অধ্যায়–
9
শাবান মাসের মুনাজাত সম্পর্কে
তোমরা কি মহান স্রষ্টার উদ্দেশ্যে শাবান মাসের সেই বিশেষ মুনাজাত নিবেদন করেছো , মাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যে মুনাজাত করার উপদেশ দেয়া হয়েছে ? এই মুনাজাতের সুউচ্চ তাৎপর্য , যা আল্লাহর ব্যাপারে উন্নত ঈমান ও জ্ঞানের শিক্ষা দেয় , তা থেকে তোমরা উপকৃত হয়েছো কি ? এই মুনাজাত সম্পর্কে বলা হয় যে এটা ইমাম আলী (আ.) এর মুনাজাত (তাঁর ও তাঁর বংশধরদের উপর এবং সকল নিষ্পাপ ইমামের উপর সালাম) , তিনি এই মুনাজাতের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে নিবেদন করতেন। খুব কম দুআ ও মুনাজাত পাওয়া যাবে যা সকল ইমামই (আ.) আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদন করতেন। সত্যিই , এই মুনাজাত হলো পবিত্র রমজান মাসের দায়িত্বগুলি গ্রহণ করার জন্য মানুষকে প্রস্তুত করা ও সতর্ক করার উপায়। এর মাধ্যমে সচেতন ব্যক্তিকে রোজার উদ্দেশ্য এবং এর মূল্যবান প্রতিদানগুলি স্মরণ করিয়ে দেয়া সম্ভব।
নিষ্পাপ ইমামগণ (আ.) মুনাজাতের মাধ্যমে অনেক বিষয় ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁদের মুনাজাতের ভাষা আদেশ-নিষেধের ভাষা থেকে একদমই আলাদা। মুনাজাতের মাধ্যমে তাঁরা গভীর আধ্যাত্মিক , অবস্তুগত এবং ঐশী বিষয় ব্যাখ্যা করতেন , আল্লাহর সম্পর্কে তাঁদের জ্ঞান প্রকাশ করতেন। কিন্তু আমরা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মুনাজাত করে যাই , অথচ এর অর্থের দিকে কোনো মনোযোগই দিই না , এবং তাঁরা মুনাজাতের মাধ্যমে আসলে কী বলতে চেয়েছেন , দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা বুঝতে ব্যর্থ হই।
এই মুনাজাতে আমরা বলি :“
হে আমার রব ! আমি যেনো তোমার ধ্যান ছাড়া আর সকল কিছুর থেকে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করতে পারি , এবং তোমার দিকে তাকানোর মাধ্যমে আমাদের অন্তর্দৃষ্টিকে এমনভাবে আলোকিত করতে পারি , যেনো আলোর পর্দা ছিন্ন করে আমাদের অন্তর্দৃষ্টি তোমার মহত্বের নিকটবর্তী হয় , এবং আমাদের আত্মা পরিপূর্ণভাবে তোমার সুপবিত্র সত্তার মালিকানাধীন হয়ে যায়।”
“
হে আমাররব !
আমি যেনো তোমার ধ্যান ছাড়া আর সকল কিছুর থেকে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করতে পারি
”
–
এই কথাটার অর্থ এমনটিও হতে পারে যে , ঐশী বিষয়ে সচেতন ব্যক্তিরা পবিত্র রমজান মাসের আগে দুনিয়াবি সুখ ত্যাগ করার মাধ্যমে নিজেকে প্রস্তুত করেন (আর দুনিয়াবি সুখকে ত্যাগ করার মাধ্যমেই আল্লাহ ব্যতীত আর সবকিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করা যায়)। আল্লাহ ব্যতীত আর সকল কিছু থেকে পরিপূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াটা সহজ কাজ নয়। এজন্যে খুব কঠোর সাধনার প্রয়োজন। ক্ষেত্রবিশেষে সেইসাথে আধ্যাত্মিক চর্চা , ধৈর্য্য , নিয়মানুবর্তিতা ইত্যাদিকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে যেনো মানুষ আল্লাহ ছাড়া দুনিয়ার আর সকল কিছু থেকে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করতে পারে।
যদি কেউ এই কাজে সফল হয়
, তাহলে সে অত্যন্ত সম্মানিত স্থান অর্জন করেছে। তবে , দুনিয়ার প্রতি বিন্দুমাত্র আকর্ষণ থাকলে আল্লাহ ছাড়া আর সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া সম্ভব না। যেভাবে রমজানের রোজা পালন করতে বলা হয়েছে , পবিত্র রমজানে কেউ যদি ঠিক সেইভাবেই রোজা রাখতে চায় , তাহলে তাকে অবশ্যই আল্লাহ ছাড়া আর সবকিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে হবে। একাজ তাকে করতে হবে যেনো সে আল্লাহর এই (নৈকট্য লাভের) উৎসব ঠিকভাবে পালন করতে পারে , মানুষের পক্ষে যতদূর সম্ভব ততখানি পর্যন্ত এই উৎসবের আয়োজকের
( Host, Allah)স্থান বুঝতে পারে। আমাদের পবিত্র রাসূল (সা.) এর (তাঁর ও তাঁর বংশধরদের উপর সালাম) একটি বক্তব্য অনুযায়ী
, এই পবিত্র রমজান মাসে মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর আয়োজিত উৎসবে অংশগ্রহণের জন্য সকল বান্দাকে আহবান জানিয়েছেন। রাসূল (সা.) বলেছেন :
“
হে মানুষ ! আল্লাহর মাস এগিয়ে আসছে... আর তোমাদেরকে আল্লাহর এই উৎসবে যোগ দেয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
”
পবিত্র রমজান মাস আসার আগের এই কয়েকটি দিনে তোমাদের চিন্তা করা উচিত , আত্মিক সংস্কার করা উচিত , এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালার দিকে মনোযোগ দেয়া উচিত , অনুচিত কর্ম ও আচরণের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত ,
এবং খোদা না করুন
, তুমি যদি কোনো পাপ করেই থাকো , তবে সেক্ষেত্রে পবিত্র রমজান মাসে প্রবেশ করার আগেই ক্ষমাপ্রার্থনা করো। সর্বশক্তিমান খোদার প্রতি আন্তরিক মুনাজাতে তোমার অন্তরকে অভ্যস্ত করে ফেলো।
আল্লাহ না করুন , কিন্তু তোমরা না আবার এই পবিত্র রমজান মাসে পরচর্চা , গিবত ইত্যাদিতে , অর্থাৎ মোটকথা পাপে লিপ্ত হও এবং মহান আল্লাহ তায়ালার দেয়া এই উৎসবে সীমালঙ্ঘন করে নিজেদেরকে দূষিত করে ফেলো। এই সম্মানিত মাসে তোমাকে সর্বশক্তিমান আল্লাহর ভোজসভায় নিমন্ত্রণ করা হয়েছে , সুতরাং সর্বশক্তিমানের এই অপূর্ব উৎসবের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করো। অন্তত রোজা রাখার বাহ্যিক আনুষ্ঠানিক রীতি-নীতিকে সম্মান করো। (রোজা রাখার প্রকৃত রীতি-নীতিগুলো অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয় , আর সেজন্যে সার্বক্ষণিক যত্ন ও প্রচেষ্টা প্রয়োজন।) রোজা রাখার অর্থ কেবলমাত্র খাওয়া-দাওয়া থেকে বিরত থাকা নয় , বরং মানুষকে পাপ থেকেও বিরত থাকতে হবে। এটুকু হলো তাদের জন্য , যারা নিতান্তই আনকোরা। (স্বর্গীয় মানুষেরা , যাঁরা খোদার মহত্বের খনি উন্মোচন করতে চান , তাদের ক্ষেত্রে রোজার নিয়ম-কানুন এর থেকে আলাদা।) অন্ততঃ রোজার প্রাথমিক আদব কায়দা মেনে চলা উচিত , এবং যেভাবে করে পানাহার থেকে বিরত থাকো , ঠিক একইভাবে চোখ , কান এবং জিহবাকেও সীমালঙ্ঘন করা থেকে সংযত করো। এখন থেকে তোমাদের জিহবাকে অপরের সমালোচনা , গিবত , মন্দ কথা এবং মিথ্যা থেকে দূরে রাখো ; হিংসা-জিঘাংসা এবং অন্যান্য শয়তানী বৈশিষ্ট্যকে নিজের অন্তর থেকে বহিষ্কার করো। যদি পারো , আল্লাহ ছাড়া আর সবকিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলো। প্রতারণা না করে নিষ্ঠার সাথে কাজ করো। মানুষ এবং জ্বীনদের মধ্যে যেসব শয়তান আছে , তাদের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলো। যদিও আমরা দৃশ্যতঃ এই মহামূল্যবান মর্যাদাকে আমাদের লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করতে পারি না , অন্ততপক্ষে এটুকু নিশ্চিত করার চেষ্টা করো যেনো তোমার রোজার সাথে কোনো পাপ না থাকে। তা না হলে তোমার রোজা ইসলামী শরীয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক হলেও সেটা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।
কোনো কাজের ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক হওয়া না হওয়া এবং সেই কাজ আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হওয়া–
এই দুয়ের মাঝে বিরাট ব্যবধান আছে। যদি পবিত্র রমজান মাসের শেষে তোমাদের কথা ও কর্মে কোনো পরিবর্তন না আসে , তোমাদের আচার-আচরণ যদি রোজার মাসের আগের দিনগুলোর থেকে ভিন্ন না হয় , তাহলে এটা সুস্পষ্ট যে রোজার প্রকৃত তাৎপর্য তোমরা উপলব্ধি করতে পারো নাই। আর তোমরা যা করেছো , তা কেবলই দৈহিক রোজা।
এই মহান মাস , যে মাসে তোমাকে ঐশী উৎসবে নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছে , এসময়ে যদি তুমি খোদার ব্যাপারে মারেফত (অন্তর্দৃষ্টি) অর্জন করতে না পারো , কিংবা অন্ততঃ নিজের ব্যাপারে অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করতে না পারো , তাহলে বুঝে নিতে হবে তুমি আল্লাহর দেয়া এই উৎসবে ঠিকভাবে অংশগ্রহণ করো নাই। তোমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে এই পবিত্র মাস , যা কিনা“
আল্লাহর মাস”
, যে সময়ে খোদার বান্দাদের জন্যে ঐশী দয়ার দরজা খুলে যায়। এবং কিছু বর্ণনা অনুযায়ী এ সময়ে শয়তানদেরকে শিকল পরিয়ে রাখা হয় ; আর এমন সময়ে যদি তোমরা নিজেদের সংস্কার করতে না পারো , আত্মশুদ্ধি করতে না পারো , নফস-এ-আমারাহ কে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারো , নিজের স্বার্থপর কামনা-বাসনাকে দমন করতে না পারো , এই দুনিয়া ও বস্তুজগতের মায়া ত্যাগ করতে না পারো , তাহলে রোজার মাস শেষ হওয়ার পরে এগুলো অর্জন করা তোমাদের পক্ষে খুবই কঠিন হবে। তাই এই অপূর্ব দয়া শেষ হবার আগেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করো , আত্মসংস্কার করো , নিজেকে বিশুদ্ধ করে তোলো। রোজার মাসের দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করো। এমনটা যেনো না হয় যে , রমজান মাস আসার আগেই শয়তান তোমাকে এমনভাবে আক্রান্ত করে ফেলেছে যে , যখন শয়তানকে শিকলবন্দী করে রাখা হয়েছে , তখন তুমি নিজে থেকেই নানারকম পাপকাজ ও ইসলামবিরোধী কাজে লিপ্ত হয়ে পড়েছো ! অনেকসময় খোদা থেকে দূরে সরে যাবার কারণে এবং বড় বড় গুনাহের কারণে সীমালঙ্ঘনকারী পাপী মানুষ অজ্ঞতা ও অন্ধকারের এতই অতলে নেমে যায় যে , শয়তানের আর তাকে প্ররোচিত করার প্রয়োজন হয় না , বরং সে নিজেই শয়তানের রং ধারণ করে।“
সিবগাত আল্লাহ”
হলো শয়তানের রঙের বিপরীত।
যে ব্যক্তি স্বার্থপর কামনা-বাসনার পিছনে ছোটে যে শয়তানের প্রতি অনুগত , ধীরে ধীরে সে-ও শয়তানের রঙ ধারণ করে। অন্ততপক্ষে এই একটা মাসে তোমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত , এবং মহামহিম খোদা অসন্তুষ্ট হন , এমন কথা ও আচরণ এড়িয়ে চলা উচিত। এখনই , এই আজকের দিনেই খোদার সাথে চুক্তি করো যে পবিত্র রমজান মাসে তোমরা পরচর্চা , গিবত , অপরের সম্পর্কে মন্দ বলা , ইত্যাদি কাজ পরিত্যাগ করবে। তোমার জিহবা , চোখ , হাত , কান এবং অন্যান্য অঙ্গকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসো। নিজের কথা ও কর্মকে তদারকি করো। তাহলে হয়তো আল্লাহ তোমার দিকে দৃষ্টি দেবেন এবং দয়া করবেন। একমাস রোজার পর শয়তানকে যখন শিকলমুক্ত করা হবে , ততদিনে তোমার সংস্কার হয়েছে , তুমি বদলে গেছো , তুমি আর শয়তানের ধোঁকায় প্রতারিত হবে না , তুমি নিজেই নিজেকে বিশুদ্ধ করে তুলবে। আমি আবারো বলছি , পবিত্র রমজানের এই তিরিশটি দিনে তোমার জিহবা , চোখ , কান এবং সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে নিয়ন্ত্রণের প্রতিজ্ঞা করো। সেইসাথে তুমি যেসব কাজ করার চিন্তা করছো , বা যেসব বিষয় শোনার পরিকল্পনা করছো , সেসবের ব্যাপারে শরয়ী দৃষ্টিকোণ কী , সেদিকে সতর্ক নজর রাখো। এটা হলো রোজা রাখার প্রাথমিক এবং বাহ্যিক নিয়ম। অন্ততঃ রোজার এই বাহ্যিক রীতিনীতিটুকু পালন করো ! কাউকে গিবত করতে দেখলে তাকে থামাও , বলো যে রোজার এই ত্রিশ দিনে নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য আমরা (আল্লাহর সাথে) বিশেষ চুক্তি করেছি। আর যদি তাকে পরচর্চা থেকে বিরত করতে না পারো , তাহলে সেই স্থান ত্যাগ করো। বসে বসে গিবত শুনো না। মুসলমানেরা যেনো তোমার থেকে নিরাপদ থাকে।
যার চোখ , হাত জিহবা থেকে অপর মুসলিম নিরাপদ নয় , সে প্রকৃত মুসলিম নয় ; যদিও সে মুখে“
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”
উচ্চারণ করা আনুষ্ঠানিক ও বাহ্যিক মুসলমান। আল্লাহ না করুন , কিন্তু যদি তোমরা কাউকে আঘাত করতে চাও , গিবত করতে কিংবা অপবাদ আরোপ করতে চাও , তাহলে জেনে রাখা উচিত যে তোমরা তোমাদের প্রভুর সামনেই আছো। (এই মাসে) তোমরা সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালার অতিথি , (আর এসময়ে যদি কারো উপর অপবাদ আরোপ করো কিংবা গিবত করো , তবে সেক্ষেত্রে) মহামহিম খোদার সামনে তোমরা তাঁরই কোনো বান্দার সাথে দুর্ব্যবহার করবে , আর খোদার কোনো বান্দাকে অপবাদ দেয়া মানে হলো খোদাকেই অপবাদ দেয়া। তারা খোদারই বান্দা , বিশেষতঃ যদি তারা জ্ঞান ও তাক্বওয়ার পথে পণ্ডিত ব্যক্তি হয়ে থাকেন। লক্ষ্য করে দেখবে যে , ক্ষেত্রবিশেষে এজাতীয় মন্দ কাজ মানুষকে এমন অবস্থায় নিয়ে যায় যে মৃত্যুর মুহুর্তেও সে খোদাকে অস্বীকার করে ! সে ঐশী নিদর্শনসমূহকে অস্বীকার করে :“
অতঃপর যারা মন্দ কর্ম করত , তাদের পরিণাম হয়েছে মন্দ। কারণ , তারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে মিথ্যা বলত এবং সেগুলো নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করত।" (সূরা আর-রূম , 30:10) এগুলো ধীরে ধীরে ঘটে। আজকে একটা ভুল দৃষ্টিভঙ্গি , আগামীকাল একটু-আধটু গিবত , পরশু কোনো মুসলিমের বিরুদ্ধে অপবাদ , এমনি করে অন্তরে এসব পাপ একটু একটু করে জমা হয় ; অন্তরকে কালো করে দেয় , মারেফত (খোদার সম্পর্কে জ্ঞান) অর্জনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় , এবং এভাবে বাড়তে বাড়তে একপর্যায়ে মানুষ সবকিছু অস্বীকার করে অবশেষে সত্যকে প্রত্যাখ্যান করে।
কুরআনের কয়েকটি আয়াতের কিছু তাফসির অনুযায়ী , মানুষের কর্মকে রিভিউ করার জন্য রাসূল (সা.) ও নিষ্পাপ ইমামগণের (আ.) সামনে উপস্থাপন করা হবে। যখন রাসূল (সা.) তোমার কর্মকে রিভিউ করবেন এবং দেখবেন যে সেটা কতই না ভুল ও পাপে পূর্ণ , কতটা দুঃখিত তিনি হবেন ! তুমি নিশ্চয়ই খোদার মনোনীত বান্দাকে দুঃখিত ও চিন্তিত দেখতে চাও না , তুমি নিশ্চয়ই তাঁর মন ভেঙে দিতে চাও না , তাঁকে দুঃখ দিতে চাও না। যখন তিনি দেখবেন যে তোমার হিসাবের খাতা কেবলই গিবত , অপবাদ , অপর মুসলিমের সম্পর্কে নাহক কথায় পূর্ণ , আর দেখবেন যে তোমার সমস্ত মনোযোগের কেন্দ্র ছিলো যত দুনিয়াবী আর বস্তুবাদী বিষয় , আর তোমার হৃদয় ছিলো হিংসা , জিঘাংসা , সন্দেহপ্রবণতা ইত্যাদিতে পরিপূর্ণ–
সেক্ষেত্রে পরম পবিত্র আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর ফেরেশতাদের উপস্থিতিতে তিনি (রাসূল (সা.)) বিব্রত হতে পারেন যে তার সম্প্রদায় ও অনুসারীরা ঐশী দয়ার ব্যাপারে অকৃতজ্ঞ ছিলো , এবং বেখেয়াল হয়ে তারা দুর্বীনিতভাবে মহান স্রষ্টার আস্থা ভঙ্গ করেছে। আমাদের নিজেদের লোক , এমনকি যদি কম সম্মানিত ব্যক্তিও হয় , তবুও সে ভুল করলে আমরা বিব্রত বোধ করি। আর তোমরা তো আল্লাহর মনোনীত ব্যক্তির (মুহাম্মাদের) ক্বওম (জাতি) , (তাঁর ও তাঁর বংশধরদের উপর সালাম)–
আর মাদ্রাসায় দাখিল হওয়ার মাধ্যমে তোমরা নিজেদেরকে আল্লাহ , তাঁর রাসূল ও ইসলামের সাথে আরো বেশি সম্পর্কযুক্ত করে ফেলেছো। এই তোমরা যদি নোংরা কাজ করো , তবে নবী (সা.) ব্যথিত হবেন , তিনি এটা সহ্য করতে পারবেন না , আর আল্লাহ না করুন (একারণে) তোমরা ধ্বংস হয়ে না যাও। আল্লাহর রাসূল (তাঁর ও তাঁর বংশধরদের উপর সালাম) ও বিশুদ্ধ ইমামগণকে আল্লাহর সামনে দুঃখিত ও ব্যথিত কোরো না।
মানুষের অন্তর হলো আয়নার মতন–
উজ্জ্বল , পরিষ্কার–
কিন্তু বেশি বেশি দুনিয়ার মায়া আর পাপের কারণে সে আয়না অন্ধকার হয়ে যায়। রোজার মাধ্যমে মানুষ কামনা-বাসনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় , ভোগ-বিলাসকে দূরে সরিয়ে রাখে এবং আল্লাহ ব্যতীত আর সবকিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। কেউ যদি অন্ততঃ প্রতারণা না করে নিষ্ঠা সহকারে সর্বশক্তিমান আল্লাহর উদ্দেশ্যে রোজা রাখে , (আমি বলছি না যে অন্যান্য ইবাদতগুলো নিষ্ঠা সহকারে করতে হবে না ; অবশ্যই সবরকম ইবাদতই নিষ্ঠা সহকারে পালন করতে হবে) , তাহলে আশা করা যায় যে , অন্ততঃ এই একটা মাসে যথাযথভাবে রোজা রাখার পুরস্কার হিসেবে খোদার করুণা তাঁর বান্দার উপর বর্ষিত হবে , এবং বান্দার হৃদয়ের আয়না থেকে কলুষ ও অন্ধকার দূর হয়ে যাবে , এবং দুনিয়াবী আনন্দ থেকে সে মুখ ফিরিয়ে নেবে। আর যখন ক্বদরের রাত উপস্থিত হবে , তখন এই বান্দা আলোকিত হয়ে উঠবে , যেটা আল্লাহর ওলী আর প্রকৃত মুমিনেরা অর্জন করেন।
এ ধরণের রোজার পুরষ্কার হলেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা :“
সাওম আমার জন্য এবং আমিই এর পুরস্কার।”
আর কোনো কিছুই এমন রোজার পুরস্কার হতে পারে না। এমনকি স্বর্গীয় বাগানও এমন রোজার পুরস্কার হতে পারে না। কেউ যদি রোজাকে মনে করে একদিকে খাদ্যের জন্য মুখ বন্ধ রাখা আর অপরদিকে গিবতের জন্য মুখ খুলে দেয়া ; বন্ধু-বান্ধবদের সাথে উষ্ণ আড্ডায় সেহরি পর্যন্ত রাতভর পরচর্চায় লিপ্ত থাকা , তবে এমন রোজা কোনোই কাজে আসবে না , এর কোনো প্রভাবও থাকবে না। যে এভাবে রোজা রাখে , সেতো খোদার উৎসবে যোগ দেবার ন্যূনতম ভদ্রতাটুকু জানে না। সে তার দয়াময়ের হক নষ্ট করেছে–
দয়াময় আল্লাহ , যিনি কিনা মানুষ সৃষ্টির আগেই তার জীবন যাপন ও বৃদ্ধির সকল উপায় উপকরণের ব্যবস্থা করেছেন। তিনি পথপ্রদর্শনের জন্য নবী পাঠিয়েছেন। তিনি ঐশী গ্রন্থ নাযিল করেছেন। মানুষকে দান করা হয়েছে মহত্বের উৎস ও আলো (আল্লাহ তায়ালা) পর্যন্ত পৌঁছার শক্তি , দেয়া হয়েছে ইন্দ্রিয় , বুদ্ধিমত্তা ও তাঁর রহমত পাবার সম্মান। এখন তিনি (আল্লাহ) তাঁর বান্দাদেরকে তাঁর গেস্টহাউজে প্রবেশের আমন্ত্রণ দান করেছেন , যেনো মানুষ সেখানে রহমতের টেবিলে বসে খোদার শোকর গুজার করতে পারে এবং তাঁর যথাসম্ভব গুণকীর্তন করতে পারে। যে বান্দা খোদার পক্ষ থেকে এমন সুযোগ পায় , যে কিনা খোদার-ই দেয়া অফুরন্ত রিজিক গ্রহণ করছে–
সেই প্রভু , সেই মেজবানের বিরোধিতা করা কি এমন বান্দার সাজে ? খোদার দেয়া রিজিক ব্যবহার করে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁর বিরোধিতা করবে–
এটা কি বান্দার করা উচিত ? যে হাত মুখে তুলে খাইয়ে দেয় , সে হাতে কামড় দেয়ার মতই কি না এ ব্যাপারটা ? খোদার উপস্থিতিতে তাঁরই সভায় নিমন্ত্রিত হয়ে রূঢ় আচরণ , অশ্রদ্ধা , উদ্ধত কাজকর্ম ইত্যাদির মাধ্যমে মেজবানের (আল্লাহ) অসম্মান-ই কি করা হবে না ? মেজবানের সামনে নোংরা এবং খারাপ কাজ করলে সেটা মানুষের অকৃতজ্ঞতার চূড়ান্ত হবে।
(রমজানের এই) অতিথিদের অবশ্যই জানতে হবে কে তার মেজবান , এবং তাঁর মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। রোজার রীতিনীতির সাথে পরিচিত হতে হবে। সৎগুণাবলীর সাথে সাংঘর্ষিক কাজকর্মের মাধ্যমে খোদাদ্রোহীতা করা যাবে না। পরম সত্তার অতিথিদের জানতে হবে মহিমান্বিত প্রভুর সান্নিধ্য কী জিনিস–
যা পাওয়ার জন্য নবীগণ (আ.) ও ইমামগণ (আ.) সর্বদা প্রচেষ্টা চালাতেন ; আলো ও মহত্বের উৎসকে পেতে চাইতেন ।“
...এবং আমাদের অন্তরের দৃষ্টিকে তোমার দিকে তাকানোর মাধ্যমে আলোকিত করে দাও , যতক্ষণ না আমাদের অন্তর্দৃষ্টি আলোর পর্দাকে ছিন্ন করে মহত্ত্বের উৎসের সাথে মিলিত না হয়।”
আল্লাহর দেয়া এই সভা-ই হলো সেই“
মহত্ত্বের উৎস”
। সদা প্রশংসিত মহিমান্বিত খোদা তাঁর বান্দাদেরকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন আলো ও মহত্ত্বের উৎসে প্রবেশ করার জন্য। কিন্তু বান্দা যদি অযোগ্য হয় , তবে সে এই চমৎকার মহান অবস্থানে পৌঁছাতে পারবে না। সদাপ্রশংসিত খোদা তাঁর বান্দাদেরকে সবধরণের দয়া ও আধ্যাত্মিক প্রশান্তির উৎসবে আহবান জানিয়েছেন , কিন্তু যদি বান্দা এই সুউচ্চ অবস্থানে উপস্থিত হবার জন্য প্রস্তুত না থাকে , সে প্রবেশ-ই করতে পারবে না। এটা কী করে সম্ভব যে দেহ ও মনের পাপ , আধ্যাত্মিক অবিশুদ্ধতা ও নীচতা সহকারে কেউ তার প্রভুর গেস্টহাউজে প্রবেশ করবে তাঁর সান্নিধ্য পাবার জন্য ?
সেজন্যে যোগ্যতা প্রয়োজন। প্রস্তুতি নেয়া দরকার। অন্ধকারের পর্দা দ্বারা আবৃত অসম্মানিত দূষিত হৃদয় নিয়ে কোনো ব্যক্তি এই আধ্যাত্মিক তাৎপর্য ও সত্যগুলো উপলব্ধি করতে পারবে না। সেজন্যে অবশ্যই সেসব পর্দা , যা আল্লাহর সাথে অন্তরের মিলিত হবার পথে বাধা , সেগুলিকে ছিন্ন করতে হবে। তবেই না একজন চমৎকার খোদায়ী সান্নিধ্যে প্রবেশ করতে পারবে।