ইসলামে হযরত আবু তালিবের অবদান

ইসলামে হযরত আবু তালিবের অবদান 0%

ইসলামে হযরত আবু তালিবের অবদান লেখক:
প্রকাশক: আলে রাসূল পাবলিকেশন্স
বিভাগ: ইতিহাস

ইসলামে হযরত আবু তালিবের অবদান

লেখক: মোঃ নুরুল মনির
প্রকাশক: আলে রাসূল পাবলিকেশন্স
বিভাগ:

ভিজিট: 34520
ডাউনলোড: 3394

পাঠকের মতামত:

ইসলামে হযরত আবু তালিবের অবদান
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 27 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 34520 / ডাউনলোড: 3394
সাইজ সাইজ সাইজ
ইসলামে হযরত আবু তালিবের অবদান

ইসলামে হযরত আবু তালিবের অবদান

লেখক:
প্রকাশক: আলে রাসূল পাবলিকেশন্স
বাংলা

মোহাম্মদ (সা.) আবু তালিবের ইয়াতিম

মহানবী (সা.) জন্মের পূর্বেই পিতাকে হারিয়েছেন। মায়ের কাছে তিনি পিতা আব্দুল্লার ইন্তেকালের কথা জানতে পেরেছেন। ছয় বছর বয়সে তিনি মাতা আমেনার স্নেহ থেকেও বঞ্চিত হন। ফলে তাঁর লালন-পালনের ভার পিতামহ জনাব আব্দুল মোতালিব গ্রহণ করেন। মাত্র দুবছর পর তিনিও এ পৃথীবি ছেড়ে চলে গেলেন। শিশু মোহাম্মদ অসহায় হয়ে পড়লেন। মহিমান্বিত আল্লাহ তাঁর হাবিবের জন্য নিজ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছেন। আট বছর বয়সে শুরু হলো নবী (সা.)-এর জীবনের এক নতুন অধ্যায় , তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ করলেন পিতৃব্য হযরত আবু তালিব। মোহাম্মদ (সা.)-কে চাচা আবু তালিব ও চাচি ফাতেমা বিনতে আসাদ প্রাণাধিক ভালবাসতেন। মোহাম্মদ (সা.)-কে তিনি কখনো মায়ের শূন্যতা বুঝতে দেননি। নিজেদের সীমাবদ্ধতা থাকলেও মোহাম্মদ (সা.)-কে তা অনুধাবন করতে দেননি। এই মহিমান্বিত পরিবারের অকৃত্রিম ভালবাসা , আদর-যন্ন আর লালন-পালন ও ছত্রছায়ায় প্রিয় নবী (সা.)-এর শিশু , কিশোর ও যৌবনকাল অতিবাহিত হয়েছিল। জীবনের সেই সময়গুলো কত সুখময় ছিল নবী (সা.) তা বুঝতে পেরেছিলেন , যখন মাতৃসুলভ চাচি ইন্তেকাল করলেন। নবী (সা.) সেই মহিয়সী চাচিকে মা বলেই ডাকতেন। তাঁর ইন্তেকালে নবী (সা.) দীর্ঘদিন অশ্রুসজল ছিলেন। হযরত আবু তালিব যেমনি পিতার ন্যায় স্নেহ ভালবাসা দিয়ে নবীকে আগলে রেখেছেন , তেমনি তাঁর ভরণ-পোষণ , পোশাক-পরিচ্ছেদ ও অন্যন্য প্রয়োজন মিটিয়েছেন অকৃপণ ভাবে। এমনকি নিজের সন্তানের চেয়েও নবীকে দিয়েছেন অগ্রাধিকার। নিজেরা কষ্টে থাকলেও নবী (সা.)-এর কষ্টে থাকা তিনি সহ্য করতে পারতেন না।

এখানে আমি পাঠকের উদ্দেশ্যে একটি হাদীস উপস্থাপন করছি: রাসূল (সা.) বলেছেন , যে ব্যক্তি তার জান-মাল , ইজ্জত-সম্মান ও সন্তানসন্ততি এবং সকল মানুষের চাইতে আমাকে অধিক ভালবাসে না তার ঈমান পরিপূর্ণ নয় । উল্লিখিত হাদীসের আলোকে প্রমাণ হয় হযরত আবু তালিব ছিলেন একজন পরিপূর্ণ ঈমানদার। একজন স্নেহবৎসল পিতা , দয়ালু চাচা ও একজন দরদি অভিভাবক। তাঁরা উভয়ই চাচা এবং ভ্রাতুষ্পুত্র একে অন্যের প্রতি এতটাই অনুরোক্ত ছিলেন যেন মনে হতো তাঁদের জীবন পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। দেশে বিদেশে হযরত আবু তালিব যেখানেই সফর করতেন নবীকে সাথে রাখতেন। যে কারণে আরবের লোকেরা মোহাম্মদ (সা.)-কে আবু তালিবের ইয়াতিম নামেও ডাকত। ভাতিজাকে কখনও তিনি একা ছাড়তেন না , এমনকি শয়ন কালেও পাশে শোয়াতেন। এরূপে নবী (সা.)-এর 8 বছর বয়স থেকে 25 বছর বয়স পর্যন্ত সুদীর্ঘ 17টি বছর তিনি হযরত আবু তালিবের গৃহে অবস্থান করেন।10

আর যেখানে এত বছর নবী (সা.) অবস্থান করলেন , সেখানে যে খাওয়া দাওয়া করেছেন তা নিশ্চই হালাল ছিল। কারণ নবী-রাসূলগণ হারাম খাদ্য গ্রহণ করেন না। তাহলে যারা বলেন , আবু তালিব ঈমান আনেননি । তারা নবী (সা.)-কে কোথায় পৌঁছালেন ? কারণ পবিত্র কোরআনে সূরা তওবার 28 নং আয়াতে আল্লাহ পাক উল্লেখ করছেন :

) يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْمُشْرِ‌كُونَ نَجَسٌ(

হে ইমানদারগন! নিশ্চই মুশরিকরা হচ্ছে অপবিত্র

তাই ঐ সকল ওলামাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই আপনাদের উক্তি সত্য হলে , নবী (সা.) কি 17 বছর হালাল খাদ্য গ্রহণ থেকে বঞ্চিত ছিলেন ? যা আদৌ বিশ্বাস যোগ্য নয়। পবিত্র কোরআনে আমরা জানতে পেরেছি নবী মূসা (আ.)-কে ফেরাউনের স্ত্রী আছিয়া (আ.) যখন লালন-পালনের সিদ্ধান্ত নিলেন এবং এই শিশুকে দুধ পান করানোর জন্য ধাত্রীর আহবান করলেন অতঃপর অসংখ্য ধাত্রীর আগমণ ঘটল কিন্তু কেউ শিশু মূসাকে দুগ্ধ পান করাতে সক্ষম হল না। তখন সেখানে উপস্থিত নবী মূসা (আ.)-এর আপন ভগ্নী বললেন , আমি আপনাদের এমন এক ধাত্রীর সন্ধান দিতে পারি , হয়তো এই শিশু তাঁর দুগ্ধ পান করবে । আর বাস্তবেও তাই ঘটল , অর্থাৎ আল্লাহ তাঁকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে নিলেন এবং মায়ের দুগ্ধই পান করালেন। উক্ত ঘটনায় ইহাই প্রমানিত হয় যে , আল্লাহর মনোনীত নবী-রাসূলগণ আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত যখন যা ইচ্ছা খাদ্য কিংবা পানীয় গ্রহণ করেন না।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে , আমাদের প্রিয় নবী (সা.) সম্পর্কে কিছু সংখ্যক মুসলমান নামধারী উম্মত এমন সব প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছেন , যা শুনে অন্য ধর্মের অনুসারীরাও লজ্জাবোধ করেন। যেমন রাসূল (সা.)-কে সদা সর্বদা অভাবী , ক্ষুধার্ত ও অসহায় হিসেবে উপস্থাপন , তালিওয়ালা জামা পরিধারণ , রাসূল (সা.)-এর সিনাছাক করে ময়লা দূরিকরণ , রাসূল (সা.)-কে নিরক্ষর নির্ধারণ ও চল্লিশ বছর পর নবী নির্ধারণ সহ বেশ কিছু অসঙ্গতিপূর্ণ কিচ্ছা-কাহিনী আমাদের সমজে প্রচলিত আছে। অথচ পবিত্র কোরআনে বেশকিছু সংখ্যক নবীর নাম ও বর্ণনা রয়েছে , যাঁদের কারো কখনো সিনাছাক করতে হয়নি এবং কেহ নিরক্ষর ছিলেন এমন প্রমাণও নেই। তাই প্রিয় নবী (সা.)-এর উম্মত হিসাবে প্রত্যেক মুসলমানের অন্তত নূন্যতম আকিদা এই হওয়া উচিৎ ছিল যে , আমাদের সমাজে যে সকল বক্তব্য রাসূল (সা.)-এর মান-মর্যাদাকে হেয় প্রতিপন্ন করে এবং ভিন্ন ধর্মের লোকেদের কাছে রাসূল (সা.)-এর শাণ ও মানকে প্রশ্নের সন্মূখিন করে তোলে , অন্তত সে সকল প্রচার-প্রচারণা থেকে বিরত থাকা।

উদহরণ স্বরুপ বলা যেতে পারে যে , ইসলামের ইতিহাসের প্রথম তিন খলিফার সন্মানিত পিতাগণ , কে কোন অবস্থানে ছিলেন বা তাঁরা প্রকাশ্যে কলেমা পড়ে ইসলামের ছায়াতলে এসেছিলেন কি না এবিষয়ে ইতিহাসে তেমন কোন আলোচনা পরিলক্ষিত হয় না। অথচ চতুর্থ খলিফার সম্মানিত পিতা সম্পর্কে যারা মর্যাদাহানীকর বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন তারা কি নিশ্চিত বলতে পারেন যে , দ্বীন ইসলাম এতে কত টুকু উপকৃত হয়েছে ?

আমাদের প্রিয়নবী হযরত মোহাম্মাদ (সা.)-এর 8 বছর বয়স থেকে শুরু করে তাঁর 50 বছর বয়স পর্যন্ত সুদীর্ঘ 42 বছরের এক অকৃত্রিম অভিভাবক ছিলেন হযরত আবু তালিব। তিনি যে কেবলমাত্র নবী (সা.)-এর অভিভাবক ছিলেন এমন নয় , তিনি ছিলেন সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠাতা , কল্যানের অগ্রদূত , মজলুমের বন্ধু ও জালেমের শত্রু। নবী (সা.)-এর বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমেও তা প্রকাশ পেয়েছে।

হযরত আবু তালিব সম্পর্কে কিছু লিখতে গিয়ে ক্ষুদ্র একজন লেখক হিসেবে যে বিষয়টি বারবার আমার অনুভূতিতে নাড়া দিয়েছে তা পাঠক সমীপে প্রকাশ করছি।

পতঙ্গ যখন আলোর সন্ধান পায়

তখন সে আর বাতি থেকে সরতে না চায়

বাতীর অগ্নিতাপে কত পতঙ্গ পুড়ে ছাই হয়ে যায়

তবুও তারা আলো থেকে সরতে না চায়।

তদরূপ হযরত আবু তালিবও সারা জীবন নূরে মোহাম্মদ -কে আগলে ছিলেন এবং আমাদের জন্য সেই শিক্ষাই রেখে গেছেন। যেমন , কোরাইশ কাফেরেরা যখন নবী (সা.)-কে তাদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য হযরত আবু তালিবের ওপর চাপ বৃদ্ধি করলো , জীবনের সেই কঠিন পরিস্থিতিতেও তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে অনড় পাহাড়ের ভূমিকা গ্রহণ করেন এবং আপন সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন যে , মোহাম্মদকে দেয়াতো দূরের কথা যারা তাঁর ক্ষতির চিন্তা করবে তাদেরই অস্তিত্ব তিনি মুছে দেয়ার সংকল্প করেছিলেন। হযরত আবু তালিব যে একজন প্রসিদ্ধ কবি-সাহিত্যক ছিলেন তা সমগ্র আরবে জনশ্রুত ছিল। আবু তালিব কোরাইশ কাফেরদের বিভিন্ন অপকর্মের বিরুদ্ধে নানা সময়ে যে সকল কবিতা , কাসীদা কিংবা বক্তব্য দিয়ে গেছেন তাতেও তাঁর ন্যায়পরায়নাতা ও একত্ববাদের ছাপ রয়েছে সুস্পষ্ট। এর কিছু অংশ সুহৃদ পাঠকের জ্ঞাতার্থে উপস্থাপন করছি।

আল্লাহর কসম! যতক্ষণ আমি জীবিত আছি , কেউ তোমায় কষ্ট দিতে পারবে না ,

শান্তচিত্তে দাও তুমি , আপন রবের ঘোষণা।

প্রকাশ করে দাও তুমি , দাওয়াত তোমার সত্য

পূর্ণাঙ্গ নসীয়তকারী তুমি , রবের তুমি বিশ্বস্ত।

দুনিয়ায় আর নাই কোন দ্বীন , তোমার দ্বীনের মত

মোহম্মদ তুমি গর্ব মোদের , তুমি সর্বউন্নত।11

হযরত আবু তালিব আমাদের নবী (সা.)-এর নূরানী চেহারার উসীলা করে যে কবিতাটি পাঠ করেছিলেন তা নিম্নরুপ :

সেই পবিত্র মহান সত্তার , প্রিয় মুখমন্ডলের উসীলায়

তীব্র উষ্ণ মরু অনাবৃষ্টি দিবসেও , পানি দ্বারা স্নাত সিক্ত হয়ে যায়।

মোহাম্মদ যে , খোদার কৃপা বনি হাশেমের গর্ব

অসহায় অনাথ বিধবার সহায় এ গোত্র , জানে আরব সর্ব

আমেনা তনয় নবী মোহাম্মদ , খোদার সেরা দান

মান-মর্যাদায় সর্বগুনী সে , আমাদেরই সন্তান।

নবী (সা.)-এর প্রতি হযরত আবু তালিবের অকুন্ঠ ভালবাসার প্রতিফলন তাঁর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়েছে , ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। অনুরূপ ভালবাসা কেবলমাত্র ঈমানী শক্তির মত আস্থা-বিশ্বাসের মাধ্যমেই সব ধরনের দু:খ-কষ্ট-যন্ত্রণাকে বিলিন করে দিয়ে মানুষকে দৃঢ়-স্থীর-অবিচল থেকে তাঁর পবিত্র কাঙ্খিত লক্ষে পৌঁছানের জন্য মৃত্যুরও মুখোমুখি করে দেয়। আর ঈমানী শক্তির বলে বলিয়ান সৈনিকেরা শতকরা একশত ভাগ বিজয়ী হবেনই। যে সৈনিক মনে করেন , আকীদা-বিশ্বাস ও আদর্শের পথে নিহত হওয়া ও হত্যা করা হচ্ছে পরম সৌভাগ্যের , তখন তার কাঙ্খিত সাফল্য অর্জিত হবেই। তার অন্ত:করণ সত্যের প্রতি ভালবাসার অলোকবর্তিকা দ্বারা অবশ্যই আলোকিত হবে। তার যাবতীয় কর্মকান্ড যুদ্ধ-সন্ধি কিংবা নীরবতা অবশ্যই ঈমানের ভিত্তিতেই নিশ্চিত হবে। প্রকৃতপক্ষে মানুষের চিন্তা-ভাবনার উৎপত্তি হয় তার বিবেক-বুদ্ধি ও আত্মা থেকেই। মানুষ যেমন তার ঔরসজাত সন্তানকে ভালবাসে ঠিক তেমনি সে তার চিন্তা-ভাবনা ও চেতনার প্রতি ভালবাসা প্রদর্শন করে । নিজ আকীদা-বিশ্বাসের প্রতি মানুষের এই ভালবাসা আপন সন্তানের প্রতি ভালবাসার চাইতেও অধিক। যে কারণে মানুষ আপন বিশ্বাস সংরক্ষণে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকেও এগিয়ে যায়। আপন আকিদা-বিশ্বাসের বেদীমূলে মানুষ তার সকল কিছু উৎসর্গ করে দিতেও কুন্ঠাবোধ করেনা। অথচ সে তার সন্তান-সন্ততি কিংবা আপনজনদের রক্ষায় ততটা ত্যাগ স্বীকারে আগ্রহি হয় না।

ধন সম্পদ অর্থ বিত্ত ও পদ মর্যদার প্রতি মানুষের টান কিংবা আগ্রহ ঐ পর্যন্ত যে পর্যন্ত না মৃত্যু তার জন্য নিশ্চিত হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ঐ মানুষই আবার যখন আকীদা-বিশ্বাসের মুখোমুখি হয় তখন সে বেঁচে থাকার চেয়ে সম্মানজনক মৃত্যুকেই অগ্রাধিকার প্রদান করে। এমন শত শত প্রমাণও আমাদের সম্মূখে বিদ্যমান রয়েছে। যারা আপন আকীদা-বিশ্বাসের মাঝে মহান সৃষ্টিকর্তার সত্য দ্বীনের আলোকিত পরশ উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন তারা বুঝে গেছেন , জীবন মানে জেহাদ আর জেহাদ মানে মুজাহিদ

হযরত আবু তালিব এমনই এক মুজাহিদ ছিলেন , যিনি নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে খোদায়ী নূরের আলো প্রজ্জ্বলিত রাখার নিমিত্তে নূরে মোহাম্মদকে হেফাজত ও সর্বসহযোগিতা প্রদান করে গেছেন। যে কারণে মক্কার গোত্রপতিগণ তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ , অস্ত্রধারণ ও তাঁকে বয়কট করেও নবী (সা.) থেকে পৃথক করতে সক্ষম হয়নি। যার মূলে ছিল নবী (সা.) ও তাঁর দ্বীনের প্রতি আবু তালিবের অগাধ বিশ্বাস , ভালবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ। আর নবী (সা.) চাচাজানের এ অবদানের স্বীকৃতি প্রদান করে গেছেন অকুন্ঠ ভাবে। যেরূপ আদর-যত্নে তিনি চাচার ঘরে লালিত-পলিত হয়েছিলেন , অনুরূপ আদরে তিনিও হযরত আলীকে লালন-পালন করেছিলেন আপন গৃহে। তবে হযরত আলীর লালন-পালনে নবী (সা.)-এর সেই উদ্দেশ্য প্রতিফলিত হয়নি যে , তিনি শুধু চাচার ঋণ শোধ করেছেন। প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে এই যে , নবী (সা.) হযরত আলীকে নবুয়্যতের নিঃর্যাসে প্রস্তুত করেছেন এবং পরবর্তিতে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হওয়ার মত উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেছিলেন।

নবী (সা.)-এর জন্য হযরত আবু তালিবের সর্বস্ব ত্যাগের যথপোযুক্ত কারণও রয়েছে। বার বছর বয়সী আমাদের প্রিয় নবী (সা.)-কে নিয়ে তিনি যে ব্যবসায়িক সফরে সিরিয়া গিয়েছিলেন , তখন তিনি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছিলেন অসংখ্য মোজেযা। শেবে আবু তালিবে আশ্রয় থাকাকালীন সময়গুলোতেও আবু তালিব প্রত্যক্ষ করেছেন আমাদের প্রিয় নবী (সা.)-এর অলৌকিক ক্ষমতাসমূহ। এমন সব খোদায়ী মদদ স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করার পরেও কি আবু তালিব নবী (সা.)-এর দ্বীন গ্রহনে অনীহা প্রকাশ করবেন ? তাহলে যারা বিবেচনা ও যাচাই-বাছাই না করে এ মহান ব্যক্তির ঈমান না আনা সম্পর্কে বক্তব্য দিচ্ছেন , তারা কি নিশ্চিত মিথ্যা প্রচার করছেন না ?

হযরত আবু তালিব রচিত কবিতা ও কাসীদাসমূহে যে বিষয়গুলো সুস্পষ্ট , তা হচ্ছে নবী (সা.)-এর প্রতি ভালবাসা , নবী (সা.)-এর হেফাজতের দৃঢ়তা ও নবী (সা.)-এর দাওয়াতী মিশনের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস। হযরত আবু তালিব রচিত কাব্য সমগ্রের সংগ্রাহক আবু হাফ্ফান আবুদী তার কাসিদায়ে ইলমিয়ায় 121টি পংক্তিতে আবু তালিবের কবিতা সংগ্রহ করেছেন। দীওয়ানই আবু তালিব নামক বইতেও হযরত আবু তালিব রচিত কবিতা ও কাসীদা রয়েছে।12

আবু তালিব কোরাইশদের উদ্দেশ্যে যে বক্তব্য ও কবিতা পাঠ করেছিলেন তা নিম্নে প্রকাশ করা হলো :

তোমাদের কি জানা নেই যে , আমরা মোহাম্মদকে মূসা ইবনে ইমরান ও ঈসা ইবনে মরিয়মের মত রাসূল হিসেবে পেয়েছি। তাঁর নবুয়্যত সংক্রান্ত বিবরণ পূর্ববর্তী আসমানী গ্রন্থ সমূহে লিপিবদ্ধ রয়েছে।

পাঠকের সুবিধার্থে যে বিষয়টি একান্তই উল্লেখ্য তা হচ্ছে হযরত আবু তালিব রচিত মূল কাসীদা ও কবিতাসমূহ আরবি ভাষায় সংগৃহীত। পরবর্তী সময়ে যদিও তা বাংলায় অনুবাদ হয়েছে তদুপরি তাতে কাব্যিক ছন্দের অমিল রয়েছে তাই আমরা মূল বিষয়টি অবিকল রেখে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কবিতার ছন্দ মিল করেছি মাত্র।

শোন যত কোরাইশ শ্রেষ্ঠ , শোন আরবগণ

খোদার শ্রেষ্ঠ নবী মোহাম্মদ , আরতো কেহ নন।

যেমন ছিলেন মূসা ও ঈসা , খোদার কৃপায় নবী

মোদের পরে আসছেন তিনি , বল্লেন তাঁরা সবই।

তাওরাত আর ইঞ্জিলে আছে , মোহাম্মদের কথা

কিতাব খুললে দেখতে পাবে তাঁর সত্যবাদীতা।

যখন কাফেরেরা হযরত আবু তালিবের নিকট এসে , আমর বিন ওয়ালিদ নামের এক সুশ্রী যুবককে পুত্র হিসেবে গ্রহণ পূর্বক মোহাম্মদ (সা.)-কে তাদের হাতে সোপর্দ করার প্রস্তাব দেয় এবং নবী (সা.)-কে হত্যার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে। তখন আবু তালিব মুহূর্তের মধ্যেই ইস্পাত কঠিন ভূমিকা গ্রহণ করেন এবং কাফেরদের প্রস্তাবের জবাবে বলেন আল্লাহর কসম তোমাদের প্রস্তাবটি অত্যন্ত খারাপ ও অমার্জনীয়। আমি তোমাদের সন্তানকে লালন পালন করবো , আর তোমরা আমার সন্তানকে হত্যা করবে ? কত জঘন্য তোমাদের মন বাসনা! মোহাম্মদকে সোপর্দ করা তো দূরের কথা তার সামান্য ক্ষতির চিন্তাও তোমরা করোনা। আল্লাহর কসম আমি বেঁচে থাকতে কখনো তা হতে দেবো না।

আবু তালিবের এমন ভূমিকা দেখে মুতাম বিন আদী নামের এক কাফের সরদার তাঁকে বলল হে আবু তালিব! জাতি তোমাকে মোহাম্মদ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য উত্তম পন্থা বলে দিয়েছে। আমার ধারণা প্রস্তাবটি তোমার মেনে নেয়া উচিত। প্রতিউত্তরে হযরত আবু তালিব বলেন , আল্লাহর কসম! এই জাতি হলো অন্যায়কারী এবং তুমি হচ্ছো তাদের সাহায্যকারী শয়তান , আর মনে রেখ , আবু তালিব কখনোই শয়তানের সাহায্যকারী ছিল না এবং হবেও না।

অতঃপর তিনি যে কবিতা পাঠ করেন , তা নিম্নরূপ :

শোন হে আরব বাসী

কোরাইশের মধ্যে যদি কোন গৌরব থাকে ,

তা হচেছ আব্দে মানাফ

আব্দে মানাফে যদি কোন গৌরব থাকে ,

তা হচ্ছে বনী হাশেম

আর বনী হাশেমের শ্রেষ্ঠ গৌরব হচ্ছে

মোহাম্মদে মোস্তফা , আহমাদে মুজতবা

কোরাইশ কাফেরেরা আমাদের প্রতি

আক্রমণ চালিয়েছে সকল প্রকার

কিন্তু তারা সফল হতে পারেনি , কোন প্রকার।

তাদের চিন্তা ভাবনায় আছে ভুল , আজো তারা বুঝতে পারেনি

আর আমরা কখনো তাদের জুলুম অত্যাচার সহ্য করিনি।

যখনই কেহ অন্যায় ভাবে করেছে অহংকার

তখনই তাদের শায়েস্তা করেছি , গর্ব করেছি চুরমার।

মর্যাদা দেই আমরা খোদার , সকল নিদর্শনে

খাদেম মোরা খোদার কাবার , ভালবাসি নবীগণে।13

সূধী পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণে শুধু এটাই বলবো হযরত আবু তালিবের কবিতা কিংবা কাসীদায় মহান খোদার একত্ববাদ তথা ঈমানের ছোঁয়া আছে কি না তা সকলের বিবেচনায় আনা প্রয়োজন নয় কি ?

ইসলাম প্রচারের পূর্বে মোহাম্মদ (সা.)

মহান সৃষ্টিকর্তা তাঁর রেসালাতের মিশনকে লক্ষ্যে পৌঁছাতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছেন। যেমন জন্মের তৃতীয় দিনে নবী ঈসা (আ.)-এর মুখে ঘোষণা করালেন :

) قَالَ إِنِّي عَبْدُ اللَّهِ آتَانِيَ الْكِتَابَ وَجَعَلَنِي نَبِيًّا(

আমি আল্লাহর দাস , আমাকে কিতাব প্রদান করা হয়েছে। আমাকে নবী বানানো হয়েছে। 14

আবার যিনি নবী-রাসূলগণের সর্দার তাঁকে রেসালাতের ঘোষণা প্রদান করতে অপেক্ষা করতে হয়েছে 40 বছর। যদি আমরা এ বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করি তবে বুঝতে পারব যাঁর যাঁর আগমণকালীন সময় পরিবেশ পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপটই এর মূল কারণ। নবী ঈসা (আ.)-এর সময়ে তাঁর শিশু অবস্থায় তাওহীদের ঘোষণার প্রেক্ষাপট ছিল , আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত পবিত্র আত্মা মরিয়মের চরিত্র মাধুরির ওপর তৎকালীন বকধার্মিক ও ধর্মব্যবসায়ীদের কালিমা লেপনের বিরুদ্ধে আল্লাহর নবী ঈসা (আ.) কর্তৃক সাবধানবাণীর প্রকাশ্য ঘোষণা প্রদান ছিল তার অত্যাবশ্যকীয় কারণ।

আর আমাদের প্রিয় নবী আগমনের পূর্বে সমগ্র আরব ছিল বর্বর মূর্খ ও অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত সমাজ। সেই সমাজের মাঝে সৃষ্টিকর্তা তাঁর নবী (সা.)-এর চরিত্র মাধুরীর আলোকিত পরশ ছড়াতে ছড়াতে যে সময়ের প্রয়োজন হয় তা ছিল 40 বছর। আর এ সময়ের মধ্যেই অসংখ্য লোক যখন খোদায়ী বিধানের আলোর পরশে সিক্ত হতে শুরু করলেন এবং নবী (সা.)-এর চারিত্রিক গুণাবলীর সৌরভ প্রস্ফুটিত গোলাপের ন্যায় সমগ্র আরবে ছড়াতে লাগল। তখন আরববাসীগণ তাঁর নাম রেখেছিলেন আল-আমিন । সৃষ্টিকর্তা প্রথমে তাঁর নবীকে দিয়ে প্রেক্ষাপট তৈরি করলেন। আর দলে দলে মানুষ যখন খোদায়ী আলোর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে লাগল তখনই সৃষ্টিকর্তা তাঁর নবীকে প্রকাশ্যে নবুয়্যতের ঘোষণা প্রদানের তাগিদ করেন এবং নবী (সা.) তাই করলেন। কিন্তু এর মানে এই নয় যে , তিনি 40 বছর পর নবী হয়েছেন। কারণ এটাও পবিত্র কোরআনে প্রকাশিত আছে , নবী ঈসা (আ.) বলছেন :

) قَالَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ يَابَنِي إِسْرَائِيلَ إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ مُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيَّ مِنَ التَّوْرَاةِ وَمُبَشِّرًا بِرَسُولٍ يَأْتِي مِنْ بَعْدِي اسْمُهُ أَحْمَدُ فَلَمَّا جَاءَهُمْ بِالْبَيِّنَاتِ قَالُوا هَذَا سِحْرٌ مُبِينٌ(

আর যখন মারইয়াম পুত্র ঈসা বলেছিল , হে বনী ইসরাঈল , নিশ্চয় আমি তোমাদের নিকট আল্লাহর রাসূল। আমার পূর্ববর্তী তাওরাতের সত্যায়নকারী এবং একজন রাসূলের সুসংবাদদাতা যিনি আমার পরে আসবেন , যার নাম আহমেদ । অতঃপর তিনি যখন সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ নিয়ে আগমণ করলেন , তখন তারা বলল , এটাতো স্পষ্ট যাদু15

আমার পর যে রাসূল আগমণ করবেন তিনি হচ্ছেন আহমদ অর্থাৎ নবী ঈসা (আ.) যখন আমাদের নবী (সা.)-এর আগমনের কথা বলছেন তখনও তিনি দুনিয়াতে আসেননি। এখানেই সুস্পষ্ট প্রমাণ হয় যে , নবুয়্যত প্রাপ্তি 40 বছর পরে নয়। পৃথিবীতে আগমনের পূর্বেই মোহম্মদ (সা.) নবী-রাসূল। আবার পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ পাক একথাও বলছেন :

) وَمَا مُحَمَّدٌ إِلَّا رَسُولٌ(

মোহাম্মদ আর কিছুই নয় তিনি শুধুই আল্লাহর রাসূল 16 অর্থাৎ যখনই মোহাম্মদ (সা.)-এর সৃষ্টি তখন থেকেই রাসূল । দুঃখজনক হলেও সত্য যে , মুসলিম উম্মার এক বিরাট অংশ তাদের নবী সম্পর্কে এমন ভুল আকিদা পোষণ করেন যে , তিনি 40 বছর পর নবুয়্যত লাভ করেছেন । যদি বিষয়টিকে সেভাবে না নিয়ে আল্লাহ পাকের পরিকল্পনা অনুযায়ী মানা হোতো যে , নবী (সা.) তাঁর নবুয়তী মিশনের পরিপূর্ণ কার্যক্রম 40 বছর বয়সে দিগন্ত জুড়ে প্রসারিত করেছেন । আর তাহলে হয়তো মুসলমানদের মাঝে রাসূল (সা.)-এর প্রতি মার্যাদাহানীকর ঐ ভুল আকিদাটি সম্প্রসারিত হোতো না।