পথ চলার বাতি

পথ চলার বাতি0%

পথ চলার বাতি লেখক:
: মুহাম্মদ ইরফানুল হক
প্রকাশক: ওয়াইজম্যান পাবলিকেশনস
বিভাগ: চরিত্র গঠনমূলক বই

পথ চলার বাতি

লেখক: আবু আবদিল্লাহ ইমাম জাফর ইবনে মুহাম্মদ আস-সাদিক্ব (আ.)
: মুহাম্মদ ইরফানুল হক
প্রকাশক: ওয়াইজম্যান পাবলিকেশনস
বিভাগ:

ভিজিট: 11087
ডাউনলোড: 2902

পাঠকের মতামত:

পথ চলার বাতি
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 61 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 11087 / ডাউনলোড: 2902
সাইজ সাইজ সাইজ
পথ চলার বাতি

পথ চলার বাতি

লেখক:
প্রকাশক: ওয়াইজম্যান পাবলিকেশনস
বাংলা

পরিচ্ছেদ-22

নিজেকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে সমর্পন করা

যে তার নিজের বিষয়কে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে সমর্পণ করে সে চিরস্থায়ী আরাম ও সার্বক্ষণিক চিন্তামুক্ত জীবন যাপন করে। একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ছাড়া সে কোন কিছু নিয়ে চিন্তা করার উর্ধ্বে। আমিরুল মুমিনীন যেরকম বলেছেন :‘‘ আমি সন্তুষ্ট ছিলাম যা আল্লাহ আমার জন্য নির্ধারণ করেছেন এবং আমি আমার বিষয়কে আমার সৃষ্টিকর্তার কাছে সমর্পণ করেছি।’’

চলে যাওয়া বিষয়গুলোতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা যে রকম ভালো ছিলেন (মানুষের প্রতি) , সেরকমই তিনি থেকে যাওয়া বিষয়গুলোতেও (মানুষের প্রতি) ভালো থাকবেন। যেমন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেনঃ একজন বিশ্বাসীর ভাষায় যে ছিলো ফেরাউনের লোকজনের ভেতরেঃ

) و َأُفَوِّضُ أَمْرِي إِلَى اللَّـهِ إِنَّ اللَّـهَ بَصِيرٌ بِالْعِبَادِ فَوَقَاهُ اللَّـهُ سَيِّئَاتِ مَا مَكَرُوا وَحَاقَ بِآلِ فِرْعَوْنَ سُوءُ الْعَذَابِ(

‘‘ আমি আমার বিষয়কে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করছি , নিশ্চয়ই আল্লাহ তার বান্দাহদের দেখেন। তাই আল্লাহ তাকে রক্ষা করলেন তাদের পরিকল্পনার অনিষ্ট থেকে এবং সবচেয়ে খারাপ শাস্তি ফেরাউনের দলকে স্পর্শ করলো।’’ (সূরা মুমিনঃ 44-45)

تفوید (তাফউইদ বা সমর্পণ করা) শব্দটিতে পাঁচটি অক্ষর আছে , প্রত্যেকটি অক্ষরে একটি আদেশ রয়েছে। যে এ আদেশগুলো গ্রাহ্য করে সে এগুলো মেনে চলে- যেমনترک (তারক বা পরিত্যাগ করা) এর ت যার অর্থ হলো এ পৃথিবীতে পরিকল্পনাগুলো ত্যাগ করা ;فنا (ফানা বা বিলীন হওয়া)-এর ف যার অর্থ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ছাড়া সবকিছুর আশা বিলীন হওয়া ;وفا (ওয়াফা বা চুক্তি)-এর و যা হলো চুক্তি বাস্তবায়ন করা এবং প্রতিশ্রুতির পূরণ করা ;یأس (ইয়া স বা হতাশ হওয়া)-এর ی যা হলো নিজেকে নিয়ে হতাশ হওয়া এবং তোমার রবের বিষয়েیقین ইয়াক্বীন এবংضمیر (দামির বা বিবেক)-এর ض , যা হলো একমাত্র আল্লাহর জন্য বিবেক এবংضرورة (দারুরাহ বা প্রয়োজন) তাঁকে (আল্লাহকে) প্রয়োজন। যে তার সবকিছু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে সমর্পণ করে সে সকালে ঘুম থেকে উঠে সব খারাপ মুক্ত হয়ে এবং রাতে সে বিশ্বাসের পূর্ণ নিরাপত্তা নিয়ে ঘুমায়।

ইয়াক্বীন (যে বিশ্বাস নিশ্চয়তায় পৌঁছেছে)

ইয়াক্বীন বান্দাহকে নিয়ে যাবে প্রত্যেক ঐশী অবস্থায় (হাল) এবং বিস্ময়কর মাক্বামে ; ঈসার (আ.) ইয়াক্বীন-এর বিশালতা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) জানালেন যে তিনি পানির উপর হাঁটতেন। তিনি বলেছেনঃ‘‘ যদি তার আরও ইয়াক্বীন থাকতো তাহলে সে বাতাসে হাঁটতো। এর মাধ্যমে তিনি ঈঙ্গিত করেছেন যে আল্লাহর কাছে রাসূলদের (আ.) বিরাট মর্যাদা থাকা সত্ত্বেও তাদের ইয়াক্বীন অনুযায়ী তাদের মর্যাদার শ্রেণী বিভাগ ছিলো। ইয়াক্বীন সব সময় বৃদ্ধি পেতে থাকে , এবং চিরকাল ধরে তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিশ্বাসীদের মাঝেও পার্থক্য আছে তাদের ইয়াক্বীনের শক্তি ও দূর্বলতা অনুযায়ী। যার ইয়াক্বীন শক্তিশালী তাকে চেনা যায় এ বাস্তবতার মাধ্যমে যে সে দেখে কোন শক্তি ও কোন ক্ষমতা নেই যা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাকে দিয়েছেন তা ছাড়া এবং তার প্রকাশ্যে ও গোপনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার আদেশ মেনে চলা ও ইবাদাত করা দেখে। থাকা ও না থাকা , বৃদ্ধি পাওয়া ও কমে যাওয়া , প্রশংসা ও দোষারোপ , শক্তি ও মর্যাদাহীনতাকে সে একই স্তরে বলে মনে করে। যে ব্যক্তি তার ইয়াক্বীনকে দূর্বল করে সে নিজের নফসকে লাগামহীন রাজত্ব করতে দেয়। সে সাধারণ জনগণের রীতিনীতি ও কথাকে অনুসরণ করে সেগুলোর কোন প্রমাণ না দিয়ে এবং এ পৃথিবীর বিষয়গুলোর জন্য সংগ্রাম করে , এর সম্পদ জমা করে এবং তা আঁকড়ে ধরে রাখে তার জিহবার মাধ্যমে তা স্বীকার করে ও সত্যায়ন করে।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ছাড়া বঞ্চিত রাখারও কেউ নেই দেয়ারও কেউ নেই এবং বান্দাহ শুধু তাই নিতে পারে যা তাকে দেয়া হয় এবং যা তার জন্য নির্ধারিত হয়। চেষ্টা রিয্ক বৃদ্ধি করে না। কিন্তু সে তা অস্বীকার করে তার কাজ ও অন্তর দিয়ে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কথায়ঃ

) ي َقُولُونَ بِأَفْوَاهِهِم مَّا لَيْسَ فِي قُلُوبِهِمْ وَاللَّـهُ أَعْلَمُ بِمَا يَكْتُمُونَ(

‘‘ তারা তাদের মুখ দিয়ে বলে যা তাদের অন্তরে নেই এবং আল্লাহ সবচেয়ে ভালো জানেন তারা কী লুকায়।’’ (সূরা আলে ইমরানঃ 167)

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাঁর বান্দাহদের প্রতি দয়ালু ছিলেন যখন তিনি তাদেরকে অর্থ উপার্জনের অনুমতি দিয়েছিলেন যেভাবে তারা চায় , যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার দেয়া সীমানা অতিক্রম না করে অথবা তাঁর প্রতি দায়িত্ব ও তাঁর রাসূলের (সা.) সুন্নাত পরিত্যাগ না করে এবং লোভের ময়দানে বন্দী না হয়ে পড়ে। কিন্তু যখন তারা তা ভুলে যায় ও নিজেদেরকে সেসবের সাথে যুক্ত করে যা তাদের বলা হয়েছে তার বিপরীত , তখন তাদেরকে ধ্বংসপ্রাপ্তদের সাথে গোনা হবে ; শেষ পর্যন্ত মিথ্যা দাবী ছাড়া যাদের কিছু থাকে না। যারা উপার্জন করে তাদের সবাই যথেষ্ট বিশ্বস্ত নয়ঃ সে শুধু নিষিদ্ধ ও সন্দেহযুক্ত জিনিস আনে উপার্জন হিসাবে। তাকে চেনা যাবে তার উপরে তার উপার্জনের প্রভাব ও তার সীমাহীন ক্ষুধা এবং কোন বিরতি ছাড়া পৃথিবীর জন্য সে কীভাবে খরচ করে তা দেখে।

ভয় ও আশা

ভয় হচ্ছে অন্তরের হেফাযতকারী এবং আশা হচ্ছে সত্তার শাফায়াতকারী। যে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাকে চেনে সে তাঁকে ভয় করে এবং তাঁর প্রতি আশা স্থাপন করে। এগুলো হচ্ছে বিশ্বাসের দু টো পাখা যা দিয়ে প্রকৃত বান্দাহ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সন্তুষ্টির দিকে উড়ে যায়। এগুলো বুদ্ধির দু টো চোখ যাদের মাধ্যমে সে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার প্রতিশ্রুতি ও হুমকি দেখতে পায় ; তার ভয় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার ন্যায় বিচার সম্পর্কে ভাবে সেই হুমকিকে খুব সতর্কতার সাথে বিবেচনা করার মাধ্যমে। আশা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার উপচে পড়া নেয়ামত ডেকে আনে এবং অন্তরকে জীবন দেয় , একই সময়ে ভয় নফসকে হত্যা করে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

‘‘ বিশ্বাসীর আছে দু ধরনেরভয় : যা চলে গেছে তা নিয়ে ভয় এবং যা আসবে তার জন্য ভয়। ’’

নফস-এর মৃত্যুতে নিহিত আছে অন্তরের জন্য জীবন যা আমলে দৃঢ়তা আনে। যে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার ইবাদাত করে ভয় ও আশার ভারসাম্য নিয়ে সে পথভ্রষ্ট হবে না এবং সে যা আশা করে তা লাভ করবে। একজন বান্দাহ ভীত ছাড়া আর কী হবে যখন সে জানে না তার কোন কাজের সময় তার খাতা বন্ধ হবে , যখন তার কাছে কৃত এমন কোন আমল নেই যা তাকে সাহায্য করতে পারে , কোন শক্তি নেই কিছু করার এবং কোন জায়গা নেই পালাবার ? কীভাবে সে আশা করতে ব্যর্থ হবে যখন সে জানে তার অক্ষমতা সত্ত্বেও সে ডুবে আছে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার রহমত ও নেয়ামতগুলোর ভেতর যা গোনা যায় না বা যেগুলোকে সংখ্যাবদ্ধ করা যায় না। প্রেমিক তার রবের ইবাদাত করে আশা নিয়ে , নিজের অবস্থা নিয়ে ভাবে জাগ্রত ব্যক্তির দৃষ্টি দিয়ে এবং যাহেদ (যে বিরত থাকে) ইবাদাত করে ভয় নিয়ে।

হারাম ইবনে হাইয়্যানকে উয়ায়েস আল-ক্বরনী বলেছিলো :‘‘ মানুষ আশার কারণে কাজ করে , কিন্তু তুমি কাজ কর ভয়ে।’’ হারাম বললোঃ‘‘ দু ধরনের ভয় আছে : স্থায়ী এবং পরিবর্তনশীল। স্থায়ী ভয় আশা আনে , আর পরিবর্তনশীল ভয় আনে স্থায়ী ভয়। একইভাবে দু ধরনের আশা আছে : গোপন ও প্রকাশ্য। গোপন আশা স্থায়ী ভয় আনে যা প্রেমের যোগসূত্রকে শক্তিশালী করে ; আর প্রকাশ্য আশা তার জীবৎকালে সে যা করেছে সে বিষয়ে তার অক্ষমতা ও ত্রুটিগুলো সম্পর্কে প্রত্যাশাগুলো পূর্ণ করে।

তৃপ্তি

তৃপ্তি হলো যখন কোন ব্যক্তি সে যা ভালোবাসে ও সে যা ঘৃণা করে তা নিয়ে সন্তুষ্ট আছে ; এটি মারেফাতের নূরের একটি রশ্মি। যে তৃপ্ত সে তার সমস্ত পছন্দে বিলীন হয়ে গেছে ; সে হচ্ছে সেই ব্যক্তি যার সাথে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সন্তুষ্ট আছেন। তৃপ্ত একটি নাম যা দাসত্বের অর্থ করে এবং একে অন্তরের আনন্দ হিসেবে বর্ণনা করা যেতে পারে।

আমি আমার পিতা মুহাম্মাদ আল বাক্বির-কে বলতে শুনেছিঃ‘‘ যা উপস্থিত আছে তার সাথে অন্তরকে যুক্ত করা হলো শিরক এবং যা নেই তার সাথে যুক্ত করা কুফর (অবিশ্বাস): কথা গ্রাহ্য না করার স্বভাবের পাখা হলো এ দু টি। আমি অবাক হই তাকে নিয়ে যে দাবী করে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার দাস হিসাবে এবং এরপর তাঁর রায়গুলো নিয়ে তর্ক করে। তৃপ্ত আধ্যাত্মিক লোকেরা (আরিফীন) এ রকম হওয়া থেকে অনেক দূরে।’’

পরিচ্ছেদ-23

দুঃখ-কষ্ট

দুঃখ-কষ্ট হচ্ছে বিশ্বাসীর অলংকার এবং বুদ্ধিমান লোকদের জন্য সম্মানের পদক , কারণ সরাসরি এর মোকাবেলার জন্য প্রয়োজন দৃঢ়তা ও অনড় পা , দু টোই বিশ্বাসের প্রমাণ। রাসূল (সা.) বলেছেনঃ‘‘ আমরা নবীরা (আ.) সবচেয়ে কঠিন দুঃখ-কষ্ট মোকাবিলা করি। আমাদের পর আসে বিশ্বাসীরা , এরপর তাদের মত অন্যরা।’’

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার নিরাপত্তায় থেকে যে দুঃখ-কষ্টের স্বাদ গ্রহণ করে সে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার নেয়ামত থেকেও এতে বেশী আনন্দ বোধ করে। সে এর আকাঙ্ক্ষা করে যখন তা নেই , কারণ রহমতের আলোগুলো দুঃখ-কষ্ট ও পরীক্ষার দাঁড়িপাল্লার নীচে থাকে। অনেকেই দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি এবং নেয়ামতে ধ্বংস হয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তার কোন বান্দাহর প্রশংসা করেন নি আদম থেকে মুহাম্মাদ পর্যন্ত , যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি তাদের পরীক্ষা করেছেন এবং দেখেছেন সে কীভাবে ইবাদাতের দায়িত্ব পালন করেছে দুঃখ-কষ্টের ভেতরে থেকে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সম্মানের পদক আসে একদম শেষ অবস্থায় , কিন্তু দুঃখ-কষ্ট আসে একদম শুরুতে।

যে দুঃখ-কষ্টের পথ ছেড়ে দেয় সে অস্বীকার করে বিশ্বাসীদের প্রদীপকে , যারা আল্লাহর নিকটবর্তী তাদের আলোর মিনারকে এবং যারা সঠিক পথে আছে তাদের পথপ্রদর্শককে। কোন বান্দাহর ভেতরে ভালো কিছু নেই যদি সে একটি পরীক্ষার জন্য অভিযোগ করে অথচ যার আগে এসেছে হাজার হাজার নেয়ামত এবং যার পরে আসবে হাজার হাজার আরাম। যে দুঃখ-কষ্টের ভেতর ধৈর্য ধরে না সে নেয়ামতগুলো গ্রহণের পর কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন থেকে বঞ্চিত হয়। একইভাবে যে নেয়ামতগুলোর কারণে দায়বদ্ধ অথচ কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করে না সে দুঃখ-কষ্টে ধৈর্য ধরা থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়। যে এ দু টোতেই প্রত্যাখ্যাত হয় সে বিতাড়িত।

আইউব তার দোয়ায় বলেছিলোঃ‘‘ হে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা , নিশ্চয়ই সত্তরটি দুঃখ-কষ্ট আমার কাছে এসেছে যখন আমাকে আপনি সত্তরটি আরাম ও স্বাচ্ছন্দ্য পাঠিয়েছেন।’’

ওয়াহাব ইবনে মুনাবিবহ বলেছেঃ‘‘ বিশ্বাসীর দুঃখ-কষ্ট হলো ঘোড়ার মুখের দড়ি এবং উটের নাকের দড়ি।’’ আলী (আ.) বলেছেনঃ‘‘ দৃঢ়তার সাথে ঈমানের সম্পর্ক হলো দেহের সাথে মাথার সম্পর্কের মত। দৃঢ়তার মাথা হলো দুঃখ-কষ্ট , কিন্তু শুধু তারা তা বোঝে যারা সৎ কাজ করে।’’

ধৈর্য

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার বান্দাহদের গীভরতম সত্তায় যে আলো ও পবিত্রতা রয়েছে , ধৈর্য তাকে প্রকাশ করে দেয় এবং তাদের ভেতরে যে অন্ধকার ও শূন্যতা আছে , দুঃশ্চিন্তা তাকে প্রকাশ করে দেয়। প্রত্যেকেই ধৈর্যশীল হওয়ার দাবী করে কিন্তু শুধু বিনয়ীরা এতে দৃঢ়। প্রত্যেকেই দুঃশ্চিন্তা অস্বীকার করে অথচ তা একজন মোনাফেক্ব এর ভেতরে স্পষ্ট। কারণ পরীক্ষা ও দুঃখ-কষ্টের শুরুই তোমাকে বলে দেয় কে সত্যবাদী ও কে মিথ্যাবাদী।

ধৈর্য হচ্ছে একটি অনুভূতি যা সার্বক্ষণিকভাবে ব্যক্তির বিবেকে বজায় থাকে কিন্তু হঠাৎ কোন বিপর্যয়ে যা ঘটে তাকে ধৈর্য বলা যায় না। দুঃশ্চিন্তা হলো তা যা মানুষের অন্তরকে বিচলিত করে এবং ব্যক্তির জন্য দুঃখ আনে , তার রং ও অবস্থা পরিবর্তন করে দেয়। প্রত্যেক বিষয় যার আরম্ভ নম্রতা , অনুতাপ এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে বিনয়পূর্ণ দোয়া ছাড়া তা আসে দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ ব্যক্তির কাছ থেকে , ধৈর্যশীলের কাছ থেকে নয়। ধৈর্যের শুরুটি তিক্ত কিন্তু এর শেষ কিছু লোকের জন্য মিষ্টি ; কিন্তু অন্যদের জন্য এর শুরু ও শেষ দু টোই তিক্ত। যে এতে এর শেষে প্রবেশ করেছে সে এতে প্রবেশ করেছে। যে এর শুরুতে প্রবেশ করেছে সে তা ছেড়ে এসেছে। যে ব্যক্তি ধৈর্যের মূল্য জানে সে এছাড়া থাকতে পারে না।

মূসা এবং খিযির (আ.)-এর ঘটনায় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেনঃ

) و َكَيْفَ تَصْبِرُ عَلَىٰ مَا لَمْ تُحِطْ بِهِ خُبْرًا(

‘‘ তুমি কীভাবে তাতে ধৈর্য ধরবে যার বিষয়ে তোমার সম্পূর্ণ জানা নেই ?’’ (সূরা কাহফঃ 68)

যে অনিচ্ছায় ধৈর্য ধরেছে , যে অন্যদের কাছে অভিযোগ করে না এবং যখন তার পর্দা ছিঁড়ে যায় দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয় না , সে সাধারণ লোকদের অন্তর্ভূক্ত। তার অংশ রয়েছে যেরকম আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেনঃ

) و َبَشِّرِ الصَّابِرِينَ(

‘‘ সুসংবাদ দাও ধৈর্যশীলদের।’’ (সূরা বাকারাঃ 155)

আর তা হচ্ছে জান্নাত ও ক্ষমার সুসংবাদ। যে দুঃখ-কষ্টকে খোলা অন্তরে গ্রহণ করেছে এবং ধৈর্য ধরেছে শান্ত অবস্থা ও মর্যাদা বজায় রেখে সে উচ্চ স্থানীয়দের অন্তর্ভূক্ত এবং তার অংশ হলো যেরকম আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেনঃ

) إ ِنَّ اللَّـهَ مَعَ الصَّابِرِينَ(

‘‘ নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।’’ (সূরা আনফালঃ 46)

দুঃখ

দুঃখ হলো আধ্যাত্মিক লোকদের চিহ্ন , যখন তারা নির্জনে থাকে তখন অদৃশ্য থেকে তাদের কাছে তা আসে তার ব্যাপকতার মাঝ দিয়ে এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার প্রশংসার তীব্রতার মাঝ দিয়ে। দুঃখ ভারাক্রান্তের বাইরের সত্তা হলো সংকোচন এবং তার ভেতরের সত্তা হলো প্রসারণ।

সে লোকজনের সাথে বসবাস করে সন্তুষ্টির সাথে , আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার নিকটবর্তী জীবন নিয়ে। দুঃখী ব্যক্তি গভীরভাবে ভাবে না , কারণ যে গভীরভাবে ভাবে সে তা করতে বাধ্য হয় কিন্তু দুঃখী ব্যক্তি প্রকৃতিগতভাবেই সেরকম। দুঃখ আসে ভেতর থেকে এবং ভাবনা আসে ঘটনা দেখে। এ দু য়ের মাঝে পার্থক্য আছে।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ইয়াক্বুবের ঘটনায় বলেছেনঃ

) إ ِنَّمَا أَشْكُو بَثِّي وَحُزْنِي إِلَى اللَّـهِ وَأَعْلَمُ مِنَ اللَّـهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ(

‘‘ আমি শুধু আমার শোক ও দুঃখের অভিযোগ করি আল্লাহর কাছে এবং আমি আল্লাহর কাছ থেকে জানি যা তোমরা তা জানো না।’’ (সূরা ইউসুফঃ 86)

এর কারণ হলো দুঃখের অবস্থায় যে জ্ঞান অর্জিত হয় তা শুধু তারই জন্য এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা এর জন্য তাকে বাছাই করেছেন এবং পৃথিবীর বাকী সবাইকে তা থেকে বঞ্চিত রেখেছেন। যখন রাবি ইবনে কুসাইমকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো কেন সে দুঃখ ভারাক্রান্ত , সে বলেছিলোঃ‘‘ কারণ আমি আমার কাছে কিছু দাবী করেছি।’’ দুঃখের ডান দিকে দাঁড়ায় সংকোচন এবং এর বাম দিকে দাঁড়ায় নিরবতা। দুঃখ হচ্ছে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার আরেফদের একটি চিহ্ন।

গভীর ভাবনা উচ্চস্থানীয় এবং সাধারণ মানুষ উভয়ই করে। যদি আরেফদের অন্তর থেকে দুঃখকে এক ঘন্টার জন্য পর্দার আড়াল করে দেয়া হয় তাহলে তারা এর জন্য সাহায্য চাইবে কিন্তু তা যদি অন্যদের অন্তরে স্থাপন করা হয় তারা তা অপছন্দ করবে। দুঃখ হলো প্রথম আর এরপরে আসে নিরাপত্তা ও সুসংবাদ। ঈমান আনার পর এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে আশ্রয় চাওয়ার মাধ্যমে তাঁর প্রয়োজন উচ্চারণ করার পর আসে গভীর ভাবনা। দুঃখ ভারাক্রান্ত ব্যক্তি গভীরভাবে ভাবে এবং যে গভীরভাবে ভাবে সে শিক্ষা গ্রহণ করে। তাদের প্রত্যেকের আছে একটি অবস্থা , একটি বিজ্ঞান , একটি পথ , সহনশীলতা ও সম্মান।

মধ্যপন্থা

মধ্যপন্থা হলো একটি আলো যার সারাংশ হলো বিশ্বাসের প্রাণকেন্দ্র , এর অর্থ হলো সে সব কিছুর সতর্কপূর্ণ বিবেচনা যেগুলোকে তাওহীদ ও ইরফান (আধ্যাত্মিক জ্ঞান) নিন্দা করেছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ‘‘ মধ্যপন্থা হলো বিশ্বাসের অংশ।’’ মধ্যপন্থা গ্রহণ করা হয় বিশ্বাসের মাধ্যমে এবং বিশ্বাসগুলো গ্রহণ করা হয় মধ্যপন্থার মাধ্যমে। মধ্যপন্থী ব্যক্তির সব ভালো। যাকে মধ্যপন্থা দেয়া হয় নি তার সব খারাপ , যদি সে ইবাদাত করে ও সাবধানী হয় তবুও।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার ভয়ের উঠোনে মধ্যপন্থায় এক কদম ফেলা সত্তর বছর ইবাদাতের চাইতে উত্তম। অন্যদিকে ঔদ্ধত্য হলো মোনাফেক্বী , সন্দেহ ও অবিশ্বাসের শুরু।

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ‘‘ যদি তোমার কোন লজ্জা না থাকে তাহলে যা ইচ্ছা কর।’’ এর অর্থ হচ্ছে যখন মধ্যপন্থা তোমাকে ছেড়ে যায় তখন তোমাকে শাস্তি দেয়া হবে সব ভালো অথবা খারাপ কাজের জন্য যা তুমি কর। মধ্যপন্থার শক্তি আসে দুঃখ ও ভয় থেকে এবং মধ্যপন্থা হলো ভয়ের বাসা। মধ্যপন্থার শুরু হচ্ছে ভয় এবং এর শেষ হচ্ছে স্বচ্ছ দৃষ্টি। একজন মধ্যপন্থী ব্যক্তি নিজের বিষয়গুলো নিয়ে ব্যস্ত , লোকজনের কাছ থেকে দূরে এবং তারা যা করে তা থেকে দূরে। যদি তারা সবাই এ মধ্যপন্থী লোকটিকে পরিত্যাগ করে তবুও।

রাসূলূল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ‘‘ যখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা একজন বান্দাহর জন্য ভালো চান , তিনি তাকে তার ভালোগুণগুলো সম্পর্কে ভুলিয়ে দেন , তার খারাপ গুণগুলো তার চোখের সামনে তুলে ধরেন এবং যারা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার স্মরণ করে না তাদের সাথে বসাকে তার কাছে অপছন্দনীয় করে দেন।’’

মধ্যপন্থা পাঁচ প্রকারেরঃ ভুল কাজের জন্য লজ্জা , অক্ষমতার জন্য লজ্জা , সম্মানিত সমসাময়িকের সামনে মধ্যপন্থা , ভালোবাসার মধ্যপন্থা , এবং ভয়ের মধ্যপন্থা। এদের প্রত্যেকটিরই অনুসারী আছে যাদেরকে মধ্যপন্থার এ বিভিন্ন শ্রেণীতে মর্যাদা দেয়া হয়েছে।

মারেফাহ

একজন আরেফ (যার মারেফাহ আছে) থাকে মানুষের সাথে কিন্তু তার অন্তর থাকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সাথে। যদি তার অন্তর চোখের এক পলকের জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাকে ভুলে যায় তাহলে সে তাঁর টানে মারা যাবে। আরেফ হলেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার ঘটনাগুলোর আমানত রক্ষাকারী , তাঁর গোপন রহস্যের ভান্ডার , তার নূরসমূহের সিন্দুক , তাঁর সৃষ্টিকূলের প্রতি তাঁর রহমতের প্রমাণ , তাঁর বিজ্ঞানগুলোর হাতিয়ার এবং তাঁর নেয়ামত ও ন্যায়বিচারের পরিমাপ। সে লোকজনের কোন প্রয়োজন অনুভব করে না , না কোন লক্ষ্যের , আর না এ পৃথিবীর। তার ঘনিষ্ট কেউ নেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ছাড়া। না আছে কোন বক্তব্য , না কোন ইশারা অথবা শ্বাস একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার মাধ্যমে , আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সাথে এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কাছ থেকে ছাড়া , কারণ সে তাঁর পবিত্রতার বাগানে আসা যাওয়া করছে এবং সে তাঁর সবচেয়ে সূক্ষ্ণ সহানুভূতিতে সমৃদ্ধ। মারেফাহ হচ্ছে শিকড় যার শাখা হচ্ছে বিশ্বাস।