পথ চলার বাতি

পথ চলার বাতি0%

পথ চলার বাতি লেখক:
: মুহাম্মদ ইরফানুল হক
প্রকাশক: ওয়াইজম্যান পাবলিকেশনস
বিভাগ: চরিত্র গঠনমূলক বই

পথ চলার বাতি

লেখক: আবু আবদিল্লাহ ইমাম জাফর ইবনে মুহাম্মদ আস-সাদিক্ব (আ.)
: মুহাম্মদ ইরফানুল হক
প্রকাশক: ওয়াইজম্যান পাবলিকেশনস
বিভাগ:

ভিজিট: 11082
ডাউনলোড: 2902

পাঠকের মতামত:

পথ চলার বাতি
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 61 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 11082 / ডাউনলোড: 2902
সাইজ সাইজ সাইজ
পথ চলার বাতি

পথ চলার বাতি

লেখক:
প্রকাশক: ওয়াইজম্যান পাবলিকেশনস
বাংলা

সত্য - মিথ্যার স্পষ্ট প্রকাশ

আরেফদের ঘনিষ্ট কথোপকথন-এ রয়েছে তিনটি মূল : ভয় , আশা ও প্রেম। ভয় হচ্ছে জ্ঞানের শাখা , আশা হচ্ছে ইয়াক্বীনের শাখা এবং প্রেম হচ্ছে মারেফাতের শাখা। ভয়ের প্রমাণ হচ্ছে পলায়ন , আশার প্রমাণ হচ্ছে সন্ধান এবং প্রেমের প্রমাণ হচ্ছে অন্য সবার উপরে মাহবুবকে (যাকে ভালোবাসা হয়) স্থান দেয়া।

যখন জ্ঞানের সত্যায়ন হয় সত্যবাদিতায় তখন সে ভয় পায়। যখন ভয় হয় সত্যিকার সে পালায়। যখন সে পালায় সে রক্ষা পায়। যখন সে অন্তরে ইয়াক্বীনের নূর দেখতে পায় সে উপচে পড়া নেয়ামত দেখতে পায়। যখন উপচেপড়া নেয়ামতের দৃশ্য দৃঢ় হয় তখন আশা আছে।

যখন সে আশার ভেতরে বিশ্বাসের মিষ্টতা অনুভব করে সে সন্ধান করে। যখন সে সন্ধানে সাফল্য লাভ করে সে তা পায়। যখন মারেফাতের নূর তার অন্তরে প্রকাশিত হয় তখন প্রেমের মৃদু-বাতাস নড়ে উঠে , সে মাহবুবের ছায়ায় আশ্রয় নেয় এবং মাহবুবকে সবার উপরে স্থান দেয় , তাঁর আদেশগুলো মেনে চলে এবং তাঁর নিষেধগুলো এড়িয়ে চলে এবং সবকিছুর উপরে সেগুলোকে স্থান দেয়। যখন সে নিবিড় সান্নিধ্যের জন্য অধ্যাবসায় চালায় তাঁর আদেশ মেনে ও নিষেধ এড়িয়ে চলার মাধ্যমে তখন সে নিবিড় মিলন ও নৈকট্যের আত্মায় পৌঁছে গেছে।

এ তিনটি মূল হচ্ছে আশ্রয়কেন্দ্র , মসজিদ ও কাবাঘরের মত : যে এ পবিত্র অঙ্গনে প্রবেশ করলো সে অন্য লোকদের কাছ থেকে নিরাপদ হয়ে গেলো। যদি কোন ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করে তাহলে তার ইন্দ্রিয়গুলো অবাধ্যতায় ব্যবহার হওয়া থেকে নিরাপদ হয়ে গেলো এবং যে ব্যক্তি কাবা ঘরে প্রবেশ করলো তার অন্তর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা স্মরণ ছাড়া অন্য যে কোন বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকা থেকে নিরাপদ হয়ে গেলো।

হে বিশ্বাসী , মনোযোগ দাও , যদি তুমি এমন অবস্থায় থাকো যে তুমি মৃত্যুর সাথে সাক্ষাতের বিষয়ে সন্তুষ্ট আছো তাহলে আল্লাহকে ধন্যবাদ জানাও তার অনুগ্রহ ও নিরাপত্তা দানের জন্য। যদি তা এছাড়া অন্য কিছু হয় তাহলে দৃঢ় সিদ্ধান্তের সাথে এ থেকে সরে যাও এবং তোমার জীবনের সে অংশের জন্য দুঃখ করো যা উদাসীনতায় কেটেছে।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সাহায্য চাও তোমার বাইরের প্রকৃতিকে অন্যায় কর্মকান্ড থেকে পবিত্র করার জন্য এবং তোমার ভেতরের সত্তার ত্রুটিগুলোকে সাফ করো। কথা গ্রাহ্য না করার শেকলগুলোকে তোমার অন্তর থেকে কেটে ফেলো এবং তোমার নফসের কামনা-বাসনার আগুনকে নিভিয়ে ফেল।

বিচারবোধ

অন্তর চার প্রকারের হতে পারে : উচুঁতে উঠানো , খোলা , নীচু এবং থেমে থাকা। অন্তর উঁচুতে উঠা (রাফ) নিহিত রয়েছে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার স্মরণের মাঝে , অন্তর খোলা (ফাতহ) নিহিত রয়েছে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সন্তুষ্টিতে , অন্তরের নীচু (খাফদ) হয়ে থাকা নিহিত রয়েছে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে মগ্ন থাকার ভেতরে এবং অন্তরের থেমে থাকা (ওয়াক্বফ) নিহিত রয়েছে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ছাড়া সবকিছুতে সাড়া দেয়াতে।

তুমি কি দেখো না যে যখন কোন বান্দাহ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাকে আন্তরিক শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে তখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ও তার মাঝে প্রত্যেক পর্দা সরিয়ে দেয়া হয় ? যদি অন্তর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সিদ্ধান্তের উৎস মেনে নেয় এবং তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে তাহলে কীভাবে সুখ , আনন্দ ও পৃথিবীর আরাম নিজেদেরকে তার কাছে মেলে ধরবে ? যখন অন্তর পৃথিবীর কিছু বিষয় ও উপায় নিয়ে ভাবনায় ব্যস্ত থাকে তখন কীভাবে তা খুঁজে পাবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কী বলেছেন ? তখন অন্তর সংকীর্ণ ও অন্ধকার হয়ে যায় একটি জনমানবহীন ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়ির মত , যার না আছে কোন সমৃদ্ধি আর না আছে কোন বাসিন্দা। যখন কোন ব্যক্তি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার স্মরণ থেকে অমনোযোগী হয়ে পড়ে তখন তুমি তাকে দেখবে তার অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দেয়া হয়েছে এবং পর্দার নীচে পড়ে গেছে। সে হয়ে গেছে অনড় ও অন্ধকার , সেই আলো পরিত্যাগ করার কারণে যা রব-এর প্রতি বান্দাহর শ্রদ্ধা প্রদর্শন থেকে উৎসারিত হয়। উচুঁতে উঠার (রাফ) চিহ্ন নিহিত আছে প্রত্যেক বিষয়ে একমত থাকায় , বিরোধিতার অনুপস্থিতিতে এবং সার্বক্ষণিক আকাঙ্ক্ষায়। ফাতহ (খোলা) নিহিত রয়েছে আল্লাহর উপরে আস্থাপূর্ণ নির্ভরতায় , সত্যবাদিতা ও ইয়াক্বীনের মাঝে। খাফদ (নীচু হয়ে থাকা)-এর চিহ্ন নিহিত আছে গর্ব , লোক দেখানো এবং লোভের মাঝে ; এবং ওয়াক্বফ (থেমে থাকা)-এর চিহ্ন নিহিত আছে আনুগত্যের মিষ্টতার প্রস্থানে , বিদ্রোহের তিক্ততায় এবং কী হারাম ও কী হালাল ,সেই জ্ঞানে সন্দেহ সৃষ্টি হওয়াতে।

মিসওয়াক (দাঁত মাজা)

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ‘‘ মিসওয়াক ব্যবহারে মুখ পরিষ্কার হয় এবং তা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করে’’ এবং তিনি এটিকে সুন্নাতের একটি অংশ করেছেন। বাইরের ও ভিতরের সত্তা উভয়ের জন্য এটি উপকারী যা বুদ্ধিমান লোকেরা গুনে শেষ করতে পারবে না। খাবার ও পানীয়ের কারণে দাঁতের যে রঙ বদলায় তা যেভাবে তুমি দূর কর সেভাবে তুমি তোমার অন্যায় কর্মকান্ডের অপবিত্রতা দূর কর বিনীত অনুরোধ , বিনয় , রাত্রের নামায এবং সূর্য ওঠার আগে ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে। পবিত্র করো তোমার বাইরের সত্তাকে নাপাকি থেকে এবং তোমার ভেতরের সত্তাকে বিরোধিতার ময়লা-কাদা এবং যে কোন হারাম কাজ করা থেকে ; আর একই সময়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার জন্য বিশুদ্ধ চিত্তে কাজ করে। রাসূলুল্লাহ (সা.)এর (মিসওয়াক) ব্যবহারকে একটি উদাহরণ হিসাবে উপস্থিত করেছেন সাবধান ও মনোযোগী লোকদের জন্য। মিসওয়াক হচ্ছে একটি পরিষ্কার , নরম চারা এবং একটি বরকতপূর্ণ গাছের সরু ডাল। দাঁতগুলোকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সৃষ্টি করেছেন মুখের ভিতরে খাবার খাওয়ার যন্ত্র হিসাবে এবং চিবানোর মাধ্যম হিসাবে , খাবার খাওয়ার আনন্দের কারণ হিসাবে এবং অন্ত্রকে সুস্থ রাখার জন্য। দাঁতগুলো হচ্ছে খাঁটি মুক্তা , যেগুলো ময়লা হয়ে যায় খাবার চিবানোর সময় উপস্থিত থাকার কারণে , যা মুখের ভিতরে দুর্গন্ধ সৃষ্টি করে এবং মাড়িতে ক্ষয়ের সৃষ্টি করে। যখন বুদ্ধিমান বিশ্বাসী নরম ডাল দিয়ে পরিষ্কার করে এবং একে খাঁটি মুক্তার উপরে বোলায় তখন সে তাদের ক্ষয় ও পরিবর্তন দূর করে এবং তাদেরকে আদি অবস্থায় নিয়ে যায়।

এরকমভাবেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা অন্তরকে পবিত্র ও পরিষ্কার করে সৃষ্টি করেছেন এর খাদ্য হিসাবে দিয়েছেন যিকর (স্মরণ) , গভীর ভাবনা , ভয় ও শ্রদ্ধাকে। যখন পবিত্র অন্তর উদাসীনতা এবং বিরক্তির কারণে ধূসর হয়ে যায় তখন তা চকচকে করা যায় তওবার বার্নিশের মাধ্যমে এবং পরিষ্কার করা যায় অনুতাপের পানি দিয়ে যেন তা ফিরে যায় তার আদি অবস্থায় ও মৌলিক সত্তায়। যেরকম আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেনঃ

) إ ِنَّ اللَّـهَ يُحِبُّ التَّوَّابِينَ وَيُحِبُّ الْمُتَطَهِّرِينَ(

‘‘ নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন যারা তাঁর দিকে ফিরে আসে এবং তিনি তাদেরকে ভালোবাসেন যারা নিজেদেরকে পবিত্র করে।’’ (সূরা বাকারাঃ 222)

রাসূল (সা.) মিসওয়াক ব্যবহারের উপদেশ দিয়েছেন যেন তা দাঁতগুলোর উপর ব্যবহার করা হয় ; কিন্তু তিনি আরও যে অর্থ বুঝিয়েছেন তা উপরের উদাহরণে আমরা উল্লেখ করেছি , তা এ কারণে যে যদি কোন ব্যক্তি বাইরের উদাহরণ থেকে ভিতরের শিক্ষা গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে মনকে অন্য চিন্তা থেকে মুক্ত করে বিশ্বাসের নীতি ও মূল-এর বিষয়ে , তাহলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা প্রজ্ঞার ঝর্নাগুলো খুলে দিবেন এবং তাঁর উপচে পড়া দান থেকে তাকে আরও দিবেন , কারণ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাদের পুরস্কারে অবহেলা করেন না যারা ভালো কাজ করে।

শৌচাগার ব্যবহার

আরবীতে শৌচাগারকে বলা হয় বিশ্রামের স্থান , কারণ সেখানে মানুষ অপবিত্রতার বোঝা থেকে বিশ্রাম পায় এবং নিজেদেরকে নোংরা ও ময়লা থেকে খালি করে। সেখানে একজন বিশ্বাসী চিন্তা করতে পারে সে কীভাবে খাবার ও এ পৃথিবীর ক্ষয়িঞ্চু জিনিস থেকে নিজেকে পরিষ্কার করে এবং কীভাবে তার মৃত্যু আসবে একই ভাবে : অতএব সে স্বাচ্ছন্দ খুঁজে পাক এ পৃথিবীকে এড়িয়ে যাওয়াতে , একে পাশে সরিয়ে রাখতে এবং তার নিজেকে ও তার অন্তরকে এর মনোযোগ কাড়া থেকে মুক্ত করতে । তার উচিত এ পৃথিবীকে নেয়া ও জড়ো করাকে ঘৃণা করা যেভাবে সে ঘৃণা করে অপবিত্রতা , শৌচাগার এবং নোংরাকে , এ কথা ভেবে যে কীভাবে একটি জিনিস এক অবস্থায় ভালো এবং অন্য অবস্থায় ঘৃণ্য হয়ে যায়। সে জানে সন্তুষ্টি ও সতর্কতা ধরে রাখা তাকে দুই পৃথিবীতেই আরাম এনে দেবে।

এভাবে আরাম আসে এ পৃথিবীকে তুচ্ছ ভেবে , এর আনন্দ ফুর্তিকে ত্যাগ করে এবং যা হারাম ও সন্দেহজনক তার অপবিত্রতা দূর করে। একজন ব্যক্তি নিজের উপরে গর্বের দরজাকে বন্ধ করে দেয় যখন সে তা বুঝতে পারে। সে অন্যায় কাজ থেকে পালায় এবং দরজা খুলে দেয় বিনয় , অনুতাপ ও মধ্যপন্থার জন্য। সে সংগ্রাম করে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার আদেশ ও নিষেধ মানতে , উত্তম পরিণতি ও আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার নৈকট্যের সন্ধানে। সে নিজেকে বন্দী করে ভয় ও দৃঢ়তা এবং ক্ষুধাগুলোকে নিয়ন্ত্রণের কারাগারে , যতক্ষণ পর্যন্ত না সে পৌঁছে যায় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার নিরাপদ আশ্রয়ে আসন্ন পৃথিবীতে এবং তাঁর সন্তুষ্টির স্বাদ গ্রহণ করে। যদি এটি হয় তার উদ্দেশ্য , তাহলে তার কাছে বাকী সব কিছুর কোন অর্থ নেই।

পরিচ্ছেদ-16

পবিত্রতা অর্জন

যদি তুমি পবিত্র হতে চাও এবং অযু করতে চাও , তাহলে পানির কাছে সেভাবে যাও যেভাবে তুমি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার রহমতের কাছে যেতে চাইতে , কারণ তিনি পানিকে তাঁর সাথে নিবিড় কথোপকথনের জন্য তাঁর কাছে যাবার চাবি বানিয়েছেন এবং একে করেছেন তাঁর দাসত্বের রাজ্যে প্রবেশ করার পথপ্রদর্শক হিসাবে। ঠিক যেভাবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার রহমত তাঁর বান্দাহদের অন্যায় কাজগুলোকে ধুয়ে মুছে দেয় , ঠিক সেভাবেই বাইরের অপবিত্রতাগুলো পরিষ্কার হয় একমাত্র পানি দিয়ে। যেভাবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেনঃ

) و َهُوَ الَّذِي أَرْسَلَ الرِّيَاحَ بُشْرًا بَيْنَ يَدَيْ رَحْمَتِهِ وَأَنزَلْنَا مِنَ السَّمَاءِ مَاءً طَهُورًا(

‘‘ তিনি বাতাসকে পাঠান সুসংবাদ হিসাবে তাঁর রহমতের আগে এবং আমরা আকাশ থেকে পবিত্র পানি বর্ষণ করি।’’ (সূরা ফুরকানঃ 48)

অন্য জায়গায় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেনঃ

) و َجَعَلْنَا مِنَ الْمَاءِ كُلَّ شَيْءٍ حَيٍّ أَفَلَا يُؤْمِنُونَ(

‘‘ আমরা প্রত্যেক জীবিত প্রাণীকে সৃষ্টি করেছি পানি থেকে। তাহলেও কি তারা বিশ্বাস করবে না ?’’ (সূরা আম্বিয়াঃ 30)

যেভাবে তিনি জীবন দেন প্রত্যেক নেয়ামতকে পানি থেকে , সেভাবেই তাঁর রহমত এবং উপচে পড়া দানের মাধ্যমে তিনি জীবন দেন অন্তরকে এবং আনুগত্যের কর্মকান্ডকে এবং এ চিন্তাভাবনাকে যে , পানির পবিত্রতা , এর পেলবতা , এর পরিচ্ছন্নতা , এর উপকারিতা এবং কীভাবে তা সব কিছুর সাথে নিরবে মিশে যায় ; পানির মাধ্যমে তিনি অন্তরকে জীবন দেন যখন তুমি তোমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে পবিত্র কর যেগুলোকে পবিত্র করার জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তোমাকে আদেশ করেছেন এবং যেগুলোকে তুমি ব্যবহার কর ফরজ ও সুন্নাত নামাযের সময়।

প্রত্যেক অঙ্গ থেকে আসে অনেক উপকারিতা। যখন তুমি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে শ্রদ্ধার চোখে দেখবে তখন তাদের উপকারিতা তোমার জন্য শীঘ্র উথলে উঠবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সৃষ্টির সাথে আচরণ কর পানির মত যা সব জিনিসের সাথে মিশে যায় এবং যা প্রাপ্য তার সব দিয়ে দেয় অথচ তার মূল সত্তায় কোন পরিবর্তন ঘটে না। এ জিনিসটি প্রকাশ পেয়েছে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কথায়ঃ‘‘ আন্তরিকভাবে বিশ্বাসী ব্যক্তি হলো পানির মত।’’ তোমার সব আনুগত্যে আল্লাহর সাথে তোমার পবিত্রতাকে সেই পানির পবিত্রতার মত করে নাও যা তিনি আকাশ থেকে বর্ষণ করেছেন এবং একে পবিত্র আখ্যা দিয়েছেন। তোমার অন্তরকে পবিত্র করো সতর্কতা ও ইয়াক্বীন দিয়ে যখন তুমি তোমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে পবিত্র কর পানি দিয়ে।

মসজিদে প্রবেশ করা

যখন তুমি মসজিদের দরজায় পৌঁছাও জেনো যে তুমি এক মহা শক্তিধর বাদশাহর দরজায় এসেছো। শুধু পরিশুদ্ধরাই তার গালিচায় পা রাখে এবং শুধু সত্যিকার বিশ্বাসীরাই তাঁর সাথে বসার অনুমতি পায়। তাই এ মহা ক্ষমতাবান বাদশাহর দরবারে এগিয়ে যাওয়ার সময় সাবধান হও। কারণ তুমি বিরাট বিপদে পড়বে যদি তুমি উদাসীন হও। জেনে রাখো যে তিনি যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন ন্যায়বিচারে এবং উপচে পড়া নেয়ামতে তোমাকে নিয়ে এবং তোমাকে দিয়ে। যদি তিনি তাঁর করুণা ও উপচে পড়া নেয়ামত নিয়ে তোমার দিকে ঝোঁকেন তাহলে তিনি তোমার আনুগত্যের সামান্য অংশকে গ্রহণ করেছেন এবং এর জন্য তোমাকে দিয়েছেন বিরাট পুরষ্কার। যদি তিনি তাঁর প্রতি সত্যবাদিতায় এবং আন্তরিকতায় তাঁর প্রাপ্য দাবী করেন তোমার প্রতি তাঁর ন্যায় বিচারের মাধ্যমে , তাহলে তিনি তোমাকে পর্দায় ঢেকে দিয়েছেন এবং তোমার আনুগত্যকে প্রত্যাখ্যান করেছেন যদিও তোমার আনুগত্য ছিলো অনেক। তিনি করেন যা তাঁর ইচ্ছা। তাঁর সামনে তোমার অক্ষমতা , স্বল্পতা , দূর্বলতা এবং দরিদ্রতা স্বীকার করো , কারণ তুমি তাঁর দিকে ফিরেছো তাঁর ইবাদাত করার জন্য এবং তাঁর কাছে যাওয়ার জন্য। তাঁর দিকে ফিরো এবং জেনে রাখো যে , কোন প্রাণীর গোপন অথবা প্রকাশ্য বিষয়ের কোন কিছুই তাঁর কাছ থেকে লুকায়িত নয়। তাঁর সামনে তাঁর বান্দাহদের মধ্যে সবচেয়ে দরিদ্র বান্দাহর মত হও ; তোমার অন্তরকে সব চিন্তা থেকে মুক্ত করো যা তোমাকে তোমার রবের কাছ থেকে ঢেকে ফেলতে পারে। কারণ তিনি শুধু তাদেরকে গ্রহণ করেন যারা দরিদ্রতম ও সবচেয়ে আন্তরিক। দেখার চেষ্টা করো কোন খাতায় তোমার নাম লিখা হবে।

যদি তুমি তাঁর একান্ত আলাপচারিতার মিষ্টতার স্বাদ এবং তোমাকে তাঁর সম্বোধনের আনন্দ পাও এবং তাঁর রহমতের পেয়ালা থেকে পান কর এবং যে নেয়ামত তিনি তোমাকে দান করেছেন এবং তোমার যে অনুরোধগুলো তিনি গ্রহণ করেছেন , তাহলে তুমি তাঁর দাসত্ব যথাযথভাবে করেছো এবং তুমি হয়তো তাঁর অনুমতি ও নিরাপত্তা বলয়ে প্রবেশ করবে। যদি তা না হয় তাহলে তার মত দাঁড়াও যার শক্তি ও ক্ষমতা কেটে ফেলা হয়েছে এবং যার নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে এসেছে। যদি সর্বশক্তিমান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা জানতে পারেন যে তোমার অন্তরে তুমি আন্তরিকভাবে তাঁর কাছে আশ্রয় চাচ্ছো তাহলে তিনি তোমাকে স্নেহ , করুণা ও দয়ার সাথে বিবেচনা করবেন। তিনি তোমাকে সে বিষয়ে সফলতা দিবেন যা তিনি ভালোবাসেন এবং যা তাঁর জন্য প্রীতিকর , কারণ তিনি উদার। তিনি ভালোবাসেন অতি উদারতা এবং তাদের ইবাদাত যারা তাঁর প্রয়োজন বোধ করে এবং যারা তাঁর দরজায় পুড়ছে তাঁর সন্তষ্টির ভিক্ষা চেয়ে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেনঃ

) أ َمَّن يُجِيبُ الْمُضْطَرَّ إِذَا دَعَاهُ وَيَكْشِفُ السُّوءَ(

‘‘ কে দুর্দশাগ্রস্থকে সাড়া দেন যখন সে তাঁকে ডাকে এবং দূর করে দেন খারাপকে ?’’ (সূরা নামলঃ 62)

দোয়া

দোয়া-র সৌজন্য পালন করো। ভেবে দেখো কাকে তুমি ডাকছো , কীভাবে তাকে ডাকছো এবং কেন তাকে ডাকছো ; পূর্ণব্যক্ত করো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার বিশালতা ও পরম মর্যাদাকে। তোমার অন্তর দিয়ে দেখো কীভাবে তিনি জানেন তোমার বিবেকের ভিতর কী আছে , কীভাবে তিনি দেখেন তোমার গোপন সত্তাকে এবং দেখেন এতে যা ঘটে গেছে এবং যা ঘটবে সত্য ও মিথ্যা দু টোই। তোমার নাজাত ও তোমার ধ্বংসের পথকে জেনে নাও যেন তুমি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাকে এমন কিছুর জন্য না ডাকো যার ভেতরে নিহিত আছে তোমার ধ্বংস অথচ তুমি মনে করছো সেখানে তোমার নাজাত রয়েছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেনঃ

) و َيَدْعُ الْإِنسَانُ بِالشَّرِّ دُعَاءَهُ بِالْخَيْرِ وَكَانَ الْإِنسَانُ عَجُولًا(

‘‘ মানুষ খারাপ-এর জন্য দোয়া করে যেভাবে তার উচিত ভালোর জন্য দোয়া করা এবং মানুষ খুব তাড়াহুড়া প্রবন।’’ (সূরা বনী ইসরাইলঃ 11 )

কী তুমি চাইছো এবং কেন তা চাইছো তা নিয়ে ভাবো ; দোয়া হওয়া উচিত সত্যের প্রতি তোমার পক্ষ থেকে পূর্ণ সাড়া এবং অন্তর গলে যাওয়া তোমার রবের কথা ভেবে। তার উচিত সব পছন্দ পরিত্যাগ করা এবং সব বিষয়কে আল্লাহর প্রতি সমর্পণ করা প্রকাশ্য ও গোপন উভয়কেই। যদি দোয়ার পূর্বশর্তগুলো পালন করা না হয় তাহলে তা ক্ববুল হওয়ার কথা ভেবো না , কারণ তিনি জানেন কী গোপন ও কী লুকায়িত আছে ; তুমি হয়তো তাঁর কাছে কিছু চাইছো যখন তিনি জানেন তুমি ঠিক এর উল্টোটি গোপন করছো।

সাহাবীদের একজন অন্যদের বললোঃ‘‘ তোমরা বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করছো আর আমি অপেক্ষা করছি পাথরের (বৃষ্টি) জন্য।’’ জেনে রাখো যদি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাদেরকে আদেশ না করতেন তাকে ডাকার জন্য তিনি কখনোই আমাদের নামাজ শেষ হওয়ার সাথে সাথে দোয়া ক্ববুল করতেন না। তাহলে তার দান কত বড় যে তিনি সাড়া দেয়ার নিশ্চয়তা দিয়েছেন যদি কেউ দোয়ার পূর্বশর্তগুলো পূরণ করে।

রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সবচেয়ে শক্তিশালী নাম কী ? তিনি বললেনঃ‘‘ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার প্রত্যেকটি নামই সবচেয়ে শক্তিশালী।’’

তোমার অন্তরকে তিনি ছাড়া আর সবকিছু থেকে মুক্ত করো এবং তাঁকে ডাকো সে নামে যা তোমার পছন্দ। বাস্তবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার একটিই নাম তা নয় : তিনি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা , এক ও সর্ব শক্তিমান।

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ‘‘ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কোন ভ্রুক্ষেপহীন অন্তরের দোয়াতে সাড়া দেন না।’’ যখন তোমাদের মধ্যে কেউ চায় তার রব তাকে তা দিক যা সে তাঁর কাছ থেকে চেয়েছে তাহলে তার উচিত সব মানুষকে পরিত্যাগ করা একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার প্রতি আশা স্থাপন করা। যখন আল্লাহ তার অন্তরে সেটি দেখেন তখন তিনি তাই দিবেন যা সে চায়।

যখন তুমি দোয়ার পূর্বশর্তগুলো প্রতিষ্ঠা করেছো যা আমি উল্লেখ করেছি এবং তোমার গভীরতম সত্তার ভেতরে তাঁর জন্য আন্তরিক হয়েছো , তাহলো সুবংবাদে আনন্দ করো যে তিনটি জিনিসের যে কোন একটি ঘটবেঃ হয় তিনি দ্রুত দিবেন যা তুমি চেয়েছো অথবা তিনি তোমার জন্য তার চেয়ে ভালো কিছু জমা রাখবেন অথবা তিনি তোমার কাছ থেকে একটি দুর্দশা হটিয়ে দিবেন যা তিনি পাঠালে তোমাকে ধ্বংস করে দিতো। রাসূল (সা.) বলেছেন যে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেনঃ‘‘ যদি কোন ব্যক্তি আমার কাছে চাওয়ার সময় আমাকেই স্মরণ করার কারণে তা ভুলে যায় তাহলে আমি তাকে তার চাইতে ভালো কিছু দিবো যা আমি তাদেরকে দেই যারা চায়।’’

আমি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাকে একবার ডাকলাম এবং তিনি সাড়া দিলেন। আমি আমার প্রয়োজন ভুলে গেলাম কারণ যখন তিনি কোন দোয়ার উত্তর দেন তাঁর দান হয় আরো বড় এবং আরো উচ্চ মূল্যের তার চাইতে যা বান্দাহরা তাঁর কাছে চায় , যদি তা জান্নাত ও তার চিরস্থায়ী নেয়ামতও হয়। এটি শুধু সেই প্রেমিকরা যারা কাজ করে , আধ্যাত্মিক ব্যক্তিরা , উচ্চস্থানীয়রা এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার নির্বাচিত ব্যক্তিরা বুঝতে পারে ।

পরিচ্ছেদ-17

রোযা রাখা

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ‘‘ রোযা এ পৃথিবীর দুঃখ কষ্টের বিরুদ্ধে একটি নিরাপত্তা এবং আখেরাতে শাস্তি থেকে বাঁচার পর্দা।’’ যখন তুমি রোযা রাখ তখন নিয়ত করো যে এর মাধ্যমে তুমি শরীরের মাংসের ক্ষুধাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করবে এবং পৃথিবীর সেসব কামনা বাসনাকে কেটে ফেলবে যা শয়তান ও তার মতদের বুদ্ধি থেকে আসে। নিজেকে একজন অসুস্থ ব্যক্তির অবস্থায় রাখো যে না চায় খাবার না চায় পানি ; আশা করো যেন যে কোন মুহূর্তে অন্যায় কাজের অসুস্থতা থেকে আরোগ্য লাভ করতে পারো। তোমার অভ্যন্তরীণ সত্তাকে পবিত্র করো প্রত্যেক মিথ্যা , নোংরা- কাদা , উদাসীনতা এবং অন্ধকার থেকে যা তোমাকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার প্রতি আন্তরিক হওয়া থেকে কেটে দেয়।

কোন এক সাহাবীকে একজন বলেছিলোঃ‘‘ তুমি ইতোমধ্যেই দূর্বল , রোযা তোমাকে আরও দূর্বল করে দেবে।’’ সে বললোঃ‘‘ আমি এ রোযাকে প্রস্তুত করছি এক লম্বা দিনের খারাপ-এর বিরুদ্ধে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাকে মেনে চলার পথে ধৈর্য তাঁর শাস্তিতে ধৈর্য ধরার চাইতে উত্তম।’’ রাসূলুল্লাহ ( সা .) আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কথা উদ্ধৃত করেছেনঃ‘‘ রোযা আমার জন্য রাখা হয় এবং আমি এর প্রতিদান।’’

রোযা নফসের কামনা-বাসনা এবং লোভের ক্ষুধাকে হত্যা করে এবং এ থেকে আসে অন্তরের পবিত্রতা , অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পরিশুদ্ধতা , ভিতরের ও বাইরের সত্তার আবাদ , নেয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞতা , দরিদ্রের জন্য দান , বিনয়পূর্ণ প্রার্থনার বৃদ্ধি , অন্তর গলে যাওয়া , কান্না এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে আশ্রয় নেয়ার সব পথ। এটি উচ্চাশা ভঙ্গের , খারাপ জিনিসগুলোর বোঝা লাঘব এবং ভালো কাজ দ্বিগুণ হওয়ার কারণ। এর ভেতরে এত নেয়ামত যে তা গোনা যায় না। এটি যথেষ্ট যে আমরা সেগুলোর কিছু উল্লেখ করেছি সে ব্যক্তির জন্য যে বোঝে এবং যাকে রোযার কল্যাণ লাভে সফলতা দেয়া হয়েছে , যদি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ইচ্ছা করেন ।