , তারা এসব করছে কারণ তারা দুনিয়ার জাতিগুলোকে লুট করার প্রতিযোগীতায় নেমেছে ; তারা প্রতিযোগীতায় নেমেছে মানুষের সম্পদ ভক্ষণ করার , মানুষের শ্রমের ফসলকে দখল করা এবং দুর্বল ও অনুন্নত জাতিগুলোকে নিজের করায়ত্ত্বে নিয়ে আসার। একারণে তারা স্বাধীনতা , উন্নতি-অগ্রগতি , সীমান্ত রক্ষা , স্বাধীনতা রক্ষা ইত্যাদি প্রতারণামূলক শ্লোগান দিয়ে প্রতিদিনই দুনিয়ার কোনো না কোনো প্রান্তে যুদ্ধের আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে , লক্ষ লক্ষ টন বোমা ফেলছে নিরাপত্তাহীন জাতিগুলোর উপর। দুনিয়াবী বিষয়ে মত্ত কলুষিত মস্তিষ্কের মানুষের কাছে এধরণের যুদ্ধ খুবই যৌক্তিক। কিন্তু তোমাদের (আলেমদের) যে লড়াই , পারস্পরিক দ্বন্দ্ব , তা এমনকি ঐসব দুনিয়ালোভী মানুষের কাছেও অযৌক্তিক। যদি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে তোমরা কেনো পরস্পর লড়াই করছো , তাহলে তারা জবাব দেবে যে ওমুক ওমুক দেশ দখল করার জন্য করছি : ওমুক ওমুক দেশের সম্পত্তি আমাদের নিতে হবে। কিন্তু যদি তোমাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে , কেনো তোমাদের মধ্যে এত দ্বন্দ্ব , কেনো তোমরা পরস্পর লড়াই করছো , তোমাদের উত্তর কী হবে ? দুনিয়ার কী লাভ তোমরা পাচ্ছো , যার জন্যে তোমরা লড়াই করছো ? মারজা-ই-তাক্বলিদ তোমাদেরকে শাহরিয়াহ নামক যে মাসিক ভাতা দেন , তা এমনকি অনেকের সিগারেট-খরচের চেয়েও কম ! ঠিক মনে পড়ছে না , তবে কোনো পত্রিকা বা ম্যাগাজিনে দেখেছি যে ওয়াশিংটনের একজন ধর্মযাজককে ভ্যাটিকান সিটি থেকে যে পরিমাণ টাকা দেয়া হয় , তা খুবই মোটা অঙ্কের। আমার মনে হয় সেটা শিয়া মাদ্রাসার গোটা বাজেটের চেয়েই বেশি ! তোমাদের এধরণের জীবনযাত্রা ও অবস্থায় কি পরস্পরের সাথে দ্বন্দ্ব-সংঘাত মানায় ?

এ সমস্ত দ্বন্দ্ব , আসলে যার কোনো পবিত্র লক্ষ্য নেই , এসব দ্বন্দ্বের গোড়া হলো দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা। যদি তোমাদের মাঝে এধরণের দ্বন্দ্ব বিদ্যমান থাকে , তবে এর কারণ হলো তোমরা নিজেদের অন্তর থেকে দুনিয়ার মায়াকে ত্যাগ করতে পারোনি। যেহেতু দুনিয়াবী লাভ খুবই সীমিত , সুতরাং সেটা অর্জনের জন্য একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করে। তুমি কোনো নির্দিষ্ট পদ অর্জন করতে চাও , যেটা কিনা আরেকজনও চায় , এমতাবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই এটা ঈর্ষা ও বিবাদের জন্ম দেবে। কিন্তু যারা খোদার লোক , যারা দুনিয়ার মায়াকে অন্তর থেকে বের করে দিয়েছে , এক আল্লাহ ছাড়া যাদের আর কোনো লক্ষ্য নেই , তারা কখনোই একে অপরের সাথে লড়াই করে না ; এমন দূর্দশা-অনৈক্যের কারণ হয়ে দাঁড়ায় না। যদি আজকে স্বর্গীয় নবীগণ সকলে কোনো শহরে একত্রিত হতেন , তবে তাঁদের মধ্যে কোনো মতানৈক্য কিংবা দ্বন্দ্ব থাকতো না , কারণ তাঁদের সকলের লক্ষ্য ও গন্তব্য একই। তাঁদের প্রত্যেকের হৃদয়ই খোদামুখী , এবং দুনিয়ার যেকোনো মায়া থেকে তাঁরা মুক্ত।

যদি তোমাদের কাজকর্ম , জীবনযাত্রা , অভিযাত্রা তেমনটাই হয় যা এখন দেখা যাচ্ছে , তাহলে তোমরা বরং খোদাকে ভয় করো। আল্লাহ আমাদেরকে রক্ষা করুন , তোমরা না আবার আলী ইবনে আবি তালিবের (আ.) অনুসারী না হয়ে দুনিয়া ত্যাগ করো। তোমাদের ভয় করা উচিত যে , তোমাদের তওবা না-ও কবুল হতে পারে , এবং ইমাম আলীর শাফায়াত তোমার উপকার না-ও করতে পারে । সুযোগ হারানোর আগেই তোমাদের উচিত এই বিষয়টার সমাধান করা। এইসব তুচ্ছ অপমানজনক দ্বন্দ্ব বাদ দাও। এসব দ্বন্দ্ব-লড়াই সম্পূর্ণরূপে অনুচিত। তোমরা কি (এক মুসলিম জাতি ভেঙে) একাধিক জাতি সৃষ্টি করছো ? তোমাদের ধর্ম কি উগ্র জাতীয়তাবাদের ধর্ম ? কেনো তোমরা সাবধান হচ্ছো না ? কেনো তোমরা বিশুদ্ধ , সৎ ও পরস্পরের প্রতি ভ্রাতৃত্বপূর্ণ নও ? কেনো ? কেনো ?

এসব বিভেদ খুব মারাত্মক , কারণ এসবের ফলস্বরূপ এমন অনৈক্যের জন্ম হয় , যার ক্ষতি পূরণ করা অসম্ভব। (বিভেদের ফলস্বরূপ) মাদ্রাসাগুলো শেষ হয়ে যাবে , সমাজে তোমরা হবে মূল্যহীন ও অসম্মানিত। এইসব দল সৃষ্টি করা কেবল তোমাদের-ই ক্ষতি বয়ে আনছে। এটা যে কেবল তোমাদের জন্যই কলঙ্কজনক তা নয় , বরং সমাজ ও জাতির জন্য এটা অসম্মান ও বদনাম ডেকে আনে , ফলস্বরূপ ইসলাম হয় ক্ষতিগ্রস্ত। যদি তোমাদের পরস্পরবিরোধিতার কারণে মুসলিম জাতির মাঝে অনৈক্য সৃষ্টি হয় , তাহলে সেটা হবে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নিকট সেটা হবে অন্যতম কবিরা গুনাহ , কারণ এর ফলে সমাজে অনৈক্য সৃষ্টি হবে , যা আমাদের উপর শত্রুদের প্রভাব বৃদ্ধির দ্বার খুলে দেবে। সম্ভবত মাদ্রাসার ভিতরে অনৈক্য ও শত্রুতার প্রসার ঘটানোর জন্য কোনো অদৃশ্য হাত কাজ করছে। মানুষের চিন্তাকে দূষিত করে , মানুষের মাঝে সংশয় ঢুকিয়ে দিয়ে এগুলোকে ধর্মীয় দায়িত্বের ছদ্মবেশ পরিয়ে সেই অদৃশ্য হাত বিভেদ ও সংঘাতের বীজ বপন করছে। এভাবে তারা ধর্মশিক্ষাকেন্দ্রে সৃষ্টি করেছে অনৈক্য , যাতে যে ব্যক্তিরা ইসলামের ভবিষ্যতের জন্য কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারতো , তারা যেনো শেষ হয়ে যায়। তারা যেনো ইসলাম ও ইসলামী সমাজের খেদমতে না আসে। সতর্ক ও সচেতন হওয়াটা আমাদের দরকার। আমার ধর্মীয় দায়িত্ব হলো এটুকু , আর ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা হলো এটুকু এজাতীয় চিন্তা করে নিজেকে বোকা বানিও না। কখনো কখনো শয়তান মানুষের জন্য দায়িত্ব-কর্তব্য নির্ধারণ করে দেয়। কখনো কখনো স্বার্থপর চাওয়া-পাওয়া মানুষকে বাধ্য করে ধর্মীয় দায়িত্বের নাম করে (স্বার্থলোভী) কাজ করতে। কোনো মুসলমানকে কষ্ট দেয়া কিংবা কোনো ভাইয়ের সম্পর্কে খারাপ কিছু বলা এগুলো কোনো ধর্মীয় দায়িত্ব নয়।

এটাই হলো দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা , নিজের প্রতি ভালোবাসা। এগুলোই হলো শয়তানের কুমন্ত্রণা , যা মানুষের জন্য আঁধার ডেকে আনে। এই শত্রুতা হলো ধ্বংসপ্রাপ্তদের শত্রুতা : জাহান্নামবাসীদের জন্যে বাকবিতণ্ডা অবশ্যম্ভাবী । (সূরা সা 'দ , ৩৮:৬৪)

শত্রুতা আর বাকবিতণ্ডা হলো জাহান্নামের জিনিস। দোযখের মানুষদের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকে , থাকে পারস্পরিক মারামারি। যদি তোমরা এই দুনিয়ার জন্যে ঝগড়া করো , তবে সাবধান হও ! কারণ তোমরা নিজেদের জন্য জাহান্নাম প্রস্তুত করছো , আর তোমরা তার মাঝপথে আছো। পরকালের দুনিয়ায় তো কোনো কিছুর জন্যে মারামারি নেই ! ওপারের দুনিয়ার মানুষেরা বিশুদ্ধ , প্রশান্ত হৃদয়ের অধিকারী। তাদের পরস্পরের মাঝে কেবলই শান্তি। খোদার প্রতি ভালোবাসা আর আনুগত্য তাদের হৃদয় ছাপিয়ে যাচ্ছে। আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়ার অন্যতম শর্ত হলো আল্লাহতে ঈমান আনা ব্যক্তিদেরকে ভালোবাসা। আল্লাহর বান্দাদের প্রতি ভালোবাসা-ই হলো তাঁর ভালোবাসার ছায়া।

তোমার নিজের হাতকে আগুনের মধ্যে দিও না। দোযখের আগুনের শিখাকে উস্কে দিও না। জাহান্নাম মানুষের নোংরা কাজকর্ম দ্বারা প্রজ্বলিত। এগুলো হলো একগুঁয়ে লোকেদের কাজ , যা দোযখের আগুনকে প্রজ্বলিত করে। হাদীসে বর্ণিত আছে : আমি জাহান্নামকে অতিক্রম করেছি যখন তার আগুন নেভানো ছিলো। যদি কোনো মানুষ নিজের কর্ম দ্বারা জাহান্নামের আগুনকে প্রজ্বলিত না করে , তবে জাহান্নামের চিহ্ন থাকবে না। এজাতীয় (একগুঁয়ে) আচরণের ভিতরেই থাকে জাহান্নাম। এজাতীয় আচরণের দিকে এগিয়ে যাওয়া মানে জাহান্নামের দিকেই এগিয়ে যাওয়া। যখন মানুষ এই দুনিয়া থেকে চলে যায় , তার সামনে পর্দা উন্মোচিত হয় , তখন সে উপলব্ধি করে যে : এ হলো তারই ফল , যা তোমরা ইতিপূর্বে নিজহাতে পাঠিয়েছো ,... (আলে ইমরান , ৩:১৮২) এবং তারা তাদের কৃতকর্মকে সেখানে উপস্থিত দেখবে (সূরা কাহফ , ১৮:৪৯)। মানুষের এই দুনিয়ার সকল কৃতকর্ম অপর দুনিয়ায় দেখা যাবে , এবং তার জন্যে সেই কর্মগুলোকে সত্যিকার রূপ দেয়া হবে : অতঃপর কেউ অনু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা দেখতে পাবে , এবং কেউ অনু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তা-ও দেখতে পাবে। (সূরা যালযালাহ , ৯৯:৭-৮)। মানুষের এই দুনিয়ার সকল কথা-কর্ম অপর দুনিয়ায় প্রতিফলিত হবে। যেনো আমাদের জীবনের সবকিছু ফিল্মে রেকর্ড করা হচ্ছিলো , আর ঐ দুনিয়ায় সেই ফিল্মটা দেখানো হবে , এবং কেউ-ই সেটার বিন্দুমাত্র অস্বীকার করতে পারবে না। আমাদের সকল কাজকর্ম , পদক্ষেপ সবকিছু আমাদেরকে দেখানো হবে , সেইসাথে আমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেবে সাক্ষ্য : ... তারা ( মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ , ত্বক) বলবে : আল্লাহ , যিনি সকল কিছুকে বাকশক্তি দিয়েছেন , তিনি আমাদেরকেও বাকশক্তি দিয়েছেন।... (সূরা ফুসসিলাত , ৪১:২১)।

আল্লাহ , যিনি সকল কিছুকে বাকশক্তি দান করবেন এবং সাক্ষী বানাবেন , তাঁর সামনে তোমার কোনো নোংরা কর্মকেই তুমি অস্বীকার করতে বা লুকাতে পারবে না। একটু চিন্তা করো , সামনে তাকাও , তোমার কর্মের পরিণতি ভেবে দেখো , মৃত্যুর পরে যেসব ভয়ানক ঘটনা ঘটে তা স্মরণে রাখো , কবরের চাপকে স্মরণ করো , বারযাখের দুনিয়াকে স্মরণ করো , এবং তার পরে যে যন্ত্রণা-দূর্দশা আসবে , তাকে উপেক্ষা কোরো না। অন্ততঃ জাহান্নামে বিশ্বাস রাখো। যদি কোনো মানুষ মৃত্যুর পরের ভয়ানক ঘটনাগুলোর কথা স্মরণে রাখে , সে তার জীবন যাপনের ধারা বদলে ফেলবে। যদি এই বিষয়ে তোমাদের ঈমান ও নিশ্চয়তা (নিশ্চিত জ্ঞান) থাকতো , তবে তোমরা এতো স্বাধীনভাবে নীতিহীন জীবন যাপন করতে না।

তোমাদের লেখনী , তোমাদের পদক্ষেপ , তোমাদের জিহবা এগুলোকে সতর্কভাবে নিয়ন্ত্রণ করো সংস্কার ও নিজেদেরকে বিশুদ্ধ করে তোলার জন্য।

অধ্যায়

ঐশী দয়া

মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের দয়া করেন বলে তিনি মানুষকে বুদ্ধিমত্তা দান করেছেন। মানুষ যেনো নিজেকে বিশুদ্ধ ও পবিত্র করতে পারে , সেই ক্ষমতা দান করেছেন। নবী ও আউলিয়াগণকে (আল্লাহর বন্ধু) পাঠিয়েছেন মানুষকে সঠিকপথে গাইড করার জন্য , যেনো মানুষ আত্মসংস্কারের মাধ্যমে নিজেদেরকে জাহান্নামের ভয়ানক শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারে। যদি এই পদ্ধতিতে কাজ না হয় (অর্থাৎ মানুষের মাঝে সংস্কার ও সচেতনতা সৃষ্টি না হয়) , তবে পরম দয়ালু আল্লাহ তায়ালা মানুষকে অন্য উপায়ে সচেতন করেন : নানারকম সমস্যা , দুঃখ-কষ্ট , দারিদ্র্য , অসুস্থতা ইত্যাদি দ্বারা। ঠিক একজন দক্ষ চিকিৎসক কিংবা ভালো নার্সের মতই তিনি (আল্লাহ তায়ালা) অসুস্থ মানুষকে তার ভয়ানক আত্মার রোগ থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করেন। যদি আল্লাহ তাঁর কোনো বান্দাকে দয়া করেন , তবে সে একের পর এক দুর্দশায় পতিত হতে থাকবে , যতক্ষণ না সে সর্বশক্তিমান স্রষ্টার নিকট ফিরে আসে , নিজের সংস্কার সাধন করে। এটাই হলো প্রকৃত পথ , এছাড়া আর কোনো পথ নেই ; কিন্তু এপথের শেষ পর্যন্ত পৌঁছতে মানুষকে নিজ পায়েই হাঁটতে হবে। যদি (দুঃখ-দুর্দশা-পরীক্ষার মধ্যদিয়ে আত্ম-সংস্কার ও আত্মশুদ্ধির) এই পথে মানুষ সাফল্য লাভ না করে , পথভ্রষ্ট মানুষটির অন্তরের রোগ দূর না হয় , যদি সে বেহেশত পাওয়ার উপযোগী না হয় , তাহলে তার আত্মাকে টেনে বের করার সময় তার উপর প্রচণ্ড চাপ প্রয়োগ করা হবে , যেনো সে ফিরে আসে , সতর্ক হয়। যদি এতেও কাজ না হয় , তাহলে কবরে , অর্থাৎ আলমে বারযাখে যেসব ভয়ানক ঘটনা ঘটে , সেখানে তাকে যন্ত্রণা ও শাস্তি দেয়া হবে , যতক্ষণ পর্যন্ত না সে বিশুদ্ধ হয় , তার সংস্কার হয় ; এবং এরপর সে দোযখে যাবে না। এর সবই হলো মানুষকে দোযখ থেকে দূরে রাখার জন্য সর্বশক্তিমান আল্লাহর দয়া। যদি আল্লাহর এত দয়া ও অনুকম্পা সত্ত্বেও মানুষ বিশুদ্ধ না হয় ? তাহলে তার শুদ্ধির জন্য আগুনে পোড়া ছাড়া আর কোনো পথ থাকবে না। ইতিহাসের কত মানুষ আত্মশুদ্ধির পথে আসেনি , নিজের সংস্কার করেনি , এবং এইসব পন্থায়ও তাদের শুদ্ধি ঘটেনি , এবং শেষমেষ দয়াময় ও করুণাময় খোদা তার বান্দাকে আগুনে পুড়ানোর মাধ্যমে বিশুদ্ধ করেছেন , ঠিক যেভাবে সোনা পুড়িয়ে খাঁটি করা হয়।

তারা সেখানে শতাব্দীর পর শতাব্দী অবস্থান করবে (৭৮:২৩) , কুরআনের এই আয়াত প্রসঙ্গে বলা হয় যে এখানে উল্লিখিত শতাব্দীর পর শতাব্দী হলো তাদের জন্য , যাদেরকে পথ দেখানো হয়েছে ,যাদের ঈমানের ভিত্তিকে রক্ষা করা হয়েছে (ইমাম বাক্বিরকে (আ.) এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তরে বলেছিলেন : এই আয়াত হলো তাদের জন্য , যাদেরকে একসময় আগুন থেকে বের করা হবে। (মাজমু '-আল-বয়ান , ভলিউম ১০ , পেইজ ৪২৪))।

এটা হলো তোমার-আমার মত মানুষের জন্য , যদি আমরা বিশ্বাসী হয়ে থাকি। প্রতিটা যুগের (আইয়াম) দৈর্ঘ্য হাজার বছর আসলে যে কত , খোদা-ই ভালো জানেন। আল্লাহ না করুন , আমরা না আবার এমন অবস্থায় পৌঁছে যাই যে আমাদেরকে বিশুদ্ধ করার এই পন্থাগুলোও কাজে আসবে না , আর চিরসুখের জান্নাতে প্রবেশের যোগ্যতা অর্জনের জন্য এই সর্বশেষ পন্থার দরকার পড়বে। আল্লাহ না করুন , যেসব বাগানের তলদেশে নদী প্রবাহিত হয় (৫৮:২২) , সেই স্থানে প্রবেশ করার যোগ্যতা অর্জনের জন্য না আবার মানুষকে কিছুদিনের জন্য দোযখে পুড়তে হয় (যেনো সে পাপ-পঙ্কিলতা , আত্মিক অশুদ্ধি এবং শয়তানের বৈশিষ্ট্য থেকে বিশুদ্ধ হতে পারে) !

তবে স্মরণ রাখতে হবে যে , এই পন্থা হলো তাদের জন্য , যাদের পাপের মাত্রা সর্বশক্তিমান আল্লাহর দয়া ও করুণা থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত হওয়ার মাত্রায় পৌঁছায়নি ; যাদের মাঝে বেহেশতে যাবার ন্যুনতম হলেও কিছু জিনিস অবশিষ্ট আছে। আল্লাহ না করুন , কোনো মানুষের পাপ এতই অপরিসীম হয়ে যায় যে , সে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালার পবিত্র সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত ও বহিষ্কৃত হতে হয় , ঐশী দয়া থেকে বঞ্চিত হয় , এবং অনন্তকাল দোযখের আগুনে পোড়া ছাড়া তাদের জন্য আর কোনো পথ না থাকে। আল্লাহ না করুন , তোমরা না আবার ঐশী দয়া ও করুণা থেকে বঞ্চিত হও এবং তাঁর (আল্লাহর) রাগ , অভিশাপ ও শাস্তির মুখোমুখি হও। তোমাদের কথা-কর্ম , আচরণ যেনো তোমাদেরকে খোদার করুণা থেকে এমনভাবে বঞ্চিত না করে যে অনন্ত ধ্বংসের মুখোমুখি হও।

এখন , যেখানে তোমরা এক মিনিটের জন্যও জ্বলন্ত একটা পাথর হাতে রাখতে পারো না , তাহলে দোযখের আগুনকে নিজের থেকে দূরে রাখো ! মাদ্রাসা ও আলেমগণকে এই আগুনের থেকে দূরে রাখো। তোমাদের অন্তর থেকে ঝগড়া-বিবাদকে অনেক দূরে সরিয়ে ফেলো। মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করো , রহমান-রহিম (করুণাময় , দয়ালু) হবার চেষ্টা করো। অবশ্য পাপী লোকেদের পাপ ও খোদাদ্রোহীতার ব্যাপারে নম্র হওয়া চলবে না। বরং তাদেরকে মুখের উপর বলে দাও যে সে পাপ করছে , তাকে নিষেধ করো , এবং নিজেও নৈরাজ্য ও বিদ্রোহ সৃষ্টি কোরো না। আল্লাহর বান্দা এবং সংকর্মীদের সাথে সদ্ব্যবহার করো। জ্ঞানী ব্যক্তিদেরকে জ্ঞানের কারণে সম্মান করো , সৎপথের ব্যক্তিদেরকে তাদের সদগুণের কারণে সম্মান করো , এবং জ্ঞানহীন অশিক্ষিতদেরকেও সম্মান করো , কারণ তারাও আল্লাহরই বান্দা। উত্তম আচরণের অধিকারী হও , দয়ালু হও , হও সৎ এবং ভ্রাতৃত্বপূর্ণ। নিজের সংস্কার করো। তুমি গোটা একটা কমিউনিটিকে গাইড করতে চাও , তাদেরকে সংস্কার করতে চাও ; কিন্তু যে ব্যক্তি নিজেরই সংস্কার ও সংশোধন করতে সক্ষম নয় , সে কী করে অপরকে পথ দেখাবে ? শাবান মাসের আর অল্প কিছুদিন বাকি। এই ক 'দিনে তওবা করে নিজেকে বদলে ফেলো , এবং পবিত্র রমজান মাসে বিশুদ্ধ আত্মা হিসেবে প্রবেশ করো।

অধ্যায় 6

আত্মিক পবিত্রতা ও পরিশুদ্ধির গুরুত্ব

যারা নিত্য-নতুন ধর্ম তৈরী করেছে , অসংখ্য মানুষকে বিপথগামী করেছে , তাদের বেশিরভাগই স্কলার ছিলো। তাদের কেউ কেউ এমনকি ধর্মশিক্ষাকেন্দ্রে পড়াশুনা করেছে। এমনকি বিভ্রান্ত মাযহাবগুলির একটির প্রতিষ্ঠাতা আমাদেরই মাদ্রাসায় পড়াশুনা করেছে। কিন্তু যেহেতু জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি তার আত্মশুদ্ধি ও আত্মিক পবিত্রতা অর্জনের চেষ্টা ছিলো না , যেহেতু সে আল্লাহর রাস্তায় অগ্রসর হয়নি এবং যেহেতু সে নিজের কলুষ দূর করেনি , সুতরাং সে ধিক্কারজনক অবস্থা বয়ে এনেছে। মানুষ যদি তার আত্মার গভীর থেকে কলুষকে দূর না করে , তাহলে যে শুধু তার সকল পড়াশুনা-ই ব্যর্থ হয়ে যাবে তা নয় , বরং উল্টা তা ক্ষতিকর হবে। যখন এসব শিক্ষাকেন্দ্রে জ্ঞানের ভিতরে শয়তানের প্রবেশ ঘটবে , তখন সেখান থেকে কেবল খারাপ জিনিস-ই বেরিয়ে আসবে : শিকড় , শাখা-প্রশাখাসুদ্ধ এক বিষবৃক্ষ। নোংরা অপরিষ্কার হৃদয়ে এসব দ্বীনি জ্ঞান যত বেশিই জড়ো করা হোক না কেনো , সেটা কেবল অন্তরের উপরে কালো আবরণকেই গভীর করবে। যে আত্মা অপবিত্র , জ্ঞান তার উপরে এক কালো চাদর : আল ইলম হুয়া আল হিজাব আল আকবার (জ্ঞান হলো সবচেয়ে বড় আবরণ)।

তাই , একজন আলেমের নীতিহীনতা ইসলামের যে ক্ষতি করে , আর কারো নীতিহীনতা সে ক্ষতি করতে পারে না। জ্ঞান হলো আলো , কিন্তু কালো দূষিত হৃদয়ে সেটা কেবল অন্ধকার ও কলুষকেই বৃদ্ধি করে। যে জ্ঞান মানুষকে খোদার নিকটবর্তী করে , সেটাই আবার দুনিয়ালোভী মানুষকে সর্বশক্তিমান থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দেয়। এমনকি একত্ববাদ তাওহীদের জ্ঞান সেটাও যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে অর্জিত হয় , সেটা হয়ে যায় অন্ধকার এক আবরণ , কারণ সেটা আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো কিছুতে লিপ্ত হওয়ার জন্যে অর্জিত। কেউ যদি সুপরিচিত চৌদ্দ রকমের সবগুলি উপায়েই পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করে , কিন্তু সেটা যদি আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্যে হয় , তাহলে এই তেলাওয়াত তার জন্য কিছুই বয়ে আনবে না , আল্লাহর থেকে দূরত্ব ও (অন্তরের উপর) আবরণ ছাড়া। তুমি যদি কিছুটা কষ্ট করো , পড়াশুনা করো , তাহলে তুমি আলেম হতে পারবে বটে , কিন্তু জেনে রাখো যে আলেম হওয়া ও পরিশুদ্ধ হওয়ার মাঝে অনেক পার্থক্য আছে।

আমাদের প্রয়াত শিক্ষক শাইখ আবদুল করিম হায়েরী ইয়াযদী (র.) বলেছেন , লোকে বলে : 'মোল্লা হওয়া কতই না সহজ , আর মানুষ হওয়া কতই না কঠিন ' কথাটা আসলে ঠিক নয় । বরং বলা উচিত : 'মোল্লা হওয়া কতই না কঠিন , আর মানুষ হওয়া তো অসম্ভব ! '

পবিত্র মানবীয় গুণাবলী অর্জন করা তোমাদের এক গুরু দায়িত্ব। তোমরা এখন ধর্মতত্ত্ব পড়াশুনায় ব্যস্ত ; শিখছো ফিকাহ , যা খুব সম্মানজনক ব্যাপার মনে কোরো না যে এটা খুব সহজ একটা ব্যাপার , ভেবো না যে তোমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলি এমনি এমনিই পালন হয়ে যাবে। যদি আল্লাহর নিকটবর্তী হবার জন্য খাঁটি নিয়ত না থাকে , তাহলে এসব ধর্মশিক্ষা কোনোই কাজে আসবে না। আল্লাহ মাফ করুন , কিন্তু যদি তোমাদের এই পড়াশুনা আল্লাহর জন্যে না হয় , বরং আত্মতৃপ্তি , পদ-পদবী-ক্ষমতা , সম্মান ইত্যাদির লোভে হয় ; তাহলে তুমি নিজের জন্য ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই উপার্জন করবে না। এইযে এত ধর্মীয় টার্ম শেখা যদি এগুলো আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্যে হয় , তাহলে পুরোটাই ধ্বংস ছাড়া আর কিছু বয়ে আনবে না।

এত ধর্মীয় টার্ম শেখা যদি এর সাথে সাথে আত্মশুদ্ধি ও তাক্বওয়া অর্জন না হয় , তাহলে সেটা মুসলিম কমিউনিটির জন্য এই দুনিয়া ও পরকালে ক্ষতি-ই বয়ে আনবে। কেবলমাত্র কিছু টার্মিনোলজি শেখাটা কাজের নয়। এমনকি একত্ববাদের জ্ঞান (ইলম আত-তাওহীদ) যদি এই জ্ঞানের সাথে সাথে আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জন করা না যায় , তাহলে দুর্দশা ছাড়া আর কিছুই আসবে না। দুনিয়ায় কত মানুষ তাওহীদের জ্ঞান নিয়ে আলেম হয়েছে এবং অসংখ্য মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে ! তোমাদের যেই জ্ঞান আছে , আরো কত মানুষের এই একই জ্ঞান ছিলো , এমনকি হয়তো বেশিও , কিন্তু তারা পথচ্যুত ছিলো , নিজেদের সংস্কার করেনি ; সুতরাং যখন তারা সমাজে (আলেম পরিচিতি সহকারে) প্রবেশ করলো , তখন অসংখ্য মানুষকে নষ্ট করলো , বিভ্রান্ত করলো।

এই নিষ্প্রাণ ধর্মীয় টার্মিনোলজি , যদি এর পাশাপাশি তাক্বওয়া ও আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জন না হয় , তাহলে যত বেশি এসব ধর্মীয় জ্ঞান একজনের মাথায় ঢুকবে , ততই তার অহংকার বেড়ে যাবে। যেই হতভাগ্য আলেম নিজের অহংকারের কাছে পরাজিত হয়েছে , সে নিজের কিংবা সমাজের সংস্কার করতে পারে না ; এবং এর ফলাফল হিসেবে আসবে কেবলই ইসলাম ও মুসলমানদের ক্ষতি। বছরের পর বছর ধর্মীয় ফান্ডের টাকা নষ্ট করে পড়াশুনা করে , বেতন-ভাতা ইত্যাদি নিয়ে সে ইসলাম ও মুসলমানের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। জাতি তাদের দ্বারা বিভ্রান্ত হবে। মাদ্রাসায় এতসব আলোচনা , ক্লাস ইত্যাদি তখন প্রকৃত ইসলামের দুনিয়ায় প্রবেশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে , বাধা হয়ে দাঁড়াবে কুরআনের জ্ঞানার্জনের পথে : উপরন্তু এটাও সম্ভব যে তার (কলুষিত আলেমের) উপস্থিতি-ই সমাজকে ইসলাম ও আধ্যাত্মিকতা জানার পথে বাধা সৃষ্টি করবে।

আমি পড়াশুনা করতে নিষেধ করছি না , বলছি না যে তোমাদের জ্ঞানার্জনের প্রয়োজন নেই ; বরং তোমাদের সতর্ক থাকতে হবে ; কারণ যদি তোমরা সমাজের কাজে লাগতে চাও , ইসলামের জন্য কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে চাও , জাতিকে ইসলামের ব্যাপারে সচেতন করতে চাও , ইসলামের মৌলিক আক্বীদাকে রক্ষা করতে চাও , তাহলে ইসলামী আইনের মৌলিক জ্ঞানের ভিত্তি খুব দৃঢ় হতে হবে , এ বিষয়ে তোমাদের দক্ষতা অর্জন করতে হবে। আল্লাহ না করুন তোমরা যদি সে জ্ঞান অর্জন করতে ব্যর্থ হও , তাহলে মাদ্রাসায় থাকার কোনো অধিকার তোমাদের নেই। (সেক্ষেত্রে) তোমরা ধর্মশিক্ষার ছাত্রদের জন্য নির্ধারিত ভাতা গ্রহণ করতে পারবে না। অবশ্যই জ্ঞান অর্জনের দরকার আছে। ফিকাহ ও উসুল শিক্ষায় তোমরা যেমন কষ্ট করো , তেমনি নিজের সংস্কারের জন্যও কষ্ট করতে হবে। জ্ঞানার্জনের পথে নেয়া প্রতিটা পদক্ষেপের সাথে সাথে প্রবৃত্তির দমনের পথেও একটি করে পদক্ষেপ নিতে হবে : প্রবৃত্তিকে দমন করতে হবে আধ্যাত্মিক ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য , মহৎ চারিত্রিক গুণাবলী অর্জনের জন্য , আধ্যাত্মিকতা ও তাক্বওয়া অর্জনের জন্য।

ফিকাহ , উসুল ইত্যাদি বিষয় শিক্ষা করাটা হলো আত্মিক পরিশুদ্ধি , পবিত্র গুণাবলী , আচরণ ও ঐশী জ্ঞান অর্জনের সূচনা। গোটা জীবনটা কেবল সূচনায় পড়ে থেকো না যাতে তোমরা সমাপ্তিটা ভুলে যাও। তোমরা এসব জ্ঞান অর্জন করছো এক সুউচ্চ পবিত্র লক্ষ্য অর্জনের জন্য : খোদাকে জানা এবং নিজেকে বিশুদ্ধ করা। তোমাদের কাজের ফলাফল ও প্রভাব উপলব্ধি করার জন্য প্ল্যান করা উচিত , সেইসাথে মৌলিক লক্ষ্য অর্জনের ব্যাপারে সিরিয়াস হওয়া উচিত।

যখন তোমরা মাদ্রাসাজীবন শুরু করো , তখন আর সবকিছুর আগে নিজেকে সংস্কারের পরিকল্পনা করা উচিত। মাদ্রাসায় থাকাকালীন সময়ে পড়াশুনার পাশাপাশি নিজেদের বিশুদ্ধ করা উচিত , যাতে তোমরা যখন মাদ্রাসা ছেড়ে গিয়ে কোনো শহর বা জেলার ইমাম হও , তারা যেনো তোমার দ্বারা লাভবান হতে পারে , তোমার কাছ থেকে উপদেশ নিতে পারে , এবং তোমার নৈতিক গুণাবলী , আচরণ , কর্ম ইত্যাদি দেখে যেনো তারা নিজেদেরকে বিশুদ্ধ করতে পারে। মানুষের মধ্যে প্রবেশ করার আগে নিজেকে সংস্কার করার চেষ্টা করো। এখন , যখন তোমাদের সময়-সুযোগ আছে , এখন যদি তোমরা নিজেদের সংস্কার করতে না পারো , তাহলে যখন মানুষ তোমাদের কাছে আসতে শুরু করবে , তখন আর নিজেদের সংস্কারের সুযোগ পাবে না।

অনেক জিনিস মানুষকে ধ্বংস করে দেয় , অধ্যয়ন ও আত্মিক বিশুদ্ধি অর্জনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি এই দাড়ি আর পাগড়িও ! যখন পাগড়িটা একটু বড় হয় , দাড়ি একটু লম্বা হয় এমন মানুষ যদি নিজেকে পরিশুদ্ধ না করে , তাহলে এটাই অধ্যয়ন থেকে দূরে সরিয়ে নেবে , সীমাবদ্ধ করে ফেলবে। নিজের দাম্ভিক সত্তাকে পায়ে মাড়িয়ে শিক্ষাগ্রহণের উদ্দেশ্যে আরেকজনের পায়ের কাছে বসাটা খুব কঠিন। শাইখ তুসী (র.) বায়ান্ন বছর বয়সেও ক্লাসে যেতেন ; অথচ বিশ থেকে ত্রিশ বছর বয়সে তিনি বেশ কিছু বই লিখেছিলেন ! তাঁর তাহযীব সম্ভবত সেই সময়েই লিখিত হয়েছিলো।

তবুও বায়ান্ন বছর বয়সে তিনি প্রয়াত সাইয়্যিদ মুর্তাজার (র.) ক্লাসে যোগ দিতেন , এবং তাঁর সমান মর্যাদা অর্জন করেছিলেন। আল্লাহ না করুন সৎ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অর্জন ও আধ্যাত্মিক ক্ষমতাকে শক্তিশালী করার আগেই না কারো দাড়ি সাদা হয়ে যায় , পাগড়ি আকারে বড় হয়ে যায় ; আর সে জ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার আশীর্বাদ থকে বঞ্চিত হয়। সুতরাং দাড়ি সাদা হবার আগেই কাজে লেগে পড়ো ; মানুষের নজরে আসার আগে নিজের অবস্থা নিয়ে চিন্তা করো ! আল্লাহ না করুন কেউ না আবার এই উদ্দেশ্যে নিজেকে গড়ে তোলে যে সে লোকের নজরে পড়বে , মানুষের মাঝে বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠবে , প্রভাবশালী হবে আর এসব করে সে তার নিজের সত্তাকে হারিয়ে ফেলবে।

নফসের উপর কর্তৃত্ব হারানোর আগেই নিজেকে গড়ে তোলো , নিজের সংস্কার করো ! সুঅভ্যাস দ্বারা নিজেকে সাজিয়ে তোলো , নিজের দোষগুলি দূর করো ! তোমাদের শিক্ষাগ্রহণ ও আলোচনায় বিশুদ্ধ হয়ে ওঠো , যেনো আল্লাহর দিকে অগ্রসর হতে পারো ! যদি কারো সৎ নিয়ত না থাকে , তাহলে সে স্বর্গীয় গৃহ থেকে অনেক দূরে সরে পড়বে। আল্লাহ না করুন ; কখনো এমনটা যেনো না হয় যে সত্তর বছর ধরে তোমরা সর্বশক্তিমান খোদার থেকে দূরে ছিলে ! তোমরা কি সেই পাথর এর গল্প শুনেছো , যেটাকে দোযখে ফেলা হয়েছিলো ? সত্তর বছর পর সেটার পতনের শব্দ শোনা গিয়েছিলো। একটা বর্ণনা অনুযায়ী , আল্লাহর রাসূল (তাঁর ও তাঁর বংশধরের উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে শান্তি ও দয়া বর্ষিত হোক) বলেছেন : সেটা ছিলো এক বৃদ্ধ লোক , যে সত্তর বছর বয়সে মারা গিয়েছিলো , আর এই সত্তর বছর ধরেই সে জাহান্নামের ভিতরে পড়ছিলো। সাবধান থাকো , যেনো মাদ্রাসায় তোমার নিজের শ্রম আর কপালের ঘাম দিয়ে পঞ্চাশ বা তার কম-বেশি সময়ে তোমরা যেনো দোযখে পৌঁছে না যাও ! সময় থাকতে এখনই চিন্তা করো ! আত্মার পরিশুদ্ধি ও সংস্কারের পথে পরিকল্পনা করো , এবং নিজের চারিত্রিক সংস্কার সাধন করো।

নিজের জন্য একজন নৈতিক শিক্ষক নির্ধারণ করে নাও ; উপদেশ-পরামর্শ-সতর্কীকরণ সেশন আয়োজন করো। তুমি নিজে নিজের সংস্কার করতে পারবে না। নৈতিক শিক্ষাদান , উপদেশ ও আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জনের জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার কোনো স্থান যদি মাদ্রাসায় না থাকে , তাহলে মাদ্রাসাটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। ফিকাহ ও উসুল (আইন ও তার মূলনীতি) শিক্ষার জন্য শিক্ষক প্রয়োজন ; প্রতিটা বিশেষ পড়াশুনা ও দক্ষতা অর্জনের জন্যই শিক্ষক অপরিহার্য , এবং আত্মতুষ্টি ও নাক-উঁচু ভাব নিয়ে কেউ-ই কোনো বিশেষ বিদ্যায় পারদর্শী হতে পারে না অথচ এটা কী করে সম্ভব যে আত্মিক ও নৈতিক বিষয়ে , যা কিনা অত্যন্ত কঠিন একটি বিদ্যা , সেটার জন্য শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণের কোনো প্রয়োজন হবে না , মানুষ সেটা নিজে নিজে এমনি এমনিই পেরে যাবে , অথচ যেখানে এই আধ্যাত্মিকতার চর্চাই ছিলো নবীগণের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ! আমি বিভিন্ন সময়ে শুনেছি যে প্রয়াত শাইখ মুর্তাজা আনসারী ছিলেন সাইয়্যিদ আলী ইবনে সাইয়্যিদ মুহাম্মাদের ছাত্র , যিনি নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বিষয়ের শিক্ষক ছিলেন।

স্রষ্টার প্রেরিত পুরুষদের প্রেরণ করা হয়েছিলো মানুষকে প্রশিক্ষিত করার জন্য , মানবতাবোধ উন্নত করার জন্য , এবং মানুষের মাঝ থেকে কদর্যতা , কলুষতা , দূর্নীতি ও অনৈতিক কাজ দূর করার জন্য। তাঁদেরকে প্রেরণ করা হয়েছিলো মানুষকে সুন্দর আচরণ ও সদগুণাবলীর সাথে পরিচিত করানোর জন্য : আমার সৃষ্টি হয়েছে মহান গুণাবলী (মাকারিম আল আখলাক) পূর্ণ করার জন্য। (উল্লিখিত উক্তিটি সূরা কলম , 68:4 নং আয়াতের তাফসিরে মুহাম্মাদ (সা.) এর উক্তি অনুবাদক।) এই জ্ঞান সর্বশক্তিমান স্রষ্টার নিকট এতই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো যে এজন্যে তিনি নবীগণকের প্রেরণ করেছেন ; অথচ আমাদের মাদ্রাসায় আলেমদের মাঝে এই জ্ঞানের ব্যাপারে কোনো গুরুত্বই দেখা যায় না। কেউ এটাকে যোগ্য মর্যাদা দেয় না। মাদ্রাসায় আধ্যাত্মিকতা ও রহস্যজ্ঞান বিষয়ে পর্যাপ্ত চর্চার অভাবে বস্তুবাদী দুনিয়াবী বিষয় এত বেশি বেড়ে গিয়েছে যে সেটা এমনকি আলেমসমাজের ভিতরে ঢুকে পড়েছে এবং তাদের অনেককেই পবিত্রতা ও আধ্যাত্মিকতা (রুহানিয়াত) থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। ক্ষেত্রবিশেষে দুনিয়াবী বিষয় আলেমদেরকে এতটাই দূরে সরিয়ে দিয়েছে যে তাদের অনেকে এমনকি রুহানিয়াত অর্থ-ই জানে না ! জানে না আলেমগণেরর দায়িত্ব কী কী এবং তাদের কাজকর্ম কেমন হওয়া উচিত। তাদের কেউ কেউ পরিকল্পনা করে যে কেবল কয়েকটা শব্দ শিখবে , নিজেদের লোকালয়ে বা অন্য কোথাও ফিরে যাবে , বিভিন্ন পদ-পদবী দখল করে বসবে , আর সেজন্যে অন্যদের সাথে লড়াই করবে। যেমনটা এক লোক বলেছিলো : আমাকে আগে শরহে লুমআহ (শরীয়া সংক্রান্ত গ্রন্থ) শিখতে দাও , তারপর আমি জানি গ্রামের মোড়লের সাথে ঠিক ঠিক কী করতে হবে। এমন হোয়ো না যে প্রথম থেকেই তুমি পড়াশুনা করবে কারো পদ-পদবী দখল করার উদ্দেশ্যে ; পড়াশুনা করবে এই নিয়তে যে তুমি কোনো গ্রাম বা শহরের মোড়ল হয়ে বসবে। তুমি তোমার স্বার্থপর কামনা ও মন্দ ইচ্ছাগুলো পূরণ করতে পারবে হয়তো , কিন্তু নিজের ও ইসলামী সমাজের জন্য তুমি ক্ষতি আর দূর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছুই বয়ে আনবে না। মুয়াবিয়াহ-ও দীর্ঘদিন রাষ্ট্রপ্রধান ছিলো , কিন্তু নিজের জন্য সে অভিশাপ , ঘৃণা ও পরকালের অনন্ত শাস্তি ছাড়া উপকারী কোনো কিছু অর্জন করতে পারেনি।

নিজেদের সংস্কার করা তোমাদের জন্যে খুব জরুরি ; যাতে তোমরা যখন কোনো সমাজ বা গোত্রের প্রধান হও , তোমরা যেনো তাদেরকেও পরিশুদ্ধ করতে পারো। কোনো সমাজ সংস্কারের জন্য পদক্ষেপ নিতে হলে তোমাদের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত ইসলাম ও মুসলিমের খেদমত করা।

যদি তুমি খোদার তরে পদক্ষেপ নাও , তবে তিনিই তো হৃদয় পরিবর্তনকারী ! তিনিই তোমার দিকে মানুষের অন্তর পরিবর্তিত করে দেবেন : নিশ্চয়ই যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম সম্পাদন করে , করুণাময় (আল্লাহ) তাদের জন্য (মুমিনদের অন্তরে) ভালোবাসা দান করবেন। (সূরা মারইয়াম , 19:96)

আল্লাহর দিকে যাত্রার পথে কিছুটা কষ্ট করো , নিজেকে নিবেদিত করো। খোদা তোমাকে প্রতিদান দেবেন ; যদি এই দুনিয়ায় না হয় তো পরকালে তিনি তোমাকে পুরস্কৃত করবেন। যদি এই দুনিয়াতে তোমার আল্লাহ ছাড়া আর কোনো কিছুই চাওয়া পাওয়ার না থাকে , তাহলে এর চেয়ে উত্তম আর কী-ই বা হতে পারে ! এই দুনিয়া কিছুই না। এই জাঁকজমক , এই নাম-যশ এগুলো সবই কিছুদিন পর শেষ হয়ে যাবে , যেভাবে মানুষের চোখের সামনে দিয়ে স্বপ্ন পার হয়ে যায় ; কিন্তু অপর দুনিয়ার পুরস্কার অসীম , এবং তা কখনোই শেষ হবে না।


5

6

7

8