হযরত আলী (আ.)-এর দৃষ্টিতে হযরত মুহাম্মদ (সা.)

হযরত আলী (আ.)-এর দৃষ্টিতে হযরত মুহাম্মদ (সা.)0%

হযরত আলী (আ.)-এর দৃষ্টিতে হযরত মুহাম্মদ (সা.) লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

  • শুরু
  • পূর্বের
  • 12 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 5686 / ডাউনলোড: 2175
সাইজ সাইজ সাইজ
হযরত আলী (আ.)-এর দৃষ্টিতে হযরত মুহাম্মদ (সা.)

হযরত আলী (আ.)-এর দৃষ্টিতে হযরত মুহাম্মদ (সা.)

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

মহানবীর জন্য দোয়া

হে আল্লাহ , আপনার করুণা ও দয়ার ছায়ায় তাঁর (সা.) স্থানকে প্রশস্ত করে দিন ; আর তাঁকে (সা.) আপনার অনুগ্রহ থেকে অশেষ পুণ্য ও কল্যাণ দান করুন। হে আল্লাহ , তাঁর স্থাপনা ও ইমারতকে সকল নির্মাতার স্থাপনা ও ইমারতের চেয়ে উচ্চ করে দিন। আপনার কাছে তাঁর মর্যাদা ও স্থানকে উচ্চ ও সম্মানিত করে দিন। তাঁর আলোকে তাঁর জন্য পরিপূর্ণ করে দিন , তাঁকে মানব জাতির কাছে নবুওয়াত ও রিসালত সহকারে আপনার পক্ষ থেকে প্রেরণ করার জন্য তাঁর সাক্ষ্য কবুল এবং তাঁর কথায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করে তাঁকে পুরস্কৃত করুন। কারণ তাঁর কথা ন্যায়ভিত্তিক এবং তাঁর ফয়সালা ও রায় সুস্পষ্ট ও চূড়ান্ত। হে আল্লাহ , আমাদেরকে ও তাঁকে জীবনের (নির্মল) আনন্দ , চিরস্থায়ী নিয়ামত , আশা-আকাঙ্ক্ষায় সন্তুষ্টি প্রকাশ , অনাবিল আনন্দ উপভোগ , চিত্তের প্রশান্তি , সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও সম্মানের উপঢৌকনাদি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে একত্রে রাখুন।

খুতবা 77 থেকে

বনু উমাইয়্যা আমাকে অল্প অল্প করে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উত্তরাধিকারের ওপর অগ্রাধিকার প্রদান করছে ; আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি , আমি যদি জীবিত থাকি তাহলে কসাই যেমন বালু-মাখা মাংস থেকে বালু ঝেড়ে ফেলে ঠিক তেমনি আমি তাদেরকে ঝেড়ে ফেলব (অর্থাৎ প্রত্যাখ্যান করব , দূরে তাড়িয়ে দেব এবং তাদের থেকে হযরত মুহাম্মদ [সাঃ]-এর উত্তরাধিকারকে পৃথক করব)।

খুতবা 89 থেকে

মহান আল্লাহ তাঁকে [হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে] রাসূলদের তিরোধানের বেশ কিছু সময়ের ব্যবধানে (এ পৃথিবীতে) প্রেরণ করেছেন। তখন জাতিসমূহ (অসচেতনতার) গভীর নিদ্রায় মগ্ন ছিল। ফিতনাসমূহ স্থায়ী হয়ে গিয়েছিল এবং মানব জাতির সার্বিক বিষয়াদি ছিল ইতস্তত বিক্ষিপ্ত। যুদ্ধের লেলিহান শিখা (পৃথিবীর সর্বত্র) প্রজ্জ্বলিত ছিল। পৃথিবীর জীবনপত্র তখন হলুদ হয়ে গিয়েছিল , এর ফলবান হওয়ার কোন আশাই ছিল না এবং এর সকল (প্রাণ সঞ্জীবনী) জলধারাও নিঃশেষ ও শুষ্ক হয়ে গিয়েছিল। এ কারণে পৃথিবী তখন (হেদায়েতের) আলোকে ঢেকে রেখেছিল এবং প্রকাশ্যে প্রবঞ্চনা দিচ্ছিল। তখন হেদায়েতের (সুপথ-প্রাপ্তির) সুউচ্চ মিনার পুরানো ও জীর্ণ-বিদীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। আর পথভ্রষ্টতার চিহ্ন ও নিদর্শনসমূহ প্রকাশ্যে বিরাজমান ছিল । পৃথিবী তখন নিজ অধিবাসীদেরকে কুৎসিত চেহারা সহকারে বরণ করত এবং এর সন্ধানকারীদের প্রতি তীব্র ভ্রুকুটি করত। তখন ফিতনাই ছিল পৃথিবীর একমাত্র ফল এবং মৃত লাশই ছিল এর (অধিবাসীদের) খাদ্য [আসলে এখানে হযরত আলী (আ.) তীব্র খাদ্যাভাব , দুর্ভিক্ষ ও সংকটের কারণে আরব জাতি যে মৃত পশু ভক্ষণ করত সেদিকেই ইঙ্গিত করেছেন। ] আর ভয়-ভীতি পৃথিবীর (পার্থিব জীবনের) অন্তর্বাস ও তরবারি এর উর্ধ্ববরণ ও চাদরে পরিণত হয়েছিল। (অর্থাৎ ভয়-ভীতি , ত্রাস , যুদ্ধ-বিগ্রহ , হানাহানি , রক্তপাত ও অশান্তি তখনকার পৃথিবী ও পার্থিব জীবনের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা ও অবিচ্ছেদ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। কাপড় যেমন দেহের সাথে লেগে থাকে ঠিক তেমনি ভয়-ভীতি যেন জীবনের নিত্য সঙ্গী হয়ে গিয়েছিল। আর উর্ধ্ববরণ ও চাদরের মত তরবারি তখনকার পার্থিব জীবনের উর্ধ্ববরণী পোশাকে পরিণত হয়েছিল।)

খুতবা 94 থেকে

মহান আল্লাহর অসীম করুণা ও দয়া হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে পৌঁছালো ও সর্বোৎকৃষ্ট খনি (বংশ) এবং সবচেয়ে সম্মানিত উৎসমূল থেকে অর্থাৎ বৃক্ষবৎ পবিত্র বংশধারা যা থেকে তিনি মহান নবীদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁর পবিত্র আমানতের সংরক্ষণকারী বিশ্বস্ত ব্যক্তিদেরকে মনোনীত করেছেন তা থেকেই তাঁকে বের করলেন। তাঁর বংশধরগণ (ইতরাত) সর্বশ্রেষ্ঠ বংশধারা যা (মহান আল্লাহর) সংরক্ষিত পবিত্র স্থানে জন্মেছে এবং বদান্যতা ও পবিত্রতায় যা সুউচ্চ হয়েছে। বৃক্ষবৎ এই পবিত্র বংশধারার রয়েছে বহু দীর্ঘ-প্রশস্ত ডাল-পালা ও শাখা-প্রশাখা এবং এমন একটি ফল যা ধরা যায় না। তাই তিনি মুত্তাকীদের নেতা (ইমাম) এবং যারা হেদায়েতপ্রাপ্ত হয়েছে তাদের চোখের দ্যুতি। তিনি এমন এক প্রদীপ যার দ্যুতি ও প্রভাব প্রকাশিত (প্রকাশ্যে বিরাজমান) এবং উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক যার আলো সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে এবং বিস্তার লাভ করেছে। তিনি সর্বোৎকৃষ্ট (চন্দন) কাঠসদৃশ , আগুনের সংস্পর্শে আসলেই যার প্রভাব ও দ্যুতির চমকানিতে সব কিছু উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তাঁর সিরাত অর্থাৎ জীবন যাপন পদ্ধতি ও অভ্যাস মধ্যপন্থা ও সরল সঠিক পথ। তাঁর সুন্নাহ্ই (আদর্শ) সুপথ প্রাপ্তি। তাঁর বাণী স্পষ্ট মীমাংসাকারী। তাঁর বিচারই ন্যায়পরায়ণতা (আদল)। মহান আল্লাহ তাঁকে রাসূলদের বিদায়ের বেশ কিছুকাল পরে সৎ কাজ (পূর্ববর্তী নবী-রাসূলদের সুন্নাহ্) থেকে জাতিসমূহ যখন বিমুখ ও অজ্ঞ ছিল ঠিক তখনই প্রেরণ করেন।

খুতবা 95

এ খুতবায় হযরত আলী (আ.) মহানবীর মহৎ গুণাবলী উল্লেখ করেছেন

মহান আল্লাহ এমন এক সময় মহানবী (সা.)-কে প্রেরণ করেছিলেন যখন সমগ্র মানব জাতি উত্তেজনা ও জটিলতার মধ্যে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল এবং ফিতনার মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছিল। প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা বিবেক-বুদ্ধি লোপ করে দিচ্ছিল এবং অহংকার ও গর্ব তাদেরকে পদস্খলিত করেছিল। চরম অজ্ঞতা ও মূর্খতা তাদেরকে নির্বোধ ও হীন করে ফেলেছিল। তখন লোকেরা বিশৃঙ্খলা ও অজ্ঞতার অমানিশায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় ও হয়রান হয়ে পড়েছিল। এরপর মহানবী মানব জাতিকে সদুপদেশ প্রদানের ক্ষেত্রে (পূর্ণ আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে) যথাসাধ্য চেষ্টা ও পরিশ্রম করলেন। তিনি নিজে সৎ পথের ওপর অবিচল থেকে (মানব জাতিকে) প্রজ্ঞা , সদুপদেশ ও সুপরামর্শের দিকে আহবান জানালেন।

খুতবা 96 থেকে

তাঁর (মহানবীর) বাসস্থান ও আবাসস্থল সর্বোত্তম বাসস্থান ও আবাসস্থল। যাবতীয় সম্মান ও মর্যাদার খনি এবং নিরাপত্তার ক্রোড়সমূহের মধ্যে তাঁর উৎসমূলই শ্রেষ্ঠ। পুণ্যবানদের হৃদয় তাঁর দিকেই ঝুঁকেছে এবং (মানব জাতির) দৃষ্টি তাঁর দিকেই নিবদ্ধ হয়েছে। মহান আল্লাহ তাঁর দ্বারা সকল হিংসা-বিদ্বেষ ও ঘৃণা দাফন করেছেন এবং (সকল) পারস্পরিক শত্রুতা ও জিঘাংসার বহ্নিশিখা নির্বাপিত করেছেন। তাঁর মাধ্যমে মহান আল্লাহ মুমিনদেরকে ভ্রাতৃসুলভ বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন এবং যারা (কুফরী ও খোদাদ্রোহিতায়) ঐক্যবদ্ধ ছিল তাদেরকে বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন করেছেন। যারা অসম্মানিত , অপদস্থ ছিল মহান আল্লাহ তাঁর মাধ্যমে তাদের সম্মানিত করেছেন এবং (মিথ্যা) গৌরব ও সম্মানকে অপদস্থ ও হেয় করেছেন। তাঁর বাণী ও কথা সুস্পষ্ট ব্যাখ্যাস্বরূপ এবং তাঁর মৌনতা ও নীরবতা গভীর তাৎপর্যমণ্ডিত বাণীসম।

খুতবা 100

এ খুতবাটি মহানবী ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইত প্রসঙ্গে

সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহর , যিনি তাঁর কৃপা তাঁর সমগ্র সৃষ্টিকুলে ছড়িয়ে দিয়েছেন এবং তাদের প্রতি তাঁর অবারিত দানের হস্ত প্রসারিত করে দিয়েছেন। আমরা তাঁর সকল কর্মকাণ্ডে তাঁরই প্রশংসা করি এবং আমরা যাতে (আমাদের ওপর) তাঁর অধিকারসমূহ যথাযথভাবে আদায় ও সংরক্ষণ করতে পারি সেজন্য তাঁরই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি। আমরা সাক্ষ্য প্রদান করি , তিনি ব্যতীত আর কোন ইলাহ্ (উপাস্য) নেই এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁরই বান্দা ও রাসূল। মহান আল্লাহ তাঁকে (বাতিল-মিথ্যার প্রাচীর) ধ্বংসকারী এবং তাঁর স্মরণ উজ্জীবনকারী হিসেবে তাঁর দীন (ঐশী আদেশ-নির্দেশ)সহ (মানব জাতির কাছে) প্রেরণ করেছেন। এরপর তিনি পূর্ণ নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততার সাথে স্বীয় রিসালতের দায়িত্ব পালন করেছেন এবং (সমগ্র জীবনব্যাপী) সুপথের ওপর অবিচল থেকেছেন। তিনি আমাদের মাঝে সত্যের পতাকা (আহলে বাইত) উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে গেছেন। যারা এই সত্যের পতাকা ও নিশান থেকে অগ্রগামী হবে তারাই (দীন থেকে) খারিজ হয়ে যাবে ; আর যারা এ থেকে পিছে পড়ে থাকবে তারাও ধ্বংস হয়ে যাবে ; আর যারা এর সাথে (সত্যের পতাকার সাথে) লেগে থাকবে (অর্থাৎ সত্য ও সত্যপন্থীদেরকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে রাখবে) তারাই (সত্যের সাথে) থাকবে। সত্যের নিশানের সুস্পষ্ট প্রমাণিত হয়েছে , তারা কথা বলার ক্ষেত্রে স্থির , প্রশান্ত , গভীর , ধীর স্থিরভাবে ও বিচক্ষণতার সাথে কাজ করে (অর্থাৎ নির্বুদ্ধিতা ও হঠকারিতার সাথে কাজ করে না এবং যখন সামর্থ্য অর্জিত হয় কেবল তখনই কাজ করে) আর তারা খুবই দ্রুত কর্ম সম্পাদন করে যখন কোন কাজ করার উদ্যোগ নেয়। যখন তোমরা তাঁর (মহানবী) সামনে তোমাদের গ্রীবাদেশ আনুগত্যের সাথে ঋজু করেছো এবং তাঁর দিকে তোমাদের অঙ্গুলি নির্দেশ করেছো ঠিক তখনই তাঁর কাছে মৃত্যু উপস্থিত হলো এবং তিনি পরপারে চলে গেলেন। অতঃপর এমন এক ব্যক্তি যিনি তোমাদেরকে সংঘবদ্ধ (করবেন) এবং তোমাদেরকে বিক্ষিপ্ততা ও বিচ্ছিন্নতা থেকে একত্র করবেন তাকে বের করে আনা পর্যন্ত মহান আল্লাহ যতদিন চাইলেন ততদিন তোমরা বেঁচে রইলে। তাই যে সামনে এগিয়ে আসে না , তার ব্যাপারে অযথা কিছু প্রত্যাশা করো না আর যে পশ্চাতে গমন করে অর্থাৎ পেছনে ফিরে যায় তার প্রতিও নিরাশ হয়ো না। কারণ সম্ভবত পশ্চাতে গমনকারীর দু পায়ের একটি স্খলিত ও স্থানচ্যুত হলেও অন্যটি অবিচল ও যথাস্থানেই স্থির থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না উভয় পা যথাস্থানে প্রত্যাবর্তন করে ঠিক হয়ে না দাঁড়ায়। জেনে রাখো , হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পবিত্র আহলে বাইতের উপমা হচ্ছে আকাশের নক্ষত্রতুল্য। একটি নক্ষত্র অস্ত গেলে অন্য একটি উদিত হয়। তাই যেন তোমাদের ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর তরফ থেকে তাঁর নেয়ামতসমূহ পূর্ণতা লাভ করেছে এবং তোমরা যা চাইতে ও আকাংক্ষা করতে তিনি (আল্লাহ) তা তোমাদেরকে দেখিয়েছেন।

খুতবা 104

নিশ্চয় মহান আল্লাহ হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে এমন এক সময় প্রেরণ করেছিলেন যখন আরবের কোন ব্যক্তি না পড়তে পারত , আর না নবুওয়াত ও ওহীরও দাবী করত। হযরত মুহাম্মদ (সা.) যারা তাঁর আনুগত্য করেছিল তাদের সাহায্যে , যারা তাঁর বিরুদ্ধাচারণ করেছিল তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেছিলেন। আর এভাবে তাদেরকে তাদের নাজাতস্থলে পৌঁছে দিয়েছিলেন এবং তাদের ওপর মৃত্যু অকস্মাৎ এসে পড়ার আগেই তাদেরকে অতি দ্রুত উদ্ধার করেছিলেন। কিন্তু ক্লান্ত-শ্রান্ত ব্যক্তি আরো ক্লান্ত ও দুর্বল হয়েছে আর দুর্বল আকীদা-বিশ্বাস পোষণকারী ব্যক্তিই মুমিনদের পথে পথ চলা থেকে থমকে দাঁড়িয়েছে এবং তার চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্থাৎ ধ্বংসপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত যাত্রা বিরতির ওপরই বহাল থেকেছে। তার মধ্যে কোন মঙ্গল ও কল্যাণ নেই। পরিণামে তিনি তাদেরকে (পথহারা , বিপথগামী , পথভ্রষ্ট আরব জাতিকে) তাদের মুক্তির পথ দেখিয়েছেন , তাদের সবাইকে তাদের নিজ নিজ স্থানে সংস্থাপন করেছেন। আর এর ফলে তাদের জীবন চাকা সচল ও আবর্তিত (হয়েছে) [অর্থাৎ তাদের সার্বিক ভাগ্যোন্নয়ন হয়েছে এবং তাদের জীবিকায় প্রাচুর্য এসেছে] এবং তাদের সার্বিক অবস্থা ভালো এবং শক্তিশালী হয়েছে। মহান আল্লাহর শপথ , আমি ছিলাম সেই পর্যন্ত তাদের সৈন্যবাহিনীর অগ্রবর্তী অংশের অন্তর্ভুক্ত রক্ষাকারী অতন্দ্র প্রহরী যে পর্যন্ত না তারা (আরব জাতি) [হেদায়েত ও ঈমানের পথে] সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়ে (একতা ও ঐক্যের) রজ্জুতে জমায়েত হয়েছিল (অর্থাৎ তারা ঈমানের দিকে ফিরে এসেছিল এবং ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল) । আমি কখনো দুর্বলতাও দেখাইনি এবং কাপুরুষতাও প্রদর্শন করিনি। আর না আমি কখনো স্বীয় কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনে অলস ও শিথিল হয়েছি। মহান আল্লাহর শপথ , আমি অবশ্যই বাতিল-অসত্য অন্যায়কে চিরে ফেলে এর পাঁজর থেকে সত্যকে বের করে আনবোই।

খুতবা 105 থেকে

মহান আল্লাহ হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে সাক্ষী , সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শনকারী হিসেবে প্রেরণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন শৈশবে সমগ্র সৃষ্টিকুলের মধ্যে সর্বোত্তম এবং বয়স্কাবস্থায় তাদের মধ্যে সবচেয়ে ভদ্র। তিনি ছিলেন স্বভাব-চরিত্রে সকল পবিত্র ব্যক্তিত্বদের মধ্যে সবচেয়ে পবিত্র। তিনি ছিলেন স্থায়ী ও অবিরাম বৃষ্টি বর্ষণকারী মেঘমালার মত দানশীলদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ (দানশীল) [অর্থাৎ যেসব মেঘ থেকে অবিরাম স্থায়ীভাবে বৃষ্টি বর্ষণ হতে থাকে সেসব মেঘের মত যারা স্থায়ীভাবে দান করে যায় তাদের মধ্যে তিনি শ্রেষ্ঠ ছিলেন।]

খুতবা 106 থেকে

তিনি (হযরত মুহাম্মদ) সত্যের সন্ধানকারীদের জন্য (হেদায়েতের) অগ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত করেছিলেন এবং পথহারা উষ্ট্র আবদ্ধকারী ব্যক্তিদের অর্থাৎ বিপথগামীদের জন্য আলোকবর্তিকা স্থাপন করেছিলেন (অর্থাৎ মরু প্রান্তরে পথহারা উষ্ট্রচালক দিশেহারা হয়ে স্বীয় উষ্ট্রী বেঁধে রাখে এবং জানেও না যে , কিভাবে সে পথ চলবে তাই সে পথ চলা ক্ষান্ত দেয়। তাই এদের জন্য পথ চলতে সহায়ক আলোকোজ্জ্বল পতাকা বা আলোকবর্তিকা স্থাপন করা হয় ঠিক তেমনি তিনি বিপথগামীদের পথের সন্ধান এবং সঠিক পথে চলার জন্য হেদায়েতের আলোকবর্তিকা ও পতাকা স্থাপন করেছিলেন)। তাই এ কারণেই তিনি আপনার একান্ত বিশ্বস্ত আমানতদার , শেষ বিচার

দিবসে আপনার সাক্ষী , নেয়ামতস্বরূপ আপনার প্রেরিত (নবী) এবং আপনার রহমতস্বরূপ সত্য রাসূল। হে আল্লাহ , আপনার আদালত অর্থাৎ ন্যায়-বিচার থেকে তাঁকে যথার্থ প্রাপ্য প্রদান করুন। আপনার অপার করুণা থেকে অগণিত কল্যাণ ও মঙ্গল দিয়ে তাঁকে পুরস্কৃত করুন। হে আল্লাহ , সকল নির্মাতার (নির্মিত) ভবনসমূহের চেয়েও তাঁর ভবন বা ইমারতকে উঁচু করুন। আর আপনার কাছে তাঁর আগমনকে সম্মানিত করুন এবং আপনার কাছে তাঁর অবস্থানকে মর্যাদাপূর্ণ করে দিন। তাঁকে ওয়াসীলাহ্ দান করুন। তাঁকে উচ্চ মর্যাদা ও সম্মানে অধিষ্ঠিত করুন । আমাদেরকে তাঁর সাথে এমতাবস্থায় (কিয়ামত দিবসে) পুনরুজ্জীবিত করুন যাতে করে আমারা লজ্জিত , অনুতপ্ত , (সত্য থেকে) বিচ্যুত , প্রতিজ্ঞা ভঙ্গকারী , বিপথগামী , বিচ্যুতকারী ও প্রলোভিত না হই।

খুতবা 108

মহান আল্লাহ তাঁকে [হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে] নবীদের পবিত্র বৃক্ষ থেকে , আলোর প্রদীপ থেকে , সুউচ্চ আকাশের মত মর্যাদা ও মহত্ত্বের শীর্ষদেশ থেকে , বাত্হা র প্রাণকেন্দ্র (পবিত্র মক্কা) থেকে অন্ধকারের প্রদীপ এবং প্রজ্ঞার প্রস্রবণ ও উৎস থেকে নির্বাচিত ও মনোনীত করেছেন।

হযরত মুহাম্মদ ছিলেন ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসক যিনি রোগের উপশম দানকারী মলম প্রস্তত করে রাখতেন এবং ক্ষতস্থানে দাগ লাগানোর যন্ত্রকে উত্তপ্ত রাখতেন। যখনই অন্ধ হৃদয় , বধির কান ও বাকশক্তিহীন জিহ্বার চিকিৎসার প্রয়োজন হতো তখনই তিনি এগুলো (অর্থাৎ চিকিৎসার এসব উপায়-উপকরণ) দক্ষতার সাথে ব্যবহার করতেন। তিনি অবহেলা-অমনোযোগ ও জটিলতার স্থানসমূহে গভীরভাবে অনুসন্ধান করে (সঠিক) ঔষধ প্রয়োগ করতেন।

খুতবা 109 থেকে

তিনি দুনিয়ার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছিলেন এবং একে অতি তুচ্ছ ও গুরুত্বহীন মনে করতেন। তিনি জেনেছিলেন , মহান আল্লাহ ইচ্ছা করেই তাঁর নিকট থেকে দুনিয়াকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন এবং একে অবজ্ঞাকারে অন্যদের জন্য প্রশস্ত করেছেন। তাই তিনি মনে-প্রাণে এ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন এবং হৃদয় থেকে এর সকল স্মৃতিচিহ্ন ও স্মরণ মুছে ফেলেছিলেন যাতে করে এ দুনিয়া থেকে গর্ব ও গৌরবের কোন পোশাক তাঁর পরিধান করতে না হয় অথবা এ দুনিয়ায় তাঁর যেন কোন পদ মর্যাদা ও আসনের লোভ ও আশার সৃষ্টি না হয়। সেজন্য তিনি চাইতেন এবং কামনা করতেন যেন তাঁর দৃষ্টি থেকে এর সকল রূপ-রস ও সৌন্দর্য বিদূরিত ও বিলীন হয়ে যায়। তিনি তাঁর নিজ প্রভুর পক্ষ থেকে দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন ও প্রচার করেছিলেন যা ছিল বান্দাদেরকে পাপের শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে তাদের সকল অজুহাত ও ওজর-আপত্তি অপনোদনকারী। তিনি তাঁর উম্মাতকে সতর্ককারী হিসেবে সদুপদেশ দিয়েছিলেন এবং সুসংবাদদাতা হিসেবে তাদেরকে বেহেশতের দিকে আহবান করেছিলেন। আর ভয় প্রদর্শনকারী হিসেবে তাদেরকে নরকাগ্নির ভীতি প্রদর্শন করেছিলেন।

আহলে বাইত সম্পর্কে

আমরা (মহানবীর আহলে বাইত) নবুওয়াতের পবিত্র বৃক্ষ ঐশী বাণী অর্থাৎ রিসালতের অবস্থান-স্থল , ফেরেশতাদের অবতরণ ও আগমনস্থল , জ্ঞানের খনি এবং প্রজ্ঞার প্রস্রবণ ও উৎসস্থল। আমাদের সাহায্যকারী ও প্রেমিক মহান আল্লাহর রহমত ও দয়ার প্রত্যাশা করবে এবং আমাদের শত্রু ও আমাদের প্রতি ঘৃণা পোষণকারী মহান আল্লাহর তীব্র রোষে নিপতিত ও অভিশপ্ত হবে।

খুতবা 110 থেকে

তোমাদের নবীর হেদায়েতের মাধ্যমে তাঁর আনুগত্য কর ও হেদায়েত প্রাপ্ত হও। কারণ তাঁর হেদায়েতই সর্বোত্তম হেদায়েত ; আর তোমরা সবাই তাঁর সুন্নাহর অনুসরণ করবে। কারণ তাঁর সুন্নাহ্ই সুন্নাহ্সমূহের মধ্যে সবচেয়ে সঠিক ও সুপথপ্রাপ্ত।

খুতবা 114

আর (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি) হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর বান্দা ও রাসূল। খুতবা 116 থেকে তিনি (মহান আল্লাহ) তাঁকে সত্যের দিকে আহবানকারী এবং সমগ্র মানব জাতির উপর সাক্ষীস্বরূপ প্রেরণ করেছিলেন। অতঃপর তিনি নিরলসভাবে স্বীয় প্রভুর বাণীসমূহ (রিসালত) প্রচার করেছেন এবং এক্ষেত্রে তিনি কোন অবহেলা ও সামান্যতম দুর্বলতাও প্রদর্শন করেন নি। তিনি মহান আল্লাহর পথে তাঁর শত্রুদের বিরুদ্ধে সামান্যতম দুর্বলতা প্রদর্শন , ঠুনকো যুক্তি ও খোঁড়া অজুহাত পেশ না করেই বরং দৃঢ়তার সাথে জিহাদ করেছেন। তিনি খোদাভীরুদের নেতা এবং যারা সুপথ প্রাপ্ত হয়েছে তাঁদের চোখের দ্যুতি।

খুতবা 122 থেকে

আমরা যখন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে ছিলাম তখন (ইসলামের জন্যই) পিতা , পুত্র , ভ্রাতা ও নিকটাত্মীয়দের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হত। অতএব , যত বিপদাপদ ও দুঃখ-কষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে , আমাদের ঈমান , সত্যের উপর অবিচল থাকা , (মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের) নির্দেশ অর্থাৎ নির্ধারিত ফায়সালা ও সিদ্ধান্তের প্রতি আত্মসমর্পণ এবং আঘাত ও ক্ষতের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টে আমাদের ধৈর্যাবলম্বনও তত বৃদ্ধি পেয়েছে।

খুতবা 125 থেকে

আর মহান আল্লাহ বলেছেন : অতঃপর যদি তোমরা কোন বিষয়ে পরষ্পর দ্বন্দ্ব ও বিবাদে লিপ্ত হও তাহলে তা (তোমরা যে বিষয়ে দ্বন্দ্বে ও বিবাদে লিপ্ত হয়েছ সেই বিষয়টি) মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে প্রত্যর্পণ কর। অতএব , মহান আল্লাহর দিকে কোন বিষয়ে প্রত্যর্পণ করার অর্থ হচ্ছে যে আমরা ঐ ব্যাপারে মহান আল্লাহর কিতাব (আল-কোরআন) অনুযায়ী ফয়সালা করব এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দিকে তা (ঐ বিতর্কিত বিষয়টি) প্রত্যার্পন করার অর্থ হচ্ছে যে আমরা ঐ ব্যাপারে তাঁর সুন্নাহ্কে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরব। আর যখন মহান আল্লাহর গ্রন্থের ভিত্তিতে নিষ্ঠা ও সততার সাথে ফয়সালা করা হবে তখন আমরাই (মহানবীর আহলুল বাইত) সকল জনগণের চেয়ে পবিত্র কোরআনের নিকটবর্তী ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বলে বিবেচিত হব। আর যখন রাসূলুল্লাহর সুন্নাহর ভিত্তিতে ফয়সালা করা হবে তখন আমরাই অন্য সকলের চেয়ে মহানবীর সুন্নাহর সবচেয়ে নিকটবর্তী এবং এ ব্যাপারে সবচেয়ে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বলে বিবেচিত হব।

খুতবা 132 থেকে

আর আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি , তিনি (আল্লাহ) ব্যতীত আর কোন উপাস্য নেই এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর একান্ত মনোনীত ও প্রেরিত (নবী)। আর আমাদের এ সাক্ষ্য এমনই এক সাক্ষ্য যেখানে (আমাদের মাঝে) বিদ্যমান গোপন রহস্য আমাদের প্রকাশ্য ঘোষণার সাথে এবং (আমাদের) অন্তর (আমাদের) কণ্ঠের সাথে পূর্ণরূপে খাপ খায় (যার ফলে আমাদের অন্তর ও মুখ নিসৃত ভাষা ও স্বীকারোক্তির মধ্যে কোন পার্থক্যই বিদ্যমান থাকে না)।

খুতবা 133

মহান আল্লাহ রাসূলদের বিদায় এবং জাতিসমূহের মধ্যকার মতবিরোধ ও দ্বন্দ্বের বেশ কিছু কাল পরে তাঁকে (মুহাম্মদ) প্রেরণ করেছিলেন। তিনি (মহান আল্লাহ) তাঁর (মুহাম্মদ) মাধ্যমে পূর্ববর্তী নবী-রাসূলদের ধারা এবং ওহী-ঐশী প্রত্যাদেশের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছিলেন। মহান আল্লাহ থেকে যারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল এবং তাঁর সাথে শিরক করেছিল তাদের বিরুদ্ধে তিনি জিহাদ করেছিলেন।