ইসলামে হযরত আবু তালিবের অবদান

ইসলামে হযরত আবু তালিবের অবদান 0%

ইসলামে হযরত আবু তালিবের অবদান লেখক:
প্রকাশক: আলে রাসূল পাবলিকেশন্স
বিভাগ: ইতিহাস

ইসলামে হযরত আবু তালিবের অবদান

লেখক: মোঃ নুরুল মনির
প্রকাশক: আলে রাসূল পাবলিকেশন্স
বিভাগ:

ভিজিট: 34434
ডাউনলোড: 3365

পাঠকের মতামত:

ইসলামে হযরত আবু তালিবের অবদান
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 27 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 34434 / ডাউনলোড: 3365
সাইজ সাইজ সাইজ
ইসলামে হযরত আবু তালিবের অবদান

ইসলামে হযরত আবু তালিবের অবদান

লেখক:
প্রকাশক: আলে রাসূল পাবলিকেশন্স
বাংলা

শেবে আবু তালিব’ - এ আশ্রয়

মক্কার কাফের মুশরিকরা শত চেষ্টা করেও যখন মোহাম্মদ (সা.)-কে তাঁর দ্বীনের প্রচার রোধ করতে ব্যর্থ হলো , আবার হাশেমিদের সাথে যুদ্ধের পরিণতি হবে ভয়াবহ এবং হযরত আবু তালিবের নিকট বার বার অভিযোগ করেও যখন কোনো ফল হলো না। তখন তারা এক পরামর্শ সভার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিল যে , সামাজিকভাবে বনী হাশেমের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করা হবে। তাঁদের সাথে কেউ উঠা-বসা , কথা-বার্তা ক্রয়-বিক্রয় ও কোনো প্রকার আদান-প্রদান কিংবা লেনদেন করবে না। এ মর্মে কাফেরদের স্বাক্ষরিত একটি শপথ পত্র তাঁরা কাবার দেয়ালে ঝুলিয়ে দিল। তদানুযায়ী সকলে প্রতিফলনও ঘটাতে লাগল।

পক্ষান্তরে , বনী হাশেম লোকদের জন্য সমাজচ্যুত হয়ে জীবনযাপন করাটা ছিল কঠিন ও যন্ত্রণাদায়ক বিষয়। উদ্ভুত পরিস্থিতির কারণে হাশেমি সর্দার হযরত আবু তালিব বিচলিত না হয়ে হেন কঠিন পরিস্থিতিকে স্বেচ্ছায় বরণ করে নিলেন। আপন ভাতিজা ও তাঁর প্রচারিত দ্বীন ইসলামকে রক্ষার নিমিত্তে তিনি অবিচল থাকলেন। অবশেষে হযরত আবু তালিব মোহাম্মদ (সা.)-এর জীবনের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে স্বগোত্রীয় লোকজন ও পরিবার-পরিজন সমেত মক্কা র অদূরে পাহাড়ের পাদদেশে একটি উপত্যকায় অবস্থান নিলেন। ইসলামের ইতিহাসে যা শেবে আবু তালিব নামে আজও পরিচিত। ঐ স্থানে প্রিয় ভাতিজা ও পরিবার-পরিজন সমেত দীর্ঘ তিন বছর অতিবাহিত করা যে কত কঠিন কাজ ছিল তার কিছু উদাহরণ নিম্নে তুলে ধরা হলো।

প্রথমত আরবের মক্কা নগরীর সর্দার ও কাবার মোতাওয়াল্লী হয়ে একটি পাহাড়ের পাদদেশে যাযাবরি জীবন ব্যবস্থাকে মেনে নেয়া কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব কি না ? তদুপরি ঐ পাহাড়ী অবস্থানে জীব-জন্তু , পোকা-মাকড় ও সাপ-বিচ্ছুযুক্ত পরিবেশে আরবের সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দীর্ঘকাল অবস্থান করা কারো পক্ষে সম্ভব কি না ? তদুপরি রয়েছে অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করার পরিস্থিতি , আবার রয়েছে কাফের মুশরিকদের নজরদারি ও গুপ্ত আক্রমণের আশঙ্কা। আমি অন্তর দিয়ে সালাম জানাই সেই অকুতোভয় মহান ঈমানদার মোমেন , হাশেমি বীর সর্দার হযরত আবু তালিবকে। যদি সেদিন তিনি তদ্রুপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করতেন তবে আমরা আমাদের প্রিয় নবী কিংবা ইসলাম-এর কোনোটাই অক্ষত পেতাম না।

এমন অসংখ্য দিবস-রজনী কিংবা হযরত আবু তালিব ও তাঁর পরিবারের লোকেরা অতিবাহিত করেছিলেন সামান্য রুটি ও কিছু ফলমূল খেয়ে। আর অধিকাংশ সময় কেটেছে পাহাড়ী গাছের লতাপাতা আহারের মধ্য দিয়ে। হযরত আবু তালিব এ দীর্ঘ বন্দি জীবনের বহু রাত কাটিয়েছেন নবী (সা.)-কে রক্ষার অতন্দ্র প্রহরী হয়ে।

অবশেষে তিন বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর , নবী (সা.) চাচা হযরত আবু তালিবকে বললেন চাচাজী আপনি কাফের সর্দার আবু সুফিয়ান , আবু লাহাব , আবু জাহেল , ওতবা ও শাইবাকে গিয়ে বলুন , তোমরা আমাদেরকে বয়কট করার উদ্দেশ্যে যে শপথপত্র কাবায় ঝুলিয়ে ছিলে , গিয়ে দেখ তা উইপোকায় কেটে নষ্ট করে ফেলেছে। যেহেতু তোমাদের শপথ পত্রেরই অস্তিত্ব বিনষ্ট হয়ে গেছে। সুতরাং তোমরা আমাদের ওপর যে বয়কট আরোপ করেছিলে তার কি আর কোনো অস্তিত্ব আছে ? কাফের সরদারেরা হযরত আবু তালিবের কথা অনুযায়ী বিষয়টি যাচাই করে দেখল মোহাম্মদের কথা সম্পূর্ণ সঠিক। আর তাতে সকলে লজ্জায় মাথা নত করে বিদায় নিল।22

পাহাড়ের পাদদেশে দীর্ঘ তিন বছর নানা প্রতিকূল পরিবেশে অবস্থান। তদুপরি খাদ্য ও পানির সার্বক্ষণিক অভাব। নানামুখী যন্ত্রণা ও বিরূপ পরিবেশ পরিস্থিতির শিকার হওয়ার পরেও নবী (সা.)-এর প্রতি আবু তালিবের ঈমান আনার আর কোনো পরীক্ষার প্রয়োজন আছে কি ? আমি এখানে একটি উদাহরণ তুলে ধরছি যেমন , কোন ব্যক্তি যদি ফুল ভাল না বাসে। তবে ঐ ব্যক্তি কি ফুলের বাগান সাজানোর জন্য নানা জাতের ফুলের চারা রোপন কিংবা তার পরিচর্যা করবে ? নিশ্চয়ই না। তাহলে যদি আবু তালিবের ইসলাম গ্রহণের কোনো ইচ্ছাই না থাকে , তবে কেন তিনি ইসলাম ও তাঁর নবীকে লালন পালনের মতো গুরু দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। আর জীবনে তাঁকে এর জন্য দিতে হয়েছে চরমমূল্য। হযরত আবু তালিব তাঁর জীবনের সর্বশক্তি দিয়ে রাসূলে আকরাম (সা.)-এর হেফাজত করেছেন এবং আল্লাহর দ্বীন প্রচারে তাঁকে সর্বাত্মক সাহায্য সহযোগিতা করেছেন। কোরাইশ কাফেরদের কথা অগ্রাহ্য করে শেবে আবু তালিবে নবী (সা.) সহ স্বপরিবারে অবস্থান ছিল হাশেমি বংশের জন্য এক মহা কঠিন পরীক্ষা। এতদসত্ত্বেও তিনি দ্বীন ইসলাম ও তাঁর নবীকে কাফেরদের কাছে মাথনত করতে দেননি।

এক শ্রেনির মুসলমান যদিও বলে থাকেন , যেহেতু নবীজি আবু তালিবের ভাতিজা ছিলেন , তাই তিনি তাঁর কর্তব্য পালন করেছেন এতে তাঁর ঈমান আনার বিষয়টি পরিস্কার হয় না সুতরাং আমি এখানে কিছু সাধারণ যুক্তি উপস্থাপন করছি। যেমন: পিতা-মাতাগণ নিজের প্রাণের চেয়েও তাদের সন্তানদের অধিক ভালোবাসেন এবং নিজের জীবনের বিনিময়েও যদি সন্তান বেঁচে যায় তবে পিতা-মাতা তাতে রাজি হয়ে যান। অনুরূপ ঘটনা যদি আমাদের সমাজে ঘটে তবে তা হবে স্বাভাবিক কিন্তু পিতা-মাতা নিজের সন্তানের পরিবর্তে ভাতিজার জন্য জীবন বাজি রাখা এটা হলো অস্বাভাবিক। আর এটা শুধুমাত্র তারই পক্ষে সম্ভব যার অন্তরে রয়েছে দৃঢ় ঈমান ও নিরঙ্কুশ ভালোবাসা। শেবে আবুতালেবে একঘরে থাকা অবস্থায় কোরাইশ গুপ্তচরেরা উপত্যকায় যাওয়ার পথে সার্বক্ষণিক দৃষ্টি রাখতো। যাতে কেউ খাদ্য সামগ্রী নিয়ে আবু তালিবের পরিবারের কাছে যেতে না পারে। এধরণের নিয়ন্ত্রণ এবং দৃষ্টি রাখা সত্বেও কখনো কখনো বিবি খাদিজার ভাতুষপুত্র হাকীম বিন হিজাম , আবুল আস ইবনে রাবি ও হিশাম ইবনে আমর রাতের গভিরে কিছু গম ও খেজুর সমেত বস্তা একটি উটের ওপর চাপিয়ে উপত্যকার কাছাকাছি আসতেন এবং রশি উটের গলায় পেঁচিয়ে উটটিকে ছেড়ে দিতেন আর উক্ত খাদ্য সামগ্রী নিয়ে উটটি অবরুদ্ধ বনি হাশিম শিবিরে পৌঁছে যেত অতঃপর তাঁরা তা নামিয়ে নিতেন। এধরণের সহযোগিতা করতে গিয়ে অনেক সময় তারা প্রতিরোধেরও সম্মুখিন হতেন।

একবার আবু জেহেল দেখতে পেল যে , হাকীম বিন হিজাম কিছু খাদ্য সামগ্রী উটের পিঠে নিয়ে উপত্যকার পথে রওনা হয়েছেন , তখন সে তীব্রভাবে তাঁর ওপর চড়াও হয়ে বললো , আমি তোমাকে কোরাইশদের কাছে নিয়ে গিয়ে অপমানিত করবো। এ নিয়ে উভয়ের মধ্যে ধস্তাধস্তি ও বাকবিতন্ডা চলতে থাকে ঐ সময় আবু বুখতুরী , যে ছিলো ইসলামের শত্রু। সে আবু জেহেলের এধরণের আচরণের তীব্র নিন্দা করে বললো , হাকীম তার ফুফু খাদিজার জন্য খাদ্য নিয়ে যাচ্ছিল এতে তোমার এত মাথা ব্যথা কেন ? তাকে বাধা দেয়ার অধিকার তোমার নেই। বুখতুরী শুধু এ কথা বলেই ক্ষান্ত হলো না , সে আবু জেহেলকে রাগান্বিত হয়ে লাথিও মারলো। অর্থাৎ আবু জেহেলের অতিরঞ্জিত অমানবিক কর্মকান্ড তার দলীয় লোকেরাও পছন্দ করতো না।

কাবার দেয়ালে চুক্তিপত্র ঝুলানো এবং তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোরাইশদের কঠোর আচরণ মুসলমানদের ধৈর্য্যশক্তি ও মনোবল বিন্দু মাত্র হ্রাস করতে সক্ষম হয়নি। মহানবী (সা.) তাঁর চাচা সর্ম্পকে যে বক্তব্য দিয়েছেন তার কিছু অংশ পাঠকের জ্ঞাতার্থে উপস্থাপন করছি। নবী (সা.) বলেন , আমার চাচাজান তাঁর পুরো পার্থিব জীবন ও অস্তিত্ব দিয়ে আমাকে আগলে রেখেছেন এবং কোরাইশদের নিকট আমার জন্য মারাত্মক ভাষায় চিঠি দিয়ে তাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন , তিনি কখনোই আমাকে তাঁর সাহায্যদান এবং পৃষ্ঠপোষকতা থেকে বিরত হবেন না। তাঁর চিঠির একটি অংশ অনুরূপ , হে মোহাম্মদের শত্রুরা! ভেবোনা যে , আমরা মোহাম্মদকে ত্যাগ করবো , কখোনোই না। সে সর্বদা আমাদের নিকট ও দূর সম্পর্কের সকল আত্মীয়-স্বজনের কাছে অত্যন্ত প্রিয় ও সম্মানিত বনি হাশিমের শক্তিশালী বাহুগুলো তাঁকে সবধরণের আঘাত ও ক্ষতি থেকে রক্ষা করবে।23

ইতিহাসের পাতায় বিভিন্ন সময়ে আমরা যে সকল ব্যক্তির ভালোবাসা ও আবেগ অনুভূতির নিদর্শন দেখতে কিংবা বর্ণনা শুনতে পাই সেগুলোর অধিকাংশই বস্তুবাদি মাপকাঠি এবং বিত্ত-বৈভবকে কেন্দ্র করেই। আর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সেই প্রোথিত ভালবাস ও আবেগ অনুভূতির বহ্নিশিখা নির্বাপিত হয়ে যায়।

আর যেসকল আবেগ ও অনুভূতির ভিত্তি হচ্ছে আত্মিয়তা ও রক্তের বন্ধন অথবা ভালোবাসার প্রিয় ব্যক্তিটি আধ্যাত্মিক পূর্ণতা ও উৎকৃষ্ট গুণাবলির ওপর প্রতিষ্ঠিত , সেই বিশ্বাস ও ন্যায় নিষ্ঠার বহ্নিশিখা কখনো তাড়াতাড়ি নিভে যায় না। অনুরূপ বলা চলে আমাদের প্রিয় নবী (সা.)-এর প্রতি আবু তালিবের ভালবসার দুটি উৎস ছিল। প্রথমটি হচ্ছে তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন মোহাম্মদ হচ্ছেন আল্লাহর প্রেরিত একজন ইনসানে কামেল অর্থাৎ সর্বদিক থেকে পরিপূর্ণ মানব। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে মোহাম্মদ (সা.) তাঁর আপন ভাতিজা।

হযরত আবু তালিব তাঁর নিজ ভাই ও সন্তানের স্থলে নবী (সা.)-কে স্থান দিয়েছেন। মোহাম্মদ (সা.)-এর আধ্যাত্মিকতা ও আত্মিক পবিত্রতায় আবু তালিব এমনই আস্থাশীল ছিলেন যে , যখনই তিনি কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগ কিংবা বিপদ-আপদের আশংকা করতেন তখনই তিনি নবী (সা.)-এর স্মরণাপন্ন হতেন এবং তাঁকে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনার জন্য অনুরোধ করতেন। আবু তালিব জীবনে কখনোই পার্থিব কোন সম্পদ অর্জন কিংবা দুনিয়াবী কোন স্বার্থ উদ্ধারের নিমিত্তে নবী (সা.)-কে ব্যবহার করেননি।

হযরত আবু তালিবের জীবনী পর্যালোচনায় যে বিষয়গুলি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তা হলো শক্তিশালী আস্থা , নিরঙ্কুশ ভালোবাস ও মনের দৃঢ়তা। আর এগুলোর সবগুলোর প্রকাশ পেয়েছে নবী (সা.)-এর লালন-পালন ও অভিভাবকত্বের গ্রহণের শুরু থেকে তাঁর ইন্তেকাল পর্যন্ত তিনি তাঁর জীবন উৎসর্গ করে গেছেন ইসলামের নবী (সা.)-এর হেফাজতে।

সুতরাং এটাই প্রমাণিত আবু তালিব ও ইসলাম পরস্পর অবিচ্ছেদ্য। অতএব হযরত আবু তালিব সম্পর্কে বিরুপ যাকিছু প্রচার করা হয় তা ঢাহা মিথ্যা , অবাস্তব , কল্পনাপ্রসূত এবং কোনো প্রকার প্রমাণ ছাড়াই।

অসুস্থ চাচার পাশে মোহাম্মদ (সা.)

শেবে আবু তালিব থেকে ফেরার প্রায় এক বছরের মধ্যেই হযরত আবু তালিব অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন 619 খ্রিষ্টাব্দ। নানা প্রতিকূল পরিবেশ আর দুঃশ্চিন্তায় দিন দিন তাঁর শরীরের অবনতি হতে থাকে। নবী (সা.)-এর আট বছর বয়স থেকে শুরু করে পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত অর্থাৎ 42 বছরের অকৃত্রিম অভিভাবক ও স্নেহময়ী পিতৃব্য চাচার অসুস্থতা নবী (সা.)-কেও অসুস্থ করে তোলে। কারণ এ চাচা নবী (সা.)-কে শুধু লালন পালনই করেননি , ছিলেন ছাঁয়ার মতো নবী (সা.)-এর পাশে আজীবন এবং ভাতিজার জন্য নিজের প্রাণ উৎসর্গ করে দিতেও সদা প্রস্তুত ছিলেন।

সেই চাচা আজ অসুস্থ! মারাত্মক রোগাক্রান্ত। নবী (সা.)-এর অন্তর ব্যথায় বিদীর্ণ। ইসলাম ও নিজের ভবিষ্যৎ চিন্তা ভাবনায় নবী (সা.)-কে বিচলিত করে তুলেছে। বিগত দিনগুলোতে চাচার সাহায্য সহানুভূতির চিত্রগুলো একে একে নবী (সা.)-এর মানসপটে ভেসে উঠতে লাগল। আর তখনই চাচার প্রতি শ্রদ্ধা ভালবাসা ও হৃদয়ের উষ্ণতা বৃদ্ধিতে নবী (সা.) অশ্রু সজল কান্না কণ্ঠে বললেন , চাচাজান আমার ও ইসলামের ওপর আপনার সকল এহসান ও অবদান অনন্ত অপরিসীম। আর মুসলমানদের জন্য এই এহসান চির অম্লান হয়ে রইল। যারা আজ আপনার উপস্থিতির কারণে আমাকে কিছু বলার সাহস পায় না। না জানি আপনার অনুপস্থিতিতে কাল তারা আমার সাথে কিরুপ আচরণ দেখায় ?

নবী (সা.) তাঁর চাচার অবদানসমূহের জন্যে মহান সৃষ্টিকর্তার নিকট তাঁর পরকালীন মুক্তি ও প্রশান্তি কামনা করে প্রার্থনা করেন। আর যতদিন তিনি অসুস্থ অবস্থায় ছিলেন এক মুহূর্তের জন্যও নবী (সা.) তাঁর স্মরণমুক্ত ছিলেন না।24

আমি অবাক হয়ে যাই , আমরা মুসলমানগণ যে নবী (সা.)-এর সুপারিশ ও নেক দৃষ্টির প্রার্থনায় দিবারাত্রি ইবাদত বন্দিগী করে যাচ্ছি পরকালীন মুক্তির লক্ষ্যে। স্বংয় নবী (সা.) যখন আপন চাচার কল্যাণ কামনায় সৃষ্টিকর্তার নিকট হাত তুলেছেন তা কীরূপ হতে পারে ? তাছাড়া নবী (সা.)-এর হাত তো বিফলে যাওয়ার নয়। তাহলে এরা কারা যারা আলেম নাম ধারণ করে হযরত আবু তালিবের ঈমান না আনার নিশ্চয়তা প্রদান করেন এবং তাঁকে কাফের বানিয়ে জাহান্নামে পাঠাতেও দ্বিধা করেননি!

তাই বলছি ঐসকল আলেমগণ কোন ইসলামের অনুসরণ করছে তা শুধু তারাই ভালো জানেন। আমি আমার নবী (সা.) ও ইসলাম সম্পর্কে যে আকীদা পোষণ করছি , তা পাঠকের অবগতির নিমিত্তে পরিষ্কার বলে দিচ্ছি। আমার নবী (সা.) সর্বদিক থেকে পরিপূর্ণ আল্লাহর রাসূল। তিনি মাসুম নিষ্পাপ। তাঁর হাত সর্বাবস্থায় আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য। তিনি নির্ভুল। কোরআন ও নবী (সা.)-এর মধ্যে পার্থক্য শুধু এইটুকু , কোরআন গ্রন্থ আর নবী জীবন্ত। অর্থাৎ উভয়ই কোরআন , একে অন্যের পরিপূরক। নবী (সা.) মৃত্যুবরণ করেননি , তিনি ইন্তেকাল করেছেন। নবী আমাদের মত মানুষ ছিলেন না , তিনি ছিলেন মানবরূপী অতিমানব। তিনি সর্বাবস্থায় আল্লাহ কর্তৃক পরিচালিত। আর ইসলাম হচ্ছে সত্য , ন্যায় ও শান্তির ধর্ম। যেহেতু নবী (সা.) কারো অবদানকে অস্বীকার করেন না এবং তিনি তাঁর চাচার জন্য আল্লাহর দরবারে হাত তুলেছেন। সুতরাং আমার দৃঢ় বিশ্বাস হযরত আবু তালিব ইন্তেকালের পর হতে আজও জান্নাতের সম্মানিত স্থানে প্রশান্তিতে অবস্থান করছেন ইনশাআল্লাহ ।

রাসূল (সা.) এর ভালবাসা , আবু তালেবের ঈমানেরই স্বাক্ষ্য স্বরূপ

আল্লাহর রাসূল (সা.) বিভিন্ন সময়ে নিজ চাচার প্রশংসা করে তাঁর প্রতি যে সম্মান দেখাতেন এবং ভালবাসা প্রকাশ করেছিলেন , সেই দৃষ্টান্তগুলোর মধ্য থেকে শুধুমাত্র দু টির প্রতি ইশারা করছি:

কোনো কোনো ঐতিহাসিক নিম্নোক্ত রেওয়ায়েতটি বর্ণনা করেছেন যে , মহানবী (সা.) তাঁর চাচাতো ভাই আক্বীল ইবনে আবি তালিবকে বলেন: আমি তোমাকে দু টি কারণে ভালোবাসি ; (প্রথমত) আমার সঙ্গে তোমার আত্মীয়তার সম্পর্কের কারণে এবং (দ্বিতীয়ত) আমি জানি যে আমার চাচাজান তোমাকে খুব ভালোবাসতেন। 25

হালাবী তার নিজ গ্রন্থ সীরাতে রাসূল (সা.)-এ বর্ণনা করেন যে , তিনি রাসূল (সা.) তাঁর প্রিয় চাচাকে সম্মান প্রদর্শন পূর্বক বলেন- যতদিন আমার চাচা আবু তালিব জীবিত ছিলেন কুরাইশ কাফেররা ততদিন আমার কোন ক্ষতি সাধন করতে পারেনি। 26

এটা স্পষ্ট যে , হযরত আবু তালিবের প্রতি মহানবী (সা.)-এর ভালোবাসা এবং তাঁর সুউচ্চ ব্যক্তিত্বের প্রতি মহানবী (সা.)-এর গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন হযরত আবু তালিবের ঈমানেরই প্রমাণ স্বরূপ। কেননা আল্লাহর রাসূল (সা.) কোরআন ও হাদীসের স্বাক্ষ্য অনুযায়ী কেবল মু মিনদেরকেই ভালোবাসেন এবং কাফের ও মুশরিকদের ব্যাপারে কঠোর হবেন। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হচ্ছে:

) مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ(

মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল এবং তাঁর সহচররা কাফেরদের প্রতি কঠোর , নিজেদের মধ্যে পরস্পর সহানুভূতিশীল...। 27

অন্য এক স্থানে বলা হচ্ছে:

) لَا تَجِدُ قَوْمًا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ يُوَادُّونَ مَنْ حَادَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلَوْ كَانُوا آبَاءَهُمْ أَوْ أَبْنَاءَهُمْ أَوْ إِخْوَانَهُمْ أَوْ عَشِيرَتَهُمْ أُولَئِكَ كَتَبَ فِي قُلُوبِهِمُ الْإِيمَانَ وَأَيَّدَهُمْ بِرُوحٍ مِنْهُ(

যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী , তাদেরকে আপনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধবাদীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে দেখবেন না , যদিও তারা তাদের পিতা , পুত্র , ভ্রাতা অথবা জাতি-গোষ্ঠী হয়। তাদের অন্তরে আল্লাহ ঈমান লিখে দিয়েছেন এবং তাদেরকে শক্তিশালী করেছেন তাঁর অদৃশ্য শক্তি দ্বারা। 28

উক্ত আয়াতগুলোর আলোকে এবং হযরত আবু তালিবের প্রতি রাসূল (সা.)-এর গভীর ভালবাসাসহ বিভিন্ন সময়ে চাচার প্রতি তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী প্রশংসা ও সম্মান প্রদর্শনের আলোকে বলা যায় , মহান আল্লাহর রাসূলের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাই প্রমান করে যে , হযরত আবু তালিব সন্দেহাতীত ভাবে খাটি ঈমানদার ছিলেন।

হযরত আবু তালিবের ম্যাইয়াতের গোসল ও জানাজার নামাজ পড়ান মোহাম্মদ (সা.)

ইসলামের ইতিহাসে পরিলক্ষিত হয় নবী (সা.)-এর হিজরতের 3 বছর পূর্বে 80 বছর বয়সে হযরত আবু তালিব ইন্তেকাল করেন। এই মহান চাচার মৃত্যুতে নবী (সা.) অত্যন্ত মর্মাহত ও দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়েন। নবী (সা.) নিজে এবং হযরত আলী হযরত আবু তালিবের গোসল সম্পন্ন করেন ও কাফন পরানোসহ ম্যাইয়াতের সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষে নবী (সা.) হযরত আবু তালিবের নামাজে জানাজা পড়ান । অতঃপর দাফন সম্পন্ন করে অশ্রুসজল চোখে লোকজনের সম্মুখে দু হাত তুলে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করে বলেন , হে খোদা আমার প্রাণ প্রিয় চাচা আবু তালিবের প্রতি তোমার দয়া ও করুণা বর্ষণ করো। তিনি আমাকে যেভাবে লালন-পালন ও শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করেছেন এবং ছায়া দান করেছেন , সেরূপ তুমিও তাঁর প্রতি তোমার করুণা বর্ষণ ও ছায়া দান করো। কবরের সকল অনিষ্ট থেকে তাঁকে রক্ষা করে। তাঁর প্রতি জান্নাতের শীতল ছায়া নসিব করো। তিনি যেমন আমার সাহায্যকারী ও অভিভাবক ছিলেন , হে খোদা তুমিও তাঁর সাহায্যকারী ও অভিভাবক হয়ে যাও।

অবশেষে উপস্থিত জনতার উদ্দেশে বললেন , যতদিন আমার চাচাজান জীবিত ছিলেন , ততদিন কেউ আমাকে উত্যক্ত করতে পারেনি। এখন তারা আমার সাথে যে যার মতো আচরণ করবে। চাচাজানের মৃত্যু আমার জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হে খোদা তোমার পক্ষ হতে আমার প্রতি ধৈর্য সাহস ও শক্তি প্রদান করো। 29

এখানে যে বিষয়টি উল্লেখ্য , হযরত আবু তালিব যে পরিপূর্ণ ঈমানদার ও মুমিন ছিলেন তার কিছু নিদর্শন উল্লিখিত ঘটনায় বিদ্যমান। যেমন কোনো নবী-রাসূল কাফের মুশরিকদের মাগফেরাত কামনায় আল্লাহর দরবারে হাত তুলেননি। সাইয়্যেদুল মুরসালিন তাঁর জন্য হাত তুলেছেন। কোনো নবী-রাসূল কাফের মুশরিকদের জানাজা পড়াননি। নবী (সা.) তাঁর জানাজা পড়েছেন। কোনো নবী-রাসূল কাফেরদের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেননি। সমগ্র দুনিয়ায় স্বীকৃত যে , হযরত আবু তালিব ছিলেন নবী (সা.)-এর একান্ত অভিভাবক। সুতরাং আকল বুদ্ধি বিবেচনা ও কোরান , হাদীসের পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় যে , হযরত আবু তালিব ছিলেন নবী (সা.)-এর প্রিয়ভাজন ঈমানদার ও মুমিন ব্যক্তিত্ব।

তাহলে যারা এই মহান ব্যক্তির ঈমান না আনার প্রচারণা চালাচ্ছেন। তারা হযরত আবু তালিবের ঈমানী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেদের ঈমানী কর্মের কিছু অংশ পরখ করে দেখুন না , তাতে নবী (সা.) কিংবা ইসলাম কতটুকু উপকৃত হয়েছে। নিশ্চই আপনারা তা বুঝতে পারবেন । নবী (সা.) ও ইসলামের জন্য হযরত আবু তালিবের কর্মকাণ্ডের সামান্য কিছু অংশ উপস্থাপন করছি :

হযরত আবু তালেব ইসলামের নবী মোহাম্মদের সকল দায়-দায়িত্ব মৃত্যুর পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত পালন করেছিলেন। তিনি নবী ও ইসলামের জন্য খাদ্য , বস্ত্র , বাসস্থান , অর্থ , অস্ত্র ও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার মতো সুসজ্জিত বাহিনী , নবী (সা.)-এর সেবায় দান করেছেন। আবার মহানবী (সা.)-এর ওপর কাফের বাহিনীর রণমহড়ার জবাবে আবু তালিব হাশেমি বংশের বীর জোয়ান ও নিজ পরিবারের সদস্য সমেত বিশাল বাহিনী নিয়ে কাফেরদের সমুচিত জবাব প্রদানে দেরি করেননি। এভাবে হযরত আবু তালিব নবী (সা.) ও ইসলামের সেবায় সদা প্রস্তুত ছিলেন।30

তাই ঐসকল আলেমদের বলছি , আপনাদের পক্ষে আবু তালিবের অনুরূপ কিছু করা সম্ভব কি ? অথচ সত্য চিরভাস্বর আর মিথ্যা চির ম্লান।