আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে গাদীর

আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে গাদীর23%

আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে গাদীর লেখক:
: মুহাদ্দিস এম, এ, রহমান
প্রকাশক: আল মুস্তাফা (সা.) আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, কোম-ইরান
বিভাগ: ইতিহাস

  • শুরু
  • পূর্বের
  • 28 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 25550 / ডাউনলোড: 4777
সাইজ সাইজ সাইজ
আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে গাদীর

আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে গাদীর

লেখক:
প্রকাশক: আল মুস্তাফা (সা.) আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, কোম-ইরান
বাংলা

মুসলিম বিশ্ব আজ পরাশক্তির চক্রান্তের শিকার। তাদের ফাদে পরে মুসলমানদের অবস্থা এখন অতি নাজুক। মুসলমানরা আজ বহু দলে বিভক্ত , মিথ্যা ও বিভ্রান্তির বেড়াজালে বন্দী , তারা নিজেদের মধ্যেই দ্বন্দ - সংঘাত , মারামারি , আর হানাহানিতে লিপ্ত। ফতোয়া দিয়ে একে অপরকে কাফির ঘোষণা এখন একদল অজ্ঞ ও পাশ্চাত্যের হাতের পুতুল ব্যক্তির নিত্য দিনের কর্মে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থা থেকে বেড়িয়ে আসার জন্য সম্মানিত বিজ্ঞ লেখক নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সুন্নীদের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ সমূহের উপর ভিত্তি করে Ghadir az didgahe ahle sunnatনামে একটি গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনা করেছেন। এ গ্রন্থে লেখক গাদীরের ঐতিহাসিক ঘটনাকে ফুটিয়ে তোলার পাশাপাশি হযরত আলী ( আ .)- এর মর্যাদা যে শিয়া - সুন্নী নির্বিশেষে সকলের কাছে অনস্বীকার্য একটি বিষয় তা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করার প্রয়াস চালিয়েছেন এবং প্রকৃত ও সত্য বিষয়কে পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন।

আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে

গাদীর

ভাষান্তর:

মুহাদ্দিস এম , এ , রহমান (কামিল)

মূল:

মুহাম্মদ রেজা জাব্বারান।

আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে গাদীর

লেখকঃ মুহাম্মদ রেজা জাব্বারান।

ভাষান্তরঃ মুহাদ্দিস এম , এ , রহমান (কামিল)

সম্পাদনাঃ আবুল কাসেম , আলী মুর্তাযা

প্রকাশকঃ জামেয়াতুল মোস্তাফা আল-আলামিয়্যাহ

কম্পোজঃ এস , এ , শাম্মী

প্রথম প্রকাশঃ ২০০৯ইং

পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে

অনুবাদকের কথা

মুসলিম বিশ্ব আজ পরাশক্তির চক্রান্তের শিকার। তাদের ফাদে পরে মুসলমানদের অবস্থা এখন অতি নাজুক। মুসলমানরা আজ বহু দলে বিভক্ত , মিথ্যা ও বিভ্রান্তির বেড়াজালে বন্দী , তারা নিজেদের মধ্যেই দ্বন্দ - সংঘাত , মারামারি , আর হানাহানিতে লিপ্ত। ফতোয়া দিয়ে একে অপরকে কাফির ঘোষণা এখন একদল অজ্ঞ ও পাশ্চাত্যের হাতের পুতুল ব্যক্তির নিত্য দিনের কর্মে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থা থেকে বেড়িয়ে আসার জন্য সম্মানিত বিজ্ঞ লেখক নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সুন্নীদের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ সমূহের উপর ভিত্তি করে Ghadir az didgahe ahle sunnatনামে একটি গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনা করেছেন। এ গ্রন্থে লেখক গাদীরের ঐতিহাসিক ঘটনাকে ফুটিয়ে তোলার পাশাপাশি হযরত আলী ( .)- এর মর্যাদা যে শিয়া - সুন্নী নির্বিশেষে সকলের কাছে অনস্বীকার্য একটি বিষয় তা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করার প্রয়াস চালিয়েছেন এবং প্রকৃত ও সত্য বিষয়কে পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন।

ঐতিহাসিকভাবে হযরত আলী (আ.) এবং মহানবীর (সা.) আহলে বাইতের মর্যাদায় বর্ণিত অসংখ্য হাদীস আজ আমাদের মাঝে অপরিচিত হয়ে রয়েছে । অথচ তার মধ্যে এমন অনেক হাদীস রয়েছে যা সনদের (সূত্রের) দিক থেকে নির্ভরযোগ্যই শুধু নয় এমনকি বর্ণনাকারীদের সংখ্যার দৃষ্টিতে মুতাওয়াতিরের পর্যায়ে পড়ে। গাদীরের হাদীস তার অন্যতম।

উপরিউক্ত হাদীসগুলো মুতাওয়াতির হওয়া এবং বারংবার মহান রাসূলের (সা.) পবিত্র মুখে উচ্চারিত হওয়ার কারণে এগুলোর বিষয়বস্তুর গুরুত্বও খুবই বেশী। কারণ পবিত্র কোরআন রাসূল (সা.) সম্পর্কে বলেছেঃ

) و َمَا يَنطِقُ عَنِ الْهَوَىٰ إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَىٰ(

অর্থাৎ তিনি নিজের প্রবৃত্তির তাড়নায় কিছু বলেন না বরং যা বলেন তা আল্লাহর ওহী বৈ কিছু না যা তার উপর অবতীর্ণ হয়।

সুতরাং এই দৃষ্টিকোণ থেকে যেমন হাদীসগুলি গুরুত্বপূর্ণ তেমনি মানব জাতির জন্য সর্বশেষ নবী এবং হেদায়াতকারী হিসেবে তার থেকে বর্ণিত এরূপ হাদীস এর বিষয়বস্তুর গুরুত্বকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। অর্থাৎ উম্মতের হেদায়াত প্রাস্থি ও সঠিক পথে অবিচল থাকার ক্ষেত্রে এ হাদীসগুলোর গুরুত্ব অসীম। গাদীরের হাদীস এমন একটি হাদীস যা বর্ণনা সূত্রের দৃষ্টিতে মুতাওয়াতির এবং এর বিষয়বস্তুর সমর্থক হাদীসসমূহও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মুতাওয়াতির অথবা মাশহুর বা মুস্তাফিজের পর্যায়ে রয়েছে ।

বিশেষতঃ এ হাদীসটি মহানবী (সা.)-এর জীবনের শেষদিনগুলোতে বর্ণিত হাদীসের একটি যা বিদায় হজ্জ থেকে প্রত্যাবর্তনের পথে গাদীরে খুম নামক স্থানে বিশেষ আয়াত অবতীর্ণের প্রেক্ষাপটে বর্ণিত হয়েছে। শুধু তাই নয় এ হাদীসটির বর্ণনার প্রেক্ষাপট এবং রাসূলের (সা.) জীবনের শেষ হজ্জে তা বর্ণিত হওয়ার বিষয়গুলো পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয় এ হাদীসটি অন্য সকল হাদীসের এমনকি পবিত্র কোরআনের বাণীসমূহের উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করার রূপরেখা দান করেছে। বিশেষতঃ এ হাদীসটি বর্ণিত হওয়া এবং রাসূল (সা.) হযরত আলী (আ.)-এর বেলায়াত বা অভিভাবকত্ব ঘোষণা করার পর পবিত্র কোরআনের সর্বশেষ অবতীর্ণ আয়াত অর্থাৎ সূরা মায়েদা র ৩নং আয়াতের নিম্নোক্ত অংশঃ

) ال ْيَوْمَ يَئِسَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِن دِينِكُمْ فَلَا تَخْشَوْهُمْ وَاخْشَوْنِ الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا(

অর্থাৎ আজ কাফিরগণ তোমাদের দ্বীনের বিরুদ্ধাচারণে হত্যাশ হয়েছে। সুতরাং তাদেরকে ভয় কর না , শুধু আমাকে ভয় কর। আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।

থেকে বোঝা যায় বেলায়াতের বিষয়টির সঙ্গে কাফেরদের নিরাশ হওয়ার সম্পর্ক রয়েছে। সেই সাথে দ্বীনের পূর্ণতা , নেয়ামতের সম্পূর্ণ হওয়া এবং ইসলাম আল্লাহর মনোনীত দ্বীন বলে স্বীকৃতি পাওয়া এ সকল বিষয়ই বেলায়াতের সাথে সম্পর্কিত। অর্থাৎ সেই দ্বীনই পূর্ণ এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও যে দ্বীনের জন্য নির্দিষ্ট তা হল বেলায়াত যার অন্তর্ভূক্ত।

ঐশী বেলায়াতের অধিকারী ব্যক্তিকে স্বীকৃতি না দেয়া জাহেলিয়াতের শামিল। যেমনটি হাদীসে এসেছে যে ,

من مات و لم یعرف امام زمانه مات میتة جاهلیه

অর্থাৎ যে তার যুগের ইমামকে না চিনে মৃত্যু বরণ করল তার মৃত্যু ঠিক ঐ ব্যক্তির মত যে জাহেলী যুগে মৃত্যু বরণ করেছে।

এ হাদীস থেকে যেমনি যুগের ইমামকে চেনার গুরুত্বটি বোঝা যায় তেমনি বোঝা যায় মুসলমান অবস্থায় মৃত্যু বরণ করার বিষয়টি নিভর করছে বেলায়াতের অধিকারী ব্যক্তিকে মেনে নেওয়ার বিষয়ের উপর।

বিষয়টির গুরুত্ব এতটা স্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও কেউ কেউ হাদীসটিতে বর্ণিত-

من کنت مولاه فعلی مولاه

মাওলা অংশটির ভিন্নরূপ ব্যাখ্যার অপপ্রয়াস চালিয়েছে। তারা দাবী করেছে মাওলা শব্দটি এ হাদীসে বন্ধু অর্থে এসেছে। অথচ এ অর্থ হাদীসের বর্ণনার প্রেক্ষাপট ও বিষয়বস্তুর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

কেউ কেউ হাদীসটি জায়িফ (দূর্বল) অথবা জাল বলে বর্ণনার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। যদিও হাদীসটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সাহাবী , তাবেয়ীন এবং হাদীসবেত্তারা বহুল সূত্রে বর্ণনা করেছেন। এ ক্ষেত্রে আল্লামা আমিনী ১১০ জন বিশিষ্ট সাহাবী ও ৮৪ জন তাবেয়ী র নাম উল্লেখ করেছেন যারা গাদীরের সর্বজন বিদিত হাদীসটি সরাসরি রাসূল (সা.) হতে বর্ণনা করেছেন।

এ হাদীসটি শিয়া আলেমদের নিকটই শুধু নয় সুন্নী মুহাদ্দিসদের নিকটও মুতাওয়াতির ও অকাট্য বলে প্রমাণিত। প্রসিদ্ধ শিয়া মুহাদ্দিস আল্লামা আব্দুল হুসাইন আমিনী তার আল গাদীর গ্রন্থে (১১ খণ্ডে রচিত) এ বিষয়টি সনদ ও দলিলসহ উভয় মাযহাবের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রমাণ করেছেন।

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে , হযরত আলী (আ.)-এর বেলায়াতের বিষয়ে এতটা অকাট্য প্রমাণাদি থাকা সত্ত্বেও কিছু কিছু স্বার্থান্বেষী ও গোড়া আলেম এ বিষয়টিকে ভিন্নভাবে চিত্রায়িত করার প্রপাগাণ্ডা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই আমরা যারা সত্য ও বাস্তবের অনুসন্ধিৎসু আমাদের কর্তব্য হল প্রকৃত সত্যকে সমাজের নিকট স্পষ্টভাবে তুলে ধরা। আর সে কারণেই এ বইটি অনুবাদের জন্য আমার মত একজন নগন্য ব্যক্তি সাহস করেছে।

লেখক এই গ্রন্থে বেলায়াতের বিষয়টি অতি সুন্দর , স্পষ্ট ও বিভিন্ন প্রমাণাদির মাধ্যমে অত্যন্ত প্রঞ্জল ভাষায় পাঠকদের জন্য তুলে ধরেছেন। তাই আসুন আমরা এই গ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে যতটুকু সম্ভব বেলায়াতের অধিকারী ব্যক্তিকে চিনে জাহেলী যুগের ন্যায় মৃত্যু বরণ করা থেকে নিস্কৃতি লাভ করি।

অনুবাদসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে বইটি ত্রুটিমুক্ত করার জন্য সম্ভাব্য চেষ্টা- প্রচেষ্টা করা হয়েছে । এ ক্ষেত্রে যারাই স্বীয় মেধা ও শ্রম ব্যয় করে সাহায়্য-সহযোগিতা করেছেন তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি এবং তাদের পারিশ্রমিক আল্লাহর নিকট কামনা করছি। সুপ্রিয় পাঠক মহোদয় তারপরেও যদি কোথাও কোন ত্রুটি আপনাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ধরা পরে তা আমাদেরকে অবহিত করলে পরবর্তী সংস্করণে সেটা সংশোধনের চেষ্টা করা হবে।

আশাকরি , এ সামান্য প্রচেষ্টা আপনাদের উপকারে আসবে। এ বই থেকে যদি বিন্দুমাত্র উপকৃত হন তাহলেই আমরা আমাদেরকে কৃতার্থ বলে মনে করবো।

আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন। আমীন

মুখবন্ধ

নিঃসন্দেহে রাসূল (সাঃ) এর পরে আলী ইবনে আবী তালিব (আ.)-এর ব্যক্তিত্ব এমনই এক মহামূল্যবান ব্যক্তিত্ব যা এই বিশ্বজগতকে স্বীয় অস্তিত্বের মাধ্যমে সৌন্দর্যমন্ডিত করেছে।

তার স্বর্ণোজ্জল ব্যক্তিত্ব মনুষ্যজগতের সুউচ্চস্তরে এমনভাবে কিরন দিচ্ছে যা যুগ যুগ ধরে মানবজাতির জ্ঞান-গরিমাকে বিস্মিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দিয়েছে।

ঐ পবিত্র ও মহান ঐশী ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য পেতে সকল বিবেকবান ব্যক্তির চেতনাকেই উৎসাহিত করে কিন্তু এটা এমনই পথ যেটা প্রেমের কদম ব্যতীত অতিক্রম করা সম্ভব নয়।

তার সম্পর্কে যা কিছু বলা ও লেখা হয়েছে , প্রকৃতার্থে শুধুই আমাদের জানা বিষয়গুলোর মধ্যেই সীমিত , তার যে পর্যায়ের ব্যক্তিত্ব আছে ঠিক সে পর্যায়ের নয়।

যদিও এই গ্রন্থের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে গাদীর দিবসকে ঈদ হিসেবে প্রমাণিত করা ও এই দিবসের কিছু আচার-অনুষ্ঠান বর্ণনা করা , কিন্তু উক্ত আলোচনার বাইরেও কিছু অধ্যায় ঐ ব্যক্তির (আলীর) ব্যক্তিত্বকে ব্যাখ্যার জন্য আলোচনা করেছি এবং রাসূলের (সা.) পাক-পবিত্র বাণীর আয়নাতে আলী ইবনে আবী তালিবের (আ.) সৌন্দর্যপূর্ণ উজ্জলষ্ঠ চেহারাকে দেখার চেষ্টা করেছি। আশাকরি , আমরা ও পাঠকবৃন্দ সকলেরই উক্ত গ্রন্থ থেকে আত্মার খোরাক জোগান দিয়ে কিছুটা হলেও আমাদের আত্মাকে পরিতৃপ্ত করতে পারবো।

পরিশেষে কিছু বিষয় উল্লেখ করা আবশ্যক বলে মনে করছি , তা হচ্ছে- এই বইয়ের অধিকাংশ আলোচনাই আহলে সুন্নাতের প্রসিদ্ধ ও বিশ্বস্ত গ্রন্থ হতে সংগৃহীত। আর প্রত্যেকটি হাদীস বা ঘটনার ক্ষেত্রে যা কিছু উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোর প্রত্যেকটির মূল গ্রন্থের , খণ্ডের , লেখকের বা অনুবাদকের , প্রকাশনীর এবং প্রকাশস্থল ও তারিখসহ নির্দিষ্ট পৃষ্ঠা নম্বর উল্লেখ করার চেষ্টা করা হয়েছে (উল্লেখিত কিছু কিছু বিষয় এ বই-এর শেষের দিকে গ্রন্থ পরিচিতিতে আলোচনা করা হয়েছে)।

এছাড়া অতি সামান্য কিছু বিষয় বা ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে যেটা আহলে সুন্নাতের গ্রন্থাদিতে বিস্তারিতভাবে আলোচনা না করার কারণে বাধ্য হয়েছি শিয়া মাযহাবের বিশ্বস্ত কিছু গ্রন্থাদির আশ্রয় নিতে এবং সে গ্রন্থগু্লোকেও আহলে সুন্নাতের গ্রন্থাদির মত সুক্ষভাবে পরিচয় করা হয়েছে। কিছু কিছু হাদীস বা ঘটনার ক্ষেত্রে অল্পসংখ্যক মূল গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছি কারণ , আমাদের বইয়ের পরিধি খুব কম। আর এর অর্থ এটা নয় যে , এই হাদীস বা ঘটনাগুলি আর অন্য কোন গ্রন্থে নেই।

আর সদা-সর্বদা চেষ্টা করেছি হাদীস বা ঘটনাগুলোকে হুবহু তুলে ধরার জন্য ,প্রয়োজনের ক্ষেত্রে উক্ত হাদীসের বা ঘটনার নিম্নে কিছু ব্যাখ্যা বা কিছু কথা সংযোজন করেছি।

আশাকরি , গাদীরের মহাসমুদ্র হতে এই বিন্দুমাত্র আলোচনায় উপকৃত হবেন।

প্রথম অধ্যায়

গাদীরের ঘটনা

ঈদ

আভিধানিকগণ ঈদ কে আওদ মূলধাতু হতে গৃহীত হয়েছে বলে মনে করেন। আর আওদ এর অর্থ হচ্ছে প্রত্যাবর্তন। সুতরাং প্রত্যেক ঈদকে তার প্রত্যাবর্তনের কারণেই উৎযাপন করা হয়ে থাকে ।

প্রতিটি ঘূর্ণায়মান গতিশীল বস্তুই প্রত্যাবর্তনের পথে নিম্ন পরিক্রমা শেষ করে ঊর্ধ্বমুখী হয় এবং তখন তার ঊর্ধ্বযাত্রা শুরু হয়। প্রকৃতিতেও আমরা তা প্রত্যক্ষ করি এবং নববর্ষকে প্রকৃতির শীতল দেহে নতুন প্রাণ সঞ্চারণের কারণে স্বাগত জানাই। প্রকৃতির সেই শীতল দেহ যা হেমন্তের আগমনে সুপ্ত ও শীতের তীব্রতায় এতটা নিশ্চিহ্ন হওয়ার দ্বার প্রান্তে পৌছে ছিল যেন অস্তিত্বে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল তা বসন্তের মৃদু মন্দ বাতাসের পদচারণায় নতুনভাবে জেগে উঠে ও ঊর্ধ্বগমন শুরু করে। এই প্রত্যাবর্তনকে অবশ্যই স্বাগত জানাতে হবে। তবে তা শুধুমাত্র সেই মতাদর্শের জন্য চুড়ান্ত লক্ষ্য বলে পরিগণিত হয় যা প্রকৃতি জগতের বস্তুগত দিকটিকেই সর্বোচ্চ মূল্য দিয়ে থাকে ।

এখন যদি এই আদর্শকে এমন একটি মতাদর্শের উপর প্রয়োগ করতে চাই যা সমগ্র বিশ্বকে মানুষের অস্তিত্বের ভূমিকা এবং তার সৃষ্টির উদ্দেশ্যকে আল্লাহর ইবাদত বলে মনে করে তাহলে অবশ্যই তার ঈদকে মানুষের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিত জীবনের মহা প্রত্যাবর্তন হিসেবে মূল্যায়ন করতে হবে। এ ধরনের মতাদর্শে মানুষের নববর্ষ এমনই এক দিন যেদিন সে তার নিজের দিকেই প্রত্যাবর্তন করে ও তার হারানো জিনিসকে সে ফিরে পায় ; এটা এমনই দিন , যে দিনে বস্তু জগতের নীচতা থেকে মুক্ত হয়ে (বস্তু আসক্তির পর্দা ভেদ করে) অবস্তু ঐশী জগতের দিকে ঊর্ধ্বযাত্রা শুরু করে । এ দিন মানুষ তার অভ্যন্তরীণ পবিত্র সত্তার উপর পড়া ধুলার আবরণকে সরিয়ে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ লাভ করে।

পবিত্র রমজান মাস এমনই এক সময় , যে সময়ে সাধক রোজাদার রিপুর তাড়নার বিরুদ্ধে পতিরোধ গড়ে তোলার তৌফিক অর্জন করে ও আল্লাহর প্রতি ভালবাসার যে আগুন পার্থিবতার (বস্তুগত কামনার) বরফের মাঝে নির্বাপিত হয়েছিল পুনরায় তাকে জ্বলন্ত করে তোলে। সতর্ক হয়ে যায় যেন এ ভালবাসায় তার সমস্ত অস্তিত্বই উত্তপ্ত হয় ও তার অস্তিত্ব থেকে সকল প্রকার কুলষতা দূর হয়ে যায় তার হৃদয় থেকে নিখাদ নির্ভেজাল ইবাদতের দ্যুতি ছড়ায় এবং এর মাধ্যমে সৃষ্টির উদ্দেশ্য সাধিত হয়। আর তখনই হয় তার জন্য ঈদুল ফিতর।

হজ্জও তেমনি একটি সুযোগ , হাজীগণ বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করার পর সফল হয় জবেহ র স্থানে তার বন্ধু নয় এমন কারো গলায় ছুরি চালাতে ও তার বন্দী আত্মাকে মুক্ত করে মনুষ্যত্বের পথে ঊর্ধ্বালোকের দিকে অগ্রসর হয়ে ইবাদতের উচ্চতর স্তরে পৌছার। আর তখনই তার জন্য ঈদুল আযহা।

এখানেই ঈদ এবং অন্যান্য উৎসবের মধ্যে বিদ্যমান পার্থক্যকে লক্ষ্য করা যায়।

উৎসব পালন আনন্দের জন্য একটি অজুহাত মাত্র। কিন্তু ঈদ হচ্ছে মানুষের পূনঃর্জীবনকে স্বাগত জানানো। এটাও একটা প্রমাণ যে , আনন্দ উৎসবের বিপরীত ঈদ হচ্ছে ধর্মীয় বিষয় এবং ইসলামী ঈদসমূহ দ্বীনের একটি অংশ।

সুতরাং ইসলামী ঈদের হাকিকাত বা বাস্তবতা হচ্ছে- দ্বিতীয় বার জীবন লাভ করা ও তা নির্ধারণের দায়িত্ব পবিত্র শরীয়াত বা ধর্মের উপর।

আমরা বিশ্বাসী যে , গাদীর দিবসটি প্রকৃত ইসলামী ঈদসমূহের বৈশিষ্ট্যের সাথে যেমন সামঞ্জস্যপূর্ণ তেমনি ইসলামী আইন প্রণেতা মহান রাসূলও (সা.) এটাকে ঈদ হিসেবে মুসলিম উম্মতের নিকট তুলে ধরেছেন।

অত্র গ্রন্থটি উপরিউক্ত দু দিক থেকে গাদীরের ঈদকে প্রমাণের পাশাপাশি এই ঈদের বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানকে বর্ণনা করেছে।

এই বিবরণগুলির বিভিন্ন অধ্যায় পাঠ করে এই বিশ্বাসে উপনীত হয়েছি যে , ঈদে গাদীর দিবসটি ইসলামের মহান ঈদসমূহের একটি , যেটাকে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ঈদ বলা যেতে পারে এবং যদি পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিতে দেখি তাহলে উপলদ্ধি করতে পারবো যে , এটা মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় ঈদ।

গাদীর

আভিধানিক অর্থে গাদীর বলতে: ক্ষুদ্র জলাশয় , পুকুর বা ডোবাকে বুঝানো হয়। ঐ সকল গর্ত যেগুলি মরুভূমিতে অপেক্ষায় থাকে যে , কখন বৃষ্টি হবে আর নিজেকে সেই বৃষ্টির পানিতে পূর্ণ করবে এবং তাকে পরিস্কার ও স্বচ্ছ করে দিবে যাতে মরুভূমির তৃষ্ণার্ত পথিকদেরকে এই সর্বদা বিস্তৃত দস্তরখান হতে পরিমাণ মত মহা মূল্যবান নেয়ামত বা অনুগ্রহ দ্বারা আপ্যায়ণ করতে পারে ও তাদের শুষ্ক মশককে পূর্ণ করে দিতে পারে , এমন ধরনের গর্তকে গাদীর বলা হয়।

গাদীরে খুম

যে সকল পথিক মদীনা হতে মক্কার দিকে যাত্রা করে , তাদের পথটির দূরত্ব হল পাচশ কিলোমিটারের চেয়ে একটু বেশী। এই পথিকগণ ২৭০ কিলোমিটার পথ অতিক্রান্ত করার পর যে স্থানে উপস্থিত হয় , সে স্থানটির নাম হচ্ছে রাগেব রাগেব জোহফা র নিকটবর্তী একটি ছোট শহর

আর জোহফা হচ্ছে- হজ্জের পাচটি মিকাত বা ইহরাম বাধার স্থানসমূহের মধ্যে একটি ; যেখানে শামের (সিরিয়ার) হাজীগণ ও যারা জেদ্দা থেকে মক্কায় যায় , তারা উক্ত স্থানে মোহরিম হয় বা ইহরাম বাধে। জোহফা হতে মক্কার দূরত্ব হচ্ছে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার ও রাগেব পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার । সেখানে একটি জলাশয় ছিল যার পানি দুর্গন্ধ , বিষাক্ত ও পথিকদের জন্য ব্যবহার অনোপযোগী এবং কাফেলা বা পথিকরা সেখানে দাড়াতো না। বলা হয়ে থাকে সে কারণেই খুম নামকরণ করা হয়েছে। কারণ , খুম ঐ সমস্ত নষ্ট জিনিসকে বলা হয়ে থাকে যা দুর্গন্ধযুক্ত। তাই পাখির খাচাকেও এ কারণেই খুম বলা হয়ে থাকে ।

মদীনা হতে ইমাম হোসাইনের (আ.) হিজরত

ওয়ালিদ ও মারওয়ানের সাথে সাক্ষাতের পরবর্তী ঘটনা সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণ লিখেছেন- ঐদিন ভোরে অর্থাৎ ৬০ হিজরীর ৩রা শাবান ইমাম হোসাইন (আ.) মক্কার দিকে রওয়ানা হন । আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস ও আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর তার খেদমতে উপস্থিত হন । তারা বলেন যে , আপনি মক্কাতেই অবস্থান করুন । তিনি বললেন- রাসূলে খোদার (সা.) তরফ থেকে আমার উপর যে নির্দেশ আছে তা আমাকে পালন করতেই হবে । ইবনে আব্বাস ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলেন । পথে তিনি বলছিলেন-واحسینا হায় হোসাইন ! এরপর আব্দুল্লাহ ইবনে উমর আসেন এবং বললেন- এখানকার পথহারা লোকদের সংশোধন করাই উত্তম হবে । যুদ্ধের পদক্ষেপ নিবেন না । তিনি বললেন-

اما علمت ان من هوان الدنیا علی الله ان راس یحیی بن زکریا اهدی الی بغی من بغایا بنی اسرائیل

“ আপনি কি জানেন না , দুনিয়া এতখানি নিকৃষ্ট যে , ইয়াহিয়া ইবনে যাকারিয়া (আ.) এর মাথা বানি ইসরাইলের এক অবাধ্যের কাছে হাদিয়া হিসেবে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল । আপনার কি জানা নেই যে বনি ইসরাইল সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত ৭০ জন নবীকে হত্যা করে । এরপর বাজারে এসে তারা কেনা কাটায় মশগুল হয় । অর্থাৎ যেন কোন ঘটনাই ঘটেনি । তবুও মহান আল্লাহ তাআলা তাদের আযাব ত্বরান্বিত করেননি । তাদেরকে অবকাশ দেন । আর অবকাশ দানের পরই চরম প্রতিশোধ গ্রহণ করেন । হে আব্দুল্লাহ ! মহান আল্লাহর ক্রোধ ও আযাবকে ভয় করুন এবং আমার সাহায্য থেকে পিছপা হবেন না । ”

হোসাইন (আ.) এর প্রতি কুফাবাসীর দাওয়াত

কুফাবাসীরা হযরত হোসাইন (আ.) এর মক্কা আগমন এবং ইয়াজিদের হাতে বাইআত গ্রহণে তার অস্বীকৃতির খবর জানত । এ খবর পেয়েই তারা সুলাইমান ইবনে সা দ খাজায়ীর ঘরে সমবেত হয় । সমাবেশে সুলাইমান ইবনে সা দ দাড়িয়ে সমবেত লোকদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন । বক্তব্য শেষে তিনি বলেন ওহে আলীর অনুসারীরা! তোমরা সবাই শুনেছ যে , মুআবিয়া মরে গেছে এবং নিজের হিসাব কিতাবের জন্য আল্লাহর দরবারে পৌছে গেছে । তার কৃতকর্মের ফল সে পাবে । তার ছেলে ইয়াজিদ ক্ষমতায় বসেছে । আপনারা আরো জানেন যে , হোসাইন ইবনে আলী (আ.) তার সাথে বিরোধিতা করেছেন এবং তিনি উমাইয়ার জালিম ও খোদাদ্রোহীদের দূরাচার থেকে রক্ষার জন্য আল্লাহর ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন । তোমরা তার পিতার অনুসারী । হোসাইন (আ.) আজ তোমাদের সমর্থন ও সহযোগিতার মুখাপেক্ষী । যদি এ ব্যপারে নিশ্চিত হও যে , তাকে সাহায্য করবে এবং তার দুশমনদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে , তাহলে লিখিত আকারে নিজের প্রস্তুতির কথা তাকে জানিয়ে দাও । যদি ভয় পাও এবং আশংকা কর যে , তোমাদের মধ্যে গাফলতি ও দুর্বলতা প্রকাশ পাবে , তাহলেও তাকে জানিয়ে দাও , তাকে তার অবস্থার উপর ছেড়ে দাও । তাকে ধোকা দিও না । এরপর তিনি নিম্নোক্ত বিষয়বস্তুর উপর একটি পত্র লেখেন-

بسم الله الرحمن الرحیم

এ পত্র হোসাইন ইবনে আলী (আ.) সমীপে সুলাইমান ইবনে সা দ খাজায়ী , মুসাইয়্যেব ইবনে নাজরা , রেফাআ ইবনে শাদ্দাদ , হাবিব ইবনে মাজাহের আব্দুল্লাহ ইবনে ওয়ায়েলসহ একদল মুমিন ও অনুসারীর পক্ষ হতে প্রেরিত হল ।

সালামের পর আল্লাহর তা ’ রিফ ও প্রশংসা যে , তিনি আপনার ও আপনার পিতার দুশমনদের ধ্বংস করেছেন । সেই জালিম ও রক্তপিপাসু , যে উম্মতের শাসন ক্ষমতা তাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে অন্যায়ভাবে চেপে বসেছে এবং মুসলমানদের বাইতুল মাল আত্মসাৎ করেছে , মন্দ লোকদের বাচিয়ে রেখেছে , আল্লাহর সম্পদকে অবাধ্য দুরাচারীদের হাতে তুলে দিয়েছে , সামুদ সম্প্রদায় যেভাবে আল্লাহর রহমত হতে বঞ্চিত হয়েছে তারাও সেভাবে আল্লাহর রহমত হতে বঞ্চিত হোক । আপনি ছাড়া আমাদের আজ কোন নেতা নেই । কজেই আপনি যদি কষ্ট করে আমাদের শহরে তাশরীফ আনেন তাহলে বড়ই অনুগ্রহ হবে । আশা করি , আপনার মাধ্যমে আল্লাহ পাক আমাদেরকে সঠিক পথে হেদায়েত করবেন ।

কুফার গভর্ণর নোমান ইবনে বশির দারুল এমারাত ’ প্রাসাদে রয়েছে । কিন্তু আমরা তার পেছেনে জামাত ও জুমার নামাজে শরীক হইনি । ঈদের দিন তার সাথে ঈদগাহে যাইনি । যদি শুনতে পাই যে , আপনি কুফায় আসছেন তাহলে তাকে কুফা থেকে বিতাড়িত করে সিরিয়া পাঠিয়ে দেব । হে পয়গাম্বরের সন্তান আপনার প্রতি সালাম , আপনার পিতার পবিত্র রুহের প্রতি সালাম ।

و السلام علیک و رحمة الله و برکته

و لا حول ولا قوة الا بالله العلی العظیم

চিঠিখানা লেখার পর পাঠিয়ে দিল । দুইদিন অপেক্ষার পর আর একদল লোককে প্রায় ১৫টি চিঠি নিয়ে হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) এর কাছে পাঠিয়ে দিল । ঐ সব চিঠির প্রত্যেকটিতে দুই কি তিন বা চার জনের স্বাক্ষর ছিল । কিন্তু হোসাইন (আ.) এত সব চিঠিপত্র পাওয়ার পরও নীরব রইলেন তাদের কোন পত্রের উত্তর দিলেন না । এমন কি মাত্র এক দিনেই ৩০০ টি চিঠি এসে তার হাতে পৌছে । এরপরও পর্যায়ক্রমে একের পর এক চিঠি আসছিল । তার চিঠি ১২হাজার ছাড়িয়ে যায় । সর্বশেষ যে চিঠিখানা তার হাতে এসে পৌছে তা ছিল হানি ইবনে হানি ছবিয়ী এবং সায়ীদ ইবনে আব্দুল্লাহ হানাফীর । তারা উভয়ে ছিল কুফার অধিবাসী । ঐ পত্রে তারা লিখেন-

بسم الله الرحمن الرحسم

ইবনে হোসাইন আলী (আ.) এর খেদমতে তার ও তার পিতার অনুসারীদের পক্ষ হতে প্রেরিত হলো । সালাম বাদ জনগন আপনার আগমনের অপেক্ষায়। আপনি ছাড়া কাউকে তারা চায় না । হে নবীর সন্তান ! অতি শীঘ্র আপনি আমাদের কাছে চলে আসুন । কেননা , বাগ-বাগিচাগুলোতে সবুজের সমারোহ এসেছে , ফলগুলো পেকেছে , লতাগুল্ম জেগে উঠেছে এবং সবুজ পত্রে গাছের সৌন্দর্য শোভায় মাতিয়ে তুলেছে । আসুন আপনি আমাদের মাঝে আসুন । কেননা আপনার সৈন্যদলের মাঝেই তো আপনি আসবেন ।

و السلام علیک و رحمة الله وبرکته و علی ابیک من قبلک

চিঠি পাওয়ার পর পত্র বাহক দু জনের কাছে হোসাইন ইবনে আলী (আ.) জিজ্ঞেস করেন এ চিঠিগুলো কে কে লিখেছে । তারা বলল , হে আল্লাহর রাসুলের সন্তান! পত্রের লেখকরা হলেন-শাব্স ইবনে রাবায়ী , হাজার ইবনে আবজার , ইয়াজিদ ইবনে হারেছ , ইয়াজিদ ইবনে রোয়াম , উরওয়া ইবনে কাইছ , আমর ইবনে হাজ্জাজ এবং মুহাম্মদ ইবনে ওমর ইবনে আতারেদ ।

মুসলিম ইবনে আকিলের কুফা গমন

এরুপ পরিস্থিতিতে হোসাইন ইবনে আলী (আ.)একদিন কাবাঘরের পাশে গিয়ে রুকন ও মাকামে ইব্রাহীমের মাঝখানে দাড়িয়ে দু রাকত নামায আদায় এবং মহান আল্লাহর দরবারে পরিস্থিতির কল্যাণকর পরিণতির জন্য দোয়া করেন । অতঃপর মুসলিম ইবনে আকিলকে ডেকে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন ।

এরপর ইমাম হোসাইন (আ.) কুফাবাসীর চিঠির জবাব লিখে মুসলিম ইবনে আকিলের মাধ্যমে প্রেরণ করেন। জবাবী পত্রে তাদের আমন্ত্রণ কবুলের ওয়াদা দিয়ে লেখা ছিল- আমি আমার চাচাত ভাই মুসলিম বিন আকিলকে তোমাদের কাছে পাঠালাম যাতে তোমাদের উদ্দেশ্য পূর্ণ করে সে সম্পর্কে আমাকে অবহিত করে ।

মুসলিম ইমামের পত্র নিয়ে কুফায় আসেন । কুফাবাসী হোসাইন ইবনে আলী (আ.) ও মুসলিম ইবনে আকিলকে পেয়ে আনন্দিত হল । তাকে মুখতার ইবনে আবী ওবায়দা সাকাফীর বাড়িতে থাকতে দিলেন । অনুসারীরা দলে দলে মুসলিম ইবনে আকিলের সাথে সাক্ষাত করতে আসতে লাগল । প্রত্যেক দল আসার সাথে সাথে মুসলিম ইমামের পত্র পড়ে শুনাতে থাকেন । আনন্দে দর্শনার্থীদের অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল এবং তার হাতে বাইআত গ্রহণ করছিল । দেখতে দেখতে আঠারশো লোক তার হাতে বাইআত গ্রহণ করে ।

মদীনা হতে ইমাম হোসাইনের (আ.) হিজরত

ওয়ালিদ ও মারওয়ানের সাথে সাক্ষাতের পরবর্তী ঘটনা সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণ লিখেছেন- ঐদিন ভোরে অর্থাৎ ৬০ হিজরীর ৩রা শাবান ইমাম হোসাইন (আ.) মক্কার দিকে রওয়ানা হন । আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস ও আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর তার খেদমতে উপস্থিত হন । তারা বলেন যে , আপনি মক্কাতেই অবস্থান করুন । তিনি বললেন- রাসূলে খোদার (সা.) তরফ থেকে আমার উপর যে নির্দেশ আছে তা আমাকে পালন করতেই হবে । ইবনে আব্বাস ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলেন । পথে তিনি বলছিলেন-واحسینا হায় হোসাইন ! এরপর আব্দুল্লাহ ইবনে উমর আসেন এবং বললেন- এখানকার পথহারা লোকদের সংশোধন করাই উত্তম হবে । যুদ্ধের পদক্ষেপ নিবেন না । তিনি বললেন-

اما علمت ان من هوان الدنیا علی الله ان راس یحیی بن زکریا اهدی الی بغی من بغایا بنی اسرائیل

“ আপনি কি জানেন না , দুনিয়া এতখানি নিকৃষ্ট যে , ইয়াহিয়া ইবনে যাকারিয়া (আ.) এর মাথা বানি ইসরাইলের এক অবাধ্যের কাছে হাদিয়া হিসেবে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল । আপনার কি জানা নেই যে বনি ইসরাইল সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত ৭০ জন নবীকে হত্যা করে । এরপর বাজারে এসে তারা কেনা কাটায় মশগুল হয় । অর্থাৎ যেন কোন ঘটনাই ঘটেনি । তবুও মহান আল্লাহ তাআলা তাদের আযাব ত্বরান্বিত করেননি । তাদেরকে অবকাশ দেন । আর অবকাশ দানের পরই চরম প্রতিশোধ গ্রহণ করেন । হে আব্দুল্লাহ ! মহান আল্লাহর ক্রোধ ও আযাবকে ভয় করুন এবং আমার সাহায্য থেকে পিছপা হবেন না । ”

হোসাইন (আ.) এর প্রতি কুফাবাসীর দাওয়াত

কুফাবাসীরা হযরত হোসাইন (আ.) এর মক্কা আগমন এবং ইয়াজিদের হাতে বাইআত গ্রহণে তার অস্বীকৃতির খবর জানত । এ খবর পেয়েই তারা সুলাইমান ইবনে সা দ খাজায়ীর ঘরে সমবেত হয় । সমাবেশে সুলাইমান ইবনে সা দ দাড়িয়ে সমবেত লোকদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন । বক্তব্য শেষে তিনি বলেন ওহে আলীর অনুসারীরা! তোমরা সবাই শুনেছ যে , মুআবিয়া মরে গেছে এবং নিজের হিসাব কিতাবের জন্য আল্লাহর দরবারে পৌছে গেছে । তার কৃতকর্মের ফল সে পাবে । তার ছেলে ইয়াজিদ ক্ষমতায় বসেছে । আপনারা আরো জানেন যে , হোসাইন ইবনে আলী (আ.) তার সাথে বিরোধিতা করেছেন এবং তিনি উমাইয়ার জালিম ও খোদাদ্রোহীদের দূরাচার থেকে রক্ষার জন্য আল্লাহর ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন । তোমরা তার পিতার অনুসারী । হোসাইন (আ.) আজ তোমাদের সমর্থন ও সহযোগিতার মুখাপেক্ষী । যদি এ ব্যপারে নিশ্চিত হও যে , তাকে সাহায্য করবে এবং তার দুশমনদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে , তাহলে লিখিত আকারে নিজের প্রস্তুতির কথা তাকে জানিয়ে দাও । যদি ভয় পাও এবং আশংকা কর যে , তোমাদের মধ্যে গাফলতি ও দুর্বলতা প্রকাশ পাবে , তাহলেও তাকে জানিয়ে দাও , তাকে তার অবস্থার উপর ছেড়ে দাও । তাকে ধোকা দিও না । এরপর তিনি নিম্নোক্ত বিষয়বস্তুর উপর একটি পত্র লেখেন-

بسم الله الرحمن الرحیم

এ পত্র হোসাইন ইবনে আলী (আ.) সমীপে সুলাইমান ইবনে সা দ খাজায়ী , মুসাইয়্যেব ইবনে নাজরা , রেফাআ ইবনে শাদ্দাদ , হাবিব ইবনে মাজাহের আব্দুল্লাহ ইবনে ওয়ায়েলসহ একদল মুমিন ও অনুসারীর পক্ষ হতে প্রেরিত হল ।

সালামের পর আল্লাহর তা ’ রিফ ও প্রশংসা যে , তিনি আপনার ও আপনার পিতার দুশমনদের ধ্বংস করেছেন । সেই জালিম ও রক্তপিপাসু , যে উম্মতের শাসন ক্ষমতা তাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে অন্যায়ভাবে চেপে বসেছে এবং মুসলমানদের বাইতুল মাল আত্মসাৎ করেছে , মন্দ লোকদের বাচিয়ে রেখেছে , আল্লাহর সম্পদকে অবাধ্য দুরাচারীদের হাতে তুলে দিয়েছে , সামুদ সম্প্রদায় যেভাবে আল্লাহর রহমত হতে বঞ্চিত হয়েছে তারাও সেভাবে আল্লাহর রহমত হতে বঞ্চিত হোক । আপনি ছাড়া আমাদের আজ কোন নেতা নেই । কজেই আপনি যদি কষ্ট করে আমাদের শহরে তাশরীফ আনেন তাহলে বড়ই অনুগ্রহ হবে । আশা করি , আপনার মাধ্যমে আল্লাহ পাক আমাদেরকে সঠিক পথে হেদায়েত করবেন ।

কুফার গভর্ণর নোমান ইবনে বশির দারুল এমারাত ’ প্রাসাদে রয়েছে । কিন্তু আমরা তার পেছেনে জামাত ও জুমার নামাজে শরীক হইনি । ঈদের দিন তার সাথে ঈদগাহে যাইনি । যদি শুনতে পাই যে , আপনি কুফায় আসছেন তাহলে তাকে কুফা থেকে বিতাড়িত করে সিরিয়া পাঠিয়ে দেব । হে পয়গাম্বরের সন্তান আপনার প্রতি সালাম , আপনার পিতার পবিত্র রুহের প্রতি সালাম ।

و السلام علیک و رحمة الله و برکته

و لا حول ولا قوة الا بالله العلی العظیم

চিঠিখানা লেখার পর পাঠিয়ে দিল । দুইদিন অপেক্ষার পর আর একদল লোককে প্রায় ১৫টি চিঠি নিয়ে হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) এর কাছে পাঠিয়ে দিল । ঐ সব চিঠির প্রত্যেকটিতে দুই কি তিন বা চার জনের স্বাক্ষর ছিল । কিন্তু হোসাইন (আ.) এত সব চিঠিপত্র পাওয়ার পরও নীরব রইলেন তাদের কোন পত্রের উত্তর দিলেন না । এমন কি মাত্র এক দিনেই ৩০০ টি চিঠি এসে তার হাতে পৌছে । এরপরও পর্যায়ক্রমে একের পর এক চিঠি আসছিল । তার চিঠি ১২হাজার ছাড়িয়ে যায় । সর্বশেষ যে চিঠিখানা তার হাতে এসে পৌছে তা ছিল হানি ইবনে হানি ছবিয়ী এবং সায়ীদ ইবনে আব্দুল্লাহ হানাফীর । তারা উভয়ে ছিল কুফার অধিবাসী । ঐ পত্রে তারা লিখেন-

بسم الله الرحمن الرحسم

ইবনে হোসাইন আলী (আ.) এর খেদমতে তার ও তার পিতার অনুসারীদের পক্ষ হতে প্রেরিত হলো । সালাম বাদ জনগন আপনার আগমনের অপেক্ষায়। আপনি ছাড়া কাউকে তারা চায় না । হে নবীর সন্তান ! অতি শীঘ্র আপনি আমাদের কাছে চলে আসুন । কেননা , বাগ-বাগিচাগুলোতে সবুজের সমারোহ এসেছে , ফলগুলো পেকেছে , লতাগুল্ম জেগে উঠেছে এবং সবুজ পত্রে গাছের সৌন্দর্য শোভায় মাতিয়ে তুলেছে । আসুন আপনি আমাদের মাঝে আসুন । কেননা আপনার সৈন্যদলের মাঝেই তো আপনি আসবেন ।

و السلام علیک و رحمة الله وبرکته و علی ابیک من قبلک

চিঠি পাওয়ার পর পত্র বাহক দু জনের কাছে হোসাইন ইবনে আলী (আ.) জিজ্ঞেস করেন এ চিঠিগুলো কে কে লিখেছে । তারা বলল , হে আল্লাহর রাসুলের সন্তান! পত্রের লেখকরা হলেন-শাব্স ইবনে রাবায়ী , হাজার ইবনে আবজার , ইয়াজিদ ইবনে হারেছ , ইয়াজিদ ইবনে রোয়াম , উরওয়া ইবনে কাইছ , আমর ইবনে হাজ্জাজ এবং মুহাম্মদ ইবনে ওমর ইবনে আতারেদ ।

মুসলিম ইবনে আকিলের কুফা গমন

এরুপ পরিস্থিতিতে হোসাইন ইবনে আলী (আ.)একদিন কাবাঘরের পাশে গিয়ে রুকন ও মাকামে ইব্রাহীমের মাঝখানে দাড়িয়ে দু রাকত নামায আদায় এবং মহান আল্লাহর দরবারে পরিস্থিতির কল্যাণকর পরিণতির জন্য দোয়া করেন । অতঃপর মুসলিম ইবনে আকিলকে ডেকে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন ।

এরপর ইমাম হোসাইন (আ.) কুফাবাসীর চিঠির জবাব লিখে মুসলিম ইবনে আকিলের মাধ্যমে প্রেরণ করেন। জবাবী পত্রে তাদের আমন্ত্রণ কবুলের ওয়াদা দিয়ে লেখা ছিল- আমি আমার চাচাত ভাই মুসলিম বিন আকিলকে তোমাদের কাছে পাঠালাম যাতে তোমাদের উদ্দেশ্য পূর্ণ করে সে সম্পর্কে আমাকে অবহিত করে ।

মুসলিম ইমামের পত্র নিয়ে কুফায় আসেন । কুফাবাসী হোসাইন ইবনে আলী (আ.) ও মুসলিম ইবনে আকিলকে পেয়ে আনন্দিত হল । তাকে মুখতার ইবনে আবী ওবায়দা সাকাফীর বাড়িতে থাকতে দিলেন । অনুসারীরা দলে দলে মুসলিম ইবনে আকিলের সাথে সাক্ষাত করতে আসতে লাগল । প্রত্যেক দল আসার সাথে সাথে মুসলিম ইমামের পত্র পড়ে শুনাতে থাকেন । আনন্দে দর্শনার্থীদের অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল এবং তার হাতে বাইআত গ্রহণ করছিল । দেখতে দেখতে আঠারশো লোক তার হাতে বাইআত গ্রহণ করে ।


4

5

6

7

8

9

10

11

12

13