হযরত ফাতিমা (আ.)

হযরত ফাতিমা (আ.)0%

হযরত ফাতিমা (আ.) লেখক:
: মোহাম্মদ নূরে আলম
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ: হযরত ফাতেমা (সা.আ.)

হযরত ফাতিমা (আ.)

লেখক: দার রাহে হাক প্রকাশনীর লেখকবৃন্দ
: মোহাম্মদ নূরে আলম
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ:

ভিজিট: 11861
ডাউনলোড: 3652

পাঠকের মতামত:

হযরত ফাতিমা (আ.)
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 38 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 11861 / ডাউনলোড: 3652
সাইজ সাইজ সাইজ
হযরত ফাতিমা (আ.)

হযরত ফাতিমা (আ.)

লেখক:
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বাংলা

হযরত ফাতিমা (আ.)

মূল:

দার রাহে হাক প্রকাশনীর লেখকবৃন্দ

অনুবাদ:

মোহাম্মদ নূরে আলম

আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,ইরান এবং একরা সাংস্কৃতিক সংস্থা,সাতক্ষীরা,বাংলাদেশ

হযরত ফাতিমা (আ.)

মূল: দার রাহে হাক প্রকাশনীর লেখকবৃন্দ

অনুবাদ: মোহাম্মদ নূরে আলম

সম্পাদনা: আবুল কাশেম

প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,ইরান এবং একরা সাংস্কৃতিক সংস্থা,সাতক্ষীরা,বাংলাদেশ

প্রথম প্রকাশ :1430 হিজরী,2009 খৃষ্টাব্দ

ওহী ও রেসালতের নবজাতক

এক নজরে ফাতেমা

নাম: ফাতেমা,সিদ্দীকা,মুবারিকাহ্,তাহিরাহ্,যাকিয়্যাহ্,রাযিয়্যাহ্,মারযিয়্যাহ্,মুহাদ্দিসাহ্,এবং যাহরা।1

ডাক নাম : উম্মুল হাসান,উম্মুল হুসাইন,উম্মুল মুহ্সিন,উম্মুল আয়েম্মা এবং উম্মে আবিহা।2

কিছু সুপরিচিত উপাধি : যাহরা,বাতুল,সিদ্দীকা,কুবরা,মুবারিকাহ্,আযরা,তাহিরা এবং সাইয়্যেদাতুন  নিসা।3

পিতা : ইসলামের মহা সম্মানিত রাসূল (সা.) হযরত মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ্ (সা.)।

মাতা : ইসলাম গ্রহণকারী সর্বপ্রথম নারী,আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর সর্বপ্রথম স্ত্রী খাদীজাতুল কুবরা।

জন্ম : পবিত্র নগরী মক্কায়,নবুওয়াত লাভের পঞ্চম বছর।4

শাহাদাত : পবিত্র মদীনা নগরী,হিজরী একাদশ বছর,রাসূলে খোদার  ইন্তেকালের আড়াই মাস পর।5

মাজার : রাজনৈতিক এবং তাঁর অসিয়তের কারণে অন্ধকার রাত্রে গোপনে আমিরুল মু মিনীন তাঁর দাফনকার্য সম্পন্ন করেন।  আজ অবধি তাঁর পবিত্র কবরের চিহ্ন উদঘাটিত হয় নি।6

সন্তান : ইমাম হাসান মুজতাবা,ইমাম হুসাইন সাইয়্যেদুশ শুহাদা,জয়নাব আল কুবরা,উম্মে কুলসুম,মুহ্সিন (তাঁর গর্ভেই মারা যায়)।7

আরবি জমাদিউসসানী মাসের বিশ তারিখে রোজ শুক্রবার,মহানবী (সা.)-এর নবুওয়াত লাভের পঞ্চম বৎসরে,মক্কার প্রস্তরময় পর্বতের পাদদেশে,কা বার সন্নিকটে,ওহী নাযিলের গৃহে,যে গৃহের অঙ্গন মহানবী (সা.)-এর খোদাপ্রেমিক মুখের পবিত্র ছটায় আলোকিত হতো,যে গৃহকে ফেরেশতারা ভাল করে চিনতো এবং সেখানে প্রতিনিয়ত আসা যাওয়া করতো,যেখানে সকাল সন্ধ্যায় রাসূলে খোদার নামাজের গুঞ্জরন প্রতিধ্বনিত হতো এবং গভীর রাত্রিতে তাঁর তিলাওয়াতের আধ্যাত্মিক ধ্বনিতে জমিনের সাথে আসমানের সংযোগ স্থাপিত হতো,ইয়াতিমদের আশার কেন্দ্র,নিঃস্ব মানুষের সাহায্যকারী,বন্দী ও নিপীড়িতদের আশ্রয়স্থল,সেই গৃহে পয়গম্বর (সা.) ও হযরত খাদিজার গৃহে একটি কন্যা জন্মগ্রহণ করে।

আল্লাহর রাসূলের দুহিতা,রিসালতের প্রথম ফল,নিষ্পাপত্বের প্রতিমূর্তি,সমগ্র মানবতা যে নারীর মধ্যে সমবেত হয়েছে,যিনি ভূপৃষ্ঠে আল্লাহর মনোনীত খলীফার স্ত্রী এবং তাঁর সমকক্ষ বলে গণ্য,পৃথিবীর বুকে নারীকুলের শ্রেষ্ঠ সেই ফাতেমা (তাঁর উপর শান্তি বর্ষিত হোক) ভূপৃষ্ঠে আগমন করেছেন।

হযরত ফাতেমার জন্মের ফলে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর গৃহ পূর্বের চেয়ে আরো অধিক দয়া ও স্নেহ-মমতার আধারে পরিণত হয়। যখন মহানবী (সা.) মক্কায় সীমাহীন কষ্টের মধ্যে জর্জরিত ছিলেন তখন হযরত ফাতেমার অবস্থান সকাল ও সন্ধ্যায় ক্লান্ত-শ্রান্ত পিতা-মাতার উপর শান্তির সুবাতাস বয়ে দিত আর রিসালতের কষ্টপূর্ণ দিনগুলোর ক্লেশকে আরামদায়ক করে তুলতো। এটা কতই না উদ্দীপনাময় বিষয় যে,একটি মেয়ে পিতার নিকট এতটা মর্যাদা লাভে সক্ষম হয় যে,তাঁর নিকট সৃষ্টি জগতের শ্রেষ্ঠ মানুষ মহানবী (সা.)-এর প্রশান্তি মেলে। আর তাঁর সম্পর্কে নবী (সা.) বলেন :

ফাতেমা আমার প্রাণের সমতুল্য,তাঁর কাছ থেকে বেহেশতের সুঘ্রান পাই। 8

এ উক্তিটি হযরত ফাতেমার জন্য আশ্চর্যজনক নয়। কেননা তিনি ঐ সমস্ত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে গণ্য যাদের ব্যাপারে বিশ্বপ্রতিপালক তাঁর আসমানী গ্রন্থ আল কোরআনে বলেন :

) إِنَّمَا يُرِيْدُ اللهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ اْلْرِّجْسَ أَهْلَ اْلْبَيْتِ وَ يُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيْرًا(

অর্থাৎ নিশ্চয়ই আল্লাহ্ চান হে আহলে বাইত, তোমাদের থেকে সকল ধরনের অপবিত্রতা দূর করতে  এবং তোমাদেরকে পুত- পবিত্র করতে 9

হযরত ফাতেমা (আ.) ইসলামের মহান নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.)-এর সার-সত্তা। হযরত ফাতেমা (আ.)-এর আলোকজ্জল জীবন সকল প্রকার ঐশী প্রশংসার যোগ্য। তিনি বিশ্ব নারীকুলের মধ্যে আল্লাহর নিকট মনোনীত হয়েছেন যিনি আপন পবিত্রতার মাধ্যমে নারী জাতিকে সম্মানের আসনে সমাসীন করেছেন। হযরত ফাতিমা (আ.)-এর অতি মর্যাদাকর অবস্থান এ সাক্ষ্য প্রদান করে যে একজন নারীও আধ্যাত্মিকতার চরম শীর্ষে আরোহন করতে পারেন যেখানে ঐশী মহাপুরুষেরা পৌঁছেছেন।

পিতার সাথে

হযরত ফাতিমা (আ.)-এর পিতার ব্যাপারে কোন কিছু বর্ণনা করার প্রয়োজন নেই। তিনি এমন পিতা ছিলেন যাকে বিশ্বস্রষ্টা সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী বলে আখ্যায়িত করেছেন। আর পবিত্র কোরআনে তাঁর ব্যাপারে বলা হয়েছে :

) وَ مَا يَنْطِقُ  عَنِ اْلْهَوَى ! إِنْ هُوَ إِلاَّ وَحْىٌ يُوْحَى(

অর্থাৎ তিনি প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে কোন কথা বলেন না। বরং ( তার কথা) ওহী বৈ কিছু নয় যা তার উপর অবতীর্ণ হয় 10

ফাতেমা তাঁর জ্যোতির্ময় জীবনের সবটুকুই ওহীর সংস্পর্শে এবং মানবতার মূর্ত প্রতীক এমনই একজন পিতার ছায়াতলে অতিবাহিত করেন। প্রায় দুই বৎসর বয়সেই তিনি পিতার সাথে কাফেরদের বয়কট ও অবরোধের শিকার হন এবং তিন বৎসর শে বে আবি তালিব 11 -এ ভীষণ ক্ষুধা যন্ত্রণা ও কষ্টের মধ্যে কাটান এবং পিতা-মাতা ও অন্যান্য মুসলমানদের সাথে ধৈর্যের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন। নবুওয়াতের  দশম বৎসরে শে বে আবি তালিব থেকে মুক্তির কিছুদিন পরেই তিনি তাঁর সম্মানিত মাতাকে হারান,যিনি দশ বৎসর দুঃখ বেদনা বিশেষভাবে অর্থনৈতিক অবরোধের কষ্টের ভীষণ চাপের মুখে ধৈর্যধারন করে পীড়িত হয়ে পড়েছিলেন।12

হযরত ফাতেমা মাতৃ হারা হয়ে গেলেন। যদিও এ ব্যাপারটা তাঁর জন্যে সাংঘাতিক বেদনাদায়ক ও অত্যন্ত দুঃখজনক ছিল তবে এ কারণে তিনি আরো বেশী করে পিতার পাশে থাকার এবং তাঁর প্রশিক্ষণের অধীনে থাকার সুযোগ পেলেন। আট বৎসর বয়সে রাসূল (সা.)-এর হিজরতের কিছু পরে তিনি নবী বংশের অন্যান্য নারীদের সাথে হযরত আলীর সঙ্গে মক্কা থেকে মদীনায় পৌঁছান।13 আর এভাবে আবারো তিনি পিতার পাশে অবস্থান গ্রহণ করেন। মদীনায় রাসূল (সা.)-এর জীবনের বিভিন্ন সম্যসার মুহূর্তে হযরত ফাতেমা পিতার সাথে ছিলেন। ওহুদ যুদ্ধে মুসলমানরা যখন পশ্চাদপসরণ করে পাহাড়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় তখন হযরত ফাতেমা বিচলতার সাথে মদীনা থেকে রাসূল (সা.)-এর যুদ্ধ  শিবিরে  দৌড়ে  আসেন এবং আমিরুল মু মিনীন হযরত আলীর সাথে তাঁর পিতার ক্ষতস্থান চিকিৎসায় আত্মনিয়োগ করেন।14

হযরত ফাতেমা (আ.) ইসলামের কোলে বড় হন। তিনি ছিলেন ইসলাম ও কোরআনের সাথী। তিনি ওহী ও নবুওয়াতের পবিত্র বাতাসে নিঃশ্বাস গ্রহণ করেছেন এবং এজন্য গর্ববোধ করতেন। তাঁর জীবন রাসূল (সা.)-এর জীবন থেকে পৃথক ছিল না। এমনকি বিবাহ পরবর্তী সাংসারিক জীবনেও তাঁর গৃহ রাসূল (সা.)-এর গৃহের সাথে সংযুক্ত ছিল। আল্লাহর নবী অন্যান্য সব গৃহ থেকে ফাতিমার গৃহে বেশী যাতায়াত করতেন। প্রতিদিন প্রভাতে মসজিদে গমনের পূর্বে তিনি হযরত ফাতেমার সাথে সাক্ষাৎ করতেন।15   হযরত রাসূল (সা.)-এর গৃহভৃত্য বলেন :

হযরত যখন কোন সফরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতেন তখন সর্বশেষ যার কাছ থেকে বিদায় নিতেন তিনি হলেন হযরত ফাতেমা এবং যখন তিনি সফর শেষে ফিরে আসতেন সর্বাগ্রে তাঁর সাথে দেখা করতেন। 16

অবশেষে রাসূল (সা.)-এর জীবনের শেষ মুহুর্তগুলোতেও হযরত ফাতেমা তাঁর শিয়রের পাশে ক্রন্দনরত অবস্থায় কাটিয়েছেন। আর তখন রাসূল (সা.) তাকে প্রবোধ দিয়ে বলেছিলেন যে তিনি অন্য সবার আগে তাঁর পিতার সাথে মিলিত হবেন।17

হযরত ফাতিমার মা

হযরত ফাতিমা শৈশবের পাঁচ বছর তাঁর সম্মানিতা ও আত্মোৎসর্গী মা হযরত খাদীজার কোলে লালিত পালিত হন। তিনি নারীদের মধ্যে সর্বপ্রথম মুসলমান হয়েছিলেন। তাঁর সম্বন্ধে  নবী (সা.) বলেছেন :

খাদীজা আমার উম্মতের সর্বোত্তম নারীদের অন্যতম। 18

হযরত খাদীজা রাসূল (সা.)-এর নিকট এতই সম্মানের পাত্রী ছিলেন যে তাঁর জীবদ্দশায় তিনি অন্য কোন বিয়ে করেন নি। হযরত খাদীজার ওফাতের পরও তিনি তাঁকে প্রচুর স্মরণ করতেন। এমনকি তিনি হযরত খাদীজার বন্ধু-বান্ধবদেরকেও সম্মানের চোখে দেখতেন। এ সম্মান এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে যে যখন কেউ তাকে কোন কিছু উপহার দিতেন তখন তাকে বলতেন এই উপহার অমুক মহিলার ঘরে নিয়ে যাও,কেননা সে খাদীজার বান্ধবী ছিল।19

হযরত আয়েশা বলেন : রাসূল (সা.) এত বেশী খাদীজার কথা স্মরণ করতেন যে একদিন আমি প্রতিবাদ করে বললাম,হে আল্লাহর রাসূল,খাদীজা তো একজন বৃদ্ধা ব্যতীত অন্য কিছু ছিলেন না। আল্লাহ্ তার চেয়ে উত্তম স্ত্রী আপনাকে দান করেছেন। তখন রাসূলে আকরাম (সা.) রাগান্বিত হয়ে বললেন,আল্লাহর কসম,আল্লাহ তায়ালা তাঁর চেয়ে উত্তম কোন স্ত্রী আমাকে দান করেন নি। খাদীজা এমন সময় ইসলামের প্রতি ঈমান এনেছিল যখন সবাই কুফরের মধ্যে নিমজ্জিত ছিল,সে এমন সময় আমার কথা সত্য বলে স্বীকৃতি দিয়েছিল যখন অন্যেরা আমাকে মিথ্যাবাদী বলে আখ্যায়িত করেছিল। খাদীজা এমন সময় তাঁর সর্বস্ব আমার কাছে অর্পণ করে যখন অন্য সবাই আমাকে বঞ্চিত করেছিল। আল্লাহ তায়ালা আমার বংশ তাঁর মাধ্যমেই অব্যাহত রেখেছেন। 20

এটা ইসলামের ইতিহাসের একটি মহা বাস্তব। কেননা সত্যিকার অর্থে হযরত খাদীজার ত্যাগ নবী (সা.)-এর রেসালতের অগ্রগতির পেছনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কোন কোন মনীষীর মতে :

ইসলাম এবং মহানবী (সা.)-এর মিশন হযরত আলীর জিহাদ আর হযরত খাদীজার দানের মাধ্যমে প্রসার লাভ করেছে। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা এ দুই মহান ব্যক্তিকে তাঁর রাসূলের প্রধান সহযোগী হিসেবে মনোনীত করেছেন। হযরত আলীর জিহাদ এবং হযরত খাদীজার দান ইসলামের বিজয় ও প্রসারের ক্ষেত্রে দু টি প্রধান কারণ ছিল। সর্বকালে বিশ্বের সকল মুসলমান ঈমানের ন্যায় মহানেয়ামতের জন্যে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল (সা.)-এর পরে এ দুই ব্যক্তির নিকট ঋণী।

হ্যাঁ,হযরত ফাতিমা এমনই এক মাতার স্মৃতিচিহ্ন আর এমনই এক পিতার সন্তান। নবুওয়াতের দশম বৎসরে হযরত খাদীজার ওফাতের পর চিরকালের জন্যে প্রিয় ও ত্যাগী মাতার স্নেহভরা কোল হযরত ফাতেমার হাতছাড়া হয়ে যায়। 21 আর তখন থেকেই শিশু ফাতিমা নবী পরিবারে তাঁর মায়ের শুন্য স্থান পূরণ করেছেন।

মদীনায় হিজরত

যে বৎসর হযরত খাদীজার ইন্তেকাল হয় সে বৎসরেই নবী (সা.) তাঁর নিবেদিত প্রাণ চাচা ও অন্য আরেকজন বড়পৃষ্ঠপোষক আবু তালিবকেও হারান।22 জনাব আবু তালিব রাসূল (সা.)-এর সবচেয়ে অন্তরঙ্গ সাথি ছিলেন। কোরাইশদের নেতা ও মক্কার অন্যতম প্রধান ব্যক্তি হিসেবে  মক্কাবাসী ও কোরাইশদের উপর প্রভাব থাকায় তিনি নবী (সা.) ও মুসলমানদের জন্যে এক গুরুত্বপূর্ণ পৃষ্ঠপোষক বলে গণ্য হতেন। আর সে জন্যে তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন কোরাইশ কাফেররা কখনই মহানবী (সা.)-এর দিকে হস্ত প্রসারিত করতে পারে নি।23

হযরত আবু তালিব তাঁর সমগ্র জীবনে কখনো রাসূল (সা.)-এর সেবা ও তাঁকে সমর্থন দানের ক্ষেত্রে ত্রুটি করেন নি এমনকি কোরাইশদের চক্রান্তের মোকাবেলায় এক শক্ত প্রাচীর হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করার লক্ষ্যে নিজের ঈমান ও ইসলাম গ্রহনকে গোপন করে রেখেছিলেন।24

তিনি মুশরিকদের নিকট বাহ্যিক ভাবে দেখাতেন আত্মীয়তার কারণে মুহাম্মদকে সহায়তা দান করেন। হযরত আবু তালিবের এ ধরণের কর্ম-কৌশলের কারণে কোরাইশরা তাকে নিজেদের লোক বলে মনে করতো এবং তাঁর ভয়ে ও সম্মানের কারণে তারা নবী (সা.)-কে হত্যা করার কোন পরিকল্পনা হাতে নিতে পারে নি। আর এভাবে আত্মত্যাগ ও ঈমান গোপন করার কারণে মুসলমানদের বিভিন্ন ফের্কার আনাড়ী আলেমরা আবু তালিবের ঈমানের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করে থাকেন এবং যিনি আপাদমস্তক ঈমান ও ত্যাগের মহীমায় বলীয়ান ছিলেন তাকে শিরক ও কুফরের মত জঘন্য ও ন্যাক্কারজনক অপবাদ দিতে কুন্ঠাবোধ করেন নি।25

হ্যাঁ,হযরত আবু তালিবের মৃত্যুর সাথে সাথে রাসূল (সা.)-এর জন্য দায়িত্ব পালন আরো বেশী কঠিন  হয়ে যায়  এবং কোরাইশদের অত্যাচার ও নির্যাতনের তীব্রতা আরো বৃদ্ধি পায়। আর তা এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে যে তারা রাসূলে খোদার প্রাণনাশের পরিকল্পনা করে এবং সিদ্ধান্ত নেয় যে বিভিন্ন গোত্র থেকে লোকজন নিয়ে হযরত মুহাম্মদের (সা.) গৃহ ঘেরাও করে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে হযরতকে হত্যা করা হবে। আর এভাবে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর হত্যার দায়ভার সকল গোত্রের উপর বর্তাবে এবং নবীর আত্মীয়-স্বজন ও বনি হাশেম গোত্রের লোকেরা রক্তের বদলা নিতে সমর্থ হবে না। পরিশেষে তারা (বনি হাশেম) রক্তের মূল্য গ্রহণে বাধ্য হবে।26

এ ধরনের ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায় নবী (সা.) আল্লাহর পক্ষ থেকে  হিজরতের আদেশপ্রাপ্ত হন।27 এর আগে ইয়াসরেবের গণ্যমান্য ও সুপরিচিত ব্যক্তিবর্গ নবী (সা.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। তারা ইসলাম গ্রহণ করে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন যে যদি হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ইয়াসরেবে (মদীনা) আসেন তাহলে তারা তাদের জান-মাল ও লোকবল দিয়ে নবী (সা.) ও ইসলামের সমর্থন করবেন। আর নবী (সা.) এই চুক্তিকে সামনে রেখেই মক্কার কোরাইশ কাফেররা যে রাতে তাঁর প্রাণনাশের চক্রান্ত করে সে রাত্রেই মক্কা ত্যাগ করেন এবং হযরত আলী নবী (সা.)-এর বিছানায় শুয়ে থাকেন। এভাবে কোরাইশ কাফেররা নবীর গৃহে আক্রমন করে হযরত আলীর সম্মুখীন হয়।28 হযরত মুহাম্মদ (সা.) বারো দিন পর মদীনার নিকটবর্তী কোবা নামক স্থানে পৌঁছান। হযরত আলী যেন তাঁর সাথে যোগ দিতে পারেন সে জন্যে তিনি সেখানে যাত্রাবিরতি করেন।29

হযরত আলী মক্কায় কয়েকদিন অবস্থান করে নবী (সা.) কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব পালন শেষে হযরত ফাতেমা ও নবী পরিবারের কয়েকজন নারীকে সাথে নিয়ে মদীনার পথে যাত্রা শুরু করেন।30

পথিমধ্যে মুশরিকদের মাধ্যমে বাধাগ্রস্থ হলে হযরত আলী তলোয়ার হাতে তুলে নেন। তিনি আক্রমণকারীদের মধ্যে একজনকে হত্যা করেন আর অন্যরা পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করে। হযরত আলী কয়েকদিন পরে নবী করীমের সাথে যোগ দেন। তারপর তিনি রাসূল (সা.)-এর সাথে মদীনা নগরীতে প্রবেশ করেন।31

হযরত ফাতেমার স্বর্গীয় ব্যক্তিত্ব

নারীকুলের শ্রেষ্ঠ রমণী হযরত ফাতেমার স্বর্গীয় ব্যক্তিত্ব আমাদের উপলব্ধি ক্ষমতার ঊর্দ্ধে এবং আমাদের সকলের প্রশংসার চেয়ে বেশী সম্মানিত। তিনি এমনই একজন মহীয়সী রমণী যাকে বিশেষ নিষ্পাপ ব্যক্তিদের মধ্যে গণ্য করা হয়ে থাকে।32 যার ক্রোধ ও অসন্তোষকে আল্লাহর ক্রোধ ও অসন্তোষ বলে বিবেচনা করা হয়।33 তিনি এবং তাঁর পরিবার ও সন্তানদের প্রতি ভালবাসা দ্বীনি ফরয বলে পরিগণিত।34 তাঁর আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বের বিস্ময়কর ও বিভিন্নমুখী পরিচয় আমাদের ন্যায় সীমিত জ্ঞানের মানুষের পক্ষে তুলে ধরা কিভাবে সম্ভব?

সুতরাং হযরত ফাতেমা (আ.) সম্পর্কে স্বয়ং মা সুম ইমামদের থেকে শোনা দরকার। এখানে ইসলামের সম্মানিত নারীর মহিমার কিছু কথা মা সুম ইমামদের পবিত্র মুখ থেকে শ্রবণ করবো :

   হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) বলেছেন যে,আল্লাহর নির্দেশে  একজন ফেরেশতা অবতীর্ণ হয়ে আমাকে বললেন, হাসান ও হুসাইন বেহেশতের যুবকদের সর্দার আর ফাতিমা সকল নারীদের নেত্রী। 35

   রাসূল (সা.) বলেছেন : চারজন রমণী পৃথিবীর বুকে সর্বোত্তম। ইমরানের কন্যা মারিয়াম,খুওয়াইলিদের কন্যা খাদীজা,মুহাম্মাদের কন্যা ফাতেমা এবং মুযাহিমের কন্যা আছিয়া (ফেরাউনের স্ত্রী)। 36

   নবী করীম (সা.) বলেছেন : জান্নাত চারজন নারীর জন্যে প্রতীক্ষমাণ। ইমরানের কন্যা মারিয়াম,ফেরাউনের স্ত্রী আছিয়া,খুওয়াইলিদের কন্যা খাদীজা এবং মুহাম্মদের কন্যা ফাতেমা। 37

   তিনি আরো বলেছেন : ফাতেমা কোন ব্যাপারে রাগান্বিত হলে আল্লাহ্ও তাতে রাগান্বিত হন এবং ফাতেমার আনন্দে আল্লাহ্ও আনন্দিত হন। 38

   ইমাম মুসা ইবনে জা ফর (আ.) বলেন : রাসুল (সা.) বলেছেন, আল্লাহ্ পৃথিবীর বুকে চারজন নারীকে মনোনীত করেছেন। তারা হলেন মারিয়াম,আছিয়া,খাদীজা ও ফাতেমা (তাদের সকলের উপর সালাম)। 39

   ইমাম আলী ইবনে মুসা আর রিযা (আ.) রাসূলে খোদার নিকট থেকে বর্ণনা করেছেন যে তিনি বলেছেন : হাসান ও হুসাইন,আমি এবং তাদের পিতার পরবর্তীতে জমিনের বুকে সর্বোত্তম ব্যক্তিদ্বয় আর তাদের মা ফাতেমা নারীদের মধ্যে পৃথিবীর বুকে সর্বোত্তম রমণী। 40

   সহীহ আল বুখারী সহীহ মুসলিম গ্রন্থদ্বয় যা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের নির্ভরযোগ্য পুস্তক সমূহের অন্যতম এবং উক্ত গ্রন্থদ্বয়ের লেখকদ্বয়ও আহলে সুন্নাতের সুবিখ্যাত ও মহান আলেমদের মধ্যে গণ্য। উক্ত গ্রন্থদ্বয়ে বর্ণিত আছে যে নবী করীম (সা.) বলেছেন : ফাতিমা  বেহেশতবাসী নারীদের নেত্রী। 41

   ইমাম জা ফর আস সাদেকের নিকট জনৈক ব্যক্তি আরজ করলো : রাসুল (সা.) যে বলেছেন,ফাতেমা বেহেশতবাসী নারীদের নেত্রী। এর অর্থ কি এটা যে তিনি তাঁর সমসাময়িক নারীদের নেত্রী? ইমাম প্রত্যুত্তরে বলেন : উপরোক্ত কথাটি হযরত মারিয়ামের ব্যাপারে বলা হয়েছে আর ফাতিমা পৃথিবীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকল নারীদের নেত্রী। 42

   হযরত রাসূলে আকরামকে (সা.) জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলো, ইয়া রাসূলুল্লাহ্,ফাতেমা কি শুধুমাত্র তাঁর যুগের নারীদের নেত্রী? রাসূল (সা.) প্রতি উত্তরে বলেন : এ কথাটি ইমরানের কন্যা মারিয়ামের ব্যাপারে বলা হয়েছে আর মুহাম্মদের কন্যা ফাতেমা পৃথিবীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকল নারীদের নেত্রী। 43

   হযরত মুফাজ্জাল (রহ.) বলেন,আমি ইমাম জা ফর আস সাদেক (আ.)-কে জিজ্ঞেস করলাম,হযরত ফাতেমার ব্যাপারে রাসূলে খোদার এই যে উক্তি ফাতেমা বেহেশতবাসী নারীদের নেত্রী -এর অর্থ কি আমাকে বলবেন? এর অর্থ কি এই যে,ফাতেমা শুধুমাত্র তাঁর যুগের নারীদের নেত্রী ছিলেন? ইমাম জবাবে বলেন : উক্ত কথাটি হযরত মারিয়ামের ব্যাপারে বলা হয়েছে যে তিনি তাঁর সমসাময়িক নারীদের নেত্রী ছিলেন। ফাতেমা পৃথিবীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকল নারীদের নেত্রী।44 ইমাম আলী ইবনে মুসা আর রিযা (আ.) তাঁর পিতামহদের কাছ থেকে,আর তাঁরা আমিরুল মু মিনীন আলী (আ.)-এর নিকট থেকে বর্ণনা করেছেন যে আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন : কিয়ামতের দিবসে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর আরশের নিচ থেকে ডাক আসবে,হে মানব সকল! তোমরা তোমাদের চক্ষুযুগল বন্ধ কর,ফাতেমা (মুহাম্মদের কন্যা) অতিক্রম করবে। 45

   হযরত আবু আইয়ূব আনসারী (রা.) হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছ থেকে বর্ণনা করছেন : কিয়ামতের দিনে আল্লাহর আরশ থেকে ধ্বনি আসবে,হে হাশরের ময়দানের লোকেরা! তোমরা তোমাদের মাথা নিচু কর। চক্ষু বন্ধ কর। ফাতেমা এখান থেকে অতিক্রম করছে। আর সত্তর হাজার বেহেশতী হুর তাঁর সঙ্গে আছে। 46

   রাসূলে আকরাম (সা.) হযরত ফাতেমাকে বলেছেন : হে ফাতেমা! আল্লাহ তায়ালা জমিনের বুকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন এবং সেখান থেকে তোমার স্বামীকে মনোনীত করেন। তিনি আমাকে ওহীর মাধ্যমে জানালেন যে আমি যেন তোমাকে আলীর সাথে বিয়ে দেই। তুমি কি জান যে আল্লাহ্ তোমার মর্যাদা ও সম্মানের দিকে তাকিয়ে তোমাকে এমন ব্যক্তির সাথে বিয়ে দিলেন যিনি সবার আগে ইসলাম ধর্মের ঘোষণা দিয়েছেন এবং যার ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা সবচেয়ে বেশী আর জ্ঞান সকলের চেয়ে অধিক। 47

   ইমাম জা ফর সাদেক (আ.) বলেন : যদি আল্লাহ্ আমিরুল মু মিনীন আলী (আ.)-কে ফাতেমার জন্যে সৃষ্টি না করতেন তাহলে তাঁর জন্যে ভূপৃষ্ঠে কোন স্বামী-ই পাওয়া যেত না। 48

   হযরত সুফিয়ান বিন উয়াইনাহ্ বলেন : ইমাম সাদেক (আ.)

) مَرَجَ اْلْبَحْرَيْنِ يَلْتَقِيَانِ(

অর্থাৎ দুই সমুদ্রকে প্রবাহিত করেন যেন তারা পরস্পর মিলিত হয়।49

আয়াতটির তাফসীরে বলেন : উক্ত আয়াতের উদ্দেশ্য হযরত  আলী এবং হযরত  ফাতিমা । আর

) يَخْرُجُ مِنْهُمَا اْلْلُؤْلُؤُ وَ اْلْمَرْجَانُ(

অর্থাৎতাদের দু ' জন থেকে মুক্তা ও প্রবাল নির্গত হবে50

আয়াতটির তাফসীরে তিনি বলেন : উক্ত আয়াতটির উদ্দেশ্য ইমাম হাসান এবং ইমাম হুসাইন। 51

   ইমাম সাদেক (আ.)-এর কাছে জনৈক ব্যক্তি প্রশ্ন করলো, কেন হযরত ফাতেমাকে যাহরা বা আলোকোজ্জ্বল বলা হয়েছে? উত্তরে তিনি বলেন : তার কারণ হচ্ছে,হযরত ফাতেমা যখন ইবাদতের উদ্দেশ্যে মেহরাবে দণ্ডায়মান হতেন তখন তাঁর নূর আসমানের অধিবাসীদের জন্যে প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠতো যেমনিভাবে জমিনের অধিবাসীদের জন্যে আকাশের তারকা আলোকোজ্জ্বল দৃষ্ট হয়। 52

   বর্ণিত আছে : যখন হযরত ফাতেমা (আ.) নামাজে বা  ইবাদত-বন্দেগিতে মগ্ন হতেন এবং তাঁর শিশু সন্তানরা ক্রন্দন করতো,তখন তিনি দেখতে পেতেন যে কোন একজন ফেরেশতা সে-ই শিশুটির দোলনা দোলাচ্ছে। 53

   ইমাম বাকের (আ.) থেকে বর্ণিত আছে যে তিনি বলেছেন : রাসূল (সা.) কোন কাজের জন্যে হযরত সালমানকে হযরত ফাতেমার গৃহে প্রেরণ করেন। হযরত সালমান বর্ণনা করছেন : হযরত ফাতেমার গৃহের দ্বারে দাঁড়িয়ে সালাম জানালাম। সেখান থেকেই গৃহাভ্যন্তরে ফাতেমার কোরআন তিলাওয়াতের ধ্বনি শোনা যাচ্ছিল আর হস্তচালিত যাঁতাকলটি যা আটা তৈরীর জন্যে ঘরে ব্যবহার করা হতো তার থেকে কিছু দূরে নিজে নিজে ঘুরছিল। 54