ইসলামে হযরত আবু তালিবের অবদান

ইসলামে হযরত আবু তালিবের অবদান 0%

ইসলামে হযরত আবু তালিবের অবদান লেখক:
প্রকাশক: আলে রাসূল পাবলিকেশন্স
বিভাগ: ইতিহাস

ইসলামে হযরত আবু তালিবের অবদান

লেখক: মোঃ নুরুল মনির
প্রকাশক: আলে রাসূল পাবলিকেশন্স
বিভাগ:

ভিজিট: 34437
ডাউনলোড: 3371

পাঠকের মতামত:

ইসলামে হযরত আবু তালিবের অবদান
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 27 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 34437 / ডাউনলোড: 3371
সাইজ সাইজ সাইজ
ইসলামে হযরত আবু তালিবের অবদান

ইসলামে হযরত আবু তালিবের অবদান

লেখক:
প্রকাশক: আলে রাসূল পাবলিকেশন্স
বাংলা

নবী মোহাম্মদ (সা.)-এর বিবাহ পড়ান হযরত আবু তালিব

চাচা হযরত আবু তালিবের সাথে নবী (সা.)-এর ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে সাফল্যের কথা ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র আরবে। তাছাড়া মোহাম্মদ (সা.)-এর সততা সদাচরণ ও সত্যবাদিতার সুনাম পূর্ব থেকেই আরববাসীদের আকৃষ্ট করে রেখেছে। আর এমন সব সুসংবাদ তৎকালিন আরবের বিশিষ্ট ধনী ব্যবসায়ী আসাদ গোত্রের খোয়াইলিদের কন্যা বিবি খাদিজার কানেও পৌঁছায়। তিনি তাঁর কর্মচারী মাইসারার মাধ্যমে নবী মোহাম্মদের কছে প্রস্তাব পাঠান তাঁর ব্যবসার দায়িত্বভার গ্রহণ করার জন্যে। নবী (সা.) তৎক্ষনাৎ খবরটি চাচা হযরত আবু তালিবকে অবহিত করেন এবং তাঁর অনুমতির অপেক্ষায় ছিলেন।

হযরত আবু তালিব পূর্ব থেকেই বিবি খাদিজার উদারতা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। তাই তিনি নবী (সা.)-কে বিবি খাদিজার ব্যবসার ভার নেয়ার অনুমতি প্রদান করেন। নবী (সা.) বিবি খাদিজার ব্যবসার দায়িত্ব নেয়ার পর দেশ-বিদেশের সফর শেষে মক্কায় ফিরে আসলে বিবি খাদিজা মাইসারার কাছ থেকে জানতে পারেন , মোহাম্মদ (সা.)-এর অক্লান্ত পরিশ্রম , সততা , ব্যবসায়িক উন্নতি ও নানা অলৌকিক ঘটনা সম্পর্কে। যতই দিন যাচ্ছিল বিবি খাদিজা নবী (সা.)-এর প্রতি ততই আকৃষ্ট হতে লাগলেন।

এ প্রসংগে উল্লেখ্য যে , বিবি খাদিজা ছিলেন তৎকালীন আরবের কোরাইশ বংশীয় পূর্বপুরুষ কুশাই -এর পুত্র আব্দুল উজ্জা তদীয় পুত্র , আসাদ , তাঁর পুত্র খোয়াইলিদের কন্যা। তাঁর জন্ম যেরূপ অভিজাত বংশে আবার তাঁর চালচলন , স্বভাব , আচরণ ও কর্মক্ষেত্রে বুদ্ধিমত্তা , তীক্ষ্ম মেধা এবং উদার মনোভাবেও ছিল আভিজাত্যের ছাপ।

সমগ্র আরবজুড়ে পিতার ব্যবসার দেখাশোনা ও কর্মপরিকল্পনাকারিণী তিনি নিজেই ছিলেন। মূলত বিবি খাদিজা সেই পুরুষের অপেক্ষায় ছিলেন যার মধ্যে থাকতে হবে বংশীয় মর্যাদা , আদর্শবাদীতা , নৈতিকতা , উদারতা ও খোদাভীরুতা। আর এই জন্য তাঁকে অনেক বছর অপেক্ষাও করতে হয়েছে। অবশেষে তিনি তা পেয়েছেন।

যখন সমগ্র আরবে মোহাম্মদ (সা.)-এর সুনাম ও যশ ছড়িয়ে পড়েছে , আর বিবি খাদিজা ও দেখলেন গত 20/25 বছরে অনুরূপ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কোনো লোকের নাম আরব জনগণের জানা ছিল না। তখন তিনি বিবেচনায় আনলেন তাঁর স্বামী হওয়ার উপযুক্ততা এই মোহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লার মধ্যেই রয়েছে।

তিনি স্বউদ্যগে তাঁর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ও নিকট আত্মীয় নাফিসা বিন্তে মুনিয়াহকে প্রস্তাবসহ নবী (সা.)-এর নিকট প্রেরণ করেন। নবী (সা.) কাবার সন্নিকটে ছিলেন। নাফিসা নবী (সা.)-কে নিজের পরিচয় দিয়ে আলোচনা করার কথা বললে নবী (সা.) আলাপচারিতায় বসলেন। নাফিসা বললেন , হে মোহাম্মদ আপনি একজন যুবক এবং একা। সামান্য কয়েকজন কিশোর ব্যতীত আপনার চেয়ে কম বয়সের পুরুষেরা বিবাহ সম্পন্ন করেছে। আপনি এখনো বিয়ে করছেন না কেন ? নবী (সা.) বললেন , বিয়ে করার জন্য আমি যথেষ্ট সমৃদ্ধশিল নই। নাফিসা বললেন , যদি আপনার সমৃদ্ধহীনতা সত্ত্বেও কোন সমৃদ্ধশিল সুন্দরী সম্মানিতা ও অভিজাত পরিবারের নারী আপনাকে বিয়ে করতে রাজি থাকেন , তবে কি আপনি তাতে সম্মতি দিবেন ? নবী (সা.) বললেন , কে হতে পারেন সেই নারী ? নাফিসা বললেন , তিনি হচ্ছেন খাদিজা বিনতে খোয়াইলিদ । এখন আপনি সম্মত হলে , বিবাহের সকল ব্যবস্থা আমি করব । নবী (সা.) বললেন , আলহামদুলিল্লাহ! আপনার প্রস্তাব অতি উত্তম। তবে আমাকে একটু সময় দিন। আমি আমার পিতৃব্য চাচার পরামর্শ নিয়ে আপনাকে জানাচ্ছি

যেহেতু হযরত আবু তালিব কাবার মোতাওয়াল্লী ছিলেন , সে কারণে তিনি বিবি খাদিজার সাথে পূর্ব থেকেই পরিচিত ছিলেন। তিনি যখন নবী (সা.)-এর কাছ থেকে এ কথা শুনলেন তখন নাফিসার প্রস্তাবকে স্বাগত জানালেন। আর মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করে বললেন , হে খোদা এদের সেই মর্যাদা দিয়ো যেন তাঁরা হতে পারে পৃথিবীর আদর্শ দম্পতিদের অন্যতম

হযরত আবু তালিব তাঁর বোন সাফিয়াকে আরবের রীতি-রেওয়াজ অনুযায়ী হযরত খাদিজার বাড়িতে পাঠালেন। মোহাম্মদ (সা.) ও তাঁর পরিবারের স্বীকৃতি প্রকাশের জন্যে। ইতিমধ্যে নাফিসাও পটভূমির কাজ সুসম্পন্ন করলেন। হবু শ্বশুরবাড়ি থেকে আগত অতিথিদেরকে বিবি খাদিজা সম্মানের সাথে আপ্যায়ন ও উপহার প্রদান করেন এবং হযরত আবু তালিব ও বর পক্ষের অতিথিদের আগমণের আমন্ত্রণ জানালেন। যথারীতি হযরত আবু তালিব তাঁর ভাই হামজা ও আব্বাস সহ আরো কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে উপহার সমেত বিবি খাদিজার বাড়িতে আসেন এবং বিবাহের দিন-তারিখ ধার্য্যপূর্বক পানাহার শেষে বিদায় নেন।

আবু তালিব নিজেই ভাতিজার পক্ষ হয়ে বিবাহের সকল প্রস্তুতির দায়িত্ব নেন। যথারীতি নির্ধারিত তারিখে বরকে আরবীয় প্রথানুসারে বনী হাশেমের রেখে যাওয়া মূল্যবান প্রত্মতাত্ত্বিক রন্নসমূহ দিয়ে সাজানো আলখেল্লা , ছড়ি , কালো পাগড়ি ও আংটি সমেত রাজকীয় সাজে সাজানো অনেকগুলো বলিষ্ঠ ঘোড়ার বহরে হাশেমি যুবকদের কুচকাওয়াজ দল ও কোরাইশ বংশের উর্দ্ধতন নেতৃবৃন্দ ও গোত্র প্রধানগণের সমন্বয়ে বরযাত্রীগণ কন্যার বাড়িতে উপস্থিত হন। আগত অথিতিদের সুস্বাগতম জানিয়ে বরণ করার জন্য বিবি খাদিজা তাঁর এস্টেটের প্রধানকে দিয়ে পূর্ব থেকেই একটি অভ্যর্থনাকারী দল প্রস্তুত রেখেছিলেন। তারা বরযাত্রীদের নিয়ে একটি বিশাল আকৃতির হলরুমে বসালেন। যে ঘরের দেয়াল ও মেঝে ছিল শ্বেতপাথরে বাঁধানো এবং ছাদ ছিল নানা কারুকার্য খচিত , সৌখিন সামিয়ানা দ্বারা আচ্ছাদিত। আর এই বিশেষ আয়োজনে বিবি খাদিজার গৃহের নারী পুরুষদের ছিল বিশেষ পোশাকের ব্যবস্থা। পুরুষদের জন্য নক্ষত্রখচিত আলখেল্লা , রঙিন পাগড়ি এবং কালো রেশমি কাপড়ের কোমর বন্ধন ও মাথার পাগড়িতে শুভ্র পালক। আর নারীরা ছিলেন জমকালো পোশাকে , যাছিল স্বর্ণ তারকা খচিত। তাদের চেহারা ব্যতিত মাথা ও চুল বিশেষ কাপড়ে আবৃত ছিল আর কোমর ও পা পর্যন্ত ছিল মূল্যবান ওড়না ও কাপড়ে আচ্ছাদিত এবং তা ছিল মুক্তা দিয়ে সাজানো। নববধুর কক্ষের সাজসজ্জায় ছিল চমৎকার শৈল্পিক নিপুণতা ও দক্ষতায় পরিপূর্ণ। রেশমী কাপড় ও জরি দিয়ে সাজানো আঙিনা। আর মেঝেতে ছিল শ্বেত রঙের মখমলের গালিচা ও রুপালী পাত্র থেকে সুগন্ধিযুক্ত সৌরভের ধোঁয়া বিচ্ছুরন হচ্ছিল চারদিকে। পানপাত্র আর গোলাপ দানিতে সাজানো ছিল বাহারী রঙের ফুল। বিবি খাদিজা এক অভিজাত সামিয়ানার নিচে উঁচু বেদীতে আসন গ্রহণ করলেন। এ যেন পূর্ণিমার চাঁদ ধরায় নেমে এলো। এখানে একটি বিষয় পাঠকের অবগতি প্রয়োজন। বিবি খাদিজার চাচা আমর বিন আসাদ এই বিবাহে কন্যার অভিভাবক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।

বিবাহ পড়ানোর পূর্বে হযরত আবু তালিব যে খোতবা প্রদান করেন তার নিম্নরূপ:

আলহামদুলিল্লাহ শুকরিয়া আদায় করি সেই মহান সৃষ্টিকর্তার , যিনি আমাদের প্রতি বর্ষণ করেছেন তাঁর অগণিত দয়া , রহমত ও বরকত। তিনি আমাদেরকে ইব্রাহীমের বংশধর ও ইসমাইলের সন্তানদের অর্ন্তভূক্ত করে পবিত্র কাবা ঘরের খাদেম মনোনীত করেছেন এবং এ মহান ঘরের নিরাপত্তা ও হজ্ব অনুষ্ঠানের সাহায্যকারী হওয়ার সুযোগ আমাদের দান করেছেন। আমার ভাতিজা মোহাম্মদ বিন্ আব্দুল্লাহ সম্পদশালী না হলেও বংশীয় মর্যাদা , জ্ঞান-বুদ্ধি , আখলাক-চরিত্র , আচার-আচরণ ও খোদাভীরুতায় সমগ্র আরবে শ্রেষ্ঠত্বের দাবি রাখে । আর খাদিজা বিন্তে খোয়াইলিদ যিনি বংশীয় ধারায় আরবের অভিজাত বংশে জন্ম নিয়েছেন। তাঁর বিচক্ষণ বুদ্ধিমত্তা ও উদার মহানুভবতায় আরব জনগণ পূর্ব থেকেই উপকৃত হয়ে আসছেন। হে খোদা! তুমি স্বাক্ষী থেকো আমি মোহাম্মদের সঙ্গে এই মহিয়সী নারীর বিবাহের দোয়া পাঠ করছি এবং পাঁচশত স্বর্ণ মুদ্রা খাদিজার দেনমোহর ধার্য্যপূর্বক এই বিবাহ সম্পন্ন করছি। হে খোদা! তুমি তাদের সংসার জীবনে তোমার প্রশান্তি দান করো। আপনারা উপস্থিত সকলে উভয়ের মঙ্গল কামনায় মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করুন।

অতঃপর বিবি খাদিজার চাচা আমর বিন্ আসাদ হযরত আবু তালিবের খোতবা শেষে কন্যার পক্ষ থেকে নিজেদের মত প্রকাশ করে তিনি বলেন , সকল প্রশংসা আল্লাহর। কিছুক্ষণ পূর্বে বনী হাশেম সর্দার যে খোতবা প্রদান করেছেন আমরা তা সত্য জ্ঞান করি এবং তার স্বাক্ষ্য প্রদান করি। তাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব আরবে অস্বীকার করার মতো কেউ নেই। আর এ কারণেই আমরা খাদিজা ও মোহাম্মদের বিবাহের ব্যাপারে আগ্রহী হই। হে খোদা! তুমি তাঁদের এই বন্ধন চির অটুট রেখো।

অভিভাবক হিসেবে তিনি বিবি খাদিজার হাতকে মোহাম্মদ (সা.) হাতে তুলে দিলেন। হযরত আবু তালিব বরের পক্ষ থেকে মোহরানা প্রদান করেন। উপস্থিত সকলে নবী (সা.)-কে বিবাহের অভিনন্দন ও তাঁদের ভবিষ্যত জীবনের শান্তি কামনায় দোয়া করেন। এই মহোৎসবে সকলেই হযরত আবু তালিবকে অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন। যখন বর-কনে এক ঘরে এলেন তখন নবী (সা.)-এর চেহারা সূর্যের ন্যয় মনে হলো , যেন চন্দ্র সূর্যের অবস্থান একই সমান্তরালে।

যথারীতি মেহমানদের রাজকীয় খাওয়া পরিবেশন করা হয়। রান্না সম্পর্কীয় যে কোনো শিল্প থাকতে পারে তা অনেকেই সেদিন জানতে পেরেছেন। ভোজন শেষে পদ্ম ফুলের নির্যাস দ্বারা মেহমানদের তৃষ্ণা নিবারণ করা হয়। অতঃপর ঘোষণা হল নববধূ প্রস্থানের জন্য প্রস্তুত। দামি রেশমি বস্ত্রে সজ্জিত একটি মাদি ঘোড়া , তার পিঠে সাদা তাবু সাজানো। কনে ও তার সখি সেই ঘোড়ায় আরোহন করার জন্য অপেক্ষমাণ। সাথে এক কাফেলা উটের সারি। যাতে রয়েছে দাস দাসীসহ কন্যার যাবতীয় ব্যবহারিক সরঞ্জামাদি। আবার অন্য দিকে আছে আগত বরযাত্রীদের সাজানো উটের সারি। একটি মশাল মিছিলের মতো কাফেলা যখন হযরত আবু তালিবের বাড়ি এসে পৌছালো , তখন হযরত আবু তালিবের স্ত্রী কন্যা ও আত্মীয়গণ আরবীয় রীতি অনুযায়ী নববধূকে বরণ করে নেন।

মোহাম্মদ (সা.) ও বিবি খাদিজার বিবাহ হাশেমি ও খোয়াইলিদ গোত্রের মাঝে খুশির জোয়ার এনে দিল। বিবাহের তিন দিন পর হযরত আবু তালিব ভোজ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। সমগ্র মক্কা নগরবাসী উক্ত অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিলেন। আর স্বয়ং নবী (সা.) মেহমানদের স্বাগত জানান ও খোঁজ-খবর নেন। এ অনুষ্ঠান তিন দিন যাবৎ স্থায়ী হয়।

হযরত আবু তালিবের এই আতিথেয়তা আজও ইসলামে ওয়ালিমা হিসেবে প্রচলিত আছে। সেই আয়োজনটি ছিল অবিস্মরণীয়। মক্কার সর্বোচ্চ মহল থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন পর্যায়ের যাযাবর ভিখারী পর্যন্ত কেউই এ বিয়েতে বাদ পড়েনি। নবী (সা.)-এর ওয়ালিমার ভোজ অনুষ্ঠানে উচুঁ-নিচুর ব্যবধান ছিল না। ছিল প্রাণবন্ত আপ্যায়নের ব্যবস্থা। আবার ভোজ শেষে উপহার। নিঃস্ব অসহায়দের পোশাক পরিচ্ছেদের ব্যবস্থা। নবী (সা.)-এর বিবাহ যেন সমগ্র মক্কায় এক অনাবিল শান্তির পরশ ছিল।

পঁচিশ বছর বয়সে নবী (সা.) চল্লিশ বছরের বিবি খাদিজাকে জীবনসঙ্গিণী করেন। দাম্পত্য জীবনে নবী (সা.) অত্যন্ত সুখী ছিলেন। ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত নবী (সা.) এক মুহূর্তের জন্যও বিবি খাদিজাকে যেমন ভুলে থাকতে পারেননি , অনুরূপ বিবি খাদিজাও বলেছেন , অনন্ত শুকরিয়া আদায় করছি সেই মহান প্রভুর যিনি আমার প্রতি দান করেছেন মোহাম্মদকে স্বামী হিসেবে। আর মোহাম্মদকে না পেলে আমি তো দয়াময়ের সকল রহমত থেকেই বঞ্চিত হতাম। 17

এখানে সম্মানিত পাঠক-পাঠিকার দৃষ্টি আকর্ষণে আমি শুধু এটুকু স্মরণ করাতে চাই , পৃথিবীর শুরু থেকে আজ পর্যন্ত কোনো নবী-রাসূলের বিবাহ কোনো সাধারণ কিংবা ঈমানহীন ব্যক্তির পক্ষে পড়ানো সম্ভব হয়েছিল কি ? অথবা এমন কোন সংবাদ কিংবা প্রমাণ কেউ উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে কি ? উত্তর একটাই না । তাহলে যারা হযরত আবু তালিবের ঈমান সম্পর্কে কথা বলেন , তারা দয়া করে কোরআন , হাদীস ও ইতিহাসের আলোকে বিষয়টি যাচাই করলেই প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন যে , তারা কতটুকু সত্য প্রকাশ করছেন।

আধ্যাত্মিক সাধনায় মোহাম্মদ (সা.)

বিবি খাদিজাকে বিবাহের পর নবী (সা.)-এর আর্থিক সঙ্কট মোচন হয়েছিল। তাই সাংসারিক প্রতিকূলতা সামাল দিতে বিবি খাদিজা-ই যথেষ্ট ছিলেন। যে কারণে নবী (সা.) ঐশী চিন্তায় নিমগ্ন হওয়ার অধিক সময় ও সুযোগ পেলেন। আর শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন চিন্তাশীল। মুসলমানদের একটা বিরাট অংশ মনে করেন যে , নবী (সা.) প্রাপ্তবয়ষ্ক হওয়ার পর থেকেই এক অজানা রহস্যলোকের সাথে তাঁর আত্মার সংযোগ ছিল। আধ্যাত্মিক জগতের অনেক দৃশ্য তাঁর মনসপটে ভেসে উঠতে লাগল। মনে হতো কে যেন তাঁর কর্ণকুহরে কি যেন বলে গেল। কে যেন তাঁকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে , কে যেন চোখের সামনে এসে আবার মূহূর্তেই হারিয়ে গেল। কখনও কখনও তিনি স্পষ্ট শুনতে পেতেন , কে যেন ডেকে বলছে , মোহাম্মদ আপনি আল্লাহর রাসূল । আর স্বপ্নে দেখতে পেতেন , স্বর্গীয় শোভামিশ্রিত অলৌকিক বিষয়াবলি। এভাবে অন্তরের প্রদীপ্ত চেতনায় তিনি অধীর হতে লাগলেন এবং এভাবেই তাঁর 15 বছর অতিবাহিত হলো। এক অজানা শঙ্কা-ভীতি , অস্বস্তি ও উদ্বেগ এবং একই সাথে অজানাকে জানার দূর্জয় কৌতূহল ও জীবন-জিজ্ঞাসা তাঁকে অভিভূত করে তুললো। সংসারের কর্মকোলাহল যেন তাঁর আধ্যাত্মিক চেতনাকে ব্যর্থ না করে। সমাজ জীবনের পঙ্কিলতা যেন ঐ পবিত্র জ্যোতির গতিস্রোত রুদ্ধ না করে।

আর বাস্তবতা হচ্ছে সহধর্মিণী খাদিজা প্রিয় স্বামীর সকল কর্মকাণ্ডে সার্বিক সহযোগিতা করতে লাগলেন। তিনি নবী (সা.)-কে 2/3 দিনের খাদ্য পানীয় প্রস্তুত করে দিতেন। নবী (সা.) তা নিয়ে হেরা গুহায় গভীর ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। খাদ্য পানীয় শেষ হয়ে গেলে নবী (সা.) গৃহে ফিরে আসতেন , আবার যেতেন। কখনও ফিরে আসতে দেরি হলে বিবি খাদিজা নিজেই খাদ্য পানীয় নিয়ে হাজির হতেন অথবা হযরত আলীকে দিয়ে হেরা গুহায় পাঠিয়ে দিতেন। বিবি খাদিজা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর স্বামীর মধ্যে এক অন্তঃবিপ্লব চলছে এবং তা ক্রমশ একটি পরিণতির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। নিশ্চই তিনি আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ , যা তিনি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন।

নবী (সা.)-এর ধ্যানমগ্ন দিনগুলোতে তিনি নিবিড় আত্মতৃপ্তি উপলব্ধি করছিলেন। আর তা সম্ভব হয়েছিল বিবি খাদিজা এবং কিশোর আলীর স্বক্রিয় সহযোগিতার দরুন। তখন রমজান মাস , এক গভীর রাতে নবী (সা.) ধ্যানমগ্ন ছিলেন। হঠাৎ তিনি শুনতে পেলেন কেউ যেন তাঁর নাম ধরে ডাকছেন , হে মোহাম্মদ , তিনি চোখ খুললেন , দেখলেন এক জ্যোর্তিময় ফেরেস্তা তাঁর সম্মুখে দণ্ডায়মান। তাঁর জ্যোতিতে গুহা আলোকিত হলো। তিনি বললেন , আমি আল্লাহর বাণী বাহক ফেরেস্তা , জিব্রাইল . হে মোহাম্মদ ,

) اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ(

পাঠ করুন আপনার প্রভুর নামে , যিনি সকল কিছু সৃষ্টি করেছেন। 18

মহা সত্যের প্রথম উপলব্ধিতে তিনি অভিভূত হয়ে পড়েন। নবী (সা.) ত্বরা করে বিবি খাদিজার কাছে ছুটে গেলেন। বিবি খাদিজা তাঁর অস্থিরতা দেখে বুঝতে পেরে বললেন , আপনার ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। আল্লাহ কখনও আপনাকে নিরাশ করবেন না , কারণ আপনি আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করেন না। আপনি অন্যের জন্য নিজে কষ্টের বোঝা বহন করেন। মানুষের দুর্যোগ দূর্বিপাকে সাহায্য সহায়তাকারীর ভূমিকা পালন করেন। দুঃস্থ নিঃস্বদের জন্য উপার্জনের ব্যবস্থা করেন এবং ঘোর বিপদেও সত্য থেকে বিচ্যুত হন না। এভাবে স্বামীকে সান্তনা দিলেন।

অতঃপর তাঁর দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই ওরাকা বিন নওফেলের স্মরণাপন্ন হলেন। যিনি ছিলেন ইঞ্জিল কিতাবের অনুসারী একজন জ্ঞানতাপস। বিবি খাদিজা নবী (সা.)-এর বিষয়ে তাকে অবহিত করলেন। ওরাকা কিতাব মিলিয়ে খুশিতে উচ্চারণ করলেন কুদ্দুসুন কুদ্দুসুন এটা সেই নিদর্শন যা মূসা ও ঈসার প্রতি প্রেরিত হয়েছিল। তবে মনে রেখো সামনে অনেক বিপদ , সাবধান থেকো । আবার বললেন , হায় মোহাম্মদ , তোমার দেশবাসী তোমার ওপর কতই না অত্যাচার করবে। তোমাকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিবে। তুমি আদম সন্তানদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। আমি বেঁচে থাকলে তোমাকে সাহায্য করব। ওরাকার মুখে এমন সব সংবাদ শুনে বিবি খাদিজার অন্তর তৃপ্ত হলো। তাঁর স্বামী মোহাম্মদ (সা.) আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ বান্দাদের অন্যতম।

তিনি ঘরে ফিরে এসে নবী (সা.)-এর হাতে হাত রেখে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন এবং আল্লাহর দ্বীন গ্রহণের প্রথম স্বাক্ষ্যদাতার গৌরব অর্জন করেন। আর দ্বিতীয় স্বাক্ষ্যদাতা হলেন কিশোর হযরত আলী। মহান সৃষ্টিকর্তার পবিত্র দ্বীন ইসলাম তাঁর প্রিয় নবী (সা.)-এর পর , যাদের সক্রিয় সহযোগিতা ও প্রাণপন ত্যাগের বিনিময়ে আমাদের নিকট পর্যন্ত এসে পৌঁছিয়েছে। তাঁদের সে অবদানকে যদি কেউ ভুলে যায় কিংবা খাটো করে দেখে তবে তা হবে অকৃজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ নতুবা নিরেট মোনাফেকি।

এখানে আরো একটি ঐতিহাসিক ঘটনা উল্লেখ করছি , নবী (সা.) প্রকাশ্যে নবুয়্যত ঘোষণা দেয়ার পূর্বে তিনি তাঁর চাঁচা হযরত আব্বাসের নিকট গিয়ে বলেছিলেন যে , আল্লাহ আমাকে তাঁর হুকুম প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছেন , সুতরাং এ মর্মে আপনি আমাকে সাহায্য করুন , আমার বাহুকে শক্তিশালী করুন। ঐসময় হযরত আব্বাস তাঁর দূর্বলতা প্রকাশ করে বলেছিলেন , হে বৎস! তুমি আমার ভাই আবু তালিবের নিকট এই বক্তব্য উপস্থাপন করো , তিনি আমাদের সকলের বয়োজ্যেষ্ঠ তিনি তোমাকে সাহায্য কিংবা সঙ্গ কোনোটাতেই পিছপা হবেন না। অতঃপর উভয়ই হযরত আবু তালিবের সম্মুখে উপস্থিত হলেন এবং হযরত আব্বাস নবী (সা.)-এর বক্তব্য পূনরাবৃত্তি করে নিজের অক্ষমতার কথা প্রকাশ করলেন। হযরত আবু তালিব সমূদয় বক্তব্য শোনার পর নবী (সা.)-কে বুকে টেনে নিলেন। অতঃপর বললেন , হে , মুহাম্মদ! যাও নির্ভয়ে ঘোষণা দাও , তোমার রবের পক্ষ হতে যা তোমাকে বলা হয়েছে। কেউ তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না , অন্তত আমি যতদিন বেঁচে আছি। 19

সুহৃদ পাঠক/পাঠিকার জ্ঞাতার্থে যে বিষয়টি উল্লেখ্য তা হচ্ছে , মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর নবী রাসূল ও বান্দাদের প্রতি যে সংবাদ বা মেসেজ প্রেরিত হয় , তা তিনটি মাধ্যমে হয়ে থাকে। যেমন ওহী , ইলহাম ও স্বপ্ন । আর এ তিনটির দুটিই নবী (সা.)-এর শিশু অবস্থা থেকে বিদ্যমান ছিল। শুধু ওহী এসেছে পরিণত বয়সে। যার প্রমাণস্বরূপ বলা চলে , মাত্র আট বছর বয়সে নবী (সা.) হজরে আসওয়াদ নামক পাথর স্থানান্তর নিয়ে যে বিরোধের সৃষ্টি হয়েছিল , তিনি তার সুষ্ঠু সমাধান দেন। এর মূলে ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে শিশু নবী (সা.)-এর অন্তরে অলৌকিক মেসেজ প্রেরণ। যাকে ইলহাম বলা হয়। যদি তা না হতো তবে ঐ পাথরকে কেন্দ্র করে প্রচুর প্রাণহানী ও গোত্রীয় দ্বন্দ্ব বিদ্যমান থাকত দীর্ঘকাল।

আমরা মুসলমানেরা শুধু নই দুনিয়ার সকল ধর্মের মানুষ এ বিষয়ে একমত যে , নবী (সা.) শিশু , কিশোর , যুবক কিংবা বৃদ্ধ অবস্থায় জীবনে কোনো কালেই কোন মিথ্যা , অশালীন , ইয়ারকী , ধোঁকা , প্রলাপ কিংবা উত্তেজিত হয়ে কোন অনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেননি। উদাহরণস্বরূপ একটি হাদিস উল্লেখ করছি হযরত আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত , রাসূল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল আপনি কখন নবুয়ত লাভ করেছেন ? তিনি বললেন , যখন আদম পানি ও মাটির মাঝে ছিলেন 20 । অর্থাৎ আদমের অস্তিত্বের পূর্বেও তিনি নবী ছিলেন। উল্লিখিত হাদীসে এটাই প্রমাণ করে নবী-রাসূলগণ আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত ও নির্ভুল। অর্থাৎ নবী (সা.)-এর বয়স যাই হোক না কেন , তিনি আল্লাহ কর্তৃক পরিচালিত সর্বাবস্থায়। একজন লেখক হিসেবে আমি তাই মনে করি। ইলহাম , স্বপ্ন কিংবা ওহী এর যেকোনোটি নবী (সা.)-এর কাছে আসা খুবই স্বাভাবিক। যেমনটি বলা চলে আল্লাহ পাক বিবি মরিয়মকে কথা না বলার ও রোজা পালনের বিষয় জানালেন এবং কারো কোনো প্রশ্ন থাকলে তার উত্তর লাভের উপায় হিসেবে নিজ শিশুর প্রতি ঈঙ্গিত প্রদানের কৌশল শিখিয়ে দিলেন এবং বাস্তবেও তাই ঘটেছিল। তিন দিনের শিশু ঈসা তৎকালীন বকধার্মিকদের কুরুচিপূর্ণ হীন মন্তব্যের বিরুদ্ধে কঠিন জবাব দিয়ে জানিয়ে দিলেন তাঁর মাতা বিবি মরিয়ম পৃথিবীর পবিত্রতম মহিলাদের অন্যতম।

) قَالَ إِنِّي عَبْدُ اللَّهِ آتَانِيَ الْكِتَابَ وَجَعَلَنِي نَبِيًّا(

তিনি আল্লাহর দাস তাঁকে কিতাব প্রদান করা হয়েছে এবং তাঁকে নবী মনোনীত করা হয়েছে। 21 নবী ঈসা (আ.)-এর এই বক্তব্য প্রদানের বিষয়টি ছিল ইলহাম।

আবার কথিত আছে নবী ইব্রাহিম (আ.)-কে আল্লাহ পাক স্বপ্নের মাধ্যমে জানিয়ে দিলেন , তোমার সবচেয়ে প্রিয় বস্তুকে কোরবানি করো । বহু ত্যাগ তিতীক্ষার পর তিনি যখন আপন সন্তান ইসমাইলকে কোরবানি দেয়ার প্রস্তুতি সম্পন্ন করলেন , তখন তাঁর কোরবানি গৃহীত হলো। আর আল্লাহর পক্ষ থেকে কোরবানি হলো এক দুম্বা। এভাবে নবী ইব্রাহীমের স্বপ্ন পরিণত হলো বাস্তবে।

আমাদের প্রিয় নবী মোহাম্মদ (সা.)-এর নিকট হযরত জিব্রাইলের আগমণই ছিল ওহী। কারণ তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন না কোনো সংবাদ নিয়েই আগমণ করতেন। উল্লিখিত ঘটনাসমূহের আলোকে এটাই প্রমাণিত যে , আল্লাহর মনোনীত কোন নবী-রাসূলই পূর্বে সাধারণ লোক ছিলেন না এবং 40 বছর পর নবী মনোনীত হয়েছেন এমন ও নয়। কারণ আল্লাহ স্বয়ং পবিত্র ও নির্ভুল এবং তাঁর মনোনীত নবী রাসূল ও ইমামগণ নির্ভুল ও মাসুম সর্বাবস্থায়।