পথ চলার বাতি

পথ চলার বাতি16%

পথ চলার বাতি লেখক:
: মুহাম্মদ ইরফানুল হক
প্রকাশক: ওয়াইজম্যান পাবলিকেশনস
বিভাগ: চরিত্র গঠনমূলক বই

পথ চলার বাতি
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 61 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 13245 / ডাউনলোড: 4505
সাইজ সাইজ সাইজ
পথ চলার বাতি

পথ চলার বাতি

লেখক:
প্রকাশক: ওয়াইজম্যান পাবলিকেশনস
বাংলা

পরিচ্ছেদ-১১

নামাজের দরজা খোলা

যখন তুমি ক্বিবলামুখী হও তোমার উচিত এ পৃথিবী থেকে , এর ভেতরে যেসব সৃষ্টি আছে এবং অন্যরা যা নিয়ে ব্যস্ত আছে তা থেকে নিরাশ হয়ে যাওয়া। তোমার অন্তর থেকে সব চিন্তা ভাবনা দূর করে দাও যা তোমাকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার প্রতি অমনোযোগী করে তুলতে পারে। আল্লাহর বিশালত্বকে দেখো তোমার গভীরতম সত্তা দিয়ে এবং স্মরণ রাখো যে তুমি তাঁর সামনে দাঁড়াবে। কারণ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেনঃ

) ه ُنَالِكَ تَبْلُو كُلُّ نَفْسٍ مَّا أَسْلَفَتْ وَرُدُّوا إِلَى اللَّـهِ مَوْلَاهُمُ الْحَقِّ(

‘‘ সেখানে প্রত্যেক সত্তা পরিচিত হবে তার সাথে যা সে আগে পাঠিয়েছে এবং তাদেরকে আল্লাহর কাছে ফেরত আনা হবে যিনি তাদের প্রকৃত পৃষ্ঠপোষক।’’ (সূরা ইউনুসঃ ৩০)

ভয় ও আশার গোড়াতে দাঁড়াও। যখন তুমি তাকবীর বল তোমার উচিত উচ্চ আকাশগুলো ও ভেজা পৃথিবীর মাঝে যা আছে তাকে তুচ্ছ জ্ঞান করা , যার সবই তাঁর মর্যাদার নীচে। কারণ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাঁর বান্দাহর অন্তরের দিকে তাকান যখন সে তাকবীর বলছে এবং দেখেন যে তার অন্তরে কিছু একটা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণার সত্যতাকে বাধা দিচ্ছে তখন তিনি বলেন ,‘‘ হে মিথ্যাবাদী! তুমি কি আমাকে ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করছো ? আমার শক্তি ও মর্যাদার শপথ , আমি তোমাকে আমার স্মরণের মিষ্টতা থেকে বঞ্চিত করবো এবং আমি আমার নৈকট্য থেকে এবং আমার সাথে ঘনিষ্ট মিলনের আনন্দ থেকে তোমাকে পর্দার মাধ্যমে দূরে সরিয়ে রাখবো।’’

জেনে রাখো যে , আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে তোমার খেদমতের কোন প্রয়োজন নেই। তুমি , তোমার ইবাদাত ও তোমার প্রার্থনার তিনি মুখাপেক্ষী নন । তিনি তোমাকে ডাকেন তাঁর নেয়ামত দিয়ে তোমার প্রতি রহমত করার জন্য , তোমাকে তাঁর শাস্তি থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য , তোমাকে তাঁর সন্তুষ্টির পথে পরিচালিত করার জন্য এবং তোমার জন্য তাঁর ক্ষমার দরজা খুলে দেয়ার জন্য। যদি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বিশ্বজগতে যা কিছু সৃষ্টি করেছেন তা বহুবার সৃষ্টি করতেন , চিরকালব্যাপী , কোন শেষ ছাড়া , আর যদি তারা তাকে সবাই প্রথ্যাখ্যান করতো অথবা তাঁর সাথে ঐক্যবদ্ধ হতো তবুও আল্লাহর জন্য তা একই হতো । প্রাণীকূলের ইবাদাত থেকে তাঁর কাছে যা আছে তা হলো তাঁর উদারতা এবং শক্তির প্রদর্শনী। অতএব নম্রতাকে বানাও তোমার পোষাক এবং অক্ষমতাকে বানাও তোমার গায়ের চাদর। প্রবেশ করো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার ক্ষমতার আরশের নীচে , তাহলে তুমি তাঁর প্রভুত্বের কল্যাণ লাভ করতে পারবে তাঁর কাছে সাহায্য ও তাঁর কাছে আশ্রয় চেয়ে।

নামাজে রুকু

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার বান্দাহ যখন সত্যিকারভাবে মাথা ঝোঁকায় (রুকু করে) আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাকে তাঁর ঔজ্জ্বল্যের আলো দিয়ে তাকে সাজান , তাকে ছায়া দেন তার মহত্ত্বের ছায়াতলে এবং তাকে পোষাক পরান তাঁর পবিত্রতার পোষাক দিয়ে। রুকু হলো প্রথম এবং সিজদা দ্বিতীয়। রুকুতে আছে সৌজন্য এবং সিজদাতে আছে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার নৈকট্য। যে সৌজন্যে ভালো নয় সে নৈকট্যের যোগ্য নয় ; অতএব রুকু র মাধ্যমে মাথা ঝোঁকাও তার মত যে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার প্রতি বিনীত , অন্তরে মর্যাদাশূন্য এবং তাঁর ক্ষমতার অধীনে ভীত , অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো আল্লাহর প্রতি সমর্পিত তার মত যে ভীত ও দুঃখিত এজন্য যে সে হয়তো যারা রুকু করে তাদের মত কল্যাণ পেতে ব্যর্থ হবে ।

বর্ণিত আছে রাবি ইবনে কুসাইম এক রুকুতে সারা রাত জাগতো সকাল পর্যন্ত। সকালে সে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলতোঃ‘‘ হায় , মুখলেস ব্যক্তিরা সামনে চলে গেছে এবং আমরা বাদ পড়ে গেছি।’’ তোমার রুকু শুদ্ধ করো পিঠ সোজা রেখে , দাঁড়ানো অবস্থায় তোমার উচ্চাশা থেকে তাঁর দাসত্ব করার জন্য নীচে নেমে এসে যা শুধু তাঁর সাহায্যের মাধ্যমেই ঘটে। তোমার অন্তর পালিয়ে আসুক শয়তানের কুমন্ত্রণা , ধোঁকা ও প্রতারণা থেকে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাঁর বান্দাহদেরকে উঁচুতে উঠাবেন তাঁর প্রতি তাদের বিনয় অনুযায়ী এবং তাদেরকে পরিচালিত করবেন বিনয় , আত্মসমর্পণ ও মর্যাদাশূন্যতার শিকড়ের দিকে তাঁর বিশালত্বের সাথে তাদের গভীরতম সত্তার পরিচিতির গভীরতা অনুযায়ী।

নামাজে সিজদা

যে ব্যক্তি সত্যিকার সিজদা করে সে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাকে কোনভাবেই হারায় না , এমনও যদি হয় যে সে তা একবার করেছে তার সারা জীবনে ; কিন্তু যে ব্যক্তি তার রবকে ঐ অবস্থায় (সিজদায়) ছেড়ে যায় সে সমৃদ্ধি লাভ করে না। সে তার মত যে নিজেকে ধোঁকা দেয় , এবং এ জীবনের পরে যে আনন্দ ও আরাম তা অবহেলা করে ও ভুলে যায় যা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাদের জন্য প্রস্তুত করেছেন যারা সিজদা করে।

যে ব্যক্তি তার সিজদায় ভালো করে সে কখনোই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছ থেকে দূরে নয় ; আর যে ব্যক্তি অসৌজন্য দেখায় এবং তাঁকে সম্মান করাতে অবহেলা করে যেহেতু তার অন্তর সিজদা অবস্থায় আল্লাহ ছাড়া অন্যকিছুর সাথে যুক্ত তাই সে কখনোই তাঁর নিকটবর্তী হবে না। অতএব সিজদা করো তার সিজদার মত যে নিজেকে মর্যাদাশূন্য দেখে এবং জানে যে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে মাটি থেকে যার উপরে লোকেরা হাঁটা-চলা করে এবং তাকে যে বীর্য থেকে তৈরী করা হয়েছে তা সবার কাছে অপবিত্র এবং তাকে জীবিত সত্তা বানানো হয়েছে যখন তার কোন অস্তিত্ব ছিলো না।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সিজদাকে করেছেন ব্যক্তির অন্তরে , গভীরতম সত্তায় ও রুহের ভিতরে তাঁর নিকটবর্তী হওয়ার ক্ষণ। যে তাঁর নিকটবর্তী হয় সে তিনি ছাড়া আর সবকিছু থেকে দূরে। তুমি কি দেখো না যে সিজদা বাইরের দিকে সম্পূর্ণ হয় না যতক্ষণ না সব জিনিস থেকে চলে যাওয়া হয় এবং চোখ যা দেখে তার উপর পর্দা পড়ে যায় ? আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা চান ভেতরের সত্তাও সেরকম হোক। যদি নামাজের ভেতর কারো অন্তর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ছাড়া অন্য কোন কিছুর সাথে যুক্ত থাকে সে সেই জিনিসেরই নিকটবর্তী হয়ে আছে এবং সে তার নামাজে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা যা চান তার বাস্তবতা থেকে বহু দূরে। কারণ তিনি বলেছেনঃ

) م َّا جَعَلَ اللَّـهُ لِرَجُلٍ مِّن قَلْبَيْنِ فِي جَوْفِهِ(

‘‘ আল্লাহ কোন ব্যক্তিকে তার বুকের ভেতরে দু টো অন্তর দেন নি।’’ (সূরা আহযাবঃ ৪)

রাসূলুল্লাহ (সা.)-র ভাষায়ঃ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেনঃ‘‘ যখন আমি কোন বান্দাহর অন্তরের উপর তাকাই , আমি জানি সত্যিই আমার জন্য তার আন্তরিক ভালোবাসা ও আনুগত্য আছে কিনা এবং আমার সন্তুষ্টি খোঁজ করে কিনা। এরপর আমি তার দায়িত্ব নেই এবং তাঁর নিকটবর্তী হই। যে তার নামাজে আমাকে ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকে সে তাদের একজন যে নিজেকে নিয়ে মশকরা করে এবং তার নাম ক্ষতিগ্রস্থদের তালিকাতে লেখা হয়।’’

তাশাহুদ

তাশাহুদ হলো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার প্রশংসা। তোমার গভীরতম সত্তায় তাঁর দাস হয়ে যাও তোমার কাজকর্মে তাঁর প্রতি ভীত ও বিনয়ী হয়ে যেহেতু তুমি কথায় ও দাবীতে তাঁর দাস। তোমার জিহবার সত্যবাদীতাকে যুক্ত করো তোমার গভীরতম সত্তার বিশুদ্ধ সত্যবাদিতার সাথে।

তিনি তোমাকে দাস হিসাবে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাকে আদেশ করেছেন তাঁর ইবাদাত করতে তোমার অন্তর , তোমার জিহবা ও তোমার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দিয়ে। তাঁর প্রতি তোমার দাসত্বকে বাস্তবে অনুভব করো তোমার উপরে তাঁর প্রভুত্বের মাধ্যমে। জেনে রাখো প্রাণীকূলের কপালের চুল তাঁর হাতে। প্রাণীকূল শ্বাসপ্রশ্বাস ও দৃষ্টি ক্ষমতার অধিকারী হয় না তাঁর শক্তি ও ইচ্ছা ছাড়া। তারা তাঁর রাজ্যে সামান্য জিনিসও জন্ম দিতে অক্ষম যদি না তা হয় তাঁর অনুমতি ও ইচ্ছা অনুযায়ী। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেনঃ

) و َرَبُّكَ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ وَيَخْتَارُ مَا كَانَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ سُبْحَانَ اللَّـهِ وَتَعَالَىٰ عَمَّا يُشْرِكُونَ(

‘‘ তোমার রব সৃষ্টি করেন এবং যাকে তাঁর ইচ্ছা বাছাই করেন ; বাছাই করাতে তাদের কোন অধিকার নেই , ত্রুটির উর্ধ্বে আল্লাহ এবং তিনি তারও উপরে যা তারা (তাঁর সাথে) যুক্ত করে।’’ (সূরা কাসাসঃ ৬৮)

অতএব আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার দাস হও , তাকে স্মরণ করে কথা ও ঘোষণার মাধ্যমে এবং তোমার জিহবার সত্যতাকে সংযুক্ত করো তোমার গভীরতম অন্তরে পবিত্রতার সাথে , কারণ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। তিনি এত শক্তিধর ও এত উচ্চ মর্যাদার যে কারো ইচ্ছাশক্তি নেই তাঁর পূর্ববর্তী ইচ্ছা শক্তির মাধ্যম ছাড়া। দাসত্বের অবস্থা পরিপূর্ণ করো তাঁর প্রজ্ঞায় সন্তুষ্ট থেকে এবং ইবাদাতের মাধ্যমে তাঁর আদেশগুলো পালন করার উদ্দেশ্যে।

তিনি তোমাকে আদেশ করেছেন তাঁর হাবীব (ভালোবাসা) মুহাম্মাদের উপরে দরুদ পাঠানোর জন্য , আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা যেন তাকে ও তার পরিবারের উপর রহমত ও শান্তি বর্ষণ করেন। অতএব যুক্ত করো তোমার অনুরোধকে মুহাম্মাদের কাছে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে তোমার প্রার্থনার সাথে , মুহাম্মাদের প্রতি আনুগত্যকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার প্রতি আনুগত্যের সাথে এবং তোমার মুহাম্মাদকে দেখার তোমার আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাকে দেখার সাথে। সতর্ক দৃষ্টি রেখো যেন তুমি জ্ঞানের রহমত থেকে বঞ্চিত না হও যা লুকানো আছে তার (মুহাম্মাদ-সাঃ) পবিত্রতার প্রতি সম্মান জানানোর ভেতরে তা না হলে তার উপরে দরুদ পাঠানোর উপকারিতা লাভের সুযোগ থেকে প্রত্যাখ্যাত হবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাকে আদেশ করেছেন তোমার জন্য ক্ষমা চাইতে এবং তোমার জন্য সুপারিশ করতে যখন তুমি আদেশ ও নিষেধগুলো এবং সুন্নাহ ও যে আদব গুলো (সৌজন্য) আছে যা রাসূলুল্লাহ (সা.)-র মাধ্যমে মানুষের কাছে প্রদর্শিত হয়েছে তা পালন করবে । আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে তার মহান মর্যাদা সম্পর্কে তোমার জানা থাকা উচিত।

সালাম

নামাজের শেষে তাসলিম (শান্তির শুভেচ্ছা)-এর অর্থ হচ্ছে নিরাপত্তা , আর তা হলো যে ব্যক্তি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার আদেশ ও তাঁর রাসূলের (সা.) সুন্নাহ পালন করলো তাঁর প্রতি বিনীত হয়ে এবং ভয়ের সাথে সে এ পৃথিবীর দুঃখকষ্ট থেকে নিরাপত্তা লাভ করলো এবং আখেরাতের শাস্তি থেকে মুক্ত থাকলো। আল-সালাম (শান্তি) আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার নামগুলোর একটি , যা তিনি তাঁর সৃষ্টির কাছে আমানত দিয়েছেন যেন তারা তা ব্যবহার করে তাদের আচার ব্যবহারে , আমানত রক্ষায় এবং চুক্তিতে এবং তাদের সাথীদের সমর্থনে ও সমাবেশগুলোতে এবং তাদের সুস্থ সামাজিক সম্পর্কের জন্য।

যদি তুমি সালামকে এর যথাযথ জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করতে চাও এবং এর অর্থ পরিপূর্ণ করতে চাও তাহলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাকে ভয় করো এবং তোমার বিশ্বাস , তোমার অন্তর ও তোমার বুদ্ধিকে সুস্থ করো। এগুলোকে বিদ্রোহের অন্যায় দিয়ে কালিমাযুক্ত করো না। তোমার অভিভাবকরা যেন তোমার কাছ থেকে নিরাপদ থাকে ; তাদের প্রতি তোমার দুর্ব্যবহার দিয়ে তাদেরকে দুশ্চিন্তাযুক্ত অথবা বিরক্ত অথবা দূরে সরিয়ে দিও না , তোমার বন্ধুদের সাথেও করো না এবং তোমার শত্রুদের সাথেও করো না। যদি কোন ব্যক্তির নিকটজনরা তার কাছ থেকে নিরাপদ না থাকে তাহলে যারা তার কাছ থেকে সবচেয়ে দূরে তারা সবচেয়ে নিরাপদ। যে ব্যক্তি সালামকে এর যথাযোগ্য স্থানে প্রতিষ্ঠিত করে না যখন তা প্রতিষ্ঠা করা উচিত তাহলে তার না আছে শান্তি , না আছে আত্মসমর্পণ। সে তার সালামে মিথ্যাবাদী যদি সে লোকজনের মাঝে তা ব্যবহার করে শুভেচ্ছা আকারেও।

জেনে রাখো মানুষের অস্তিত্ব বজায় আছে এ পৃথিবীর পরীক্ষা ও দুঃখ কষ্টের মাঝে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাকে পরীক্ষা করতে পারেন তাঁর রহমত দিয়ে , তার কৃতজ্ঞতাবোধ দেখার জন্য অথবা দুঃখকষ্ট দিয়ে দেখার জন্য যে সে তাঁকে মেনে চলার বিষয়ে দৃঢ়তা ও উঁচু মানসিকতা প্রদর্শন করে কিনা , অথবা তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহে অসম্মানিত হয় কিনা , যদিও তাঁর সন্তুষ্টি ও রহমতে পৌঁছা যায় না তাঁর অনুগ্রহ ছাড়া। তাকে মেনে চলার একমাত্র উপায় হচ্ছে যখন তিনি সফলতা দান করেনঃ কেউ তাঁর কাছে সুপারিশ করতে পারে না তার অনুমতি ও রহমত ছাড়া।

পরিচ্ছেদ-১২

তওবা

তওবা হচ্ছে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার রশি এবং তাঁর বান্দাহদের জন্য মনোযোগের প্রধান মাধ্যম যাদেরকে অবশ্যই অনুতপ্ত থাকতে হবে প্রত্যেক অবস্থায়। বান্দাহদের প্রত্যেক দলেরই রয়েছে এর নিজস্ব ধরনের তওবা।

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর তওবা হচ্ছে বাইরের বিরক্তি উদ্রেককারী উৎসের কারণে ভেতরের গভীরতম সত্তায় যে অস্থিরতার সৃষ্টি হয় তার জন্য এবং আউলিয়াদের তওবা আসে তাদের চিন্তার রঙে পরিবর্তন ঘটা থেকে , পরিশুদ্ধদের (আবরার) তওবা নিহিত থাকে তাদেরকে যা সামান্যতম পীড়ন করে তা শান্তভাবে পরিত্যাগ করার ভেতরে , উচ্চস্থানীয়দের তওবা হলো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ছাড়া অন্য বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে এবং সাধারণ মানুষের তওবা অন্যায় কাজের কারণে। এদের প্রত্যেকেই তাদের তওবার কারণ ও উদ্দেশ্য জানে এবং সে সম্পর্কে সচেতন। কিন্তু এখানে এসব সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে অনেক লম্বা সময় প্রয়োজন হবে।

সাধারণ মানুষের তওবা হলো সে তার অভ্যন্তরীণ সত্তাকে অনুতাপের পানি দিয়ে ধোয় এবং তার ভুল কাজকে সর্বক্ষণ স্বীকার করে। সে যা করেছে তার জন্য দুঃখ করে এবং তার জীবনের যতটুকু বাকী আছে তা নিয়ে ভয় করে। সে তার অন্যায় কাজগুলোকে সামান্য ভাবে না যে , সেক্ষেত্রে তা তাকে অলসতার দিকে নিয়ে যাবে ; সে যা হারিয়েছে তার জন্য তার ক্রমাগত কান্না এবং দুঃখ করাটাও একটি ইবাদাত। তার উচিত নিজেকে পৃথিবীর ক্ষুধা থেকে বিরত রাখা এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সাহায্য চাওয়া তওবা করার জন্য এবং সে কাজ আবার করা থেকে তাকে রক্ষা করার জন্য যা সে আগে করেছে। সে নিজেকে অজ্ঞতা ও ইবাদাতের উঠানে প্রশিক্ষণ দেয় । সে বাধ্যতামূলক কাজগুলো যেগুলো সে আগে করে নি তা পূরণ করে এবং সে সাহায্যের জন্য অন্যদের ডাকে সাড়া দেয়। অসৎসঙ্গ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয় , রাতে জেগে কাটায় , দিনের বেলায় পিপাসার্ত থাকে , তার সম্পত্তির উপরে সর্বক্ষণ ভাবে এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে সাহায্য চায় , তাঁর কাছে অনুরোধ করে আরাম ও দুঃসময়ে তাকে দৃঢ় রাখার জন্য এবং তার পরীক্ষা ও দুঃখ দুর্দশায় স্থির রাখার জন্য যেন সে তওবাকারীদের মাক্বাম থেকে নীচে পড়ে না যায়। এটি তাকে তার অন্যায় কাজ থেকে পবিত্র করবে , তার জ্ঞান বৃদ্ধি করবে এবং তার মর্যাদা উঁচুতে উঠানো হবে। যেভাবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেনঃ

) ف َلَيَعْلَمَنَّ اللَّـهُ الَّذِينَ صَدَقُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِينَ(

‘‘ আর আল্লাহ অবশ্যই তাদেরকে জেনে নিবেন যারা সত্যবাদী এবং অবশ্যই জেনে নিবেন মিথ্যাবাদীদের।’’ (সূরা আনকাবুতঃ ৩)

নিজেকে গুটিয়ে নেয়া ( উযলাহ )

যে ব্যক্তি পৃথিবী থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাকে দুর্গের ভেতর নেন এবং নিরাপত্তা দেন তার অভিভাবকত্বের (বেলায়েতের) মাধ্যমে। যে ব্যক্তি নিজেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে আল্লাহর কাছে গুটিয়ে নিয়েছে তার কীইনা আনন্দ , এটি করার জন্য তাকে অবশ্যই পার্থক্য করতে হবে সত্য ও মিথ্যার মধ্যে , দারিদ্র্যকে ভালোবাসতে হবে , দুঃখ কষ্ট এবং বিরত থাকাকে বেছে নিতে হবে এবং নিজেকে গুটিয়ে নেয়ার প্রত্যেকটি সুযোগ গ্রহণ করতে হবে। তাকে অবশ্যই তার প্রত্যেকটি কাজের ফলাফল নিয়ে ভাবতে হবে , ইবাদাত করবে যত বেশী সম্ভব , অহংকার পরিত্যাগ করবে এবং সর্বক্ষণ যিকর-এ নিয়োজিত থাকবে উদাসীনতা ছাড়া যা হলো শয়তানের শিকারের ভূমি এবং প্রত্যেক দুর্দশার শুরু , আর এসব কিছুর কারণ অষ্পষ্ট। তার উচিত তার বাড়ি থেকে সব কিছু বিদায় করে দেয়া যার শীঘ্রই কোন প্রয়োজন নেই।

ঈসা (আ.) বলেছেনঃ‘‘ তোমার জিহবাকে পাহারা দাও যেন তোমার অন্তরে উন্নয়ন ঘটাতে পারো এবং তোমার বাসস্থানকে তোমার জন্য যথেষ্ট বানাও। লোক দেখানো এবং অতিরিক্ত রিয্ক থাকা থেকে সাবধান থাকো। তোমার রবের সামনে নম্র হও এবং তোমার ভুলের জন্য কাঁদো। লোকজন থেকে পালাও যেভাবে তুমি পালাও সিংহ ও বিষাক্ত সাপ থেকে। সেগুলো ছিলো ঔষধ এবং এখন সেগুলো রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে । এরপর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সাথে সাক্ষাত করো যেখানে তুমি চাও। রাবি ইবনে কুসাইম বলেছিলোঃ‘‘ যদি তুমি আজ এমন কোন স্থানে যেতে পারো যেখানে তুমি কাউকে চেনো না এবং যেখানে তোমাকে কেউ চেনে না তাহলে তাই করো।’’

নিজেকে গুটিয়ে নিলে তা আনে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জন্য নিরাপত্তা , একটি মুক্ত অন্তর , সুস্থ রিয্ক , শয়তানের অস্ত্রগুলোর ধ্বংস , প্রত্যেক খারাপকে এড়িয়ে চলা এবং অন্তরের জন্য বিশ্রাম। কোন নবী নেই এবং কোন নবীর ওয়াসী নেই যে তার জীবনে একবার নিজেকে গুটিয়ে নেয় নি , হয় তার শুরুতে অথবা তার শেষে।

নিরব থাকা

নিরবতা তাদের চিহ্ন যারা সেসব বাস্তবতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে যা ইতোমধ্যেই এসেছে এবং যার বিষয়ে কলম ইতোমধ্যেই লিখেছে। এটি হচ্ছে এ পৃথিবী ও আখেরাতের সব বিশ্রামের চাবি : এটি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সন্তুষ্টি আনে , আমলের হিসাবকে সহজ করে এবং এটি ভুলত্রুটি থেকে একটি নিরাপত্তা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা এটিকে পর্দা বানিয়েছেন মূর্খদের জন্য এবং অলংকার বানিয়েছেন জ্ঞানীদের জন্য।

নিরবতার মাধ্যমে কামনা-বাসনাকে একপাশে সরিয়ে রাখা যায় এবং এর সাথে আসে আত্ম-শৃঙ্খলা , ইবাদাতের মিষ্টতা , হৃদয়ের কাঠিন্য দূরীভূত হওয়া , বিরত থাকা , ধার্মিকতা এবং জ্ঞান ভান্ডার। অতএব তোমার জিহবাকে তালা মারো সে কথার উপরে যা অত্যন্ত জরুরী নয় , বিশেষ করে যখন তুমি দেখো তুমি কারো সাথে কথা বলবে এমন কোন যোগ্য লোক দেখছো না ; তখন ছাড়া যখন তুমি একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সাথে সম্পর্কিত বিষয়ে কথা বলছো।

রাবি ইবনে কুসাইম একটি মোটা কাগজ তার সামনে রাখতো যার উপরে সে লিখে রাখতো সে দিনের বেলায় কী বলেছে। রাতে সে নিজে নিজের হিসাব নিতো তার বেঁচে থাকাকালেই। দেখতো সে কী বলেছে নিজের পক্ষে এবং নিজের বিপক্ষে। এরপর সে বলতোঃ‘‘ হায় , যারা নিরব তারা রক্ষা পেয়েছে।’’

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর একজন সাহাবী তার মুখের ভেতরে নুড়িপাথর ভরে রাখতো। যখন সে কিছু বলতে চাইতো তখন যদি সে জানতো তা আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তায়ালার প্রতি , আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তায়ালার পথে এবং আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তায়ালার জন্য , তখন সে তার মুখের ভেতর থেকে তা বের করতো। সাহাবীদের অনেকেই এমনভাবে শ্বাস প্রশ্বাস নিতেন যেন মনে হতো কোন ডুবন্ত মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস এবং কথা বলতেন অসুস্থ মানুষের মত।

মানুষের ধ্বংস নিহিত আছে তার কথা-বার্তা ও নিরবতার মাঝে

সৌভাগ্য তাদের যাদেরকে কথাবার্তায় কী সঠিক ও কী ভুল এ সম্পর্কে এবং নিরবতার বিজ্ঞান ও এর সুবিধাগুলো সম্পর্কে জ্ঞান দেয়া হয়েছে। কারণ এটি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর গুণাবলীর একটি এবং নির্বাচিত ব্যক্তিদের বিশেষ চিহ্ন। যে কথার মূল্য বোঝে সে নিরবতার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। যদি ব্যক্তিকে নিরবতার সুক্ষ্ণ বিষয়গুলো দেখানো হয় এবং এর মূল্যবান ভান্ডার তার কাছে গচ্ছিত রাখা হয় তখন তার কথা ও নিরবতা উভয়ই ইবাদাত। এ ইবাদাতের রহস্য শুধু তিনিই জানেন যিনি সবার বাদশাহ , সর্ববাধ্যকারী আল্লাহ।

বুদ্ধি ও কামনা-বাসনা

বুদ্ধিমান মানুষ যা সত্য তার কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং তার বক্তব্য হয় ন্যায়পরায়ণ ; যা মিথ্যা তা থেকে সে কুঁকড়ে সরে যায় এবং তার কথায় এর বিরোধিতা করে। সে এ পৃথিবীকে পিছনে ঠেলে দেয় কিন্তু তার বিশ্বাসকে ত্যাগ করে না।

বুদ্ধিমান মানুষের প্রমাণ দু টো জিনিসে নিহিত : সত্য কথা এবং সঠিক কাজ। বুদ্ধিমান মানুষ এমন কিছু বলে না যা বুদ্ধি প্রত্যাখ্যান করে , না সে নিজেকে সন্দেহে পড়তে দেয় , না সে পরিত্যাগ করে তাদের সাহায্য যারা পরীক্ষিত। তার কাজকর্মে জ্ঞান পথ দেখায় ; যে পথে সে চলে সেখানে ইরফান (আধ্যাত্মিক জ্ঞান) তার নিশ্চয়তা এবং সহনশীলতা তার সার্বক্ষণিক সাথী। কামনা-বাসনা বুদ্ধির শত্রু , সত্যের প্রতিপক্ষ এবং মিথ্যার সাথী। কামনা-বাসনার শক্তি আসে দুনিয়ার ক্ষুধা থেকে এবং এর প্রাথমিক প্রকাশ হচ্ছে হারাম কাজ করা , দায়িত্বে অবহেলা করা , সুন্নাহকে হালকা করে দেখা এবং আনন্দ ফুর্তিতে মগ্ন হওয়া।

পরিচ্ছেদ-১৩

ঈর্ষা

একজন ঈর্ষাপরায়ণ ব্যক্তি আগে নিজেরই ক্ষতি করে যার প্রতি সে ঈর্ষাপরায়ণ তাকে ক্ষতি করার আগে , ঠিক যেমনটি ঘটেছিলো ইবলিসের বেলায়। তার ঈর্ষার কারণে সে অভিশাপকে নিজের উপরে বয়ে এনেছিলো , অথচ আদমের জন্য সে এনেছিলো নির্বাচন , হেদায়েত , প্রকৃত চুক্তির স্তরে আরোহণ এবং বাছাই হওয়া। অতএব তোমার প্রতি ঈর্ষা করা হোক ঈর্ষাকাতর হওয়ার চাইতে , কারণ ঈর্ষাপরায়ণের শাস্তি সবসময় যাকে ঈর্ষা করা হয় তার চেয়ে বেশী ; এভাবেই রিয্ক(জীবনোপকরণ) নির্ধারন করা হয়।

লোভ

বলা হয়েছে যে কাব আল আহবারকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো বিশ্বাসের মধ্যে সবচেয়ে সুস্থ জিনিস এবং সবচেয়ে কলুষিত কী ? সে উত্তর দিয়েছিলোঃ সবচেয়ে সুস্থ জিনিস হলো সতর্কতা এবং সবচেয়ে কলুষিত হলো লোভ।

সম্পদের লোভ হচ্ছে শয়তানের মদ , যা সে নিজ হাতে তুলে দেয় তার পছন্দনীয়দের জন্য। যে এতে মাতাল হয় সে আল্লাহর শাস্তির ব্যাথ্যতেই শুধু ভদ্র হয় -যে তাকে এ পানীয় দিয়েছিলো তার নিকটে অবস্থান করে। বিশ্বাসের বদলে মানুষের এ পৃথিবী পছন্দ করা ছাড়া যদি লোভের জন্য আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তায়ালার পক্ষ থেকে শাস্তির আর কোন কারণ না থাকতো , তাহলেও তা মারাত্মক শাস্তির কারণ হতো। আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেনঃ

) أ ُولَـٰئِكَ الَّذِينَ اشْتَرَوُا الضَّلَالَةَ بِالْهُدَىٰ(

‘‘ তারা হলো যারা সঠিক পথের বিনিময়ে ভুল কিনে’’ (সূরা বাকারাঃ ১৬)

বিশ্বাসীদের আমীর বলেছেনঃ‘‘ তুমি যার প্রতি ইচ্ছা উদার হও এতে তুমি হয়ে যাবে তার রাজপুত্র। যার কাছ থেকে ইচ্ছা সাহায্য প্রার্থনা করো এতে তুমি তার সমান হয়ে যাবে। তুমি যার প্রয়োজনে থাকো তার হাতে তুমি বন্দী’’ । যে লোভী তার কাছ থেকে বিশ্বাস কেড়ে নেয়া হয় সে তা টেরও পায় না। কারণ বিশ্বাস বান্দাহকে সৃষ্টিগতভাবে লোভী হতে বাধা দেয়। তিনি আরও বলেছেনঃ‘‘ হে আমার বন্ধু , আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার ভান্ডার সম্মানের পদক দিয়ে পূর্ণ এবং যে ভালো আচরণ করে তাকে পুরস্কৃত করতে তিনি অবহেলা করেন না।’’

মানুষের যা আছে তা কলংকিত হয় ত্রুটি দিয়ে। বিশ্বাস তাকে উদ্বুদ্ধ করে আল্লাহর উপর আস্থা রাখতে , মধ্যপন্থায় , কামনা-বাসনা পরিত্যাগ , আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার আনুগত্যকে আঁকড়ে থাকতে এবং জনগণের বিষয়ে নিরাশ হতে। যদি সে তা করে তাহলে তার বিশ্বাসের কাছেই আছে এবং সঠিক পথ অবলম্বন করেছে । যদি সে তা না করে তাহলে বিশ্বাস তাকে ছেড়ে যায় এবং তাকে তার খারাপ প্রকৃতির কাছে ফেলে যায়।

ভালোর আদেশ করা ও খারাপকে নিষেধ করা

যে ব্যক্তি তার দুঃচিন্তা ছুঁড়ে ফেলে নি , তার নিজের সত্তার খারাপ ও তার ক্ষুধা থেকে পবিত্র হয় নি , শয়তানকে পরাজিত করে নি এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার বেলায়েতের অধীনে এবং তাঁর নিরাপত্তার ভেতর প্রবেশ করে নি সে যথাযথভাবে ভালোর আদেশ এবং খারাপকে যথাযথভাবে নিষেধ করতে অক্ষম এবং যেহেতু সে উল্লেখিত গুণাবলী অর্জন করতে পারে নি , সে ভালোর আদেশ ও খারাপকে নিষেধ করার জন্য যে পদক্ষেপই গ্রহণ করুক তা তার বিরুদ্ধেই যাবে এবং জনগণ তা থেকে কোন উপকার লাভ করবে না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেনঃ

) أ َتَأْمُرُونَ النَّاسَ بِالْبِرِّ وَتَنسَوْنَ أَنفُسَكُمْ وَأَنتُمْ تَتْلُونَ الْكِتَابَ أَفَلَا تَعْقِلُونَ(

‘‘ কী ? তোমরা কি জনগণকে ভালো হওয়ার আদেশ দাও এবং নিজেদের সত্তাকে অবহেলা কর অথচ তোমরা কোরআন পড়ছো , তোমরা কি বুঝ না ?’’ (সূরা বাকারাঃ 44)

যে তা করে তাকে ডেকে বলা হয়ঃ‘‘ হে বিশ্বাসঘাতক , তুমি কি আমার সৃষ্টি থেকে তা দাবী কর যা তুমি নিজে প্রত্যাখ্যান করেছো এবং নিজের উপর লাগামকে (এই বিষয়ে) ঢিল দিয়েছো ?’’

বর্ণিত আছে যে আলাবা আল আসাদি রাসূলুল্লাহকে (সা.) এ আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেঃ

) ي َا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا عَلَيْكُمْ أَنفُسَكُمْ لَا يَضُرُّكُم مَّن ضَلَّ إِذَا اهْتَدَيْتُمْ(

‘‘ হে যারা বিশ্বাস কর , নিজেদের সত্তার যত্ন নাও ; যে ভুল করে সে তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারে না যখন তোমরা সঠিক পথে আছো।’’ (সূরা মায়িদাঃ 105)

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ‘‘ ভালোর আদেশ দাও এবং খারাপকে নিষেধ করো এবং যে ক্ষতি তোমাদের স্পর্শ করে তা সহ্য কর , ঐ সময় পর্যন্ত যখন তোমরা দেখতে পাও নীচতাকে মেনে চলা হচ্ছে , আবেগকে অনুসরণ করা হচ্ছে এবং যখন প্রত্যেকেই তার নিজের মতামতকে বড় করে দেখবে , তখন তোমরা শুধু নিজেদের বিষয়ে মনোযোগ দাও এবং সাধারণ জনগণের বিষয়গুলো উপেক্ষা করে যাও।’’

যে ব্যক্তি ভালোর আদেশ দেয় তার জানা দরকার কী অনুমোদিত এবং কী নিষিদ্ধ ; অবশ্যই সে যেন সে বিষয়ে নিজের পছন্দ-অপছন্দ থেকে মুক্ত থাকে যখন সে ভালোর আদেশ দেয় , জনগনকে ভালো উপদেশ দেয় , যেন তাদের প্রতি ক্ষমাশীল ও দয়ালু হয় এবং তাদের নরমভাবে ও পরিষ্কারভাবে আহবান করে এবং সেইসাথে তাদের বিভিন্ন চরিত্র সম্পর্কেও খেয়াল রাখে , যেন সে প্রত্যেককে তার যথাযথ স্থানে রাখতে পারে।

তাকে অবশ্যই দৃষ্টি রাখতে হবে নফসের চালাকি এবং শয়তানের ফাঁদ-এর দিকে। তাকে অবশ্যই ধৈর্য ধরতে হবে যদি কোন বিপদ আপদ আসে এবং যে বিষয়ে সে তাদেরকে উপদেশ দেয় সে বিষয়ে অবশ্যই সে জনগণের কাছ থেকে তার কোন প্রতিদান নিবে না , না তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করবে। সে অবশ্যই আক্রমণাত্মক ও আবেগপূর্ণ হবে না। সে নিজের জন্য রাগান্বিত হবে না। সে অবশ্যই নিজের নিয়তকে একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার জন্য স্থির করবে এবং তাঁর সাহায্য চাইবে এবং তাকেই চাইবে। কিন্তু যদি জনগণ তার বিরোধিতা করে এবং তার প্রতি কর্কশ আচরণ করে তাহলে তাকে অবশ্যই ধৈর্য ধরতে হবে এবং যদি তারা তার সাথে একমত হয় এবং তার মতকে গ্রহণ করে , তাহলে তাকে অবশ্যই কৃতজ্ঞ হতে হবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে , তার কাছে নিজেকে সমর্পণ করবে এবং সে নিজের ত্রুটিগুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখবে।

পরিচ্ছেদ-3

কীভাবে জ্ঞানী ব্যক্তিরা ধ্বংস হয়

তাক্বওয়া (সতর্কতা) এবং ভয় হলো জ্ঞানের উত্তরাধিকার এবং এর পরিমাপ। জ্ঞান হচ্ছে আধ্যাত্মিকতার রশ্মি এবং ঈমান -এর হৃদয় । যে তাক্বওয়া (সতর্কতা) উপেক্ষা করেছে সে জ্ঞানী ব্যক্তি নয় , এমনও যদি হয় সে জ্ঞানের অস্পষ্ট বিষয়গুলো সম্পর্কে চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে পারে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেনঃ

) إ ِنَّمَا يَخْشَى اللَّـهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ(

‘‘ তাঁর দাসদের মাঝে একমাত্র জ্ঞানী ব্যক্তিরাই আল্লাহকে ভয় পায়।’’ ( সূরা ফাতিরঃ 28)

জ্ঞানী ব্যক্তিরা আটটি জিনিসে ধ্বংস হয়ঃ লোভ এবং কৃপণতা , লোক দেখানো (রিয়া) এবং স্বজনপ্রীতি , প্রশংসার প্রতি ভালোবাসা , সে বিষয়ের ভিতরে সন্ধান করা যার বাস্তবতায় তারা পৌঁছাতে অক্ষম , অতিরঞ্জিত প্রকাশভঙ্গি দিয়ে বক্তব্যকে সৌন্দর্যমন্ডিত করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করা , আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সামনে বিনয়ের অভাব , আত্মম্ভরিতা এবং যা জানে সে অনুযায়ী কাজ না করা।

ঈসা (আ.) বলেছেনঃ মানুষের মধ্যে সবচেয়ে ঘৃণ্য হলো ঐ ব্যক্তি যে তার জ্ঞানের জন্য প্রসিদ্ধ , তার কাজের জন্য নয়।’’ রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ‘‘ কোন বেয়াদব আহবানকারীর সাথে বসো না যে তোমাকে আহবান করে নিশ্চিত জ্ঞান থেকে সন্দেহের দিকে , আন্তরিকতা থেকে লোক দেখানোর দিকে , বিনয় থেকে অহংকারের দিকে , সৎ উপদেশ থেকে শত্রুতার দিকে এবং আত্মনিয়ন্ত্রণ থেকে আকাঙ্ক্ষার দিকে। তার কাছে যাও যে জ্ঞানী , যে তোমাকে আহবান করে অহংকার থেকে বিনয়ের দিকে , লোক দেখানো থেকে আন্তরিকতার দিকে , সন্দেহ থেকে নিশ্চিত জ্ঞানের দিকে , আকাঙ্ক্ষা থেকে আত্মনিয়ন্ত্রণের দিকে , শত্রুতা থেকে সৎ উপদেশ-এর দিকে।’’ কোন ব্যক্তিই সৃষ্টির কাছে উপদেশ দেয়ার যোগ্যতা রাখে না শুধু সে ছাড়া যে এ খারাপ জিনিসগুলোকে পিছনে ফেলতে পেরেছে তার সত্যবাদিতার মাধ্যমে। সে বক্তৃতার ত্রুটিগুলো দেখতে পায় এবং জানে কী সঠিক ও কী সঠিক নয় এবং চিন্তার ক্রটিসমূহ এবং নফসের লালসা ও আকাঙ্ক্ষাগুলো সম্পর্কে জানে।

ইমাম আলী (আ.) বলেছেনঃ‘‘ দয়ালু ও স্নেহশীল চিকিৎসকের মত হও যে ওষুধ নিবার্চন করে যা উপকারী হবে।’’ তারা ঈসাকে (আ.) জিজ্ঞেস করলোঃ‘‘ কার সাথে আমরা বসবো , হে রুহুল্লাহ ?’’

তিনি বললেনঃ‘‘ তার সাথে যার চেহারা তোমাকে আল্লাহর কথা মনে করায় এবং যার কথা তোমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে এবং যার কাজ তোমাকে আখেরাতকে পেতে উৎসাহিত করে।’’

নিজেকে পাহারা দেয়া ( রিয়াইয়াহ )

যে তার হৃদয়কে কোন কিছু না শোনার প্রবৃত্তি থেকে রক্ষা করে , নফসকে ক্ষুধা থেকে রক্ষা করে এবং অজ্ঞতার বিরুদ্ধে বুদ্ধিকে রক্ষা করে তাকে মুত্তাকীদের দলে প্রবেশ করানো হবে। এরপর যে তার জ্ঞানকে কল্পনাবিলাস থেকে রক্ষা করবে এবং সম্পদকে হারাম থেকে , তাকে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভূক্ত করা হবে।

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ‘‘ প্রত্যেক মুসলিম নর ও নারীর জন্য জ্ঞান সন্ধান করা বাধ্যতামূলক।’’ আর তাহলো নিজ সত্তা সম্পর্কে জ্ঞান। অতএব সত্তার জন্য প্রয়োজন যে সে প্রত্যেক অবস্থায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে অথবা কৃতজ্ঞতার অভাব স্বীকার করে ক্ষমা চাইবে। যদি তা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে গ্রহণযোগ্য হয় তাহলে তা হবে তার উপরে একটি নেয়ামত এবং যদি না হয় তাহলে তা হবে তার প্রতি (আল্লাহর) ন্যায়বিচার। প্রত্যেক সত্তার জন্য কাজ করা প্রয়োজন যেন তা আনুগত্যের কাজগুলোতে সফলতা লাভ করে এবং ক্ষতিকর কাজ করা থেকে বিরত থাকার চেষ্টাকে রক্ষা করে চলে।

এসবের ভিত্তি হচ্ছে সব প্রয়োজন ও নির্ভরতা একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার উপরে তা বুঝতে পারা এবং তাক্বওয়া ও আনুগত্য। এর চাবি হচ্ছে তোমার বিষয়গুলো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে ছেড়ে দেয়া , সব সময় মৃত্যুকে স্মরণ করে পাওয়ার আশাকে কেটে ফেলা এবং সর্ব-বাধ্যকারী আল্লাহর সামনে তুমি দাঁড়িয়ে আছো তা ভাবা। এটি তোমাকে বিশ্রাম দিবে বন্দীত্ব থেকে , উদ্ধার করবে শত্রু থেকে এবং সত্তাকে শান্তি দিবে । ইখলাস অর্জনের পথ হচ্ছে সুশৃংখল আনুগত্য এবং তার মূল নির্ভর করে জীবনকে একটি দিন -এর মত বিবেচনা করাতে।

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ‘‘ এই পৃথিবীর জীবন এক ঘন্টার মত , তাই একে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার আনুগত্যে ব্যয় করো।’’ এ সবকিছুর দিকে দরজা হচ্ছে সর্বক্ষণ গভীর ভাবনার মাধ্যমে পৃথিবী থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া। এ গুটিয়ে নেয়ার উপায় হচ্ছে সন্তুষ্টি এবং এমন সব পার্থিব বিষয় পরিত্যাগ করা যা তোমার সাথে সম্পর্কিত নয়। গভীর ভাবনার পথ হলো শূন্যতা (আকাঙ্ক্ষাবিহীনতা) এবং শূন্যতার খুঁটি হচ্ছে নফসকে বিরত রাখা বিরত থাকার পূর্ণতা হলো তাক্বওয়া (সতর্কতা) এবং তাক্বওয়ার দিকের দরজা হলো ভয়। ভয়-এর প্রমাণ হলো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার হামদ ও তাসবীহ করা , আন্তরিকতার সাথে তার আদেশ মেনে চলাতে লেগে থাকা , ভয় ও সতর্কতা , এবং নিষিদ্ধ জিনিস থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখা ; আর এই পথের পথপ্রদর্শক হচ্ছে জ্ঞান।

সর্বশক্তিমান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেনঃ

) إ ِنَّمَا يَخْشَى اللَّـهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ(

‘‘ তাঁর দাসদের মধ্যে তারাই আল্লাহকে ভয় করে যারা জ্ঞানী।’’ (সূরা ফাতিরঃ 28)

কৃতজ্ঞতা

প্রত্যেক শ্বাস নেয়ার সাথে তোমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত , নিশ্চয়ই হাজার ধন্যবাদ অথবা তারও বেশী। কৃতজ্ঞতার সবচেয়ে নিচের স্তর হচ্ছে রহমত আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছ থেকে আসছে তা দেখতে পাওয়া , তার কারণ যাই হোক না কেন এবং সে কারণের সাথে হৃদয় যুক্ত না থাকা। এতে আছে-যা দেয়া হয়েছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা ; এর অর্থ হচ্ছে তাঁর দেয়া নেয়ামতের বিষয়ে তার অবাধ্য না হওয়া অথবা তাঁর আদেশ ও নিষেধগুলোর বিরোধিতা না করা-তাঁর দান করা নেয়ামতের কারণে।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার একজন কৃতজ্ঞ দাস হও সবদিক থেকে , তাহলে তুমি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাকে সবদিক থেকে উদার রব হিসাবে দেখতে পাবে। যদি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার মুখলেস দাসদের জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার ইবাদাতে প্রত্যেক অবস্থায় ধন্যবাদ জানানোর চাইতে কোন উত্তম পথ থাকতো তাহলে তিনি ঐ ইবাদাতকে অন্য সব সৃষ্টির উপরে নাম দিতেন। যেহেতু এর চাইতে উত্তম কোন ইবাদাত নেই তাই তিনি সব ইবাদাতের মধ্যে এ ইবাদাতকে বাছাই করেছেন এবং যারা এ ধরনের ইবাদাত করে তাদেরকে বাছাই করেছেন এই বলেঃ

) و َقَلِيلٌ مِّنْ عِبَادِيَ الشَّكُورُ(

‘‘ আমার দাসদের মধ্যে খুব অল্প ক জনই কৃতজ্ঞতা স্বীকারকারী।’’ (সূরা সাবাঃ 13)

পূর্ণ কৃতজ্ঞতা স্বীকার হলো সবচেয়ে কম কৃতজ্ঞতা প্রকাশে তোমার অক্ষমতা নিয়ে দুঃখ করা এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার প্রশংসা আন্তরিকভাবে করার মাধ্যমে তা প্রকাশ করা। কারণ ধন্যবাদ দেয়াটাও বান্দাহর উপর আল্লাহর একটি দান এবং এর জন্যও সে অবশ্যই ধন্যবাদ জানাবে। পূর্ববর্তী নেয়ামতের চাইতেও এটি বেশী মূল্যবান , যা তাকে প্রথম অবস্থায় ধন্যবাদ দিতে উদ্বুদ্ধ করেছিলো। তাই , যত বার একজন ধন্যবাদ দেয় তার জন্য উচ্চতর ধন্যবাদ দেয়া বাধ্যতামূলক হয়ে যায় এবং এভাবে তা চলবে অনন্তকাল পর্যন্ত , আর এভাবে সে তাঁর নেয়ামতে ডুবে থেকে কৃতজ্ঞতার সর্বোচ্চ অবস্থা অর্জনে অক্ষম হয়ে যায়। কারণ কীভাবে বান্দাহ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার নেয়ামতের সমান কৃতজ্ঞতা জানাবে এবং কীভাবে সে আল্লাহর কাজের সাথে নিজের কাজ সমান করবে যখন সবসময়ই বান্দাহ হলো দূর্বল এবং তার কোন রকম শক্তি নেই শুধুমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছ থেকে ছাড়া ?

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার তাঁর বান্দাহদের কাছ থেকে আনুগত্যের প্রয়োজন নেই , কারণ চিরকালের জন্য নেয়ামত বৃদ্ধি করে যাওয়ার ক্ষমতা তাঁর রয়েছে। অতএব আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার একজন কৃতজ্ঞ বান্দাহ হও এবং এভাবে তুমি আশ্চর্যজনক জিনিসগুলো দেখতে পাবে।

বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময়

যখন তুমি তোমার বাড়ি থেকে বের হও , তা এমনভাবে হও যেন তুমি আর ফেরত আসবে না। বের হও শুধু আল্লাহর আনুগত্য করার জন্য অথবা ঈমানের জন্য। তোমার আচার-আচরণে প্রশান্ত অবস্থা ও মর্যাদা বজায় রাখো এবং আল্লাহকে স্মরণ করো গোপনে ও প্রকাশ্যে।

আবু যার-এর সাথীদের একজন আবু যার-এর পরিবারের একজনকে জিজ্ঞেস করলো সে কোথায়। সে নারী বললোঃ‘‘ তিনি বাইরে গেছেন।’’

যখন ঐ ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলো কখন আবু যার ফিরবেন , ঐ নারী বললোঃ‘‘ কখন তিনি ফিরবেন তা আরেকজনের উপর নির্ভর করে , কারণ তার নিজের কোন ক্ষমতা নেই।’’ আল্লাহর ধার্মিক ও পথভ্রষ্ট বান্দাহদের কাছ থেকে শিখো , যেখানেই তুমি যাও। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে বলো তোমাকে তাঁর মুখলেস ও সত্যবাদী বান্দাহদের মাঝে স্থান দিতে এবং যারা চলে গেছে তাদের সাথে যুক্ত করতে এবং তাদের সাথে জড়ো করতে। তাঁর প্রশংসা করো এবং ধন্যবাদ দাও সে কারণে যেসব ক্ষুধা থেকে তিনি তোমাকে সরিয়ে রেখেছেন এবং অন্যায়কারীদের কুৎসিৎ কাজ থেকে তোমাকে তিনি রক্ষা করেছেন বলে। তোমার দৃষ্টিকে নামিয়ে রাখো অশ্লীল কামনা ও নিষিদ্ধ জিনিস থেকে এবং তোমার ভ্রমণে সঠিক পথ অনুসরণ করো। সতর্ক দৃষ্টি রাখো , আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাকে ভয় করো প্রত্যেক পদক্ষেপে , যেন তুমি পুলসিরাত পার হচ্ছো। মনযোগ হারিয়ো না। তাঁর লোকদেরকে সালাম বলো- প্রথমে সালাম দিয়ে এবং উত্তর দিয়ে। তাদের সাহায্য করো যারা সৎকাজের জন্য তা চায় , তাদের পথ দেখাও যারা পথ হারিয়ে ফেলেছে এবং মূর্খদের উপেক্ষা করো।

যখন তুমি বাড়িতে ফেরত আসো-এতে প্রবেশ করো যেভাবে একটি লাশ কবরে প্রবেশ করে , যার একমাত্র চিন্তা হলো আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা লাভ করা।

কোরআন তেলাওয়াতের বিষয়ে

যে কোরআন তেলাওয়াত করে এবং নিজেকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সামনে বিনয়ী করে না , যার অন্তর নরম হয় না , অনুতপ্ত হয় না এবং তাঁর ভিতরে ভয় জাগে না , সে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার বিষয়ের বিরাটত্বকে যথাযথ মূল্য দেয় না এবং সে স্পষ্টভাবে ক্ষতির মধ্যে আছে।

যে ব্যক্তি কোরআন তেলাওয়াত করবে তার তিনটি জিনিস প্রয়োজনঃ একটি ভীতিপূর্ণ অন্তর , প্রশান্ত ও গ্রহণে আগ্রহী শরীর এবং একটি যথাযথ তেলাওয়াতের স্থান।

যখন তার অন্তর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাকে ভয় করে তখন অভিশপ্ত শয়তান তার কাছ থেকে পালায়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেনঃ

) ف َإِذَا قَرَأْتَ الْقُرْآنَ فَاسْتَعِذْ بِاللَّـهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ(

‘‘ যখন তুমি কোরআন পড় , আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাও অভিশপ্ত শয়তান থেকে।’’ (সূরা নাহলঃ 98)

যখন সে সব ধরনের সংযুক্তি থেকে নিজেকে মুক্ত করে তখন তার অন্তর তেলাওয়াতে মগ্ন হয় এবং কোরআনের নূর ও এর উপকারিতা লাভে তাকে কোন কিছু বাধাগ্রস্থ করে না। যখন সে একটি নির্জন জায়গা পায় এবং মানুষজন থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেয় দু টি গুণাবলী নিয়ে- অন্তরের বিনয় এবং শারীরিক প্রশান্তি , তখন তার আত্মা এবং তার বাতেনী সত্তা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সাথে মিলন অনুভব করবে , এবং সে আবিষ্কার করবে ,সেই মিষ্টি স্বাদ যখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তার সৎকর্মশীল বান্দাহর সাথে কথা বলেন , কীভাবে তিনি তাদের সাথে তাঁর নম্রতা প্রকাশ করেন এবং তাদেরকে বাছাই করেন তাঁর বিভিন্ন সম্মানজনক চিহ্ন ও আশ্চর্যজনক নিদর্শনের জন্য। যদি সে সেই শরবতের এক পেয়ালা পান করে সে কখনোই আর এই অবস্থা ও এই মুহুর্তটির চেয়ে অন্য কিছুকে বেশী চাইবে না । সে এটিকে প্রত্যেক আনুগত্য ও মগ্নতার উপরে স্থান দিবে যেহেতু তাতে রয়েছে রবের সাথে কথপোকথন-কোন মাধ্যম ছাড়াই।

তাই সাবধান হও কীভাবে তুমি তোমার রবের কিতাব পড় , যিনি তোমার অভিভাবক , যাকে তুমি চাও , কীভাবে তুমি তাঁর আদেশে সাড়া দাও এবং তাঁর নিষেধগুলো এড়িয়ে চল এবং কীভাবে তুমি তাঁর সীমানা মেনে চল , কারণ তা এক মহাক্ষমতাবান কিতাবঃ

) ل َّا يَأْتِيهِ الْبَاطِلُ مِن بَيْنِ يَدَيْهِ وَلَا مِنْ خَلْفِهِ تَنزِيلٌ مِّنْ حَكِيمٍ حَمِيدٍ(

‘‘ মিথ্যা-এর মাঝে প্রবেশ করবে না সামনে থেকে অথবা পিছন থেকে , তা নাযিল হয়েছে প্রজ্ঞাবান ও প্রশংসিত-এর কাছ থেকে।’’ (সূরা হা-মীম আস-সাজদাহঃ 42)

অতএব তা তেলাওয়াত করো ধারাবাহিকভাবে এবং গভীর ভাবনার সাথে এবং তার প্রতিশ্রুতি ও হুমকির সীমানা মেনে চলো। এর উদাহরণ ও সতর্কবানীর উপর গভীরভাবে ভাবো। সতর্ক থাকো শুধু এর অক্ষরগুলোর তেলাওয়াতকে অযাচিত মর্যাদা দেয়া থেকে এবং একই সময়ে এর ভেতরে থাকা আইনগত সীমানা মেনে চলতে ব্যর্থ হওয়া থেকে।

পরিচ্ছেদ-4

পোষাক

বিশ্বাসীর পোষাকের শ্রেষ্ঠ অলংকার হচ্ছে তাক্বওয়া (সতর্কতা) এবং সবচেয়ে বেশী রহমতপ্রাপ্ত পোষাক হচ্ছে ঈমান। যেভাবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেনঃ

) و َلِبَاسُ التَّقْوَىٰ ذَٰلِكَ خَيْرٌ(

‘‘ এবং যে পোষাক পাহারা দেয় (অন্যায়ের বিরুদ্ধে) ; তা সর্বোত্তম।’’ (সূরা আরাফঃ 26)

বাইরের পোষাক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছ থেকে একটি নেয়ামত যা আদমের সন্তানদের ভদ্রতা বজায় রাখার জন্য দেয়া হয়েছে ; এটি সম্মানের একটি চিহ্ন যা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আদমের বংশধরদের দিয়েছেন। তিনি এ সম্মান অন্য কোন প্রাণীকে দেন নি। এটি বিশ্বাসীদের দেয়া হয়েছে তাদের দায়িত্ব পালনের একটি মাধ্যম হিসাবে। তোমার শ্রেষ্ঠ পোষাকগুলো হচ্ছে সেগুলো যা তোমাকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার দিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে দেয় না , যে পোষাকগুলো প্রকৃতপক্ষে তোমাকে আল্লাহর স্মরণ এবং তাঁর কৃতজ্ঞতা এবং আনুগত্যের কাছে আনে। যেগুলো তোমাকে পরিচালিত করে না অহংকার , ধোঁকা , কপটতা , গর্ব অথবা দাম্ভিকতার দিকে ; কারণ এগুলো ধ্বংসকারী দুর্যোগ এবং এসবের পরিণতি হচ্ছে হৃদয়ের কাঠিন্য।

যখন তুমি তোমার পোষাক পরবে তখন স্মরণ করো যে আল্লাহ তাঁর রহমত দিয়ে তোমার ভুল কাজগুলো ঢেকে দেন। তোমার উচিত তোমার ভিতরের অংশকে ঢেকে দেয়া যেভাবে তুমি তোমার পোষাক দিয়ে বাইরের অংশকে ঢেকে দিচ্ছো। তোমার ভিতরের সত্য ঢেকে যাক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার ভয়ে এবং তোমার বাইরের সত্য ঢেকে যাক আনুগত্যে।

আল্লাহর উপচে পড়া নেয়ামতকে স্মরণ রাখো। যেহেতু তিনি শারীরিক অভদ্রতা ঢাকতে পোষাক তৈরীর উপায় উপকরণ সৃষ্টি করেছেন এবং দরজা খুলে দিয়েছেন তওবা , অনুতাপ ও সাহায্য প্রার্থনার জন্য , যেন ভিতরের অংশ এবং সেগুলোর ভুল কাজ ও খারাপ চরিত্রকে ঢেকে দিতে পারেন।

অন্যের দোষ প্রকাশ করে দিও না যেহেতু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তোমার ভিতরে এর চেয়ে খারাপ জিনিস গোপন করেছেন। নিজের ক্রটিগুলো নিয়ে চিন্তা করো এবং সে বিষয় ও পরিস্থিতিগুলো উপেক্ষা করো যা তোমার সাথে সম্পর্কিত নয়। সাবধান থাকো হয়তো তুমি অন্যের কাজ কর্মের বিষয়ে নিজের জীবনকে খরচ করে ফেলবে এবং তোমাকে দানকৃত অপূরণীয় সম্পদ অন্যের সাথে বিনিময় করে ফেলবে এর মাধ্যমে নিজেকে ধ্বংস করে ফেলবে। অন্যায় কাজগুলোকে ভুলে যাওয়া আল্লাহর সবচেয়ে বড় শাস্তি আনে এ পৃথিবীতে এবং আখেরাতে তা হয় শাস্তির প্রধান কারণ। যতক্ষণ বান্দাহ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাকে মেনে চলায় ব্যস্ত থাকে , নিজের দোষগুলো স্বীকার করে এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার প্রতি ঈমান কমে যাবে এমন জিনিস পরিত্যাগ করে তখন সে ধ্বংস থেকে রক্ষা পায় এবং সে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার রহমতের সমূদ্রে নিমজ্জিত হয় এবং প্রজ্ঞা ও স্বচ্ছ জ্ঞানের মুক্তা ও উপকারিতা লাভ করে।

কিন্তু যখন সে ভুলে যায় নিজের অন্যায় কাজগুলো এবং নিজের ক্রটিগুলো সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে এবং তার ক্ষমতা ও শক্তিতে পিছিয়ে পড়ে , সে কখনো সফল হবে না।

লোক দেখানো ( রিয়া )

নিজের কাজকে এমন কাউকে দেখিও না যে না পারে জীবন দিতে আর না পারে মৃত্যু দিতে এবং যে তোমার বোঝা নিতে পারে না। লোক দেখানো হলো একটি গাছ যার ফল হচ্ছে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সাথে অন্য খোদাদের গোপনে শরীক করা এবং এর শিকড় হচ্ছে মোনাফেক্বী। বিচার দিনে মোনাফেক্বকে বলা হবেঃ‘‘ তোমার কাজের পুরস্কার যা তুমি মনে কর তা নাও তাদের কাছ থেকে যাদেরকে তুমি আমার অংশীদার হিসেবে নিয়েছিলে। তাদের কাছে চাও যাদের ইবাদাত তুমি করেছিলে এবং ডেকেছিলে , যাদের কাছ থেকে তুমি আশা করেছিলে এবং যাদেরকে তুমি ভয় করতে। জেনে রাখো তোমার ভিতরের কোন কিছু আল্লাহর কাছ থেকে লুকাতে পারো নাঃ তুমি প্রতারিত হবে তোমাকে দিয়েই।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেনঃ

) ي ُخَادِعُونَ اللَّـهَ وَالَّذِينَ آمَنُوا وَمَا يَخْدَعُونَ إِلَّا أَنفُسَهُمْ وَمَا يَشْعُرُونَ(

‘‘ তারা ধোঁকা দিতে চায় আল্লাহকে ও বিশ্বাসীদের , কিন্তু তারা নিজেদেরকেই ধোঁকা দেয় এবং তারা তা বুঝে না। (সূরা বাকারাঃ 9)

লোক দেখানো সবচেয়ে বেশী ঘটে যেভাবে মানুষ অন্যের দিকে তাকায় , কথা বলে , খায় , পান করে , কোন জায়গায় আগমন করে , যেভাবে অন্যের সাথে বসে , পোষাক পরে , হাসে এবং যেভাবে তারা নামাজ পড়ে , হজ্ব করে , জিহাদ করে , কোরআন তেলাওয়াত করে এবং যেভাবে সব ধরনের বাহ্যিক ইবাদাত করে। কিন্তু যে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার প্রতি আন্তরিক , যে তাঁকে অন্তরে ভয় করে এবং যে নিজেকে সব প্রচেষ্টার পরও পিছিয়ে আছে দেখতে পায় সে এর ফলাফল হিসাবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাকে পাবে তার প্রতি সন্তুষ্ট এবং সে তাদের একজন হবে যারা লোক দেখানো ও মোনাফেক্বী থেকে মুক্ত হওয়ার আশা রাখে , তবে এ শর্তে যে সে ঐ অবস্থায় পথ চলতে থাকে।


3

4

5

6

7

8

9

10

11

12