মহানবী (সা.)-এর বন্দী পরিবার

 মহানবী (সা.)-এর বন্দী পরিবার0%

 মহানবী (সা.)-এর বন্দী পরিবার লেখক:
: এ.কে.এম. রশিদুজ্জামান
প্রকাশক: ওয়াইজম্যান পাবলিকেশনস
বিভাগ: ইমাম হোসাইন (আ.)

 মহানবী (সা.)-এর বন্দী পরিবার

লেখক: মুহাম্মদ ইরফানুল হক
: এ.কে.এম. রশিদুজ্জামান
প্রকাশক: ওয়াইজম্যান পাবলিকেশনস
বিভাগ:

ভিজিট: 9161
ডাউনলোড: 2713

পাঠকের মতামত:

মহানবী (সা.)-এর বন্দী পরিবার
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 29 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 9161 / ডাউনলোড: 2713
সাইজ সাইজ সাইজ
 মহানবী (সা.)-এর বন্দী পরিবার

মহানবী (সা.)-এর বন্দী পরিবার

লেখক:
প্রকাশক: ওয়াইজম্যান পাবলিকেশনস
বাংলা

শহীদদের পবিত্র মাথাগুলোকে কুফায় উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের কাছে প্রেরণ

[ মানাক্বিব ’ , ইরশাদ ’ ও মালহুফ ’ গ্রন্থে আছে] এরপর উমর বিন সা ’ আদ ইমাম হোসেইন (আ.) -এর মাথাটি আশুরার দিনই উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের কাছে পাঠালো। তারপর সে ইমামের সাথীদের ও আত্মীয়দের মাথাগুলো জমা করলো যাদের সংখ্যা ছিলো বাহাত্তর। এরপর সে সেগুলো শিমর বিন যিলজাওশন , ক্বায়েস বিন আল-আশ ’ আস , আমর বিন হাজ্জাজ এবং উযরাহ বিন ক্বায়েসকে দিয়ে পাঠালো , যারা তা উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের কাছে পৌঁছালো।

তাবারি বলেন যে , খাওলি ইমাম হোসেইন (আ.)-এর মাথাটি [কুফার] রাজপ্রাসাদে নিয়ে এলো এবং দেখলো যে তার তোরণ বন্ধ আছে। সে মাথাটি তার নিজের বাসায় নিয়ে গেলো এবং তা কাপড় ধোয়ার ড্রামের নিচে রাখলো। তার স্ত্রী ছিলো দুজন। এদের একজন ছিলো বনি আসাদ গোত্রের এবং অন্যজন ছিলো বনি হাযরাম গোত্রের যার নাম ছিলো নাওয়ার , সে ছিলো মালিক বিন আক্বরাবের কন্যা। সেদিন ছিলো নাওয়ারের দিন [স্বামীর সাথে থাকার] ।

হিশাম [বিন মুহাম্মাদ কালবি] বলে যে , আমার পিতা নাওয়ার থেকে শুনেছে যে , খাওলি ইমাম হোসেইন (আ.)-এর মাথাটি এনে উঠানে কাপড় ধোয়ার একটি ড্রামের নিচে ঢেকে রেখেছিল। এরপর সে ঘরে প্রবেশ করলো এবং বিছানার ওপর বিশ্রাম নেওয়ার জন্য শুয়ে পড়লো। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম , তুমি কী খবর এনেছো ? সে জবাব দিলো , আমি তোমার জন্য প্রচুর সম্পদ নিয়ে এসেছি। এটি হলো হোসেইনের মাথা যা তোমার বাড়ির উঠানে পড়ে আছে। আমি বললাম , তোমার ওপর দুর্ভোগ হোক , মানুষ সোনা ও রুপা আনে , আর তুমি এনেছো রাসূলুল্লাহর (সা.) নাতির মাথা ? আল্লাহর শপথ , আমি কখনোই বিছানার ওপর তোমার পাশে মাথা রাখবো না। এরপর আমি বিছানা থেকে দূরে সরে গেলাম এবং বাড়ির উঠানে এলাম। এরপর সে [খাওলি] তার অন্য স্ত্রীকে ডেকে পাঠালো , যে ছিলো বনি আসাদ গোত্রের এবং সে তার বিছানায় উঠলো , আর আমি বসে রইলাম মাথাটির দিকে তাকিয়ে। আল্লাহর শপথ , আমি দেখলাম একটি আলোর স্তম্ভ একটি পাতের মত উঠান থেকে আকাশের দিকে উঠে গেছে ― আর কিছু সাদা রঙের পাখি তা তাওয়াফ করছে। এরপর যখন সকাল হলো সে তা [উবায়দুল্লাহ] ইবনে যিয়াদের কাছে নিয়ে গেলো।

সাইয়েদ ইবনে তাউস তার ইক্ববাল ’ গ্রন্থে বলেন , জেনে রাখো যে , আশুরার সন্ধ্যায় ইমাম হোসেইন (আ.)-এর পরিবার , কন্যারা ও শিশু সন্তানরা শত্রুদের হাতে বন্দী হন। তারা শোক , দুঃখ ও কান্নার মাঝে ঘেরাও হয়ে পড়লেন। তারা সারা দিন যে অবস্থায় পার করেছেন সে ব্যাথা ও অসম্মান বর্ণনা করা আমার কলমের শক্তির বাইরে। তারা রাত কাটালেন পরিত্যক্ত অবস্থায় এবং কোন সাহায্যকারী ও তাদের পুরুষদের অনুপস্থিতির মাঝে। অন্যদিকে শত্রুরা তাদেরকে চরম ঘৃণা করছিল এবং তাদেরকে ঘৃণ্য মনে করে ফেলে রেখেছিল। এর মাধ্যমে তারা মুরতাদ [ধর্মত্যাগী] উমর বিন সা ’ আদ-এর নৈকট্য চেয়েছিল , যে মুহাম্মাদ (সা.)-এর সন্তানদের এতিম করেছিল এবং যে তাদের হৃদয়কে আহত করেছিল ― আর [নৈকট্য] চেয়েছিল উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের যে ছিলো নাস্তিক এবং ইয়াযীদ বিন মুয়াবিয়ার [নৈকট্য] , যে ছিলো বিদ্রোহী ― ধর্মদ্রোহী কথায় ও ঔদ্ধত্যের চুড়ায়।

এরপর তিনি বলেন যে , আমি মাসাবীহ ’ -এ একটি হাদীস দেখেছি যা ইমাম জাফর আস-সাদিক্ব (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে , আমার পিতা ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে আলী [আল বাক্বির] (আ.) আমাকে বলেছেন যে: আমি আমার পিতা আলী ইবনে হোসেইন [যায়নুল আবেদীন] (আ.)-কে বহনের জন্য ইয়াযীদ যে বাহন পাঠিয়েছিলো সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন , আমি একটি দুর্বল ও উলঙ্গ উটের পিঠে [হাওদার আসন ছাড়া] চড়েছিলাম , আর ইমাম হোসেইন (আ.)-এর মাথাটি একটি বাঁশের মাথায় উঠিয়ে রাখা হয়েছিল। আর আমার পিছনে নারীদের বসানো হয়েছিল জিন ছাড়া খচ্চরের ওপর। একই সময়ে রক্ষীরা আমাদের মাথার পিছনে এবং চারিদিক থেকে ঘেরাও করেছিল বর্শা লম্বা করে। যদি আমাদের কারো চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি পড়েছে , তাহলে তাদের মাথায় আঘাত করা হয়েছে বর্শা দিয়ে , যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা দামেশকে প্রবেশ করলাম , একজন ঘোষক ঘোষণা দিচ্ছিলো , হে সিরিয়াবাসীরা , এরা হলো অভিশপ্ত পরিবারের বন্দীরা। [আউযুবিল্লাহ]

[তাবারির গ্রন্থে আছে] আযদি বলেন যে , আবু যুহাইর আবাসি বর্ণনা করেছে কুররাহ বিন ক্বায়েস তামিমি থেকে যে , সে বলেছে , আমি পাহারায় ছিলাম যখন [ইমাম] পরিবারের নারী ও শিশুদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো ইমাম হোসেইনের শাহাদাতের স্থানটির পাশ দিয়ে। তারা উচ্চকণ্ঠে কাঁদতে লাগলেন এবং নিজেদের চেহারাতে আঘাত করতে লাগলেন। আমি সবই ভুলতে পারি কিন্তু ঐ সময়টিকে ভুলতে পারি না যখন ফাতিমা (আ.)-এর কন্যা যায়নাব তার ভাই হোসেইনের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন এবং তাকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখলেন। তিনি চিৎকার করে বললেন , হে মুহাম্মাদ , হে মুহাম্মাদ , আকাশের ফেরেশতাদের সালাম আপনার ওপরে , এ হলো হোসেইন যে রক্তে ভিজে গেছে এবং কর্তিত অবস্থায় মরুভূমিতে গড়িয়ে পড়েছে , হে মুহাম্মাদ , আপনার কন্যাদের বন্দী করা হয়েছে এবং আপনার বংশ শহীদ হয়ে পড়ে আছে ; আর বাতাস তাদের লাশের উপর বালি ছিটিয়ে দিচ্ছে। সে [কুররাহ] বলে যে , আল্লাহর শপথ , তার কথাগুলো প্রত্যেক বন্ধু ও শত্রুকে কাঁদিয়েছে।

যায়েদাহ থেকে একটি সুপরিচিত হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে , ইমাম আলী যায়নুল আবেদীন (আ.) বলেছেন যে , আমাদের ওপর যা আপতিত হয়েছিল কারবালার সমতলে , তা যখন ঘটলো ― আমার পিতা ও তার সন্তানদের মাঝে তার সাথীরা , ভাইয়েরা এবং অন্যান্যরা শহীদ হয়ে গেলেন। আর তার নারী-স্বজনদের এবং পরিবারকে উটগুলোয় উঠানো হলো যেগুলোতে বসার জন্য কোন আসন ছিলো না এবং কুফার দিকে নিয়ে যাওয়া হলো। আমার দৃষ্টি পড়লো শহীদদের ওপর যারা মাটিতে পড়েছিলেন এবং তাদেরকে কেউ দাফন করে নি ― আমার হৃদয় চাপে সংকুচিত হয়ে গেলো। তা আমার ওপরে এত মারাত্মক ছিলো যে আমি শোকে প্রায় মৃত্যুর কাছে চলে গিয়েছিলাম। আমার ফুফু যায়নাব (আ.) , যিনি ছিলেন আলী (আ.)-এর কন্যা , আমার অবস্থা অনুভব করতে পারলেন এবং বললেন , হে আমার নানা , বাবা ও ভাইয়ের প্রতিচ্ছবি , কেন তুমি তোমার জীবনকে বিপদাপন্ন করছো ? আমি জবাব দিলাম , কেন আমি অস্থির হবো না , কেন আমি আমার জীবনকে বিপদাপন্ন করবো না , যখন আমি দেখছি আমার মাওলা , আমার ভাইয়েরা , চাচারা , চাচাতো ভাইয়েরা এবং আমার পরিবার রক্ত আর ধুলায় মেখে মাটিতে গড়িয়ে পড়েছে , আবরণহীন ও বস্ত্রহীন অবস্থায় , মরুভুমিতে ? তাদের কাফনও পরানো হয় নি , দাফনও করা হয় নি। কেউ তাদের পাশে নেই , না কোন মানুষ তাদের চারপাশে ঘুরছে ― যেন তারা তুর্কী অথবা দায়লামি বংশ। তিনি বললেন , তুমি যা দেখছো তার কারণে স্থিরতা হারিও না , আল্লাহর শপথ , তোমার বাবা ও তোমার দাদা , রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছ থেকে উপদেশ লাভ করেছেন যেন এ মারাত্মক দুর্যোগের তাপ সহ্য করেন। আর আল্লাহ এ উম্মতের একদলের কাছে অঙ্গীকার নিয়েছেন যাদেরকে এ পৃথিবীর ফেরাউনের মতো ব্যক্তিরা চেনে না , কিন্তু তারা আকাশের বাসিন্দাদের মাঝে সুপরিচিত যে , তারা এ দেহগুলোর টুকরোগুলোকে জড়ো করবে এবং দাফন করবে। আর তারা তোমার বাবার কবরের মাথার দিকে একটি নিদর্শন [গম্বুজ ও মিনার] প্রতিষ্ঠা করবে কারবালার ভূমিতে , যা চিরদিন থাকবে এবং কখনোই মুছে ফেলা হবে না। আর যদি কুফরের নেতারা এবং পথভ্রষ্টদের সমর্থকরা তা মুছে ফেলতে চায় , তাহলে এর নিদর্শন না কমে বরং প্রচুর সংখ্যায় বাড়তেই থাকবে এবং এ বিষয়টি দিনের পর দিন বৃদ্ধি পেতে থাকবে।

শেইখ তুসি থেকে বর্ণিত হয়েছে যে , বনি আসাদ গোত্রের লোকেরা একটি নতুন চাটাই এনে তা ইমাম হোসেইন (আ.)-এর দেহের নিচে বিছিয়ে দিয়েছিল। দীযাজ থেকে বর্ণিত হয়েছে যে সে বলেছে , আমি আমার দাসদের বিশেষ একদলকে নিয়ে ইমাম হোসেইন (আ.)-এর কবর খুঁড়ে উম্মুক্ত করলাম। আমি দেখলাম একটি নতুন চাটাইয়ের ওপর ইমাম হোসেইন (আ.)-এর দেহ শোয়ানো আছে , আর তা থেকে মেশকের সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। আমি ঐ চাটাইটি আগের জায়গাতেই রেখে দিলাম যার ওপরে ইমামের দেহ শোয়ানো ছিলো। এরপর আমি আদেশ দিলাম মাটি দিয়ে ভরে দিতে এবং তার ওপর পানি ছিটিয়ে দিতে।

আবিল জারুদ থেকে বর্ণিত হয়েছে যে , প্রথমে ইমাম হোসেইন (আ.)-এর কবর মাথার দিক থেকে উম্মোচন করা হলো , এরপর পায়ের দিকে। মেশকের সুগন্ধ তা থেকে ছড়িয়ে পড়ছিলো এবং কারো এতে সন্দেহ ছিলো না।

যায়েদাহ থেকে একটি সুপরিচিত হাদীস বর্ণিত হয়েছে যে , জিবরাঈল রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বললেন , আপনার এ নাতি , তিনি তা বললেন ইমাম হোসেইন (আ.)-এর দিকে ইশারা করে , শহীদ হবে আপনার পরিবার , বংশ এবং আপনার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত ধার্মিক একদল মানুষের সাথে ফোরাত নদীর তীরে ― জায়গাটির নাম কারবালা। তিনি আরো বললেন , যখন তারা লুটিয়ে পড়বে তাদের আরামের জায়গায় , আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাদের আত্মাগুলোকে নিজের হাতে হরণ করবেন , আর সপ্তম আকাশের ফেরেশতারা আসবে লালমনি ও পান্না-এর ট্রে নিয়ে যা পূর্ণ থাকবে চির জীবন লাভের পানি দিয়ে এবং থাকবে জান্নাতের চাদর ও সুগন্ধি , এরপর তারা দলে দলে তার লাশের জানাযার নামাজ পড়বে। এরপর আল্লাহ আপনার উম্মতের মধ্যে একটি দলকে ক্রিয়াশীল করবেন , যাদেরকে মুশরিকদের রাজ্য চিনতে পারবে না , না তারা তার সাথে রক্ত , বক্তব্য , ধারণা ও কার্যক্রমে সম্পৃক্ত থাকবে। তারা তাদেরকে দাফন করবে এবং একটি নিদর্শনকে দাঁড় করাবে শহীদদের সর্দারের জন্য ঐ মরুভূমির বুকে , যা সৎকর্মশীলদের জন্য পথপ্রদর্শক হিসাবে কাজ করবে এবং বিশ্বাসীদের জন্য সম্মৃদ্ধির মাধ্যম হবে এবং প্রতিদিন প্রত্যেক আকাশ থেকে একশ লক্ষ ফেরেশতা একে তাওয়াফ করবে এবং তার প্রতি সালাম পেশ করবে। তারা আল্লাহর তাসবিহ করবে এবং তাঁকে অনুরোধ জানাবে তাদেরকে নাজাত দেওয়ার জন্য যারা তার কবর যিয়ারতে গেছে। এরপর তারা যিয়ারাতকারীদের নাম লিখে নিবে।

কুফাতে সাইয়েদা যায়নাব বিনতে আলী (আ.)-এর খোতবা

উমর ইবনে সা ’ আদ কারবালা থেকে মহানবী (সা.)-এর পরিবারের অবশিষ্ট সদস্যদের বন্দী করে কুফার নিকটবর্তী স্থানে আসলে সেখানকার লোকেরা দৃশ্য দেখার জন্য জমায়েত হলো। কুফার লোকেরা বন্দীদের পরিচয় জেনে কাঁদতে শুরু করে। এ সময় সাইয়েদা যায়নাব বিনতে আলী (আ.) একটি ভাষণ দেন।

আবু মানসূর তাবারসি তার ইহতিজাজ ’ -এ বর্ণনা করেছেন যে , কুফাবাসীদের মধ্যে ইমাম আলী বিন আবি তালিব (আ.)-এর কন্যা যায়নাব (আ.)-এর খোতবা ছিলো তাদের প্রতি তিরস্কার ও দমনমূলক। হিযাম বিন সাতীর আসাদি বর্ণনা করেছে যে , যখন ইমাম আলী বিন হোসেইন (আ.)-কে অসুস্থ অবস্থায় কারবালা থেকে কুফা আনা হলো , কুফার নারীরা নিজেদের জামার কলার ছেঁড়া শুরু করলো এবং উচ্চ স্বরে কাঁদতে লাগলো এবং পুরুষরাও তাদের আহাজারির সাথে যোগ দিলো। ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) , যিনি অসুস্থ ছিলেন , তাদেরকে ক্ষীণ কণ্ঠে ডেকে বললেন , হে যারা কাঁদছো , তোমরা ছাড়া আর কারা আমাদের হত্যা করেছে ? সাইয়েদা যায়নাব (আ.) বিনতে আলী (আ.) লোকদেরকে ইশারা করলেন চুপ থাকার জন্য। হিযাম আসাদি আরো বলে যে , আল্লাহর শপথ আমি কখনো কোন নম্র নারীকে তার চাইতে বাগ্মী দেখি নি যিনি বিশ্বাসীদের আমির আলী (আ.)-এর কণ্ঠে বলছিলেন , তিনি লোকদেরকে ইশারা করলেন কথা শোনার জন্য। তাদের নিশ্বাস বুকের ভেতরে বন্ধ হয়ে গেলো এবং তাদের সম্মিলিত কন্ঠের সুর মিলিয়ে গেলো। এরপর তিনি আল্লাহর প্রশংসা করলেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর সালাম পেশ করলেন এবং বললেন ,

আম্মা বা দ , হে কুফাবাসীরা , হে অহংকারী ব্যক্তিরা , হে প্রতারক ব্যক্তিরা , হে পেছনে পলায়নকারীরা , শুনে রাখো , তোমাদের কান্না যেন কখনো না থামে এবং তোমাদের বিলাপ যেন কখনো শেষ না হয়। নিশ্চয়ই তোমাদের উদাহরণ হচ্ছে সেই নারীর মতো যে নিজেই তার সুতার প্যাঁচ খুলে ফেলে তা প্যাঁচানোর পর। তোমরা তোমাদের অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছো প্রতারণার মাধ্যমে এবং তোমাদের মাঝে লোক দেখানো আত্ম-গরিমা , সীমা অতিক্রম এবং অসততা ছাড়া কিছু বাকী নেই। তোমরা দাসীদের প্রতি প্রেমবাক্য এবং শত্রুদের প্রতি মিষ্টি কথাকে তোমাদের ঐতিহ্য হিসাবে নিয়েছো। তোমাদের উদাহরণ হলো বিস্তীর্ণ বনের মতো অথবা কবরস্থানের মূল্যবান গহনার মতো। জেনে রাখো , কী খারাপই না তোমরা নিজেদের জন্য এনেছো যা আল্লাহর ক্রোধ ডেকে এনেছে তোমাদের ওপরে এবং তোমরা আখেরাতে ক্রদ্ধ আগুনের ভেতরে জায়গা অর্জন করেছো। তোমরা আমার ভাইয়ের জন্য কাঁদছো ? হ্যাঁ , নিশ্চয়ই , আল্লাহর শপথ , তোমাদের কাঁদা উচিত , তোমরা এর যোগ্য। প্রচুর কাঁদো , কম হাসো , এভাবেই তোমরা অপমানে আক্রান্ত হয়েছো এবং ঘৃণার ভেতরে বন্দী হয়েছো যা তোমরা কখনোই ধুয়ে ফেলতে পারবে না। কীভাবে তোমরা শেষ নবী ’ (সা.)-এর সন্তান এবং তোমাদের মাঝে রিসালাতের খনি ’ -র রক্ত নিজেদের হাত থেকে ধুয়ে ফেলবে ― যিনি ছিলেন বেহেশতের যুবকদের সর্দার , যুদ্ধক্ষেত্রের সেনাপতি এবং তোমাদের দলের আশ্রয়। তিনি ছিলেন তোমাদের বিশ্রামের এবং তোমাদের কল্যাণের বাসস্থান। তিনি ক্ষত নিরাময় করতেন এবং তোমাদেরকে রক্ষা করতেন , যেসব খারাপ তোমাদের দিকে আসতো। তোমরা তার কাছে যেতে যখন তোমরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ করতে। তিনি ছিলেন তোমাদের শ্রেষ্ঠ পরামর্শদাতা , তোমরা তার ওপর নির্ভর করতে এবং তিনি ছিলেন তোমাদের পথ চলার বাতি। জেনে রাখো , কী খারাপই না তোমরা নিজেদের জন্য এনেছো এবং ক্বিয়ামতের দিনের জন্য কী বোঝাই না তোমরা তোমাদের ঘাড়ে তুলে নিয়েছো। আত্মার ধ্বংস! আত্মার ধ্বংস! ধ্বংস! তোমাদের সন্ধান ব্যর্থ হোক এবং তোমাদের হাত অবশ হয়ে যাক , কারণ তোমরা তোমাদের রিযক্ব-এর বিষয়টি প্রবহমান বাতাসের কাছে হস্তান্তর করেছো। তোমরা আল্লাহর ক্রোধের ভেতরে জায়গা করে নিয়েছো এবং ঘৃণা ও দুর্ভাগ্যের মোহর তোমাদের কপালে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।

দুর্ভোগ হোক তোমাদের! তোমরা কি জানো তোমরা মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রিয় সন্তানের মাথা কেটে বিচ্ছিন্ন করেছো ? এবং কী অঙ্গীকার তোমরা তার সাথে ভঙ্গ করেছো ? এবং তার প্রিয় পরিবারকে তোমরা রাস্তায় বের করে এনেছো ? এবং তাদের মর্যাদার কোন্ আবরণ [বোরখা] তোমরা তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছো ? এবং কোন্ রক্ত তোমরা তার কাছ থেকে ঝরিয়েছো ? কী কুটিল জিনিসই না তোমরা জন্ম দিয়েছো যে , আকাশগুলো যেন ভেঙ্গে পড়বে এবং জমিন ছিন্ন- বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে , আর পাহাড়গুলো টুকরো হয়ে ভেঙ্গে পড়বে পৃথিবী ও আকাশের মাঝের জায়গা পূর্ণ করে।

তোমাদের বিষয়গুলোর বধূ হলো চুলবিহীন , অপরিচিত , নোংরা , অন্ধ , কুৎসিত ও গম্ভীর। তোমরা আশ্চর্য হচ্ছো কেন আকাশ থেকে রক্ত বৃষ্টি হয়েছে ? আখেরাতের শাস্তি আরো অপমানকর এবং তখন কোন সাহায্যকারী থাকবে না। তোমাদের এ অবসর যেন তোমাদেরকে হালকা মনের না করে দেয় , কারণ সর্বশক্তিমান ও পবিত্র আল্লাহ সম্পর্কে কেউ পূর্ব-ধারণা করতে পারে না এবং প্রতিশোধ নেওয়ার বিষয়ে তিনি ভুলে যান না ; না , কখনোই না , তোমাদের রব তোমাদের জন্য ওঁত পেতে আছেন।

এরপর তিনি নিচের শোকগাঁথাটি আবৃত্তি করলেন , কী উত্তর দিবে যখন নবী জিজ্ঞেস করবেন , তোমরা ছিলে শেষ উম্মত ; কেমন আচরণ করেছো তোমরা আমার বংশ ও আমার সন্তানদের সাথে ― যারা ছিলো সম্মানিত ; যাদের কিছুকে বন্দী করেছিলে এবং তাদের কিছুকে তাদের রক্তে ভিজিয়েছো ? এটি তো সেই প্রতিদান নয় যে বিষয়ে আমি তোমাদেরকে উপদেশ দিয়েছিলাম যার মাধ্যমে তোমরা আমার ক্বুরবা ’ [রক্তজ]-এর প্রতি আচরণ করেছো ; আমি আশঙ্কা করি , যে গযব ইরাম ’ -এর লোকজনের ওপর পড়েছিল ঐ রকম একটি গযব তোমাদের ওপর অবতরণ করবে। এ কথা বলে তিনি তার মুখ তাদের দিক থেকে ঘুরিয়ে নিলেন।

হিযাম বলে যে , আমি দেখলাম সব পুরুষ এদিক সেদিক চলে গেলো এবং তারা গভীর অনুতপ্ত ছিলো। আমার পাশে দাঁড়ানো একজন বৃদ্ধ মানুষ ভীষণ কাঁদলো এবং তার দাড়ি তার চোখের পানিতে ভিজে গেলো। সে তার হাত দুটো আকাশের দিকে তুলে ধরলো এবং বললো , আমার বাবা-মা কোরবান হোক তাদের জন্য যাদের বৃদ্ধ , যুবক ও নারীরা সব বৃদ্ধ , যুবক ও নারীদের ওপরে বাছাইকৃত। তাদের পরিবার সম্মানিত এবং তাদের মর্যাদা সুউচ্চ। এরপর সে বললো , তাদের পুর্বপুরুষরা এবং তাদের বংশধরগণ শ্রেষ্ঠ। যখন আগামীকাল তাদের বংশধরদের গণনা করা হবে , তখন ধ্বংসপ্রাপ্ত ও অভিশপ্তদের মাঝে তাদের [বংশধর] থাকবে না।

ইমাম আলী বিন হোসেইন (আ.) বলেছেন , হে প্রিয় ফুফু , দয়া করে চুপ থাকুন , যা ঘটে গেছে তা ভবিষ্যতের জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে। আলহামদুলিল্লাহ , আপনি কোন প্রশিক্ষণ ছাড়াই বিচক্ষণ ব্যক্তি এবং জ্ঞানী , যাকে আর বুঝানোর প্রয়োজন নেই। নিশ্চয়ই কান্না ও আহাজারি তাদেরকে ফেরত আনতে পারবে না যারা চলে গেছে।

কুফার জনগণের ভেতর ইমাম আলী বিন হোসেইন (আ.)-এর যুক্তি পেশ

এরপর হিযাম বিন সাতীর বলে যে , ইমাম আলী বিন যায়নুল আবেদীন (আ.) জনতার সামনে এগিয়ে এলেন এবং তাদেরকে ইশারা করলেন চুপ থাকার জন্য। এরপর তিনি বসলেন , আল্লাহর প্রশংসা ও তাসবিহ করলেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর সালাম পেশ করলেন। তারপর বললেন ,

হে জনতা , তোমাদের মধ্যে যারা আমাকে চিনো , তারাতো আমাকে চিনোই , আর যারা আমাকে চিনো না ― আমি আলী , হোসেইনের সন্তান , যার মাথা বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে ফোরাতের তীরে কোন অপরাধ বা দোষ ছাড়াই। আমি তার সন্তান যার পবিত্রতা লঙ্ঘন করা হয়েছে এবং যার রহমতপূর্ণ জীবনকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে. তার সম্পদ লুট করা হয়েছে এবং তার নারীদের বন্দী করা হয়েছে। আমি তার সন্তান যাকে হত্যা করেছে একদল সংঘবদ্ধ মানুষ , আর এ [শাহাদাতের] সম্মান আমাদের জন্য যথেষ্ট।

হে জনতা , আমি তোমাদেরকে আল্লাহর নামে বলছি , তোমরা কি জানো না যে তোমরা আমার পিতাকে একটি চিঠি লিখেছিলে তাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে ? তোমরা তাকে ধোঁকা দিয়েছো অঙ্গীকারের মাধ্যমে এবং তাকে সাহায্য করার প্রতিশ্রতি দিয়ে এবং তার কাছে আনুগত্যের শপথ করে। এর পরিবর্তে তোমরা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছো এবং তাকে পরিত্যাগ করেছো। তোমরা যেন তার মাধ্যমে ধ্বংস হও যার জন্ম তোমরা দিয়েছো এবং তোমাদের আদর্শ যেন কদর্য হয়ে যায়। তোমরা কিভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সামনে দাঁড়াবে যখন তিনি বলবেন: তোমরা আমার সন্তানকে হত্যা করেছো এবং আমার পবিত্রতার মর্যাদা লঙ্ঘন করেছো , তোমরা আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নও।

পুরুষদের মাঝে কান্নার রোল উঠলো এবং তারা পরস্পরকে বলতে লাগলো , তোমরা ধ্বংস হয়ে গেছো এবং তোমরা [তা] জানো না। এরপর ইমাম (আ.) আরও বললেন , তার ওপর আল্লাহর রহমত হোক যে আমার উপদেশ গ্রহণ করে এবং আমার পরামর্শকে হেফাযত করে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সা.) এবং তার বংশের পথে যে , আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে রক্ত সম্পর্ক রেখে আরো উত্তম হেদায়েতের অধিকারী।

তারা তাকে বললো , হে রাসূলুল্লাহর সন্তান , আমরা সবাই কথা শুনি , অনুগত এবং আপনার পবিত্রতার প্রশংসাকারী। আমরা আপনাকে পরিত্যাগ করবো না এবং আপনার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিবো না। তাই আদেশ করুন আমাদের , আপনার রব আপনার ওপর রহমত করুন , আমরা আপনার সাথে আছি যুদ্ধ ও শান্তির সময়ে। এরপর আমরা তার ওপর প্রতিশোধ নিবো যে আপনাদের ওপরে জুলুম করেছে অথবা আমাদের ওপর। একথা শুনে ইমাম (আ.) বললেন ,

হায় আশ্চর্য , হায় আশ্চর্য , হে প্রতারণাপূর্ণ ধোঁকাবাজের দল , একটি বিরাট বাধা আছে তোমাদের এবং তোমাদের ব্যর্থ আকাঙ্ক্ষার মাঝে। তোমরা কি আমার সাথে একই আচরণ করতে চাও যেভাবে তোমরা আমার পূর্বপুরুষদের সাথে আচরণ করেছো ? না , কখনোই না। হাজ্বীদের আনন্দিত উটদের রবের শপথ , আমার পিতার ও আমার পরিবারের শাহাদাতের গভীর ক্ষতসমূহ এখনো আরোগ্য লাভ করে নি , যে আঘাতগুলো রাসূলুল্লাহ (সা.) , আমার পিতা ও তার সন্তানদের বুকে করা হয়েছে তা এখনো স্মৃতি থেকে মুছে যায় নি। আমার ঘাড়ের হাড়গুলো ভেঙ্গে গেছে দুঃখে এবং এর তিক্ততা আমার কণ্ঠ ও শ্বাসনালীর মাঝখানে উপস্থিত আছে , আমার হৃদয়ের হাড়গুলো আমার শ্বাসরুদ্ধ করে দিচ্ছে। আমি চাই যে তোমরা যেন আমাদের উপকারকারীদের অন্তর্ভুক্ত না হও , আর না আমাদের অনিষ্টকারীদের অন্তর্ভুক্ত হও।

এরপর তিনি বললেন , এটি কোন আশ্চর্যের বিষয় নয় যে হোসেইনকে (আ.) হত্যা করা হয়েছে , তার পিতার মতোই , যিনি ছিলেন তার চাইতে উত্তম এবং তার চাইতে শ্রেষ্ঠ। হে কুফাবাসীরা , উল্লাসিত হয়ো না আমাদের দুর্দশায় , যা একটি বিরাট দুর্যোগ। যিনি শহীদ হয়ে পড়ে আছেন ফোরাতের তীরে , আমার জীবন তার জন্য কোরবান হোক ― আর তার হত্যার শাস্তি হবে জাহান্নামের আগুন।