কোরআনের পরিচয়

কোরআনের পরিচয়0%

কোরআনের পরিচয় লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: কোরআন বিষয়ক জ্ঞান

কোরআনের পরিচয়

লেখক: নূর হোসেন মজিদী
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 20098
ডাউনলোড: 2766

কোরআনের পরিচয়
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 33 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 20098 / ডাউনলোড: 2766
সাইজ সাইজ সাইজ
কোরআনের পরিচয়

কোরআনের পরিচয়

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

অত্র গ্রন্থে কোরআন মজীদের বেশ কিছু আয়াত উদ্ধৃত হয়েছে এবং এ সব আয়াতের মধ্যে এমন আয়াতও রয়েছে যাতে আল্লাহ্ তা আলা নিজের জন্য উত্তম পুরুষে বহুবচন অর্থাৎ আমরা শব্দ ব্যবহার করেছেন। তৎকালীন আরবী বাকরীতিতে সর্বোচ্চ কর্তৃত্বশালীদের মুখে নিজের জন্য এক বচন অর্থেই আমরা ব্যবহারের প্রচলন ছিলো , এ কারণে তৎকালীন আরবের মোশরেকরা কোরআন মজীদে আল্লাহ্ তা আলা নিজের জন্য আমরা ব্যবহার করায় এ ব্যাপারে প্রশ্ন তোলে নি তথা একে বহু ঈশ্বরবাদের সপক্ষে প্রমাণ বলে দাবী করে নি। কিন্তু যদিও বাংলা সহ আরো অনেক ভাষায় সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব বা বিনয় প্রকাশের জন্য এর প্রচলন রয়েছে তথাপি বাংলা বাকরীতিতে অনেক ক্ষেত্রে এক ব্যক্তির পক্ষ থেকে বিনয়স্বরূপ আমরা এবং কর্তৃত্বভাব প্রকাশের জন্য আমি ব্যবহারেরও প্রচলন আছে। এ কারণে বাংলা ভাষায় আল্লাহ্ তা আলার জন্য আমরা ব্যবহার বেখাপ্পা শুনায় বিধায় আমরা এক বচনে এর অনুবাদ করেছি। অত্র গ্রন্থে এ ধরনের সকল আয়াতের ক্ষেত্রেই আমরা এ রীতি অনুসরণ করেছি।

বিসমিল্লাহ্ পাঠ নিয়ে বিতর্ক

এ বিষয়ে একটা আনুষঙ্গিক বিতর্ক এই যে , কোরআন মজীদের 114টি সূরাহর মধ্যে সূরাহ্ আত্-তাওবাহ্ বাদে 113টি সূরাহর শুরুতে যেبِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ রয়েছে তা সংশ্লিষ্ট সূরাহ্ সমূহের অংশ কিনা।

এ বিষয়ে ফক্বীহদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। ফক্বীহদের মধ্যে অনেকে মনে করেন যে , যে যে সূরাহর শুরুতেبِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ রয়েছে সে সে ক্ষেত্রে তা সংশ্লিষ্ট সূরাহর অংশ এবং কোরআন তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে যেমন ঐ সবبِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ যথাস্থানে তেলাওয়াত্ করতে হবে ঠিক সেভাবেই নামাযে কোনো সূরাহ্ পড়ার সময় (সূরাহ্ আত্-তাওবাহ্ বাদে) তাبِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ সহ পাঠ করতে হবে।

অন্য একদল ফক্বীহ্ মনে করেন যে , সূরাহ্ সমূহের শুরুতে যেبِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ রয়েছে তার মধ্যে কেবল সূরাহ্ আল্-ফাতেহার শুরুতে তা ঐ সূরাহর অংশ , অন্যান্য সূরাহর শুরুতে তা সংশ্লিষ্ট সূরাহ্ সমূহের অংশ নয়। সুতরাং নামাযে ঐ সব সূরাহর শুরুতে তা পাঠ করতে হবে না। তাঁদের মতে , ঐ সব সূরাহর শুরুতেبِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ লেখা হয়েছে বিভিন্ন সূরাহকে পরস্পর থেকে পৃথক করে দেখানোর জন্য।

আবার কেউ কেউ মনে করেন যে , সূরাহ্ আন্-নামল্-এর ভিতরে যেبِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ রয়েছে কেবল তা-ই কোরআন মজীদের অংশ ; সূরাহ্ আত্-তাওবাহ্ বাদে সূরাহ্ আল্-ফাতেহাহ্ সহ অন্যান্য সূরাহর শুরুতে যেبِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ রয়েছে তার কোনোটিই ঐ সব সূরাহর অংশ নয় , বরং কোরআন তেলাওয়াতبِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ বলে শুরু করা যরূরী বিধায় সূরাহ্ আল্-ফাতেহাহর শুরুতে এবং বিভিন্ন সূরাহর মধ্যে পার্থক্য নির্দেশের জন্য অন্যান্য সূরাহর শুরুতে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) স্বউদ্যোগে বা জিবরাঈলের পরামর্শে তা যোগ করেন।

কোরআন তেলাওয়াতের সময় সকল মুসলমানই কোরআন মজীদে লিখিত সবগুলোبِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ যথাস্থানে তেলাওয়াত করে থাকেন। কিন্তু এ মতপার্থক্যের কারণে প্রথমোক্ত মতের অনুসারীরা নামাযে প্রতিটি সূরাহর শুরুতে (সূরাহ্ আত্-তাওবাহ্ বাদে)بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ পাঠ করেন , দ্বিতীয় মতের অনুসারীরা নামাযে কেবল সূরাহ্ আল্-ফাতেহাহর শুরুতে তা পাঠ করেন এবং তৃতীয় মতের অনুসারীরা নামাযে কেবল প্রথম রাক্ আতে সূরাহ্ আল্-ফাতেহাহর শুরুতে তা পাঠ করে থাকেন।

এ মতপার্থক্য সম্বন্ধে কেবল এতোটুকু উল্লেখ করাই যথেষ্ট যে , এ মতপার্থক্য হচ্ছে কোরআন মজীদের ব্যাখ্যা ও ব্যবহার সংশ্লিষ্ট মতপার্থক্য ; এর সাথে কোরআন মজীদের অবিকৃত থাকা বা না-থাকার কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ , এ ব্যাপারে কোনোরূপ মতপার্থক্য নেই যে , স্বয়ং হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর নির্দেশে 114টি সূরাহর মধ্যে 113টির সূরাহর শুরুতেبِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ লেখা হয়েছে। সুতরাং এটা সন্দেহাতীত যে , কোরআন মজীদ তিনি যেভাবে রেখে গিয়েছেন তা সেভাবেই আছে ; তাতে কোনো ধরনের রদবদল হয় নি।

যদিও কোরআন মজীদ হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) যেভাবে রেখে গিয়েছেন ঠিক সেভাবেই আছে কিনা এ প্রশ্নের জবাব দেয়ার জন্য ওপরের আলোচনাই যথেষ্ট এবং মুসলিম মনীষীদের মধ্যকার উপরোক্ত বিতর্কের সমাধান করা অপরিহার্য মনে না হতে পারে , কিন্তু যেহেতু কোরআন মজীদ নাযিল্ হয়েছে ইলমী ও ইবাদী ব্যবহারের জন্য সেহেতু এ বিতর্কের অবসানও অপরিহার্য বলে আমরা মনে করি এবং এ কারণে এ বিষয়টির ওপর আলোকপাত করছি।

যারা মনে করেন যে , কোরআন মজীদের 114টি সূরাহর মধ্যে 113টির সূরাহর শুরুতে যেبِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ লেখা হয়েছে তা এ সব সূরাহর বা অন্ততঃ সূরাহ্ আল্-ফাতেহাহ্ বাদে 112টি সূরাহর অংশ নয় তাঁদের এ মত ঠিক নয় , বরং সূরাহ্ আত্-তাওবাহ্ বাদে বাকী 113টি সূরাহর ক্ষেত্রেইبِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ এ সব সূরাহর অংশ। কারণ , সূরাহ্ সমূহের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করাই যদি উদ্দেশ্য হতো তাহলে সে জন্য সূরাহ্ সমূহের শুরুতে ও/বা শেষে অন্য যে কোনো পার্থক্য নির্দেশক চিহ্ন বা সঙ্কেত বা শব্দ ব্যবহার করাই যথেষ্ট হতো , কোরআন মজীদেরই (সূরাহ্ আন্-নামল্-এর) একটি আয়াতকে এভাবে ব্যবহার করা হতো না।

এর পরেও আমরা যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেই যে ,بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ দুই সূরাহর পার্থক্য নির্দেশের জন্য লেখা হয়েছে তাহলে সূরাহ্ আত্-তাওবাহর শুরুতেও তা লেখা হতো এবং কোনো সূরাহর শুরুতেই তা তেলাওয়াত্ করা হতো না। আর যদি তা কেবল সূরাহ্ আল্-ফাতেহাহর শুরুতেই কোরআন মজীদের অংশ হতো তাহলে তা অন্য কোনো সূরাহর শুরুতে লেখা হতো না।

যারা মনে করেন যে , কোরআন তেলাওয়াতের জন্য যরূরী বিধায় এভাবে লেখা হয়েছে তাঁদের কথা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ , সে ক্ষেত্রে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর মৌখিক আদেশ ও আমলই যথেষ্ট হতো। এমনকি তা যদি সূরাহ্ আল্-ফাতেহাহর শুরুতেও এর অংশ না হতো তাহলে সেখানেও তা লেখা হতো না।بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ বলে কোরআন তেলাওয়াত্ শুরু করার প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে গোটা উম্মাহর মধ্যে মতপার্থক্য নেই , যদিও তা কি ফরয/ওয়াজিব্ নাকি সুন্নাত্ তা ভিন্ন আলোচ্য বিষয়। সুতরাং কোনো সূরাহর মাঝখান থেকে তেলাওয়াত্ শুরু করলে যেভাবে সংশ্লিষ্ট স্থানে লেখা না থাকা সত্ত্বেও নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর আমল অনুসরণেبِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ বলে তেলাওয়াত্ শুরু করা হয় , ঠিক সেভাবেই সূরাহর বা কোরআনের শুরু থেকে তেলাওয়াত্ করার ক্ষেত্রে সকলেই তা পড়ে তেলাওয়াত্ শুরু করতেন ; সূরাহ্ সমূহের শুরুতে লেখার প্রয়োজন হতো না।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে , কোরআন মজীদের শুরু থেকে বা কোনো সূরাহর শুরু থেকে বা কোনো সূরাহর মাঝখান থেকে - তথা যেখান থেকেই তেলাওয়াত শুরু করা হোক না কেন তাاعوذ بالله من الشيطان الرجيم বলে শুরু করা অপরিহার্য। কারণ , আল্লাহ্ তা আলা এরশাদ করেন:

অতএব , (হে রাসূল!) আপনি যখন কোরআন পাঠ করবেন তখন বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চান। (সূরাহ্ আন্-নাহল্: 98)

এমতাবস্থায় হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) যদি কোরআন তেলাওয়াতের শুরু সংক্রান্ত হুকুম পালনের কথা সকলকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য এবং সূরাহ্ সমূহের মধ্যকার পার্থক্য নির্দেশের জন্য কোনো কিছু যোগ করতে চাইতেন তাহলে প্রত্যেক সূরাহর শুরুতেاعوذ بالله من الشيطان الرجيم যোগ করাই হতো অধিকতর উত্তম। এমনকি সে ক্ষেত্রে সূরাহ্ আত্-তাওবাহর শুরুতেبِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ না লেখার যে কারণ সম্পর্কে সকলে একমতاعوذ بالله من الشيطان الرجيم লেখা হলে সে কারণ সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়াতো না।

এ থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে , কোরআন মজীদের 114টি সূরাহর মধ্যে 113টির শুরুতে যেبِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ লেখা হয়েছে তা হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) নিজের পক্ষ থেকে বা জিব্রাঈলের পরামর্শে লিপিবদ্ধ করান নি , বরং ঐ সূরাহ্গুলোبِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ সহই নাযিল্ হয়েছে এবং তা ঐ সব সূরাহর প্রথম আয়াত বা প্রথম আয়াতের অংশ।

এ মতের বরখেলাফে কোনোই অকাট্য দলীল বর্তমান নেই।

কতক কপিতে শব্দগত পার্থক্যের অভিযোগ

কোনো কোনো বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে যে , কোনো কোনো ছ্বাহাবীর নিকট কোরআন মজীদের যে নিজস্ব কপি ছিলো তাতে বর্তমানে প্রচলিত কোরআন মজীদ অর্থাৎ মুছ্বহাফে উছমান্ থেকে কতক শব্দের ও কতক শব্দের বানানে পার্থক্য ছিলো। এ ব্যাপারে ছ্বাহাবী উবাই বিন্ কা ব্-এর কপি সম্পর্কে বলা হয় যে , তাতে সূরাহ্ আল্-ফাতেহাহরو لا الضالين স্থলেغير الضالين লেখা ছিলো।

এ সম্বন্ধে বলতে হয় যে , যেহেতু এ সব বর্ণনা খবরে ওয়াহেদ্ , সেহেতু এগুলো গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ , যেভাবে সকল শীর্ষস্থানীয় ছ্বাহাবীর সহায়তাক্রমে সর্বত্র মুছ্বহাফে উছমান্ প্রচার করা হয়েছিলো এবং সকলকে নিজ নিজ কপি তার সাথে মিলিয়ে নিয়ে সংশোধনের নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো , আর এ নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত হয়েছিলো , এমতাবস্থায় কোনো ছ্বাহাবীর কপিতে তা থেকে কোনো শব্দগত পার্থক্য থাকার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ , ছ্বাহাবীরা যে কোরআন তেলাওয়াত করতেন তা কোনো গোপনীয় বিষয় ছিলো না , বিশেষ করে প্রত্যেক মুসলমানকে যেহেতু দৈনিক কয়েক বার নামাযে সূরাহ্ আল্-ফাতেহাহ্ পাঠ করতে হয় সেহেতু কারো পক্ষ থেকেو لا الضالين স্থলেغير الضالين পড়া ও তা গোপন রাখা সম্ভব ছিলো না , ফলে তাঁর মুছ্বহাফে কীরূপ লেখা ছিলো তা-ও গোপন থাকতো না। এমতাবস্থায় তাঁকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিবাদের সম্মুখীন হতে হতো এবং এ নিয়ে সংঘাতের সৃষ্টি হতো না। কিন্তু এ ধরনের কোনো বিরোধ-সংঘাতের কথা কোনো অকাট্য সূত্রেই জানা যায় না।

সুতরাং সর্বোচ্চ মুতাওয়াতির্ সূত্রে বর্ণিত গ্রন্থ কোরআন মজীদের মোকাবিলায় সন্দেহ সৃষ্টিকারী এ ধরনের দাবী সম্বলিত খবরে ওয়াহেদ্ বর্ণনাকে আদৌ সত্য বলে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। বরং এ ধরনের বর্ণনাসমূহ যে ইসলামের দুশমনদের দ্বারা অনুপ্রবিষ্ট মিথ্যা ছিলো এ ব্যাপারে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই।

ক্বিরাআতে বিভিন্নতার প্রশ্ন

অনেকে কোরআন মজীদের সাত , দশ বা ততোধিক বিখ্যাত পাঠ বা তেলাওয়াৎকেও কোরআনের অবিকৃত থাকার ওপর সংশয় সৃষ্টিকারী বলে মনে করেন। এ প্রশ্নটি তোলা হয় বিষয়টি সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণার অভাবে।

কোরআন মজীদের সাত , দশ বা ততোধিক বিখ্যাত পাঠ ( তেলাওয়াত্ )- এর উদ্ভব হয় কোরআন নাযিল্ ও গ্রন্থাবদ্ধ হওয়ার এবং অভিন্ন কপি প্রচারিত হওয়ার অ নেক পরে। আর এ বিষয়টি প্রায় পুরোপুরি তেলাওয়াতের সৌন্দর্যের সাথে সম্পৃক্ত ; এর সাথে কোরআন মজীদের পাঠ ( text)-এর কোনোই সাংঘর্ষিকতা নেই। অন্যদিকে তেলাওয়াত্ - সৌন্দর্যের প্রতি দৃষ্টি রেখে এ ধরনের বিভিন্ন পাঠের উদ্ভাবন এক ধরনের ইজতিহাদী বিষয় - যার কোনোটিকেই গ্রহণ ক রা অপরিহার্য নয় এবং এর বাইরেও যে কেউ যে কোনোভাবে তেলাওয়াত্ করতে পারে , কেবল শর্ত এই যে , কোরআন মজীদের পাঠ ( text)-এ কোনো রকমের হ্রাস - বৃদ্ধি করতে পারবে না , দীর্ঘ ও স্বল্পবিরতি ইত্যাদির ক্ষেত্রে ব্যাকরণিক বিষয়গুলো মেনে চলবে এবং অর্থে যাতে পরিবর্তন না ঘটে সেদিকে খেয়াল রাখবে।

কতক সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে , উপরোক্ত পাঠসমূহের উদ্ভাবকগণের মধ্যে কদাচিৎ কতক ক্ষেত্রে বর্ণ ও শব্দ সংক্রান্ত মতপার্থক্য ছিলো। আসলে এ ধরনের মতপার্থক্য আদৌ ছিলো কিনা তা নিশ্চিত নয়। কারণ , এ সব বর্ণনা মিথ্যাও হতে পারে। এমনকি এ সব বর্ণনা সত্য হলেও তাতে কিছুই আসে যায় না। কারণ , ছ্বাহাবীদের যুগ থেকে সর্বসম্মতভাবে চলে আসা মুছ্বহাফে উছ্মানের কোনো শব্দ বা বর্ণের ব্যাপারে পরবর্তীকালে কেউ ভিন্নমত পোষণ করে থাকলে (সত্যিই যদি কেউ করে থাকেন) তার যে কোনোই মূল্য নেই তা সুস্থ বিচারবুদ্ধির অধিকারী যে কেউই স্বীকার করতে বাধ্য।

অন্যদিকে তাঁদের মধ্যে হারাকাত , ই রাব্ ও যতির ব্যাপারেও কদাচিৎ মতপার্থক্য হয়েছে , কিন্তু তাতে কোরআন মজীদের মূল পাঠে (যাতে এগুলো ছিলো না) কোনোই পার্থক্য ঘটছে না। এরূপ ক্ষেত্রে যথাযথ ইলমী যোগ্যতার অধিকারীরা ব্যাকরণসম্মত ও সঠিক তাৎপর্যের প্রতি দৃষ্টি রেখে এ ধরনের মতপার্থক্যের নিরসন করতে সক্ষম। অবশ্য হারাকাত , ই রাব্ ও যতি সংক্রান্ত মতপার্থক্যগুলো খুবই গৌণ ও সংখ্যায়ও খুবই কম।

মতপার্থক্য যখন অকাট্যতার প্রমাণ

কোরআন মজীদের পাঠের বেলায় কতক ক্ষেত্রে হারাকাত , ই রাব্ ও যতির ব্যাপারে যে মতপার্থক্য ঘটেছে - তাৎপর্যের দৃষ্টিতে যা নেহায়েতই গৌণ , তা থেকে প্রমাণিত হয় যে , অতীতের কোরআন-বিশেষজ্ঞগণ এর নির্ভুল ও সুন্দরতম উচ্চারণ নিশ্চিতকরণ এবং তাৎপর্যের ক্ষেত্রে সামান্যতম দুর্বলতাকেও এড়াবার জন্য দারুণভাবে চেষ্টিত ছিলেন। এ কারণে তাঁরা তাঁদের পূর্ববর্তীদের দেয়া হারাকাত্ ও ই রাবের সাথে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মতপার্থক্য করেছেন। এ মতপার্থক্যের ভিত্তি ছিলো এই যে , যেহেতু এগুলো স্বয়ং রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ) থেকে আসে নি সেহেতু তাঁদের বিবেচনায় এগুলোতে কোনো দুর্বলতা থাকলে তা অবশ্যই সংশোধন করা উচিত। এ থেকে সুস্পষ্ট যে , যারা এহেন খুটিনাটি বিষয়ে এতো যত্নবান তাঁরা হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) থেকে সর্বোচ্চ মুতাওয়াতির্ সূত্রে বর্ণিত কোরআন মজীদের মূল পাঠে সামান্যতম এদিক-সেদিক হওয়া থেকেও কতো সচেতন ছিলেন। আর এ সচেতনতা ও সতর্কতা ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে।

একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানের হারাকাত্ প্রশ্নে মতপার্থক্য প্রসঙ্গে

অত্র গ্রন্থকারের জানামতে কোরআন মজীদের পাঠের ক্ষেত্রে হারাকাত্ সংক্রান্ত ভিন্নমতের ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে কেবল একটি হারাকাতের সাথে গুরুত্বপূর্ণ আমলী তথা ফিক্বহী প্রশ্ন জড়িত। তা হচ্ছে ওযূর আয়াত। এ আয়াতে এরশাদ হয়েছে:

) ي َا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا قُمْتُمْ إِلَى الصَّلاةِ فَاغْسِلُوا وُجُوهَكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ إِلَى الْمَرَافِقِ وَامْسَحُوا بِرُءُوسِكُمْ وَأَرْجُلَكُمْ إِلَى الْكَعْبَيْنِ(

হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখন নামাযে যাওয়ার উদ্দেশ্যে দণ্ডায়মান হবে তখন তোমরা তোমাদের চোহারাসমূহ ও হাতগুলো কনুই পর্যন্ত ধৌত করো এবং তোমাদের মাথাগুলো মাসেহ্ করো ও পাগুলো টাখনু পর্যন্ত (মাসেহ্ করো)। (সূরাহ্ আল্-মাএদাহ্: 6)

এখানে উক্ত আয়াতেরارجلکم শব্দের লাম (ل ) হরফের হারাকাত্ নিয়ে মতপার্থক্য হয়েছে। অধিকাংশের মতে এর উচ্চারণ হবে আরজুলাকুম্ এবং কতকের মতে এটির উচ্চারণ হবে আরজুলেকুম্ । প্রথমোক্ত উচ্চারণ সঠিক গণ্য করলে পায়ের আঙ্গুলের অগ্রভাগ থেকে পায়ের গিরা (টাখনু) পর্যন্ত হাত টেনে পুরো পায়ের পাতা মাসেহ্ করতে হবে , আর দ্বিতীয়োক্ত উচ্চারণকে সঠিক গণ্য করলে পায়ের পাতার অগ্রভাগ থেকে টাখনুর দিকে হাত টেনে আংশিক মাসেহ্ করলেই যথেষ্ট হবে।

এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ মতপার্থক্য সন্দেহ নেই , কিন্তু এর সমাধান আদৌ কঠিন নয়। এখানে দু টো উচ্চারণই ব্যাকরণসম্মত। কিন্তু যেহেতু মতপার্থক্য হয়েছে সেহেতু ইসলামী বিধিবিধান নির্ণয় সংক্রান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি - সতর্কতার নীতির আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে। তা হচ্ছে , পুরো পায়ের পাতাই মাসেহ্ করতে হবে। কারণ , এমনকি যদি আংশিক মাসেহ্ করারই হুকুম দেয়া হয়ে থাকে সে ক্ষেত্রেও পুরো পায়ের পাতা মাসেহর মধ্যে উক্ত অংশ শামিল থাকায় এবং আংশিক নাকি পুরো এ ব্যাপারে সংশয় দেখা দেয়ায় পুরো পায়ের পাতা মাসেহ্ করলে ভুল হবে না।

এখানে উক্ত আয়াতের তাৎপর্য থেকে সুস্পষ্ট যে , উপরোক্ত আরজুলাকুম্ আরজুলেকুম্ উচ্চারণবিতর্কে পা ধোয়ার অথবা জুতা বা মোযার (যে ধরনের চামড়ার মোযার কথা বলা হয় তা আসলে এক ধরনের জুতা) ওপর মাসেহ্ করার হুকুমের অর্থ করার কোনোই সুযোগ নেই। কারণ , উক্ত আয়াতে দু টি ক্রিয়াপদের আওতায় দু টি বাক্য রয়েছে ও বাক্যদ্বয়ে দু টি করে চারটি কর্ম রয়েছে এবং সংযোজক ওয়াও দ্বারা বাক্য দু টিকে যুক্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে জুতা বা মোযা-র তো কোনো উল্লেখই নেই। উক্ত আয়াতে আরজুলাকুম্ কর্মকে মাসেহ্ ক্রিয়াপদের আওতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ধৌতকরণ ক্রিয়াপদের অধীনে গণ্য করার কোনো সুযোগই নেই। কোরআন মজীদে বা আরবী সাহিত্যের অন্যত্র এভাবে সংশ্লিষ্ট ক্রিয়াপদকে উপেক্ষা করে কোনো কর্মের ওপর অন্য বাক্যস্থ ক্রিয়াপদের ক্রিয়া করার কোনো দৃষ্টান্ত আদৌ নেই। পা ধোয়ার হুকুমের সপক্ষে যে সব হাদীছ হাযির করা হয় রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর ওফাতের দুই শতাধিক বছর পরে সংকলিত সে সব খবরে ওয়াহেদ্ হাদীছের কোনোই গ্রহণযোগ্যতা নেই।

অন্যদিকে কতক লোক হাতের চেয়ে পায়ে ধুলাময়লা বেশী লাগার যুক্তি দেখিয়ে ওযূর হুকুমের পিছনে মনগড়া কারণ নির্দেশ করে , অথচ আল্লাহ্ তা আলা এ ধরনের কারণ বলেন নি। বস্তুতঃ ওযূর হুকুমের পিছনে স্রেফ্ আল্লাহ্ তা আলার আনুগত্য পরীক্ষা করা ছাড়া কোনো বস্তুগত কারণ নিহিত নেই। তা থাকলে তায়াম্মুম্ (যাতে চেহারায় ও হাতে মাটি তথা ধুলা লাগাতে হয়) ওযূ ও গোসলের বিকল্প হতে পারতো না। অবশ্য পা সহ শরীরের কোনো অংশে বাহ্যিক নাপাকী থাকলে ওযূ শুরু করার আগে অবশ্যই তা অপসারণ করে ও পানি দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে , (বেশী ধুলাবালি ও কাদার ক্ষেত্রেও তা-ই করতে হবে ,) অতঃপর ওযূ করতে হবে - যার শেষ রুকন্ হচ্ছে পা মাসেহ্ করা।