সতর্ক করা
সর্তক করার সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি হলো যখন কথা সত্যের সীমানা অতিক্রম না করে এবং কাজসমূহ আন্তরিকতার সীমানা অতিক্রম না করে। সতর্ককারী ও যাকে সতর্ক করা হচ্ছে তারা একজন জাগ্রত ও অন্যজন ঘুমন্ত ব্যক্তির মত। যে ব্যক্তি তার কথা অগ্রাহ্য করা , বিরোধিতা ও বিদ্রোহের ঘুম থেকে জেগে উঠে অন্যদের সেই ঘুম থেকে জাগায় সে ভালো কাজ করে।
যে ব্যক্তি সীমালংঘনের মরুভূমিতে ভ্রমণ করে এবং নিজেকে নিমজ্জিত করে বিভ্রান্তির বন্যতায় , তার মার্জিত স্বভাব ত্যাগ করে সুনাম , লোক দেখানো ও বিখ্যাত হওয়ার ভালোবাসায় , যারা সৎকর্মশীলতার পোষাক পরেছে তাদের সময় নষ্ট করে এবং তার বাইরের চেহারা প্রকৃত অবস্থাকে লুকিয়ে রেখেছে- যা তার ভেতরে আছে। বাস্তবে সে ভেতরে শূন্য এবং তার ভেতরের দেউলিয়াত্ব ডুবে গেছে প্রশংসার ভালোবাসায় এবং ঢেকে গেছে লোভের অন্ধকারে । কতই না প্রতারিত সে তার কামনা বাসনার মাধ্যমে। কীভাবেই না সে জনগণকে পথভ্রষ্ট করে তার কথায়! আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেনঃ
)
ل
َبِئْسَ الْمَوْلَىٰ وَلَبِئْسَ الْعَشِيرُ(
‘‘
নিশ্চয়ই খুব খারাপ এই অভিভাবক এবং নিশ্চয়ই খুব খারাপ এই সাথী।’’
(22:13)
কিন্তু যাকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা রক্ষা করেছেন তাওহীদের আলো , সমর্থন এবং সুন্দর সফলতা দিয়ে , তার অন্তরকে অপবিত্রতা থেকে পরিষ্কার করা হয়েছে। সে নিজেকে ইরফান (আধ্যাত্মিক জ্ঞান) থেকে এবং সতর্কতা অবলম্বন থেকে বিচ্ছিন্ন করে না ; সে পথভ্রষ্ট লোকের কথাগুলো শোনে অথচ বক্তাকে উপেক্ষা করে–
সে যেই হোক। প্রজ্ঞাবানরা বলেছেনঃ‘
প্রজ্ঞা গ্রহণ করো যদি তা কোন পাগলের মুখ থেকেও আসে।’
ঈসার (আ.) কথা অনুযায়ীঃ‘‘
তার সাথে বসো যে তোমাকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যখন তুমি তাকে দেখতে পাও ও তার সাক্ষাতে যাও , সে যখন কথা বলে তখন তা সংরক্ষণ কর। সে ব্যক্তির সাথে বসো না যাকে তোমার বাইরের সত্তা গ্রহণ করে কিন্তু ভিতরের সত্তা তাকে প্রত্যাখ্যান করে।’
সে ঐ ব্যক্তি যে তার দাবী করে যা তার ভেতরে নেই ; যদি তুমি আন্তরিক হও তাহলে তারা তোমার দিকে ঝুঁকবে। যখন তুমি কাউকে এ তিনটি গুণসম্পন্ন দেখবে , তাহলে তাকে দেখার ও তার সাথে সাক্ষাত করার সুযোগ গ্রহণ করো এবং তাদের সাথে বসো , যদি তা শুধু এক ঘন্টার জন্যও হয়। এর একটি প্রভাব পড়বে তোমার বিশ্বাস , তোমার অন্তর এবং তোমার ইবাদাতের উপর–
তার বরকতে।
যদি কোন ব্যক্তির কথা তার কাজকর্মকে অতিক্রম করে না , যার কাজকর্ম তার সত্যবাদিতাকে অতিক্রম করে না এবং যার সত্যবাদিতা তার রবের সাথে তর্ক করে না , তাহলে তার সাথে শ্রদ্ধার সাথে বসো এবং রহমত ও বরকতের জন্য অপেক্ষা করো। তোমার বিরুদ্ধে প্রমাণের বিষয়ে সাবধান হও এবং তোমার সাথে তার সময়কে প্রীতিকর কর , যাতে তুমি তাকে তিরস্কার না কর এবং ক্ষতিগ্রস্থ না হও। তার প্রতি তাকাও তার উপর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার নেয়ামত ও তাকে তাঁর নির্বাচন করা এবং তাকে তাঁর মর্যাদা দেয়ার দৃষ্টি দিয়ে।
পরামর্শ
সবচেয়ে ভালো পরামর্শ ও সবচেয়ে যা জরুরী তাহলো তুমি যেন তোমার রবকে ভুলে না যাও এবং যেন তুমি তাঁকে সবসময় স্মরণ রাখো এবং তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না কর এবং যেন তুমি তাঁর ইবাদাত কর-হোক দাঁড়িয়ে অথবা বসে। তাঁর নেয়ামত দেখে অন্ধ হয়ে যেও না এবং তার প্রতি সবসময় কৃতজ্ঞ থাকো। তাঁর করুণা , বিশালতা ও নিরাপদ ছাতার নীচ থেকে বেরিয়ে যেও না- এতে হয়তো তুমি পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে এবং ধ্বংসের মাঝে পড়ে যাবে , যদি এমনও হয় যে দুঃখ-কষ্ট ও দুর্দশা তোমাকে স্পর্শ করেছে এবং পরীক্ষার আগুন তোমাকে পুড়ছে। জেনে রাখো , যে দুঃখ-দুর্দশা তিনি পাঠান তা তাঁর চিরস্থায়ী সম্মানের পদক দিয়ে পূর্ণ এবং যে পরীক্ষায় তিনি ফেলেন তা তাঁর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য আনে। এমনও যদি হয় তা কিছু সময় পরে আসে। কী নেয়ামতই না আছে সে ব্যক্তির জন্য যার জ্ঞান আছে এবং যাকে সেখানে সফলতা দান করা হয়েছে।
বর্ণিত আছে যে কেউ একজন রাসূলুল্লাহর (সা.) পরামর্শ চাইলো , তিনি বললেনঃ‘‘
কখনো রাগ হয়ো না , কারণ রাগের ভেতর আছে তোমার রবের বিরোধিতা। ওযর দেখানোতে সাবধান থাকো , কারণ এর ভেতর আছে লুকানো শিরক। নামায পড়ো তার মত যে চিরবিদায় নিচ্ছে , কারণ এর ভেতর আছে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সাথে যোগাযোগ এবং তাঁর নৈকট্য। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সামনে বিনম্র হও যেভাবে তুমি তোমার সৎকর্মশীল প্রতিবেশীদের সামনে বিনম্র হও , কারণ এর ভেতর আছে ইয়াক্বীন-এ বৃদ্ধি ।’’
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাদের [নবী পরিবার (আ.)] দূরবর্তী ও নিকটবর্তী সব পূর্বপুরুষদের উপদেশগুলোকে একক বৈশিষ্ট্যে একত্র করেছেন।
সতর্কতা (তাক্বওয়া)
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার ভাষায়ঃ
)
و
َلَقَدْ وَصَّيْنَا الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِن قَبْلِكُمْ وَإِيَّاكُمْ أَنِ اتَّقُوا اللَّـهَ(
‘‘
নিশ্চয়ই আমরা তাদের আদেশ দিয়েছি–
যাদেরকে তোমাদের আগে কিতাব দেয়া হয়েছিলো এবং তোমাদেরও যে , তোমাদের উচিত আল্লাহর প্রতি (তোমাদের দায়িত্বে) সতর্ক হওয়া ।’’
(সূরা নিসাঃ 131)
প্রত্যেক নির্ভুল ইবাদাতের সারাংশ হচ্ছে এটি : তাক্বওয়ার মাধ্যমেই মানুষ উচ্চ স্থান ও সর্বোচ্চ মর্যাদা লাভ করে। তাক্বওয়ার মাধ্যমেই মানুষ একটি ভালো জীবন যাপন করে যেখানে আছে সার্বক্ষণিক সাহচর্য।
)
إ
ِنَّ الْمُتَّقِينَ فِي جَنَّاتٍ وَنَهَرٍ ﴿٥٤﴾ فِي مَقْعَدِ صِدْقٍ عِندَ مَلِيكٍ مُّقْتَدِرٍ(
‘‘
নিশ্চয়ই যারা পাহারা দেয় (অন্যায়ের বিরুদ্ধে) তারা থাকবে বাগানগুলোতে এবং নদীগুলোতে- সম্মানের আসনে সবচেয়ে শক্তিশালী বাদশাহর সাথে।’’
(সূরা কামারঃ 54-55)
পূর্ণ আস্থা রাখা (তাওয়াক্কুল)
তাওয়াক্কুল একটি পেয়ালা যা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে মুখ সীল করা অবস্থায় আছেঃ কেউ এ থেকে পান করতে পারবে না এবং এর সীল ভাঙ্গতে পারবে না আস্থাশীলরা ছাড়া। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেনঃ
)
و
َعَلَى اللَّـهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُتَوَكِّلُونَ(
‘‘
আল্লাহর উপরেই শুধু আস্থাশীলরা নির্ভর করুক।’’
(সূরা ইবরাহীমঃ 12)
)
و
َعَلَى اللَّهِ فَتَوَكَّلُوا إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ(
‘‘
আল্লাহর উপরেই তোমাদের নির্ভর করা উচিত যদি তোমরা বিশ্বাসী হয়ে থাকো।’’
(সূরা মায়িদাঃ 23)
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাওয়াক্কুলকে বিশ্বাসের চাবি বানিয়েছেন এবং বিশ্বাসকে তাওয়াক্কুলের তালা বানিয়েছেন। তাওয়াক্কুলের বাস্তবতা (হাক্বীক্বাত) হলো নিজের উপরে অন্যদের অগ্রাধিকার দেয়া। অন্যদের অগ্রাধিকার দেয়ার মূল হচ্ছে অন্য ব্যক্তির দাবীকে এগিয়ে দেয়া। যে আস্থা রাখে সে তার আস্থাতে দু’
টো অগ্রাধিকারের একটিকে ক্রমাগতভাবে সত্যায়ন করে যায়। যদি সে সৃষ্টিকে অগ্রাধিকার দেয় তাহলে এটি হয়ে যায় একটি পর্দা যাতে সে ঢেকে যায়। যদি সে আস্থার কারণের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাকে অগ্রাধিকার দেয় তাহলে সে তাঁর সাথে থাকে। যদি তুমি তাওয়াক্কুলের মানুষ হতে চাও এবং সৃষ্টির মানুষ হতে না চাও তাহলে তোমার রুহের উপর পাঁচ বার তাকবীর বলো এবং তোমার সব আশাকে বিদায় জানাও যেভাবে মৃত্যু বিদায় জানায় জীবনকে।
সবচেয়ে নিচের স্তরের তাওয়াক্কুল হলো তোমার অগ্রযাত্রার সামনে তোমার সর্বোচ্চ আশাকে স্থান দেয়া , এ ছাড়া আর কিছু নয়। তোমার না উচিত তোমার অংশ চাওয়া , না দেখার চেষ্টা করা তোমার কীসের অভাব আছে , কারণ এ দু’
টোর যে কোন একটি তোমার ঈমানের বন্ধনকে ছিঁড়ে ফেলবে আর তুমি তা বুঝতেও পারবে না। যদি তুমি সত্যিকারভাবেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ থাকো যে তাওয়াক্কুলকারীদের একটি পদক নিয়ে বেঁচে থাকবে এ দু’
টো অগ্রাধিকারের যে কোন একটি বিষয়ে তাঁর উপর তাওয়াক্কুল করার মাধ্যমে তাহলে এ ঘটনাটি দৃঢ়ভাবে ধরে রাখো। বর্ণিত আছে তাওয়াক্কুল সম্পন্ন এক ব্যক্তি ইমামদের (আ.) একজনের কাছে এলো এবং তাকে বললোঃ‘‘
তাওয়াক্কুলের বিষয়ে একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আমার প্রতি দয়া করুন ।’’
ইমাম জানতেন যে ঐ ব্যক্তির ছিলো প্রশংসনীয় তাওয়াক্কুল ও অসাধারণ (তাক্বওয়া) সতর্কতা এবং তিনি ঐ ব্যক্তি প্রশ্ন করার আগেই দেখতে পেয়েছিলেন যে , সে যে প্রশ্ন করছিলো তার বিষয়ে সে আন্তরিক। তিনি বললেন ,‘‘
তুমি যেখানে আছো সেখানেই থাকো এবং আমার সাথে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো।’’
যখন তিনি তার উত্তর সাজাচ্ছিলেন একজন দরিদ্র লোক পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো। ইমাম তার পকেটে হাত দিলেন এবং কিছু বের করলেন এবং দরিদ্র লোকটিকে তা দিলেন। এরপর তিনি প্রশ্নকারীর দিকে ফিরে বললেনঃ‘‘
আসো এবং জিজ্ঞেস করো সে সম্পর্কে যা তুমি দেখেছো।’’
লোকটি বললোঃ‘
হে ইমাম , আমি জানি যে আপনি আমাকে প্রশ্নটির উত্তর দিতে পারতেন আমাকে অপেক্ষা করানোর আগেই। তাহলে কেন আপনি দেরী করলেন ?’
এবার ইমাম বললেনঃ‘‘
বিশ্বাস হচ্ছে আমি বলার আগেই অর্থের উপর চিন্তা করা। কারণ কীভাবে আমি আমার গভীরতম সত্তার বিষয়ে অবহেলা করতে পারি যখন আমার রব তা দেখতে পান ? আমি কীভাবে তাওয়াক্কুলের বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করতে পারি যখন আমার পকেটে একটি মুদ্রা রয়েছে ? আমার জন্য অনুমতি নেই যে তাওয়াক্কুলের বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করবো যতক্ষণ না আমি তাকে তা (মুদ্রাটি) না দিয়েছি। অতএব বুঝে নাও!’
প্রশ্নকারী গভীর নিশ্বাস ফেললো এবং শপথ করলো যে যতদিন সে বেঁচে আছে সে কোন বাড়িতে আশ্রয় খুঁজবে না , না মরণশীল কারো উপর নির্ভর করবে ।