কোরআনের মু‘জিযাহ্

কোরআনের মু‘জিযাহ্ 0%

কোরআনের মু‘জিযাহ্ লেখক:
: নূর হোসেন মজিদী
প্রকাশক: -
বিভাগ: কোরআন বিষয়ক জ্ঞান

কোরআনের মু‘জিযাহ্

লেখক: নূর হোসেন মজিদী
: নূর হোসেন মজিদী
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 43027
ডাউনলোড: 3688

পাঠকের মতামত:

কোরআনের মু‘জিযাহ্
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 60 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 43027 / ডাউনলোড: 3688
সাইজ সাইজ সাইজ
কোরআনের মু‘জিযাহ্

কোরআনের মু‘জিযাহ্

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

কোরআনের অলৌকিকতা সম্পর্কে আপত্তি

অন্ধ আপত্তি : বিভ্রান্তি সৃষ্টিই উদ্দেশ্য

কোরআন মজীদ আল্লাহর কালাম্ হিসাবে সমগ্র মানব জাতির প্রতি এই বলে চ্যালেঞ্জ প্রদান করেছে যে , সম্ভব হলে তারা যেন কোরআনের সূরাহ্ সমূহের যে কোনো একটি সূরাহর সমতুল্য একটি সূরাহ্ রচনা করে নিয়ে আসে। কিন্তু কোনো মানুষই এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণে সক্ষম হয় নি। বরং কোরআন মজীদ কর্তৃক প্রদত্ত চ্যালেঞ্জের সামনে প্রত্যেকেই অক্ষমতার শির নত করে দিতে বাধ্য হয়েছে।

কিন্তু কোরআন মজীদের অন্ধ দুশমনদের জন্য কোরআনের মোকাবিলায় এ পরাজয় ছিলো অসহনীয়। তাই তারা অন্ধ বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে কোরআন মজীদ সম্পর্কে নানা রকম মিথ্যা ও ভিত্তিহীন আপত্তি তুলে মানুষের কাছে এ মহাগ্রন্থের মর্যাদাকে খাটো করার এবং কোরআন মজীদের সাথে ভালোভাবে পরিচিত নয় এমন লোকদেরকে কোরআনের প্রতি বিমুখ করার ঘৃণ্য পন্থা অবলম্বন করে।

অত্র অধ্যায়ে আমরা কোরআন মজীদের অন্ধবিরোধী পরাজিত দুশমনদের উত্থাপিত এ সব আপত্তি তুলে ধরবো এবং তার জবাব দেবো। এ থেকে একদিকে যেমন এ সব লোকের জ্ঞানের দৌড় ও চিন্তাধারা সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়বে , তেমনি এ-ও সুস্পষ্ট হয়ে যাবে যে , এ লোকেরা প্রবৃত্তির দাসবৃত্তির কারণে কীরূপ অন্ধভাবে আবোল-তাবোল বকছে এবং নিজেদেরকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়ার লক্ষ্যে ঘৃণ্য তৎপরতার আশ্রয় নিয়েছে।

এক : কোরআনে সাহিত্যিক ত্রুটি

তথ্যাভিজ্ঞ মহল জানেন , একদল খৃস্টান ধর্মযাজক ও পাশ্চাত্য জগতের একদল ইসলাম-বিশেষজ্ঞ খৃস্টান পণ্ডিত (প্রাচ্যবিদ)-এর পক্ষ থেকে কোরআন মজীদ সম্পর্কে কতক ভিত্তিহীন আপত্তি তুলে ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ লোকদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চলে আসছে। বর্তমানে এমন অনেক লোকও এ কাফেলায় যোগ দিয়েছে যারা কোরআন মজীদের জ্ঞান ও সাহিত্যিক মান সম্পর্কে আদৌ বিশেষজ্ঞ নয়। এদের সংখ্যা অনেক। তবে সামান্য চিন্তা করলেই , কোরআন ও ইসলাম সম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞান রাখে এমন যে কোনো লোকের কাছেই এদের আপত্তির অসারতা সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। এ থেকে পরিস্কার বোঝা যায় যে , আপত্তিকারীরা জেনে বুঝে উদ্দেশ্যমূলকভাবে এবং অজ্ঞ লোকদেরকে বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যে এহেন নোংরা অপকৌশলের আশ্রয় নিয়েছে।

এরা বলে : কোরআনে এমন অনেক বাক্য রয়েছে যা আরবী ভাষার ব্যাকরণিক নিয়ম-বিধি এবং বালাগ্বাত্ ও ফাছ্বাহাত্-এর সাথে সামঞ্জস্যশীল নয়। অতএব , এহেন গ্রন্থ মু জিযাহ্ হতে পারে না।

জবাব : দুই দিক থেকে তাদের এ আপত্তি অসার ও ভিত্তিহীন :

প্রথমতঃ আরবী ভাষার ইতিহাসে আরবরা যখন বালাগ্বাত্ ও ফাছ্বাহাতের ক্ষেত্রে উন্নতির চরম শিখরে উপনীত হয় তখন এবং বালাগ্বাত্ ও ফাছ্বাহাতের শ্রেষ্ঠতম নায়কগণের উপস্থিতিতে কোরআন মজীদ নাযিল্ হয়। আর কোরআন মজীদ তাদেরকেই এই বলে চ্যালেঞ্জ প্রদান করে যে , তাদের যদি শক্তি থাকে তাহলে তারা কোরআন মজীদের সূরাহ্ সমূহের মধ্য থেকে যে কোনো একটি সূরাহর সাথে তুলনীয় একটি সূরাহ্ নিয়ে আসুক। আর চ্যালেঞ্জ প্রদানের সাথে সাথেই এ-ও স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে , কোরআন মজীদের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা মানবীয় শক্তি-ক্ষমতা ও প্রতিভার উর্ধে , এমনকি দুনিয়ার সমস্ত মানুষ যদি একত্রিত হয় এবং এ কাজে পরস্পরকে সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করে , তবুও।

আল্লাহ্ তা আলা কোরআন মজীদের কোনো সূরাহর সমতুল্য সূরাহ্ রচনার চ্যালেঞ্জ দেয়ার সাথে সাথে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে জানিয়ে দিয়েছেন যে , তারা কখনোই এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারবে না। আল্লাহ্ তা আলা এরশাদ করেন :

) فان لم تفعلوا و لن تفعلوا(

এবং তোমরা যদি তা না পারো - আর (আল্লাহ্ জানেন যে ,) তোমরা কখনোই তা পারবে না , । (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : 24)

অতএব , কোরআন মজীদে যদি আরবী ব্যাকরণের নিয়ম-নীতির সামান্যতম ব্যতিক্রমও পরিলক্ষিত হতো , তাহলে আরবী ভাষা , তার ব্যাকরণগত নিয়ম-নীতি , শৈল্পিক কারুকার্য , বাকমাধুর্য , প্রাঞ্জলতা , ওজস্বিতা ইত্যাদি সম্পর্কে অন্যদের তুলনায় অধিকতর ওয়াকেফহাল এ ভাষার বালাগ্বাত্ ও ফাছ্বাহাতের শিরোমণিদের পক্ষ হতেই কোরআন মজীদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা হতো। তাদের পক্ষ থেকে খুব সহজেই এ যুক্তি উপস্থাপন করা হতো যে , ব্যাকরণ ও বালাগ্বাত্-ফাছ্বাহাতের বিচারে পর্যন্ত এ গ্রন্থে অমুক অমুক ত্রুটি আছে ; এমতাবস্থায় কী করে তা খোদায়ী কালাম্ হতে পারে ? আর শুধু এ যুক্তির জোরেই তাদের পক্ষে কোরআন মজীদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হওয়া সম্ভব ছিলো। এমতাবস্থায় উভয় পক্ষই তর্কযুদ্ধ ও তলোয়ারের যুদ্ধ - উভয় ধরনের যুদ্ধের হাত থেকেই রেহাই পেয়ে যেতো।

আর প্রকৃতই যদি এরূপ ঘটনা ঘটতো অর্থাৎ ঐ যুগে আরবী ভাষা ও সাহিত্যের বালাগ্বাত্-ফাছ্বাহাতের শিরোমণিদের - যারা সর্ব যুগেই আরবী ভাষা ও সাহিত্যের বালাগ্বাত্-ফাছ্বাহাতের শ্রেষ্ঠতম নায়করূপে স্বীকৃত - তাদের পক্ষ থেকে যদি কোরআন মজীদে ব্যাকরণগত ও বালাগ্বাত্-ফাছ্বাহাত্ সংক্রান্ত ভুল-ত্রুটি ও দুর্বলতা নির্দেশ করা হতো তাহলে নিশ্চয়ই ইতিহাসে তার উল্লেখ পাওয়া যেতো। অন্ততঃ অমুসলিম ইতিহাসবিদগণ , বিশেষ করে ইসলামের বিরোধী ইতিহাসকারগণ তা উল্লেখের সুযোগ কোনোভাবেই হাতছাড়া করতেন না। কিন্তু ইসলামের বন্ধু-দুশমন নির্বিশেষে কোনো ইতিহাসকারের ইতিহাসেই এ ধরনের কোনো ঘটনার উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায় না।

দ্বিতীয়তঃ কোরআন মজীদ যখন নাযিল্ হয় তখন বর্তমানে প্রচলিত গ্রন্থাবদ্ধ আরবী ব্যাকরণের কোনো অস্তিত্ব ছিলো না। বরং আরবী ভাষার বালাগ্বাত্-ফাছ্বাহাতের নায়কদের কথা বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করে এবং তাদের বক্তব্যের বাক্যগঠন ও শব্দসংযোজন প্রক্রিয়া ইত্যাদি নিয়ে সূক্ষ্মভাবে চিন্তা-গবেষণা করে পরবর্তীকালে আরবী ব্যাকরণের নিয়ম-বিধি সমূহ উদ্ঘাটন ও সংকলিত করা হয় ; কেবল তার পরেই আরবী ব্যাকরণ এক বিধিবদ্ধ শাস্ত্রের পর্যায়ে উন্নীত হয়।

তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেয়া হয় যে , কোরআন মজীদ খোদায়ী ওয়াহী নয় - কোরআন-বিরোধীরা যেরূপ দাবী করছে - তথাপি এটা সবাই মেনে নিতে বাধ্য যে , এ মহাগ্রন্থ বালাগ্বাত্-ফাছ্বাহাতের মহানায়কদের বক্তব্য থেকে কোনো অংশে পশ্চাদপদ নয় , বরং অধিকতর উন্নত মানের। কারণ , কোরআন মজীদ আরবী ভাষার বালাগ্বাত্ ও ফাছ্বাহাতের পূর্ণতাবিধানে বিরাট ভূমিকা পালন করেছে , যে কারণে আরবী ব্যাকরণের নিয়ম-বিধি সমূহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎস হচ্ছে কোরআন মজীদ।

অতএব , কোরআন মজীদ নাযিলের পরে প্রণীত আরবী ব্যাকরণের কোনো একটি নিয়ম যদি কোরআন মজীদের সাথে সামঞ্জস্যশীল না হয় তাহলে তা ঐ নিয়মেরই ত্রুটি ও দুর্বলতার পরিচায়ক ; কোরআনের নয়। তেমনি কোরআন মজীদের কোনো বাক্য বা বাক্যাংশ যদি আরবী ব্যাকরণের কোনো কাঠামোতেই ফেলা সম্ভব না হয় তাহলে তা-ও বিধিবদ্ধ ব্যাকরণের ও সংশ্লিষ্ট ব্যাকরণগ্রন্থ প্রণেতার জ্ঞানের অসম্পূর্ণতার পরিচায়ক ; কোরআন নাযিলকালীন আরবদের ভাষার মানদণ্ডে তা নিয়মবহির্ভূত ছিলো না।

তাছাড়া কোরআন মজীদের কোনো বাক্যকে কেবল তখনই আরবী ব্যাকরণের নিয়মের সাথে সামঞ্জস্যহীন বলা যেতে পারে যদি ঐ বাক্যটির পঠনপ্রক্রিয়া (قرأت ) সর্বসম্মত হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট বাক্যটির পঠনপ্রক্রিয়ায় যদি মতপার্থক্য থাকে এবং একটি বিশেষ পাঠ আরবী ব্যাকরণের নিয়মের সাথে সামঞ্জস্যহীন হয় তাহলে তা ঐ বিশেষ পাঠটির অগ্রহণযোগ্যতাই প্রমাণ করে , কোরআন মজীদের দুর্বলতা প্রমাণ করে না এবং তা তার মর্যাদাকে বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ন করে না। কারণ , কোরআন মজীদের এই বিখ্যাত পঠনপ্রক্রিয়াগুলো এক ধরনের ইজতিহাদের মাধ্যমে নির্ণীত হয়েছে ; সংশ্লিষ্ট ক্বারীগণ নিজস্ব চিন্তা-গবেষণা থেকে এ জাতীয় সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন , স্বয়ং হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) থেকে মুতাওয়াতির্ পর্যায়ে ও অকাট্যভাবে এ সব পঠনপ্রক্রিয়া বর্ণিত হয় নি।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য , কোরআন মজীদের সাতটি বিখ্যাত এবং অপেক্ষাকৃত কম খ্যাত আরো তিনটি পঠনপ্রক্রিয়া ( قرأت ) প্রচলিত রয়েছে। এই পঠনপ্রক্রিয়ার বিভিন্নতা মানে কোরআন মজীদের পা [ Text -متن ]- এর বিভিন্নতা নয়। এ পার্থক্য হচ্ছে কতক ক্ষেত্রে যতি বা বিরতির পার্থক্য এবং কদাচিৎ ই রাব্ ( اعراب - বাক্যমধ্যস্থ ভূমিকার ভিত্তিতে শব্দের শেষবর্ণের স্বরচিহ্ন )- এর পার্থক্য।

এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য যে , হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর যুগে আরবী লেখায় নোকতাহ্ , স্বরচিহ্ন ও যতিচিহ্ন ব্যবহার করা হতো না । কিন্তু এ সত্ত্বেও লেখাপড়া-জানা আরবরা নির্ভুলভাবেই আরবী লেখা পড়তে পারতেন। পরবর্তীকালে প্রধানতঃ অনারবদের কোরআন পাঠের সুবিধার্থে এগুলো উদ্ভাবন ও যোগ করা হয়। (এখনো আরব জাহানের আরবী বই-পুস্তক ও পত্রপত্রিকায় স্বরচিহ্ন ব্যবহৃত হয় না।) এছাড়া কোরআন মজীদের লিপিতে কেবল শ্রুতিমাধুর্য তথা পাঠসৌন্দর্যের উদ্দেশ্যে ধ্বনির মাত্রা , গ্রাম ও টান ইত্যাদি নির্দেশের লক্ষ্যে কতক চিহ্ন ব্যবহার করা হয় যার সাথে অর্থের কোনো সম্পর্ক নেই এবং যা অন্য কোনো আরবী বই-পুস্তকে ব্যবহৃত হয় না।

কোরআন মজীদের পঠনপ্রক্রিয়ার বিভিন্নতার বিষয়টি প্রধানতঃ এরূপ যে , ক্ষেত্রবিশেষে কেউ হয়তো কোথাও বিরতি সহকারে পড়েছেন , কেউ হয়তো পরবর্তী ও পূর্ববর্তী বাক্যদ্বয় বা বাক্যাংশদ্বয়কে অথবা বাক্য ও বাক্যাংশকে বিরতিহীনভাবে একত্রে পড়েছেন। এ ধরনের পঠনপ্রক্রিয়ার পার্থক্যের ফলে কোরআন মজীদের কোনো আয়াত বা তার অংশের তাৎপর্যে সাধারণতঃ কোনোই পার্থক্য ঘটে না। আর যদি কোথাও সামান্য পার্থক্য ঘটে সে ক্ষেত্রে যেখানে যে পঠনপ্রক্রিয়া অধিকতর ব্যাকরণসম্মত তা-ই গ্রহণ করতে হবে।

প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী হযরত রাসূলে আকরাম্ ( ছ্বাঃ ) এ সাত বা দশ ধরনের পঠ নপ্রক্রিয়ায় কোরআন পাঠের অনুমতি দিয়েছিলেন , কিন্তু প্রকৃত পক্ষে এ পঠনপ্রক্রিয়াগুলো হযরত রাসূলে আকরাম্ ( ছ্বাঃ ) থেকে মুতাওয়াতির্ সূত্রে বর্ণিত নয় বিধায় তা অকাট্য নয়। অর্থাৎ কোরআন মজীদের পাঠ [ Text -متن ]হযরত নবী করীম ( ছ্বাঃ ) থেকে যেভাবে মানবজাতির ইতিহাসে সর্বে াচ্চ পর্যায়ের ব্যতিক্রমী মুতাওয়াতির্ ভাবে বর্ণিত হয়েছে , উক্ত সাত বা দশ পঠনপ্রক্রিয়া ( قرأت ) সেরূপ মুতাওয়াতির্ ভাবে বর্ণিত হয় নি। অতএব , উক্ত দশ পঠনপ্রক্রিয়ার বাইরে কোরআন মজীদের আরো যে সব ব্যতিক্রমী পঠনপ্রক্রিয়া রয়েছে সে সব কেউ অনুসরণ করলেও দোষের কিছু নেই। বরং কোরআন - বিশেষজ্ঞদের জন্য সমগ্র কোরআন মজীদের ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ পঠনপ্রক্রিয়ার অন্ধ অনুসরণের পরিবর্তে যেখানে যে পঠনপ্রক্রিয়া অধিকতর ব্যাকরণসম্মত ও তাৎপর্য গ্রহণের জন্য অধিকতর সহায়ক সে ক্ষেত্রে সে পঠনপ্রক্রিয়া অনুসরণ করা উচিত।

দুই : কোরআনের অলৌকিকতার অনুধাবন সর্বজনীন নয়

কোরআন মজীদের অলৌকিকতা সম্পর্কে আপত্তিকারীরা আরো বলে : নীতিগতভাবেই বালাগ্বাত্ ও ফাছ্বাহাতের অধিকারী কালাম্ মু জিযাহ্ হতে পারে না , যদিও অন্যরা অনুরূপ কালাম্ রচনায় অক্ষম হয়। কারণ , কোনো কালামের বালাগ্বাত্ ও ফাছ্বাহাত্ বিচারের ক্ষমতা সকলের থাকে না। বরং মুষ্টিমেয় সংখ্যক লোকই তা বিচার করতে পারেন। অথচ মু জিযাহ্ সকলের বোধগম্য হওয়া অপরিহার্য - যাতে সবাই মু জিযাহ্ প্রত্যক্ষ করে মু জিযাহ্ প্রদর্শনকারীর নবুওয়াত-দাবীর সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারে।

জবাব : এ আপত্তিটিও পূর্ববর্তী আপত্তিটির ন্যায় দুর্বল , ত্রুটিপূর্ণ ও ভিত্তিহীন। কারণ , মু জিযাহর জন্য এটা কোনো শর্ত নয় যে , তা সমস্ত মানুষের বোধগম্য হতে হবে। মু জিযাহর সাথে এ ধরনের শর্ত জুড়ে দেয়া হলে কোনো মু জিযাহকেই মু জিযাহ্ রূপে গণ্য করা সম্ভব হবে না। কারণ , যে কোনো মু জিযাহর প্রতি লক্ষ্য করলেই আমরা দেখতে পাবো যে , কোনো না কোনো দিক থেকে তা সমস্ত মানুষের জন্য অনুধাবনযোগ্য নয়। বরং মু জিযাহ্ হচ্ছে এমন কাজ যা কিছু লোক প্রত্যক্ষ করে ও তার মু জিযাহ্ হওয়ার বিষয়টি অনুধাবন করে এবং পরম্পরা সূত্রে ও মুতাওয়াতির্ পর্যায়ের বর্ণনার মাধ্যমে অন্য লোকদের জন্য তা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।

উদাহরণ স্বরূপ , কেবল জাদুকরদের পক্ষেই প্রত্যয়ের সাথে বোঝা সম্ভব ছিলো যে , হযরত মূসা ( আঃ) যা দেখিয়েছেন তা জাদু নয় - জাদুবিদ্যার মাধ্যমে তা দেখানো সম্ভব নয়। আর তাদের অক্ষমতা ও পরাজয়ই সাধারণ মানুষের জন্য হুজ্জাত্ ছিলো। অন্যথায় সাধারণ মানুষ তাঁকে বড় ধরনের একজন জাদুকর মনে করতে পারতো। অনুরূপভাবে চিকিৎসাবিজ্ঞান যে জন্মান্ধকে দৃষ্টি দিতে পারে না (অন্ততঃ ঐ সময়কার চিকিৎসাবিজ্ঞান পারতো না) তা কেবল চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের পক্ষেই বোঝা ও হযরত ঈসা ( আঃ)কে নবীরূপে চেনা সম্ভব ছিলো। অন্যথায় সাধারণ মানুষ তাঁকে অত্যন্ত উঁচু দরের একজন ডাক্তার মনে করতে পারতো। তেমনি কোরআন মজীদের একটি ছোট সূরাহর অনুরূপ একটি সূরাহ্ রচনা করতেও আরবী ভাষা ও সাহিত্যের বালাগ্বাত্ ও ফাছ্বাহাতের নায়কদের সম্মিলিত ব্যর্থতা ও অক্ষমতার স্বীকৃতি সাধারণ মানুষের সামনে প্রমাণ করে যে , হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) কোরআন নামে যা পেশ করেছেন তা রচনা করা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় , অতএব , তা তাঁর নিজের রচিত নয় , বরং তা আল্লাহ্ তা আলার কালাম্।

কিন্তু ইতিপূর্বে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে , সমস্ত নবী-রাসূলের ( আঃ) আনীত মু জিযাহর মধ্যে কোরআন মজীদ বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। কারণ , কালের প্রবাহে মুতাওয়াতির্ বর্ণনার তাওয়াতোর্ হারিয়ে যেতে পারে এবং সংশ্লিষ্ট মু জিযাহর ঐতিহাসিকতা সম্পর্কে সন্দেহের উদ্রেক হতে পারে , কিন্তু কোরআন মজীদ হচ্ছে চিরস্থায়ী ও সর্বকালীন মু জিযাহ্। যতোদিন আরব-অনারব নির্বিশেষে আরবী ভাষার সাথে পরিচিত লোকেরা বিদ্যমান থাকবে কোরআন মজীদের মু জিযাহর বৈশিষ্ট্যও ততোদিন বিদ্যমান থাকবে।

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করতে হয় যে , কোরআন মজীদ হচ্ছে মানবজাতির ইতিহাসে সর্বাধিক শক্তিশালী মুতাওয়াতির্ সূত্রে বর্ণিত গ্রন্থ যার একটি শব্দের ব্যাপারেও এ গ্রন্থ নাযিলের সময় থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত কোনোরূপ বিবেচনাযোগ্য মতপার্থক্য হয় নি এবং বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই যে , সর্ব যুগে সর্বস্থানে কোরআন মজীদের একটিই সংস্করণ বিদ্যমান। কিন্তু বর্তমানে তাওরাত্ ও ইনজীল্ নামে বাইবেল -এ যা অন্তর্ভুক্ত আছে তা এ পর্যায়ের নয়।

একদিকে যেমন বর্তমান বাইবেলের বহু সংস্করণ বিদ্যমান , তেমনি তা অধ্যয়ন থেকে সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ে যে , এতে আল্লাহর কালামের কিছু অংশের সাথে , যেটিকে যে নবীর ( আঃ) ওপর অবতীর্ণ কিতাব্ বলে দাবী করা হয় তাতে - সে নবীর ( আঃ) জীবনেতিহাস , নবী-রাসূলগণের ( আঃ) উক্তি এবং সংকলকদের বর্ণনা ও ব্যাখ্যা সংমিশ্রিত রয়েছে। অন্যদিকে বাইবেলভুক্ত পুস্তকসমূহ সংশ্লিষ্ট নবীদের ( আঃ) যুগে সংকলিত হয় নি এবং যখন সংকলিত হয়েছে তখন তা মুতাওয়াতির্ সূত্রভিত্তিক বর্ণনার ওপর ভিত্তি করে সংকলিত হয় নি এবং সংশ্লিষ্ট বর্ণনাকারীদের সম্পর্কিত তথ্য সংরক্ষণ করা হয় নি ; পরবর্তী পর্যায়েও বহু যুগ পর্যন্ত তা মুতাওয়াতির্ সূত্রে বিস্তার লাভ করে নি ও সংশ্লিষ্ট বর্ণনাকারীদের সম্পর্কে তথ্য সংরক্ষিত হয় নি। আর এ সব পুস্তকের বিকৃতি এবং বিভিন্ন সংস্করণ হওয়ার জন্য এটাই দায়ী।

দ্বিতীয়তঃ পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণের ( আঃ) প্রদর্শিত মু জিযাহ্ সমূহ সম্পর্কে কেবল কোরআন মজীদের সাক্ষ্য থেকেই প্রত্যয় উৎপাদিত হওয়া সম্ভব , তবে কেবল মুসলমানরাই এ ধরনের প্রত্যয়ের অধিকারী। অন্যথায় , কোরআন মজীদের খোদায়ী কালাম্ হওয়ার বিষয়ে যারা ঈমান পোষণ করে না তাদের জন্য পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণের ( আঃ) প্রদর্শিত মু জিযাহ্ সমূহ প্রত্যয় উৎপাদনকারী হতে পারে না। কারণ , ঐ সব মু জিযাহর বর্ণনা প্রামাণ্য মুতাওয়াতির্ পর্যায়ের নয়। অর্থাৎ প্রতিটি যুগের সমস্ত বর্ণনাকারীর ধারাবাহিকতা এবং বর্ণনাকারীদের নির্ভরযোগ্যতা যাচাইমূলক পরিচিতি সংরক্ষিত হয় নি যেভাবে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) থেকে মুতাওয়াতির্ সূত্রে বর্ণিত হাদীছ সমূহের সকল যুগের বর্ণনাকারীদের নাম , পরিচয় , জীবনেতিহাস ইত্যাদি সবই সংরক্ষিত হয়েছে।

তাই দেখা যায় , মুসলমানরা কোরআন মজীদে বর্ণিত পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণের ( আঃ) নবুওয়াত ও তাঁদের মু জিযাহ্ সমূহের ব্যাপারে ততোখানি দৃঢ় ঈমান পোষণ করে ঠিক যতোখানি দৃঢ় ঈমান পোষণ করে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর নবুওয়াত ও মু জিযাহ্ সমূহের ওপর। আর কোরআন মজীদের তাওয়াতোর্ তো মুতাওয়াতির্ হাদীছে সমূহের তাওয়াতোরের তুলনায়ও বহু গুণে বেশী।

বস্তুতঃ কেউ যদি কোরআন মজীদের আল্লাহর কালাম্ ও হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর নবী হওয়ার বিষয়ে ঈমানের অধিকারী না-ও হয় তথাপি কোনো বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন ওয়াকেফহাল লোকের পক্ষেই এ ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করা সম্ভব নয় যে , বর্তমানে প্রচলিত কোরআন নামক গ্রন্থখানিকে হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) আল্লাহর কিতাব্ বলে দাবী করে রেখে গেছেন এবং তিনি যেভাবে রেখে গেছেন সামান্যতম পরিবর্তন ছাড়াই তা হুবহু বর্তমান আছে।

অন্যদিকে তাওরাত্ ও ইনজীলের অনুসারী হবার দাবীদার লোকদেরও অনেকেই , এমনকি তাদের মধ্যকার অনেক পণ্ডিত-গবেষক পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণের ( আঃ) মু জিযাহ্ সমূহের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করে থাকেন এবং তাঁরা এ সব মু জিযাহর পার্থিব ও বস্তুগত কারণ ভিত্তিক ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করছেন। যেমন : হযরত মূসা ( আঃ)-এর লাঠি মানে তাঁর রাজনৈতিক শক্তি - বানী ইসরাঈলকে সঙ্ঘবদ্ধ করার মাধ্যমে তিনি যার অধিকারী হয়েছিলেন , আর হযরত ঈসা ( আঃ)-এর দ্বারা মৃতকে জীবন্ত করা মানে আধ্যাত্মিকভাবে মৃত বানী ইসরাঈলকে আধ্যাত্মিক জীবন দান এবং জন্মান্ধকে দৃষ্টিদান মানে অজ্ঞদেরকে জ্ঞানের আলোতে নিয়ে আসা ইত্যাদি।

কিন্তু সকল ক্ষেত্রে তাদের পক্ষে এভাবে রূপক ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাই দেখা যায় , ইয়াহূদী ও খৃস্টান উভয় ধর্মাবলম্বীরা হযরত মূসা ( আঃ)কে নবী হিসেবে স্বীকার করা সত্ত্বেও অনেক ইয়াহূদী-খৃস্টান পণ্ডিত মানতে পারছেন না যে , তাঁর লাঠির আঘাতে লোহিত সাগরের পানি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গিয়ে তাঁদেরকে মিসরের মূল ভূখণ্ড থেকে সীনাই উপদ্বীপে পৌঁছার সুযোগ তৈরী করে দিয়েছিলো। তাঁরা গলদঘর্ম হয়ে চিন্তা-গবেষণা করেও ভেবে পাচ্ছেন না যে , তিনি কীভাবে সীনাই-এ পৌঁছলেন।

এ ব্যাপারে তাঁদের মতামতসমূহের মধ্যে আছে : তিনি লোহিত সাগর নয় , ভাটার সময় নীল নদ পার হয়েছিলেন ; মিসরের মূল ভূখণ্ড ও সীনাই-এর মধ্যকার সীমান্তের কোনো নিরাপদ জায়গা দিয়ে পার হয়েছিলেন , সীমান্তে হয়তো কোনো ছোটখাট হ্রদ ছিলো , তাঁরা তা-ই পার হয়েছিলেন ; ভূমধ্য সাগরের উপকূলবর্তী কোনো ছোট উপসাগর পার হয়েছিলেন ; প্রবল বায়ুপ্রবাহের ফলে সুয়েয উপসাগরের পানি সরে যাওয়ায় তাঁরা সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েছিলেন ইত্যাদি। কিন্তু চূড়ান্ত বিশ্লেষণে তাঁরা যখন দেখতে পান যে , লক্ষ লক্ষ লোক সাথে নিয়ে ফির্ আউন ও তার সৈন্যসামন্তদের নাগাল অতিক্রম করে এর কোনো পন্থায়ই তাঁদের পক্ষে মিসরের মূল ভূখণ্ড থেকে সীনাই উপদ্বীপে পৌঁছা সম্ভব নয় তখন তাঁরা বিষয়টি অমীমাংসীত রেখে দিতে বাধ্য হয়েছেন।

তাঁদের এ সব সন্দেহ - সংশয়কে দোষারোপ করা যায় না। কারণ , এ সব পণ্ডিত ব্যক্তি অকাট্যভাবে জানেন যে , বর্তমানে প্রচলিত তাওরাত্ ও ইনজীল্ হিসেবে দাবীদার পুস্তকসমূহ সহ বাইবেলভুক্ত পুস্তকগুলো এবং হযরত মুহাম্মাদ ( ছ্বাঃ )- এর পূর্ববর্তী নবী - রাসূলগণের ( আঃ ) নবুওয়াত ও মু জিযাহর বিষয়টি , এমনকি তাঁদের অনেকের ঐতিহাসিকতার বিষয়টিও তাঁদের ( ইয়াহূদী - খৃস্টান পণ্ডিতদের ) নিকট অকাট্য প্রত্যয় উৎপাদনকারী মু তাওয়াতির্ সূত্রে পৌঁছে নি। শুধু তা - ই নয় , তাঁরা এ ব্যাপারেও অকাট্য প্রত্যয়ের অধিকারী যে , যে সব নবী - রাসূলের ( আঃ ) ঐতিহাসিকতা সম্বন্ধে তাঁরা মোটামুটি নিশ্চিত তাঁদের উপস্থাপিত ঐশী গ্রন্থগুলোও দারুণভাবে বিকৃত হয়েছে। তাঁরা এ - ও জানেন যে , বরং প্রকৃত সত্য হলো , ঐ সব গ্রন্থ আদৌ বিদ্যমান নেই। কারণ , গ্রন্থগুলোর পাঠ ( Text)থেকেই প্রমাণিত হয় যে , এগুলো তাঁদের পরে অন্য লোকদের দ্বারা লিখিত।

কিন্তু মানবজাতির ইতিহাসে কোরআন মজীদ সর্বোচ্চ মুতাওয়াতির্ গ্রন্থ হওয়া সত্ত্বেও যথেষ্ট তথ্যাভিজ্ঞ না হওয়া , বক্রচিন্তা , খুঁতখুঁতে স্বভাব বা সন্দিগ্ধমনা হবার কারণে কারো মনে হয়তো কোরআন মজীদের মুতাওয়াতির্ হওয়া ও অবিকৃত থাকার ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষ করে চৌদ্দশ বছর আগে নাযিল্ হওয়ার কারণে কোরআন মজীদের সর্বোচ্চ তাওয়াতোরের বিষয়টি সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে হলে যথেষ্ট অধ্যয়নের পরিশ্রম স্বীকার করতে হবে। কিন্তু যথাযথ যোগ্যতা ও প্রস্তুতির অভাবে অনেকের পক্ষেই তা সম্ভব নয়। এমনকি যাদের যথাযথ যোগ্যতা ও প্রস্তুতি আছে তাঁদেরও অনেকের পক্ষেই এ জন্য যথেষ্ট সময় ব্যয় করা সম্ভব না-ও হতে পারে।

আর যে সব পণ্ডিত ও মনীষী এ ব্যাপারে যথেষ্ট অধ্যয়ন ও গবেষণা করে কোরআন মজীদের সর্বোচ্চ তাওয়াতোর্ সম্বন্ধে অকাট্য প্রত্যয়ে উপনীত হয়েছেন তাঁদের মধ্যে যারা কোরআন মজীদের ওপর ঈমানদার নন সে ক্ষেত্রে এ মহাগ্রন্থের তাওয়াতোর্ প্রশ্নে অকাট্য প্রত্যয়ে উপনীত হওয়া সত্ত্বেও এর ঐশিতায় ঈমানদার না হওয়ার কারণে তাঁরা এর তাওয়াতোরের বিষয়টি প্রচার থেকে বিরত থাকতে পারেন। অন্যদিকে তাঁদের মধ্যে যারা কোরআন মজীদের ওপর ঈমানদার তাঁদের মতের ওপর সাধারণ মানুষ আস্থাশীল না-ও হতে পারে। মানুষ সন্দেহ করতে পারে যে , কোরআন মজীদের ঐশিতায় ঈমানদার (তাদের ধারণায় অন্ধ বিশ্বাসী) হবার কারণে এ সব মনীষী এ গ্রন্থের তাওয়াতোর্ সম্বন্ধে নিশ্চিত না হওয়া সত্ত্বেও দাবী করছেন যে , তাঁরা এ ব্যাপারে অকাট্য প্রত্যয়ে উপনীত হয়েছেন। শয়ত্বানের কুমন্ত্রণার কারণে এটা হওয়াই স্বাভাবিক।

বিশেষ করে অমুসলিম জনগণের মনে কোরআন মজীদের সর্বোচ্চ তাওয়াতোর্ সম্বন্ধে মুসলিম মনীষীদের দাবী প্রত্যয় সৃষ্টি করতে না-ও পারে। তাছাড়া কোরআন মজীদের তাওয়াতোর্ সম্বন্ধে প্রত্যয় হাছ্বিলের মানে এ নয় যে , অকাট্যভাবেই এটি ঐশী গ্রন্থ। বরং তাওয়াতোর্ থেকে অকাট্যভাবে কেবল এটাই প্রমাণিত হয় যে , হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) এ গ্রন্থ যেভাবে রেখে গেছেন এটি ঠিক সেভাবেই বর্তমান আছে ; এতে কোনো ধরনের পরিবর্তন ঘটে নি। এ সত্য স্বীকার করেও যে কোনো অমুসলিমের মনে হতে পারে যে , এটি কোনো ঐশী গ্রন্থ নয় , বরং হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)ই এটি রচনা করেছিলেন।

এমতাবস্থায় এমন একটি উপায় থাকা অপরিহার্য যা চৌদ্দশ বছর পরবর্তী বর্তমান প্রজন্মের জন্যই শুধু নয় , বরং হাজার হাজার বছর পরবর্তী প্রজন্মসমূহের কাছেও কোরআন মজীদকে অকাট্যভাবে ঐশী গ্রন্থ হিসেবে তুলে ধরবে। স্বয়ং কোরআন মজীদের চ্যালেঞ্জই হচ্ছে সেই একমাত্র পন্থা যা সমস্ত রকমের সন্দেহ-সংশয় ও শয়ত্বানী কুমন্ত্রণার জঞ্জাল অপসারণ করে যে কোনো সত্যান্বেষীর সামনে এ মহাগ্রন্থকে খোদায়ী কিতাব্ হিসেবে অকাট্যভাবে তুলে ধরছে। কারণ , সুস্থ বিচারবুদ্ধির অধিকারী যে কোনো ব্যক্তির নিকটই এটা একটা সুস্পষ্ট ও অকাট্য সত্য হিসেবে পরিগণিত হতে বাধ্য যে , যে গ্রন্থ খোদায়ী কিতাব্ হওয়ার দাবী করে তার সূরাহ্ সমূহের যে কোনো একটির (ক্ষুদ্রতমটির হলেও) সমতুল্য একটি সূরাহ্ তৈরীর জন্য সমগ্র মানবজাতিকে চ্যালেঞ্জ দিয়েছে , অথচ তার বিরোধীরা সকলে মিলেও প্রায় দেড় হাজার বছরেও সে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে নি , তখন সে গ্রন্থ সন্দেহাতীতভাবেই ঐশী গ্রন্থ।

সূর্য যখন মধ্যগগনে দেদীপ্যমান থাকে তখন তার অস্তিত্ব ও উপস্থিতি এবং সময়টি দিন হওয়ার ব্যাপারে অন্য কোনোরূপ যুক্তিতর্ক ও অনুসন্ধানের আশ্রয় গ্রহণের প্রয়োজন হয় না। ঠিক সেভাবেই মধ্যগগনের সূর্যের ন্যায়ই চ্যালেঞ্জ প্রদান করে দীর্ঘ চৌদ্দশ বছরেও চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার মতো কোনো ব্যক্তি বা সমষ্টিকে না পাওয়াই প্রমাণ করে যে , কোরআন মজীদ আল্লাহর কিতাব। আর কোরআন যখন সন্দেহাতীতভাবে আল্লাহর কিতাব্ এবং সেই কোরআনে যখন ঘোষণা করা হয়েছে যে , স্বয়ং আল্লাহ্ই কোরআনকে রক্ষা করবেন , তখন কোরআন মজীদ যে সমস্ত রকমের বিকৃতির উর্ধে তাতেও সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই।

কিন্তু চরম পরিতাপের বিষয় যে , কোরআন মজীদের এ চ্যালেঞ্জের বিষয়টি যেভাবে প্রচারিত হওয়া উচিত ছিলো - যা প্রতিটি মুসলমানের ঈমানী দায়িত্ব - সে তুলনায় সহস্রাংশ পরিমাণেও তা প্রচার করা হয় নি ও হচ্ছে না। ফলে অমুসলিমদের মধ্যকার সত্যান্বেষী লোকদের নিকট কোরআন মজীদের ঐশিতা অকাট্যভাবে প্রতিভাত হওয়া তো দূরের কথা অনেক মুসলমানেরও কোরআন সংক্রান্ত ধারণা বহুলাংশে অস্বচ্ছ। বিশেষ করে মুসলমান হিসেবে জন্মগ্রহণকারী ও আজীবন মুসলমান হিসেবে পরিচয় প্রদানকারী কতক লোক যখন কোরআন মজীদের কোনো কোনো বিধান পরিবর্তনের পদক্ষেপ নেয় বা দাবী তোলে বা এ সব বিধানের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে অথবা বলে যে , চৌদ্দশ বছর আগেকার প্রেক্ষপটে নাযিল হওয়া এ সব বিধিবিধান বর্তমান কালে হুবহু প্রয়োগযোগ্য নয় , তখন বোঝাই যায় যে , কোরআন মজীদ সম্পর্কিত তাদের ধারণা ঈমানের পর্যায়ভুক্ত নয়। কিন্তু এ জন্য তাদেরকে যতোটা দোষ দেয়া যায় তার চেয়ে বেশী দোষারোপ করতে হয় কোরআন মজীদের স্বরূপ তথা এর মু জিযাহ্ বা ঐশিতার বিষয়টি প্রচার না করাকে।

তিন : কোরআন চ্যালেঞ্জযোগ্য

আপত্তিকারীরা আরো বলে : আরবী ভাষার বালাগ্বাতের সাথে পরিচিত যে কোনো লোকের পক্ষেই কোরআনে ব্যবহৃত শব্দাবলীর অনুরূপ উন্নত মানের শব্দসম্ভার সংগ্রহ করা সম্ভব। আর যে ব্যক্তি আলাদাভাবে এক একটি শব্দের সাথে পরিচিত , তার পক্ষে ঐ সব শব্দ পরস্পর গ্রথিত করে কোরআনের বাক্যাবলীর ন্যায় বাক্য রচনা করা খুবই সহজ ব্যাপার। অতঃপর এ জাতীয় বাক্যাবলী সুবিন্যস্ত করে কোরআনের ন্যায় গ্রন্থ রচনা করাও তার পক্ষে সম্ভব।

জবাব : উত্থাপিত এ আপত্তি এমন কোনো যুক্তিভিত্তিক বক্তব্য নয় যা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন হতে পারে। কারণ , কোনো ব্যক্তির যদি কোরআন মজীদে ব্যবহৃত শব্দাবলীর অনুরূপ শব্দ তৈরী করার ও কোরআন মজীদের বাক্যাবলীর অনুরূপ বাক্য রচনার ক্ষমতা থাকে তাহলেই যে তার পক্ষে কোরআন মজীদের অনুরূপ কোনো গ্রন্থ রচনা বা কোরআনের কোনো সূরাহর অনুরূপ সূরাহ্ রচনা করা সম্ভব হবে - এরূপ মনে করার পিছনে কোনোই যৌক্তিকতা নেই। কারণ , কোনো ব্যক্তির শব্দগঠন ও বাক্যরচনার যোগ্যতা থাকলেই তার গ্রন্থ বা প্রবন্ধ রচনার যোগ্যতা থাকবেই এমন নয়। কী করে এটা দাবী করা যেতে পারে যে , যেহেতু মানবজাতির যে কোনো সদস্যই কোনো ভবন নির্মাণে এক বা একাধিক ইট গাঁথতে সক্ষম সেহেতু যে কারো পক্ষেই একেকটি সুরম্য প্রাসাদ গড়ে তোলা সম্ভব ?!

এটাই বা কী করে সম্ভব যে , আরবী ভাষাভাষী যে কোনো লোক বা আরবী-জানা যে কোনো লোকই বালাগ্বাত্ ও ফাছ্বাহাতের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ বক্তৃতা-ভাষণ প্রদানে বা কবিতা রচনায় সক্ষম হবে ?! অথচ আরবী ভাষাভাষী প্রতিটি লোকই তো আরবী ভাষার বাগ্মিতামণ্ডিত ভাষণ ও উন্নত মানের কবিতাসমূহের শব্দাবলী আলাদাভাবে উচ্চারণ করতে সক্ষম।

কারণ , শুধু আরবী ভাষা বা কোরআন মজীদের ক্ষেত্রেই নয় , বরং যে কোনো ভাষার ক্ষেত্রেই সুন্দর সুন্দর শব্দ আয়ত্ত করতে বা বিচ্ছিন্নভাবে সুন্দর বাক্য রচনা করতে সক্ষম ব্যক্তিমাত্রই সুন্দর কবিতা বা কথিকা বা প্রেরণাদায়ক ভাষণ রচনা করতে সক্ষম নয়। তবে কবি-সাহিত্যিকগণ চেষ্টা করলে অন্য কবি-সাহিত্যিকের রচনার সম মানের বা তার চেয়ে উন্নততর মানের রচনা উপস্থাপনে সক্ষম হতে পারেন , ঐ সব কবিতা বা রচনার শব্দাবলী মুখস্তকারী যে কোনো ব্যক্তির পক্ষে তা সম্ভব নয়। কিন্তু বালাগ্বাত্ ও ফাছ্বাহাতের বিচারে কোরআন মজীদ এমন এক ব্যতিক্রমী মানের গ্রন্থ যে , কোরআনের সমস্ত শব্দের সাথে পরিচিত যে কোনো লোকের পক্ষে তো দূরের কথা , আরবী ভাষার বালাগ্বাত্ ও ফাছ্বাহাতের নায়কদের পক্ষেও এর সমতুল্য গ্রন্থ বা এর কোনো সূরাহর অনুরূপ সূরাহ্ রচনা করা সম্ভব নয় ; সম্ভব হলে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর যুগের কোরআন-বিরোধী বালাগ্বাত্ ও ফাছ্বাহাতের মহানায়করা এ থেকে মোটেই পিছপা হতো না।

এদের এ আপত্তির ত্রুটি ও দুর্বলতা ছ্বারফাহ্ (صرفة ) তত্ত্বের প্রবক্তাদের বক্তব্যের ত্রুটি ও দুর্বলতারই অনুরূপ। এ তত্ত্বের প্রবক্তারা অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে , কোরআন মজীদের বিকল্প রচনা করা সম্ভব , কিন্তু কোরআনের অলৌকিকত্ব এখানে যে , যে কেউ কোরআন মজীদের সাথে মোকাবিলা করার উদ্যোগ নেবে আল্লাহ্ তা আলা তাকে তা থেকে বিরত রাখবেন।

কিন্তু এ তত্ত্বে ত্রুটি ও দুর্বলতা নিহিত রয়েছে। তা হচ্ছে :

(1) তাঁদের এ তত্ত্বের দ্বারা তাঁরা যদি বুঝাতে চান যে , আল্লাহ্ তা আলা মানুষকে কোরআনের অনুরূপ গ্রন্থ রচনার ক্ষমতা দিতে পারেন , কিন্তু তিনি কাউকেই এ ক্ষমতা দেন নি , তাহলে তা অবশ্য সঠিক কথা হবে। কিন্তু এ অর্থে ছ্বারফাহ্ শুধু কোরআন মজীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় , বরং সমস্ত নবী-রাসূলের ( আঃ) সমস্ত মু জিযাহর ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য।

আর ছ্বারফাহ্ তত্ত্বের দ্বারা তাঁরা যদি এ কথা বুঝাতে চেয়ে থাকেন যে , মানুষ কোরআনের বিকল্প রচনায় সক্ষম , কিন্তু আল্লাহ্ তা আলা তাদেরকে কোরআনের মোকাবিলা থেকে বিরত রেখেছেন এবং তাদের এ কাজের উদ্যোগ নেয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করে রেখেছেন , তাহলে তা গ্রহণযোগ্য নয়। বরং এ দাবীর অযথার্থতা স্বতঃই সুস্পষ্ট। কারণ , আমরা জানি যে , বহু লোকই কোরআন মজীদের বিরুদ্ধে মোকাবিলার (এর বিকল্প রচনা করার) চেষ্টা করেছিলো এবং এ ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা আলা যে তাদেরকে বিরত রাখেন নি শুধু তা-ই নয় , বরং এ ক্ষেত্রে তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করে চেষ্টা চালিয়েছিলো। কিন্তু কোরআন মজীদের বিরুদ্ধে মোকাবিলা ও এর বিকল্প রচনার ক্ষমতা তাদের ছিলো না। তাই শেষ পর্যন্ত তারা কোরআন মজীদের বালাগ্বাত্ ও ফাছ্বাহাতের মোকাবিলায় স্বীয় অক্ষমতা স্বীকার করে নিয়ে পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয়।

(2) কোরআন মজীদের অলৌকিকতা যদি ছ্বারফাহ্ তত্ত্বের ওপর ভিত্তিশীল হয় অর্থাৎ বিষয়টি যদি এরূপ হয় যে , কোরআন মজীদ নাযিলের পর আল্লাহ্ তা আলা মানুষের কাছ থেকে এর বিকল্প উপস্থাপনের ক্ষমতা হরণ করে নিয়েছেন , তাহলে তার অর্থ হবে এই যে , কোরআন মজীদের অবতরণ ও চ্যালেঞ্জ প্রদানের পূর্বেকার বাগ্মী ও কবি-সাহিত্যিকদের যে সব বক্তব্য ও কবিতা বিদ্যমান ছিলো (এবং এখনো রয়েছে) তাতে কোরআন মজীদের সম মানের কবিতা , ভাষণ ইত্যাদি বিদ্যমান থাকা সম্ভব। কিন্তু এহেন কোনো কিছু বিদ্যমান থাকলে কোরআন মজীদের চ্যালেঞ্জের জবাবে এর বিরোধীরা তা উপস্থাপন করতো এবং পরম্পরায় তা আমাদের পর্যন্ত পৌঁছতো। কিন্তু যেহেতু এহেন কোনো বক্তব্য উদ্ধৃত হয় নি , সেহেতু এটা সপ্রমাণিত যে , কোরআন মজীদ হচ্ছে খোদায়ী মু জিযাহ্ যার মোকাবিলা ও বিকল্প রচনা করা মানুষের পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়।

এ তত্ত্বের ভিত্তিহীনতা আরো এক দৃষ্টিকোণ থেকেও সুস্পষ্ট। তা হচ্ছে , কোরআন মজীদের বিকল্প রচনার চ্যালেঞ্জ প্রদানের ভিত্তি এই যে , সৃষ্টির কালাম্ ও স্রষ্টার কালাম্ কখনোই এক মানের হতে পারে না । অতএব , কোরআন মজীদের আল্লাহর কালাম্ হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ হলে তোমরা সকলে মিলে এর বিকল্প রচনার চেষ্টা করে দেখো। তোমরা যদি মনে করো যে , এটি মানুষের [হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর] রচিত তাহলে , তোমাদের ধারণা অনুযায়ী , এক ব্যক্তির রচিত গ্রন্থের মোকাবিলায় সকলে মিলে উন্নততর না হোক , অন্ততঃ সম মানের গ্রন্থ উপস্থাপনে সক্ষম হবে , আর যদি সক্ষম না হও (এবং আল্লাহ্ জানেন যে , সৃষ্টির পক্ষে স্রষ্টার কালামের সম মান সম্পন্ন কালাম্ রচনা সম্ভব নয়) তাহলে তোমরা এ কোরআনকে আল্লাহর কালাম্ রূপে মেনে নাও। তার পরিবর্তে সৃষ্টির মধ্যে যেমন স্রষ্টার কালামের সম মানের কালাম্ রচনা করার ক্ষমতা থাকা সম্ভব নয় , অন্যদিকে , যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেয়া হয় যে , তা সম্ভব , তাহলে আল্লাহ তা আলা মানুষকে প্রদত্ত সে স্বাভাবিক ক্ষমতা হরণ করে নিয়ে তাকে অক্ষম বানিয়ে এরপর তাকে চ্যালেঞ্জ দেবেন আল্লাহ তা আলার মহান মর্যাদার সাথে এটা সামঞ্জস্যশীল নয়।

অবশ্য সৃষ্টি বা সৃষ্টিলক্ষ্যের প্রয়োজনে আল্লাহ তা আলা কোনো মানুষের কোনো স্বাভাবিক ক্ষমতা হরণ করে নিতে পারেন , সেটা ভিন্ন কথা , কিন্তু প্রদত্ত ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে চ্যালেঞ্জ দেবেন এ ধরনের নীচু মানের কাজ আল্লাহ তা আলার শানে চিন্তা করাও অসম্ভব। দ্বিতীয়তঃ এভাবে বিকল্প রচনার ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে যদি কোরআনের সামনে নতি স্বীকার করাতে হয় তাহলে তার চেয়ে উত্তম হয় যদি আদৌ কারো মনে কোরআনের খোদায়ী কিতাব্ হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টি না হয়। কিন্তু এভাবে মানুষকে যন্ত্র বানিয়ে তাঁর আনুগত্যে বাধ্য করা আল্লাহ্ তা আলার নীতি নয়। বরং আল্লাহ তা আলা চান , মানুষ তার ইচ্ছাশক্তি ও কর্মের পূর্ণ স্বাধীনতা সত্ত্বেও স্বীয় বিচারবুদ্ধি ও জ্ঞানের ফয়ছ্বালার ভিত্তিতে স্বেচ্ছায় তাঁর আনুগত্য করুক।

চার : পূর্ববর্তী ঐশী গ্রন্থাবলীর সাথে কোরআনের বৈপরীত্য

এরা বলে : আমরা যদি কোরআনের মু জিযাহ্ হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেও নিই , তথাপি একে এর উপস্থাপনকারীর সত্যবাদিতার দলীল হিসেবে গ্রহণ করতে পারি না। কারণ , কোরআনে যে সব কাহিনী বর্ণিত হয়েছে সেগুলোতে অনেক ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী আসমানী গ্রন্থ তাওরাত্ ও ইনজীলের সাথে বৈপরীত্য রয়েছে , অথচ তাওরাত্ ও ইনজীল্ নিশ্চিতভাবেই আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত আসমানী গ্রন্থ।

জবাব : আপত্তিকারীদের এ আপত্তিটি মূলগতভাবেই একটি ভ্রমাত্মক অপযুক্তি ( Fallacy -مغالطة )। কারণ , কোরআন মজীদ মু জিযাহ্ হওয়ার মানে হচ্ছে , তা আল্লাহর কালাম্ এবং যিনি তা উপস্থাপন করেছেন তিনি আল্লাহর নবী । এমতাবস্থায় অন্য যে কোনো লেখা বা কথা তার সাথে সাংঘর্ষিক হলে তার মিথ্যা ও বিকৃত হওয়া অকাট্যভাবে প্রমাণিত ও তা অবশ্য প্রত্যাখ্যাত। এর বিপরীতে যে সব পুস্তকের (বর্তমানে তাওরাত্ ও ইনজীল্ নামে প্রচলিত পুস্তক সমূহ) আল্লাহর মু জিযাহ্ হওয়া প্রমাণিত নয় এবং যাদের নামে সেগুলো প্রচলিত তাঁদের ঐতিহাসিকতা ও তাঁদের সাথে ঐ সব পুস্তকের সম্পর্ক অকাট্যভাবে (তাওয়াতোর্ পদ্ধতিতে) প্রমাণযোগ্য নয় সে সব পুস্তককে আসমানী কিতাব্ বলে দাবী করে তার মানদণ্ডে বিচার করে মু জিযাহর বাহকের নবুওয়াত-দাবী প্রত্যাখ্যান করা একটা হাস্যষ্কর অপযুক্তি বৈ নয়।

সুতরাং বর্তমানে তাওরাত্ ও ইনজীল্ নামে যা প্রচলিত আছে তাতে বর্ণিত উদ্ভট ও কুসংস্কারমূলক কাহিনীসমূহের সাথে কোরআন মজীদের বৈপরীত্য বরং এ মহাগ্রন্থের খোদায়ী ওয়াহী হওয়ার বিষয়টিকে অধিকতর সুস্পষ্টরূপে প্রমাণ করে এবং কোরআন মজীদ সম্পর্কে যে কোনো রূপ সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টির সম্ভাবনাকে দূরীভূত করে। কারণ , ঐ সব গ্রন্থে যে সব গাঁজাখুরী ধরনের কিচ্ছা-কাহিনী বর্ণিত হয়েছে - যা আল্লাহ্ তা আলার পবিত্র সত্তা ও মহান নবী-রাসূলগণ ( আঃ) সম্বন্ধে বিচারবুদ্ধির কাছে গ্রহণযোগ্য নয় - তা থেকে কোরআন মজীদ মুক্ত ও পবিত্র , বরং কোরআন এ সবকে সুস্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।

অতএব , এ সব ক্ষেত্রে বর্তমানে প্রচলিত তাওরাত্ ও ইনজীলের সাথে কোরআন মজীদের বৈপরীত্য বরং কোরআনের ওয়াহী হওয়ারই আরেকটি প্রমাণ। এ প্রসঙ্গে আমরা ইতিপূর্বেও আলোচনা করেছি এবং বর্তমানে তাওরাত্ ও ইনজীল্ নামে যা প্রচলিত আছে তাতে বিদ্যমান উদ্ভট ও গাঁজাখুরী ধরনের কিচ্ছা-কাহিনীর অংশবিশেষ তুলে ধরেছি এবং প্রমাণ করেছি যে , বর্তমানে প্রচলিত তাওরাত্ ও ইনজীল্ আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে যথাক্রমে হযরত মূসা ( আঃ) ও হযরত ঈসা ( আঃ)-এর ওপর নাযিলকৃত তাওরাত্ ও ইনজীল্ থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।

আপত্তিকারীরা যেহেতু বর্তমানে প্রচলিত তাওরাত্ ও ইনজীলকে আসমানী কিতাব্ বলে দাবী করে থাকে সেহেতু এখানে উক্ত নামের পুস্তকগুলো ও আরো কতগুলো পুস্তকের সংকলন বাইবেল সম্পর্কে অত্যন্ত সংক্ষেপে একটি সমন্বিত স্বচ্ছ ধারণা দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছি।

এ প্রসঙ্গে যে বিষয়টি সম্পর্কে খুব কম লোকই সচেতন তা হচ্ছে বাইবেলভুক্ত পুস্তকসমূহের বিকৃতি কোনো সাধারণ বিকৃতি নয় অর্থাৎ পুস্তকগুলোর মূল কাঠামো ঠিক রেখে মাঝে মাঝে কিছু কিছু সংযোজন-বিয়োজনের ব্যাপার নয়। বরং বাইবেলভুক্ত পুস্তকসমূহের কাঠামোই প্রমাণ করে যে , এগুলো যাদের নামে প্রচলিত তাঁদের পরবর্তী কালে রচিত হয়েছে। এ কারণে , ঐ সব পুস্তকে সংশ্লিষ্ট নবীদের (অর্থাৎ যে পুস্তক যে নবীর নামে প্রচলিত তাতে তাঁর) জীবনকাহিনী , সংশ্লিষ্ট লেখকদের উপস্থাপনা ও কিছু কিছু খোদায়ী ওয়াহীর সংমিশ্রণ ঘটেছে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে ঘটনার বিবরণ ও ওয়াহীর উদ্ধৃতিতেও বিকৃতিসাধন করা হয়েছে।

বাইবেলভুক্ত পুস্তকগুলোর মধ্যে গীতসংহিতা , হিতোপদেশ , উপদেশক সোলায়মানের পরম গীত বাদে বাকী পুস্তকগুলোর গ্রন্থনাকাঠামো সম্পূর্ণরূপে মানবরচিত বইপুস্তকের , বরং সাধারণ স্তরের লেখকদের বইপুস্তকের গ্রন্থনাকাঠামোর অনুরূপ। (উপরোল্লিখিত চারটি পুস্তক মূলতঃ দো আ ও ওয়াযের সংকলন ; অবশ্য তা-ও বিকৃতিমুক্ত নয়।) উপরোক্ত চারটি পুস্তক এবং স্বল্প বিকৃতি যুক্ত গণনা পুস্তক দ্বিতীয় বিবরণ -এর অংশবিশেষ - যাতে বিভিন্ন হুকুম-আহ্কাম্ বর্ণিত হয়েছে - বাদে গোটা বাইবেল হচ্ছে একটি বিকৃতিভারাক্রান্ত ইতিহাসগ্রন্থ মাত্র - যার রয়েছে পারস্পরিক বিরাট পার্থক্যযুক্ত বহু সংস্করণ।

বর্তমানে বিশ্বে সর্বাধিক প্রচলিত (এবং বাংলাদেশেও প্রচলিত) বাইবেল -এর পুরাতন নিয়ম অংশে 39টি পুস্তক ও নতুন নিয়ম অংশে 27টি পুস্তক রয়েছে। কিন্তু এ্যাপোক্রিফা বাইবেল -এর পুরাতন নিয়ম অংশে আরো 12টি অতিরিক্ত পুস্তক রয়েছে। অন্যদিকে রোম্যান ক্যাথলিক বাইবেলে এ তিনটি অংশই রয়েছে , তবে এ্যাপোক্রিফা বাইবেল -এর পুরাতন নিয়ম ভুক্ত 12টি পুস্তকের মধ্যে ইদরীস-1 , ইদরীস-2 মানাসসার প্রার্থনা এ থেকে বাদ দেয়া হয়েছে।

বাইবেলের অনেকগুলো পুস্তক , বিশেষ করে নতুন নিয়ম ভুক্ত পুস্তকগুলোর মধ্য থেকে প্রথম চারটি পুস্তক বাদে বাকী 23টি পুস্তককে স্বয়ং বাইবেল-প্রণেতারাও কোনো নবীর সাথে সম্পৃক্ত করেন নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ সব পুস্তককে তাঁরা নবীদের ( আঃ) সাথে সম্পৃক্তকৃত পুস্তক সমূহের সাথে অভিন্ন সংকলনে স্থান দিয়ে পবিত্র পুস্তক -এর মর্যাদা দিয়েছেন।

অন্যদিকে পুরাতন নিয়ম -এর প্রথম পাঁচটি পুস্তককে তাওরাত্ (অর্থাৎ তাওরাতের পাঁচটি পর্যায়ক্রমিক খণ্ড) বলে এবং নতুন নিয়ম -এর প্রথম চারটি পুস্তককে ইনজীল্ বলে দাবী করা হয়। তবে এ চারটি পুস্তক তাওরাতের পাঁচ পুস্তকের ন্যায় ইনজীলের পর্যায়ক্রমিক চারটি খণ্ড নয় , বরং একই বিষয়ে চারজন লেখকের লেখা চারটি ভিন্ন ভিন্ন পুস্তক। বলা বাহুল্য যে , চারটি পুস্তকের প্রতিটিই হচ্ছে হযরত ঈসা ( আঃ)-এর জীবনকাহিনী। অবশ্য তাতে তাঁর প্রতি নাযিলকৃত আসমানী কিতাবের (ইনজীলের) আয়াত সমূহের কিছু অংশও তাঁর উক্তি হিসেবে (বিকৃতি সহ) স্থান পেয়েছে।

উক্ত চারটি পুস্তকের মধ্যে বহু পরস্পরবিরোধিতার অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও খৃস্টানরা এ চারটি পুস্তককেই সঠিক গণ্য করে নতুন নিয়ম -এ স্থান দিয়েছে ও পবিত্র (!) পুস্তকের মর্যাদা দিয়েছে। অবশ্য বাইবেল-প্রণেতাদের প্রতি এ জন্য কৃতজ্ঞতা জানাতে হয় যে , তাঁরা এ চারটি পুস্তকের নামকরণ করেছেন এর লেখকদের নামে , হযরত ঈসা ( আঃ)-এর নামে নয়। অবশ্য এছাড়া উপায়ও ছিলো না। কারণ , চারজন লেখকের একই বিষয়ে লেখা পুস্তক চালাতে গিয়ে তাঁরা লেখকদের নাম ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছেন।

তবে এই তথাকথিত ইনজীলের সংস্করণ মাত্র চারটি নয়। বরং সেন্ট পল্ - যিনি প্রথমে হযরত ঈসা ( আঃ)-এর বিরোধী ছিলেন এবং তাঁর উর্ধলোকে গমনের পরে (ইয়াহূদী ও খৃস্টান মতে , শূলে বিদ্ধ হয়ে নিহত হবার পরে) খৃস্ট ধর্ম গ্রহণ করেন এবং ঈসা ( আঃ)-এর প্রত্যক্ষ শিষ্যদের পরিবর্তে এ ধর্মের মুখপাত্রে পরিণত হন - সুবিধাজনক বিবেচনায় ইনজীলের এ চারটি সংস্করণকে অনুমোদন প্রদান করেন। অন্যথায় তথাকথিত ইনজীলের সংস্করণ অনেক। এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকায় 25টি ইনজীলের তালিকা আছে। 1813 খৃস্টাব্দে লন্ডন থেকে প্রকাশিত প্রোটেস্ট্যান্ট খৃস্টানদের বিখ্যাত গ্রন্থ এক্সিহোমো-তে প্রাথমিক যুগের 77টি (সংস্করণের) ইনজীলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। [ আল্লামাহ্ মোহাম্মাদ ছ্বাদেক্বী প্রণীত ও মৎ কর্তৃক বাংলায় অনূদিত বাইবেলে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) গ্রন্থে এর বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।]

ইনজীলের বিভিন্ন সংস্করণের মধ্যে একমাত্র বারনাবা ( Barnabas) লিখিত পুস্তকটিই অধিকতর নির্ভরযোগ্য। অবশ্য হযরত ঈসা ( আঃ)-এর প্রত্যক্ষ শিষ্য বারনাবা লিখিত পুস্তকটিও শুধু খোদায়ী কালামের (ইনজীলের) সংকলন নয় , বরং হযরত ঈসা ( আঃ)-এর জীবনকাহিনী - যাতে তাঁর যবানীতে খোদায়ী কালাম্ও রয়েছে। তবে প্রাপ্ত যে সব পুস্তক ইনজীল্ হবার দাবীদার সেগুলো অধ্যয়ন করলে বারনাবাসের ইনজীল কেই মোটামুটি ইচ্ছাকৃত বিকৃতি থেকে মুক্ত বলা চলে যদিও ছোটোখাটো ভুলভ্রান্তি রয়েছে।

উল্লেখ্য , ইনজীল্ নামে অভিহিত হযরত ঈসা ( আঃ)-এর জীবনীপুস্তকগুলোর লেখকদের মধ্যে একমাত্র বারনাবাই ছিলেন হযরত ঈসা ( আঃ)-এর ছ্বাহাবী (হাওয়ারী)।

যদিও প্রচলিত সবগুলো ইনজীলেই রাসূলে আকরাম্ হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর আগমন সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে , তবে তাঁর নামকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে বা পারাক্লিতাস্ হিসেবে অনুবাদ করা হয়েছে। কিন্তু একমাত্র বারনাবার ইনজীলের বিভিন্ন জায়গায় সুস্পষ্ট ভাষায় তাঁর মুহাম্মাদ নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া এ পুস্তকে এ-ও উল্লেখ করা হয়েছে যে , তাঁর রূহ্ হচ্ছে প্রথম সৃষ্টি ও আল্লাহ্ তা আলার সমগ্র সৃষ্টিকর্মের কেন্দ্রবিন্দু এবং আল্লাহ্ তা আলা বলেছেন , তাঁকে সৃষ্টি করা না হলে কিছুই সৃষ্টি করা হতো না। তেমনি এ পুস্তকে ত্রিত্ববাদকে অস্বীকার ও নিন্দা করা হয়েছে এবং হযরত ঈসা ( আঃ)-এর নিহত না হওয়া ও উর্ধলোকে আরোহণের কথা বলা হয়েছে। এ সব কারণে সেন্ট পল্ ও তাঁর অনুসারীরা বারনাবাসের ইনজীলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।

যাই হোক , কোরআন মজীদ যেভাবে সংরক্ষিত আছে হযরত ঈসা ( আঃ)-এর ওপর নাযিলকৃত ইনজীল্ যে কোনোরূপ বিকৃতি ও সংমিশ্রণ ছাড়া সেভাবে সংরক্ষিত নেই - এ সত্য অস্বীকার করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। তাওরাতের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। নিঃসন্দেহে হযরত মূসা ( আঃ)-এর গোটা জীবনকাহিনী , এমনকি তাঁর মৃত্যু সংক্রান্ত অধ্যায় তাঁর ওপরে আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত তাওরাতের অংশ বলে দাবী করার মতো হাস্যকর কাজ কোনো কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন ইয়াহূদী বা খৃস্টান করবেন না বলে আশা করা যায়।

পাঁচ : কোরআনে স্ববিরোধিতা

কোরআন-বিরোধীরা দাবী করে যে , কোরআনে স্ববিরোধী কথাবার্তা রয়েছে। তাদের দাবী অনুযায়ী কোরআনে এমন দু টি স্ববিরোধী কথা রয়েছে যা কোরআনের ওয়াহী হওয়াকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে। তা হচ্ছে :

(1) হযরত যাকারিয়া ( আঃ)-এর দো আ কবুল হওয়ার নিদর্শন এই যে , তিনি তিনদিন লোকদের সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলবেন না। এ কথা বুঝাতে গিয়ে কোরআন এক জায়গায় উল্লেখ করেছে :

) قال آيَتک اَلاّ تکلم الناس ثلاثة ايام الا رمزاً( .

তিনি (আল্লাহ্) বললেন : তোমার নিদর্শন এই যে , তুমি তিন দিন প্রতীকী ভাষায় ব্যতীত লোকদের সাথে কথা বলবে না। (সূরাহ্ আালে ইমরান্ : 41)

কিন্তু অন্যত্র একই প্রসঙ্গে উক্ত আয়াতের বিপরীতে তিনি তিন রাত লোকদের সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলবেন না বলে উল্লেখ করা হয়েছে :

) قال آيَتک اَلاّ تکلم الناس ثلاثة ليال سوياً( .

তিনি (আল্লাহ্) বললেন : তোমার নিদর্শন এই যে , তুমি তিন রাত স্বাভাবিক (বা একভাবে) কথা বলবে না। (সূরাহ্ মারইয়াম্ : 10)

উপরোক্ত দু টি আয়াত পরস্পর বিরোধী। কারণ , দো আ কবুল হওয়ার নিদর্শন হিসেবে একটিতে তিন দিন এবং অপরটিতে তিন রাত স্বাভাবিক কথা না বলার উল্লেখ করা হয়েছে।

জবাব : আরবী ভাষায়يوم শব্দটি কখনো কখনো দিন অর্থাৎ সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময় বুঝাতে ব্যবহৃত হয় এবং সে ক্ষেত্রে তার বিপরীত অর্থ তথা রাত্রি অর্থাৎ সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত সময় বুঝাতেليل শব্দ ব্যবহৃত হয়। যেমন , কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে :

) سخرها عليهم سبع ليل و ثمانية ايام حُسوماً( .

তিনি তাদের ( আাদ্ জাতির) ওপর সাত রাত ও আট দিনের জন্য তাকে (প্রবল বায়ু প্রবাহকে) বলবৎ করে দিলেন। (সূরাহ্ আল্-হাাক্বক্বাহ্ : 7)

এ আয়াতেيومليل পরস্পরের বিপরীত অর্থে ব্যহৃত হয়েছে।

কিন্তু আরবী ভাষায় কখনো কখনোيوم বলতে পুরো দিন ও রাত বুঝানো হয় । যেমন , কোরআন মজীদ এরশাদ হয়েছে :

) و تمتعوا فی دارکم ثلاثة ايام( .

আর তোমরা তিন দিনের জন্য (অর্থাৎ তিন দিন ও তিন রাত্রির জন্য) তোমাদের বাড়ীঘরে অবস্থানের সুবিধা ভোগ করে নাও। (সূরাহ্ হূদ : 65)

অনুরূপভাবেليل শব্দটি কখনো কখনো সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত সময় বুঝাতে ব্যবহৃত হয়। যেমন , কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে :

) و الليل اذا يغشی( .

শপথ রাত্রির যখন তা (সব কিছুকে অন্ধকারে) আবৃত করে নেয়। (সূরাহ্ আল্-লাইল্ : 1)

তেমনি ওপরে যেমন উদ্ধৃত করা হয়েছে :

) سخرها عليهم سبع ليل و ثمانية ايام حُسوماً( .

তিনি তাদের ( আাদ জাতির) ওপর সাত রাত ও আট দিনের জন্য তাকে (প্রবল বায়ু প্রবাহকে) বলবৎ করে দিলেন। (সূরাহ্ আল্-হাাক্বক্বাহ্ : 7)

কিন্তু কখনো কখনোليل শব্দটি পুরো দিন-রাত্রি বুঝাবার জন্য ব্যবহৃত হয়। যেমন , কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে :

) و اذا واعدنا موسی اربعين ليلة(

আর আমি যখন মূসাকে চল্লিশ রাত্রির জন্য (অর্থাৎ পর পর চল্লিশ দিন-রাত্রির জন্য) প্রতিশ্রুতি দিলাম। (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : 51)

বস্তুতঃ পুরো দিন-রাত বুঝাবার জন্য শুধুيوم বা শুধুليل ব্যবহারের দৃষ্টান্ত আরবী ভাষায় ভুরি ভুরি রয়েছে ; কোরআন মজীদেও এর আরো দৃষ্টান্ত রয়েছে।

উপরোক্ত দৃষ্টান্তসমূহ থেকে সুস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে , হযরত যাকারিয়া ( আঃ)-এর দো আ কবুল হওয়া সংক্রান্ত উক্ত দু টি আয়াতের মধ্যে প্রথমটিতে পুরো দিন-রাত্রি বুঝাতেليل ব্যবহৃত হয়েছে এবং একইভাবে দ্বিতীয়টিতে পুরো দিন-রাত্রি বুঝাতেيوم ব্যবহৃত হয়েছে। অতএব , উক্ত আয়াতদ্বয়ের মধ্যে কোনোরূপ স্ববিরোধিতার অস্তিত্ব নেই। উক্ত আয়াতদ্বয়ের মধ্যে স্ববিরোধিতা তো নেই-ই , বরং আয়াতদ্বয় পরস্পরের ব্যাখ্যাকারী।

এছাড়া উভয় আয়াতেই যদি শুধুيوم ব্যবহৃত হতো তাহলে কারো পক্ষে তিন দিন ও তিন রাত্রি এবং কারো পক্ষে শুধু তিন দিন (রাত্রি নয়) অর্থ গ্রহণ করার সুযোগ থাকতো। অনুরূপভাবে উভয় আয়াতে যদি শুধুليل ব্যবহৃত হতো তাহলে কারো পক্ষে তিন দিন ও তিন রাত্রি এবং কারো পক্ষে শুধু তিন রাত্রি (দিন নয়) অর্থ গ্রহণ করার সুযোগ থাকতো। এমতাবস্থায় দুই আয়াতে দুই শব্দ ব্যবহৃত হওয়ায় তাৎপর্য গ্রহণের ক্ষেত্রে আর কোনো মতপার্থক্যের সুযোগ থাকলো না।

উক্ত আয়াতদ্বয়ের মধ্যে যারা স্ববিরোধিতা কল্পনা করেছে তারাيوم কে শুধু সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত অর্থে এবং অনুরূপভাবেليل কে শুধু সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় অর্থে গ্রহণ করেছে। অথচ উভয় শব্দেরই এতদভিন্ন অন্য অর্থও রয়েছে। তা হচ্ছে , উভয় শব্দেরই অন্যতম অর্থ পুরো দিন-রাত্রি

উল্লেখ্য , অন্য অনেক ভাষায়ই দিন রাত শব্দদ্বয়ের এ ধরনের ব্যবহার প্রচলিত আছে। বাংলা ভাষায় দিন বলতে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময় এবং দিন - রাত চব্বিশ ঘণ্টা উভয়ই বুঝানো হয়। ফার্সী ভাষায় روز ( দিন ) ش ب ( রাত )- এর ব্যবহার আরবী ভাষার অনুরূপ। যেমন , বলা হয় : دو شب آنجا بوديم - আমরা দুই রাত ( অর্থাৎ দুই দিন - রাত ) সেখানে ছিলাম। ইংরেজী ভাষায়ও এ ধরনের প্রচলন রয়েছে। যেমন , বলা হয় : Hotel fare per night 100 dollar. - হোটেল-ভাড়া প্রতি রাত (অর্থাৎ প্রতি দিন-রাত ) একশ ডলার। এখানে শুধু রাতের ভাড়া বুঝানো উদ্দেশ্য নয় , বরং দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টার ভাড়া বুঝানোই উদ্দেশ্য।

অতএব , উক্ত দুই আয়াতের মধ্যে স্ববিরোধিতার কল্পনা যে ভিত্তিহীন তা বলাই বাহুল্য।

এখানে আরেকটি বিষয়ও উল্লেখ করা যেতে পারে। তা হচ্ছে , উক্ত আয়াতদ্বয়ের মধ্যে স্ববিরোধিতা থাকলে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর যুগের ইসলাম-বিরোধী আরবরা একে পুঁজি করে কোরআনের বিরুদ্ধে মোকাবিলা করতো। কিন্তু শব্দদ্বয়ের অর্থ সম্পর্কে অবগত থাকায় তারা প্রতিবাদ করে নি। এ থেকে আরো সুস্পষ্ট যে , আরবী ভাষায় যথাযথ জ্ঞান ছাড়াই বিরোধীরা কোরআন মজীদের বিরুদ্ধে হাস্যকর আপত্তি তুলেছে।

এ প্রসঙ্গে আরো একটি বিষয় উল্লেখ করা যরূরী মনে করছি , তা হচ্ছে , অনেকেইرمز শব্দের অর্থ করেছেন আকার-ইঙ্গিত অর্থাৎ তিনি মুখে কথা বলতে পারেন নি , বরং যাকে যা কিছু বলার তা ইশারা-ইঙ্গিতে বলেছেন। এ অর্থ গ্রহণ সঠিক বলে মনে হয় না , কারণ , মুখে কথা বলতে না পারাটা সকলের কাছে অসুস্থতার লক্ষণ। এমতাবস্থায় তা আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে তাঁর নবীকে প্রদত্ত মু জিযাহ্ (آية ) হিসেবে গণ্য হতে পারে না।

বস্তুতঃرمز শব্দের অর্থ আকার-ইঙ্গিত বা ইশারা । তবে এর মানে হাতের বা শারীরিক আকার-ইঙ্গিত বা ইশারা নয় , বরং আকার-ইঙ্গিত বা ইশারা র ভাষা তথা রহস্যজনক ও প্রতীকী ভাষা যা বোঝার জন্য অনেক বেশী মাথা ঘামাতে হয়। এ ধরনের কথাবার্তা যে কোনো ব্যক্তির জন্য মর্যাদা বা গুরুত্বের পরিচায়ক। এমতাবস্থায় কোনো ব্যক্তি সব সময় যে ধরনের ভাষায় কথাবার্তা বলেন তার পরিবর্তে তিনি হঠাৎ করে আকার-ইঙ্গিতবাচক বা রহস্যময় ভাষায় কথা বলা শুরু করলে সবাই আশ্চার্যান্বিত হয়ে যায় যে , এটা তাঁর পক্ষে কী করে সম্ভব হলো। ফলে তাঁর মর্যাদা বা গুরুত্ব অনেক বেশী বেড়ে যায়। বিশেষ করে যে সব লোক ইঙ্গিতবাচক ভাষায় কথা বলতে সুদক্ষ তাঁরাও সারা দিনে হয়তো কয়েক বার এ ধরনের কথা বলেন ; অনবরত এ ধরনের ভাষায় কথা বলা তাঁদের পক্ষেও সম্ভব নয়।

কিন্তু হযরত যাকারিয়া ( আঃ) তিন দিন এ ধরনের ইঙ্গিতবাচক বা প্রতীকী ভাষায় কথা বলেন। অর্থাৎ স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলা তাঁর যবানে এ ধরনের কথা জারী করে দেন - যা ছিলো একটি মু জিযাহ্ (آية ) । অত্র আলোচনার ধারাবাহিকতায় পরে যে আয়াত উদ্ধৃত হচ্ছে (অর্থাৎ সূরাহ্ মারইয়াম্-এর 10 নং আয়াত) তাতেও তিনি স্বাভাবিক কথা বা একভাবে কথা বলবেন না বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকে মনে হয় , তিনি এক এক সময় এক এক ধরনের বাকভঙ্গিতে ইঙ্গিতবাচক কথা বলেছিলেন। এছাড়া সূরাহ্ মারইয়াম-এর পরবর্তী আয়াতে (11) লোকদেরকে সকাল-সন্ধ্যা আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা (তাসবীহ্) করার জন্য নির্দেশ সম্বলিত ওয়াহী জানিয়ে দেয়ার কথা বলা হয়েছে - যা থেকে নিশ্চিতভাবে বলা চলে যে , তিন দিনের জন্য তাঁর কথা বলার ক্ষমতা স্থগিত হয়ে যায় নি।

বস্তুতঃ কোরআন মজীদে যে স্ববিরোধিতার কোনো স্থান নেই তা এক অনস্বীকার্য সত্য। কিন্তু কিছু লোক এ সত্যকে অস্বীকার করে কোরআন মজীদের মর্যাদাকে খাটো করার লক্ষ্যে বৃথা হীন প্রয়াস পাচ্ছে। কিন্তু তারা এ ব্যাপারে একেবারেই গাফেল হয়ে আছে যে , তাদের গ্রন্থ বর্তমানে প্রচলিত ইনজীলে শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্ববিরোধিতা এবং যথার্থই স্ববিরোধিতা রয়েছে।

ইনজীল্ নামধারী মথি পুস্তকের দ্বাদশ অধ্যায়ে বলা হয়েছে , যীশূ [হযরত ঈসা ( আঃ)] জানান যে , তাঁর দেহ তিন দিন ও তিন রাত কবরস্থ থাকবে। কিন্তু উক্ত মথি পুস্তকেরই অন্যত্র এবং ইনজীল্ নামধারী অপর তিনটি পুস্তকে এ ব্যাপারে বলা হয়েছে : যীশূ শুক্রবারের দিনের শেষাংশের কিছু সময় , শনিবার রাত (অর্থাৎ শুক্রবার দিবাগত রাত) , শনিবার দিন ও প্রভাতের পূর্ব পর্যন্ত রোববার রাতে (অর্থাৎ মোট দেড় দিনের কিছু বেশী সময়) কবরে ছিলেন।

বর্তমানে ইনজীল্ নামে পরিচিত বিভিন্ন পুস্তকের শেষ দিকে এ বিষয়টির উল্লেখ আছে। তাই বর্তমান ইনজীলের অন্যতম লেখক মথিকে ও বর্তমানে প্রচলিত ইনজীল্ নামধারী পুস্তকগুলোকে যারা আসমানী গ্রন্থ বলে বিশ্বাস করে তাদেরকে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে , এই তিন দিন ও রাত্রির হিসাব কীভাবে মিলানো হয়েছে ? এই মথি পুস্তকেরই অন্যত্র এবং ইনজীল্ নামধারী অন্যান্য পুস্তকে যা বলা হয়েছে তার সাথে এই তিন দিন ও রাত্রি র সামঞ্জস্য কোথায় ?

আশ্চর্যের বিষয় যে , পাশ্চাত্য জগতের পণ্ডিত (!) ব্যক্তিরা উদ্ভট ও গাঁজাখুরী গালগল্পে ঠাসা তাওরাত্ ও ইনজীল্ নামে পরিচিত পুস্তকসমূহে বিশ্বাস পোষণ করেন এবং এগুলোকে ওয়াহী বলে মনে করেন , কিন্তু কোরআন মজীদকে গ্রহণ করতে পারেন নি। অথচ এই কোরআন মজীদ সমগ্র মানবতার পথপ্রদর্শনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে এবং মানবতাকে ইহকাল ও পরকাল উভয় কালের কল্যাণ ও সৌভাগ্যের দিকে পথপ্রদর্শন করেছে। কিন্তু কী আর করা! কারণ , মানুষের স্বাধীন চিন্তাচেতনার ও বিচারবুদ্ধির জন্য ধর্মান্ধতা হচ্ছে এক মারাত্মক মারণ ব্যাধি , আর সত্যান্বেষী লোকের সংখ্যা খুবই কম।

(2) তারা বলে : কোরআনে দ্বিতীয় যে স্ববিরোধিতা রয়েছে তা হচ্ছে , কোরআন কখনোবা মানুষের কাজের দায়-দায়িত্ব মানুষের ওপরই চাপিয়ে দিয়েছে অর্থাৎ মানুষ স্বীয় ক্ষমতা ও এখতিয়ারের বলে কাজ করে থাকে বলে উল্লেখ করেছে। যেমন , বলেছে :

) فمن شاء فليؤمن و من شاء فليکفر(.

অতঃপর যে চায় সে ঈমান আনবে এবং যে চায় কাফের হবে। (সূরাহ্ আল্-কাহ্ফ্ : 29)

আবার কোথাও কোথাও কোরআন সমস্ত ক্ষমতা ও এখতিয়ার আল্লাহর হাতে সমর্পণ করেছে। এমনকি মানুষের কাজকর্মকেও আল্লাহর প্রতি আরোপ করেছে। যেমন , বলেছে :

) و ما تشاؤن الا ان يشاء الله( .

তোমরা ইচ্ছা করবে না আল্লাহ্ যা ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত। (সূরাহ্ আল্-ইনসাান্/ আদ্-দাহর : 30)

সাধারণভাবে বলা যায় যে , কোরআন মজীদে কতগুলো আয়াত রয়েছে যাতে আল্লাহর বান্দাহদেরকে তাদের কাজের ব্যাপারে এখতিয়ারের অধিকারী বলে উল্লেখ করা হয়েছে , অন্যদিকে অপর কতগুলো আয়াতে মানুষকে এখতিয়ার বিহীন রূপে তুলে ধরা হয়েছে এবং সমস্ত কাজ আল্লাহর প্রতি আরোপ করা হয়েছে। কোরআনের এ দুই ধরনের আয়াতের মধ্যে সুস্পষ্ট স্ববিরোধিতা বর্তমান কোনো ব্যাখ্যার মাধ্যমে যা নিরসন করা সম্ভব নয়।

এর জবাব এই যে , কোরআন মজীদে যে কোথাও কোথাও বান্দাহদের কাজকে তাদের নিজেদের ওপর আরোপ করা হয়েছে এবং কোথাও কোথাও যে তা আল্লাহর প্রতি আরোপ করা হয়েছে - উভয়ই স্ব স্ব স্থানে সঠিক এবং এতদুভয়ের মধ্যে কোনোরূপ স্ববিরোধিতার অস্তিত্ব নেই। কারণ ,

প্রতিটি মানুষই স্ব স্ব সহজাত অনুভূতি ও বিচারবুদ্ধি দ্বারা এ সত্য অনুভব করে যে , সে কতোগুলো কাজ করার জন্য শক্তি ও ক্ষমতার অধিকারী এবং স্বাধীনভাবে ঐ সব কাজ করতে বা করা থেকে বিরত থাকতে সক্ষম। এ হচ্ছে এমন বিষয় মানবিক প্রকৃতি ও বিচারবুদ্ধি যার সত্যতার সাক্ষ্য প্রদান করে। এ ব্যাপারে কেউ সামান্যতম সন্দেহও পোষণ করতে পারে না। এ কারণে বিশ্বের সমস্ত জ্ঞানবান লোকই দুষ্কৃতিকারীকে তিরষ্কার ও শাস্তি প্রদান করেন। এটাই প্রমাণ করে যে , মানুষ স্বীয় কাজকর্মে স্বাধীনতা ও এখতিয়ারের অধিকারী এবং কোনো কাজ সম্পাদনের জন্য তাকে বাধ্য করা হয় না।

অন্যদিকে বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন প্রতিটি মানুষই লক্ষ্য করে থাকে যে , সাধারণভাবে পথ চলার সময় তার যে গতি তার সাথে উঁচু স্থান থেকে পড়ে যাবার ক্ষেত্রে তার গতিতে পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্য থেকে সে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে , প্রথমোক্ত গতির ক্ষেত্রে সে স্বাধীন ও এখতিয়ার সম্পন্ন , কিন্তু দ্বিতীয়োক্ত গতির ক্ষেত্রে সে অনিচ্ছাকৃতভাবে বাধ্য।

বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ আরো লক্ষ্য করে যে , যদিও সে কতোগুলো কাজ সম্পাদনের ব্যাপারে স্বাধীন ; সে চাইলে স্বেচ্ছায় সে কাজগুলো সম্পাদন করতে পারে এবং চাইলে স্বেচ্ছায় সে কাজগুলো করা থেকে বিরত থাকতে পারে , তথাপি তার এখতিয়ারাধীন এ সব কাজের অধিকাংশ পটভূমি বা পূর্বশর্ত সমূহ তার এখতিয়ারের বাইরে। যেমন : মানুষের কাজের পটভূমি , তার আয়ুষ্কাল , তার অনুভূতি ও অনুধাবনক্ষমতা , তার ঐ কাজের প্রতি আগ্রহ , তার অভ্যন্তরীণ চাহিদাসমূহের কোনো একটির জন্য কাজটি অনুকূল হওয়া এবং সবশেষে কাজটি সম্পাদনের শক্তি ও ক্ষমতা।

বলা বাহুল্য যে , মানুষের কাজের এ পটভূমিসমূহ তার এখতিয়ারের গণ্ডির বাইরে এবং এ পটভূমিসমূহের স্রষ্টা হচ্ছেন সেই মহাশক্তি যিনি স্বয়ং মানুষেরই স্রষ্টা।

অতএব , এ বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের কাজকর্মকে একই সাথে যেমন মানুষের প্রতি আরোপ করা চলে , তেমনি তা আল্লাহ্ তা আলার প্রতিও আরোপ করা চলে - যিনি এ কাজসমূহের সমস্ত পটভূমি সৃষ্টি করেছেন।

দ্বিতীয়তঃ বিচারবুদ্ধি বলে যে , সৃষ্টিকর্তা সমস্ত সৃষ্টিকে অস্তিত্ব দান করার পর নিজেকে কাজ থেকে গুটিয়ে নেন নি বা অবসর গ্রহণ করেন নি এবং সৃষ্টিলোকের পরিচালনা থেকেও হাত গুটিয়ে নেন নি , বরং সৃষ্টিলোকের অস্তিত্ব টিকে থাকা ও অব্যাহত থাকার বিষয়টি তাদের সৃষ্টির ন্যায়ই সৃষ্টিকর্তার শক্তি ও ইচ্ছার মুখাপেক্ষী। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা ব্যতিরেকে সৃষ্টিলোকের পক্ষে এমনকি মুহূর্তের জন্যও টিকে থাকা সম্ভব নয়।

সৃষ্টিকর্তার সাথে সৃষ্টিলোকের সম্পর্ক একজন নির্মাতার সাথে তার নির্মিত ভবনের সম্পর্কের ন্যায় নয় - যেখানে ভবনটি শুধু তার অস্তিত্বলাভের ক্ষেত্রে এর নির্মাতা ও শ্রমিকদের ওপর নির্ভরশীল , কিন্তু অস্তিত্ব লাভের পরে তাদের থেকে মুখাপেক্ষিতাহীন এবং এমনকি নির্মাতা ও শ্রমিকদের বিলয় ঘটলেও ভবনটি তার অস্তিত্ব অব্যাহত রাখতে পারে। তেমনি এ সম্পর্ক একজন গ্রন্থকারের সাথে তাঁর রচিত গ্রন্থের সম্পর্কের ন্যায়ও নয় , যেখানে গ্রন্থটি রচনার ক্ষেত্রেই শুধু গ্রন্থকারের অস্তিত্বের প্রয়োজন , কিন্তু রচিত হয়ে যাবার পর গ্রন্থটির টিকে থাকা ও অস্তিত্ব অব্যাহত থাকার জন্য গ্রন্থকার , তাঁর হস্তাক্ষর ও তাঁর লিখনকর্মের আদৌ প্রয়োজন নেই।

কিন্তু সৃষ্টিজগতের সাথে সৃষ্টিকর্তার সম্পর্ক যদিও সমস্ত রকমের উপমার উর্ধে তথাপি অনুধাবনের সুবিধার্থে একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। তা হচ্ছে : সৃষ্টিজগতের সাথে সৃষ্টিকর্তার সম্পর্ক বৈদ্যুতিক বাতির আলোর সাথে বিদ্যুতকেন্দ্রের সম্পর্কের ন্যায়। বৈদ্যুতিক বাতি ঠিক ততোক্ষণই আলো বিতরণ করতে পারে যতক্ষণ তারের মাধ্যমে বিদ্যুতকেন্দ্র থেকে বিদ্যুত এসে বাতিতে পৌঁছে। বস্তুতঃ বাতি তার আলোর জন্য প্রতিটি মুহূর্তেই বিদ্যুতকেন্দ্রের মুখাপেক্ষী ; যে মুহূর্তে বিদ্যুতকেন্দ্র থেকে বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হবে , ঠিক সে মুহূর্তেই বাতি নিভে যাবে এবং আলোর স্থানে অন্ধকার আধিপত্য বিস্তার করবে।

ঠিক এভাবেই সমগ্র সৃষ্টিজগত স্বীয় অস্তিত্বলাভ , স্থিতি ও অব্যাহত থাকার জন্য তার মহান উৎসের মুখাপেক্ষী এবং প্রতিটি সৃষ্টিই তার মহান উৎসের মনোযোগ (توجه ) ও সাহায্যের মুখাপেক্ষী। প্রতিটি সৃষ্টিই প্রতিটি মুহূর্তেই সে মহান উৎসের সীমাহীন দয়া ও করুণায় পরিবেষ্টিত হয়ে আছে ; মুহূর্তের জন্যও যদি এ দয়া ও করুণার সাথে তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায় তাহলে সমগ্র সৃষ্টিনিচয় সাথে সাথেই অনস্তিত্বে পর্যবসিত হবে এবং সৃষ্টিলোকের আলো হারিয়ে যাবে।

অতএব , দেখা যাচ্ছে , বান্দাহদের কাজ জাবর্ ও এখতিয়ারের মধ্যবর্তী একটি অবস্থার অধিকারী এবং মানুষ এ দুই দিকেরই সুবিধা পাচ্ছে। কারণ , মানুষ কোনো কাজ সম্পাদন করা বা না করার ক্ষেত্রে স্বীয় শক্তি ও ক্ষমতার ব্যবহারে পুরোপুরি স্বাধীন। কিন্তু তার এ শক্তি ও ক্ষমতা এবং কাজ সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত রকমের পটভূমি ও পূর্বশর্ত (مقدمات ) তার নিজের নয় , বরং এগুলো সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে তাকে দেয়া হয়েছে। এ সব কিছুর অস্তিত্বলাভের ব্যাপারে যেমন মানুষ সৃষ্টিকর্তার প্রতি মুখাপেক্ষী , তেমনি এ সবের স্থিতি ও অব্যাহত থাকার ব্যাপারেও সে প্রতি মুহূর্তেই তাঁরই দয়া-অনুগ্রহ ও মনোযোগের মুখাপেক্ষী। সুতরাং মানুষ যে কাজই সম্পাদন করছে এক হিসেবে তা তার নিজের প্রতি আরোপযোগ্য , আরেক হিসেবে তা আল্লাহ্ তা আলার প্রতি আরোপযোগ্য।

[جبر মানে বাধ্য করা । এটি কালাম্ শাস্ত্রের একটি বিশেষ পরিভাষা। যারাجبر -এ বিশ্বাসী তারা সৃষ্টিকুলের সমস্ত কাজ স্রষ্টার প্রতি আরোপ করে। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি প্রধান মত হচ্ছে : (1) সৃষ্টির শুরুতে বা সৃষ্টিপরিকল্পনার মুহূর্তে সৃষ্টিকর্তা ভবিষ্যতের সব কিছু খুটিনাটি সহ নির্ধারণ করে রেখেছেন এবং তদনুযায়ী সব কিছু স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘটে চলেছে। (2) প্রতি মুহূর্তে স্রষ্টা যা চান তার দ্বারা তা-ই করিয়ে নেন। (3) প্রতিটি মানুষ (এবং অন্যান্য প্রাণীও) মাতৃগর্ভে আসার পর সৃষ্টিকর্তা তার ভাগ্যলিপি নির্ধারণ করে দেন। (4) প্রতি বছর একবার সৃষ্টিকর্তা গোটা সৃষ্টিকুলের , বিশেষতঃ মানুষের পরবর্তী এক বছরের ভাগ্যলিপি নির্ধারণ করে দেন। এ সব বিষয় নিয়ে অত্র লেখকের অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম গ্রন্থে বিচারবুদ্ধি ও কোরআন মজীদের আলোকে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।]

কোরআন মজীদের উক্ত আয়াত সমূহেও এ সত্যই তুলে ধরা হয়েছে। এ সব আয়াতে বুঝাতে চাওয়া হয়েছে যে , স্বীয় কাজকর্মের ওপরে মানুষের শক্তি-ক্ষমতা ও এখতিয়ারের নিয়ন্ত্রণ তার কাজকর্মের ওপর খোদায়ী প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণের পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে না। কারণ , তিনি মানুষের কাজকর্মের প্রতি দৃষ্টি রাখেন এবং মানুষের কাজকর্মে তাঁরও ভূমিকা রয়েছে।

বস্তুতঃ একেই বলা হয়امر بين الامرين (দু টি অবস্থার মাঝামাঝি একটি অবস্থা)। আর মুসলমানদের মধ্যে এ ব্যাপারে চৈন্তিক দিক থেকে বিভিন্ন মত এবং বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই বিভিন্ন মতের একটি সংমিশ্রিত রূপ বিরাজ করলেও বিশেষ করে আমলের দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায় যে , তারা মানুষের কাজকর্মের প্রকৃতি সম্পর্কে অবচেতনভাবে হলেও এ আক্বীদাহ্ই পোষণ করে। পবিত্র আহলে বাইতের ( আঃ) ধারাবাহিকতায় আগত ইমামগণও এ বিষয়টির ওপর খুবই গুরুত্ব আরোপ করতেন এবং এ তত্ত্বকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে জাবর্ তাফ্ভীয্ - এ উভয় তত্ত্বকে বাতিল প্রমাণ করে দিয়েছেন।

[تفويض (অর্পণ) হচ্ছে কালাম্ শাস্ত্রের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা। এর মানে হচ্ছে , মানুষকে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে ; সৃষ্টিকর্তা তার কাজকর্ম মোটেই নিয়ন্ত্রণ করেন না। একেاختيار (নির্বাচন/ বেছে নেয়া) তত্ত্বও বলা হয়। মু তাযিলাহ্ ফিরক্বাহ্ এ তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলো।]

এ বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী বিধায় আমরা এখানে একটি সহজ উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি পাঠক-পাঠিকাদের সামনে সহজবোধ্য করে তোলার প্রয়াস পাবো :

এমন এক ব্যক্তির কথা মনে করুন যার হাত দু টি অকেজো , ফলে সে তার হাত দু টি নাড়াচাড়া করতে এবং তা দ্বারা কাজকর্ম করতে পারে না। কিন্তু একজন চিকিৎসক একটি বৈদ্যুতিক যন্ত্রের সাহায্যে তার হাত দু টিকে সচল ও সক্ষম করে দিলেন। ডাক্তার যখনই তার হাতে উক্ত যন্ত্র থেকে বিদ্যুত-তরঙ্গ সরবরাহ করেন তখন সে ইচ্ছা করলে তার হাত দু টি নাড়াচাড়া ও তা দিয়ে কাজকর্ম করতে পারে এবং না চাইলে কিছু না করেও থাকতে পারে। কিন্তু যখনই ডাক্তার তার হাতের সাথে উক্ত যন্ত্রের সংযোগ ছিন্ন করে দেন বা তাতে বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধ করে দেন তখন সে অক্ষম অবস্থায় ফিরে আসে এবং ইচ্ছা করলেও সে তার হাত দু টি নাড়াচাড়া করতে পারে না।

এখন পরীক্ষা ও গবেষণার লক্ষ্যে ডাক্তার রোগীর হাত দু টির সাথে উক্ত যন্ত্রটির সংযোগ প্রদান করলেন এবং রোগীও স্বীয় ইচ্ছা ও এখতিয়ার অনুযায়ী তার হাত দু টি নাড়াচাড়া ও তা ব্যবহার করে কাজকর্ম করতে শুরু করলো । তার এ কাজকর্ম নির্বাচন ও তার শুভাশুভ পরিণতির ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে ডাক্তারের কোনো ভূমিকা নেই। কারণ , ডাক্তার তাকে এ সব কাজ করতে বা না করতে বাধ্য করে নি। বরং ডাক্তার যে কাজ করলেন তা হচ্ছে , তিনি রোগীকে কাজ করার শক্তি সরবরাহ করলেন এবং রোগীর পসন্দ মতো যে কোনো কাজ করার ক্ষেত্রে তাকে সাহায্য করলেন।

এখন এ ব্যক্তির হাত নাড়াচাড়া করা ও তা দ্বারা কাজকর্ম করাকে আমরাامر بين الامرين -এর দৃষ্টান্ত রূপে গণ্য করতে পারি। কারণ , তার এভাবে হাত নাড়াচাড়া ও কাজকর্ম করার বিষয়টি উক্ত যন্ত্র থেকে বিদ্যুত-তরঙ্গ সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল , আর এ বিদ্যুত-তরঙ্গ সরবরাহের বিষয়টি পুরোপুরি ডাক্তারের এখতিয়ারাধীন। অন্যদিকে ঐ ব্যক্তির হাত নাড়াচাড়া ও কাজকর্ম করাকে পুরাপুরিভাবে ডাক্তারের প্রতিও আরোপ করা চলে না। কারণ , ডাক্তার তাকে শুধু শক্তি সরবরাহ করেছেন , কিন্তু হাত নাড়াচাড়া ও তা দিয়ে কাজকর্ম রোগী স্বেচ্ছায় সম্পাদন করেছে ; রোগী চাইলে হাত নাড়াচাড়া ও তা দিয়ে কাজকর্ম করা থেকে বিরতও থাকতে পারতো।

উপরোক্ত ক্ষেত্রে কাজকর্মের কর্তা রোগী একদিকে যেমন স্বীয় এখতিয়ারের বলে কাজকর্ম সম্পাদন করেছে এবং জাবর্ বা যান্ত্রিকতার শিকার হয় নি , তেমনি তার কাজকর্মের পুরো এখতিয়ারও তাকে প্রদান করা হয় নি , বরং সর্বক্ষণই তাকে অন্যত্র থেকে শক্তি ও সাহায্য গ্রহণ করতে হয়েছে।

এটাই হচ্ছেلا جبر و لا تفويض بل امر بين الامرين - না জাবর্ , না তাফভীয্ , বরং এতদুভয়ের মধ্যবর্তী একটি অবস্থা। মানুষের সমস্ত কাজকর্ম এ অবস্থার মধ্য দিয়েই সংঘটিত হয়ে থাকে। একদিকে যেমন মানুষ স্বীয় ইচ্ছা অনুযায়ী কাজকর্ম সম্পাদন করে থাকে , অন্যদিকে আল্লাহ্ তা আলা যার পটভূমি বা পূবশর্তাবলী তৈরী করে দেন তথা তিনি যা ইচ্ছা করেন তার বাইরে সে কোনোকিছু করতে বা করার ইচ্ছা করতে পারে না।

এতদসংক্রান্ত সমস্ত আয়াতের এটাই লক্ষ্য। অর্থাৎ কোরআন মজীদ একদিকে মানুষের জন্য এখতিয়ার প্রমাণ করে জাবর্-এ বিশ্বাসীদের চিন্তাধারার অসারতা প্রমাণ করেছে , অন্যদিকে মানুষের কাজকর্মকে আল্লাহর প্রতি আরোপ করে তাফ্ভীয্-এর প্রবক্তাদের অভিমতকে ভিত্তিহীন প্রমাণ করেছে।

জাবর্ ও তাফ্ভীয্-এর মধ্যবর্তী যে মধ্যম পন্থা রয়েছে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর পবিত্র আহলে বাইত্ - যাদেরকে আল্লাহ্ তা আলা সমস্ত রকমের অপকৃষ্টতা থেকে মুক্ত রেখেছেন (সূরাহ্ আল্-আহযাাব্ : 33) - আমাদের জন্য তা সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। এবারে আমরা এ প্রসঙ্গে তাঁদের পথনির্দেশ থেকে দু টি দৃষ্টান্ত উদ্ধৃত করছি :

(1) এক ব্যক্তি হযরত ইমাম জা ফার ছ্বাদেক্ব্ ( আঃ)-এর কাছে প্রশ্ন করলো : আল্লাহ্ তা আলা কি মানুষকে খারাপ কাজ করতে বাধ্য করেন ?

ইমাম : না।

আল্লাহ্ কি সমস্ত কাজই তাঁর বান্দাহদের ওপর ন্যস্ত করেছেন ?

না।

তাহলে প্রকৃত অবস্থাটা কী ?

আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে তাঁর বান্দাহদের ওপর দয়া ও অনুগ্রহ বর্ষিত হচ্ছে এবং জাবর্ ও তাফ্ভীযের মধ্যবর্তী একটি পথ অনুসৃত হচ্ছে।

(2) হযরত ইমাম জা ফার্ ছ্বাদেক ( আঃ) থেকে বর্ণিত আরেকটি রেওয়াইয়াতে বলা হয়েছে : না জাবর্ , না তাফ্ভীয্ , বরং প্রকৃত বিষয় হচ্ছে এতদুভয়ের মাঝামামাঝি । (প্রাগুক্ত)

বিভিন্ন হাদীছ গ্রন্থে এ জাতীয় রেওয়াইয়াতের সংখ্যা অনেক।

সে যা-ই হোক , কোরআন মজীদে যারা স্ববিরোধিতা কল্পনা করেছে তারা যে বিষয়টির গভীরতা ও প্রকৃত তাৎপর্য অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।

অবাক হতে হয় এ কারণে যে , কোরআন মজীদে উক্ত দুই ধরনের আয়াত একটি-দু টি নয়. বরং অনেক থাকা সত্ত্বেও কোরআন নাযিলের যুগের আরবের মোশরেক ও ইয়াহূদী-খৃস্টান যাজক-পণ্ডিতগণ এ সব আয়াতের অর্থ সঠিকভাবে বুঝতে পারার কারণে এগুলোকে স্ববিরোধী বলে দাবী করেন নি , অথচ এ যুগের তথাকথিত আলোকদীপ্ত প্রাচ্যবিদ পণ্ডিতগণ এগুলোকে স্ববিরোধিতার নিদর্শন বলে দেখাবার ভণ্ডামিমূলক অপচেষ্টা চালাচ্ছেন!

ছয় : মু জিযাহর নিয়মের লঙ্ঘন

কোরআন মজীদের অলৌকিকতা অস্বীকারকারীরা বলে : যে গ্রন্থের বিকল্প কেউ রচনা করতে পারে না তা-ই যদি মু জিযাহ্ হিসেবে পরিগণিত হয় তাহলে ইউক্লিড আল্-ম্যাজেস্ট্ গ্রন্থদ্বয়ও মু জিযাহ্ রূপে গণ্য হওয়া উচিত , অথচ এ দু টি গ্রন্থ মু জিযাহ্ নয়।

[Euclid -اقليدس খৃস্টপূর্ব তৃতীয় ও চতুর্থ শতাব্দীর বিখ্যাত জ্যামিতিবিদ। তাঁর জ্যামিতিক তত্ত্বগুলোর সংকলনও এ নামেই পরিচিত। আর الکتاب المجسطی ( The Almagest)মিসরের আলেকজান্দ্রিয়ার বিখ্যাত বিজ্ঞানী টলেমী কর্তৃক খৃস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে লিখিত গণিতশাস্ত্র ও নক্ষত্র বিজ্ঞান বিষয়ক বিখ্যাত গ্রন্থ। ]

জবাব : প্রথমতঃ মানুষ উল্লিখিত গ্রন্থদ্বয়ের বিকল্প রচনায় অক্ষম নয়। এমনকি এ দু টি গ্রন্থ এমন পর্যায়ের নয় যে , মানুষ এতদুভয়ের সামনে অক্ষমতায় নতজানু হবে ; এমন সম্ভাবনাও কল্পনা করা যায় না। কারণ , সাম্প্রতিক যুগের জ্যোতির্বিদ ও জ্যামিতিবিদদের মধ্যে এমন অনেকে রয়েছেন যারা নক্ষত্রবিজ্ঞান ও জ্যামিতির ওপরে লিখিত এ দু টি গ্রন্থের তুলনায় উন্নততর , সহজতর ও উৎকৃষ্টতর গ্রন্থ এ উভয় বিষয়ে রচনা করেছেন। বরং পূর্ববর্তী গ্রন্থদ্বয়ে স্থান পায় নি এমন অনেক বিষয়ে পরবর্তীকালীন বিভিন্ন গ্রন্থ সমৃদ্ধতর। ফলতঃ পরবর্তীকালীন অনেক গ্রন্থ উক্ত গ্রন্থ দু টির তুলনায় শ্রেষ্ঠতর ও পূর্ণতর।

স্মর্তব্য , উপরোক্ত গ্রন্থ দু টির প্রণেতাদ্বয় সুদীর্ঘকালীন অধ্যয়ন , পর্যবেক্ষণ ও অধ্যবসায়ের পর তাঁদের গ্রন্থ দু টি রচনা করেছিলেন যা প্রাকৃতিক বিধান অনুযায়ী কোনো অসাধ্য কাজ ছিলো না , কিন্তু হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) নিরক্ষর হয়েও এবং কোনো মানুষের কাছে জ্ঞানার্জন না করেও কোরআন মজীদের মতো মহাজ্ঞানময় গ্রন্থ উপস্থাপন করেন - যা প্রমাণ করে যে , একমাত্র আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে প্রদত্ত না হলে এ মহাগ্রন্থ উপস্থাপন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিলো না।

দ্বিতীয়তঃ মু জিযাহর জন্য আমরা যে সব শর্তের উল্লেখ করেছি তার মধ্যে একটি শর্ত হচ্ছে , মু জিযাহ্ চ্যালেঞ্জ সহকারে প্রদর্শিত হতে হবে এবং মু জিযাহ্ প্রদর্শনকারীর নবুওয়াত্ বা অন্য কোনো খোদা-প্রদত্ত বিশেষ পদ লাভের দাবীর সপক্ষে প্রমাণস্বরূপ হতে হবে।

মু জিযাহর আরেকটি শর্ত এই যে , সংশ্লিষ্ট কাজটি প্রাকৃতিক বিধিবিধানের ব্যতিক্রমে সংঘটিত হতে হবে। (অলৌকিকতা সংক্রান্ত আলোচনার শুরুতে আমরা এ বিষয়ের ওপর বিস্তারিত আলোকপাত করেছি।) আর উল্লিখিত গ্রন্থ দু টিতে এ সব শর্তের একটিও বিদ্যমান নেই।