হযরত ফাতিমা (আ.)

হযরত ফাতিমা (আ.)0%

হযরত ফাতিমা (আ.) লেখক:
: মোহাম্মদ নূরে আলম
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ: হযরত ফাতেমা (সা.আ.)

হযরত ফাতিমা (আ.)

লেখক: দার রাহে হাক প্রকাশনীর লেখকবৃন্দ
: মোহাম্মদ নূরে আলম
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ:

ভিজিট: 11891
ডাউনলোড: 3700

পাঠকের মতামত:

হযরত ফাতিমা (আ.)
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 38 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 11891 / ডাউনলোড: 3700
সাইজ সাইজ সাইজ
হযরত ফাতিমা (আ.)

হযরত ফাতিমা (আ.)

লেখক:
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বাংলা

জ্যোতির্ময় চাদর

একবার আলী (আ.) জনৈক ইহুদীর কাছ থেকে সামান্য পরিমান যব ঋণ নিয়েছিলেন। ইহুদী লোকটি ঋণের পরিবর্তে কিছু বন্ধক চাইলো। হযরত আলী (আ.) হযরত  ফাতেমার পশমী চাদরটি বন্ধক রাখলেন।

ইহুদী লোকটি চাদরটি নিয়ে তার কোন একটি কক্ষে রেখে দিল। রাত্রিতে কোন এক কাজের জন্যে ইহুদীর স্ত্রী ঐ কক্ষে প্রবেশ করলে দেখতে পেল যে ঘরের কোন জায়গা থেকে আলোকছটা সারা ঘরকে আলোকিত করেছে। মহিলা তার স্বামীকে জানালো যে,ঐ ঘরের ভিতরটা আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছে। ইহুদী লোকটি তার স্ত্রীর কথায় বিস্ময় প্রকাশ করে। সে একেবারে ভুলেই গেছে যে সে কক্ষে হযরত ফাতেমার চাদরখানা রাখা আছে। লোকটি দ্রুত সে কক্ষে প্রবেশ করে দেখতে পেল যে,হযরত ফাতেমার চাদরটি থেকে নূর ভেসে আসছে। আর সে নূর দিয়েই সমস্ত ঘর আলোকিত হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন উজ্জ্বল চন্দ্র অত্যন্ত নিকট থেকে আলো বিতরণ করছে। ইহুদী লোকটি অবাক নয়নে তাকিয়ে রইল। লোকটি বুঝতে পারলো যে,এ আলো হযরত ফাতেমার চাদরের কাছ থেকেই আসছে। সে তার আত্মীয়-স্বজনদের খবর দিল। মহিলাটিও তার আত্মীয়দের সংবাদ পাঠালো। দেখতে দেখতে প্রায় আশিজন ইহুদী জড়ো হয়ে গেল। তারা সবাই ঘটনাটি স্বচক্ষে অবলোকন করলো। পরিশেষে তারা সবাই কলেমা পাঠ করে ইসলামে দীক্ষিত হলো।98

বস্ত্রহীন পবিত্র রমণীর জন্যে বেহেশতী পোশাক

একদা কয়েকজন ইহুদী একটা বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। এ কারণে তারা মহানবীর নিকট এসে বললো : প্রতিবেশী হিসেবে আমাদের উপর আপনার অধিকার আছে। আমরা আপনাকে অনুরোধ করছি দয়া করে আপনার মেয়ে ফাতেমাকে আমাদের মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে পাঠাবেন। আশা করি তার বদৌলতে এই বিয়ের অনুষ্ঠান আরো বেশী সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়ে উঠবে। এ নিমন্ত্রনে হযরত ফাতেমার অংশগ্রহণের ব্যাপারে তারা নবী (সা.)-কে বেশ পীড়াপীড়ি করছিল।

মহানবী (সা.) বললেন : সে (ফাতেমা) আলী বিন আবি তালিবের স্ত্রী। আর তার নির্দেশেই সে (ফাতেমা) পরিচালিত হয়।

তারা বিনীত কণ্ঠে এ ব্যাপারে নবী (সা.)-কে মধ্যস্থতা করার জন্যে আরজি পেশ করে।

ইহুদীরা এ বিয়ের অনুষ্ঠানে আকর্ষণীয় সব ধরনের জাকজমকপূর্ণ পোশাক,অলংকার ও সৌন্দর্যের সমাবেশ ঘটিয়েছিল। তারা মনে করেছিল যে,হযরত ফাতেমা পুরাতন ও ছেঁড়া কাপড় পরিধান করে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবে। আর তারা এভাবে তাঁকে অপমান ও খাটো করতে চেয়েছিল।

এ সময়ে হযরত জিবরাঈল (আ.) অত্যন্ত জাকজমকপূর্ণ অলংকারাদিসহ এমন জান্নাতি পোশাক নিয়ে আসলেন যার দ্বিতীয়টি মানুষ কখনো দেখেনি। হযরত ফাতেমা (আ.) সেই কাপড় পড়ে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করলে দর্শকরা তার কাপড়ের রং দেখে ও সুঘ্রান পেয়ে বিস্ময়াভিভূত হয়ে যায়। হযরত ফাতেমা (আ.) ইহুদীদের গৃহে প্রবেশ করলে ইহুদী মহিলারা তাঁর সামনে সেজদাবনত হয়ে মাটিতে চুমু খেতে শুরু করে। সেদিন উপস্থিত অনেক ইহুদী এ অলৌকিক ঘটনা দেখে ইসলাম গ্রহণ করেছিল।99

ফেরেশতারা হযরত ফাতেমাকে সাহায্য করেন

হযরত আবু যার গিফারী (রা.) বলেন : একবার রাসূল (সা.) আলীকে ডাকার জন্যে আমাকে পাঠান। আলীর গৃহে এসে তাঁকে ডাকলে কেউ আমার ডাকে সাড়া দিল না। তখন হস্তচালিত যাতাকলটি নিজে নিজেই ঘুরছিল কিন্তু এর পার্শ্বে কেউ ছিল না। আবারো আলীকে আহবান করলাম। আলী ঘরের বাইরে আসলেন। আমি তাঁকে নবী (সা.)-এর কথা বললে তিনি রাসূল (সা.)-এর সাথে দেখা করার জন্যে যাত্রা করলেন। তিনি নবী (সা.)-এর কাছে পৌঁছলে নবী (সা.) তাঁর সাথে বিস্তারিত কথোপকথন করলেন এবং এমন কিছু বললেন যা আমি বুঝতে পারলাম না। তাই মহানবী (সা.)-এর কাছে প্রশ্ন করলাম : হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আলীর গৃহের হস্তচালিত যাঁতাকলটি দেখে আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছি। যাঁতাকলটি কিভাবে নিজে নিজেই ঘুরছিল অথচ এর পার্শ্বে  কেউ ছিল না?

মহানবী (সা.) বলেন : আমার কন্যা ফাতেমা এমন একজন রমণী যার অন্তর ও সর্বাঙ্গকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহকে আল্লাহ্ ঈমান ও ইয়াকিনে পূর্ণ করেছেন। আল্লাহ্ ফাতেমার অক্ষমতা ও দৈহিক দূর্বলতার ব্যাপারে অবহিত। তাই তিনি তাঁর জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে গায়েবীভাবে সাহায্য করে থাকেন। তুমি কি জান না আল্লাহর এমন অনেক ফেরেশতা আছেন যারা মুহাম্মদ (সা.)- এর বংশকে সাহায্য করার জন্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত।100

আহলে বাইতের আত্মত্যাগ ও সূরা আল ইনসানের (দাহর) অবতীর্ণ হওয়ার ঘটনা

শিয়া ও সুন্নী উভয় মাযহাবের প্রায় সকল বর্ণনাকারী বর্ণনা করেছেন যে,আমিরুল মুমিনীন আলী (আ.),হযরত ফাতেমা (আ.) এবং ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন আর তাদের দাসী ফিদ্দা তাদের মানত মোতাবেক তিন দিন রোজা রেখেছিলেন।

প্রথম রাত্রে যখন তারা সকলে ইফতারী করতে মনস্থ করেন সে সময়ে একজন ভিক্ষুক দরজায় কড়া নাড়লো। হযরত আলী তার নিজের ইফতারীর অংশটুকু ভিক্ষুককে দিয়ে দিলেন। হযরত আলীকে অনুসরণ করে অন্যেরাও তাদের নিজ নিজ অংশ ভিক্ষুককে দান করলেন। অবশেষে তারা সকলে পানি পান করে রোজা ভঙ্গ করলেন। আবার দ্বিতীয় রাত্রে একজন ইয়াতিম এসে দরজায় হাঁক দিল। আবারো তারা সকলে তাদের ইফতারী সেই ইয়াতিমকে দান করে দিলেন। এরকম তৃতীয় রজনীতে একজন কয়েদী কিছু সাহায্য প্রার্থনা করলে এবারেও তারা তাদের ইফতারীর সবটুকুই তাকে দিয়ে দিলেন।

এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সূরা আল ইনসান অবতীর্ণ হয়।101

নিম্নের এ আয়াতটিতে ঐ সকল মহান ব্যক্তিদের আত্মত্যাগ ও দানের প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে।

) وَ يُطْعِمُوْنَ اْلْطَّعَامَ عَلَى حُبِّهِ مِسْكِيْنًا وَ يَتِيْمًا وَ أَسِيْرًا(

অর্থাৎ তারা আল্লাহর ভালবাসায় মিসকিন,ইয়াতিম ও কয়েদীকে খাদ্য দান করেন। 102

অনেক বিজ্ঞ ধর্মীয় আলেমরা বলেছেন যে,এই পবিত্র সূরাতে সকল ধরনের জান্নাতী নেয়ামতের বর্ণনা ও প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়েছে তবে জান্নাতি হুরের কোন বর্ণনা আসেনি। এর কারণ হচ্ছে হযরত ফাতেমা যখন এ আয়াতে উল্লিখিত হয়েছেন তখন জান্নাতী হুরের কোন বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না। শুধুমাত্র হযরত ফাতেমার সম্মানের দিকে দৃষ্টি রেখেই এমনটি করা হয়েছে।103

উপরোক্ত ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ শিয়া ও সুন্নী বিভিন্ন তাফসীরের গ্রন্থাবলীতে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে তাফসীরে কাশশাফ গ্রন্থের লেখক আল্লামা জারুল্লাহ্ যামাখশারী একজন উচ্চ পর্যায়ের সুন্নী আলেম ও মুফাসসির । তিনি তার স্বীয় তাফসীরে  উক্ত ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন।

হযরত ফাতেমা ও তাতহীরের আয়াত

বহু সংখ্যক সুন্নী আলেম ও মুফাসসির এবং প্রায় সকল শিয়া মুফাসসির ও হাদীস বর্ণনাকারী নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন যে তাতহীরের আয়াত তথাঃ

) إِنَّمَا يُرِيْدُ اللهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ اْلْرِّجْسَ أَهْلَ اْلْبِيْتِ وَ يُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيْرًا(

হযরত মুহাম্মদ (সা.) সহ হযরত আলী,ফাতেমা,হাসান ও হুসাইনকে উদ্দেশ্য করে অবতীর্ণ হয়েছে।104 এই আয়াতে  আহলে বাইতের  উদ্দেশ্য হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বংশধর এই নিষ্পাপ ব্যক্তিবর্গ। আর বিশিষ্ট মুফাসসিরদের মতে তাদের নিষ্পাপত্বের বিষয়টিও প্রমাণ করে। তা ছাড়া আরো প্রচুর হাদীস ও দলিল প্রমাণাদি এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান।

আগ্রহী ব্যক্তিরা এ ব্যাপারে আরো অধিক জানার জন্যে বিস্তারিত বিবরণ সমৃদ্ধ গ্রন্থসমূহ খুলে দেখতে পারেন।  আমরা এখানে একটিমাত্র  হাদীস বর্ণনা করাই যথেষ্ট মনে করছি।

নাফে বিন আল হিমরী বলেন : আমি আট মাস মদীনাতে বসবাস করেছিলাম। তখন প্রতিদিন রাসূল (সা.)-কে দেখতাম যখন তিনি ফজর নামাজ আদায়ের জন্যে ঘরের বাইরে আসতেন তখন সর্বপ্রথম ফাতেমার ঘরের দরজার সন্নিকটে গিয়ে বলতেন :

) أَلْسَّلاَمُ عَلَيْكُمْ يَا أَهْلَ اْلْبَيْتِ وَ رَحْمَةُ اللهِ وَ بَرَكَاتُهُ ,أَلْصَّلاَةُ ,إِنَّمَا يُرِيْدُ اللهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ اْلْرِّجْسَ أَهْلَ اْلْبَيْتِ وَ يُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيْرًا(

অর্থাৎ আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহ্মাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ্ , হে আহলে বাইত। নামাজের সময় হয়েছে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ ইচ্ছা করেছেন তোমাদের থেকে সকল ধরনের পাপ - পঙ্কিলতা দূরীভূত করতে হে আহলে বাইত এবং তোমাদেরকে পুত - পবিত্র করতে। 105

মুবাহিলাতে রাসূল আকরাম (সা.)-এর সঙ্গী

প্রচুর সংখ্যক হাদীস বর্ণনাকারী তাদের হাদীস গ্রন্থে এবং ঐতিহাসিক ও মুফাসসিরগন তাদের ইতিহাস ও তাফসীরের কিতাবসমূহে সুস্পষ্ট ভাবে বর্ণনা করেছেন যে,হযরত ফাতেমা আয যাহরা (আ.),নাজরানের খৃষ্টান পাদ্রীদের সাথে নবী (সা.)-এর চ্যালেঞ্জের আহবানে অংশগ্রহণকারী আহলে বাইতের পাঁচ সদস্যের মধ্যে অন্যতম। এ বিষয়টি তাদের উচ্চ মর্যাদা ছাড়াও এমন একটি শক্তিশালী প্রমাণ যার মাধ্যমে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, নবী (সা.)-এর নিষ্পাপ আহলে বাইত হযরত আলী,হযরত ফাতেমা,ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন বৈ কেউ নন। তাঁর অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন ও স্ত্রীবর্গ এ বিশেষ মর্যাদার মধ্যে গণ্য নন। নিম্নে সংক্ষিপ্তাকারে মুবাহিলার ঘটনা বর্ণনা করা হলো :

একদা নাজরানের কতিপয় খৃষ্টান পাদ্রী হযরত মুহাম্মদ (সা.) খেদমতে এসে হযরত ঈসা (আ.)-এর সম্পর্কে আলাপ আলোচনা করলেন। হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাদের উদ্দেশ্যে নিম্নের এ আয়াতটি পাঠ করেন :

) إِنَّ مَثَلَ عِيْسَى عِنْدَ اللهِ كَمَثَلِ آدَمَ خَلَقَهُ مِنْ تُرَابٍ(

অর্থাৎ নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট ঈসার উদাহরণ আদমের ন্যায় যেমনি করে তিনি তাকে ( আদমকে) মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। 106

তারপরও উপস্থিত খৃষ্টান পাদ্রীরা সন্তুষ্ট হলো না। বরং তারা উক্ত আয়াতের প্রতিবাদ করে বসে। তখন মুবাহিলার আয়াত অবতীর্ণ হয়। সে আয়াতে আল্লাহ্ বলেন :

) فَمَنْ حَآجَّكَ فِيْهِ مِنْ بَعْدِ مَا جَآءَكَ مِنَ اْلْعِلْمِ فَقُلْ تَعَالَوْا نَدْعُ أَبْنَآءَنَا وَ أَبْنَآءَكُمْ وَ نِسَآءَنَا وَ نِسَآءَكُمْ وَ أَنْفُسَنَا وَ أَنْفُسَكُمْ ثُمَّ  نَبْتَهِلْ فَنَجْعَلْ لَّعْنَتَ اللهِ عَلَى اْلْكَاذِبِيْنَ(

অর্থাৎ যারা তোমার কাছে (মাসিহ্ সম্পর্কে) অকাট্য জ্ঞান ও দলীল আসার পরও তোমার সাথে তর্কে লিপ্ত হয় তুমি তাদেরকে বলে দাও,আস! আমরা আমাদের সন্তানদের আহবান করি আর তোমরাও তোমাদের সন্তানদের আহবান জানাও,আমরা আমাদের নারীদের ডেকে আনি আর তোমরাও তাই কর এবং আমরা আমাদেরকে ডেকে আনি আর তোমরাও তোমাদেরকে ডেকে আন। অতঃপর এসো  আমরা মুবাহিলা (চ্যালেঞ্জ) করি এবং মিথ্যাবাদীদের উপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষণ করি।”107

মুবাহিলার অর্থ হচ্ছে : কোন বিষয়ে বিবাদমান ও শত্রুভাবাপন্ন  দু পক্ষ পরস্পরের উপর অভিশাপ বর্ষন করবে আর তারা আল্লাহর কাছে বাতিল পক্ষের উপর আযাব ও অভিশাপ কামনা করবে। এ কাজ শুধুমাত্র আল্লাহর মনোনীত পয়গম্বরদের দ্বারাই সম্ভব। কেননা তারাই আল্লাহর সাথে সত্যিকার সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন।

নাজরানের খৃষ্টানরা প্রথমে সম্মত হয়েছিল যে তারা পরের দিন মুবাহিলাতে অংশগ্রহণ করবে কিন্তু রাসূল (সা.)-এর কাছ থেকে ফিরে গিয়ে তারা নিজেদের মধ্যে এ নিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হয়। ইতোমধ্যে খৃষ্টান পাদ্রী তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন : যদি মুহাম্মদ আগামীকাল তাঁর সন্তান ও আহলে বাইতের সদস্যদের নিয়ে আসে তাহলে তাঁর সঙ্গে মুবাহিলা হতে বিরত থাকবে আর যদি তার সঙ্গী-সাথি ও সাহাবীদের নিয়ে আসেন তাহলে তাঁর সাথে মুবাহিলায় কোন আপত্তি নেই।

তার পরের দিন যথারীতি হযরত মুহাম্মদ (সা.),আমিরুল মুমিনীন আলী (আ.),হযরত ফাতেমা আয যাহরা,ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনকে সাথে নিয়ে মুবাহিলার উদ্দেশ্যে যথাস্থানে উপস্থিত হলেন। তিনি খৃষ্টানদের মুখোমুখি মাটির উপর বসে পড়েন। অতঃপর তিনি তাঁর আহলে বাইতকে বলেন : আমি যখন দোয়া করবো তখন তোমরা তার শেষে আমিন বলবে। খৃষ্টানরা তাঁর প্রতিনিধি দলকে দেখেই ভীতসন্ত্রস্থ হয়ে গেল। খৃষ্টানরা তাঁর পদ্ধতি অপরাপর সত্যপন্থী নবী ও রাসূলদের পদ্ধতির অনুরূপ বলে স্বীকারোক্তি পেশ করলো। তারা নবী (সা.)-এর অনুরোধ জানালো যে,তিনি যেন মুবাহিলা পরিত্যাগ করে তাদের সাথে শান্তি চুক্তিতে সম্মতি হন। তারা শান্তি ও সন্ধির পক্ষে সম্মতি স্বরূপ কিছু অর্থ পরিশোধ করে ফিরে গেল।108

ক্ষুধার্ত পিতার জন্যে কান্না

আবদুল্লাহ্ বিন আল হাসান বলেন : একদা রাসূল (সা.) হযরত ফাতেমার গৃহে আগমন করেন। তখন হযরত ফাতেমা এক টুকরো যবের শুকনো রুটি নবী (সা.)-এর সামনে হাজির করলেন। হযরত মুহাম্মদ (সা.) তা দিয়ে ইফতার করলেন। অতঃপর বলেন :

কন্যা আমার! তোমার প্রিয় পিতা তিন দিন পূর্ব থেকে এ পর্যন্ত এই প্রথম এক টুকরো রুটি খেল। একথা শুনে হযরত ফাতেমা ক্রন্দন শুরু করে দিলেন। আর আল্লাহর রাসূল (সা.) তাঁর হস্ত মোবারকের দ্বারা হযরত ফাতেমার চেহারা থেকে অশ্রু মুছে দিলেন। 109

মহানবী (সা.)-এর কাছে হযরত ফাতেমার সম্মান

নবী পত্নী হযরত আয়েশা থেকে বর্ণিত যে, যখনি হযরত ফাতেমা রাসূল (সা.) কাছে আসতেন তখনি তিনি হযরত ফাতেমার সম্মানে জায়গা ছেড়ে উঠে দাড়াতেন এবং ফাতেমার মাথায় চুমু খেতেন। আর তাকে নিজের স্থানে বসিয়ে দিতেন। আবার যখন হযরত মুহাম্মদ (সা.) হযরত ফাতেমার সাক্ষাতে গমন করতেন তখন তাঁরা পরস্পরের মুখে চুম্বন করতেন এবং পাশাপাশি বসতেন। 110

শাহাদাত

মহানবী (সা.) ইন্তেকালের পর বিভিন্ন রকম দুঃখ-কষ্ট হযরত ফাতেমার অন্তরে প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করেছিল এবং বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ তাঁর জীবনটাকে তিক্ত ও অসহ্য করে তুলেছিল। তিনি তাঁর সম্মানিত পিতাকে অত্যন্ত ভালবাসতেন এবং কখনো তাঁর বিচ্ছেদকে সহ্য করতে পারতেন না। একদিকে তাঁর জন্যে পিতার বিয়োগ ব্যথা অত্যন্ত বেদনাদায়ক ছিল। অপরদিকে আমিরুল মুমিনীনের খেলাফতের বিরুদ্ধে চক্রান্তকারীদের আচরণ হযরত ফাতিমা আয যাহরার রুহ্ ও দেহে সাংঘাতিক ক্ষতের সৃষ্টি করে।

আর এ মুছিবত ও দুঃখ কষ্ট ছাড়াও অন্যান্য ব্যথা বেদনা তাঁকে জর্জরিত করেছিল -যার অবতারণা থেকে এখানে বিরত থাকছি- এসকল কারণেই।

হযরত ফাতেমা (আ.) পিতার ইন্তেকালের পর সর্বদা ক্রন্দনরত ও শোকার্ত ছিলেন। তিনি কখনো তাঁর পিতার কবর যিয়ারতে গিয়ে অনেক কাঁদতেন।111 আবার কখনো শহীদদের কবরের পার্শ্বে গিয়ে আহাযারী করতেন।112 আর নিজ গৃহে কান্না ও শোক পালন ব্যতীত অন্য কিছুই করতেন না। তাঁর ক্রন্দন ও রোনাজারীর ব্যাপারে মদীনাবাসীরা প্রতিবাদ করলে আমিরুল মুমিনীন আলী (আ.) তাঁর জন্যে জান্নাতুল বাকী কবরস্থানের এক প্রান্তে একটি ছোট্ট ঘর তৈরী করে দেন যা পরবর্তীতে বাইতুল আহ্যান বা শোকের ঘর নামে আখ্যায়িত হয়েছে। হযরত যাহরা (আ.) প্রতিদিন সকালে হাসানাইন তথা ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনকে সাথে নিয়ে সেখানে চলে যেতেন আর রাত পর্যন্ত কবরগুলোর পাশে কান্নাকাটি করতেন। রাত্রি হলেই আমিরুল মুমিনীন আলী (আ.) তাঁকে কবরস্থান থেকে বাড়িতে নিয়ে আসতেন। আর এ কাজ তাঁর অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।113 রাসূল (সা.)-এর সাথে বিচ্ছেদে হযরত যাহরার ব্যথা বেদনা ও দুঃখ কষ্ট এত মাত্রায় বৃদ্ধি পায় যে নবী (সা.)-এর যে কোন স্মৃতিই তাঁকে কান্নায় জর্জরিত ও অস্থির করে তুলতো। হযরত রাসূল (সা.)-এর মুয়াযযিন হযরত বেলাল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে,নবী (সা.)-এর তিরোনের পর আর কোনদিন কারো জন্যে আযান বলবেন না। একদিন হযরত যাহরা (আ.) বললেন : আমার পিতার মুয়াযযিনের কণ্ঠে আযান শুনতে মন চায় । এ সংবাদ হযরত  বেলালের কর্ণগোচর হলে তিনি তড়িৎগতিতে এসে হযরত ফাতেমার সামনে আযান দিতে দাঁড়িয়ে যান। যখন হযরত বেলালের কণ্ঠে আল্লাহু আকবারের ধ্বনি উচ্চারিত হলো তখন হযরত ফাতেমা চোখে আর কান্না ধরে রাখতে পারলেন না। আর যখন হযরত বেলালের আযান আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ্ -তে পৌঁছায় তখন হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.) উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। উপস্থিত লোকজন হযরত বেলালকে বললেন : থামুন!  রাসূলের কন্যা মারা যাচ্ছেন। তারা মনে করেছিলেন যে,হযরত ফাতেমা ইহলোক ত্যাগ করেছেন। হযরত  বেলাল আযান অসম্পূর্ণ রেখে ক্ষান্ত হলেন। যখন হযরত ফাতেমার চৈতন্য ফিরে আসলো তখন হযরত বেলালকে আযান সম্পূর্ণ করার জন্যে বললেন। কিন্তু হযরত বেলাল তাঁর খেদমতে আরজ করলেন : হে নারীদের নেত্রী! আমার আযানের ধ্বনি শ্রবনের ফলে আপনার প্রাণনাশের আশংকা করছি। 114

অবশেষে  হযরত  ফাতেমা (আ.)-এর অসহনীয় মর্মপীড়া এবং তাঁর উপর আরোপিত দুঃখ-কষ্ট তাঁকে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই শয্যাশায়ী  করে ফেললো। পরিশেষে এ আঘাত ও দুঃখ-কষ্টের কারণে একাদশ হিজরীর জামাদিউল উলার তের তারিখে,কারো মতে জামাদিউসসানী মাসের তৃতীয় দিনে অর্থাৎ হযরত নবী করীমের তিরোধানের মাত্র পঁচাত্তর অথবা পঁচানব্বই দিনের ব্যবধানে তিনি চিরদিনের জন্যে এ নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণ করেন। তিনি তাঁর শাহাদাতের মাধ্যমে তাঁর অনুসারীদের অন্তরসমূহকে চিরদিনের জন্যে শোকের সাগরে ভাসিয়ে গেছেন।115