ইমাম হাসান রা: এর দৃষ্টিতে লাইফ স্টাইল

ইমাম হাসান রা: এর দৃষ্টিতে লাইফ স্টাইল0%

ইমাম হাসান রা: এর দৃষ্টিতে লাইফ স্টাইল লেখক:
প্রকাশক: যাহরা একাডেমী ক্বোম, ইরান
বিভাগ: ইমাম হাসান (আ.)

ইমাম হাসান রা: এর দৃষ্টিতে লাইফ স্টাইল

লেখক: আবদুল্লাহ
প্রকাশক: যাহরা একাডেমী ক্বোম, ইরান
বিভাগ:

ভিজিট: 5183
ডাউনলোড: 2177

পাঠকের মতামত:

ইমাম হাসান রা: এর দৃষ্টিতে লাইফ স্টাইল
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 57 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 5183 / ডাউনলোড: 2177
সাইজ সাইজ সাইজ
ইমাম হাসান রা: এর দৃষ্টিতে লাইফ স্টাইল

ইমাম হাসান রা: এর দৃষ্টিতে লাইফ স্টাইল

লেখক:
প্রকাশক: যাহরা একাডেমী ক্বোম, ইরান
বাংলা

ইমাম হাসান রা: এর দৃষ্টিতে

লাইফ স্টাইল

আবদুল্লাহ

যাহরা একাডেমী , কোম , ইরান

ইমাম হাসান রা: এর দৃষ্টিতে লাইফ স্টাইল

লেখক : আবদুল্লাহ

সম্পাদক : শারীফা খাতুন

প্রকাশক : যাহরা একাডেমী , কোম , ইরান।

প্রকাশকাল : জানুয়ারী- 2016

সম্পাদকীয়

মহানবী স. তাঁর পবিত্র বিদায় হজ্বের ভাষণে বলেন: হে লোকসকল! আমি তোমাদের মাঝে দুটি মূল্যবান বস্তু রেখে যাচ্ছি , এর একটি হলো আল্লাহর কিতাব , আর অপরটি হলো আমার আহলে বাইত। এরা হাওজে কাওসারে আমার সাথে মিলিত হওয়ার আগ পর্যন্ত একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না।1

অতএব আমাদেরকে ইহকালে শান্তি এবং পরকালে মুক্তি পেতে হলে কুরআন শরীফ এবং আহলে বাইতের অনুসরণ করা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। মহানবী স. এর পবিত্র আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য হলেন ইমাম হাসান রা: যিনি 7 বছর মহানবীর সাহচর্যে থেকে ইল্ম ও আমলের দিক থেকে সবার মডেলে রুপান্তরিত হন।

লাইফ স্টাইল বা জীবনযাপন পদ্ধতি সম্পর্কে ইমাম হাসান রা: অনেক হাদীস বলে গেছেন যা অধ্যায়ন করে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করলে ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রে আমরা সুখ শান্তি ফিরে পাব। আর প্রতিষ্ঠিত হবে দূর্নীতি ও সন্ত্রাসমুক্ত ইসলামী সমাজ।

আজকে সকল অশান্তির মূল কারণ হলো আমরা আহলে বাইতের আদর্শ থেকে দূরে সরে গেছি। যে আহলে বাইতকে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পাক পবিত্র বলে ঘোষণা দিয়েছেন তাদেরকে বাদ দিয়ে এমন ব্যক্তিদের অনুসরণ করছি যাদের নিষ্পাপতার কোন দলীল নেই।

অতএব আমাদের উচিত তাদেরকে অনুসরণ করা যাদেরকে আল্লাহ তাআলা মাসুম বা নিষ্পাপ বলে ঘোষণা দিয়েছেন এবং সেই সঙ্গে তাদেরকে অনুসরণ করারও নির্দেশ দিয়েছেন। তাদের অনুসরণ করতে হলে প্রথমে তাদের বক্তব্য ও আদর্শ সম্পর্কে জানতে হবে। আর এ উদ্দেশ্য নিয়েই আমাদের এ ক্ষুদ্র প্রয়াস। আল্লাহ আমাদের সকলের প্রচেষ্টাকে কবুল করুন। আমিন।

ইমাম হাসান রা: এর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

নবী বংশের দ্বিতীয় ইমামের নাম ইমাম হাসান রা:।

ইমাম হাসান রা: এর জন্ম হয়েছিল 3 হিজরীর 15 রমজান মঙ্গলবার মদীনার কুরাইশ বংশে। ইমামতি ধারার দ্বিতীয় ইমাম হযরত হাসান রা: ছিলেন প্রথম ইমাম হযরত আলী রা: ও খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতেমা রা: এর বড় ছেলে এবং হযরত মুহাম্মাদ স. এর প্রিয় নাতি ও হযরত আবু তালিবের প্রিয় পোত্র। ইমাম হাসান রা: এর মূল নাম আল হাসান। আল মুজতাবা ছিল তাঁর উপাধি। আর আবু মুহাম্মাদ ছিল তাঁর ডাক নাম।

নাতির জন্মের সুসংবাদ শুনেই নবীজী স. প্রিয় কন্যার ঘরে যান এবং নবজাতক শিশুকে কোলে তুলে নেন। তিনি শিশুর ডান কানে আজান ও বাম কানে একামত দেন এবং আল্লাহর আদেশে তাঁর নাম রাখেন আল হাসান।

ইমাম হাসান রা: এর বাল্য জীবনের প্রথম পর্যায়ের 7 বছর অতিবাহিত হয় মহানবী হযরত মুহাম্মদ স. এর কাছে। তাঁর স্নেহভরা ও মহানুভব পৃষ্ঠপোষকতায় ইমাম হাসান রা: এর মধ্যে তাঁর সকল সৎগুণের বিকাশ ঘটে। মহানবী স. এর উপর যখনই কোন ওহী অবতীর্ণ হতো এবং তা তিনি তাঁর সাহাবীদের কাছে প্রকাশ করতেন তখনই ইমাম হাসান রা: তা অবহিত হতেন।

মহানবী স. নতুন নাজিল হওয়া কোন ওহী হযরত ফাতেমা রা: এর কাছে ব্যক্তিগতভাবে জানানোর আগেই তিনি তা হুবহু তেলাওয়াত করে শুনিয়ে তাঁকে হতবাক করে দিতেন। এ ব্যাপারে হযরত ফাতেমা রা: কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জানান , ইমাম হাসান রা: এর মাধ্যমে ঐ ওহী সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। ইমাম হাসান রা: শান্তিপূর্ণ পথে ইসলামের প্রচার ও শিক্ষা বিস্তারের পবিত্র মিশনে নিজেকে নিষ্ঠার সাথে নিয়োজিত রাখেন।

ইমাম হাসান রা: তাঁর পিতা আমিরুল মোমেনীন ইমাম আলী রা: এর শাহাদাতের পর ইমামতের দায়িত্ব লাভ করেন। ঐ সময় তাঁর বয়স হয়েছিল 37 বছর। একই সাথে তিনি 6 মাসব্যাপী খেলাফতের দায়িত্বও পালন করেন। কিন্তু ইমাম হাসান রা: তাঁর পরিবারের শত্রু মুয়াবিয়ার চক্রান্তের ফলে খেলাফতের দায়িত্ব তার কাছে ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। তবে শর্ত ছিল যে , মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর খেলাফত পুনরায় ইমাম হাসান রা: এর কাছে ফেরত দেয়া হবে। কিন্তু ক্ষমতা গ্রহণের পর মুয়াবিয়া প্রকাশ্য ভাষণে শান্তি-সমঝোতা বাতিল বলে ঘোষণা করে এবং মৃত্যুর আগে নিজ পুত্র পাপাচারী ইয়াজিদকে ক্ষমতায় বসিয়ে যায়।

তাকওয়া-পরহেজগারীর দিক দিয়ে ইমাম হাসান ছিলেন তাঁর পিতা ইমাম আলী রা: এর মতই এবং নানা মহানবী স. এর এক খাঁটি অনুসারী। ইমাম হাসান রা: এর বিলাসী জীবন যাপনের পর্যাপ্ত সুযোগ ছিল , কিন্তু তিনি তাঁর সব সম্পদ দরিদ্রদের কল্যাণে ব্যয় করেছেন।

ইমাম হাসান রা: ছিলেন অত্যন্ত সৌজন্যবোধসম্পন্ন ও নিরহংকারী মানুষ। রাস্তায় ভিক্ষুকদের পাশে গিয়ে বসতে তাঁর কোন দ্বিধা ছিল না। ধর্মীয় বিষয়াদিতে জিজ্ঞাসার জবাব দিতে তিনি মদীনার পথেও বসে যেতেন। তিনি অত্যন্ত সম্প্রীতিবোধসম্পন্ন ও অতিথিপরায়ণ ছিলেন এবং কোন দরিদ্র ও নিঃস্ব লোক তাঁর বাড়িতে গেলে তিনি তাদেরকে কখনই খালি হাতে ফিরিয়ে দেননি। ইমাম হাসান রা: 50 হিজরীর 28 সফর মাত্র 46 বছর বয়সে মদীনায় শাহাদাত বরণ করেন। মদীনার জান্নাতুল বাকীতে তাঁর মাজার রয়েছে।2

মহানবী স. ইমাম হাসান রা: সম্পর্কে বলেন:

হাসান ও হোসাইন বেহেশতের যুবকদের সর্দার।3

ইমাম হাসান রা: এর দৃষ্টিতে লাইফ স্টাইল

ভূমিকা

ভালোভাবে জীবনযাপন করতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই লাইফ স্টাইল বা জীবনযাপন পদ্ধতি সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত হতে হবে। আর যে লাইফ স্টাইল আমরা গ্রহণ করব তা যদি ইসলামী শরীয়তের বিরোধী হয় তাহলে তা দিয়ে আমরা আমাদের জীবনের আসল লক্ষ্যে কখনো পৌঁছতে পারব না।

আর তাই সঠিক লাইফ স্টাইল সম্পর্কে জানার জন্য আমরা এ বইয়ে মহানবীর পবিত্র আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য ইমাম হাসানের 50 টি হাদীসের মাধ্যমে একটি সঠিক ধারণা পাঠকদের কাছে তুলে ধরতে চাই।

1) সর্বোত্তম ব্যক্তির পরিচয়

ইমাম হাসান রা: সর্বোত্তম ব্যক্তির পরিচয় সম্পর্কে বলেন

النَّاسُ أَرْبَعَةٌ فَمِنْهُمْ مَنْ لَهُ خُلُقٌ وَ لَا خَلَاقَ لَهُ وَ مِنْهُمْ مَنْ لَهُ خَلَاقٌ وَ لَا خُلُقَ لَهُ قَدْ ذَهَبَ الرَّابِعُ وَ هُوَ الَّذِي لَا خَلَاقَ وَ لَا خُلُقَ لَهُ وَ ذَلِكَ شَرُّ النَّاسِ وَ مِنْهُمْ مَنْ لَهُ خُلُقٌ وَ خَلَاقٌ فَذَلِكَ خَيْرُ النَّاسِ

অর্থ

মানুষ 4 ধরণের:

1। কিছু লোকের ভালো চরিত্র আছে কিন্তু সম্পদ নাই।

2। কিছু লোকের সম্পদ আছে কিন্তু ভালো চরিত্র নাই।

3। কিছু লোকের না ভালো চরিত্র আছে আর না কোন সম্পদ আছে। এরা হলো সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি।

4। আর কিছু লোকের ভালো চরিত্রও আছে আবার সম্পদও আছে। এরা হলো সর্বোত্তম ব্যক্তি।4

2) উন্নতির মাধ্যম

প্রতিটি ব্যক্তিই চাই তার জীবনে যেন উন্নতি হয় , তবে সঠিক রাস্তা জানা না থাকার কারণে অনেকেই উন্নতি করতে পারে না। ইমাম হাসান রা: পরামর্শকে উন্নতির সোপান হিসেবে তুলে ধরে বলেন

ما تشاور قوم إلا هدوا إلى رشدهم

অর্থ

"পরামর্শের মাধ্যমে একটি জাতি উন্নতির পথে এগিয়ে যায়।"5

পরামর্শের গুরুত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআন মাজিদে বলেন

وَ أَمْرُهُمْ شُورى‏ بَيْنَهُمْ

অর্থাৎ ঈমানদার ব্যক্তিদের একটি অন্যতম বৈশিষ্ঠ হলো তারা তাদের কাজসমূহ পরামর্শের ভিত্তিতে পরিচালনা করে।6

তবে পরামর্শের সময় অবশ্যই জ্ঞানী , সাহসী ও অভিজ্ঞ ব্যক্তির সাথে পরামর্শ করতে হবে যাতে তার কাছ থেকে সঠিক রাস্তা পাওয়া যায়। তাই মহানবী স. হযরত আলী রা: কে বলেন

হে আলী! ভীতু ব্যক্তির সাথে পরামর্শ করবে না , কারণ সে মুক্তির পথকে তোমার সামনে বন্ধ করে দিবে , কৃপণ ব্যক্তির সাথে পরামর্শ করবে না , কারণ সে তোমাকে তোমার উদ্দেশ্য থেকে দূরে ঠেলে দিবে , আর লোভী ব্যক্তির সাথে পরামর্শ করবে না , কারণ সে লোভ লালসাকে তোমার সামনে সঠিক রাস্তা হিসেবে তুলে ধরবে।

3) চালচলন পদ্ধতি

মানুষ চাই সবাই যেন তাকে সম্মান করে , তার সাথে ভাল ব্যবহার করে , এমনকি যাদের ব্যবহার খারাপ তারাও চায় অন্যরা যেন তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করে। তবে অন্যদের থেকে ভালো আচরণ পেতে হলে কি করতে হবে এ সম্পর্কে ইমাম হাসান রা: বলেন

صَاحِبِ النَّاسَ مِثْلَ مَا تُحِبُّ أَنْ يُصَاحِبُوكَ بِهِ

অর্থ

"মানুষের সাথে সেরূপ ব্যবহার কর যেরূপ ব্যবহার তাদের থেকে পছন্দ কর।"7

অতএব প্রথমে আমাদের নিজেদের থেকে শুরু করতে হবে। আমরা যদি আমাদের চালচলনকে সংশোধন করতে পারি তাহলে একসময় দেখব যারা আমাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করত তারাও তাদের ব্যবহারকে সংশোধন করেছে।

আমরা স্বয়ং ইমাম হাসানের জীবনীতে দেখতে পাই যে , এক ব্যক্তি তাকে অনেক গালিগালাজ করা সত্বেও তিনি তার সাথে মিষ্টি ব্যবহার করেন। এতে ঐ ব্যক্তি মুগ্ধ হয়ে সাথে সাথে নিজের ভুল স্বীকার করে ইমামের ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হয়।

4) উত্তম চরিত্রের গুরুত্ব

নবী রাসুল প্রেরণের একটি বিরাট উদ্দেশ্য ছিল মানুষের চরিত্র সংশোধন। কারণ চরিত্র ভালো না হলে একটি মানুষ পরিপূর্ণতায় পৌঁছতে পারে না। ইনসানে কামেল বা পরিপূর্ণ মানব হতে হলে অবশ্যই উত্তম চরিত্রের অধিকারী হতে হবে। এ সম্পর্কে ইমাম হাসান রা: বলেন

إِنَّ أَحْسَنَ الْحَسَنِ الْخُلُقُ الْحَسَنُ

অর্থ

"উত্তম কাজসমূহের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম হলো উত্তম চরিত্র।"8

আমরা ইসলামের ইতিহাসের প্রতি নজর দিলে দেখতে পাই যে , আল্লাহর রাসুলের উত্তম চরিত্রে মুগ্ধ হয়ে অনেক কাফের ইসলাম গ্রহণ করেছেন। অল্প সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ইসলাম ছড়িয়ে পড়ার একটি কারণ ছিল মহানবীর উত্তম চরিত্র। অতএব আমরা যদি উত্তম চরিত্রের অধিকারী হতে পারি তাহলে আজকেও স্বল্প সময়ের মধ্যে গোটা বিশ্বে ইসলামের পতাকা উত্তোলিত হবে।

5) উপহাসের পরিনাম

আমরা অনেক সময় একজনকে হাসানোর জন্য অন্যজনকে নিয়ে উপহাস ও ঠাট্টা বিদ্রুপ করি। আর এর মাধ্যমে শুধু অন্যের মনে কষ্টই দিই না বরং নিজেদেরও অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করি। উপহাসের সেই ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে মহানবী স. এর প্রিয় নাতি ইমাম হাসান রা: বলেন

المزاح يأكل الهيبة

অর্থ

"উপহাস ব্যক্তিত্বকে ধ্বংস করে দেয়।"9

আসলে যারা অপরকে নিয়ে উপহাস করে তারা প্রকৃতপক্ষে নিজেদেরকে নিয়েই উপহাস করে , কারণ এর মাধ্যমে তারা মনের অজান্তে নিজেদের অবস্থানকে অপরের সামনে ছোট করে দেয়।

পবিত্র কুরআন মাজিদে আল্লাহ তাআলা বলেন

হে ঈমানদারগণ! (পুরুষদের) একটি দল যেন অন্য দলকে উপহাস না করে , হতে পারে যাদেরকে উপহাস করা হচ্ছে তারাই উপহাসকারীদের থেকে উত্তম। আর মহিলাদেরও একটি দল যেন অন্য দলকে উপহাস না করে , হতে পারে যাদেরকে উপহাস করা হচ্ছে তারাই উপহাসকারীদের থেকে উত্তম।10

6) কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন না করার ফল

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে যেসব নিয়ামত দান করেছেন সেগুলোর শুকরিয়া আদায় করা আমাদের কর্তব্য। আমরা যদি শুকরিয়া আদায় করি তাহলে মহান আল্লাহ তার নিয়ামতের পরিমাণ বাড়িয়ে দিবেন , আর যদি হীনমন্যতার স্বীকার হয়ে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা থেকে বিরত থাকি তবে আমরা কঠিন শাস্তিতে আক্রান্ত হব। ইমাম হাসান রা: এ সম্পর্কে বলেন

اللُّؤْمُ أَنْ لَا تَشْكُرَ النِّعْمَةَ

অর্থ

"নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন না করা হলো নিচুতা ও হীনমন্যতা"11

নিয়ামতের শুকরিয়া আদায়ের পদ্ধতি:

হাদীস শরীফে এসেছে ইমাম জাফর সাদেক আ: এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলেন: তোমাদের এলাকায় কেমন আছ ?

উত্তরে সে বলল: হে রাসুলের সন্তান! ভাল আছি। আল্লাহ আমাদের উপর অনুগ্রহ করলে শুকরিয়া আদায় করি , আর অনুগ্রহ না করলে ধৈর্য্য ধরে থাকি।

তখন ইমাম বললেন: আরবের কুকুরও এরকম।

তখন সে বলল: তাহলে কী বলব ?

ইমাম বললেন: বল যে , আল্লাহ নিয়ামত দান করলে তার রাস্তায় খরচ করি , আর নিয়ামত থেকে বঞ্চিত করলে শুকরিয়া আদায় করি।12 (কারণ আল্লাহ যা করেন তা বান্দাদের মঙ্গলের জন্যই করেন)

7) প্রতিবেশীর সাথে ভালো ব্যবহার

বাড়ির চারদিকে চল্লিশ ঘর পর্যন্ত যারা বসবাস করে তাদেরকে বলা হয় প্রতিবেশী।13 প্রতিবেশীর হক আদায় করা সকলের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য। যে তার প্রতিবেশীকে কষ্ট দিবে সে বেহেশতের ঘ্রাণ থেকেও বঞ্চিত হবে। আর তার স্থান হবে জাহান্নাম। ফেরেশতা জিবরাঈল আল্লাহর রাসুলকে প্রতিবেশীর হক আদায়ের ব্যপারে এত নসীহত করতেন যে , তিনি মনে করেছিলেন প্রতিবেশীকে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী বানিয়ে দেয়া হবে।14 প্রতিবেশীর সাথে ভালো ব্যবহারের ব্যপারে ইমাম হাসান রা: বলেন

أَحْسِنْ جِوَارَ مَنْ جَاوَرَكَ تَكُنْ مُسْلِما

অর্থ

"প্রতিবেশীর সাথে উত্তম ব্যবহার কর , যাতে করে প্রকৃত মুসলিম হতে পার।"15

এক ব্যক্তি ইমাম হাসানকে বলল: আমার প্রতিবেশী আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। ইমাম তাকে বললেন: তুমি মাগরিব নামাজের পর 2 রাকাত নামাজ পড়ে এ দুয়াটি পাঠ করবে:

يَا شَدِيدَ المِحَالِ، يَا عَزِيزُ اَذلَلتَ بِعِزَّتِكَ جَمِيعَ مَا خَلَقتَ، اِكفِنِى شَرَّ فُلَانٍ بِمَا شِئتَ‏

লোকটি যে রাতে এ আমল করল সে রাতেই ঐ প্রতিবেশী মারা যায়।16

8) বুদ্ধিমান ব্যক্তির কর্তব্য

আক্ল বা বুদ্ধি এক অমুল্য সম্পদ যা আল্লাহ তার বান্দাদেরকে দান করেন। বুদ্ধিমান ব্যক্তির বৈশিষ্ঠ্য হলো 10 টি: যার থেকে অন্যরা কল্যাণ আশা করে , যার অনিষ্ঠতা থেকে মানুষ নিরাপদ , যে নিজের ভালো কাজকে ছোট এবং অন্যের ভালো কাজকে বড় মনে করে , জ্ঞান অন্বেষণ করা থেকে নিরাশ হয় না , স্বীয় প্রয়োজন পূরণার্থে আল্লাহর কাছে দোয়া করে , প্রসিদ্ধ হওয়ার চেয়ে নামবিহীন হিসেবে থাকাকে বেশী পছন্দ করে , ধন সম্পদের চেয়ে দারিদ্রকে বেশী পছন্দ করে , দুনিয়ায় যা নিজের ভাগ্যে জুটে তাতেই খুশি থাকে , অন্যদেরকে নিজের চেয়ে বেশী ভালো ও ঈমানদার মনে করে।17

যে ব্যক্তির এ বৈশিষ্ঠ্যগুলো থাকবে তার কাছে কেউ নসীহত চাইলে প্রতারিত হবে না। আর এ সম্পর্কে ইমাম হাসান রা: বলেন

لَا يَغُشُّ الْعَاقِلُ مَنِ اسْتَنْصَحَهُ

অর্থ

"বুদ্ধিমান ব্যক্তির কাছে উপদেশ চাওয়া হলে সে ধোঁকা দেয় না।"18

অতএব কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তির কাছে উপদেশ বা কোন বিষয়ে পরামর্শ চাইলে সে যদি ধোঁকা দেয় তাহলে মনে করতে হবে , সে আসলে বুদ্ধিমান নয় বরং একটি প্রতারক।

9) আল্লাহর ইবাদতের ফল

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানব জাতিকে একমাত্র তার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবীর সবকিছু মানুষের জন্য , কিন্তু মানুষকে আল্লাহর জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। কারো ইবাদতের প্রতি আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই , বরং মানুষ যেন সম্মান ও মর্যাদার সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করতে পারে এজন্য ইবাদতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইবাদত মানুষকে কলুষতা থেকে মুক্ত করে আলোর পথ দেখায়। আল্লাহর ইবাদতের মাধ্যমে মানুষ পারে সবাইকে নিজের অনুগত করতে। ইমাম হাসান রা: এ সম্পর্কে বলেন

مَنْ عَبَدَ اللَّهَ عَبَّدَ اللَّهُ لَهُ كُلَّ شَيْ‏ءٍ

অর্থ

"যে ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদত করবে আল্লাহ সব কিছুকে তার অনুগত করে দিবেন।"19

সর্বোত্তম ইবাদত কোনটি ?

মানুষ 3 রকম ভাবে আল্লাহর ইবাদত করে

1। একদল মানুষ বেহেশতের লোভে আল্লাহর ইবাদত করে। এটি হলো ব্যবসায়ীদের ইবাদত।

2। আরেকদল জাহান্নামের ভয়ে আল্লাহর ইবাদত করে। এটি হলো পরাধীন ব্যক্তিদের ইবাদত।

3। আরেক দল মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের জন্য ইবাদত করে। এটি হলো স্বাধীন ব্যক্তিদের ইবাদত এবং এটিই সর্বোত্তম ইবাদত।20

10) প্রকৃত আপনজন

যতক্ষন পর্যন্ত বন্ধুত্বের দিক থেকে কেউ নিকটে না আসবে ততক্ষণ পর্যন্ত শুধুমাত্র বংশ পরিচয় মানুষকে নিকটে নিয়ে আসতে পারে না। আবু লাহাব নবীর চাচা হওয়া সত্বেও যেহেতু নবীকে বন্ধু হিসেবে মেনে নিতে পারেনি সেহেতু সে নবীর থেকে অনেক দূরে চলে গেছে , অপরদিকে হযরত সালমান ফারসি ইরানের অধিবাসী হওয়া সত্বেও মহানবীকে জান প্রাণ দিয়ে ভালবাসার কারণে নবীর আহলে বাইতের অন্তর্ভূক্ত হয়েছে।21

অতএব কে আমাদের আপনজন তা জানতে হলে দেখতে হবে বন্ধুত্বের দিক থেকে কে কাছাকাছি অবস্থান করছে। এ সম্পর্কে বেহেশতের যুবকদের সর্দার হযরত ইমাম হাসান রা: বলেন

الْقَرِيبُ مَنْ قَرَّبَتْهُ الْمَوَدَّةُ وَ إِنْ بَعُدَ نَسَبُهُ وَ الْبَعِيدُ مَنْ بَعَّدَتْهُ الْمَوَدَّةُ وَ إِنْ قَرُبَ نَسَبُهُ

অর্থ

"আপনজন হলো সে ব্যক্তি যে বন্ধুত্বের কারণে নিকটে থাকে , যদিও সে বংশের দিক থেকে দূরে। আর দূরতম ব্যক্তি হলো যাকে বন্ধুত্ব দূরে ঠেলে দেয় (অর্থাৎ বন্ধুত্ব না করে দূরে দূরে থাকে) যদিও সে বংশের দিক থেকে নিকটে।"22

11) অপরাধীর মাফ চাওয়ার সুযোগ

অপরাধ দুধরনের। কিছু অপরাধ আল্লাহর হকের সাথে সংশ্লিষ্ট , সেগুলোর ক্ষেত্রে মাফ করার কোন সুযোগ নেই। বরং ঐসব অপরাধের জন্য যে শাস্তি ইসলামে নির্ধারণ করা হয়েছে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। যেমন: ব্যভিচারের শাস্তি , মিথ্যা অপবাদের শাস্তি , মদপানের শাস্তি , চোরের শাস্তি ইত্যাদি।

আর যেসব অপরাধ মানুষের হকের সাথে সংশ্লিষ্ট সেগুলোর ক্ষেত্রে অপরাধী মাফ চাইলে তাকে ক্ষমা করে দেয়ার সুযোগ রয়েছে। আর তাই ইমাম হাসান রা: বলেন

لَا تُعَاجِلِ الذَّنْبَ بِالْعُقُوبَةِ وَ اجْعَلْ بَيْنَهُمَا لِلِاعْتِذَارِ طَرِيقاً

অর্থ

"অপরাধীকে শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া করো না। বরং তাকে মাফ চাওয়ার সুযোগ দাও।"23

12) খোদাভীরূর সাথে মেয়ের বিয়ে

আজকে আমাদের সমাজে অহরহ নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায় যৌতুক বা নেশার কারণে স্ত্রীর উপর স্বামীর নির্যাতনের খবর। এর মূল কারণ হলো উপযুক্ত পাত্রের সাথে মেয়ের বিয়ে না দেয়া। বিয়ের সময় পাত্রের ধন সম্পদের দিকে যেভাবে নজর দেয়া হয় সেভাবে যদি তার ধর্মীয় অবস্থার দিকেও নজর দেয়া হয় তাহলে আস্তে আস্তে পত্রিকার পাতা থেকে এ খবরসমূহ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। প্রতিষ্ঠিত হবে নারী নির্যাতন মুক্ত ইসলামী সমাজ। পারিবারিক কলহ দূরীভূত হয়ে ফিরে আসবে সুখ শান্তির আমেজ।

এক ব্যক্তি ইমাম হাসানের নিকট ভালো পাত্রের বৈশিষ্ঠ্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে ইমাম তাকে বলেন

زوجها من رجل تقي فإنه إن أحبها أكرمها و إن أبغضها لم يظلمها

অর্থ

"পরহেজগার লোকদের সাথে তোমাদের মেয়ের বিবাহ দাও। কারণ তারা তোমাদের মেয়েকে পছন্দ করলে তাকে সম্মান করবে , আর তাকে পছন্দ না করলেও তার উপর জুলুম করা থেকে বিরত থাকবে।"24

13) আল্লাহর আনুগত্যের ফল

আল্লাহর আনুগত্য থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারনে আজকে মুসলিম জাতি বিভিন্ন দলে বিভক্ত। বিশ্বে মুসলমানদের সংখ্যা 150 কোটির বেশী হওয়া সত্বেও তারা একদিকে কাফেরদের হাতে লাঞ্ছিত হচ্ছে , অপরদিকে ইরাক , সিরিয়া ও ইয়েমেনে মুসলমান নামধারী সন্ত্রাসীদের হাতে নির্যাতিত হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে মুসলমানদের মুক্তির একটি উপায় হলো আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্যের দিকে ফিরে আসা। যতদিন পর্যন্ত আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য সমাজে প্রতিষ্ঠিত না হবে ততদিন অনৈক্য দূরীভূত হবে না। এ সম্পর্কে ইমাম হাসান রা: বলেন

لَوْ أَنَّ النَّاسَ سَمِعُوا قَوْلَ اللَّهِ وَ رَسُولِهِ لَأَعْطَتْهُمُ السَّمَاءُ قَطْرَهَا وَ الْأَرْضُ بَرَكَتَهَا وَ لَمَا اخْتَلَفَ فِي هَذِهِ الْأُمَّةِ سَيْفَانِ وَ لَأَكَلُوهَا خَضْرَاءَ خَضِرَةً

অর্থ

মানুষ যদি আল্লাহ ও তার রাসুলের কথা শুনত তাহলে আসমান রহমতের বৃষ্টি বর্ষণ করত এবং জমিন তার বরকতসমূহ দান করত। আর এ উম্মতের মধ্যে কোন ধরণের অনৈক্য সৃষ্টি হত না। আর তারা কিয়ামত পর্যন্ত সবুজ শ্যামল দুনিয়ার নেয়ামত থেকে উপকৃত হত।25

14) প্রকৃত কল্যাণ

মানুষ অনেক সময় কোন একটি জিনিসকে কল্যাণকর মনে করে তা কামনা করে , কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ঐ জিনিস তার জন্য ক্ষতিকর। আবার অনেক সময় কোন একটি জিনিসকে ক্ষতিকর মনে করে তা অপছন্দ করে , কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ঐ জিনিস তার জন্য কল্যাণকর। এজন্য আমাদের সকলের উচিত প্রকৃত কল্যাণ সম্পর্কে অবগত থাকা। ইমাম হাসান রা: এ সম্পর্কে বলেন

الْخَيْرُ الَّذِي لَا شَرَّ فِيهِ الشُّكْرُ مَعَ النِّعْمَةِ وَ الصَّبْرُ عَلَى النَّازِلَةِ

অর্থ

যে কল্যাণের মধ্যে কোন ধরণের ক্ষতি নাই তা হলো নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা এবং বিপদে ধৈর্যধারণ করা।26

নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করার অর্থ হলো যখনই কোন নেয়ামত আল্লাহর পক্ষ থেকে আসবে তখন সেটাকে আল্লাহর রাস্তায় ব্যবহার করা। কারণ প্রতিটি নেয়ামত আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের কাছে আমানত স্বরূপ। অতএব সে আমানতকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে।

আর বিপদে ধৈর্যধারণ করার অর্থ হলো বালা মুসিবত দেখে ভয় না পাওয়া , বরং বালা মুসিবতকে এক ধরনের নেয়ামত মনে করা।27 কারণ বালা মুসিবতের মধ্য দিয়েই মানুষ উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করে।

15) সত্যকে আঁকড়ে ধরা

মহানবী স. এর পবিত্র আহলে বাইত সবসময় সত্যের উপর ছিলেন। তারা কখনো অসত্যের ধারে কাছে যেতেন না। ইমাম হাসান রা: এ সম্পর্কে বলেন

إِنَّا أَهْلُ بَيْتٍ إِذَا عَلِمْنَا الْحَقَّ تَمَسَّكْنَا بِهِ

অর্থ

আমরা নবীর আহলে বাইত যখনই সত্যকে চিনতে পেরেছি সেটাকে আঁকড়ে ধরেছি।28

অতএব প্রতিটি মুসলমানের উচিত সত্যকে জানার সাথে সাথে তা কবুল করা এবং সে অনুযায়ী আমল করা।

যারা সত্যকে জানার পরও তার বিরোধীতা করেছে তাদের সংখ্যা ইসলামের ইতিহাসে কম নয়। আমরা দেখতে পাই , কারবালার ময়দানে যারা ইমাম হুসাইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল তারা সবাই জানত যে , ইমাম হুসাইন রা: সত্যপথে আছেন। কিন্তু এটা জানার পরও শুধুমাত্র দুনিয়ার লোভ লালসায় পড়ে তারা মহানবীর প্রিয় নাতিকে 72 জন সঙ্গী সহ নৃশংসভাবে শহীদ করে নিজেদের দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতকে ধ্বংস করে।