মহানবী (সা.)-এর বন্দী পরিবার

 মহানবী (সা.)-এর বন্দী পরিবার0%

 মহানবী (সা.)-এর বন্দী পরিবার লেখক:
: এ.কে.এম. রশিদুজ্জামান
প্রকাশক: ওয়াইজম্যান পাবলিকেশনস
বিভাগ: ইমাম হোসাইন (আ.)

 মহানবী (সা.)-এর বন্দী পরিবার

লেখক: মুহাম্মদ ইরফানুল হক
: এ.কে.এম. রশিদুজ্জামান
প্রকাশক: ওয়াইজম্যান পাবলিকেশনস
বিভাগ:

ভিজিট: 9163
ডাউনলোড: 2714

পাঠকের মতামত:

মহানবী (সা.)-এর বন্দী পরিবার
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 29 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 9163 / ডাউনলোড: 2714
সাইজ সাইজ সাইজ
 মহানবী (সা.)-এর বন্দী পরিবার

মহানবী (সা.)-এর বন্দী পরিবার

লেখক:
প্রকাশক: ওয়াইজম্যান পাবলিকেশনস
বাংলা

কুফায় সাইয়েদা ফাতিমা বিনতে হোসেইন (আ.)-এর খোতবা

যাইদ বিন মূসা বিন জাফর তার পিতা থেকে বর্ণনা করেছে , যে তার পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে ফাতিমা সুগরা [বিনতে হোসেইন] (আ.)-এর খোতবা বর্ণনা করেছে , যা তিনি কারবালা থেকে ফেরার পর দিয়েছিলেন:

আল্লাহর প্রশংসা করছি সব বালুকণার সংখ্যায় এবং পৃথিবী পর্যন্ত আকাশগুলোর ওজনের সমান। আমরা তার প্রশংসা করি এবং তাকে বিশ্বাস করি এবং শুধু তারই ওপর নির্ভর করি এবং আমরা বলি যে আল্লাহ ছাড়া আর কোন খোদা নেই , তিনি অদ্বিতীয় ও তাঁর কোন অংশীদার নেই এবং মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর দাস ও রাসূল। কোন দোষ ছাড়াই তার সন্তানদের মাথা বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে ফোরাত নদীর তীরে। হে আল্লাহ , আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই যদি আমি আপনার বিষয়ে কোন মিথ্যা বলি অথবা আমি যদি কোন ভুল ধারণা পোষণ করি আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)-এর খিলাফতের বিষয়ে , যার অধিকার অন্যায়ভাবে দখল করা হয়েছিল এবং তাকেও কোন অপরাধ ছাড়াই হত্যা করা হয়েছে আল্লাহর ঘরগুলোর একটিতে , যেভাবে তার সন্তানদের হত্যা করা হয়েছে গতকাল। সেখানে ছিলো একদল লোক যারা নিজেদের মুসলমান দাবী করেছিল , তাদের মাথা যেন তাদের ঘাড়ের ওপর না থাকে , তিনি পিপাসার্ত ছিলেন যতক্ষণ না তার সত্তাকে আপনার কাছে তুলে নেয়া হয়েছিল। তার ছিলো প্রশংসনীয় চরিত্র , ধার্মিক বংশধর এবং সুবিখ্যাত গুণাবলী ও প্রশংসনীয় ধর্ম এবং তিনি আপনার পথে কোন তিরস্কার ও ধমককে ভয় করতেন না। হে আল্লাহ , আপনি তাকে আপনার ইসলামের দিকে পথ দেখিয়েছেন শৈশব থেকেই এবং আপনি তার বালেগ বয়সের গুণাবলীকে প্রশংসা করেছেন। তিনি সার্বক্ষণিকভাবে আপনার রাসূলের প্রতি আন্তরিক ছিলেন এবং আপনার দরুদ তার ওপর বর্ষিত হয়েছে ঐ সময় পর্যন্ত যখন আপনি তাকে আপনার নিজের কাছে ডেকে নিলেন। তিনি বিরত ছিলেন এ পৃথিবীর বিষয়ে এবং তিনি সম্পদলোভী ছিলেন না। আর তিনি ছিলেন আখেরাতের বিষয়ে আশাবাদী। এরপর তিনি আপনার পথে সংগ্রাম করেছেন এবং আপনি তাকে ভালোবেসেছেন ও তাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন এবং তাকে সিরাতাল মুসতাক্বিমের পথ দেখিয়েছেন।

আম্মা বা ’ দ , হে কুফাবাসীরা , হে ধোঁকাবাজ , প্রতারক এবং অহংকারী ব্যক্তিরা , আমরা এক পরিবার যাদেরকে আল্লাহ পরীক্ষা করেছেন তোমাদের বিষয়ে এবং তিনি তোমাদের পরীক্ষা করেছেন আমাদের বিষয়ে। তিনি এ পরীক্ষাগুলোকে আমাদের জন্য ঐশী প্রশান্তি লাভের কারণ করেছেন এবং এ বিষয়ে আমাদের জানিয়েছেন। আমরা তাঁর জ্ঞানের হেফাযতকারী অভিভাবক এবং তাঁর বুদ্ধির ভাণ্ডার। আমরা তাঁর প্রজ্ঞাকে স্বীকৃতি দেই এবং তার পৃথিবীতে তাঁর দাসদের ওপর আমরা তাঁর প্রমাণ। তিনি আমাদের অত্যন্ত ভালোবাসেন তার দয়ার মাধ্যমে এবং আমাদেরকে তাঁর সৃষ্টিকূলের ওপর মর্যাদা দিয়েছেন তার নবীর মাধ্যমে। তোমরা আমাদেরকে মিথ্যা বলেছো এবং কুফুরী করেছো আমাদের [ওপর অত্যাচারের] মাধ্যমে। তোমরা মনে করেছো আমাদের হত্যা করা বৈধ এবং আমাদের জিনিসপত্র লুট করেছো যেন আমরা তুরস্ক ও কাবুলের কাফের। এই গতকাল ছিলো যখন তোমরা আমাদের দাদাকে হত্যা করেছো এবং তোমাদের তরবারিগুলো আমাদের , আহলুল বায়েত [নবী পরিবার]-এর রক্ত ছিটিয়েছে। তোমরা তোমাদের চোখকে শীতল করেছো প্রাচীন শত্রুতার কারণে এবং উল্লাস করেছো আল্লাহর বিরুদ্ধে উদ্ধত হয়ে এবং যে ধোঁকার জন্ম দিয়েছো তার কারণে। আমাদের রক্ত ঝরানোতে ও আমাদের জিনিসপত্র লুট করে উল্লাসিত হয়ো না , কারণ এ মহাদুর্যোগের এবং বিরাট জবাইয়ের মাধ্যমে আমাদের কাছে যা পৌঁছেছে তা কোরআনের এ আয়াতের সাথে একমত

) س َابِقُوا إِلَى مَغْفِرَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا كَعَرْضِ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ أُعِدَّتْ لِلَّذِينَ آمَنُوا بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ ذَلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيمِ (21) مَا أَصَابَ مِنْ مُصِيبَةٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي أَنْفُسِكُمْ إِلَّا فِي كِتَابٍ مِنْ قَبْلِ أَنْ نَبْرَأَهَا إِنَّ ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ(

প্রতিযোগিতা করো দ্রুত এগোবার জন্য তোমাদের রবের ক্ষমা এবং এক জান্নাতের দিকে ― যার বিস্তৃতি আকাশ ও পৃথিবীর বিস্তৃতির মতো , [এটি] প্রস্তুত করা হয়েছে তাদের জন্য যারা বিশ্বাস করে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলে ; এটি আল্লাহর অনুগ্রহ , তিনি তা দান করেন যাকে তাঁর ইচ্ছা এবং আল্লাহ বিরাট অনুগ্রহের প্রভু। কোন দুর্যোগ ঘটে না পৃথিবীতে অথবা তোমাদের নিজেদের ভেতরে , যা আগে থেকেই একটি কিতাবে নেই ― আমরা ঘটতে দেই , তা আল্লাহর জন্য সহজ। [সূরা হাদীদ: 21-22]

তোমরা যেন বহিস্কৃত হও! অপেক্ষা করো সে অভিশাপের জন্য যা শীঘ্রই তোমাদের ওপর অবতরণ করবে। আকাশগুলোর প্রতিশোধ তোমাদের ওপর অবতরণ করবে একের পর এক এবং ক্ষয়ে যেতে থাকবে ,

) أ َوْ يَلْبِسَكُمْ شِيَعًا وَيُذِيقَ بَعْضَكُمْ بَأْسَ(

অথবা তিনি তোমাদেরকে বিভিন্ন দলে পরিণত করবেন এবং তোমাদের মধ্যে কিছুকে অন্যের যুদ্ধের স্বাদ গ্রহণ করাবেন। [সূরা আন ’ আম: 65]

এরপর আমাদের ওপর তোমরা যে জুলুম করেছো , [সে জন্য] তোমরা কিয়ামতের দিনে থাকবে চিরস্থায়ী ভয়ানক আযাবের ভেতর। জেনে রাখো , জালেমদের ওপর আল্লাহর অভিশাপ! তোমাদের দুর্ভোগ হোক! তোমরা কি জানো এবং তোমরা কি বুঝো ? তোমরা কেমন হাত দিয়ে আমাদের দিকে বর্শা তাক করেছিলে ? কেমন সত্তা নিয়ে তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করতে এসেছিলে ? কেমন পা নিয়ে আমাদের সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধ করতে এগিয়ে এসেছিলে ? তোমাদের অন্তরগুলো শক্ত হয়ে গেছে। তোমাদের কলিজা লোহায় পরিণত হয়েছে এবং তোমাদের হৃদয় অন্ধ হয়ে গেছে। আর তোমাদের কান ও চোখের ওপর মোহর মেরে দেওয়া হয়েছে। শয়তান তোমাদের উস্কানি দিয়েছে এবং তোমাদের আদেশ দিয়েছে এবং তোমাদের চোখগুলোকে অন্ধ করে দিয়েছে , আর তোমরা কখনোই হেদায়াত খুঁজে পাবে না। তোমরা যেন ধ্বংস হয়ে যাও হে কুফাবাসীরা , রাসূল (সা.)-এর কত রক্তের দায় তোমাদের ওপর ? এবং কী পরিমাণ [প্রতিশোধ] তোমাদের ঘাড়ের ওপর ? এরপর তোমরা তার ভাই আলী ইবনে আবি তালিবের সাথে প্রতারণা করেছো এবং তার সন্তানদের সাথেও ― যারা নবীর বংশ এবং তারা ছিলো পবিত্র ও ধার্মিকদের অন্তর্ভুক্ত। তোমাদের মাঝে একজন দম্ভ করে বলেছিল: আমরাই তারা যারা আলী এবং তার সন্তানদেরকে হত্যা করেছি ভারতীয় তরবারি ও বর্শা দিয়ে এবং আমরা তাদের নারীদের বন্দী করেছি তুরস্কের বন্দীদের মতো এবং আমরা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি এবং তা একটি যুদ্ধই ছিলো। তার মুখের মধ্যে কাদা যে তা বলেছে। তোমরা গর্ব করেছো তাদের হত্যা করে যাদের আল্লাহ প্রশংসা করেছেন এবং পবিত্র করেছেন এবং তাদের কাছ থেকে অপবিত্রতা দূরে সরিয়ে রেখেছেন ? নিশ্বাস বন্ধ করো , এরপর বসো যেভাবে একটি কুকুর তার লেজের আগায় বসে , যেভাবে তোমাদের পিতা বসতো। প্রত্যেক ব্যক্তি তাই লাভ করবে যা সে আগে পাঠিয়েছে। দুর্ভোগ হোক তোমাদের , তোমরা আমাদের হিংসা করতে আল্লাহ যে অনুগ্রহ আমাদের ওপর করেছেন তার কারণে। আমাদের এতে কী দোষ যদি আমাদের নদী প্রচুর পানিতে পূর্ণ থাকে , আর তোমাদের নদী শুকিয়ে যায় , যা একটি কেঁচোকে লুকাতে পারে না ?

) ذ َلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيمِ(

এ হলো আল্লাহর অনুগ্রহ , তিনি তা দান করেন যাকে তাঁর ইচ্ছা এবং আল্লাহ বিরাট অনুগ্রহের প্রভু। [সূরা হাদীদ: 21]

) و َمَنْ لَمْ يَجْعَلِ اللَّهُ لَهُ نُورًا فَمَا لَهُ مِنْ نُورٍ(

যাকে আল্লাহ নূর দেন না , তার জন্য নূর থেকে কিছু নেই। [সূরা নূর: 40]

বলা হয়েছে যে এ কথা শুনে কান্নার কণ্ঠগুলো উচ্চকিত হলো এবং জনতা বললো , যথেষ্ট হয়েছে হে পবিত্রদের কন্যা , আপনি আমাদের হৃদয় পুড়িয়ে ফেলেছেন , আমাদের ঘাড় নিচু করে দিয়েছেন এবং আমাদের বিবেকে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন। এরপর তিনি চুপ করে গেলেন। তার ও তার পিতা ও তার নানার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।

কুফাতে সাইয়েদা উম্মে কুলসুম বিনতে আলী (আ.)-এর খোতবা

সাইয়েদ ইবনে তাউস তার মালহুফ ’ -এ খোতবাগুলো উদ্ধৃত করেছেন এবং এরপর বলেছেন যে , সেদিন ইমাম আলী (আ.)-এর কন্যা উম্মে কুলসুম (আ.) পর্দার পেছন থেকে কেঁদে উঠলেন এবং বললেন , হে কুফাবাসীরা , তোমরা যেন খারাপের সম্মুখীন হও , কেন তোমরা ইমাম হোসেইন (আ.)-কে সাহায্য করা থেকে বিরত রইলে ? কেন তাকে হত্যা করলে ? কেন তোমরা তার জিনিসপত্র লুট করলে এবং এগুলোর মালিক বনে গেলে ? কেন তার নারী-স্বজনদের বন্দী করেছো এবং তাকে নিশ্চুপ করে দিয়েছো ? তোমরা যেন ধ্বংস হয়ে যাও এবং শিকড় শুদ্ধ উৎপাটিত হয়ে যাও। দুর্ভোগ হোক তোমাদের , তোমরা কি জানো তোমরা কিসের জন্ম দিয়েছো ? তোমরা কি জানো কী গুনাহের বোঝা তোমরা তোমাদের পিঠের ওপর তুলে নিয়েছো ? এবং কী রক্ত তোমরা ঝরিয়েছো ? এবং কোন নারীদের তোমরা বন্দী করেছো ? এবং কোন শিশুদের লুট করতে চাও ? এবং কোন জিনিসপত্র তোমরা লুটতরাজ করেছো ? তোমরা রাসূল (সা.)-এর পরে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষকে হত্যা করেছো। আর তোমাদের হৃদয় থেকে দয়া বিদায় নিয়েছে।

) أ َلَا إِنَّ حِزْبَ الشَّيْطَانِ هُمُ الْخَاسِرُونَ(

জেনে রাখো , একমাত্র হিযবুল্লাহ-ই [আল্লাহর দল] সফলতা লাভ করবে [সূরা মুজাদালাহ: 22]

জেনে রাখো , অবশ্যই শয়তানের দল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। [সূরা মুজাদালাহ: 19]

এরপর তিনি বললেন ,

তোমরা আমার ভাইকে হত্যা করেছো , অভিশাপ তোমাদের ওপর। তোমরা অবশ্যই এর পুরস্কার হিসাবে পাবে আগুন ― যাতে চিরকাল পুড়বে। তোমরা তার রক্ত ঝরিয়েছো যার রক্ত ঝরানোকে হারাম ঘোষণা করেছেন আল্লাহ কোরআন ও মুহাম্মাদ (সা.)-এর মাধ্যমে ; তোমরা যেন আগুনের সংবাদ পাও যেখানে তোমরা আগামীকাল প্রবেশ করবে এবং চিরস্থায়ীভাবে সেখানে যাবে। আমি আমার ভাইয়ের জন্য সারা জীবন কাঁদবো , যিনি জন্ম নিয়েছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পরে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হিসাবে। আমার গালে অশ্রু বইছে বন্যার মতো এবং বৃষ্টির মতো ― যা কখনো শুকোবে না।

বলা হয়েছে , জনতা কাঁদতে লাগলো এবং উচ্চকণ্ঠে আহাজারি করতে লাগলো। নারীরা তাদের নিজেদের চুল ছিঁড়লো এবং মাথায় বালি মাখলো। তারা তাদের চেহারায় খামচি দিলো এবং তাতে আঘাত করতে শুরু করলো এবং বললো , হায় , হায়। পুরুষরা কাঁদতে শুরু করলো এবং নিজেদের দাড়ি ধরে টানলো। কোনদিন পুরুষ ও নারীদের এমন বিলাপ দেখা যায় নি।

কুফায় উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদের প্রাসাদে নবী পরিবারের বন্দীরা

শারহে হামাযিয়া ’ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে , সে [উবায়দুল্লাহ] আদেশ দিলো যেন [ইমাম হোসেইন আ.-এর] মাথাটি তার ডান পাশে রাখা একটি বর্মের ওপর রাখা হয়। আর তার কাছেই দুই সারিতে লোকজন দাঁড়িয়ে ছিলো।

আযদি বলেন যে , সুলাইমান বিন রাশীদ বর্ণনা করেছে হামীদ বিন মুসলিম থেকে যে , আমি দেখলাম ইমাম হোসেইন (আ.)-এর মাথা তার কাছেই রাখা আছে। আর সে তার দাঁতগুলোতে তার হাতের বেত দিয়ে এক ঘন্টা ধরে আঘাত করছে। যখন যাইদ বিন আরক্বাম দেখলেন যে সে তার হাতকে নিবৃত্ত করছে না , তিনি উচ্চকণ্ঠে বললেন , তোমার বেত সরিয়ে নাও এ দাঁতগুলো থেকে , কারণ আল্লাহর শপথ , যিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই , আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দুটো ঠোঁটকেই দেখেছি সেগুলোর ওপর চুমু দিতে। এ কথা বলার পর বৃদ্ধের দুঃখ বিস্ফোরিত হলো এবং তিনি কাঁদতে লাগলেন। ইবনে যিয়াদ বললো , তোমার রব তোমাকে কাঁদাক। আল্লাহর শপথ , যদি তুমি বৃদ্ধ না হতে অথবা নির্বোধে পরিণত না হতে এবং তোমার বুদ্ধি চলে না যেতো , আমি তোমার মাথা উড়িয়ে দিতাম। এরপর সে উঠে দাঁড়ালো ও চলে গেলো। আমি যখন রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এলাম , দেখলাম লোকজন পরস্পরকে বলছে , আল্লাহর শপথ , যাইদ বিন আরক্বাম এমন কথা উচ্চারণ করেছে যে যদি যিয়াদের সন্তান তা শুনতো , সে তাকে হত্যা করে ফেলতো। আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম সে কী বলেছে। তারা বললো , সে বলেছে: একজন দাস একজন দাস লাভ করেছে এবং সে মনে করছে সব মানুষ তার দাসের সন্তান [আরবী প্রবাদ] । হে আরবরা , আজ থেকে তোমরা দাসে পরিণত হয়েছো। তোমরা ফাতেমা (আ.)-এর সন্তানকে হত্যা করেছো এবং মারজানাহর সন্তানকে তোমাদের অধিনায়ক বানিয়েছো। সে তোমাদের মাঝে ধার্মিকদের হত্যা করে। আর জেনে রাখো , সে তোমাদেরকে তার দাস বানিয়েছে। তোমরা নিজেদেরকে অপমানের ভেতরে প্রবেশ করিয়েছো এবং মৃত্যু হোক তাদের যারা নিজেদের অপমানের ভেতর প্রবেশ করিয়েছে।

শেইখ সাদূক্ব তার আমালি ’ গ্রন্থে এবং ফাত্তাল নিশাপুরি তার রাওযাতুল ওয়ায়েযীন ’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন উবায়দুল্লাহর এক খাদেমের কাছ থেকে যে , সে বলেছে , যখন ইমাম হোসেইন (আ.)-এর মাথাটি উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের কাছে আনা হলো সে এটিকে একটি সোনালী ট্রে-তে রাখতে আদেশ দিলো। এরপর সে তার বেত দিয়ে এর সামনের দাঁতগুলোতে আঘাত করতে লাগলো এবং বললো , হে আবা আবদিল্লাহ , তুমি খুব তাড়াতাড়িই বৃদ্ধ হয়ে গেছো। উপস্থিতদের মধ্যে একজন বললো , আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে দেখেছি সেখানে চুমু দিতে যেখানে তুমি তোমার বেত দিয়ে আঘাত করছো। সে বললো , এ দিনটি হলো বদরের দিনের বদলা। এরপর সে আদেশ দিলো আলী বিন হোসেইন (আ.)-কে শেকলে বাঁধতে এবং তার পরিবারের নারী ও অন্যান্য বন্দীদের সাথে কারাগারে পাঠাতে। আমি তাদের সাথে ছিলাম এবং দেখলাম সবগুলো রাস্তা পুরুষ ও নারীতে পূর্ণ ছিলো এবং তারা নিজেদের চেহারায় আঘাত করছিল এবং কাঁদছিলো। তারা তাদেরকে কারাগারে ঢুকালো এবং দরজায় তালা মেরে দিলো। এরপরে সে আলী বিন হোসেইন (আ.) এবং নারীদের সাথে ইমাম হোসেইন (আ.)-এর মাথা আনতে বললো , তাদের সাথে সাইয়েদা যায়নাব (আ.)ও ছিলেন। ইবনে যিয়াদ বললো , সব প্রশংসা আল্লাহর যে তিনি তোমাদেরকে অপমান করেছেন এবং হত্যা করেছেন। এরপর উবায়দুল্লাহ তাদেরকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ করলো এবং সব জায়গায় ইমাম হোসেইন (আ.)-এর মৃত্যুর সংবাদ পাঠালো ও ইমাম হোসেইন (আ.)-এর মাথাসহ বন্দীদেরকে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে পাঠালো।

শেইখ তুসী বর্ণনা করেছেন যে , যখন ইমাম হোসেইন (আ.) এর শাহাদাতের সংবাদ মদীনায় পৌঁছলো , আক্বীল বিন আবি তালিবের কন্যা আসমা একদল নারীর সাথে বেরিয়ে এলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কবরের দিকে গেলেন ও চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন। এরপর তিনি মুহাজির ও আনসারদের দিকে তাকিয়ে বললেন , আপনারা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে কী উত্তর দেবেন যখন রাসূলুল্লাহ (সা.) আপনাদের জিজ্ঞেস করবেন কিয়ামত ও হিসাব দেওয়ার দিনে ― যেদিন সত্য টিকে থাকবে ― যে তোমরা আমার বংশধরকে পরিত্যাগ করেছিলে ও অনুপস্থিত ছিলে এবং তাদেরকে জুলুমকারিদের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলে ; এখন কেউ নেই যে তোমাদের জন্য আল্লাহর কাছে শাফায়াত করবে ; যখন কারবালার মরুভূমিতে মৃত্যু তার দিকে এসেছিল , তার কোন সাহায্যকারী ছিলো না , না ছিলো কোন সাথী যারা বলবে , আমরা তার প্রতিরক্ষা করবো-অন্যের হাতে নিহত হওয়া থেকে। ’ বর্ণনাকারী বলেছে যে , আমরা এর আগে নারী-পুরুষদের এভাবে কাদঁতে দেখি নি।

নবী পরিবারের বন্দীদের কুফা থেকে দামেস্কে প্রেরণ

ইমাম হোসেইন (আ.)-এর মাথা পাঠিয়ে দেওয়ার পর উবায়দুল্লাহ শিশুদের এবং নারীদের প্রস্তুত করলো এবং ইমাম আলী বিন হোসেইন (আ.) এর গলায় একটি লোহার বেষ্টনি পরালো এবং তাদেরকে মাথার পিছনে রওয়ানা করিয়ে দিলো মাখফার বিন সা ’ লাবাহ আ ’ য়েযী এবং শিমর বিন যিলজাওশানকে দিয়ে এবং তারা একসময়ে মাথাগুলো বহনকারী কাফেলার সাথে যুক্ত হলো। ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) পথে তাদের সাথে কোন কথা বললেন না সিরিয়া পৌঁছা পর্যন্ত।

তারীখুল খামীস ’ গ্রন্থ থেকে উল্লেখ করা হয়েছে যে , তারা [মাথা বহনকারীরা] এগিয়ে যেতে থাকলো একটি গির্জাতে পৌঁছানো পর্যন্ত এবং সেখানে তারা দুপুর পর্যন্ত বিশ্রাম নেয়ার জন্য প্রবেশ করলো। সেখানে তারা দেখলো দেয়ালে লেখা আছে , যে উম্মত হোসেইনকে হত্যা করেছে , এরপরও তারা আশা করে যে কিয়ামতের দিন তার নানা তাদের জন্য সুপারিশ করবে ? তারা একজন পাদ্রীকে জিজ্ঞেস করলো , কে এ বাক্যগুলো লিখেছে ? সে বললো , এগুলো নবুয়ত ঘোষণার একশত পঞ্চাশ বছর আগে এখানে লেখা হয়েছিল।

সিবতে ইবনে জাওযী তার ধারাবাহিক বর্ণনাকারীদের মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন আবু মুহাম্মাদ আব্দুল মালিক বিন হিশাম নাহউই মিসরি থেকে , একটি হাদীসের মধ্যে আছে যে , তারা [মাথা বহনকারীরা] যখনই তাদের জিনিসপত্র নামাতো প্রতিবারই ট্রাংক থেকে পবিত্র মাথাটিও বের করে বর্শার ওপরে ওঠাতো। তারা সারা রাত পাহারা দিত ― সকাল পর্যন্ত এবং যাত্রা শুরুর আগে তা আবার ট্রাংকে ঢুকিয়ে রাখতো এবং সামনে অগ্রসর হতো। তাদের কোন এক যাত্রা বিরতির সময় এক পাদ্রীর গির্জার কাছে এলো। বরাবরের মতো তারা মাথাটি বর্শার ওপরে ওঠালো এবং একে পাহারা দিলো , আর বর্শাটিকে গির্জার দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখলো। মধ্যরাতে পাদ্রী দেখলো একটি আলোর রশ্মি মাথা থেকে বেরিয়ে আসছে এবং আকাশে পৌঁছে গেছে। সে গির্জার ওপর থেকে তাদের দিকে তাকিয়ে বললো , তোমরা কারা ? তারা উত্তর দিলো , আমরা ইবনে যিয়াদের সাথী। সে বললো , এটি কার মাথা ? তারা বললো , এটি হোসেইনের , আলী বিন আবি তালিব ও আল্লাহর নবীর কন্যা ফাতেমার সন্তান। সে বললো , তোমরা বলতে চাও তোমাদের নবী ? তারা হ্যাঁ-সূচক উত্তর দিলো। একথা শুনে সে বললো , তোমরা মানুষের মধ্যে নিকৃষ্ট। যদি মসীহর [ঈসা-আ.] কোন পুত্র-সন্তান থাকতো আমরা তাকে আমাদের চোখের ওপর রাখতাম [আমরা তাকে অনেক সম্মান দিতাম] । আরো বললো , তোমরা কি কিছু চাও , আমাকে কি একটা উপকার করতে পারো ? তারা জিজ্ঞেস করলো তা কী ? সে বললো , আমার দশ হাজার আশরাফী আছে , তোমরা তা নিতে পারো যদি মাথাটি আমাকে দাও। সকাল পর্যন্ত তা আমার কাছে রাখতে দিবে এবং যখন তোমরা আবার যাত্রা করবে তখন তা আমার কাছ থেকে ফেরত নিয়ে নিও। তারা বললো , এতে আমাদের কোন ক্ষতি নেই। একথা বলে তারা মাথাটি তার কাছে হস্তান্তর করলো এবং সে [পাদ্রী] বিনিময়ে তাদেরকে আশরাফীগুলো দিলো। পাদ্রী মাথাটি পানি দিয়ে ধুয়ে নিলো। এতে সুগন্ধি মাখালো এবং তা তার উরুর ওপর রেখে সকাল পর্যন্ত অনেক কাঁদলো। যখন সকাল হলো সে বললো , হে মাথা , আমার নিজের ওপরে ছাড়া আমার আর কোন ক্ষমতা নেই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই এবং আপনার নানা আল্লাহর রাসূল। আপনি সাক্ষী থাকুন যে আমি আপনার বন্ধু ও গোলাম। এরপর সে গির্জা ও এর ভেতরে যা ছিলো সব পরিত্যাগ করলো এবং আহলুল বাইত (আ.)-এর গোলামদের সারিতে প্রবেশ করলো।

ইবনে হিশাম তার সীরাহ ’ -তে বলেছেন যে , তারা মাথাটি নিয়ে সম্মুখে অগ্রসর হলো এবং যখন দামেস্কের কাছে পৌঁছলো , তারা পরস্পরকে বলতে শুরু করলো যে , আসো আমরা আশরাফীগুলো আমাদের মাঝে ভাগ করে নেই। হয়তো ইয়াযীদ সেগুলো দেখলে আমাদের কাছ থেকে নিয়ে যাবে। থলেটি আনা হলো এবং খোলা হলো। তারা দেখলো তা মাটিতে পরিণত হয়েছে এবং এর এক পাশে লেখা ,

) و َلَا تَحْسَبَنَّ اللَّهَ غَافِلًا عَمَّا يَعْمَلُ الظَّالِمُونَ إِنَّمَا يُؤَخِّرُهُمْ لِيَوْمٍ تَشْخَصُ فِيهِ الْأَبْصَارُ(

এবং ভেবো না জালেমরা যা করে সে সম্পর্কে আল্লাহ গাফেল। তিনি তাদের শুধু ঐ দিন পর্যন্ত রেহাই দেন যেদিন চোখগুলো পলকহীন তাকিয়ে থাকবে (আতঙ্কে) । [সূরা ইবরাহীম: 42]

এবং অন্য পাশে লেখা:

) و َسَيَعْلَمُ الَّذِينَ ظَلَمُوا أَيَّ مُنْقَلَبٍ يَنْقَلِبُونَ(

এবং শীঘ্রই জালেমরা জানতে পারবে কী খারাপ ফেরার দিকেই না তারা ফিরে আসবে। [সূরা আশ শুআরা: 227]

এ দেখে তারা সেগুলোকে বুরদা নদীতে নিক্ষেপ করলো।

সাইয়্যেদ ইবনে তাউস বলেন যে ইবনে লাহী ’ আহ এবং অন্যরা এ সংবাদটি দিয়েছে , যা থেকে আমরা একটি অংশ উল্লেখ করছি যতটুকু আমাদের প্রয়োজন: আমি কা ’ বা তাওয়াফ করছিলাম। তখন এক ব্যক্তিকে বলতে শুনলাম , হে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করো। কিন্তু আমি জানি তুমি তা কখনো করবে না। আমি বললাম , হে আল্লাহর বান্দাহ , আল্লাহকে ভয় করো এবং এ কথা উচ্চারণ করো না। এমনও যদি হয় যে তোমার গুনাহ বৃষ্টির ফোটাগুলোর অথবা গাছগুলোর পাতার সংখ্যার সমান। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও , নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমা করে দেবেন। কারণ আল্লাহতো পরম ক্ষমাশীল ও পরম করুণাময়। সে বললো , আসো , যেন তোমাকে আমি আমার সম্পর্কে বলতে পারি। সে বললো , আমরা ছিলাম পঞ্চাশ জন যারা হোসেইনের মাথা নিয়ে সিরিয়া যাচ্ছিলাম। প্রতি রাতে আমরা হোসেইনের মাথাকে একটি ট্রাঙ্কে ঢুকিয়ে রাখতাম এবং একে ঘিরে থেকে মদপান করতাম। এক রাতে আমার বন্ধুরা মদপান করলো এবং মাতাল হলো এবং বেহুশ হলো , কিন্তু আমি মদ পান করি নি। যখন রাত্রির এক অংশ পার হয়ে গেলো , আমি একটি বজ্রপাতের শব্দ শুনতে পেলাম এবং বিদ্যুৎ চমকাতে দেখলাম। হঠাৎ আকাশের দরজাগুলো খুলে গেলো এবং নবী আদম (আ.) , নূহ (আ.) , ইবরাহীম (আ.) , ইসমাইল (আ.) , ইসহাক্ব (আ.) এবং আমাদের রাসূল মুহাম্মাদ (সা.) , সাথে জিবরাঈল এবং অন্যান্য ফেরেশতারা , নেমে এলেন। জিবরাঈল ট্রাঙ্কের কাছে এলেন এবং পবিত্র মাথাটি তা থেকে তুলে জড়িয়ে ধরলেন এবং চুমু দিতে লাগলেন। এরপর প্রত্যেক নবী তাকে অনুসরণ করে একই কাজ করলেন যতক্ষণ পর্যন্ত না তা শেষ নবী (সা.)-এর কাছে পৌঁছালো। রাসূলুল্লাহ কাঁদতে শুরু করলেন এবং অন্য নবীরা তাকে সমবেদনা জানাতে লাগলেন। তখন জিবরাঈল বললেন , হে মুহাম্মাদ (সা.) আমি আপনার উম্মত সম্পর্কে আপনার অনুগত। আপনি যদি আমাকে আদেশ করেন আমি তাদের ওপর জমিন উল্টিয়ে দিবো যেভাবে আমি দিয়েছি নবী লূতের (আ.) জাতিকে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন , হে জিবরাঈল , নিশ্চয়ই আল্লাহর সামনে তাদের বিরুদ্ধে হিসাব চাইবো। এরপর ফেরেশতারা আমাদের হত্যা করতে অগ্রসর হলো। আমি বললাম , আশ্রয় দিন , আশ্রয় দিন , হে আল্লাহর রাসূল। আর তিনি (সা.) বললেন , দূর হও , আল্লাহ যেন কখনো তোমাদের ক্ষমা না করেন।