পথ চলার বাতি

পথ চলার বাতি16%

পথ চলার বাতি লেখক:
: মুহাম্মদ ইরফানুল হক
প্রকাশক: ওয়াইজম্যান পাবলিকেশনস
বিভাগ: চরিত্র গঠনমূলক বই

পথ চলার বাতি
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 61 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 13250 / ডাউনলোড: 4508
সাইজ সাইজ সাইজ
পথ চলার বাতি

পথ চলার বাতি

লেখক:
প্রকাশক: ওয়াইজম্যান পাবলিকেশনস
বাংলা

1

পরিচ্ছেদ-২০

ক্ষমা

ক্ষমতা থাকা সত্তেও কাউকে ক্ষমা করে দেয়া হচ্ছে রাসূলদের (আ.) এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাকে যারা ভয় করে তাদের গোপন রহস্য। ক্ষমা হলো তা যখন তুমি তোমার সাথীকে বাহ্যিকভাবে সে যে অন্যায় করেছে তার জন্য তাকে অভিযুক্ত কর না , যখন তুমি সেই কারণকে ভুলে যাও যা ভেতরে কষ্টের সৃষ্টি করেছে এবং যখন তুমি তোমার পছন্দে বিরাট উদারতা প্রদর্শন কর তার উপরে তোমার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও। কেউ ক্ষমায় পৌঁছানোর পথ পায় না শুধু সে ছাড়া যাকে আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ক্ষমা ও মার্জনা করে দিয়েছেন সে যে গুনাহ করেছে তা থেকে এবং যে কাজ সে ফেলে রেখেছিলো তার জন্য এবং যাকে তাঁর সম্মানের পদক দিয়ে সাজানো হয়েছে এবং তাঁর জ্যোতির নূরের পোষাক পরানো হয়েছে।

এটি এজন্য যে ক্ষমা ও মার্জনা আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তায়ালার দু টো গুণাবলী যা তিনি আমানত রেখেছেন তাঁর বিশুদ্ধ বন্ধুদের ভেতরে যেন তারা তাদের সৃষ্টিকর্তা ও নির্মাতা সৃষ্টির সাথে যেমন আচরণ করেন সেরূপ আচরণ অবলম্বন করে। এজন্য তিনি বলেছেনঃ

) و َلْيَعْفُوا وَلْيَصْفَحُوا أَلَا تُحِبُّونَ أَن يَغْفِرَ اللَّـهُ لَكُمْ وَاللَّـهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ(

‘‘ তাদের উচিত ক্ষমা করা ও উপেক্ষা করা। তোমরা কি চাও না যে আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন ? আর আল্লাহ ক্ষমাশীল , করুণাময়। (সূরা নূরঃ ২২)

যদি তুমি তোমার মত একজন মরণশীলকে ক্ষমা না কর তাহলে তুমি কীভাবে সর্ববাধ্যকারী বাদশাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা আশা কর ?

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন যে , তার রব তাকে আদেশ করেছেন এ গুণগুলো ধারণ করতে এই বলেঃ‘‘ তার সাথে একতাবদ্ধ হও যে তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং তাকে ক্ষমা করো যে তোমার প্রতি অন্যায় করে ; তাকে দান কর যে তোমাকে বঞ্চিত করে এবং তার প্রতি ভালো ব্যবহার করো যে তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে।’’ তিনি আমাদেরকে আদেশ করেছেন তাকে অনুসরণ করার জন্য। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেনঃ

) و َمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانتَهُوا(

‘‘ রাসূল তোমাদের যা দেয় , তা গ্রহণ করো এবং যা তিনি তোমাদের নিষেধ করেন তা থেকে সরে থাকো।’’ (সূরা হাশরঃ ৭)

ক্ষমা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার একটি গোপন রহস্য যা তাঁর বাছাইকৃত ব্যক্তিদের অন্তরে আছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ‘‘ তোমাদের মধ্যে কেউ কি আবু দামদাম-এর মত ক্ষমতা রাখো ?’’ - তারা বললোঃ‘‘ হে আল্লাহর রাসূল- আবু দামদাম কে ?’’ রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেনঃ‘‘ তোমাদের একজন পূর্বপুরুষ যে সকালে ঘুম থেকে জেগে বলতোঃ হে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা , সাধারণ জনগণ কর্তৃক আমার সম্মানহানি করাকে আমি ক্ষমা করে দিয়েছি।’’

সতর্ক করা

সর্তক করার সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি হলো যখন কথা সত্যের সীমানা অতিক্রম না করে এবং কাজসমূহ আন্তরিকতার সীমানা অতিক্রম না করে। সতর্ককারী ও যাকে সতর্ক করা হচ্ছে তারা একজন জাগ্রত ও অন্যজন ঘুমন্ত ব্যক্তির মত। যে ব্যক্তি তার কথা অগ্রাহ্য করা , বিরোধিতা ও বিদ্রোহের ঘুম থেকে জেগে উঠে অন্যদের সেই ঘুম থেকে জাগায় সে ভালো কাজ করে।

যে ব্যক্তি সীমালংঘনের মরুভূমিতে ভ্রমণ করে এবং নিজেকে নিমজ্জিত করে বিভ্রান্তির বন্যতায় , তার মার্জিত স্বভাব ত্যাগ করে সুনাম , লোক দেখানো ও বিখ্যাত হওয়ার ভালোবাসায় , যারা সৎকর্মশীলতার পোষাক পরেছে তাদের সময় নষ্ট করে এবং তার বাইরের চেহারা প্রকৃত অবস্থাকে লুকিয়ে রেখেছে- যা তার ভেতরে আছে। বাস্তবে সে ভেতরে শূন্য এবং তার ভেতরের দেউলিয়াত্ব ডুবে গেছে প্রশংসার ভালোবাসায় এবং ঢেকে গেছে লোভের অন্ধকারে । কতই না প্রতারিত সে তার কামনা বাসনার মাধ্যমে। কীভাবেই না সে জনগণকে পথভ্রষ্ট করে তার কথায়! আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেনঃ

) ل َبِئْسَ الْمَوْلَىٰ وَلَبِئْسَ الْعَشِيرُ(

‘‘ নিশ্চয়ই খুব খারাপ এই অভিভাবক এবং নিশ্চয়ই খুব খারাপ এই সাথী।’’ (২২:১৩)

কিন্তু যাকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা রক্ষা করেছেন তাওহীদের আলো , সমর্থন এবং সুন্দর সফলতা দিয়ে , তার অন্তরকে অপবিত্রতা থেকে পরিষ্কার করা হয়েছে। সে নিজেকে ইরফান (আধ্যাত্মিক জ্ঞান) থেকে এবং সতর্কতা অবলম্বন থেকে বিচ্ছিন্ন করে না ; সে পথভ্রষ্ট লোকের কথাগুলো শোনে অথচ বক্তাকে উপেক্ষা করে সে যেই হোক। প্রজ্ঞাবানরা বলেছেনঃ প্রজ্ঞা গ্রহণ করো যদি তা কোন পাগলের মুখ থেকেও আসে। ঈসার (আ.) কথা অনুযায়ীঃ‘‘ তার সাথে বসো যে তোমাকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যখন তুমি তাকে দেখতে পাও ও তার সাক্ষাতে যাও , সে যখন কথা বলে তখন তা সংরক্ষণ কর। সে ব্যক্তির সাথে বসো না যাকে তোমার বাইরের সত্তা গ্রহণ করে কিন্তু ভিতরের সত্তা তাকে প্রত্যাখ্যান করে। সে ঐ ব্যক্তি যে তার দাবী করে যা তার ভেতরে নেই ; যদি তুমি আন্তরিক হও তাহলে তারা তোমার দিকে ঝুঁকবে। যখন তুমি কাউকে এ তিনটি গুণসম্পন্ন দেখবে , তাহলে তাকে দেখার ও তার সাথে সাক্ষাত করার সুযোগ গ্রহণ করো এবং তাদের সাথে বসো , যদি তা শুধু এক ঘন্টার জন্যও হয়। এর একটি প্রভাব পড়বে তোমার বিশ্বাস , তোমার অন্তর এবং তোমার ইবাদাতের উপর তার বরকতে।

যদি কোন ব্যক্তির কথা তার কাজকর্মকে অতিক্রম করে না , যার কাজকর্ম তার সত্যবাদিতাকে অতিক্রম করে না এবং যার সত্যবাদিতা তার রবের সাথে তর্ক করে না , তাহলে তার সাথে শ্রদ্ধার সাথে বসো এবং রহমত ও বরকতের জন্য অপেক্ষা করো। তোমার বিরুদ্ধে প্রমাণের বিষয়ে সাবধান হও এবং তোমার সাথে তার সময়কে প্রীতিকর কর , যাতে তুমি তাকে তিরস্কার না কর এবং ক্ষতিগ্রস্থ না হও। তার প্রতি তাকাও তার উপর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার নেয়ামত ও তাকে তাঁর নির্বাচন করা এবং তাকে তাঁর মর্যাদা দেয়ার দৃষ্টি দিয়ে।

পরামর্শ

সবচেয়ে ভালো পরামর্শ ও সবচেয়ে যা জরুরী তাহলো তুমি যেন তোমার রবকে ভুলে না যাও এবং যেন তুমি তাঁকে সবসময় স্মরণ রাখো এবং তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না কর এবং যেন তুমি তাঁর ইবাদাত কর-হোক দাঁড়িয়ে অথবা বসে। তাঁর নেয়ামত দেখে অন্ধ হয়ে যেও না এবং তার প্রতি সবসময় কৃতজ্ঞ থাকো। তাঁর করুণা , বিশালতা ও নিরাপদ ছাতার নীচ থেকে বেরিয়ে যেও না- এতে হয়তো তুমি পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে এবং ধ্বংসের মাঝে পড়ে যাবে , যদি এমনও হয় যে দুঃখ-কষ্ট ও দুর্দশা তোমাকে স্পর্শ করেছে এবং পরীক্ষার আগুন তোমাকে পুড়ছে। জেনে রাখো , যে দুঃখ-দুর্দশা তিনি পাঠান তা তাঁর চিরস্থায়ী সম্মানের পদক দিয়ে পূর্ণ এবং যে পরীক্ষায় তিনি ফেলেন তা তাঁর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য আনে। এমনও যদি হয় তা কিছু সময় পরে আসে। কী নেয়ামতই না আছে সে ব্যক্তির জন্য যার জ্ঞান আছে এবং যাকে সেখানে সফলতা দান করা হয়েছে।

বর্ণিত আছে যে কেউ একজন রাসূলুল্লাহর (সা.) পরামর্শ চাইলো , তিনি বললেনঃ‘‘ কখনো রাগ হয়ো না , কারণ রাগের ভেতর আছে তোমার রবের বিরোধিতা। ওযর দেখানোতে সাবধান থাকো , কারণ এর ভেতর আছে লুকানো শিরক। নামায পড়ো তার মত যে চিরবিদায় নিচ্ছে , কারণ এর ভেতর আছে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সাথে যোগাযোগ এবং তাঁর নৈকট্য। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সামনে বিনম্র হও যেভাবে তুমি তোমার সৎকর্মশীল প্রতিবেশীদের সামনে বিনম্র হও , কারণ এর ভেতর আছে ইয়াক্বীন-এ বৃদ্ধি ।’’

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাদের [নবী পরিবার (আ.)] দূরবর্তী ও নিকটবর্তী সব পূর্বপুরুষদের উপদেশগুলোকে একক বৈশিষ্ট্যে একত্র করেছেন।

সতর্কতা (তাক্বওয়া)

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার ভাষায়ঃ

) و َلَقَدْ وَصَّيْنَا الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِن قَبْلِكُمْ وَإِيَّاكُمْ أَنِ اتَّقُوا اللَّـهَ(

‘‘ নিশ্চয়ই আমরা তাদের আদেশ দিয়েছি যাদেরকে তোমাদের আগে কিতাব দেয়া হয়েছিলো এবং তোমাদেরও যে , তোমাদের উচিত আল্লাহর প্রতি (তোমাদের দায়িত্বে) সতর্ক হওয়া ।’’ (সূরা নিসাঃ ১৩১)

প্রত্যেক নির্ভুল ইবাদাতের সারাংশ হচ্ছে এটি : তাক্বওয়ার মাধ্যমেই মানুষ উচ্চ স্থান ও সর্বোচ্চ মর্যাদা লাভ করে। তাক্বওয়ার মাধ্যমেই মানুষ একটি ভালো জীবন যাপন করে যেখানে আছে সার্বক্ষণিক সাহচর্য।

) إ ِنَّ الْمُتَّقِينَ فِي جَنَّاتٍ وَنَهَرٍ ﴿٥٤﴾ فِي مَقْعَدِ صِدْقٍ عِندَ مَلِيكٍ مُّقْتَدِرٍ(

‘‘ নিশ্চয়ই যারা পাহারা দেয় (অন্যায়ের বিরুদ্ধে) তারা থাকবে বাগানগুলোতে এবং নদীগুলোতে- সম্মানের আসনে সবচেয়ে শক্তিশালী বাদশাহর সাথে।’’ (সূরা কামারঃ ৫৪-৫৫)

পূর্ণ আস্থা রাখা (তাওয়াক্কুল)

তাওয়াক্কুল একটি পেয়ালা যা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে মুখ সীল করা অবস্থায় আছেঃ কেউ এ থেকে পান করতে পারবে না এবং এর সীল ভাঙ্গতে পারবে না আস্থাশীলরা ছাড়া। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেনঃ

) و َعَلَى اللَّـهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُتَوَكِّلُونَ(

‘‘ আল্লাহর উপরেই শুধু আস্থাশীলরা নির্ভর করুক।’’ (সূরা ইবরাহীমঃ ১২)

) و َعَلَى اللَّهِ فَتَوَكَّلُوا إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ(

‘‘ আল্লাহর উপরেই তোমাদের নির্ভর করা উচিত যদি তোমরা বিশ্বাসী হয়ে থাকো।’’ (সূরা মায়িদাঃ ২৩)

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাওয়াক্কুলকে বিশ্বাসের চাবি বানিয়েছেন এবং বিশ্বাসকে তাওয়াক্কুলের তালা বানিয়েছেন। তাওয়াক্কুলের বাস্তবতা (হাক্বীক্বাত) হলো নিজের উপরে অন্যদের অগ্রাধিকার দেয়া। অন্যদের অগ্রাধিকার দেয়ার মূল হচ্ছে অন্য ব্যক্তির দাবীকে এগিয়ে দেয়া। যে আস্থা রাখে সে তার আস্থাতে দু টো অগ্রাধিকারের একটিকে ক্রমাগতভাবে সত্যায়ন করে যায়। যদি সে সৃষ্টিকে অগ্রাধিকার দেয় তাহলে এটি হয়ে যায় একটি পর্দা যাতে সে ঢেকে যায়। যদি সে আস্থার কারণের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাকে অগ্রাধিকার দেয় তাহলে সে তাঁর সাথে থাকে। যদি তুমি তাওয়াক্কুলের মানুষ হতে চাও এবং সৃষ্টির মানুষ হতে না চাও তাহলে তোমার রুহের উপর পাঁচ বার তাকবীর বলো এবং তোমার সব আশাকে বিদায় জানাও যেভাবে মৃত্যু বিদায় জানায় জীবনকে।

সবচেয়ে নিচের স্তরের তাওয়াক্কুল হলো তোমার অগ্রযাত্রার সামনে তোমার সর্বোচ্চ আশাকে স্থান দেয়া , এ ছাড়া আর কিছু নয়। তোমার না উচিত তোমার অংশ চাওয়া , না দেখার চেষ্টা করা তোমার কীসের অভাব আছে , কারণ এ দু টোর যে কোন একটি তোমার ঈমানের বন্ধনকে ছিঁড়ে ফেলবে আর তুমি তা বুঝতেও পারবে না। যদি তুমি সত্যিকারভাবেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ থাকো যে তাওয়াক্কুলকারীদের একটি পদক নিয়ে বেঁচে থাকবে এ দু টো অগ্রাধিকারের যে কোন একটি বিষয়ে তাঁর উপর তাওয়াক্কুল করার মাধ্যমে তাহলে এ ঘটনাটি দৃঢ়ভাবে ধরে রাখো। বর্ণিত আছে তাওয়াক্কুল সম্পন্ন এক ব্যক্তি ইমামদের (আ.) একজনের কাছে এলো এবং তাকে বললোঃ‘‘ তাওয়াক্কুলের বিষয়ে একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আমার প্রতি দয়া করুন ।’’

ইমাম জানতেন যে ঐ ব্যক্তির ছিলো প্রশংসনীয় তাওয়াক্কুল ও অসাধারণ (তাক্বওয়া) সতর্কতা এবং তিনি ঐ ব্যক্তি প্রশ্ন করার আগেই দেখতে পেয়েছিলেন যে , সে যে প্রশ্ন করছিলো তার বিষয়ে সে আন্তরিক। তিনি বললেন ,‘‘ তুমি যেখানে আছো সেখানেই থাকো এবং আমার সাথে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো।’’ যখন তিনি তার উত্তর সাজাচ্ছিলেন একজন দরিদ্র লোক পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো। ইমাম তার পকেটে হাত দিলেন এবং কিছু বের করলেন এবং দরিদ্র লোকটিকে তা দিলেন। এরপর তিনি প্রশ্নকারীর দিকে ফিরে বললেনঃ‘‘ আসো এবং জিজ্ঞেস করো সে সম্পর্কে যা তুমি দেখেছো।’’ লোকটি বললোঃ হে ইমাম , আমি জানি যে আপনি আমাকে প্রশ্নটির উত্তর দিতে পারতেন আমাকে অপেক্ষা করানোর আগেই। তাহলে কেন আপনি দেরী করলেন ? এবার ইমাম বললেনঃ‘‘ বিশ্বাস হচ্ছে আমি বলার আগেই অর্থের উপর চিন্তা করা। কারণ কীভাবে আমি আমার গভীরতম সত্তার বিষয়ে অবহেলা করতে পারি যখন আমার রব তা দেখতে পান ? আমি কীভাবে তাওয়াক্কুলের বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করতে পারি যখন আমার পকেটে একটি মুদ্রা রয়েছে ? আমার জন্য অনুমতি নেই যে তাওয়াক্কুলের বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করবো যতক্ষণ না আমি তাকে তা (মুদ্রাটি) না দিয়েছি। অতএব বুঝে নাও! প্রশ্নকারী গভীর নিশ্বাস ফেললো এবং শপথ করলো যে যতদিন সে বেঁচে আছে সে কোন বাড়িতে আশ্রয় খুঁজবে না , না মরণশীল কারো উপর নির্ভর করবে ।

পরিচ্ছেদ-২১

ভাইদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন

বিশ্বাসে যারা ভাই তারা করমর্দন করে তাদের প্রতি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার ভালোবাসার কারণে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ‘‘ যখনই ভাইরা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার পথে করমর্দন করে তাদের ভুল কাজগুলো দূর হয়ে যায় এবং এতে তারা সেদিনের মত হয়ে যায় যে দিন তাদের মা তাদেরকে জন্ম দিয়েছিলো।’’ যখন দুই ভাইয়ের পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা বৃদ্ধি পায় তখন তাদের জন্যও তার বৃদ্ধি ঘটে। দুজনের মধ্যে যার আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার ধর্ম সম্পর্কে বেশী জ্ঞান আছে তার জন্য বাধ্যতামূলক যে সে তার বন্ধুকে উৎসাহিত করবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা যে বাধ্যতামূলক কাজগুলোকে প্রয়োজনীয় করেছেন তা সম্পাদন করতে এবং তাকে পথ দেখাবে সোজা পথে যাওয়ার জন্য , সস্তুষ্টি ও মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে , তাকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার রহমতের সুসংবাদ দিবে এবং তাঁর শাস্তির ভয় দেখাবে। অন্য ভাইটি তার পথ দেখানোর রহমতকে চাইবে এবং তা সে দৃঢ়ভাবে ধরে রাখবে যার দিকে সে ডাকছে , তার সতর্কবাণী মনে রাখবে এবং তার মাধ্যমে পথ দেখবে এবং এই পুরো সময়ে সে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে নিরাপত্তা চাইবে এবং তাঁর সাহায্য ও সফলতা চাইবে।

ঈসা (আ.)-কে একবার জিজ্ঞেস করা হলোঃ‘‘ আজ সকালে আপনি কেমন আছেন ?’’ তিনি বললেনঃ আমি যা আশা করি তার কল্যাণ আমার আয়ত্তে নেই , না আমি প্রতিরোধ করতে পারি তাকে যার বিরুদ্ধে আমি সতর্ক পাহারায় আছি। একই সময়ে আমাকে আদেশ করা হয়েছে অনুগত হয়ে চলতে এবং নিষেধ করা হয়েছে বিদ্রোহ করতে। আমি মনে করি না আমার চাইতে বেশী ফক্বির কোন ফক্বির আছে। উয়ায়েস আল-ক্বারানিকে একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো , সে বলেছিলোঃ‘‘ ঐ লোক সকালে কেমন থাকবে যখন সে জানে না সে সন্ধ্যায় বেঁচে থাকবে কিনা এবং সন্ধ্যায় সে জানে না সকাল পর্যন্ত সে বেঁচে থাকবে কিনা ?’’

আবু যার বলেছিলোঃ‘‘ সকালে আমি ধন্যবাদ দেই আমার রবকে এবং ধন্যবাদ দেই আমাকে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ‘‘ যে সকালে ঘুম থেকে ওঠে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাকে ছাড়া অন্য কিছুর আশা করে সে ক্ষতিগ্রস্থ ও সীমালংঘনকারীদের অন্তর্ভূক্ত হয়েছে।

সংগ্রাম ও শৃঙ্খলা

প্রশান্তি সেই বান্দাহর অধিকারে যে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার জন্য সংগ্রাম করে তার নিজের প্রকৃতি ও কামনা-বাসনার বিরুদ্ধে : যে তার কামনা-বাসনাকে পরাজিত করে সে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সন্তুষ্টি জিতে নেয় এবং আল্লাহর দাসত্বে যার বুদ্ধি তার নিজের সত্তাকে পিছনে ফেলে দেয় চেষ্টা , সংগ্রাম , আত্মসমর্পণ এবং বিনয়ের মাধ্যমে সে এক বিরাট বিজয় অর্জন করেছে। বান্দাহ ও আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার মাঝে নফস ও কামনা-বাসনার চেয়ে বেশী অন্ধকার অথবা এর চেয়ে বেশী নির্জন কোন পর্দা নেই। এগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ও তাদেরকে ধ্বংস করার জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার পূর্ণ প্রয়োজন অনুভব করা , ভয় , ক্ষুধা , দিনের বেলা পিপাসা এবং রাতের বেলায় জেগে থাকার চাইতে ভালো আর কোন অস্ত্র নেই।

যখন এ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন কোন ব্যক্তি মারা যায় সে মৃত্যুবরণ করে শহীদের মর্যাদা নিয়ে। যদি সে সোজা পথ অনুযায়ী চলে তাহলে তার শেষ তাকে নিয়ে যাবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সর্বোচ্চ সন্তুষ্টির কাছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেনঃ

) و َالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا وَإِنَّ اللَّـهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِينَ(

‘‘ আর যারা আমাদের জন্য কঠিন সংগ্রাম করে , আমরা অতি অবশ্যই তাদেরকে পথ দেখাবো আমাদের পথে এবং অতি অবশ্যই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সাথে আছেন।’’ (সূরা আনকাবুতঃ ৬৯)

যখন তুমি দেখ অন্য কেউ তোমার চেয়ে বেশী চেষ্টা করছে তখন নিজেকে তিরস্কার করো ও বকা দাও নিজেকে উৎসাহিত করার জন্য-আরো বেশী চেষ্টা করতে।

আদেশ ও নিষেধের লাগাম পরাও নিজের সত্তাকে এবং এমনভাবে কাজ চালিয়ে যাও যেন তুমি একজন প্রশিক্ষক যে তার ঘোড়াকে একটি পদক্ষেপও নিতে দেয় না যদি তা পুরোপুরি সঠিক না হয়।

রাসূলুল্লাহ (সা.) এত লম্বা সময় ধরে নামায পড়তেন যে তার পা দু টো ফুলে যেতো। তিনি বলতেনঃ আমি কীভাবে একজন কৃতজ্ঞ বান্দাহ না হই ? রাসূলুল্লাহ (সা.) চেয়েছিলেন যেন তার সম্প্রদায় তা বিবেচনা করে। যাতে তারা সংগ্রাম , পরিশ্রম ও শৃঙ্খলাকে কোন অবস্থাতেই উপেক্ষা না করে। যদি তোমার আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার ইবাদাতের মিষ্টি স্বাদ পাওয়ার অভিজ্ঞতা হতো , বরকত দেখতে পেতে এবং এর আলোতে আলোকিত হতে তাহলে তুমি এর অনুপস্থিতিতে এক ঘন্টার জন্যও ধৈর্য ধরতে না , এমনকি তোমাকে কেটে টুকরো করে ফেললেও না। কেউ এ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় না যদি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছ থেকে এরকম নিরাপত্তা ও সফলতা থেকে কাউকে প্রত্যাখ্যান করা না হয় যা অর্জন করেছিলো তার পূর্বপুরুষেরা ।

রাবি ইবনে কুসাইমকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো কেন সে রাতে ঘুমাতো না। সে উত্তর দিয়েছিলোঃ‘‘ কারণ আমি ভয় পাই যে রাতটি হয়তো আমি ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিবো।’’

মৃত্যু নিয়ে ভাবা

মৃত্যুকে নিয়ে ভাবলে তা আশা আকাঙ্ক্ষাকে হত্যা করে , কথা গ্রাহ্য না করার শিকড়কে কেটে ফেলে এবং অন্তর শক্তিশালী হয় আখেরাতের জীবন সম্পর্কে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার প্রতিশ্রুতিতে।

এটি প্রকৃতিকে পরিশুদ্ধ করে এবং কামনা-বাসনার চিহ্নগুলো ভেঙ্গে ফেলে , লোভের আগুনকে নিভিয়ে ফেলে এবং পৃথিবীকে ঘৃণ্য বানিয়ে দেয় ; এটিই হলো রাসূলুল্লাহর (সা.) কথার অর্থঃ‘‘ এক ঘন্টার জন্য ভাবা এক বছরের ইবাদাতের চেয়ে উত্তম।’’ ঐ এক ঘন্টার ভাবনা হলো সেই মুহূর্ত যখন তুমি এ পৃথিবীর সাথে তোমাকে বেঁধে রাখা রশিগুলো খুলে ফেলবে এবং সেগুলোকে আখেরাতের সাথে বেঁধে নিবে। যখন মৃত্যুকে এভাবে স্মরণ করা হয় , আকাশ থেকে রহমত বর্ষণ কখনোও বন্ধ হয় না। যদি কোন ব্যক্তি মৃত্যুর বিষয় এবং এ থেকে তার নিজের পালানোর উপায়ের অভাবের বিষয় , তার বিরাট অক্ষমতার বিষয় , কবরে কত লম্বা সময় ধরে সে থাকবে এবং কেয়ামতের সময় তার কিংকর্তব্যবিমূঢ়তার বিষয় না ভাবে তাহলে তার ভেতরে ভালো কিছু নেই।

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ‘‘ আনন্দ ফুর্তির ধ্বংসকারীকে স্মরণ রেখো।’’ যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হলো সেটি কী , তিনি বললেনঃ‘‘ মৃত্যু। যখনই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কোন বান্দাহ তা করে যখন সে ধনী তখন এ পৃথিবী তার জন্য সংকীর্ণ হয়ে যায়। যখন সে একে স্মরণ করে কষ্টের সময় তখন তা তার জন্য প্রশস্ত হয়ে যায়।’’ মৃত্যু হলো পরবর্তী পৃথিবীর প্রথম ষ্টেশন এবং এ পৃথিবীর শেষ ষ্টেশন। রহমতপ্রাপ্ত সে যে নিজের প্রতি উদারতা দেখায় এবং উপকার লাভ করে শুরুতে এবং রহমতপ্রাপ্ত সে যে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে শেষে।

আদম সন্তানের সবচেয়ে নিকট সাথী হলো মৃত্যু। যদিও সে স্বপ্ন দেখে যে তা সবচেয়ে দূরে । মানুষ নিজেকে কতই না আঘাত করে। এর চেয়ে দূর্বল আর কোন প্রাণী আছে ? মৃত্যুতেই নিহিত আছে মুখলেস (আন্তরিক) লোকদের উদ্ধার এবং অন্যায়কারীদের ধ্বংস।

এজন্যই কিছু মানুষ মৃত্যুকে চায় যখন অন্যরা একে ঘৃণা করে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ‘‘ যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সাথে সাক্ষাত করে তাহলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তার সাথে সাক্ষাত করতে ভালোবাসেন এবং যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সাথে সাক্ষাত করাকে ঘৃণা করে তাহলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তার সাথে সাক্ষাত করাকে ঘৃণা করেন।’’

ভালো ধারণা

ভালো ধারণার শিকড় হলো ব্যক্তির বিশ্বাস ও তার অন্তরের সুস্থতা ; ভালো ধারণার চিহ্ন হলো যখনই সে তাকায় সে পবিত্রতা ও ধার্মিকতার দৃষ্টি দিয়ে দেখে যেখানেই সে যায় এবং মধ্যপন্থা , বিশ্বস্ততা , নিরাপত্তা ও সত্যবাদিতা তার অন্তরে স্থাপন করা হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ‘‘ তোমার ভাইদের সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখো। এর মাধ্যমে তুমি অন্তরের পবিত্রতা ও প্রকৃতিতে দৃঢ়তা লাভ করবে।’’ উবাই ইবনে কা ব বলেছিলোঃ যখন তুমি তোমার ভাইদের ভেতর কোন গুণকে পছন্দ না কর তাহলে এর সত্তরটি ব্যাখ্যা দাও এবং দেখো যে এর কোন একটির সাথে তোমার অন্তর শান্তি পায় কিনা। যদি তা না হয় তাহলে নিজেকে দোষারোপ করো যদি তাকে মার্জনা করতে না পারো। যদি তোমার কোন গুণ থাকে যার সত্তরটি ব্যাখ্যা আছে তাহলে তোমার উচিত তাকে অপছন্দ করার চাইতে তোমার নিজেকে আরও বেশী অপছন্দ করা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা দাউদ (আ.)-কে বলেছিলেনঃ আমার বান্দাহদের স্মরণ করিয়ে দাও আমার রহমত ও নেয়ামতগুলো সম্পর্কে। তারা শুধু বিশেষ ভালো জিনিসগুলোই আমার কাছ থেকে দেখতে পেয়েছে তাই তাদের উচিত শুধু তাই আশা করা যে , যা বাকী রয়ে গেছে তা ইতোমধ্যেই তারা যা পেয়েছে তারই মত হবে।’’ ভালো ধারণা ভালো ইবাদাত এনে দেয়। যে ব্যক্তি ধোঁকায় পড়েছে সে বিদ্রোহের ভিতর পড়ে থাকে যদিও সে ক্ষমার আশা করে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সৃষ্টির প্রতি ভালো ধারণা রাখা তাদের জন্য বিশেষভাবে রাখা হয়েছে যারা তাঁকে মানে , তাঁর পুরস্কার আশা করে এবং তাঁর শাস্তিকে ভয় পায়।

রাসূলুল্লাহ (সা.) তার রবের কাছ থেকে বর্ণনা করেছেনঃ‘‘ আমি আছি আমার বান্দাহদের ভালো ধারণার সাথে , হে মুহাম্মাদ , যে তার রবের সম্পর্কে ভালো ধারণার নেয়ামতগুলোর বাস্তবতা মেনে চলতে ব্যর্থ হয় সে তার নিজের বিরুদ্ধে প্রমাণ জোরদার করেছে এবং সে তাদের একজন যারা তাদের কামনা-বাসনার শিকলে প্রতারিত হয়েছে।’’

সত্যবাদিতা

সত্যবাদিতা একটি নূর যা এর পৃথিবীতে বাস্তবে আলো বিকিরণ করেঃ এটি সূর্যের মত , যার বাস্তবতা থেকে সবকিছু আলো খোঁজে , এ বাস্তবতায় কোন হ্রাস পাওয়া ছাড়াই। প্রকৃতপক্ষে একজন সত্যবাদী ব্যক্তি প্রত্যেক মিথ্যাবাদীকে বিশ্বাস করে তার সত্যবাদিতার বাস্তবতার কারণে। এর অর্থ হলো সত্যবাদিতার বিরোধী কোন কিছু-এমনকি যা সত্যবাদিতা নয় তাও এর সাথে একই জায়গায় বাস করতে অনুমোদিত , যা আদমের ক্ষেত্রে ঘটেছিলো- সে ইবলিসকে বিশ্বাস করেছিলো যখন সে মিথ্যা বলেছিলো। ইবলিস মিথ্যা শপথ করেছিলো আর আদমের ভিতরে কোন মিথ্যা কথা ছিলো না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেনঃ

) ف َنَسِيَ وَلَمْ نَجِدْ لَهُ عَزْمًا(

‘‘ আমরা তার ভিতরে দৃঢ়তা পাই নি।’’ (সূরা ত্বোয়া-হাঃ 115)

কারণ ইবলিস এমন কিছু আবিষ্কার করেছিলো যা আগে জানা ছিলো না , প্রকাশ্যেও এবং গোপনেও। ইবলিসকে হাজির করা হবে তার মিথ্যার সাথে এবং সে কখনোই আদমের সত্যবাদিতা থেকে লাভবান হবে না। অথচ তা থেকে আদম লাভবান হয়েছে , যে ইবলিসের মিথ্যা কথা বিশ্বাস করেছিলো যেভাবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সাক্ষ্য দিয়েছেন তার জন্য যখন তিনি বলেছেন যে সে (আদম) অনড় থাকতে পারে নি সে বিষয়ে যা তার আচরণের বিপরীত ছিলো। তা প্রকৃতপক্ষে এটিই বুঝায় যে তার নির্বাচিত হওয়া শয়তানের মিথ্যাতে হারিয়ে যায় নি।

সত্যবাদিতা হচ্ছে সত্যবাদীর বৈশিষ্ট্য। সত্যবাদিতার বাস্তবতা দাবী করে যে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাঁর বান্দাহকে পবিত্র করবেন যে রকম তিনি ঈসার (আ.) সত্যবাদিতা সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন- যা ঘটবে বিচার দিনে।

তিনি তা ইঙ্গিত করেছেন মুহাম্মাদ (সা.)-এর সম্প্রদায়ের সত্যবাদী লোকদের নির্দোষিতা উল্লেখ করেঃ

) ه َـٰذَا يَوْمُ يَنفَعُ الصَّادِقِينَ صِدْقُهُمْ(

‘‘ আজ সেইদিন যেদিন সত্যবাদীদের জন্য তাদের সত্য লাভ বয়ে আনবে।’’ (সূরা মায়িদাঃ 119)

আমিরুল মুমিনীন বলেছেনঃ‘‘ সত্যবাদীতা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার একটি তরবারী- তাঁর আকাশে ও পৃথিবীতে ; প্রত্যেক জিনিসকে তা কেটে ফেলে যা তা স্পর্শ করে।’’ তুমি যদি জানতে চাও তুমি সত্যবাদী না মিথ্যাবাদী , তাহলে তুমি সত্যবাদিতা বলতে যা বুঝাও ও এ জন্য তোমার দাবীর সবকিছুর দিকে তাকাও। এরপর এ দুটোকে ওজন করো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছ থেকে একটি পাল্লাতে , যেন এমন যে তুমি হাশরের দিনে উপস্থিত আছো। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেনঃ

) و َالْوَزْنُ يَوْمَئِذٍ الْحَقُّ(

‘‘ এবং সে দিনের মাপ হবে নিখুঁত।’’ (সূরা আরাফঃ 8)

তুমি যা বুঝাতে চাও তাতে যদি সাম্য ও যথার্থতা থাকে তাহলে তোমার দাবী সফল এবং তোমার সত্যবাদিতা সত্য যখন জিহবা হৃদয়ের সাথে ভিন্নমত রাখে না এবং না হৃদয় জিহবা-এর সাথে ভিন্নমত রাখে। এ বর্ণনায় সত্যবাদী ব্যক্তি হলো সেই ফেরেশতার মত যে তার আত্মাকে বের করে আনে ; যদি আত্মাকে বের করে আনা না হয় তাহলে সে আর কী করবে ?

ইখলাস (বিশুদ্ধ আন্তরিকতা)

প্রত্যেক সম্মানিত কাজের ভিতরে ইখলাস রয়েছে। এটি একটি মনোভাব যা শুরু হয় গ্রহণ (ক্ববুল হওয়া) দিয়ে এবং শেষ হয় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সন্তুষ্টি দিয়ে। অতএব যার কাজ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা গ্রহণ করেন এবং যার উপরে তিনি সন্তুষ্ট সে হচ্ছে মুখলেস ব্যক্তি , তার কাজের পরিমাণ খুব কম হওয়া সত্ত্বেও। যার কাজ গৃহীত হয় না সে মুখলেস নয় , তার কাজের পরিমাণ বেশী হওয়া সত্ত্বেও। যেভাবে আমরা দেখি আদম (আ.) ও ইবলিস (তার উপর লানত)-এর মাঝে কী ঘটেছিলো ।

ক্ববুল হওয়ার নিদর্শন হচ্ছে সত্যবাদিতা এবং সঠিকতার উপস্থিতি- যা আশা করা হয় সবকিছু ব্যয় করার পর , প্রত্যেক নড়াচড়া ও স্থিরতায় সঠিক সচেতনতা বজায় রেখে । তার যা আছে তা ধরে রাখতে মুখলেস ব্যক্তির সত্তা নিয়োজিত থাকে এবং তার জীবন ব্যয় হয় তার যা আছে তা গুছিয়ে নিতে এবং জ্ঞান ও কাজ এবং কর্মী ও কর্মের মধ্যে ঐক্য আনতে। যদি সে তা অর্জন করে থাকে তাহলে সে সব অর্জন করেছে এবং যদি সে তা হারায় তাহলে সে সব হারায় ; এবং তা বাস্তবায়িত হয় শিরকহীনতার (তারযিহ) অর্থকে পবিত্র করার মাধ্যমে। যেমন প্রথম ইমাম বলেছেনঃ‘‘ যারা কাজ করে তারা ধ্বংস হয়ে যাবে তারা ছাড়া যারা ইবাদাত করে ; যারা ইবাদাত করে তারা ধ্বংস হয়ে যাবে তারা ছাড়া যারা জানে ; যারা জানে তারা ধ্বংস হয়ে যাবে তারা ছাড়া যারা সত্যবাদী ; যারা সত্যবাদী তারা ধ্বংস হয়ে যাবে তারা ছাড়া যারা মুখলেস (আন্তরিক) ; যারা মুখলেস তারা ধ্বংস হয়ে যাবে তারা ছাড়া যারা মুত্তাক্বী (সতর্ক) ; যারা মুত্তাক্বী তারা ধ্বংস হয়ে যাবে তারা ছাড়া যারা নিশ্চিত (ইয়াক্বীন) হয়েছে ; এবং যারা নিশ্চিত হয়েছে তারা সুমহান চরিত্রের ; যেমন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেনঃ

) و َاعْبُدْ رَبَّكَ حَتَّىٰ يَأْتِيَكَ الْيَقِينُ(

‘‘ এবং তোমার রবের দাসত্ব করো ঐ পর্যন্ত যখন তোমার ইয়াক্বীন এসে যাবে।’’ (সূরা হিজরঃ 99)

একদম নীচের ইখলাস হলো যখন বান্দাহ নিজের উপর চাপ প্রয়োগ করে যতটুকু তার পক্ষে সম্ভব এবং এরপর সে তার কাজের কোন মূল্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে আছে বলে মনে করে না যার কারণে সে তার রবকে তার কাজের পুরস্কার দিতে বলবে তার জ্ঞান অনুযায়ী , কারণ যদি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাকে দাসত্বের (উবুদিয়াহ) সব দায়িত্ব পালন করতে বলেন তখন সে তা করতে পারবে না। মুখলেস ব্যক্তির সর্বনিম্ন মাক্বাম হলো এ পৃথিবীতে সব অন্যায় কাজ থেকে নিরাপত্তা এবং আগুন থেকে রক্ষা পাওয়া এবং পরবর্তী পৃথিবীতে জান্নাত পাওয়া।

পরিচ্ছেদ-5

তাক্বওয়া ( সতর্কতা )

তাক্বওয়ার তিনটি স্তর আছেঃ

1। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার উপর নির্ভর করে তাক্বওয়া। যার অর্থ হচ্ছে পরস্পরবিরোধী বিষয়গুলো পরিত্যাগ করা এবং সামান্য সন্দেহকেও পরিত্যাগ করা এবং এটিই হচ্ছে তাক্বওয়া যা সর্বোচ্চস্থানীয় ব্যক্তিরা অনুশীলন করে।

2। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার বিষয়ে তাক্বওয়া। যার অর্থ হচ্ছে সব সন্দেহপূর্ণ বিষয় পরিত্যাগ করা এবং নিষিদ্ধকে (হারাম) সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করা , এটি উচ্চ শ্রেণীর লোকদের তাক্বওয়া।

3। আগুন ও শাস্তির বিরুদ্ধে তাক্বওয়া। যার পরিণতিতে হারামকে পরিত্যাগ করা হয়- এটি সাধারণ জনগণের তাক্বওয়া।

তাক্বওয়া হচ্ছে পানির মত যা একটি নদীতে বইছে। তাক্বওয়ার তিনটি স্তর হলো সব রং-এর ও প্রকারের গাছ যা ঐ নদীর তীরে রোপন করা হয়েছে। প্রত্যেক গাছ নদী থেকে পানি শোষণ করে তার মর্ম , ক্ষমতা , তার কোমলতা এবং স্থুলতা অনুযায়ী।

এরপর সেসব গাছ এবং ফল থেকে প্রাণীরা যে উপকারিতা লাভ করে তা তাদের মান ও মূল্য অনুযায়ী। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেনঃ

) و َزَرْعٌ وَنَخِيلٌ صِنْوَانٌ وَغَيْرُ صِنْوَانٍ يُسْقَىٰ بِمَاءٍ وَاحِدٍ وَنُفَضِّلُ بَعْضَهَا عَلَىٰ بَعْضٍ فِي الْأُكُلِ(

‘‘ খেজুর গাছগুলোর একটি শিকড় এবং (অন্যদের) বিভিন্ন শিকড়- তারা একই পানি থেকে সিক্ত হয় এবং তাদের কিছুকে আমরা অন্যগুলোর চাইতে বেশী ফল দান করি।’’ (সূরা রা দঃ 4)

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার আনুগত্যে তাক্বওয়া হচ্ছে গাছগুলোর জন্য পানির মত এবং গাছগুলোর প্রকৃতি এবং তাদের বিভিন্ন রং ও স্বাদের ফলগুলো হচ্ছে বিশ্বাসের মাত্রার মত। যার আছে সর্বোচ্চ মাত্রার বিশ্বাস এবং আত্মায় আছে বিশুদ্ধতম প্রকৃতি তার আছে সর্বোচ্চ তাক্বওয়া। যে ব্যক্তি মুত্তাক্বী তার ইবাদাত হচ্ছে শুদ্ধতর ও বেশী আন্তরিক এবং যে এরকম সে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার নিকটতর।

কিন্তু প্রত্যেক ইবাদাত যা তাক্বওয়া ছাড়া অন্য কিছুর উপরে প্রতিষ্ঠিত তার ফলাফল শূন্য। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেনঃ

) أ َفَمَنْ أَسَّسَ بُنْيَانَهُ عَلَىٰ تَقْوَىٰ مِنَ اللَّـهِ وَرِضْوَانٍ خَيْرٌ أَم مَّنْ أَسَّسَ بُنْيَانَهُ عَلَىٰ شَفَا جُرُفٍ هَارٍ فَانْهَارَ بِهِ فِي نَارِ جَهَنَّمَ(

‘‘ তাই সে কি উত্তম যে তার ভিত্তি স্থাপন করেছে আল্লাহ ভীতি ও তার সন্তুষ্টির উপরে , নাকি সে যে তার ভিত্তি স্থাপন করেছে এক ভঙ্গুর , ফাপাঁ তীরের উপর , এতে তা তাকে নিয়ে ভেঙ্গে পড়েছে জাহান্নামের আগুনের ভিতর ?’’ (সূরা তওবাঃ 109)

তাক্বওয়ার ব্যাখ্যা হচ্ছে ক্ষতিকর কিছু না থাকা সত্ত্বেও কোন বিষয়ে প্রবেশ না করা শুধু এ ভয়ে যে তাতে এরকম কিছু রয়েছে। বাস্তবে তা হলো বিদ্রোহ ছাড়া আনুগত্য , ভুলে যাওয়া ছাড়া স্মরণ , অজ্ঞতা ছাড়া জ্ঞান এবং তা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা গ্রহণ করেন এবং তা প্রত্যাখ্যাত হয় না।

আল্লাহ ভীতি

তোমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও ইন্দ্রিয়গুলোর দরজা বন্ধ করে দাও সেসব জিনিসের উপর যা তোমার অন্তরকে ক্ষতিগ্রস্থ করবে , আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে তোমার খারাপ অবস্থান সরিয়ে ফেলো এবং এর পিছনে আনো কেয়ামতের দিনের শোক ও অনুতাপ এবং যত খারাপ কাজ করেছো তার জন্য লজ্জা। একজন সাবধানী ব্যক্তির অবশ্যই তিনটি নীতি থাকতে হবেঃ সে সব মানুষের ত্রুটি উপেক্ষা করবে , সে তাদেরকে অপমান করা থেকে বিরত থাকবে এবং তার উচিত তিরস্কারের পর প্রশংসা করে সাম্য আনা।

আল্লাহ ভীতির ভিত্তি হচ্ছে সর্বক্ষণ নিজের হিসাব নেওয়া। কথায় সত্যবাদী হওয়া ও লেনদেনে বিশুদ্ধ হওয়া , প্রত্যেক সন্দেহপূর্ণ জিনিস ছেড়ে দেয়া , প্রত্যেক ত্রুটি ও সন্দেহ পরিত্যাগ করা , যা তোমার সাথে সম্পর্কিত নয় সেসব কিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করা এবং সে দরজাগুলো না খোলা যেগুলো তুমি জানবে না কীভাবে বন্ধ করতে হয়।

তার সাথে বসো না যে তোমার কাছে যা স্পষ্ট তা অস্পষ্ট করে তোলে , তার সাথেও নয় যে বিশ্বাসকে হালকা ভাবে নেয়। সে জ্ঞান সম্পর্কে প্রশ্ন করো না যার জন্য তোমার অন্তরের ক্ষমতা নেই এবং যা তুমি বুঝতে পারবে না- তা যেই বলুক এবং তাকে কেটে দাও যে তোমাকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছ থেকে কেটে দেয়।

সামাজিক মেলামেশা

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সৃষ্টির সাথে সামাজিক সৌজন্যমূলক সম্পর্ক রাখার সময় তাঁর অবাধ্য হওয়ার মত সব কাজ এড়িয়ে চলা বান্দাহর উপর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার অতিরিক্ত উদারতার চিহ্ন। যে তার গভীরতম সত্তায় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার প্রতি আন্তরিক ও বিনয়ী তার বাহ্যিক দিকে ভালো সামাজিক মেলামেশা থাকবে।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কারণে লোকজনের সাথে মিশো এবং মেলামেশা করো না শুধু পৃথিবীর বিষয়ে তোমার অংশের জন্য , মর্যাদা লাভের জন্য , লোক দেখানোর জন্য অথবা সুখ্যাতির জন্য। শরিয়তের সীমা রক্ষায় ব্যর্থ হয়ো না সামাজিক মেলামেশার কারণে। যেমনঃ অন্যের সাথে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা অথবা সুখ্যাতি অর্জনের জন্য , কারণ এগুলো তোমার ক্ষতি পূরণ করবে না এবং তুমি আখেরাত হারাবে কোন ফিরতি সুযোগ ছাড়া। তোমার চেয়ে বয়সে বড়দের সাথে এমন আচরণ করো যেমন করতে তোমার বাবার সাথে এবং তোমার চেয়ে বয়সে ছোটদের সাথে তেমন যেমন করতে তোমার সন্তানের সাথে। তোমার সমবয়সীদের সাথে আচরণ করো যেমন করতে ভাইয়ের সাথে। তুমি নিজে যা নিশ্চিত জানো তা বদল করো না ঐ জিনিসের সাথে যা তুমি অন্যের কাছ থেকে শুনেছো এবং যা তুমি সন্দেহ কর। নম্র হও যখন তুমি সৎকাজের আদেশ কর এবং দয়ালু হও যখন তুমি খারাপকে নিষেধ কর। কখনোই কোন পরিস্থিতিতে ভালো উপদেশ পরিত্যাগ করো না। যেমন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেনঃ

) و َقُولُوا لِلنَّاسِ حُسْنًا(

‘‘ মানুষের সাথে ভালো কথা বলো’’ (সূরা বাকারাঃ 83)

সেসব জিনিস থেকে নিজেকে কেটে ফেলো যা তোমাকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার স্মরণ ভুলিয়ে দেয় , যখন লোভ জাগা তোমাকে তাঁর আনুগত্য থেকে অমনোযোগী করে দেয় কারণ তা আসে শয়তানের বন্ধু ও সাহায্যকারীদের কাছ থেকে। তাদেরকে দেখা যেন তোমাকে সত্যের অনুসরণ থেকে সরিয়ে না দেয়। কারণ তা হবে অবশ্যই এক ভয়ানক ক্ষতি। আমরা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি।

ঘুম

মনোযোগী লোকের ঘুম ঘুমাও , উপেক্ষাকারীর ঘুম ঘুমিয়ো না , বুঝদারদের মাঝে মনোযোগীরা ঘুমায় শুধু বিশ্রামের জন্য এবং অলসতার কারণে ইচ্ছা করে ঘুমিয়ো না।

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ‘‘ আমার চোখগুলো ঘুমায় কিন্তু আমার অন্তর ঘুমায় না।’’ যখন তুমি ঘুমের জন্য শোও এ নিয়ত রাখো যে তুমি ফেরেশতাদের উপর তোমার বোঝা লাঘব করবে এবং নফসকে এর ক্ষুধা থেকে বিচ্ছিন্ন করবে এবং ঘুমের মাধ্যমে নিজেকে পরীক্ষা করবে ; এ সত্যকে জেনে রাখো যে তুমি অক্ষম ও দূর্বল। তোমার কোন শক্তি নেই তোমার নড়াচড়া ও স্থিরতার উপর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার হুকুম ও পরিমাণ ছাড়া। মনে রেখো ঘুম হচ্ছে মৃত্যুর ভাই। এটিকে ব্যবহার করো মৃত্যুর দিকে পথ প্রদর্শক হিসেবে , কারণ মৃত্যু থেকে জেগে উঠার কোন পথ নেই অথবা ফিরে এসে তোমার কাজকে শুদ্ধ করা নেই যা তুমি হারিয়েছো। যে ব্যক্তি ওয়াজিব ও নফল নামাজের সময় ঘুমিয়ে পার করে দেয় তার ঘুম হচ্ছে উপেক্ষাকারীদের ঘুম এবং তার পথ হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্থদের পথ ; সে দোষী। যে তার বাধ্যতামূলক ও নফল নামাজের দায়িত্ব সম্পাদন করেছে এবং তার দায়িত্বসমূহ পালন করেছে সে একটি প্রশংসিত ঘুম ঘুমাচ্ছে। আমাদের সময়ে যারা এ গুণাবলী অর্জন করেছে তাদের জন্য ঘুমের চাইতে নিরাপদ আর কিছু আমি জানি না। কারণ লোকেরা তাদের বিশ্বাসকে পাহারা দেয়া এবং তাদের আচরণের যত্ন নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তারা তাদের বাম দিকের পথ ধরেছে। যখন একজন মুখলেস বান্দাহ বেজায়গায় কথা না বলার জন্য সংগ্রাম করে , তখন কীভাবে সে সে কথা শোনা এড়িয়ে যাবে যা তাকে কথা না বলা থেকে বাধা দিবে যদি তার একটি নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকে ? ঘুম হচ্ছে এমন একটি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেনঃ

) إ ِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولَـٰئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولًا(

‘‘ নিশ্চয়ই শ্রবনশক্তি এবং দৃষ্টিশক্তি এবং অন্তর , এসব কিছুকে সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে।’’ (সূরা বনী ইসরাইলঃ 36)

অতিরিক্ত ঘুমের মধ্যে অনেক খারাপ লুকায়িত আছে আমরা যেভাবে উল্লেখ করেছি যদি সেভাবেও হয়। খুব বেশী ঘুম আসে অতিরিক্ত পানে এবং অতিরিক্ত পান আসে অতিরিক্ত তৃপ্তি থেকে। এ দু টোই নফসের উপর ভারী হয়ে দেখা দেয় আনুগত্য করার পথে এবং এগুলো অন্তরকে গভীর ভাবনা এবং বিনয়ী না করে শক্ত করে দেয়।

তোমার ঘুমকে এ পৃথিবীর শেষ বিষয় বানিয়ে ফেলো। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাকে স্মরণ করো তোমার অন্তর ও জিহবা দিয়ে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার প্রতি তোমার আনুগত্য দিয়ে তোমার অন্যায় কাজকে পরাভূত করো এবং তাঁর কাছে সাহায্য চাও যখন তুমি ঘুমাও সকালের নামাজ পর্যন্ত উপাস থেকে। যদি তুমি রাতে জেগে উঠো , শয়তান তোমার কানে ফিসফিস করে বলেঃ‘‘ আবার ঘুমাও , এখনও তোমার জন্য লম্বা রাত রয়েছে ,’’ কারণ সে চায় তুমি নিবিড় আত্ম পর্যালোচনা এবং তোমার রবের সামনে তোমার অবস্থা তুলে ধরা হারাও। মনোযোগ হারিয়ো না সকালে ক্ষমা চাইতে , কারণ সে সময় প্রার্থনায় মগ্নদের মাঝে দেখা দেয় আল্লাহকে পাওয়ার অনেক আকাঙ্ক্ষা।

পরিচ্ছেদ-6

হজ্ব

যদি তুমি হজ্বে যেতে চাও , তাহলে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তোমার অন্তরকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার প্রতি নিবদ্ধ কর একে বিচ্ছিন্ন করে এবং তোমার ও আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার মাঝে প্রত্যেক বাধা থেকে একে মুক্ত করে। তোমার সৃষ্টিকর্তার উপরে তোমার সব বিষয় ছেড়ে দাও , তাঁর উপর নির্ভর করো তোমার প্রত্যেক কর্মে ও স্থিরতার প্রত্যেক মুহূর্তে , আত্মসমর্পন করো তাঁর আদেশ , সিন্ধান্ত এবং রায়ের কাছে। পরিত্যাগ করো এ পৃথিবীকে , বিশ্রামকে এবং এবং সব সৃষ্টিকে। সেসব দায়িত্ব পালন করো যেগুলো তুমি অন্য লোকদের জন্য পালন করতে দায়বদ্ধ। নির্ভর করো না তোমার রিয্ক্বের উপর , যে পশুর উপর তুমি আরোহন কর , তোমার সাথীদের উপর না তোমার খাদ্য এবং তোমার যৌবন ও না তোমার সম্পদের উপর। কারণ ভয় করো যে এগুলো তোমার শত্রু হয়ে যাবে এবং তোমার জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াবে। এভাবে তুমি বুঝতে পারবে যে কোন ক্ষমতা ও কোন শক্তি নেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার অভিভাবকত্ব ও তাঁর পক্ষ থেকে সফলতা দান করা ছাড়া।

হজ্বের জন্য প্রস্তুতি নাও সে ব্যক্তির মত যে ফেরত আসবে আশা করে না। ভালো লোকদের সাথী হও এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার ও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি তোমার সব দায়িত্ব পালনে পরিশ্রমী হও। যত্নবান হও সৌজন্য দেখানোতে , অধ্যাবসায়তে , ধৈর্য ধরাতে , কৃতজ্ঞতা স্বীকারে , দয়া করাতে এবং উদারতায় সব সময় অন্যকে নিজের আগে রেখে , তাদেরকেও যারা তোমাকে প্রত্যাখ্যান করে। এরপর অযু কর আন্তরিক তওবার পানি দিয়ে অন্যায় কাজের কারণে। পোষাক পড় সত্যবাদিতার , পবিত্রতার , বিনয়ের এবং ভয়ের। হজ্বের পোষাক পড়ে নিজেকে বিরত রাখো প্রত্যেক জিনিস থেকে যা তোমাকে বাধা দেয় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার স্মরণে। নয়তো তা তোমাকে বাধা দিবে তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশে।

তাঁর আহবানে সাড়া দাও এক উত্তর দিয়ে যার অর্থ স্পষ্ট , বিশুদ্ধ এবং আন্তরিক। যখন তুমি তাঁকে ডাকো , তাঁর প্রতি তোমার বিশ্বাসকে দৃঢ়ভাবে ধরে রাখো। তাওয়াফ কর তোমার অন্তর দিয়ে ফেরেশতাদের সাথে যারা আরশকে তাওয়াফ করে যেভাবে তুমি তাওয়াফ কর মুসলিমদের সাথে যারা কাবাকে প্রদক্ষিণ করে। দ্রুত এগিয়ে যাও যখন তুমি দৌড় দাও ভয়ে , তোমার কামনা বাসনা থেকে , শক্তি ও ক্ষমতা সম্পর্কে ব্যক্তিগত সব অনুমান থেকে নিজেকে মুক্ত করে। যখন তুমি মিনাতে যাও পিছনে ফেলে যাও কথা গ্রাহ্য না করার স্বভাবকে এবং ভুলগুলোকে। তা চেও না যা তোমার জন্য হারাম এবং যা পাওয়ার যোগ্য তুমি নও। তোমার দোষগুলো স্বীকার করো আরাফাতে , আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সাথে তোমার চুক্তি মেলে ধর , তাঁর তাওহীদের শপথের মাধ্যমে তাঁর নিকটবর্তী হও ও তাঁকে ভয় করো মুযদালিফাতে। তোমার আত্মা নিয়ে সর্বোচ্চ সমাবেশে আরোহন করো যখন তুমি আরাফাতের পর্বতে আরোহন করো। কামনা বাসনা ও লোভের গলাকে কেটে ফেলো কোরবানীতে। পাথর মারো তোমার ক্ষুধাকে , হীন অবস্থাকে , অশ্লীলতাকে এবং দোষনীয় কাজগুলোকে যখন তুমি আক্বাবাহর স্তম্ভকে পাথর ছুঁড়ে মারো। তোমার বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ দোষগুলোকে কামিয়ে ফেলো যখন তুমি তোমার মাথা কামাও এবং প্রবেশ করো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার নিরাপত্তা বেষ্টনীতে তাঁর আশ্রয়ে তাঁর চাদরের ভিতরে , তাঁর নিরাপত্তার ঘরে এবং তাঁর সতর্ক পাহারার ভিতরে এবং তোমার আশা আকাঙ্ক্ষার পিছনে ছোটা পরিত্যাগ করো তার পবিত্র দরবারে প্রবেশ করে। বায়তুল্লাহয় যাও এবং এর চারদিকে হাঁটো এর মালিক ও তাঁর প্রজ্ঞাকে , তাঁর মর্যাদাকে ও তাঁর শক্তিকে প্রশংসা করে। পাথরকে (হাযরে আসওয়াদ) জড়িয়ে ধরো তাঁর সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট থেকে এবং তাঁর শক্তির সামনে বিনীত হও। তাঁকে ছাড়া সবকিছু পরিত্যাগ করো বিদায়ী তাওয়াফে। তোমার আত্মা ও তোমার অভ্যন্তরীণ সত্তাকে পবিত্র করো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সাথে মোলাকাতের জন্য , যেদিন তুমি তাঁর মোলাকাত লাভ করবে সাফা -তে দাঁড়িয়ে।

মারওয়াহতে নিজের গুণাবলী নিশ্চিহ্ন করে আল্লাহর কাছ থেকে সাহস ও সৌজন্য গ্রহণ করো । তোমার হজ্বের অবস্থাগুলোতে সামঞ্জস্য বজায় রাখো এবং তোমার রবের সাথে যে চুক্তি তুমি করেছো তা পূরণ করো , যার জন্য তুমি বিচার দিনে তাঁর কাছে দায়বদ্ধ। জেনে রাখো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা হজ্বকে বাধ্যতামূলক করেছেন এবং তিনি তাঁর বিষয়ে অন্য সব ইবাদাত থেকে এটিকে বাছাই করেছেন যখন তিনি বলেছেনঃ

) و َلِلَّـهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلًا(

‘‘ আল্লাহর জন্য আল্লাহর ঘরে হজ্ব মানব জাতির উপর বাধ্যতামূলক এবং প্রত্যেকের উপরে যারা সেখানে যেতে সক্ষম।’’ (সূরা আলে ইমরানঃ 97)

রাসূলুল্লাহ (সা.) হজ্বের আনুষ্ঠানিক কর্মকান্ডগুলোকে সাজিয়েছেন মৃত্যু , কবর , পুনরুত্থান এবং বিচার দিনের প্রস্তুতি ও ইঙ্গিত হিসেবে। মানবজাতির জন্য এ শিক্ষায় তিনি তাদের মধ্যে পার্থক্য করেছেন কারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং কারা আগুনে প্রবেশ করবে , শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত হজ্বের আনুষ্ঠানিক কর্মকান্ডগুলিকে সাজিয়ে যাদের বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা আছে তাদেরকে দেখিয়ে ।

যাকাত

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য বাধ্যতামূলক দান (যাকাত) তোমার শরীরের প্রত্যেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে প্রাপ্য। এমনকি তোমার প্রত্যেক চুলের গোড়া থেকেও। প্রকৃতপক্ষে তোমার জীবনের প্রত্যেক মুহূর্তে যাকাত বাধ্যতামূলক। চোখের যাকাত হলো সহানুভুতিসহ দৃষ্টিপাত এবং কামনা-বাসনার দৃষ্টি ও এ ধরনের জিনিস থেকে চোখকে সরিয়ে রাখা। কানের যাকাত হলো সবচেয়ে ভালো শব্দ শোনা। যেমন প্রজ্ঞা , কোরআন , বিশ্বাসের জন্য লাভজনক বিষয়গুলো , যেমন , সতর্কবানী এবং এর বিপরীতগুলো এড়িয়ে চলা যেমন- মিথ্যা , অপবাদ এবং এরকম জিনিস।

জিহবার যাকাত হলো মুসলমানদের সৎ উপদেশ দেয়া , যারা উদাসীন তাদেরকে জাগ্রত করা , অনেক তাসবীহ এবং যিকর করা এবং এরকম অন্যান্য জিনিস।

হাতের যাকাত হলো অন্যের জন্য টাকা-পয়সা খরচ করা , তোমাকে দেয়া আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার নেয়ামতগুলোর বিষয়ে উদার হওয়া , জ্ঞান ও তথ্য লিখে রাখাতে তা ব্যবহার করা যার মাধ্যমে অন্য মুসলমানেরা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার আনুগত্যে লাভবান হবে এবং একে খারাপ থেকে নিয়ন্ত্রণ করা। পায়ের যাকাত হলো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার প্রতি দায়িত্ব পালনে দ্রুত যাওয়া-যেমন , ধার্মিক লোকদের সাক্ষাতে যাওয়া , যিকর-এর সমাবেশে যাওয়া , লোকজনের মাঝে সম্পর্ক ঠিক করে দেয়া , আত্মীয়তার বন্ধন বজায় রাখা , জিহাদে নিয়োজিত হওয়া এবং এমন জিনিস করা যা তোমার অন্তরকে সুস্থ এবং তোমার বিশ্বাসকে শুদ্ধ করবে।

আমরা এখানে কিছু যাকাত-এর পথ উল্লেখ করেছি , যেগুলো অন্তর বুঝতে পারে এবং সত্তা তা সম্পাদন করতে পারে। যদিও আরো অনেক আছে উল্লেখ করার মত যেগুলো আয়ত্বে আনতে পারে শুধু তাঁর মুখলেস ও অত্যন্ত নিকট বান্দাহরা। নিশ্চয়ই তারা যাকাতের নেতা এবং তাদেরই আছে এ মর্যাদার চিহ্ন। হে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাকে সে জিনিসে সফলতা দিন যা আপনি ভালোবাসেন এবং যাতে আপনি সন্তুষ্ট হন।


4

5

6

7

8

9

10

11

12