মহানবী (সা.)-এর বন্দী পরিবার

 মহানবী (সা.)-এর বন্দী পরিবার0%

 মহানবী (সা.)-এর বন্দী পরিবার লেখক:
: এ.কে.এম. রশিদুজ্জামান
প্রকাশক: ওয়াইজম্যান পাবলিকেশনস
বিভাগ: ইমাম হোসাইন (আ.)

 মহানবী (সা.)-এর বন্দী পরিবার

লেখক: মুহাম্মদ ইরফানুল হক
: এ.কে.এম. রশিদুজ্জামান
প্রকাশক: ওয়াইজম্যান পাবলিকেশনস
বিভাগ:

ভিজিট: 9116
ডাউনলোড: 2685

পাঠকের মতামত:

মহানবী (সা.)-এর বন্দী পরিবার
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 29 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 9116 / ডাউনলোড: 2685
সাইজ সাইজ সাইজ
 মহানবী (সা.)-এর বন্দী পরিবার

মহানবী (সা.)-এর বন্দী পরিবার

লেখক:
প্রকাশক: ওয়াইজম্যান পাবলিকেশনস
বাংলা

ইমাম হোসেইন (আ.)-এর শাহাদাতের পর

মহানবী (সা.)-এর বন্দী পরিবার

সংকলনে

মুহাম্মাদ ইরফানুল হক

এ. কে. এম. রাশিদুজ্জামান

ওয়াইজম্যান পাবলিকেশনস

শিরোনাম : ইমাম হোসেইন (আ.)-এর শাহাদাতের পর

মহানবী (সা.)-এর বন্দী পরিবার

সংকলনে : মুহাম্মাদ ইরফানুল হক

এ.কে.এম. রাশিদুজ্জামান

প্রকাশক : ওয়াইজম্যান পাবলিকেশনস

279/5 , মাসকান্দা , ময়মনসিংহ।

গ্রন্থস্বত্ব : প্রকাশক কর্তৃক সংরক্ষিত।

প্রকাশকাল : 25 মহরম , 1434 হি. ,

26 অগ্রহায়ণ , 1419 বাং. ,

10 ডিসেম্বর , 2012 খ্রি. ।

কম্পোজ প্রচ্ছদ : আলতাফ হোসাইন

ISBN : 978-984-33-6037-3

Captive Family of Prophet (s.) ―After the Martyrdom of Imam Hossain (a.), Compiled by Md. Irfanul Huq & A.K.M. Rashiduzzaman, Published by Wiseman Publications, Mashkanda, Mymensingh, Bangladesh.

© Wiseman Publications, 2012.

ALL RIGHTS RESERVED FOR THE PUBLISHER.

Published in December 2012 (First Edition), Printed in Bangladesh, Pages-56.

ForContact : wiseman1472313@yahoo.com, (8802) 01922683019

Topics : Historical incidences of Karbala – Martyrdom of Imam Hussain Ibne Ali (a.) – Heartrending Tragedy of Islam – Teachings of Sacrifice in Islam – Steadfastness of Ahlul Bayt (a.) – Captive Family of Prophet (s.).

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:

নিশ্চয়ই হোসেইন হেদায়াতের বাতি ও নাজাতের নৌকা। ”

[মীযান আল-হিকমাহ , হাদীস-433 ; সাফিনাতুল বিহার , খণ্ড-1 ;

মদিনাতুল মায়াজিয , খণ্ড-4 , পৃষ্ঠা-52 ; খাসায়িসুল হোসেইনিয়া , পৃষ্ঠা-45 ;

নাসিখুত্ তাওয়ারিখ , পৃষ্ঠা-57]

ইমাম হোসেইন (আ.)-এর শাহাদাতের পর

মহানবী (সা.)-এর বন্দী পরিবার

ইমাম হোসেইন (আ.)-এর শাহাদাত

মহান আল্লাহর সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রিয় নাতি ইমাম হোসেইন (আ.) ছিলেন ইমাম আলী (আ.) ও হযরত ফাতিমার (আ.) প্রিয় সন্তান যাকে কারবালায় হিজরী 61 সনের 10ই মুহাররম নির্মমভাবে পিপাসার্ত , ক্ষুধার্ত ও অসহায় অবস্থায় শহীদ করা হয়। সাইয়েদুশ্ শুহাদা ইমাম হোসেইন (আ.) সম্পর্কে মহানবীর (সা.) সবচেয়ে সুপরিচিত হাদীস যা সেখানকার উপস্থিত হত্যাকারীরা পর্যন্ত জানতো যে , হাসান ও হোসেইন বেহেশতের যুবকদের সর্দার। [জামে আত-তিরমিযী , হাদীস-3720]

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন , আর হোসেইনের (আ.) বিষয়ে — সে আমার থেকে , সে আমার সন্তান , আমার বংশ , মানবজাতির মধ্যে তার ভাইয়ের পরে শ্রেষ্ঠ। সে মুসলমানদের ইমাম , মুমিনদের অভিভাবক , জগতসমূহের রবের প্রতিনিধি , তাদের সাহায্যকারী যারা সাহায্য চায় , তাদের আশ্রয় যারা আশ্রয় খোঁজে , [সে] আল্লাহর প্রমাণ তাঁর পুরো সৃষ্টির ওপরে , সে বেহেশতের যুবকদের সর্দার , উম্মতের নাজাতের দরজা। তার আদেশই হলো আমার আদেশ। তার আনুগত্য করা হলো আমারই আনুগত্য করা। যে-ই তাকে অনুসরণ করে সে আমার সাথে যুক্ত হয় এবং যে তার অবাধ্য হয় সে আমার সাথে যুক্ত হতে পারে না। ’ [মীযান আল-হিকমাহ , হাদীস-428]

ইমাম হোসেইন (আ.) ছিলেন অত্যন্ত পরহেজগার , বিনয়ী , জ্ঞানী , সাহসী এবং স্বাধীনতাকামী একজন নেতা। তিনি তার নানা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর উম্মতের সংশোধনের জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে উদ্দ্যোগ নেন। কিন্তু সে সময়ের খলিফা [শাসক] ইয়াযীদ বিন মুয়াবিয়া তা অপছন্দ করে এবং তার সব ধরনের অন্যায় ও অপকর্মকে সম্মতি দিয়ে তার প্রতি আনুগত্য করার আদেশ দেয়। আর তা করা না হলে তাকে হত্যা করা হবে বলে জানিয়ে দেয়। ইমাম হোসেইন (আ.) তার সব অপকর্মের প্রতিবাদ করেন এবং আনুগত্য করতে অস্বীকার করেন।

কিন্তু তিনি জানতে পারেন ইয়াযীদ হজ্বের সময় তাকে হত্যার জন্য মক্কায় তার দূত পাঠিয়েছে। পবিত্র কাবা ঘরের কোন স্থানে তার রক্ত ঝরুক এটি তিনি পছন্দ করেন নি। তাই হজ্ব না করেই 8ই জিলহজ্ব ইমাম হোসেইন (আ.) মক্কা থেকে মরুভূমির দিকে বেরিয়ে পড়েন। [বর্তমান ইরাকের] কুফা এলাকা থেকে অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি ইমাম হোসেইন (আ.)-কে চিঠি পাঠিয়েছিলেন যেন তিনি কুফায় যান এবং সেখানে গিয়ে তাদের ধর্মীয় নেতৃত্ব দেন। এতে ইসলাম ধ্বংস ও বিকৃতি থেকে রক্ষা পাবে। এসব চিঠির কারণে ইমাম হোসেইন (আ.) মক্কা ত্যাগ করে কুফার দিকে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু পথে ইয়াযীদের নিয়োগ করা গভর্নর উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের আদেশে হুর বিন ইয়াযীদ ইমামকে বাধা প্রদান করে এবং কারবালা প্রান্তরে নিয়ে যায়। এখানে শত্রুরা প্রায় ত্রিশ হাজার সসস্ত্র সৈন্য মোতায়েন করে এবং ইমাম হোসেইন (আ.)-কে জোরপূর্বক বাইয়াত [আনুগত্য] করার জন্য চাপ প্রয়োগ করে। তারা জানায় যে , যদি তা না করা হয় তাহলে তাদের সাথে যুদ্ধ করতে হবে।

ইমাম হোসেইন (আ.)-এর সাথে ছিলো কেবল অল্প ক ’ জন বন্ধু ও সাহায্যকারী এবং তার পরিবারের নারী ও শিশুরা। যুদ্ধ করতে পারেন এমন পুরুষের সংখ্যা ছিলো 70 জনেরও কম। তিনি অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করে সত্য ইসলামকে রক্ষার জন্য [আত্মরক্ষার] যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলেন।

শত্রুরা ইমাম হোসেইন (আ.)-কে কাবু করার জন্য পাশেই বয়ে যাওয়া ফোরাত নদীর তীর ঘেরাও করে রাখে যাতে ইমাম হোসেইন (আ.) ও তার সাথীরা পানি থেকে বঞ্চিত হন। একটানা কয়েক দিন ইমামের পরিবারের নারী , শিশুরা ও সাথীরা পানি থেকে বঞ্চিত হয়। শিশুরা পানির পিপাসায় কাতর হয়ে যায়। এমন অবস্থায় শত্রুরা 9ই মহররম ইমামকে যুদ্ধ শুরুর জন্য অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করে এবং ইমামের তাবুর দিকে তীর নিক্ষেপ করতে থাকে। ইমাম হোসেইন (আ.) শত্রুদের কাছে তার দূত পাঠালেন এ বলে যে , তিনি একটি রাত ইবাদতের জন্য সময় চান। শত্রুরা এক রাতের জন্য তাকে সময় দেয়।

ইমাম হোসেইন (আ.) ও তার সব সাথীরা জীবনের শেষ রাতটি আল্লাহর যিকির , দোয়া , নামায ও কুরআন তেলাওয়াতে কাটালেন। সকাল হলে ইমাম হোসেইন (আ.)-এর বড় ছেলে হযরত আলী আকবর (আ.) আযান দিলেন এবং সবাই নামায আদায় করলেন। এরপর শত্রুরা বৃষ্টির মতো তীর ছুঁড়ে যুদ্ধ শুরু করে ইমামের একদল ক্লান্ত , ক্ষুধার্ত , পিপাসার্ত ও পরহেজগার সাথীদের বিরুদ্ধে। যাদের সংখ্যা নগন্য। ইমাম হোসেইন (আ.)-এর সাথে থাকা শিশু সহ মোট সংখ্যা প্রায় 100 লোকের বিরুদ্ধে 30 ,000 সসস্ত্র সেনাদলের যুদ্ধ। পৃথিবীর ইতিহাসে এ রকম অসম যুদ্ধ আর দেখা যায় না।

জোর করে চাপিয়ে দেওয়া এ যুদ্ধে ইমাম হোসেইন (আ.)-সহ মোট 72 জন শহীদ হন। শত্রুরা ইমাম হোসেইন (আ.)-এর সন্তান মাত্র 6 মাসের শিশু আলী আসগরকেও তীর নিক্ষেপ করে হত্যা করে। জঘন্য ও নিকৃষ্টতম ঐ শত্রুরা তাদেরকে হত্যার পর তাদের লাশের মাথাগুলো কেটে বর্শার মাথায় বিদ্ধ করে এবং দশ জন ঘোড়সওয়ার দেহগুলোকে ঘোড়ার পায়ের আঘাতে আঘাতে পিষ্ট করে।

তারা তাবুগুলো লুট করে ও তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। লুট করার সময় শোকার্ত পরিবারের সদস্যদের চাবুক মারে। ইমাম হোসেইন (আ.)-এর মেয়ে পাঁচ বছরের শিশু সাকিনার কানের দুল কান থেকে ছিঁড়ে নেয় এবং তা থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। শিশুরা ভয়ে ও ব্যাথায় কাঁদতে থাকলে তাদের গালে চড় মারে। নারীদের মাথার চাদরও [বোরখা] কেড়ে নেয়। নবী পরিবারের নির্যাতিত অসহায় এসব সম্মানিত ব্যক্তিরা মরুভূমিতে আশ্রয়হীনভাবে খোলা আকাশের নীচে চলে আসেন।

চিত্র: [....] ইমাম হোসেইন (আ.)-এর মদীনা থেকে যাত্রা করে

মক্কা হয়ে কারবালায় যাওয়ার রুট।

[― ] মহানবীর (সা.) পরিবারের বন্দী অবস্থায় কারবালা থেকে

কুফা হয়ে দামেস্কে গমনের রুট।

এরপর নবী পরিবারের বেঁচে থাকা সব সদস্যদের বন্দী করা হয় এবং তাদের সাথে নিকৃষ্ট ও অপমানজনক আচরণ করা হয়। সব বন্দীদের প্রথমে কুফায় উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদের প্রাসাদে নেওয়া হয়। এরপর সেখান থেকে সিরিয়ার দামেস্কে ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার রাজপ্রাসাদে নেওয়া হয়। কারবালা থেকে কুফা ছিল প্রায় 76 কিলোমিটার এবং কুফা থেকে দামেস্ক ছিল প্রায় 1200 কিলোমিটার। কুফা থেকে দামেস্কে [শামে] যাওয়ার এ দীর্ঘ পথে কাফেলাটি বিভিন্ন যায়গায় মোট উনিশটি স্থানে বিশ্রামের জন্য থামে। থামার যায়গাগুলো ছিল প্রথম বিশ্রামের স্থান , তাফরিত্ , মাশহাদ আল-নুকতা , ওয়াদি আল-নুখলা , মুসাল , নাসিবুন , আ ’ ইনুল ওয়ারদা , রাক্কা , জুসাক্ব , দাওয়ায়াত , হাল্ব , ক্বিন্নাসরিন , মায়াররা আল-নুমান , শিযর , কাফরি তালিব , সিবুর , হামাত , হিমাস ও বালবাক।

মহানবীর (সা.) বন্দী পরিবারের নারী , শিশু ও একমাত্র জীবিত পুরুষ [অসুস্থ] ইমাম আলী ইবনে হোসেইন (আ.)-কে প্রায় 20 দিন ধরে কয়েদিদের মতো দড়িতে হাত বাঁধা অবস্থায় জিন ছাড়া ও ছাউনি-বিহীন উটে ও খচ্চরে চড়ে ― আবার কখনোবা পায়ে হেঁটে ― মরুভূমির উত্তপ্ত দিনগুলোতে এ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে।

আমরা এ সংকলনটিতে ইমাম হোসেইন (আ.)-এর শাহাদাতের পর কারবালায় বেঁচে থাকা নবী পরিবারের সম্মানিত সদস্যদের সাথে এবং ইমাম হোসেইন (আ.)-এর লাশ ও কেটে নেওয়া মাথার সাথে কি অমানবিক , অপমানজনক ও প্রতিশোধমূলক আচরণ করা হয়েছে এবং পথিমধ্যে নবী পরিবারে নির্যাতিত ও শোকার্ত সদস্যগণ যেসব বক্তব্য দিয়েছেন তা বিভিন্ন ঐতিহাসিক বর্ণনাগুলো থেকে উপস্থাপন করবো। এ বর্ণনাগুলো প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা শেইখ আব্বাস কুম্মি রচিত শোকার্তের দীর্ঘশ্বাস ’ [নাফাসুল মাহমুম] থেকে নেওয়া হয়েছে।

শাহাদাতের পরের ঘটনাবলী

বর্ণনাকারী বলে যে , ইমাম হোসেইন (আ.)-এর শাহাদাতের পর তারা তার পোশাক লুট করে নিয়ে যায়। তার গায়ের জামা নিয়ে যায় ইসহাক বিন হেইওয়াহ হাযরামি , সে তা পরার পর তার কুষ্ঠ রোগ দেখা দিয়েছিল এবং তার চুল পড়ে গিয়েছিল।

ইমাম জাফর আস-সাদিক্ব (আ.) বলেন যে , ইমাম হোসেইন (আ.)-এর দেহে তেত্রিশটি বর্শার আঘাত ও চৌত্রিশটি তরবারির আঘাত ছিলো। তার পাজামা নিয়ে যায় বাহর বিন কা ’ আব তামিমি এবং বর্ণিত আছে যে সে শয্যাশায়ী হয়ে গিয়েছিল এবং তার পাগুলো অবশ হয়ে গিয়েছিল। তার পাগড়ি কেড়ে নেয় আখনাস বিন মুরসিদ হাযরামি যে তা মাথায় পরেছিল এবং অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তার স্যান্ডেলগুলো কেড়ে নেয় আসাদ বিন খালিদ এবং তার আংটি নেয় বাজদুল বিন সালীম কালবি যে তার আঙ্গুল কেটে তা নিয়ে গিয়েছিল [আল্লাহর অভিশাপ তার ওপরে] । যখন মুখতার তাকে [বাজদুলকে] গ্রেফতার করলো সে তার হাত ও পা কেটে ফেলেছিল , সে তার রক্ত প্রবাহিত হতে দিয়েছিল যতক্ষণ না তার মৃত্যু হয়। ইমামের গোসলের পর পরার জন্য পশমের তৈরী লম্বা জামা ছিলো যা লুট করে নিয়ে যায় ক্বায়েস বিন আল আশআস। তার বর্ম নিয়ে যায় উমর বিন সা ’ আদ এবং যখন তাকে হত্যা করা হয় মুখতার তা উপহার দেয় তার হত্যাকারী আবি উমরোহকে। তার তরবারি নিয়ে যায় জামী ’ বিন খালক আওদী ; আবার এও বর্ণিত হয়েছে যে , এক তামিমি ব্যক্তি আসাদ বিন হানযালাহ অথবা ফালাফিস মুনশালি তা নিয়ে যায়। তার বিদ্যুৎগতি তরবারিটি যুলফিক্বার ছিলো না , ছিলো অন্য একটি যা ছিলো নবুয়ত ও ইমামতের একটি আমানত এবং তার বিশেষ আংটিও যা তার পরিবারের নিরাপদ হেফাযতে ছিলো।

শেইখ সাদুক্ব থেকে মুহাম্মাদ বিন মুসলিম বর্ণনা করেন যে , ইমাম জাফর আস-সাদিক্ব (আ.)-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল ইমাম হোসেইন (আ.)-এর আংটি সম্পর্কে যে , তার পোষাক লুটের সময় কে তা নিয়েছে। ইমাম (আ.) উত্তর দিলেন , যে রকম বলা হয় তেমন নয়। ইমাম হোসেইন (আ.) ওসিয়ত করে যান তার সন্তান ইমাম আলী যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর কাছে এবং হস্তান্তর করে গিয়েছিলেন তার আংটি এবং ইমামতের জিনিসপত্র যা এসেছিল আল্লাহর রাসূল (সা.) থেকে আমিরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর কাছে। ইমাম আলী (আ.) তা ইমাম হাসান (আ.)-এর কাছে হস্তান্তর করেন এবং ইমাম হাসান (আ.) তা ইমাম হোসেইন (আ.)-এর কাছে দিয়ে যান , যা পরবর্তীতে আমার পিতা [ইমাম মুহাম্মাদ আল বাক্বির (আ.)]-এর কাছে আসে এবং তা আমার কাছে পৌঁছেছে। এটি আমার কাছে আছে এবং আমি জুম ’ আর দিন পরি এবং তা পরে নামাজ পড়ি। মুহাম্মাদ বিন মুসলিম বলেন যে , আমি শুক্রবার দিন তার সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলাম এবং তার সাথে নামাজ পড়লাম। যখন তিনি নামাজ শেষ করলেন তিনি তার হাত আমার দিকে লম্বা করলেন এবং আমি তার আঙ্গুলে আংটিটি দেখলাম যাতে খোদাই করে লেখা আছে আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই , আমি আল্লাহর সাথে সাক্ষাতে প্রস্তুত। তখন ইমাম বললেন , এটি হলো আমার প্রপিতামহ আবু আব্দুল্লাহ হোসেইন (আ.)-এর আংটি।

শেইখ সাদুক্বের আমালি ’ ও রাওযাতুল ওয়ায়েযীন ’ -এ বর্ণিত আছে যে , ইমাম হোসেইন (আ.)-এর ঘোড়া তার কেশর ও কপালকে তার রক্তে রঞ্জিত করে নিলো এবং দৌঁড়াতে শুরু করলো ও চিৎকার করতে থাকলো। যখন নবীর নাতনীরা তার চিৎকার শুনতে পেলেন তারা তাঁবু থেকে বেরিয়ে এলেন এবং ঘোড়াটিকে দেখলেন তার আরোহী ছাড়া , এভাবে তারা জানতে পারলেন ইমাম হোসেইন (আ.) শহীদ হয়ে গেছেন।

ইবনে শাহর আশোব তার মানাক্বিব ’ -এ এবং মুহাম্মাদ বিন আবি তালিব বলেন যে , ইমাম হোসেইন (আ.)-এর ঘোড়া সেনাবাহিনীর ঘেরাও থেকে পালিয়ে এলো এবং তার কপালের চুল রক্তে ভেজালো। সে দ্রুত নারীদের তাঁবুর দিকে ছুটে গেলো এবং চিৎকার করতে লাগলো। এরপর সে তাঁবুর পিছনে গেলো এবং তার মাথাকে মাটিতে আঘাত করতে লাগলো যতক্ষণ না মৃত্যুবরণ করলো। যখন সম্মানিতা নারীরা দেখলেন ঘোড়াটিতে আরোহী নেই তারা বিলাপ শুরু করলেন এবং সাইয়েদা উম্মে কুলসুম (আ.) তার মাথাতে হাত দিয়ে আঘাত করতে লাগলেন এবং উচ্চকণ্ঠে বললেন , হে মুহাম্মাদ , হে নানা , হে নবী , হে আবুল ক্বাসিম , হে আলী , হে জাফর , হে হামযা , হে হাসান , এ হলো হোসেইন , যে মরুভূমিতে পড়ে গেছে এবং তার মাথা ঘাড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তার পাগড়ী ও পোশাক লুট করে নিয়ে গেছে। এ কথা বলে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন।

ইমাম হোসেইন (আ.)-এর জিনিসপত্র লুট এবং তার আহলুল বাইতের কান্না ও বিলাপ

সাইয়েদ ইবনে তাউস বর্ণনা করেন যে , একজন নারী গৃহকর্মী ইমাম হোসেইন (আ.)-এর তাঁবু থেকে বেরিয়ে এলো এবং এক ব্যক্তি তাকে বললো , হে আল্লাহর দাসী , তোমার সর্দারকে হত্যা করা হয়েছে। সে বলে যে , আমি আমার গৃহকর্তার কাছে দৌড়ে গেলাম এবং কাঁদতে শুরু করলাম , এ দেখে সব নারীরা উঠে দাঁড়ালেন এবং বিলাপ শুরু করলেন। বলা হয়েছে যে , তখন সেনাবাহিনী একত্রে এগিয়ে আসে রাসূলুল্লাহর (সা.) বংশধর ও যাহরা (আ.)-এর চোখের আলো হোসেইন (আ.)-এর তাঁবু লুট করার জন্য এবং নারীদের কাঁধ থেকে চাদর ছিনিয়ে নেয়ার জন্য। রাসূলুল্লাহর (সা.) পরিবারের কন্যারা এবং তার আহলুল বাইত একত্রে বিলাপ শুরু করলেন এবং কাঁদলেন তাদের সাথী ও বন্ধুদের হারিয়ে।

বলা হয়েছে , আল্লাহর শপথ আমি আলী (আ.)-এর কন্যা যায়নাব (আ.)-কে ভুলতে পারি না যিনি হোসেইনের (আ.) জন্য কাঁদছিলেন এবং শোকাহত কণ্ঠে বলেছিলেন , হে মুহাম্মাদ , আকাশের ফেরেশতাদের সালাম আপনার উপর , এ হলো হোসেইন , যে পড়ে গেছে [নিহত হয়েছে] , যার শরীর রক্তে ভিজে গেছে এবং তার শরীরের অঙ্গপ্রতঙ্গ কেটে ফেলা হয়েছে এবং আপনার কন্যারা বন্দী হয়েছে। আমি আল্লাহর কাছে অভিযোগ করি এবং মুহাম্মাদ মুস্তাফা (সা.)-এর কাছে এবং আলী মুরতাযা (আ.) ও ফাতিমা যাহরা (আ.) এবং শহীদদের নেতা হামযার কাছে , হে মুহাম্মাদ (সা.) , এ হলো হোসেইন , যে মরুভূমিতে গড়িয়ে পড়েছে এবং বাতাস তার জন্য শ্বাসকষ্ট পাচ্ছে এবং সে নিহত হয়েছে অবৈধ সন্তানদের হাতে , আহ শোক , হায় মুসিবত , আজ আমার নানা রাসূল (সা.) পৃথিবী থেকে চলে গেছেন , হে মুহাম্মাদ (সা.)-এর সাথীরা , আসুন ও দেখুন মুস্তাফা (সা.)-এর বংশকে কিভাবে কয়েদীদের মতো বন্দী করা হয়েছে।

অন্য আরেকটি বর্ণনায় নিচের কথাগুলো এসেছে , হে মুহাম্মাদ (সা.) , আপনার কন্যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে এবং আপনার বংশকে হত্যা করা হয়েছে। বাতাস তাদের উপর ধুলো ফেলছে। এ হলো হোসেইন , তার মাথা ঘাড় থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে এবং তার পোশাক ও চাদর লুট করা হয়েছে। আমার বাবা কোরবান হোক তার জন্য যার দলকে সোমবার দিন হামলা করা হয়েছে। আমার পিতা তার জন্য কোরবান হোক যার তাঁবুর দড়ি ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। আমার পিতা তার জন্য কোরবান হোক যার সাথে সাক্ষাৎ এখন আর সম্ভব নয় এবং তার আঘাতগুলো সুস্থ হবার নয়। আমার পিতার জীবন তার জন্য কোরবান হোক যার জন্য আমার জীবন কোরবান। আমার পিতা কোরবান হোক তার জন্য যিনি দুঃখের ভিতর ও তৃষ্ণার্ত অবস্থায় নিহত হয়েছেন। আমার পিতা তার জন্য কোরবান হোক যার দাড়ি থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত পড়েছে। আমার পিতা তার জন্য কোরবান হোক যার নানা মুহাম্মাদ আল মুস্তাফা (সা.) , আমার পিতা তার জন্য কোরবান হোক যার নানা আকাশগুলোর রবের রাসূল। আমার পিতা কোরবান হোক খাদিজাতুল কুবরা (আ.)-এর জন্য। আমার পিতা কোরবান হোক আলী আল-মুরতাযা (আ.)-এর জন্য। আমার পিতা কোরবান হোক ফাতিমা যাহরা (আ.)-এর উপর যিনি নারীদের সর্দার। আমার পিতা তার জন্য কোরবান হোক যার জন্য সূর্য ফিরে এসেছিল যেন তিনি নামাজ পড়তে পারেন।

বর্ণনাকারী বলেন , আল্লাহর শপথ , এ কথাগুলো শুনে প্রত্যেকেই কেঁদেছিল ― হোক সে বন্ধু অথবা শত্রু । এরপর সাকিনা (আ.) তার পিতার দেহ জড়িয়ে ধরেন এবং বেদুইনরা চারিদিকে জমা হলো এবং তাকে তার কাছ থেকে টেনে সরিয়ে নিলো।

কাফ ’ আমির মিসবাহ ’ -তে আছে যে , সাকিনা (আ.) বলেছেন যে , যখন হোসেইন (আ.) শহীদ হয়ে যান , আমি তাকে জড়িয়ে ধরে ছিলাম এবং জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম এবং আমি তাকে বলতে শুনলাম , হে আমার শিয়ারা [অনুসারীরা] আমাকে স্মরণ করো যখন পানি পান কর এবং আমার জন্য কাঁদো যখন ভ্রমণকারী অথবা শহীদের কথা শোন। তা শুনে আমি ভয়ে উঠে পড়ি এবং কান্নার কারণে আমার চোখ ব্যথা করছিল ; এরপর আমি আমার মুখে আঘাত করতে থাকি।

ইবনে আবদ রাব্বাহ তার ইক্বদুল ফারীদ ’ -এ বর্ণনা করেছেন হাম্মাদ বিন মুসলিমাহ থেকে , তিনি সাবীত থেকে , তিনি বর্ণনা করেছেন আনাস বিন মালিক থেকে যে: যখন আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে দাফন করলাম , সাইয়েদা ফাতিমা যাহরা (আ.) আমার কাছে এলেন এবং বললেন , হে আনাস , কীভাবে তোমার অন্তর সায় দিলো রাসূলুল্লাহ (সা.) চেহারায় মাটি ঢালতে ? এ কথা বলে তিনি কাঁদতে লাগলেন এবং উচ্চকণ্ঠে বললেন , হে প্রিয় বাবা , আপনি রাজী হয়েছেন যখন আপনার রব আপনার সাক্ষাৎ চেয়েছেন , হে আমার প্রিয় বাবা যার নিকটবর্তী হলেন তার রব (শেষ পর্যন্ত) । ফাতিমা (আ.)-এর অবস্থা ছিলো এরকম তার পিতার দাফনের পর , তাহলে কী নেমে এসেছিল সাকিনা (আ.)-র উপর যখন তিনি তার পিতার রক্তাক্ত লাশ জড়িয়ে ধরেছিলেন , যা ছিলো মাথাবিহীন এবং তার পাগড়ী ও পোশাক লুট হয়ে যাওয়া , হাড়গুলো ভাঙ্গা ও বাঁকা পিঠসম্পন্ন ? এরপর তিনি তার অবস্থা এভাবে বর্ণনা করেছেন: কিভাবে তোমাদের অন্তর সায় দিলো যখন তোমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সন্তানকে হত্যা করলে ? কিভাবে তোমরা তার বুকের হাড়গুলো ভেঙ্গে পিষে ফেললে যা ছিলো পবিত্র জ্ঞান ’ -এর ভাণ্ডার ?

সাইয়েদ ইবনে তাউস বলেন যে , উমর বিন সা ’ আদ তার সাঙ্গপাঙ্গদের মাঝে উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করলো , কে চায় স্বেচ্ছায় হোসেইনের পিঠ ও বুকের ওপর ঘোড়া চালাতে ? দশ জন লোক তা করার জন্য স্বেচ্ছায় এগিয়ে এলো। তাদের মধ্যে ছিলো , ইসহাক বিন হাইওয়াহ হাযরামি , যে ইমাম হোসেইন (আ.)-এর জামা লুটে নিয়েছিলো , অন্যরা ছিলো আখনাস বিন মুরসিদ , হাকীম বিন তুফাইল সুমবোসি , উমর বিন সাবীহ সাইদাউই , রাজা ’ বিন মানকায আবাদি , সালীম বিন খাইসামাহ জুফী , ওয়াহেয বিন না ’ য়েম , সালেহ বিন ওয়াহাব জু ’ ফী , হানি বিন সাবীত হাযরামি এবং উসাইদ বিন মালিক [আল্লাহর অভিশাপ তাদের সবার উপর] । তারা ইমাম হোসেইন (আ.)-এর দেহ ঘোড়ার খুরে পিষ্ট করে যতক্ষণ না তার বুক ও পিঠ পিষে যায়। বর্ণনাকারী বলে যে এ দশ জন উবায়দুল্লাহর কাছে আসে এবং উসাইদ বিন মালিক তাদের মধ্যে থেকে বলে যে , আমরা শক্তিশালী ঘোড়ার খুর দিয়ে পিঠের ওপরে বুক পিষেছি। [উবায়দুল্লাহ] ইবনে যিয়াদ বললো , তোমরা কারা ? তারা বললো , আমরা হোসেইনের পিঠ ঘোড়ার পায়ের নিচে পিষ্ট করেছি যতক্ষণ পর্যন্ত না তার বুকের হাড়গুলো গুঁড়ো হয়ে গেছে। সে [উবায়দুল্লাহ] তাদেরকে কিছু উপহার দিলো।

আবু আমর যাহিদ বলে যে , আমরা ঐ দশ জন সম্পর্কে অনুসন্ধান করেছি এবং সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে , তাদের সবাই ছিলো জারজ। [পরে] মুখতার সাক্বাফি তাদের সবাইকে গ্রেফতার করেছিল এবং তাদের হাত ও পা লোহার বেড়িতে বেঁধেছিলো। এরপর সে আদেশ দিয়েছিল ঘোড়া দিয়ে তাদের পিঠ পিষ্ট করতে , যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা মারা যায়।