ইমাম জাওয়াদ (আ.)

ইমাম জাওয়াদ (আ.)0%

ইমাম জাওয়াদ (আ.) লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ইমাম মুহাম্মাদ বিন আলী আল জাওয়াদ (আ.)

  • শুরু
  • পূর্বের
  • 14 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 5132 / ডাউনলোড: 1930
সাইজ সাইজ সাইজ
ইমাম জাওয়াদ (আ.)

ইমাম জাওয়াদ (আ.)

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

ইমাম রেজা (আ.)-এর শাহাদতের সংবাদ

উমাইয়া ইবনে আলী বলেন ,যখন ইমাম রেজা (আ.) খোরাসানে ছিলেন ,আমি তখন মদীনায় ছিলাম এবং ইমাম জাওয়াদ (আ.)-এর সাথে যোগাযোগ রাখতাম। ইমামের আত্মীয়-স্বজনরা প্রায়ই তার সাথে সালাম বিনিময় করতে আসতেন। একদিন তাঁর দাসীকে বললেন ,তাদেরকে (আত্মীয়-স্বজন) শোক পালনের জন্য প্রস্তুত থাকতে বল। পরের দিন আবারও তাদেরকে শোক পালনের জন্য প্রস্তুত হতে বললেন। তারা (আত্মীয়-স্বজনরা) বললেন : কার জন্যে শোক পালন করতে ? ইমাম জাওয়াদ (আ.) বললেন : সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানুষের (ইমাম রেযা) জন্যে শোক পালন করতে। ’

কিছুদিন পর ইমাম রেজা (আ.)-এর শাহাদতের খবর পাওয়া গেল এবং জানা গেল যেদিন ইমাম জাওয়াদ (আ.) বলেছিলেন , শোক পালনের জন্য প্রস্তুত থাক ’ ঠিক সেই দিনই ইমাম রেযা (আ.) খোরাসানে শহীদ হয়ে ছিলেন (আ ’ লামুল ওয়ারা ,পৃ.334) ।

1 কাজীর স্বীকারোক্তি : কাজী ইয়াহিয়া ইবনে আকসাম নবী পরিবারের ঘোর শত্রু ছিল। সে নিজেই স্বীকার করে যে ,একদা মসজিদে নববীতে ইমাম জাওয়াদকে দেখলাম। তাঁর সাথে বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্ক করলাম তিনি সব বিষয়ের যথাযথ জবাব দিয়ে আমাকে তুষ্ট করলেন। বললাম একটি ব্যাপারে আপনাকে প্রশ্ন করব কিন্তু লজ্জা পাচ্ছি কিভাবে তা করব। ইমাম জাওয়াদ (আ.) বললেন : তোমার প্রশ্ন করার প্রয়োজন নেই ,আমিই বলে দিচ্ছি তুমি কি প্রশ্ন করতে চাও! তুমি প্রশ্ন করতে চাও যে বর্তমানে ইমাম কে ?

বললাম ,জী হ্যাঁ ,ঠিকই বলেছেন ,আল্লাহর কসম ,আমি এ প্রশ্নই আপনার কাছে করতে চেয়েছিলাম। ইমাম জাওয়াদ (আ.) বললেন : আমিই বর্তমান যুগের ইমাম। বললাম : তার প্রমাণ কী ? এমন সময় ইমামের হাতে যে লাঠিটি ছিল তা মুখ খুলল এবং বলল : ইনিই হচ্ছেন আমার মাওলা এবং এই যুগের ইমাম ও আল্লাহর স্পষ্ট দলিল বা হুজ্জাত (উসূলে কাফী ,1ম খণ্ড ,পৃ. 353 ;বিহারুল আনওয়ার ,50তম খণ্ড ,পৃ. 68) ।

2 প্রতিবেশীর মুক্তি : আলী ইবনে জাবির বলেন ,ইমাম জাওয়াদ (আ.)-এর নিকট ছিলাম। ইমামের একটি দুম্বা হারিয়ে যাওয়ায় জনগণ তাঁর এক প্রতিবেশীকে টেনে হেঁচড়ে ইমামের কাছে নিয়ে এল। ইমাম বললেন : তোমাদের কাণ্ড দেখে দুঃখ হয়! তাকে ছেড়ে দাও ,সে দুম্বা চুরি করেনি। বর্তমানে দুম্বাটি অমুকের বাড়িতে আছে যাও ,ওটাকে নিয়ে এস।

ইমাম যার কথা বলেছিলেন ঠিক সে বাড়িতেই দুম্বাটি পাওয়া গেল। ইমাম কর্তৃক আদিষ্টরা বাড়ীর মালিককে চুরির দায়ে মার-ধোর করল এবং তার জামা কাপড় ছিড়ে ফেলল। কিন্তু বাড়ীওয়ালা শপথ করে বলল যে ,সে দুম্বা চুরি করেনি। তাকে ইমামের কাছে ধরে আনল। ইমাম বললেন : তোমাদের জন্য আফসোস হয়! তোমরা ঐ ব্যক্তির উপর অত্যাচার করেছ। দুম্বাটি নিজেই ঐ ব্যক্তির ঘরে ঢুকে পড়ে এবং সে খবরই জানত না।

ফলে ইমাম ঐ ব্যক্তিকে তুষ্ট করার জন্য এবং ক্ষতিপূরণস্বরূপ তাকে কিছু স্বর্ণ মুদ্রা দান করলেন (বিহারুল আনওয়ার ,50তম খণ্ড ,পৃ. 47) ।

3 কারাবন্দীর নিস্কৃতি : আলী ইবনে খালেদ বলেন : খবর পেলাম এক ব্যক্তিকে মদীনা থেকে ধরে এনে সামাররাতে কারাবন্দী করা হয়েছে। বলছে ঐ ব্যক্তি নবুওয়াতের দাবী করেছে।

জেলখানায় গিয়ে তার সাথে দেখা করলাম এবং তাকে একজন বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী ব্যক্তি বলে মনে হলো। তার কাছে কারারুদ্ধ হওয়ার ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলাম। বলল ,সাইয়্যেদুশ শোহাদা হযরত ইমাম হুসাইনের মাথা মোবারক দাফন করা আছে বলে কথিত শামের ঐ স্থানে ইবাদত করছিলাম।3 এক রাত্রে বিশেষ ভাবে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল ছিলাম। হঠাৎ এক ব্যক্তিকে আমার সামনে দেখতে পেলাম ;তিনি আমাকে বললেন : ওঠো।

আমি উঠে দাঁড়ালাম এবং তার সাথে কিছু দূর যাওয়ার পর দেখলাম কুফার মসজিদে অবস্থান করছি। প্রশ্ন করলেন : এটা কোন মসজিদ ,জান কি ? বললাম : জী হ্যাঁ ,এটা কুফার মসজিদ।সেখানে নামাজ পড়ে বাইরে এলাম। পুনরায় কিছু দূর চলার পর দেখলাম মদীনায় মসজিদে নববীতে অবস্থান করছি। রাসূল (সা.)-এর মাজার জিয়ারত করে এবং মসজিদে নামাজ পড়ে বাইরে এলাম। আরো কিছু দূর গিয়ে দেখলাম মক্কায় আল্লাহর ঘরে অবস্থান করছি। তাওয়াফ করে বাইরে এলাম এবং কিছু পথ চলার পর দেখলাম শামে যেখানে ছিলাম সেখানেই পৌঁছে গিয়েছি। আর তখন ঐ মহান ব্যক্তি আমার চোখের আড়াল হয়ে গেলেন।

এই অলৌকিক ঘটনা আমার জন্য খুবই আশ্চর্যজনক ছিল। এভাবে এক বছর কেটে যাওয়ার পর পুনরায় ঐ মহান ব্যক্তির আগমন ঘটে এবং এক বছর পূর্বে যা ঘটেছিল ঠিক তারই পুনরাবৃত্তি ঘটল কিন্তু এবার যখন তিনি চলে যাচ্ছিলেন তখন আমি তাঁকে কসম দিয়ে তাঁর পরিচয় দিতে বললাম। তিনি বললেন , আমি মুহম্মদ ইবনে আলী ইবনে মূসা ইবনে জাফর ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনুল হুসাইন ইবনে আলী ইবনে আবি তালীব ’ (অর্থাৎ ইমাম জাওয়াদ ) ।

এ অলৌকিক ঘটনাকে কারো কারো কাছে বর্ণনা করলাম। এভাবে ঘটনাটি মো ’ তাসেমের উজির মুহাম্মদ ইবনে আবদুল মালেক যিয়াতের কাছে পৌঁছে যায়। যিয়াত আমাকে বন্দী করে কারাগারে নেয়ার নির্দেশ দেয় এবং মিথ্যা প্রচার করে যে আমি নবুওয়াত দাবী করেছি।

আলী ইবনে খালেদ বলেন তাকে বললাম : তুমি কি চাও তোমার এ ঘটনাকে যিয়াতকে বিস্তারিত লিখে জানাব। আর এভাবে যদি সে প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে অজ্ঞাত থাকে তাহলে জ্ঞাত হবে। বলল : লিখুন।

ঘটনাটি যিয়াতের কাছে বিস্তারিত লিখলাম। যিয়াত ঐ পত্রের অপর পিঠে জবাব লিখে পাঠাল ,তাকে বল : যে ব্যক্তি তাকে এক রাত্রে কয়েক ঘন্টার মধ্যে শাম থেকে কুফা ,কুফা থেকে মদীনা ,মদীনা থেকে মক্কায় এ সুদীর্ঘ পথ ভ্রমন করিয়েছেন আবার ফিরিয়ে এনেছেন তাকেই মুক্তি দিতে।

যিয়াতের এ জবাবে দুঃখিত হলাম। পরের দিন চিঠির জবাব জানাতে এবং সান্ত্বনা দিতে জেলখানায় গেলাম কিন্তু দেখলাম যে ,জেলার ও প্রহরীরা অস্থির এবং বিচলিত। জানতে চাইলাম ,কী হয়েছে ?

বলল : যে লোকটি নবুওয়াত দাবী করেছিল ,সে গত রাতে জেল থেকে পালিয়েছে কিন্তু জানিনা কিভাবে সে পালাতে সক্ষম হলো ? মাটির নীচে চলে গিয়েছে না আকাশে উড়ে গেছে ? অনেক খোঁজা-খোঁজি করেও তার কোন সন্ধান পাওয়া যায় নি।4

4. ইমাম রেযা (আ.)-এর নিকটতম ব্যক্তি ,আবা সালত হারুভীকে ইমামের শাহাদতের পর মামুনের নির্দেশে কারাবন্দী করা হয়েছিল। তিনি বলেন :

এক বছর জেলে থাকার পর হতাশায় পড়লাম। রাত্র জেগে ইবাদত বন্দেগী করতে লাগলাম এবং রাসূল (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতকে আমার শাফায়াতকারী হিসাবে প্রার্থনা করলাম। তাঁদের সম্মান ও মর্যাদার বিনিময়ে আল্লাহর কাছে মুক্তি প্রার্থনা করলাম। দোয়া শেষ না হতেই ইমাম জাওয়াদকে জেলখানায় আমার সামনে দেখতে পেলাম।

তিনি বললেন : এই আবা সালত ,তুমি কি অসহায় হয়ে পড়েছ ? সবিনয়ে নিবেদন করলাম : হ্যাঁ আমার নেতা ,আল্লাহর শপথ! আমি অসহায় হয়ে পড়েছি।

ইমাম বললেন : ওঠো। অতঃপর তিনি শিকলে হাত দিলে বন্ধন খুলে গেল এবং আমার হাত ধরে বাইরে নিয়ে এলেন। প্রহরীরা আমাকে দেখতে পেল কিন্তু ইমামের অলৌকিক ক্ষমতা ও বিরাট ভাবমূর্তি দেখে তারা কিছুই বলতে সাহস করল না। অতঃপর ইমাম বললেন : চলে যাও ,আল্লাহ্ তোমাকে রক্ষা করবেন ,এরপর থেকে কখনোই তুমি মামুনকে দেখতে পাবে না ;আর মামুন ও তোমাকে দেখতে পাবে না। ’ ইমাম যা বলেছিলেন ঠিক তাই হয়েছিল।5

5. মো ’ তাসেম আব্বাসীর সভায় : ইবনে আবু দাউদের বন্ধু যারকান বলেন ,একদা দাউদ দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে মো ’ তাসেমের সভা হতে ফিরছিল। কারণ জানতে চাইলে বলল : অদ্য আমার মনে হচ্ছিল হায়! যদি বিশ বছর পূর্বে মারা যেতাম ? প্রশ্ন করলাম : কেন ? বলল : মো ’ তাসেমের সভায় আবু জাফর (ইমাম জাওয়াদ) যেভাবে আমাকে কুপোকাত করল সে কারণে। বললাম : ঘটনাটা কী ?

বলল : এক ব্যক্তি চুরি করে তা স্বীকার করেছিল ;ফলে সে মো ’ তাসেমের কাছে তার উপর আল্লাহর হুকুম জারী করে তাকে পবিত্র করার অনুরোধ করল। খলিফা সকল দরবারি ফকীহদেরকে একত্র করল এবং মুহাম্মদ ইবনে আলী ইমাম জাওয়াদকেও ডেকে পাঠাল। আমাদেরকে প্রশ্ন করল : চোরের হাত ,কোথা থেকে কাটতে হবে ?

আমি (দাউদ) বললাম : হাতের কব্জি থেকে।

বলল : তার দলিল কি ?

বললাম : কেননা তায়াম্মুমের আয়াতে হাত বলতে হাতের কব্জি পর্যন্ত বুঝানো হয়েছে।

) ف َامْسَحُوا بِوُجُوهِكُمْ وَأَيْدِيكُمْ(

অর্থাৎ তোমরা যদি পানি না পাও ,তাহলে পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম কর এবং তোমাদের মুখ মন্ডল ও হস্তদ্বয়কে মাছেহ কর (মুছিয়া ফেল) । (সূরা নিসা : 43)

কিছু সংখ্যক ফকীহ আমার এ যুক্তির সমর্থন করলেন। কিন্তু কিছু সংখ্যক বললেন ,না ,কনুই পর্যন্ত কাটতে হবে। মো ’ তাসেম বলল তার দলিল কি ? তারা বলল : ওজুর আয়াতে হাত বলতে হাতের কনুই পর্যন্ত বোঝান হয়েছে।

) ف َاغْسِلُوا وُجُوهَكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ إِلَى الْمَرَ‌افِقِ(

অর্থাৎ তোমাদের মুখমণ্ডল এবং হস্তসমূহকে কনুই পর্যন্ত ধৌত কর (সূরা মায়িদাহ : 6) ।

অতঃপর মো ’ তাসেম মুহাম্মদ ইবনে আলী ইমাম জাওয়াদ (আ.)-এর কাছে জিজ্ঞাসা করল : এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী ?

ইমাম বললেন : এরাতো বললই ,আমি আর কিছু বলতে চাচ্ছি না। মো ’ তাসেম পীড়াপীড়ি করতে লাগল এবং কসম খেল অবশ্যই আপনাকে মতামত দিতে হবে।

মুহাম্মদ ইবনে আলী আল জাওয়াদ (আ.) বললেন : যেহেতু কসম খেয়েছ তাই আমার মতামত বলছি। এরা সকলেই ভুল সিদ্ধান্ত দিয়েছে কেননা চোরের শুধুমাত্র আঙ্গুল কাটা যাবে ,আর সমস্ত হাত অবশিষ্ট থাকবে।

মো ’ তাসেম বলল : তার দলিল কী ?

ইমাম জাওয়াদ (আ.) বললেন : যেহেতু রাসূল (সা.) বলেছেন ,যুগপৎভাবে সাতটি অঙ্গের মাধ্যমে সিজদা সম্পাদিত হয় - কপাল ,দুই হাতের তালু ,দুই হাঁটু এবং পায়ের দুই বৃদ্ধাংগুলি। সুতরাং যদি চোরের হাতের কব্জি অথবা কনুই থেকে কেটে ফেলা হয় তাহলে সিজদার জন্য হাতই অবশিষ্ট থাকে না। এ ছাড়াও আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেছেন :

) و َأَنَّ الْمَسَاجِدَ لِلَّـهِ فَلَا تَدْعُوا مَعَ اللَّـهِ أَحَدًا(

অর্থাৎ এবং নিশ্চয় সকল মসজিদ (সাতটি অঙ্গ যার উপর সিজদা ওয়াজেব)6 আল্লাহর জন্য ,সুতরাং তোমরা আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাহাকেও (মা ’ বুদরূপে) ডাকিও না (সূরা জিন : 18) । ”

সুতরাং যা আল্লাহর জন্য তা কাটা যাবে না।

ইবনে আবি দাউদ বলে : মো ’ তাসেম ইমাম জাওয়াদ (আ.)-এর দলিলকে যুক্তিযুক্ত মনে করে তা গ্রহণ করেছিল। আর সে মোতাবেক চোরের আঙ্গুল কেটে ফেলার নির্দেশ দেয়। আমরা যারা ভুল সিদ্ধান্ত দিয়েছিলাম ,উপস্থিত জনগণের সামনে অপমানিত হলাম। আর আমি এতই লজ্জিত হয়েছিলাম যে ,সেখাইে নিজের মৃত্যু কামনা করি (তাফসীরে আইয়াশী ,1ম খণ্ড ,পৃ. 319 ,বিহারুল আনওয়ার ,50তম খণ্ড ,পৃ. 5) ।

ষড়যন্ত্রমূলকবিয়ে

ইমাম রেজা (আ.)-এর জীবন যাপন বিশ্লেষন করতে গিয়ে যেমনটি বলা হয়েছে ,মামুন আব্বাসী সমাজের বিশৃঙ্খলা ও আলাভীদের বিদ্রোহ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নিজেকে রাসূল (সা.)-এর আহলে বাইতের ভক্ত হিসাবে অভিহিত করত। এ প্রচেষ্টাকে বাস্তবায়িত করার জন্যে সে ইমাম রেযা (আ.)-এর উপর ওয়ালী আহাদের পদ চাপিয়ে দিয়েছিল এবং এর মাধ্যমে ইমামকে নিকট থেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চালিয়েছিল।

অপর দিকে বনী আব্বাসেরা মামুনের এ পদ্ধতিতে বিশেষ ভাবে নারাজ এবং রাগান্বিত হয়। কেননা তারা মনে করেছিল ,এভাবে খেলাফত বনী আব্বাসদের কাছ থেকে বনি হাশিমদের কাছে হস্তান্তরিত হয়ে যাবে। ইমাম রেযা (আ.) যখন মামুনের মাধ্যমে বিষাক্রান্ত হয়ে শাহাদাত বরণ করেন ,বনি আব্বাস খুশী হয়ে মামুনের দিকে প্রত্যাবর্তন করল।

মামুন একান্ত গোপনে ইমাম রেজা (আ.)-কে বিষ প্রয়োগ করে শহীদ করেছিল। সে সমাজকে তার এ জঘন্য পাপ থেকে অজ্ঞাত রাখতে চেয়েছিল এবং তার এ পাপকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য বাহ্যিক ভাবে দুঃখ ও শোক পালন করেছিল। এমনকি তিন দিন যাবৎ সে ইমাম রেজা (আ.)-এর রওজা মোবারকে অবস্থান করে এবং রুটি ও লবণ খেয়ে থাকে। এভাবে শিয়াদের সামনে নিজেকে শোকার্ত হিসাবে উপস্থাপন করে।

কিন্তু এতসব ভন্ডামি ও গোপনীয়তা রক্ষা করা সত্ত্বেও আলী বংশীয়দের বুঝতে বাকী রইল না যে ,ইমামের হন্তা স্বয়ং মামুন ছাড়া আর কেউ নয়। সেহেতু তারা নিদারুনভাবে দুঃখ ভারাক্রান্ত এবং ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। মামুন দেখল তার হুকুমত পুনরায় বিপদের সম্মুখীন। তাই উপায় অন্বেষণের জন্য এবং প্রতিকারক হিসাবে এক নতুন ষড়যন্ত্র শুরু করল। সে দেখাতে চাইল যে আমি ইমাম জাওয়াদকে অত্যন্ত ভালবাসি এবং অধিক সুযোগ লাভের আশায় তার কন্যাকে ইমাম জাওয়াদ (আ.)-এর সাথে বিবাহ দেয়। ইমাম রেজাকে যুবরাজের পদ দিয়ে যা হাসিল করতে চেয়েছিল এ বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে সে লক্ষ্যে পৌঁছাতে চেষ্টা করেছিল।

সঙ্গত কারণেই মামুন 204 হিজরীতে অর্থাৎ ইমাম রেজা (আ.)-এর শাহাদতের এক বছর পর ইমাম জাওয়াদ (আ.)-কে মদীনা থেকে বাগদাদ নিয়ে আসে এবং তার কন্যা উম্মুল ফাযলকে ইমাম জাওয়াদ (আ.)-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে।

রিয়ান ইবনে শাবিব বলেন : বনী আব্বাসরা যখন শুনতে পেল যে মামুন তার কন্যাকে ইমাম জাওয়াদ (আ.)-এর সাথে বিাবহ দিতে চায় ,তখন তারা ভয় পেয়ে গেল। তারা মনে করতে লাগল খোদা না করুন ,হুকুমত আব্বাসীয়দের হাতছাড়া হয়ে যায়! এ কারণে তারা মামুনের কাছে গেল এবং প্রতিবাদ করে বলল : আপনি এ সিদ্ধান্ত পরিত্যাগ করুন। আপনি তো জানেন আমাদের সাথে আলী বংশীয়দের কী ঘটেছে ? পূর্ববর্তী খলিফারা আলী বংশীয়দেরকে তাচ্ছিল্য করত এবং নির্বাসন দিত।

ইতোপূর্বে যখন ইমাম রেজা (আ.)-কে যুবরাজের পদে অধিষ্টিত করেছিলেন দুশ্চিন্তায় ছিলাম। কিন্তু সে সমস্যার সমাধান হয়ে গিয়েছে। এখন আপনার কসম খেয়ে বলছি ,এ বিবাহের মাধ্যমে পুনরায় আমাদেরকে দুঃখিত করবেন না ,এ বিবাহ থেকে বিরত থাকুন। আপনার কন্যাকে আব্বাসীয়দের মধ্য থেকে যে আপনার কন্যার যোগ্য তার সাথে বিবাহ দিন।

মামুন জবাব দিল তোমাদের এবং আলী বংশীয় মধ্যে যা ঘটেছে তার জন্যে তোমরাই দায়ী। যদি সুবিচার (ন্যায় বিচার) কর ,তাহলে বুঝবে তারা তোমাদের থেকে উত্তম। আমার পূর্ববর্তী খলিফারা যা করেছে তা ছিল আত্মীয়তার সম্পর্ককে ছিন্ন করা। আর আমি ইহা থেকে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাচ্ছি। ইমাম রেযা (আ.)-কে যুবরাজ করাতেও আমি অনুতপ্ত নই। আমি তাঁকে খেলাফত দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেন নি। অবশেষে নিয়তি যা ছিল তাই ঘটে গেল। আর আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে আলী আল জাওয়াদকে এ কারণে আমার মেয়েকে তাঁর সাথে বিবাহের জন্য নির্বাচন করেছি যে ,তিনি এত কম বয়সেই সমস্ত জ্ঞানীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং এটাই বিস্ময় ও আশ্চর্যের কারণ। এ বিষয়টি আমার জন্য স্পষ্ট ,আশা করি সর্বস্তরের জনগণের জন্যও তা স্পষ্ট হবে। যার মাধ্যমে তারা বুঝবে যে আমার সিদ্ধান্তই সঠিক এবং তিনিই (ইমাম জাওয়াদ) আমার কন্যার সহধর্মী হওয়ার একান্ত যোগ্য।

আব্বাসীয়রা বলল : যদিও এ বালক আপনার বিস্ময় ও আশ্চর্যের কারণ হয়েছে কিন্তু সে এখনও বাচ্চা ,পর্যাপ্ত জ্ঞানার্জন করেনি। অপেক্ষা করুন ততক্ষণে সে পর্যাপ্ত সাহিত্য ও ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করুক। অতঃপর আপনার ইচ্ছা বাস্তবায়িত করেন।

মামুন বলল : তোমাদের প্রতি আফসোস হয় এ যুবককে আমি তোমাদের চেয়ে ভাল চিনি। তিনি এমন পরিবারের যাদের জ্ঞান আল্লাহ্ প্রদত্ত এবং তাদের অনুশীলনের প্রয়োজন হয় না। তাঁর মহান পিতারা সর্বদাই ইসলামী জ্ঞান ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র ও সবার শীর্ষে ছিলেন। তারপরও যদি আগ্রহী হও তাহলে তাঁকে পরীক্ষা করে দেখতে পারো ,এর মাধ্যমে আমি যা বলেছি তা তোমাদের জন্য স্পষ্ট হবে।

তারা বলল : এ প্রস্তাবটি ভাল ,আমরা তাকে পরীক্ষা করে দেখব এবং আপনার সামনেই তাঁর কাছে ফেকাহ শাস্ত্র (ইসলামী মাসলা মাসায়েল) সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে। যদি ঠিকমত উত্তর দেয় তাহলে আমাদের আর কোন আপত্তি থাকবে না। আর এভাবে সবার কাছে আপনার সঠিক সিদ্ধান্ত স্পষ্ট হয়ে যাবে। আর যদি আমাদের প্রশ্নের ঠিক ঠিক জবাব দিতে না পারেন ,সে ক্ষেত্রেও আমাদের সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এবং আপনি বিবাহের এ সিদ্ধান্ত পরিত্যাগ করবেন।

মামুন বলল : যখন ইচ্ছা তাকে পরীক্ষা করতে পারো।

আব্বাসীয়রা কাজী ইয়াহিয়া ইবনে আকসামের কাছে গেল এবং তাকে বলল তোমাকে বিরাট অংকের টাকা দেয়া হবে এ শর্তে যে ,ইমাম জাওয়াদ (আ.)-এর কাছে এমন প্রশ্ন করতে হবে যেন তিনি তার জবাব না দিতে পারেন। ইয়াহিয়া এ শর্তে রাজি হলো। অতঃপর তারা মামুনের কাছে গিয়ে একটি দিন ধার্য করল। নির্দিষ্ট দিনে সকলে সমবেত হলো। মামুনের নির্দেশে ইমাম জাওয়াদ (আ.)-এর জন্য মঞ্চ তৈরী হলো। ইমাম জাওয়াদ (আ.) প্রবেশ করলেন এবং নির্ধারিত মঞ্চে আসন গ্রহণ করলেন। প্রত্যেকেই স্ব স্ব স্থানে বসল এবং ইয়াহিয়া ইমামের মুখোমুখি বসল। মামুন ও ইমাম জাওয়াদ (আ.)-এর পাশে গিয়ে বসল।

ইয়াহিয়া মামুনকে বলল : অনুমতি দিলে আবু জাফর (আ.)-এর কাছে প্রশ্ন করতে পারি ? মামুন বলল : স্বয়ং তাঁর কাছেই অনুমতি চাও! ইয়াহিয়া ইমামকে বলল : অনুমতি দিলে আপনার কাছে প্রশ্ন করতে পারি।

ইমাম জাওয়াদ (আ.) বললেন : যদি চাও প্রশ্ন কর!

ইয়াহিয়া বলল : যদি কোন ব্যক্তি এহরাম অবস্থায় শিকার করে শরীয়তে তার হুকুম কী ?

ইমাম জাওয়াদ (আ.) বললেন : এ মাসয়ালার বিভিন্ন রূপ রয়েছে। সে কি মাসজিদুল হারামে ” বাইরে ছিল না মধ্যে। সে কি জানত যে ,এ কাজ হারাম ,না জানত না। ইচ্ছাকৃত ভাবে শিকার করেছে ,না অসাবধানতা বসত। সে কি গোলাম ছিল ,না স্বাধীন। বালক ছিল ,না বয়স্ক। এটা কি তার প্রথম শিকার ছিল ,না দ্বিতীয়। শিকার পাখি ছিল ,না পশু বা অন্যকিছু। শিকার ছোট্ট ছিল ,না বড়। শিকারী কি তার এ কাজের জন্য অনুতপ্ত ,না আবারও তা করতে চায়। রাত্রে শিকার করেছে ,না দিনে। তার ইহরাম কি ওমরার ইহরাম ছিল ,না হজের ইহরাম।

ইমাম জাওয়াদ (আ.) তখন মাত্র নয়-দশ বছরের বালক। ইমাম (আ.) মূল প্রশ্নটিকে যখন এমন বিচক্ষণতার সাথে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করলেন ,ইয়াহিয়া হতবাক হয়ে গেল। তার চেহারায় পরাজয় এবং অক্ষমতার চিহ্ন স্পষ্ট দৃশ্যমান হলো এবং সে তোতলিয়ে কথা বলতে লাগল। এভাবে উপস্থিত সকলের কাছে ইমাম জাওয়াদ (আ.)-এর বিচক্ষণতা ও জ্ঞান ক্ষমতা এবং ইয়াহিয়ার অজ্ঞতা ও পরাজয় সুস্পষ্ট হলো।

মামুন বলল : এ বিশেষ নেয়ামতের (ইমাম জাওয়াদের) জন্য আল্লাহর শোকর আদায় করছি ,আমি যা মনে করেছিলাম ঠিক তাই হয়েছে।

অতঃপর আব্বাসীয়দের দিকে মুখ করে বলল : যা তোমরা অস্বীকার করছিলে এখন তার প্রমাণ পেয়েছ তো ?