কোরআনের মু‘জিযাহ্

কোরআনের মু‘জিযাহ্ 0%

কোরআনের মু‘জিযাহ্ লেখক:
: নূর হোসেন মজিদী
প্রকাশক: -
বিভাগ: কোরআন বিষয়ক জ্ঞান

কোরআনের মু‘জিযাহ্

লেখক: নূর হোসেন মজিদী
: নূর হোসেন মজিদী
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 43108
ডাউনলোড: 3700

পাঠকের মতামত:

কোরআনের মু‘জিযাহ্
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 60 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 43108 / ডাউনলোড: 3700
সাইজ সাইজ সাইজ
কোরআনের মু‘জিযাহ্

কোরআনের মু‘জিযাহ্

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

অপচয়-অপব্যয় নিষিদ্ধ

কোরআন মজীদের উপরোক্ত আয়াতে এবং এ ধরনের আরো যে সব আয়াতে মানুষকে দানে উৎসাহিত ও কার্পণ্যে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে , তার পাশাপাশি এমন অনেক আয়াতের উল্লেখ করা যেতে পারে যাতে অপচয় ও অপব্যয়ে নিষেধ করা হয়েছে এবং এর ক্ষতিকারকতা সম্বন্ধে মানুষকে জানানো হয়েছে। যেমন , এরশাদ হয়েছে :

) ولا تسرفوا انه لا يحب المسرفي( .

আর তোমরা অপচয় করো না ; নিঃসন্দেহে তিনি (আল্লাহ্) অপচয়কারীদের ভালোবাসেন না। (সূরাহ্ আল্-আন্ আাম্ : 141)

) ان المبذرين کانوا اخوان الشياطين( .

নিঃসন্দেহে অপচয়কারীরা শয়তানদের ভাই। (সূরাহ্ বানী ইসরাাঈল্ : 27)

ধৈর্যধারণে উৎসাহ প্রদান

কোরআন মজীদ বিপদাপদের মুখে ধৈর্য-সহ্য ও দৃঢ়তার নির্দেশ প্রদান করেছে , ধৈর্যশীল ও অটল লোকদের প্রশংসা করেছে এবং তাদের জন্য বিরাট পুরষ্কারের সুসংবাদ দিয়েছে। যেমন , এরশাদ হয়েছে :

) انما يوفی الصابرون اجراهم بغير حساب( .

অবশ্যই ধৈর্যশীল লোকেরা তাদের প্রাপ্য সীমাহীন সুপ্রতিদান লাভ করবে। (সূরাহ্ আয্-যুমার : 10)

) و الله يحب الصابرين( .

আর আল্লাহ্ ধৈর্যশীলদেরকে ভালোবাসেন। (সূরাহ্ আালে ইমরাান্ : 146)

কিন্তু এখানে মনে রাখতে হবে যে , কোরআন মজীদ যালেমের মোকাবিলায় ময্লূমের হাত-পা বেঁধে রাখে নি এবং তাকে তার অধিকার আদায়েও নিষেধ করে নি। বরং যুলুমের মূলোৎপাটন ও ধরণীর বুকে সুবিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যালেম-অত্যাচারীর মোকাবিলায় রুখে দাঁড়ানো ও ন্যায়সঙ্গতভাবে যালেমের নিকট থেকে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য কোরআন মজীদ ময্লূমকে অনুমতি প্রদান করেছে। এ প্রসঙ্গে কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে :

) فمن اعتدی عليکم فاعتدوا عليه بمثل ما اعتدی عليکم.(

অতএব , যে তোমাদের বিরুদ্ধে চড়াও হয়েছে তোমরাও তার বিরুদ্ধে চড়াও হও ঠিক যেভাবে সে তোমাদের বিরুদ্ধে চড়াও হয়েছে। (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : 194)

নরহত্যার শাস্তি

কেউ যদি স্বেচ্ছায়-সজ্ঞানে কাউকে হত্যা করে সে ক্ষেত্রে কোরআন মজীদের বিধানে ঘাতককে হত্যা করার জন্য নিহত ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনদেরকে অধিকার দেয়া হয়েছে। কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে :

) و من قتل مظلوماً فقد جعلنا لئليه سلطاناً فلا يسرف فی القتل( .

যে কেউ অন্যায়ভাবে নিহত হয়েছে আমি তার অভিভাবককে পরিপূর্ণ অধিকার প্রদান করেছি (প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য) , কিন্তু সে-ও যেন (ঘাতককে) হত্যার ব্যাপারে অপচয় না করে (বাড়াবাড়িমূলক কাজ না করে)। (সূরাহ্ বানী ইসরাাঈল্ : 33)

ইহ-পারলৌকিক বিধিবিধানের সমন্বয়

কোরআন মজীদ যেহেতু ভারসাম্য ও মধ্যম পন্থা ভিত্তিক আইন-কানূন্ ও শর ঈ বিধান প্রবর্তন করেছে , সেহেতু ইহজাগতিক সমাজব্যবস্থা ও সামাজিক বিধিবিধানে পরজাগতিক বিধিবিধানের সাথে সঙ্গতি বিধান করেছে এবং এ উভয় জগতের বিধিবিধানের মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছে।

কোরআন মজীদ একদিকে যেমন মানুষের ইহজাগতিক বিষয়াদিকে সংশোধন ও পরিশুদ্ধ করার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে , অন্যদিকে মানুষের পারলৌকিক সৌভাগ্যেরও নিশ্চয়তা বিধান করেছে। হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) এ সব মহান আইন-বিধান সম্বলিত কোরআন মজীদ নিয়ে এসেছেন যার উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্বমানবতাকে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উভয় জগতের সৌভাগ্যে উপনীত করা।

কোরআন মজীদ বর্তমানে প্রচলিত তাওরাতের ন্যায় নয় যার আইন-বিধান সমূহ কেবল বস্তুগত জগতের সাথে সংশ্লিষ্ট - যাতে ইহজগতের প্রতি দৃষ্টি দেয়া হয়েছে , কিন্তু অপর জগতের প্রতি দৃষ্টি দেয়া হয় নি।

হ্যা , বর্তমানে প্রচলিত তাওরাত্ বস্তুজগতের মধ্যে এমনভাবে সীমাবদ্ধ যে , পরজগতের প্রতি সামান্যতম দৃষ্টিও প্রদান করে নি। এমনকি নেক কাজের পুরষ্কারকেও ইহজগতের মধ্যে সীমাবদ্ধ করেছে। বর্তমানে প্রচলিত তাওরাত্ বলেছে যে , নেক কাজের পুরস্কার হচ্ছে জাগতিক ধনসম্পদ বৃদ্ধি এবং ইহজগতে অন্যদের ওপর আধিপত্য। অন্যদিকে পাপের শাস্তিকেও ইহজগতের মধ্যে সীমাবদ্ধ রূপে দেখিয়েছে , বলেছে , পাপের শাস্তি হচ্ছে ধনসম্পদ ও ক্ষমতা-আধিপত্য হাতছাড়া হয়ে যাওয়া।

অন্যদিকে কোরআন মজীদ বর্তমানে প্রচলিত ইনজীলের অনুরূপও নয় - যার আইন-কানূন্ ও বিধিবিধান শুধু পরকালের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং ইহজাগতিক বিষয়াদি তথা সমাজব্যবস্থা ও জীবনবিধানের প্রতি যা উপেক্ষা প্রদর্শন করেছে।

বর্তমানে প্রচলিত তাওরাত্ ও ইনজীল্ উভয়ের বিপরীতে কোরআন মজীদের আইন-কানূন্ ও বিধিবিধান হচ্ছে সর্বাত্মক ও পূর্ণাঙ্গ - যাতে ইহকালীন বৈষয়িক জীবন ও সমাজব্যবস্থা যেমন শামিল রয়েছে , তেমনি পরকালীন জীবনের সাফল্য ও কল্যাণের নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে। কোরআন মজীদে মানুষের জীবনের বস্তুগত ও অবস্তুগত কোনো বিষয়ের প্রতিই উপেক্ষা প্রদর্শন করা হয় নি।

কোরআন মজীদ তার ভারসাম্যপূর্ণ শিক্ষার মাধ্যমে একদিকে যেমন মানুষকে পরকালীন জীবনের প্রতি মনোযোগী করে তুলেছে , অন্যদিকে তাকে পার্থিব জীবনের বিষয়াদির প্রতিও মনোযোগ দিতে বলেছে। যেমন , পরকালীন জীবনের প্রতি মানুষকে আগ্রহী করে তোলার জন্য কোরআন মজীদ এরশাদ করেছে :

) و من يطع الله و رسوله يدخله جنات تجری من تحتها الانهار خالدين فيها و ذالک الفوز العظيم.(

আর যে কেউ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে সে বেহেশতে প্রবেশ করবে - যার তলদেশ দিয়ে নহর প্রবাহিত হচ্ছে ; সেখানে সে চিরদিন থাকবে। আর এ হচ্ছে এক বিরাট সাফল্য। (সূরাহ্ আন্-নিসাা : 13)

) و من يعص الله و رسوله و يتعد حدوده يدخله ناراً خالداً فيها و له عذاب مهين(

আর যে কেউ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতা করবে ও তাঁর নির্ধারিত সীমারেখা লঙ্ঘন করবে সে দোযখে প্রবেশ করবে ও চিরদিন সেখানে থাকবে , আর তার জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি। (সূরাহ্ আন্-নিসাা : 14)

) فمن يعمل مثقال ذرة خيراً يره( .

অতএব , যে কেউ অণুমাত্রও সৎকর্ম করবে (পরকালে) সে তা দেখতে পাবে। (সূরাহ্ আয্-যিলযালাহ্ : 7)

) و من يعمل مثقال ذرة شراً يره(

আর যে কেউ অণুমাত্রও পাপকর্ম করবে (পরকালে) সে তা দেখতে পাবে। (সূরাহ্ আয্-যিলযালাহ্ : 8)

) و ابتغ فيما اتاک الله الدار الآخرة و لا تنس نصيبک من الدنيا(

(হে রাসূল!) আল্লাহ্ আপনাকে যে পরকালের গৃহ প্রদান করেছেন তাকে আঁকড়ে ধরুন (এবং তা ঠিক রাখার জন্য যথাযথ কাজ করুন) , আর পার্থিব জগতে আপনার অংশকেও ভুলে যাবেন না। (সূরাহ্ আল্-ক্বাছ্বাছ্ব্ : 77)

কোরআন মজীদের বহু আয়াতেই জ্ঞানার্জন ও তাক্ব্ওয়া-পরহেযগারীর জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে , একই সাথে পার্থিব জীবনের স্বাদ-আনন্দ ও আল্লাহর দেয়া নে আমত সমূহের সঠিক ব্যবহারকে বৈধ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কোরআন মজীদ এরশাদ করেছে :

) قل من حرم زينة الله التی اخرج لعباده و الطيبات من الرزق(

(হে রাসূল!) বলুন , আল্লাহ্ তাঁর বান্দাহদের জন্য যে সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছেন এবং যে সব পবিত্র রিয্ক্ব্ প্রদান করেছেন কে তা হারাম করেছে ? (সূরাহ্ আল্-আ রাাফ্ : 32)

পারস্পরিক সম্পর্ক

কোরআন মজীদ মানুষকে আল্লাহ্ তা আলার ইবাদত ও আনুগত্য করা , সৃষ্টিলোকের নিদর্শনাদি ও শর ঈ বিধিবিধান নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা এবং সৃষ্টিলোকের অস্তিত্ব , মানুষের রহস্য ও তার সত্তায় নিহিত বিভিন্ন সত্য সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করার জন্য বার বার আহবান জানিয়েছে। কিন্তু কোরআন মজীদ শুধু মানুষকে আল্লাহ্ তা আলার সান্নিধ্যে পৌঁছে দিয়ে তথা বান্দাহ্ ও স্রষ্টার মধ্যে সম্পর্ক সৃষ্টি করে দিয়েই নিজের দায়িত্ব শেষ করে নি , বরং মানবজীবনের অপর দিকটি অর্থাৎ মানুষের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কের প্রতিও দৃষ্টি প্রদান করেছে , বিশেষ করে মানুষের মধ্যে মায়া-মহব্বত ও আন্তরিক সুসম্পর্ক গড়ে তোলার ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করেছে।

কোরআন মজীদ বেচাকিনা ও ব্যবসা-বাণিজ্যকে বৈধ ঘোষণা করেছে এবং রেবা ও নির্বিচার সম্পদ বৃদ্ধি করার প্রবণতাকে হারাম করেছে। যেমন , এরশাদ হয়েছে :

) و احل الله البيع و حرم الربا( .

আর আল্লাহ্ ব্যবসায়কে হালাল করেছেন এবং রেবাকে হারাম করেছেন। (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : 275)

[আভিধানিক অর্থে রেবা মানে বৃদ্ধি। কিন্তু পারিভাষিক অর্থে অবাণিজ্যিক প্রয়োজনে গৃহীত ঋণের ওপর আসলের চেয়ে অতিরিক্ত গ্রহণই হচ্ছে রেবা। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ধানের ওপর টাকা লাগানো র যে রেওয়াজ আছে যাতে ধান ওঠার আগে ব্যক্তিকে একটি নির্দিষ্ট দরে ধানের অগ্রিম মূল্য দেয়া হয় যার দর ঐ সময়কার ও ধান ওঠার সময়কার বাজার দরের চেয়ে কম। ইসলামের দৃষ্টিতে এ ধরনের লেনদেন বেচাকিনা হিসেবে ছ্বহীহ্ নয়। ফলে এর মাধ্যমে ঋণদাতা যে মুনাফা করে তা রেবা। অন্যদিকে বিভিন্ন ব্যাঙ্ক , আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান কিস্তিতে বাজার-মূল্যের চেয়ে বেশী মূল্যে গার্হস্থ্য সামগ্রী সরবরাহ করে যে অতিরিক্ত মুনাফা করে তা-ও রেবা। কোনো দোকানদার নগদ বেচাকিনার ক্ষেত্রে একই পণ্য বিভিন্ন মূল্যে বিক্রি করলে বাকী বিক্রির ক্ষেত্রে সবচেয়ে কম মূল্যে বিক্রি না করলে হাদীছ অনুযায়ী এর অতিরিক্ত মুনাফা হবে রেবা।]

কোরআন মজীদ মানুষের প্রতি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা এবং তা ভঙ্গ না করার জন্য আদেশ দিয়েছে। যেমন , এরশাদ করেছে :

) يا ايها الذين آمنوا اوفوا بالعقود(

হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদের প্রতিশ্রুতিসমূহ রক্ষা করো। (সূরাহ্ আল্-মাাএদাহ্ : 1)

অবশ্য এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য যে , কোনো যুলুম , অন্যায় বা পাপাচারের কাজের প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গীকার করলে বা ভালো কাজ না করার অঙ্গীকার করলে তা ভঙ্গ করা ও শর ঈ বিধান অনুযায়ী অঙ্গীকার ভঙ্গের কাফ্ফারাহ্ দেয়া ফরয ; এরূপ ক্ষেত্রে অঙ্গীকার রক্ষা করা কঠিন গুনাহ্। তেমনি কোনো মোবাহ্ কাজে (যেমন : তালাক্ব্ প্রদানের) অঙ্গীকার করার পর তা ভঙ্গ করার মধ্যে কল্যাণ মনে করলে তা ভঙ্গ করে কাফ্ফারাহ্ প্রদান জায়েয আছে।

বিবাহে উৎসাহ প্রদান

যেহেতু মানব প্রজাতির অস্তিত্ব ও ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য নারী ও পুরুষের মাঝে বৈবাহিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হওয়া অপরিহার্য , সেহেতু কোরআন মজীদ এ স্বভাবসম্মত কাজটি সম্পাদন অর্থাৎ বিবাহ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছে। এরশাদ হয়েছে :

) و انکحوا الايامی منکم و الصالحين من عبادکم و امائکم. ان يکونوا فقراء يغنهم الله من فضله و الله واسع عليم(

আর তোমরা তোমাদের মধ্যকার স্বামী বা স্ত্রী বিহীন নারী ও পুরুষদেরকে এবং তোমাদের বিবাহযোগ্য দাস-দাসীদেরকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে দাও। আর এরা যদি দরিদ্র ও নিঃসম্বল হয়ে থাকে তো আল্লাহ্ তাঁর অনুগ্রহ দ্বারা তাদেরকে সচ্ছলতা দান করবেন। আর আল্লাহ্ সীমাহীন উদারতার অধিকারী ও সর্ববিষয়ে সদা ওয়াকেফহাল। (সূরাহ্ আন্-নূর্ : 32)

) فانکحوا ما طاب لکم من النساء مثنی و ثلاث و رباع فان خفتم ان لا تعدلوا فواحدة( .

তোমাদের জন্য যারা উত্তম এমন নারীদের মধ্য থেকে বিবাহ করো দু জন , তিন জন বা চারজনকে , কিন্তু তোমরা যদি ভয় করো যে , তাদের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারবে না তাহলে মাত্র একজনকে বিবাহ করো। (সূরাহ্ আন্-নিসাা : 3)

সদাচরণ ও কল্যাণকর কাজ

কোরআন মজীদ স্ত্রীর সাথে সদাচরণ করতে ও তার সমস্ত স্বাভাবিক প্রয়োজন পূরণের জন্য স্বামীর প্রতি নির্দেশ দিয়েছে। তেমনি কোরআন মজীদ সমস্ত মুসলমানের সাথে , বিশেষ করে পিতা-মাতা , আত্মীয়-স্বজন ও ঘনিষ্ঠ জনদের সাথে সদাচরণের জন্য আদেশ দিয়েছে। বরং কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে সদাচরণ হচ্ছে মানবজীবনের জন্য অপরিহার্য ব্যাপক ভিত্তিক ও সর্বজনীন কর্মসূচী। তাই শুধু মুসলমানদের সাথেই নয় , বরং মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে মানব প্রজাতির প্রতিটি সদস্যের সাথেই সদাচরণ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে :

) و عاشروهن بالمعروف(

আর তোমরা তাদের (তোমাদের স্ত্রীদের) সাথে সদাচরণ করো। (সূরাহ্ আন্-নিসাা : 19)

) و لهن مثل الذی عليهن بالمعروف(

আর তাদের ওপরে যেভাবে (তোমাদের অধিকার) রয়েছে ঠিক সেভাবেই (তোমাদের ওপর) রয়েছে তাদের জন্য ন্যায়সঙ্গত অধিকার। (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : 228)

) و اعبدوا الله و لا تشرک به شيئاً و بالوالدين احساناً و بذی القربی و اليتامی و المساکين و الجاری ذی القربی و الجاری ذی الجنب و الصاحب بالجنب و ابن السبيل و ما ملکت ايمانکم ان الله لا يحب من کان مختالاً فخوراً(

তোমরা আল্লাহর বন্দেগী ও দাসত্ব করো এবং তাঁর সাথে কোনো কিছুকে শরীক করো না। আর পিতামাতার সাথে সদাচরণ করো এবং সদাচরণ করো আত্মীয়-স্বজন , ইয়াতীম , মিসকীন্ , নিকট প্রতিবেশী , দূর প্রতিবেশী , বন্ধু-বান্ধব , পথিক এবং তোমাদের দাস-দাসী (ও অধীনস্থ)দের সাথে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ উদ্ধত-অহঙ্কারী লোকদেরকে পসন্দ করেন না। (সূরাহ্ আন্-নিসাা : 36)

) و احسن کما احسن الله اليک و لا تبغ الفساد فی الارض ان الله لا يحب المفسدين(

আর (অন্যদের প্রতি) কল্যাণকামী ও দয়ার্দ্র হও ঠিক যেভাবে আল্লাহ্ তোমার প্রতি দয়া করেছেন। আর ধরণীর বুকে বিপর্যয় সৃষ্টি , দুষ্কৃতি ও পাপাচার করো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ বিপর্যয়সৃষ্টিকারী ও দুর্বৃত্ত-পাপাচারীদেরকে পসন্দ করেন না। (সূরাহ্ আল্-ক্বাছ্বাছ্ব্ : 77)

) ان رحمة الله قريب من المحسنين(

অবশ্যই আল্লাহর রহমত্ সৎকর্মশীল ও কল্যাণকারীদের অত্যন্ত কাছাকাছি অবস্থান করছে। (সূরাহ্ আল্-আ রাাফ্ : 56)

) و احسنوا ان الله يحب المحسنين(

আর তোমরা (অন্যদের) কল্যাণ সাধন করো ; নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ কল্যাণকারীদের পসন্দ করেন। (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : 195)

এ হচ্ছে কোরআন মজীদের ভারসাম্যপূর্ণ ও মধ্যম পন্থা অবলম্বনের শিক্ষাসমূহের কিছু দৃষ্টান্ত মাত্র।

ভালো কাজে আদেশ দান ও মন্দ কাজ প্রতিরোধ

কোরআন মজীদ মুসলিম উম্মাহর সমস্ত সদস্যের ওপর ভালো কাজের আদেশ দান ও মন্দ কাজের প্রতিরোধকে অপরিহার্য কর্তব্য রূপে নির্ধারণ করে দিয়েছে এবং এ দায়িত্বকে কোনো বিশেষ জনগোষ্ঠী বা মুষ্টিমেয় সংখ্যক লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেয় নি। কোরআন মজীদ তার এ মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে ব্যাপক আইন-বিধান প্রণয়ন করেছে , বরং এর মাধ্যমেই স্বীয় শিক্ষাকে প্রাণময় ও চিরস্থায়ী করেছে।

ইসলাম সমাজের প্রতিটি ব্যক্তিকে এবং প্রতিটি পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে পরস্পরের জন্য পর্যবেক্ষক ও পথনির্দেশকের দায়িত্ব প্রদান করেছে এবং প্রতিটি ব্যক্তিকেই অন্যদের ওপর দায়িত্বশীল করেছে। প্রকৃত পক্ষে ইসলাম প্রতিটি মুসলিম ব্যক্তির ওপর একেক জন পুলিশের দায়িত্ব প্রদান করেছে যে অন্যদেরকে নেক কাজ , কল্যাণ ও চিরন্তন সৌভাগ্যের দিকে পথনির্দেশ প্রদান করবে এবং যুলুম-শোষণ , নির্যাতন , লুণ্ঠন , পাপ ও দুষ্কৃতি থেকে তাদেরকে ফিরিয়ে রাখবে। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে সমস্ত মুসলমানই ইসলামের প্রচার-প্রসার এবং ইসলামী আইন-বিধান বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বশীল।

এমতাবস্থায় , এর চেয়ে বৃহত্তর এবং এর চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী ও প্রভাবশালী কোনো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কথা কল্পনা করাও সম্ভব কি ?

বর্তমান যুগে যে কোনো দেশেই রাষ্ট্রীয় আইন-কানূন্ কার্যকরী করার জন্য বিরাট পরিচালকমণ্ডলী ও শান্তিশৃঙ্খলা বাহিনীর আশ্রয় নেয়া হয় , কিন্তু তা সত্ত্বেও আইনলঙ্ঘন প্রতিরোধ করা সম্ভবপর হয় না। কারণ , পরিচালনা ও শান্তিশৃঙ্খলা বাহিনী যতোই বিশাল এবং যতোই সুসজ্জিত হোক না কেন , তাদের পক্ষে জাতির প্রতিটি মানুষের সাথে প্রতিটি স্থানে ও প্রতিটি সময়ে অবস্থান করে তাদের সমস্ত কাজকর্মের ওপর দৃষ্টি রাখা সম্ভবপর নয়।

কিন্তু ইসলাম এক সমুন্নত মহান পরিকল্পনা ও কর্মসূচীর আশ্রয় নিয়ে এবং ভালো কাজের আদেশ দান ও মন্দ কাজ প্রতিরোধ কে প্রতিটি মুসলমানের জন্য বাধ্যতামূলক করে দিয়ে কার্যতঃ শক্তিশালী ও বিশালায়তন এক বাহিনী সৃষ্টি করেছে। আর অন্যান্য বাহিনী ও এ বাহিনীর মধ্যে রয়েছে এক বিরাট পার্থক্য। তা হচ্ছে , কোনোরূপ ব্যয়বাজেট ছাড়াই এ বাহিনী যথারীতি তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে এবং সর্বত্র , সব সময় ও সব বিষয়ে দৃষ্টি রাখছে , আর সেই সাথে ইসলামের সমুন্নত আইন-বিধান বাস্তবায়নেরও নিশ্চয়তা বিধান করছে।

শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড জ্ঞান ও ন্যায়নিষ্ঠা

কোরআন মজীদ একের ওপর অন্যের প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্বের জন্য একমাত্র যে বিষয়টিকে মানদণ্ডরূপে গ্রহণ করেছে তা হচ্ছে জ্ঞান ও ন্যায়নিষ্ঠা - নীতিনিষ্ঠতা তথা খোদাভীরুতা। যেমন , কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে :

) ان اکرمکم عند اببه اتقاکم(

অবশ্যই তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সর্বাধিক সম্মানের পাত্র সেই ব্যক্তি যে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক ন্যায়নিষ্ঠ ও খোদাভীরু। (সূরাহ্ আল্-হুজুরাাত্ : 13)

) قل هل يستوی الذين يعلمون و الذين لا يعلمون( .

(হে রাসূল!) বলুন : , যারা জানে (জ্ঞানের অধিকারী) আর যারা জানে না (অজ্ঞ) তারা কি সমান হতে পারে ? (সূরাহ্ আয্-যুমার : 9)

সাম্য ও সমতা প্রতিষ্ঠা

কোরআন মজীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও গভীরতম আইন-বিধান ও শিক্ষাসমূহের অন্যতম হচ্ছে সাম্য ও সমতা। কোরআন মজীদ তার এ সাম্যের বিধানের আওতায় সমস্ত মুসলমানের মধ্যে ঐক্য , অভিন্নতা ও সাম্য প্রতিষ্ঠা করেছে , সবাইকে এক কাতারে এনে দাঁড় করিয়েছে এবং যে কোনো ধরনের বিশেষ অগ্রাধিকার ও বর্ণগত ভেদাভেদের মূলোৎপাটন করেছে , তেমনি একের ওপর অন্যের প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্বের মূলোচ্ছেদ করেছে।

হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) এরশাদ করেন : জাহেলীয়াতের যুগে যারা ঘৃণ্য , নীচ ও পদদলিত ছিলো মহান আল্লাহ্ তা আলা ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় দান করে তাদেরকে সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী করেছেন এবং ইসলামের মাধ্যমে জাহেলী যুগের গর্ব-অহঙ্কার - বর্ণ , গোত্র আত্মীয়-স্বজন ও পূর্বপুরুষের গৌরব , আর সব রকমের বর্ণ ও শ্রেণীগত ভেদাভেদের মূলোৎপাটন করেছেন। সাদা-কালো , আরব-অনারব নির্বিশেষে সমস্ত মানুষই আদমের বংশধর , আর আল্লাহ্ আদমকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। বস্তুতঃ শেষ বিচারের দিনে আল্লাহর নিকট প্রিয়তম লোক হিসেবে তারাই গণ্য হবে যারা সর্বাধিক ন্যায়নিষ্ঠ - খোদাভীরু। (فروع کافی-٢، باب ٢١: ان المؤمن کفو المؤمنة .)

হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) আরো এরশাদ করেছেন : সাধারণ জনগণের ওপর জ্ঞানীদের মর্যাদার তুলনা হচ্ছে তোমাদের মধ্যকার মুষ্টিমেয় সংখ্যক (শ্রেষ্ঠতর) লোকদের ওপর আমার মর্যাদা। (الجامع الصغير با شرح مناوی ٤/٤٣٢ .)

ইসলাম ঈমানী পূর্ণতার কারণে হযরত সালমান ফার্সীকে অন্য মুসলমানদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করেছে (যদিও তিনি ছিলেন অনারব) , এমনকি তাঁকে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর পরিবারের সদস্য হিসেবে পর্যন্ত ঘোষণা করেছে (بحار الانوار- ٤، باب ٧٦: فضائل سلمان .) , অন্যদিকে স্বয়ং হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর চাচা হওয়া সত্ত্বেও আবূ লাহাব্-কে তার কুফরী ও খোদাদ্রোহিতার কারণে জাহান্নামী হিসেবে ঘোষণা করেছে।

হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর জীবনচরিতও প্রমাণ করে যে , তিনি কখনোই এবং কোনো অবস্থায়ই স্বীয় বংশ-গোত্র বা বর্ণকে অন্যদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্য প্রদান করেন নি। তেমনি ঐ যুগের মানুষ যে সব বিষয়কে গৌরবের কারণ রূপে গণ্য করতো এবং তৎকালে প্রচলিত গর্ব-অহঙ্কার , শ্রেষ্ঠত্ব , মর্যাদা ও বিশেষ সুবিধার আরো যে সব মানদণ্ড বিদ্যমান ছিলো সেগুলোর ভিত্তিতে তিনি কোনোদিনই গর্ব-অহঙ্কার করেন নি বা বিশেষ সুবিধা গ্রহণ করেন নি। বরং তিনি মানুষকে আল্লাহ্ তা আলার একত্ব , নবুওয়াত্ , পরকাল ও নেক আমলের দিকে আহবান করেছেন।

হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) লোকদেরকে চিন্তা ও কর্মের ঐক্য এবং এক খোদার ইবাদত্-বন্দেগী ও আনুগত্যের দিকে পথনির্দেশ দিয়েছেন ও পরিচালনা করেছেন। এ পন্থায় তিনি মানুষের অন্তঃকরণের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে , তাদের অন্তর থেকে অযৌক্তিক গর্ব-অহঙ্কারের মূলোৎপাটন করতে এবং তার পরিবর্তে তাদের হৃদয়ে প্রেম-ভালোবাসা , মায়া-মহব্বত , সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের অঙ্কুরোদ্গম ঘটাতে সক্ষম হন। এর ফলে দেখা গেছে , অনেক সম্পদশালী ও সম্ভ্রান্ত লোক , ইতিপূর্বে ছোটলোকরূপে পরিগণিত দরিদ্র পরিবারের ছেলেদের সাথে নিজেদের মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের সাথে আত্মীয়তার বন্ধন প্রতিষ্ঠা করেছেন।

কালোত্তীর্ণ পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান

সার্বিকভাবে আমরা বলতে পারি যে , কোরআন মজীদের ধর্মীয় বিধিবিধান ও পার্থিব আইন-কানূনে এবং ইসলামের নৈতিক শিক্ষায় ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ের কল্যাণের প্রতি দৃষ্টি দেয়া হয়েছে। ইসলাম এমন আইন-বিধান ও সমাজব্যবস্থা প্রদান করেছে যা সকল যুগের সকল দেশের সকল মানবগোষ্ঠীর প্রয়োজন পূরণে তথা তাদের সকল সমস্যার সমাধানে সক্ষম।

ইসলামের আইন-বিধানে একদিকে যেমন মানুষের বস্তুগত ও পার্থিব জীবনের প্রতিটি দিক-বিভাগের প্রতি দৃষ্টি দেয়া হয়েছে , তেমনি মানুষের অবস্তুগত , মনোজাগতিক , নৈতিক , আধ্যাত্মিক ও পারলৌকিক প্রতিটি দিক-বিভাগের প্রতিও দৃষ্টি দেয়া হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে , যিনি এহেন নিখুঁত , পূর্ণাঙ্গ , সর্বাত্মক ও সর্বব্যাপক আইন-বিধান উপস্থাপন করেছেন তাঁর নবুওয়াতে কোনোরূপ সন্দেহের অবকাশ আছে কি ? বিশেষ করে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) যখন একদল সভ্যতার আলো বর্জিত ও নিরক্ষর মানুষের মাঝে দুনিয়ায় আগমন করেছেন এবং এমন লোকদের মধ্যে বড় হয়েছেন যারা আসমানী কিতাবের শিক্ষার সাথে এক বিন্দুও সম্পর্ক রাখতো না - এর সাথে পরিচিতও ছিলো না , ফলতঃ এ পর্যায়ের আইন-বিধান ও শিক্ষা ছিলো তাদের চিন্তাশক্তির , বরং তাদের কল্পনাশক্তিরও উর্ধে। তাই এ আইন-বিধান না তিনি কারো কাছ থেকে শিখে নিয়ে উপস্থাপন করেছিলেন , না নিজে রচনা করেছিলেন , বরং তা আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকেই তাঁকে প্রদান করা হয়েছিলো - এতে আর কোনোরূপ সন্দেহের অবকাশ থাকে কি ?