সত্যের আলো

সত্যের আলো0%

সত্যের আলো লেখক:
প্রকাশক: যাহরা একাডেমী ক্বোম, ইরান
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

  • শুরু
  • পূর্বের
  • 19 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 7483 / ডাউনলোড: 2389
সাইজ সাইজ সাইজ
সত্যের আলো

সত্যের আলো

লেখক:
প্রকাশক: যাহরা একাডেমী ক্বোম, ইরান
বাংলা

হযরত আবু বকরের খেলাফতের প্রতি মা ফাতিমার অস্বীকৃতি

হযরত ফাতিমা সালামুল্লাহ আলাইহি তার দুনিয়া ত্যাগের পূর্বমূহুর্ত পর্যন্ত হযরত আবু বকরকে খলিফা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেন নি ।59

তিনি কি জানতেন না যে নবীজি বলেছেনঃ

مَنْ ماتَ وَلَمْ يَعْرِفْ إمامَ زَمانِهِ ماتَ مَيْتَةً جاهِلِيَّةً

অর্থাৎঃ যে ব্যাক্তি তার যামানার ইমামকে না চিনে মৃত্যু বরণ করলো সে জাহেলিয়াতের সাথে মৃত্যু বরণ করল।60

নিশ্চয়ই নবী করিম (সা.) এর প্রিয় কন্যা হযরত আবু বকরের খেলাফতের প্রতি অস্বীকৃতি প্রদানের কারণে জাহেলিয়াতের মৃত্যু বরণ করতে পারেন না । কেননা প্রিয়নবী (সা.) তাকে উদ্দেশ্য করে বলেছেনঃ

فاطمه سیدة نساء العالمین

অর্থাৎঃ ফাতিমা বিশ্ব নারীদের নেত্রী।

তিনি আরো বলেছেনঃ

فاطمه سیدة نساء اهل الجنّة

অর্থাৎঃ ফাতিমা বেহেশতের নারীদের নেত্রী। 61

তিনি কখনো এমন কাজ করতে পারেন না যাতে তিনি জাহেলী মৃত্যু বরণ করতে পারেন । তাহলে তো নবীজীর কথা মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে যায় । হযরত ফাতিমার ব্যাপারে তিনি বলেছেন ,

ফাতিমা আমার দেহের অংশ , যে ফাতিমাকে কষ্ট দেয় সে আমাকে কষ্ট দেয় । 62

যদি হযরত ফাতিমার (সা.আ.) বেহেশতে যাওয়ার ব্যাপারটা নিশ্চিত হয়ে থাকে তাহলে কি হযরত আবু বকরের খেলাফতের অস্বীকার করেও বেহেশতে যাওয়া যায় ? হযরত আবু বকর যদি সত্যিই ইমাম বা খলিফা হয়ে থাকেন তাহলে তো হযরত ফাতিমার (সা.আ.) জন্য ফরজ ছিল ইমামের আনুগত্য করা । আর ফাতিমার (সা.আ.) বিরোধীতাই প্রমাণ করছে যে , তিনি হযরত আবু বকরকে বৈধ খলিফা হিসেবে মান্য করতেন না । তিনি নিশ্চয় তার যমানার ইমামকে চিনে মৃত্যু বরণ করেছেন । আর এভাবেই তিনি বেহেশতের নারীদের নেত্রী হিসেবে গন্য হবেন । তিনি তো কোন ভুল-ত্রুটি করতে পারেন না । আর খেলাফতের অস্বীকার করার মত ভুল ! মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সূরা আহযাবের 33 নং আয়াতে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন যে তিনি আহলে বাইতকে সব ধরণের অপবিত্রতা বা পাপ পংকিলতা থেকে মুক্ত রেখেছেন । অতএব এটা পরিস্কার হয়ে যায় যে নবী (সা.) এর ইহলোক ত্যাগের পর তিনি আবু বকর ব্যতীত অন্য কাউকে ইমাম হিসেবে মানতেন । তিনি মসজিদে নববীতে ফাদাক বাগান কেড়ে নেওয়ার প্রতিবাদে হযরত আবু বকরের বিরুদ্ধে আর হযরত আলীর ন্যায্য খেলাফতের স্বপক্ষে যে ঐতিহাসিক বক্তব্য রেখেছেন তা থেকে স্পষ্ট প্রতিয়মান হয় যে তিনি হযরত আলীকেই তার ইমাম বা নেতা হিসেবে মান্য করতেন ।63

হযরত ফাতিমার ব্যাপারে মহানবী (সা.) আরো বলেছেনঃ

فاطمة مهجة (بهجة) قلبي، وابناها ثمرة فؤادي، وبعلها نور بصري، والأئمّة من ولدها أمناء ربي وحبل الممدود بينه و بين خلقه، من اعتصم بهم نجا ، ومن تخلف عنه هوى

অর্থাৎঃ- ফাতিমা আমার হৃদয়ের উল্লাস , তার দু ছেলে আমার অন্তরের ফসল এবং তার স্বামী আমার নয়নের জ্যোতি আর তার সন্তানদের মধ্যে থেকে ইমামরা হচ্ছেন আমার রবের আমানত রক্ষাকারী । তারা সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টিকুলের মাঝে (সমন্বয় সাধনকারী) দীর্ঘ রশ্মি । যে তাদের শক্ত করে আকড়ে ধরলো সে নাযাত পেল আর যে তাদের কাছ থেকে দুরে সরে থাকলো সে ধ্বংস হলো । 64

উক্ত হাদীসে নবী করিম (সা.) হযরত ফাতিমা ও তার স্বামী-সন্তানদের গুরুত্ব এবং তাদের অনুসরনের ব্যাপারে স্পষ্ট দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন । হযরত ফাতিমাকে হৃদয়ের উল্লাস বলার কারণ কোন মতেই শুধুমাত্র সন্তান হওয়ার কারণে নয় বরং তিনি ফাতিমার ভিতর এমন সব মহৎ গুনাবলীর সমাবেশ দেখতে পেয়েছিলেন যার কারণে এতসব বিশেষণ উল্লেখ করেছেন । তার স্বামী ও সন্তানদের অনুসরণ নাজাত ও মুক্তি বয়ে আনবে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন । সুতরাং এটা বুঝতে আর বাকী থাকার কথা নয় যে নেতৃত্ব ও নাজাতের প্রশ্নে হযরত ফাতিমাও তার স্বামীকে অনুসরন করতেন তার সম্মানিত পিতার ইন্তেকালের পর । কেননা তাতেই রয়েছে নাজাত ও মুক্তি ।

হাদীসশরীফে বার ইমাম

ইতিপূর্বে উল্লেখিত হয়েছে যে , আল - কোরআনে আল্লাহ বলেন , ক্বিয়ামতের ময়দানে প্রত্যেককে তার ইমামের সাথে পুনরুত্থিত করা হবে । আর এটা নিঃসন্দেহে সত্য যে রাসূল ( সা .) এর পরলোকগমনের পর মুসলমানদের মধ্যে বিভিন্ন পথ ও মতের উদ্ভব হয়েছে । আর ন্যায় সঙ্গত কারণেই প্রত্যেক জনগোষ্ঠীকে তার অনুসৃত নেতৃত্বের সাথে ক্বিয়ামতের দিবসে পুনরুত্থিত করা হবে । সে কারণে ইসলাম ও ইসলামী উম্মতকে সঠিক খাতে প্রবাহিত এবং সকল প্রকার বিচ্যুতি থেকে সংরক্ষিত রাখার জন্যে ইমামদের গুরুত্ব অতুলনীয় প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা ( সা .) বলেছেন ,

لا یزال الاسلام عزیزا الی اثنی عشر خلیفة

অর্থাৎঃ ইসলাম প্রিয়পাত্র হবেনা যতক্ষন না পর্যন্ত বারজন খলিফা অতিবাহিত হবে ।65

মহানবী (সা .) এর অন্তর্ধানের পর ইসলামে বারজন খলিফা বা নেতা আগমন করবেন , এ ব্যাপারে বিভিন্ন হাদীস ও ইতিহাস গ্রন্থে দু ধরণের হাদীস পরিলক্ষিত হয় ।

একঃ এমন সব হাদীস যেখানে শুধূমাত্র বারজন খলিফার আগমন বার্তা দেয়া হয়েছে যে তারা সকলে কোরাইশ বংশ থেকে হবেন । দৃষ্টান্ত স্বরূপঃ

روی البخاری عن جابر بن سمره قال: سمعت رسول الله یقول: «یکون اثناعشر امیرا» فقال کلمه لم اسمعها، فقال ابی: انه قال: «کلهم من قریش»

অর্থাৎঃ আল বুখারী জাবির বিন সামারাহ থেকে বর্ণনা করেছেন যে তিনি বলেছেন আমি আল্লাহর রাসূলের কাছ থেকে শুনেছি যে তিনি বলেছেনঃ বারজন নেতা ( আমার পরে ) আগমন করবে । অতঃপর একটি শব্দ উচ্চারণ করলেন , আমি শুনতে পাইনি । আমার পিতা বলেন , তিনি বলেছেন তারা সকলে কুরাইশ বংশ থেকে হবেন ।66

মুসলিম তার সহীহাতে জাবির বিন সামারাহ থেকে নিম্নলিখিত ভাবে বর্ণনা করেছেন , জাবির বিন সামারাহ বলেনঃ

دخلت مع ابی علی النبی (ص) فسمعته یقول: ان هذا الامر لا ینقضی حتی یمضی فیهم اثنی عشر خلیفة قال ثم تکلم بکلام خفی علی، قال فقلت لابی: ما قال ؟ قال : «کلهم من قریش»

অর্থাৎঃ আমি আমার পিতার সাথে নবী ( সা .) এর খেদমতে উপস্থিত হলাম । অতঃপর আমি শুনতে পেলাম যে তিনি বলেছেনঃ যতক্ষন পর্যন্ত বরাজন খলিফা আগমন না করেছেন ততক্ষন পর্যন্ত মুসলমানদের ক্রিয়া কর্ম সুস্পষ্টভাবে সম্পন্ন হবে না । তিনি ( জাবির ) বলেনঃ নবী ( সা .) কি যে বললেন আমি তা বুঝতে পারি নি । তিনি বলেন , আমি আমার বাবাকে বললাম , তিনি কি বলেছিলেন ? উত্তরে আমার পিতা বলেন , তিনি বলেছেনঃ তারা সবাই কুরাইশ বংশ থেকে হবেন । 67

মুসলিম অন্যত্র আরো হাদীস বর্ণনা করেছেন । তিনি উল্লেখ করেন যে নবী ( সা .) বলেছেনঃ

لا یزال امر الناس ماضیا ما ولیهم اثنی عشر رجلا ثم تکلم النبی (ص) یکلمه خفیت علی فسألت ابی: ماذا قال رسول الله (ص) ؟ فقال «کلهم من قریش»

অর্থাৎঃ যতক্ষন পর্যন্ত বারজন খলিফা মানুষের উপর কর্তৃত্ব না করছেন ততক্ষন পর্যন্ত তাদের কাজ কর্ম সঠিকভাবে সম্পন্ন হবে না । অতঃপর নবী ( সা .) কি যেন উচ্চারণ করলেন আমি তা বুঝতে পারিনি । আমি আমার পিতাকে জিজ্ঞেস করলাম নবী ( সা .) কি বলেছেন ? তিনি বলেন নবী ( সা .) বলেছেন , তারা সকলে কুরাইশ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ।

আবু দাউদ জাবির বিন সামারাহ থেকে বর্ণনা করেছেন যে তিনি বলেছেনঃ

سمعت رسول الله (ص) یقول: لا یزال هذا الدین عزیزا الی اثنی عشر فکبر الناس و ضجوا، ثم قال لابی: یا اباه ما قال ؟ قال: «کلهم من قریش»

অর্থাৎঃ আমি রাসূলুল্লাহর কাছ থেকে শুনেছি , তিনি বলেছেন , বারজন পর্যন্ত এ দ্বীন পৃথিবীর বুকে সম্মানিত থাকবে । অতঃপর জনগনের তাকবীর ধ্বনীতে কোলাহল সৃষ্টি হল । পরে তিনি কি যেন একটা শব্দ বললেন । আমি আমার পিতাকে জিজ্ঞেস করলাম , হে পিতা তিনি কি বলছেন ? পিতা বললেন তিনি বলেছেন , তারা সকলে কুরাইশ বংশ থেকে আসবেন ।68

তিরমিযি তার সহীহাতে এভাবে উল্লেখ করেছেনঃ

قال جابر بن سمره انه قال رسول الله: یکون من بعدی اثنی عشر امیرا ثم تکلم بشلی لم افهمه فسألت الذی یلینی، فقال: قال کلهم من قریش.

অর্থাৎঃ জাবির বিন সামারাহ বলেছেন যে রাসূল ( সা .) বলেছেনঃ আমার পরবর্তী বারজন আমীর আগমন করবেন । অতঃপর তিনি কিছু বললেন যা আমার বোধগম্য হয়নি । আমি আমার পেছেনে উপবিষ্ট ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলাম যে তিনি কি বলেছেন ? তিনি বললেন রাসূল ( সা .) বলেছেনঃ তারা সবাই কুরাইশ বংশদ্ভুত হবেন ।69

জনাব তিরমিযি উক্ত হাদীসটিকে সহি ও হাসান বলে আখ্যায়িত করেছেন । তিনি একই রকম আরো অনেক হাদীস জাবির বিন সামারাহ থেকৈ বর্ণনা করেছেন ।

বারজন খলিফা সংক্রান্ত বিষয়ে মুসনাদে আহামাদের গ্রন্থকার , জাবির বিন সামারাহ থেকে নিম্নলিখিতরূপে বর্ণনা করেছেনঃ

قال سمعت النبی یقول : یکون لهذه الامه اثنی عشر خلیفة

অর্থাৎঃ তিনি বলেছেন , আমি নবী ( সা .)- এর কাছ থেকে শুনেছি যে তিনি বলেছেনঃ আমার উম্মতের জন্যে বারজন খলিফা আগমন করবেন । লেখক মোট 34 টি সূত্রে একই ধরণের হাদীস তার গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন ।70

আল হাকেম নিশাপুরী তার বিখ্যাত আল মুসতাদরাক আস - সহিহাইন ফি মারিফাত আস - সাহাবা - তে আউন বিন জাহফিা থেকে উপরোক্ত হাদীসসূহের ন্যায় আরো হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন এগুলো তার পিতার কাছ থেকে শুনেছেন ।71

তাছাড়াও আরো বহু ইতিহাস ও হাদীস গ্রন্থে এ ধরণের হাদীস বর্ণিত আছে ।72

উপরোক্ত বিষয় সম্পর্কে সুন্নী বিশ্বের বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ আ্ল্লামা জালালুদ্দীন সূয়ুতি তার সুপরিচিত গ্রন্থ তারিখ আল খোলাফা তে নিম্নলিখিতরূপে লিপিবদ্ধ করেছেনঃ

و عند احمد و البزار بسند حسن عن ابن مسعود انه سئل کم یملک هذه الامه من خلیفه ؟ فقال: سألنا عنها رسول الله (ص) فقال : اثنا عشر کعده نقباء بنی اسرائیل.

অর্থাৎঃ আহমাদ ও আল বাযযার উত্তম সনদের ভিত্তিতে ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণনা করছেন যে তাকে জিজ্ঞেস করা হলো , কতজন খলিফা এ উম্মতের উপর শাসন চালাবনে ? তিনি বললেন , আমারা এ প্রসংঙ্গে নবী ( সা .) কে প্রশ্ন করেছিলাম তিনি বলেছেন , তার বনি ইসরাইলের বারজন নকীবের সমান সংখ্যক হবেন ।73

ইবনে হাজার তার স্বীয় গ্রন্থে এভাবে বর্ণনা দিচ্ছেনঃ

اخرج الطبرانی عن جابر بن سمره ان النبی (ص) قال: یکون بعدی اثنی عشر امیرا کلهم من قریش.

অর্থাৎঃ তাবারানী জাবির বিন সামুরাহ থেকে বর্ণনা দিচ্ছেন যে নবী ( সা .) বলেছেনঃ আমার পরে বারজন নেতা আগমন করবে , তারা সকলে কুরাইশ বংশের হবেন ।74

আমরা এই প্রথম প্রকার হাদীসসমূহ থেকে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে , মুসলিম উম্মতের কাজ - কর্ম সুস্পষ্টভাবে পরিচালনার জন্যে , ইসলামকে সম্মানের আসনে অধিষ্ট করার লক্ষে নবী ( সা .)- এর বংশ কুরাইশ থেকে তার অন্তর্ধানের পর পর্যায়ক্রমে ইমাম বা খলিফা হিসেবে বারজন সুমহান ব্যক্তি আগমন করবেন ।

দুইঃ এমন সব হাদীস যেখানে স্পষ্ট করে বার ইমামের নাম উল্লেখ করা হয়েছে । অনেক সুন্নী গ্রন্থকার তাদের প্রত্যেকের নাম তাদের বর্ণিত হাদীসসমূহে উল্লেখ করেছেন । তারা বলেছেনঃ বার ইমামের প্রথম হচ্ছেন আলী ইবনে আবি তালিব । অতঃপর তার জৈষ্ঠ পুত্র হাসান , তার পর হুসাইন ( আ .) । অতঃপর হুসাইনের বংশ থেকে নয়জন ইমাম আসবেন যার শেষজন হবেন মাহদী মওউদ ।

ইয়া নাবিউল মাওয়াদ্দা গ্রন্থে এভাবে বর্ণিত আছেঃ

আতাল নামক একজন ইয়াহুদী মহানবী ( সা .) এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে আরজ পেশ করলোঃ হে মুহাম্মদ , কয়েকটা প্রশ্ন আমি আপনাকে করতে চাই , যা কিছুদিন থেকৈ আমার মানসপটে আন্দোলিত হচ্ছে । যদি আপনি এর উত্তর আমাকে প্রদান করেন তাহলে আমি আপনার হস্তে ইসলাম গ্রহন করবো ।

নবী পাক ( সা .) বললেন , হে আবু আম্মারা , তুমি প্রশ্ন করে যাও , কোন অসুবিধা নেই । ঐ ব্যক্তি কয়েকটি প্রশ্ন করলো এবং প্রতিবারেই আপনি সত্য বলেছেন , বলে সম্মতি প্রকাশ করলো । লোকটি জিজ্ঞেস করলোঃ আমাকে বলে দিন , আপনার উত্তরাধীকারী কে ? কেননা কোন নবীই উত্তরাধীকারী না রেখে দুনিয়া ত্যাগ করেন নি । আমাদের নবী হযরত মূসা ( আ .) বলে গেছেন তার অবর্তমানে হযরত ইউশায় বিন নুন হলেন আল্লাহর নবী । নবী করিম ( সা .) উয়াহুদী লোকটির প্রশ্নের উত্তরে বললেনঃ

আমার উত্তরাধীকারী হলো আলী ইবনে আবি তালিব এবং তার পরে আমার দুই সস্তান হাসান ও হুসাইন । অতঃপর অবশিষ্ট নয়জন ইমাম , হুসাইনের বংশ থেকে আগমন করবেন ।

হে মুহাম্মদ দয়া করে তাদের নাম বলে দিন - লোকটি বললো । নবী ( সা .) বললেনঃ হুসাইনের পরলোকগমনের পর তার পুত্র আলী , তার অন্তর্ধানের পর স্বীয় পুত্র মুহাম্মদ , তার ইন্তেকালের পর জা ফর আর জাফরের তিরোধনের পর তদীয় পুত্র মুসা , মুসার ইহলোক ত্যাগের পর তার ছেলে আলী , আলীর ইন্তেকালের পর ততদীয় পুত্র মুহাম্মদ আর মুহাম্মদের পর তদীয় পুত্র আলী , আলীর ইন্তেকালের পর তদীয় ছেলে হাসান এবং হাসানের পর তদতীয় সন্তান মুহাম্মদ মাহদী পর্যায়ক্রমে ইমাম হবেন । তারা আল্লাহর হুজ্জাত বা যমিনের বুকে অকাট্য দলীল ।

পরক্ষনেই ইয়াহুদী লোকটি ইসলাম গ্রহন করলেন । তিনি সঠিক পথনির্দেশনা পেয়ে আল্লাহর অশেষ প্রশংসা করে বিদায় নিলেন ।75

এ ধরণের প্রচুর হাদীস ইমামীয়া মতাবলম্বীদের গ্রন্থাদিতে পরিলক্ষিত হয় । যেহেতু আমরা তাদের কোন বর্ণনা এ পুস্তকে লিপিবদ্ধ করতে অনিচ্ছুক তাই প্রথম থেকেই চেষ্টা করে আসছি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের নির্মল ও পরিশুদ্ধ উৎসসূহ থেকেই সকল হাদীস বর্ণনা করতো ।

আরো একটা হাদীসে জাবির বিন আব্দুল্লাহ আনসারী থেকে বর্ণিত আছে যে তিনি বলেছেনঃ যখন

) أ َطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ(

অর্থাৎঃ তোমরা আল্লাহকে অনুসরণ কর , অনুসরণ ও আনুগত্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যে উলুল আমর - এর ।

আয়াতটি অবতীর্ণ হয় তখন আমি রাসূরে খোদা ( সা .) কে জিজ্ঞেস করলামঃ হে আল্লাহর রাসূল , আমরা আল্লাহ ও তার রাসূলকে চিনেছি । এখন উক্ত আয়াত অনুযায়ী উলুল আমর কে চেনা আমাদের জন্য একান্ত প্রয়োজন যাদেরকে অনুসরণ করা , যাদের আনুগত্য করা আমাদের জন্যে ফরজ করা হয়েছে । অনুগ্রহ করে আপনি আমাদের জন্যে উলুল আমরের উদ্দেশ্য বলে দিন ।

রাসূলে আকরাম ( সা .) উত্তরে বললেনঃ হে জাবির , তারা আমার উত্তরাধীকারী এবং আমার পরবর্তীকালের ইমাম । তাদের প্রথম জন আলী ইবনে আবি তালিব । অতঃপর পর্যায়ক্রমে হাসান , হুসাইন , আলী ইবনে হুসাইন এবং মুহাম্মদ ইবনে আলী । তৌরাতে এই শেষোক্ত ইমামের নাম বাক্বির হিসেবে প্রসিদ্ধ । তুমি বৃদ্ধ বয়সে মুহাম্মদ বিন আলীর সাক্ষাত লাভ করবে তাকে আমার সালাম পৌছিয়ে দিও ।

অতঃপর তদীয় পুত্র জাফর , জাফরের ছেলে মুসা , তার পুত্র আলী , আলীর পুত্র মুহাম্মদ , মুহাম্মদের পুত্র আলী এবং তদীয় পুত্র হাসান অতঃপর হাসানের পুত্রের আসল নাম ও ডাক নাম আর আমার আসল নাম ও ডাক নাম একই হবে । আল্লাহ তাকে সমগ্র বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত করবেন । তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালে গমন করবেন । তার অদৃশ্যতার সময়সীমা দীর্ঘ হবে । যাদের ঈমান শক্তিশালী তারাই শুধু তার নেতৃত্বের উপর অটল থাকবেন ।76

অন্যত্র এভাবে উল্লেখ আছে , রাসূলুল্লাহ বলেছেনঃ আমি নবীদের সর্দার আর আলী বিন আবি তালিব হচ্ছেন উত্তরাধীকারীদের নেতা । নিশ্চয়ই আমার পরে বারজন উত্তরাধীকারী হবেন । তাদের সর্ব প্রধান ও সর্ব প্রথম হচ্ছেন আলী ইবনে আবি তালিব । তারপর হাসান , হাসানের পর তারই সহোদর ভ্রাতা হুসাইন এবং হুসাইনের পর পর্যায়ক্রমে আলী বিন হুসাইন , মুহাম্মদ বিন আলী , জা ফর বনি মুহাম্মদ , মুসা বিন জা ফর , আলী ইবনে মুসা , মুহাম্মদ বিন আলী , আলী ইবনে মুহাম্মদ , হাসান ইবনে আলী এবং সর্বশেষ ইমাম হচ্ছেন আল মাহদী ।77

মুসলিম তার সহীহাতে নিম্নলিখিতভাবে হাদীসটি উল্লেখ করেছেনঃ

قال رسول الله (ص): لا یزال الدین قائما حتی تقوم الساعة او یکون علیکم اثنی عشر خلیفة، اولهم علی بن ابی طالب ثم الحسن ثم الحسین ثم علی بن الحسین.................................آخرهم المهدی.

অর্থাৎঃ আল্লাহর রাসূল ( সা .) বলেছেনঃ দ্বীন ইসলাম ধ্বংস হবে না কিয়ামত পর্যন্ত , অথবা বারজন খলিফার আগমন পর্যন্ত , তাদের মধ্যে সর্বপ্রথম ইমাম হচ্ছেন আলী ইবনে আবি তালিব , অতঃপর হাসান , তারপর হুসাইন , তারপর আলী ইবনে হুসাইন…… . তাদের সর্বশেষ হচ্ছেন আল মাহদী ।

জনাব বুখারীও তার সহীহাতে এ হাদীসটি উল্লেখ করেছেন । ইয়া নাবিউল মাওয়াদদ্দা গ্রন্থে উক্ত হাদীসটির মধ্যে অতিরিক্ত আরো কয়েকটি কথা সংযুক্ত করা হয়েছে । গ্রন্থকারآخرهم المهدی অর্থাৎ সর্ব শেষ আল মাহদী কথাটি বর্ণনা করার পর লিখেছেনঃ

هم ائمة مطهرون معصومون و خلفائی من بعدی

অর্থাৎঃ { নবী ( সা .) বলেছেন } তারা হচ্ছেন পবিত্র মা সুম ইমাম এবং আমার পরবর্তীতে আমার খলিফা ।78

ইসলামীমাযহাব ও তার বৈশিষ্ট্য

ইত্যপূর্বেকার আলোচনা থেকে এটা দিব্যলোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে গেছে যে , নবী ( সা .) কর্তৃক মনোনীত খলিফা ব্যতীত মানুষের নির্বাচিত খলিফাদের অনুসরণ কোনক্রমেই সুন্নতের অনুসরণ বলে গন্য হতে পারে না ।

অতএব নবী ( সা .) এর সুন্নতের অনুসারী সাহাবা , তাবেয়ীন ও তাবেয় তাবেয়ীন এবং তাদের পরবর্তীকালের জনগন আহলে বাইতের অনুসারী ছিলেন । আর বর্তমান যুগের ইমাম , আহলে বাইতের বার ইমামের সর্বশেষ মহাপুরুষ । বার ইমামের অনুসারী হওয়ার জন্য নবী ( সা .) এরই তাগিদ রয়েছে । তাদের কর্মপন্থা , রীতিনীতি ও জীবন চরিত সকল কিছুই ছিল নবী ( সা .) এর সুন্নাতের - ই চরম পরাকাষ্ঠা । তারা ছিলেন নবীজির সুন্নতের বহিঃপ্রকাশ ।

কিন্তু দূর্ভাগ্যবশতঃ আমরা মুসলমানরা আজ বিভিন্ন মাযহাবে বিক্ষিপ্ত । মুসলমান জাতি আজ শিয়া সুন্নীতে দ্বিধা বিভক্ত । আবার সুন্নীদের রয়েছে চার মাযহাব । আসলে আমরা কি কখনো খুটিয়ে দেখেছি এ সুন্নী মাযহাবসমূহের আবির্ভাব কিভাবে হয়েছে ? এ বিষয়ে ইমামিয়া মাযহাবের কোন গ্রন্থের উদ্ধৃতি না টেনে বাংলাদেশের বহুল পরিচিত ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রকাশিত একটি পুস্তক থেকে উদ্ধৃতি প্রদান - ই যথাযথ মনে করছি । সেখানে এভাবে বলা হয়েছেঃ

আব্বাসীয় আমলটা ছিল নানা দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ । এই আমলের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন মতবাদ রূপ লাভ করে । সুফী ও শরীয়তের ইমামগন আত্মপ্রকাশ করতে থাকেন । বিভিন্ন জ্ঞান - বিজ্ঞানের অনুবাদ হয় আরবীতে , গ্রীক দর্শন ইসলামী চিন্তার উপর গভীর ও সূদুর প্রসারী প্রভাব বিস্তার করে । এই সময়ের মধ্যেই ইসলামী সমাজ , রাষ্ট্র ও চিন্তা যে রূপ পরিগ্রহ করে , তাকে অনুসরন করেই শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে মুসলমান গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে চলে । সংক্ষিপ্ত আকারে হলেও নিচে আমরা সে সব অবস্থার রূপ ও পরিনতি কি হয়েছিলো তা দেখতে প্রয়াস পাব ।

দ্বিতীয় আব্বাসীয় খলিফা মানসুরের সময় ইমাম আবু হানিফা ( রহ .) ইসলাসের অবিকৃত রূপ ও তার সমাজ ব্যাবস্থার পরিবর্তনের উপর মত প্রকাশ করেন । আবু হানিফার জনপ্রিয়তা ও প্রভাব দেখে মনসুর তাকে কুক্ষিগত করার প্রয়াসে বাগদাদের প্রধান বিচারপতির পদ প্রদান করেন । আবু হানিফা ( রহ .) এই প্রস্তাব অস্বীকার করায় মনসুর তাকে কারারুদ্ধ করেন , কারাগারেই আবু হানিফার মৃত্যু হয় । সুন্নী মতবাদের আরেক জন প্রচারক ইমাম মালেক ( রহ .) কেও বেত্রাঘাতে জর্জরিত করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয় । এই ভাবে কুরআন ও রাসুলুল্লাহর অনুসারী দু জন শরীয়তের ইমামের মুখ বন্ধ করে দেয়া হয় । এই সময় মদীনায় খাটি ইসলামী চিন্তার দার্শনিক ও মর্মগত দিক ব্যাখ্যা করে বলেছেন ইমাম জা ফর সাদেক ( আ .) । হযরত আলীর ( আ .) প্রপৌত্রের এমন ধর্ম ব্যাখ্যা মনসুরকে বিচলিত করল । মনসুর ইমাম জা ফর সাদেকের রাজসভায় আহব্বান করে তাকে হত্যা করার সংকল্প করলেন । কিন্তু ইমাম জাফর সাদেকের সঙ্গে কথা বলে খলিফা যখন বুঝতে পারল যে , সাধকের প্রচেষ্টা প্রধানত সমাজ নয় , ব্যক্তিগত ও আত্মিক উৎকর্ষেরই তিনি প্রচারক , তখন ইমাম জা ফর সাদেককে তার অবস্থার উপর ছেড়ে দেওয়াই তার কাছে যুক্তিযুক্ত বলে বিবেচিত হয় । তবে মনসুর সেই সঙ্গে এ কথাও বুঝতে পারলেন যে , তার রাজবংশের স্থায়িত্বের জন্যে প্রয়োজন এক সুদৃঢ় মতবাদের । সেই মতবাদ কুরআন ও সুন্নাহকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করবে যা তার স্বার্থের প্রতিকুল নয় । তেমন মতবাদ তিনি তার অনুগত আইনজ্ঞদের দ্বারা করিয়ে নিলেন ও সেই মতবাদের নাম দিলেন সুন্নী মতবাদ । এই মতবাদের মধ্যে নবী বংশের দাবীর কথা যেমন নেই , তেমনই রাসূলু্ল্লাহর ( সা .) ও তার অব্যবহিত দুই খলিফার সময়কার সমাজ ব্যবস্থার কথাও নেই । পরবর্তীকালে খলিফা হারুনুর রশীদের সময়ে সাম্রাজ্যের প্রধান বিচারপতি আবু ইউসুফের নেতৃত্বে এক আইনজ্ঞ দলের সহায়তায় ইমাম আবু হানিফার নাম দিয়ে হানাফী মাযহাবের ধর্মীয় বিধি সুস্পষ্ট আকার ধারন করতে থাকে । তাতেও ব্যক্তিগত আচার অনুষ্ঠান ও এমন সামাজিক সমস্যা প্রাধান্য লাভ করে যাতে রাজবংশের স্থায়িত্ব ও সমাজের সামন্তবাদী প্রকৃতির পরিবর্তন করার কোন প্রচেষ্টার ইঙ্গিতমাত্র নেই । পরবর্তী মাযহাবগুলোকেও এমনি ভাবে রাজতন্ত্রের ও সমাজতন্ত্রের পরিপোষক রূপে ছাটাই করে ছাড়পত্র দেওয় হয় ।79

এখন দেখুন সুন্নী মাযহাবগুলো এমন সব জালেম রাজা বাদশাহরা তৈরী করেছেন যাদের কালো হাত রঞ্জিত হয়েছে ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম মালিকের ন্যায় আরো বহু জ্ঞানী গুনী ইসলামী ব্যক্তিদের রক্ত লালীমায় । আর আমরা গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়ে চলছি আর দাবী করছি নবীর সুন্নতের অনুসারী হিসেবে । তাই আজকে আমাদেরকে আহলে বাইতের তরীতে আরোহন করে ইহকাল ও পরকালের নাযাতের ব্যবস্থা করা একান্ত প্রয়োজন ।