আধ্যাত্মিক বিস্ময় : শেইখ রজব আলী খাইয়্যাত

আধ্যাত্মিক বিস্ময় : শেইখ রজব আলী খাইয়্যাত0%

আধ্যাত্মিক বিস্ময় : শেইখ রজব আলী খাইয়্যাত লেখক:
: মুহাম্মদ ইরফানুল হক
প্রকাশক: ওয়াইজম্যান পাবলিকেশনস
বিভাগ: দর্শন এবং আধ্যাত্মিকতা

আধ্যাত্মিক বিস্ময় : শেইখ রজব আলী খাইয়্যাত

লেখক: মুহাম্মাদ রেইশাহরি
: মুহাম্মদ ইরফানুল হক
প্রকাশক: ওয়াইজম্যান পাবলিকেশনস
বিভাগ:

ভিজিট: 26989
ডাউনলোড: 4743

পাঠকের মতামত:

আধ্যাত্মিক বিস্ময় : শেইখ রজব আলী খাইয়্যাত
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 34 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 26989 / ডাউনলোড: 4743
সাইজ সাইজ সাইজ
আধ্যাত্মিক বিস্ময় : শেইখ রজব আলী খাইয়্যাত

আধ্যাত্মিক বিস্ময় : শেইখ রজব আলী খাইয়্যাত

লেখক:
প্রকাশক: ওয়াইজম্যান পাবলিকেশনস
বাংলা

প্রথম অধ্যায়

আত্মগঠনের পথ

হযরত শেইখ তার আকর্ষণীয় ক্ষমতা দিয়ে মেধাবী ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ দিতে ও আত্মগঠনে প্রভাবিত করতে খুব ভালোভাবেই সক্ষম ছিলেন। হযরত শেইখের এক শিষ্য বলেন :

একবার আমি হযরত শেইখ ও মরহুম আয়াতুল্লাহ শাহ আবাদির66 সাথে তাজরীশ স্কোয়ারে ছিলাম। হযরত শেইখ আয়াতুল্লাহ শাহ আবাদীকে খুবই পছন্দ করতেন , কেউ একজন এসে আয়াতুল্লাহকে জিজ্ঞেস করলো : আপনি সত্য বলেন না এই লোক (হযরত শেইখকে দেখিয়ে) ?

মরহুম শাহ আবাদী বললেন : কোন সত্যের বিষয়ে আপনি কথা বলছেন ? আপনি কী বুঝাতে চাইছেন ?

লোকটি আবার বললো : আপনাদের মধ্যে কে সঠিকটি বলে ?

আয়াতুল্লাহ শাহ আবাদী বললেন : আমি শেখাই এবং তারা (ছাত্ররা ) শেখে ; তিনি (হযরত শেইখ) তৈরী করেন এবং মানুষ গড়েন।

এটি ইঙ্গিত করে এ ঐশী ব্যক্তিত্ব ও সাধক কত বেশী বিনয়ী ও আত্ম -প্রত্যাখ্যানকারী ছিলেন এবং হযরত শেইখের বক্তব্য ও প্রশিক্ষণ দানের ক্ষমতা কত ফলপ্রসূ ছিলো।

ষাট বছর আমি ভুল পথে হাঁটছিলাম

ডঃ হামিদ ফারযাম হযরত শেইখের আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও কথার প্রভাব এভাবে বর্ণনা করেন :

প্রফেসর জালালুদ্দীন হুমাই তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নেতৃস্থানীয় সাহিত্যের প্রফেসর ছিলেন । তিনি মা আরিফ (আধ্যাত্বিক জ্ঞানে) , ফার্সী সাহিত্য এবং ইসলামী সূফীতত্ত্বের একজন বিখ্যাত বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিত্ব ছিলেন এবং আমার নিজেরও প্রফেসর ছিলেন। তিনি ষাট বছর বয়সে হযরত শেইখের সাক্ষাত লাভ করেন। আমি সতেরো বছর বয়সে প্রফেসর হুমাইর অধীনে পড়েছি। তিনি ইতোমধ্যেই আবু রিহান বিরুনীর আল-তাফহীমু লি আওয়াইল সানাআত আল-তানজীম এবং ইযযুদীন মাহমুদ কাশানীর মিসবাহ আল হিদায়া ওয়া মিফতাহুল কিফায়া সম্পাদনা করেছিলেন। তিনি খুবই বিজ্ঞতার সাথে গাযালী নামাহ লিখেছেন , যা হলো ইমাম গাযালীর জীবন ও কর্মের সংগ্রহ। তার মিসবাহ আল হিদায়া র ব্যাপক ভূমিকাটি নিজেই তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক সূফীতত্ত্বের একটি নিঁখুত কোর্স।

যাহোক এই সূফীসাধক আমার শিক্ষক ছিলেন ষাটোর্ধ বয়সে। প্রতিদিনকার মত একদিন আমি হযরত শেইখের সাথে দেখা করতে গেলাম। তিনি বললেন :

তোমার প্রফেসর জালালুদ্দীন হুমাই আমার কাছে এসেছিলেন। আমি তাকে কিছু বাক্য বললাম , তা এত গভীরভাবে তাকে স্পর্শ করলো যে সে নিজের কপালে আঘাত করলো এবং বললো : অদ্ভুত!! আমি ষাট বছর ধরে ভুল পথ ধরে হাঁটছিলাম

আসলে তা ছিলো হযরত শেইখের কথা ও ব্যক্তিত্বের প্রভাব যা প্রফেসর হুমাইর মত বিজ্ঞ ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন লোককে এত গভীর ভাবে স্পর্শ করেছিলো। আল্লাহ তাদের রুহের ওপর রহমত করুন। দোয়া ও নামাযের কিছু কিছু বৈঠকে যখন হযরত শেইখ নিবিষ্ট হতেন তখন বলতেন :

বন্ধুরা! যেসব কথা আমি আপনাদেরকে বলছি তা হচ্ছে আধ্যাত্মিকতার সর্বশেষ ক্লাসের কথা।

এবং সত্যিই তাই ছিলো।

হযরত শেইখের আরেক শিষ্য বলেন : হযরত শেইখের শিক্ষা তামাকে সোনায় পরিণত করে।

হযরত শেইখের মানুষ তৈরীর ক্ষমতার গোপন রহস্য হচ্ছে শ্রোতাদের ওপর তার প্রভাব এবং শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ধরন ও পদ্ধতি যা তিনি তার শিষ্যদের ওপর প্রয়োগ করতেন।

নিজের আচরণ দিয়ে নিজেকে তৈরী করা

ইসলামী ঐতিহ্যের দৃষ্টিতে নৈতিকতার শিক্ষকদের জন্য প্রধান শর্ত হচ্ছে তারা নিজেরা ঐভাবে চলতে বাধ্য যা তারা শেখান। এ বিষয়ে আমিরুল মুমিনীন ইমাম আলী (আঃ) বলেছেন :

যে জনগণকে পথ দেখাবার উদ্যোগ নেবে , অন্যকে শেখাবার আগে তার উচিৎ নিজেকে শেখানো (যথেষ্টভাবে) এবং অন্যকে ভালো আচরণ শেখানোর জন্য কথা বলার আগে তার নিজের চরিত্র দিয়ে তা শেখাবে। 67

সবচেয়ে অসাধারণ যে বৈশিষ্ট্য হযরত শেইখের আলোচনায় ছিলো তা হলো হযরত আমিরুল মুমিনীন (আঃ) এর উপরোল্লেখিত শিক্ষা পদ্ধতি প্রয়োগ করা এবং অন্যকে তার ভালো আচরণ দিয়ে আল্লাহর দিকে ডাকা।

যদি হযরত শেইখ মানুষকে তাওহীদের দিকে ডাকতেন , তাহলে তিনি ইতোমধ্যেই (أرباب متفرّقون ) বহু ইলাহ যারা নিজেদের মধ্যে

বিভেদ করে (ইউসুফঃ 39) এবং তারও ওপরে তার নফসের মূর্তিকে ধ্বংস করেছেন। তিনি যদি মানুষকে সব কাজে আন্তরিকতার দিকে ডাকতেন , তাহলে তার নিজের কাজ ও ভঙ্গি ছিলো সবটুকুই আল্লাহর প্রতি আন্তরিকতাপূর্ণ। যদি তিনি কখনো উদাসীনতা অনুভব করতেন , তাহলে আল্লাহর অনুগ্রহ তার সাহায্যে এগিয়ে আসতো এমনভাবে যে তিনি একবার বলেছেন :

যতবার আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য আমি সূইকে কাপড়ের ভেতর প্রবেশ করাতাম ততবারই তা আমার আঙ্গুলে ঢুকে যেতো।

আর তিনি যদি অন্যকে আল্লাহর প্রেমের দিকে ডাকতেন তাহলে তিনি নিজেই আল্লাহ প্রেমের আগুনে পুড়ছিলেন। যদি তিনি অন্যকে ডাকতেন জ্ঞান ও আত্মত্যাগের প্রতি এবং তাদের সেবার প্রতি , তাহলে তিনি নিজেই ছিলেন এ পথের অগ্রপথিক। যখন তিনি পৃথিবীকে বলতেন ডাইনী বুড়ি এবং অন্যদেরকে একে পছন্দ করার বিরুদ্ধে সতর্ক করতেন , তখন তার নিজের সাধক জীবন ছিলো এক পরিষ্কার প্রমাণ যে এ ডাইনী বুড়ি-র প্রতি তিনি ছিলেন পুরোপুরি অনাগ্রহী। আর সবশেষে তিনি যদি অন্যদেরকে বলতেন নফসের খেয়ালখুশীর বিরুদ্ধে আল্লাহর জন্য সংগ্রাম করতে , তাহলে তিনি নিজে ছিলেন এর অগ্রভাগে এবং ইউসুফ (আঃ) এর মতো কঠিন পরীক্ষায় বিজয়ী।

শিক্ষা পদ্ধতি

যে পদ্ধতিতে হযরত শেইখ তার শিষ্যদের আত্ম -গঠনের শিক্ষা দিতেন তা দু ভাগে ভাগ করা যায়:

1. উম্মুক্ত বৈঠক

2. ব্যক্তিগত সাক্ষাত

1. উম্মুক্ত বৈঠক

হযরত শেইখের উম্মুক্ত বৈঠকগুলো সপ্তাহে একদিন তার বাড়িতেই অনুষ্ঠিত হতো। একইভাবে বেশীরভাগ ইসলামী উৎসবের দিন , নিষ্পাপ ইমাম (আঃ)-র জন্ম দিন ও শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষ্যে তার বাড়িতেই বৈঠক করতেন। মুহাররম , সফর68 ও পবিত্র রমযানের সময় তিনি ওয়াজ নসীহতের অধিবেশনও রাখতেন। এগুলো মাঝে মাঝে তার বন্ধুদের বাড়িতে প্রায় দু বছরের মত চলেছে।

সাপ্তাহিক অধিবেশন বা বৈঠকগুলো হতো বৃহস্পতিবার মাগরিব ও ইশার নামাযের পর। নামাযের ইমামতি করতেন হযরত শেইখ। নামাযের পর তিনি মরহুম ফায়েদের69 কিছু ছোট কবিতা আকর্ষণীয় ও মনোমুগ্ধকর কন্ঠে আবৃত্তি করতেন যাতে ছিলো ইস্তেগফার (আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া) :

আমি ক্ষমা চাই আল্লাহর কাছে যা (আমি করেছি) মাশুক (আল্লাহ) ছাড়া অন্যের জন্য ,

আমি ক্ষমা চাই আমার কাল্পনিক অস্তিত্বের জন্য ,

যেদিন কোন মুহূর্ত পার হয়ে যায় তার সুন্দর চেহারা স্মরণ না করে ,

আমি ক্ষমা চাই আল্লাহর কাছে অসংখ্যবার সে মুহূর্তটির জন্য।

যে জিহ্বা বন্ধুকে স্মরণ করায় নিয়োজিত নয় ,

তার খারাপ থেকে সতর্ক হও এবং চাও আল্লাহর কাছে ক্ষমা ,

এর অবহেলার কারণে জীবন এসেছে তার শেষ প্রান্তে ,

আমি একটি ঘন্টার জন্যেও সচেতন ছিলাম না ,

আমি ক্ষমা চাই আল্লাহর কাছে (সে অবহেলার জন্য)।

হযরত শেইখের এক শিষ্য বলেন : তিনি এমনভাবে এ কবিতাগুলো গাইতেন যে আমরা না কেঁদে পারতাম না। অবশেষে অসাধারণ আকর্ষণীয় আধ্যাত্মিক অবস্থায় তিনি ইমাম যায়নুল আবেদীন (আঃ) এর পনেরোটি মোনাজাতের কোন একটি পড়তেন।

অন্য এক শিষ্য বলেন : তার দোয়ার অনুষ্ঠানে আমি কাউকে তার চেয়ে বেশী কাঁদতে দেখি নি ; তার কান্না ছিলো সত্যিই হৃদয় বিদারক।

দোয়ার শেষে , চা পরিবেশনের পর হযরত শেইখ কথা বলতে ও নসিহত করা শুরু করতেন। তিনি ছিলেন খুবই ভালো বক্তা ; তিনি তার বক্তব্যে অন্যদের কাছে পৌঁছে দিতেন যা তিনি কোরআন ও হাদীস থেকে পেয়েছেন এবং তাও যা তিনি তার নিশ্চিত জ্ঞানের মাধ্যমে জেনেছেন।

বৈঠকে উপস্থিত ব্যক্তিদের সম্বোধন করার জন্য যে শব্দটি তিনি বেশীরভাগ সময়ই ব্যাবহার করতেন তা হলো রুফাক্বা (বন্ধুরা) ; এবং তার বক্তব্যের প্রধান বিষয়গুলো ছিলো : তাওহীদ , আন্তরিকতা , অন্তরে আল্লাহ প্রেমের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি , আল্লাহর নৈকট্য , মানুষের সেবা , আহলুল বায়েত (আঃ) এর কাছে অনুরোধ (তাওয়াসসূল) , ফারাজের অপেক্ষা ; আর সতর্ক করতেন দুনিয়া প্রেম থেকে , আত্ম -প্রাধান্য ও নফসের খেয়াল খুশী থেকে। পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে উপরোক্ত বিষয়গুলো বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

ড: সুুবাতি হযরত শেইখের সাথে তার পরিচয়ের শুরু সম্পর্কে এবং তার বৈঠকগুলো কেমন ছিলো সে সম্পর্কে বলেন : হাই স্কুলের শেষ দিকে আমাকে হযরত শেইখের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন ড: আব্দুল আলী গুইয়া , যিনি - নিউক্লিয়ার ফিজিক্স -এ ফ্র্যান্স থেকে পি এইচ ডি ডিগ্রী অর্জন করেছিলেন এবং হযরত শেইখের বৈঠকে দশ বছর যোগদান করেছিলেন। তার বৈঠক ছিলো সংক্ষিপ্ত , ব্যক্তিগত এবং খুব কম লোকই উপস্থিত থাকতেন। যখনই বৈঠকে খুব বেশী লোক হয়ে যেত এবং অচেনা লোকেরাও উপস্থিত হয়ে যেত তিনি অস্থায়ী ভাবে বৈঠক স্থগিত ঘোষণা করতেন। এর অর্থ তিনি অনুসারীদের সংখ্যা বৃদ্ধিতে উৎসাহী ছিলেন না।

শুধু কিছু কথা , কিছু উপদেশ এবং প্রচার যা দোয়াতে গিয়ে শেষ হতো এছাড়া বৈঠকে আর কিছু উপস্থাপন করা হতো না। যদিও কথাগুলো ছিলো পুনরাবৃত্তিমূলক কিন্তু বৈঠক ছিলো আধ্যাত্মিকভাবে এতই আকর্ষণীয় যে যা কিছু পুনরাবৃত্তিমূলক কথা আমরা শুনতাম তা আমাদের মোটেও ক্লান্ত ও বিরক্ত করতো না।70 যেমন কোরআনের আয়াত আপনি যতই তেলাওয়াত করেন তা সবসময় সতেজ ও সুখকর। তার কথাও ছিলো সবসময় সতেজ ও সুখকর।

বৈঠকগুলো ছিলো এতই আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ যে , কেউই ব্যক্তিগত ও দুনিয়াবি বিষয় তুলতো না এবং কেউ যদি হঠাৎ বস্তুগত বিষয়ে কথা বলেই ফেলতো তার আশে পাশের লোকেরা তাকে উপেক্ষা করতো অবজ্ঞা অথবা এমনকি ঘৃণাভরে। হযরত শেইখের কথা প্রধানত ছিলো : আল্লাহর নৈকট্য আল্লাহর প্রেম ও এবং আল্লাহর দিকে সফর। তিনি আল্লাহর নৈকট্য এভাবে সংক্ষেপে বর্ণনা করতেন :

তোমার উচিত তোমার উসসা (উস্তাদ) পরিবর্তন করা , অর্থাৎ তুমি এ পর্যন্ত যা করেছো তা কেবল তোমার নিজের জন্য। এখন থেকে , যাই তুমি করো , আল্লাহর জন্য করো এবং (জেনে রেখো) এটি হচ্ছে আল্লাহর দিকে সবচেয়ে কাছের রাস্তা। নিজের সত্তাকে পায়ের নিচে ফেলো , মাশুককে জড়িয়ে ধরো। 71

সব মানবিক স্বার্থপরতা আত্ম -প্রেমের কারণে ঘটে , তুমি কিছুই হতে পারবে না যতক্ষণ না তুমি আল্লাহ প্রেমিকে পরিণত হবেঃ

যদি তুমি নিজেকে পরিত্যাগ করো , তুমি মাশুকের সাথে মিলিত হবে ; না হয় চিরদিনের জন্য জ্বলতে থাকো , কেননা তোমার অবস্থা অপরিপক্ক।

তোমার উচিত তাঁর প্রেমে কাজ করা । তা হলো , তাকে ভালোবাসো এবং কাজ করো তাঁর ভালোবাসার কারণে। তাকে ভালোবাসা ও তার জন্যে কাজ করা হলো আধ্যাত্মিক অগ্রগতির রহস্য যা মানবজাতি করতে পারে এবং তা সম্ভব। তাই , সব মানবিক অগ্রগতি অর্জন সম্ভব প্রবৃত্তির ইচ্ছার বিরোধিতা করে ; তুমি তা অর্জন করতে পারবে না যতক্ষণ না তুমি তোমার নফসের (প্রবৃত্তির লালসা) সাথে কুস্তি লড়ো এবং কুপোকাত না করো।

তিনি আমিত্বের বিষয়ে বলেনঃ

এখানে ক্লান্ত শরীর ও ভগ্ন হৃদয় কেনাও উত্তম , আমিত্ব বি ক্রি র বাজার এ বাজার থেকে অনেক দূরে।

এবং তিনি আরও বলেন :

তোমার মূল্য তত বেশী যতটা তুমি দাবী করবে ; তুমি যদি আল্লাহকে দাবী করো তাহলে তোমার মূল্য অসীম। আর যদি তুমি পৃথিবী (পৃথিবীর সম্পদ) দাবী করো তোমার মূল্য তত নিচু যা তুমি আশা করেছো। কখনো বলো না আমি এটি চাই , ওটি চাই (বরং) দেখো আল্লাহ কী চান। যদি তুমি কোন ভোজ দাও , দেখো তুমি কাকে দাওয়াত করছো যাকে তোমার ইচ্ছা নাকি আল্লাহ যাকে চান তুমি দাওয়াত করো তাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি তোমার প্রবৃত্তির ইচ্ছার পদাঙ্ক অনুসরণ করবে তুমি কোথাও পৌঁছাতে পারবে না। অন্তর হচ্ছে আল্লাহর বাসস্থান। এখানে কাওকে প্রবেশ করতে দিও না। শুধু আল্লাহ বাস করবেন এবং আল্লাহ কর্তৃত্ব করবেন তোমার অন্তরে। ইমাম আলী (আঃ)- কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো তিনি কীভাবে এতো উচ্চ মাক্বাম অর্জন করেছিলেন। তিনি উত্তরে বললেন :

আমি অন্তরের প্রবেশ দ্বারে বসেছিলাম এবং আল্লাহ ছাড়া কাউকে ঢুকতে দিই নি।

তার সংক্ষিপ্ত কথার পর হালকা নাস্তা পরিবেশন করা হতো এবং এর পর মুনাজাত শুরু হতো। তার মুনাজাত ছিলো খুবই মনোজ্ঞ এবং আধ্যাত্মিক অবস্থা ছিলো মনমুগ্ধকর। তিনি দোয়া সাধারণভাবে ও আনুষ্ঠানিকভাবে আবৃত্তি করতেন না , বরং তা ছিলো যেন নিচু স্বরে প্রিয়তমার কাছে প্রেমের গান । তিনি এমনভাবে ডুবে যেতেন মাশুকের ভেতর মুনাজাতের সময় যেন তা ছিলো কোন মা তার হারানো সন্তান খুঁজছে ; আন্তরিকভাবে কান্না- কাটি করতেন ও বিলাপ করতেন এবং কথা বলতেন বন্ধুর সাথে তাঁর পবিত্র উপস্থিতিতে।

কোন কোন সময় মনে হতো তিনি মুনাজাতের সময় ঐশী প্রেরণা লাভ করতেন যার চিহ্ন ও প্রভাব তার কথায় ও আচরণে প্রকাশ পেতো। তিনি অনেক দুঃখ করতেন যে তার বন্ধুরা ততটুকু অগ্রসর হতে পারে নি যতটুকু তিনি তাদের নিয়ে আশা করেছিলেন। তিনি চাইতেন যেন তার বন্ধুদের শীঘ্র চোখ খুলে যায় এবং ফেরেশতা ও পবিত্র ইমামদের (আঃ) দেখতে পায়।

যখন কেউ যিয়ারত থেকে [পবিত্র ইমামদের (আঃ) মাযার থেকে] ফিরে আসতেন তিনি তাদের জিজ্ঞেস করতেন : তুমি কি সেই বরকতময় সত্তাকে দেখেছো ?

অবশ্যই কেউ কেউ এ বিষয়ে সফল হয়েছিলেন , ভালো আধ্যাত্মিক অবস্থান অর্জন করেছিলেন এবং এমনকি কিছু ঐশী প্রেরণাও লাভ করেছিলেন। অন্যরা অবশ্য পেছনে পড়েছিলেন।

যা হোক তার মুনাজাত ছিলো মনমুগ্ধকর ও উজ্জীবীতকারী। তিনি মুনাজাতের অর্থগুলো জানতেন এবং তার কিছু শব্দগুচ্ছের ওপর জোর দিতেন পুনরাবৃত্তি করে এবং কোন কোন সময় ব্যাখ্যা করে। তিনি দোয়ায়ে ইয়াসতাশির মুনাজাতে খামসা আশার প্রায়ই পড়তেন। তিনি বিশ্বাস করতেন দোয়ায়ে ইয়াসতাশির72 হলো আল্লাহর প্রতি প্রেমের প্রকাশ।

মোহাররম মাসে তিনি খুব কম কথা বলতেন ; তিনি এর পরিবর্তে আহলুল বায়েতের দুঃখ কষ্ট বর্ণনা সম্বলিত তাক্বদীসের কিছু কবিতা আবৃত্তি করতেন এবং কাঁদতেন , তারপর মুনাজাত করতেন।

বিরত থাকার উপর গুরুত্ব দান

হযরত শেইখ বিশ্বাস করতেন মানুষ সৃষ্টির পেছনে যে প্রজ্ঞা রয়েছে তা হলো তার আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করা (পৃথিবীতে)।73 যখন মানুষ এ মাক্বাম অর্জন করে তখন সে ঐশী কাজ সম্পাদন করে। যে পথে এ স্থানে পৌঁছানো যায় তা হলো আল্লাহর অনুগত্য ও প্রবৃত্তির বিরোধিতা করার মাধ্যমে। এ বিষয়ে তিনি বলেন : একটি হাদীসে কুদসীতে বলা হয়েছে :

হে আদমের সন্তান! আমি সব কিছু তোমার জন্য সৃষ্টি করেছি এবং তোমাকে তৈরী করেছি আমার জন্য। 74

আমার দাস! আমাকে মেনে চলো ঐ পর্যন্ত যখন আমি তোমাকে বানিয়ে ফেলবো আমার মত অথবা আমার উদাহরণ। 75

প্রিয় বন্ধুরা! এসব হাদীস অনুযায়ী আপনারা আল্লাহর প্রতিনিধি ; আপনারা নাশপাতির মত , ফলের রাজা! নিজেদের মূল্য বুঝুন , শরীরী সত্তার খেয়াল খুশী অনুসরণ করবেন না , আল্লাহকে মেনে চলুন যেন আপনারা একটি উচ্চস্থান অর্জন করতে পারেন যা আপনাদেরকে ঐশী কাজ করতে সক্ষম করবে। আল্লাহ বিশ্ব জগতের পুরোটাকে সৃষ্টি করেছেন আপনাদের জন্য এবং আপনাদের সৃষ্টি করেছেন তার জন্য। দেখুন কী উচ্চ মাক্বামইনা তিনি আপনাদের দান করেছেন।

হযরত শেইখ বিশ্বাস করতেন ব্যক্তিকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেয়া হবে যখন সে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে মাক্বাম অর্জন করবে। তিনি বলতেন : যে ভাবে চামচ খাবার খাওয়ার জন্য , কাপ চা খাওয়ার জন্য , সে ভাবে ব্যক্তি মানুষ হওয়ার জন্য।

তিনি বারবার বলতেন :

আল্লাহ আমাকে কারামত দিয়েছেন ; তোমরাও আল্লাহর কাজ করো তিনি তোমাদেরকেও তা দিবেন। হে রাজমিস্ত্রী , হে দর্জি! যখন তুমি ইট বসাও অথবা সেলাই করো সূঁচ দিয়ে তা করো আল্লাহর প্রেম নিয়ে এবং আল্লাহ সম্পর্কে সচেতন থাকো , যখন তোমরা পোষাক পড়বে যার একগজ একশত তোমান , বলো না আমি এটি কিনেছি এক মিটার একশত তোমানে।76 এর পরিবর্তে বলো , আল্লাহ এটি আমাকে দান করেছেন। আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করো! নিজের প্রতিনিধিত্ব করো না!

অভ্যন্তরীণ অবস্থা জানা

হযরত শেইখ শ্রোতাদের অভ্যন্তরীণ অবস্থা সম্পর্কে জানতেন অতিন্দ্রীয় ক্ষমতা দিয়ে। কিন্তু তিনি কখনই সবার সামনে কোন ব্যক্তির দুর্বল দিকটি প্রকাশ করতেন না। অবশ্য তিনি তা এমনভাবে করতেন যে ব্যক্তি নিজে সেই সতর্কবানী বুঝতে পারতো এবং চেষ্টা করতো নিজেকে শুদ্ধ করতে। এরকম দু টো ঘটনার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা নিচে দেয়া হলোঃ

হযরত শেইখকে পরীক্ষায় ফেলা

একজন বিখ্যাত ধর্মপোদেষ্টা বলেন : এক অপরাহ্নে , 1956 সনে আমি তেহরানের বাজারে মসজিদে শেইখ আব্দুল্লাহ হোসেইনের পাশে মাদ্রাসা-ই-শেইখ আব্দুল্লাহ হোসেইনে ছিলাম। হযরত শেইখ রজব আলীর বিখ্যাত শিষ্য শেইখ আব্দুল করীম হামিদ আমার কাছে এসে তার উস্তাদ হযরত শেইখ রজব আলী সম্পর্কে কথা বললেন এবং বললেন তার ইখলাসের ও আধ্যাত্মিক মাক্বামের কথা। সবশেষে আমাকে হযরত শেইখের বৈঠকে বৃহস্পতিবার দিনে তার সাথে যেতে বললেন। আমি তার সাথে গেলাম। আমরা যখন এসে পৌঁছুলাম হযরত শেইখ তখন কিবলামূখী হয়ে বসে ছিলেন এবং আমিরুল মুমিনীন আলী (আঃ) এর একটি মুনাজাতে নিমন্ন ছিলেনঃ

হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে নিরাপত্তা চাই সেই দিনের যেদিন না সম্পদ , না সন্তান কোন উপকারে আসবে।

একই সময় তার পিছনে বসে থাকা তার ভক্তরা মুনাজাতটি তার সাথে আবৃত্তি করছিলেন। আমিও লোকজনের পেছনে সর্বশেষ সারিতে বসে পড়লাম এবং মনে মনে বললাম : হে আল্লাহ! যদি তিনি আপনার অলীদের একজন হন তাহলে আমার বৈঠকগুলোর আকার বড় করে দিন যেন আমি তা থেকে ভালো বস্তুগত সুবিধা পেতে পারি! যখনই এ চিন্তা আমার মন ছুঁয়ে গেলো , হযরত শেইখ তার দোয়ার মাঝখানে বললেনঃ

আমি বলছি অর্থের কথা ভুলে যাও , কিন্তু সে এখানে এসেছে আমাকে অর্থ দিয়ে পরীক্ষা করতে।

তিনি তা ফার্সীতে বললেন এবং তারপর মুনাজাত (আরবীতে) আবৃত্তি করে যেতে লাগলেনঃ

আমি আপনার নিরাপত্তা চাই সে দিন যে দিন না সম্পদ----

একজন গুপ্তচরের উপস্থিতি

ক্রমা ন্নয়ে উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তা এবং বিখ্যাত ব্যক্তিরাও হযরত শেইখের বৈঠকে যোগদান করতে লাগলো। হযরত শেইখের মতে তারা আসতো তাদের সমস্যা সমাধানের জন্য এবং হযরত শেইখের বাড়িতে ডাইনী বুড়ির (পৃথিবীর) খোঁজে। এর পরও কেউ কেউ হযরত শেইখের খোতবা থেকে উপকৃত হতেন তাদের ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী।

এ ধরনের ব্যক্তিত্বদের উপস্থিতির কারণে শাহের গোয়েন্দা বিভাগ বৈঠকগুলোর ব্যাপারে সন্দেহ করতে শুরু করে এবং হাসান-ইল-বেইগী নামে এক মেজরকে ভিন্ন পরিচয়ে , আরেকজন গুপ্তচরের সাথে নিযুক্ত করে বৈঠকে যোগদান করতে। রিপোর্ট করার জন্য সরকারী কর্মকর্তারা কেন বৈঠকে যোগদান করছে তা যেন তারা জানতে পারে।

যখন গোয়েন্দা বিভাগের এ চর বৈঠকে প্রবেশ করলো হযরত শেইখ তার খোতবার মাঝে বললেন , তার শ্রোতাদের উপদেশ দিয়েঃ

মনোযোগ দাও আল্লাহর দিকে এবং আল্লাহ ছাড়া কাউকে তোমার অন্তরে ঢুকতে দিও না। কারণ অন্তর হচ্ছে আয়না র মত এবং যদি তাতে সামান্য দাগ পড়ে তা খুব দ্রুতই দেখবে। এখন , কেউ দেখতে মনে হয় গোয়েন্দা এবং আসে নাম বদলে ; উদাহরণ স্বরূপ তার নাম হাসান কিন্তু সে ভান করে অমুক।

এ কথাগুলো গোয়েন্দা বিভাগের চরকে এতটা মুগ্ধ ও আশ্চর্যান্বিত কওে দেয় যে , মেজর হাসান ইল বেইগী , যার সত্যিকার নাম কারো জানা ছিলো না , সে সাভাক (গোয়েন্দা বিভাগের নাম) থেকে ইস্তফা দেয়।

প্রথমে তোমার বাবাকে সন্তুষ্ট করো!

কোন কোন সময় হযরত শেইখ কিছু কিছু ব্যক্তিকে তার বৈঠকে ঢুকতে দিতেন না অথবা তাদের ওপর শর্ত আরোপ করতেন। হযরত শেইখের একজন শিষ্য যিনি তার সাথে 20 বছর ছিলেন তিনি বর্ণনা করেন কীভাবে তার হযরত শেইখের সাথে সম্পর্ক শুরু হয়ঃ প্রথম দিকে আমি যতভাবেই চেষ্টা করলাম তার বৈঠকে যোগদান করতে তিনি আমাকে অনুমতি দিলেন না। একদিন আমি তাকে মসজিদ-ই জামাহতে দেখতে পেলাম এবং সালাম দেয়ার পর তাকে জিজ্ঞেস করলাম কেন তিনি আমাকে তার বৈঠকে প্রবেশ করতে দেন না। তিনি বললেন :

প্রথমে তুমি তোমার বাবাকে খুশী করো , তার পর আমি তোমার সাথে কথা বলবো।

সে রাতে আমি বাড়ি চলে গেলাম এবং আমারে বাবার পায়ে পড়ে গেলাম। তাকে অনুরোধ করলাম আমাকে ক্ষমা করে দেয়ার জন্য। আমার বাবা খুব অবাক হয়ে বললেন : কী হয়েছে ?

আমি বললাম :

আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না , শুধু ক্ষমা করে দিন।

আমি জানতাম না যে আমি কী করছিলাম এবং সবশেষে আমার বাবা আমাকে ক্ষমা করে দিলেন।

পরদিন সকালে আমি হযরত শেইখের বাড়ি চলে গেলাম। আমাকে দেখার সাথে সাথে তিনি বললেন :

ভালো করেছো ! এখন এসো এবং আমার পাশে বসো

তখন থেকে অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইন্তেকাল পর্যন্ত আমি তার সাথে ছিলাম।

2. বিশেষ দিক নির্দেশিকা

একজন নিখুঁত উস্তাদের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আল্লাহর পথে তার দিক নির্দেশনা যা সন্ধানকারীকে সত্য সন্ধানের বিভিন্ন ধাপে তার অবস্থান অনুযায়ী পথ দেখাবে। অবশ্যই এ দায়িত্বটি প্রকাশ্যে অন্যদের সামনে করা সম্ভব নয়।

একজন ডাক্তার যতই বিশেষজ্ঞ ও অভিজ্ঞ হোক সব রোগীকে একই পেস ক্রি পশনে একই ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করতে পারেন না। প্রত্যেক রোগীর ভিন্ন ও নির্দিষ্ট ওষুধ প্রয়োজন। এটিও সম্ভব যে কোন কোন কারণে দু জন রোগীকে একই রোগের জন্য ভিন্ন ওষুধ দেয়া হয়। আত্মার রোগের জন্যও এটি সত্য।

নৈতিকতার একজন শিক্ষক প্রকৃতপক্ষে একজন মানুষের আত্মার শিক্ষক। তিনি নৈতিকতা সম্পর্কীত রোগগুলিকে আরোগ্য করতে পারেন যদি তিনি তা প্রথমেই চিহ্নিত করতে পারেন ঐ রোগের উৎসকে এবং তার কাছে যদি যথাযথ ওষুধও থাকে।

আল্লাহর রাসূলগণ (আঃ) ছিলেন আত্মার প্রধান শিক্ষক ও প্রশিক্ষক। তারা এ ধরণের বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন। তারা শুধু মানব সমাজের সাধারণ প্রয়োজন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন না বরং সাথে সাথে সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির ব্যক্তিগত প্রয়োজন সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন ছিলেন।

ইমাম আলী (আঃ) হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর বৈশিষ্ট সম্পর্কে বলেনঃ

তিনি ছিলেন একজন চিকিৎসক , তার চিকিৎসা জ্ঞান নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়াতেন তার রোগীর খোঁজে। আর তার ওষুধ ও যন্ত্রপাতি সব সময় প্রস্তুত থাকতো। সেগুলো ব্যবহার করা হতো প্রয়োজন অনুযায়ী এবং আরোগ্য করতেন আত্মাগুলোকে যেগুলো ভুগছিলো অন্ধত্বে , বধিরতায় ও বাকশক্তিহীনতায়। তার ওষুধ নিয়ে তিনি খুঁজে ফিরতেন অবহেলার বাড়িগুলো ও হতবিহবল অবস্থানগুলো। 77

যারা আধ্যাত্মিক আলেম তারা নবীদের প্রকৃত উত্তরাধিকারী ও তাদের প্রতিনিধি। তাদেরও এ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তারাই যারা আমিরুল মুমিনীন আলী (আঃ) এর মতে :

সত্য অর্ন্তদৃষ্টির উপর ভিত্তি করে জ্ঞান তাদের কাছে পৌঁছেছে এবং তারা নিশ্চিত হয়েছে এমন রুহ অর্জন করেছে। 78

অবশ্যই যেভাবে আমিরুল মুমিনীন (আঃ) বলেছেন :

আধ্যাত্মিক আলেম যারা সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে সর্বোচ্চ মাক্বামের অধিকারী তারা সংখ্যায় খুব কম। 79

একজন নিখুঁত শিক্ষকের কথা

মরহুম আয়াতুল্লাহ মির্যা আলী (রঃ) বলেছেন : এই পথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে একজন জ্ঞানী ও নিস্বার্থ পূর্ণতাপ্রাপ্ত (কামিল) উস্তাদ পাওয়া। যখন কোন ব্যক্তি আল্লাহর পথে সন্ধানকারী হয় যদি সে তার জীবনের অর্ধেকও উস্তাদ খোঁজায় ব্যয় করে ফেলে তাও যথাযথ। যে তার উস্তাদ খুঁজে পেয়েছে সে তার অর্ধেক পথ অতিক্রম করেছে।

হযরত শেইখের শিষ্যদের প্রতি তার পথ নির্দেশনার গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় যে আমিত্ব প্রত্যাখান , আন্তরিকতা এবং অদৃশ্য থেকে সাহায্যের মাধ্যমে তিনি আত্মিক পূর্ণতার এমন উঁচু স্থানে উঠেছিলেন যে তিনি সক্ষম ছিলেন অন্যদের জীবনের আত্মিক রোগ ও সমস্যা চিহ্নিত করতে এবং তাদের আরোগ্য ও সমাধান করতে। এ বাস্তবতা সুস্পষ্ট তাদের কাছে যারা হযরত শেইখের জীবনের সাথে পরিচিত ছিলেন।

জীবনে গুনাহ ও দূর্যোগ

ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের অনুচিত কাজগুলো তার সমস্যা ও দূর্যোগ হওয়ার মূল কারণ। পবিত্র কোরআন বলে :

) وَمَا أَصَابَكُمْ مِنْ مُصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ(

যে দূর্যোগ তোমার আসে তা তোমার হাতের উপার্জনের কারণে। (আল শুরা : 30)

উপরের আয়াতটি ব্যাখ্যা করে আলী (আঃ) বলেনঃ

গুনাহ সম্পর্কে সতর্ক হও , যেহেতু সব দূর্যোগ ও রিয্ক্বে দোষত্রুটি এমনকি গায়ে আঁচড় লাগা অথবা মাটিতে পড়ে যাওয়া গুনাহ করার কারণে ঘটে। কারণ , সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেনঃ যে কোন দূর্যোগ তোমার ঘটে তা তোমার হাত যা উপার্জন করেছে তার জন্য। 80

যদি কোন ব্যক্তি সত্যিই বিশ্বাস করে যে অনুচিত কাজগুলো মৃত্যুর পরের জীবনেই শুধু দুঃখ কষ্ট আনবেনা এ পৃথিবীতেই বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত করবে তখন সে অন্যায় কাজ করা এড়িয়ে চলবে। সে সম্পর্কে ভাববেও না। এ বিশ্বাস যতই দৃঢ় হবে ততই ধার্মিক ব্যক্তি তৈরীর ভিত্তি প্রস্তুত হবে।

হযরত শেইখ তার অতিন্দ্রীয় বোধশক্তি ও আত্মার দৃষ্টি দিয়ে বাস্তবেই দেখতে পেতেন কষ্ট ও সমস্যার সাথে সম্পর্কিত খারাপ কাজগুলোকে এবং সেগুলো উল্লেখ করে তিনি মানুষের সমস্যার ও কষ্টের সমাধান করতেন। আত্ম -গঠনের এ পদ্ধতি ব্যবহার করে তিনি তাদের কামালিয়াতে বা পরিপূর্ণতার দিকে পরিচালিত করতেন।

আমরা আপনার কাছেও বাকিতে বিক্রী করি!

হযরত শেইখের এক সন্তান বলেন :

একদিন বিখ্যাত মরহুম মুরশিদ চিলোই81 হযরত শেইখের কাছে গেলেন এবং তার ব্যাবসায় মন্দা চলবার অভিযোগ করে বললেন : দাদাশ (বন্ধু)! আমরা কী এক অবস্থার ভিতর পড়েছি ?! দীর্ঘদিন আমাদের সমৃদ্ধশালী অবস্থা হয়েছিলো। আমরা 3-4 টি বড় পাতিল ভরতি চেলো (রান্না চাল) বি ক্রী করতাম অনেক ক্রে তার কাছে। কিন্তু হঠাৎ করে সব বদলে গেছে এবং ক্রে তারা একের পর এক আমাদের পরিত্যাগ করেছে। বি ক্রী খুব ধীর এবং আমরা সারা দিনে এক পাতিলও বি ক্রী করি না ।

হযরত শেইখ একটু ভাবলেন এবং বললেন : এটি তোমার ত্রুটি ; তোমরা ক্রে তাদের প্রত্যাখ্যান কর।

মুরশিদ বললেন : আমি কাউকে প্রত্যাখ্যান করিনি ; এমনকি আমি বাচ্চাদের পরিবেশন করি এবং তাদেরকে অর্ধেকটা কাবাব দেই।

হযরত শেইখ বললেন :

কে ছিলো সেই সাইয়্যেদ যে তিন দিন (তোমার ওখানে) বাকীতে খেয়েছিলো এবং শেষবার তোমরা তাকে দোকান থেকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিলে।

খুব লজ্জিত হয়ে মুরশিদ হযরত শেইখের ওখান থেকে চলে গেলেন এবং দ্রুত ঐ সাইয়্যেদ এর খোঁজ করলেন। যখন তিনি তাকে পেলেন তিনি তার কাছে ক্ষমা চাইলেন এবং রেষ্টুরেন্টের জানালায় একটি নোটিশ টাঙ্গিয়ে দিলেন :

আমরা বাকীতে বি ক্রী করি , এমন কি আপনার কাছেও , নগদ অর্থ ও ঋণ দিবো যতটুকু আমাদের সম্ভব!

বাচ্চাকে কষ্ট দেয়া

হযরত শেইখের একজন মর্যাদাবান শিষ্য বলেছেন :

আমার দু বছরের পুত্রটি , যে এখন চল্লিশ বছর বয়স্ক। তার বিছানা ভিজিয়ে ফেললো এবং তার মা তাকে এমন মার দিলো যে তার প্রায় মারা যাবার মত অবস্থা হলো। এক ঘন্টা পর আমার স্ত্রীর এত জ্বর এলো যে আমরা তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিলাম ডাক্তারদের কাছে। ওষুধের জন্য ষাট তোমান খরচ করলাম কিন্তু জ্বর কমলো না বরং আরো খারাপ হলো। আমরা ডাক্তারের সাথে আবার দেখা করলাম আরো চল্লিশ তোমান খরচ করে যা আমাদের জন্য সে দিনগুলোতে খুব বেশী ছিলো।

যাহোক , সে সন্ধ্যায় আমি হযরত শেইখেকে তুলে আনলাম তার সাথে তার বৈঠকে যাওয়ার জন্য। আমার স্ত্রীও গাড়িতে ছিলো। যখন হযরত শেইখ গাড়িতে উঠলেন আমি আমার স্ত্রীকে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম ; বললাম : এ হলো আমার সন্তানের মা। তার জ্বর এসেছে। আমি তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু জ্বর কমে নি।

হযরত শেইখ আমার দিকে তাকালেন এবং আমার স্ত্রীকে বললেনঃ একটি বাচ্চাকে এভাবে মারা উচিত নয় ; তার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও , যাও তাকে খুশী করো এবং তার জন্য কিছু কিনো , সে অসুখ থেকে সেরে উঠবে।

আমরা তাই করলাম এবং তার জ্বর নেমে গেলো!

স্ত্রীকে কষ্ট দেয়া

ঐ একই ব্যক্তি বর্ণনা করেন : একদিন হযরত শেইখ ও আমি আগা রাদমানিশের বাড়িতে গেলাম। আমি তাকে (হযরত শেইখকে) বললাম : আমার বাবা82 1352হিঃ/1933 সনে ইন্তেকাল করেছেন। আমি দেখতে চাই তিনি কেমন আছেন (বারযাখে)।

হযরত শেইখ বললেন : সূরা ফাতেহা পড়ো!

এরপর তিনি ভাবলেন এবং কিছুক্ষণের জন্য চুপ রইলেন এবং বললেনঃ তারা তাকে আসতে দিচ্ছে না , সে অসুবিধায় আছে তার স্ত্রীর কারণে! তোমার সৎ মা আসছেন।

আমি বললাম :

তিনি ছিলেন একজন গ্রামের মহিলা এবং আমার বাবার স্ত্রী এবং যেহেতু আমার পিতা আরো কয়েক জন মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন তাই তিনি আমার বাবার সাথে কথা বলেন নি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। যখনই আমার বাবা দরজা দিয়ে প্রবেশ করতেন তিনি অন্য দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতেন।

আমি হযরত শেইখকে বললামঃ

তাকে জিজ্ঞেস করুন আমি তার জন্য কী করতে পারি আমার বাবার সাথে উনি সন্তষ্ট হওয়ার জন্য।

হযরত শেইখ বললেন :

সে [আমি] যেন ক্ষুধার্তকে খাওয়ায়।

আমি জিজ্ঞেস করলাম কত জনকে ? বললেন একশত জনকে। আমি বললাম : আমার এত লোককে খাওয়ানোর ক্ষমতা নেই , এবং শেষ পর্যন্ত তিনি সংখ্যা নামিয়ে চল্লিশ জনে আনলেন। এর পর হযরত শেইখ বললেনঃ তোমার বাবার কন্ঠ এখন শোনা যাচ্ছে। সে মহিলা সন্তুষ্ট হওয়াতে তোমার বাবাকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। তিনি বলছেন আমার ছেলেকে বলুন কেন সে দুই বিয়ে করেছে । দেখুক আমি কী কষ্টের ভিতর পড়েছি! এখন সতর্ক হও সমান আচরণের জন্য (স্ত্রীদের মাঝে)।

হযরত শেইখের আরেক বন্ধু বলেন : আমি তাকে বারযাখে আমার বাবার অবস্থা জিজ্ঞেস করলাম।

হযরত শেইখ বললেন : তিনি ঝামেলার ভিতর পড়েছেন তোমার মায়ের দ্বারা!

আমি দেখলাম তিনি সঠিক বলেছিলেন ; আমার বাবা আরেক জন মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন এবং আমার মা এ বিষয়ে রাগান্বিত ছিলেন। তাই আমি আমার মায়ের কাছে গেলাম এবং তাকে খুশী করলাম। পরের বার যখন আমি হযরত শেইখের সাক্ষাতে গেলাম তিনি আমাকে দেখার সাথে সাথে বললেন :

কী ভালোইনা দু জন লোকের মাঝে পুনরায় বন্ধুত্ব করে দেয়া ; তোমার বাবা এখন আরামে আছেন!

স্বামীকে কষ্ট দেয়া

হযরত শেইখের এক শিষ্য বলেন : এক মহিলা ছিলেন যার স্বামী ছিলো একজন সাইয়্যেদ এবং সে ছিলো হযরত শেইখের বন্ধু। সে তার স্বামীকে অনেক বিরক্ত করতো। কিছু সময় পর সে ইন্তেকাল করে। তার জানাযায় হযরত শেইখ উপস্থিত ছিলেন। পরে তিনি বললেন :

এই মহিলার রুহ তর্ক করছিলো যখন তাকে কবর দেয়া হচ্ছিলো , এই বলে যে কোথায়! এখন আমি মৃত , তো কী হয়েছে ?! যখন তাকে কবরে শোয়ানো হচ্ছিলো তার আমল এক ভয়াল কালো কুকুরে পরিণত হলো। যখন মহিলা দেখলো যে কুকুরটিকে তার সাথে কবর দেয়া হচ্ছে (তাকে কবরে শাস্তি দেয়ার জন্য) সে বুঝতে পারলো কী রহস্য স্থুপীকৃত করেছে নিজের জন্য জীবনব্যাপী। সে বিলাপ করতে লাগলো। অনুনয় করতে লাগলো এবং চিৎকার করতে লাগলো। আমি দেখলাম সে খুবই বিপর্যস্ত অবস্থায় আছে। তাই আমি এই সাইয়্যেদকে বললাম তাকে ক্ষমা করে দেয়ার জন্য আমার কারণে। কুকুরটি চলে গেলো এবং তাকে কবর দেয়া হলো।

অসন্তুষ্ট বোন

হযরত শেইখের এক সন্তান বর্ণনা করেন :

একজন আর্কিটেক্ট ছিলেন যার কাজ ছিলো বাড়ি তৈরী করা ও বি ক্রী করা। তিনি প্রায় একশত ফ্ল্যাট তৈরী করলেন কিন্তু খুব বেশী ঋণের কারণে তিনি মারাত্মক আর্থিক সমস্যায় পড়ে গেলেন এবং গ্রেফতার হয়ে জেলে যাবার অবস্থা হলো। তিনি আমার বাবার কাছে এলেন এবং বললেন তিনি বাড়িতে যেতে অক্ষম এবং লোকদের কাছ থেকে লুকাতে হবে।

সংক্ষিপ্ত চিন্তার পর হযরত শেইখ বললেন :

যাও বোনকে সন্তুষ্ট করো! আর্কিটেক্ট বললেন : আমার বোন সন্তুষ্ট আছে ; হযরত শেইখ বললেন সে সন্তুষ্ট নয় , আর্কিটেক্ট কিছুক্ষণ ভেবে বললেন : হ্যা , যখন আমার বাবা ইন্তেকাল করেন তিনি কিছু অর্থ আমাদের লিখে দিয়ে যান। আমার বোনের অংশ ছিলো পনেরো শত তোমান যা আমি মনে করতে পারি তাকে আমি দেই নি।

তার পর তিনি চলে গেলেন এবং কিছু সময় পর ফিরে এলেন এবং বললেন : আমি আমার বোনকে পাঁচ হাজার তোমান দিয়েছি এবং তার অনুমতি নিয়েছি।

আমার বাবা কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে ভাবলেন এবং বললেন :

সে বলছে সে সন্তুষ্ট নয় , তার কি কোন বাসা আছে ?

আর্কিটেক্ট বললেনঃ না , সে একজন ভাড়াটে । হযরত শেইখ বললেন : যাও তোমার সবচেয়ে ভালো বাড়িগুলোর একটির মালিকানা তার নামে করে দাও এবং এর পর আমার কাছে আসো দেখি কী করতে পারি।

আর্কিটেক্ট বললেন : হযরত শেইখ! আমরা দু জন আছি বাড়িগুলোর অংশীদার হিসেবে। কীভাবে আমি তা করতে পারি ? হযরত শেইখ বললেন :

আমি আমার বুদ্ধির শেষ মাথায় চলে এসেছি ; কিন্তু আল্লাহর এই দাস এখনও সন্তুষ্ট নয়।

সবশেষে তিনি চলে গেলেন , আনুষ্ঠানিকভাবে তার এক বাড়ি তার বোনের কাছে হস্তান্তর করলেন এবং তাকে সাহায্য করলেন তার ঘরের আসবাবপত্র স্থানান্তর করতে। যখন তিনি ফেরত আসলেন হযরত শেইখ তাকে বললেনঃ এখন এটির সমাধান হয়ে গেলো!

পরদিন তিনি তার তিনটি বাড়ি বি ক্রী করতে সমর্থ হলেন এবং সমস্যা থেকে মুক্তি পেলেন।

বোনের প্রতি দয়া না করা

তেহরানের বাজারের এক ব্যাবসায়ী দেউলিয়া হয়ে গেলো। যখন সে তার বন্ধুর কাছে তার দুঃখের কথা বলছিলো হযরত শেইখ তার দোকানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তাকে দেখে তার বন্ধু তাকে উপদেশ দিলেন হযরত শেইখের কাছে সমস্যার কথা বলতে। শেইখ বললেন : তুমি একজন নিষ্ঠুর ব্যক্তি ; তোমার বোন জামাই মরে গেছে চার মাস হলো এবং তুমি তোমার বোনের সাথে ও তার (ইয়াতিম) সন্তানদের সাথে দেখা করো নি। এটি তোমার সমস্যার উৎস।

ব্যাবসায়ী বললো : আমাদের মাঝে গণ্ডগোল আছে।

হযরত শেইখ বললেন : তোমার সমস্যার মূল সেখানে কিন্তু তুমি নিজে তা জানো না।

ব্যাবসায়ী তার বন্ধুর কাছে ফেরত গেলো এবং তাকে বললো হযরত শেইখ যা বলেছেন তাকে। তারপর সে কিছু গৃহসামগ্রী কিনলো। সেগুলো তার বোনের কাছে নিয়ে গেলো এবং তার সাথে মিটমাট করে নিলো এতে তার সমস্যাও দূর হয়ে গেলো।

অসন্তুষ্ট মা

একজন যুবকসহ বেশ কিছু লোককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো। তার আত্মীয়রা হযরত শেইখের কাছে গেলো এবং তাকে অনুনয় করে এর সমাধান চাইলো। হযরত শেইখ তাদের বললেন যে সে তার মা-এর কারণে ঝামেলায় পড়েছে। তারা তার মায়ের কাছে গেলো এবং তিনি বললেন তিনি যে দোয়াই করেন কোন কাজ হচ্ছে না। তারা তাকে বললোঃ হযরত শেইখ বলেছেন আপনি তার প্রতি অসন্তুষ্ট।

তিনি বললেন : তা সত্য ; আমার ছেলে যখন নতুন বিয়ে করেছে তখন একদিন আমি দুপুরের খাবারের পর দস্তরখান পরিস্কার করলাম। বাসন কোসন একটি ট্রেতে রাখলাম , এবং আমার ছেলের বউয়ের দিকে এগিয়ে দিলাম রান্না ঘরে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমার ছেলে আমার কাছ থেকে ট্রে-টি নিয়ে আমাকে বললো : আমি তোমাকে কোন কাজের লোক এনে দিই নি!

শেষ পর্যন্ত তার মা তার প্রতি সন্তুষ্ট হলেন এবং তার ছেলের জন্য দোয়া করলেন। পরদিন ঘোষণা করা হলো যে একটি ভুল হয়েছে এবং যুবকটিকে মুক্তি দেয়া হলো।

ভগ্ন হৃদয় চাচী

হযরত শেইখের এক বন্ধু বলেছেন :

আমার বাবা এত বেশী অসুস্থ ছিলেন যে , কোন কিছুই তাকে সুস্থ করছিলো না। আমি হযরত শেইখকে বললাম যে আমার বাবা অসুস্থ এবং এক বছর ধরে বিছানায়। হযরত শেইখ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমার কোন চাচী আছে কিনা। আমি বললাম আছে। হযরত শেইখ বললেন : তোমার বাবা তোমার চাচীর কারণে জটিলতায় পড়েছেন এবং যদি তিনি দোয়া করেন তাহলে তিনি সুস্থ হবেন।

আমি আমার চাচীকে অনুরোধ করলাম আমার বাবার জন্য দোয়া করতে কিন্তু আমার বাবা সুস্থ হলেন না। আমি হযরত শেইখের কাছে আবার গেলাম এবং বললাম আমার বাবা সুস্থ হন নি আমার চাচী সন্তুষ্ট হওয়া সত্বেও। হযরত শেইখ আমাকে কিছু নির্দেশনা দিলেন আমার চাচীর চারটি ইয়াতিম সন্তানের জন্য কিছু উপকার করতে এবং আমাকে বললেন তাদেরকে দোয়া করতে বলতে। হযরত শেইখ যেভাবে বলেছিলেন আমি তাই করলাম এবং আমার চাচীকে জিজ্ঞেস করলাম আমার বাবার সাথে তার অসন্তুষ্টির কারণ কি ?

তিনি বললেন : আমার স্বামী মারা যাবার পর তোমার বাবা আমাকে ও আমার সন্তানদেরকে তার নিজের বাসায় নিয়ে গেলেন থাকার জন্য। একদিন আমি তোমার মায়ের সাথে ঝগড়া করছিলাম যখন তোমার বাবা এলেন এবং আমার সন্তানদেরসহ আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। আমার হৃদয় তখন ভেঙ্গে গিয়েছিলো।

শেষ পর্যন্ত আমার চাচী সন্তুষ্ট হওয়ার পর আমার বাবা সুস্থ্য হয়ে উঠলেন কিন্তু পুরোপুরি স্বাস্থ্য ফিরে পেলেন না। আবার আমি হযরত শেইখের কাছে ঘটনাটি বললাম। এবার তিনি আমাকে নির্দেশ দিলেন সাইয়্যেদের উপকার করতে যাকে তিনি পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং আমি তা করার পর আমার বাবা পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেলেন।

মালিকের সন্তানকে কষ্ট দেয়া

হযরত শেইখের এক শিষ্য বলেন যে তিনি বলেছেনঃ তোমরা কখনই অযথা দুর্যোগগ্রস্ত হও না।

একবার আমার মাথা কেটে গিয়েছিলো এক দূর্ঘটনায়। আমি কিছু বন্ধুদের সাথে হযরত শেইখের সাথে সাক্ষাত করতে গেলাম। হযরত শেইখকে আমার বন্ধু বললো : দেখুনতো সে কি করেছে যার জন্য তার মাথা কেটেছে! , হযরত শেইখ কিছুক্ষণ ভাবলেন এরপর বললেন : সে একটি বাচ্চাকে কষ্ট দিয়েছে কারখানাতে।

আমি দেখলাম তিনি ঠিক বলেছেন। আমি একটি বাঁকা করার যন্ত্রের অপারেটর ছিলাম যা সে দিনগুলোতে একটি বিরল পেশা ছিলো। এ ধরনের পেশার লোকেরা তাদের মালিকের কাছে সাধারণত প্রিয় ছিলো। একবার আমার মালিকের ছেলে আমার একটি ভুল ধরলো যা তার সাথে সম্পর্কিত ছিল না। তাই তার সাথে আমার ঝগড়া হলো এমন ভাবে যে সে কেঁদে ফেললো।

হযরত শেইখ বললেন : তুমি যদি তাকে সন্তুষ্ট না করো তাহলে তোমার সমস্যা চলতেই থাকবে।

আমি গেলাম (সেই বাচ্চাটির কাছে) এবং ক্ষমা চাইলাম।

কর্মচারীকে কষ্ট দেয়া

বেশ কিছু কর্মকর্তা ফাইনান্স ডিপার্টমেন্ট থেকে এলেন হযরত শেইখের সাথে সাক্ষাত করতে তার এক শিষ্যের বাড়িতে। তাদের একজন বললেন : আমার শরীর চুলকায় এবং তা সারে না। হযরত শেইখ সামান্য ভেবে বললেন : আপনি একজন সাইয়্যেদ মহিলাকে অসন্তুষ্ট করেছেন।

ঐ ব্যক্তি বললো :

এরা তাদের ডেস্কে বসতে আসে কিন্তু তাদের দায়িত্ব পালন করে না এবং যদি আপনি তাদের কিছু বলেন তারা কেঁদে ফেলে!

দেখা গেলো ঐ সাইয়্যেদ মহিলা তাদের অফিসে নিয়োগ প্রাপ্ত ছিলেন এবং তিনি তাকে কষ্ট দিয়েছেন তার মন্তব্য দিয়ে।

হযরত শেইখ বলেন : আপনি এই চুলকানী থেকে সুস্থ হবেন না যতক্ষণ না আপনি তার কাছে ক্ষমা চান।

হযরত শেইখের আরেক শিষ্য বলেন :

আমরা বসে ছিলাম হযরত শেইখের উপস্থিতিতে তারই এক বন্ধুর উঠানে। সেখানে একজন উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মকর্তাও ছিলেন যিনি নিয়মিত হযরত শেইখের বৈঠকে যোগ দিতেন। কোন অসুস্থতার কারণে তিনি পা লম্বা করে দিয়ে বলেন : হযরত! আমি আমার পায়ের ব্যাথায় গত তিন বছর ধরে ভুগছি। যা-ই করি না কেন কোন ফল পাই না কোন ওষুধ কাজে লাগে না।

নিয়ম অনুযায়ী হযরত শেইখ উপস্থিত সাথীকে বললেন সূরা ফাতিহা পড়তে , এরপর কিছুক্ষণ ভাবলেন এবং বললেন : আপনার পায়ে ব্যাথা শুরু হয়েছে সেদিন থেকে যেদিন আপনি টাইপিষ্ট মহিলাকে তার ভুলের জন্য বকা দিয়েছিলেন এবং চিৎকার করেছিলেন। যিনি ছিলেন এক সাইয়্যেদ মহিলা যার হৃদয় ভেঙ্গে যায় এবং সে কেঁদেছিলো। এখন আপনার উচিত তাকে খুঁজে বের করা এবং তাকে ক্ষমা করে দেয়ার জন্য অনুরোধ করা যেন ব্যাথা চলে যায়।

ভদ্রলোক বললেন : আপনি সঠিক বলেছেন , সে একজন টাইপিষ্ট ছিলো আমাদের অফিসে এবং আমি তার প্রতি চিৎকার করেছিলাম তাতে সে কেঁদেছিলো।

বৃদ্ধার অধিকার হরণ করা

হযরত শেইখের শিষ্যদের একজন কিছু খাবার খাওয়ার পর তার আধ্যাত্মিক অবস্থা হারিয়ে ফেলে। তিনি এর জন্য হযরত শেইখের সাহায্য চাইলেন। হযরত শেইখ বললেন :

যে কাবাব তুমি খেয়েছো তার মূল্য পরিশোধ করেছিলো অমুক ব্যবসায়ী যে এক বৃদ্ধা মহিলার অধিকার হরণ করেছে।

অন্যকে অপমান করা (খারাপ ভাষায়)

হযরত শেইখের এক শিষ্য বলেছেন :

একদিন হযরত শেইখ ও আমি আরো কয়েকজনের সাথে ইমাম-যাদেহ ইয়াহইয়া সড়ক ধরে যাচ্ছিলাম। তখন একজন বাইসাইকেল চালক এক পথচারীকে ধাক্কা দিলো। পথচারী সাইকেল চালককে গাধা বলে অপমান করলো।

তা শুনে হযরত শেইখ বললেন :

তার ভিতরটি সাথে সাথে গাধায় পরিণত হয়ে গেলো।

অন্য আরেক শিষ্য বলেন :

একবার আমি বাজারের ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম একটি ঘোড়ার গাড়ি যাচ্ছে এবং লোক ঘোড়ার লাগাম ধরে আছে। হঠাৎ করে একজন মানুষ ঘোড়ার সামনে লাফ দিয়ে এগিয়ে গেলো রাস্তা পার হওয়ার জন্য। গাড়ির চালক তার প্রতি চিৎকার করে বললো : ঐ ব্যাটা ঘোড়া! আমি দেখলাম ঐ গাড়ির চালকও ঘোড়ায় পরিণত হয়েছে এবং লাগাম দু টুকরো হয়ে গেছে।

পশুদের প্রতি অমানবিক আচরণ

ইসলামে পশুদের প্রতি অমানবিক আচরণ এক ঘৃণ্য কাজ।83 একজন মুসলমানের অনুমতি নেই যে সে কোন পশুকে কষ্ট দেয় অথবা এমনকি অভিশাপ দেয়। মুহাম্মাদ (সঃ) বলেন :

তোমরা পশুদের প্রতি যে অমানবিক আচরণ করো তা যদি ক্ষমা করা হয় তবে তোমাদের অনেক গুনাই ক্ষমা করা হয়। 84

যদিও হালাল গোশতের পশুকে জবাই করা ইসলামে অনুমোদিত তারপরও জবাইয়ের জন্য রয়েছে নিয়মকানুন যা পশুকে যতটুকু সম্ভব কম ব্যাথা দেয়। একটি নিয়ম হচ্ছে পশুদেরকে অবশ্যই জবাই করা যাবে না একই প্রজাতির অন্য পশুর সামনে।85

ইমাম আলী (আঃ) বলেন :

কোন ভেড়াকে অন্য আরেক ভেড়ার সামনে জবাই করো না এবং কোন উটকে অন্য কোন উটের সামনে , যখন তারা দেখছে পশুদের জবাই করা হচ্ছে। 86

তাই , কোন পশুর মাথা কেটে নেয়া তার মায়ের সামনে এক চরম তিরস্কারযোগ্য কাজ , কারণ তা অমানবিকতা ও হিংস্রতা প্রকাশ করে , যা এ কাজের অপরাধীর উপর বিরাট ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।

হযরত শেইখের এক শিষ্য বলেন :

একজন কসাই এলো হযরত শেইখের কাছে এবং বললো : আমার সন্তান মারা যাচ্ছে , আমি কী করবো ?

হযরত শেইখ বললেন : তুমি এক বাছুরকে জবাই করেছো তার মায়ের চোখের সামনে।

কসাই হযরত শেইখকে অনুরোধ করলো তার জন্য কিছু একটা করতে , হযরত শেইখ বললেন :

এটি (পশুটি) বলছে : কখনই না , সে আমার বাচ্চাকে জবাই করেছে তাই তার বাচ্চা অবশ্যই মরবে! 87