পরিচ্ছেদ-23
দুঃখ-কষ্ট
দুঃখ-কষ্ট হচ্ছে বিশ্বাসীর অলংকার এবং বুদ্ধিমান লোকদের জন্য সম্মানের পদক , কারণ সরাসরি এর মোকাবেলার জন্য প্রয়োজন দৃঢ়তা ও অনড় পা , দু’
টোই বিশ্বাসের প্রমাণ। রাসূল (সা.) বলেছেনঃ‘‘
আমরা নবীরা (আ.) সবচেয়ে কঠিন দুঃখ-কষ্ট মোকাবিলা করি। আমাদের পর আসে বিশ্বাসীরা , এরপর তাদের মত অন্যরা।’’
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার নিরাপত্তায় থেকে যে দুঃখ-কষ্টের স্বাদ গ্রহণ করে সে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার নেয়ামত থেকেও এতে বেশী আনন্দ বোধ করে। সে এর আকাঙ্ক্ষা করে যখন তা নেই , কারণ রহমতের আলোগুলো দুঃখ-কষ্ট ও পরীক্ষার দাঁড়িপাল্লার নীচে থাকে। অনেকেই দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি এবং নেয়ামতে ধ্বংস হয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তার কোন বান্দাহর প্রশংসা করেন নি–
আদম থেকে মুহাম্মাদ পর্যন্ত , যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি তাদের পরীক্ষা করেছেন এবং দেখেছেন সে কীভাবে ইবাদাতের দায়িত্ব পালন করেছে দুঃখ-কষ্টের ভেতরে থেকে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সম্মানের পদক আসে একদম শেষ অবস্থায় , কিন্তু দুঃখ-কষ্ট আসে একদম শুরুতে।
যে দুঃখ-কষ্টের পথ ছেড়ে দেয় সে অস্বীকার করে বিশ্বাসীদের প্রদীপকে , যারা আল্লাহর নিকটবর্তী তাদের আলোর মিনারকে এবং যারা সঠিক পথে আছে তাদের পথপ্রদর্শককে। কোন বান্দাহর ভেতরে ভালো কিছু নেই যদি সে একটি পরীক্ষার জন্য অভিযোগ করে অথচ যার আগে এসেছে হাজার হাজার নেয়ামত এবং যার পরে আসবে হাজার হাজার আরাম। যে দুঃখ-কষ্টের ভেতর ধৈর্য ধরে না সে নেয়ামতগুলো গ্রহণের পর কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন থেকে বঞ্চিত হয়। একইভাবে যে নেয়ামতগুলোর কারণে দায়বদ্ধ অথচ কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করে না সে দুঃখ-কষ্টে ধৈর্য ধরা থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়। যে এ দু’
টোতেই প্রত্যাখ্যাত হয় সে বিতাড়িত।
আইউব তার দোয়ায় বলেছিলোঃ‘‘
হে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা , নিশ্চয়ই সত্তরটি দুঃখ-কষ্ট আমার কাছে এসেছে যখন আমাকে আপনি সত্তরটি আরাম ও স্বাচ্ছন্দ্য পাঠিয়েছেন।’’
ওয়াহাব ইবনে মুনাবিবহ বলেছেঃ‘‘
বিশ্বাসীর দুঃখ-কষ্ট হলো ঘোড়ার মুখের দড়ি এবং উটের নাকের দড়ি।’’
আলী (আ.) বলেছেনঃ‘‘
দৃঢ়তার সাথে ঈমানের সম্পর্ক হলো দেহের সাথে মাথার সম্পর্কের মত। দৃঢ়তার মাথা হলো দুঃখ-কষ্ট , কিন্তু শুধু তারা তা বোঝে যারা সৎ কাজ করে।’’
ধৈর্য
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার বান্দাহদের গীভরতম সত্তায় যে আলো ও পবিত্রতা রয়েছে , ধৈর্য তাকে প্রকাশ করে দেয় এবং তাদের ভেতরে যে অন্ধকার ও শূন্যতা আছে , দুঃশ্চিন্তা তাকে প্রকাশ করে দেয়। প্রত্যেকেই ধৈর্যশীল হওয়ার দাবী করে কিন্তু শুধু বিনয়ীরা এতে দৃঢ়। প্রত্যেকেই দুঃশ্চিন্তা অস্বীকার করে অথচ তা একজন মোনাফেক্ব এর ভেতরে স্পষ্ট। কারণ পরীক্ষা ও দুঃখ-কষ্টের শুরুই তোমাকে বলে দেয় কে সত্যবাদী ও কে মিথ্যাবাদী।
ধৈর্য হচ্ছে একটি অনুভূতি যা সার্বক্ষণিকভাবে ব্যক্তির বিবেকে বজায় থাকে কিন্তু হঠাৎ কোন বিপর্যয়ে যা ঘটে তাকে ধৈর্য বলা যায় না। দুঃশ্চিন্তা হলো তা যা মানুষের অন্তরকে বিচলিত করে এবং ব্যক্তির জন্য দুঃখ আনে , তার রং ও অবস্থা পরিবর্তন করে দেয়। প্রত্যেক বিষয় যার আরম্ভ নম্রতা , অনুতাপ এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে বিনয়পূর্ণ দোয়া ছাড়া–
তা আসে দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ ব্যক্তির কাছ থেকে , ধৈর্যশীলের কাছ থেকে নয়। ধৈর্যের শুরুটি তিক্ত কিন্তু এর শেষ কিছু লোকের জন্য মিষ্টি ; কিন্তু অন্যদের জন্য এর শুরু ও শেষ দু’
টোই তিক্ত। যে এতে এর শেষে প্রবেশ করেছে সে এতে প্রবেশ করেছে। যে এর শুরুতে প্রবেশ করেছে সে তা ছেড়ে এসেছে। যে ব্যক্তি ধৈর্যের মূল্য জানে সে এছাড়া থাকতে পারে না।
মূসা এবং খিযির (আ.)-এর ঘটনায় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেনঃ
)
و
َكَيْفَ تَصْبِرُ عَلَىٰ مَا لَمْ تُحِطْ بِهِ خُبْرًا(
‘‘
তুমি কীভাবে তাতে ধৈর্য ধরবে যার বিষয়ে তোমার সম্পূর্ণ জানা নেই ?’’
(সূরা কাহফঃ 68)
যে অনিচ্ছায় ধৈর্য ধরেছে , যে অন্যদের কাছে অভিযোগ করে না এবং যখন তার পর্দা ছিঁড়ে যায় দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয় না , সে সাধারণ লোকদের অন্তর্ভূক্ত। তার অংশ রয়েছে যেরকম আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেনঃ
)
و
َبَشِّرِ الصَّابِرِينَ(
‘‘
সুসংবাদ দাও ধৈর্যশীলদের।’’
(সূরা বাকারাঃ 155)
আর তা হচ্ছে জান্নাত ও ক্ষমার সুসংবাদ। যে দুঃখ-কষ্টকে খোলা অন্তরে গ্রহণ করেছে এবং ধৈর্য ধরেছে শান্ত অবস্থা ও মর্যাদা বজায় রেখে সে উচ্চ স্থানীয়দের অন্তর্ভূক্ত এবং তার অংশ হলো যেরকম আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেনঃ
)
إ
ِنَّ اللَّـهَ مَعَ الصَّابِرِينَ(
‘‘
নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।’’
(সূরা আনফালঃ 46)
দুঃখ
দুঃখ হলো আধ্যাত্মিক লোকদের চিহ্ন , যখন তারা নির্জনে থাকে তখন অদৃশ্য থেকে তাদের কাছে তা আসে তার ব্যাপকতার মাঝ দিয়ে এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার প্রশংসার তীব্রতার মাঝ দিয়ে। দুঃখ ভারাক্রান্তের বাইরের সত্তা হলো সংকোচন এবং তার ভেতরের সত্তা হলো প্রসারণ।
সে লোকজনের সাথে বসবাস করে সন্তুষ্টির সাথে , আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার নিকটবর্তী জীবন নিয়ে। দুঃখী ব্যক্তি গভীরভাবে ভাবে না , কারণ যে গভীরভাবে ভাবে সে তা করতে বাধ্য হয় কিন্তু দুঃখী ব্যক্তি প্রকৃতিগতভাবেই সেরকম। দুঃখ আসে ভেতর থেকে এবং ভাবনা আসে ঘটনা দেখে। এ দু’
য়ের মাঝে পার্থক্য আছে।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ইয়াক্বুবের ঘটনায় বলেছেনঃ
)
إ
ِنَّمَا أَشْكُو بَثِّي وَحُزْنِي إِلَى اللَّـهِ وَأَعْلَمُ مِنَ اللَّـهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ(
‘‘
আমি শুধু আমার শোক ও দুঃখের অভিযোগ করি আল্লাহর কাছে এবং আমি আল্লাহর কাছ থেকে জানি যা তোমরা তা জানো না।’’
(সূরা ইউসুফঃ 86)
এর কারণ হলো দুঃখের অবস্থায় যে জ্ঞান অর্জিত হয় তা শুধু তারই জন্য এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা এর জন্য তাকে বাছাই করেছেন এবং পৃথিবীর বাকী সবাইকে তা থেকে বঞ্চিত রেখেছেন। যখন রাবি ইবনে কুসাইমকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো কেন সে দুঃখ ভারাক্রান্ত , সে বলেছিলোঃ‘‘
কারণ আমি আমার কাছে কিছু দাবী করেছি।’’
দুঃখের ডান দিকে দাঁড়ায় সংকোচন এবং এর বাম দিকে দাঁড়ায় নিরবতা। দুঃখ হচ্ছে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার আরেফদের একটি চিহ্ন।
গভীর ভাবনা উচ্চস্থানীয় এবং সাধারণ মানুষ উভয়ই করে। যদি আরেফদের অন্তর থেকে দুঃখকে এক ঘন্টার জন্য পর্দার আড়াল করে দেয়া হয় তাহলে তারা এর জন্য সাহায্য চাইবে কিন্তু তা যদি অন্যদের অন্তরে স্থাপন করা হয় তারা তা অপছন্দ করবে। দুঃখ হলো প্রথম আর এরপরে আসে নিরাপত্তা ও সুসংবাদ। ঈমান আনার পর এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে আশ্রয় চাওয়ার মাধ্যমে তাঁর প্রয়োজন উচ্চারণ করার পর আসে গভীর ভাবনা। দুঃখ ভারাক্রান্ত ব্যক্তি গভীরভাবে ভাবে এবং যে গভীরভাবে ভাবে সে শিক্ষা গ্রহণ করে। তাদের প্রত্যেকের আছে একটি অবস্থা , একটি বিজ্ঞান , একটি পথ , সহনশীলতা ও সম্মান।