শোকার্তের দীর্ঘশ্বাস (প্রথম খণ্ড)

শোকার্তের দীর্ঘশ্বাস (প্রথম খণ্ড)0%

শোকার্তের দীর্ঘশ্বাস (প্রথম খণ্ড) লেখক:
প্রকাশক: ওয়াইজম্যান পাবলিকেশনস
বিভাগ: ইতিহাস

শোকার্তের দীর্ঘশ্বাস (প্রথম খণ্ড)

লেখক: আল্লামা আব্বাস বিন মুহাম্মাদ রেযা আল কুম্মি
প্রকাশক: ওয়াইজম্যান পাবলিকেশনস
বিভাগ:

ভিজিট: 45223
ডাউনলোড: 4000

পাঠকের মতামত:

শোকার্তের দীর্ঘশ্বাস (প্রথম খণ্ড)
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 90 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 45223 / ডাউনলোড: 4000
সাইজ সাইজ সাইজ
শোকার্তের দীর্ঘশ্বাস (প্রথম খণ্ড)

শোকার্তের দীর্ঘশ্বাস (প্রথম খণ্ড)

লেখক:
প্রকাশক: ওয়াইজম্যান পাবলিকেশনস
বাংলা

হুজর বিন আদির শাহাদাত

হুজর বিন আদি ছিলেন ইমাম আলী (আ.) এর সাথীদের একজন এবং তিনি ভাতা পেতেন। তাকে হুজর আল খায়ের (কল্যাণের হুজর) বলে ডাকা হতো। তিনি সুপরিচিত ছিলেন তার রোযা , অনেক ইবাদত ও দোআর জন্য। বলা হয় যে তিনি দিন ও রাতে এক হাজার রাকাত নামায পড়তেন এবং জ্ঞানী সাথীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এছাড়াও আরও কম বয়সে তিনি সম্মানিতদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। সিফফীনের যুদ্ধে তিনি ছিলেন কিনদা গোত্রের পতাকাবাহী এবং নাহরেওয়ানের যুদ্ধে (ইমাম আলীর সৈন্যদলের) তিনি ছিলেন বাম পাশের অংশের ডান শাখার অধিনায়ক।

ফযল বিন শাযান বলেন যে , সম্মানিতদের , সর্দারদের ও ধার্মিক তাবেঈনদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন জানদাব বিন যুহাইরাহ (যাদুকরদের হত্যাকারী) , আব্দুল্লাহ বিন বুদাইল , হুজর বিন আদি , সুলাইমান বিন সুরাদ , মুসাইয়্যাব বিন নাজাবাহ , আল-ক্বামাহ , আশতার , সাঈদ বিন কায়েস এবং তাদের মত আরও। যুদ্ধ তাদেরকে কিনে নিয়েছিলো এবং তারা (সংখ্যায়) বৃদ্ধি পেয়েছিলেন এবং তারা ইমাম হোসেইন (আ.) এর সাথে থেকে শহীদ হয়েছিলেন।

যখন মুগীরা বিন শা বাহকে কুফার গভর্নর বানানো হলো , সে মিম্বরে উঠলো এবং ইমাম আলী (আ.) ও তার শিয়াদেরকে গালি-গালাজ করলো। সে উসমানের হত্যাকারীদের অভিশাপ দিলো এবং তাকে ক্ষমা করে দেয়ার জন্য প্রার্থনা করলো। হুজর তার জায়গা থেকে উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন ,

) يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ بِالْقِسْطِ شُهَدَاءَ لِلَّـهِ وَلَوْ عَلَىٰ أَنفُسِكُمْ(

হে যারা বিশ্বাস করো , ন্যায়বিচারের জন্য দৃঢ়ভাবে দাঁড়াও , আল্লাহর জন্য সাক্ষী হয়ে , যদি তা তোমাদের নিজেদের বিরুদ্ধেও হয়। ” [সূরা নিসা: ১৩৫]

আমি সাক্ষ্য দেই যে , যে ব্যক্তিকে তুমি গালিগালাজ করেছো তার মর্যাদা তার চাইতে অনেক বেশী যাকে তুমি প্রশংসা করেছো। আর যাকে তুমি বাহবা দিয়েছো সে বদনামের যোগ্য তার চাইতে বেশী যাকে তুমি অপবাদ দিয়েছো। ” মুগীরা বললো , দুর্ভোগ তোমার জন্য , হে হুজর , এ ধরনের কথাবার্তা থেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করো এবং বাদশাহর ক্রোধ থেকে নিজেকে দূরে রাখো যা বৃদ্ধি পাবে তোমাকে হত্যা করা পর্যন্ত। ” কিন্তু হুজর এতে সামান্যতম দমেন নি এবং এ বিষয়ে তিনি সব সময় বিরোধিতা করতেন। একদিন যথারীতি মুগীরা মিম্বরে উঠলো এবং সে দিনগুলো ছিলো তার জীবনের শেষ সময় এবং ইমাম আলী (আ.) ও তার শিয়াদের অভিশাপ দিতে লাগলো। হঠাৎ হুজর দ্রুত উঠে দাঁড়ালেন এবং উচ্চ কন্ঠে বললেন যা মসজিদে যারা ছিলো সবাই শুনতে পেলো , এই , তুমি কি তাকে জানো না যাকে তুমি অস্বীকার করছো ? তুমি বিশ্বাসীদের আমিরকে অপবাদ দিচ্ছো ও অপরাধীদের প্রশংসা করছো ?

হিজরি ৫০ সনে , মুগীরা মৃত্যুবরণ করে এবং কফা ও বসরার উপকন্ঠ যিয়াদ বিন আবীহর নিয়ন্ত্রণে আসে , যে তখন কুফাতে আসে। যিয়াদ হুজরকে ডাকলো , যে তার পুরাতন বন্ধু ছিলো এবং বললো , আমি শুনেছি তুমি মুগীরার সাথে কী আচরণ করেছো এবং সে তা সহ্য করে গেছে। কিন্তু আল্লাহর শপথ আমি তা সহ্য করবো না। আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি আলীর জন্য বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা আল্লাহ আমার অন্তর থেকে মুছে দিয়েছেন এবং তা (তার) শত্রুতা ও হিংসা দিয়ে বদলে দিয়েছেন। এছাড়া মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে শত্রুতা ও বিদ্বেষ আল্লাহ মুছে দিয়েছেন আমার অন্তর থেকে তার জন্য ভালোবাসা ও বন্ধুত্ব দিয়ে। যদি তুমি সঠিক পথে থাকো তোমার পৃথিবী ও বিশ্বাস নিরাপদ থাকবে , কিন্তু যদি তোমার হাত দিয়ে ডানে বামে আঘাত কর , তাহলে তুমি তোমাকে ধ্বংস করবে এবং তোমার রক্ত আমাদের জন্য বৈধ হয়ে যাবে। আমি সতর্ক করার আগে শাস্তি দেয়া অপছন্দ করি এবং না আমি গ্রেফতার করা পছন্দ করি কোন কারণ ছাড়া। হে আল্লাহ , আপনি সাক্ষী থাকুন। ” হুজর বললো , সেনাপতি আমাকে কখনোই দেখবেন না তা করতে যা তিনি অপছন্দ করেন এবং আমি তার উপদেশ গ্রহণ করবো। ” এ কথা বলে হুজর বের হয়ে এলেন । এভাবে তিনি গোপনীয়তা অবলম্ব করনেলন এবং এরপর থেকে সতর্ক থাকলেন। যিয়াদ তাকে পছন্দ করতো। শিয়ারা হুজরের সাথে সাক্ষাৎ করতে লাগলো এবং তার বক্তব্য শুনতে লাগলো। যিয়াদ সাধারণত শীতকালে বসরায় এবং গ্রীষ্মকালে কুফায় কাটাতো। (তার অনুপস্থিতিতে) সামারাহ বিন জুনদাব ছিলো বসরায় তার প্রতিনিধি এবং কুফাতে আমর বিন হুরেইস।

একদিন আম্মারা বিন উক্ববাহ যিয়াদকে বললো , শিয়ারা হুজরের সাথে দেখা করছে এবং তারা তার দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে এবং আমি আশঙ্কা করছি যে হয়তো তারা আপনার অনুপস্থিতিতে বিদ্রোহ করে বসবে। ” যিয়াদ হুজরকে ডাকলো এবং তাকে সতর্ক করলো এবং বসরার উদ্দেশ্যে গেলো তার নিজের জায়গায় আমর বিন হুরেইসকে রেখে। শিয়ারা হুজরের সাথে সাক্ষাৎ করতে থাকলো এবং যখন তিনি মসজিদে বসতেন , জনতা তার কথা শুনতে আসতো। তারা মসজিদের অর্ধেক দখল করে রাখতো এবং যারা তাদেরকে দেখতে আসতো তারাও তাদের ঘিরে বসতো যতক্ষণ না সারা মসজিদ ভরে যেতো। তাদের হৈচৈ বৃদ্ধি পেলো এবং তারা মুয়াবিয়ার বদনাম ও যিয়াদকে গালাগালি করতে লাগলো। যখন আমর বিন হুরেইসকে একথা জানানো হলো সে মিম্বরে উঠলো। শহরের গণ্যমান্যরা তাকে ঘিরে বসলো এবং সে তাদেরকে আমন্ত্রণ জানালো আনুগত্যের জন্য এবং বিরোধিতার বিষয়ে সতর্ক করলো। হঠাৎ হুজরের লোকজনের মধ্যে একটি দল লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো এবং তাকবীর দিতে থাকলো। তারা তার কাছে গেলো এবং তাকে অভিশাপ দিতে লাগলো এবং তাকে পাথর ছুঁড়ে মারতে লাগলো। আমর মিম্বর থেকে নেমে গেলো এবং প্রাসাদে গেলো এবং দরজা বন্ধ করে দিলো ; আর যিয়াদকে এ বিষয়ে লিখলো।

যখন যিয়াদ এ বিষয়ে জানতে পারলো তখন সে কা ব বিন মালিকের কবিতা আবৃত্তি করলো , গ্রামে সকাল হওয়ার সময় থেকে আমাদের সর্দারেরা তাদের আপত্তি জানালো , (এ বলে) কেন আমরা আমাদের বীজ বপন করবো যদি আমরা (মাঠে) তা আমাদের তরবারি দিয়ে রক্ষা করতে না পারি। ” এরপর সে বললো , আমি (ভেতরে) শূন্য , যদি আমি কুফাকে হুজরের হাত থেকে নিরাপদ না করি এবং তাকে অন্যদের জন্য উদাহরণ না বানাই। হে হুজর , তোমার মায়ের জন্য আক্ষেপ , তোমার রাতের খাদ্য তোমাকে খেঁকশিয়ালের কাছে এনেছে। ” এটি একটি প্রবাদ যে , এক ব্যক্তি এক রাতে খাবারের খোঁজে বের হলো কিন্তু সে নিজেই খেঁকশিয়ালের খাবারে পরিণত হলো। এরপর সে (যিয়াদ) কুফার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো এবং প্রাসাদে প্রবেশ করলো। সে একটি সিল্কের জোব্বা এবং একটি সবুজ পালকের কোট গায়ে বেরিয়ে এলো এবং মসজিদে প্রবেশ করলো। তখন হুজর তার বন্ধুদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে মসজিদে বসা ছিলেন। যিয়াদ মিম্বরে উঠলো এবং একটি হুমকিমূলক বক্তব্য রাখলো। সে কুফার সম্মানিত ব্যক্তিদের বললো , তোমাদের স্বজনের মধ্যে যারা হুজরের সাথে বসে আছে ডাকো এবং তোমাদের ভাইদের ও সন্তানদের এবং নিকটজনদের , যারা তোমাদের কথা শুনবে তাদেরকে নিজেদের কাছে , যতক্ষণ না তাদরেকে তোমরা তার কাছ থেকে আলাদা করছো। ” তারা তাই করলো এবং বেশীরভাগই ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো এবং যখন যিয়াদ দেখলো যে হুজরের অনুসারীদের সংখ্যা কমে গেছে সে শাদ্দাদ বিন হাইসাম হিলালিকে ডাকলো , যে ছিলো পুলিশ বাহিনীর প্রধান এবং তাকে বললো হুজরকে তার কাছে আনতে। সে এলো এবং হুজরকে সেনাপতির ডাকে সাড়া দিতে বললো। হুজরের সাথীরা বললো , না , আল্লাহর শপথ , আমরা তা মানবো না। ” তা শুনে শাদ্দাদ তার পুলিশ বাহিনীকে বললো তাদের তরবারি খুলে তাদেরকে সবদিক থেকে ঘেরাও করতে। এভাবে তারা হুজরকে ঘেরাও করলো। বাকর বিন উবাইদ আমুদি আঘাত করলো আমর বিন হুমাক্বের মাথায় এবং তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন। আযদ গোত্র থেকে দুজন , আবু সুফিয়ান এবং আজালান তাকে মাটি থেকে তুললো এবং তাকে আযদ গোত্রের উবায়দুল্লাহ বিন মালিকের ঘরে নিয়ে গেলো , যেখানে তিনি লুকিয়ে ছিলেন কুফা ত্যাগের আগ পর্যন্ত। উমাইর বিন যাইদ কালবি হুজরের শিষ্যদের একজন ছিলো , সে বললো , আমাদের মাঝে আমার কাছে ছাড়া কারো কাছে তরবারি নেই , আর তা যথেষ্ট নয়। ” হুজর বললেন , তাহলে তুমি কী পরামর্শ দিচ্ছো ? সে বললো , উঠো এবং তোমাদের আত্মীয়দের কাছে যাও যেন তারা তোমাকে রক্ষা করতে পারে। হুজর উঠলেন এবং স্থান ত্যাগ করলেন। যিয়াদ , যে তাদের দিকে মিম্বরে বসে তাকিয়ে ছিলো , উচ্চ কন্ঠে বললো , হে হামাদান , তামীম , হাওয়াযিন , বাগীয , মাযহাজ , আসাদ ও গাতাফান গোত্রের সন্তানরা , উঠো এবং বনি কিনদার ঘরগুলোর দিকে যাও হুজরের দিকে এবং তাকে এখানে নিয়ে এসো। ”

যখন হুজর তার বাড়িতে এলেন তিনি দেখলেন যে তার সমর্থকদের সংখ্যা কম। তিনি তাদের মুক্ত করে দিয়ে বললেন , তোমরা সবাই ফিরে যাও , কারণ তোমাদের প্রতিরোধের শক্তি নেই এবং তোমাদেরকে হত্যা করা হবে। ” যখন তারা ফেরত যেতে চেষ্টা করলো মাযহাজ ও হামাদান গোত্রের অশ্বারোহী সৈনিকরা এসে পড়লো এবং তাদের মুখোমুখি হলো এবং ক্বায়েস বিন যাইদ গ্রেফতার হলো এবং অন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো। হুজর বনি হারবের রাস্তার দিকে গেলেন যা বনি কিনদার একটি শাখা এবং সোলাইমান বিন ইয়াযীদ কিনদির বাড়িতে আশ্রয় নিলেন। তারা তার পিছনে পিছনে দৌড়ে সুলাইমানের বাড়িতে পৌঁছে গেলো। সুলাইমান তার তরবারি খুললো বাইরে গিয়ে মোকাবেলার জন্য , তখন তার কন্যা কাঁদতে শুরু করলো । হুজর তাকে থামালেন এবং তার বাড়ি ত্যাগ করলেন একটি চিমনীর ভিতর দিয়ে। এরপর তিনি বনি আনবারাহর দিকে গেলেন যা ছিলো বনি কিনদারই আরেকটি শাখা এবং আব্দুল্লাহ বিন হুরেইসের বাড়ি , সেখানে তিনি আশ্রয় নিলেন - যিনি ছিলেন মালিক আশতার নাখাঈর ভাই। আব্দুল্লাহ তাকে হাসিমুখে স্বাগতম জানালেন। হুজরের কাছে হঠাৎ খবর এলো যে , পুলিশ আপনাকে নাখার রাস্তায় খুঁজছে , কারণ এক কালো কৃতদাসী তাদেরকে সংবাদ দিয়েছে এবং তারা আপনাকে খুঁজছে। ” হুজর আব্দুল্লাহর সাথে বেরিয়ে এলেন রাতের অন্ধকারে এবং রাবি আ বিন নাজিয আযদির বাড়িতে আশ্রয় নিলেন। যখন পুলিশ বাহিনী তাকে পেতে ব্যর্থ হলো তখন যিয়াদ মুহাম্মাদ বিন আল আশআসকে ডাকলো এবং বললো , হয় হুজরকে আনো , নয়তো আমি তোমাদের সব খেজুর গাছ ধ্বংস করে দিবো এবং তোমাদের বাড়িঘর গুঁড়ো করে দেবো এবং তোমরা নিজেদের রক্ষা করতে পারবে না , আমি তোমাদের টুকরো টুকরো করে ফেলবো । মুহাম্মাদ বললো , আমাকে কিছু সময় দিন যেন আমি তাকে খুঁজতে পারি। ” যিয়াদ বললো , আমি তোমাকে তিন দিনের সময় দিচ্ছি , যদি এ সময়ের মধ্যে হুজরকে আমার কাছে আনো তাহলে তোমরা মুক্ত , আর নয়তো তোমরা নিজেদেরকে মৃতদের মধ্যে গণ্য করতে পারো। ” সৈন্যরা মুহাম্মাদকে কারাগারের দিকে হিঁচড়ে নিয়ে গেলো আর তার চেহারার রঙ বদলে গেলো। সে সময় হুজর বিন ইয়াযীদ কিনদি নামে এক ব্যক্তি , যে বনি মুররাহ গোত্রের একজন ছিলো , তার জিম্মাদার হলে তারা তাকে ছেড়ে দিলো।

হুজর রাবি ’ আর বাড়িতে এক দিন ও এক রাতের জন্য ছিলেন , এরপর তিনি রুশাইদ নামে একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে , যে ছিলো ইসফাহানের লোক , পাঠালো মুহাম্মাদ বিন আল আশাসের কাছে একটি সংবাদ দিয়ে যে , আমাকে জানানো হয়েছে উদ্ধত অত্যাচারী (যিয়াদ) তোমার সাথে কী আচরণ করেছে। ভয় পেয়ো না , কারণ আমি তোমার কাছে আসবো। এরপর তুমি যিয়াদের কাছে যাবে তোমার কিছু লোকজন নিয়ে এবং তাকে বলো আমাকে নিরাপত্তা দিতে এবং আমাকে মুয়াবিয়ার কাছে পাঠাতে , যেন সে সিদ্ধান্ত নেয় আমাকে নিয়ে কী করা উচিত। ” তাই হুজর বিন ইয়াযীদ , জারীর বিন আব্দুল্লাহ এবং মালিক আশতারের ভাই আব্দুল্লাহকে সাথে নিয়ে মুহাম্মাদ যিয়াদের সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলো এবং হুজরের সংবাদ দিলো। যিয়াদ তা শুনলো ও একমত হলো। তারা হুজরের কাছে একজন দূতকে পাঠালো তাকে জানানোর জন্য এবং তিনি যিয়াদের কাছে এলেন । তাকে দেখে যিয়াদ তাকে বন্দী করার আদেশ দিলো। তাকে দশ দিন কারাগারে বন্দী রাখা হলো এবং যিয়াদ আর কিছু করলো না হুজরের অন্যান্য সমর্থকদের ধাওয়া করা ছাড়া।

যিয়াদ হুজরের সমর্থকদের পিছু ধাওয়া করতে থাকলো যতক্ষণ পর্যন্তনা সে যারা পালিয়ে গিয়েছিলো তাদের বারো জনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হলো। এরপর সে কুফার চারটি এলাকার সর্দারদের ডাকলো , যারা ছিলো: আমর বিন হুরেইস , খালিদ বিন আরফাতাহ , ক্বায়েস বিন ওয়ালীদ এবং আবু মূসা আশআরীর সন্তান আবু বুরদা। সে তাদেরকে বললো , তোমরা সবাই হুজর সম্পর্কে যা দেখেছো সে বিষয়ে সাক্ষ্য দিবে। ” আর তারা সাক্ষ্য দিলো যে , হুজর দল গঠন করেছিলো এবং খলিফাকে গালি দিচ্ছিলো , যিয়াদকে তিরস্কার করছিলো এবং সে আবু তুরাবকে (ইমাম আলীকে) নির্দোষ বলছিলো এবং তার উপর আল্লাহর রহমতের জন্য দোআ করছিলো এবং তার শত্রুও প্রতিপক্ষদের সাথে নিজের সম্পর্কচ্ছেদ করেছিলো এবং যারা তার সাথে আছে তারা তার বন্ধুদের মধ্যে সর্দার এবং তারাও একই মত পোষণ করে। যিয়াদ তাদের সাক্ষ্য পড়ে দেখলো এবং বললো , আমি এ সাক্ষ্যকে স্বীকৃতি দেই না এবং আমি মনে করি এটি অসম্পূর্ণ। আমি চাই আরেকটি চিঠি এ রকম কথাসহ লেখা হোক। ”

তাই আবু বুরদা লিখলো , আল্লাহর নামে যিনি দয়ালু , করুণাময়। এটি এক সাক্ষ্য দিচ্ছি আবু মূসার সন্তান , আবু দারদা , রাব্বুল আলামীনের জন্য যে , হুজর বিন আদি অবাধ্য হয়েছে এবং দলত্যাগ করেছে। সে খলিফাকে অভিশাপ দিয়েছে এবং ফাসাদ ও যুদ্ধের দিকে আহ্বান করেছে। সে একদল সৈন্য জামায়েত করেছে এবং খিলাফত থেকে মুয়াবিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করার আহ্বান জানিয়েছে। সে আল্লাহ সম্পর্কে অশ্লীল অবিশ্বাস চাষ করেছে। ” যিয়াদ বললো , তোমরা স্বাক্ষর দাও। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো যেন এ মূর্খ বিশ্বাসঘাতকের মাথা কেটে ফেলা হয়। ” এরপর অন্যান্য তিন এলাকার সম্মানিত লোকেরাও একইভাবে সাক্ষ্য দিলো। এরপর সে জনগণকে ডাকলো এবং বললো , তোমরা সাক্ষ্য দাও যেভাবে চার এলাকার লোকেরা সাক্ষ্য দিয়েছে। ” তাই সত্তর জন সাক্ষ্য দিলো। যাদের মধ্যে ছিলো ইসহাক , মূসা , এবং ইসমাইল , যারা ছিলো তালহা বিন উবায়দুল্লাহর সন্তান।

মুনযির বিন যুবাইর , আম্মারাহ বিন উক্ববাহ , আব্দুর রাহমান বিন হিবার , উমর বিন সা আদ বিন আবি ওয়াক্কাস , ওয়ায়েল বিন হুজর হাযরামি , যিরার বিন হুবাইরাহ , শাদ্দাদ বিন মুনযির - যে ইবনে বাযীহ নামে সুপরিচিত ছিলো , হাজ্জাজ বিন আবজার আজালি , আমর বিন হাজ্জাজ , লুবাইদ বিন আতারুদ , মুহাম্মাদ বিন উমাইর বিন আতারুদ , আসমা বিন খারেজা , শিমর বিন যিলজাওশান , যাজর বিন ক্বায়েস জু ’ ফি , শাবাস বিন রাব ’ ঈ , সিমাক বিন মুহযিমা আসাদি - যে ছিলো কুফার চারটি মসজিদের একটির রক্ষনাবেক্ষণকারী , যেগুলো তৈরী করা হয়েছিলো ইমাম হোসেইন (আ.) এর হত্যার আনন্দে এবং তারা আরও দুজনের নাম এতে অন্তর্ভুক্ত করলো কিন্তু তারা তা স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করলো। দুজন ছিলো শুরেইহ বিন আল হারস ক্বাযী এবং শুরেইহ বিন হানি। যখন শুরেইহ বিন আল হারসকে হুজর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলো সে বললো , সে সব সময় রোযা রাখে এবং সারা রাত ইবাদতে মগ্ন থাকে। ” শুরেইহ বিন হানি বললো , আমি শুনেছি আমার নাম এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে (আমার অনুমতি ছাড়া) তাই আমি তা বাতিল করছি। ”

যিয়াদ এরপর সাক্ষীদের প্রমাণপত্র ওয়ায়েল বিন হুজর এবং কাসীর বিন শিহাবের কাছে দিলো এবং তাদেরকে হুজর বিন আদি এবং তার সাথীদেরসহ সিরিয়ার দিকে পাঠিয়ে দিলো। সে তাদের আদেশ দিলো রাতে পুলিশ বাহিনীর সাথে কুফার বাইরে রওনা দিতে এবং তারা ছিলো চৌদ্দ জন। যখন তারা আযরামের কবরস্থানে পৌঁছলো , যা কুফার একটি স্টেশন , হুজরের একজন শিষ্য ক্বাবীসাহ বিন যাবীয়াহ আবাসির চোখ পড়লো তার নিজের বাড়ির উপর। সে দেখলো তার কন্যারা বাড়ি থেকে দেখছে এবং সে ওয়ায়েল এবং কাসীরের কাছে অনুরোধ করলো তাকে তার বাড়ির কাছে নিয়ে যেতে যেন সে অসিয়ত করে যেতে পারে। যখন তারা তাকে বাড়ির কাছে নিয়ে গেলো তার কন্যারা কাঁদতে শুরু করলো । সে কিছক্ষণের জন্য চুপ করে থাকলো এবং তাদেরকেও চুপ করতে বললো এবং তারা তা করলো। তখন সে বললো , আল্লাহকে ভয় করো ও সবর করো। কারণ এ ভ্রমণে আমি আমার রবের কাছ থেকে ভালো সমাপ্তি আশা করছি দুটো বিষয়ে যে , হয় আমাকে হত্যা করা হবে - যা উত্তম সফলতা , অথবা আমাকে মুক্তি দেয়া হবে এবং আমি তোমাদের কাছে সুস্বাস্থ্যে ফিরে আসবো। যিনি তোমাদের রিয্ক্ব দিয়েছিলেন এবং দেখাশোনা করেছিলেন তিনি ছিলেন আল্লাহ এবং তিনি জীবিত এবং কখনও মৃত্যুবরণ করবেন না এবং আমি আশা করি তিনি তোমাদের পরিত্যাগ করবেন না এবং তোমাদের কারণে আমার বিষয়টি বিবেচনা করবেন। ” এ কথা বলে সে ফেরত এলো এবং তার লোকজন তার জন্য দোআ করলো।

এরপর তারা আরও এগুলো এবং মারজ আযরাত পৌঁছালো , যা সিরিয়া থেকে কিছু মাইল দূরে এবং তাদেরকে সেখানে বন্দী করে রাখা হলো। মুয়াবিয়া ওয়ায়েল বিন হুজর এবং কাসীরকে তার কাছে ডেকে পাঠালো। যখন তারা এলো সে চিঠি খুললো এবং সিরিয়াবাসীদের উপস্থিতিতে পড়লো। যার বিষয়বস্তু ছিলো এরকম: আল্লাহর দাস মুয়াবিয়া বিন আবু সুফিয়ান সমীপে , যিয়াদ বিন আবু সুফিয়ান থেকে। আম্মা বা আদ , আল্লাহ আমিরুল মুমিনীনের জন্য একটি সুন্দর বিচার করেছেন এবং তার শত্রুদের সরিয়ে দিয়েছেন এবং বিদ্রোহীদের স্বেচ্ছাচারিতা ধ্বংস করেছেন। যুবকদের বন্ধু আলীর অনুসারী বিদ্রোহীরা , আমিরুল মুমিনীনের অবাধ্য হয়েছে হুজর বিন আদির নেতৃত্বে এবং মুসলমানদের দল থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছে এবং আমাদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আল্লাহ তাদের ক্রোধকে দমিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের উপর আমাদের আধিপত্য দান করেছেন। এরপর আমি কুফার ধার্মিক , সম্মানিত ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের ডেকেছি এবং তারা সাক্ষী দিয়েছে যা তারা দেখেছে এবং আমি তাদের পাঠিয়েছি পরহেজগার ও ধার্মিক লোকদের সাক্ষীপত্র সাথে দিয়ে , যাদের স্বাক্ষর চিঠির শেষে যুক্ত করা আছে। ”

যখন মুয়াবিয়া এ চিঠি পড়লো তখন সে এ সম্পর্কে সিরিয়াবাসীদের অভিমত চাইলো। ইয়াযীদ বিন আল আসাদ বাজালি বললো , তাদেরকে সিরিয়ার গ্রামগুলোতে ছড়িয়ে দিন যেন আহলে কিতাবরা (খৃস্টান ও ইহুদী) তাদের কাজ শেষ করে। ” হুজর তখন মুয়াবিয়ার কাছে একটি সংবাদ পাঠালো এ বলে , আমরা এখনও আমিরুল মুমিনীনের বাইয়াতের মধ্যেই আছি। আমরা তা পরিত্যাগ করি নি এবং না আমরা প্রতিবাদ করেছি। আমাদের শত্রুরা ও অকল্যাণ কামনাকারীরা আমাদের বিরুদ্ধে স্বাক্ষী দিয়েছে। ” যখন মুয়াবিয়া এ সংবাদ পেলো সে বললো , নিশ্চয়ই যিয়াদ আমাদের দৃষ্টিতে হুজরের চাইতে বেশী নির্ভরযোগ্য। ” এরপর সে হাদাবাহ বিন ফায়ায কুযাঈকে (যার এক চোখ অন্ধ ছিলো) আরও দুজন লোকসহ রাতের বেলা পাঠালো হুজর এবং তার সাথীদের আনার জন্য। যখন কারিম বিন আফীফ খাস আমি তাকে দেখলো সে বললো , আমাদের অর্ধেককে হত্যা করা হবে এবং অন্য অর্ধেককে মুক্তি দেয়া হবে। ” মুয়াবিয়ার দূত তাদের কাছে এলো এবং তাদের ছয় জনকে মুক্ত করে দিলো সিরিয়াবাসীদের মধ্যস্থতায়। অন্য আট জনের বিষয়ে মুয়াবিয়ার দূত বললো , মুয়াবিয়া আদেশ পাঠিয়েছেন যদি তোমরা আলীর সাথে সম্পর্কচ্ছেদ কর ও তাকে অভিশাপ দাও তাহলে আমরা তোমাদের মুক্ত করে দিবো , আর নয়তো তোমাদেরকে হত্যা করা হবে এবং আমিরুল মুমিনীন বিশ্বাস করেন যে তোমাদের রক্ত ঝরানো আমাদের জন্য বৈধ তোমাদের শহরের লোকদের সাক্ষ্যের কারণে , কিন্তু আমির দয়া দেখিয়েছেন , যদি তোমরা ঐ ব্যক্তির সাথে সম্পর্কচ্ছেদ কর , তোমাদের মুক্তি দেয়া হবে। ” যখন তারা একথা শুনলো তারা তা পালন করতে অস্বীকার করলো , তাই তাদের হাত থেকে দড়ি খুলে ফেলা হলো এবং তাদের কাফন আনা হলো। আর তারা উঠলো এবং সারা রাত ইবাদতে কাটালো।

যখন সকাল হলো , মুয়াবিয়ার সাথীরা তাদেরকে বললো , হে (বন্দী) দল , গত রাতে আমরা দেখেছি যে তোমরা অনেক নামায পড়েছো ও দোআ করেছো , এখন আমাদের বল যেন আমরা জানতে পারি উসমান সম্পর্কে তোমরা কী বিশ্বাস রাখো ? তারা বললো , সে ছিলো প্রথম ব্যক্তি যে অন্যায় আদেশ দিয়েছে এবং ভুল পথ তৈরী করেছে। ” তারা বললো , আমিরুল মুমিনীন তোমাদেরকে আরও ভালো জানেন। ” তখন তারা তাদের মাথার কাছে দাঁড়ালো এবং বললো , তোমরা এখন ঐ ব্যক্তির (ইমাম আলীর) সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করছো , নাকি না ? তারা বললো , না , বরং আমরা তার সাথে বন্ধুত্ব রাখি। ” তা শুনে মুয়াবিয়ার দূতদের প্রত্যেকে এক একজনকে ধরলো তাদেরকে হত্যা করার জন্য। তখন হুজর তাদের বললো , অন্তত আমাদের অযু করতে দাও এবং আমাদের কিছু সময় দাও যেন আমরা দুরাকাত নামায পড়তে পারি , কারণ আল্লাহর শপথ , যখনই আমি অযু করেছি আমি নামায পড়েছি। ” তারা এতে সম্মত হলো এবং তারা নামায পড়লো। নামায শেষ করে হুজর বললেন , আল্লাহর শপথ , আমি কখনই এত সংক্ষিপ্ত নামায পড়ি নি। পাছে লোকে মনে করে আমি তা করেছি মৃত্যুকে ভয় করে। ” হাদাবাহ বিন ফায়ায আ ওয়ার তার দিকে এগুলো একটি তরবারি নিয়ে তাকে আক্রমণ করার জন্য , তখন হুজর কাপতে শুরু করলেন। হাদাবাহ বললো , তুমি বলেছিলে তুমি মৃত্যুকে ভয় কর না , আমি এখনও বলছি তোমাকে তোমার মাওলার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করতে এবং আমরা তোমাকে ছেড়ে দিবো। ” হুজর বললেন , কিভাবে আমি ভয় পাবো না , যখন কবর প্রস্তুত এবং কাফন পরা হয়েছে এবং তরবারি কোষমুক্ত হয়েছে , আল্লাহর শপথ যদিও আমি ভয় পাই , আমি ঐ ধরনের কথা উচ্চারণ করি না যা আল্লাহর ক্রোধ আনে। ”

এ বইয়ের লেখক বলেন যে , আমি একটি রেওয়ায়েত স্মরণ করতে পারি যে , হুজর ইমাম আলী (আ.) এর সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলেন যখন তিনি (ইমাম-আলী আ.) মাথায় আঘাত পেয়েছিলেন ইবনে মুলজিমের তরবারি থেকে। তিনি ইমামের দিকে মুখ করে দাঁড়ালেন এবং কবিতা আবৃতি করলেন , দুঃখ রোযাদার মাওলার জন্য , (যিনি) পরহেজগার , এক সাহসী সিংহ , এবং নৈতিক গুণাবলীর দরজা। ” যখন ইমাম আলী (আ.) তার দিকে তাকালেন এবং তার কবিতা শুনলেন , তিনি বললেন , তখন তোমার অবস্থা কী হবে যখন তোমাকে বলা হবে আমার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করতে , তখন তুমি কী বলবে ?

হুজর বললেন , হে আমিরুল মুমিনীন , আমাকে যদি টুকরো টুকরোও করা হয় এবং জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করা হয় , তবুও আমি তা আপনার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করার চাইতে বেশী পছন্দ করি। ” ইমাম বললেন , তুমি ভালো কাজ সম্পাদনে সফল হও , হে হুজর! তোমাকে হয়তো আল্লাহ প্রচুর পুরস্কার দিবেন তোমার নবী (সা.) এর পরিবারের প্রতি তোমার ভালোবাসার জন্য।

এরপর হুজরের বাকী ছয় জন সাথীকে তরবারির নিচে দেয়া হলো। আব্দুর রহমান বিন হিসসান আনযী এবং কারীম বিন আফীফ খাসা আমি বাদ রইলো এবং তারা বললো , আমাদেরকে মুয়াবিয়ার কাছে নিয়ে যাও , যেন আমরা সেই ব্যক্তি সম্পর্কে বর্ণনা করতে পারি যার বিষয়ে সে আমাদের আদেশ করেছে। ” তখন তাদেরকে মুয়াবিয়ার কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। যখন কারীম সেখানে প্রবেশ করলো , সে বললো , আল্লাহ , আল্লাহ , হে মুয়াবিয়া , নিশ্চয়ই তুমি এ নশ্বর বাড়ি থেকে চিরস্থায়ী বাড়ির দিকে যাবে , তখন তোমাকে জিজ্ঞেস করা হবে কেন তুমি আমাদের রক্ত ঝরিয়েছো। ” মুয়াবিয়া বললো , তাহলে আলী সম্পর্কে তোমার কী বলার আছে ? সে বললো , যা তুমি বলো। আমি আলীর ধর্ম থেকে নিজেকে বিচ্ছিন করছি যার ভালোবাসা ও আনুগত্যের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর ইবাদত করতাম। ” তখন শিমর বিন আব্দুল্লাহ খাস আমী উঠে দাঁড়ালো এবং তার পক্ষ হয়ে আবেদন করলো এবং মুয়াবিয়া তাকে তখন ক্ষমা করে দিলো , কিন্তু একটি শর্ত দিয়ে যে , সে একমাস কারাগারে থাকবে এবং মুয়াবিয়া যতদিন না বলবে সে কুফা ত্যাগ করতে পারবে না।

এরপর সে আব্দুর রহমান বিন হিসসানের দিকে ফিরলো এবং বললো হে রাবিয়া গোত্রের ভাই , আলী সম্পর্কে তোমার কী বলার আছে ? সে বললো , আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আলী তাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যারা আল্লাহকে সবচেয়ে বেশী স্মরণ করতেন এবং ভালোর দিকে ডাকতেন এবং খারাপকে নিষেধ করতেন এবং অন্যদের দোষ ত্রুটি ক্ষমা করতেন। ” মুয়াবিয়া বললো , তাহলে উসমান সম্পর্কে তোমার কী বলার আছে ? সে উত্তর দিলো , সে ছিলো প্রথম ব্যক্তি যে নিপীড়নের দরজা খুলেছিলো এবং ধার্মিকতার দরজা বন্ধ করেছিলো। ” এ কথা শুনে মুয়াবিয়া বললো , নিশ্চয়ই তুমি নিজেকে হত্যা করেছো। ” সে বললো , বরং আমি তোমাকে হত্যা করেছি। ” মুয়াবিয়া তখন তাকে যিয়াদের কাছে ফেরত পাঠালো এ সংবাদ দিয়ে যে , সে হচ্ছে তাদের মধ্যে নিকৃষ্ট যাদেরকে তুমি আমার কাছে পাঠিয়েছো। তাকে কঠিন নির্যাতন করো , কারণ সে তার যোগ্য এবং তাকে হত্যা করো যত খারাপভাবে সম্ভব হয়। ” যখন তাকে যিয়াদের কাছে পাঠানো হলো সে তাকে ক্বায়েস নাতিফের কাছে পাঠালো যে তাকে জীবন্তকবর দিল।

যে সাত জনকে শহীদ করা হয়েছিলো তারা ছিলেন:

১) হুজর বিন আদি

২) শারীক বিন শাদ্দাদ হাযরামি

৩) সাইফী বিন ফুযাইল শাইবানি

৪) ক্বাবীসাহ বিন যাবীয়াহ আবাসি

৫) মাযহার বিন শিহাব মিনক্বারি

৬) কুদাম বিন হাইয়্যান আনযি এবং

৭) আব্দুর রহমান বিন হিসসান আনযি

(আল্লাহর রহমত ও বরকত হোক তাদের ওপরে)

এ বইয়ের লেখক বলেন যে , হুজরের শাহাদাত মুসলমানদের ওপরে এক ব্যাপক প্রভাব ফেলে , যারা মুয়াবিয়াকে এর জন্য তিরস্কার করেছিলো। আবুল ফারাজ ইসফাহানি বলেন যে , আবু মাখনাফ বলেন , ইবনে আবি যায়েদা আমার কাছে বর্ণনা করেন আবু ইসহাক থেকে যে , সে বলেছে , আমি স্মরণ করতে পারি লোকজন বলছিলো প্রথম বেইজ্জতি যা কুফার উপর আপতিত হয়েছিলো তা ছিলো হুজরের শাহাদাত , মুয়াবিয়ার ভাই হিসেবে যিয়াদকে গ্রহণ এবং ইমাম হোসেইন (আ.) এর শাহাদাত। ”

মৃত্যুর সময় মুয়াবিয়া বলেছিলো , আমি গভীর সমস্যায় পড়বো ইবনুল আদবারের জন্য। ” ইবনুল আদবার বলা হতো হুজর বিন আদিকে কারণ তার পিতাকে আদবার ” ডাকা হতো কারণ তার পিঠে তিনি একটি তরবারির আঘাত পেয়েছিলেন এবং রেওয়ায়েত এসেছে যে খোরাসানের গভর্নর রাবি বিন যিয়াদ হারিসি যখন হুজর এবং তার সাথীদের শাহাদাতের সংবাদ পেলেন তখন মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষা করলেন। তিনি তার দুহাত তুললেন (আকাশের দিকে) এবং বললেন , হে আল্লাহ , যদি আপনি আমাকে বিবেচনা করেন তাহলে এ মুহূর্তে আমাকে মুত্যু দিন। ” এরপর তিনি মৃত্যুবরণ করলেন।

ইবনে আসীর তার কামিল ’ -এ বলেন যে হাসান বসরী বলেছেন:য়ামবিয়া তার ভিতরে চারটি বৈশিষ্ট্য রাখতো। তার প্রত্যেকটি ছিলো তার ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট। প্রথম সে মুসলিম জাতির উপর নিজেকে চাপিয়ে দেয় তরবারির শক্তি দিয়ে এবং খিলাফতের বিষয়ে তাদের মতামত নেয়ার তোয়াক্কা করে নি যখন নবী (সা.) এর সাহাবীরা এবং অন্যান্য সম্মানিত ও উদার ব্যক্তিরা তাদের মাঝে উপস্থিত ছিলেন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে , সে তার বিদ্রোহী সন্তান ইয়াযীদকে (খলিফা হিসেবে) নিয়োগ দেয় , যে ছিলো মদখোর , সিল্কের পোশাক পড়তো এবং তাম্বুরীন বাজাতো। তৃতীয়টি হলো , সে যিয়াদকে তার ভাই হিসেবে গ্রহণ করেছিলো যখন নবী (সা.) বলেছেন , শিশু সন্তান (ঐ নারীর) স্বামীর এবং ব্যভিচারীর জন্য পাথর ” এবং চতুর্থটি হচ্ছে যে , সে হুজর এবং তার সাথীদের হত্যা করেছে। হুজর ও তার সাথীদের বিষয়ে তার দুর্ভোগ হোক।

বর্ণিত হয়েছে যে জনগণ বলতো , প্রথম যে বেইজ্জতি কুফার উপর আপতিত হয়েছিলো তা ছিলো হাসান বিন আলী (আ.) এর শাহাদাত , হুজর বিন আদির শাহাদাত এবং যিয়াদকে আবু সুফিয়ানের সন্তান বলে গ্রহণ করা। ”

হিনদ বিনতে যাইদ আনসারিয়া একজন শিয়া মহিলা ছিলেন যে হুজরের প্রশংসায় কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন।

এ বইয়ের লেখক বলেন যে , ঐতিহাসিকরা হুজরের শাহাদাত সম্পকে আরও কিছু কারণ নথিভুক্ত করেছেন। তারা বলেন যে , একবার যিয়াদ শুক্রবার দিন খোতবা দিচ্ছিলো এবং তা দীর্ঘায়িত করে ফেললো। এ কারণে নামায বাতিল হয়ে গেলো। তা অনুমান করে হুজর বিন আদি উচ্চ কন্ঠে বলে উঠেন , নামায ” , কিন্তু যিয়াদ তাকে উপেক্ষা করলো এবং চালিয়ে যেতে থাকলো। হুজর আবার বলে উঠলেন , নামায ” , কিন্তু সে খোতবা দিতেই থাকে। হুজর শঙ্কিত হলেন যে নামাযের সময় অতিক্রম হয়ে যাবে , তাই তিনি কিছু বালি তার হাতে নেন এবং নামাযের জন্য উঠে দাঁড়ান। তা দেখে অন্যরাও দাঁড়িয়ে গেলো। এ দেখে যিয়াদ মিম্বর থেকে নেমে গেলো এবং নামায আদায় করলো। এরপর সে এ বিষয়ে মুয়াবিয়ার কাছে অতিরঞ্জিত করে লিখলো। মুয়াবিয়া লিখে পাঠালো যে হুজরকে শিকলে বেঁধে তার কাছে পাঠাতে। যখন যিয়াদ তাকে গ্রেফতার করতে চাইলো তার গোত্রের লোকেরা উঠে দাঁড়ালো এবং তাকে রক্ষা করলো। হুজর তাদের থামালেন এবং তাকে শিকলে বাঁধা হলো ও মুয়াবিয়ার কাছে পাঠানো হলো। যখন তিনি মুয়াবিয়ার কাছে গেলেন তিনি বললেন , শান্তিবর্ষিত হোক আমিরুল মুমিনীনের উপর। ” মুয়াবিয়া বললো , আমি কি আমিরুল মুমিনীন ? আল্লাহর শপথ আমি তোমাকে ক্ষমা করবো না এবং না তোমার কোন যুক্তি গ্রহণ করবো। তাকে নিয়ে যাও ও মাথা কেটে ফেলো। ” তার দায়িত্বে যারা ছিলো হুজর তাদেরকে বললেন , কমপক্ষে আমাকে দু রাদকাত নামায পড়তে দাও। ” তাকে সময় দেয়া হলো এবং তিনি তা দ্রুত সম্পাদন করলেন এবং বললেন , আমি যদি ভয় না পেতাম (যে পাছে তোমরা মনে কর আমি মৃত্যুকে ভয় করি) তাহলে আমি তা দীর্ঘায়িত করতাম। ” তখন তিনি যারা উপস্থিত ছিলো তাদের দিকে ফিরে বললেন , আমাকে কবর দাও শিকলগুলো ও আমার দেহের রক্তসহ , কারণ আমি আগামীকাল কিয়ামতের দিন উঁচু রাস্তায় মুয়াবিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করতে চাই। ”

আসাদুল গাবাহ ’ তে লেখা আছে যে হুজর ছিলেন তাদের একজন যারা ভাতা পেতেন দুহাজার পাঁচশত। তাকে শহীদ করা হয় ৫১ হিজরিতে এবং তার কবর আযরাতে সুপরিচিত এবং তিনি ছিলেন (অন্যদের জন্য) একজন অসিয়ত সম্পাদনকারী।

একই বইয়ের লেখক বলেন , ইমাম হোসেইন (আ.) যে চিঠি মুয়াবিয়াকে লেখেন তাতে এ কথাগুলো লেখা ছিলো ,

তুমি কি হুজর বিন আদি এবং অন্যান্য ইবাদতকারীদের হত্যাকারী নও যারা নিপীড়ন প্রতিরোধ করেছিলো এবং বিদ ’ আতকে গুরুতর অন্যায় মনে করতো এবং যারা আল্লাহর পথে কোন তিরস্কারকে ভয় করতো না ? তুমি তাদেরকে হত্যা করেছো নিপীড়ন ও অবিচারের মাধ্যমে যদিও তাদেরকে নিরাপত্তা দেয়ার অঙ্গীকার করেছিলে। ”